আরণ্যক – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
যুক্তির আতশ কাচ দিয়ে সবকিছুর বিশ্লেষণ সম্ভব নয়।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ যেমন আছে, তেমনি আছে অতীন্দ্রিয় জগৎ। সে জগতে সবকিছু বিচিত্র, সবকিছু যুক্তির মাধ্যমে যাচাই করা চলে না। এই অতিপ্রাকৃত জগৎকে গায়ের জোরে অস্বীকার যারা করে, তারা পৃথিবীর বারো আনা রহস্যের খোঁজ পায় না।
অনেক সময় আমরা মনকে বোঝাই এসব চোখের ভুল, মনের ভুল, যা ঘটেছে নিছক কল্পনা অথবা মনের তৈরি মায়া, কিন্তু সঙ্গোপনে নিজের মনের মুখোমুখি যখন বসি, তখন এসব অবজ্ঞা করা দুরূহ হয়ে ওঠে।
ভণিতা ছেড়ে আসল ঘটনার কথা বলি।
রায়পুর থেকে ছত্রিশ মাইল পশ্চিমে। আধা শহর, নাম খুরশীদগড়। আধা শহর বলছি এইজন্য, পাকা রাস্তা আছে, গোটা কয়েক অফিস, একটা পেট্রোল পাম্প, মোটরের কারখানা। পাকা রাস্তার পরিধি পার হলেই নিবিড় জঙ্গল। ছোটো ছোটো টিলা। কিছুটা অঞ্চল সংরক্ষিত। সরকারি বনবিভাগের।
প্রথম এসেছিলাম বছর দশেক আগে। এক টিম্বার কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে।
কাজ বিশেষ কিছু নয়। জঙ্গল থেকে কাটা কাঠের হিসাব রাখতে হত। দুজন কর্মচারী, মাসান্তে তাদের মাইনে দেওয়া। অবসর সময়ে শিকার।
শিকারের হাতেখড়ি হয়েছিল উড়িষ্যার জঙ্গলে। বাবা সেখানে বনবিভাগে ছিলেন। জরিপের কাজে। তিনিই হাতে করে শিকার শিখিয়েছিলেন। প্রথমে সম্বর, অ্যান্টিলোপ, তারপর বন্য বরাহ, শেষকালে লেপার্ড।
নিজের দক্ষতার ওপর বেশ আস্থা হয়েছিল। এদিক-ওদিক থেকে শিকারের জন্য ডাকও আসত।
তারপর খুরশীদগড়ে আবার যখন এলাম, তখন আমার পদোন্নতি হয়েছে। এক বিশ্বজোড়া পেট্রোল কোম্পানির আমি ভ্রাম্যমাণ পরিদর্শক।
বড়ো শহর বদলায়। তার রাস্তাঘাট বাড়ি-বাগান কয়েক বছর অন্তর নতুন রূপে পালটায়। কিন্তু খুরশীদগড়ের মতন আধা শহর শতাব্দীর পর শতাব্দী একরকম থাকে।
পুরোনো বাসিন্দারা এসে ঘিরে ধরল। কুশল প্রশ্ন, নিমন্ত্রণের হিড়িক। অনেক রাত পর্যন্ত গল্পগুজব।
আড্ডা ভাঙবার মুখে আদিবাসীর দল এসে দাঁড়াল। খালি গা, পরনে নেংটি, চুলে পালক গোঁজা। কারও কারও হাতে টাঙ্গি আর বর্শা। এদের বাস জঙ্গলের মধ্যে ঝরনার ধারে। রাস্তা তৈরির কাজ করে। মেয়ে-পুরুষ দুজনেই।
সারা বছর এ কাজ থাকে না, বিশেষ করে বর্ষাকালে। তখন এরা জঙ্গল সাফ করে চাষবাস করে। হরিণ কিংবা পাখি শিকার করে আগুনে ঝলসে খায়।
‘বাবু, তুই এসেছিস— এবার বাঁচা!’
মনে হল চেনা লোক। দশ বছর আগে আমাকে দেখেছে।
মুখ তুলে দেখলাম, ঠিক তাই। মোড়ল কথা বলছে। চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু পেশী এখনও সতেজ। টানটান চেহারা।
‘আগের বার বাঁচিয়েছিলি।’
এর আগে একবার চিতার উপদ্রব হয়েছিল। এদের ছাগল মুরগি তুলে নিয়ে যেত। একবার উঠোনে তেল মাখিয়ে একটা বাচ্ছাকে রোদে শুইয়ে রেখেছিল দিন-দুপুরে। চিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে নিয়ে উধাও।
এক বুড়ো কাছে বসে পাহারা দিচ্ছিল। সে মুহূর্তের জন্য দেখল একটা হলুদ ঝিলিক উঠানের ওপর পড়েই আবার মিলিয়ে গেল।
সেইসময় এরা দল বেঁধে এসেছিল।
‘বাবু, তোর বন্দুক নিয়ে একবার চল। আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে!’
গিয়েছিলাম।
চিতা শিকার সহজ নয়। বন্দুক হাতে সবসময় সজাগ থাকতে হয়। চিতার থাবার তলায় ডানলোপিলোর প্যাডিং। পাশ দিয়ে গেলেও শব্দ পাওয়া যায় না। তা ছাড়া এরা গাছে উঠতে ও দক্ষ। যে গাছের তলায় শিকারি বন্দুক নিয়ে তৈরি হয়ে আছে, চিতা হয়তো ওত পেতে রয়েছে সেই গাছেরই ডালে। সুযোগ বুঝে শিকারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
প্রথমত একটা ‘কিল’ রাখা হল।
ঝরনার ধারে একটা ঝোপের পাশে মরা মোরগ।
আমি কাছেই একটা গাছের ডালে বসে রইলাম।
একদিন, দু-দিন গেল, কিছু হল না।
অথচ ঝোপের মধ্যে চিতার ল্যাজ আছড়ানোর শব্দ কানে এল। বার দুয়েক পাতার ফাঁকে তার জ্বলন্ত দুটি চোখও দৃষ্টিগোচর হল।
কিন্তু চিতা বাইরে এল না। সম্ভবত সে বাতাসে মানুষের গন্ধ পেয়ে থাকবে। বুঝলাম, এভাবে তাকে কাবু করা যাবে না।
আদিবাসীদের বললাম, ‘তোমরা এক কাজ করো, তিনদিক থেকে ঝোপটা পেটাতে শুরু করো। তাহলেই চিতা বের হয়ে পড়বে। ফাঁকা দিকে আমি তৈরি থাকব বন্দুক নিয়ে। বের হলেই গুলি চালাব।’
এতে বিপদের সম্ভাবনাও যথেষ্ট।
মরিয়া চিতা লোকেদের ঘাড়ের ওপরও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যার ওপর পড়বে নিস্তার নেই।
কিন্তু শিকারে কিছু বিপদের সম্ভাবনা থাকেই।
ঝোপের একটা দিকে ঝরনা।
ঝরনা এখনও অনেক নীচে। ঝুঁকে পড়লে তবে তার উচ্ছল জলস্রোত দেখা যায়। ঢালু পাড় জঙ্গলে সমাকীর্ণ।
সেদিকে বন্দুক তাগ করে আমি বসলাম।
এদিকে লোকেরা টিন আর ক্যানেস্তারা পিটতে লাগল। অত্যুৎসাহী দু-একজন কাপড়ের বলে পেট্রোল মাখিয়ে তাতে আগুন জ্বেলে ঝোপের মধ্যে ফেলতে শুরু করল।
কাজ হল। ঝোপের অন্তরাল থেকে চিতার ত্রু«দ্ধ গর্জন শোনা গেল।
প্রায় ঘণ্টা কয়েক পর।
ঝোপের মধ্যে একটা তীব্র আলোড়ন। চিতাটা লাফিয়ে শূন্যে উঠল। পরিষ্কার দিনের আলো। আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘ নেই।
হলুদ রং-এর একটা বলের আকার। চিতা নিজের শরীরটা গুটিয়ে নিয়েছে। কাচের মার্বেলের মতন জ্বলছে দুটো চোখ। বড়ো বড়ো দাঁতের ফাঁক দিয়ে লাল টকটকে জিভটা বেরিয়ে পড়েছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করলাম। পর পর দুটো।
প্রথমটা পিছনের পায়ের ওপর লাগল। দ্বিতীয়টা চোয়ালে। চোয়াল ভেঙে যাবার শব্দ হল। শূন্যেই ডিগবাজি দিয়ে চিতাটা নীচের ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। তার প্রাণে বেঁচে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। চোয়াল গুঁড়িয়ে যেতে নিজের চোখে দেখেছি! কিন্তু আপশোশ হল, শিকার হাতের মুঠোয় এল না।
খুব অল্প সময়, তবু তার মধ্যে নজর এড়ায়নি।
চিতার একটা কান নেই। সম্ভবত বনেবাদাড়ে ঘোরার সময় কাঁটাগাছে লেগে কানটা কেটে গেছে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য আরও বিস্ময়কর।
চিতার দেহের একপাশে কোনো দাগ নেই! ধূসর বর্ণ।
পরে দু-একজন প্রত্নতত্ত্ববিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছি। তারা কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি।
চিতাটা যে মারা গিয়েছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার আরও একটা কারণ ছিল।
তারপর থেকে আর কোনোরকম উপদ্রব হয়নি।
দশ বছর পরে আবার সেই উপদ্রব।
‘বাঁচা বাবু, বাঁচা! সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে!’
পিছনে দাঁড়ানো একজন মোড়লের কথার প্রতিবাদ করল।
‘একী বাঘ যে বাবু বন্দুকে টোটা ভরে মারবে, আরে বাঘ খতম। এ তো পিরেত। বাঘের রূপ ধরে এসেছে।’
শুনলাম, কোনো মন্তব্য করলাম না।
আদিবাসীদের জগতে ভূতপ্রেতের অবাধ রাজত্ব। হঠাৎ ঝড়ে গাছ পড়ে গেল সেও অপদেবতার কাণ্ড, আবার গভীর রাত্রে শকুনিশাবকের করুণ কান্নাও প্রেতের কারসাজি।
যাহোক, ঠিক করলাম, পরের দিনই শিকারে বের হব।
মোড়লকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলে দিলাম। চিতার গতিবিধি সম্বন্ধে বিশেষরূপে ওয়াকিবহাল হবার জন্য।
পরের দিন সকালে খাটিয়ায় বসে চা পান করছি, মোড়ল এসে দাঁড়াল।
‘কী খবর বলো?’
‘খবর আর কী বলব বাবু! কাল মোমিন যা বলেছে, কথাটা মিথ্যা নয়।’
‘মোমিন কে? আর সে কী বলেছে?’
‘মোমিন আমার ভাইয়ের ছেলে। সে যে বলেছে, চিতা নয় অপদেবতা, ঠিকই বলেছে।’
‘কেন?’
‘তাকে শিকার করা যায় না। মাস ছয়েক আগে বনবিভাগের এক সাহেব এসেছিল। দশদিন ধরে নাজেহাল। এই দেখল, চিতা সামনের এক গাছের আড়ালে, বন্দুক ছুড়ল, ব্যস কোথাও কিছু নেই। একটু পরেই দেখল, চিতা পিছনের পাথরের এক ঢিবির পাশে।
শেষকালে সাহেব বন্দুক কাঁধে নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। স্বীকার করেছিল, চিতা নয়, ভৌতিক কিছু-একটা।’
হেসে বললাম, ‘সাহেব শিকারে যাবার আগে ক-গ্লাস শরাব টেনে নিতেন, সে হিসাব রাখো মোড়ল? শুধু সামনে-পিছনে কেন, তেমন হলে চারপাশে চারটে চিতা দেখতে পেত।’
আমার রসিকতায় মোড়ল হাসল না।
মোড়লের কাছে শুনলাম, নদীর ওপারে বনের মধ্যে চিতার আস্তানা।
সময় সুযোগ বুঝে সে নদী সাঁতরে এপারে চলে আসে।
দুপুরে যখন এপারের মাঠে আদিবাসি ছেলেরা গোরু-ছাগল চরাতে আসে, তখন তাদের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে চিতা ছোটো সাইজের গোরু কিংবা ছাগলের ওপর লাফিয়ে পড়ে। তারপর আধমরা শিকার পিঠে নিয়ে অক্লেশে নদী পার হয়ে নিজের আস্তানায় ফিরে যায়।
কোনো কোনোদিন এপারের জঙ্গলের মধ্যে বসেও আহার শেষ করে। একটা বেপরোয়া ভাব, অকুতোভয়, অসমসাহসিক।
পীতবর্ণের এই অগ্নিশিখা আশপাশের সকলের আতঙ্ক।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আজ দুপুর বেলা গাছের ডালে বন্দুক নিয়ে অপেক্ষা করব, ঠিক গোচারণ ভূমির পাশে। হয়তো কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু এ ছাড়া আর পথ দেখছি না।’
খাওয়াদাওয়ার পর খাকি সার্ট আর হাফপ্যান্ট পরে তৈরি হচ্ছি, এল গোকুলপ্রসাদ।
আমি যে পেট্রোল কোম্পানির প্রতিনিধি, গোকুলপ্রসাদ সেই কোম্পানির এখানকার ডিস্ট্রিবিউটর।
আমাকে দেখে বলল, ‘একী, রণসাজে কোথায়? অবশ্য কিপাং নদীর ধারে হরিয়াল আর তিতিদের ঝাঁক নামে এইসময়।’
‘পাখি নয় গোকুল, চিতা-শিকারে।’
দৃশ্যত গোকুলপ্রসাদের মুখের রং বদলাল। সে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ‘জঙ্গলে যে চিতা অত্যাচার করছে, সেটা নাকি?’
‘হ্যাঁ, আদিবাসির দল এসেছিল। সেই চিতার কথাই বলল।’
‘সর্বনাশ, ও কাজ ভুলেও করবেন না!’ গোকুলপ্রসাদের কণ্ঠে আতঙ্কের স্পর্শ।
‘কেন?’
‘ওটা চিতা নয়, অশরীরী কিছু।’
উচ্চহাস্য করে উঠলাম। জানতাম, গোকুলপ্রসাদ কখনো নেশা ভাং করে না। জীবনে বিড়ি-সিগারেটও খায়নি। কাজেই নেশার ঘোরে কিছু দেখবে এমন সম্ভাবনা কম।
তবে গোকুলপ্রসাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বছর খানেক আগে। তখনও পর্যন্ত সে অকলঙ্ক চরিত্র ছিল। বছর খানেকের মধ্যে যদি নেশার দাস হয়ে থাকে তো বলতে পারব না।
তাই প্রশ্ন করলাম, ‘কী ব্যাপার বলো তো?’
গোকুলপ্রসাদ খাটিয়ার ওপর চেপে বসল।
‘দিন পনেরো আগে আমি রায়পুর থেকে ফিরছিলাম চাচার বাড়ি থেকে। বের হতে দেরি হয়ে গেল। মাঝপথে সন্ধ্যা নামল। আমি গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম। জঙ্গলের পাশের রাস্তায় এসেছি, দেখি ঝোপের ধারে একটা চিতা। বসে বসে নিজের থাবা চাটছে। মোটরের হেডলাইটে তার দুটো চোখ সবুজ মার্বেলের মতন জ্বলে উঠল।
আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে কোনো হাতিয়ার নেই। চিতা যদি মোটরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলেই বিপদ!
মাইল দুয়েক গিয়ে মোটরের গতি কমালাম। বাঁক ঘুরতেই এক দৃশ্য। ঝোপের কাছে বসে চিতাটা থাবা চাটছে।’
আমি হেসে অভয় দিলাম, ‘তোমার কি ধারণা এত বড়ো জঙ্গলে চিতা মাত্র একটি-ই? আর নেই?’
গোকুলপ্রসাদ মানতে চাইল না। সে বললে, ‘কিন্তু এক চিতা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। এক সাইজ, এক বসার ভঙ্গি। পরপর চারবার এক দৃশ্য দেখলাম।’
আমি আর কিছু বললাম না।
এ দেশে সিদ্ধিপান নেশার মধ্যে পরিগণিত হয় না। খুব সম্ভব চাচার বাড়িতে গোকুলপ্রসাদ সিদ্ধির শরবত পান করে থাকবে। তারই কল্যাণে রাস্তার দু-পাশে কেবল চিতাই দেখেছে।
একটু বসে গোকুলপ্রসাদ চলে গেল। তারপরেই মোড়ল এল।
আমি তৈরিই ছিলাম, মোড়লের সঙ্গে বের হয়ে পড়লাম।
‘এবার ”কিল” কী হবে?’ পথে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘একটা ছাগলের বাচ্ছা এনেছি। সেটাকে গাছের তলায় বেঁধে রাখব। তুই মাচা বেঁধে গাছের ডালে বসবি।’
এমন ব্যবস্থায় সন্দেহ প্রকাশ করলাম।
‘কিন্তু চিতার পক্ষে গাছে ওঠা মোটেই অসুবিধাজনক নয়।’
মোড়ল বলল, ‘সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তুই গাছে উঠে গেলে জঙ্গল থেকে কাঁটাগাছ এনে তলায় রেখে দেব। কাঁটাগাছ দেখলে বাঘ সেদিকে ঘেঁষে না।’
আয়োজন অবশ্য ভালোই, কিন্তু কোনো কারণে বিপদের সম্মুখীন হলে দ্রুত গাছ থেকে অবতরণ করার পথ বন্ধ।
আমি শুধু মোড়লকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যে গাছে মাচা বাঁধা হবে তার আশেপাশে অন্য গাছ আছে?’
মোড়ল মাথা নাড়ল, ‘না।’
আমার এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য, চিতাটা পাশের কোনো গাছে উঠে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কিনা?
যখন মাচার কাছে গিয়ে পৌঁছোলাম, তখন দুপুরের রোদ স্তিমিত। এমনিতেই ঘন অরণ্যের মধ্যে সূর্যালোকের প্রবেশ নিষেধ।
জনচারেক লোক অপেক্ষা করছিল। একজনের হাতে দড়িতে বাঁধা ছাগলছানা। সেটার পরিত্রাহি চিৎকারে অরণ্য মুখরিত।
আমি ভেবেছিলাম আমার সঙ্গে কেউ একজন মাচায় থাকবে, কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল কেউ থাকতে রাজি নয়।
এমনকী মোড়লেরও বাড়িতে মেয়ের অসুখ।
তবে যাবার সময় মোড়ল আশ্বাস দিয়ে গেল, আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। ছাগলছানার চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে চিতাটা শীঘ্রই দেখা দেবে।
তা ছাড়া, এই সময় বনের জন্তুরা অনেকেই নদীতে জলপান করতে আসে।
অতএব গাছে হেলান দিয়ে বন্দুক কোলে নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম।
রেদের তেজ ম্লান হয়ে এল। গাছের ছায়া দীর্ঘতর।
দু-একটা মেটে রং-এর খরগোশ ইতস্তত দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। পাখিরা কুলায়ে ফিরল। তাদের অপূর্ব কাকলিতে অরণ্যের নীরবতা খানখান হয়ে গেল।
সন্ধ্যা নামল। ঝোপে ঝোপে জোনাকির ঝাঁক। দূরে দু-একটা ময়ূরের ডাক শোনা গেল।
কিন্তু চিতাটার দেখা নেই।
আরও আশ্চর্য, ছাগলছানা নির্ভয়ে ঘুমোচ্ছে। কোনোদিক থেকে কোনো উপদ্রব হতে পারে, এমন চিন্তা তার নেই।
কাগজে-মোড়া খাবার আর ফ্লাস্ক থেকে জলপান করলাম। বুঝতে পারলাম, সারাটা রাত এইরকম ত্রিশঙ্কুর মতন কাটাতে হবে।
এই সময়ে গাছ থেকে নেমে ফেরার চেষ্টা বাতুলতা।
একটু বোধ হয় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম, নিশাচর পাখির কর্কশ কণ্ঠস্বরে তন্দ্রা ভেঙে গেল।
ছাগলছানা তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঝোপের পাশে দুটি জ্বলন্ত দৃষ্টি। বুঝতে পারলাম, চিতা ঝোপের মধ্যে অপেক্ষা করছে। সুযোগ বুঝে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
এখন আর অন্ধকার নেই। চাঁদের অমল জ্যোৎস্নায় বনভূমি যেন স্নান করে উঠেছে। আমি যেদিকে বসে আছি, সেদিকটা অন্ধকার, ঘন পাতার রাশির জন্য, কিন্তু গোচারণ ভূমি, নদীর পাড়, ছোটো ছোটো ঝোপ সব দুগ্ধধবল।
ঝোপটা নড়ে উঠল। আমি বন্দুক নিয়ে তৈরিই ছিলাম।
চিতা সন্তর্পণে ঝোপ থেকে বাইরে এসে দাঁড়াল।
চিতাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কোথাও একটু অন্ধকার নেই।
আমি এক ঝলক দেখেই চমকে উঠলাম।
একটা কান কাটা! শরীরের একদিকে কোনো দাগ নেই! ধূসর বর্ণ!
তার অর্থ, বছর দশেক আগে যে-চিতাকে গুলি করে হত্যা করেছিলাম, পরলোক থেকে সেই চিতা ফিরে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য মুহূর্তের জন্য এমন একটা চিন্তা আমার মনকে আচ্ছন্ন করেছিল, তারপরই মনকে বোঝাতে শুরু করলাম। যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে।
কাঁটা ঝোপের আঘাতে যেকোনো জন্তুরই কান কাটা যেতে পারে। এর মধ্যে আশ্চর্যজনক কিছু নেই। বিশেষ করে সিংহ, বাঘ, চিতা যারা শিকার ধরবার আগে গুড়ি মেরে চলে।
আর দেহের কিছুটা ধূসর হওয়াও বিচিত্র নয়। কে জানে, সামনে দাঁড়ানো চিতাটা দশ বছর আগে নিহত চিতার বংশোদ্ভূত কিনা।
চিতার গন্ধে ছাগলছানা জেগে উঠেছে। শুধু জেগে ওঠা নয়, বিপদের গুরত্ব বুঝতে পেরেছে।
তারস্বরে চিৎকার করছে আর রজ্জুমুক্ত হবার প্রাণপণ চেষ্টা।
আশ্চর্য, চিতার লক্ষ্য কিন্তু ছাগলছানা নয়। সে একদৃষ্টে আমার দিকে দেখছে! দুটি চোখে প্রতিহিংসা বিচ্ছুরিত।
একটু চিন্তায় পড়লাম।
কিছু বলা যায় না। যে ডালে আমি বসে আছি, সেটা এমন কিছু উঁচুতে নয়। দু-একবার চেষ্টা করলেই নাগাল পেয়ে যেতে পারে।
তারপর দুজনে জড়াজড়ি করে কাঁটার স্তূপের ওপর পড়ব।
বন্দুক ঠিক করে বসে রইলাম।
চিতা শূন্যে লাফ দিলেই ট্রিগার টিপব। দোনলা বন্দুক। প্রয়োজন হলে দ্বিতীয় গুলি ছুড়তে হবে।
‘ঠিক তাই।’
চিতাটা নীচু হয়ে মাটির সঙ্গে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দিল। প্রবল বেগে ল্যাজটা আছড়াচ্ছে। ল্যাজের ঝাপটায় শুকনো পাতার স্তূপ ইতস্তত উড়তে লাগল। দৃষ্টি কিন্তু আমার দিকে।
কয়েক মুহূর্ত, তারপরই চিতা লাফ দিল।
সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুড়লাম।
ঠিক পাঁজরে গিয়ে লাগল। শূন্যেই মুখ বিকৃত করে চিতাটা পাক দিয়ে সশব্দে মাটির ওপর পড়ল। চার পা প্রসারিত করে মরণযন্ত্রণায় সমস্ত শরীরটা বার কয়েক কুঞ্চিত করল, তারপর স্থির হয়ে গেল।
এখন নামা বিপদজনক। তা ছাড়া আমার নামার উপায়ও ছিল না। তলায় কাঁটার স্তূপ।
অনেক শিকার-কাহিনিতে পড়েছি, বাঘ নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে, মৃতের ভান করে। উৎফুল্ল শিকারি কাছে গেলে, তার প্রচণ্ড থাবার আঘাতে কিংবা দংশনে প্রাণ হারায়।
ঠিক করলাম, সারাটা রাত গাছের ওপরই থাকব। যা-কিছু করার, ভোরের আলো ফুটলে করাই সমীচীন হবে।
কোমরের বেল্ট খুলে নিজেকে গাছের ডালের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধলাম নিদ্রার ঘোরে ছিটকে নীচে পড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়।
নির্মেঘ আকাশ। সবকিছু দিনের মতন পরিষ্কার।
চিতার দিকে দেখতে দেখতে চমকে উঠলাম।
স্পষ্ট দেখেছিলাম, আমার গুলি তার পাঁজর বিদ্ধ করেছিল, কিন্তু চোয়াল থেকে রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়ছে।
দশ বছর আগে ঠিক যেখানে গুলি লেগেছিল।
পাঁজর আর চোয়ালের দূরত্ব অনেকটা। গুলি পিছনে চোয়ালে লাগবে তা সম্ভব নয়।
আশ্চর্য কাণ্ড। এই প্রথম শরীরে একটা শিহরণ অনুভব করলাম। অরণ্যে অন্য সব শব্দ জাদুমন্ত্রে যেন থেমে গেল। এমনকী ঝিঁঝির ডাও।
একসময়ে নিদ্রিত হয়ে পড়েছিলাম।
যখন ঘুম ভাঙল, তখন ভোর হয়ে গেছে। চারিদিকে, পাখির স্বর শোনা যাচ্ছে।
সামনের দিকে চেয়েই চমকে উঠলাম। কোথাও চিতা নেই! অথচ ছাগলছানাও উধাও!
অলৌকিক ব্যাপার। গাছ থেকে অনেক কষ্টে নেমে পড়লাম। কাঁটায় দু-এক জায়গায় ছড়ে গেল।
কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলাম। রক্তের সামান্য দাগও নেই। ছাগলছানা যে দড়িতে বাঁধা ছিল, তাও নেই। খুঁটিটাও নিখোঁজ।
তাহলে কাল রাতে সবকিছু কি স্বপ্নে ঘটেছিল? তা কি সম্ভব?
নিজের বন্দুক পরীক্ষা করে দেখলাম। দুটো গুলিই রয়েছে। গুলি ছোড়া হয়েছিল তার কোনো প্রমাণ নেই।
একটু পরেই আদিবাসিরা এসে জড়ো হবে। কী বলব তাদের? আমার কাহিনি তাদের চিতার সম্বন্ধে অলৌকিকত্বই প্রমাণ করবে।
ছাগলছানাটাও নেই। তার অর্থ চিতা এসেছিল।
আমার পরাজয়ের কাহিনি আদিবাসিদের কাছে রটে যাওয়ার চেয়েও নিঃশব্দে আত্মগোপন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
চলতে শুরু করলাম।
একটু চলতেই মনে হল পিছনে কে যেন আমাকে অনুসরণ করছে। পিছন ফিরে দেখেই থমকে দাঁড়ালাম। চলার শক্তি কে যেন হরণ করে নিল।
গাছের আড়ালে সেই চিতা! দুটি চোখে আগুনের ঝলক। চোয়াল আর পাঁজরে রক্তক্ষত।
আহত চিতা কি আমাকে অনুসরণ করছে?
কিন্তু বন্দুকে দুটো গুলিই যখন অটুট, তখন চিতা আহত হল কী করে?
বন্দুক তুললাম। মনে হল, ভোরের কুয়াশার মধ্যে চিতা যেন মিলিয়ে গেল।
একবার নয়, এক দৃশ্য বার বার তিনবার।
অগ্নি-ঝরা দৃষ্টি দিয়ে আমাকে জরিপ করতে করতে চিতা চলেছে।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে।
বয়স হয়েছে। শিকার করার শক্তি আর নেশা কোনোটাই নেই।
প্রায় অবসর জীবনযাপন করছি।
মাঝে মাঝে রায়পুর অঞ্চলের বনবিভাগের কয়েক জন দেখা করতে আসে।
সকলের মুখেই এক কাহিনি শুনি।
কাটা কান আর রক্তাক্ত দেহ নিয়ে যে চিতাকে প্রায়ই রাত্রের অন্ধকারে দেখা যায়, তাকে বধ করা কোনো শিকারির পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
সকলেই বাধ্য হয়ে স্বীকার করেছে, ওটা সাধারণ চিতা নয়। হয়তো চিতাই নয়— চিতার প্রেতাত্মা।
আমারও তাই মত।
কিন্তু আমার যুক্তিবাদী বন্ধুরা, যাঁরা সবকিছু বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে চান, তাঁদের আমি কী করে বোঝাব?
অতীন্দ্রিয় জগতের রহস্য যুক্তিনির্ভর নয়— বিশ্বাস-নির্ভর।
Post a Comment