গায়ে হলুদ – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রাবণ মাসের দিন, বর্ষার বিরাম নেই, এই বৃষ্টি আসছে, এই আকাশ পরিস্কার হয়েযাচ্ছে। ক্ষেতে আউশ ধানের গোছা কালো হয়ে উঠেছে, ধানের শীষ দেখা দিয়েছে অধিকাংশ ক্ষেতে।
পুঁটি সকালে উঠে একবার চারিদিকে চেয়ে দেখল—চারিদিকে মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। হয়তো বা একটু পরে টিপ-টিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দেবে। আজ তার মনে একটা অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি, সেটাকে আনন্দও বলা যেতে পারে, ছদ্মবেশি বিষাদও বলা যায়। কি যে ঠিক করে না যায় বোঝা, না যায় বোঝানো। আজ তার বিয়ের গায়ে-হলুদের দিন। এমন একটা দিন তার বারো বছরের ক্ষুদ্র জীবনে এইবার প্রথম এলো। সকালে উঠতেই জ্যেঠিমা বলেছে—ও পুঁটি, জলে ভিজে ভিজে কোথাও যেন যাস নি; আর তিনটে দিন কোনো রকমে ভালোয় ভালোয় কেটে গেলি বাঁচি।
আজ কি বার?—মঙ্গলবার! শনিবার বুঝি বিয়ের দিন। পুঁটির মনে সত্যিই কেমন হয়, আনন্দের একটা ঢেউ যেন গলা পর্যন্ত উঠে আটকে গেল। বিয়ে বেশি দূরে কোথাও নয়, এই গ্রামেই, এমন কি এই পাড়াতেই। এক ঘর ব্রাহ্মণ আজ বছরখানেক হলো অন্য জায়গা থেকে উঠে এসেছেন এখানে, দুখানা বড় বড় মেটে ঘর বেঁধেছেন—একখানা রান্নাঘর। এতদিন ধরে সে সঙ্গিনীদের সঙ্গে সেই বাড়িতে কুল পাড়তে গিয়েছে, সত্যনারায়ণের সিন্নি আনতে গিয়েছে, যখন পাড়ার প্রান্তের ঘন জঙ্গল কেটে সে ভদ্রলোক বাড়ি তৈরী করেন ঘাটে যাবার পথে একেবারে ডান ধারে, তখন সে কতবার ভেবেছে এই ঘন বনের মধ্যে বাড়ি করে বাস করবার কার না জানি মাথাব্যাথা পড়ল।
কে জানত, সেই বাড়িটাই—আজ এক বছর এখনও পোরেনি—তবে শ্বশুরবাড়ি হবে!
কতদূর আশ্চর্যের কথা, কতদূর বিস্ময়ের কথা, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। অথচ তারই ক্ষুদ্র জীবনে এমন একটা মহাশ্চর্য ব্যাপার সম্ভব হলো। যখনই সে একথাটা ভাবে তখনই সে সুদ্ধ তার মন সুদ্ধ যেন কতদূরে কোথায় চলে যায়।
ওই ভদ্রলোকের একটি মাত্র ছেলে, নাম সুবোধ, তারই সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে। সুবোধকে এই সন্ধের আগে তাদের বাড়িতে কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখেছে—বেশ ফর্সা, লম্বামতো মুখ, এবার ম্যাট্রিক দিয়েছে, এখনও পরীক্ষার ফল বার হয় নি। আগে আগে, সত্যি কথা বলতে গেলে, সুবোধের মুখ পুঁটি তত পছন্দ করত না। তার দাদার সঙ্গে যতবার এসেছে তাদের বাড়িতে—পুঁটি ভাবত—দেখো না ঘোড়ার মতো মুখখানা। কিন্তু আজকাল আর সুবোধের মুখ ঘোড়ার মতো তো মনে হয়ই না, মনে হয় বেশ চমৎকার মুখ। গ্রামের ছেলেদের মধ্যে অমন চোখ, অমন রঙ, অমন মুখের গড়ন কার আছে?
রায়েদের পুঁটি সেদিন বলেছিল তাকে—হ্যাঁরে, তুই যে বড় ঘোড়ামুখো বলতিস, তোর অদেষ্টে শেষকালে কিনা সেই ঘোড়ামুখোই জুটল!
পুঁটি মারতে ছুটে গিয়েছিল তার পিছু পিছু।
পুঁটির বাবা গোলার দোরে দাঁড়িয়ে ধান পাড়বার ব্যবস্থা করছে। তার বাবা বেশ
চাষীবাসী গেরস্ত। পুঁটিদের বাড়িতে চারটে বড় বড় ধানের আউড়ি আছে, গোলা আছে একটা।
আউড়ি জিনিসটা গোলার চেয়ে অনেক ছোটো, তিন চার বিশ ধান ধরে—আর একটা গোলায় ধরে
এক পৌটি অর্থাৎ ষোলো বিশ ধান।
তাদেরও ধান আছে গোলা ভর্তি, সব কটা আউড়ি ভর্তি। কলকাতায় চাকরি করে এ পাড়ার হরিকাকা, তিনি মাঝে মাঝে গাঁয়ে এসে পুঁটির বাবাকে বলেন—আর কি রায় মশায়, এ বাজারে তো আপনিই রাজা। গোলা ভর্তি ধান রেখেছেন ঘরে, আপনার মহড়া নেয় কে? কলকাতায় ‘কিউতে দাঁড়িয়ে এক সের চাল নিতে হচ্ছে—আর আপনি—
পুঁটি জিজ্ঞেস করেছিল—কিসে দাঁড়িয়ে চাল নিতে হয় বাবা, বলছিল হরিকাকা?
—কে জানে কিসে দাঁড়িয়ে, তুই নিজের কাজ কর, আমি নিজের করি—মিটে গেল।
—তুমি জান না বুঝি ও কথাটার মানে? না বাবা?
—না জেনে তো পায়ের উপর পা দিয়ে এ বাজারে চালিয়ে দিলাম মা। কলিকাতার মুখ না দেখেও তো বেশ চলে যাচ্ছে।
কলকাতায় নাকি মানুষের এক সের চালের জন্য চার ঘণ্টা কোথায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়—কিন্তু যে বাড়িতে তার বিয়ে হচ্ছে, তাদের অবস্থা এত ভালো নয়। সুবোধ যদি পাস করে, তবে হরিকাকা ভরসা দিয়েছেন কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাকে ওঁর অফিসে চাকরি করে দেবেন। তা হলে তাকেও কি কলকাতায় গিয়ে বাসায় থাকবে হবে আর সেই কিসে দাঁড়িয়ে রোজ এক সের চাল নিয়ে এসে রাঁধতে হবে? সে বড় কষ্ট—তবে, মানে সুবোধ যদি সঙ্গে থাকে, সে বোধহয় সব রকমই কষ্টই করতে প্রস্তুত আছে।
তাদের ধানের গোলা থেকে ধান পাড়া হচ্ছে, খাবরাপোতা থেকে সীতানাথ কলু আড়তদার এসেছে—ধান কিনে নিয়ে যাবে। বিয়ের খরচপত্র ধান বেচে করতে হবে কিনা।
ওর জ্যেঠিমা বললেন, ও পুঁটি আজ কোথাও বেরিও না। নাপিত ও বাড়ি থেকে হলুদ নিয়ে আসবে, সেই হলুদ গায়ে দিয়ে তোমায় নাইতে হবে।
এমন সময় সাধন জেলে এসে ভিজতে ভিজতে উঠোনে দাঁড়াল। হাত জোড় করে মাথা নিচু করে প্রণাম করে বলল, পাতপেন্নাম।
তার বাবা বললে—ও সাধন, বাবা তোমায় ডেকেছি যে একবার। আমার যে কিছু মাছের দরকার এই শনিবারে।
কি জানি কেন পুঁটির বুকটা দুলে উঠল। এই শনিবার—এই শনিবারে তা হলে সত্যিই তার—
সাধন বলল—আজ্ঞে, মাছের যে বড্ড গোলমাল যাচ্ছে। গাঙে কি মাছ আছে? ডুমোর বাঁওড়ের মাছ সব যাচ্ছে কলকাতায়। বিরাশি টাকা দর। এমন দর বাপের জম্মে কোনো কালে শুনি নি রায় মশায়। এক সের পোনা ইস্তক পড়তে পাচ্ছে না। মরগাঙে বাঁধল দিয়েলাম—একদিন কেবল এক সাড়ে এগার সের গজাড় মাছ—
পুঁটির বাবা বিস্ময়ের সুরে বললে—সাড়ে এগার সের গজাড়! এমন কথা তো কখনও শুনি নি—
—অরিবত গজাড় রায় মশায়। মাছের এমন দর, গজাড় মাছই বিক্রি হলো দশ আনা সের।
পুঁটি আর দাঁড়াল না। মাকে এমন আজগুবি খবরটা দিতে ছুটল বাড়ির মধ্যে। বৃষ্টি একটু থেমেছে, একটু বেরুতে পারলে ভালো হতো। তার জীবনে যে একটা আশ্চর্য ব্যাপার হতে চলেছে এ কথাটা কারও সঙ্গে আনন্দ করে বলাও চলে না। বেহায়া বলবে, নিন্দে করবে। কেবল বলা চলে তার সমবয়সী পাঁচি, আর ক্ষেন্তি জেলেনির মেয়ে টুনির কাছে। আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার—তার চেয়ে অন্তত সাত বছরের বড় লতিদিদির এখনও বিয়ে হয় নি—অথচ লতিদিকে সবাই বলে সুন্দরী, লতিদির বাপের অবস্থা ভালো। লতিদি লেখাপড়া জানে ভালো। গান করে, ওর বাবা যখন কলকাতা চাকরি করত, তখন লতিদি স্কুলে পড়ত সেখানে।
কত বই পড়ে বসে বসে দুপুর বেলা। পুঁটি ভালো লেখাপড়া জানে না, লতিদি একটু ঠ্যাকারে, সে লেখাপড়া জানে না বলে বুঝি আর মানুষ না?
তাকে বলে—তুই বই-টই নাড়িস নে পুঁটি। কি বুঝিস তুই এর আস্বাদ?
পুঁটি হয়তো বলে—এ কি বই বল না লতিদি?
—যা যাঃ, আর বইয়ের খবরে দরকার নেই। শরৎ চাটুজ্জ্যের নাম শুনেছিস? কোথা থেকে শুনবি? তোরা তো শুধু জানিস ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে কি করে চিঁড়ে কুটতে হয়। তাই করগে যা—এদিকে কেন আবার?
আচ্ছা, আজ তার লতিদিকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে—কই লতিদি, তুমি এত বই পড়ে টড়ে বসে আছ, এতসব নাম জান—কই তোমার তো আজও বিয়ে হলো না। আমার জীবনে এত বড় একটা আশ্চর্যি কাণ্ড তো টুক করে ঘটে গেল। ধানের নিন্দে কর, বাবার গোলায় ধান ছিল বলেই তো আজ—কই তোমাদের তো—তারপর ম্যাট্রিক পাস বর। এ গাঁয়ে পাস করা ছেলে একমাত্র আছে মুখুজ্জেদের জীবনদা।
সে নাকি দুটো পাস—কোথায় চাকরি করছে যেন—যেন ঐ দিকে কোথায়। যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছে, সে মুখ্যু নয়। পাসের খবর বেরুবার দেরি নেই—বাবা বলেন, সুবোধ নিশ্চয়ই পাস করবে। হে ভগবান, তাই যেন করো, পাস যেন সে করে, সত্যনারায়ণের সিন্নি দেবে সে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে।
নাপিত এসে বললে—মা ঠাকুরুন, ও বাড়ি থেকে দেখে এলাম। গায়ে হলুদের লগ্ন বেলা দশটার পর। আপনাদের যা দিতে হবে তার আগে দিয়ে দেবেন।
গায়ে হলুদের তত্ত্ব আসবে ও বাড়ি থেকে। কি রকম জিনিসপত্র না জানি আসে। পুঁটির মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। একখানা লাল কাপড় নিশ্চয়ই দেবে। পুঁটির মোটে তিনখানা শাড়ি আর একখানা ডুরে শাড়ি আছে মায়ের বাক্সে তোলা। এবার তার অনেক কাপড় হবে, গহনাও হবে। পাঁচ ভরি সোনা দেবার কথাবার্তা হয়েছে। এতদিন দুটি দুল ছাড়া অন্য কোনো গহনা তার অঙ্গে ওঠেনি—অথচ ও কুমারী মেয়ে লতিদিরই হাতে ছ’গাছা করে চুড়ি, গলায় লকেট ঝোলানো হার, কানে পাশা, হাতে আংটিও আছে। ও থাকত শহরে, সেখানে মেয়েদের চালচলন আলাদা। এ সব পাড়াগেঁয়ে মেয়েরা কাঁচের চুড়ি ছাড়া আবার কি গহনা পরে? অত পয়সাও নেই তার বাপের। গোলায় দুটো ধান আছে মাত্র, নগদ পয়সা কোথায়। যা কিছু করতে হয়, সে ঐ ধান বেচে।
ভীষণ বৃষ্টি এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে সামান্য ঝড়। রান্নাঘরের ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে বকনা বাছুরটা ভিজছে। কচুপাতায় জল জমে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাদের কৃষাণ বীরু মুচি বলছে—ও দিদি ঠাকরোণ, তা একটু তামাক দ্যাও মোরে, বিয়েবাড়ি যে মনেই হচ্ছে না। দুই-দশ ছিলিম তামাক পোড়বে তবে তো বুঝব যে নগনশা লেগেছে। পুঁটি বিরুকে ধমক দিয়ে বলল—যাঃ, তোর আর বক্তৃতা দিতে হবে না। তামাক আমি কোথায় পাব? কাকিমার কাছে গিয়ে চাইগে যা—
একটু বেলা হয়েছে। বাড়িতে অনেক লোক এসেছে বিয়ের জন্য। বিয়েবাড়ির মতো দেখাচ্ছে বটে—কুমোরপুরের কাকিমা, পাঁচঘর মাসিমা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছেন—আজ বেলা এগারোটার সময়ে আরও একদল আসবে, ইস্টিশানে গাড়ি গিয়েছে। মেয়েরা সবাই দল বেঁধে নদীতে নাইতে গেল। কুমোরপুরের কাকিমা যাবার সময়ে তাকে বলে গেল—বাঁড়ুজ্জে বাড়ি পিঁড়ি চিত্তির করতে দিয়ে আসা হয়েছে, দেখে আসিস পুঁটি সে-দুখানা পিঁড়ি হয়েছে কি-না। কাকিমার এটা অন্যায় কথা। তার লজ্জা করে না? নিজের বিয়ের পিঁড়ি নিজে বুঝি সে চাইতে যাবে? এত বেহায়া সে এখনও হয় নি।
তার বাবা চন্ডিমণ্ডপ থেকে হেঁকে বললেন—ও পুঁটি হাতায় করে একটু আগুন নিয়ে এসো মা—
চণ্ডিমণ্ডপের দোর পর্যন্ত গিয়ে শুনল ওর বাবা আর এখন অজ্ঞাত লোকের মধ্যে নিন্মোক্ত
কথাবার্তা:
—তাহলে পালকির বন্দোবস্ত দেখতে হয়—
—আজ্ঞে পালকি কোথায় মিলবে? ষোলডুবুরির কাহারপাড়া নির্বংশ। পালকি বইবার মানুষ নেই এ দিগের।
—তবে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসো বনগাঁ থেকে।
—এ কাদা-জলে দশ টাকা দিলেও আসবে না। আসবার রাস্তা কই?
—ওরা বিদেশী লোক। বর আসবার ব্যবস্থা আমাদেরই করে দিতে হবে। বুঝলে না? আমরাই
পারছি নে, ওরা কোথায় কি পাবে? হিম হয়ে বসে থেকো না। যা হয় হিললে লাগিয়ে
দ্যাও একটা।
—আচ্ছা বাবু, বলদের গাড়িতে বর আনলি কেমন হয়?
—আরে না না। –সে বড় দেখতে খারাপ হবে। সে কি—না না। শুনছি ওরা ইংরিজি বাজনা
আনছে। বলদের গাড়ির পেছনে ইংরিজি বাজিয়ে বর আসবে, তাতে লোক হাসবে।
—কেন বাবু তাতে কি? বলদের গাড়িতে কি বর যায় না? একেবারে আপনাদের বাড়ির
পেছনে এসে থামবে—সেই তো ভালো।
—বলদের গাড়িতে বর যাবে কেন? সে কি আর ভদ্দরলোকের বর যায়? তা ছাড়া পেছনের ও
পথ আইবুড়ো পথ। ওখান দিয়ে বর আসবে না, সামনের তেঁতুল তলার রাস্তা দিয়ে বরকে আনতে
হবে। তুমি আজকেই যাও দিকি ষষ্ঠীতলা। সেখানে ক’ঘর কাহার আছে শুনিছি। সেখান
থেকেই পালকি আনতে—
—সে যে এখান থেকে তিনকোশ সাড়ে তিনকোশ রাস্তা বাবু।
পুঁটি আর সেখানে দাঁড়াল না। সুবোধ বর সেজে আসবে বলদের গাড়িতে? হি –হি—সে বড় মজা
হবে এখন। ধুতরো ফুলের মালা গলায় দিয়ে?
দৃশ্যটা মনে কল্পনা করে নিয়েই হাসতে হাসতে পুঁটির দম বন্ধ।
—ও তিনু—তিনু রে—শোন শোন একটা মজার কথা—
তিনু চার বছরের খুড়তুতো ভাই। উঠোনের নিচে দিয়েই যাচ্ছে। সে মুখ উঁচু করে ওর দিকে চেয়ে বললে—কি লে ডিডি?
—জানিস? এই আমাদের বাড়ি বর আসবে—
—বল?
—হ্যাঁ-রে। ধুতরো ফুলের মালা পরে বলদের গাড়ি চেপে ইংরিজি বাজনা বাজিয়ে—হি—হি—
তিনু না বুঝে হাসলে—হি—হি—
এই সময়ে ওদের জ্যাঠাইমা বাড়ির ছেলেমেয়েকে ডাক দিলেন—ওরে, সবাই এসে কাঁঠাল খেয়ে যা—ও হিমু, পান্তা ভাত কে কে খাবে ডাক দিয়ে নিয়ে আয়। এক হাঁড়ি পান্তা রয়েছে। সেগুলো কাঁঠাল দিয়ে ওঠাতে হবে। এই যুদ্ধের বাজারে—
পান্তা ভাত ও কাঁঠাল পুঁটির অতি প্রিয় খাদ্য। কিন্তু আজ এখন তার খাবার নাম করার জো নেই—খিদেও পেয়েছিল, ইচ্ছে করলে সে কলসি থেকে কাঁঠাল-বীচি ভাজা আর মুড়ি লুকিয়ে পেড়ে নিয়ে খেতে পারত—কিন্তু সে ইচ্ছে তার নেই। তাতে ভগবান রাগ করবেন। আজকের দিনে সে ভগবানকে রাগাবে না। বেলা বাড়ল। ও বাড়িতে শাঁক ও হুলুর শব্দ শোনা গেল। অবিশ্যি খুব কাছে নয় পুঁটির ভাবী শ্বশুরবাড়ি। তা হলেও শাঁকের শব্দ না আসবার মতো দূরও নয়। ওর খুড়তুতো বোন শ্যামা বললে—ওই শোন দিদি, দাদাবাবুর গায়ে হলুদ হচ্ছে—পুঁটি ধমক দিয়ে বললে—চুপ। মেরে ফেলে দেব। দাদাবাবু কে?
-বা-রে, হয়েছেই তো—আর তো দুদিন দেরি—
—না। তা হোক। আগে বলতে নেই।
জ্যাঠাইমা তো বলছে?
—কি বলছে?
—বলেছে, আমাদের জামাইয়ের গায়ে হলুদ হচ্ছে—সেখান থেকে তত্ত্ব নিয়ে নাপিত এবার এসে পৌঁছে যাবে—
—না। তা হোক। আগে বলতে নেই।
—আচ্ছা দিদি-দাদাবাবু—ইয়ে সুবোধবাবু পাস করেছে?
—খবর এখনও বের হয়নি।
—আমি ও পাড়ার রাধীদের বাড়ি গিয়েছিলাম এই এট্টু আগে। রাধীর দাদা পাস করেছে, কাল বিকেলে কলকাতা থেকে ওর কাকা খবর দিয়েছে।
—তোর দাদাবাবুর—ইয়ে মানে ওর—দূর, এই কেশববাবুর ছেলের খবর কে পাঠাবে কলকাতা থেকে? ওদের তো কেউ নেই কলকাতায়।
একটু পরে ওদের বাড়িতে শাঁক বেজে উঠল, হুলু পড়ল। নাপিত তত্ত্ব নিয়ে আসছে তেঁতুলতলার পথে, বাড়ি থেকে দেখা গিয়েছে।
পুঁটির বুক আনন্দে দুলে উঠল—জ্যাঠাইমা বলছিলেন, আশীর্বাদ হয়ে গেলেও বিয়ে না হতে পারে, কিন্তু গায়ে হলুদ হয়ে গেলে বিয়ে নাকি আর ফেরে না। এবার তাহলে সেই আশ্চর্য ব্যাপারটা তার জীবনে ঘটে গেল।
কেউ আর বাধা দিতে পারবে না। পাড়াগাঁয়ে কত রকমে ভাঙচি দেয় লোকে। তার বিয়েতেও ভাঙচি দিয়েছিল। বলেছিল, মেয়ের রঙ কালো, মুখ-চোখ ভালো না—লেখাপড়া জানে না—আরও কত কি। কিন্তু সুবোধ—না। ছিঃ, ওর নাম করতে নেই, নাম হিসেবে মনে ভাবতে নেই।
তারপর বাকি অনেকগুলো কি ব্যাপার স্বপ্নের মতো তার চোখের সামনে দিয়ে ঘটে গেল। শাঁকের ডাক, হুলুধ্বনি, মা, কাকিমা, জ্যাঠাইমা তাকে তেল-হলুদ মাখিয়ে দিলেন। গায়ে হলুদের তত্ত্ব এলো লালপেড়ে শাড়ি, তেল-হলুদ, একটা বড় মাছ, এক হাঁড়ি দই। তার সমবয়সী বন্ধু তিনজন খেতে এলো তাদের বাড়ি। তাকে কাছে বসিয়ে কত যত্ন করে মাছ দিয়ে, দই দিয়ে, মা জ্যাঠাইমা কত আদর করে খাওয়ালেন, কত মিষ্টি কথা বললেন। সোনার পিঁড়িতে সিঁদুর দেওয়া হলো, প্রদীপ দেখানো হলো, –যাতে শুন্য ধানের গোলা সামনের ভাদ্র মাসে আউস ধানে অন্তত অর্ধেকটা পুরে যায়। বাবা বলেন, গোলার ধান খালি হয়ে যেত না। মধ্যে কি একটা গভর্নমেন্টের হাঙ্গামা এলো—কেউ গোলায় ধান জমিয়ে রাখতে পারবে না, তাতেই অনেক ধান কর্জ দিতে হলো গ্রামের লোকজনকে।
গায়ে হলুদের তত্ত্বে আরও অনেক জিনিস এসেছিল, খাওয়া-দাওয়ার পরে গাঁয়ের মেয়েরা কেউ কেউ দেখতে এলো—তখন সে নিজেও দেখল। আগে লজ্জায় ওদিকেও সে যায় নি। একটা শাড়ি, একটা ব্লাউজ, সায়া একটা—আলতা, সাবান, আয়না আর গন্ধতেল। এ সব জিনিস তার নিজস্ব। কারও ভাগ নেই এতে। সে ইচ্ছে করে যদি কাউকে দেয় তবেই সে পাবে, নইলে নিজের বাক্সে রেখে দিতে পারে, কারও কিছু বলবার নেই।
সব কাজ মিটতে বেলা দুটো পার হয়ে গেল।
পুঁটির মন ছটফট করছিল, ওপাড়ার লতিদি, হিমি, অন্ন, রাধী—এরা কেউ আসে নি—এদের গিয়ে একবার দেখা দেওয়া দরকার–যাতে তারা বুঝতে পারে যে, তার গায়ে হলুদের মত আশ্চর্য ব্যাপারটা আজ সত্যিই ঘটে গিয়েছে। আচ্ছা, যখন ইংরিজি বাজনা বাজিয়ে বর আসবে তাদের বাড়ির দোরে তেঁতুলতলার ওই পথটা দিয়ে, বোধনতলার কাছে পালকি নামিয়ে প্রণাম করে—বাজি পু্ড়বে, লোকজনের হৈ হৈ হবে—ওঃ সে সময়ের কথা ভাবাও যায় না।
দ্যাখে যেন পাড়ার সব মেয়েরা এসে।
সে বেড়াতে বেড়াতে গেল মুখুজ্জেদের বাড়ি। মুখুজ্জেগিন্নি ওকে দেখে বললেন—কি রে পুঁটি, আয় মা আয়। গায়ে হলুদ হয়ে গেল? আহা, এখন ভালোয় ভালোয় দু-হাত এক হয়ে গেলে—বোসো মা, বোসো।
একটু পরে লতিকাও হাজির হলো। পুঁটিকে দেখে বললে, ও পুঁটি, তোর আজ গায়ে হলুদ ছিল না: হয়ে গেল? কি তত্ত্ব এলো শ্বশুরবাড়ি থেকে?
মুখুজ্জেগিন্নি বললেন—বোস মা তোরা। লতি, পুঁটির সঙ্গে গল্প কর। একটু চা করে আনি। যাক, ভালোই হলো, আজকাল মেয়ের বিয়ে দেওয়া যে কী কষ্ট, যে দেয় সে-ই জানে!
পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে গাঙ্গুলীদের ছোট বৌ ডেকে বললে—ও কে, পুঁটি নাকি? গায়ে হলুদ হয়ে গেল? তা কই আমাদের একবার বলতেও তো হয়? এই তো বাড়ির পেছনে বাড়ি—
পুঁটি বললে—গেলেন না কেন বৌদি? আমরা তো বারণ করিনে যেতে। শাঁক যখন বাজল, তখনও যদি যেতেন—
লতিকা ভাবলে, পুঁটি ছেলে মানুষ, এ উত্তরটা দেওয়া উচিত হলো না। এখানে ও কথা বলা ঠিক হয় নি। কিন্তু এর পরবর্তী ব্যাপারের জন্য সে বা পুঁটি কেউ প্রস্তুত ছিল না। গাঙ্গুলীদের ছোট বৌ মুখ লাল করে উত্তর দিলে—কি বললি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আমরা কখনও গায়ে হলুদ দেখি নি, শাঁকে ফুঁ পড়লে অমনি কুকুরের মতো ছুটে যাব তোমাদের বাড়ি পাতা পাততে। অত অংখার ভালো নারে পুঁটি। তোমার বাপের বড্ড ধানের গোলা হয়েছে না? অমন বিয়ে আমরা কখনও কি দেখিছি জীবনে? ছেলের না আছে চাল, না চুলো—সংসারে মানুষ নেই বলে হাড়ি ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলের বিদ্যে কত, তা জানতে বাকি নেই—এবার তো ম্যাট্রিক ফেল করেছে—
এখানে লতিকা আর না থাকতে পেরে বললে—কে বললে ছোট বৌদি? সুবোধবাবুর পাসের খবর তো পাওয়া যায় নি?
—কেন পাওয়া যাবে না? চিঠি এসেছে ফেল করেছে বলে—ওরা সে চিঠি লুকিয়ে ফেলেছে। বিয়ের আগে ও খবর জানাজানি হতে দেবে না। উনিই হাট থেকে চিঠি আনেন। পোস্টকার্ডে চিঠি। উনি সন্ধের পর সুবোধদের বাড়ি দিয়ে এলেন। আমাদের চোখে ধুলো দেওয়া—
পুঁটির সামনে সব অন্ধকার হয়ে বিশ্বসংসার লেপে পুছে গিয়েছে। মুখরা দর্পিত ছোট বৌয়ের মুখের কাছে সে কি করে দাঁড়াবে। চেঁচামেচি শুনে মুখুজ্জেগিন্নি হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন, লতিকা ওর হাত ধরে নিয়ে ঘরের মধ্যে গেল।
মুখুজ্জেগিন্নি ঘরের মধ্যে এসে চাপা গলায় বললেন—আহা, ছেলেমানুষ—ওর সাধ-আহ্লাদের দিনটাতে অমন করে বিষ ছড়াতে আছে—ছিঃ ছিঃ—দ্যাখ তো মা লতি কাণ্ডটা—
কাঠের পুতুলের মতো আড়ষ্ট পুঁটির হাত ধরে ততক্ষণ লতিকা বলছে—চল চল পুঁটি তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি—ছিঃ, বৌদির কাণ্ড! ও সব কথা মনে করিস নে, মিথ্যে কথা। চল পুঁটি—ভাই—
লতিকার গলার সুরে ও কথার ভাবে কিন্তু পুঁটির মনে হলো লতিদিও এ খবরটা জানে—কি জানি হয়তও গাঁয়ের সবাই জানে—সে-ই কেবল জানত না এতোক্ষণ। পথে পা দিয়েই লজ্জায় অপমানে সে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেলে বললে—লতিদি, আমি কী বলেছিলাম ছোট বৌদিকে?—খারাপ কিছু?
Post a Comment