গুদোমে গুমখুন – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
পাল্লার একদিকে সুখ আর একদিকে দুঃখ। দুঃখের দিকটাই ঝুলে আছে। সুখ যে একেবারেই নেই, বলি কী করে! বেঁচে তো আছি, মরে তো যাইনি। দু-বেলা দুমুঠো জুটছে। মাথার উপরে ছাদ আছে। চেয়ার আছে, টেবিল আছে। বিছানা আছে। তবে চাদরটা সরাবেন না। তোশকে একটা-দুটো খাবলা দেখতে পাবেন। তুলোর ডেলা দাঁত বের করে আছে। তা হবে না। ফর্টি ইয়ারস ফেইথফুল সার্ভিস দিয়ে আসছে। আমার বউয়ের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছিল। আমার বউ আমার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে এসেছিল আগে। একদিন পরে একটা লরি চেপে এসেছিল যাবতীয় ফাউ। বউয়ের ফাউ সাধারণত যা আসে। চাইলেও আসে, না চাইলেও আসে। একটা খাটের বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ফুলশয্যার খাট খোলা অবস্থাতেই আসে। মাথার দিক, পায়ের দিক, দুটো সাইড, দু-পিস চালি, আটখণ্ডে ছতরি। পরে ফিট করে নিতে হয়। একমাত্র মড়ার খাটই ফিট হয়ে আসে।
এইসব জানা কথা আর জানিয়ে লাভ নেই। অবান্তর সেন্টিমেন্ট। চল্লিশ বছর আগে বয়েস যখন পঁচিশ, কে আর ভেবেছিল মরতে হবে। খাটের সঙ্গে ড্রেসিং টেবিল এসেছিল, একটা লোহার আলমারি, তাগড়া একটা ছোবড়ার গদি, লেপ, তোশক, বালিশ। মনে আছে, সাইলেনসার ফাটা লরিটা যখন বিকট শব্দ করে আসছিল আমি তখন নতুন ধুতি, কোরা গেঞ্জি পরে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলুম। ঢ্যাঙা আলমারিটা দুলছিল বিজ্ঞের মতো। যেন কথা বলছিল, হুঁ হুঁ বাব্বা, আমি আসছি। খাঁজে খাঁজে, ভাঁজে ভাঁজে, পাটে পাটে ভরবে জীবনের আবর্জনা। ধুতি, শাড়ি, জামা, প্যান্ট, শাল, সোয়েটার, কার্ডিগান। লকারে কিছু গয়না। নগদ দু একশো, ইনশিয়োরেনসের পলিসি, বার্থ সার্টিফিকেট। পাল্লাটা যতবার খুলবে, ধড়াস শব্দ। জীবনের ওইটাই জাতীয় সংগীত। বেশ আছ। বেশ আছ, হঠাৎ ধড়াস। শ্বশুরমশাই একটা ইজি চেয়ারও দিয়েছিলেন। কেন তা জানি না।
হয়তো ওই ত্রিভঙ্গের ভাষায় বলতে চেয়েছিলেন, বাবাজীবন, টেক ইট ইজি। সারাজীবন একটা বুটিদার এঁচোড়কেই তো আলিঙ্গন করতে হবে। সারফেসটা রাফ। আঠা আছে। তেল মেখে ছাড়াতে হবে। তেল হল ধৈর্য, সহনশীলতা। আর মেজাজের গরমমশলা দিয়ে ভালো করে কষতে পারলে বেশ সুস্বাদু। বাবাজীবন, টেক ইট ইজি। ছোবল মারবে, তবে মরবে না, নেশা হবে। তখন এই ত্রিভঙ্গে দেহভার এলিয়ে দিয়েও আরাম। পাবে।
সেই সব জিনিস চল্লিশ বছর ধরে রয়েছে। এখন অবশ্য দাঁত বের করে আছে। প্রাচীন হয়েছে তো। রং, পালিশ চটে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় মুখ সুপার ইম্পোজ করলে মনে হয় পক্স হয়েছিল। কালো কালো দাগ। দিশি কাচের শেষ অবস্থাটা এইরকমই। তবে আয়না জিনিসটা খুব সহজ নয়। ঘোর দার্শনিক। আত্মদর্শন করায়। মানুষ সব দেখতে পায় না। নিজের মুখ দেখতে পায় না। আয়না দেখায়। যুবকের পালিশ করা মুখ, প্রৌঢ়ের তোবড়া মুখ, বৃদ্ধের বিদায়ী মুখ। শেষ অবস্থায় ফেড আউট। আয়না আর কিছু দেখাবে না, প্রয়োজন নেই। তুমিও যাচ্ছ, আয়নাও যাচ্ছে।
চল্লিশ বছর আগে এইসব ভাবিনি। পঁচিশে পঁয়ষট্টির ভাবনা আসবে কেন। তখন তো। মোড়কখোলা যৌবন। তাজা চানাচুরের মতো মুচমুচে। বেঁচে থাকার ড্যাম্প লাগেনি। বন্ধুকে বন্ধু মনে হয়, প্রতিবেশীকে আত্মীয়। মানুষকে মানুষ মনে হয়। বাঘ, সাপ, শেয়াল, ছুঁচো, বাইসন, বিছে মনে হত না। ঝকঝকে দেয়াল, ঝলমলে আলো, টলটলে বউ। সে আবার প্রেম করে বিয়ে। কেলেঙ্কারি কাণ্ড বইকি! চল্লিশ বছর আগে উপন্যাসের পাতা ছিঁড়ে সিনেমার পরদা ফুড়ে। অনুশাসনের বাঁধ ভেঙে প্রেমের জোয়ার আসেনি। ব্যাভিচার ছিল, প্রেম উঁকি মারছিল, তবে বিয়ে হত না। অভিভাবকদের এক থাপ্পড়ে প্রেম চটকে যেত। বেশির ভাগ ঘায়েল হত মেয়েরা। তাদের
সরিয়ে নেওয়া হত। গৃহবন্দি, নজরবন্দি। তাড়াতাড়ি ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়া হত। প্রেমের মতো পাপ আর নেই। প্রেম করে বিয়ে? মামার বাড়ি? আমরা তোমার বিয়ে দেব, দেখে-শুনে। সম্বন্ধ করে। ছেলে দেখব, ঘর দেখব, পেশা দেখব। বিয়ের পর মশারির ভেতর যত পারো প্রেম করো, রাত এগারোটার পরে, গুরুজনরা শুয়ে পড়লে, তার আগে কখনওই নয়। প্রেমের কথা বলবে ফিশফিশ করে। কেউ যেন না শুনতে পায়। আই লাভ ইউ বলে ধিতিং ধিতিং নেচো না। ললেস লাভার হলে ঠান্ডা করে দেব। মানে সাইলেনসার লাগানো রিভলভার। মাঝরাতে স্বামী-স্ত্রী প্রেমের কথা বলবে চুপিচুপি। মোড়ের মাথার মাঝরাতের উন্মাদ কুকুরের মতো চিকার ছেড়ো না।
আমার প্রেম ফুল প্রেম ছিল বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। হাফ প্রেম। প্রেমের মতো। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাইনি, ইলোপ করিনি প্রেমিকাকে। পেটানিও খাইনি। কোনও রাইভ্যালও ছিল না। আমাদের পাড়ারই মেয়ে। আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল। আমার বাবাকে কাকাবাবু বলত। ইংরেজি, অঙ্ক আটকে গেল আমার পণ্ডিত পিতার কাছে তালিম নিত। আমাদের বাড়িতে তার খুব সুখ্যাতি ছিল। আমি কতটা গবেট বোঝাবার জন্যে তার উপমা টানা হত। ইনটেলিজেন্ট, ভেরি শার্প। চোখা মেয়ে। এমন কথাও শুনতে হত, লেখাপড়ায় ও একদিন তোমার কান কেটে ছেড়ে দেবে। তারপরে একটা উপসংহার হত, হবে না কেন! মেয়েদেরইতো যুগ আসছে, গান বাজনা-নাচ-ছবি আঁকা-লেখাপড়া সব একসঙ্গে সামলাতে পারে মেয়েরা। ডিভেশন আছে, সিনসিয়ার, সিরিয়াস। কমপিটিটিভ পরীক্ষায় মেয়েরা মাস্টার্স ডিগ্রিতে মেয়েরা ফার্স্ট। তোমরা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান করে যাও। লজ্জা হওয়া উচিত। পায়ের ধুলো নাও। প্রার্থনা করো, মানুষের মতো একটু বুদ্ধি দাও মা। এ লজ্জা রাখি কোথায়, বোভাইন ব্রেন ইন এ হিউম্যান ক্রোনিয়াম।
হিংসে হত, রাগ হত। এত সুখ্যাতি কীসের। বাবার সামনে টেবিলে বসে মাথা নীচু করে অঙ্ক কষছে এক মনে। ঘাড়ের কাছে এলো খোঁপা। বিপরীত দিকের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে চুলে। চকচক করছে। ঢালু কপাল। বড় বড় চোখের পাতা। ধারালো মুখ। মোলায়েম রং এর শাড়ি। গোল গোল হাত। অঙ্ক না পারি ভালোবাসতে তো পারি।
প্রেমে পড়ে গেলুম। একতরফা প্রেম। পেছন থেকে দেখি, পাশ থেকে দেখি। মুখে কিছু বলি না। প্রেমকে স্পর্শ করতে হয়। খুব সাবধানে এগোতে হয়, ছোট্ট নিরীহ, কালো পিপড়ের মতো। হাত বেয়ে, পা বেয়ে, ঘাড় বেয়ে উঠতে হয়। ডুমো মাছির মতো ভ্যানভ্যান করলে হয় না। বাবা হয়তো উঠে গেছেন, কি সেইদিনের মতো অফিসে চলে গেছেন, সে বসে বসে পড়ছে, আমি তখন খুব সেবা করার চেষ্টা করতুম। জল এনে দিচ্ছি, পেনসিলের শিস বেড়ে দিচ্ছি, গরম তেলেভাজা এনে খাওয়াচ্ছি। আপত্তি করত না। সেবা নিত। তার মানে, ওষুধ ধরেছে। প্রেমেও অ্যালোপ্যাথি, হোমিয়োপ্যাথি আছে। ধাত বুঝে। যদি বেড়ে যায়, মানে রেগে যায়, তার অর্থ এই নয় যে ফেঁসে গেল। হোমিয়োতে প্রথমে বাড়ে তারপরে কমে।
নির্লজ্জ না হলে প্রেম হয় না। মান-সম্মান বোধ নিয়ে অফিসের বড় কর্তা হওয়া যায়, প্রেমিক হওয়া যায় না। চোরের মতো দুর্বল জায়গায় রাতের অন্ধকারে সিঁদ কেটে প্রথমে মাথাটা গলাতে হয়। ছেলেগিরি না ফলিয়ে আমি দাসভাবে তার উপাসনা করেছিলুম। ম্যায় গুলাম, ম্যায় গুলাম। অত বড় একটা শিবঠাকুর, যাঁর পাওয়ারের কোনও সীমা ছিল না, রেগে গেলে নটরাজ, দক্ষের যজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ করে দিলেন যিনি, যাঁর দলে নন্দী-ভৃঙ্গি, হাতে ত্রিশূল, গলায় বিষধরের লকেট, তিনি হয়ে গেলেন চিত, বুকের পাটায় মা কালী। পদতলে পড়ে ভোলা। এই হল সারেন্ডার। মেয়েদের পায়ে পড়তে হয়। আমাদের বাড়িতে সেকালে কাপড় বিক্রি করতে আসত ফিরিঅলা। পিঠে কাপড়ের বোঝা। সামনে একটু ঝুঁকে আছে। হাতে একটা লোহার সরু ডাণ্ডা। সেটা হল গজকাঠি। নিঃশব্দে চোরের মতো কুঁজো হয়ে ঢুকল। সেই যে ঢুকল বেরোবার আর নাম নেই। নিস্তব্ধ দুপুর। ঘুঘুর বিশ্রম্ভালাপ। কর্তারা কাছারিতে। ঠান্ডা লাল মেঝেতে ছত্রাকার শাড়ি। মেয়েরা ঘিরে বসে আছে। রঙের বাহারে চিত্তজয়। মেয়েদের অন্তরে সিঁদিয়ে গেছে শাড়িওলা। প্রেমের ফিরিঅলাকেও এই কায়দাতেই ঢুকতে হয়। দুর্গাজয় বরং সহজ মেয়েদের মন জয়ের চেয়ে।
আমার ফ্রেন্ড কৈলাস বলেছিল, বর্ষাকালে ময়ূর দেখেছিস? আমি দেখেছি শান্তিনিকেতনে। সবুজে সবুজ। সাদা ফুল, হলুদ ফুল, মাধবী, কুন্দ, গুলঞ্চ, বকুল। ময়ূর হঠাৎ পেখম খুলল। আহা! সে কী দৃশ্য রে ভাই! অবিশ্বাস্য সুন্দর। ময়ূরকণ্ঠী রঙের শিহরন। গায়ে কাঁটা দেয়। ময়ূর নাচছে। ঘুরে ঘুরে। নেচেই চলেছে খড়খড়ে পায়ে। শুধুমাত্র একটি ময়ূরীর জন্যে। ধৈর্য চাই, নিষ্ঠা চাই, সাধনা চাই। ধর তক্তা মার পেরেক নয়। চা তৈরির কায়দা। একফুটের জলে, দু চামচে দার্জিলিং, ঢাকা। ঘড়ি ধরে পাঁচমিনিট ধ্যান। কাপে ঢালো। সোনালি তরল, ভুরভুরে গন্ধ, পরিমাণ মতো দুধ, চিনি। এর নাম প্রেম। রুটি সেঁকা দেখেছিস? চাটু থেকে উনুনে। ফোঁস করে ফুলল। এই ফোলাটা প্রেম। বেশিক্ষণ থাকবে না ফোলাটা থেবড়ে যাবে। এই থেবড়ানো অবস্থাটা হল দাম্পত্য জীবন। ওপর-নীচ এক। বুকে পিঠে সেঁটে গেল। এই হল থিয়োরি। এইবার প্র্যাকটিস।
প্রেমের সঙ্গে গান আসে। যেমন সর্দির সঙ্গে জ্বর। সেই সময়কার হিট গান শোনো কথাটি শোনো অভিমানে যেও না চলে। তোলো, তোলো, ও মুখ ভোলা কেন লাজে নীরব হলে। আর একটা ছিল, মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দেব খোঁপায় তারার ফুল। সারাদিন এইসব গান হু হু হুঁ করতুম। সবুজ আরও সবুজ, নীল আরও নীল। প্রেমযমুনায় হয়তো বা কেউ ঢেউ দিল রে। রাতে বিছানায় শুয়ে মনে হত, উঃ কী সুখ, ফুলের শয্যায় শুয়ে আছি রাজকুমার। হাতে পক্ষীরাজ খচরমচর করছে। দূরে দূরে বহুদূরে রাজপ্রাসাদের মিনারে, খুপরিঘরের গবাক্ষে একটি মুখ। রাজকুমারী বসন্তবালা। এক-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে যেন হাভানা চুরুটের ধোঁয়া। স্কাইলার্ক। গম্বুজে বিরহের কাতরানি কাতরাচ্ছে। আমি মোগল রাজকুমার। আমার পিতা হরিশঙ্কর উচ্চ বিদ্যালয়ের আদর্শবাদী, পিউরিটান শিক্ষক নন, মোগল বাদশা। দাক্ষিণাত্য বিজয়ে গেছেন। সাড়ে সাতশোয় সংসার চালাবার টাকড়ানো দুশ্চিন্তা নেই। কলের মুখে করপোরেশনের অনর্গল জলধারার মতো জীবিকার মকরমুখ দিয়ে অর্থের ধারা নামছে। ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর তক্তাপোশ হাতির দাঁতের পালঙ্ক হয়ে উঠছে। লাল সিমেন্টের মেঝে হয়ে গেছে ইতালিয়ান মার্বেল। জানালায় জানালায় চিকনের পরদার ফুরফুরে পাহাড়ি বাতাস। দূরে কোথাও, দূরে দূরে সানাই বাজছে দরবারিতে। আগামীকাল সকালে আমাকে আর টিউশানিতে যেতে হচ্ছে না। প্রতাপবাবুর পাঁঠা ছেলে ঘাড় কাত করে বসে আছে টেবিলে। ঠোঁটে কচি কচি গোঁফের রেখা। হাফপ্যান্ট খুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ঊরুস্তম্ভ। সোঁটা সোঁটা লোম। বিচ্ছুর মতো দুটো চোখ। প্রতাপবাবুর দুঃস্বপ্ন। মাস্টার পিটিয়ে আই এ এস করে দাও এই অ্যাসটাকে। পঁচিশ টাকার বকবকানি। নাদুর। দোকানে সপার্ষদ এক কাপ চা আর একটা ওমলেটের ব্যবস্থা। খানিক কান ফাটানো আলোচনা ঋত্বিক ঘটক, নেহরুর বিদেশ নীতি, কাফকার মেটামরফোসিস, সুচিত্রা সেনের সাতপাক, বড়ে গোলামের বালম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রানার, সোবার্সের সেঞ্চুরি, মিত্তির বাড়ির আরতি রোজ কেন এত রাতে বাড়ি ফেরে, অমরের নতুন কবিতা, বিমলের আর্মিতে ইন্টারভিউ, চুলে কাট। বউদির বোনের হৃদয়হীনতায় সত্যেনের দেহত্যাগের সংকল্প।
সব যেন অতীতে ফেলে আসা কোনও জীবনের স্মৃতি। সুখের বিছানায় শুয়ে আছি রাজকুমার। এই পাড়ারই আর এক বিছানায় রাজকুমারী। মাঝে একের চার মাইল অন্ধকার রাতের ব্যবধান–দশ-বারোটা বাড়ি, তিন-চারটে দোকান। রাজকুমারী কমলা রঙের শাড়ি পরে সাদা চাদরে পাশ ফিরছে সবুজ মশারির ভেতর। একটু সর্দি হয়েছে। নাকটা ফোঁস ফোঁস করছে। ছোট্ট কপালের দুটো পাশ টিপ টিপ করছে যেখানে কাব্যের ভাষায়, চূর্ণ কুন্তল অবাধ্য হয়ে আছে। আষ্টেপৃষ্ঠে সর্দি জড়ানো নায়িকাদের মনে হয় প্রেমের জারক রসে কাচের বয়ামে ফাল্গুনের টোপাকুলের মতো জরে আছে। বুকের কাছে সাঁই সাঁই শব্দ বলছে, ভালোবাসি ভালোবাসি।
চোখ বুজে পড়ে আছি। মান্ধাতার আমলের তোশক। জায়গায় জায়গায় ডেলাপাকানো তুলল। ওয়াড়ের একটা জায়গা ছেড়া। তার মধ্যে থাকে আমার ক্ষুদ্র সঞ্চয়। দু-দশ টাকার নোট। চিত হয়ে শুলে মাথার ওপর বনেদি বাড়ির ছাদ। দু-এক জায়গার প্লাস্টার খসে গিয়ে টালি বেরিয়ে পড়েছে। কবে খুলে কার মাথায় পড়বে নিয়তিই জানেন। এ সবই হল প্লেন লিভিং অ্যান্ড হাই। থিংকিং-এর উদাহরণ। শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভালো লাগে, পৃথিবীটা কী-সুন্দর! বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর যাকে ভালোবাসি, সে কাছে না থাকলেও নাড়াচাড়া করা। তার হাতে হাত ঠেকেছে। চোখে চোখ রেখেছি। এখনও অনেক কিছুই বাকি। এই বাকিটুকু কল্পনা। বাস্তবে এখনও দেখার ছাড়পত্র মেলেনি। যে ঘরে শুয়ে আছি, একটা হলঘর। সেই দূর কোণে আর একটা খাট। পাশে একটা টেবিল, চেয়ার। টেবিলল্যাম্পের আলো। তপস্বী এক মানুষ লেখাপড়ায় ডুবে আছেন। অসীম জ্ঞানসমুদ্রে একটা ডিঙি ভাসছে। কত উপদেশ সন্তানকে! আলোর বৃত্তে পতঙ্গের মতো ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে মরো না। ফার্স্ট ডিভিশন, ফার্স্ট ক্লাস, ডক্টরেট। সম্মানের জীবিকা। নিরাপত্তা, সুখ। কে শুনছে! একটি বুকের আঁচল সরিয়ে কল্পনার চোখে দুধের মতো সাদা দুটি থলে বিস্ময়। মাথা রেখে কানপাতা। ধকধক শব্দ। গলার কাছে শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। অন্ধকারে তরল দুটি চোখ। উত্তপ্ত নিশ্বাস। চিকন একটা হারের শীতল স্পর্শ। ফিশফিশ কণ্ঠস্বর, এ কী হচ্ছে! করছ কী তুমি! আমার হাত পৃথিবী পরিভ্রমণে মরিয়া! ডেভিড লিভিংস্টোন। ডার্কেস্ট আফ্রিকা। ভিকটোরিয়া ফলস। মানুষের হাত। চিতার কাঠ ধরে, গোলাপের বৃন্ত ধরে, নুয়ে পড়া ডাল থেকে বাতাবি হেঁড়ে। স্কুলের নগেন পণ্ডিতমশাই, উঁচু ক্লাসে যখন পড়ি, মন ভালো থাকলে সামান্য আদিরসাত্মক হতেন। নায়িকার দেহসুষমার বর্ণনায় বাতাবির উপমা টানতেন, কোরক। থেকে ফল থেকে অলাবু। বর্ণনা বিশদ হত। শরীরে পুল। সেদিন আমরা ফুটবলটা ভালো খেলতুম। রাতে গভীর নিদ্রা। স্বপ্নে ক্লিয়োপেট্রা!
বুঝলে, নিষ্ঠাই বড় কথা। লেগে থাকার ক্ষমতা। অনুশীলন। নিজেকে ছাঁকতে ছাঁকতে ঝিনুকের পেটের জলের মতো পরিশ্রুত করা গেল। একেশ্বরবাদী। কারও দিকে তাকাই না। ভদ্র। বাজে বকি না। বাজে কাজে সময় নষ্ট করি না। শ্রীচৈতন্যের প্রেম, বুদ্ধের হৃদয়, শঙ্করের মেধা। জমি তৈরি। প্রেম ফেল করলে বৈরাগ্যের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া যায়। হয় সংসার, খাট, বিছানা, সানাই, নয় শ্মশান। বলো হরি, বলো হরি।
অসুখ জিনিসটা যেমন খারাপ, আবার তেমনই উপকারীও। রোগশয্যার ধারে প্রেম দানা বাঁধে। তপস্বী পিতা একদিন সকালে আবিষ্কার করলেন তাঁর প্রশস্ত পৃষ্ঠদেশে মুক্তোর মালা তৈরি হয়েছে। আড়াআড়ি বেল্টের মতো। অসহ্য যন্ত্রণা। জ্বরও এসে গেল। তিনি তাঁর হোমিয়োপ্যাথির জ্ঞান দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেও চিকিৎসার জন্যে বন্ধু অ্যালোপাথ বিজয়বাবুকে ডাকতে বললেন। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, ভোগাবে। ভাইরাল ইনফেকশন যে গো। এর নাম হারপিস জোস্টার। দেখছ না, বেল্টলাইক ফরমেশন। পার্ললাইক কম্পোজিশন। রেস্ট অ্যান্ড অ্যাবসলিউট রেস্ট।
হল কেন? আমার তো অসুখ করার কথা নয়।
কেন নয়?
আমার মন খুব স্ট্রং, দুশ্চিন্তা করি না। আমার শরীরের ক্ষয় খুব কম।
এটা ক্ষয় ব্যাধি নয়। ভাইরাস ইনফেকশন। ইনফেকশন মানে ইমিউনিটির অভাব। তার মানে শরীর উইক। তার মানে মন দুর্বল। তার মানে? মাঝখানে প্রশ্ন দু-পাশেদুজন। ডাক্তার ও রোগী। তার মানে এজিং। বয়েস বাড়ছে।
তা তো বাড়ছেই। সে আর কী করা যাবে। সকলেরই বাড়বে।
ডাক্তারবাবু একটা ইনজেকশন দিয়ে তলপিতলপা গুটিয়ে চলে গেলেন। সংসারে সেবা করার মতো কেউ নেই। কর্তার স্ত্রী অনেক আগেই জীবন নাটক শেষ করে চলে গেছেন। একমাত্র।
ফলটিই সম্বল। ডাক্তারবাবু একটা লোশন দিয়ে গেছেন। তুলোয় ভিজিয়ে সাবধানে লাগাতে হবে। তাহলে একটু আরাম পাবেন। লাগাচ্ছি। ভয়ও করছে, যদি অসাবধানে লেগে যায়।
প্রশ্ন করলেন, বিরক্তি বোধ করছ?
বিরক্তি বোধ করব কেন?
সেবা জিনিসটাই তো বিরক্তিকর।
আমার কাছে নয়।
জানালার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতীত ভাবছেন। যার সেবা করার কথা, তিনি নেই। অসুস্থ হলে স্ত্রীর অভাব বোঝা যায়। স্ত্রীর কাছে যতটা সহজ হওয়া যায়, অন্যের কাছে ততটা সহজ হওয়া যায় না। এই সময় তনুশ্রী এসে গেল। কী হয়েছে বুঝতে যতটুকু সময় গেল, তারপর আমার আর কিছু করার রইল না।
এক-একটা মেয়ের ভেতর সেবা থাকে। পরকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে। আলাদা। মশলা দিয়ে তৈরি। একই ওয়ার্কশপ থেকে বেরলেও মেটিরিয়াল আলাদা। ঝাঁ করে একবার বাড়ি চলে গেল, ফিরে এল একটা ব্যাগ নিয়ে। শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ, চিরুনি, তোয়ালে ইত্যাদি নিয়ে। টাকা এল না, হিরে এল না, একটা মেয়ে এল, মনে হল পৃথিবীতে সত্যযুগ এসে গেল। সীমাহীন আনন্দ। মরা গাঙে বান ডাকল। ঘরেতে ভ্রমর এল।
রান্না করার একজন ঠাকুর ছিল। মনে হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের রাঁধুনি। সব রান্নারই এক স্বাদ। ভাত কখনও শক্ত, কখনও পিণ্ডি। খেতে বসে গাইতে ইচ্ছে করত, কেন চোখের জলে। ভিজিয়ে দিলেম না। একটু অন্যমনস্ক না হলে মুখে দেওয়া দুঃসাধ্য হত। ঠাকুর! এটা কী?
রুই মাছের দমপোক্ত।
ঠাকুর এটা কী?
মোচার কোফতা কারি।
সব একরকম। হড়হড়ে তেল, ভড়ভড়ে গন্ধ। মুখে দিলেই মনে হবে মরে যাই। যে কোনও আসামীকে খাওয়ালেই স্বীকারোক্তি বেরিয়ে আসবে। ধোলাই দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
তনু রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভালো রান্নার সুগন্ধে বাড়ি ভরে গেল। তনুর মাস্টারমশাই সেই রোগযন্ত্রণার মধ্যেই বললেন, বহুকাল পরে অতীত ফিরে এল। মা যখন রাঁধতেন ঠিক এইরকম সুবাস বেরত। সামান্য ভালো।
মেঝেতে তোশক বিছিয়ে তনু বসল। রাত ক্রমশ এগোচ্ছে। মাস্টারমশাই স্যুপ খেয়েছেন। প্রশংসা এখনও ফুরোয়নি। পা মুড়ে কোলের ওপর হাত জুড়ে বসে আছে, তনু যেন ধর্মকথা শুনতে বসেছে। সামনে পড়ে আছে হ্যামলেট। পড়া আর পড়ানো দুটোই হবে। সময়ের দাম। কত। একটুও নষ্ট করা চলবে না। যা গেল তা চিরতরে গেল। আর ফিরবে না। একদিন বয়েস বেড়ে গেল, মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল আরও একদিন।
আমরা তক্তপোশে বসে দৃশ্যটা দেখছি। তনুকে বোন ভাবার চেষ্টা করছি অনেকক্ষণ ধরে। ভয়ংকর একটা অঙ্কর সঙ্গে ধস্তাধস্তি চলেছে সেই সন্ধে থেকে। খাতার তিনটে পাতা ভরে গেছে। সংখ্যায়। সমাধানের সন্ধান মেলেনি। খাটের ওপর যিনি বসে আছেন তাঁর কাছে গেলে নিমেষে হয়ে যাবে জানি। একবার মাত্র তাকাবেন। পেনসিলটা হাতে নেবেন। তিন লাইনে উত্তর বেরিয়ে আসবে। হিয়ার ইজ ইয়োর অ্যানসার। সো সিম্পল, ধরতে পারলে না। আমার মাথা আর গদর্ভের মাথায় কোনও তফাত নেই। মস্তিষ্কের ভাঁজ মনে হয় কম কম। জটিলকে সরল করতে পারে না, তার ওপর রণে ভঙ্গ দেওয়া স্বভাব। অঙ্কের ফাঁকে ফাঁকে তনুর দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। কেমন বসে আছে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে। পিঠের দিকটা খুব সুন্দর। চওড়া ভারি কাঁধ। খোঁপা। সুগঠিত গলা। বোন হলে সর্বনাশ হয়ে যেত। তনু আমার প্রেমিকা। অঙ্কের মাথা না থাকতে পারে, প্রেমের মাথা বেশ ভালো। অঙ্কে ঢোকার ক্ষমতা নেই, হৃদয়ে ঢোকার ক্ষমতা আছে।
দুজনে হ্যামলেটে বিভোর। কত রকমের ব্যাখ্যা। মাঝে নেসফিল্ড সাহেব আসছেন গ্রামার নিয়ে। শেলি, কিটস, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ঢুকে পড়েছেন। গোটা ইংল্যান্ডের কবিকুল ঘরে। জন ডন, মার্লো। ইতিহাস আর সাহিত্য পাশাপাশি চলেছে। স্মৃতি থেকে বেধড়ক উদ্ধৃতিতে তাক লেগে যাচ্ছে। যে-কথা প্রায়ই বলেন সেইটাই মনে হয় ঠিক। ব্রহ্মচর্যে মেধা বাড়ে। বীর্য থেকেও জঃ, ওজঃ থেকে মেধা।
আমার বন্ধু-কাম-গুরু কৈলাসের কাছে প্রবলেমটা ফেলেছিলুম। তনুর এমন অপমানজনক মেধা হল কী করে। ওই মেধার জন্যে নিত্য আমাকে অপমান সইতে হয়। ক্রমশই আমি ছাগলের। স্ট্যাটাসে নেমে যাচ্ছি। কৈলাস বলেছিল, মেধা কেন হবে না। মেয়েদের তো বীর্যই নেই। ক্ষয়েরও কোনও প্রশ্ন নেই। মেধা-নাড়ি নিয়েই জন্মায়। সেই কারণেই তো মা সরস্বতী। বাবা সরস্বতী হল না কেন! বিদ্যার এলাকাটাই হল মেয়েদের। বীণা বাজাবে, কথাকলি নাচবে, সাহিত্য-শিল্পে পারদর্শী হবে। খনার কথাই ভাব না। শ্বশুরমশাই হেরে গেলেন। অ্যাস্ট্রোনমি, অ্যাস্ট্রোলজি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, পলিটিকস সব মেয়েদের। বিদ্যা শব্দটাই তো স্ত্রীলিঙ্গ। ছেলেরা মাটি কোপাবে, মোট বইবে, গাড়ি চালাবে, কল চালাবে, ফুটবল খেলবে, আড্ডা মারবে। এর জন্যে লজ্জায় অধোবদন হওয়ার তো কোনও কারণ দেখি না। আমরা তো মা সরস্বতীকে পুজো করি। তনু হল জ্যান্ত সরস্বতী। পুজো করবি, পায়ের বুড়ো আঙুল ডোবানো চরণামৃত পান করবি। এতে লজ্জার কিছু নেই।
মন এমন বেয়াড়া জিনিস, নিজের ভাবনায় নিজেকেই ঘাবড়ে যেতে হয়। একবার মনে হল, তনুকে শেষে মা বলতে হবে নাকি! এত প্রশংসা, এমন বিমোহিত অবস্থা। দৃষ্টিতে এত প্রেম! তনু ছাড়া জীবন অচল! কখনও বলছেন, তাহলে তুই এইবার একটু গান গা। তনু সঙ্গে সঙ্গে গাইছে, তোমার অসীমে। কখনও বলছেন, এইবার একটু চা খাওয়া। তোর হাতের চা তুলনাহীন। কখনও বলছেন, এইবার একটু শুয়ে পড়। তনু এক রাউন্ড ঘুম দিয়ে উঠছে।
আজ্ঞাপালনের এমন অপূর্ব দৃষ্টান্ত খুব কম দেখা যায়। তনু বলেছিল, গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটা এইরকমই হওয়া উচিত। শিষ্য গুরুর সঙ্গে মিশে যাবে। তার আলাদা কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। তোমার বাবা, তাই তুমি বুঝতে পারো না, এমন একজন মানুষ হয় না লাখে একটা। মেঘের মতো প্রেম।
গুরু কৈলাসকে জিগ্যেস করলুম, মেঘের মতো প্রেম জিনিসটা কী! তনু বলেছে।
ভালো বলেছে। মেঘ যখন বৃষ্টি ঢালে, সারা দেশ ভেসে যায়। মানুষ চেষ্টা করলেও পারবে না। পিচকিরি দিয়ে, শাওয়ার দিয়ে কতটা জায়গায় জল দেওয়া যায়? সামান্য জায়গায়। বৃষ্টির জল মাটিতে পড়ামাত্রই জীবন। পিনপিন করে গাছপালা বেরোতে লাগল। চারপাশ সবুজে সবুজে সবুজ। পৃথিবীতে মেঘের ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে ঝরে। মেঘ কিছু চায় না। নদী-পুকুর সব ভরভরন্ত করে দেয়। বীজের ঘুম ভাঙায়। নিজে ফুরিয়ে যায়। আকাশ ছাপিয়ে যখন বৃষ্টি নামে তখন। কোনও ফাঁকা মাঠে কী নদীর ধারে একেবারে একা গিয়ে দাঁড়াবি, দাঁড়ালেই বুঝতে পারবি কী আবেগ! কী কোমল আলিঙ্গন! গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পাতায় পাতায় শুনবি বৃষ্টির গান। শুনতে পাবি কবিতা। তোর তনুশ্রী যে কোনও দিন কবি হয়ে যাবে।
অনেক রাতে যখন ঘুম আসে না, তখন তাকিয়ে দেখি, রুগির বিছানায় তনু একপাশে আড় হয়ে সেবা করছে। মৃদু স্বরে বলেছে, মাস্টারমশাই খুব কষ্ট হচ্ছে! কী করি বলুন তো!
কী করবে মা, আনন্দ শেয়ার করা যায়। যন্ত্রণা নিজেকেই ভোগ করতে হয়। শেয়ার করা যায় না। ম্যান শুড সাফার অ্যালোন। গভীর রাত। সবাই গভীর ঘুমে, তুমি শুধু একা জেগে বসে আছো তোমার যন্ত্রণা নিয়ে। সহ্য করার চেয়ে বড় সাধনা আর কিছু নেই।
আপনি একটু শোবার চেষ্টা করুন। আমি আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিয়ে দিই।
ওতে কিছু হবে না মা, তুমি এইবার একটু শুয়ে পড়ো।
শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। মেঝের বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি তনু হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে বসে আছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে। ভোরের নরম আলোয় যেন একটা পাথরের মূর্তি বসে আছে। ভোরের নদী, ঘুম ভাঙা অরণ্য, বাসা থেকে ওড়ার চেষ্টা করছে সাদা একটা পায়রা, নদীর জলে। স্নানে নেমেছেন কোনও বৈষ্ণব, জল ভাঙার চুনচুন শব্দ। পুকুর ঘাট ছেড়ে একটা হাঁস ঢেউ কেটে কেটে চলেছে এপার থেকে ওপারে। এই সবই হল পবিত্র পৃথিবীর দৃশ্য।
স্তব্ধ হয়ে তনুর প্রার্থনা দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, আমি খুব নীচের তলার মানুষ। যার কাছে দীক্ষা নেওয়া উচিত তাকে আমি কুকুরের মতো কামনার জিভ দিয়ে চাটার চেষ্টা করছি। আমি একটা দ্বিপদ জন্তু।
পৃথিবীতে কত রকমেরই না মানুষ আছে! একজন অষ্টাবক্র লোক, পাড়াতেই থাকে। যাওয়া আসার পথে প্রায়ই দেখা হত। হাঁটার ধরনটা ছিল গোরিলার মতো। কৈলাস বলত, কোত গরদান তাংপিছানি, দোনো হ্যায় বজ্জাতকি নিশানী। বড়বাজারে ব্যবসা। গায়ে অফুরন্ত তেল ডলে চান করেন। রোজ রাতে রাবড়ির হাঁড়ি হাতে বাড়ি ফেরেন। কোনও অনুষ্ঠানে চাঁদা চাইতে গেলে আধঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে একটা টাকা ছাড়েন। ধরা আর ছাড়া অর্থনীতির একমাত্র কৌশল। ধরার সময় যতটা তৎপর, ছাড়ার সময় ঠিক ততটাই শ্লথ। তবেই মানুষের অর্থভাগ্য খোলে। কৈলাস ভদ্রলোকের নাম রেখেছিল বজ্ৰবাঁটুল। স্ত্রী খুব সুন্দরী। সেই কারণে আমরা বলতুম, বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্টের বাড়ি। মাঝে মাঝে আমাদের প্ল্যান হত, বজ্ৰবাঁটুলের কারাগার থেকে কেমন করে ওই বন্দিনী সুন্দরীকে উদ্ধার করা যেতে পারে। পয়সা দেখে বিয়ে দিয়েছে মেয়ের বাপ। এইরকম অসম মিলন সহ্য করা যায় না। ভদ্রমহিলাকে দেখলে আমরা বলতুম, ক্যাপটিভ লেডি।
বজ্ৰবাঁটুল কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। বাড়িতে কারওকে আপ্যায়ন করতেন না। ভয় ছিল, বউ যদি পালায়। সিনেমা যে কোনও সময় মানুষের সর্বনাশ করতে পারে। সেই বজ্ৰবাঁটুল হঠাৎ মমাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে পড়লেন আমাকে দেখে।
শুনলুম, মাস্টারমশাইয়ের খুপ খারাপ একটা অসুখ করেছে!
ঠিকই শুনেছেন, হারপিস জোস্টার।
ভেনার্যাল ডিজিজ।
ভেনার্যাল নয়, ভাইরাল ডিজিজ।
ওই হল, একই ব্যাপার। ওঁর মতো চরিত্রের মানুষের এই হল! ঘোর কলি। তা শুনলুম ঘরসংসার ছেড়ে এসে সেবা করছে বিপ্লববাবুর মেয়ে। ব্যাপারটা কী বলল তো। যে বাড়িতে আইবুড়ো। একটা ছেলে, সেই বাড়িতে আইবুড়ো একটা মেয়ে রাত কাটাচ্ছে, এও তো আর এক ভেন্যারাল। ডিজিজ। তোমাদের ফ্যামিলির আর কোনও প্রেস্টিজ রইল না। তোমার ঠাকুরদার নামে চুনকালি পড়ল। বাড়িতে দ্বিতীয় কোনও মহিলা নেই। রাতের পর রাত। ভাবতেও আমার কেমন লাগছে। ভদ্রলোকের পাড়া। বেশ মজায় আছো, কী বলল।
প্যাঁচার মতো হাসছে লোকটা। কথার মধ্যে থলথলে ইঙ্গিত। বেশ আনন্দ পাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল মারি এক ঘুসি। নীচের দাঁতটা ফেলে দিই। কোনওরকমে নিজেকে সংযত করে বললুম, কেন নোংরা কথা বলছেন?
তোমরা নোংরামি করছ বলে। মাস্টারমশাইয়ের কাছে ছাত্ররা গিয়ে কী শিখবে? বৃন্দাবন লীলা। বিশাল একটা রবারের পুতুলের মতো লোকটা হেলেদুলে চলে গেল। আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। আর ঠিক সেইসময় কৈলাস এসে পড়ল সাইকেলে চেপে। কৈলাস দাদার। কারখানায় যাচ্ছে খাবার পৌঁছে দিতে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলছে। রাস্তায় পা রেখে দাঁড়িয়েছে। কী হল, এমন গরুচোরের মতো দাঁড়িয়ে আছিস!
বজ্ৰবাঁটুল যা-তা বলে গেল, তনু আমাদের বাড়িতে আছে বলে। খারাপ খারাপ কথা।
তুই কী বললি?
কিছুই তেমন বলতে পারলুম না।
তুই বেটা ছোটলোকের মতো ভদ্রলোক। ঠাস করে একটা চড় মারতে পারলি না! তনু তোদের বাড়িতে আছে তো ওর বাবার কী? ব্যাটা রক্ষেকালীর বাচ্চা। তুই এবার থেকে রোজ বিকেলবেলা তনুর হাত ধরে বেড়াতে বেরোবি। ওই মদনা ব্যাটার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে খুব হ্যা হ্যা, হা হা। করবি। হিন্দি গান গাইবি। এই মাঘেই তোর সঙ্গে তনুর বিয়ে দেব। আমার খুব কষ্ট হবে ঠিকই। বুক ফেটে ভেঙে যায় মা; কারণ তনুর তরীতে আমিই ভাসব ভেবেছিলুম।
তনু আমার মতো বেকারকে বিয়ে করবে কেন?
ওর বাপ করবে। তনু তোকে ভালোবাসে।
তনু আমাকে নয় আমার বাবাকে ভালোবাসে।
মাস্টারমশাইকে একভাবে ভালোবাসে। তোকে আর এক ভাবে। সময় পেলে কথামৃত পড়বি। সেখানে ঠাকুর একটা সুন্দর কথা বলেছেন। একই বিছানা। ডানপাশে স্বামী, বাঁ-পাশে ছেলে। ছেলেকে আদর করার সময় এক ভাব। স্বামীকে আদর করার সময় আর এক ভাব। তুই একটা চিরকালের বোকা, কিছুই বুঝতে পারিস না। দুটো ভালোবাসার টানে তনু সংসার থেকে ছিটকে এসেছে।
অতীতের স্মৃতি হল গর্তের সাপ। মাঝে-মধ্যে হিল হিল করে বেরিয়ে আসে। সে আবার ময়াল সাপ। শরীরে চাকা চাকা গোল গোল বর্ণবাহার হল এক-একটা উজ্জ্বল ঘটনা। বিয়েটা মাঘেই হল। যেমন হয় বোকা বোকা সাজ। গরদের পাঞ্জাবি। কোঁচানো, চুনট করা ধুতি। পায়ে নিউকাট। মিনমিনে পালিশ। মামাতো বোন সুধা লবঙ্গ দিয়ে মুখে চন্দনের ফোঁটা মেরেছে। চন্দনে পাঞ্চ করা ছিল তিলক মাটি। জেল্লাটা ভালোই খুলেছিল বোকা বোকা মুখে। কৈলাস সেজেছিল কর্তাব্যক্তির মতো। মালকোঁচা মারা ধুতি, হাফ হাতা শার্ট। আমার চেয়ে তার আনন্দ বেশি। মাঝ সমুদ্রের ভাসমান জাহাজকে বন্দরে ভিড়িয়েছে কাপ্তেন কৈলাস। বউভাতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল বজ্ৰবাঁটুলকে। লোকটা মহাপাজি। চলে যাওয়ার সময় চ্যাকোর চ্যাকোর পান চিবোতে চিবোতে বলে গেল, ধন্যবাদটা আমাকেই দিও হে ছোকরা। বিয়েটা আমিই এগিয়ে দিলুম। ব্যাপারটা তা হলে জট পাকিয়ে যেত।
সংসারের প্রবেশপথটা খুব সুন্দর। খিলান, মেহগনি কাঠের পালিশ করা দরজা, মাথার ওপর পোঁ ধরেছে সানাই। জুই-রজনীগন্ধ ছড়াচ্ছে। অভাব, অভিযোগ, দুঃখ কষ্ট সব বেনারসি চাপা। শাশুড়ির গয়নায় সেজে ও বাড়ির বউ এসেছে এ বাড়ির নিমন্ত্রণে। এক রাতের জন্য ভেতরের দৃশ্যটা আরব্য রজনীর মতো। হলুদ-লাল আলোর ছায়া। ভেলভেটের আদিম ঝালরে মিহি চিনির মতো আলোর গুঁড়ি। আমির, ওমরাহ, বাদশা, বেগমদের জমায়েত। শান্তিদি ভাঙা গালে পাউডার ঘষেছে। চোখে কাজল। বিশ বছর আগে ফেলে আসা যৌবন থেকে নজর ধার করে মোহময়ী। হয়ে আমাকে ফিশফিশ করে বলছে, কী করতে হয় জানিস তো! না, আড়ালে আয় বলে দিচ্ছি।
শান্তিদি আমার হাতটা চেপে ধরল। মাঝের আঙুলে একটা তামার রিং, তার পাশের আঙুল একটা সিসের রিং। হাতের তালুটা খুব গরম। লম্বা লম্বা, সরু সরু আঙুল। বেশ লম্বা। ছিপছিপে শরীর। আমাকে টানতে টানতে একেবারে ভাঁড়ার ঘরে। ঘরে কেউ নেই। সবাই নতুন বউকে সাজাতে ব্যস্ত। শান্তিদি একেবারে আমার বুকের কাছে। আজ খুব যত্ন করে চুল বেঁধেছে। বুকের আঁচল একপাশে সরে গেছে। লাল চকচকে ব্লাউজ।
‘তোকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে বিলু। তোর চেহারাটা আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।’ মুখটা ধারালো। নাকটা খাড়া। চোখ দুটো বাদাম চেরা। পাতলা তিরতিরে ঠোঁট। এইরকম মুখ আর চেহারার একটা আকর্ষণ আছে। কী করতে চাইছে বোঝার আগেই দু-হাতে গলা জড়িয়ে ধরে শান্তিদি আমার ঠোঁটে বেশ ঘন করে চুমু খেয়েই দূরে সরে গেল। সেই মুহূর্তে আমি কেমন যেন হয়ে গেলুম। সাপ যেন ছোবল মেরে দূরে সরে গেল। শান্তিদি খুব দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে। বুকের ওঠানামা। অদ্ভুত একটা গলা করে বলল, তুই সরে যা, আমার সামনে থেকে সরে যা।
বড় বড় গামলায় রসে ভাসছে রসগোল্লা, পান্তুয়া, হলদে হলদে কমলাভোগ। সব যেন ফ্যাল। ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বোকার মতো পায়ে পায়ে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলুম। নানারকম মশলার গন্ধ। একটা একশো পাওয়ারের আলো। দেয়ালের রং ময়লা। কাঠের একটা টেবিলের ওপর অনেক শালপাতা। কিছু কাঁচা পাঁপড় মেঝেতে ছড়িয়ে আছে।
শান্তিদির জীবনটা ভেঙে গেছে। বড়লোকের মেয়ে ছিল, আদুরে মেয়ে। নামী স্কুলে পড়ত। ভালো নাচত। বাবার ব্যবসা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলেন। শেষের দিকে একের পর এক ব্যাঙ্ক ফেল করতে লাগল। গণেশের পর গণেশ ওলটাচ্ছে। হঠাৎ যুদ্ধ শেষ। দেশ বিভাগ। রায়ট। স্বাধীনতা। শান্তিদির বাবা পাগল হয়ে গেলেন। বিক্রি হয়ে গেল স্টুডিবেকার গাড়ি। একটা বাগান ছিল, বিক্রি হয়ে গেল। লোকজন, পোষ্যরা সব ভেগে গেল। দুটো। অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল, খেতে না পেয়ে মরে গেল। অনেকেরই উল্লাস ব্যাটা বাঙালি, খুব লপচপানি হয়েছিল। বেলুন এইবার চুপসেছে। শান্তিদির মায়ের নামে নানা কেচ্ছা। প্রশ্নতেই। উত্তর, সংসারটা চলছে কী করে। মেয়েদের তো একটাই ক্যাপিটাল। শান্তিদির লড়াই সেই থেকে শুরু। রাস্তার দিকের দোতলার বারান্দায় শান্তিদির বাবা বসে থাকতেন, আর থেকে থেকে। চিৎকার করতেন চিল চিল ছোঁ মারলে, ছোঁ মারলে। মানুষটাকে কেউ দেখত না। মাঝে মাঝে মারধোর করত। এখনও মনে আছে, শান্তিদির মা আর বড়মামা এমন মেরেছিল, ভদ্রলোকের চওড়া পিঠে লাল লাল, সোঁটা সোঁটা দাগ। রাস্তা দিয়ে যে যাচ্ছে তাকেই দেখাচ্ছেন, এই দেখ এই দেখ আমার পিঠে জমা খরচ। এরপর ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরেই ফেললে। শান্তিদির বিয়ে। হতে হতেও হল না। রটনা, মায়ের জন্যেই হল না। একজন আর্টিস্ট খুব ঝুঁকেছিল। শান্তিদিকে মডেল করে অনেক ছবি এঁকেছিল। পড়তি জমিদারের ছেলে। রোজগার না থাক বাড়ির মেঝে মার্বেল পাথরের। শান্তিদির মাকে আমরা বলতুম, হোয়াইট টাইগ্রেস। যৌবনের পড়ন্ত আলোয় বসে থাকা সেই মহিলাকে আমরা দেখেছি। মেয়েদের সংসার ভেঙে গেলে আর কিছু থাকে না। রূপ আর দেহ হল বিয়েবাড়ির বাইরে ডাস্টবিনের ধারে ছড়িয়ে পড়ে থাকা এঁটো পাতার মতো। কুকুরের দল এসে সারারাত ছেঁড়াঘেঁড়ি করে ভোরে চলে যায়।
সংসার একটা নেশা। চিনেপাড়ার ওপিয়াম ডেন। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলে দৃশ্যটা এইরকম, গুহার মতো একটা জায়গা, ভেতরটা ধোঁয়া ধোঁয়া। আলোটা নেশায় লাল। কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ আধশোয়া, মেয়েরা নেচে নেচে ঘুরছে। অস্ফুট গুঞ্জন, জড়িত কণ্ঠ, শিথিল হাতে বিচলিত কোনও সুন্দরীর পোশাকের প্রান্ত আঁকড়ে ধরার চেষ্টা। কেউ বুকে হেঁটে এগিয়ে চলেছে যেখানে নীল কাচের পাত্রে রয়েছে লাল চেরি। যে একেবারে বেহুশ তার সর্বস্ব হরণ করে নিচ্ছে নেশামণ্ডলের অধিকারী। যে স্বেচ্ছায় ঢুকছে, সে আর বেরোতে পারছে না। একটু একটু করে চুর হতে হতে বঁদ। মিষ্টি ঘণ্টাধ্বনি, সিল্কের খসখস শব্দ, মশলার গন্ধ, শালুকের কাণ্ডের মতো ললিত হাতের ছোবল, ঝিনুকের কপালে ভোরের সূর্য, গোলাপি অন্ধকারে খইয়ের মতো জোনাকির। আলো। সাদা রেশম ঢাকা একজোড়া বাতাবি, মাঝে পিঁপড়ের পায়ে হাঁটার পথ। শিলাজতুর পিচ্ছিলতা। মিহি বৃষ্টির মতো আসক্তি। যন্ত্রণা, চাপা আর্তনাদ, ফাঁদে পড়া পশুর অসহায়তা। নেশার গলায় কেউ বললে, ‘বহুত আনন্দ’। সঙ্গে সঙ্গে সেই গহ্বরে সবাই গুঞ্জন করে উঠল, ‘আনন্দ, আনন্দ’। কেউ বললে, ‘বড় যন্ত্রণা’। সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন, যন্ত্রণা। কেউ তেড়েফুঁড়ে উঠল, ‘মুক্তি, মুক্তি’। অধিকারীর নিষ্ঠুর গলা, মুক্তি। ভোরের আগে মুক্তি নেই। গুহার বাইরে বিবেকের গান শোনা যাবে,
লোভ মোহ আদি পথে দস্যুগণ, পথিকের করে সর্বস্ব মোষণ,
পরম যতনে রাখ রে প্রহরী, শম দম দুই জনে।
সাধুসঙ্গ নামে আছে পান্থ-ধাম, শ্রান্ত হলে তথায় করিবে বিশ্রাম,
পথভ্রান্ত হলে শুধাইবে পথ, সে পান্থ-নিবাসীগণে।
যদি দেখ পথে ভয়ের আকার, প্রাণপণে দিও দোহাই রাজার,
সে পথে রাজার প্রবল প্রতাপ, শমন ডরে যাঁর শাসনে।
শোনা গেলে কী হবে! জীবন-আফিমের নেশা বড় ভয়ংকর। একবার ধরে গেলে আর তো ছাড়া যায় না। চোরাবালির মতো ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে। প্রেম, বিরহ, মূৰ্ছা। উৎসবের রাত তার যাবতীয় আড়ম্বরের চকমকি খসিয়ে সাধারণ রাত হয়ে গেল। হাতা-খুন্তি, চটের ব্যাগের জীবন। হিসেবের খাতা। আয়ের ঘরে একটা লাইন তো ব্যয়ের ঘরে একশোটা।
তবে ভার্যা যদি মনোরমা হয় তাহলে অভাবেও কত ভাব!
কিছু পয়সা সঞ্চয় করে সেই পুরীতে বেড়াতে যাওয়া। ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সুইস সুইস শব্দ। ফ্যানার বুজবুজি। পায়ের দিকের শাড়িটা সামান্য উপর দিকে টেনে তুলে তনুশ্রী ভাঙা ঢেউ মাড়িয়ে হাঁটছে, ছুটছে, লাফাচ্ছে। বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়ছে। এলো খোঁপা লুটোপুটি খাচ্ছে। চওড়া পিঠে। নীল আর সবুজের মহাখেলা।
কে আমি?
আমি তখন রাজকুমার। কোন প্রতিষ্ঠানের দাস নেই! দু-পাশে হাত ঝুলিয়ে ন্যালাখ্যাবলার মতো দিনে অন্তত একবার বড়কর্তার টেবিলের সামনে করুণ মুখে দাঁড়াতে হয় না কি আমাকে! সেই বড় দাস এই ছোট দাসটিকে উন্মোচন করে বড়ই আনন্দ পেয়ে থাকেন! আত্মসম্মানের আলখাল্লাটিকে ছিঁড়ে ফেলে তিনি বাক্যের লিঙ্গ দিয়ে ধর্ষণ করেন। সামনের চেয়ারে বসার অধিকার নেই। মানুষ হলেও সবাই তো মানুষ নয়। কত টাকার মানুষ তুমি? হাতিবাগানের হাটের জামা, না টিকিট লাগানো বড় দোকানের দামি জামা! তুমি কার্পেট না পাপোশ? তোমার মতো ইডিয়েট তো আমি দুটো দেখিনি! পয়সা খরচ করে লেখাপড়া শিখেছিলেন, না চালকলা দিয়ে! এটা কী হয়েছে? এটা কী? হোয়াট এ মেস! এটা তোমার বাপের আপিস! গুপ্তকে তুমি অর্ডারটা ইস্যু করলে কার হুকুমে!
—আজ্ঞে, আপনিই তো স্যার সই করেছিলেন!
শাট আপ ইউ ফুল! নৃপেনবাবু ধরিয়ে না দিলে আমি ধরতেই পারতুম না!
কী ধরালেন স্যার! গুপ্তরটাই তো লোয়েস্ট রেট!
নো, নো স্যার। লোয়েস্ট ব্যানার্জির। গুপ্তরা প্যাকিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এক্সক্লডেড। ব্যানার্জিরটা ইনকুডেড। সেই যোগটা কে করবে! আমি না, না আমার বাবা! রেজাল্ট! কোম্পানির এক লাখ টাকা গচ্চা। এই টাকাটা কে দেবে! ইয়োর ফাদার। শুনেছি, তুমি নাকি কাজ করতে করতে গুনগুন করে গান গাও! এত ফুর্তি কীসের!
স্যার! এবারের মতো মাপ করে দিন! আমি এতটা খেয়াল করিনি স্যার।
যাও। এখন গুপ্তর হাতে পায়ে ধরে অর্ডারটা উইথড্র করে আনো।
সেটা কী সম্ভব স্যার! একবার ইস্যু করা হয়ে গেছে।
সম্ভব কী অসম্ভব সে তো জানি না। কত টাকা খেয়েছিলে! ভমিট ইট আউট। হয় এক লাখ টাকা পে করো, আর না হলে উইথড্র করে আনো।
আপনি আমাকে বাঁচান স্যার। সবে বিয়ে করেছি।
কে বলেছিলেন, সেই শ্রীকৃষ্ণ নাকি উপনিষদ! তুমি যে-সে নও। তোমার ভেতরে আছে। লিঙ্গশরীর। অর্ধাঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ, জ্যোতির্ময় এক লাইটার। তার মধ্যে আছে তরল গ্যাস। স্পিরিট। চৈতন্যের চাকা লাগানো। বুড়ো আঙুল দিয়ে খটাং করলেই আত্মার আলোয় উদ্ভাসিত। বাক্যের
অস্ত্র তোমাকে বিদ্ধ করতে পারবে না। নিতম্বে বাক্যের পদাঘাত তোমাকে ভূপতিত করতে পারবে না। চাকরি চৌপাট হলেও অনাহারে ভেটকে যাবে না। তুমি বুষ্টু হলেও ব্রহ্ম। তুমি জন্মেছ। নাকি! যে মৃত্যুর কথা ভাবছ।
অর্ধাঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ আত্মার স্বর্গীয় লাইটার বড়বাবুর পায়ের কাছে পড়ে আর্তনাদ করছে, বাঁচান স্যার, আমাকে বাঁচান। গুরু কৃপায় ঈশ্বর কৃপা নয়, আপনার কৃপা চাই।—ওটা যদি না পারো, তাহলে এইটা তো পারবে, ব্যানার্জিকে গিয়ে বলল, ইনফ্লুডেড-এর বদলে এক্সকুডেড লিখিয়ে এনে ফাইলে ঢোকাও।
অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ আত্মপুরুষ এইবার ব্যানার্জির পদতলে। তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি মহেশ্বর। সখা তুমি, পিতা তুমি। এইবার সে বাড়ি ফিরছে। সম্মানিত, সম্রান্ত, তনুশ্রীর স্বামী। মুখে একটা হাসি ঝুলিয়েছে। টান টান খাড়া। অপমানের কাদা, উপেক্ষা করে উদাসীনতার জলে ধুয়েছে, বগলে একপাউন্ড পাউরুটি। সংস্কৃতিমনস্ক এক যুবক। ময়দানে বঙ্গসংস্কৃতি। দেবব্রত বিশ্বাসের উদাত্ত কণ্ঠে, আকাশ ভরা সূর্য তারা। জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রজয়ন্তী। সিনেমার পর্দায় ফেলিনি, ক্রফো, আইজেনস্টাইন, টেস্ট ক্রিকেটে মার্চেন্ট, ওয়াদেকর, সাহিত্যে কামুকাফকা সার্জ। লাল জামার রাজনীতি, পুঁজিবাদে আগুন লাগাও। শ্রমিক তুমি পার্লামেন্টে হাতুড়ি ঝোলাও। বন্ধুগণ! নেচে ওঠো। বিধান রায়কে চটকে দাও, প্রফুল্ল সেন কলা খাও, অতুল্য ঘোষ নিপাত যাও। গণনাট্য সঙ্রে গান টেবিলে তাল ঠুকে। কাঁধে ব্যাগ ঝোলা ইনটেলেকচ্যুয়াল, ঝুলঝাড়ু মাথা, ক্যালকাটা হ্যান্ডলুম পাঞ্জাবি, জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি। এইসবের ভেতর দিয়ে উড়তে উড়তে আসছে তনুশ্রীর প্রেমিক। আত্মার ঝাড়লণ্ঠন, সংস্কৃতির সার্চলাইট;না-বোঝা কথার ফুলঝুরি। সুন্দরী স্যুটকেস খুলো না, তাহলে পায়ের ফাঁকে লেজ ঢোকানো একটা নেড়ি কুকুর বেরিয়ে পড়বে। পায়ের ওপর দিয়ে চাকা চলে গেলে কুকুর যেরকম আর্তনাদ করে, সেই রকম আর্তচিৎকার বুকে চাপা আছে। তবু মুখে এক ফালি কাঁচা হাসি। স্ত্রী মনে করছে, সফল, সম্মানিত এক মানুষ সারাদিনের পর ফিরে এল। কর্মই যার ধর্ম। ছেলে আদো-আদো গলায় বলবে, আমি বাবার মতো হব। কনিষ্ঠরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলবে, আশীর্বাদ করুন। কাকে বলছে জানে না। যে জানে সে বসে আছে অন্নদাতা হয়ে। তার চোখে এই লোকটা একটা ইডিয়েট ভৃত্য। প্রতিটি টাকায় সেই কথা লেখা আছে। এই জামার ডিজাইন সেই গালাগাল, এই উদরের অন্ন সেই গালাগাল। এমনকি রাতে, যখন সে স্ত্রীকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে তখন সেই মশারির চালে ওই কাঁচ্ছি:টা সেনগুপ্ত সায়েবের মুখ। কুতকুতে চোখ, ঘোঁতঘোঁত গলা, আবার বিয়ে করা হয়েছে! প্রেম! ছেলে হবে, মেয়ে হবে। লেখাপড়া, দুধ, মাছ, জামাকাপড়, পেনসিল, খাতা, শীতের চিড়িয়াখানা, হাজার টাকার পচপানি, গেঁড়িগুগলির সংসার! সব আমার হাতে। মুহূর্তে ফিউজ করে দিতে পারি। জমিদারবাড়ির বাগানের একপাশে, নর্দমার ধার ঘেঁষে চাকরবাকরের ঘর। জমিদারবাবুর চোখে কর্তাটি শুয়োরের বাচ্চা। সারাদিন খিদমত খাটে। অনেক রাতে দু-ঢোক খেয়ে রামুর মার পাশে ধাড়ি একটা শূকরের মতোই শুয়ে পড়ে। অদৃশ্য লম্বা একটা জিভ বের করে ক্ষতস্থান লেহন করে। বাপের বেটা রামু শামুকে জড়িয়ে চটের বিছানায় শুয়ে আছে। বারোমাসই সর্দি, টনসিল, আমাশা, চোখের ঘা।
রামুর মায়ের পেটে আর একটা ঘাই মারছে। রামুর বাবা মানুষের কথা শুনেছে, মানুষ ঠিক কী জিনিস তা জানে না। এইটুকু জানে, এক ধরনের মানুষ আর এক ধরনের মানুষকে জুতো মেরে টাকা দেয়। ভয় দেখায়। একমাত্র নিজেকেই মানুষের মতো মানুষ ভাবে, বাকি সব ছাগল। অনেক বই পড়ে, বক্তৃতা দেয়, ভোটে দাঁড়ায়, বিরাট ঠাকুরঘরে বসে পুজো করে আর অন্য। মানুষের মাথা চিবিয়ে খায়। পৃথিবীটাকে এরা নিজেদের মধ্যে বেশ ভাগ করে নিয়েছে। বাকি সবাই নর্দমার ধারে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে শূকরের পাল।
পুরীতে গিয়ে সাতদিনের জন্যে এইসব কথা ভোলা গিয়েছিল। অফিসের সেই হলদে বাড়িটা নেই। ছাঁটাগোঁফ সেনগুপ্ত নেই। তাকে ঘিরে মোসায়েবদের সংকীর্তন পার্টি নেই, মনুমেন্টের তলায় মানবশঙ্খল উন্মোচনের গণসংগীত নেই, সেইসব ম্যাগাজিন নেই যার পাতায় পাতায়। সমাজতত্ব, রাষ্ট্রতত্ব, ধর্মতত্ব, বিত্ততত্ব, পৃথিবীর নতুন মডেলের কথা, কাঁড়ি কাঁড়ি উপদেশ, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ, বাংলার নবজাগরণের প্রলয়কাণ্ড। সেই বাঙালি। যারা সায়েবের
জুতোর ফিতে বাঁধত, আবার বুকে হাত রেখে বীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলত, আমাদের বিবেকানন্দ। সভার প্রধান অতিথি বাঁধানো দাঁত খুলে যাওয়ার ভয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে বলতেন, আমাদের রবীন্দ্রনাথ, শুধু বাংলার নয়, ভারতের নয়, এশিয়ার নয়, ইউরোপের নয়, সারা বিশ্বের। তিনিই আমাদের শোনালেন মহামন্ত্র। মানুষ মানুষ মানুষ, মানুষকে ভালোবাসো, আমাদের সমস্ত সংকীর্ণতায় জ্বেলে দিলেন মশালে আগুন। আমরা উড়ে গেলুম, পুড়ে গেলুম, তাই তো শুধাই, পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কী সন্ন্যাসী!
না, পুরীর সাতটা দিনের স্মৃতিতে এর কিছুই ছিল না। এই বিশাল বালুকাবেলা আমাদের, সমুদ্রমহান আমাদের, সব ঢেউ সব ফেনা, রংবেরং-এর ঝিনুক যত কুড়োতে পেরেছি, আকাশের যতটা নিতে পারা যায়, সূর্যোদয় আমাদের, সূর্য্যাস্ত আমাদের, রাতের তারা, ঢেউয়ের শব্দ। এর কোনও ঠিকানাতেই এমন কোনও লোক বসেছিল না, যে বলতে পারত অ্যায়! ইধার আও! তোমার ভ্যালুয়েশন সাড়ে সাতশো টাকা। সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে সমুদ্র দেখার অধিকার তোমার নেই। তুমি কি এক গেলাস ফলের রস খেয়ে প্রাতভ্রমণে যাও! ক্লোজড ডোর মিটিং-এ তুমি কি কোনও কোম্পানির ভাগ্য নির্ধারণের অংশীদার? তোমার কি এক কেজি মাংসখেকো হুমদো। কুকুর আছে? তোমার সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলে কেউ স্যার বলে? একটা মানুষকে টোস কিংবা রোস্ট করার ক্ষমতা কি তোমার আছে? যাও, সমুদ্র নয়, নর্দমা দেখ গে যাও।
সাতটা দিনের স্বাধীনতা। মানুষ হিসেবে কোন ক্যাটিগোরিতে পড়ছি, সে বিচার নেই। কোনও কাজের কোনও কৈফিয়ত কারওকে দিতে হবে না। সমুদ্র সৈকত ধরে তনুশ্রী ছুটছে চঞতীর্থের দিকে, পেছনে আমি। কেউ বলার নেই, এটা অসভ্যতা। হঠাৎ পাশাপাশি বসে পড়া। শুনে শেখা গানের একটা-দুটো লাইন কোরাসে, এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু, একটি সে নাম আমি লিখেছিনু। বসে থাকতে থাকতে সমুদ্রের নোনা বাতাসে তনুশ্রীর গা চটচটে হয়ে উঠত। চিরদিনের কথা ভেবে মনে দুঃখ জমত। জানালার গরাদ ধরে এসে দাঁড়াত ছেলেবেলা। অনন্তের গায়ে অন্ধকার সমুদ্রের ফসফরাস নৃত্য দেখতে দেখতে একদিন যে চলে যেতে হবে, এই বিষণ্ণতা আসত। আমি হঠাৎ তনুশ্রীর হাত চেপে ধরতুম। যেন যেতে নাহি দিব। আমাদের মধ্যে তখন এইসব কথা হত, তনুশ্রী ঢেউয়ের ওপর দিয়ে কথা বললে,
কী হল কী তোমার! ভয় করছে?
ভয় নয়, আমরা ফুরিয়ে যাচ্ছি।
কাঁচা বয়সের শেলি, কিটস, ব্রাউনিং পড়া বাঙালিরা পাশে মহিলা থাকলে এইরকম ন্যাকা ন্যাকা কথা বলতে ভালোবাসে। চলে যাওয়া সময়ের কথা। জীবনের নশ্বরতার কথা। প্রকৃতির চিরবিদ্যমানতার কথা। এই যেদিন রব না পাশে, ডাকিব না প্রিয়তম। যদিও পোড়ানো হবে, তবুও বলব, শূন্য সমাধি মোর ঢেকে দিও ফুলদলে। চার চৌকো পাথরের বেদি বড় রোমান্টিক। অভিমানের আধার। প্রেমের ঝরাপাতা, বিরহের জলে প্যাঁচপ্যাচে। হাতুড়ি পিটে যাদের খেতে হয় না, তাদের কথাবার্তা এই রকমই, ললিপপ মার্কা। মদের মতো এইসব কথার কিক আছে।
তনুশ্রী আমার কাঁধে হাত, পিঠে মাথা রেখে বলেছিল, ভয় কী, আমরা দুজনে তো একসঙ্গেই ফুরোচ্ছি। আমরা দুজনে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব। সমুদ্রের ওইখানে, এই জায়গাটায় আমাদের বসে থাকাটা পড়ে থাকবে। অন্য কেউ এসে বসবে। আবার অন্য কেউ।
খুব বড় মাপের কথা বলার প্রতিভা আমাদের ছিল না। সে থাকলে তো কত কথাই করতুম। প্রথম শীতে গায়ে কাঁথা, জমাট শীতে লেপ, পোস্তর বাটি চচ্চড়ি, পুঁইশাকের ছ্যাঁচড়া, চুনো মাছের ঝাল, এই তো জীবনের বহর। সে আর ব্ল্যাকহোলের মতো সর্বগ্রাসী কথা বলে কী করে!
তনু অবশ্য সলিড কথা থেকে লিকুইড কথায় চলে গিয়েছিল। কান্না। কাঁদছ কেন?
—এমনি, ভালো লাগছে।
এই সিচ্যুয়েশনে একটা গানের প্রয়োজন ছিল। বাঙালির প্রেমিক ছেলে, একদিকে ভুসভুসে বালি, সামনে ধপাস ধপাস অন্ধকার সমুদ্র, পিঠে একটা নরম রোদভরা প্রাণী—এই সব উপাদানের মধ্যে বসে একটা রবীন্দ্রসংগীত সামান্য ভুল সুরে গাইবে না! এমন ব্যতিক্রম তো হতে পারে না।
বেশ গলা হাঁকিয়ে ধরে ফেললুম। বেশ উপযোগী একটি গান—
কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে…
সঙ্গে সঙ্গে তনুও কুঁই কুঁই করে উঠল।
তোমার অভিসারে যাব অগম পারে
চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে…
হাত সাতেক দূরে অন্ধকার থেকে একজোড়া গলা বলে উঠল, বলিহারি, বলিহারি। চার গলায় গান যে হল,
পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা
দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা।
সকলই নিবে কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে
মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে…
এই, সকলই নিবে কেড়ে-তে এসে আর পারা গেল না। গলা ভারাক্রান্ত। দু-চারবার হ্যাঁচকা হেঁচকি। অসম্ভব হল কান্না চাপা। রবীন্দ্রনাথ জানতেন কোথায় মোচড় মারতে হয়। চার গলাতেই কান্না—সকলই নিবে কেড়ে। ঢেউ আসছে, ফেনা কেটে সরে যাচ্ছে। ফেনা ফাটার ফিট ফিট শব্দ। রেণু রেণু জলের স্পর্শ। গানটা চলছে। চার ফেরতা, পাঁচ ফেরতা। থামানো যাচ্ছে না।
স্বর্গদ্বারের শেষ মাথার সেই দোকানের ঝাঁক। সেখানে স্বপ্ন বিক্রি হয়। একপাশে অন্ধকার সমুদ্র ফুসছে, অন্যপাশে আলোকমালায় সজ্জিত দোকান-পাট, হোটেল। সবাই অভ্যস্ত জীবনের গুটি কেটে বেরিয়ে এসেছে রঙিন প্রজাপতির মতো। আমি পেছন থেকে দেখছি, আজও, কাউন্টারের সামনে ঝুঁকে আছে তনু, পরে আছে সিল্কের শাড়ি। দেহের মসৃণ নিম্নভাগ মৎস্যকুমারীর মতো, স্থির একটা ছন্দ। বড় আলো, ছোট আলো, নানা আলোয় ঝলমলে দোকান। ফরসা ঘাড়ের কাছে সরু সোনালি হারের চিকিমিকি। দৃশ্যটা একজন মানুষকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ঝিনুকের নানারকম হার, দুল তুলে তুলে দেখছে তনু। এটা দেখছে, ওটা দেখছে। গলায় পরছে, খুলছে। আমাকে দেখাচ্ছে, মতামত নিচ্ছে। আঁচল সরিয়ে নীল বুকের ওপর ঝিনুকের লকেট ভাসিয়ে একমুখ হেসে বলছে, কেমন! আবার দাম শুনে থমকে গিয়ে করুণ মুখে আমার দিকে। চাইছে। দেখছে, একটা বন্দি লোক। দু-হাতে অদৃশ্য হাতকড়া। খরচ করার অঢেল স্বাধীনতা এই লোকটার নেই। সেই আধমোটা, নারকোল কুলের মতো মাথা, সেই আমার কারারক্ষী সেনগুপ্তের ছায়া আমাদের দুজনকে ঘিরে আছে। সুখ, সখ, আহ্লাদ সব তার নিয়ন্ত্রণে। তুমি কটা খাবে, কী পরবে, কেমন পরবে, সবই তার কৃপা।
তবু আমি বলছি, তোমার যদি পছন্দ হয়ে থাকে তুমি নাও, দামের কথা ভেবো না।
কথাটা বলতে বলতে মনে হয়েছিল, রিচার্ড বাটন এলিজাবেথ টেলরকে বলছেন, ডার্লিং, ইফ দ্যাট প্লিজেস ইউ টেক দ্যাট ডায়মন্ড নেকলেস। নাথিং ইজ প্রেশাস দ্যান ইয়োর আইভরি নেক।
মনে আছে, এর পর আমরা কিছু কটকি গামছা কিনেছিলুম, জামদানি কেনার আনন্দে। সেই রাতে হোটেলের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছিল তনু। নীল কোলের ওপর সমুদ্র থেকে কুড়িয়ে পাওয়া যত ঝিনুক, দোকান থেকে কেনা যত ঝিনুকের গয়না। আলিবাবার মাঝরাতে মোহর গোনার মতো দৃশ্য। খুশিতে মুখ উপচে পড়ছে। কত কত দেখো কত ঝিনুক। সব আমি কুড়িয়েছি।
আমি যে তখন অঘ্রান মাসের মুলোর মতো তরতাজা। তনু লকলকে পালং। আমি একটু একটু করে তার দিকে এগোচ্ছি। একটা সাপ খেলা করছে পিঠের দিকে। তনুর ঘাড় বেয়ে, পিঠের ঢাল বেয়ে আমার নাক নামছে। ঠোঁট দুটো ত্বক ছুঁয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ কোমরে। বেড় দিয়ে শরীরের সামনের দেয়াল ধরে ওপরে উঠছে। নরম দুটি ফল। মখমলের মতো গিরিপথ। খসখসের মৃদু গন্ধ। পাখির ঠোঁট ফল ঠোকরাবে। ক্রমশই বর্বরতা বাড়ছে। ডানার ঝাপট মারছে পাখি। রাতের জোয়ার এসেছে সমুদ্রে। গর্জন ভীষণ। ছেড়া আকাশে তারার চুরমার। নুনের গন্ধ। কিরকিরে। বালি। জঘনের স্বাদ। ছড়ানো ঝিনুক। এনামেলের শব্দ। কোনও কথা নেই। শুধু শ্বাসের হাপর। ছাড়ানো চুলে ফোঁটা গন্ধরাজ মুখ। কপালে কেঁপে যাওয়া টিপ। আবেগে আধবোজা চোখ। ফসফরাসের ভাস্কর্য।
অনেক অনেক পরে ছড়ানো ঝিনুকের মাঝে উঠে বসল তনুশ্রী। ঘামে ভেজা পিঠ। কপালে চুল নেমে এসেছে। গড়ুরের ছিন্নভিন্ন ডানার মতো সাজপোশাক চারপাশে ছড়ানো। লজ্জা নিয়ে। একপাশে বসে আছি। ঝড় চলে যাওয়ার পর ভাঙা বোতলের উপলব্ধির মতো। তনু সেই অনাবৃত অবস্থাতেই আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার শরীরে। জীবন্ত আবেগ।
হোটেলের সামনে স্বর্গদ্বারের পথ নির্জন। ঘুমিয়ে পড়েছে সব দোকান। বাতাসের বালি নিয়ে খেলা। সমুদ্রের ঢেউয়ে শঙ্খের গর্জন। উদবেল কুরুক্ষেত্র। ঢেউ সব পাণ্ডব ও কৌরবপক্ষীয় সৈন্যসামন্ত। মহারথীরা সব শাঁখ বাজাচ্ছেন। পাঞ্চজন্য হৃষিকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ। শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চজন্য, অর্জুনের দেবদত্ত, ভীমের পৌন্ড্র, যুধিষ্ঠিরের অনন্তবিজয়, নকুলের সুঘোষ, সহদেবের মণিপুষ্পক। সমুদ্র থেকে একের পর এক সেই শাঁখের শব্দ।
সব ঝিনুক একে একে কুড়িয়ে একটা বেতের ঝাঁপিতে রাখা হল। ঝিনুকের গয়না আর একটায়। শুয়ে কী হবে! রাতের আর কতটুকুই বা পড়ে আছে তলানি। সমুদ্রের সামনের রাস্তায় নেমে এলুম আমরা দুজনে। যতটা পারা যায় ভোগ করে নাও। দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগ চাবুক আছে, থাকবে, থাক। এরই মধ্যে থেকে আনন্দটা নিংড়ে নিতে হবে। কয়েক ফোঁটা যা পাওয়া যায়। তনু আর আমি হাত ধরাধরি করে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে হাঁটছি। রাজবাড়ির দালানে, চার-পাঁচটা লোক আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আমরা হাত দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছি। পুলিশ চৌকির পাশ দিয়ে সমুদ্রকে ডান দিকে রেখে। হঠাৎ তনু বললে, তোমার খিদে পাচ্ছে না!
তনু এই ভাবেই কথা বলত, আমার খিদে পেয়েছে। আমার ঘুম পেয়েছে, বলবে না।
এক কাপ চা, কিছু খাবার পেলে মন্দ হত না। তেমন কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। মাঝরাতের বাতাস ছাড়া আর কী পাওয়া যাবে! আমরা আরও অনেক দূরে যেতে পারতুম। টহলদার পুলিস বললে, হোটেলে ফিরে যাও। কিছু খারাপ লোক এই সময় ঘুরে বেড়ায়।
জীবনের সমস্ত বালি চালুনি দিয়ে চালতে চালতে এইরকম দু-একটা সোনার কুচি চকচক করে ওঠে। খুব পয়সাতেই যে খুব সুখ এমন কথা আর বলতে পারব না। আমাদের পুরোনো বাড়ির টিনের চালের রান্নাঘর থেকে বর্ষার বোদা সকালে ভারী আকাশের দিকে যখন ইলবিলি করে। কয়লার উনুনের ধোঁয়া উঠত, তখন ভাঙা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে দেখতুম, ছোট্ট মানুষের ছোট সুখ। একটা নতুন দিনের আরতি। পাহাড়ি কম্বলের উষ্ণতায় ছেয়ে যেত মন। যা। আছে তাই দিয়েই তনু রাঁধবে। চাকি-বেলনের ঠকাস ঠকাস শব্দ। গরম রুটির খসখসে গন্ধ। আলুর তরকারি। টিফিন কৌটো রেডি। ন’টার সময় দৌড়োবে ছোকরা। দরজায় দাঁড়িয়ে হাসি মুখে দুর্গা দুর্গা। দেরি কোরো না। ছাতাটা হারিয়ে এস না। পারলে একটু চা এনো। আজ একজোড়া বর্ষার জুতো কিনবে। কিনবেই কিনবে।
মস্ত বড় পৃথিবী। কোটি কোটি মানুষ। বিশাল হিমালয়। বিপুল নায়াগ্রা ফলস, বিশ্রী রকমের বড়লোক রফফেলার, ভয়ংকর মাথা আইনস্টাইন, বিধ্বংসী অ্যাটম বোমা, সনি লিস্টনের ঘুসি, জাপানি সামুরাই, রানি এলিজাবেথ, সুন্দরী মেরিলিন, সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস, হোয়াইট হাউস, তারই মাঝে অখ্যাত পাড়ায় অজ্ঞাত একটা লোক। আকাশের অনেক নীচে। হাজার তিরিশ ইটে গাঁথা একটুকরো বাড়ি। শ্যাওলাধরা ছোট্ট একটা উঠোন। কলঘর। টিনের দরজা। খোলে দড়াম শব্দে। শিকলের ঝনাৎকার। হ্যান্ডপাম্পের ঢং ঢকং। এপাশ থেকে ওপাশ তার। ঝোলা লাল গামছা, আটপৌরে শাড়ি। বল সাবান। ক্ষার ফোঁটাবার লোহার কড়া, কয়লা ভাঙার হাতুড়ি। টবে টবে গোটাকতক রিকেটি গাছ। ফুলের আশা! ভাঁজ করা বস্তার পাপোশ। আনাজের ঝুড়ি, আঁশ আর নিরামিশ দু-ধরনের বঁটি। মা লক্ষ্মীর পট, লক্ষ্মীর ঝাঁপি। খোবা মতো একটা মেনি বেড়াল। ছোট্ট একটা টেবিল। পৃথিবীর লাখ লাখ কিউবিক ফুট কাঠের মাত্র কয়েক কিউবিক ফুটে তৈরি। তার ওপর ছোট্ট একটা আয়না। কোটি মুখের একটা মুখ। ছোট্ট বুরুশ, সাবানের। ফ্যানার দলা। দাড়ি চাঁচা। এতটুকু একটা ব্যাগ বগলে খাঁচার দরজা খুলে বাজারে। বিশাল হল। আতঙ্কের, ভয়ের। সেটাকে যত ছোট করা যায় ততই সুখের। দুটো প্রাণীর ভাব-ভালোবাসা। গায়ে গা লাগিয়ে বসা। দেহের উত্তাপ। মনে থেকে মনে সেতু নির্মাণ। সাগর বন্ধনের চেয়ে আনন্দের। তুচ্ছ কিছু কথা। ঘটি, বাটি, গামলার সুখ। ঘোড়ার পিঠে তরোয়াল হাতে রাজ্য জয়ের স্বপ্ন নয়, একটা তোলা উনুনের স্বপ্ন।
দোর তালা বন্ধ করে। হেঁশেল-র্টেসেল গোছগাছ করে। আলো নিবিয়ে, টুক করে পা তুলে মশারিতে ঢুকে পড়া। খোঁপাটা আলগা করে বালিশে মাথা। দিনের যুদ্ধ শেষ। রাতের বিরাম। ডায়েরিতে লিখে রাখার মতো কোনও দিন নয়। অনেক দিনের একটা দিন। সকালে পড়ে থাকবে আলোর গায়ে আছাড় খাওয়া মরা বাদুলে পোকার মতো।
একটা হাত বুকে এসে পড়বে। ভারী একটা পা চেপে আসবে তলপেটে। ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস। ঘনিষ্ঠতার সুখ। মাথার ছাত, চারপাশের দেয়াল সরিয়ে দিলেই বড় অসহায়। মানুষের বর্ণমালার ছেড়া দুটো অক্ষর, ক আর খ। হা হা আকাশের তলায় কুচো চিংড়ি। এই সংকীর্ণতাতেই মহতের স্বপ্ন। এই সময় জড়াজড়ি করে যত আশা-আকাঙ্ক্ষার মালা গাঁথা। দু চারটে হাই, টান শরীর ক্রমে শিথিল। কথা জড়াতে জড়াতে এক সময় তলিয়ে যাওয়া ডুব। সাঁতার। যেখানে থাকা সেইখানেই থাকা। যায় না কোথাও। শুধু দিনটা মাড়িয়ে চলে যায়। বোঝাও যায় না, মৃত্যুর দিকে আরও এগিয়ে যাওয়া গেল।
লিভার, পিলে, ফুসফুস আরও সেকেন্ডহ্যান্ড হয়ে গেল।
তনু জিগ্যেস করলে, তোমার পকেটের খবর কী?
কেন বলো তো! সেই কানের দুল?
ধুস, দুল কী হবে! আমাকে একটা ভালো ঢালাই করা তোলা উনুন কিনে দেবে! কাগজে বিজ্ঞাপন দেখছিলুম। বেশ অনেকদিন টিকবে। ভালো আঁচ হবে। সহজে ধরবে, কম কয়লা লাগবে। এই বালতির উনুন একেবারে টেকে না।
এই তোমার চাহিদা! কালই আমার সঙ্গে চলো। কিনে দেবো।
খুব বেশি দাম হলে কিনব না! সামনে অনেক খরচ।
তনু তখন মা হতে চলেছে। সেই যে সমুদ্র, সেই যে ফেনা, সেই যে ঝিনুক সেই যে রাত। আমাদের সন্তান আসছে। শ্রীক্ষেত্রের দান।
কত আর দাম হবে। চলোনা দেখাই যাক।
একটা বড় কিছু হতে চলেছে, সেই আনন্দে তনু আমাকে পাশ বালিশ করে ফেলল। শরীরটা ভারী হয়েছে। মধ্যভাগের স্ফীতিতে ঘনিষ্ঠতার ব্যবধান বেড়েছে। আমার আর তনুর মাঝে আর একটা প্রাণ। শরীরে আড়ালে টলটল করছে, তালশাঁসের মতো। আনন্দ হচ্ছে, উদবেগ। আবার এও মনে হচ্ছে যাঃ তনু মা হয়ে গেল।
কানের কাছে মুখ এনে লাজুক গলায় বললে, হ্যাঁগো বাজারে পেয়ারা উঠেছে? বেশ ডাঁসা ডাঁসা।
উঠেছে।
পয়সা কুলোলে আনবে? খুব খাই খাই বেড়েছে। ঝাল ঝাল চানাচুর, লেবুর আচার। মনে হয়, এটা ছেলে। তনুর শ্বাসে দুধের গন্ধ লেগেছে। ত্বক খুব তেলতেলে হয়েছে। তনু আর প্রেমিকা রইল না। সংসারে ঢুকে গেল। ক্লান্ত তৃপ্ত। ঘুমিয়ে পড়ল। আমার সঙ্গে মাছের মতো খেলা করার ক্ষমতা নেই।
একটা উনুন, ডাঁসা পেয়ারা, আচার, চানাচুর—এই চাহিদা। এই খাঁচার এই দুই প্রাণীর এই হল জগৎ। একটু আগে রাশিয়ার নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন, তাঁর নভোযান থেকে বেরিয়ে মহাকাশের নিরালম্ব ভাসমানতায় বিচরণ করে বিশ্বমানবকে স্তম্ভিত করে দিয়েছেন। মহাকাশে। মানবের জয়যাত্রার সূচনা। আবার ওদিকে পূর্ব ও পশ্চিমকে আলাদা করতে বার্লিনে পাঁচিল তুলেছে কমিউনিস্টরা। কমিউনিস্ট-খপ্পর থেকে মানুষ যাতে পশ্চিমের ধনতন্ত্রের প্রাচুর্যে, ভোগে, উন্নত জীবনে না পালাতে পারে। হো চি মিন-এর ভিয়েতনামে ভয়ংকর যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে আসছে। বিলাসবহুল ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের বাজারে মাছের দাম কমছে না। চিনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘোলাটে হচ্ছে। কাশ্মীর নিয়ে ধুন্ধুমার। আমি মশারির ভেতর, আমার পাশে তনু। ঘুমে অচৈতন্য। ছোট্ট কপালে সিঁদুরের টিপ। ঠোঁটের কোণের হাসি কাঁপছে। স্বপ্ন দেখছে কোনও। ভীষণ সবুজ একটা মাঠ, নীলের চেয়েও নীল আকাশ। দিগন্তের দিক থেকে। একটি শিশু টলমলে পায়ে সামনে দু-হাত তুলে হেলে-দুলে ছুটে আসছে। সবকালের সব মানুষই এই ভাবে প্রবেশ করে। হো চি মিন, গ্যাগারিন, কেনেডি, দ্য গল, রাসেল, আইনস্টাইন। আসবে, তারা হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে আসবে। বর্ষার গঙ্গায় চিতি কাঁকড়ার মতো। কেউ চাপা পড়বে, কেউ যুদ্ধে মরবে। কিছু বিপ্লবে নাচতে গিয়ে শহিদ হবে, কেউ শুধু প্রাণধারণ করবে, কাঁধে করে কারওকে গদিতে বসানো হবে, কেউ মালিক হবে, কেউ মজুর, আবার কেউ কেউ হবে স্ট্যাচু।
খুব সাবধানে ভয়ে ভয়ে তনুর পেটে কান ঠেকালুম। কী রে ব্যাটা। কে এলি। কী করছিস ওই। অন্ধকারে। থই থই জল। আর এক শঙ্করাচার্য, নাকি শ্রীচৈতন্য, গৌতম বুদ্ধ, বলরাম, বাসুদেব। শোনোবৎস, বড় অভাবের সংসার। তোমার মায়ের সাকুল্যে সাতখানা শাড়ি। সোনা-দানা তেমন নেই। মাছ, মাংস, ডিম স্বপ্ন। টিনের দুধের দাম বেড়েছে। রোজগারের ক্ষমতা আমার তেমন নেই। সবাই বলে মাথামোটা। তোমার মায়ের মাথা খুব ভালো। চাকরির বাজারে নামলে সংসার সম্পদে ভেসে যেত। এখন ভেতরে ভেসে ভেসে মায়ের মাথাটি নেওয়ার চেষ্টা করো, আর তোমার ঠাকুরদার আদর্শের উত্তরাধিকার। আমরা পার্টনারশিপে তোমাকে এনেছি বটে, তবে আমি হলুম স্লিপিং পার্টনার। আমার কোনও কিছু নেওয়ার চেষ্টা কোরো না। তাহলেই বিপদ। তাহলে নীল আকাশ তোমাকে পাগল করবে, চাঁদের আলোয় ঝিরিঝিরি গাছের পাতা দেখে। রবীন্দ্রসংগীত গাইতে ইচ্ছে করবে, পাখিদের জটলায় সময় ভাসিয়ে দেবে। একতাল মাটি নিয়ে মূর্তি গড়তে বসবে, বৃদ্ধার কাছে গিয়ে পুরোনো দিনের গল্প শুনতে চাইবে। কোনও দরবেশের পেছনে পেছনে অকারণে অনেকটা পথ চলে যাবে। নদীর গান শুনতে ইচ্ছে করবে, মানুষকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে। মন্দিরে গিয়ে আরতি দেখতে ইচ্ছে করবে। প্রেম করতে ইচ্ছে। করবে। এমন সব কাণ্ড তুমি করতে থাকবে যার ফলে নুন আনতে পান্তা ফুরোবে। অভাব, অপমান, উদবেগ। সকলের পৃথিবী তোমাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে। ভোগ করতে পারবে না। কিছুদিন দর্শক হয়ে জীবন কাটাবে। ধূর্ত হও, শঠ হও, নিষ্ঠুর হও, হৃদয়হীন হও, স্বার্থপর হও, বেইমান হও। পৃথিবীটা শয়তানের।
ওই সময়টা শুয়ে শুয়ে প্রায়ই আমাদের এই রকম কথা হত, ইনকামটা যদি কোনওরকমে আর পাঁচশো টাকা বাড়ত, তাহলে আর আমাদের এত দুশ্চিন্তা থাকত না। মাত্র পাঁচশো টাকা। তনু। সংসার চালায়। ফাইনান্স মিনিস্টারের মতো বাজেট করে। তিনি বছরে একবার করেন, তনু মাসে একবার। কখনও এইটায় হেঁটে ওইটায় লাগায়, কখনও ওইটা হেঁটে এইটায়। ছাঁটকাটের কারবার।
প্রায়ই দেখতুম ঠাকুরঘরে চোখ বুজে আছে স্থির হয়ে। ভগবানই ভরসা। অঘটন যদি কেউ ঘটাতে পারেন তিনি ভগবান। গরিবের ভরসা তিনি। মানুষ এইরকম ভেবে আসছে চিরকাল। বারের। উপপাস, সন্তোষী মা সবই চালু হয়ে গেল। কার ক্ষমতা বেশি জানা তো নেই। কামনা তো অনেক, সুসন্তান, রোজগার, সুস্বাস্থ্য, সুগৃহ, মানসম্মান, প্রতিপত্তি। একটু বড়লোক হতে পারলে মন্দ কী।
সবচেয়ে সস্তার মাতৃসদনে আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হল। নিখুত একটি পুত্র। হাত-পা বেশ বড়সড়। চোখ দুটো সুন্দর। ফরসা রং। নর্মাল ডেলিভারি। তনু ভোগেনি, তনু ভোগায়নি। কর্মী মেয়েদের এই রকমই হয়। ওই যে রোজ দু-ঘণ্টা ধরে ঘর মুছত, রান্নাবান্না, জল তোলা, ওইটাই তো সেফ ডেলিভারির কারণ মশাই। বিপদ তো অলস বড়লোকদের।
দুই থেকে আমরা তিন হয়ে গেলুম। তরতর করে বাড়তে লাগল আমাদের সন্তান।
এই সময় অদ্ভুত যে ঘটনাটা ঘটল সেটাও তো বলা দরকার। ক্যারাম খেলার একটা মার আছে, সেটাকে বলে ট্যানজেন্ট। সরাসরি খুঁটিটাকে মারা হবে না, একটু কায়দার মার, রিবাউন্ডও আর এক কায়দা। স্ট্রাইকারটা প্রথমে বোর্ডের ধারের কাঠে গিয়ে লাগবে, সেখান থেকে ছিটকে এসে। খুঁটিটাকে পকেটে পাঠাবে। সেইরকম একটা ঘটনাই ঘটল আমার জীবনে। রিবাউন্ড এফেক্ট। একটি ছেলে আমার কাছে পড়ত। সরলা মেমোরিয়ালের ছাত্র। সে হঠাৎ স্কুল ফাইনালে থার্ড হয়ে গেল। কৃতিত্বটা তারই, আমি নিমিত্ত মাত্র। সেই ছেলেটির পাশাপাশি আমারও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। হবে না কেন, মাস্টারমশাইয়ের ছেলে তো। ওর কোচিং-এর ধরনটাই আলাদা।
আমিও মাস্টারমশাই হয়ে গেলুম। রাস্তায় বেরোলেই, মাস্টারমশাই কেমন আছেন? সৌরভ সাতটা লেটার পেয়েছে। আপনার কোনও তুলনা নেই। মাস্টারমশাই। দোকানে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্রই, আরে আরে মাস্টারমশাইকে আগে ছেড়ে দে। কী চাই মাস্টারমশাই। ঢিপঢ়াপ প্রণামও জুটতে লাগল। বাসে উঠে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ বসার জায়গাও দিতে লাগলেন।
নীলাচলে সন্তানলাভ। স্বয়ং জগন্নাথ। তারপরেই বোধহয় এই সৌভাগ্যোদয়। তাহলে নাম রাখ নীলাচল। কৈলাস বললে, এই সুযোগ, চেপে ধর, লাইন খুলছে।
লাইন মানে?
লাইন মানে মানুষ ক্রমশ বোকা হচ্ছে। সবাই ভাবছে, ছেলেমেয়ে ডিগ্রি ডিপ্লোমা ডক্টরেট পেয়ে ইউরোপ আমেরিকা যাবে, আই এ এস করবে। যতদিন সাহেবরা ছিল, ততদিন বাংলার কদর। ছিল। এখন সব ইংলিশ। কিছু লোকের হাতে পয়সা এসেছে, তারা সাহেব হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এই সুযোগ, মাস্টারমশাইয়ের নামে একটা মডেল, কেজি স্কুল খুলে ফেল, আর একটা কোচিং সেন্টার। তনুকেও কাজে লাগা। ম্যানেজমেন্ট আর প্রচারের দায়িত্ব আমার।
জায়গা?
সেটাও আমার দায়িত্ব। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য—এর চেয়ে ভালো ব্যবসা আর নেই। কোচিং সেন্টার, নার্সিংহোম।
শেষে জোচ্চুরি!
জোচ্চুরি কোথায়!
এ অনেকটা ভাঙা বাড়ির দরজা-জানালা, মার্বেল পাথর বিক্রি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দু-দলের মারদাঙ্গায় লাটে উঠেছে, হাসপাতাল পাতালে গেছে। এই ভাঙা আসরে আমরা তবলা বাজাব। টুইঙ্কল, টুইঙ্কল লিটল স্টার, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর। বাঙালি বিবি, জেন্টলম্যান। স্টিংকিং মানি অ্যাম্বিশন। এর নাম হল প্যারালাল সিস্টেম। ঝোপ বুঝে মারো কোপ।
এখানে ওসব চলবে?
এখানে নয় ম্যান। এতকাল তোমার ভাগ্যসূর্য উত্তরায়ণে ছিল, এইবার দক্ষিণায়ণে যাবে। অর্থাৎ এটা আমরা করব সাউথে।
মোটা ছেলে, রোগা ছেলে, ছিচকাঁদুনে ছেলে, তেওঁটে ছেলে, একবপ্না ছেলে, ঘাড় কাত মেয়ে, খ্যাঁতখেতে মেয়ে, মুখরা মেয়ে, নীরব মেয়ে, যেখানে যত ছিল সব নিয়ে শুরু হয়ে গেল ইংলিশ মিডিয়াম। কৈলাসের কেরামতি, বিধবা মাইমাকে ভুজুং ভাজং দিয়ে মামার বাড়ির খানিকটা। ম্যানেজ করেছিল। মামা নামকরা ডাক্তার ছিলেন। বাড়িটাও বিশাল। খোলামেলা জায়গা। অনেকটা। টাকাটাও কৈলাস জোগাড় করেছিল। প্রচারেরও অভাব হয়নি।
তনুর কিন্তু ভালো লাগেনি এইসব। তুমি অন্যায় করছ, মাস্টারমশাই বেঁচে থাকলে তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করতেন। তুমি ব্যবসা ফেঁদেছ। তুমি তাঁর আদর্শ থেকে সরে যাচ্ছ। অভাব আর আদর্শ হাত ধরাধরি করে চলে। কে তোমাকে বড়োলোক হতে বলেছে? আমরা তো বেশ আছি।
লোভ যে আমার ছিল না, তা নয়। মনে হয়েছিল, বাপ-ঠাকুরদার আমলের জীবন থেকে বেরিয়ে আসি। ছেলেটাকে মানুষ করি। বিলেত পাঠাই। সেনগুপ্তর শাসন থেকে বেরিয়ে আসি। মনের মতো একটা বাড়ি করি। সামনে-পেছনে বাগান। ঢুকেই সামনের দেয়ালে অয়েলে আঁকা মাস্টারমশাইয়ের ছবি। আমার মায়ের কোনও ছবিই নেই। জানিই না কেমন দেখতে ছিলেন তিনি! কার্পেট মোড়া বসার ঘর। মনের মতো একটা লাইব্রেরি। এই সব যদি হয়ই, মাস্টারমশাইয়ের আত্মা কেন রাগ করবেন।
আমি কৈলাসের মুঠোয় চলে গেলুম। কৈলাস ব্যবসা বোঝে। আমাদের কোচিং সেন্টার ক্রমশ বড় হতে লাগল। নোটস আজ সাজেশনের খুব নাম হল। কম পড়ে অনেকেই পাস করতে চায়। ক’জন আর শিক্ষিত হতে চায়। আমাদের কেজি স্কুলের তাক লাগানো ভড়ং। ড্রেস, খাতা, বই, ডিসিপ্লিন, মাইনে—সব মিলিয়ে সমীহ করার মতো একটা ব্যাপার।
তনু কিন্তু ক্রমশই দূরে সরতে লাগল। হচ্ছে না, এসব ঠিক হচ্ছে না। সেই আগের তুমি অনেক ভালো ছিলে। কোনও ব্যাখ্যা নেই। কেন, ভালো ছিলুম। তখন নাকি আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। বোঝাতে পারিনি, স্বপ্ন ভালো, না স্বপ্নকে বাস্তব করাটা ভালো। একটা লোক সারাজীবন চটে শুয়ে রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। সে তো অপদার্থ।
রোজ রাতে তনু কাঁদে। কাঁদছ কেন?
তোমার মৃত্যু হচ্ছে।
আমাদের বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। বছরে একবার ফার্স্ট ক্লাসে চেপে। সপরিবারে বিদেশভ্রমণ। তোমাকে সাজাব, তোমাকে খাওয়াব, তোমাকে সুখের সাগরে পদ্মফুলে ভাসাব।
যদি পারো, যদি বাপের ব্যাটা হও, মাস্টারমশাইয়ের মতো হও। কিছু ভালো ছেলেকে পড়াও, জীবন তৈরি করো। না হয় কিছু কমই খেলে। না হয় মোটা কাপড়-জামাই পরলে।
তনুর একই উপদেশ রোজ শুনতে শুনতে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল। আমার একটা ভুঁড়ি হয়েছে। মুখের ধারালো ভাবটা কমে এসেছে। ক্রমশ গোল হচ্ছে। দুটো চিবুক হয়েছে। কথাবার্তার ধরন পাল্টেছে। এমন কিছু লোকের সঙ্গে স্বার্থের খাতিরে মিশতে হচ্ছে যারা অসৎ। না, ভালো হচ্ছে না। সাতশো টাকা নিয়ে আমাদের সেই পুরী ভ্রমণ, সি-বিচে সেই দৌড়, সেই ঝিনুক কুড়োনো, সেই ঢালাই উনুন নিয়ে বাড়ি ফেরা, চারটে ডাঁসা পেয়ারা। কোন জীবনটা ভালো ছিল। প্রেম বড়ো, না প্রতিপত্তি বড়।
খুব বাঁচা বেঁচে গেলুম। কৈলাসের মাইমাই ল্যংটা মারলেন। কৈলাস আর আমি ছিটকে বেরিয়ে এলুম। কেজি, মন্তেসরি, কোচিং সবই রইল—আমরা রইলুম না। প্রিন্সিপ্যাল হয়ে বসলেন প্রফেসর চক্রবর্তী। তিনি স্যুট পরেন, মুখে বায়ু চুরুট। কৈলাসের মাইমার বয়কাট চুল, রেগে গেলে বাংলা বলেন, নয় তো ইংলিশ। আমাদের কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করে দিলে। কৈলাস ফিরে এল তার পুরোনো ছাপাখানায়। আমি বেকার। জগন্নাথস্বামী নয়ন পথগামী ভবতু সে।
এইবার কী হবে তনু?
এইবার ঠিক হবে। ছাত্রছাত্রীর অভাব হবে না। বাড়িতে বসেই শুরু করা যাক। সকাল-বিকেল শুরু হয়ে গেল ছেলে পড়ানো। দেখতে দেখতে কুঠিয়াটা হয়ে উঠল গুরুগৃহ। মাস্টারমশাই। কেউ মাইনে দিতে পারে, কেউ পারে না, কিন্তু ভারি সম্মান। ভবিষ্যতের কারিগর। কষ্ট খুব, কিন্তু খুব সুখ। কিছু কিছু উৎকৃষ্ট ছেলেমেয়েও আসতে লাগল। যাদের শুধু লেখাপড়া নয় জ্ঞানও হবে। পড়াতে গিয়ে নিজের পড়াশোনাও বেড়ে গেল। মাথাটাও খুলে গেল। বাড়িতে প্রায় সব সময়েই বিদ্যাচর্চা। লক্ষ্মীর আড়ত থেকে মা সরস্বতীর আখড়া। তনুর এখন এক নয়, অনেক ছেলে।
মাস্টারমশাই যেমন বলতেন, আমিও সেইরকমই বলি, মশাই এর হবে না। ব্যর্থ চেষ্টা করবেন না। বরং কোনও লাইনে ফেলে দিন। লেখাপড়া মানে শুধুই ডিগ্রি, ডিপ্লোমা নয়, সব শিক্ষাই শিক্ষা—প্লাম্বিং, কার ড্রাইভিং, ইলেকট্রিশিয়ান। কিছু করে যাতে জীবনে দাঁড়াতে পারে। যা হয় না, তা হয় না। গলা নেই গান, শরীর ভাঙে না নাচ, দেখার চোখ নেই ছবি আঁকা। ভেতরে না। থাকলে বাইরে তার প্রকাশ পায় না। স্বামীজির কথা।
পয়সাঅলা অভিভাবকরা রেগে যেতেন। অনেকেই বলতেন দুমুখ। ব্যাটার খুব ট্যাঁক ট্যাঁক কথা। এইভাবে গোটা কুড়ি ছেলেমেয়ে বেশ ভালো তৈরি হল। বড় বড় জায়গায় গিয়ে বসল। আদর্শ। মানুষ হয় তো সবাই হল না তবে শিক্ষিত হল। বড় জীবনের দিকে চলে গেল। মাস্টারমশাইকে হয়তো মনে রাখলে না, কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের মনে তারা রইল।
এই সময়েই তনু বললে, দোতলাটা তোলা যাক। ঘরের দরকার হবে। নীচেটা ড্যাম্প। তোমার ব্রঙ্কাইটিস হয়েছিল। মাঝেমাঝেই তেড়েফুঁড়ে ওঠে। দোতলায় রোদ পাবে। খোলামেলা বাতাস। অনেক দূর দেখা যায়। টাকা কিছু জমাতে পেরেছি টেনেটুনে সংসার চালিয়ে। মনে হয় হয়ে যাবে।
বাড়ি দোতলা হল। একটা মনের মতো বারান্দা। তিনখানা শোবার ঘর। বাথরুম। দুটো বেতের চেয়ার কেনা হল। রাতের দিকে পাশাপাশি দুজনে বসি। তনুর চুলে পাক ধরেছে। শরীরটা ভারী হয়েছে। আজকাল আগের মতো আর খাটতে পারে না। খাটার অভ্যাসটা অবশ্য যায়নি।
সবাই বলে, আমাকে নাকি আমার বাবার মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে। স্বভাবটা যে তাঁর মতো হচ্ছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। লোভ প্রায় চলেই গেছে। কামনা-বাসনা কুঁকড়ে গেছে। চাটুকারিতা সহ্য হয় না। বাইরেটা আর ভালো লাগে না। নিজের ভেতরেই থাকতে ইচ্ছে করে। সব এত পালটে গেছে! এখন কোনও ছেলে একটা লেটার কম পেলে তার বাবা-মা এসে চোখ রাঙায়। এটা কী হল মাস্টারমশাই!
বেতের চেয়ারটায় কী আছে কে জানে। বসলেই নানারকম ভাব আসে। কৈলাস সেদিন বেশ বলেছিল, দ্যাখ, আমরা কীরকম বসে বসে বুড়ো হয়ে গেলুম। কোনও চেষ্টাই করতে হল না। সব কিছুর জন্যে কসরত করতে হয়, বুড়ো হওয়ার জন্যে কিছুই করতে হয় না। খেয়ালই ছিল না, কবে চোখে চশমা উঠল। বাইফোকাল হল। মুখগহ্বরে জিভ একদিন আনমনা ঘুরতে ঘুরতে
আবিষ্কার করল, তিনটে দাঁত নেই। সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে হাঁটু একদিন অনুভব করল জল শুকিয়ে এসেছে। পেট একদিন ঘোষণা করল, পরিপাক শক্তি দুর্বল হয়ে এসেছে। গুরুপাক সহ্য হচ্ছে। ভোরবেলা আর শিস দেওয়া পাখির মতো ফুড়ুত করে বিছানা থেকে উড়ে যেতে পারছি না।
Second Childishness and mere oblivion
Sans teeth, Sans eye, Sans taste, -Sans-everything
কৈলাস বলছে, আবার এসে সেই গোড়া থেকে শুরু করতে হবে, একই নাটক, একই পরিণতি, অন্য নামে, অন্যখানে।
.
২.
ফুটো সড়াক করে হড়কে অনেক দূর চলে গেছে। রিপভ্যান উইঙ্কলের যেন ঘুম ভাঙল। সেই অবস্থা আমার। রাস্তার দিকে ঝুল-বারান্দায় বসে থাকি। অবাক হয়ে দেখি, এসব কী! কত পরিবর্তন। রাস্তায় প্রতি পাঁচজনে চারজন রমণী! শাড়ি মধ্যবয়সিদের ভূষণ হলেও তরুণীদের সালোয়ার-কামিজ। তরতর করে চলেছে কলেজে, কাজে, কি নাচের স্কুলে। নিছক বেড়াতে, কি রোল কাউন্টারে। অনেকের সঙ্গেই বয়ফ্রেন্ড। বিউটি পার্লারে ছাঁটা চুল, কপালের দু-পাশে নিদ্রিত বাদুড়ের ডানার মতো লটরপটর। স্কুটারের পেছনে আলটপকা বসে ফরফর চলেছে। কোনও ভয়ডর নেই। আজকাল কর্তা-গিন্নি দুজনেই রোজগারে বেরোয়। স্ত্রীকে অফিসে ড্রপ করে স্বামী নিজে অফিসে চলে যায়। ফেরার সময় স্ত্রীকে কালেক্ট করে আনে। অনেকে সপ্তাহে একদিন রাঁধে। ফ্রিজে লাট করা থাকে। গরম করে করে সারা সপ্তাহ চলে। ফ্রিজ থেকে বার করো আবার ঢোকাও। সবই খাবারের মৃতদেহ। মর্গ থেকে বেরোল। পোস্টমর্টেম হল। খাওয়া তো নয়, পোস্টমর্টেম। লাশ আবার চালান করে দেওয়া হল ঠান্ডি ঘরে। একালের মানুষের সময় কোথায়! এই সংস্কৃতির নাম রেখেছি কোল্ট কালচার, অশ্ব সংস্কৃতি। সবাই ঘোড়া, পিঠে চেপে বসেছে অ্যাম্বিশন। টগবগর ছুট। দৌড় দৌড়। এই বুঝি আমাকে মেরে বেরিয়ে গেল। মানুষের চোখের দিকে তাকালে অস্থির একটা অন্দরমহলের খবর পড়া যায়। পর্বতারোহীর মতো সবাই দড়ি ধরে ঝুলছে। উপরে উঠতে চায়, টপে, শীর্ষে। সেখানে আছেটা কী! তা জানা নেই।
শয়তান চরিত্রটা কেমন? রাস্তার উটকো বদমাইশ ছেলের মতো। হাতটা মুঠো করে সামনে ধরে বলছে এই নে, কী আছে বল তো! মনে মনে যখন যা চাই, হাতের মুঠোয় তাই আছে ভাবি। কী আছে রে! হিরে! সোনার ঘড়ি, টাটকা মোহর। যেই হাত খুলল, দেখা গেল কিছুই নেই, ফক্কা। সেই ফক্কার পেছনে ছুটছে। রাজনীতি করি। জনসেবা গণসেবা। জীবন জমিতে পেতে দিয়েছি, কার্পেটের মতো, জনগণের পদতলে। এত ত্যাগ! স্বামীজির বাণী শিকাগোর শতবর্ষে, বীজ থেকে অঙ্কুর হচ্ছে তাহলে! বেটার লেট দ্যান নেভার। ওই যে মোড়ের মাথায় বিমানবাবুর বাড়ি। সাতকাঠা জমি। এক ব্যাটা ভাড়াটে বসে আছে চারশো টাকায়। বিমান আছেন দিল্লিতে মেয়ের কাছে। ফিরবে না কোনওদিন। দেশসেবাটা তাহলে কেমন হবে! ভাড়াটেটাকে সপরিবারে পাড়া ছাড়া করো। প্রয়োজন হলে পেটাও। চিনেবাদাম আঙুলের চাপে ভাঙে, আখরোটের জন্য হাতুড়ি। আর প্রয়োজন হলে বউটাকে মোড়ের মাথায় চেপে ধরে, একটু খোলামেলা করে দাও। তাতেও যদি না হয়, একালের ভাষায় বাবুকো বানাও। অ্যায়সা বানাও কী, সারাজীবনের মতো ত্রিভঙ্গ। তারপর জমিবাড়ি দখল করে, গোটাচারেক বহুতল। শ-খানেক ফ্ল্যাট মানে একশো ইনটু আট লাখ। হাফ তো আগেই এসে যাচ্ছে হাতে, অ্যাডভান্স। কিছু এদিকে দাও, কিছু ওদিকে দাও, বাকিটা নিজে খাও। মোড়ের মাথায় লোহার পাইপের কারবারি, হার্ডওয়্যার মার্চেন্ট, এম ফিল, পি এই ডি, ডি লিট ফিলিট কিছুই নয়। ক্লাস ফোর মুকুন্দ, সাতটা মিষ্টির দোকান, সতেরোটা জার্সি গরুর মালিক আশু। কাঠের কারবারি পরেশ, এরাই হল ফ্ল্যাটের খদ্দের। পাশবালিশে নোট। সেই নোটের নাম ব্ল্যাকমানি। কর্তা করেন মেল পলিটিক্স। গিন্নি করেন। ফিমেল পলিটিক্স। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন রেডক্রস। যুদ্ধ বন্ধ তো আর করা যায় না। মানুষ সমাজ, কাল, ইতিহাস, যুদ্ধের কমা, ফুলস্টপ। রেডক্রস কর্মীরা লণ্ঠন হাতে, স্ট্রেচার নিয়ে হতাহতদের সেবায় ব্যস্ত। সেইরকম পলিটিক্যাল রেডক্রস। ওই যে মোড়ের মাথায় মহিলাকে বানানো হল, তার হয়ে কে কথা বলবে! আমার মহেশ্বর নন্দী ভূঙ্গিসহ একটা কাণ্ড করেছে, নারী নির্য্যাতন। আবার ওই খালপাড়ের কেলাবের ছেলেরা, সেদিন রাতের দিকে মন খারাপ লাগছিল বলে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিল। একে গরমকাল তাই রক্ত আরও গরম হয়ে গিয়েছিল। আর রক্ত গরম হয়েছিল বলে, তারা চালের টালি সরিয়ে মাঝরাতে ঘরে ঢুকেছিল। তারপর আর কিছুই নয়, সবে মিলে করি কাজ, পশু হতে নাহি লাজ। তা সেই মেয়েটির হয়ে কে আন্দোলন করবে। ফেস্টুন, ব্যানার তৈরিই আছে। যখন যেটা লাগে। রাস্তায় নেমে নগর পরিক্রমা। নগর পরিক্রমা তো মহাপ্রভু শিখিয়েই গেছেন! হরিনাম, রামনাম, গোলে হরিবোল নাম। কিছু উষ্ণ বক্তৃতা। পথ। অবরোধ। থানা অবরোধ, স্মারকলিপি পেশ। পুলিশ ধরে নিয়ে এল জগাকে। একটা ফোন। আমি বলছি, তোমার যম। কোথায় ট্রান্সফার হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। কুচবিহারে না মাথাভাঙায়। আজ্ঞে স্যার! কানে কম শুনছ নাকি! স্যার গণধর্ষণ! গণ শব্দটা আছে তো! মানেটা কী! গণ মানেই পবিত্র। বুঝতে পারলেন। জগাকে চা, কফি খাইয়ে ঠোঁটের সিগারেটে নিজের লাইটারে আগুন। ধরিয়ে, স্যালুট করে ছেড়ে দিন। আর যার কেউ নেই, নিরীহ সেই রকম একটাকে ধরে ফাঁসিয়ে দিন। কর্তব্যপরায়ণ! দেবো মেখলিগঞ্জে চালান করে। এমন কেস দিয়ে দেবো নিজেই। সাসপেন্ড। যন্ত্র আমাদের হাতে। মন্ত্র যেমন পড়াব তেমনি পড়বে।
ঝুল-বারান্দায় বসে বসে দেখি, আকাশ সেই আগের মতোই আছে। বাতাস ধুলো আর ধোঁয়ায়। ভারাক্রান্ত হলেও চেনা যায়। যে কটা গাছ মাল্টিস্টোরিডের ধাক্কা বাঁচিয়ে আজও আছে, সেই আগের মতোই। কুকুর, বেড়াল, কাক, স্বভাব কিছুই বদলায়নি। ভীষণ রকম বদলে গেছে মানুষ। পুরোনো দিনের বড়লোকরা ধুকছে। ফুটিফাটা, পলেস্তারা খসা সাবেককালের বাড়ি। ছাদে জলের ট্যাঙ্ক উলটে আছে। লোহার খাঁচা মরচে ধরে ঝাঁঝরা। যেন টিবি হয়েছে। কেউ দেখার নেই। হয় কোনও বৃদ্ধ, না হয় কোনও বৃদ্ধা। বসে আছে একা শ্মশান জাগায়ে। নতুন বড়লোকরা। এসেছে। পাটি করে বড়লোক, ধান্দা করে বড়লোক, চিটফান্ডের বড়লোক, দালালি করে। বড়লোক। যাত্রা করে বড়লোক, ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা, ক্যাটারিং, সুপারমার্কেট, দোকান, পলিক্লিনিক, নার্সিংহোম। দু-চাকা, চার চাকা, তিন চাকার ছড়াছড়ি। এদের কিশোর, যুবক, যুবতির হাতে কালচারের কন্ট্রোল। এরা যে গান শোনে, সে গান আমার কাছে অর্থহীন শব্দ। এরা যেভাবে চলে-ফেরে, কথা বলে, আমাদের কালে সেটাকে বলা হত অসভ্যতা। এদের মেয়েদের সংক্ষিপ্ত সাজপোশাক আমাদের কালে ছিল গণিকারুচি। ছোট ছোট লাল, নীল লঞ্চেস মার্কা গাড়ি বেরিয়েছে। পুড়ুৎ-পাড়াৎ সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। ভেতরে উদোম গান। ওলে ওলে, পেয়ার পেয়ার। কার আবার পেট ফেঁপেছে। ভুটুর ভুটুর। এই প্রজন্মের প্রাণীরা দেখছি কয়েকটা জিনিস ভীষণ ভালোবাসছে। গান, খেলা আর পিকনিক। প্রায় সব বাড়ি থেকেই যখন-তখন বিকট গান ছিটকে বেরিয়ে আসে। বুক ফাটানো তাল বাদ্যযন্ত্রের শব্দ। যেন। স্বজনহারানো কোনও গোরিলা বুক থাবড়াচ্ছে। এ বাড়িতে গান, তো ওই বাড়িতে শাশুড়ি পুত্রবধূর কাজিয়া। শাশুড়ি-জীবটি সংখ্যায় ক্রমশ কমে আসছে। শহরে আর তেমন চোখে পড়ে।
। মনে হয় প্রতিকূল আবহাওয়া দেখে মাইগ্রেট করে অন্য কোথাও সরে গেছে, শ্বশুর অল্পস্বল্প দেখা যায়। এই প্রজন্ম শাশুড়ি বিদায়ের মতো শ্বশুর বিদায় করতে পারেনি মনে হয় একটি কারণে, সেটা হল প্রপার্টি। হয়তো বাড়িটা শ্বশুরের নামে। শ্বশুর হল দলিল। তাই প্যান্তাখাঁচা মুখে সকালে এক কাপ চা এগিয়ে দিতে হয়। বুড়োর আবার বাঁচার শখ। হার্ট বারদুয়েক হেঁচকি। তুলেছে, চোখে মশারি, শরীরের ফ্রেমটা আছে, মাথা ঝরে গেছে। তিনি এই নরখাদক রাস্তায় মাঝে-মধ্যে কেরদানি করে বেরিয়ে আসেন। দশ-পা হেঁটেই শরীরটাকে টান টান করে বুকটা চিতিয়ে দেখাতে চান, মরদ এখনও শক্তি ধরে। কী বলল হে! যৌবন মনে হয় এখনও যায়নি! কোথাও বসে আছে পোঁ ধরে। আর ঠিক সেই সময় একালের রোডবাগ, কোম্পানির প্রশ্রয় পাওয়া অটো, ছুঁয়িমুয়ি করে নাচতে নাচতে পাশ দিয়ে প্রায় কানকি মেরে ছুটে গেল। নাতির বয়সি। ডনজুয়ান; পাশে পাপড়িচুলো মাই লাভ, শাটিনের সালোয়ারে মোমপালিশ, হেঁকে বলছে, দাদু! ব্যায়াম করছ! কাকে বলছে! সত্তর সালে প্রেসিডেন্সিতে দর্শনের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট ছিলেন। বৃদ্ধ হয়েছেন। যাঁর জীবনদর্শন হল তোমাদের কাছে হারতে চাই না। শেষতক খাড়া থাকতে চাই। কানে কম শোনেন। সেনিলিটি এসে গেছে। ছোকরার ব্যঙ্গ বুঝতে না পেরে মৃদু হাসলেন। ভাবলেন প্রশংসা করছে। যেই এগোতে গেলেন ঘড়ঘড়িয়া স্কুটার। পেছনে ঠ্যাং। বাড়ানো আরোহিণী। ক্যাঁৎ লাথি, কেতরে বেরিয়ে গেল। তা, এত কমের ওপর দিয়ে গেল। যাঁরা এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারে আছেন তাঁদের কী কম খোঁয়াড়! অধ্যাপক ঘেরাও। সারারাত ছেলেতে মেয়েতে টাকে তবলা বাজিয়ে গেল। বাথরুমে যেতে দিলে না। শেষে ক্যাথিটার দিয়ে জল খালাস। কোথায় কোন কলেজে যেন প্রিন্সিপ্যাল তিন মাস হল ঢুকতেই পারছেন না। কাছাকাছি এলেই দেখমার করে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঝুল-বারান্দায় বসে এইসব দেখি। বড়দিন থেকে নিউইয়ার, শুরু হল বাঙালির পিকনিক মরশুম। খোলা ট্রাকে ছেলে আর মেয়েদের পাপুয়া ড্যান্স। সিক সিক সিটি। লাউড স্পিকারে হিন্দি গান। আনন্দে জাগিছে শোনার চাঁদেরা। সারাটা বছর কত কাজ, কত শ্রম, কত সাফল্য, কত উন্নতি, কত কৃতিত্ব। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এইবার আনন্দ কিছু হবে না! নাচতে নাচতে চলো ডায়মন্ড হারবার, বিষ্ণুপুর, ফলতা। পথে ওঁত পেতে আছে আর একদল। গাড়ির পর গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায়। চোলি ধরে টানাটানি। ছোরাছুরি হাসপাতাল।
মাঝে মধ্যে কৈলাস এসে আমার পাশে থ্যাবড়া একটা মোড়ায় বসে।
কী বুঝছিস! এইরকম একটা প্রশ্ন কৈলাস করবেই।
বোঝার তো কিছু নেই। দেখার আছে অনেক।
তোর লাক ভালো। পুত্রবধূটি মনের মতো হয়েছে।
মেটিরিয়াল ভালো ছিল, তার ওপর তনুর ট্রেনিং। যাওয়ার আগে তৈরি করে দিয়ে গেছে। তবে ভাই জাতটা তো পুত্রবধূর। সেটা সবসময় মনে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। সেই তো মুকেশের গান রাজকাপুরের ঠোঁটে, এ ভাই জেরা দেখকে চলো, আগে ভি দেখো, পিছে ভি।
সহি বাত।
যখন খুশি চা চাইতে পারিস?
ভাই, সাহসে কুলোয় না। তাছাড়া চক্ষুলজ্জা বলে একটা জিনিস তো আছে! একালের মায়েদের তো দম ফেলার অবকাশ নেই। ডেলি রুটিনটা শুনবি! সকালে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই তেড়েফুঁড়ে উঠল। বাড়িতে যে কাজের ছেলেটা আছে সেটাকে খোঁচা মেরে মেরে তোলা হল। দেহাতি ছেলে। বাংলা বোঝে না। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কচলাকচলির পরই, বাড়ি কেঁপে উঠল। গানস অফ ন্যাভারোন। মানে পাম্প চালু হল। এরপর চা, নাতনির স্কুলের টিফিন।
কত বয়েস হল! এর মধ্যে স্কুল!
তা হল বইকী, দু-বছর পাঁচমাস। একালে তো আমাদের কালের নিয়ম চলবে না। ইংলিশ মিডিয়াম। এখনই বলে, মে আই গো টুঁ টয়লেট। আবার বলে, প্লিজ দাদাই কাম হিয়ার। আর ঘুরতে-ফিরতে সরি তো আছেই। উইকলি পরীক্ষা। তিন কিস্তিতে অ লিখতে শিখেছে। পার্ট বাই পার্ট। প্রথমে গোল্লা। তারপর বাঁক। সব শেষে পাশের পাদানি আর আঁকসি। সেই নাতনিকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাবে স্কুলে। ফিরে এসেই রান্নাঘরে। ছেলে বেরোবে। তার আবার রকমারি বেরোনো। খবরে কাগজের কাজ তো। মেজাজটাও তেমন সুবিধের নয়।
তোর ছেলে তারও মেজাজ!
আরে এটা কালের ধর্ম। একালের সব ছেলেরই মেজাজ। বুড়োরাও কপি করছে। সেদিন এক লিকপিক বুড়ো ষণ্ডামার্কা এক সাইক্লিস্টকে বলছে, মারব থোবনায় এক ভাট্টা, সবক’টা দাঁত মুড়কি হয়ে যাবে। আমাকে বাজারে সেদিন আমার চেয়েও এক বুড়ো বলেছে, বেশি রেলা নিও না। ছতরি খুলে নোবো। এ তোমার যুগধর্ম। তা শোনো, রান্নার ফাঁকেই আবার বেরিয়ে গেল মেয়েকে আনতে। এনেই ঢুকে গেল রান্নাঘরে।
তা তুই কী করিস, এই নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসায় একটু সাহায্য করতে পারিস তো।
না ভাই, এই পাকতেড়ে চেহারার বুড়ো ওই স্কুলে গেলে সবাই আর্তনাদ করে উঠবে। সেখানে সব সুন্দরীদের কুম্ভমেলা। উদবেগ, উৎকণ্ঠা। আকাশজ্যোতি এম আর ডরু এক করে ফেলছে। যত বলা হচ্ছে, এম উলটে গেলে ডরু হয়, ডরু উলটে গেলে এম, ও ওলটাচ্ছে, কিন্তু ধরতে পারছে না, কোন ওলটে কী হল! অনিরুদ্ধর আরও কেলেঙ্কারি। সে ব্যাঙ হয়ে গেছে। লাফ মেরে ফাইভ থেকে নাইনে চলে যাচ্ছে। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, ফাইভ, নাইন, টেন। কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না ভাই। ওর বাবা তো রেগে মায়ের সঙ্গে কথাই বন্ধ করে দিয়েছে। বলছে, কনসেপশানের সময় মা ইনঅ্যাটেনটিভ ছিল। শেষে সাইকোলজিস্ট। দেড়শো টাকা ফি। বললেন, ওর ই-ফিকশেসান। ওই ফাইভের ই-টাই হল কালপ্রিট। ওই ই-টাই নাইনের ই-র দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে উপায়! একটা বছর এই চলুক, ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, ফাইভ, সিক্স, সেভেন, এইট, নাইন, টেন। ওর কথা ভাবলে রাতে ঘুম হয় না ভাই! আর আমার শ্রমণা। কী যে করব আমি! সুইসাইড করব। কেন কী হল! ক্লাসে ঢুকল। ডেস্কে বসল। ঘাড় কাত। যা জিগ্যেস করবে, কোনও উত্তর নেই। বোবা। এদিকে মাসে মাসে আশি টাকা। ওর আর বিয়েটিয়ে হবে না। কে বিয়ে করবে মুখকে! আমার বোনের মেয়েটা শিয়োর আমেরিকা যাবে। শ্রমণার জন্যে শ্ৰমণার বাবা দায়ী। বাপ ঘাড় কাত মেয়েরও ঘাড় কাত। কৈলাস ভাই, এই আমার একদিনের অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় দিন আমি আর যেতে চাই না। শিশুদের ওই যন্ত্রণা। শুদ্ধ বাংলায় নিদারুণ নিপীড়ন আর মায়েদের ওই ভয়ংকর উৎকণ্ঠা আমার সহ্য হয় না। আমাদের সেই ইজের পরা। ইস্কুলের দিনগুলোর কথা ভাব। তুই আর আমি ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়েছিলুম। বগলে বই খাতা, পায়ে বুটজুতো, ঘাস-ছাঁটা চুল, ভয় ভয় দৃষ্টি। শিক্ষকমশাইদের মনে হত বাঘ। হেডমাস্টারমশাই সিংহ।
কৈলাস উপসংহারের দিকে আসতে চাইছে, তাহলে তুই আছিসটা কেমন?
খুব আলতোভাবে আছি। বেশি ভর দিতে পারছিনা, যদি ভেঙে যায়।
তার মানে পুত্র, পুত্রবধূকে বিশ্বাস করো না?
ওদের নয়। আমি এই যুগটাকে বিশ্বাস করি না। এ যুগে কেউই কারওকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে। এ যুগটা কী রকম জানিস। ইংরেজিতে বলি, ট্রাস্ট ইন গড, বাট লক ইয়োর কার। সকলের ওপর আস্থা রেখো। কিন্তু নিজের ওপর আস্থা রাখতে ভুলোনা। আর। একটা উপদেশ শোন। হোয়েন-ফেসড উইথ এ সিরিয়াস হেলথ প্রবলেম, গেট অ্যাটলিস্ট ফ্রি। মেডিক্যাল ওপিনিয়নস। বাড়িতে রান্নার গ্যাস থাকলেও কয়লার উনুন বজায় রেখো। ইলেকট্রিক আলো জ্বাললেও মোমবাতি আর দেশলাই হাতের কাছেই যেন থাকে।
কৈলাস বললে, বয়েস হলে মানুষ সিনিক হয়ে যায়। তুই বেশ ভালোই আছিস।
কৈলাস চলে গেল। বোধহয় চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল, তাই চায়ের কথা পেড়েছিল। বিশাল চেহারার মালিক। বহুতল বাড়ির মতো। বড়লোকের ছেলে। খাওয়াদাওয়ার অভাব ছিল না, আড়াটাও ভালো ছিল, তাই বিশাল। এখন একটু থলথলে। চলে যেতে বারান্দায় যেন একটু আলোবাতাস খেলল।
নাতনির সঙ্গে আমার সময় বেশ ভালোই কাটে। নানা সময়ে আমার নানান চরিত্র। তবে বেশির ভাগ সময়েই আমি রিয়া। সামনের বাড়িতে প্রায় আমার নাতনির বয়সিই একটি মেয়ে থাকে, তার নাম রিয়া। আমার নাতনির নাম পূজা। পূজা তাকে বন্ধু করতে চায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দুজনে কথা হয়। রিয়া কিন্তু এ-বাড়িতে আসে না। খুব বড়লোক বলেই হয়তো তাকে মা-বাবা আসতে দেয় না। আমাকে রিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়।
ডল পুতুলের মতো ফুটফুটে পূজা ব্যস্তসমস্ত হয়ে এল, কী রে রিয়া, কী করছিস তুই।
এর উত্তরে গলাটা সরু করে কাঁদো কাঁদো ভাবে আমাকে বলতে হবে আর বলিস না ভাই পূজা, আমাকে না আমার মাম্মি খুব মেরেছে।
পূজা অমনি, ভীষণ উতলা হয়ে জিগ্যেস করবে, কেন কেন, তুই কী করেছিলিস রে রিয়া?
আমি না একটা সুন্দর গেলাস ভেঙে ফেলেছি রে পূজা।
গেলাস নিয়ে তুই আবার কী করছিলিস!
ওই যে আমাকে তলপ্যান খেতে দিয়েছিল।
পূজা কমপ্লান বলতে পারে না তলপ্যান বলে। পূজা তখন খুব বিরক্ত হয়ে বলবে,
আঃ তোকে কেন তোর মাম্মি গেলাসে দেয়! ভাঙলি কেন! খুব মেরেছে।
ভীষণ মেরেছে রে!
কই দেখি, দেখি কোথায় লেগেছে।
এই দেখ, এই জায়গাটায়। কী হবে রে পূজা।
কোনও ভয় নেই, আমি তো আছি।
আমাকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেবে না রে!
ঠিক আছে তুই আমাদের বাড়িতে আমার কাছে থাকবি।
তোর মাম্মি বকবে।
কিছু বলবে না। আমার মাম্মি তোকে কিছু বলবে না।
এর পর পূজা একটু গম্ভীর মুখে বলবে, রিয়া! তুই কিন্তু খুব জিনিস ভাঙিস!
কেন রে রিয়া!
কী করব বল ভাই পূজা, খুব ইচ্ছে হল হাত দিয়ে দেখি। আর অমনি উলটে গেল। আর ভেঙে গেল। আর আমার মাম্মি এসে দুম দুম করে পেটাল।
কোথায় কোথায়?
এই যে পিঠে।
দেখি দেখি—
পিঠটা দেখে বললে, ও কিছু হয়নি। আমি ওষুধ দিয়ে দোব।
আমি কোথায় থাকব রে পূজা! আমার কী হবে!
আমি তো আছি রিয়া। আমি তো আছি।
আমাদের এই খেলায় পূজা মাঝে মাঝে রিয়া হয়, আমি তখন পূজা। সময় সময় সব গুলিয়ে যায়। তখন পূজা জিগ্যেস করে, তুমি কে? পূজা না রিয়া! পূজার থুপুর থুপুর পায়ে ওর মা দুটো তোড়া পরিয়ে দিয়েছে। যখন ছোটে ঝুনুর ঝুনুর শব্দ হয়। কপালের ওপর ঝুলে আছে রেশমের মতো চুল, কালো হিরের মতো দুটো চোখ। যখন আমার পাশে চিত হয়ে ঘুমোয়, মুখে চাঁদের আলো এসে পড়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবি, পৃথিবীতে শুরুর কোনও শেষ নেই। সবসময়েই শুরু হচ্ছে নতুন জীবন, নতুন পথ চলা। দেখতে দেখতে পূজা বড় হবে, আমি আরও বুড়ো হব, আমি বেরোচ্ছি পূজা ঢুকছে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি। সহপাঠী, পড়া কথা, প্রেম, বিবাহর সংসার, আমার জায়গায় আমার ছেলে, আর একটা পূজা, আর একটা রিয়া, একই রকমের পুতুল, টিয়া, হাঁস, বাঘ, হনুমান, গাড়ি, কটর কটর বন্দুক। খিলখিল হাসি, অভিমানের কান্না। বিধাতাপুরুষ এ এমন এক গল্প ফেঁদেছেন যার কোনও শেষ নেই। নদী আছে, পাহাড় আছে, গ্রাম আছে, শহর আছে, গাছ আছে, পাখি আছে, দোলনা আছে, শ্মশান আছে। এসো, খেলা করো চলে যাও। খেলার মাঠ, দু-পাশেদুই গোলপোস্ট। গোল খাও, গোল দাও।
সাড়ে তিনজন মানুষের ছোট্ট সংসার! চারপাশে সমস্যার সমুদ্র বিশৃঙ্খল, এলোমেলো সমাজ। আমার ভূমিকা দর্শকের। কোনও অভিভাবক আমার কাছে আর ছাত্র-ছাত্রী পাঠাবেন না। আমি ব্যাকডেটেড। আমি ইংরেজি পড়াতে গেলেই আগে নেসফিল্ডের গ্রামার, রো অ্যান্ড ওয়েব, গঙ্গাধর ব্যানার্জি পড়াতে চাইব। ছেলে বলবে, সে আবার কী! এখন ব্যাকরণ ছাড়াই ইংরেজি শেখা যায়। সেই কারণে আমি সম্পূর্ণ বেকার। চোখের জন্যে নিজেও আর বেশি লেখাপড়া করতে পারি না। নয়া জমানার খবরের কাগজ আমাদের জন্যে নয়। হাবোড়-তাবোড় কী যে থাকে! রঙিন পাতার শাড়ি, চুল, ত্বক, রান্না, নায়িকার অবৈধ প্রণয়, মেয়েদের শেকল ছেড়ার আন্দোলন, বিদেশের লাম্পট্য, স্বদেশের ধর্ষণ, সব মিলিয়ে বাদশাহি দোকানের মাটন চাঁপ, রুমালি রোটি। ভীষণ গুরুপাক।
নাতনিটাই আমার বন্ধু। বললে, ঘোড়া হও। পিঠে চেপে হ্যাট হ্যাট, আবার গান গায়, চল মেরে ঘোড়া হ্যাট-হ্যাট। খুব নাচতে শিখছে। আমাকে নাচ দেখায় ঘুরে ঘুরে। হাতের মুদ্রা, চোখের ভঙ্গি। ভেতরে নাচ আছে। মাঝে মাঝে নাচ পায়। তখন আর তাকে থামানো যায় না। সারা ঘর গোল হয়ে ঘুরবে। দুধ সাদা ফ্রক হাঁসের পেখমের মতো উড়তে থাকবে। একটা বন্দুক আছে, সেইটা দিয়ে গুলির শব্দ করে বলবে, মরে যাও। আমাকে জিভ বের করে উলটে পড়তে হবে। তখন এসে কাতুকুতু দেবে। সঙ্গে সঙ্গে আমি বেঁচে উঠব। পরমুহূর্তেই গুলির শব্দে আবার আমি মরে যাব, আবার কাতুকুতুতে বেঁচে উঠব। পর্যায়ক্রমে এই চলতে থাকবে। ক্লান্ত হয়ে পড়লেও নিষ্কৃতি নেই। মৃত্যুর দৃশ্যে আমার মৃত্যুভাবনা আসবে। সত্যিই তো আর ক’টা দিন। হয়েই তো এসেছে। এইবার পায়ে পায়ে লকলকে আগুনে গিয়ে শুতে হবে। এক মুঠো ছাই।
মেয়েটাকে তেল মাখাই। চানের পর্বটা বড় মধুর। বড় একটা বালতিতে বসিয়ে দিতে হবে। আধবালতি জল। নাচানাচি। জল ছেটকাছিটকি। মসৃণ ত্বক জেল্লা দিয়ে উঠবে। মাথার জল মুখ দিয়ে ঝরে পড়ার সময় দম আটকে আসার আতঙ্কে একটু ছটফটানি। তারপর গা মোছানো। মাথা মোছানোর সময় একটু কান্না। পাউডার। পাতলা নীল ফ্রকে মহা খুশি হয়ে নেচে ওঠা বিশাল বিপুল একটা পৃথিবীর মধ্যে কী সামান্য একটা ঘটনা। কিন্তু কী আনন্দের। আমি সেবা করার সুযোগ পাই। মনে পড়ে যায়। তনু ডান হাতের কনুইয়ের কাছ থেকে ভাঁজ করে আমাকে পেছন দিকটা দেখাচ্ছে। দেখো কতটা কেটে গেছে খোঁচা লেগে! ফরসা গোল একটা হাত। লাল রক্ত। পৃথিবীর কারওকে নয়, একমাত্র আমাকে বলছে। নিয়ে আয় তুলো, নিয়ে আয় আয়োডিন। যত না হয়েছে তার চেয়ে বেশি আমার ব্যস্ততা। অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে আলতো আলতো করে
পরিষ্কার করা। একটু একটু আয়োডিনের ছোঁয়া, উ, জ্বালা করছে, বলে সামনে ঝুঁকে পড়া। তখন সেই ঘাড়ে আলগা খোঁপা, পিঠের অনেকটা অনাবৃত চকচকে অংশ দেখতে পাওয়া। তখন আমার সেবা, আরও সেবা, ফুঁ দেওয়া। জীবন অনেক বড় ব্যাপার, যুদ্ধ, অভিযান, আবিষ্কার, বিপ্লব, গিলোটিন, ওয়াটারলু, ট্রাফালগার, কিন্তু এই যে মুক্তোর দানার মতো, ভেতরে, অন্তরে মানুষকে ভালোবাসার একটা শুক্তি খুঁজে পাওয়া, এর কোনও দাম নেই তবু কোহিনুর। এইটুকুর জন্যেই বাঁচা যায়। কিছুই পেলুম না, এইটুকুই পেলুম। আমার লতার প্রথম মুকুল চেয়ে আছে মোর পানে।
পূজা মাঝে মাঝে আমার পুত্রবধূ হয়ে যায়। আমি তখন তার বাবা। আমার পুত্রবধূ আমাকে যা যা বলে পূজাও আমাকে তাই বলে। বাবা, তুমি সেই ঠান্ডা জলে চান করছ, তোমার না বুকে সর্দি বসেছে। এক্ষুনি কাশি হবে। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না! তারপর আমার ছেলেকে ডেকে নালিশ করবে, এই যে শুনছ, তোমার বাবাকে কিছু বলো।
এইরকম সব ছোটোখাটো মজার দিন যাচ্ছে। রাতটাই একটু অন্যরকম। দরজা বন্ধ করলেই উদোম নিঃসঙ্গ। চিত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা। এপাশ ওপাশ। মাথার কাছে খোলা জানালা। এক আকাশ গনগনে তারা। হঠাৎ বয়ে আসা ক্যালেন্ডারের পাতা কাঁপানো বাতাস। অনেক রাতে আকাশ মাঝে মাঝে অট্টহাসি হাসে। হাততালি দেয়। জেগে থাকলে এইসব শোনা যায়। সাপের হিস হিস শব্দ। ছাদে ভারী কিছু পড়ে গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। আগে খুব ভূতের ভয় ছিল, এখন নিজেই ভূত হয়ে গেছি। মানুষের সবচেয়ে বড় সঙ্গী তার নিঃসঙ্গতা।
শুয়ে শুয়ে দেখি, জীবনটা যেন কার্পেটের মতো গুটিয়ে এসেছে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য। বেশ মজা লাগে। সময়ের ব্যবধানে ছাড়া ছাড়া নয়। সব এক ঠাঁয়ে এসে জড়ো হয়েছে। তনুর ফেলে যাওয়া অজস্র স্মৃতি। পায়ের দিকে আলমারি, ফুলশয্যার রাতে যে সব। পোশাক পরেছিল, শাটিনের শায়া, বেনারসি ব্লাউজ, এমনকি বক্ষবন্ধনীটি পর্যন্ত সযত্নে রাখা। সেই রাতের একটি নারী শরীরকে একেবারে নিজের অধিকারে পাওয়ার প্রথম বিস্ময় আজও কাটেনি। হঠাৎ একটা বই শুরু হয়ে যাওয়া। পর্দা সরে গেল। অজস্র আলো। বাদ্যযন্ত্রীরা আবহসংগীত বাজাচ্ছে। প্রম্পটার প্রম্পট করছে। নাটক শুরু। দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, দায়িত্ব, রহস্য, রোমাঞ্চ। একটা মেয়েকে ঘিরেই সব তৈরি হয়। জড়িয়ে জড়িয়ে ওঠে। কুঁড়ি, ফুল, ফল, পাখি, দিন, রাত, গতি, বছর দিয়ে মাপলে মহাকালের এক পলক। জীবন দিয়ে মাপলে মিসিসিপি, ইয়াংসিকিয়াং।
এই সময় গলার কাছে একটা শব্দ শুনতে পাই। যেন সানাইয়ের সর্দি হয়েছে। বাগেশ্রী, কেদারা কি জয়জয়ন্তী, কি সোহিনী না হয় একটা কিছু ধরতে চাইছে। প্রথমে খুকখুক কেশেহুঁশিয়ারি। দিতে চাই, রাত অনেক, এখন বাদ্যবাজনা পাবলিক অ্যালাউ করবে না। অন্তত তোমার বাজনা। তুমি কি লোকাল ক্লাব? ক্লাব ইংরেজি শব্দ। পশ্চিমবাংলার প্রগতিশীল সংস্কৃতিতে উচ্চারণ, কিলাব। কেলাবও হতে পারে। আজকাল এইরকম ভাষা শুনি, গাড়িটা খুব হরেন দিচ্ছিল, কেলাবের মুরারী ডেরাইভারকে ধরে বেধড়ক পিটিয়েছে। ব্যাগি প্যান্ট, জামা, ঘাড় অবদি ঝুলুর লক্কা চুল। শারুক খান, সানি দেওল। এই ছেচা বেড়ার কেলাব সারারাত আলমারি-আকৃতির। কেলে স্পিকার বক্স দিয়ে গোটা পল্লিটাকে গানে গানে চুবিয়ে দিতে পারে, তুমি পারো না।
ছোট কাশিতে যখন কাজ হয় না, তখন একটা বড় মাপের কাশি ছাড়ি। উচিত কাজ নয়, উলটো দিকের ঘরেই পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনি। কাশির মতো বিরক্তিকর কিছুই নেই। বড় কাশিতেও উপদ্রব কমে না। সি, সাঁই, সুই নানা ধরনের শব্দ। মাঝে মাঝে একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে নিজেই। একটু কালোয়াতি করি। ছাত্রজীবনের সেই গান মনে পড়ে, জেগে আছি একা, জেগে আছি। কারাগারে। জানলায় ঝকঝকে কালো আকাশ। মাঝে মাঝে উল্কাপাত। প্রহরে প্রহরে পেঁচার ডাক। ফুলশয্যার রাতটা তনুর সঙ্গে আমি জেগেই কাটিয়েছিলুম। জীবনের যত কথা এক রাতেই বলার চেষ্টা। মনের নাট-বল্ট-পিনিয়ান-গিয়ার-হেয়ার স্প্রিং-ব্যালেন্স হুইল সব খুলে ফেলা। আর এই হাঁপানির সঙ্গে আমার চির ফুলশয্যা। শোয়ার উপায় নেই। শুলেই মনে হয় কংসরাজ বুকে জাঁতা চাপিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। জল থেকে ভোলা কাতলা মাছের মতো খাবি খাওয়া।
জিনিসটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। কাশির ঠেলায় ঘুলঘুলি থেকে চড়াই উড়ে যায়। বিচারে বসল পরিবার। অত্যাচারের ফল। তিনবার চান, ঠান্ডা জলপান ইত্যাদি ব্যাভিচারের এই পরিণাম। ডাক্তার এলেন। প্রবীণ এম ডি। বুকে কল বসিয়ে ধমকের সুরে বললেন, টানুন, জোরে টানুন।
শ্বাস টানা মাত্রই, ধমকে ধমকে, গমকে গমকে কাশি। গঙ্গ, সিমব্যাল, স্যাকসোফোন সব একসঙ্গে। হৃদকমলে বড় ধুম লেগেছে। মজা দেখিছে আমার মন পাগলে। প্রবীণ ডাক্তারবাবু বললেন, করেছেন কী মশাই, বুকে যে রামচৌকি বসিয়ে ফেলেছেন! অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে। কী খাবেন, দশ, পনেরো, উনিশ, ছাব্বিশ, আটত্রিশ। কোনটা? অসহায়ের মতো ওদের দিকে তাকালুম। রোজগার তো নেই। বোস্ট আর্টিস্ট। দশের কমে কিছু থাকলে ভালো হত। অনেকটা খেলতে পারে এইরকম ব্রড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক আর দশের নীচে নেই। মনমোহনবাবু গ্যাট করে সব বাড়িয়ে দিয়েছেন। ডাক্তারবাবু রসিকতা করে বললেন, দশে ক্যাপসুলের খোলসটা হতে পারে। শেষে উনিশে রফা হল। সাতদিন এই চলুক। খুব সাবধান। ঠান্ডা যেন একটুও না লাগে। কাঁচা-পাকা জলে চান। পেট ঠেসে খাবেন না। পৃথিবীর প্রোপোরশন, একের চার ভাগে সলিড, তিনের চার ভাগ লিকুইড। রাতের খাওয়াটা সন্ধের। একটু পরেই সেরে নিয়ে বেশ খানিক পায়চারি করবেন। হজম করিয়ে শুতে যাবেন। পেট যত খালি রাখবেন ততই রিলিফ।
তিনটে দিন গেল। কথায় আছে, চলছিল রুগির উঠে বসে, কাল হল রুগির বদ্যি এসে। আগে শ্বাস নিলে ফুসফুস তবু চলছিল, যা হয় একটু বাতাস ঢুকছিল। এখন মনে হচ্ছে দুটো পাথরের টুকরো। বাতাস ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে।
কৈলাস বললে, বুড়ো বয়সে দুম করে অ্যান্টিবায়োটিক কেন খেতে গেলি! সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।
সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল মানে?
পেটে একটা উদ্ভিদের বাগান আছে। সমুদ্রের তলায় যেমন থাকে। ফ্লোরা, ফনা। তাদের কাজ হল এনজাইম-টেনজাইম, হজমি রস সাপ্লাই করা, চড়া কোনও খাবার থেকে পেটের দেয়ালটাকে রক্ষা করা। যেই অ্যান্টিবায়োটিক খেলে, অমনি সেই বাগান শুকোতে লাগল। তোর এখন উচিত, খুব দই খাওয়া। টক দই।
দই খাব কী রে! আমার তো হাঁপানি।
অ্যাঁ, হাঁপানি কী রে! তোর হাঁপানি হবে কী করে! ফ্যামিলিতে কারও ছিল! বাবা, মা, দিদু, দিদা?
শুনিনি।
তোদের বংশলতিকা নেই।
আছে। রামহরির তিন পুত্র, রাখহরি, বলহরি, হরিহরি। রাখহরির তিন পুত্র এক কন্যা। এইরকম সব আছে। সেই মহাপ্রভুর কাল থেকে। কারও নামের পাশে ব্র্যাকেটে হাঁপানি লেখা নেই।
তাহলে তোর এটা হাঁপানি নয়, অন্য কিছু। একটা সুইমিং কম কিনে দিনকতক সাঁতার প্র্যাকটিস কর।
কোথায় করব ছাদে, জলের ট্যাঙ্কে। বারাসতের দিকে একটা পুকুর আছে বেশ বড়। সেখানে করবি?
ওর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
তাহলে এক কাজ কর। তপনকে ধরে আনি। যোগাসনের এক্সপার্ট। আসনে এসব ম্যাজিকের মতো সেরে যায়।
পরের দিন তপন এল। খোঁজপাত করে জানা গেল, তপন আমার পিতৃদেবের ছাত্র ছিল। যোগের। এখন খুব বাজার। কুঁজোকে সোজা করে, মোটাকে রোগা করে, রোগাকে মোটা।
মেঝেতে কম্বল পাতা হল। তপন ছোট্ট একটা লেকচার দিল। অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা। সাঁই সাঁই করে শ্বাস নিতে হবে। শ্বাসেই আরাম, শ্বাসরাম। কাকচক্ষু প্রাণায়াম। সেটা কী? ঠোঁটটাকে সরু করে জিভটাকে রোল করে তেড়ে বাতাস টানুন। গিলে ফেলুন। নাক দিয়ে ছেড়ে দিন। ছত্রিশবার। বাতাস পান করুন।
অনেকক্ষণ ধরে কসরত চলল! ঠোঁট সরু হচ্ছে, কিন্তু জিভ গোল হচ্ছে না।
কৈলাস পাশেই ছিল। বললে, পাকা জিভ তো, তাই গোলা হচ্ছে না। প্র্যাকটিস করতে হবে। মাখম মাখাতে হবে। অভ্যাস করলেই এসে যাবে। ঝাল খেয়ে উস করে বাতাস টানা আর কী!
তিন রকমের প্রাণায়াম করতে হবে। দাঁড়িয়ে, বুকে হাত দিয়ে শ্বাসটানা। খাঁচা যেন সামনের দিকে ঠেলে ওঠে। আর একটা হল বায়ু সঞ্চালিনী। মাথা বৃত্তাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে শ্বাস টানা আর ছাড়া। বেশ ভজকট ব্যাপার! তাল কেটে যায় থেকে থেকে। এর পর ধনুরাসন, নৌকাসন, সর্বাঙ্গাসন, হলাসন, কম্বলের ওপর বুড়ো বয়সে ধস্তাধস্তি কাণ্ড। শেষে ডাক পড়ল পুত্রবধূর।
আমাকে মেঝেতে উবু হয়ে বসতে হবে। যে ভাবে বাথরুমে বসা হয়। তারপর আমার পুত্রবধূ শিরদাঁড়ার দু-পাশেদুহাতে ধপধপ থাবড়াবে। ওপর থেকে নীচে নীচ থেকে ওপরে। এর নাম মনে হয় সুড়সুড়ি। কে দেবে। আমার পুত্রবধূ।
কৈলাস বললে, ধনুক আর নৌকো আমি করে দেব। শরীরটাকে পেছনে দুমড়ে দেওয়া তো।
তপন বললে, না না, কোনওরকম বলপ্রয়োগ চলবে না। এই বয়েসে খিল খুলে গেলে কেলেঙ্কারি। তপনের মধ্যে বেশ একটা গুরু-গুরু ভাব এসেছে। কথায় কথায় বলল, কয়েক মাস পরেই আমেরিকা চলে যাবে। সেখানে বিরাট ব্যাপার। হলিউডের চিত্রতারকারা, মিলিয়ন ডলার টেনিস খেলোয়াড়রা, পপ সিঙ্গাররা যোগের ভক্ত। এখানকার কয়েকজন ওখানে গিয়ে খুব নাম করেছেন। বিপুল বড়োলোক হয়েছেন। এক-একজনের তিনটে, চারটে করে রোলসরয়েস। সেই সদভাবনার কথা ভেবেই তপন ঝড়ের আগের আবহাওয়ার মতো গুমোট মেরে গেছে। তপন। চলে গেল।
কৈলাস বললে, তাহলে নিয়ম মেনে এগুলো কোরো। অনেক কষ্টে তপনকে ধরে এনেছিলুম। বড় বড় লোককে ও যোগ শেখায়। তোর অনেক ভাগ্য যে এককথায় চলে এল। সেই ভাগ্যটা এখন কাজে লাগা।
নিজে নিজে যা করা যায় চেষ্টা করব। পুত্রবধূর সাহায্য আমি নিতে পারব না। ইজের পরে চিত হয়ে পড়ে আছি, পা থেকে মাথা পর্যন্ত সুড়সুড়ি দিচ্ছে, সেনসেশন, উবু হয়ে বসে আছি, পিঠে ধাঁই থাপ্পড়। এইসব কেলেঙ্কারি আমার দ্বারা হবে না ভাই।
তবে হাঁপিয়ে মরো।
কৈলাস রেগে চলে গেল।
এতক্ষণ পূজা সব দেখছিল। তির তির করে বেরিয়ে এল তার কোণ থেকে। এসেই বললে, তুই রিয়া, না পূজা।
রিয়া।
না, তুমি এখন বাবা।
তার মানে পূজা এখন আমার পুত্রবধূ সুস্মিতার ভূমিকায়।
পূজা তার মায়ের ভঙ্গি অনুকরণ করে বললে, বাবা। শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো।
শোবো কেন রে!
সেনচেশন।
ওই প্রক্রিয়াটা খুব ভালো লেগেছে। সুড়সুড়ি।
ও তো হয়ে গেছে পূজা। আবার কাল হবে।
পূজা নয়, আমি ছুম্মি। পূজা রান্নাঘরে। বাবা! শুয়ে পড়ো, আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি। বাবার শুতে হল। আবার উবু হয়ে বসতে হল। গুটগুটে, ফুটফুটে মেয়েটা কখনও সুড়সুড়ি দেয়, কখনও পিঠের দু-পাশে ছোটো ছোটো হাতে থাপ্পড় মারে। সমানে গান চলেছে। কখনও হুঁ হুঁ করে। কখনও বাণী বসিয়ে। ম্যাও ম্যাও, ম্যাও ছোতে ছোতে পা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার চরিত্র পালটে গেল। হয়ে গেলুম পূজা। পূজা সুস্মিতাতেই রইল। শুরু হল, আমাকে চান করানো খেলা। দু-চার ঘা মারও হল, অসভ্যতা করার সাজা।
মারছ কেন মা! আমি কী করেছি!
দাঁতে দাঁত চেপে বললে, কী করেছি কী করেছি। কী করেছিস জানিস না তুই। জল থেকে উঠতে চাইছিস না কেন? সর্দি হবে না! রিয়া তোর চেয়ে অনেক সভ্য। রিয়াকে দেখে শেখ, শেখ। কখন। চান করে, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে।
কোথায় জল, কোথায় তোয়ালে! শিশুর কল্পনায় নিমেষে সব এসে যাচ্ছে। ছোট ছোট হাতে অদৃশ্য তোয়ালে দিয়ে বৃদ্ধের শুকনো, শীর্ণ মুখ মোছানো, পাউডার মাখানো, সবশেষে কপালে অদৃশ্য টিপ পরানো। কড়ে আঙুলটা কুটুস করে কামড়ে দেওয়া।
ডাক্তার বদল করতে হল। ফুসফুসে বাতাস ঢুকছে না। সেখানে গজলের মাইফেল চলেছে। চড়া পর্দায় বেলো ফুটে হারমোনিয়ামের সিঁসি শব্দ। জিন্দেগি, জিন্দেগি, এদিকে সামান্য কয়েক সি সি বাতাসের জন্যে আমার জিন্দেগি কাহিল হয়ে গেল। নতুন ডাক্তারবাবু বয়েসে তরুণ। ফুসফুসের বিষয়টা গুলে খেয়েছেন। প্রেসক্রিপশন দেখে বললেন, এক্স-রে না করিয়েই এই চড়া অ্যান্টিবায়োটিক এতগুলো খেয়ে বসলেন। এই বয়সে কাজটা ভালো হল কী? এখন সব ওষুধ বন্ধ। আগে এক্স-রে।
পুত্রবধূর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। তেওঁটে মার্কা শ্বশুর হওয়ার চেষ্টা করিনি। করলেও হত না। মানাত না। যারা ছেলেবেলায় কম খেয়ে ম্যালনিউট্রিশনে সারাটা জীবনই ছোকরা মেরে থাকে তারা কোনওদিন ডাকসাইটে বাবা, কি নিপীড়ক শ্বশুর হতে পারে না। এইটা আমার জীবনে শাপে বর হয়েছে। বাড়ির পরিবেশে কোনও টানটান, গুমোট ভাব নেই। এটা হল না, ওটা হল না, এ কী করলে মা, এই জাতীয় কোনও ভ্যানতাড়া নেই। ডিসিপ্লিন ডিসিপ্লিন করে শাস্তি চটকানো লোহার সংসার তৈরি হয়নি। যেমন জোটে, খাও দাও আনন্দে থাকো। বাইরের জগৎটা তো কেলসে গেছে, ভেতরটাকে অহংকারের ঠুসঠাসে অশান্ত করে তুললো না।
ডাক্তারবাবু চলে যেতেই পুত্রবধূ বললে, নাও, রাজবেশ ছেড়ে তৈরি হও। চলো এক্স-রে।
আজ থাক না রে, কাল হবে।
তোমার পরামর্শে আর চলছিনা ভাই। এবার আমার ম্যানেজমেন্ট। মা থাকলে তোমাকে পেটাত। নিজের ওপর অত্যাচারের একটা সীমা আছে। তুমি পরশু কৈলাসকাকুর বাড়িতে আইসক্রিম খেয়েছ?
কে বললে?
আমার গুপ্তচর সর্বত্র। কাজটা ভালো করেছ? তোমার ছেলেকে বললে, ফাটাফাটি করবে। সেইটাই চাইছ।
এক্স-রে কারখানায় গেলুম। জামা, গেঞ্জি খুলে একটা প্লেটে বুক ঠেসে, দু-হাত ওপরে তুলে, দমবন্ধ অবস্থায় অন্তর্লোকের ছবি তোলালুম। দুজনে যখন একসঙ্গে বেরোই তখন একটু মার্কেটিং হয়। সেটা বেশ সুখের, আনন্দের অভিজ্ঞতা। স্বামীর কাছে যতটা না ফ্রি হতে পারে, আমার কাছে পারে। আমি মানুষের স্বপ্ন পড়তে পারি। ভেতরের আনন্দ দেখতে পাই। অল্প কিছু নিয়ে থাকার মহানন্দ। এটা তনুরও ছিল। সব মেয়েরই থাকে মনে হয়। আধুনিকতার এনামেলটা সরাতে পারলেই অকৃত্রিম অন্তরের উন্মোচন। কাপ, ডিশ, একটুকরো প্লাস্টিক, আশায় ভরা কাপড়কাচার গুঁড়ো, প্রতিশ্রুতি জড়ানো শ্যাম্পু, স্বাদে ভরা চানাচুর, কাপড় শুকোতে দেওয়ার ক্লিপ, দু-পাতা। টিপ, পূজার জন্যে বিস্কুট। আধুনিক দোকান সাজসজ্জায় লোভনীয়। কিছুক্ষণ দাঁড়াতে ভালো। লাগে। হেটোর হেটোর করে হাঁটা। অনর্গল কথায় বেশ গোছানো ভবিষ্যতের ছক কষা। আসছে, আসছে, আসতে পারে, এইটাই ভালো। আসবে যে না সে তো সবাই জানি। পরাজয়ের একটা ধারাবাহিকতা থাকে। সেখান থেকে বেরোনো যায় না। মাস্টারমশাই পরাজিত, আমিও তাই, আমার ছেলে কেমন করে টগবগিয়ে ঘোড়া ছোটাবে। আশা করাটাই অন্যায়।
সংসারের বাইরে দুজনে গল্প করতে করতে সময়কে ফাঁকি দিয়ে অসুখকে কলা দেখিয়ে হুহু গাড়ি, টেম্পো, লরি, অটোর এলোমেলো ছোটাছুটির বৃত্তে গা বাঁচিয়ে, খানিক ঘোরাঘুরি হল। ঘরে ফিরেও খুব খারাপ লাগল না। বাইরে বেড়াতে গিয়ে হোটেলে ফেরার মতো। এমন এক রাজ্য যেখানে কোনও সংবিধান নেই, রাজা নেই, অনুশাসন নেই। নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী, পৃথিবীর পরে ওই নীল আকাশ।
পরের দিন ফুসফুসের ছায়াচিত্রে চোখ রেখে ডাক্তারবাবু বললেন, এ তো দেখছি আরতি হচ্ছে। এত ধোঁয়া ঢোকালেন কী করে!
সে তো সবাই জানে। কলকাতার মানুষ। মাছ যেমন জলে, আমরা সেইরকম লাখ লাখ মানুষ ধোঁয়ায় খলবল করছি। কতরকমের ধোঁয়া।
এই যে দেখছেন, সাদা সাদা ঢেউ খেলানো দাগ, এগুলো আপনার শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা।
ও আর আমি দেখে কী করব।
আহা, জিনিসটা তো আপনার! কী করছেন স্বচক্ষে একবার দেখুন।
মনে মনে বললুম, হেট দ্য সিন, নট দ্য সিনার।
তাহলে আগের ওষুধ আর চলবে না। অ্যান্টিবায়োটিকের অন্য গ্রুপে যাওয়া যাক।
আগের বেশকিছু ওষুধ যে রয়েছে। অনেক দাম।
সে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনার বউমা ভাববে। নিশ্চিন্তে আপনি সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করুন।
এই নিন, গোল, গোল, গোল। তিন গোল্লা, মানে সকালে-দুপুরে-রাতে। খাওয়ার পর একটা করে। আর এই দু-জোড়া চামচে এঁকে দিলুম। কাফ সিরাপ। দু-চামচ করে দুবার। একটু নির্মল বাতাসে থাকার চেষ্টা করুন। অ্যাভয়েড ডাস্ট, স্মোক, স্পাইসি ফুড, টেনশন, অ্যাংজাইটি।
পড়তে হলে নতুন বই পড়বেন, পুরোনো বই চলবে না। বিছানায় না শোয়াই ভালো।
বসে থাকা চলবে?
তা চলতে পারে, তবে শান্ত সংযত ভাবে। ধপাস ধপাস করবেন না। তুলোর ধুলো আপনার পক্ষে ডেনজারাস। ঢ্যাঁড়স, বেগুন, টম্যাটো, টক ফল, ডাল-চিংড়ি, কাঁকড়া, ইলিশ, আইসক্রিম, দই, মিষ্টি, তেলেভাজা স্পর্শ করবেন না।
বাকি রইল কী?
এইবার নিজে নিজে পরীক্ষা করবেন। এক-একটা জিনিস খাবেন, অপেক্ষা করবেন, যেই দেখবেন বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে বাতিল। এইভাবে যা থাকে সেইটাই আপনার খাদ্য।
ফ্যামিলি হিস্ট্রিতে তো হাঁপানি নেই।
ইতিহাসের কতটুকু জানেন, গ্র্যান্ডফাদার, গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্রেট টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি।
গ্র্যান্ডফাদার। অদম, ইভেও চলে যেতে পারেন। ভগবান কেন আপেল খেতে বারণ করেছিলেন। হোয়াট ওয়াজ দ্য মেডিসিন্যাল কজ। আপেল টক। খেলেই রেসপিরেটারি ডিসট্রেস বাড়বে। অনেক কিছু চিন্তা করার আছে। মিথের মধ্যে টুথ আছে।
ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশন ঠুকে দিয়ে চলে গেলেন। বাথরুমে ঢুকলুম চান করতে। চিরকালের অভ্যাস, বালতিতে জল পড়ার শব্দের সঙ্গে রাগ-রাগিনীর আলাপ। ভৈরবী আসতে পারে, চৌড়ি এসে যেতে পারে। ভৈরো এলে বহুত আচ্ছা। স্বরচিত গানে সুর বসাতে পারি। মিঞামল্লার ধরেছিলুম হঠাৎ কাশি, ভয়ংকর রকমের। গাইতে চেয়েছিলুম গান, শুরু হয়ে গেল বাজনা। ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সংগীত। শেষে এমন হল, দম নিতে পারি না। আঁকুপাকু অবস্থা। সেই সময় মনে হল, বাথরুমে মরাটা কি ঠিক হবে! মানুষ কত পবিত্র জায়গায় মরে। তীর্থে, জাহ্নবী কূলে। অর্ধঅঙ্গ গঙ্গাজলে, অর্ধাঙ্গ থাকবে স্থলে। কেহ বলবে হরে হরে, করে করে দিয়ে তালি।
মনে হওয়া মাত্রই দমাস করে দরজাটা খুলে ফেললুম। বাইরে উদবিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে পুত্র, পুত্রবধু, পূজা। আমার কষ্টে সকলের মুখে যন্ত্রণা।
পূজা এগিয়ে এসে হাত ধরল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে দাদাই!
উত্তর দিতে পারছি না। সামান্য একটু বাতাস চাই। টাকা, সম্মান, সম্পত্তি, সব বৃথা। একটু বাতাস।
আমার অবস্থা দেখে পূজা কেঁদে ফেলল, দাদাই ওমা! দাদাই!
আমি জানালায় মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছি। পুত্রবধূ আমার পিঠে হাত ঘষছে। পুত্র বলছে এসব ডাক্তারে হবে না।
আমি ভাবছি, মানুষের মৃত্যুটা মোটেই সুখের নয়। জন্মেও যন্ত্রণা, মৃত্যুতেও যন্ত্রণা। বাঁচাটাও যন্ত্রণা। ভাবছি, আবার একবার পৃথিবীতে আসব কি না! হলুদ রোদে সবুজ পাতা ঝিলমিল করছে। তিনটে পাখি গান গাইছে। অ্যান্টেনায় ধ্যানস্থ মাছরাঙা। এই সব দেখছি, সামান্য একটু বাতাসের জন্যে হাপরের মতো হাঁপাচ্ছি। পৃথিবীতে এত বাতাস আর হরিনামের ঝুলির মতো। আমার এই ফুসফুসে এক চুমুক বাতাস কেন ঢোকে না। ভাবছি, মুহূর্তে প্রাণ যদি বেরিয়ে যায়, তাহলে পাখি হয়ে কিছুক্ষণ অ্যান্টেনায় বসব। তারপর উড়ে যাব যে-স্কুলে পড়তুম, সেই স্কুলবাড়ির গম্বুজে। সেখান থেকে কালীমন্দিরের চূড়ায়। প্রাচীন বটগাছে অন্য পাখির জটলায় কিছুক্ষণ কাটাব। তারা বুঝতেই পারবে না, এ পাখিটা অন্য জাতির পাখি, প্রাণপাখি। তারপর কৈলাসের বারান্দায় গিয়ে বসব। কৈলাস ভাববে, পাখিটার মন খারাপ। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর। নিজের চেয়ে স্বজন কে আছে। সেই নিজেকেই তো হরিয়েছে পাখি। ইতিমধ্যে আমার। দেহ খাটে চেপে শ্মশানে এসে যাবে। ষাট-বাষট্টি বছরের প্রাচীন আবাসস্থল। জিওল গাছের ডালে বসে ছাই হওয়াটা দেখব, তারপর সিন্ধুসারসের মতো উড়তে উড়তে পশ্চিম আকাশের দিকে। যেতে যেতে বিন্দুর মতো রেণুর মতো অদৃশ্য। কিছুকাল চন্দ্রবিন্দুর চুটকি লাগানো নামটা পড়ে থাকবে। দু-একটা কাগজে, খাতায়, পাতায়, রেকর্ডে।
এই সব ভাবনার মধ্যেই আমাকে বসিয়ে ফেলা হয়েছে। যাকে বলে স্কোয়াট। আমার পুত্রবধূ পিঠ থাবড়াচ্ছে। পূজা ছোট ছোট হাত দিয়ে বুকের কাছটা মালিশ করছে। আর কিছুটা ব্যবধানে, আমার পুত্র চ্যুতরাজ্য রাজার মতো পায়চারি করছে আর বলছে, সামথিং মাস্ট বি ডান, সামথিং মাস্ট বি ডান।
এই সময় কৈলাস এসে হাজির। সকলের উতলা অবস্থা দেখে বললে, হাঁপানি সারে না বাবা!
আগুনে ঘৃতাহুতি হল। উত্তেজিত পুত্র আরও উত্তেজিত হয়ে বললে, কাকাবাবু, দিস ইজ নট হাঁপানি।
দেন হোয়াট ইজ ইট?
দিস ইস অ্যালার্জি। কয়েক হাজার বইয়ের ধুলো। সারা বাড়ি তো বইয়ে ঢাকা। যত না পড়ে তার চেয়ে বেশি ঝাড়ে। ডাস্ট অ্যালার্জি। মা থাকলে বাড়াবাড়িটা কম হত। মা তো নেই। সারাদিন ঝাড়ন হাতে নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। এ হল সরস্বতী পাউডারের এফেক্ট।
বাবা যার নাম কেষ্ট তার নামই কৃষ্ণ। অ্যালার্জিও হাঁপানি। একে নিয়েই ঘর করতে হবে। তবে মন্দের ভালো, হাঁপানিতে পরমায়ু বেড়ে যায়। দমের কাজ হয় তো, ফুসফুসের স্ট্রেংথ বাড়ে। হাঁপানি বলে স্বীকার করে নিতে তোমরা লজ্জা পাচ্ছ কেন? পৃথিবীর অনেক বড় বড় লোকের হাঁপানি ছিল, আছে, থাকবে। রাষ্ট্রনায়ক, যোদ্ধা, লেখক, অভিনেতা, বিশ্বসুন্দরী। হাঁপানি, টাক, সুগার, আরথারাইটিস, চিতায় না চড়ালে কিওর হয় না।
কৈলাস চলে গেল। সত্য কথা বলার অপরাধে সবাই ক্ষুব্ধ। আরও নামকরা একজন ডাক্তারবাবুর খবর এল। রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনের ফাইল নিয়ে তথায় গমন। সময়টা খুব অদ্ভুত। রাত সাড়ে দশটা। চেম্বার উপচে রুগিরা সব রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছেন। সকলেরই ফুসফুস বিকল। বিভিন্ন বয়েস। আমিও তাঁদের একজন হয়ে ফুটপাথের একপাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলুম। অদূরেই কলকাতার ফুর্তি পাড়া। সেই বিখ্যাত প্রাচীন রেস্তোরাঁ। মেট্রো রেলের কুদলে রাখা রাজপথ। টানা রিকশায় নেশায় কাত হয়ে চলেছেন রহিস আদমি। পকেটের, পেটের, বুকের ত্রিবিধ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে রাতের অভিসারে চলেছেন জনপদবধূর কুঞ্জে। এদের বুকে এখনও প্রচুর বাতাস। নায়িকারা মাঝে মাঝে হাওয়া খেতে বাইরে বেরিয়ে আসছে। মাছরাঙার মাছ ধরার কায়দায় খদ্দের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। ঘর ক্রমশ খালি হচ্ছে। অবশেষে। তারিখ বদলের কিছু আগে ডাক পড়ল।
ডাক্তারবাবুর তখন কফি ব্রেক। বুকের ছবি আলোকিত পর্দায় আটকালেন। এক চুমুক কফি, তারপর প্রশ্ন,
ডেলি ক’প্যাকেট চলে?
আজ্ঞে আমি জীবনে ধূমপান করিনি। যখন ছোট ছিলুম, তখন একবার কালীপুজোর সময় প্যাঁকাটি টেনেছিলুম।
শুয়ে পড়ুন।
সহকারী উলটো দিকে একটা বিছানা দেখালেন। দেয়ালে স্টেথিস্কোপ ঝুলছে। সেই পুরোনো ধরনের পরীক্ষা। জোরে, আরও জোরে। ভস ভস করে। উঠে বসলুম।
সমস্ত ওষুধ গঙ্গার জলে ফেলে দিন। কে বলেছিল খেতে! ওই ওষুধের ঠেলায় তো সব জড়িয়ে গেছে লাংসে। কে ছাড়াবে মশাই! কার অত সময় আছে! লাংস দুটো তো অ্যারারুটে চুবিয়ে এনেছেন।
আমার ঠিক কী হয়েছে ডাক্তারবাবু!
ইউ আর সিটিং অন ভলক্যান।
কী করব ডাক্তারবাবু?
স্রেফ ওইটা মনে রাখবেন। স্মরণ, মনন, নিদিধ্যাসন। তিনটে পাফ দিলুম। সকাল, সন্ধে, রাত্তিরে। ঠোঁট দুটো ফাঁক করে ফ্যাঁস, ফ্যাঁস।
আবার আসব কী?
না এসে যাবেন কোথায়!
রাত বারোটা। চেম্বারে তখনও দশজন। না, আমি একা নই! আমার দলে অনেকেই। ওয়ার্কস অফ দ্য ওয়ার্লড ইউনাইট। ইনকিলাব। ওয়ার্কার তো বটেই। চব্বিশ ঘণ্টা হাপর চালাই। নো ওয়ার্ক নো পে। পরের দিন দুশো টাকা নিয়ে তিনটে ভসভসি কিনতে গেলুম। পদ্মা মেডিকেলের মালিক হেসেই অস্থির। শ পাঁচেক লাগবে মশাই।
ফাইভ হানড্রেড! কমে কিছু হয় না?
হয়, পুরোনো ঘি। জোগাড় করুন।
সেই কালো কালো বিশ্রী দুর্গন্ধ। ঠাকুরদা ঠাকুরমার কালের ব্যাপার!
ঘি পুরোনো হলে আর ঘি থাকে না। আত্মশক্তি, বজ্রশক্তি, মহাশক্তি, মা চণ্ডী। আপনি যে রাস্তায় চলেছেন, সে রাস্তাটা হল বধস্য ধনক্ষয়। কোনওদিন দেখেছেন হাঁপানি সেরেছে। টাকে কেষ্ট ঠাকুরের মতো চুল গজিয়েছে, কাজের মহিলা তিরিশ দিন এসেছে, মুখা স্ত্রী ঝগড়া ভুলতে পেরেছে। এই দেখুন, আমার দুটোই আছে। বিশ্বজোড়া টাক আর বুক ভরা অ্যাসথামা। অশ্বত্থামা। মহাভারত তো পড়েছেন! রাত্রে গুপ্তভাবে পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে ধষ্টদ্যুম্ন, উত্তেমৌজা, যুধামনু, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র আর পাণ্ডু শিবিরের সমস্ত সৈন্য, হাতি, ঘোড়া, ফিনিশ করে দিলেন। শেষে ব্রহ্মশিব অস্ত্রে উত্তরার গর্ভের শিশুটিকেও নিধন করলেন। কুরুক্ষেত্রে কৌরব পক্ষের প্রায় সবাই মরেছিলেন, একমাত্র অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের মণি দান করে বনে চলে যান। এই অপরাজেয় অশ্বত্থামাই হল অ্যাসথামা। আর ওই মণিটা হল ভসভস হাঁপানি। এই হল মেডিকেল মহাভারত।
তাহলে কী করব?
যদি ট্যাঁকের জোর থাকে তাহলে এইসব ফাঁসফেঁসে কিনুন, আর তা না হলে ঘরে বসে জীবনের যে ক’টা দিন তলানি পড়ে আছে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করুন। তিনিই যোগবলে উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানকে জীবিত করেছিলেন, অশ্বত্থামার কোপ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন তাকে ঝোপে পাঠিয়ে। এই তো আমার এত বড়ো দোকান, ওষুধের তো শেষ নেই! আমি কী করি!
কী করেন ভাই?
প্রথম যেদিন শুরু হল, অতটা বুঝিনি। ভোরে প্রবল কাশি। থামছে না। ঘরে বসে কাশব। পরিবার পরিজন উঠে পড়বে। বিরক্ত হবে। ছাতে গিয়ে কাশব, এ তো মসজিদের আজান নয় যে পল্লিবাসী সহ্য করবে। বাথরুমে কাশব। পাশের ঘরেই পুত্র-পুত্রবধূ। সবে বিয়ে হয়েছে, খোঁয়ারি ভাঙেনি এখনও। মহা সমস্যা। প্রাণ খুলে কোথায় গিয়ে কাশি! কাশিকে ভয় পাই না, ভয় মানুষের সহানুভূতি আর ঘৃণাকে। কেউ যেন না বলতে পারে, ইউ আর এ নইসেন্স! খাঁটি কথা। আমারও একই অবস্থা। আমি কাশছি, হাঁইফাই করছি, আর সবাই গেল গেল করছে। তা আপনি কী করলেন?
অ্যাজমা তো মেডিকেল সায়েন্সের আওতায় পড়ে না। ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স। প্রথম প্রথম বাড়িসুদ্ধ সবাই আমার চারপাশেদাঁড়িয়ে হায় হায় করত। বুকে, পিঠে হাত বোলাত, রসুন তেল মালিশ করত। যেই জেনে গেল হাঁপানি, তিরানব্বইয়ের আগে নড়বে না, তখন দেখলুম, আমি একা। সকলেই বলতে লাগল, তোমার তো হাঁপানি। আড়ালে আদর—হেঁপো। শত্রুদের চোখে বেটা হেঁপো। তখন আমি মেডিসিন ছেড়ে ম্যানেজমেন্টে গেলুম। কাশার একটা জায়গা বাড়ির মধ্যেই খুঁজে বের করলুম। সেইটাই আমার কাশীধাম, বারাণসী। রান্নাঘরের পাশে ভাঁড়ার ঘর। জানালা নেই। শব্দ বাইরে যাবে না। সেইখানেই আমি ভোরটা ম্যানেজ করি। প্রথমে প্রাণ খুলে উদারা, মুদারা, তারায় কাশতুম। শেষে প্রফেশনাল কাফার হলুম। সেটা শিখলুম আমার কুকুর জুলির কাছে। জুলি যখন তারস্বরে ভৌ ভৌ করে, তখন কোনও লাভ হয় না, ভুকভুক করবেন, মাঝে মাঝে ভৌ। নিভৃত একটা জায়গা খুঁজে নিন। পেয়ে যাবেন। মাঝে মাঝেদরবারিতে গাইবেন—আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে তুমি অভাগারে চেয়েছ। আমি না ডাকিতে হৃদয় মাঝারে নিজে এসে দেখা দিয়েছ। আমি যাঁর চিকিৎসায় আছি তাঁরও অ্যাজমা। ফলে ভালোই হয়েছে। মাঝে মাঝে ফোন,
—হ্যালো, ডাক্তারবাবু খবর কী?
—উঁকি মারছে। আপনার?
—নহবত বসছে।
—মেরে দিন, এক ডোজ ডেকাড্রেন, ডেরিফাইলিন পাঞ্চ করে।
আমরা সবাই এক সুরে বাঁধা। একই সূত্রে বাঁধিয়েছি সহস্র পরাণ, বন্দেমাতরম।
কৈলাসকে বললুম, কৈলাস এই ব্যাপার। তুই আমার একটা ব্যবস্থা করে দে। রান্নাঘর, শোয়ার ঘর, বসার ঘরের মতো কাশির ঘর। গুদোম-টুদোম হলেও চলবে। একান্তে বসে কাশব। হাঁপাব। তনু হাঁপানি হয়ে ফিরে এসেছে। মনে, বনে, কোণে, তোকে নিয়ে থাকব। শেষে একদিন, গুদোমে গুমখুন।
Post a Comment