ইপানিমার মেয়েটি – হারুকি মুরাকামি
ইপানিমার মেয়েটি ১৯৬৩/১৯৮২
{গেট্জ/গিলবার্তোর সঙ্গীত দিয়ে শুরু হয়েছিল।} দীর্ঘ, গায়ের রঙ তামাটে, তরুণ, চমৎকার… {আর এভাবেই এগিয়েছিল।}
১৯৬৩ সালে ইপানিমার মেয়েটি এভাবেই সমুদ্র দর্শন করেছিল। আর এখন ১৯৮২ সালে এসে ইপানিমার মেয়েটি একইভাবে সমুদ্র দেখছে। তখন থেকে। একটুও বাড়েনি তার বয়স। একটা ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছে তার, আর সময়ের সাগরে ভাসছে সে। তার বয়স যদি একটু বাড়েও, চল্লিশের বেশি মনে হবে না তাকে। আর এটাও সম্ভব যে, সে এত বেশি বয়স্ক নয়, তবে সে ছিপছিপে আর টান-টান ত্বকের অধিকারী থাকবে না আগের মতো। হয়ত তার তিনটি সন্তান থাকবে। সূর্যের তাপ তার ত্বকের জন্য ভাল নয়। এখনও তাকে সুন্দরীই বলা যাবে, তবে পঁচিশ বছর আগের মতো তারুণ্যতো আর আশা করা যাবে না।
সঙ্গীতে কিন্তু সে বুড়ো হয়নি একটুও। স্টান গেঞ্জ এর বাঁধা ছন্দের স্যাক্সাফোনের মোলায়েম সুরে সে বরাবরই ইপানিমার আঠারো বছরের যুবতী, শান্তশিষ্ট, দয়াবতী। টার্নটেবলে রেকর্ডটা চাপিয়ে দিতেই সে এসে হাজির হয়। যতবারই সুরটি শুনি আমার স্মৃতিপটে হাইস্কুলের করিড়োর ভেসে ওঠে। অন্ধকার, স্যাঁতসেতে করিড,র। সিলিং অনেক ওপরে আর যখন কনসার্ট ফ্লোরের ওপর দিয়ে হাঁটি আমার পদশব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। উত্তর দিকের দেয়ালে কয়েকটা জানালাও আছে; কিন্তু সূর্যের আলো সেখানে কমই ঢোকে, কারণ ভবনটি একটা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। যতদূর মনে পড়ে করিডোরটা সব সময় থাকত নীরব সুনসান।
করিডোরের কথা মনে হতেই ‘ইপানিমার মেয়েটি” নামের সঙ্গীতটি কেন আমি শুনি জানি না। কোনো কার্য-কারণ খুঁজে পাই না। আমার চৈতন্যের কূপে ইপানিমার মেয়েটি ১৯৬৩ কোন ধরনের নুড়ি ফেলে দিয়েছিল? হাইস্কুল ভবনের করিডোর আমাকে লেটুস, টমেটো, শসা, কাঁচালঙ্কা, অ্যাসপারাগাস, পেঁয়াজ এর সালাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। করিডোরের মাথায় নিশ্চয়ই কোনো সালাদের দোকান নেই। করিডোরের শেষে আছে একটা দরজা আর তারপরেই পঁচিশ মিটার লম্বা একটা সুইমিং পুল।
.
১.
করিডোর কেন সালাদের কথা মনে করিয়ে দেয় জানি না। কোনো কার্য-কারণও নেই। মনের ভেতর এই দু’য়ের সংযোগ হয়ত কোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কিছু। কোনো ভাগ্যাহত মহিলার মতো, যে কিনা সদ্য রঙ করা কোনো বেঞ্চের ওপর বসে পড়ছে। ওই সালাদ একটা মেয়ের কথা মনে করিয়ে দেয় আমাকে, যার সঙ্গে চেনাজানা ছিল আমার। এখানে একটা স্পষ্ট সম্বন্ধ রয়েছে। মেয়েটি সারাক্ষণ সালাদ খেত।
“ইংরেজি ক্লাসের (কচ কচ) জন্য পেপারটা (কচ কচ কচ) শেষ করছে? আমারটা এখনও (কচ কচ) শেষ হয়নি। বাকি আছে একটু (কচ কচ) খানি।”
আমি সবজি খুব পছন্দ করি আর যখনই আমাদের দেখা হয় এ রকম করে সালাদ খাই আমরা। সে খুব কঠিন মনের একটি মেয়ে আর তার বিশ্বাস নানা ধরনের সবজি খেলে সব কিছু ঠিকঠাক চলবে। মানুষ যদি সবজি খাওয়া অব্যাহত রাখে তাহলে বিশ্ব হয়ে উঠবে শান্তিময়, সুন্দর, স্বাস্থ্যকর ও ভালবাসায় পূর্ণ। “স্ট্রবেরি বিবৃতির মতো অনেকটা। একদা, এক দার্শনিক লিখেছিলেন, “একটা সময় ছিল যখন বস্তু ও স্মৃতি তত্ত্বজ্ঞানসমৃদ্ধ গভীরতা দিয়ে ভাগ করা হতো।” ইপানিমার মেয়ে ১৯৬৩/১৯৮২ কোনো রকম শব্দ না করে নিগুঢ় তপ্ত সমুদ্র তটের ওপর দিয়ে হাঁটছে। এটা একটা দীর্ঘ সমুদ্র তট আর ধীর-শুভ্র ঢেউ তা ধুয়ে দিচ্ছে। বাতাস নেই, দিগন্ত ফাঁকা। সমুদ্রের গন্ধ পাচ্ছি আমি। প্রখর রোদে পুড়ে যাচ্ছি। একটা ছাতার নিচে শুয়ে বিয়ারের একটা ঠাণ্ডা ক্যান খুলি। সে তখনও হাঁটছে। তার দীর্ঘ, টানটান শরীরে বিকিনি ছাড়া আর কিছুই নেই এখন।
“হেই।” সাহস করে বলি। সে জবাব দেয় “হেই।”
“একটা বিয়ার খেলে কেমন হয়?” প্রস্তাব দেই আমি। একটুখানি দ্বিধায় পড়ে সে। সারাদিন বিচে হেঁটে-হেঁটে সে নিশ্চয়ই তৃষ্ণার্ত এখন। “ঠিক আছে চলুক।” তারপর আমরা ছাতার তলায় বসে বিয়ার পান করি।
.
২.
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আমি নিশ্চিত ১৯৬৩ সালে এই সময় একই জায়গায় আমি আপনাকে দেখেছি।” মাথাটা একটুখানি তুলে সে উত্তর দেয়, “সে তো অনেক দিন আগের কথা, তাই না?”
“হ্যাঁ সে অনেক আগের কথা।”
বিয়ারের অর্ধেকটা খেয়ে ক্যানের মুখের দিকে তাকায় সে। খুবই সাধারণ একটা মুখ, কিন্তু সে যখন দেখল আমার কাছে মনে হলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে ওখানে। যেন গোটা পৃথিবীই ধারণ করে আছে ওটা।
“হয়ত আমাদের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১৯৬৩ তে? হ্যাঁ ১৯৬৩ তে-ই তো। হ্যাঁ দেখা হয়েছিল একে অপরের।”
“তখন থেকে আপনার বয়স কিন্তু একটুও বাড়েনি।”
“কারণ আমি একজন বিমূর্ত মেয়ে যাকে বলে মেটাফিজিক্যাল গার্ল।”
আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি। সব সময় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বলে আমাকে খেয়াল করেননি। আমি নিশ্চিত।”
“হতেও পারে।” বলল সে তারপর হাসল। চমৎকার হাসি, তবে একটুখানি বিষণ্ণতার আভাস ছিল তাতে। “হয়ত সারাক্ষণই সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিলাম, সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছিল না।”
আমি নিজেই আর একটা বিয়ারের ক্যান খুলে তাকে অফার করলাম। মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করল সে। “আমি খুব বেশি একটা বিয়ার খাইনে। ধন্যবাদ, হাঁটাটা অব্যাহত রাখতে হবে আমাকে আগের মতো।”
“দীর্ঘ সময় হেঁটে জুতোর তলায় বালির উত্তাপ অনুভব করছেন না?”
“না আমার জুতোর সোলও মেটাফিজিক্যালি তৈরি। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেননি?”
.
৩.
হ্যাঁ। সে জুতোর ভেতর থেকে তার শীর্ণ পা দুটো বের করে আমাকে দেখাল। সত্যিই সোলগুলো মেটাফিজিক্যাল। আলতো করে সেগুলো স্পর্শ করলাম, না-গরম না-ঠাণ্ডা। সোল স্পর্শ করার সময় ঢেউয়ের অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম। ঢেউয়ের শব্দ পর্যন্ত মেটাফিজিক্যাল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে আবার খুলোম এবং ঠাণ্ডা বিয়ারে চুমুক দিলাম। সূর্য এক ফোঁটাও নড়ল না। সময় স্থির হয়ে রইল। মনে হলো একটা আয়নার ভেতর ঢুকে গেছি। “যখনই আপনার কথা মনে হয়, তখনই আমার স্কুল ভবনের করিডোর স্মরণে আসে। কেন এমন হয় বলে আপনার ধারণা?” সাহস করে জিজ্ঞেস করি।
“মানবতার নির্যাস নিহিত আছে তার যৌগে পরিণত হওয়ার ভেতর” সে বলল, “মানব-বিজ্ঞানের উচিত নয় লক্ষ্যকে খুঁজে বের করা বরং তার খোঁজা উচিত মূল বিষয় যা শরীরের সঙ্গে যুক্ত।”
“হুঁ।”
“যে ভাবেই হোক বেঁচে থাক, বাঁচো, বাঁচো। তাতেই চলবে। তুমি জীবন যাপন করছ এটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। শুধু এটুকুই বলতে পারি। আমি শুধু এমন একটা মেয়ে যার আত্মাটা মেটাফিজিক্যাল।” এবং ইপানিমার মেয়েটি ১৯৬৩/১৯৮২ তার হাঁটু থেকে বালু মুছে উঠে দাঁড়াল।
“বিয়ারের জন্য ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ আপনাকেও।”
মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে সাবওয়ে ট্রেনে দেখা হয়। ‘থ্যাঙ্ক-ইও-ফর দ্য বিয়ার’ হাসি ছুঁড়ে দেয় আমার দিকে। তারপর থেকে আমাদের মধ্যে বাক্য বিনিময় হয় না আর। তবে আমার মনে হয়, আমাদের ভেতর হৃদয়ের যোগাযোগ আছে। জানি না কোথায় আমরা যুক্ত, তবে আমি নিশ্চিত, বন্ধনটি অদ্ভুত দূরের এক পৃথিবীর কোনো খানে আছে। বন্ধনটার কথা ভাবি আমি। বন্ধনটা নীরবে থাকে অন্ধকার করিডোরটার ভেতর যেখান দিয়ে কেউ চলাফেরা করে না। এসব ভাবার সময় অনেক বছরের পুরনো স্মৃতি ধীরে ধীরে আমার মনে এসে ভিড় জমায়। ওখানেও বন্ধন আছে একটা, যা আমাকে ও আমার সত্তাকে যুক্ত করে। অদ্ভুত দূরের পৃথিবীতে কারও সঙ্গে দেখা হবে আমার। আশাকরি ওটা হবে একটা উষ্ণ স্থান। ঠাণ্ডা কিছু বিয়ারের সন্ধান মিললে কিছুই বলার থাকবে না আমার। ওই পৃথিবীতে আমিই স্বয়ং আমি আর স্বয়ং আমিই আমি। বিষয়বস্তু হচ্ছে লক্ষ্য এবং লক্ষ্যই বিষয়বস্তু। কোনো যাওয়া-আসার পথ নেই মাঝখানে। তারা ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। পৃথিবীর কোনো স্থানে এই অদ্ভুত জায়গার অস্তিত্ব আছে।
১৯৬৩/১৯৮২ এর ইপানিমার মেয়ে এখন সমুদ্রতট দিয়ে হেঁটে চলেছে। শেষ রেকর্ডটি ক্ষয়প্রাপ্ত না-হওয়া পর্যন্ত সে বিরতিহীনভাবে হাঁটতে থাকবে…
Post a Comment