একটি ভূতের গল্প – মার্ক টোয়েন
ব্রড ওয়ে ধরে অনেকদূর গিয়ে একটা প্রকাণ্ড পুরনো বাড়ির একটা বড় ঘর আমি নিয়েছিলাম। আমি আসবার অনেক বছর আগে। থেকেই বাড়িটার উপরের তলাগুলো সম্পূর্ণ খালি পড়ে ছিল। বাড়িটাকে যেন ধূলো আর মাকড়শার জাল, নির্জনতা ও নীরবতার হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম যেদিন সিঁড়ি বেয়ে আমার ঘরে উঠলাম, মনে হল আমি বুঝি গোরস্থানের ভিতর দিয়ে মৃত ব্যক্তিদের গোপনতাকে আক্রমণ করতে চলেছি। জীবনে এই প্রথম একটা কুসংস্মরণত ভয় আমাকে পেয়ে বসল; সিঁড়ির একটা অন্ধকার কোণে মোড় নিতেই একটা অদৃশ্য মাকড়শার জালের সূক্ষ্ম তন্তুগুলো যখন আমার মুখের উপর ঝুলে পরে সেখানে লেগে রইল, তখন আমি যেন ভূত দেখার মত শিউরে উঠলাম।
ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সেই অপচ্ছায়া ও অন্ধকারকে বিদায় করে তবে স্বস্তি পেলাম। চুল্লিতে আরামপ্রদ আগুন জ্বলছিল; আরামের নিঃশ্বাস ফেলে তার সামনে বসে পড়লাম। দুঘণ্টা সেখানে বসে অতীতের কথা ভাবতে লাগলাম; মনে পড়ল কত অতীতের দৃশ্য; অতীতের কুয়াশা ভেদ করে ফুটে উঠল কত আধ-ভোলা মুখ; কল্পনায় শুনতে পেলাম সেই সব কণ্ঠ স্বর যা অনেকদিন আগেই। চিরকালের মত নীরব হয়ে গেছে, আর সেই সব পরিচিত গান যা এখন আর কেউ গায় না। আমার জাগ্রত-স্বপ্ন যখন ধীরে ধীরে করুণ থেকে করুণতর সুরে নেমে গেল, তখন বাইরের ঝড়ের হাহাকার পরিণত হল মৃদু বিলাপে, জানালার কাঁচের উপরে বৃষ্টির ক্রুদ্ধ। আঘাত অস্ফুট মৃদু শব্দে পরিণত হল, রাস্তার সব শব্দ একে একে থেমে গেল, এবং সর্বশেষ বিলম্বিত পথিকের দ্রুত পদশব্দও দূর হতে দূরে মিলিয়ে গেল; কোথাও একতি শব্দ রইল না।
আগুনটা নিভে আসছে। একটা নির্জনতাবোধ যেন আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। উঠে পোশাক ছাড়লাম, ঘরের মধ্যে চলাফেরা করলাম। পা টিপে টিপে, যা কিছু করছি সবই চুপি চুপি; যেন আমার চারপাশে এমন সব শত্রুরা ঘুমিয়ে আছে যাদের ঘুম ভাঙালে মারাত্মক বিপদ ঘটবে। বিছানায় শুয়ে পড়লাম; শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের গর্জন ও অনেক দূরের সব জানালা বন্ধ করার অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
গভীর ঘুমই ঘুমিয়েছিলাম, কিন্তু কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম তা জানি না। হঠাৎ দেখি ঘুম ভেঙে গেছে। আর একটা রোমহর্ষক প্রত্যাশায় বুকটা ভরে উঠেছে। চারদিক স্তব্ধ। শুধু আমার বুকের ভিতরটা ছাড়া-সেখানে হস্পন্দনের শব্দ হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিছানার চাদরগুলো পায়ের দিকে নেমে যেতে লাগল, যেন কেউ সেগুলিকে ধরে টানছে! আমি নড়তে পারছি না; কথা বলতে পারছি না। কম্বলগুলো তখনও নেমে যাচ্ছে; আমার বুক পর্যন্ত খোলা হয়ে পড়ল। তখন অনেক চেষ্টায় সেটাকে চেপে ধরে মাথার উপর পর্যন্ত টেনে দিলাম। অপেক্ষা করে রইলাম, কান পাতলাম। অপেক্ষা করেই আছি। আবার সেই টান শুরু হল; একশ সেকেণ্ড ধরে আবার আমি জড়বৎ পড়ে রইলাম; শেষ পর্যন্ত আবার আমার বুক পর্যন্ত খোলা হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত শক্তি সঞ্চয় করে কম্বলটাকে যথাস্থানে টেনে এনে শক্ত হাতে চেপে ধরে রইলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম। আবার একটা আলতো টান অনুভব করলাম; সঙ্গে সঙ্গে মুঠোটাও শক্ত করলাম। আল্তো টান ক্রমে জোরদার হতে লাগল-আরও, আরও জোরদার হল। আমার হাত থেকে খসে গিয়ে এই তৃতীয়বার কম্বলটা পড়ে গেল। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। বিছানার পায়ের দিক থেকে জবাবে আর একটা আর্তনাদ উঠল। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। আমি তখন যেটুকু বেঁচে আছি, মরে গেছি তার চাইতে বেশী। ইতিমধ্যে ঘরের ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম-মনে হল, একটা হাতির পা-মানুষের পায়ের মত মোটেই নয়। তবে শব্দটা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে-এই যা ভরসা। শুনতে পেলাম, শব্দটা দরজার কাছে গেল, হুড়কো বা তালা না খুলেই বেরিয়ে গেল, দালান ও কড়িকাঠ নাড়াতে নাড়াতে দালান পার হয়ে গেল–আবার সেই সব্ধতা নেমে এল।
উত্তেজনা প্রশমিত হলে নিজে নিজেই বললাম, এটা স্বপ্ন-একটা বীভৎস স্বপ্নমাত্র। এই কথা ভাবতে ভাবতে একসময় দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল যে সত্যি এটা স্বপ্নই ছিল; তখন একটা সুখকর হাসিতে আমার ঠোঁট দুটি ভরে উঠল; আবার খুসি হয়ে উঠলাম। উঠে একটা আলো জ্বালালাম; হুড়কো ও তালা যেমন ছিল তেমনই আছে; আর একটা স্বস্তির হাসি বুকের মধ্যে উথলে উঠে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। গড়িয়ে পড়ল। পাইপটা তুলে নিয়ে ধরালাম। তারপর আগুনের সামনে বসবার উপক্রম করতেই-আমার কাঁপা আঙুলের ফাঁক দিয়ে পাইপটা নীচে পড়ে গেল, গাল থেকে উবে গেল সব রক্ত, আঁতকে উঠতেই আমার শান্ত শ্বাস-প্রশ্বাসও থেমে গেল! অগ্নিকুণ্ডের পাশে ছাইয়ের উপর আমার পায়ের ছাপের পাশাপাশি আর একটা পায়ের ছাপ-ছাপটা এত বড় যে তার তুলনায় আমার পায়ের ছাপটা যেন কোন শিশুর! তাহলে সত্যি অতিথি এসেছিল; আর হাতির পায়ের শব্দের ব্যাপারটাও বোঝা গেল।
আলো নিভিয়ে দিয়ে ভয়ে অবশ দেহ নিয়ে বিছানায় ফিরে গেলাম। বহুক্ষণ ধরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কান পেতে রইলাম। মেঝের উপর দিয়ে কোন ভারী দেহকে নেবার মত একটা ঘস্-ঘস্ আওয়াজ মাথার উপর শুনতে পেলাম। তারপর দেহটাকে ছুঁড়ে ফেলে। দেওয়া হল, আর তার ধাক্কায় আমার জানালাগুলো কেঁপে উঠল। বাড়িটার দূরবর্তী অংশ গুলোতে সশব্দে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণ পরে পরেই শুনতে পেলাম, চুপি চুপি পায়ে কেউ যেন দালান দিয়ে ভিতরে ঢুকছে, আর বেরিয়ে যাচ্ছে, সিঁড়ি বেয়ে উঠছে আর নামছে। কখনও বা সেই শব্দ আমার দরজার কাছে এসে একটু ইতস্তত করে আবার চলে যাচ্ছে। দূরবর্তী দালান-পথে শিকলের অস্পষ্ট ঝন্ঝন্ শব্দ শুনতে পেলাম, কান পাতলাম; ঝন্ঝন্ শব্দ কখনও এগিয়ে আসছে-কখনও শ্রান্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে; অপদেবতার প্রতিটি পদক্ষেপের তালে তালে বাড়তি শিকলের ঝন্ঝন্ শব্দ হচ্ছে। কিছু অস্পষ্ট কথাও কানে এল; অর্ধ-উচ্চারিত কিছু আর্তনাদকে যেন জোর করে স্তব্ধ করে দেওয়া হল; অদৃশ্য পোশাকের খসূ-খস্ শব্দ, অদৃশ্য পাখার শোঁ-শোঁ শব্দ। তখন মনে হল, কেউ আমার ঘরটাকে আক্রমণ করেছে-এখানে আমি একা নই। আমার বিছানাকে ঘিরে দীর্ঘশ্বাস ও শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ; রহস্যময় ফি সফি স্ কথা। ঠিক মাথার উপরে দেখতে পাচ্ছি সিলিং-এর গায়ে নরম প্রস্ফুরক আলোর তিনটি ছোট বৃত্ত মুহূর্তকাল সেখানে জ্বলতে জ্বলতে ঝুলে রইল, তারপর নীচে পড়ে গেল-দুটো আমার মুখের উপর, আর একটা বালিশের উপর। তরল পদার্থের মত চটচট করতে লাগল, গরম লাগল। আমার মন বলল, সেগুলো রক্তের ডে লা-আলো জ্বালিয়ে সেগুলো দেখার দরকারও বোধ করলাম না। তারপরই দেখলাম কতকগুলি অনুজ্জ্বল পাণ্ডুর মুখ, উর্ধে তোলা সাদা হাত, বিদেহী অবস্থায় বাতাসে ভাসছে; তারপরই অদৃশ্য হয়ে গেল। সব ফিসফিসানি, সব কণ্ঠ স্বর, সব শব্দ থেমে গেল। নেমে এল নিস্তব্ধতা। কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মনে হল, আলো দেখতে না পেলে আমি মরে যাব; ভয় আমাকে দুর্বল করে তুলেছে। ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। মুখের উপর একটা চটচটে হাতের ছোঁয়া লাগল। আমার সব শক্তি নিমেষে উধাও হয়ে গেল; আহত পঙ্গুর মত বিছানায় পড়ে গেলাম। তখন পোশাকের খখস্ শব্দ শুনতে পেলাম-মনে হল সেটা দরজার ভিতর দিয়ে বাইরে চলে গেল।
আবার সব কিছু শান্ত হলে রুগ্ন, দুর্বল দেহ নিয়ে গুঁড়ি মেরে বিছানা থেকে নামলাম; গ্যাসটা জ্বালাতে হাত কাঁপতে লাগল একশ বছরের বুড়োর মত। আলো দেখে মনে কিছুটা বল ফিরে এল। আসনে বসে ছাইয়ের উপরকার বড় বড় পায়ের কথাই যেন স্বপ্নের ঘোরে ভাবতে লাগলাম। দেখতে দেখতে সব কিছু কেমন ঝাপসা হয়ে এল। চোখ তুলে তাকালাম; গ্যাসের আলোও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার সেই হাতির পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। সেটা আসছে-কাছে, আরও কাছে, ছাতা-পরা হল-ঘর পেরিয়ে; সেটা যত কাছে আসছে ঘরের আলো ততই ম্লান হতে ক্লানতর হচ্ছে। পায়ের শব্দ আমার দরজার কাছে এসে থামল-আলো কমতে কমতে একটা ঈষৎ নীল রঙে রূপান্তরিত হল; আমার চারপাশে সব কিছু যেন একটু ভৌতিক গোধূলির আলোয় আচ্ছন্ন। দরজা খোলে নি, অথচ বাতাসের একটা মৃদু ঝলক এসে আমার গালে লাগল; আমার সামনে এসে দাঁড়াল একটা প্ৰকাণ্ড ধোঁয়াটে দেহ। বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকে দেখতে লাগলাম। একটা পাণ্ডুর আভা জিনিসটার উপর ছড়িয়ে পড়ল; ধীরে ধীরে সেই ধোঁয়া আকার গ্রহণ করল–একটা হাত দেখা দিল, তারপর দুটি পা, তারপর শরীর এবং সকলের শেষে বাপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একখানি বিষণ্ণ মুখ। জালের বাসা থেকে মুক্ত হয়ে মহামান্য কার্ডিফ দানবতার পেশীবহুল সুন্দর উলঙ্গ দেহ নিয়ে আমার মাথার উপরে দেখা দিল!
আমার সব দুঃখ অন্তর্হিত হল-কারণ একটি শিশু ও জানে যে এই সদয় মুখ কারও কোন ক্ষতি করতে পারে না। আমার মনের খুসির ভাব তৎক্ষণাৎ ফিরে এল, আর তার সঙ্গে মিল রেখেই বুঝি গ্যাসের আলোটা আবার উজ্জ্বল দীপ্তিতে জ্বলে উঠল। এই দানব বন্ধুটিকে অভ্যর্থনা জানাতে পেরে আমি যত খুসি হলাম, কোন নির্জন সমাজ পরিত্যক্ত মানুষই সঙ্গ লাভ করে তত খুসি হয় না।
আরে, এ সব তাহলে তুমি ছাড়া কেউ নয়? তুমি কি জান, দু তিন ঘণ্টা ধরে আমি ভয়ে মরতে বসেছিলাম? তোমাকে দেখে সত্যি খুব ভালো লাগছে। আহা, একট। এমন চেয়ার যদি থাকত-এখানে,ওটার মধ্যে বসতে চেষ্টা করো না!
কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমি বাধা দেবার আগেই সে ওটার মধ্যে ঢুকতেই ওটা সবেগে নীচে নেমে গেল-জীবনে কখনও একটা চেয়ারকে ও ভাবে খা-খা হয়ে ভেঙে যেতে আমি দেখি নি।
থাম, থাম, তুমি তো সব কিছু ধ্বংস-
আবার অনেক দেরী। আবার একটা শব্দ, আর সঙ্গে সঙ্গে আর একটা চেয়ার ভেঙে খানখান।
কী আশ্চর্য! তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু নেই? তুমি কি এখানকার সব আসবাবপত্র ভেঙে ফেলতে চাও? এখানে, এখানে, ওরে কাঠ মুখখু-
কিন্তু সবই বৃথা। আমি ধরে ফেলবার আগেই সে বিছানার উপর বসে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে সেটা একটা শোচনীয় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল।
আচ্ছা, এটা কি রকম আচরণ তোমার? প্রথমে তো ঘরময় ঘুরতে ঘুরতে একগাদা ভবঘুরে ভূতকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে ভুয়ে আধ-মরা করে ফেললে; তার পরে এমন অশালীন পোশাক পরে এলে যা একমাত্র সন্ত্রান্ত রঙ্গমঞ্চ ছাড়া অন্য কোন সভ্য সমাজই বরদাস্ত করত না, এমন কি ঐ উলঙ্গ-বাহার বেশ যদি তোমার জাতির হত তাহলে সেটাও তারা বরদাস্ত করত না, তবু যাহোক করে আমি যেই সেটাকেও মেনে নিলাম অমনই তুমি তার প্রতিদানে বসবার মত যে আসবাব পাচ্ছ সেটাকেই ভেঙে চুরমার করে ফেলছ? কেন এ রকম করছ? যেমন নিজের ক্ষতি করছ, তেমনই আমারও ক্ষতি করছ। তোমার শিরদাঁড়ার শেষ প্রান্তটা ভেঙে ছ; জংঘাস্থিটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে এমনভাবে ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে যে, একটা শ্বেত পাথরের উঠোনের মত দেখাচ্ছে। এর জন্য তোমার যে লজ্জিত হওয়া উচিত-সেটা বুঝবার মত বয়স তোমার হয়েছে।
আচ্ছা, আর কোন আসবাব ভাঙ ব না। কিন্তু আমিই বা কি করব? একটা শতাব্দী ধরে একটু বসবার ফুঁ রসুৎ পেলাম না। তার চোখে জল এসে গেল।
আমি বললাম, আহা বাছারে, তোমার প্রতি এতটা কঠোর হওয়া আমার উচিত হয় নি। হাজার হোক, তোমার বাপ-মা নেই। তবে এখানে মেঝেতে বস-আর কোন কিছুই তো তোমার ভর সইবে না-আর তাছাড়া, মাথার উপরে ওখানে বসে থাকলে তো তোমার সঙ্গে আমরা মিশতে পারব না; তাই আমার ইচ্ছা তুমি এখানে নীচে বস, তাহলেই ঐ উঁচু টু লটার উপর উঠে আমি তোমার মুখোমুখি বসে। গল্প করতে পারব।.
সে মেঝেতে বসে পড়ল। আমার দেওয়া চুরুট ধরিয়ে আমার লাল কলটা গলার জড়িয়ে নিল এবং আমার স্নানের গামলাটাকে উল্টো করে শিরস্ত্রাণের মত মাথায় চাপিয়ে নিজেকে একটি দেখবার মত আরামদায়ক জীব করে তুলল। তারপর হাঁটু দুটো ভেঙে তার মৌচাকের মত গর্তওয়ালা অদ্ভুত পায়ের পাতা দুটোকে গরম করবার জন্য আগুনের দিকে মেলে ধরল।
তোমার পায়ের পাতা ও পায়ের পিছন দিকটা ও রকম গর্ত আর কাটকাটা কেন?
ও তো নারকীয় শীতের ফাটা-নিউয়েল-এর গোলাবাড়িতে বিশ্রাম করতে গিয়ে মাথার পিছন দিকটা পর্যন্ত সবটা শরীর ঐ ভাবে ফেটে গেছে। তবু জায়গাটা আমার খুব পছন্দ; লোকে যেমন নিজের পুরনো বাড়ি ভালবাসে, আমিও তেমনই ওই জায়গাটাকে ভালবাসি। সেখানে থেকে যে শান্তি পাই তেমন শান্তি আর কোথাও নেই।
এইভাবে আধ-ঘণ্টা গল্প করবার পরে আমার মনে হল তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সেও সেই কথাই বলল।
ক্লান্ত? তা হবে। এবার তোমাকে সব কথা বলব, কারন তুমি আমার সঙ্গে বড় ভাল ব্যাবহার করেছে। রাস্তার ওপাশে যাদুঘরে যে প্রস্তরীভূত মানুষটি আছে আমি তারই আত্মা। আমিকার্ডিফ দনব–এর ভুত। ওই দেহটি কে যতদিন করব না দিচ্ছে ততদিন আমার বিশ্রাম নেই। মানুষ যাতে আমার এই মনোবাসনা পূরণ করে সে জন্য আমার কি করা স্বাভাবিক বল? ভয় দেখিয়ে তাদের এ কাজে বাধ্য। করা–দেহটা যেখানে আছে সেখানেই ভয় করা! তাই তো রাতের পর রাত আমি যাদুঘরের উপরে ভয় করছি। অন্য সব ভুতদের সাহায্যই আমি পেয়েছি। কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। কারন মাঝ রাতে কেউ যাদুঘরে আসে না। তখন মনে হল, পথের মাঝ খানে। এই জায়গাটাতে একটু ভর করলে মন্দ হয় না। মনে হল, আমার কথাগুলি যদি কাউকে শোনাতে পারি, তাহলেই কাজ ফতে করতে পারব, কারণ পরোলোকে এসে আমি খুব ভাল সঙ্গীসাথী পেয়েছি। রাতের পর রাত আমরা এই ছাতা-পরা হল-ঘরের মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরে বেড়িয়েছি, পায়ের শিকল টেনে টেনে চলেছি, আর্তনাদ করেছি, ফি ফি স্ করে কথা বলেছি, সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি আর নেমেছি, আর তাতেই বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু আজ রাতে যখন তোমার ঘরে আলো দেখতে পেলাম, তখন নতুন উদ্যম নিয়ে নবীন উৎসাহে কাজে নেমে পড়লাম। কিন্তু আমি বড় ক্লান্ত-শ্রান্তিতে একেবারেই ভেঙে পড়েছি। তোমাকে মিনতি করছি, আমাকে কিছুটা আশা দাও!
উত্তেজনায় আমার আসন থেকে ছিটকে পড়ে আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম: এ যে ভয়ংকর বাড়াবাড়ি! এ রকমটা তো কখনও ঘটে নি! আরে ভুল-সর্বস্ব বুড়ো জীবাশ্ম, তোমার সব পরিশ্রম যে জলে গেছে-তুমি তো ভর করেছ তোমার একটা প্লাস্টারের মূর্তির উপর-আসল কার্ডিফ দানব তো রয়েছে আলবানী-তে। এমন ভুলটা করলে তুমি? তোমার নিজের দেহাবশেষকেও তুমি চেন না?
কারও মুখে এতখানি লজ্জা ও শোচনীয় অপমানের দৃষ্টি আমি আগে কখনও দেখি নি।
প্রস্তরীভূত মানুষটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল; বলল:
ঠিক করে বল তো, এ কথা সত্য?
আমি যেমন এখানে বসে আছি সেই রকম সত্য!
মুখ থেকে পাইপটা নিয়ে সে ম্যান্টে ল-এর উপর রাখল, এক মুহূর্ত ইতস্তত করল (পুরনো অভ্যাসমত নিজের অজ্ঞাতেই যেখানে পাতলুনের পকেট থাকবার কথা সেখানে হাত দুটো ঢুকিয়ে দিল) এবং শেষ পর্যন্ত বলল:
দেখ, এত অদ্ভুত আমার কখনও লাগে নি। প্রস্তরীভূত মানুষ সবাইকে বিক্রি করেছে, কিন্তু এবার দেখছি তার নীচে ফাঁকিবাজী এতদূর নেমে গেছে যে শেষ পর্যন্ত সে নিজের প্রেতাত্মাকেও বিক্রি করে দিয়েছে। দেখ বাবা, আমার মত একটি অসহায় বন্ধুহীন প্রেতাত্মার জন্য তোমার হৃদয়ে যদি এতটুকু করুণা থাকে তাহলে আজকের এই ঘটনা কখনও প্রকাশ করো না। ভাব তো, নিজে যদি নিজেকে এভাবে বোকা বানাতে তাহলে তোমার মনের ভাবটা কি হত।
তার রাজকীয় পদশব্দ এক ধাপ এক ধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পরিত্যক্ত রাজপথে মিলিয়ে গেল। বেচারি! সে চলে যাওয়াতে আমার দুঃখ হল-আরও দুঃখ হল এই জন্য যে সে আমার লাল কম্বল ও স্নানের গামলাটাও সঙ্গে নিয়ে গেছে।
*এটা ঘটনা। মূল নকল মূর্তিটা থেকে সুকৌশলে আর একটা নকল মূর্তি তৈরি করে সেটাকেই একমাত্র আসল কার্ডিফ-দানব হিসাবে নিউ ইয়র্ক-এ প্রদর্শিত হয়েছিল, আর ঠিক সেই একই সময়ে আলবনী-র যাদুঘরেও সে মূর্তি প্রচুর দর্শক আকর্ষণ করেছিল।
Post a Comment