আলেকজান্ডারের বাঁটুল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

আলেকজান্ডারের বাঁটুল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

বাঁটুল, ফিরে এস

জিনিসটা দেখতে ক্রিকেটবলের মতো। কিন্তু বেজায় খসখসে এবং কালো রঙের। হাতে নিয়ে দেখলুম বেশ ওজনদারও বটে। সারা গায়ে হিজিবিজি কী সব লেখা আছে দুর্বোধ্য ভাষায়। সেই সঙ্গে জায়গায় জায়গায় সূক্ষ্ম নকশার কারিকুরি। নাড়াচাড়া করে দেখে বললুম, “জিনিসটা কী?”

যিনি এটা নিয়ে সকালবেলা কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ড্রইংরুমে হাজির হয়েছেন, তার নাম বেণীমাধব রায়। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। স্বাস্থ্যবান শক্তসমর্থ চেহারার মানুষ। আমার প্রশ্ন শুনে একটু হেসে বললেন, “বুঝতে পারলেন? এটা আসলে একটা লোহার বাঁটুল। কিন্তু ও লোহায় মরচে ধরার যো নেই।”

অবাক হয়ে বললুম, ‘বাঁটুল? তার মানে যা ছুঁড়ে আদিবাসীরা পাখি-টাকি শিকার করে? বাঁটুল তো আমি দেখেছি। গুলতি থেকে মার্বেলের গুলির সাইজের মাটির বাঁটুল আমিও ছেলেবেলায় কতবার ছুঁড়েছি কার্নিশে পায়রা মারতে। বাঁটুল কখনও এমন প্রকাণ্ড হয়, দেখিনি তো! তাছাড়া এটার ওজন মনে হচ্ছে প্রায় আধকিলো। গুলিত থেকে ছোঁড়াও তো অসম্ভব মশাই।”

বেণীমাধবাবু রহস্যময় হাসলেন। “এটা প্রায় তেরশো বছরের পুরোনো গ্রিক বাঁটুল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণে আসার সময় আফিগানিস্তানে পাঞ্জশির উপত্যকায় ঘোরবন্দ নদীর ধারে তাবু ফেলেছিলেন। ওই সময় তার বাঁটুলটা হারিয়ে যায়। ওই আমলের ইতিহাসে এসব কথা আছে। যাই হোক, তার প্রায় ২২৩৯ বছর পরে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে পুরাবিজ্ঞানী জন মার্শাল ওই এলাকায় এক লুপ্ত সভ্যতার ধ্বংশাবশেষ পুনরুদ্ধারের সময় মাটির তলা থেকে এমনি একটা বাঁটুল কুড়িয়ে পান। তেমনি একটা বাঁটুল আমার ভাগ্যেও জুটেছে। তবে আমি এটা কোথায় পেয়েছি, তা বলা যাবে না। জিনিসটার দাম কয়েক কোটি টাকা। মার্শালের বাঁটুলটা লন্ডনের জাদুঘরে আছে সেটা কিন্তু আলেকজান্ডারের নয়।”

হাঁ করে শুনছিলুম। শোনার পর বললুম, “কিন্তু এটাই যে সম্রাট আলেকজান্ডারের বাঁটুল, তার প্রমাণ কী?”

বাঁটুলটার গায়ে খোদাই করা হিজিবিজিতে আঙুল রেখে বেণীমাধববাবু বললেন, “এই তো সব লেখা আছে প্রাচীন গ্রিক হরফে। আর এই গোল চিহ্নটা দেখছেন, এটা হল গ্রিক সম্রাটের শিলমোহর।”

কর্নেলের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, উনি দাঁতে চুরুট কামড়ে একটা প্রকাণ্ড ইংরেজি বই খুলে গম্ভীর মুখে পড়ছেন। ওঁরা সাদা দাড়িতে চুরুটের ছাই পড়ছে, সেদিকে লক্ষ্যই নেই। বেণীমাধববাবু বাঁটুলদা কফিটেবিলে চৌকোণা কৌটোয় রাখলে এতক্ষণে মুখ তুলে কর্নেল বললেন, “হাকী যেন বলছিলেন বেণীমাধব? রাতবিরেতে আপনার ঘরে ভূতের উপদ্রব হয়?”

বেণীমাধব গম্ভীর হয়ে গেলেন। “হ্যাঁ কর্নেল। একমাস হল জিনিসটা আমি পেয়েছি। তারপর থেকেই প্রায়ই রাত্রিবেলা অদ্ভুত সব কাণ্ড হচ্ছে আমার ঘরে। দেয়ালে টাঙানো ছবি পড়ে যাচ্ছে। ঝনঝন শব্দে। কিন্তু আলো জ্বালিয়ে দেখি কিছু পড়েনি–কিংবা ভাঙেনি। কোনো রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে শুনি, কেউ ধুপধুপ শব্দ করে ঘরের ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছে! অথচ আলো জ্বাললে আর তাকে দেখতে পাচ্ছি না। কোনোরাতে হঠাৎ শুনি, ফিসফিস করে কারা কথাবার্তা বলছে। আলো জ্বাললে আর তাকে দেখতেন, কেউ ধুপধুপশয়ে দেখি কিছু পরে ঘরে। দেয়ালে টাগ্রাম পেয়েছি। তারপর জ্বাললেই সব চুপ। সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে গতরাতে। এতসব কাণ্ডের পর এমনিতেই আতঙ্কে ঘুম আসতে চায় না। প্রায় জেগেই কাটাই। কাল সাড়ে তিনটেয় এক কাণ্ড হল। টেবিলল্যাম্পটা জ্বেলেই রাখি সারারাত। হঠাৎ দেখি কালো কুচকুচে একটা হাত মাথার দিকের জানালা দিয়ে ঢুকে টেবিলল্যাম্পের সুইচ অফ করে দিল। লাফিয়ে উঠে বসলুম। পিস্তল আছে আমার। পিস্তল নিয়ে সুইচ টিপে বড় আলো জ্বেলে দিলুম। উঁকি মেরে কাউকে দেখতে পেলুম না। সকালে দেখি টেবিল আর জানালার ধারে এই লোমগুলো পড়ে আছে।”

পকেট থেকে বেণীমাধববাবু একটা কাগজের মোড়ক বের করে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল মোড়কাটা খুললেন। কয়েকটা কালো দু-তিন ইঞ্চি লোম। কর্নেল একটা লোম চিমটি কেটে তুলে বললেন, “বেজায় শক্ত দেখছি। যেন সূচ। ঠিক আছে। এগুলো থাক। আর বাঁটুলটা…”

কথা কেড়ে বেণীমাধববাবু বললেন, “ওটা আপাতত আপনার কাছেই থাক কর্নেল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছি এবার। জিনিসটা ঘরে রাখতে সাহস হচ্ছে না। ভেবেছিলুম ব্যাংকের লকারে নিয়ে গিয়ে রাখব কি না। কিন্তু আজকাল কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। লকার ভেঙে চুরি যাওয়া কিছু আশ্চর্য নয়। আপনিই ওটা রাখুন।”

কর্নেল মোড়ক এবং বাঁটুলের সুদৃশ্য কৌটোটা হাতে নিয়ে পাশের ঘরে রেখে এলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে বেণীমাধববাবু। আমরা তাহলে ওবেলা একবার আপনার বাড়িতে যাচ্ছি। আপনার ঘরটা একবার পরীক্ষা করা দরকার।”

বেণীমাধববাবু নমস্কার করে চলে গেলেন। কর্নেল আবার সেই ইংরেজি বইটা খুলে বসলেন। বললুম, “এটা কি সত্যি বাঁটুল? এবং আলেকজান্ডারেরই বাঁটুল বলে মনে করেন?”

গোয়েন্দাপ্রবর বই থেকে মুখ তুলে হাসলেন। “ডার্লিং! সেকালের বীরপুরুষরা ছিলেন সবই তাগড়াই মানুষ। খাদ্যে তখনও কেউ ভেজাল দিতে শেখেনি। হাওয়াবাতাসও এমন বিষিয়ে যায়নি। বিশুদ্ধ বাতাসে তারা শ্বাসপ্রশ্বাস নিতেন এবং অনেকে আস্ত একটা রামপাঁঠা খেয়ে হজম করতেন।

তাদের বাঁটুল কি একালের মার্বেলের গুলির মতো হবে।”

বুঝলুম, রসিকতা করছেন। চটে যাওয়ার ভান করে বললুম, বাজে কথা বলবেন না! বরং এত ভেজাল খেয়ে এবং দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েও একালের মানুষ যা করছে, তা সেকালের ওই বীরপুরুষেরা কল্পনাও করতে পারতেন না। আমার ধারণা, বেণীমাধববাবু এই সকালবেলা একটা আজগুবি গল্প বলে তাকে তাক লাগিয়ে দিলেন।”

“তাই বুঝি?”

“ঠিক তাই। ভুঁয়ো বাঁটুলটা একটা ছল। লোমগুলো নিশ্চয় কোনো বাড়ির রোয়াকের আড্ডাবাজ কোনো পাঁঠার। আমার সন্দেহ, ওর কোনো উদ্দেশ্য আছে।”

“কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে তোমার সন্দেহ হচ্ছে?”

“বলা কঠিন এই মুহূর্তে। তবে ভদ্রলোকের চেহারায় কেমন ধূর্ততার ছাপ আছে। চোখ দুটো দেখলেন না বেড়ালের মতো যেন।”

কর্নেল হো-হো করে হেসে বললেন, “বুঝতে পারছি, ওঁকে তুমি পছন্দ করোনি। ডার্লিং! বেণীমাধব রায় একসময়কার বিখ্যাত ব্যবসায়ী বংশের মানুষ। এখন ওঁদের অবস্থা পড়ে গেছে। কিন্তু এদেশে কিউরিও দ্রব্যের কারবারী হিসেবে নাম করতে হবে সবার আগে। বিচিত্র ধরনের প্রাচীন জিনিস উনি কেনাবেচা করেন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ওঁর কিউরিও শপে তুমি দেশবিদেশের বহু কোটিপতি খদ্দেরের দর্শন পাবে দুবেলা। কাজেই ওঁর প্রতি অকারণ সন্দেহ পোষণ কোরো না। কেন উনি আমার সঙ্গে ছলনা করতে আসবেন মিছিমিছি?”

কর্নেলের কথা শুনেও আমার সন্দেহ গেল না। কিন্তু আর কথা না বাড়িয়ে ওঁর বইটার দিকে তাকালুম। খুব পুরনো বই বলে মনে হল। পোকায় যথেচ্ছ কেটেছে বইটাকে। জায়গায়-জায়গায় দুটো-একটা করে শব্দ কামড়ে খেয়েছে। বললুম, “এত মন দিয়ে কী বই পড়ছেন বলুন তো?”

কর্নেল বললেন, “আলেকজান্ডারের জীবনী। তাঁর সমকালের এক গ্রিক ঐতিহাসিক আরিয়ানের লেখা।”

“তার মানে আপনি বিশ্বাস করছেন, জিনিসটা সত্যি আলেকজান্ডারের বাঁটুল?”

কর্নেল বইটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “সেকথা পরে। কিন্তু গ্রীকসম্রাট আলেকজাণ্ডারের একটা প্রিয় বাঁটুল সত্যি ছিল এবং তা আফগানিস্তানে এসেও হারিয়েও গিয়েছিল। পড়ে দেখলে ‘ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।”

বইটা নিয়ে খোলা পাতাটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলুম! একখানে লেখা আছে :

“….সম্রাট খুব ভেঙে পড়েছিলেন বাঁটুল হারিয়ে। সারারাত ঘুমোননি। সকালে ঘোরবন্দ নদীর ধারে একখণ্ড পাথরের উপর বসে আমাদের বললেন, আমাকে হিন্দুস্থান থেকে হয়তো নিরাশ হয়ে ফিরতে হবে। বাঁটুলটা বড় পয়মন্ত ছিল। আমরা তাকে খুব বোঝালুম। কিন্তু তার মুখ থেকে দুঃখের ছাপ মুছল না। পরে হিন্দুস্থানের রাজা পোরাসের (পুরু) সঙ্গে আমাদের যুদ্ধে জয় হলে তখন সম্রাটকে বললুম, দেবতা জিউস আপনার সহায়-তখন সম্রাট আমার কানে কানে বললেন, কাল রাতে দেবতা জিউস আমাকে স্বপ্নে আদেশ দিয়েছেন, আর এগিও না। ফিরে যাও।”

পড়ার পর বললুম, “হুঁ–তাহলে সত্যিসত্যি একটা বাঁটুল ছিল। কিন্তু..”।

কর্নেল আমার কথা কেড়ে বললেন, “ কিন্তু রহস্যটা হল অন্যত্র। জয়ন্ত, ময়রার যেমন সন্দেশে রুচি থাকে না, তেমনি খবরের কাগজের লোক হওয়াতে কাগজে রুচি নেই।”

অবাক হয়ে বললুম, “হঠাৎ একথার অর্থ?”

“তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার দুইয়ের পাতায় অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটা তুমি পড়োনি।”

“কী বিজ্ঞাপন?”

কর্নেল হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে দুইয়ের পাতার একটা বিজ্ঞাপন দেখালেন। বিজ্ঞাপনটা ছোট। “বাঁটুল, যেখানেই থাক, ফিরে এস। যা চাও, পাবে। রবিবার যশোর রোডে মন্দিরতলায় রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো, ইতি মামা।”

বিজ্ঞাপনের শেষ কথাগুলো অদ্ভুত বটে। কিন্তু এখানে সম্ভবত একটা ছেলের নাম। আজকাল কত ছেলে বাড়ি থেকে পালাচ্ছে!

আমার মনের কথা যেন টের পেলেন গোয়েন্দামশাই। একটু হেসে বললেন, ‘কে বলতে পারে বিজ্ঞাপনের বাঁটুল আলেকজান্ডারের বাঁটুল নয়?”

জোর গলায় বললুম, “অসম্ভব। ইনি জনৈক শ্রীমান বাঁটুল চন্দ্র ছাড়া কেউ নয়। আলেকজান্ডারের বাঁটুল কেউ চিনতে চাইলে বেণীমাধববাবুর কিউরিও শপেই যেতে পারত। তাছাড়া ইতি–মামা, যখন লেখা আছে, তখন আর কথা নেই। সম্ভবত বাঁটুলচন্দ্রটি বড় সেয়ানা ছেলে।”

কর্নেল আর কোনো মন্তব্য করলেন না। বইটা টেনে নিয়ে ফের পড়তে শুরু করলেন।…

.

আরেক ধাঁধা

বেণীমাধব রায়ের বাড়ি সল্টলেকের উত্তর সীমায়। পেছনে খাল। তার ওধারে দমদম এয়ারপোর্টগামী ভি. আই. পি. রোড়। বাড়িটা বছর দুই আগে বানিয়েছেন বেণীমাধব। একতলা হলেও বেশ বড় ও নিরিবিলি জায়গায়। এপাশে-ওপাশে অনেকটা তফাতে কয়েকটা বাড়ি সবে তৈরি হচ্ছে। বিকেল পাঁচটায় পৌঁছে ঝটপট চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলুম। উলুকাশ আর ঝোঁপঝাড়-গাছপালায় জায়গাটা জঙ্গল হয়ে আছে। তাছাড়া যে সময়ের কথা বলছি, তখন সল্টলেকে সবে ঘরবাড়ি হচ্ছে। চারদিক প্রায় খাঁ খাঁ করছে। যে ঘরে ভূতের উপদ্রব হয়, সেই ঘরটা একেবারে উত্তর অংশে। পেছনে একটুকরো পোড়ো জঙ্গুলে জমি। তার পেছনে তারকাটার উঁচু বেড়া। বেড়া ঘেঁষে গাছপালা গজিয়েছে। কর্নেল সে দিকটা কিছুক্ষণ ঘুরে দেখলেন। তারপর আমরা ঘরটাতে ঢুকলুম।

বেণীমাধব অবিবাহিত মানুষ। এ বাড়িতে তার এক পিসিমা আর দূরসম্পর্কের এক ভাগ্নে অমল, তাছাড়া একজন রাঁধুনি দয়ার ঠাকুল, দুজন চাকর ভবা ও চাঁদু, দারোয়ান বীরবাহাদুর, ঝি পাঁচুর মালোকজন বলতে এই। বেণীমাধববাবুর গাড়ি আছে দুটো। কিন্তু ড্রাইভার রাখেননি। একটা নিজে চালান, অন্য গাড়িটা অমলকে দিয়েছেন। অমল মামার টাকায় ইলেকট্রোনিক জিনিসপত্রের ব্যবসা করে। তার দোকান আছে চৌরঙ্গী এলাকায়। আমরা অমলকে দেখতে পেলুম না। সে তার দোকান থেকে বাড়ি ফেরে অনেক রাতে। আমরা আসব বলে বেণীমাধববাবু তিনটের মধ্যে তাঁর কিউরিও শপ বন্ধ করে বাড়ি চলে এসেছেন।

বেণীমাধবের শোবার ঘরটা বেশ বড়। খাটের পাশে একটা টেবিল। তার গা ঘেঁষে জানালা। সেই জানালা দিয়ে একটা লোমশ হাত ঢুকে টেবিলল্যাম্প নিভিয়ে দিয়েছিল। কর্নেল খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, “হ্যাঁ–অনেক লোম পড়ে আছে দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা বেণীমাধববাবু, কাল রাতে যখন ঘটনাটা ঘটল, তারপর কোনো মোটরগাড়ির শব্দ শুনেছিলেন কি?”

বেণীমাধব বললেন, “পেছনে খালের ওধারে ভি. আই. পি. রোড। সে শব্দ তত দিনরাত সবসময় শোনা যায়।”

“না। ধরুন, কাছাকাছি কোনো গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শুনেছিলেন কি?”

“খেয়াল করিনি।”

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, “খালের ধারে তারকাটার বেড়ার একটা জায়গা কেউ ফঁক করে রেখেছে দেখে এলুম। সেখানেও এমনি কালো লোম পড়ে আছে কাজেই বানরজাতীয় প্রাণী ওই পথেই এসেছিলাম। ওদিকে খালের ওপর একটা কাঠের পোলও দেখতে পেলুম। আমার ধারণা, প্রাণীটা কেউ পুষেছে এবং ট্রেনিং দিয়েছে। তারপর গাড়ি করে তাকে এনে আপনার বাড়ির দিকে পাঠিয়েছে।”

বেণীমাধববাবু চিন্তিতমুখে বললেন, “কিন্তু কেন? টেবিলল্যাম্পটা নিভিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য কী?”

“টেবিলল্যাম্প তো সারারাত জ্বালিয়ে রাখেন বলেছিলেন?”

“হ্যাঁ কর্নেল। ভূতুড়ে কাণ্ড কয়েকরাত চলার পর ওটা জ্বালিয়ে রাখতে শুরু করি।”

“টেবিলল্যাম্প জ্বললে আর কোনো উৎপাত ঘটে না বুঝি?”

“না।”

“তাহলে বোঝা যাচ্ছে, টেবিলল্যাম্প কেন নেভানোর দরকার হয়েছিল।” কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন। তারপর একটু হাসলেন। “টেবিলল্যাম্পটা এপাশে সরিয়ে ভালই করেছেন। মে মাসের এই গরমে জানালা বন্ধ করা যাবে না। প্রাণীটার নাগালের বাইরে রাখাই ভাল। তা আপনি কি মশারি খাঁটিয়ে শোন?”

“উপায় নেই কর্নেল। সল্টলেকে বারমাস যা মশার উৎপাত।”

ঘরের ভেতর আসবাবপত্র প্রচুর। বেশিরভাগই সেকেলে ডিজাইনের জিনিস। আমি প্রকাণ্ড একটা কাঠের আলমারির দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বেণীমাধব একটু হেসে বললেন, “এসব জিনিস আমার ঠাকুরদার আমলের। মায়াবশে এগুলো বদলে আধুনিক ডিজাইনের ফার্নিচার কিনিনি। তাছাড়া আজকালকার জিনিস বড় ঠুনকো।”

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, “পুরানো জিনিসের প্রতি ওঁর মায়া থাকা স্বাভাবিক, জয়ন্ত। ওঁর কিউরিও শপ তার প্রমাণ।”

বেণীমাধব বললেন, “ঠিক বলেছেন, কর্নেল। যে জিনিস যত পুরনো, তার প্রতি আমার তত মায়া। বাতিকও বলতে পারেন। ওই যে ব্রোঞ্জের প্রদীপটা দেখছেন, ওটা গুপ্তযুগের। টাকার অংকে ওটার দাম লক্ষ টাকা–কিন্তু ওটা বেচিনি। দোকান থেকে এনে রেখেছি। আর এই পোড়ামাটির সিংহটা দেখছেন, ওটা ভারহুত স্তূপ থেকে সংগৃহীত। নানা হাত ঘুরে আমার হাতে এসেছিল। এটাও বেচিনি।” তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে ফের বললেন। “বাঁটুলটাও আমি মায়ায় পড়ে বেচিনি। বিক্রী করতে চাইলে ওর দাম পেতুম দেড়কোটি টাকা।”

কথা বলতে বলতে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘরে আলো জ্বলেছে। একবার কফি, একবার চা এবং কিছু মিষ্টদ্রব্যও খাওয়া হয়েছে আমাদের। হঠাৎ কর্নেল উত্তেজিতভাবে একটা জানালার দিকে আঙুল তুলে বলে উঠলেন, “আরে ওটা কী।” তারপর হন্তদন্ত হয়ে ওদিকে উঠে গেলেন। পর্দা তুলে প্রায় চৈচিয়ে বললেন, “বেণীমাধববাবু! সেই আজগুবি বাঁদরটা পালাচ্ছে! এই মাত্র উঁকি দিচ্ছিল এখানে।”

বেণীমাধব লাফিয়ে উঠে বললেন, “তবে রে ব্যাটা!” তাপর বিছানার চাদর তুলে ওঁর পিস্তলটা নিয়ে রাগে অস্থির হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে ওঁর চেঁচামিচি শুনলুম।

আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। এবার আরও ভড়কে গেলুম কর্নেলের কাণ্ড দেখে। বেণীমাধববাবু বেরিয়ে যেতেই উনি তার বিছানার তলায় হাত ভরে একটু চাবির গোছা টেনে নিলেন। তারপর ঝটপট একটা টেবিলের ড্রয়ারের চাবি মেলাতে থাকলেন। কয়েকটা চাবির পর একটা চাবি ফিট করল। তখন ড্রয়ার খুলে কী সব হাতড়াতে-হাতড়াতে চাপা গলায় বললেন, “জয়ন্ত! তুমি ওঁকে কিছুক্ষণ আটকে রাখো গিয়ে। বুঝতে পেরেছ কী বলছি?”

কর্নেলের সঙ্গে বহুবছর কাটাচ্ছি। আমাকে কী করতে হবে তখনই টের পেয়েছিলুম। পেছনের দরজায় বেরিয়ে দেখি, ঠাকুর-চাকর-দারোয়ান সবাই বেরিয়ে পড়েছে। তারা খামোকা “চোর! চোর!” বলে চেঁচাচ্ছে। বেণীমাধব পিস্তল উঁচিয়ে কাঁটাতারের বেড়াটার দিকে নজর রেখে দাঁড়িয়ে আছেন সম্ভবত তার ধারণা, প্রাণীটা ফোকর গলিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে। অমনি তাকে গুলি করবেন।

আমি গিয়ে তফাতে অন্ধকারে একটা ঝোঁপের দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলুম, “ওই পালাচ্ছে।”

বেণীমাধব “কই, কই,– বলে সেদিকে ছুটলেন। আমি তার পেছনে দৌড়লুম। তারপর ফের প্রাণীটাকে দেখতে পাওয়ার ভান করে বললুম, “দেখুন তো, ওটা কুকুর, না সেই জন্তু?

বেণীমাধব হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, “কোথায় কোথায়?”

“ওপাশে ওই যে বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, তার ভেতর ঢুকল যেন।”

“চলুন তো দেখি!”

বাড়িটার ভেতর অন্ধকার ঠাসা। বেণীমাধব বললেন, “টর্চটা আনা উচিত ছিল। থাগে। মনে হচ্ছে, ব্যাটাচ্ছেলে কেটে পড়েছে, চলুন।”

আসতে আসতে বললুম, “এক কাজ করলে হত না বেণীমাধববাবু? কর্নেল বলেছিলেন, ভি. আই. পি.রোডে গাড়ি চাপিয়ে কারা প্রাণীটাকে নিয়ে আসে। চলুন তো, সেই ফোকর গলিয়ে আমরা দেখে আসি। অন্তত গাড়ির নম্বর নিতে পারব।”

কথাটা মনে ধরল ওঁর। বাড়ির পেছনে আগাছা ঢাকা জমি পেরিয়ে তারকাঁটার বেড়ার ফোকর খুঁজতে দেরি হল না। ওধারের রাস্তা থেকে যথেষ্ট আলো আসছিল। খালের ধারে দাঁড়িয়ে কোনো থেমে থাকা গাড়ি দেখা গেল না। যাবে না, তা তো আমি জানিই। কিন্তু ওঁকে আটকে রাখা দরকার। বললুম, “খাল পেরিয়ে গেল ভাল হত। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না কিছু। রাস্তার মধ্যিখানে আইল্যান্ডে ওইসব জসল করে রেখেছে যে!”

বেণীমাধব বললেন, “ঠিক বলেছেন জয়ন্তবাবু। চলুন!”

কিন্তু পা বাড়াতে গিয়ে কর্নেলের ডাক কানে এল। “বেণীমাধববাবু! জয়ন্ত! কোথায় আপনারা?”

কর্নেল বাড়িটার পেছনের বারান্দা থেকে ডাকছিলেন। অগত্যা আমরা ফিরে এলুম। আসতে আসতে বেণীমাধব রুষ্টভাবে বললেন, “কালই নিজের খরচায় ফোকরটা বন্ধ করে দেব। গভমেন্টের লোকেরা কিছু লক্ষ্য রাখে না।”

ঘরে ঢুকে ক্লান্তভাবে উনি বসলেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন, “এভাবে ঘর খোলা রেখে যাওয়া আমি সঙ্গত মনে করিনি। তাই উত্তেজনা দমন করে পাহারা দিলুম। কোন দিকে পালাল দেখলেন?”

বেণীমাধব শ্বাস ছেড়ে বললেন, “দেখতে পেলে তো গুলি করে মারতুম। টর্চ নিতে মনে ছিল না। আলো-আঁধার হয়ে আছে জায়গাটা।”

আমি বললুম, “বোঝা যাচ্ছে, কোনো কারণে, কেউ মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই জন্তুটা সন্ধ্যা হতে না হতেই পাঠিয়ে দিয়েছিল আপনার বাড়িতে। সম্ভবত ঘরে ঢুকে লুকিয়ে থাকত খাটের নিচে।

বেণীমাধব র‍্যাকের মাথা থেকে টর্চ দিয়ে ঝটপট খাটের তলাটা দেখলেন। ওঁর মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। এবার মনে হল, ভেতর ভেতরে খুব ভয় পেয়ে গেছেন।

আবার কফি এল। কফি শেষ করে ঘড়ি দেখে কর্নেল বললেন, “আজ উঠি বেণীমাধববাবু। আপনার ভাগ্নে অমলবাবুর ফিরতে বোধকরি রাত হবে। ওর সঙ্গে পরে সময়মতো আলাপ করা যাবে।

বেণীমাধববাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছে হেসে ফেললুম। কর্নেল ধমকের সুরে বললেন, “চুপ। কোনো কথা নয়।”

ইলিয়ট রোডে কর্নেলের ফ্ল্যাটে পৌঁছলুম যখন, তখন রাত আটটা বেজে গেছে। কর্নেল সোফায় আরাম করে বসে চুরুট ধরিয়ে বললেন, “তাহলে বোঝা গেল, একটা আজগুবি জন্তু–ধর, কোনো বাঁদরই তার মনিবের হুকুমে সত্যিসত্যি বেণীমাধবের বাড়ির জানালায় হাত বাড়িয়ে টেবিলল্যাম্প নিভিয়েছিল। এই ঘটনাটা মিথ্যা হলে বেণীমাধব আমার কথা শুনে অমন হুলস্থূল করে ছুটে বেড়াতেন না।“

“কিন্তু ওঁর ঘরে গোয়েন্দাগিরি করলেন কেন আপনি?”

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, “দুটো জিনিস পরীক্ষা করার সুযোগ নিয়েছিলুম। একঢ়িলে দুটো পাখি মারা বলতে পার। প্রথমটার কথা বললুম তোমাকে। দ্বিতীয়টা হল দৈনিক সত্যসেবকের সেই বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত। বেণীমাধবের ড্রয়ারে নোটবইয়ের ভেতর বিজ্ঞাপনের একটা কাটিং দেখলুম। সেটার চেয়ে বিস্ময়কর হল, দৈনিক সত্যসেবকের সেই বিজ্ঞাপন বিভাগের একটা রসিদ। একশো কুড়ি টাকা দিয়ে বেণীমাধবই ওই বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। হ্যাঁ–তোমাকে বললে তুমিই তোমাদের কাগজের বিজ্ঞাপন বিভাগ থেকে ওই তথ্যটুকু এনে দিতে পারতে। কিন্তু বেণীমাধববাবুর বাড়ি যাওয়ার পর কথাটা আমার মাথায় এসেছিল হঠাৎ।”

“কেন?” কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। তারপর একসময় চোখ খুলে বললেন, “আজ শুক্রবার। রবিবার আগামী পরশু। তৈরি থেকো জয়ন্ত।”

কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাড়ির পথে চলেছিল, তখন মাথাটা ভো ভো করছে। কিছুতেই মাথায় আসছে না, বেণীমাধবের ওইরকম অদ্ভুত বিজ্ঞাপন দেওয়ার কারণ কী?

.

মন্দিরে মৃত্যুর ত্রাস

দমদম এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে কিছুদুর যাওয়ার পর যশোর রোডের ধারে কর্নেলের এক বন্ধু ডাক্তার শিবকালী মজুমদারের বাড়ি। ডাঃ মজুমদার কর্নেলের বয়সী। কিন্তু কর্নেলের মতো মোটাসোটা তাগড়াই নন। বেঁটে রোগাটে গড়ন। প্রকাণ্ড গোঁফ। তাঁর সঙ্গে আমার চেনাজানা অনেকদিনের। রবিবার সন্ধ্যায় কর্নেলের সঙ্গে পৌঁছে দেখি, ডাঃ মজুমদার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

বাড়ির সামনে ঢাকা লনে চেয়ার পেতে বসে অনেক গল্পসল্প হল। রাতের খাওয়াদাওয়ার পর ডাঃ মজুমদার বললেন, “সাড়ে নটা বাজে। এখনই বেরিয়ে পড়া যাক। মন্দিরতলা অবশ্য কাছেই। থানাতেও আপনার কথামতো সব জানিয়ে রেখেছি। আমরা মন্দিরের পেছনে পুকুরপাড় ঘুরে যাব। মন্দিরে রাতে কেউ থাকে না।”

ডাঃ মজুমদার এর আগে কয়েকটা কেসে কর্নেলকে সাহায্য করেছেন। সেগুলো ছিল হত্যাকাণ্ড। ডাঃ মজুমদার একজন নামকরা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ। এটা অবশ্য হত্যাকাণ্ডের কেস নয়। তবু সঙ্গে তিনি থানায় আমার ভালই লাগছিল।

ওঁর বাড়ির পেছনে অন্ধকার মাঠের ধানক্ষেত, সজিক্ষেত আর চাষ জমিতে জলকাদায় একাকার হয়ে সেই পুকুরপাড়ে পৌঁছলুম। ঘন আগাছার জঙ্গল সেখানে। টর্চের আলো সাবধানে পায়ের কাছে ফেলে তিনজনে হাঁটছিলুম। পুকুরটা খুব গভীর মনে হল। যশোর রোডে মোটরগাড়ি চলাচলের বিরাম নেই। হেডলাইটের ছটা বারবার দেখিয়ে দিচ্ছিল সামনের মন্দিরটাকে। সেকালের বিশাল মন্দির। বটগাছ আছে পাশে। আমরা বটগাছের আড়ালে ওঁত পেতে বসলুম। ঘড়িতে নটা পঁয়তাল্লিশ, তখন রাস্তায় একটা জিপ যাচ্ছে দেখতে পেলাম। পেছনে একটা ট্রাক আসছিল, তার আলোয় জিপটাকে পুলিশের বলে মনে হল। জিপটা ট্রাকটাকে যেতে দিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থামল। ডাঃ মজুমদার ফিসফিস করে বললেন, “পুলিশ এসে গেল তাহলে।”

জিপটা একটু থেমেই চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে মন্দিরের কাছাকাছি এসে ব্রেক কষল একটা প্রাইভেট কার। গাড়ির দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ভেতরে আলো জ্বলল এবং দেখলুম বেণীমাধব নামছেন। তিনি একা এসেছেন গাড়ি নিয়ে। উত্তেজনায় আমার দম আটকে যাচ্ছিল। বেণীমাধব গাড়ি থেকে নেমে মন্দিরের সামনে এসে একটু কাশলেন। মন্দিরের সামনে পাঁচিল এবং উঁচু ফটক রয়েছে। ফটক দিয়ে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেখলুম। পাঁচিলটা তত উঁচু নয়। বেণীমাধবকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। ভেতরে গিয়ে উনি আবার কাশলেন। তারপর টর্চ জ্বেলে মন্দিরের ভেতরে আলো ফেললেন। আমরা এবার উঠে দাঁড়িয়ে ওঁর ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করছি। টর্চের আলোটা কয়েক সেকেন্ড মাত্র স্থির রইল। তারপর বেণীমাধব আলো নিভিয়ে ফেললেন এবং হন্তদন্ত ফিরে চললেন ওঁর গাড়ির দিকে।

কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন, “বেণীমাধববাবু! বেণীমাধববাবু!” তারপর দৌড়লেন রাস্তার দিকে। সেই সময় মন্দিরের দুপাশ থেকে কয়েকজন পুলিশ বেরিয়ে টর্চ জ্বালল। ভারিক্তি গলায় পুলিশ অফিসারের হাঁকডাক শুনতে পেলুম-”গাড়ি থামান! নইলে গুলি করব।”

কিন্তু বেণীমাধবের গাড়িটা বোঁ করে গুলতির মতো ছুটে গেল। পুলিশের জিপটা একটু তফাতে গাছের আড়ালে দাঁড় করানো ছিল। পুলিশ অফিসার এবং কনস্টেবলরা দৌড়ে গিয়ে জিপে চাপলেন। তারপর জিপটা দ্রুত ছুটল বেণীমাধবের গাড়ির উদ্দেশে। কর্নেল চেঁচিয়ে কিছু বললেন পুলিশ অফিসারকে, হয়তো কানে গেল না।

ঘটনাটা এত ঝটপট ঘটে গেল যে আমার হকচকানি কাটতে সময় লাগল। কর্নেল ততক্ষণে ফটক দিয়ে মন্দিরবাড়িতে ঢুকেছেন। ডাঃ মজুমদার আর আমি অন্ধকারে বটতলায় দাঁড়িয়ে আছি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে। এবার হুঁশ ফিরল। দুজনে মন্দিরবাড়িতে গিয়ে ঢুলুম।

কর্নেল টর্চ জ্বেলে মন্দিরের ভেতর আলো চমক খাওয়া স্বরে বললেন, “ এ কী!”

যা দেখলুম, শরীর শিউরে উঠল আতঙ্কে। শিবলিঙ্গের নিচে একটা লোক চিত হয়ে পড়ে আছে। তার চোখদুটো ঠেলে বেরিয়েছে। দাঁতের ফাঁকে জিভও বেরিয়ে রয়েছে। বীভৎস দেখাচ্ছে তাকে। নাকের তলায় একটু রক্তও আছে। মনে হল, কেউ লোকটাকে মেরে ফেলেছে। লোকটার মুখে খোঁচাখোঁচা গোঁফ দাড়ি। দেখতে ভিখিরিদের মতো।

ডাঃ মজুমদার বললেন, “সর্বনাশ! এ আবার কে?” তারপর হন্তদন্ত হয়ে মন্দিরে ঢুকলেন জুতো খুলে রেখে। কর্নেল বললেন, “আপনিই পরীক্ষা করে দেখুন। আমি মন্দিরে ঢুকব না।”

টর্চের আলোটা পরীক্ষা করে দেখার পর ডাঃ মজুমদার গম্ভীর মুখে বললেন, “বহুক্ষণ আগেই মারা গেছে। গলায় ফাঁস আটকে মেরে ফেলা হয়েছে সম্ভবত। হা–এই যে দেখছি, নাইলনের দড়ি পড়ে রয়েছে। কর্নেল, আমার মনে হচ্ছে–শিবলিঙ্গের আড়ালে খুনী বসেছিল ওত পেতে। এই লোকটা যে কোনো কারণেই হোক, এখানে ঢুকে সম্ভবত প্রণাম করছিল। সেই সময় গলায় আচমকা ফঁস আটকে হ্যাঁচকা টান দিয়েছে।”

তারপর উনি পায়ের কাছে ঝুঁকে কী কুড়িয়ে নিলেন। উত্তেজিতভাবে বললেন, ফের, “কর্নেল! কর্নেল! এ যে দেখছি সেইরকম কালো-কালো লোম! দেখুন!”

কর্নেল হাত বাড়িয়ে নিলেন। টর্চের আলোয় পরীক্ষা করে বললেন, “হ্যাঁ। প্রাণীটা যে শিম্পাঞ্জি, তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু পুলিশ অফিসার ভদ্রলোকের কাণ্ড দেখুন। আমি বারণ করলুম বেণীমাধববাবুর পেছনে ছুটতে। শুনলেন না। বেণীমাধববাবুকে তো ওঁরা বাড়িতেই পাওয়া যেত পরে। আসল রহস্য পেছনে ফেলে রেখে ওঁর পেছনে ছোটার মানে হয় না।”

ডাঃ মজুমদার বললেন, “পুলিশ বেণীমাধবকে পাকড়াও করে করবেটা কী? উনি প্রভাবশালী লোক। তাছাড়া ওঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটাই বা কী? মন্দিরে আসা নিশ্চয় অপরাধ নয়।”

“আমার ধারণা, পুলিশ আপনার বক্তব্য ঠিক বুঝতে পারেনি।

“আমি ওদের বলেছিলুম, মন্দিরতলায় একটা চোরাই মাল কেনাবেচা হবে। আপনার কথা বলেছিলুম। যাকগে, এখন এই লাশটার ব্যাপারে কী করা যায় বলুন তো?”

কর্নেল রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটু হেসে বললেন, “মনে হচ্ছে, বেণীমাধবের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে পুলিশ ফিরে আসছে। বেণীমাধবকে গ্রেফতার করা সম্ভব নয়। বিনা অভিযোগে।”

পুলিশের জিপটা সত্যি ফিরে এল। জিপ থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন সেই পুলিশ অফিসার। বললেন, “বেণীমাধব রায় মহা ধড়িবাজ লোক। বলে কী, মন্দিরে প্রণাম করতে গিয়েছিলুম। যাই হোক, ওঁকে ঘাঁটালুম না আপাতত। কিন্তু অন্য পার্টি তো এল না কর্নেল।”

কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, “ এসেছিল। কিন্তু তৃতীয় এক পার্টি তাকে খুন করে মাল হাতিয়ে কেটে পড়েছে অনেক আগেই। ওই দেখুন।”

মন্দিরের ভেতর লাশটা দেখেই পুলিশ অফিসার চমকে উঠলেন। “সর্বনাশ! এ আবার কে?”

কর্নেল বললেন, “যেই হোক, একে কিন্তু বেণীমাধববাবু খুন করেননি–তা আপনারা এবং আমরা সবাই দেখেছি। বেণীমাধব এই মড়াটা দেখেই ভয় পেয়ে চলে গেছেন। আইনত উনি বড়জোর একজন সাধারণ সাক্ষী হতে পারেন। যাইহোক, বডিটা মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন এখনই।”

আমরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালুম। পুলিশ অফিসার আবার জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কনস্টেবলরা মন্দিরে পাহারায় রইল। কর্নেল বললেন, “চলুন ডাঃ মজুমদার। কনস্টেবলদের বলে যাচ্ছি, দরকার হলে আমাদের সঙ্গে আপনার বাড়িতে যোগাযোগ করবে ওরা। এখানে দাঁড়িয়ে কোনো লাভ নেই।”

ডাঃ মজুমদারের বাড়ির সামনের লনে আমরা বসলুম। রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। জোরাল হাওয়া দিচ্ছিল বলে মশার উৎপাত নেই। কফি এল একপ্রস্থ। কফি খেতে খেতে ডাঃ মজুমদার বলেন, “লোকটার পরিচয় না পেলে কিছু বোঝা যাবে না। দেখে মনে হল, পাগলা ভিখিরি-টিখিরি যেন। ওকে খুন করল কেন?”

কর্নেল হাসলেন। “বাঁটুল রহস্য আরো ঘনীভুত হলে ডাঃ মজুমদার। শুধু এটুকুই আপাতত বলতে পারি।”

আমি বললুম, “বেণীমাধবের কাছেই সব রহস্যের চাবি রয়েছে। চলুন না, তার কাছে যাই!”

কর্নেল হাসলেন। “দরকার নেই ডার্লিং! উনিই কাল সকালে আমার কাছে হাজির হবেন।”

ডাঃ মজুমদার বললেন, “আচ্ছা কর্নেল, শিম্পাঞ্জিকে দিয়ে মানুষ খুন করানো কী সম্ভব?”

“নিশ্চয় সম্ভব। শিম্পাঞ্জি বুদ্ধিমান প্রাণী। তাকে খুন করতে শেখানো মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। প্রথমে মানুষের ডামি তৈরি করে ডামির গলায় ফাঁস আটকানোর ট্রেনিং দিলেই শিখে নেবে। বেণীমাধবের ঘরে টেবিলল্যাম্প না নিভলে ভৌতিক উপদ্রব শুরু হয় না। তাই শিম্পাজিটাকে তার মালিক টেবিলল্যাম্পের সুইচ অফ করতেও শিখিয়েছে। আরো কত কী শিখিয়েছে কে জানে!”

“ভৌতিক উপদ্রবটা সত্যি অদ্ভুত!” ডাঃ মজুমদার বললেন। “ব্যাপারটা কী হতে পারে?”

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, “নিছক একটা ক্যাসেটে টেপের ব্যাপার সম্ভবত। বেণীমাধবের ঘরে আলো না থাকলেই ব্যাপারটা জমে ওঠে। আলো জ্বললে ভূতুড়ে উৎপাত মোটেও জমে না। বরং ধরা পড়ার চান্স থাকে। আমার ধারণা, শিম্পাঞ্জিটা খুদে টেপরেকর্ডার নিয়ে এসে জানালা ধারে সেটা চালিয়ে দেয়। ক্যাসেটে কাঁচ ভাঙার শব্দ, ফিসফিস করে কথাবলার শব্দ, হাঁটাচলার শব্দ–সবই রেকর্ড করা আছে।”

অবাক হয়ে বললুম, “কিন্তু এর উদ্দেশ্য কী?”

কর্নেল বললেন, “হয়তো কেউ কোনো কারণে বেণীমাধববাবুকে ভয় দেখাচ্ছে।” ডাঃ মজুমদার মন্তব্য করলেন, “কিছু বোঝা যাচ্ছে না। রহস্য সত্যিই ঘনীভূত…”।..

.

পলাতক দেহরক্ষী অ্যাস্টিডোনা

পরদিন সকালে কর্নেলের বাড়ি গিয়ে দেখি বেণীমাধব হাজির। এদিন ওঁকে ভীষণ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। চোখদুটো লাল। উস্কখুস্ক চুল। আমাকে দেখে কোনো সম্ভাষণ করলেন না। কর্নেলের সঙ্গে আগের কোনো কথার জের টেনে বললেন, “যা বলছিলুম, কর্নেল! সত্যি আমি এতখানি তলিয়ে ভাবিনি। নইলে আপনাকে ব্যাপারটা জানাতুম। বৈজুনাথের সঙ্গে আমার অনেকদিনের কারবার। দুনিয়া জুড়ে ওর ঘাঁটি। অদ্ভুত-অদ্ভুত পুরনো জিনিস জোগাড় করে সে কিউরিও শপে বেচে। আলেকজান্ডারের বাঁটুল আমি তার কাছেই কিনেছিলুম। বাঁটুলটা কেনার পর বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম। জিনিসটা বেচার ইচ্ছে ছিল না। ভেবে ছিলুম সাজিয়ে রাখব ঘরে। কিন্তু রাখতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গেল। তারপর দেখি…”

কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, “দেখলেন না যে ওটা দুভাগ হয়ে গেছে এবং ভেতরে আছে। একটা প্রকাণ্ড হিরে!”

আমি চমকে উঠলাম। বেণীমাধবের মুখেও বিস্ময় ফুটে উঠল। বললেন, “তাহলে আপনি দেখেছেন।”

“হ্যাঁ।” কর্নেল বললেন। “তবে বাঁটুলটা আমার হাত থেকে দৈবাৎ পড়ে যায়নি। ওর ভেতরে, হিরে লুকানো আছে, সেটা আরিয়ানের লেখা সম্রাট আলেকজান্ডারের জীবনী পড়েই জেনেছি। ওটা দেখতে বাঁটুলেরই মতো এবং গ্রিক যোদ্ধারা আত্মরক্ষার জন্য এ জিনিস কাছে রাখতেন বটে, কিন্তু কিছু বাঁটুলের ভেতর মূল্যবান পাথর রা মণিমুক্তাও লুকিয়ে রাখা হত। সেগুলো আসলে বাঁটুল নয়, কৌটো। বিশেষ করে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে কিংবা পররাজ্যে হানা দেবার সময় এই অদ্ভুত কৌটো কাজে লাগাত। লুণ্ঠিত বিশেষ মণিমুক্তা এর ভেতর নিরাপদে রাখা যেত। কেউ টের পেত না। ভাবত, ওটা আত্মরক্ষার অস্ত্র মাত্র।”

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ফের বললেন, “আপনি বাঁটুলটা দিয়ে গেলে আতস কাঁচের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখেছিলুম, ওটার মাঝামাঝি জোড়া দেওয়া এবং একটা কালো বিন্দু রয়েছে। সেখানে ছুরির ডগার চাপ দিতে খুলে গেল। অবাক হয়ে দেখলুম, ভেতরে প্রকাণ্ড একটা হিরে ঝলমল করছে। তখন বুঝলুম কেন এটা আপনি আমার জিম্মায় রাখতে দিয়ে গেছেন।”

বেণীমাধব বললেন, “বৈজুনাথ বলেছিল, এরকম গ্রিক বাঁটুল তার কাছে আরো একটা আছে। সেটা নাকি সম্রাট আলেকজাণ্ডারের বাবা ফিলিপের। বৈজুনাথ সেটার দাম দেড়গুণ বেশি চেয়েছিল। আমি তখনও জানি না এর ভেতর কী আছে। তাই বেশি দাম শুনে নিতে রাজি হইনি। পরে পস্তাম খুব। বৈজুনাথের বিরুদ্ধে দেশবিদেশের প্রত্নদ্রব্য নিয়ে চোরাকারবারের অভিযোগে পুলিশের হুলিয়া ঝুলছে। প্রকাশ্যে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা কঠিন। সে-ও বরাবর গোপনে দেখা করত। তার এক বন্ধু থাকে পার্কস্ট্রিটে। তাকে বলে এলুম বৈজুনাথ যেন শিগগির দেখা করে আমার সঙ্গে। কিন্তু কদিন পরে বৈজুনাথ আমার দোকানে এল ভিখিরির ছদ্মবেশে। কিন্তু আমার গরজ দেখে সে এবার বাঁটুলটার দাম আরো বাড়িয়ে দিল।”

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, “কত চাইল বৈজুনাথ?”

“আলেকজান্ডারের বাঁটুলের দাম চেয়েছিল পাঁচহাজার টাকা। দরাদরি করে তিনহাজারে কিনেছিলুম। এটার দাম চাইল দশ হাজার টাকা। অথচ প্রথমে চেয়েছিল মোটে ছ’হাজার টাকা।”

“তারপর আপনি কী বললেন ওকে?”

“আমি একটু দ্বিধায় পড়লুম। যদি এ বাঁটুলটার ভেতর হিরে না থাকে? তাছাড়া….” একটু বিষণ্ণভাবে হাসলেন বেণীমাধব। তাছাড়া বাঁটুলটা যে সত্যিসত্যি ফিলিপের, তার প্রমাণ কী? ওটা। জাল বাঁটুলও তো হতে পারে। প্রত্নদ্রব্য হিসেবে এসব জিনিসের বাজার দর প্রচণ্ড। তাই জাল হওয়া খুব স্বাভাবিক।”

“ঠিক বলেছেন। তবে আলেকজান্ডারের বাঁটুলটা অবশ্য জাল নয় বলে মনে হচ্ছে। কারণ ওর ভেতর হিরে আছে এবং আরিয়ান ঠিক তারই আভাস দিয়েছেন জীবনীগ্রন্থে।”

বেণীমাধব বললেন, “বৈজুনাথের সামনে সেটা তো পরীক্ষা করা যায় না। তাছাড়া সে আমাকে দেবেও না গোপনে তার চোখের আড়ালে পরীক্ষা করতে। তাই ইতস্তত করছিলুম। তখন বৈজুনাথ নিজে থেকে প্রস্তাব দিল, ঠিক আছে। টাকা জোগাড় করে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন কৌশলে। কারণ আমার পক্ষে আর এখানে আসা সম্ভব হবে না। পুলিশ ওঁত পেতে বেড়াচ্ছে। কোন কাগজে কীভাবে বিজ্ঞাপন দিতে হবে, তাও সে বলে দিয়ে গেল। সে একথাও বলল যে, আমার বাড়িতে যাবে না।”

বৈজুনাথ নামটা তো বাঙালি নয় তাহলে দৈনিক সত্যসেবকে বিজ্ঞাপন দিতে বলেছিল কেন?”

বেণীমাধব হাসলেন। “বৈজুনাথ ওর ছদ্মনাম। ও আসলে বাঙালি। ওর প্রকৃত নাম আমিও জানি না। অনেকগুলো নাম নিয়ে ও কারবার চালাত।”

“তারপর আপনি বিজ্ঞাপন দিলেন?”

“শেষপর্যন্ত দিলাম। আমার লোভ বেড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া মনে মনে ঠিক করেছিলুম নির্জন মন্দিরে আমাকে সে বাঁটুলটা বেচামাত্র ওটা খুলে দেখে নেব। যদি হিরে না থাকে, তাহলে….”

“তাহলে পিস্তল দেখিয়ে ওকে ভয় পাইয়ে টাকা ফেরত নেবেন–এই তো?”

“ঠিক বলেছেন।”

“হুঁ–বৈজুনাথ আপনার বাড়ি যেতে চায়নি কেন বোঝা যাচ্ছে। সে ভেবেছিল, বাড়িতে ওকে পেয়ে আপনি ব্ল্যাকমেইল করে কম দাম দেবেন।”

“বৈজনাথ বড় ধুরন্ধর ছিল। কিন্তু বেঘোরে মারা পড়ল শেষ পর্যন্ত।”

এতক্ষণে টের পেলুম, যশোর রোডের সেই মন্দিরে যার মড়া দেখেছি, সেই লোকটা বৈজুনাথ। ভিখিরির ছদ্মবেশেই ওখানে গিয়েছিল সে।

কর্নেল বললেন, “বাঁটুলের ভেতরে হিরের খোঁজ কেউ আগে থেকেই জানত, বেণীমাধববাবু। তাই সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তার সম্পর্কে আমরা এখনও কিছু জানি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি যে তার একটা শিক্ষিত শিম্পাঞ্জি আছে। শিম্পাঞ্জিকে দিয়ে সে টেবিলল্যাম্প নিভিয়ে ক্যাসেট বাজিয়ে ভূতপ্রেতের ভয় দেখিয়েছে আপনাকে। সে ভেবেছিল, আলেকজান্ডারের বাঁটুলের ভেতরকার হিরের খবর আপনি জানেন না। অতএব ভূতের উৎপাতে উত্যক্ত হয়ে ভাববেন ওই বাঁটুলটাই এর মূলে এবং ওটা হাতছাড়া করতে চাইবেন। আচ্ছা বেণীমাধববাবু, কেউ কোনোদিন কি আপনার দোকানে এসে বাঁটুলের খোঁজ করেছিল?”

বেণীমাধববাবু বললেন, “বাঁটুল সম্পর্কে কেউ খোঁজ করেনি। তবে হ্যাঁ–একজন খদ্দের কিছুদিন আগে জিগ্যেস করছিল। খ্রীস্টপূর্ব কোনো গ্রিক প্রত্নদ্ৰব্য আমার কাছে পাওয়া যায় নাকি।”

“কেমন চেহারা তার, মনে আছে?”

“আপনার মতোই মুখে দাড়ি ছিল। তবে কালো দাড়ি। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মধ্যে। লম্বা গড়ন। গায়ের রঙ ময়লা। লোকটাকে আমার মনে আছে। কারণ..” একটু ভেবে বেণীমাধব বললেন, “

হাওর নাকটার জন্য। ওরকম বাঁকা লম্বা নাক সচরাচর দেখা যায় না। বাজপাখির মতো কতকটা। তার চোখে সানগ্লাস ছিল। লোকটাকে আমার পছন্দ হয়নি। কেমন নাকিস্বরে ইংরেজিতে কথা বলছিল।”

কর্নেল গুম হয়ে কী ভাবতে থাকলেন। চোখ বুজে টাকে একবার হাত বুলিয়ে সাদা দাড়িতে আঁচড় কাটতে থাকলেন অভ্যাসবশে। আমি একটা পত্রিকায় চোখ রাখলুম। বেণীমাধব উসখুস করছিলেন। কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। সেই সময় কর্নেল বললেন, “পার্কস্ট্রিটে বৈজুনাথের সেই বন্ধুর চেহারা কেমন?”

বেণীমাধববাবু বললেন, “নাঃ। সে নয়। সে যত ছদ্মবেশে আসুক, আমি চিনে ফেলব। তাছাড়া সে ফর্সা, মোটাসোটা। তার নাকটা বেঁটে। আমার বয়সী লোক।”

“নাম কী?”

“ভোমরলাল চোপরা। অবাঙালি। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের বড় ব্যবসা আছে। তবে বুঝতেই পারছেন, সে কেমন।”

“ঠিকানাটা লিখে দিন প্লিজ। ফোন নাম্বার জানলে তাও লিখে দিন।”

বেণীমাধব একটুকরো কাগজে ঠিকানাটা লিখে দিলেন। কর্নেল সেটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললে, “ঠিক আছে। আপনি কিছু ভাববেন না বেণীমাধববাবু। আপনার মূল্যবান জিনিস নিরাপদেই থাকছে। খুনে শিম্পাঞ্জির মালিককে খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগবে এই যা।”.

বেণীমাধববাবু চলে গেলে বললুম। “ভোমরালালের পক্ষে বাঁটুলের গুপ্তরহস্য জানা খুবই সম্ভব। তাই না কর্নেল?”

কর্নেল একটু হেসে ফোন তুলে ডায়াল করলেন। তারপর ওঁর এইসব কথাবার্তা শুনলুম। ইংরেজিতেই কথা বলেছিলেন কর্নেল।…”হ্যালো! আমি মিঃ চোপরার সঙ্গে কথা বলতে চাই।…ও, আচ্ছা! কোথায়! ..আচ্ছা, আচ্ছা।…হ্যাঁ, আমি ওঁর এক বন্ধু কথা বলছি। আমার নাম বি.এম.রায়। কবে ফিরবেন বলে গেছেন? …কিন্তু আমার যে জরুরি দরকার ওঁর সঙ্গে। ট্রাংক কলে কথা বলব, যদি ঠিকানাটা দয়া করে জানান।..বুঝেছি! আচ্ছা, ঠিক আছে।”

কর্নেল ফোন রেখে বললেন, “চোপরা গেছে কাশ্মীরে বেড়াতে। শ্রীনগরে দুদিন থেকে যাবে লাডাকে। ওর পি. এ. ফোন ধরেছিল। বলল, ওঁর সঙ্গে ট্রাংকলে যোগাযোগ করা যাবে না, কোথাও থাকার ঠিক নেই।”

হাসতে হাসতে বললুম, “কলকাতার গরম সহ্য হচ্ছিল না। তাই বুঝি লাডাকে?”

কর্নেল বললেন, “লাডাকের রাজধানী লেহ। সেখানে নাকি চোপরার কোম্পানির একটা ব্রাঞ্চ অফিস আছে। ওর পি. এ. বলল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, চোপরা একটু কিছু আঁচ করেই কেটে পড়েছে কলকাতা থেকে। কারণ ওর পি. এ. বলল কবে কলকাতা ফিরবে ঠিক নেই। লাভাক থেকে বিদেশেও যেতে পারে।”

“দেশবিদেশে যাদের কারবার তাদের পক্ষে এটা স্বাভাবিক তাই না?”

কর্নেল জবাব না দিয়ে আবার চোখ বুজলেন। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ উঠে গিয়ে সেই পুরনো ইংরেজি বইটা নিয়ে এলেন। দ্রুত পাতা উল্টে একখানে চোখ রেখে বললেন, “হুঁ-লাড়াক। আরিয়ান লিখেছেন, মৃত্যুকাল পর্যন্ত সম্রাটের সন্দেহ ছিল, পলাতক দেহরক্ষী অ্যাস্টিডোনা তার অমূল্য বাঁটুল চুরি করে নিয়ে পূর্বদিকে পালিয়ে গেছে। তাঁর মৃত্যুর পর এক চীনা পরিব্রাজক আলেকজান্দ্রিয়ায় আমাকে বলেছিলেন, কাশ্মীরের উত্তরে ডাক রাজ্যে একদল গ্রিককে দেখেছেন। বুঝলুম, ওরা সম্রাটের বাহিনী থেকে পলাতক গ্রিক দেহরক্ষী সেনাদল। বাঁটুল হারিয়ে সম্রাট এত খাপ্পা হয়েছিলেন যে তার দেহরক্ষী পঞ্চাশজন সৈনিককেই প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন। অ্যাস্টিড়োনা এদের নায়ক ছিল। সে পালিয়ে যায় প্রথমে। পরে তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আরো চল্লিশজন। বাকি ন’জনের মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। চীনা পরিব্রাজকের কথায় জানা গেল, সেই একচল্লিশ জন গ্রিক সৈনিক লাক রাজ্যে বাস করছে।”

কর্নেল ওই অংশটুকু পড়ার পর বললেন, “আরিয়ানের প্যাপিরাসে লেখা পুঁথি পাওয়া গিয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার একটি ধ্বংসবশেষে। তা ১৮৯৪ সালে ইংরেজ ঐতিহাসিক হালডেন ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এই বইটা ১৯০৮ সালে প্রকাশিত চতুর্থ সংস্করণ। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে পেয়ে গিয়েছিলাম। এটা এত কাজে লাগবে ভাবতেই পারিনি।”

বললুম, “কাজে আর কতটুকু লাগল? শিম্পাঞ্জিওয়ালা খুনীকে যদি ধরিয়ে দিতে পারত, তাহলে বুঝতাম!”

কর্নেল আমার পরিহাসে কান করলেন না। আপনমনে বিড়বিড় করে কিছুক্ষণ ‘লাডাক’ এবং ‘গ্রিক দেহরক্ষীদল’ কথাদুটো উচ্চারণ করলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, “জয়ন্ত! এই প্রচণ্ড গরমে প্রাণ আইঢাই করছে। যাবে নাকি, লাডাকে? সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পনেরোহাজার ফুট উঁচুতে লাডাকের অবস্থান। এখন সেখানে দারুণ স্নিগ্ধ আবহাওয়া। চিরবসন্তের দেশ ডার্লিং।”

হুঁউ, আমার বৃদ্ধ বন্ধু আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন। বললুম, “যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু সেখানে সেই খুনে শিম্পাঞ্জি, আর তার দুষ্ট মনিবটির সঙ্গে দেখা হবার চান্স আছে কি?”

“থাকতেও পারে!”

“তাহলেই তো মুশকিল!”

“মুশকিল কীসের?” প্রাজ্ঞ গোয়েন্দাপ্রবর নিভে যাওয়া চুরুটে অগ্নিসংযোগ করে বললেন, “যেখানে মুশকিল, সেখানেই মুশকিল আসান। ডার্লিং জয়ন্ত, শেষপর্যন্ত এই বুড়োকে কিন্তু সত্যি মুসলিম পীর মুশকিল আসান সাজতে হবে এবং তুমি হবে আমার চেলা।”

“ছদ্মবেশ ধরতে হবে নাকি?”

“হুঁউ। লাডাকের অধিবাসীরা মোটামুটি দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। মুসলিম এবং বৌদ্ধ। হিন্দুর সংখ্যা খুবই কম। কাজেই মুসলিম পীর সাজাটা নিরাপদ। কারণ আমাকে বৌদ্ধলামা মানাবে না, যতই নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করি, তাছাড়া…” কর্নেল নিজে সাদা দাড়ি দেখিয়ে বললেন, “লামাদের দাড়ি থাকে না। তাই লামা সাজতে হলে আমার এই সুন্দর দাড়িটা হেঁটে ফেলতে হবে। জয়ন্ত, প্রাণ ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু এই দাড়ি ত্যাগ করা অসম্ভব।”

উদ্বিগ্ন হয়ে বললুম, “আপনি না হয় সর্বশাস্ত্রজ্ঞ মানুষ। মুসলিম মন্ত্র আওড়ানো আপনার পক্ষে সম্ভব। কিন্তু আমি ওসব কিছু জানিনে!”

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, “ভয় নেই। আমি মাঝে মাঝে যা আওড়াব–তুমিও তাই আওড়াবে।”

সায় দিলুম বটে, কিন্তু ব্যাপারটা ভাল লাগছিল না।

.

পীরবাবার কেরামতি

শ্রীনগর থেকে লাডাকের রাজধানী লেহ-এর দূরত্ব ৪৩৪ কিলোমিটার। শোনমার্গ নামে একটা জায়গা থেকে রাস্তার দু’ধারের দৃশ্য বদলাতে শুরু করেছিল। ফুলে-ফুলে ঢাকা মাঠ, দূরে সাদা তুষারে ঢাকা পর্বতশ্রেণি। রাস্তা ক্রমশ এঁকেবেঁকে চড়াইয়ে উঠছিল। তারপর পাহাড়ের রাজ্য। পিলে চমকানো বাঁকের নিচে অতল খাদ দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। আর কী অদ্ভুত গড়নের সব পাহাড়! কত রকম রঙ তাদের–সোনালী, খয়েরী, কালো, কোনোটা নীল। দিগন্তে যেন আদিম যুগের সব অতিকায় ডাইনোসর দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনো পাহাড়ের গড়ন বেঁটে, কোনোটা যেন দৈত্যের মতো। কোনোটার মাথায় সেকালের ভাঙাচোরা দুর্গ–নিচে পর্যন্ত পাথর ছড়ানো। বৌদ্ধ মন্দির গুম্ফাও দেখতে পাচ্ছিলুম। হদলে রঙের আলখেল্লাধারী বৌদ্ধ ধর্মগুরু লামাদেরও দেখতে পাচ্ছিলুম। দুপুরে লেহ পৌঁছে বাস থেকে আমরা নেমেছিলুম। তখন ছদ্মবেশ ধরিনি।

যে হোটেলে আমরা উঠলুম, তা থিসে গুম্ফার কাছাকাছি নিরিবিলি একটা পাহাড়ের গায়ে, হোটেলের নাম ‘সানি লজ’। তার মালিক সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার। পাঞ্জাবের লোক। অর্জুন সিং নাম। দেখলুম, উনি কর্নেলের পরিচিত। নিচের উপত্যকায় ঘাসের মাঠে গুজ্জর রাখালরা ভেড়া চরাচ্ছিল। অর্জুন সিং বললেন, “ওরা যাযাবর জাতি। ওদের বলা হয় গুজ্জর বখরাওয়ালা। কর্নেল, আপনি নাগপা উপজাতির কথা জানতে চাইছেন তো? নাগপারা থাকে সামনের ওই পাহাড়টার পেছনে। ওদের চেহারা ভারি সুন্দর। কিংবদন্তি আছে যে ওরা নাকি গ্রিকদের বংশধর। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে পৌঁছলে কোনো

কারণে একদল গ্রিক সৈনিক পালিয়ে এসেছিল লাডাকে। নাগপারা তাদেরই নাকি বংশধর।”

কর্নেল বললেন, “হা-ওদের কথা বইয়ে পড়েছি। ওদের সম্পর্কে আমার খুব আগ্রহ।”

অর্জুন সিং বললেন, “ঠিক আছে। ওদের একজনের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। তাকে ডেকে পাঠাব।”

কর্নেল বললেন, ‘দরকার নেই। আমি গিয়ে আলাপ করব ওদের সঙ্গে।”

অর্জুন সিং গম্ভীর মুখে বললেন, “নাগপারা এমনিতে খুব ভদ্র। কিন্তু ওরা বাইরের লোকের প্রতি খুব সন্দেহপরায়ণ। তাই বাইরের লোকের সঙ্গে মিশতে চায় না। তাছাড়া ওরা কি দুর্দান্ত হিংস্র প্রকৃতিরও। সাবধানে মেলামেশা করা দরকার।”

কথা হচ্ছিল হোটেলের ব্যালকনিতে বসে। একটু পরেই কর্নেল বললেন, “আচ্ছা ব্রিগেডিয়ার সিং, এখানে কলকাতার ভোমরলাল চোপরা কোম্পানির একটা ব্রাঞ্চ অফিস আছে শুনেছিলুম। কোথায় সেটা?” অর্জুন সিং একটু হেসে বললেন, “চোপরাকে চেনেন নাকি?”

“না । নাম শুনেছি।”

“চোপরা বিপজ্জনক লোক। ও আসলে চোরাচালানি। এখান থেকে চীনের কাশগড়ে যাবার একটা রাস্তা আছে। দুর্গম রাস্তা অবশ্য। চোপরা সেই রাস্তায় চীন থেকে বে-আইনিভাবে জিনিসপত্র আমদানি করে। আমাদের সেনাবাহিনী সারা এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। কারণ সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। চোপরার ধূর্ততা অসাধারণ। সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে কারবার করে।”

“চোপরার অফিসটা কোন্ এলাকায়?”

অর্জুন সিং আঙুল তুলে শহরের দিকে দেখিয়ে বললেন, “ওই যে একটা সাদা বাড়ি–তার নিচে বাজার দেখা যাচ্ছে। বাজারের পেছনে গম্বুজওলা মসজিদের পাশেই চোপরার অফিস। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। টিলার আড়ালে পড়ে গেছে।”

এরপর কর্নেল আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলেন অর্জুন সিংকে, চুপি চুপি অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললেন। তারপর দেখলুম অর্জুন সিং হা-হা করে হেসে উঠলেন প্রচণ্ড উঁড়ি দুলিয়ে। কর্নেল আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন ঘরে। বললেন, “এবেলা বিশ্রাম করা যাক। সন্ধ্যার মুখে আমরা বেরুব। জয়ন্ত, তখন আমি কিন্তু মুশকিল আসান পীর। আর তুমি আমার চেলা।”

ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, “ছদ্মবেশ না ধরলেই কি নয়?”

কর্নেল একটু হেসে শুধু বললেন, “যস্মিন দেশে যদাচার।”

ব্রিগেডিয়ার অর্জুন সিং বিকেল গড়িয়ে আমাদের ঘরে এলেন। চাপা গলায় বললেন, “হ্যাঁ-খবর নিয়েছি। চোপরা এসেছে দিন চারেক আগে।”

কর্নেল বললেন, “আমাদের পোশাক পরা শেষ হলে আমরা বেরুব কিন্তু।”

“করিডর দিয়ে এগিয়ে পেছনের দিকে নেমে যাবার সিঁড়ি আছে। ওদিকটা নির্জন। আপনারা নিশ্চিন্তে বেরুতে পারেন। ওদিকে দরজা আমি খুলে রাখছি। নামবার সময় কিন্তু ভেজিয়ে দিয়ে যাবেন।” বলে অর্জুন সিং চলে গেলেন।

কর্নেল দরজা এঁটে দিয়ে স্যুটকেশ খুলে বললেন, “চিৎপুরে দাশ অ্যাণ্ড কোম্পানি যাত্রা থিয়েটারের পোশাক ভাড়া দেয়। এগুলো তাদের কাছ থেকে জোগাড় করেছি। ডার্লিং, তোমার তো দাড়ি নেই। অতএব নকল দাড়ি পরতে হবে। মুখ আর দু-হাতের চামড়া একটু ময়লা দেখানো দরকার। পেন্ট এনেছি। মেখে নাও। আশা করি, কখনও-কখনও থিয়েটারে নেমেছে। অসুবিধা হলে আমি সাহায্য করব।”

কিছুক্ষণ পরে সাজগোজ শেষ করে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ালুম, না পারলুম নিজেকে চিনতে, না কর্নেলকে চিনতে। দুজনের পরনে দুটো কালো আলখেল্লা। মাথায় নোংরা রঙিন কাপড়ের পাগড়ি। গলায় ইয়া মোটা রঙিন পাথরের মালা। কর্নেলের হাতে একটা হাতলওয়ালা ধূপদানি, আর প্রকাণ্ড কালো চামর। আমার হাতে একটা মস্তবড় লোহার চিমটে। চিমটেয় আংটা পরানো রয়েছে অনেকগুলো। কর্নেল দেখিয়ে দিলেন, কেমন করে চিমটেটা তুলে বুকে মৃদু ঘা মারতে হবে এবং ঝুনঝুন শব্দ উঠবে। সেইসঙ্গে বিড়বিড় করতে হবে–ঠোঁট দুটো সবসময় কাপবে। তারপর কী বলতে হবে, তাও শিখিয়ে দিলেন।

ধূপদানিতে একগাদা টিকে ভরে আগুন ধরালেন কর্নেল। তারপর ধূপ ছড়িয়ে দিলেন। ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেল। তারপর বেরিয়ে পড়লুম।

হোটেলের পেছনে খাড়া পাহাড়। খাঁজকাটা গা দিয়ে নিচের রাস্তায় নামলুম যখন, তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল বেমক্কা চেঁচিয়ে উঠলেন, “ইয়া পীর মুশকিল আসান।”

ট্রেনিং মতো আমিও চেঁচিয়ে বললুম, “যাহা মুশকিল তাহা আসান।”

রাস্তা ক্রমশ বাজারের দিকে নেমেছে! ঘোড়ার টানা গাড়ি, মোটরগাড়ি, হরেকরকম যানবাহন চলাচল করছে। তত বেশি ভিড় চোখে পড়ল না। পীরবাবা যে দোকানের সামনে দাঁড়াচ্ছেন এবং ওই বুলি বলে হাঁক দিচ্ছেন, সেই দোকানের লোক এসে ধূপদানির তলার দিকে বাটির মতো গোল পাত্রটাতে ঠকাস করে পয়সা ফেলছে। আর পীরবাবা তার মাথার চামর বুলিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়ে ‘মুশকিল আসান করছেন।

কর্নেল ঠিকই বলেছিলেন, প্রচুর মুসলিম এদেশে বাস করে। গম্বুজওলা মসজিদের সামনের ধাপবন্দী সিঁড়িতে আমরা যখন বসলুম, তখন ধাপের নিচে ভিড় জমে গেল। মসজিদ থেকে প্রার্থনা করে দলে দলে লোক বেরিয়ে এল। তারাও ভিড় করে দাঁড়াল। পীরবাবা সমানে হাঁক দিচ্ছেন, “ইয়া পীর মুশকিল আসান!” আমি পাল্টা চেঁচিয়ে উঠছি, “যাহা মুশকিল তাহা আসান!”

আড়চোখে দেখছিলুম, বাঁপাশে–রাস্তার ধারে একটা বাড়ির মাথায় সাইনবোর্ডে লেখা আছে : ‘চোপরা অ্যান্ড কোং।’ অফিস এখন বন্ধ। দোতলার ঘরগুলোতে আলো জ্বলছে।

পীরবাবার ধূপদানির তলাকার বাটিটা পয়সার ভরে গেল। তারপর ভিড় ক্রমশ কমে গেল। মনে হল, খুব সকাল সকাল এখানকার লোকেরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। একদল লোক আবার প্রার্থনার জন্য মসজিদে ঢুকল এবং কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে গেল। পীরবাবা আর তার চেলা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। আর কেউ আশীর্বাদ নিতে আসছে না। রাত আটটা বাজে। মসজিদের ভেতর ঘড়ির বাজনা শুনে বুঝলুম সেটা।

এবার কোত্থেকে দুটো রাস্তার কুকুর এসে আমাদের বেজায় ধমকাতে শুরু করল। কিছুতেই তাড়ানো গেল না তাদের। তখন হঠাৎ পীরবাবা গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন, “বেটা! বাঁটুলঠো নিকালো! মার দো দোনো কুত্তাকো!”

আমি অবাক হয়ে তাকাচ্ছি। পীরবাবা ফের জোরগলায় ধমক দিলেন, “কঁহা তেরা বাঁটুল? হাম তুমকো যো বাঁটুল দিয়া, কঁহা রাখা তুম? দেখো আভি ছুঁড়কে।”

তারপর কুকুর দুটোর দিকে ঘুরে চেঁচালেন আগের মতো হিন্দিভাষায়–”যে-সে বাঁটুল নয়, পাঁচ-পাঁচশো গ্রাম ওজন। মারলে তোদের মাথা ফুটো হয়ে যাবে জানিস ব্যাটারা?”

কুকুর দুটো কী বুঝল কে জানে, হয়ত মুঠো নাড়া দেখেই কেটে পড়ল লেজ গুটিয়ে। তারপর দেখি চোপরা অ্যান্ড কোং-এর পাশের গলি থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। সে হনহন করে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। পরনে প্যান্টশার্ট, ফর্সা, মোটাসোটা গড়ন। নাকটা মোটা। সে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “সেলাম পীর বাবা।”

পীরবাবা চামর তুলে মিঠে গলায় বললেন, “এস বেটা! মুশকিল আসান করে দিই!”

লোকটা নিচের সিঁড়িতে ধপাস করে বসে পড়ল।

“বেটা তোমার নাম কী?”

“জী পীরবাবা, আমার নাম ভোমরলাল চোপরা। সামান্য ব্যবসাদার।”

আমি চমকে উঠলুম। তারপর সামলে নিয়ে বিড়বিড় করার ভঙ্গিতে ঠোঁট কাঁপাতে থাকলুম। কর্নেল একটু হেসে বললেন, “কী মুশকিলে পড়েছ, বলো তো বেটা ভোমরলাল?”

ভোমরলাল এদিক-ওদিক তাকিয়ে চাপাগলায় বলল, “পীরবাবা আমার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলুম, আপনি কত লোকের মুশকিল আসান করছেন। তাই আপনার কাছে এলুম। বাবা, আমি বড্ড মুশকিলে পড়েছি। কিন্তু এখানে রাস্তার ধারে সে সব কথা খুলে বলা যাবে না। দয়া করে যদি

আমার ঘরে পায়ের ধুলো দেন, ভাল হয়।”

পীরবাবা উঠে দাঁড়ালেন। “ঠিক হ্যায় বেটা! চলো।”

আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। ধূর্ত চোপরা নিশ্চয় ঘরের ভেতর উজ্জ্বল আলোয় আমাদের ছদ্মবেশ ধরে ফেলবে। কর্নেল কাজ ঠিক করছেন না। কিন্তু কর্নেল দেখলুম, দিব্যি হেঁটে চলেছেন ওর পেছনে।

পাশের সরু গলিতে ঢুকে একটা দরজা। তারপর সিঁড়ি। ওপরে গিয়ে একটা ঘরে আমাদের বসাল চোপরা। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।

পীরবেশী কর্নেল মিষ্টি হেসে বললেন, “এবার বলো বেটা কী মুশকিলে পড়েছ?”

অমনি প্যান্টের পকেট থেকে পিস্তল বের করে বলল, “টু শব্দ করলে মরবে। কৈ বাঁটুলটা বের কর। চটপট। নইলে খুলি উড়িয়ে দেব দুজনের!”

.

শিম্পাঞ্জির কবলে

হকচকিয়ে গিয়েছিলুম চোপরার কাণ্ড দেখে। লোকটা দেখছি, সত্যি খুনে প্রকৃতির। ইচ্ছে করল, এই ফুট আড়াই লম্বা ও ভারি লোহার চিমটেটা নিয়ে ওর পিস্তলধরা হাতটাকে গুঁড়িয়ে দিই। কিন্তু কর্নেল ততক্ষণে মুখে প্রচণ্ড ভয় ফুটিয়ে ধুপ করে বসে পড়েছেন তারপর হাউমাউ করে বললেন, “দিচ্ছি বাবা, আগে তোমার এই সাংঘাতিক জিনিসটা সরাও!”

বলে আমার দিকে ঘুরলেন। “ব্যাটা! তুম ভি বৈঠ যাও।” তখন আমিও করুণ এবং ভীত মুখ করে ওঁর ভঙ্গিতে হাটু দুমড়ে আসন করে বসলুম।

চোপরার একহাতে পিস্তল, অন্য হাতটা বাড়িয়ে আছে। কর্নেল তার আলখেল্লার ভেতর থেকে সত্যি একটা বাঁটুল বের করলেন। ঠিক যেমনটি বেণীমাধব ওঁকে রাখতে দিয়েছেন, তেমনটি। উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবলুম, বেণীমাধবের বাঁটুলটাই কি শয়তান চোপরাকে দিয়ে দিচ্ছে কর্নেল?

চোপরা খপ করে বাঁটুলটা কেড়ে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এবং নেড়েচেড়ে দেখল। গায়ের ওপরকার খোদাই করা নকশা ও লেখাজোখাও দেখল। দেখে বলল, “এই ব্যাটা ফকির! কোথায় পেলি এ জিনিস?”

কর্নেল বললেন, “নাগপাদের বস্তির কাছে একটা পাহাড়ী গুহায় কুড়িয়ে পেয়েছি বাবা!”

“ওখানে মরতে গিয়েছিলি কেন?”

“ওটাই যে আমার ডেরা বাবা!” কর্নেল মিষ্টি হেসে বললেন। তারপর চোখদুটো ধুরন্ধর লোকের মতো একটু টিপে চাপা গলায় ফের বললেন “মাসখানেক আগে তোমার মতো এক বড়া আদমিকে এমনি একটা জিনিস দিয়েছিলুম। কিন্তু সে তোমার মতো পিস্তল বের করেনি। তাকে খুশি হয়ে দিয়েছিলুম। জিনিসটা খুব পয়মন্ত। ঘরে থাকলে মুশকিল আসান হয়। তারপরে…”

চোপরার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, “আর কাউকে দিয়েছিস নাকি?”

কর্নেল বললেন, “আহা, বলতে দাও সেকথা। পয়মন্ত জিনিসটা পেয়ে লোকটার কপাল ফিরে গিয়েছিল। কিছুদিন পরে এসে বলল, জিনিসটা হারিয়ে ফেলেছে। আর একটা যদি দিই, তার খুব উপকার হয়।”

“তুই আবার দিলি তাকে?”

“হ্যাঁ বাবা। গুহার ভেতর খুঁজলেই এ জিনিস পাওয়া যায়।”

চোপরা পিস্তল পকেটে ভরে বলল, “নাগপারা তোকে থাকতে দেয় ওদের এলাকায়? শুনেছি ওরা খুব দুর্ধর্ষ প্রকৃতির মানুষ। বাইরের লোককে ওদের এলাকায় যেতেই দেয় না!”

কর্নেল হাসলেন। “ব্যাটা আমি খোদার ফকির। পীর মুশকিল আসানের চেলা। আমাকে নাগপারা কিছু বলে না।”

চোপরা বাঁটুলটা আবার ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, “এই ব্যাটা ফকির! জিনিসটার জন্য তোকে দুটো টাকা দিচ্ছি। আর শোন, এ জিনিস আমার আরও চাই। তোকে আরও টাকা দেব। তোর ডেরায় আমাকে নিয়ে চল।

কর্নেল আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে বললেন, “সর্বনাশ! নাগপারা যদি টের পায়, তাহলে আমাকে আর আমার চেলাকে তো বটেই, তোমাকেও মেরে ফেলবে। বাবা, একটু ধৈর্য ধরো। আমি কাল সকালে তোমাকে আরও কয়েকটা এনে দেব। ভেব না!”

চোপরা ক্রুর চাহনিতে একবার কর্নেলের দিকে, আরেকবার আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “উঁহু! আজ রাতেই চাই। নে–ওই শিগগির।”

কর্নেল আরও আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে বললেন, “কথা শোনো বাবা! নাগপা বস্তিতে সাংঘাতিক একপাল কুকুর আছে। তারা রাত জেগে পাহারা দেয়। আমাদের দুজনকে তারা কিছু বলবে না। কিন্তু তোমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারব না।”

চোপরা ফের পিস্তল বের করে বলল, “তবে রে ব্যাটা ফকির। আমার সঙ্গে চালাকি হচ্ছে? নাগপা-বস্তি কোথায় আমি জানি না বুঝি? ওরা থাকে উপত্যকার সমতলে। পাহাড়-টাহাড় ওদের বস্তি থেকে খানিকটা দূরে। বস্তি দিয়ে গেলে তবে তো ওদের কুকুরের পাল্লায় পড়ব। আমরা ঘুরপথে যাব। ওঠ শিগগির।”

আমি মনে মনে ঘাবড়ে গেলুম। কর্নেলের মুখটাও গম্ভীর দেখলুম। চোপরা পিস্তলটা ওঁর পাগড়িতেই ঠকাতেই উনি “ওরে বাবা! যাচ্ছি, যাচ্ছি!” বলে উঠে দাঁড়ালেন।

ধুরন্ধর চোপরা হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে বলল, “এই ব্যাটা ফকিরের চেলা, তুই এখানে থাক। ফকিরবুড়ো যদি আমাকেও কোথাও বেমক্কা ফেলে কেটে পড়ে! তুই জামিন রইলি। গুহাটা দেখে এসে তবে তোকে ছেড়ে দেব। আর ফকিরবুড়ো যদি আমাকে ঠকায়, তাহলে তোর পরিণাম কী হবে আগে দেখে রা। এ বুড়োও দেখে যাক্। তাহলে আমাকে ঠকাবে না।”

বলে সে শিস দিল তিনবার। অমনি অন্যপাশের একটা দরজা ঠেলে যে বেরিয়ে এল, তাকে দেখে প্রচণ্ড চমকে উঠলুম। গোয়েন্দাপ্রবর তাহলে ঠিকই আঁচ করেছিলেন।

কালো বীভৎস চেহারার একটা শিম্পাঞ্জি ঘরে ঢুকল। কুতকুতে চোখে আমাদের দেখতে দেখতে বিকট ভঙ্গিতে হাসবার মতো দাঁত বের করল। চোপরা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “জান্ডু। তুই এই ব্যাটাকে পাহারা দিবি। পালানোর চেষ্টা করলেই ওকে নিকেশ করে ফেলবি।” বলে চোপরা হাত দিয়ে গলা টেপার ইশারা করল।

হতচ্ছাড়া শিম্পাঞ্জিটা আবার দাঁত বের করল আমার দিকে তাকিয়ে। কর্নেলের পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে চোপরা তাকে বাইরের দরজা দিয়ে নিয়ে গেল। তরপর দরজা বন্ধ করল। বুঝতে পারলুম, দরজায় তালা দিচ্ছে সে।

আমি শিম্পাঞ্জির দিকে তাকিয়ে রইলুম! ভয়ে বুকে টিপটিপ করছে। আমার গায়ের কালো আলখেল্লার ভেতর রিভলবার লুকিয়ে রেখেছি। কিন্তু জন্তুটাকে গুলি করলে চোপরার লোকেরা টের পেয়ে যাবে। তাছাড়া বাইরে যাবার পথ বন্ধ। একা তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারব না। ওর লোকেদের কাছেও যে আগ্নেয়াস্ত্র নেই, কে বলতে পারে?

শিম্পাঞ্জিটা হেলে-দুলে গদাইলস্করী চালে আমার দিকে এগিয়ে এল। তারপর দাঁত দেখিয়ে ধমক দেবার ভঙ্গিতে বাঁদুরে ভাষায় কী যেন বলল। আমি ভয়ে-ভয়ে ওর সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করলুম। বললুম, “ওহে জাম্বু! এস, এস। তোমার সঙ্গে আলাপ করা যাক্।”

অমনি ভেতরের দরজায় একটা হোঁকামোটা চীনাদের মতো চেহারার লোক উঁকি মেরে ধমক দিয়ে বলল, “চু। বাঁচিত করলে জাম্বু থাপ্পড় মারবে। চুপচুপ বসে থাক্।”

লোকটার হাতে দেখছি একটা লম্বাটে সেকেলে পিস্তল! সে আবার দরজার পর্দার আড়ালে চলে গেল। বুঝলুম, আমার সত্যিই টু শব্দ করা চলবে না।

ঘরটা বেশ বড়ো। মেঝে কাশ্মীরী কার্পেটে ঢাকা। বাড়িটা কাঠের মনে হল। মেঝেও কাঠের। তাই জাম্বু নড়াচড়া করলেই মচমচ শব্দ হচ্ছে। সে আমাকে কিছুক্ষণ ধমক দিয়ে মেঝেয় গড়াগড়ি খেল। তারপর সোফায় চিত হয়ে শুয়ে মানুষের মতো ঠ্যাং নাচাতে থাকল। কিন্তু আমি একটু নড়লেই সে চমকে উঠছিল এবং দাঁত বের করে ধমক দিচ্ছিল। কখনও জিভ বের করে ভেংচি কাটছিল। রাগে আমি অস্থির। কিন্তু কিছু করার নেই। এদিকে কর্নেলের জন্যও ভীষণ ভাবনায় পড়েছি। চোপরা অসম্ভব ধূর্ত লোক বটে। নাগপা বস্তিটা কোথায় কর্নেল সঠিক জানেন না। কোন্ পাহাড়ে গুহা আছে, তাও জানেন না। গুহা যে থাকবেই তারও মানে নেই। কর্নেল কেন যে ছাই ওসব বলতে গেলেন তাকে! হয়তো এবার নিজের প্রাণটিও খোয়াবেন বেঘোরে–আমার প্রাণটিও যাবে শেষ পর্যন্ত।

শিম্পাঞ্জিটা চিত হয়ে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে মুখ কাত করে আমাকে দেখে নিয়ে জিভ বের করে ভেংচি কাটছে। তারপর দাঁত বের করে অদ্ভুত কিচমিচ শব্দে যেন হাসছে। আমার আর সহ্য হল না। ফের সে জিভ বের করে ভেংচি কাটলে আমিও জিভ দেখিয়ে ভেংচি কাটলুম।

তখন সে তড়াক করে উঠে বসল। তারপর হেলে-দুলে এগিয়ে এল। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল আমার। মরিয়া হয়ে আলখেল্লার ভেতর হাত ভরে রিভলভার বের করব ভাবছি, সে লম্বাটে হাত বাড়িয়ে আমার দুটো কান মুলে দিল। রাগে-দুঃখে আমি গর্জে উঠলুম, “তবে রে হতচ্ছাড়া!” সেই সময় দরজার পা তুলে সেই লোকটা ধমক দিল, “ফের চাঁচাচ্ছিস?”

বললুম, “জাম্বু আমার কান মুলে দিচ্ছে দেখছ না?”

লোকটা হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসল। “বেশ করেছে! তুই নড়াচড়া করছিস কেন?”

কানদুটো জ্বালা করছিল। রক্ত বেরুচ্ছে কি না কে জানে! পাগড়ির দুপাশ টেনে কানদুটো ঢেকে ফেললুম। জাম্বু এবার আমার সামনেই মেঝেতে চিত হয়ে শুল। এবং চার হাত-পা তুলে স্থির হয়ে রইল। লোকটা আবার আড়ালে চলে গেল।

সময় কাটছে না। কর্নেলের সঙ্গে এতকাল কত সাংঘাতিক অ্যাডভেঞ্চারে গেছি, কিন্তু এমন বিপদে কখনও পড়িনি। কর্নেলের বার্ধক্যজনিত বুদ্ধি বিভ্রম ছাড়া একে কী বলব? কেন যে যেচে এমন করে বাঘের মুখে গলা বাড়িয়ে দিতে এলেন!

শিম্পাঞ্জিটা সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে–চোখ বুজে হাত-পা তেমনি ওপরে তুলে রেখেছে। ঘুমোচ্ছে বদমাস খুনে বাঁদরটা! হঠাৎ দরজাটা প্রায় নিঃশব্দে খুলে গেল এবং কর্নেলকে দেখতে পেলুম। সেই পীরবাবার পোশাকটা পরনে। পাগড়ি নেই মাথায়। স্বপ্ন নয় তো?

স্বপ্ন নয়–ব্যাপারটা সত্যি ঘটছে। কর্নেল দরজা খুলেই ইশারা করলেন বেরিয়ে যেতে। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালুম। কিন্তু পা বাড়াতেই মেঝেয় শব্দ হল এবং শিম্পাঞ্জিটা চোখ খুলল। তখন একলাফে দরজার দিকে গেলুম। জন্তুটা লাফিয়ে উঠল। ভেতরের দরজার পর্দা তুলে নোকটাও উঁকি মারল। কিন্তু কর্নেল দড়াম করে দরজা আটকে ঝটপট তালা এঁটে দিলেন। ইন্টারলকিং সিস্টেমের দরজা আটকে গেল। তারপর দুজনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলুম। তারপর আরেকটা দরজা পেরিয়ে গলিতে-গলি থেকে রাস্তায়।…

.

ওল্টি ও হিস্টোফান

হোটেলে আমাদের ঘরে ঢুকে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, চোপরা এখনও পাহাড়ের চাতালে পড়ে রয়েছে। শীতটা সে এতক্ষণে হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে। যেটুকু গরম পড়ে, সন্ধ্যার পর থেকে তা চাপা দিতে ঠাণ্ডা হিম সাংঘাতিক একটা হাওয়া আসে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে। রাত যত বাড়ে, ঠাণ্ডার দাপটও তত বাড়ে। আশা করি সেটা টের পেয়েছ, ডার্লিং!”

বললুম, “ততটা পাইনি আলখেল্লার দৌলতে। কিন্তু চোপরাকে বেকায়দায় ফেললেন কীভাবে?”

“ওকে নিয়ে এই হোটেলের পাশ দিয়ে গেছি। ঢাল বেয়ে নেমে বাঁদিকে একটা পাহাড়ের চাতালে উঠেছি। তারপর আচমকা ধূপদানিটা ওর পিস্তলধরা হাতের ওপর প্রচণ্ড জোরে মেরেছি। পিস্তলটা খাদে গিয়ে পড়েছে। তখন ওকে জাপটে ধরে কুপোকাত করতে দেরি হয়নি। পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলেছি পাগড়ি দিয়ে। পাগড়িটা এত কাজে লাগবে ভাবতে পারিনি। দশহাত লম্বা পাগড়ি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে রেখে ওর পকেট থেকে চাবি নিয়ে দৌড়ে গেছি। যাক গে, তুমি আলখেল্লাটা ছেড়ে ফেলল। রাত দশটা বাজে প্রায়।”

আলখেল্লা ছেড়ে রাতের পোশাক পরে বললুম, “সেই বাঁটুলটার কী হল?”

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, “ওটা তো নকল বাঁটুল। মসজিদের সিঁড়িতে বসে থাকার সময় দুটো কুকুর এসে পড়ায় আমার বুদ্ধি খুলে গিয়েছিল। নইলে আমার উদ্দেশ্য ছিল, সারারাত ওখানে থেকে চোপরার অফিসের দিক লক্ষ্য রাখা। আর কথা নয়। ঘুমনো যাক।”

বিছানায় শুয়ে আলো নিভিয়ে বললুম, “তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ওইসব বাঁটুল একটা-দুটো নয়–আরও থাকতে পারে। গ্রিক দেহরক্ষীদের কাছেও নিছক অস্ত্র হিসেবে ওগুলো কি ছিল না? সম্রাটের বাঁটুল কিংবা তাঁর বাবা ফিলিপের বাঁটুল অ্যাস্টিডোনা করেছিল।”

কর্নেল ঘুম জড়ানো গলায় পাশের বিছানা থেকে বললেন, “ফিলিপের বাঁটুলে চোপরা কোনো হিরে পায়নি। সে ওর কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি। সারাপথ ওর সঙ্গে কথা বলে এর আভাস পেয়েছি। চোপরার বিশ্বাস, সব বাঁটুলে হিরে লুকোনো থাকতে নাও পারে। কিন্তু কিছু বাঁটুলে যে থাকবেই, তা নিশ্চিত।”

“হিরের কথা বলেছিল নাকি চোপরা?”

“হিরের কথাটা বলেনি। বলছিল, কিছু বাঁটুল খুব পয়মন্ত তা সে জানে। আবার কিছু বাঁটুল অপয়া, তাও সে জানে। যাক এসব কথা। ঘুমোও।”

বেশ শীত করছিল। কম্বল মুড়ি দিতে হল। বেশ আরামে ঘুমোনো গেল সারারাত। সকালে উঠে দেখি, কর্নেল বিছানায় নেই। ব্যালকনিতে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কফি খেলুম। তারপর কর্নেল ফিরলেন। বুঝলুম, অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। গলা থেকে বাইনোকুলার ঝুলছে। লাডাকের পাখি প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে বেরিয়েছেন সম্ভবত।

একটু হেসে বললেন, “সেই চাতালটা লক্ষ্য করেছি দূর থেকে। বাইনোকুলার দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। চোপরা নেই। আমার পাগড়িটা টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। ওর কাছে ছোরাও ছিল বোঝা গেল। তবে ডার্লিং, সেখানে এক মজার দৃশ্য দেখতে পেলুম। দুটো পাহাড়ী ছাগল জাতীয় প্রাণী পাগড়ির টুকরোগুলো মহানন্দে চিবুচ্ছে।”

ব্রিগেডিয়ার অর্জুন সিং এলেন।

কর্নেল বললেন, “ব্যস্ত হবেন না ব্রিগেডিয়ার সিং। কলকাতা থেকে আজ বেণীমাধব এসে পড়ার কথা। ওঁকে দিয়েই ফাঁদে ফেলব চোপরাকে। বৈজুনাথকে যে সে শিম্পাঞ্জি দিয়ে খুন করিয়েছে, সেটা প্রমাণ করা চাই আইনের চোখে। নইলে চোপরাকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করবেন না।”

অর্জুন সিং বললেন, “হ্যাঁ–সেও একটা কথা। তবে পুলিশকে আগেভাগে জানানো উচিত।”

কর্নেল বললেন, “পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দাপুলিশের অফিসাররা ইতিমধ্যে শ্রীনগরে পৌঁছে গেছেন। সেখান থেকে ওঁরা লেহ এসে পৌঁছবেন যেকোনো সময়ে। কাশ্মীরের গোয়েন্দাপুলিশ অনুমতি না দিলে ওঁরা তো চোপরাকে গ্রেফতার করতে পারবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি কলকাতা থেকে।”

অর্জুন সিং হেসে বললেন, “আঁটঘাট না বেঁধে আপনি কাজে নামেন না দেখছি।”

উত্তেজনায় অস্থির হয়ে রইলুম। আমার বেশি রাগ শিম্পাঞ্জিটার ওপর। পাজি বাঁদরটা আমার কান দুটো মুলে ব্যথা করে ফেলেছে। বাঁদরের হাতে কানমলা খাওয়ার চেয়ে অপমানজনক আর কিছু নেই।

বিকেলে বেণীমাধববাবু এসে পৌঁছলেন। পথে বাস খারাপ হয়েছিল, তাই খুব ভুগেছেন। ওঁর জন্য পাশের ঘর বুক করা ছিল। আমরা কথাবার্তা বলছি, সেই সময় এলেন পশ্চিমবঙ্গ গোয়েন্দাপুলিশের এক বড়কর্তা প্রণব রুদ্র। ওঁর সঙ্গে আমার চেনাজানা অনেকদিনের। পর্যটক সেজে এসেছেন দলবল নিয়ে। উঠেছেন অন্য একটা হোটেলে।

প্রণববাবু আর কর্নেল চাপা গলায় কথা বলতে থাকলেন। আমি আর বেণীমাধব ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। দৃশ্য দেখার জন্য আমি একটা ভিউফাইন্ডার নিয়ে গেছি। সেটা চোখে রেখে কথা বলছি বেণীমাধবের সঙ্গে এবং মাঝে মাঝে বেণীমাধবও আমার ভিউফাইন্ডারটা নিয়ে দৃশ্য দেখছেন। তারিফ করছেন।

হঠাৎ উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “জয়ন্তবাবু! দেখুন তো ওই পাহাড়ের রাস্তায় ওটা কী?”

ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে দেখি, খানিকটা দুরে সোনালী রঙের পাহাড়ের গায়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায় চোপরার সেই শিম্পাঞ্জিটা হেলে-দুলে চলেছে এবং তার পেছন-পেছন যাচ্ছে একটা লোক। তাকে চিনতে পারলুম না। লোকটার পরনে মাদারির পোশাক। মাথায় পাগড়ি, হাতে একটা ডুগডুগি রয়েছে। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না।

একটু পরে তারা নিচে নামতে থাকল। সমতলে নেমে গেলে আর তাদের দেখতে পেলুম না। সামনে আরেকটা পাহাড়ের আড়াল রয়েছে। কর্নেলকে তক্ষুণি ডেকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলুম।

কর্নেল বললেন, “ওদিকেই নাগপা বস্তি আছে শুনেছি। চোপরার উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। যাইহোক, বেণীমাধববাবু, আপনি আর দেরি করবেন না। চোপরার অফিসে চলে যান।”

বেণীমাধব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনাকে দেখে চোপরা নিশ্চয় অবাক হবে। আপনি বলবেন, এতকাল বৈজুনাথের সঙ্গে কারবার করেছেন। বৈজুনাথই বলেছিল, নাগপা বস্তির ওদিকে একটা পাহাড়ের গুহায় বাঁটুল কুড়িয়ে পেয়েছে। এখন বৈজুনাথ নেই। তাই আপনি চোপরার সাহায্য চাইছেন। কাজেই আরও বাঁটুল উদ্ধার করতে পারলে দুজনে আধাআধি ভাগ করে নেবেন।”

বেণীমাধব চিন্তিতমুখে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল ও প্রণব রুদ্র বেরুলেন তার মিনিট দশেক পরে। কর্নেল আমাকে হোটেলেই থাকতে বলে গেলেন।

চুপচাপ একা বসে থাকতে খারাপ লাগছিল। বিকেলের ঝলমলে রোদে বাইরের অপূর্ব দৃশ্য। এভাবে কাহাতক বসে থাকা যায়? কর্নেলের নির্দেশ মানতে ইচ্ছে করছিল না। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে পড়লুম।

হোটেলের নিচের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতেই ডানদিকের উপত্যকায় একটা বস্তি চোখে পড়ল। ওটাই কি নাগপা বস্তি? পাহাড়ের ঢালে সবুজ ঘাসে একজন গুজ্জর রাখাল ভেড়া চরাচ্ছিল। তাকে হিন্দিতে জিগ্যেস করতে সে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, ওটাই নাগপা বস্তি।

মাথায় কী খেয়াল চাপল সোজা ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলুম। নিচের উপত্যকায় পৌঁছে কিছুদূর এগিয়ে একটি খাল দেখতে পেলুম। স্বচ্ছ জল বেয়ে যাচ্ছে। খালের ধারে উইলো আর পপলার গাছের জঙ্গল। খালের বুকে অজস্র পাথর। পা রেখে-রেখে সাবধানে ওপারে চলে গেলুম। জঙ্গলের পর ফাঁকা ঘাসের জমিতে যেই গেছি, একটা সাদা কুকুর দৌড়ে এল। শিস দিতেই সে থেমে গেল। তার কাছে এগোব কি না ভাবছি, একটি কমবয়সী মেয়ে-মাথায় স্কার্ফ জড়ানো, পরনে সুন্দর রঙীন ঘাগরা, একটা প্রকাণ্ড পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। অপূর্ব সুন্দর চেহারা মেয়েটির। ফর্সা রঙ। বড়জোর বছর দশেক বয়স।

কুকুরটা ছুটে গিয়ে তার কোলে উঠল। আমি একটু হেসে হিন্দিতো বললুম”তোমার নাম কী?”

মেয়েটি হাসল একটু। কিন্তু কিছু বলল না।

পকেট হাতড়ে ভাগ্যিস কয়েকটা চকোলেট পেয়ে গেলুম। কাল আসার পথে কিনেছিলুম শোনমার্গে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল বারবার। কাঁহাতক জল খাওয়া যায়? তাই চকোলেট চুষছিলাম কর্নেলের পরামর্শে। এখন চকোলেটগুলো কাজে লাগল।

মেয়েটি দ্বিধা না করে সেগুলো নিলো। কুকুরটার মুখেও খুঁজে দিল একটা। তারপর ভাঙা-ভাঙা হিন্দি বলল, “তুমি কি এখানে বেড়াতে এসেছ? কোথায় থাকো তুমি?”

বললুম, “আমি কলকাতা থেকে আসছি। খুব সুন্দর তোমাদের দেশ।”

মেয়েটি মাথা দুলিয়ে বলল, “আমার বাবা বলে কলকাতা আরও সুন্দর দেশ।”

“তাই বুঝি? নাম কী তোমার?”

“ওণ্টি।”

“ওণ্টি? বাঃ, বেশ সুন্দর নাম তো তোমার।”

ওণ্টির সঙ্গে কথা বলছি, সেই সময় ওদিকে কোথায় ডুগডুগির শব্দ শোনা গেল। ওণ্টির কানে গেলে সে চঞ্চল হয়ে উঠল। বলল, “মাদারি খেলা দেখাতে এসেছে। আমি খেলা দেখব।”

সে কোল থেকে কুকুরটাকে নামিয়ে দিল। কুকুরটা কিন্তু চাপা গরগর শব্দ করে ওণ্টির দুপায়ের ফাঁকের ঢুকে পড়ল। ওণ্টি না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছিলুম, কুকুরটা তার সহজাত বোধে টের পেয়েছে যে কাছাকাছি একটা বিপজ্জনক জন্তু এসেছে। বললুম, “ওণ্টি, চলো! তোমার সঙ্গে মাদারির খেলা দেখব।”

গাছপালার ফাঁকে পাথরের এবড়োখেবড়ো ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। নাগপারা গরিব মানুষ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওন্টির পেছন-পেছন ঘরগুলোর কাছে যেতেই একটা লোক বেরিয়ে এল। সে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। ওণ্টি তাকে দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলল। তখন সে হাসিমুখে আমাকে ‘নমস্তে’ করল।

ওণ্টির কুকুরটা এগোতে চাইছিল না। ওণ্টি অগত্যা তাকে কোলে তুলে নিল আবার। লোকটা ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বলল, “আপনি কলকাতার নোক শুনে খুশি হলুম স্যার! আমার বড় ইচ্ছে করে কলকাতা যাই। কিন্তু পয়সাকড়ি পাব কোথায় অত?”

ঝটপট ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললুম। লোকটা ওণ্টির বাবা। তার নাম হিস্টোফোন। এ নাম যে গ্রিক ভাষার অপভ্রংশ, তাতে ভুল নেই। বংশপরম্পরা প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে এই নাগপারা গ্রিক ভাষার একটা অপভ্রংশ উপভাষা ব্যবহার করে আসছে। হিস্টোফোন সামান্য লেখাপড়া জানে। তাকে কলকাতা নিয়ে যাব বলায় সে খুশি হয়ে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। ততক্ষণে ওণ্টি মাদারির খেলা দেখতে উধাও হয়েছে।

ঠাসাঠাসি পাথরের বাড়ি নিয়ে বস্তিটা দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ এবং আকারে ছোট। একটা ইঁদারার কাছে ফাঁকা জায়গায় মাদারি খেলা দেখাচ্ছে। ভিড় করে লোকেরা দেখছে। বস্তির অসংখ্য কুকুর নিরাপদে তফাতে দাঁড়িয়ে বেদম গালাগালি করছে শিম্পাঞ্জিটাকে।

হিস্টোফোন বলল, “মাদারিররা ভালুক বা বাঁদর নিয়ে খেলা দেখাতে আসে। তবে এই মাদারিটাকে এর আগে দেখিনি। ওর ওই জন্তুটা কী বলুন তো স্যার?”

“ওটা একটা শিম্পাঞ্জি।”

হিস্টোফোন অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “ওটা দেখতে বড্ড কুচ্ছিত। ওর স্বভাবও নিশ্চয় ভাল নয়।”

“তা তো নয়ই। শিম্পাঞ্জি বিপজ্জনক জন্তু।”

হিস্টোফোন তারিফ করে বলল, “তবু কেমন বশ মানিয়েছে দেখুন!”

একটু পরে সে আমাকে এককাপ কড়া চা এনে দিল। চা খেতে খেতে দেখলুম, খেলা শেষ করে ‘মাদারি’ শিম্পাঞ্জিটাকে নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। ভয় হল, শিম্পাঞ্জিটা আমাকে চিনতে পারবে না তো?

কিন্তু ওদের ঘিরে নিয়ে আসছে নাগপাদের নানা বয়সী মানুষের ভিড়। আমাকে মাদারি বা জাম্বু কেউই দেখতে পেল না ভিড়ের ভেতর থেকে। ওরা এগিয়ে গিয়ে একটা বাড়ির সামনে থামল। সেই সময় ওণ্টি ফিরে এসে তার বাবাকে কী বলল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। হিস্টোফোন বলল, “মাদারি আর জাভুটা আজ রাতে সোলোন নামে একজনের বাড়িতে থাকবে। সোলোন ওকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গেল।

জিগ্যেস করলাম, “সোলোন কে?”

“আমাদের সর্দারের ছেলে। এ বস্তিতে একমাত্র সোলোনই আপনাদের কলকাতা গিয়েছিল। আপনি কিন্তু আমাকে কলকাতা নিয়ে যাবেন স্যার?”

তাকে আশ্বাস দিয়ে বললুম, “তাহলে উঠি হিস্টোফোন।”

আসার সময় ওণ্টিকে একটু আদর করে এলুম। ওর বাবা হিস্টোফোন আমাকে সেই খাল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এল। তারপর চাপা গলায় বলল, “আপনি যদি আমাকে কলকাতা দেখাতে নিয়ে যান, তাহলে আপনাকে একটা সুন্দর জিনিস উপহার দেব। জিনিসটা ওণ্টি কুড়িয়ে পেয়েছিল।”

“জিনিসটা কী হিস্টোফোন?”

“একটা লোহার বল। বলটার গায়ে ছবি আঁকা আছে।”

হিস্টোফোন এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বলল, “এ জিনিসের দাম আছে স্যার! একমাস আগে কলকাতার একটা লোক এসেছিল বস্তিতে। সে আমাদের সর্দারকে বলেছিল, লোহার বল কিনতে এসেছে। সর্দার খুব রেগে গিয়েছিল। এসব লোহার বল নাকি দেবতাদের খেলার জিনিস। বস্তির অনেকে কুড়িয়ে পেয়ে ঘরে তুলে রেখেছে। কেউ প্রাণ গেলেও বেচবে না। কারণ, এ বল তো মানুষ তৈরি করেনি। দেবতারা সেকালে তৈরি করেছিলেন খেলবেন বলে। খেলা হয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলেছেন। তো স্যার, সর্দার কলকাতার লোকটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বস্তি থেকে ।”

কান খাড়া করে শুনছিলুম। খুব চমকে উঠেছিলুম ওর কথা শুনে। “বললুম, সেই লোকটা কেমন করে জানল লোহার বলের কথা?”

হিস্টোফোন আরও গলা চেপে বলল, “আমার কলকাতা দেখার খুব ইচ্ছে বলেই বলছি আপনাকে। যেন আর কেউ না জানতে পারে স্যার।”

“জানতে পারবে না। বললো হিস্টোফোন!”

“আমার খুড রাস্টোফানই এর মূলে। খুড়ো শহরের একটা হোটেলে কাজ করে। সেই লোকটার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল। তাকে সঙ্গে করে একদিন বস্তিতে নিয়ে এসেছিল খুড়ো। ঘরের তাকে একটা এরকম লোহার বল রাখা ছিল। সেটা দেখে লোকটা আগ্রহ প্রকাশ করল। খুড়ো বলল, এটা দেবতাদের খেলার জিনিস। আপনি আমার অতিথি। ভাল লাগে তো নিন। তবে সর্দার জানলে রাগ করবে!”

উত্তেজনায় অস্থির হয়ে বললুম, “হিস্টোফোন জিনিসটা একবার দেখাবে আমাকে?”

হিস্টোফোন হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। বেলা পড়ে এসেছে। শিগগির অন্ধকার হয়ে যাবে। খালের ধারে একটা পাথরের ওপর বসে হিস্টোফোনের প্রতীক্ষা করতে থাকলুম। মিনিট পাঁচেক পরে সে ফিরে এল। জামার পকেট থেকে জিনিসটা বের করে বলল, “এই দেখুন স্যার!”

সেই গ্রিক বাঁটুল। একই রকম হিজিবিজি লেখা আর নকশা আঁকা। হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে বললুম, “তোমাকে আমি কিছু টাকা দিচ্ছি হিস্টোফোন! জিনিসটা আমাকে দাও।”

অমনি হিস্টোফোন বাঁটুলটা খপ করে কেড়ে নিল আমার হাত থেকে। গম্ভীর মুখে বলল, “উঁহু! আগে কলকাতা নিয়ে যাবেন। তারপর দেব!”

বুঝলুম, নাগপারা যতই ভদ্র হোক–গোঁয়ার-গোবিন্দ কম নয়। হাসতে হাসতে বললুম, ঠিক আছে। তাই দিও। শোন, আমি থাকি সানি লজ হোটেলে। ওই যে দেখছ, পাহাড়ের গায়ে লাল, নীল আলোয় হোটেলের নাম লেখা। তুমি কাল সকালেই যেও বরং। গিয়ে বলো, জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করব।”

হিস্টোফোন আমার নামটা বিড়বিড় করে মুখস্থ করে নিল। আমি সাবধানে খাল পেরিয়ে ওপারে গেলুম, হিস্টোফোন এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে চলে যাচ্ছে।

হোটেলে পৌঁছে দেখি, কর্নেল ফেরেননি। ব্যালকনিতে চুপচাপ বসে রইলুম। উত্তেজনায় মনে মনে ছটফট করছিলুম। হিস্টোফোনের বাঁটুলটার ভেতর কি হিরে আছে? যদি থাকে, হিরেটা ওকে ফেরত দেওয়া উচিত। বেচারা গরিব মানুষ। ওটা বেচলে সে বড়লোক হয়ে যাবে।

কর্নেল ফিরলেন ঘণ্টাখানেক পরে। বললেন, “কোথাও বেরোও নি তো?” বলে হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমার আপাদমস্তক দেখে মুচকি হাসলেন। “উঁহু, বেরিয়েছিলে দেখছি।”

“আপনি কি অন্তর্যামী?”

“না। তবে তোমার জুতোয় আর প্যান্টে লাল ধুলোর ছোপ দেখে বুঝেছি, বেরিয়েছিলে।”

একটু হেসে বললাম, “বসুন অনেক কথা আছে।”

.

ডাইনির গুহায়

এ রাতে কিছু ঘটেনি। সকালে বেণীমাধব এলেন ঘরে। তখন শুনলুম, চোপরা ভীষণ সতর্ক হয়ে গেছে। বেণীমাধবকে পাত্তাই দেয়নি। বলেছে, ওসব কারবারে সে নেই। ইচ্ছে করলে বেণীমাধব একা বাঁটুলের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে পারেন। বাঁটুলের ভেতর হিরে থাকার কথা চোপরা নাকি বিশ্বাস করে না।

কর্নেল বললেন, “অসাধারণ ধূর্ত লোক এই চোপরা। আমার এই ফাঁদে সে পা দিল না তাহলে!”

আমি বললুম, “তা দিল না। কিন্তু ওদিকে সে খুনে শিম্পাঞ্জি আর একটা লোককে নাগপা বস্তিতে পাঠিয়েছে যখন, তখন বোঝা যাচ্ছে–সে একটা বাঁটুল সংগ্রহ করতে চায়।”

“ঠিক তাই।” কর্নেল সায় দিয়ে চুরুট টানতে থাকলেন। চোখ বন্ধ। তারপর হঠাৎ নড়ে বসলেন। “জয়ন্ত! তোমার নাগপা বন্ধু হিস্টোফোনের তো আসার কথা এখন?”

“হ্যাঁ। কিন্তু কৈ? আটটা বেজে গেল।”

কর্নেল উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালেন। চোখে বাইনোকুলার রেখে নাগপা বস্তির দিকটা কিছুক্ষণ লক্ষ্য করলেন। তারপর বললেন, “ওদের বস্তিতে কী একটা গণ্ডগোল হচ্ছে যেন। অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।”

ব্যালকনিতে গিয়ে বললুম, “বাইনোকুলারটা দিন তো দেখি।”

কর্নেল দূরবীক্ষণ যন্ত্রটা দিলে চোখ রাখলুম। তারপর চমকে উঠলুম। হিস্টোফোন বলেই তো মনে হচ্ছে–সে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যিখানে। আর চারদিক থেকে লোকেরা হাত নেড়ে যেন শাসাচ্ছে। ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে চোখ কচলাচ্ছে ওণ্টি। তার কোলে সেই সাদা কুকুরটা।

বাইনোকুলার ফেরত দিয়ে ব্যস্তভাবে বললুম, “কী হয়েছে দেখে আসি।”

কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, “যাবে? কিন্তু …”

বেণীমাধব বললেন, “আমি বরং যাই জয়ন্তবাবুর সঙ্গে।”

কর্নেল চিন্তিতভাবে বললেন, “আচ্ছা। কিন্তু সাবধানে থাকবেন।”

আমরা দুজনে হন্তদন্ত হয়ে চললুম। রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে ঢাল বেয়ে নামলুম। ঘাসের ঢালু জমিতে সেই গুজ্জর রাখালকে ভেড়া চরাতে দেখলুম। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

খাল পেরিয়ে যাবার পর আবছা গোলমালের শব্দ এল। বস্তির পেছনে প্রকাণ্ড সব পাথর রয়েছে। তার আড়ালে গিয়ে দুজনে বসে পড়লুম। ওদের ভাষা জানি না। শুধু বুঝলুম, হিস্টোফোনকে ওরা কোনো কারণে গালাগালি করছে আর শাসাচ্ছে যেন। তা কি আমার জন্য। নাগপা বস্তিতে বাইরের লোককে এনে খাতির করেছিল বলে?

একটু পরে ওণ্টির কুকুরটা ধুপ করে কোল থেকে লাফিয়ে পড়ল। তারপর দৌড়ে আমাদের কাছে চলে এল। পেছন-পেছন দৌড়ে ওকে ধরতে এল ওণ্টি। এসেই আমাদের দেখে থমকে দাঁড়াল।

ইশারায় ওকে ডেকে জিগ্যেস করলুম, “কী হয়েছে ওণ্টি?”

ওণ্টি কান্না জড়ানো স্বরে বলল, “বাবা তোমাকে দেবতাদের বল দিয়েছে বলে বাবাকে সবাই বকছে। সর্দার বলছে, বাবার হাত-পা বেঁধে ডাইনির গুহায় ফেলে দিয়ে আসবে।”

“কিন্তু দেবতাদের বল তো তোমার বাবা আমাকে দেয়নি। ওটা ওদের দেখাচ্ছে না কেন তোমার বাবা?”

ওন্টি চোখ মুছতে মুছতে কুকুরটাকে কোলে নিল। তারপর বলল, “বলটা তো আমার। আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। রোজ বলটা নিয়ে আমি খেলতে যাই। রণির সঙ্গে খেলি যে। বাবা জানলে বকবে । তাই লুকিয়ে যাই।”

“তোমার এই কুকুরটার নাম বুঝি রণি?”

ওণ্টি মাথা নাড়ল। বলল, “আজ সকালে বলটা নিয়ে খেলছিলুম। মাদারিটা সর্দারের বাড়ির সামনে বসেছিল। ওর বাঁদরটাকে লেলিয়ে দিল আর বাঁদরটা এসে রনির কাছ থেকে কেড়ে নিল।”

খাপ্পা হয়ে বললুম, “মাদারিটা কোথায় এখন?”

“চলে গেছে।” ওণ্টি নাক মুছে বলল, “আমি সর্দারকে বললুম–কিন্তু বিশ্বাস করল না। বলল, তুই ঝুট বলছিস। তোর বাবা বলটা সেই কলকাতার লোকটাকে বেচে দিয়েছে।”

এই সময় হট্টগোলটা হঠাৎ বেড়ে গেল। পাথরের ফাঁকে উঁকি মেরে দেখলুম, লোকেরা হিস্টোফোনকে দড়িতে বাঁধছে। আর থাকতে পারলুম না। দৌড়ে ওদের সামনে হাজির হলুম আমরা। ওরা আমাদের দেখে একটু হকচকিয়ে গেল। টুলে বসে থাকা একটা লোক। সাদা চুলদাড়ি, হিংস্র চেহারা এবং তার পরনে আঁট পাতলুন আর গায়ে একটা নীলরঙের বেঢপ জ্যাকেট। সে দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচিয়ে কিছু বলল। মনে হল এদের সর্দার সে।

কিন্তু কিছু বলার আগেই লোকগুলো ঝাঁপিয়ে এসে আমাকে আর বেণীমাধবকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলল। চ্যাঁচামেচি করেও ফল হল না। এক মিনিটের মধ্যে ওরা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল। পকেটে রিভলবার থাকা সত্ত্বেও কিছু করা গেল না।

ফার, পাইন, ওকপার পপলার গাছের ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা পাহাড়ের ধারে এনে ফেলল আমাদের। তারপর চড়াই বেয়ে উঠতে শুরু করল। পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা দেখা যাচ্ছিল। গুহার মুখে ধপাস করে ফেলে দিয়ে ওরা দৌড়ে পালিয়ে গেল।

এই তাহলে ডাইনির গুহা! অজানা আতঙ্কে বুক ধড়াস করে উঠল। আমার পাশে বেণীমাধবকে উপুড় করে ফেলেছে। বেণীমাধব অনেক কষ্টে চিত হয়ে বললেন, “এ কী বিপদে পড়া গেল জয়ন্তবাবু!”

গুহার ভেতর দিকের অন্ধকার থমথম করছে। মুখ ঘুরিয়ে দেখলুম, একরাশ হাড়গোড় আর কয়েকটা মড়ার খুলি পড়ে আছে। শিউরে উঠলুম। বললুম, “সর্বনাশ! গুহার ভেতর নিশ্চয় মানুষখেকো জন্তু আছে, বেণীমাধববাবু!”

তারপর খসখস শব্দ শুনে বাঁদিকে ঘুরে, দেখি, শুধু আমরা দুজন নই–বেচারা হিস্টোফোনকেও ফেলে দিয়ে গেছে আমাদের সঙ্গে। হিস্টোফোন গুহার দেয়ালে খাঁজকাটা একটা পাথরে পায়ের দড়িটা জোরে ঘষছে। ডাকলুম, “হিস্টোফোন।”

হিস্টোফোন হিংস্র মুখভঙ্গি করে দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলল। তারপর সামনে পায়ের বাঁধনটা ঘষড়াতে থাকল। তার দেখাদেখি আমরাও অন্যপাশের দেয়ালের দিকে গড়িয়ে গেলুম। গুহার মুখে খানিকটা জায়গা বাইরের রোদের আভায় আলোকিত হয়ে আছে। কিন্তু মুখে ঝোঁপজঙ্গল বলে আলোটা খুব কম। উঁচু ধারাল একটা পাথর খুঁজে আমরা দুজনে পালাক্রমে আগে পায়ের বাঁধনটা ঘষড়াতে শুরু করলুম। হাতের বাঁধন আগে কাটা যাবে না। কারণ আমাদের প্রত্যেকের হাত পিঠের দিকে বাঁধা।

দড়িগুলো শক্ত লতা দিয়ে তৈরি। তাই সহজে ছেঁড়া যায় না। কতক্ষণ পরে হিস্টোফোনের কথা শুনে ঘুরে দেখি, সে বাঁধন কেটে ফেলেছে। হিংস্ৰমুখে সে বলল, “ডাইনিটা তোমাকে খেয়ে ফেলুক। তোমার জন্য আমার এই দুর্দশা। আমি চললুম।”

বললুম, “হিস্টোফোন! কথা শোনো। তুমি গিয়েও তো বস্তিতে ঢুকতে পারবে না! কিন্তু তোমার মেয়ে ওণ্টির কী হবে ভেবে দেখেছ হিস্টোফোন?”

হিস্টোফোন একটু ভড়কে গেল এবার। মুখ গোমড়া করে বলল, “সন্ধে অব্দি কোথাও লুকিয়ে থাকব। তারপর চুপিচুপি ওন্টিকে নিয়ে পালিয়ে যাব।”

“বরং এক কাজ করো হিস্টোফান! তুমি আমাদের বাঁধন খুলে দাও। আমাদের সঙ্গে হোটেলে গিয়ে থাকবে, তারপর সন্ধ্যায় তোমার মেয়েকে নিয়ে যাবে। রাতেই তোমাকে নিয়ে কলকাতা চলে যাব।”

হিস্টোফোনের মনে ধরল কথাটা। সে ভয়ের চোখে গুহার ভেতরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু বাঁধন খুলে দিতে দিতে যদি ডাইনিটা এসে পড়ে?”

“আমার প্যান্টের পকেটে রিভলবার আছে। বের করে হাতের কাছে রাখো।”

“আমি গুলি ছুঁড়তে জানি না।”

“তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি কী করতে হবে।”

হিস্টোফোন ঝটপট আমার পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে ফেলল। তাকে মুখে বুঝিয়ে দিলাম, ট্রিগার কীভাবে টানতে হবে। সেফটি-ক্যাচ তোলার ঝামেলা নেই। অস্ত্রটা অটোমেটিক। ভাগ্যিস ওরা আমাকে চিত করে ফেলে দিয়েছিল–একটু কাত হলেই চোট খেয়ে গুলি বেরিয়ে যেত।

হিস্টোফোন আমার বাঁধন খুলে দিল। তারপর বেণীমাধবের বাঁধন খুলতে শুরু করল। আমি রিভলভার নিয়ে তৈরি রইলুম। কিন্তু ডাইনি হোক আর যেই হোক, মানুষখেকোটির কোনো সাড়া নেই। বেণীমাধবের বাঁধন খুলে দিলে উনি উঠে পড়লেন। তারপর আমরা তিনজনে গুহা থেকে বের হয়ে এলুম।

কিন্তু যেমনি পা বাড়াতে গেছি, চড়বড় করে গুহার সামনে একরাশ পাথর পড়ল। অমনি পিছিয়ে এলুম। হিস্টোফোন উত্তেজিতভাবে বলল, “সর্বনাশ, বস্তির লোকেরা আড়ালে ওত পেতে আছে। ওরা আমাদের বেরুতে দেবে না। বেরুলেই পাথর ছুঁড়বে।”

রাগে খেপে গিয়ে রিভলবার থেকে পরপর দুটো গুলি ছুড়লুম। পাহাড়ে প্রচণ্ড প্রতিধ্বনি হল। তারপর তিনজনে বেরিয়ে গেলুম গুহার বাইরে।

কিন্তু আবার চড়বড় করে পাথর পড়া শুরু হল, আবার গুহায় ঢুকতে হল। ওরা আড়ালে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। খামোকা গুলি ছুঁড়ে লাভ নেই।

হঠাৎ হিস্টোফোন কান খাড়া করে কী শুনে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “গুলির শব্দে ডাইনিটার ঘুম ভেঙে গেছে! সর্বনাশ! এবার কী হবে?”

ঘুরে দেখি গুহার ভেতর অন্ধকারে দুটো হলদে আলো জুলজুল করছে। অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলুম। আলো দুটো ক্রমশ এগিয়ে আসছিল। বেণীমাধবের হাতে তাঁর পিস্তলটা দেখতে পেলুম এতক্ষণে। আমি আলো দুটো লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার আগেই উনি পিস্তলের গুলি ছুড়লেন। অমনি কানফাটানো গর্জন শুনলুম। পলকের মধ্যে দেয়ালের ধারে সরে গিয়েছিলুম সহজাত আত্মরক্ষা প্রবৃত্তির বশেই। কী একটা হলুদ-কালো প্রাণী লাফ দিয়ে পড়ল মাঝখানে। সঙ্গে সঙ্গে আমি রিভলভারের ট্রিগারে চাপ দিলুম। আবার বিকট গর্জন শুনলুম। তারপর দেখি, একটা চিতাবাঘ ডিগবাজি খেতে-খেতে বেরিয়ে গেল গুহার বাইরে।

“তাহলে ইনিই নাগপাদের মানুষখেকো ডাইনি।” বেণীমাধব মন্তব্য করলেন।

হিস্টোফোন গম্ভীর মুখে বলল, “ডাইনিটা এখন চিতাবাঘ সেজেছে।”

গুহার মুখে উঁকি মেরে দেখলুম, চিতাবাঘের পিঠে রক্ত দগদগ করছে। সে গড়াতে গড়াতে নেমে চলেছে পাথরের উপর দিয়ে। ওদিকে একদঙ্গল নাগপাকে দেখলুম পড়ি-কী মরি করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়চ্ছে। হিস্টোফোন তাই দেখে হাসতে লাগল। বললুম, “এখানে আর নয়। হিস্টোফোন, ঘুরপথে আমাদের এখনই হোটেলে পৌঁছনো দরকার।”…

.

শেষ লড়াই

সমতলে জঙ্গল ও পাথরের ভেতর অশেষ কষ্ট ভোগ করে সেই খালটার ধারে পৌঁছলাম আমরা। হিস্টোফোন করুণ মুখে বলল, “ওণ্টির জন্য আমার মন কেমন করছে, তার মা বেঁচে থাকলে ভাবনা ছিল না।”

তাকে আশ্বাস দিয়ে বললুম, “ভেব না। পুলিশের সাহায্যে তাকে তোমার কাছে এনে দেব।”

খালের জলে তৃষ্ণা মিটিয়ে আমরা সামনে উঁচু রাস্তার দিকে এগোচ্ছি, হঠাৎ একটা প্ৰকাণ্ড নীল রঙের পাথরের আড়ালে ধূসর রঙের টুপি দেখতে পেলুম। চোপরা নয় তো? ইশারায় বেণীমাধব ও হিস্টোফোনকে চুপচাপ আসতে বলে পা টিপে এগিয়ে গেলুম, টুপিওয়ালা লোকটি ওদিকে ঘুরে কী দেখছে। তার পেছনে গিয়ে রিভলভার উঁচিয়ে হ্যান্ডস আপ’ বলতে গেছি, আর লোকটা চাপা গলায় বলে উঠেছে, “চুপ, চুপ!”

চমকে উঠে গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে আবিষ্কার করলুম এবং হেসে ফেললুম।

কর্নেল আঙুল দিয়ে পাথরের ওপাশে কিছু নির্দেশ করলেন। উঁকি মেরে দেখলুম, একটা ফাঁকা ঘাসজমিতে ওক গাছের ছায়ায় বসে আছে ভোমরালাল চোপরা আর মাদারিবেশী তার সেই চেলা। শিম্পাঞ্জিটা থেবড়ে বসে আপেল খাচ্ছে আর পিঠ চুলকোচ্ছে। বেণীমাধববাবু চাপা স্বরে বললেন, “আরে! চোপরার ওই সঙ্গীটাই আমার দোকানে গিয়েছিল। ওর বাঁকানো বাজপাখির নাকটা দেখুন।”

চোপরার হাতে একটা বাঁটুল। হিস্টোফোন ফিসফিস করে বলল, “ওই দেখুন, দেবতার বলটা আমার মেয়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে কি না। খামকা আমাকে ওরা ভোগাল!” একটু পরে চোপরা উঠে দাঁড়াল। বাঁকা নাকওয়ালা সঙ্গীকে কিছু বলল। ওর সঙ্গী ডাকল, “ওই জাম্বু! খুব হয়েছে।”

জাম্বু পেছনে, ওরা সামনে–কয়েক পা এগিয়েছি, অমনি পাথরের আড়াল থেকে গর্জন করে বেরিয়ে এল রক্তাক্ত আহত সেই চিতাবাঘটা। জাম্বু পাল্টা গর্জন করল। তারপর চিতাটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোখের পলকে দুটি জানোয়ার মরণপণ লড়াইয়ে নেমে গেল। শিম্পাঞ্জি আর চিতাবাঘ পরস্পর জন্ম-শত্রু।

চোপরা পকেট থেকে পিস্তল বের করেছে, কিন্তু গুলি ছুঁড়তে পারছে না।–পাছে শিম্পাঞ্জিটার গায়ে গুলি লাগে। দুটি হিংস্র জন্তুর গর্জনে ও লড়াইয়ে তুমুল কাণ্ড চলেছে। চিতাটা আমার গুলিতে জখম না হলে হয়ত পিঠটান দিত শিম্পাঞ্জির এক থাপ্পড় খেয়েই। কিন্তু আহত চিতাবাঘটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে আচমকা শিম্পাঞ্জিটার গলা কামড়ে ধরল। শিম্পাঞ্জিটা নেতিয়ে পড়ল। সেই সুযোগে চোপরা চিতাটার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করল। তখন চিতাটাও নেতিয়ে পড়ল। ক্রমশ দুটি প্রাণীর দেহ নিস্পন্দ হয়ে গেল।

দুটি জানোয়ারই মারা পড়েছে। চোপরা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সময় হিস্টোফোন দৌড়ে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে গিয়ে চোপরার পায়ের তলা থেকে তার বাঁটুলটা কুড়িয়ে নিল। চোপরা তো তার দিকে পিস্তল তাক করে বলল, “এই ব্যাটা নাগপা! ওটা দে, বলছি। নইলে তোর মুণ্ডু উড়িয়ে দেব।”

কর্নেল আমাদের ইশারা করলেন। আমাদের তিনজনের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র। কর্নেল বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, “পিস্তল ফেলে দাও ভোমরালাল! চোপরা ভড়কে গিয়ে পিস্তল ফেলে দিল। আর ওর ঢ্যাঙা বাজনেকো সঙ্গীটা গতিক বুঝে দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর পালিয়ে গেল। তাকে তাড়া করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলুম।

চোপরা কোনো কথা বলল না। শিম্পাঞ্জিটার কাছে ধপাস করে বসে পড়ল। কর্নেল বললেন, “শোক প্রকাশ পরে করবেন ভোমরালালজী! এখন আমাদের সঙ্গে আসুন।”

চোপরা ঘাড় গোঁজ করে বসে রইল।

তখন কর্নেল বললেন, “জয়ন্ত, তুমি হোটেলে গিয়ে প্রণববাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করো। ব্রিগেডিয়ার অর্জুন সিংকে বললে উনি যোগাযোগ করিয়ে দেবেন। তুমি ওদের নিয়ে এস। আসামীকে গ্রেফতার করে কলকাতা নিয়ে যেতে হবে।”

আমি পা বাড়ালুম। হিস্টোফান বলল, “দেবতার বল ফিরে পেয়েছি আর আমার ভয় নেই। সর্দারকে গিয়ে দেখালেই আমার সব দোষ মাফ। আমি বস্তিতে ফিরে চললুম।”

সে দৌড়ে খাল পেরিয়ে চলে গেল। আমি চললুম হোটেলের দিকে। উঁচু রাস্তার উঠে বাঁ-দিকে ঘুরে দেখলুম, হিস্টোফানকে দেখে তার মেয়ে ওণ্টি দৌড়ে আসছে। কুকুরটাও তার দিকে দৌড়চ্ছে। বস্তি থেকে দলে-দলে লোকেরা বেরিয়ে অবাক হয়ে ওদের দেখছে। ডাইনির গুহা থেকে যে বেঁচে ফিরতে পেরেছে এবং শুধু তাই নয়, দেবতার বল উদ্ধার করে নিয়ে গেছে, সম্ভবত বস্তিতে এবার তার সম্মান বেড়ে যাবে।

বাবা-মেয়ের উজ্জ্বল মুখ দূর থেকে রোদ ঝলমল করতে দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গেল।

কিন্তু হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছেই ফিরতে হল। ব্রিগেডিয়ার অর্জুন সিং আর প্রণব রুদ্র একদল পুলিশ নিয়ে এদিকেই হন্তদন্ত হয়ে আসছেন।…

No comments