লাবাম্বা – হুমায়ূন আহমেদ

লাবাম্বা – হুমায়ূন আহমেদ

মিতুর ঘর থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার–মা, আমার টাকা?

মিতুর মা আফরোজার অফিসের গাড়ি চলে এসেছে, নিচ থেকে হর্ণ দিচ্ছে। তার দাঁড়াবার সময় নেই। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কি হল?

আমার টাকা কোথায় গেল মা?

আমি কি জানি কোথায় গেল।

টেবিলের উপর রেখে বাথরুমে মুখ ধুতে গেছি….

কত টাকা?

পাঁচশ টাকার একটা নোট। আজ আমি বন্ধুদের চটপটি খাওয়াব। কে আমার টেবিল থেকে টাকা নেবে?

আফরোজা কথা বাড়াতে চাইছেন না। অফিসের মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছে। সহকর্মীরা নিশ্চয়ই বিরক্তমুখে বসে আছেন। সেদিন কথায় কথায় রমিজ সাহেব বলেছেন–তার এগারো বছরের চাকরি জীবনে এ রকম না কি কখনো হয়নি যে, গাড়ি হর্ণ দিয়েছে আর মহিলা সহকর্মী নেমে এসেছেন। শেষ মুহূর্তেও মহিলাদের না-কি কিছু কাজ বাকি থাকে।

আফরোজা মেয়ের ঘরে এসে ব্যাগ খুলে টাকা বের করলেন। মিতু বললো, তুমি ময়লা টাকা দিচ্ছ কেন? আমি ময়লা টাকা দিয়ে বন্ধুদের চটপটি খাওয়াবো না। আমি এই টাকা নেব না।

নতুন টাকা আমি এখন পাব কোথায়?

সেটা আমি জানি না। তুমি আমাকে চকচকে নতুন একটি নোট দিয়ে তারপর অফিসে যাবে। নয়তো তোমাকে আমি ঘর থেকে বেরুতে দেব না। দরজা বন্ধ করে আটকে রাখবো।

মিতু এবার ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। তার আচার আচরণ কাজকর্ম সবই এখনো স্কুলের মেয়ের মত। সে সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করে দেবে। নিচ থেকে ক্রমাগত গাড়ির হর্ণ ভেসে আসছে। আফরোজার কাছে ঝকঝকে টাকা নেই। যন্ত্রণায় পড়া গেল।

মিতু খাটে বসে আছে। হাসিমুখেই বসে আছে। পা নাচাচ্ছে। তার গায়ে তার বাবার একটা শার্ট।

মা, আমাকে অফিসে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

হোক দেরি।

এই দুশ টাকা রেখে দে। এই নোট দুটি তো মোটামুটি পরিষ্কারই আছে।

অসম্ভব। আমি মাত্র দুশ টাকা নিয়ে যাব?

তুই বড় যন্ত্রণা করিস মিতু। আমি কি অফিসে যাব না?

না।

কী যে তুই পাগলের মত বলিস।

আমি যদি ইউনিভার্সিটিতে যেতে না পারি, তুমিও পারবে না।

ঘরে বসে থেকে আমি কি করবো?

আমার টাকা কোথায় গেল খুঁজে বের করবে।

আফরোজা কাজের মেয়ে লাইলীকে নিচে পাঠালেন। সে বলে আসবে তিনি আজ অফিসে যাবেন না। তার শরীর ভাল না। জ্বর আসছে।

মিতু পা নাচানো বন্ধ করে বলল, টাকাটা লাইলী নেয়নি তো মা? ঘরে আমরা চারজন মাত্র মানুষ। আমি তুমি লাইলী আর জিতুর মা। তুমি নিশ্চয়ই নাওনি। বাকি থাকছে লাইলী আর জিতুর মা। জিতুর মা নেবে না কাজেই কালপ্রিট হচ্ছে লাইলী।

আমার তো মনে হয় তুই-ই কোথায় রাখতে কোথায় রেখেছিস।

আমি টেবিলের উপরই রেখেছি। এই দেখ, ঠিক এইখানে। পেনসিল-কাটার দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে বাথরুমে মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি হাপিশ।

হাপিশ মানে?

হাপিশ মানে হজম হয়ে গেছে।

এই জাতীয় স্ল্যাং আমার সামনে বলবি না।

হাপিশ মা খুব ভদ্র স্ল্যাং। ভদ্র স্ল্যাং শুনেই তোমার এই অবস্থা। ভালগার স্ল্যাং শুনলে…মা একটা শুনবে?

মিতু আমি যে তোর মা এটা মনে থাকে না?

উঁহু, মনে থাকে না। আমার সব সময় মনে হয়, তুমি আমার বান্ধবী। বান্ধবীর স্ল্যাং কি জান মা? চামমি।

চামমি?

হা, চামমি। আর বান্ধবের স্ল্যাং হল চামমা।

চুপ কর।

আর প্রেমের স্ল্যাং হল–লদকা। আমি প্রেম করছি হবে–আমি লদকাচ্ছি।

প্লীজ স্টপ ইট।

মিতু খিলখিল করে হাসছে। লাইলী এসে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। আফরোজা বললেন, বলে এসেছ?

লাইলী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

ওরা কেউ কিছু বলেছে?

জ্বে না।

আফরোজা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, শোন লাইলী, মিতু একটা পাঁচশ টাকার নোট টেবিলে রেখেছিল। বাতাসে উড়ে বোধ হয় নিচে কোথাও পড়েছে। খুঁজে বের কর। মিতু তুই আমার ঘরে আয়। ও নোটটা খুঁজে বের করুক।

মিতু মা’র সঙ্গে মা’র শোবার ঘরে চলে এল। চাপা গলায় বলল, মা তোমার তো দারুন বুদ্ধি। ভাল কায়দা বের করেছে তো। আচ্ছা তোমার কি ধারণা লাইলী টাকাটা নিয়েছে….?

যেখানে সেখানে ফেলে রাখলে তো নেবেই।

ওর মুখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না ও নিয়েছে।

গ্রামের মেয়েদের মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না।

তোমার কি ধারণা গ্রামের মেয়েদের বুদ্ধি শহরের মেয়েদের চেয়ে বেশী?

তুই শুধু শুধু এত কথা বলিস। মাথা ধরে যায়….চুপ কর।

মিতু গম্ভীর গলায় বলল, আচ্ছা মা, এই বিষয়ে বাবার একটা মতামত টেলিফোনের মাধ্যমে জেনে নিই? তোমার আপত্তি নেই তো?

আফরোজা বিরক্তস্বরে বললেন, তুই তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবি এতে আমার আপত্তি থাকবে কেন?

মিতু হাসল। মা রেগে গেছে এটা সে বুঝতে পারছে। হাসি দেখে আরো রেগে যাবে। মাকে রাগাতে তার ভালই লাগে।

মা, তুমি কি রেগে গেছ?

রাগব কেন?

বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম, এই জন্য… তোমার এক্স হাসবেন্ড….

তোর এই ধরনের কথাবার্তা অসহ্য।

পুরো ব্যাপারটা তুমি নরম্যালি নিতে পারছ না বলে তোমার কাছে অসহ্য লাগে। বাবা তোমাকে ফেলে চলে গেছে আর সেই দুঃখে তুমি মোটা হতে হতে মিস কিংকং…

আফরোজার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এরকম করে কোনো মেয়ে কথা বলতে পারে? কোথায় যাচ্ছে এখনকার ছেলেমেয়েরা?

মা শোনো, বাবা তো বিয়ে করে দিব্যি সব গুছিয়ে ফেলেছে। তুমি আর দেরি করো। তোমার সাইজের কাউকে খুঁজে বের করে কিছুদিন লদকাও তারপর শুভ বিবাহ।

মেয়েকে কঠিন ধমক দেবার ইচ্ছা আফরোজা সামলালেন। কী হবে ধমক দিয়ে?

শুধু শুধু অফিস কামাই হল। সারাদিন ঘরে বসে থেকে হবেটা কি? এই সপ্তাহের বাজারটা করে রাখলে হয়। মিতুকে কি বলবেন, সে যেন তার বাবাকে বলে তার গাড়িটা আজকের জন্যে আনিয়ে নেয়? মিতু বললেই গাড়ি চলে আসবে। লোকটা মেয়েঅন্ত প্রাণ।

মিতু তার বাবাকে টেলিফোন করছে। মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল —

বাবা শোনো। তুমি তোমার মূল্যবান একটা জাজমেন্ট আমাকে দাও তো। গ্রামের মেয়েদের বুদ্ধি কি শহরের মেয়েদের চেয়ে বেশী?

মারুফ সাহেব বললেন, হঠাৎ বুদ্ধির প্রসঙ্গ কেন?

হঠাৎ না। এটা নিয়ে মা’র সঙ্গে আমার তর্ক হচ্ছে। তোমার মতামত কি?

মতামত দিতে পারছি না। গ্রামের মেয়ে তেমন দেখিনি। তুই কেমন আছিস বল। ইউনিভার্সিটিতে যাসনি?

যাব কিভাবে? আমার সব চুরি হয়ে গেছে বাবা।

সে কি।

তুমি যে চকচকে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়েছিলে, টেবিলের উপর রেখেছিলাম–হাপিশ হয়ে গেছে।

কাজের মেয়ে-টেয়ে কেউ নিয়েছে নিশ্চয়ই।

আমার ধারণা লাইলী নিয়েছে। ওর উপরই আমার ঘর গোছানোর দায়িত্ব। বাবা শোনো, তোমার এই প্রসঙ্গে কী মতামত?

তোর কথা বুঝতে পারছি না।

তোমার কি মনে হয় লাইলী টাকাটা নিতে পারে?

চোখের সামনে পড়ে থাকলে নিতেও পারে। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়।

লাইলী কিন্তু স্বাভাবিক আচরণ করছে। মা তাকে বলেছেন টাকা খুঁজে বের করতে। ও টাকা খুঁজে যাচ্ছে।

ও, আচ্ছা।

বাবা শোনো, তুমি কি একটা বাজি রাখবে আমার সঙ্গে?

কী বাজি?

বাজি হচ্ছে–আমি বলছি ও টাকা নিয়েছে। তুমি বলছ, না। এই নিয়ে বাজি। পাঁচশ টাকা বাজি।

বাজি-টাজি না, তোর পাঁচশ টাকা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কখন পাঠাবে?

এই এক্ষুণি পাঠাচ্ছি। ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠাচ্ছি।

ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠালে হবে না বাবা, তোমাকে নিয়ে আসতে হবে।

আমি তো এখন আসতে পারবো না মা। অফিসে খুব কাজ। আমি না হয় সন্ধ্যার পর…।

এই সব চলবে না। বাবা, তোমাকে এক্ষুণি আসতে হবে। এই মুহূর্তে না হলে…

না হলে কি…

হলে আমি ভয়ংকর কিছু করে বসব। খুবই ভয়ংকর। যেমন ধর ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়া জাতীয়।

ভয়ংকর কিছু করতে হবে না, আমি আসছি।

এক্ষুণি আসছ তো?

হা।

বাবা শোনো, কিছু ফুল নিয়ে আসতে পারবে?

কী ফুল?

গোলাপ।

আচ্ছা নিয়ে আসবো।

বাবা শোনো, তুমি এলে তোমাকে নিয়ে আইসক্রীম খেতে যাব।

আচ্ছা, যাওয়া যাবে।

আমাদের সঙ্গে যদি তোমার প্রাক্তন স্ত্রীকে নেই তাহলে কি তুমি রাগ করবে?

মারুফ সাহেব হেসে ফেললেন। মিতুও হাসল।

.

লাইলী তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। তার বুক ধক ধক করছে। যদি নোটটা না পাওয়া যায়। যদি তারা মনে করে সে নোট নিয়েছে। তখন তারা কি করবে? বেগম সাহেব কি বাড়ি থেকে বের করে দেবেন? ঢাকা শহরে একটা ভাল বাড়ি পাওয়া খুব কষ্টের। এই বাড়িটা ভাল। এই বাড়ির মেয়েটা ভাল। বেগম সাহেবও ভাল। এই বাড়ি ছেড়ে যেতে। তার কষ্ট হবে।

মিতু তার ঘরে এসে দাঁড়াল। লাইলী তাকালো ভয়ে ভয়ে। মিতু বলল, পাওয়া গেছে লাইলী?

জ্বে না আফা।

থাক, আর খুঁজতে হবে না।

টাকা আমি নেই নাই আফা।

টাকা তুমি নাওনি সেটা আমি জানি। টাকা তুমি নেবে কি করে? আমি রাখলে তবে তো নেবে। আমি টাকা রাখিনি। টাকা আমার ব্যাগেই আছে।

লাইলী নির্বোধের মত তাকাচ্ছে। কিছু বুঝতে পারছে না। মিতু হালকা গলায় বলল, টাকার ব্যাপারটা নিয়ে একটা নাটকের মত করে আমি মাকে আটকেছি। বাবাকেও ডেকে আনাচ্ছি, যাতে আজ সারাদিন বাবা, মা আর আমি আমরা তিনজন এক সঙ্গে থাকতে পারি।

লাইলী এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। মিতুর মনে হল গ্রামের মেয়েরা আসলে শহরের মেয়েদের চেয়ে বোকা, নয়তো ব্যাপারটা বুঝতে লাইলীর এত সময় লাগার কথা না।

মিতু তার খাটে বসতে বসতে বলল, আজ হচ্ছে আমার বাবা-মা’র ম্যারেজ ডে। তারিখটা মা’র মনে আছে কিন্তু বাবা ভুলে গেছেন। কাজেই বাধ্য হয়ে আমাকে একটা নাটক করতে হল। এখন বুঝতে পারছ?

জ্বে আফা।

আচ্ছা, তাহলে এখন তুমি চলে যাও। আমার খুব মন খারাপ লাগছে। বাবা আসার। আগ পর্যন্ত আমি কাঁদব। তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। বাবার গাড়ি দেখলেই আমার দরজায় টোকা দেবে। সঙ্গে সঙ্গে আমি কান্না বন্ধ করব। পারবে না?

পারুম আফা।

মিতু দরজা বন্ধ করে তার সিডি প্লেয়ারে লাবাম্বা জিপসী গান ফুল ভলমে দিয়ে দিল। হৈ-চৈ ধরনের গান ছাড়া সে কাঁদতে পারে না। পুরো ফ্ল্যাট বাড়ি কাঁপিয়ে জিপসী ব্যান্ড গাইছে–লাবাম্বা। লাবাম্বা। মিতু তার বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

No comments