আজকের দ্রৌপদী – হরিশংকর জলদাস
দুটো বাড়ি, পাশাপাশি।
সেনবাড়ি আর ধরবাড়ি। মাঝখানে পাঁচিল, মাথা সমান। বাড়ি দুটোর মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল, আগে। ভালো রান্না হলে এবাড়ির তরকারি ওবাড়িতে যেত, শীতে ওবাড়ির পিঠে এবাড়িতে আসত, আগে। এখন আসে না। আগে সেনবাড়ির ছেলেপুলেরা ধরবাড়ির উঠানে খেলতে যেত, এখন যায় না। ধরবাড়ির ছোটরা সেনবাড়িতে খেলতে খেলতে খাটে ঘুমিয়ে পড়ত, সেনগিন্নি কোলে করে ঘুমন্ত বাচ্চাকে ধরবাড়িতে পৌছে দিতেন, এখন দেন না। দুই বাড়ির মাঝখানে এখন কনক্রিটের দেয়াল।
সেনবাড়ির কর্তা প্রতুল সেন, চন্দ্রবিকাশ ধর ওবাড়ির গার্জেন I প্রতুলবাবু টিঅ্যান্ডটির কর্মকর্তা আর ধরবাবু অ্যাডভোকেট। একজন নন্দনকাননে অফিস করেন, অন্যজন চট্টগ্রাম কোর্টবিল্ডিং-এ প্র্যাকটিস করেন। দুজনের মধ্যে গলায় গলায় ভাব। ছুটিছাঁটার দিনে একসঙ্গে বসে ধরে আর সেনে গল্প হয়, সুখদুঃখের কথা বিনিময় হয়।
সেনবাবুর ফলদ গাছের প্রতি বড় টান, বাড়ির চারপাশে গাছ লাগান। ধরবাবুর গাছের প্রতি তেমন টান নেই। বলেন, ‘গাছটাছ লাগিয়ে কী হবে, শুধু পাতাপুতার আবর্জনা! তার চেয়ে খোলা জায়গা ভালো। আলো- বাতাসের অবাধ খেলা।
সেনবাবু নাছোড়। ধরবাবুকে গাছ লাগাতেই হবে। ডবল ডবল গাছ কেনেন। একটা এবাড়িতে লাগালে আরেকটা ধরবাড়িতে লাগান। গাছ বড় হয়। এবাড়ির গাছের ডাল ওবাড়ির সীমানায় যায়। ধরবাড়ির নারকেল গাছের কাঠবিড়ালি-খাওয়া কচি ডাব সেনবাড়ির টিনের চালে পড়ে। সেনবাড়ির গিন্নি উঠানে দাঁড়িয়ে কাঠবিড়ালি তাড়ান, ‘শ, শ! হুশ! যা যা মরার কাঠবিড়ালি!’
তারপর গলা উঁচিয়ে বলেন, ‘ও শ্যামাদি, কাঠবিড়ালি তো সব নারকেল খেয়ে শেষ করল!’
কালক্রমে উভয় বাড়ির ছেলেপুলেরা বড় হতে লাগল। প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে হাই স্কুল। তারপর কলেজ। উভয় বাড়ির জৌলুস বাড়তে থাকল। বেড়ার ঘরের জায়গায় একতলা বাড়ি তুললেন ধরবাবু। আর প্রতুল সেনের ভিটেয় উঠল দোতলা বাড়ি। তাঁর ইনকাম বেশি। টিঅ্যান্ডটি’র চাকরিতে ঘুষঘাষের সুযোগসুবিধেও বেশি। উভয় পরিবারে ধনের বৈষম্য যা-ই হোক, মনের মালিন্য হয় না কখনো। পারিবারিক সম্পর্ক আগের মতোই অটুট থাকে।
সেনবাবুর তিন ছেলে, এক মেয়ে। ধরবাবুর একটাই সন্তান, ওই প্রভাসচন্দ্র ধর। কল্যাণ সেন ছাড়া প্রতুলবাবুর অন্য দুটো ছেলেই অকাজের। কল্যাণ বড়, মেজটা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আর পড়ল না। ছোটটা হাবাগোবা। ঠেলেঠুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এগিয়েছিল। মেয়ে শাশ্বতী ভীষণ সুন্দরী। এক কানাডানিবাসী বর শাশ্বতীর প্রতি বড় আগ্রহী হয়ে উঠল। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ওই প্রবাসীকেই মাধ্যমিক পাস শাশ্বতীকে বিয়ে দিলেন সেনবাবু। কল্যাণ সেন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করল, চুয়েট থেকে। নামকরা একটা প্রাইভেট ফার্মে উঁচু বেতনে চাকরি পেল কল্যাণ।
প্রভাস আর্টস নিয়ে লেখাপড়া করল। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর অনার্সে ভর্তি হলো, বাংলায়। ক্রমে অনার্স, এমএ পাস করল প্রভাস। বিসিএস দিয়ে সরকারি কলেজে অধ্যাপনার চাকরিও পেল।
কল্যাণের মাঝারি হাইট, সুঠাম দেহ। উজ্জ্বল রং। চেহারায় একটু কঠোর কঠোর ভাব। সেটা জন্মগত। রাগী নয় সে, তবে চেহারা রাগী রাগী।
প্রভাস দীর্ঘদেহী। স্বাস্থ্য ভালো। কল্যাণের মতো বনেদি চেহারা নয় তার, তবে একধরনের স্নিগ্ধ কোমলতা তাকে সর্বদা ঘিরে রাখে। তার উন্নত নাসা। নাকের দু’পাশে উজ্জ্বল দুটো চোখ। চোখের সৌন্দর্যের জন্যই শুধু প্রভাসকে ভালোবাসা যায়। কম কথা বলা, সৌম্য আচরণ প্রভাসের বাড়তি গুণ।
কল্যাণ আর প্রভাসের মধ্যে রেষারেষি, ছোটবেলা থেকে। স্কুলের পড়ালেখায় কল্যাণ কিছুতেই প্রভাসকে পেছনে ফেলতে পারত না। অন্যান্য সাবজেক্টে মাঝেমধ্যে এগিয়ে থাকলেও ইংরেজি আর গণিতে প্রভাসকে অতিক্রম করতে পারত না কল্যাণ। এজন্য তার মনে চাপা ক্রোধ। সেই ক্রোধ এক বিকেলে বেরিয়ে এলো।
সবে নাইনে উঠেছে তারা। একই স্কুলে, একজন সায়ন্সে আরেকজন আর্টসে। শীতবিকেলে স্কুলমাঠে ব্যাডমিন্টনের আসর বসেছে। সিনিয়ররা খেলা ছেড়ে দিলে কল্যাণ আর প্রভাস ব্যাট হাতে নিল। দুজনে দুদিকে দাঁড়াল। অল্পক্ষণের মধ্যে খেলা জমে উঠল। দুজনেই চৌকস। তবে প্রভাসের খেলায় কারুকার্য বেশি। দর্শকও জুটে গেল অনেক। উভয়েই এক এক সেটে জয় পেল। তৃতীয় সেট চলছে। দর্শকরা উত্তেজিত। ঘন ঘন হাততালি দিচ্ছে। কেউ এদিকে, কেউ ওদিকে। প্রভাসের জন্য যেন হাততালি বেশি। দর্শকের উত্তেজনা প্রভাস-কল্যাণের মধ্যে সংক্রমিত হলো। মরণপণ লড়াইয়ে মগ্ন হলো উভয়ে। এ চাপ দিলে ও ফিরিয়ে দিচ্ছে। ও নেট ঘেঁষে কর্ক ফেলতে চাইলে এ ত্বরিতে এসে তা ওপারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। একটা সময়ে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, কেহ নাহি হারে জিতে সমানে সমান। তৃতীয় সেটে জয় পেল প্রভাস। কল্যাণ মুখ গোমড়া করে মাঠ ছাড়ল। সেই থেকে উভয়ের মধ্যে রেষারেষি আরও বেড়ে গেল।
.
একদিন ধর-দম্পতি সিদ্ধান্ত নিলেন—ছেলেকে বিয়ে করাবেন। ছেলে তো এখন সরকারি মহিলা কলেজে পড়ায়! বেতনও কম পায় না। প্রভাসের বয়সও ঊনত্রিশ পেরিয়ে গেছে। ধরগিন্নি প্রভাসের মনোভাব জেনে নিলেন। বিয়েতে প্রভাসের আপত্তি নেই। ভেতরে ভেতরে মেয়েরও খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন চন্দ্রবিকাশ ধর। মেয়ে পাওয়া গেল। নন্দনকাননের চৌধুরীবাড়ির মেয়ে। জীবন চৌধুরীর মানি-এক্সচেঞ্জের কাজকারবার। হাজারিগলিতে অফিস। জীবন চৌধুরীর একমাত্র কন্যা অহনা চৌধুরী। চট্টগ্রাম কলেজে দর্শনে এমএ পড়ছে। সুশ্রী, লাবণ্যময়ী, মিতভাষী। অহনার বড় গুণ—তার মধ্যে সুন্দর একটা মন আছে।
বন্ধু দিলীপকে দিয়ে প্রাইমারি কথাবার্তাও সেরে নিয়েছেন ধরবাবু। কনে দেখাতে রাজি হয়েছেন জীবন চৌধুরী। তারিখও নির্ধারিত হয়ে গেছে। সেনবাবুর সঙ্গে আলাপ না করে কনে দেখতে যান কী করে ধরবাবু! এক বিকেলে সেনবাড়িতে উপস্থিত হলেন চন্দ্রবিকাশবাবু।
ভূমিকা ছাড়া বললেন, ‘বুঝলে প্রতুল, ছেলের বিয়ে দেব ঠিক করেছি। তোমার মতামত দরকার। তাই এলাম।’
‘প্রভাসের বিয়ে দেবে! এত তাড়াতাড়ি!’ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন প্রতুল সেন।
চন্দ্ৰবিকাশবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি দেখলে কোথায় তুমি? প্রভাসের বয়স তো কম হলো না! ঊনত্রিশ পার হচ্ছে।’
একটু থেমে গলা বাড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ধরবাবু আবার বললেন, ‘তা তোমার সংবাদ কী? একই বছরে তো জন্ম কল্যাণের! ছেলের বিয়ের কথা ভাবছ না?’
‘এতদিন তো ভাবিনি! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে কল্যাণকে বিয়ে করিয়ে দেওয়া উচিত। দেখি, ওর মায়ের সঙ্গে আলাপ করে। ছেলের মতামতও তো নেওয়া দরকার!’ বললেন সেনবাবু।
‘যা করবে তাড়াতাড়ি করো। শুভস্য শীঘ্রম।’
সেনবাবু বললেন, ‘তা প্রভাসের বিয়ে সম্পর্কে কী যেন বলতে এসেছিলে?’
‘বলছিলাম কী, প্রভাস আমার একমাত্র ছেলে। তার মায়েরও বয়স হয়েছে। মায়ের বড় সাধ পুত্রবধূ ঘরে আনবে।’ বললেন ধরবাবু। একটু ভূমিকা করেই বললেন।
এরপর কন্যা ঠিক করার কথা, চৌধুরীবাড়ির প্রসঙ্গ, জীবন চৌধুরীর ঐশ্বর্যের প্রসঙ্গ, কনে অহনা চৌধুরীর কথা বিস্তারিত বললেন। অহনা যে অসাধারণ রূপবতী, মিষ্টভাষী—এসব কথাও বলতে ভুললেন না ধরবাবু। সর্বশেষে বললেন, ‘আগামী পরশু কনে দেখার তারিখ। তুমি আর বউদি না গেলে কনে দেখা অসম্পূর্ণ থাকবে।’
‘তোমার ছেলে আর আমার ছেলের মধ্যে পার্থক্য কী? যাব, অবশ্য যাব।’ সেনবাবু ধরবাবুকে আশ্বস্ত করলেন।
দুই
চৌধুরীবাড়ি। বিশাল ড্রইংরুম।
একদিকের সোফায় ধরগিন্নি আর সেনগিন্নি, পাশের সোফায় প্ৰতুলবাবু আর চন্দ্রবিকাশবাবু। তাঁদের পাশে চন্দ্রবিকাশবাবুর বন্ধু দিলীপবাবু মুখোমুখি সোফায় চৌধুরীবাবু মানে জীবন চৌধুরী, তাঁর পাশে সহোদর সুকুমার চৌধুরী। ও পাশের সোফায় চৌধুরীগিন্নি এবং অহনা চৌধুরী। একটু দূরে ছোট একটা কাঠের সোফায় বসেছে প্রভাস।
অহনার ঘরে ঢোকা, বসার ভঙ্গি, প্রণাম করার রীতি দেখে সবাই মুগ্ধ। চন্দ্ৰবিকাশবাবু বলেই ফেললেন, ‘অহনা মাকে আমাদের খুব পছন্দ। বেয়াই মশায়ের ইচ্ছে জানলে সামনে আগাতে আপত্তি নেই আমাদের।’
জীবন চৌধুরী সম্মতির হাসি হাসলেন।
সেনগিন্নি বললেন, ‘তাহলে ছেলেতে-মেয়েতে একটু কথা বলুক। চৌধুরীগিন্নি বললেন, ‘তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আধুনিক যুগ। ওরা পরস্পরকে জেনে নিক।’
তারপর স্বামীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে চৌধুরীগিন্নি আবার বললেন, ‘তুমি ওঁদের চা-নাস্তার তদারক করো। আমি একটু ভেতরবাড়িতে যাচ্ছি।’
অহনাকে সোফা থেকে তুললেন তিনি, তারপর প্রভাসকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এসো বাবা।’
খাবারপর্ব চুকে গেল। সবাই নানা খোশগল্পে মাতলেন। বিয়ের দিনতারিখও ধার্য হয়ে গেল। পৌষের ১৪ তারিখে বিয়ে।
প্রতুল সেনের কী হলো কে জানে, হঠাৎ বলে বসলেন, ‘ছেলের বিয়েতে কিন্তু সত্তর ইঞ্চির একটা ফ্ল্যাট টিভি দিতে হবে বেয়াই মশাই।’
জীবনবাবু শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা সবাই শিক্ষিত মানুষ। মেয়ের বিয়েতে কী কী দিতে হবে জানি।’
‘না, বললাম এজন্য যে, অনেক কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে ঠকায়। প্রথমে বলে, হেন দেব তেন দেব। দেওয়ার বেলা অষ্টরম্ভা।’ প্রতুলবাবু গলায় একটু উষ্ণতা মিশিয়ে বললেন।
‘আমরা সে দলের নই।’
‘তার পরও কথাটা হয়ে থাকলে ভালো।’
এসময় ধরবাবু বলে উঠলেন, ‘আহ প্রতুল! আমাদের তো কোনো দাবি নেই!’
‘আমার আছে।’ প্রতুলবাবু বললেন।
এ নিয়ে বড় একটা ফ্যাসাদ হয়ে গেল। এক কথা থেকে অন্য কথা। একটা সময়ে জীবনবাবু বললেন, ‘ওঘরে মেয়ে বিয়ে দেব না আমি। আপনারা আসুন।’
জীবনবাবুর ভাই সুকুমার চৌধুরী হই হই করে উঠলেন, ‘আরে দাদা, রাগ করছ কেন? বসো বসো।’
জীবনবাবু ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘প্রতুলবাবু ধরবাবুর আকাঙ্ক্ষার কথাই বলেছেন। ওঁর কথাগুলো নিশ্চয়ই ধরবাবুর কথা। প্রতুলবাবুর তো কোনো স্বার্থ নেই এখানে, ধরবাবু যা বলতে বলেছেন, প্রতুলবাবু তা-ই বলেছেন। ওরকম লোভী পরিবারে আমি মেয়ে বিয়ে দেব না।’
জীবনবাবুর কথা শুনে প্রতুল সেন মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। ধরবাবু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জীবনবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
বড় একটা বেদনা নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে এলেন।
.
আলাপের মাঝখানে প্রতুলবাবু হঠাৎ সত্তর ইঞ্চি টিভি দাবি করে বসলেন! টিভির ব্যাপারে ধরপরিবারের কোনো দাবি ছিল না। তার পরও সেনবাবুর টিভির দাবিতে ভীষণ একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল। ধরবাবু বোকা বনে গেলেন। ধরগিন্নিও অবাক হয়ে গেছেন। প্রভাসও এরকম দাবির কূলকিনারা খুঁজে পেল না। গোটা পরিবার হতভম্ব। সেনবাবুকে এর কারণ জিজ্ঞেস করার রুচি হলো না ধরবাবুর। যে-লোক এই পরিবারের এত নিকটবন্ধু, সে কিনা প্যাচ মেরে বিয়েটা ভেঙে দিল!
একদিন, সে মাসতিনেক পরে, প্রতুলবাবুর মারপ্যাচের অর্থ খোলসা হয়ে গেল ধরপরিবারের কাছে।
তিনমাস পরে কল্যাণের বিয়ে হলো। প্রতুলবাবু ওই অহনা চৌধুরীকেই পুত্রবধূ করে ঘরে আনলেন।
প্রভাসের কনে-দেখার আসরেই অহনাকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল প্রতুল সেনের। টিভির প্যাচটা দিয়ে বিয়ে ভাঙানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সফলও হয়েছিলেন।
ধরপরিবার স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। এতবড় চালাকি! এতবড় বেইমানি! এতদিনের ঘনিষ্ঠ প্রতুল সেন এত বড় মীরজাফর!
দুই বাড়ির সীমানায় দেয়াল উঠল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হলো। পাড়ার মানুষের মুখে মুখে এই ঘটনা কিস্সার রূপ নিল।
.
অহনা সংসার করে, সুখের সংসার। কল্যাণ তাকে আদরে-সোহাগে ভরিয়ে রেখেছে। শাশুড়ি বউমা ছাড়া কথা বলে না। প্রতুলবাবু বলেন, আমার এক মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে গেছে, বদলে আরেক মেয়ে ঘরে এসেছে।
অহনা আমার পুত্রবধূ নয়, মেয়ে।
তার পরও অহনার ভেতরটা কেন জানি জ্বলে, এক অজানা বেদনা তাকে কুরে কুরে খায়।
দোতলা থেকে ধরবাড়ির সবকিছু দেখা যায়—উঠান, কলতলা, তুলসীর মঞ্চ। অহনা চন্দ্ৰবিকাশবাবুকে দেখে, ধরগিন্নিকে দেখে আর দেখে প্রভাসকে। প্রভাস মাথা নিচু করে ঘরে ঢোকে, মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরোয়। কখনো ওপরদিকে মাথা তোলে না! তুললে দেখত—অহনা নামের এক নারী কী অপরিসীম তৃষ্ণা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে!
তিন
স্বয়ংবর সভা। দ্রৌপদী আজ এই সভা থেকে তার স্বামী নির্বাচন করবে। পাঞ্চালরাজের কন্যা দ্রৌপদী। কন্যা বিবাহযোগ্যা হলে স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ। দ্রৌপদী শ্যামবর্ণা, পদ্মপলাশলোচনা। কুঞ্চিত কেশকলাপ। নিত্যযৌবনা।
রাজা পাঞ্চাল একটি আকাশযন্ত্র এবং একটি প্রায়-দুর্জয় ধনু নিৰ্মাণ করালেন। ঘোষণা দিলেন, যে এই ধনুতে জ্যা যোজনা করে আকাশযন্ত্রের মধ্যদিয়ে লক্ষ্যবস্তু বিদ্ধ করতে পারবে, তাকেই স্বামী হিসেবে বরণ করবে দ্রৌপদী।
স্বয়ংবর সভায় নানা দেশের রাজপুত্ররা উপস্থিত হয়েছে। উপস্থিত হয়েছে ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের সঙ্গে কর্ণ। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে উপস্থিত আছে পঞ্চপাণ্ডব।
রাজঘোষণার শেষে কর্ণ এগিয়ে এলো। কারণ সে বীর, অসাধারণ ধনুর্ধর। দীপ্তিময় দেহ তার। দীর্ঘদেহী। উন্নত নাসিকা, উজ্জ্বল নেত্র। মহাবীর কর্ণ অগ্রসর হয়ে ধনুতে তীর যোজনা করে।
কর্ণ সূতপুত্র। একথা কারও অজানা নয়। যতই উপযুক্ত হোক, হীনজাতীয় সূতপুত্রকে তো আর বিয়ে করা যায় না!
দ্রৌপদী বলল, ‘কর্ণ যতবড় বলবীর্যশালী পুরুষই হোক না কেন, উচ্চবংশে জন্ম নয় তার। সুতরাং কর্ণ ক্ষত্রিয়কন্যার বিবাহযোগ্য পাত্র নয়। কর্ণ লক্ষ্যবস্তু ভেদ করতে সক্ষম হলেও আমি তাকে বিয়ে করব না।’
দ্রৌপদীর কথা শুনে সভার মধ্য হতে উপহাসধ্বনি উঠল। অপমানিত কর্ণ ক্রোধান্বিত হয়ে উঠল। ভূমিতে সজোরে ধনুটি নিক্ষেপ করে সভাস্থল ত্যাগ করল সে। তার পর সমস্ত ক্ষত্রিয় একের পর এক অকৃতকার্য হলো।
ফাঁপরে পড়ে গেলেন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ। কন্যার স্বয়ংবর সভা বুঝি ভণ্ডুল হতে চলল!
নিরুপায় দ্রুপদ ঘোষণা করলেন, ‘সভায় উপস্থিত যে-কোনোজন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।’
কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে ছদ্মবেশী অজুর্ন লক্ষ্যভেদ করল। দ্রৌপদী তাকে বরমাল্য দিয়ে বরণ করল। কিন্তু সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান সেখানে হলো না। দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চভ্রাতা মা-কুন্তীর নিকটে উপস্থিত হলো। মা তখন গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করছিলেন।
গৃহের বাহির থেকে পুত্ররা বলল, ‘মা, এক অসাধারণ সামগ্রী আমরা ভিক্ষে করে এনেছি। ওটা নিয়ে কী করব এখন?’
ঘরের ভেতর থেকে কুন্তী বললেন, ‘তোমরা পাঁচজন মিলে সে জিনিস ভোগ করো।’
এরপর পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়ে হলো। ভ্রাতৃগণের মধ্যে স্থির হলো—দ্রৌপদী এক একজন পাণ্ডবের সঙ্গে এক বছর করে বাস করবে, তখন অন্য ভাইয়েরা দ্রৌপদীর সঙ্গে ভাসুরের মতো আচরণ করবে।
.
তারপর তো দ্রৌপদী আর পঞ্চপাণ্ডবের জীবনে কত উথালপাতাল! কত নিগ্রহ, কত নির্যাতন, কত কপটতা, কত দুরভিসন্ধি! এবং সবশেষে যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
কুরুক্ষেত্রের বিপরীত প্রান্তে কৌরব আর পাণ্ডবদের তাঁবু পড়েছে। এক প্রান্তে কুরুসৈন্য, দুর্যোধন-দুঃশাসন। অন্য দিকে পাণ্ডব-তাঁবু। সৈন্যসামন্ত, কৃষ্ণ, দ্রৌপদী, পঞ্চপাণ্ডব এবং স্বপক্ষের সসৈন্য রাজন্যবর্গ।
সমস্ত দিন রণদামামা। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। হাজার সৈন্যের প্রাণপাত। কৌরবদের প্রথম সেনাপতি ভীষ্ম। দশ দিন যুদ্ধ করে শরশয্যা গ্রহণ করলেন তিনি। এর পরের সেনাপতি দ্রোণ। দ্রোণের মৃত্যুর পর যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ল কর্ণের ওপর। যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণ অপ্রতিরোধ্য। দোর্দণ্ডপ্রতাপে সে গোটা যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ায়। রথী, মহারথীরা তার সামনে দাঁড়াতে পারে না। অর্জুন ছাড়া অন্যান্য পাণ্ডব কর্ণের হাতে পরাস্ত হচ্ছে বারবার। নিত্যদিনের যুদ্ধকথা পাণ্ডবশিবির পর্যন্ত পৌছে যায়। দিনান্তে পাণ্ডরশিবিরে পরামর্শসভা বসে। সেখানে কর্ণের শৌর্যবীর্যের কথা আলোচিত হয়। শুনে দ্রৌপদীর ভেতরে আলোড়ন ওঠে। কীসের যেন ঝড় বইতে থাকে দ্রৌপদীর হৃদয়ে! এ কীসের মন্থন অনুভব করছে দ্রৌপদী? ভেবে কূল পায় না। কর্ণের বীরত্বগাথা শুনে দ্রৌপদীর খুশি হবার কথা নয়। কিন্তু কেন জানি, কর্ণকথা শুনে দ্রৌপদীর উল্লাস বোধ হয়। কেন? কেন?
দ্রৌপদী একা বসে ভাবে—এই কর্ণ তো একদা তার হবার কথা ছিল! স্বয়ংবর সভায় সে তো তার বীর্যবত্তার পরিচয় দিতে উদ্যত হয়েছিল! ও যে সত্যি সত্যি একজন মহাবীর, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। এরকম একজন প্রবলপ্রতাপী মানুষ তার স্বামী হলে দোষের কী ছিল? কিন্তু সেদিন তার যে কী হয়েছিল! হীনজাতের দোহাই দিয়ে কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সে। আর কী আশ্চর্য! সেই হীনজাতের কর্ণের জন্য হৃদয়ে এত তোলপাড় হচ্ছে আজ! আহা, কর্ণকেও যদি স্বামী হিসেবে পাওয়া যেত! পাঁচজনের জায়গায় না হয় ছয়জন হতো! যদি কর্ণকে হৃদয়ের কাছে পাওয়া যেত, পরম তৃপ্তি পাওয়া যেত!
এরকম ভাবনা দ্রৌপদীর ভেতরটাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে, আনমনা করে তোলে তাকে। পঞ্চস্বামীর সামনে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। নিজেকে সংযত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় দ্রৌপদী। কিন্তু অবুঝ মন বিবেকের কথা শোনে না।
স্বামীদের সঙ্গে, পুত্রদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে থাকে দ্রৌপদী।
যুদ্ধ একসময় শেষ হয়।
পাণ্ডবদের জয় হয়।
কিছুদিন রাজ্যশাসনের পর পাণ্ডবরা স্বর্গযাত্রা করে। সঙ্গে যায় দ্রৌপদী।
চার
অহনা ভেতরে ভেতরে অবিন্যস্ত হতে থাকে। একধরনের বিবর্ণ বিপর্যস্ততা অহনাকে বিধ্বস্ত করতে থাকে। রক্তক্ষরণ হতে থাকে অহনার মস্তিষ্কে, হৃদয়ে।
কল্যাণের সঙ্গে ঘর করছে অহনা। কল্যাণ তাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তার আচরণে-সোহাগে কোনো খামতি নেই। তারপরও অহনার অন্তরে কীসের যেন অভাব! কীসের অভাব, কার অভাব? কে সে? সে কি প্রভাস? তার প্রথমদেখা পুরুষ, প্রথম হাতধরা পুরুষ!
সেই বিকেলে একপর্যায়ে হাতটা ধরেছিল প্রভাস। মা এনে তার ঘরে বসিয়ে দিয়েছিলেন দুজনকে। বলেছিলেন, তোমরা কথা বলো। আমি একটু ওদিকটা সামলাই। বলে মা সরে গিয়েছিল ঘর থেকে। কী সুন্দর মিষ্টি করে কথা বলেছিল প্রভাস! বলেছিল, খুব ধনী নই আমরা, তবে তুমি অসুখে থাকবে না। তোমাকে আজীবন ভালোবেসে যাব আমি। বলে অহনার ডান হাতটা নিজের দিকে টেনে নিয়েছিল প্রভাস। সেই স্পর্শ, এই এতদিন পরেও অহনার হাতে লেগে আছে। মাঝে মাঝে হাত বোলায় সেই স্পর্শিত অংশে।
কল্যাণ তাকে পরম সুখে রেখেছে। শ্বশুর-শাশুড়ির তুলনা নেই। তার পরও মনের মধ্যে খোঁচাখুঁচি। মাঝেমধ্যে মনে হয়—তার স্বামী কল্যাণ না হয়ে প্রভাস হলেই ভালো হতো। কী দারুণ শান্ত স্বভাব প্রভাসের! কখনো উঁচু গলা শোনা যায় না তার! পাড়াতো ননদিনী বলে, প্রভাসদার তুলনা নেই। পাড়ার সবাই মান্যিগণ্যি করে তাকে। স্বভাবচরিত্র খুবই ভালো প্রভাসদার। কল্যাণও ভালো। তবে অল্পতে রেগে যায় খুব। তখন তার হুঁশ থাকে না। চিৎকার চেঁচামেচি করে। আহা, প্রভাস যদি তার হতো, কতই-না ভালো হতো!
পাঁচ
পরীক্ষিতের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করে। তারা হিমালয়, বালুকার্ণব, মেরুপর্বত পার হতে থাকে।
একদিন পথে দ্রৌপদী পতিত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে।
ভীমসেন যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করে, ‘দ্রৌপদীর অকালমৃত্যুর কারণ কী দাদা?’
যুধিষ্ঠির বলে, ‘অজুর্নের প্রতি দ্রৌপদীর পক্ষপাতিত্ব ছিল। তাছাড়া…।’
‘তাছাড়া কী দাদা?’ ভীম আবার জিজ্ঞেস করে।
‘কর্ণের প্রতিও প্রচণ্ড দুর্বলতা পোষণ করত দ্রৌপদী, মনে মনে। এটা অপরাধ। এই অপরাধেও দ্রৌপদীর অকালে মৃত্যু হলো।’ ধীরস্থির কণ্ঠে বলে গেল যুধিষ্ঠির।
ভীম স্তম্ভিত।
ছয়
অহনা আসন্নপ্রসবা। গত কদিন ধরে খুব কষ্ট পাছে। ম্যাটারনিটিতে ভর্তি করানো হয়েছে তাকে।
ডাক্তার বলেছেন—ক্রিটিকেল অবস্থা। দুজনকে বাঁচানো যাবে না।
মায়ের অবস্থা সন্তানের চেয়ে খারাপ।
অহনা মাঝেমধ্যে জ্ঞান হারাচ্ছে।
কল্যাণকে একা পেয়ে অহনা বলল, ‘আমি বাঁচব না কল্যাণ। মরার আগে আমি আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করতে চাই।’
‘কী ইচ্ছে? কী ইচ্ছে তোমার? আমাকে বলো।’ কল্যাণ উদগ্রীব কণ্ঠে বলে।
অহনা কোঁকানো গলায় বলে, ‘আমার বাসনা পূরণ করা তোমার পক্ষে কঠিন হবে।’
প্রবল আগ্রহ নিয়ে কল্যাণ বলে, ‘বলো তুমি। যত কঠিনই হোক, তোমার ইচ্ছা পূরণ করব আমি।’
অহনা নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলে না। হয়তো কথা বলার শক্তি ফুরিয়ে গেছে তার অথবা বাসনার কথাটা বলার জন্য শক্তি সঞ্চয় করছে সে।
এই সময় কল্যাণ অহনার হাত ঝাঁকিয়ে আবার বলে ওঠে, ‘অহনা, তুমি আমার স্ত্রী। তোমার আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব আমার। বলো, তোমার কী বাসনা?’
‘আমি মরার আগে প্রভাসকে একনজর দেখতে চাই।’ শান্ত স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলে অহনা।
Post a Comment