মহান চীন এবং কিছু ড্রাগন – হুমায়ূন আহমেদ
বিশেষ এক ধরনের জটিল ব্যাধি আছে যা শুধুমাত্র লেখকদের আক্রমণ করে। লেখকরা তাদের লেখালেখি জীবনে কয়েকবার এই ব্যাধিতে ধরাশায়ী হন। পৃথিবীতে এমন কোনো লেখক পাওয়া যাবে না-যিনি জীবনে একবারও এই জটিল অসুখের শিকার হন নি। মেটেরিয়া মেডিকায় এই অসুখের বিবরণ থাকা উচিত ছিল কিন্তু নেই লেখকদের নিয়ে কে ভাবে?
যাই হোক, অসুখটার ইংরেজি নাম ‘writer’s Block’, বাংলায় লেখক বন্ধ্যা রোগ বলা যেতে পারে। এই রোগের লক্ষণ এরকম-হঠাৎ কোনো একদিন লেখকের মাথা শূন্য হয়ে যায়। তিনি লিখতে পারেন না। গল্প-কবিতা দূরে থাকুক স্বরে ‘অ-ও না। তিনি অভ্যাসমতো রোজ কাগজ-কলম নিয়ে বসেন এবং কাগজের ধবধবে শাদা পাতার কোনায় কোনায় ফুল-লতাপাতা আঁকার চেষ্টা করেন। কাপের পর কাপ চা ও সিগারেট খান। একসময় উঠে পড়েন। এটা হচ্ছে রোগের প্রাথমিক পর্যায়।
রোগের দ্বিতীয় পর্যায়ে লেখক ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত হন। সারা রাত জেগে থাকেন। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অকারণে রাগারাগি করতে থাকেন-যেমন, চা এত গরম কেন?’ [চা গরম হবারই কথা। লেখক আইসটি খেতে চাইলে ভিন্ন কথা।] ‘সবাই উঁচু গলায় কথা বলছে কেন?” [সবাই স্বাভাবিক গলাতেই কথা বলছে। এরচে নিচু গলায় কথা বললে কানাকানি করতে হয়। এই গ্লাসে করে আমাকে পানি কেন দেয়া হলো?’ [লেখক জীবনে কখনো কোন গ্লাসে পানি দেয়া হয়েছে তা নিয়ে মাথা ঘামান নি। ব্যাধিগ্রস্ত হবার পর গ্লা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। কী রকম গ্লাসে পানি দেয়া হলে তিনি খুশি হবেন তাও কিন্তু খোলসা করে বলছেন না।]
রোগের শেষ পর্যায়ে লেখক ঘোষণা করেন তিনি আর লেখালেখি করবেন। অনেক হয়েছে। …… ছাল’ লিখে ফায়দা নেই। [ছালের আগের শব্দটা বুদ্ধিমান পাঠক গবেষণা করে বের করে নিন।] লেখকের মুখের ভাষা বস্তি লেভেলে নেমে আসে। তাঁর মধ্যে কাজী নজরুল সিনড্রম দেখা যায়। হাতের কাছে যাই পান তাই ছিঁড়ে ফেলেন। নিজের পুরনো লেখা, টেলিফোন বিল, ইলেকট্রিসিটি বিল সব শেষ। তারপর এক অনিদ্রার মধ্যরাতে স্ত্রীকে ডেকে তুলে শান্ত গলায় বলেন, আমি বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সুইসাইড করব। তোমার কাছে থেকে বিদায় নেবার জন্যে তোমার কাঁচাঘুম ভাঙিয়েছি। তার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। এখন দয়া করে একুশটা ঘুমের ওষুধ আমাকে দাও আর এক গ্লাস ঠা পানি।
কোনো কোনো পাঠক হয়তো ভাবছেন আমি writer’s Block নামক রোগটা নিয়ে রসিকতা করছি। তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এই পৃথিবীর অনেক লেখক (খ্যাত এবং অখ্যাত) এই ভয়াবহ অসুখের শেষ পর্যায়ে এসে আত্মহত্যা করেছেন। এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে পড়ছে তারা হলেন
কবি মায়াকোভস্কি (রাশিয়া)
ঔপন্যাসিক হেমিংওয়ে (নোবেল প্রাইজ বিজয়ী, আমেরিকান)
ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা (নোবেল প্রাইজ বিজয়ী, জাপানি)
কবি জীবনানন্দ দাশ (বাংলাদেশ)
বিখ্যাতদের মতো অতি অখ্যাতরাও যে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন তার উদাহরণ আমি। গত শীতের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ আমাকে এই রোগে ধরল। কঠিনভাবে ধরল। এক গভীর রাতে শাওনকে ডেকে তুলে বললাম, কোথা সে ছায়া সখি কোথা সে জল? কোথা সে বাধাঘাট অশ্বত্থল?’ সে হতভম্ব হয়ে বলল, এর মানে?
আমি বললাম, তুমি খুব আগ্রহ করে একজন লেখককে বিয়ে করেছিলে। সেই লেখক কিছু লিখতে পারছেন না। কোনোদিন পারবেনও না। আমি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। লেখকের সঙ্গে জীবনযাপনের আগ্রহ তারপরেও যদি তোমার থাকে, তুমি অন্য লেখক খুঁজে বের কর। আমি শেষ। আসসালামু আলায়কুম।
জীবন সংহারক রাইটার্স ব্লকের কোনো ওষুধ নেই। এন্টিবায়োটিক বা সালফা ড্রাগ কাজ করে না, তবে সিমটোমেটিক চিকিৎসার বিধান আছে। সিমটোমেটিক চিকিৎসায় লেখককে অতি দ্রুত তিনি যে পরিবেশে বাস করেন সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তার প্রিয়জনরা সবাই তার আশেপাশে থাকবেন, তবে লেখালেখি বিষয়ে কেউ তার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারবেন না। লেখকের সঙ্গে কোনো বিষয়েই কেউ তর্কে যাবেন না। তিনি যা বলবেন সবাই ‘গোপাল বড়ই সুবোধ বালকের মতো তাতে সায় দেবে।
আমার লেখক বুক দূর করার ব্যবস্থা হলো। প্রধান উদ্যোগী অন্যপ্রকাশের মাজহার। আমার এই অসুখে সে-ই সবচে’ ক্ষতিগ্রস্ত। আমি বই না লিখলে সে ছাপবে কী? সামনেই একুশের বইমেলা!
মাজহার এক সকালবেলা অনেক ভণিতার শেষে বলল, আমি জানি আপনি দেশের বাইরে যেতে চান না। চলুন না ঘুরে আসি। আপনি লেখালেখি করতে পারছেন না।-এটা কোনো ব্যাপার না। সারাজীবন লেখালেখি করতে হবে তাও তো না। এক জীবনে যা লিখেছেন যথেষ্ট। এমনি একটু ঘুরে আসা। আপনি হ্যাঁ বললে খুশি হবো।
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আনন্দে মাজহারের কালো মুখ বেগুনি হয়ে গেল। হিসাব মতো তার মুখে বত্রিশটা দাঁত থাকার কথা, সে কীভাবে যেন চল্লিশটা দাঁত বের করে হেসে ফেলল।
হুমায়ূন ভাই, কোথায় যেতে চান বলুন-ইন্দোনেশিয়ার বালি, মালয়েশিয়ার জেনটিং, থাইল্যান্ডের পাতায়া/ফুকেট, মরিশাস, মালদ্বীপ।
আমি বললাম ড্রাগন দেখতে ইচ্ছা করছে। চীনে যাব।
মাজহারের মুখের ঔজ্জ্বল্য সামান্য কমল। সে আমতা আমতা করে বলল, চীনে এখন ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। টেম্পারেচার শূন্যেরও নিচে….
আমি আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বললাম, চীন।
মাজহারের মনে পড়ল রাইটার্স ব্লকের রোগীর সব কথায় সায় দিতে হয়। সে বলল, অবশ্যই চীন। আমরা গরম দেশের মানুষ। ঠাণ্ডা কী জানি না। হাতে কলমে ঠাণ্ডা শেখার মধ্যেও মজা আছে।
হঠাৎ করে আমার মাথায় চীন কেন এলো বুঝতে পারলাম না। এমন না যে আমি চীন দেখি নি। পনেরো বছর আগে একবার গিয়েছিলাম। প্রায় একমাস ছিলাম। চীন দেশের নানান অঞ্চলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই দেশে আরেকবার না গিয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যেত। কিন্তু আমার মাথায় বাচ্চাদের মতো ঘুরছে-চীন, চীনের ড্রাগন।
সফরসঙ্গীর দীর্ঘ তালিকা তৈরি হলো। রাইটার্স ব্লক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীকে একা ছাড়া যাবে না। তার চারপাশে বন্ধুবান্ধব থাকতে হবে।
আমার সফরসঙ্গীরা হলেন–
০১. চ্যালেঞ্জার এবং চ্যালেঞ্জার-পত্নী। চ্যালেঞ্জার একজন অভিনেতা। বেচারী একদিন নুহাশ চলচ্চিত্রে নাটকের শুটিং দেখতে এসেছিল। নাপিতের এক চরিত্রে কাউকে অভিনয় করার জন্যে পাচ্ছিলাম না। তাকে ধমক দিয়ে জোর করে নামিয়ে দিলাম। আজ সে বিখ্যাত অভিনেতা। শুনেছি বাংলাদেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে তার সম্মানী সর্বোচ্চ। চ্যালেঞ্জার-পত্নী স্কুল শিক্ষিকা। স্বামীর প্রতিভায় তেমন মুগ্ধ না তবে স্বামীর নানাবিধ যন্ত্রণায় কাতর।
০২. কমল, কমল-পত্নী এবং কন্যা আরিয়ানা।
কমলও আমার নাটকের অভিনেতা। ডায়ালগ ছাড়া অভিনয়ে সে অতি পারঙ্গম। ডায়ালগ দিলেই নানা সমস্যা। তোতলামি, মুখের চামড়া শক্ত হয়ে যাওয়া, হাত-পা বেঁকে যাওয়া শুরু হয়। সে আমার নাটকে অতি দক্ষতার সঙ্গে, রাইফেল কাঁধে মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তান আর্মির সেপাই, পথচারী, দুর্ভিক্ষে মৃত লাশের ভূমিকা করেছে। এই মহান অভিনেতা অভিনয়ের জন্য কোনো সম্মানি দাবি করেন না। ডেডবডির ভূমিকায় তিনি অনবদ্য। ডেডবডির ভূমিকায় এক বটগাছের নিচে তিনি আড়াই ঘণ্টা হাঁ করে পড়েছিলেন। এর মধ্যে মুখে পিঁপড়া ঢুকেছে, কামড় দিয়ে তার জিহ্বা ফুলিয়ে ফেলেছে, তিনি নড়েন নি। কমল পত্নীর নাম লিজনা। একসময় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। অভিনেতা স্বামীর পেছনে সময় দিতে গিয় স্কুল ছেড়েছেন। এখন তাঁর প্রধান কাজ অভিনেতা স্বামীর কস্টিউম গুছিয়ে দেয়। এই দম্পতির একমাত্র কন্যা আরিয়ানার বয়স চার। পরীশিশুর চেয়েও সুন্দর। পুরো চায়না ট্রিপে আমার অনেকবারই ইচ্ছা করছে, মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করি। নিজের ছেলেমেয়ে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেমেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করার আমার অভ্যাস নেই বলে করা হয় নি।
০৩. মাজহার, মাজহার-পত্নী তাদের শিশুপুত্র অমিয় এবং টমিও।
মাজহারের একটি পরিচয় আগেই দিয়েছি, তারচেয়ে বড় পরিচয় সেও আমার নাটকের একজন অভিনেতা। তার এক মিনিটের একটি দৃশ্য আমি পুরো একদিন শুট করার পর ফেলে দিয়ে বাসায় চলে আসি। পরের দিন আমার হয়ে শাওন সেই দৃশ্য শুট করতে যায়। আমি নিশ্চিত ছিলাম সে পারবে। সে আমার মতো অধৈর্য না। তার ধৈর্য বেশি। সে এক মিনিটের এই দৃশ্য শুট করতে দেড় দিন সময় নেয়। শুটিং শেষে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাজহার কেমন করেছে? সে খড়খড়ে গলায় বলেছে, তুমি জানো না সে কেমন করেছে? সব বন্ধু-বান্ধবকেই অভিনেতা বানাতে হবে?
আমি এখনো আশাবাদী। কারণ আমার চিফ অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর (জুয়েল রানা) আমাকে বলেছে যে, মাজহার স্যারের না-সূচক মাথা নাড়া এবং হা-সূচক মাথা নাড়া খারাপ হয় নি। প্রায় ন্যাচারাল মনে হয়েছে।
মাজহার-পত্নী স্বর্ণা সিলেটের মেয়ে। মা স্বভাবের মেয়ে। মাতৃভাব অত্যন্ত প্রবল। দীর্ঘদিন ধরে তাকে চিনি। তার মুখ থেকে এখনো কারো প্রসঙ্গে একটি মন্দ কথা শুনি নি। স্বর্ণা স্বামীর অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ। স্বামীর প্রথম অভিনয়ের দিন সে মানতের রোজা রেখেছে। শাহজালাল সাহেবের দরগায় বিশেষ মোনাজাতের ব্যবস্থা করেছে।
এই দম্পতির একমাত্র পুত্রসন্তান অমিয়। নামটা রেখেছেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। মাজহার পুত্রের নামের জন্যে আমার কাছে প্রথম এসেছিল।
আমি নাম রেখেছিলাম-অরণ্য। মাজহার এই নাম রাখে নি, কারণ এই নামের একটা বাচ্চাকে সে চেনে। সেই বাচ্চা খুবই দুষ্টু প্রকৃতির। অরণ্য নাম রাখলে বাচ্চা বন্যস্বভাবের হয়ে যেতে পারে।
‘যে যার নিন্দে তার দুয়ারে বসে কান্দে। আমাদের অমিয় (বয়স চার) মাশাল্লাহ অতি দুষ্টু প্রকৃতির হয়েছে। তার সঙ্গে খেলতে এসে তার হাতে মার খায় নি এমন কোনো শিশু নেই। কামড় দিয়ে রক্ত বের করার বিষয়েও সে ভালো দক্ষতা দেখাচ্ছে। এই দিকে সে আরো উন্নতি করবে বলে সবারই বিশ্বাস। বেইজিং-এর ম্যাগডোনাল্ড রেস্টুরেন্টে বার্গার খাওয়ার সময় সে ফ্লাইং কিক দিয়ে দুই চায়নিজ বাচ্চাকে একই সঙ্গে ধরাশায়ী করে রেস্টুরেন্টের সবার প্রশংসাসূচক দৃষ্টি লাভ করেছে।
তার বিষয়ে একটি গল্প এখনই বলে নেই, পরে ভুলে যাব।
আমি কোনো একটি পত্রিকায় ইন্টারভ্যু দিচ্ছি। বিষয়বস্তু বাংলাদেশের ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ’। অতি জটিল বিষয়। যিনি ইন্টারভ্যু নিচ্ছেন তিনি কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করছেন, যার উত্তর আমি জানি না। মোটামুটি অসহায় বোধ করছি। আমার পাশে নিরীহ মুখ করে অমিয় বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ইন্টারভ্যু নামক বিষয়টাতে যথেষ্ট মজা পাচ্ছে। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন একটু বলুন, বাংলাদেশের কোন কোন গল্পকার কাফফাঁকে অনুসরণ করেন?
উত্তরের জন্যে আমি আকাশ-পাতাল হাতড়াচ্ছি, এমন সময় আমার গালে প্রচণ্ড এক চড়। আমার প্রায় পড়ে যাবার মতো অবস্থা। প্রথমে ভাবলাম–প্রশ্নকর্তা আমার মূর্তায় বিরক্ত হয় চড় লাগিয়েছেন। ধাতস্থ হয়ে বুঝলাম প্রশ্নকর্তা না চড়
দিয়েছে অমিয়। আমি উত্তর দিতে দেরি করায় সে হয়তো বিরক্ত হয়েছে। প্রশ্নকর্তা ভীত গলায় বলল, স্যার এই ছেলে কে?
আমি বললাম, অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহারুল ইসলামের ছেলে। সে বলল, আপনাকে মারল কেন?
আমি বললাম, ছেলে তার বাবার মতো হয়েছে। সাহিত্য পছন্দ করে না। সাহিত্য বিষয়ক কোনো আলোচনাও পছন্দ করে না। ইন্টারভ্যু এই পর্যন্ত খাক।
জি আচ্ছা থাক।
এত সহজে প্রশ্নকর্তা যে তার ইন্টার বন্ধ করল তার আরেকটি কারণ ইতিমধ্যে অমিয় প্রশ্নকর্তার ক্যামেরার উপর ঝাপ দিয়ে পড়েছে। ক্যামেরা নিয়ে দু’জনের দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে।
অমিয়’র চড় খেয়ে আমি তেমন কিছু মনে করি নি। তার কারণ সে আমাকে ডাকে-বুব ধু। বুব বু’র অর্থ বন্ধু। বন্ধু বলতে পারে না, বলে খুব বু। একজন বন্ধু আরেক বন্ধুর গালে চড়-থাপ্পর মারতেই পারে।
ও আচ্ছা টমিওর কথা বলা হয় নি। অমিয়র ভাই টমিও মায়ের পেটে। তার এখনো জন্ম হয় নি। সে মায়ের পেটে করে বেড়াতে যাচ্ছে।
০৪. স্বাধীন খসরু। অভিনেতা।
সে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে না। কারণ সে আছে ইংল্যান্ডে। তার সঙ্গে কথা হয়েছে সে সরাসরি ইংল্যান্ড থেকে বেইজিং-এ চলে আসবে। সে অভিনয় শিখেছে লন্ডন স্কুল অব ড্রামা থেকে। যে স্কুল পৃথিবীর অনেক বড় বড় অভিনেতার জন্ম দিয়েছে। উদাহরণ-এলিজাবেথ টেলর, পিটার ও টুল…। সে ইংল্যান্ডের সব ছেড়ে-ছুঁড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে শুধুমাত্র অভিনয়ের আকর্ষণে। আমার সব নাটকেই তাকে দেখা যায়। সে নাম করেছে তারা তিনজন’-এর একজন হিসেবে। দেশের বাইরে তার জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। তাকে নিয়ে একবার আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে গিয়েছিলাম। বাঙালি সমাজ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আনন্দময় দৃশ্য। ছেলে হিসেবে সে অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ। অতি তুচ্ছ কারণে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে-এটি নিত্যদিনকার দৃশ্য। তার গত জন্মদিনে আমরা তাকে নরসিংদীর বিশাল এক গামছা উপহার দিয়েছি। উপহারপত্রে লেখা ‘পবিত্র অশ্রুজল মোছার জন্যে।
০৫. শাওন ও লীলাবতী।
শাওনকে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। তার প্রভাতেই সে দীপ্ত। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী পরিচয় অবশ্যই তার জন্যে সুখকর না। লীলাবতীর পরিচয় দেয়া প্রয়োজন। লীলাবতী তার গর্ভে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা কন্যা। গত পাঁচ মাস ধরে সে মায়ের পেটের অন্ধকারে বড় হচ্ছে। মা’র সঙ্গে সেও চীনে যাচ্ছে। তার ভ্রমণ অতি আনন্দময়। সে বাস করছে পৃথিবীর সবচে’ সুরক্ষিত ঘরে। সে ঘর অন্ধকার হলেও মায়ের ভালোবাসায় আলোকিত।
ভ্রমণ বিষয়ে শাওনের উৎসাহ সীমাহীন। যেখানে ঘরের বাইরে পা ফেলতে পারলেই সে খুশি, সেখানে সে যাচ্ছে চীনে! মিং ডায়ানেষ্টিক সভ্যতা দেখবে, চীনের প্রাচীর দেখবে।
দেশের ভেতর সে আমাকে নিয়ে ঘুরতে পারে না। প্রধান কারণ দোকানে দোকানে জিনিসপত্র দেখে বেড়ানো আমার স্বভাব না। রেস্টুরেন্টে রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া আমার অপছন্দ। তারপরে ও কোথাও কোথাও যাওয়া হয়। লোকজন তখন যে তার দিকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকায় তা-না। লোকজনের দৃষ্টিতে থাকে-হুমায়ূন আহমেদ নামক ভালো মানুষ লেখককে কুহক মায়ায় তুমি মুগ্ধ করেছ। তুমি কুহকিনী!
দেশের বাইরে তার সেই সমস্যা নেই। আমাকে পাশে নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে কেউ সেই বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাবে না। দু’একজন হয়তো ভাববে-বাচ্চা একটা মেয়ে বুড়োটার সঙ্গে বসে আছে কেন? এর বেশি কিছু না। এ ধরনের দৃষ্টিতে শাওনের কিছু যায় আসে না।
দেশের বাইরে শাওনের ঝলমলে আনন্দময় মুখ দেখতে আমার ভালো লাগে। তবে মাঝেমধ্যে একটা বিষয় চিন্তা করে বুকের মধ্যে ধাক্কার মতো লাগে। আমি ষাট বছরের বুড়ি ধরতে যাচ্ছি। চলে যাবরি ঘন্টা বেজে গেছে। আমার মৃত্যুর পরেও এই মেয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। সে কি একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবে? না-কি আনন্দময় অন্য কোনো পুরুষ আসবে তার পাশে। সে কোনো এক রেস্টুরেন্টে মাথা দুলিয়ে হেসে হেসে গল্প করবে তার সঙ্গে-এই কী হয়েছে। শোন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন না….’
০৬ পুত্র নুহাশ।
না না, সে আমাদের সঙ্গী না। শাওন যেখানে আছে সেখানে সে যাবে কিংবা তাকে যেতে দেয়া হবে তা হয় না।
নুহাশকে আমার সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ দেখা করতে দেয়া হয়। তবে আমার ঘরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয় না। সে আসে, গ্যারেজে দাঁড়িয়ে মোবাইলে এসএমএস করে জানায় বাবা আমি এসেছি। আমি নিচে নেমে যাই। গাড়িতে কিছুক্ষণ এলোমেলোভাবে ঘুরি। মাঝ মধ্যে মাথায় হাত রাখি। সে লজ্জা পায় বলেই চট করে হাত সরিয়ে নেই। তাকে বাসায় নামিয়ে মন খারাপ করে ফিরে আসি।
যে পুত্র সঙ্গে যাচ্ছে না তার নাম সফরসঙ্গী হিসেবে কেন লিখলাম? এই কাজটা লেখকরা পারেন। কল্পনায় অনেক সঙ্গী তারা সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে পারেন।
দীর্ঘ চীন ভ্রমণে অদৃশ্য মানব হয়ে আমার পুত্র আমার সঙ্গে ছিল। একবার ফরবিডেন সিটিতে প্রবল তুষারপাতের মধ্যে পড়লাম। কমল কমলের মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, মাজহার তার ছেলেকে নিয়ে। আমি শাওনকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। তার পেটে লীলাবতী। পা পিছলে পড়লে বিরাট সমস্যা। হঠাৎ দেখি একটু দূর দিয়ে মাথা নিচু করে নুহাশ হাঁটছে। তার মুখ বিষণ। চোখ আর্দ্র। আমি বললাম, বাবা, আমার হাত ধর। আমার দায়িত্ব শাওনকে হাত ধরে ঠিকমতো নিয়ে যাওয়া। তোমার দায়িত্ব আমাকে ঠিকমতো নিয়ে যাওয়া। সে এসে আমার হাত ধরল।
কল্পনার নুহাশ বলেই করল। লেখকরা তাদের কল্পনার চরিত্রদের নিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেন। লেখক হবার মজা এইখানেই।
প্রথম রজনী…
ঢাকা থেকে হংকং। হংকং থেকে বেইজিং।
প্লেন থেকে নামলাম। এয়ারপোর্টের টার্মিনাল থেকে বের হলাম, একসঙ্গে সবার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। মেয়েদের চুল বলেই খাড়া হলো না, তবে ফুলে গেল। কারণ সহজ। তাপমাত্রা শূন্যের সাত ডিগ্রি নিচে। হাওয়া বইছে। টেম্পারেচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিল ফ্যাক্টর। চিল ফ্যাক্টরের কারণে তাপমাত্রা শূন্যের আঠারো-উনিশ ডিগ্রি নিচের চলে যাবার কথা। এই হিসাব কেমন করে করা হয় আগে জানতাম। এখন ভুলে গেছি।
কমল বলল, হুমায়ূন ভাই, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আছে।
আমি বললাম, হুঁ।
শুধু মেয়েরা খুশি। বেড়াতে বের হলে সব কিছুতেই তারা আনন্দ পায়। বড়ই আহ্লাদী হয়।
শাওন বলল, ঠাণ্ডাটা যা মজা লাগছে।
বাকিরাও তার সঙ্গে গলা মেলাল। তাদেরও নাকি মজা লাগছে। তারা সিগারেট খেলা শুরু করল। সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গি করে ধোঁয়া ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাসের জলীয় বাষ্প জমে যায়। মনে হয়, বুনকা বুকা ধোঁয়া।
বাচ্চারা সবার আগে কাহিল হলো। কারোর হাত-মোজা নেই। ঠাণ্ডয় হাত শক্ত হয়ে গেল। তারা শুরু করল কান্না। কে তাকায় বাচ্চাদের দিকে বাচ্চাদের মায়েদের ঠাণ্ডা নিয়ে আহ্লাদী তখনো শেষ হয় নি।
বাংলাদেশ আম্বেসির ফাস্ট সেক্রেটারি অ্যাম্বেসির গাড়ি নিয়ে এসেছেন। তার নাম মনিরুল হক। তিনি আমাদের হয়ে হোটেল বুকিংও দিয়ে রেখেছেন। তাঁর দায়িত্ব আমাদেরকে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। এক গাড়িতে হবে না। আরো কয়েকটা গাড়ি লাগবে। তিনি ব্যস্ত হয়ে চলে গেছেন গাড়ির সন্ধানে। আমরা দুর্দান্ত শীতে থরথর করে কাঁপছি।
অ্যাম্বেসির বিষয়টা বলি। একজন লেখক বুন্ধুবান্ধব নিয়ে বেড়াতে যাবে, তার জন্যে অ্যাম্বেসি গাড়ি পাঠাবে বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি এই জিনিস না। লেখক কবি সাহিত্যিক-পেইন্টার তাদের কাছে কোনো বিষয় না। প্রবাসে যেসব বাংলাদেশী বাস করেন, তারাও তাদের কাছে কোনো বিষয় না। অ্যাম্বেসি দেখে বেড়াতে আসা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের, আমলাদের। সেইসব মহামানবরা অ্যাম্বেসির গাড়ি নিয়ে শপিং করেন। অ্যাম্বেসির কর্মকর্তারা বাজারসদাই-এ সহায়তা করেন।
পৃথিবীর বাকি দেশগুলির অ্যাম্বেসির অনেক কর্মকাত্রে প্রধান কর্মকাণ্ড, তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। এত সময় বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির কর্মকর্তাদের নেই। তাদেরকে নানান স্টেট ফাংশনে ডিনার খেতে হয়। অনেকগুলি পত্রিকা পড়তে হয় (দেশে কী হচ্ছে জানার জন্যে। সময়ের বড়ই অভাব।
আমি কখনো দেশের বাইরে গেলে অ্যাম্বেসির সঙ্গে যোগযোগ করে যাই না। আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। বেইজিং-এ অ্যাম্বেসিকে আগেভাগে জানানোর কাজটি করেছে মাজহার। যে লোক অ্যাম্বেসি থেকে এসেছেন তিনি যে অ্যাম্বাসেডর কর্তৃক নির্দেশ পেয়ে এসেছেন তাও না। তিনি এসেছেন, নিজের আগ্রহে এবং আনন্দে। তিনি লেখক হুমায়ূন আহমেদের অনেক বই পড়েছেন, অনেক নাটক দেখেছেন। লেখককে সামনাসামনি দেখার ইচ্ছাই তার মধ্যে কাজ করেছে।
এই সৌভাগ্য আমার প্রায়ই হয়। অ্যাম্বেসিতে সিরিয়াস কিছু ভক্ত পাওয়া যায়। তারা যে আগ্রহ দেখায় তার জন্যে ও সমস্যায় পড়তে হয়। ১৯৯৬ সালে বিশাল এক দল নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডুতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। অ্যাম্বেসিতে মোটামুটি হুলস্থুল পড়ে গেল। অ্যাম্বেসিতে তিনটি ডিনার দিল। কাঠমাণ্ডুর লেখক শিল্পীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ব্যবস্থা করল। আমি বিব্রত (এবং খানিকটা আনন্দিতও)। সমস্যা দেখা দিল তারপর যখন বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি আমার এবং আমার দলের পেছনে বিরাট অঙ্কের খরচ দেখাল। খরচের হিসাব চলে গেল জাতীয় সংসদে। শাওনের মা, বেগম তহুরা আলি তখন সংসদ সদস্য। তাঁর কাছেই সংসদের আলোচনার কথা শুনলাম। খুবই লজ্জা পেলাম।
কাজেই আমি অ্যাম্বেসির তরুণ সুদর্শন হাস্যমুখি ফার্স্ট সেক্রেটারিকে শক্তভাবে বললাম, আপনি যে কষ্ট করেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ। তবে আপনার কাছ থেকে আর কোনো সাহায্য-সহযোগিতা আমি নেব না। আপনাদের কারো বাড়িতে ডিনার খাব না, অ্যাম্বাসেডর সাহেবের সঙ্গে দেখা করব না।
মনিরুল হক অতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আপনি যা বলবেন তাই।
মনিরুল হক তাঁর কথা রাখেন নি। তিনি তাঁর বাড়িতে বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আমাদের অ্যাম্বাসেডরও উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, পৃথিবীর সংস্কৃতি চর্চা, ধর্ম নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ (এবং শিক্ষনীয়) বিষয়ে আলোচনা করলেন। এই আলোচনায় আমার সফরসঙ্গীরা উপকৃত হয়েছে বলে মনে হয়। কারণ তারা গভীর আগ্রহে আলোচনা শুনল।
দেশে ফেরার সময় মনিরুল হক সাহেব কাঁচুমাচু হয়ে একটা প্রস্তাব দিলেন। অ্যাম্বাসেডর সাহেব ফরেন সেক্রেটারির জন্য উপহার হিসেবে একটা গলফ সেট পাঠাবেন। গলফ সেটটা অত্যন্ত দামি বিধায় লাগেজে দেয়া যাচ্ছে না। হাতে করে নিয়ে যেতে হবে। আমরা কি নিয়ে যাব? একবার ঢাকায় পৌঁছলে আমাদের আর কিছুই করতে হবে না। সেক্রেটারি সাহেব লোক পাঠিয়ে নিয়ে যাবেন।
আমি গলফ সেট কাঁধে করে নিয়ে যেতে খুবই রাজি ছিলাম। আমার সফরসঙ্গীরা বাদ সাধল। তারা মনে করল, এতে লেখক হুমায়ূন আহমেদের সম্মানহানি হবে। গলফ সেট নেয়া হলো না।
আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের কাছে এতদিনে নিশ্চয়ই গলফ সেট পৌঁছে গেছে। আশা করি, গলফে তার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আমরা মন্ত্রী, সচিব এবং এ্যাম্বাসেডরদের সর্ব বিষয়ে উন্নতি কামনা করি।
বেইজিং-এ আমাদের জন্যে যে হোটেল ঠিক করা ছিল, তার নাম Gloria Plaza. চমঙ্কার হোটেল। সামনেই ক্রিসমাস, এই উপলক্ষে সুন্দর করে সাজানো। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ভেতরে চমৎকার উষ্ণতা। ডেস্কের চায়নিজ মেয়েরা সুন্দর ইংরেজি বলছে। ব্যবহার আন্তরিক। এক যুগ আগের দেখা চীন এবং বর্তমানের আধুনিক চীনের কোনো মিল নেই।
আমাদের হোটেলে দাখিল করে মনিরুল হক সাহেব কয়েকটা টিপস দিলেন। প্রথম টিপস, কেনাকাটা করতে গেলেই দামাদামি করতে হবে। এখানকার দোকানপাট ইউরোপ-আমেরিকার মতো না-যে দাম লেখা থাকবে সেই দামেই সোনামুখ করে কিনতে হবে। চায়নিজ দোকানিরা জিনিসপত্রের গায়ে আকাশছোঁয়া দাম লিখে রাখে, কাজেই শুরু করতে হবে পাতাল থেকে। যে বস্তুর গায়ে লেখা পাঁচশ’ ইয়েন, তার দাম বলতে হবে পাঁচ ইয়েন। কিছুক্ষণ দরদাম করার পর দশ ইয়েনে ঐ বস্তু পেয়ে যাওয়ার কথা।
মেয়েরা আসন্ন দরদামের কথা ভেবে আনন্দে অধীর হয়ে গেল। এই কাজটি মেয়েরা কেন জানি না খুবই আগ্রহের সঙ্গে করে। চারঘন্টা সময় নষ্ট করে তারা একশ’ টাকার জিনিস ৯৫ টাকায় কিনে এমন ভাব করবে যেন তারা চেঙ্গিস খান, এইমাত্র এক রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছে। চারঘন্টা তাদের কাছে কোনো বিষয় না, পাঁচ টাকা বিষয়।
আমি নিজে নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারে এক অতি বিত্তবান তরুণীকে পেঁপের দাম দু’টাকা কমানোর জন্যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট দরদাম করতে দেখেছি। বিত্তবান তরুণীরা পরিচয় দিলে আপনারা কেউ কেউ চিনতেও পারেন। তার নাম মেহের আফরোজ শাওন। তিনি ফিল্মে অভিনয় করেন এবং গান করেন।
মনিরুল হক সাহেবের দ্বিতীয় টিপস হলো-এখানে সবকিছুর দু’টা নাম। একটা ইংরেজি নাম, একটা চায়নিজ নাম। হোটেল Glonia Plaza র একটা চায়নিজ নাম আছে। চায়নিজ নাম জানা না থাকলে মহাবিপদ। কোনো ট্যাক্সি ড্রাইভারই ইংরেজি নাম জানে না। মনিরুল হক সাহেবের এই উপদেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা না করায় আমি যে বিপদে পড়েছিলাম যথাসময়ে তা বর্ণনা করা হবে।
হোটলের রুমগুলি সবার পছন্দ হলো। শুধু মাজহারের হলো না। তার ধারণা, তার নিজের রুম ছাড়া বাকি সবগুলো ভালো।
অনেক ঝামেলা করে সে তার রুম পাল্টালো। রাতে সবাইকে নিয়ে খেতে যাব, তখন শুনি বর্তমান রুমটাও মাজহার বদলাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। কারণ এই রুমের সবই ভালো, শুধু কমোড়ের ঢাকনিটায় কালো কালো দাগ।
রাত এগারোটায় দ্বিতীয় দফা রুম বদলানোর পর আমরা খাদ্যের সন্ধানে বের হলাম। কাছেই ম্যাকডোনাল্ড। বার্গার খাওয়া হবে। মেয়েদের মধ্যে আবারো আনন্দের ঝড় বয়ে গেল। আচ্ছা, মেয়েরা সবসময় জাংক বস্তু পছন্দ করে কেন? জাংক ফুড, জাংক স্বামী। একজন ভালোমানুষ স্বামীকে মেয়েরা যত পছন্দ করে, তারচেয়ে দশগুণ বেশি পছন্দ করে জাংক স্বামী। এই জন্যেই কি নারী চরিত্র ‘দেবো না জানন্তি, কুত্রাপি মনুষ্যা?
শুকনা বার্গার চিবুতে চিবুতে দুঃসংবাদ শুনলাম। হোটেল গ্লোরিয়া প্রাজার নাশতা বিষয়ক দুঃসংবাদ। প্রতি রুমের একজন ফ্রি নাশতা খাবে। অন্যজনকে কিনে খেতে হবে। আমি বলতে গেলে পৃথিবীর সব দেখেই গেছি-এমন অদ্ভুত নিয়ম দেখি নি এবং কারো কাছে থেকে শুনিও নি।
রাতেই দলগতভাবে সিদ্ধান্ত হলো, সকালবেলা প্রতি রুমের স্বামী বেচারা নাশতা খেতে যাবে, তার দায়িত্ব হবে স্ত্রীর নাশতা লুকিয়ে নিয়ে আসা। সেদ্ধ ডিম, রুটি, মাখন, কলা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা কোনো ব্যাপারই না। পরের দিন স্ত্রীদের পালা, তারা স্বামীদের নাশতা নিয়ে আসবে। দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ চুরি চুরি খেলার কথা ভেবে আনন্দে সবাই আত্মহারা। আমি ক্ষীণ স্বরে আপত্তি করতে গিয়ে ধমক খেলাম। ব্যাপারটায় নাকি প্রচুর ফান আছে। আমি মাথামোটা বলে ফানটা ধরতে পারছি না। খাবার চুরি এবং বই চুরিতে পাপ নেই-এইসবও শুনতে হলো।
পাঠক শুনে বিস্মিত হবেন পুরুষদের কেউ কোনো চুরি করতে পারে নি। পুরুষদের একজন শুধু একটা কমলা পকেটে নিয়ে ফিরেছে।
দ্বিতীয় দিন ছিল মহিলাদের পালা। তারা যে পরিমাণ খাবার চুরি করেছে তা দিয়ে বাকি সবাই এক সপ্তাহ নাশতা খেতে পারে। মনস্তত্ত্ববিদ এবং সমাজ বিজ্ঞানীরা এই ঘটনা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে কি উপনীত হতে পারেন?
নিষিদ্ধ নগরে তুষার ঝড় নিষিদ্ধ পল্লীর কথা আমরা জানি। নিষিদ্ধ পল্লী–Red Light Area, যেখানে নিশিকন্যারা থাকেন। নগরের আনন্দপ্রেমীরা গোপনে ভীড় করেন। নিষিদ্ধ নগরী কী? নিষিদ্ধ নগরী হলো–Forbidden City, চায়নিজ ভাষায় ও গং (GuGong). বেইজিং-এর ঠিক মাঝখানে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা মিং এবং জিং (ging) সম্রাটদের প্রাসাদ। বিশাল এক নগর। প্রজারা কখনো কোনোদিনও এই নগরে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনই কঠিন নিয়ম। এই নগর প্রজাদের জন্যে নিষিদ্ধ বলেই নগরীর নাম ‘নিষিদ্ধ নগরী’।
নগরীতে প্রাসাদ সংখ্যা কত? আট শ’। প্রসাদে ঘরের সংখ্যা আট হাজারের বেশি।
এই নগরীর নির্মাণ শুরু হয় ১৪০৬ সনে। দুই লক্ষ শ্রমিক ১৪ বৎসর অমানুষিক পরিশ্রম করে নির্মাণ শেষ করে। এই নগরীর কঠিন পাঁচিল এমন করে বানানো হয় যেন কামানের গোলা কিছুই করতে না পারে। সম্রাটরা ধরেই নিয়েছিলেন, তাদের কঠিন দেয়াল ভেঙে কেউ কোনোদিন ঢুকতে পারবে না। হায়রে নিয়তি! ব্রিটিশ সৈন্যরা ১৮৬০ সনে নিষিদ্ধ নগরী দখল করে নেয়। হতভম্ব সম্রাট শুধু তাকিয়ে থাকেন।
নিষিদ্ধ নগরীর শেষ সম্রাটের নাম পুই (Pu Yi), ১৯১২ সনে তাকে সিংহাসন ছাড়তে হয়। শেষ হয় নিষিদ্ধ নগরীর কাল। শেষ সম্রাটকে নিয়ে যে ছবিটি বানানো হয়, The Last Emperor, সেটা হয়তো অনেকেই দেখেছেন। না দেখে থাকলে দেখতে বলব, কারণ ছবিটি চীন সরকারের অনুমতি নিয়ে নিষিদ্ধ নগরীর ভেতরেই শুট করা হয়। প্রথম নিষিদ্ধ নগরীর ভেতর ৩৫ মিমি ক্যামেরা ঢোকে।
রাজা-বাদশাদের বিলাসী জীবন কেমন ছিল তা দেখার আগ্রহ আমি কখনো বোধ করি নি। সব বিলাসের একই চিত্র। সোনা, রুপা, মণি মাণিক্য। হাজার হাজার রক্ষিতা। পান এবং ভোজন। এই বাইরে কী?
কারো গান-বাজনার শখ থাকে, কেউবা ছবি আঁকেন, এইখানেই শেষ। সম্রাটদের সমস্ত মেধার সমাপ্তি নারী এবং সুরায়।
প্রথমবার নিষিদ্ধ নগরীতে ঢুকে এমন মন খারাপ হয়েছিল! মনে হচ্ছিল, চীনের হতদরিদ্র মানুষদের দীর্ঘনিঃশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে আছে। রক্ষিতারা যেখানে থাকত সেখানে গেলাম। একসঙ্গে তিন হাজার রক্ষিতার থাকার ব্যবস্থা। প্রত্যেকের জন্যে পায়রার খুপরির মতো খুপরিঘর। কী বীভৎস তাদের জীবন! ইচ্ছে হলে কোনো একদিন কিছুক্ষণের জন্যে এদের একজনকে সম্রাট ডেকে নেবেন। কিংবা নেবেন না। উপহার হিসেবে পাঠাবেন ভিনদেশের রাজা মহারাজাদের কাছে।
মোঘল সম্রাটরা বেশ কয়েকবার চীন সম্রাটদের কাছ থেকে রূপবতী চৈনিক মেয়ে উপহার পেয়েছেন।
এইসব রূপবতীদের সংগ্রহ করত রাজপুরুষরা। কোনো এক চাষির ঘরে ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। মেয়ে বড় হয়েছে। বাবা-মাকে ছেড়ে তাকে চিরদিনের জন্যে চলে যেতে হচ্ছে নিষিদ্ধ নগরীর উঁচু পাঁচিলের ভেতর।
সেবারে সম্রাটদের সুরাপাত্র এবং পিকদান দেখেছিলাম। সুরাপাত্র স্বর্ণের থাকবে এটা ধরে নেয়া যায়-থুথু ফেলার সব পাত্রও সোনার হতে হবে? মণি মাণিক্য খচিত হতে হবে? ম্রাটের থুথু এতই মূল্যবান?
যাই হোক, ভ্রমণ প্রসঙ্গে যাই। আমি দলবল নিয়ে নিষিদ্ধ নগরীতে ঢুকলাম। ছোট্ট বক্তৃতা দিলাম অনেক মিউজিয়াম আছে। তোমরা দেখতে পার। দেখার কিছু নেই। কোন সোনার পাত্রে রাজা থুথু ফেলতেন, কোন হীরা মণি মাণিক্যের টাট্টিখানায় হাগু করতেন তা দেখে কী হবে? তাছাড়া খুব বেশি জিনিসপত্র এখানে নেই।
অনেক কিছু লুট করে নিয়ে গেছে ব্রিটিশরা। তারা ব্রিটিশ মিউজিয়াম সাজিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় লুট করা হয়েছে (১৯৪৭) চিয়াং কাইশেকের নির্দেশে। তিনি সব নিয়ে গেছেন তাইওয়ানে। সেখানকার ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়ামের বেশির ভাগ জিনিসপত্রই নিষিদ্ধ নগরীর।
সম্রাটদের প্রাসাদ দেখেও কেউ কোনো মজা পাবে না। সব একরকম। কোনো বৈচিত্র্য নেই। দোচালা ঘরের মতো ঘর। একটার পর একটা। ঢেউয়ের মতো।
আমার নেগেটিভ কথা সফরসঙ্গীদের উপর বিন্দুমাত্র ছাপ ফেলল না। তারা সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, একী! কী দেখছি! এত বিশাল! এত সুন্দর! এটা না দেখলে জীবন বৃথা হতো।
পরম করুণাময় আমার সফরসঙ্গীদের উচ্ছ্বাস হয়তো পছন্দ করলেন না। তিনি ঠিক করলেন তাঁর তৈরি সৌন্দর্য দেখাবেন। হঠাৎ শুরু হলো তুষারপাত। ধবধবে শাদা তুষার ঝিলমিল করতে করতে নামছে। যেন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোছনার ফুল। যেন চাঁদের আলো ভেঙে ভেঙে নেমে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো নিষিদ্ধ নগর বরফের চাদরে ঢেকে গেল। আমি তাকিয়ে দেখি, চ্যালেঞ্জার এবং চ্যালেঞ্জার পত্নী কাঁদছে। আমি বললাম, কাঁদছ কেন?
চ্যালেঞ্জার বলল, বাচ্চা দুটাকে রেখে এসেছি এত সুন্দর দৃশ্য তারা দেখতে পারল না, এই দুঃখে কাদছি। স্যার, আমি এই দৃশ্য আর দেখব না। হোটেলে ফিরে যাব।
শাওন মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল। আমি বললাম, ক্যামেরাটা দাও, ছবি তুলে দেই। সে বলল, এই দৃশ্যের ছবি আমি তুলব না। ক্যামেরায় কোনোদিন এই দৃশ্য ধরা যাবে না।
অবাক হয়ে দেখি তার চোখেও পানি। সে আমাকে চাপা গলায় বলল, এমন অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য তোমার কারণে দেখতে পেলাম। আমি সারাজীবন এটা মনে রাখব।
মেয়েরা আবেগতাড়িত হয়ে অনেক ভুল কথা বলে। আমার কারণে যে-সব খারাপ অবস্থায় সে পড়েছে সেসবই তার মনে থাকবে, সুখস্মৃতি থাকবে না। মেয়েরা কোনো এক জটিল কারণে দুঃখস্মৃতি লালন করতে ভালোবাসে।
অন্য সফরসঙ্গীদের কথা বলি। মাজহার তুষারপাতের ছবি নানান ভঙ্গিমায় তুলতে গিয়ে পিচ্ছিল বরফে আছাড় খেয়ে পড়েছে। তার দামি ক্যামেরার এইখানেই ইতি। কমলের কাছে মাজহার হলো গুরুদেব। গুরুদেব আছাড় খেয়েছেন, সে এখনো খায় নি-এটা কেমন কথা! গুরুদেবের অসম্মান। কমল তার মেয়ে আরিয়ানানসই গুরুদেবের সামনেই ইচ্ছা করে আছাড় খেয়ে লম্বা হয়ে পড়ে রইল।
চীন ভ্রমণ শেষে সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সবচে’ আনন্দ পেয়েছে কী দেখে? গ্রেটওয়াল? ফরবিডেন সিটি, টেম্পেল অব হেভেন, সামার প্যালেস?
সবাই বলল, নিষিদ্ধ নগরে তুষারপাত।
তুষার সন্ধ্যা নিয়ে লেখা রবার্ট ফ্রস্টের প্রিয় কবিতাটি মনে পড়ে গেল।
STOPPING BY WOODS ON A SNOWY EVENING
Whose woods these are I think I know.
His house is in the village though;
He will not see me stopping here
To watch his woods fill up with snow.
My little horse must think it queer
To stop without a farmhouse near
Between the woods and frozen lake
the darkest evening of the year.
He gives his hamess bells a shake
To ask if there is some mistake.
The only other sound’s the sweep
Of easy wind and downy flake.
The Woods are lovely, dark and deep.
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.
.
দীর্ঘতম কবরখানা
পৃথিবীর দীর্ঘতম কবরখানার দৈর্ঘ্য কত? পনেরশ মাইল। আরো লম্বা ছিল তিনহাজার নয়শ’ চুরাশি মাইল। বর্তমানে অবশিষ্ট আছে পনেরশ’ মাইল। চায়নার বিখ্যাত গ্রেটওয়ালের কথা বলছি। এই অর্থহীন দেয়াল তৈরি করতে এক লক্ষের উপর শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে। দেয়াল বলে কবরখানা বলাই কি যুক্তিযুক্ত না।
অর্থহীন দেয়াল বলছি, কারণ যে উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল, মোঙ্গলদের হাত থেকে সাম্রাজ্য রক্ষা, সে উদ্দেশ্য সফল হয় নি। মোঙ্গলরা এবং মাঞ্চুরিয়ার দুর্ধর্ষ গোত্র বারবারই দেয়াল অতিক্রম করেছে।
গ্রেটওয়াল বিষয়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছি। পবিত্র কোরআন শরীফের একটি সূরা আছে-সূরা কাহাফ। কাহাফের ভাষ্য অনুযায়ী অনেকে মনে করেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই প্রাচীর নির্মাণ করেন।
ওরা বলল, ‘হে জুলকারনাইন। ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা এই শর্তে কর দেব যে, তুমি আমাদের এই ওদের মধ্যে এক প্রাচীর গড়ে দেবে।’ (১৮:৯৪)
জুলকারনাইন স্থানীয় অধিবাসীদের শ্রমেই প্রাচীর তৈরি করে দেন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট যে আমাদের নবীদের একজন, এই তথ্য কি পাঠকরা জানেন? জুলকারনাইন হলেন আলেকজান্ডার দা গ্রেট।
চীনের ইতিহাস বলে মোট পাঁচ দফায় প্রাচীর তৈরি হয়। প্রথম শুরু হয় জিন ডায়ানেস্টির আমলে (Qin Dynasty), যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ২০৮ বছর আগে। বর্তমানে যে প্রাচীর আছে তা তৈরি হয় সম্রাট হংথু (মিং ডায়ানেস্টি, ১৩৬৮ সন)–এর শাসনকালে। শেষ করেন সম্রাট ওয়ানলি (মিং ডায়ানেস্টি, ১৬৪০)।
প্রাচীরের গড় উচ্চতা ২৫ ফিট। তিন লক্ষ শ্রমিকের তিনশ বছরের অর্থহীন শ্ৰম। কোনো মানে হয়? কোনো মানে হয় না। মানব সম্পদের এই অপচয় সম্রাটরাই করতে পারেন। রাজা-বাদশাদের কাছে সাধারণ মানুষের জীবন সব সময়ই মূল্যহীন ছিল।
আমরা আজ যাব দীর্ঘতম কবরখানা দেখতে। চীনের পরিচয় চীনের দেয়াল। সেই দেয়াল দেখা সহজ বিষয় না। আমার সফরসঙ্গীদের আনন্দ উত্তেজনায় টগবগ করার কথা। তারা কেমন যেন ঝিমিয়ে আছে। গা ছাড়া ভাব। কারণটা ধরতে পারলাম না।
এক পর্যায়ে মাজহর কাঁচুমাচু হয়ে বলল, গ্রেটওয়াল দেখার প্রোগ্রামটা আরেকদিন করলে কেমন হয়!
আমি বললাম, আজ অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নেই। গতকাল ফরবিডেন সিটি দেখে সবাই টায়ার্ড। আজকে বিশ্রাম করতে পারলে ভালো হতো। মেয়েরা বিশেষ করে কাহিল হয়ে পড়েছে। নড়াচড়াই করতে পারছে না।
আমি বললাম, মেয়েরা যেহেতু ক্লান্ত তারা অবশ্যই বিশ্রাম করবে। গ্রেটওয়াল পালিয়ে যাচ্ছে না।
মাজহারের মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। একই সঙ্গে মেয়েদের মুখেও হাসি। একজন বলে ফেলল, দেরি করে লাভ নেই, চল রওনা দেই।
আমি বললাম, তোমাদের না রেস্ট নেবার কথা, যাচ্ছ কোথায়?
মেয়েদের মুখপাত্র হিসেবে মাজহার বলল, সিল্ক মার্কেটে টুকটাক মার্কেটিং করবে। মেয়েদের মার্কেটিং মানেই বিশ্রাম।
মেয়েরা বিপুল উৎসাহে বিশ্রাম করতে বের হলো। দুপুর দু’টা পর্যন্ত এই দোকান থেকে সেই দোকান, দোতলা থেকে সাততলা, সাততলা থেকে তিনতলা, তিনতলা থেকে আবার ছয়তলা করে বিশ্রাম করল। প্রত্যেকের হাতভর্তি নানান সাইজের ব্যাগ। দুপুরে দশ মিনিটের মধ্যে লাঞ্চ শেষ করে আবার বিশ্রামপর্ব শুরু হলো।
সিল্ক মার্কেটের যত আবর্জনা আছে, তার বেশির ভাগ আমরা কিনে ফেললাম। মেয়েরা দরদাম করতে পারছে এতেই খুশি। কী কিনছে এটা জরুরি না। আমি একবার ক্ষীণ স্বরে বললাম, যা কিনছ সবই ঢাকায় পাওয়া যায়। সবাই আমার কথা শুনে এমনভাবে তাকাল যেন এত অদ্ভুত কথা কখনো তারা শোনেনি।
আমি ক্লান্ত, এবং হতাশ। রাত দশটার আগে কারো বিশ্রাম শেষ হবে এমন মনে হলো না। বিশ্রামপর্ব দশটায় শেষ হবে, কারণ সিল্ক রোড বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ মেয়েদের কেনাকাটা দেখলাম। এর মধ্যে এরা কিছু চায়নিজও শিখে নিয়েছে। দোকানি বলছে, ইয়ি বাই। আরা লছে, উয়ু। জিজ্ঞেস করে জানলাম ‘ইয়ি বাই’ হলো একশ’, আর ‘উয়ু হলো পাচ। মেয়েদের বিদেশী ভাষা শেখার ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়ে নিজের মনে কিছুক্ষণ ঘুরলাম। একদিকে শিল্পীদের মেলা বসেছে। একজন হাতের বুড়ো আঙুলে চায়নিজ ইংক লাগিয়ে নিমিষের মধ্যে অতি অপূর্ব ছবি বানাচ্ছেন। আমার আগ্রহ দেখে তিনি আমার আঙুলে কালি লাগিয়ে কাগজ এগিয়ে দিলেন। আমি অনেক চেষ্টা করেও কিছু দাঁড়া করতে পারলাম না। শিল্পী যেমন আছে ভাস্কর ও আছে। সিল্ক মার্কেটের এক কোনায় দেখি এক চাইনিজ বুড়ো একদলা মাটি নিয়ে বসে আছে। দুশ’ ইয়েনের বিনিময়ে সে মাটি দিয়ে অবিকল মূর্তি বানিয়ে দেবে। তার সামনে বিশ মিনিট বসলেই হবে। বিশ মিনিট বসে বিশ্রাম নেবার সুযোগ পাওয়া যাবে ভেবেই বসলাম। একজন ভাস্কর কীভাবে কাজ করে তা দেখার আগ্রহ তো আছেই।
বৃদ্ধ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমাকে দেখে অতিদ্রুত মাটি ছানতে শুরু করল। কুড়ি মিনিটের জায়গায় আধঘন্টা পার হলো। মূর্তি তৈরি। আমি বললাম, কিছু মনে করো না, মূর্তিটা আমার না। চায়নিজ কোনো মানুষের।
মূর্তির চোখ পুতি পুতি। নাক দাবানো।
বুড়ো বলল, তোমার চেহারা তো পুরোপুরি চায়নিজদের মতো।
আমি বললাম, তাই না–কি?
বুড়ো বলল, অবশ্যই।
আশেপাশের সবাই বুড়োকে সমর্থন করল। আমিও নিশ্চিত হলাম আমার চেহাৱা চৈনিক। ইতিমধ্যে শাওন চলে এসেছে। তার কাছে ইয়েন যা ছিল সব শেষ। আমাকে যেতে হবে ডলার ভাঙাতে। সে বলল, তুমি চায়নিজ এক বুড়োর মূর্তি হাতে নিয়ে বসে আছে কেন?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, চায়নিজ বুড়ো তোমাকে কে বলল? এটা আমার নিজের ভাস্কর্য। উনি বানিয়েছেন। উনি একজন বিখ্যাত ভাস্কর।
কত নিয়েছে?
দুশ’ ইয়েন।
আমাকে ডাকলে না কেন? আমি পঁচিশ ইয়েনে ব্যবস্থা করতাম।
বলেই সে দেরি করল না, দরাদরি শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবাক হয়ে দেখি, আমাদের মহান ভাস্কর ত্রিশ ইয়েনে শাওনের মূর্তি বানাতে রাজি হয়েছেন।
শাওন বলল, তুমি ডলার ভাঙিয়ে নিয়ে এসো, ততক্ষণ উনি আমার একটা মূর্তি বানাবেন। আমার খানিকক্ষণ রেষ্টও হবে। পা ফুলে গেছে।
ডলার ভাঙিয়ে ফিরে এসে দেখি, মহান ভাস্কর চায়নিজ এক মেয়ের মূর্তি বানিয়ে বসে আছেন। শাওন খুশি। মূর্তির কারণে না। শাওন খুশি কারণ মহান ভাস্কর তার মোটা নাককে শাওনের অনুরোধে খাড়া করে দিয়েছেন। চেহারা চায়নিজ মেয়েদের মতো হলো না তো খাড়া হয়েছে।
আমরা হোটেলে ফিরলাম রাত আটটায়। কে কী কিনল সব ডিসপ্লে করা হলো। সবার ধারণা হলো তারা যা কিনেছে সেটা ভালো না। অন্যদেরটা ভালো। মাজহারের মুখ হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। একটু আসছি’ বলে সে বের হয়ে গেল। ফিরল রাত দশটায়। শাওন কিছু মুখোশ কিনেছে, যেগুলি সে কিনে নি। মাজহার গিয়েছিল ঐগুলি কিনতে।
আমি ঠাট্টা করছি না, সারাদিনের বিশ্রামের কারণে সব মেয়ের পা ফুলে গেল। তারা ঠিক করল ফুট ম্যাসাজ করাবে। হোটেলের কাছেই বিশাল ম্যাসাজ পার্লার।
ম্যাসাজের বিষয়টা এবার দেখছি। এক যুগ আগে ম্যাসাজ পার্লার চোখে পড়ে নি। আধুনিক চীনের অনেক রূপান্তরের এটি একটি। আমাদের হোটেল থেকে ম্যাগডোনাল্ড রেস্টুরেন্টের দূরত্ব দশ মিনিটের হাঁটা পথ। এরমধ্যে চারটা ম্যাসাজ পার্লার। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ম্যাসাজ পার্লারে মাসাজ নিচ্ছে চায়নিজরাই। কঠিন পরিশ্রমী চৈনিক জাতি গী টেপাটেপির ভক্ত হয়ে পড়েছে। মাও সে তুঙ-এর মাথায় নিশ্চয়ই এই জিনিস ছিল না।
রাস্তায় প্রসটিটিউটরাও নেমেছে। রূপবতী কন্যারা বিশেষ এক ধরনের কালে পোশাক পরে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘুরছে। কেউ তাদেরকে নিয়ে বিব্রত বা চিন্তিত না। এমন একজনের পাল্লায় আমি নিজেও একদিন পড়েছিলাম। ঘটনাটা বলি, বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির ফার্স্ট সেক্রেটারি আমাকে বইয়ের দোকানে নিয়ে যাচ্ছেন। দু’জন গল্প করতে করতে এগুচ্ছি, হঠাৎ কালো পোশাকের এক তরুণী এসে আমার হাত ধরল। আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। রূপবতী এক তরুণী। মায়া মায়া চেহারা। সে আদুরে গলায় বলল, আমাকে তুমি তোমার হোটেলে নিয়ে চল। আমি ম্যাসাজ দেব। বলেই চোখে কুৎসিত ইশারা করল। এমন নোংরা ইশারা চোখে করা যায় আমার জানা ছিল না। আমি হতভম্ব।
মনিরুল হক ধমক দিয়ে মেয়েটিকে সরিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, বর্তমান চীনে এই বিষয়টা খুব বেড়েছে। আমি বললাম, পুলিশ কিছু বলে না? মনিরুল হক বললেন, না।
পার্ল এস বাকের ‘গুড আর্থের চীন এবং বর্তমান চীন এক না। এই দেশ আরো অনেকদূর যাবে। ক্ষমতায় ও শক্তিতে পাল্লা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। মানুষ বদলাবে, মূল্যবোধ বদলাবে। ঘরের দরজা-জানালা খুলে দিলে আলো-হাওয়া যেমন ঢোকে-কিছু মশা-মাছিও ঢোকে। মহান চীন তার দরজা-জানালা খুলে দিয়েছে। আলো-হাওয়া এবং মশা-মাছি ঢুকছে।
মূল গল্পে ফিরে আসি। পরের দিন গ্রেটওয়াল দেখতে যাবার কথা, যাওয়া হলো না, কারণ সফরসঙ্গীরা যে যার মতো মার্কেটে চলে গেছে। সবাই বলে গেছে এক ঘন্টার মধ্যে ফিরবে। তারা ফিরল সন্ধ্যায়। প্রত্যেকের হাতভর্তি ব্যাগ। মুখে বিজয়ীর হাসি।
শেষ পর্যন্ত গ্রেটওয়াল দেখা হলো। সেও এক ইতিহাস। বাবস্থা করল এক টুর কোম্পানি। তারা গ্রেটওয়াল দেখাবে। ফাও হিসেবে আরো কিছু দেখাবে ফ্রি। জনপ্রতি ভাড়া একশ’ ডলার। সেখানেও দরাদরি। কী বিপদজনক দেশে এসে পৌঁছলাম! একেকবারে আমরা বলছি-”না, পোষাচ্ছে না।’ বলে চলে আসার উপক্রম করতেই তারা বলে, “একটু দাঁড়াও, ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে দেখি। তারা চ্যাও টু করে কিছুক্ষণ কথা বলে, তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘ম্যানেজমেন্ট আরো দু’ডলার করে কমাতে রাজি হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ১০০ ডলার ভাড়া কমিয়ে আমরা ত্রিশ ডলারে নিয়ে এলাম। বাচ্চাদের টিকিটি লাগবে না। তারা ফ্রি। ট্যুর কোম্পানির রূপবতী অপারেটর নিচু গলায় বলল, তোমাদের যে এত সস্তায় নিয়ে যাচ্ছি খবরদার এটা যেন অন্য টুরিস্টরা না জানে! জানলে কোম্পানি বিরাট বিপদে পড়ে যাবে।
টুর কোম্পানির বাসে উঠার পরে জানলাম, ট্যুরিস্টরা যাচ্ছে বিশ ডলার করে। একমাত্র আমরা ত্রিশ ডলার। অস্ট্রেলিয়ার এক গাধা সাহেব-মেম শুধু একশ’ ডলার করে টিকিট কেটেছে। অস্ট্রেলিয়ার সেই গাধা দম্পত্তির সঙ্গে আমরা ভালো খাতির হয়েছিল। আমরা একসঙ্গে চায়নিজ হার্বাল চিকিৎসা নিয়েছি, সেই প্রসঙ্গে পরে আসব।
কোম্পানির বাস সরাসরি আমাদের গ্রেটওয়ালে নিয়ে গেল না। জেড তৈরির এক কারখানায় এন ছেড়ে দিল। যদি আমরা জেডের তৈরি কিছু কিনতে চাই। টুর কোম্পানির সঙ্গে জেড কারখানার বন্দোবস্ত করা আছে। টুর কোম্পানি যাত্রীদের এনে এখানে ছেড়ে দেবে। কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য হবে। বিনিময় কমিশন।
পাঠকদের মধ্যে যারা আগ্রার তাজমহল দেখেছেন, তারা এই বিষয়টি জানেন। তাজমহল দর্শনার্থীরা সরাসরি তাজ দেখতে যেতে পারেন না। তাদেরকে মিনি তাজ বলে এক বস্তু প্রথমে দেখতে হয়। সেখানকার লোকজন সবাই কথাশিল্পী। তাদের কথার জালে মুগ্ধ হয়ে মিনি তাজ কিনতে হয়। সেই মিনি তাজ আজ পর্যন্ত কেউ অক্ষত অবস্থায় বাংলাদেশে আনতে পারেন নি। বর্ডার পার হবার আগেই অবধারিতভাবে সেই তাজ ভেঙে কয়েক টুকরা হবেই।
জেড এম্পোরিয়াম থেকে কেনাকাটা শেষ করে বাসে উঠলাম, ভাবলাম এইবার বোধহয় গ্রেটওয়াল দেখা হবে। ঘণ্টাখানিক চলার পর বাস থামল আরেক দোকানে। এটা না-কি সরকার নিয়ন্ত্রিত মুক্তার কারখানা। ঝিনুক চাষ করা হয়। ঝিনুক থেকে মুক্তা বের করে পালিশ করা হয়-নানান কর্মকাণ্ড।
একজন মুক্তা বিশেষজ্ঞ সব টুরিস্টকে একত্র করে মুক্তার উপর জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিলেন। মুক্তার প্রকারভেদ, ঔজ্জল্য, এইসব বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান দান করে তিনি ঘোষণা করলেন-এইবার আপনাদের সামনে আমি একটা ঝিনুক খুলব। আপনারা অনুমান করবেন ঝিনুকের ভেতর মুক্তার সংখ্যা কত। যার অনুমান সঠিক হবে তাকে আমাদের পক্ষ থেকে একটা মুক্ত উপহার দেয়া হবে। এইখানেই শেষ না, আপনাদের ভেতর যেসব মহিলা টুরিষ্ট আছেন তাদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা। সবচে’ রূপবতীকেও একটা মুক্তা উপহার দেয়া হবে।
মেয়েদের মধ্যে টেনশন এবং উত্তেজনা। মেকাপ ঠিক করা দরকার। সেই সুযোগ কি আছে?
চায়নিজ ভদ্রলোক (চেহারা অবিকল অভিনেতা ব্রুসলির মতো) বড় সাইজের একটা ঝিনুক তুলে আমাকেই প্রথম জিজ্ঞেস করলেন, বলে এর ভেতর কটা মুক্তা?
একটা ঝিনুকে একটাই মুক্ত থাকার কথা। এরকমই তো জানতাম। আমি বললাম, একটা।
সফরসঙ্গীরা আমাকে নানান বিষয়ে জ্ঞানী ভাবে। তারা মনে করল এটাই সত্যি উত্তর। প্রত্যেকেই বলল, একটা শুধু বলেই ক্ষান্ত হলো না, জ্ঞানীর হাসিও হাসল। যে হাসির অর্থ-কী ধরা তো খেলে! এখন দাও সবাইকে একটা করে মুক্তা।
সফরসঙ্গীদের মধ্যে শুধু চ্যালেঞ্জার বলল, সতেরোটা। চ্যালেঞ্জারের বোকামিতে আমরা সবাই যথেষ্ট বিরক্ত হলাম।
ঝিনুক খোলা হলো। ঝিনুক ভর্তি মুক্তা। মুক্তা গোনা হলো এবং দেখা গেল মুক্তার সংখ্যা ১৭। কাকতালীয় এই ঘটনার ব্যাখ্যা আমি জানি না। আমি আমার এক জীবনে অনেক কাকতালীয় ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। এটি তার একটি। চ্যালেঞ্জারকে একটা বড়সড় মুক্তা দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জারের চোখে পানি। তার চোখের অশ্রু গ্লান্ডে মনে হয় কোনো সমস্যা আছে, সে কারণে এবং সম্পূর্ণ অকারণে চোখ থেকে এক দেড় লিটার পানি ফেলতে পারে।
শ্রেষ্ঠ রূপবতীর পুরস্কার পেল শাওন। সে এমন এক ভঙ্গি করল যেন শেষ মুহূর্তে সে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় রানার্স আপকে পরাজিত করে সোনার মুকুট জিতে নিয়েছে।
কমল তার স্ত্রীর উপর খুব রাগ করল, ধমক দিয়ে বলল, কোথাও বেড়াতে গেলে সাজগোজ করে বের হবে না? ঢাকা থেকে তো দুনিয়ার সাজের জিনিস নিয়ে এসেছ, এখন ঘুরছ ফকিরনীর মতো।
মুক্তা বিষয়ক জটিলতা শেষ করে বাস ছুটছে গ্রেটওয়ালের দিকে। একসময় থামল। আমরা কৌতূহলী হয়ে তাকালাম। কোথায় গ্রেটওয়ালঃ চায়নিজ হার্বাল মেডিসিনের বিশাল দালান। হার্বাল বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে না-কি হার্বাল মেডিসিনের কিংবদন্তি ডাক্তারেরা আমাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবেন। শুধু ওষুধপত্র নগদ ডলারে কিংবা ক্রেডিট কার্ডে কিনতে হবে।
.
ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয় বনাম বাংলাদেশের কয়েকজন গবেই
ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বাস থেমেছে, আমরা হৈচৈ করে নামছি। ওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ছুটে এলেন। চাপা গলায় নিখুঁত ইংরেজিতে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ক্লাস চলছে, অধ্যাপকরা গবেষণা করছেন। হৈচৈ চলবে না। পিন পাতনিক নৈঃশব্দ্য বজায় রাখতে হবে।
আমরা গেলাম ঘাবড়ে। মায়েরা নিজেদের বাচ্চাদের মুখ চেপে ধরলেন। এ কী ঝামেলা! রওনা হয়েছি গ্রেট ওয়াল দেখতে, এ কোন চক্করে এসে পড়লাম?
বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা আমাদের হলঘরের মতো ঘরে দাঁড় করিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। হলঘরের চারপাশে নানান ধরনের ভেষজ গাছ। প্রতিটির গায়ে চায়নিজ নাম, বোটানিকেল নাম। দুটি গাছ চিনলাম। একটি আমাদের অতিপরিচিত ঘৃতকুমারী,, অন্যটা জিনসেং, যৌবন ধরে রাখার ওষুধ। দেয়ালে বিশালাকৃতির ছবি। একটিতে মাও সে তুং ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। অন্য একটিতে World Health Organization–এর প্রধানের সঙ্গে হাসি হাসি মুখে কী যেন আলোচনা করছেন। বিদেশী যেসব ছাত্র-ছাত্রী ভেষজ বিদ্যা শিখতে এসেছে তাদের ছবিও অাছে।
হলঘরের এক প্রান্তে অতি বৃদ্ধ এক চায়নিজের মর্মর পাথরের মূর্তি। ভারতবর্ষের ভেষজ বিজ্ঞানের জনক যেমন মহর্ষি চরক, এই চায়নিজ বৃদ্ধও (নাম মনে নেই) চৈনিক ভেষজ বিজ্ঞানের জনক। সফর সঙ্গীরা চৈনিক ভেষজ বিজ্ঞানীরা সামনে নানান ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমি ভাবছি কখন এই চক্কর থেকে উদ্ধার পাব।
মিনিট পাঁচেক পার হলো, এক অতি স্মার্ট তরুণী ঢুকল। সে পোশাকে স্মার্ট। ইংরেজি কথা বলায় স্মার্ট। পুরো চীন ভ্রমণে আমার দেখা মতে সবচে’ স্মার্ট তরুণী। সে আমাদের একটি সুসংবাদ দিল।
সুসংবাদটা হচ্ছে, ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাজ্ঞানী চিকিৎসকরা বিনামূল্যে আমাদের শরীরের অবস্থা দেখতে রাজি হয়েছে। আমরা যে অতি দূরদেশ থেকে এখানে এসেছি, ভেষজ চিকিৎসা সম্পর্কে আগ্রহ দেখাচ্ছি, তার কারণেই আমাদের প্রতি এই দয়া।
আমরা কৃতজ্ঞতায় ছোট হয়ে গেলাম এবং ভেষজ চিকিৎসকদের মহানুভবতায় হলাম মুগ্ধ ও বিস্মিত।
আমাদের একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। স্মার্ট তরুণী ব্যাখ্যা করলেন আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক, কী করে আমাদের জীবনীশক্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভেষজ বিজ্ঞানই আমাদের একমাত্র পরিত্রাতা। তিনি জানালেন, তিনজন চিকিৎসক একসঙ্গে ঘরে ঢুকবেন। তারা কেউ চৈনিক ভাষা ছাড়া কিছুই জানেন না। সবার সঙ্গে একজন করে ইন্টরপ্রেটার থাকবে।
মহান চিকিৎসকরা আমাদের মল-মূত্র কফ কিছুই পরীক্ষা করবেন না। নাড়ি দেখে সব বলে দেবেন।
আমরা আবারো অভিভূত।
নাড়ি দেখে রোগ নির্ণয় বিষয়ে তারাশংকরের বিখ্যাত উপন্যাস আছে আরোগ্য নিকেতন। সেই উপন্যাসের আয়ুর্বেদশাস্ত্রী কবিরাজ নাড়ি দেখে মৃত্যুব্যাধি ধরতে পারতেন। আমার ভেতর রোমাঞ্চ হলো এই ভেবে যে, উপন্যাসের একটি চরিত্র বাস্তবে দেখব।
স্মার্ট তরুণী বললেন, মহান ভেষজবিদের সম্বন্ধে শেষ কথা বলে বিদায় নিচ্ছি। আধুনিক ডাক্তাররা নাড়ি ধরে শুধু Pulse beat শোনে। আমাদের মহান শিক্ষাগুরু নাড়ি ধরেই হার্ট, লিভার, কিডনি এবং রক্ত সঞ্চালন ধরেন। প্রাচীন চৈনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের এই হলো মহত্ত্ব। এই বিদ্যা হারিয়ে যাচ্ছিল, আমাদের ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয় তা পুনরুদ্ধার করেছে। আপনারা কি এই আনন্দ সংবাদে হাততালি দিবেন?
আমরা মহা উৎসাহে হাততালি দিলাম।
স্মার্ট তরুণী হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমাদের মহান চিকিৎসকরা প্রবেশ করছেন, আপনারা যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে আচরণ করবেন, এই আমার বিনীত অনুরোধ।
দরবারে মহারাজার প্রবেশের মতো দুই বৃদ্ধ এক বৃদ্ধা প্রবেশ করলেন। দেখেই মনে হচ্ছে-তাদের জীবন থেকে রস কষ নিঃশেষ হয়ে গেছে। চোখে মুখে ক্লান্তি ও হতাশী।
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলাম। তারা তিনজনই বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।
স্মার্ট তরুণী বললেন, আপনারা তিনজন করে আসুন। আপনাদের কী অসুখ কিছুই বলতে হবে না। উনাৱা নাড়ি ধরে সব জানবেন।
প্রথমে গেলাম আমি, মাজহার এবং কমল। তিনজনেরই বুক ধড়ফড় করছে জানি কী ব্যাধি ধরা পড়ে।
বৃদ্ধ ভেষজ মহাজ্ঞানী অনেকক্ষণ আমার নাড়ি ধরে ঝিম ধরে রইলেন। তারপর চোখ খুলে বললেন, হার্টের অসুখ।
আমি তার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে ঘনঘন কয়েকবার হা-সূচক মাথা নাড়লাম।
তিনি বললেন, আগে আমাদের কাছে এলে বুক কেটে চিকিৎসা করার প্রয়োজন হতো না।
আমি আরো মুগ্ধ। এই জ্ঞানবৃদ্ধ নাড়ি ধরে জেনে ফেলেছেন যে আমার বাইপাস হয়েছে। কী আশ্চর্য!
তোমার রক্ত দূষিত। রক্ত নষ্ট হয়ে গেছে। রক্ত ঠিক করতে হবে।
আপনি দয়া করে ঠিক করে দিন।
স্নায়ুতন্ত্রেও সমস্যা। রক্তের সঙ্গে স্নায়ু ঠিক করতে হবে।
আপনি দয়া করে ঠিক করে দিন।
আমি প্রেসক্রিপশন দিচ্ছি। ছ’মাস ওষুধ খেতে হবে। তোমার সমস্যা মূল থেকে দূর করা হবে।
ধন্যবাদ, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ওষুধগুলি ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রাগ স্টোর ছাড়া কোথাও পাবে না। তোমার ভদ্রতা এবং ভেষজ বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস আমাকে মুগ্ধ করেছে বিধায় তুমি বিশেষ কমিশনে ওষুধগুলি পাবে। দামটা দিবে ডলারে। ডলার না থাকলে ক্রেডিট কার্ড।
আমি উনার হাতে ক্রেডিট কার্ড তুলে দিলাম। একবার মনে হলো পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলি।
উনার কাছ থেকে বের হয়ে আমি দলের অন্যদের মুগ্ধ গলায় মহান ভেষজ বিজ্ঞানীরা নাড়িজ্ঞানের কথা বললাম। কী করে নাড়িতে হাত দিয়েই তিনি আমার বাইপাসের কথা বলে ফেললেন সেই গল্প।
শাওন বলল, তোমার যে বাইপাস হয়েছে এটা বলার জন্যে কোনো ভেষজ বিজ্ঞানী লাগে না। যে কেউ বলতে পারে।
আমি বললাম, কীভাবে?
তোমার বুক যে কাটা এটা শার্টের কলারের ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। যে হাতে নাড়ি ধরা হয়েছে সেই হাতও কাটা। হাত কেটে রগ নেয়া হয়েছে।
আমি থমকে গেলাম। শাওন বলল, তুমি কি ওষুধ কেনার জন্যে টাকা পয়সা দিয়েছ?
আমি মিনমিন করে বললাম, হ্যাঁ।
কত দিয়েছ?
কত এখনো জানি না, ক্রেডিট কার্ড নিয়ে গেছে।
শাওন বলল, কী সর্বনাশ!
আমি বিড়বিড় করে বললাম, সর্বনাশ তো বটেই।
মাজহারের সঙ্গে ডাক্তারের কথাবার্তা এখন তুলে দিচ্ছি।
ডাক্তার : হুঁ হুঁ। তোমার কিডনি প্রায় শেষ। এখন রক্ষা না করলে আর রক্ষা হবে না।
মাজহার : বলেন কী!
ডাক্তার : তোমার মাথায় চুল যে নেই তার কারণ কিডনি।
মাজহার : আপনার মাথায়ও তো কোনো চুল নেই। আপনারও কি কিডনি সমস্যা?
ডাক্তার : (চুপ)
মাজহার : আপনি আপনার নিজের কিডনির চিকিৎসা কেন করছেন না?
ডাক্তার : তোমার যা দেখার দেখেছি Next যে তাকে পাঠাও।
মাজহারের নির্বুদ্ধিতার অনেক গল্প আছে। তার বুদ্ধিমত্তার এই গল্পটি আমি অনেকের সঙ্গেই আগ্রহের সঙ্গে করি।
কমলের বেলাতেও দেখা গেল তার রক্ত দূষিত। লিভার অকার্যকর, স্নায়ুতন্ত্রে ঝিমুনি। কমল জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ল। সে বলল, আমি যে গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়ি, এখন তার কারণ বুঝলাম। আমার স্নায়ুতন্ত্রেই ঝিমুনি।
আমি ছাড়া পুরো দলের কেউ এক ডলারের ওষুধও কিনল না। কমল কিনতে চাচ্ছিল, মাজহারের ধমকে চুপ করে গেল। আমি চারশ’ ডলারের ওষুধ কিনলাম। অস্ট্রেলিয়ান গাধাটারও নাকি কমলের মতো সমস্যা-রক্ত দূষিত, লিভার অকার্যকর, স্নায়ুতন্ত্রে ঝিমুনি। সে কিনল এক হাজার ডলারের ওষুধ। ছয়মাসের সাপ্লাই।
চারশ’ ডলারের ওষুধের এক পুরিয়াও আমি খাই নি। নিজের বোকামির নির্দশন হিসেবে জমা রেখে দিয়েছি। পাঠকদের জন্যে তার একটা ছবি দেয়া হলো।
ভেষজ বৃক্ষ নিয়ে আমার নিজের যথেষ্টই উৎসাহ আছে। নুহাশ পল্লীতে যে ভেষজ উদ্যান তৈরি করেছি তাতে ২৪০ প্রজাতির গাছ আছে। তারপরেও বলছি, এই শতকে এসে পুরনো গাছগাছড়ায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা হাস্যকর। গাছগাছড়া থেকেই আমরা আধুনিক ওষুধে এসেছি। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞান কঠিন পরীক্ষা নিরীক্ষার বিজ্ঞান। শত শত বৎসরের সাধনায় এই বিজ্ঞান বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। এখান থেকে আরো অনেকদূর যাবে। একে অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস কারোই থাকা উচিত নয়।
প্রাচীন চৈনিক ভেষজ বিজ্ঞান সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতার ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। সম্রাটরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন নিজেদের স্বার্থে। তারা চেয়েছেন অমরতা, ভোগ করার ক্ষমতা। প্রাচীন ভেষজ বিজ্ঞান সম্রাটদের অমরত্বের ওষুধ দিতে পারে নি। চিরস্থায়ী যৌবনের ওষুধও দিতে পারে নি। আমার ধারণা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান কোনো একদিন পারবে।
চেঙ্গিজ খা’র সঙ্গে চীন দেশীয় চারজন ভেষজ বিজ্ঞানীরা সাক্ষাৎকার বিষয়ক একটি গল্প বলি।
চেঙ্গিজ খা বৃদ্ধ এবং অশক্ত। মৃত্যুভীতি ঢুকে গেছে। তিনি মৃত্যু নিবারক ওষুধ চান। অর্থ যা প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি দেয়া হবে, ওষুধ চাই। বার্ধক্য রোধ করতে পারে, এমন ওষুধ কি পাওয়া যাবে?
চেঙ্গিজ খা বললেন, পারবেন আপনারা বানিয়ে দিতে?
চারজনের মধ্যে তিনজনই বললেন, অবশ্যই পারব। বিশেষ বিশেষ লতাগুল্ম আছে। সময় লাগবে। একেক গুলু একেক সময়ে জন্মায়। তবে পারব। না পারার কিছু নেই।
শুধু একজন বললেন, জরা ও মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি। একে কিছুতেই আটকানো যাবে না।
চেঙ্গিজ খা সেই চিকিৎসককে বললেন, ধন্যবাদ। বাকি তিনজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন।
ভালো কথা, আমরা যে তিনজনের পাল্লায় পড়েছিলাম তারা কোন দলের?
পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই। চারশ’ ডলারের ওষুধের বস্তা হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি এবার সত্যি সত্যি গ্রেটওয়ালের কাছে এনে রাখল।
সবার মনে আনন্দ। শুধু আমার এবং কমলের মন ভালো না। কমলের মন ভালো নেই, কারণ মাজহারের চোখ রাঙানির কারণে তার চিকিৎসা হয় নি।
আমার মন ভালো নেই, কারণ আমার চিকিৎসা হয়েছে।
সফরসঙ্গীরা হৈ হৈ করে গ্রেটওয়ালে ছোটাছুটি করছে। তাদের ক্যামেরা বিরামহীনভাবে ক্লিক ক্লিক করছে। গ্রেটওয়াল না, গ্রেটওয়ালের পাশে তাদেরকে কেমন দেখাচ্ছে এটা নিয়েই তারা চিন্তিত।
সবাইকেই অন্যরকম লাগছিল। দিন শেষের সূর্যের আলো পড়েছে তাদের মুখে। বিশাল গ্রেটওয়ার দিগন্তে মিশে আছে, মনে হচ্ছে বিশাল এক নদী। দৃশ্যটা একই সঙ্গে সুন্দর এবং মন খারাপ করিয়ে দেবার মতো।
গ্রেটওয়ালের এক কোনায় দেখি, দানবের মতো সাইজের এক মঙ্গোলিয়ান ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়ার মালিক ইয়েনের বিনিময়ে দর্শনার্থীদের ঘোড়ায় চড়াচ্ছেন।
গ্রেটওয়াল দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছি ঘোড়া দেখে তেমন মুগ্ধ হলাম। যেন পাথরে তৈরি ভাস্কর্য। নিঃশ্বাস ফেলছে না এমন অবস্থা। আমি এক ঘন্টার চুক্তি করে ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। কমল ছুটে এসে বলল, এক-কী হুমায়ূন ভাই, ঘোড়ায় বসে আছেন কেন?
আমি বললাম, ঘোড়া আমার অতি পছন্দের একটি প্রাণী। নুহাশ পল্লীতে আমার দু’টা ঘোড়া ছিল। সে বলল, সবাই গ্রেটওয়ালে ছোটাছুটি করছে, আর আপনি ঝিম ধরে ঘোড়ায় বসে আছেন, এটা কেমন কথা?
আমি নামলাম না। বসেই রইলাম। দুর্ধর্ষ মোঙ্গলরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে যখন ছুটে যেত তখন তাদের কেমন লাগত ভাবতে চেষ্টা করলাম।
পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। মোঙ্গলরা নেই, তাদের ভগ্নস্বপ্ন পড়ে আছে।
.
টুরিস্টের চোখে
টুরিস্টদের দেশ ভ্রমণের কিছু নিয়ম আছে। তারা প্রতিটি দর্শনীয় জায়গায় যাবে। যা দেখবে তাতেই মুগ্ধ হবে। মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই, পয়সা উসুল করার ব্যাপার আছে। মুগ্ধ হওয়া মানে পয়সা উসুল হওয়া।
প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে তারা কতক্ষণ থাকবে তারও নিয়ম আছে। ক্যামেরায় যতক্ষণ ফিল্ম আছে ততক্ষণ। ফিল্ম শেষ হওয়া মানে দেখা শেষ। আজকাল ডিজিটাল ক্যামেরা বের হয়ে নতুন যন্ত্রণা হয়েছে। এইসব ক্যামেরায় ফিল্ম লাগে না। যত ইচ্ছা ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক করে যাও।
আমরা বেইজিং-এর দর্শনীয় স্থান সবই দেখে ফেললাম।
.
গ্রীষ্ম প্রাসাদ (Summer Palace)
UNESCO ১৯৯৮ সনে সামার প্যালেসকে World Heritage–এর লিস্টে স্থান দিয়েছে। গ্রীষ্ম প্রাসাদ দেখে সবাই মুগ্ধ। মুগ্ধ হবারই কথা। সম্রাটরা রাজকোষ ঢেলে দিয়েছেন নিজের গ্রীষ্ম প্রাসাদ বানাতে। সম্রাটরা গরমে কষ্ট করবেন তা কী করে হয়? গরমের সময় Kuming Lake–এর সুশীতল হাওয়া ভেসে আসে। কী শান্তি।
বিকেলে সম্রাট বা সম্রাট পত্নীর লেকের পাশে হাঁটতে ইচ্ছা হতে পারে। তার জন্যে তৈরি হলো হাঁটার পথ Long Corridor অর্থের কী বিপুল অর্থহীন অপচয়! সম্রাট পত্নী লেকের হাওয়া খাবেন। সহজ ব্যাপার না। সম্রাট পত্নীর কথা লিখলাম, কারণ গ্রীষ্ম প্রাসাদ সম্রাট পত্নী Dawager Cix’র শখ মেটানোর জন্যে ১৮৬০ সনে বানানো হয়।
পাঠকরা কি অনুমান করতে পারবেন গ্রীষ্ম প্রাসাদের মূল অংশ কোনটা? মূল অংশ দীর্ঘজীবী ভবন। যেখানে সম্রাট এবং সম্রাট পত্নীর দীর্ঘজীবনের জন্য মন্ত্র পাঠ করতে হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে না থাকলে কে ভোগ করবে? সম্রাটদের জীবনের মূলমন্ত্র তো একটাই–ভোগ।
গ্রীষ্ম প্রাসাদে আমার কাছে ভালো লেগেছে মার্বেলের বজরা। অতি দামি মার্বেলে বিশাল এক বজরা বানিয়ে পানিতে ভাসানোর বুদ্ধি কার মাথায় এসেছিল এটা এখন আর জানা যাবে না। যার মাথায় এসেছিল, তার কল্পনাশক্তির প্রশংসা করতেই হয়।
আগেই বলেছি আমরা বেড়াতে গেছি শীতকালে। কিউমিং লেকের পুরোটাই তখন জমে বরফ। দেখে মনে হবে বরফের জমাট সমুদ্র। সেখানে ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে দৌড়াচ্ছে। শাওনের শখ হলো বরফের উপর হাঁটবে। সে বলল, আমি জীবনে এই প্রথম লেক জমে বরফ হতে দেখলাম। এর উপর হাঁটব না! তাকে আটকালাম। সে বরফের লেকে নামলেই অন্যসব মেয়েরা নামবে। তাদের সঙ্গে বাচ্চারা নামবে এবং অবধারিতভাবে আছাড় খেয়ে কেউ না কেউ কোমর ভাঙবে। শাওন এবং স্বর্ণা দুজনই সন্তানসম্ভবা। তাদের পেটের সন্তানরা মায়ের আছাড় খাওয়াকে ভালোভাবে নেবে-এরকম মনে করার কারণ নেই।
এদিকে অমিয় খুবই যন্ত্রণা করেছে। বানরের মতো বাবার গলা ধরে ঝুলে আছে তো আছেই। গলা ছাড়ছে না। উদ্ভট উদ্ভট আবদারও করছে। তার আবদারে আমরা সবাই মহাবিরক্ত, শুধু মাজহার খুশি। তার ধারণা এতে ছেলের বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পাচ্ছে। অমিয়’র উদ্ভট আবদারের নমুনা দেই-পাথরের বজরা দেখে সে ঘোষণা করল, এই বজরায় চড়ে সে ঘুরবে। কাজটা এক্ষুণি করতে হবে।
মাজহার আনন্দিত গলায় আমাকে বলল, ছেলের বুদ্ধি দেখেছেন হুমায়ূন ভাই। পুরা বজরা পাথরের তৈরি, অথচ ছেলে দেখামাত্র বুঝে ফেলেছে এটা পানিতে ভাসে।
এক চায়নিজ শিশু আমাদের দেশের হাওয়াই মিঠাই টাইপ একটা খাবার খেতে খেতে যাচ্ছিল। হঠাৎ অমিয় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে এটা নিয়ে নিজে খেতে শুরু করল। আমরা সবাই বিব্রত, শুধু মাজহারের মুখে গর্বের হাসি। মাজহার আমাকে বলল, আমার ছেলের অধিকার আদায়ের চেষ্টাটা দেখে ভালো লাগছে। সাহসী ছেলে। অন্য একজন খাচ্ছে, আমি কেন খাব না! এটাই তার spirit. মাশাল্লাহ।
আমাদের দলে দুটা শিশু। অতি দুষ্ট অমিয়, অতি শিষ্ট আরিয়ানা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুরো চায়না ট্রিপে দেখেছি চায়নিজ তরুণীরা অমিয়কে নিয়ে মহাব্যস্ত। তারা আরিয়ানার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। কত মেয়েই না ছোঁ মেরে অমিয়কে কোলে তুলল! কত না অদির! চকলেট গিফট লজেন্স গিফট। অথচ পাশেই পরী শিশুর মতো আরিয়ানা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে।
মূল বিষয়টা পুরুষ সন্তানের প্রতি চায় নিজদের গভীর প্রীতি। আধুনিক চায়নায় একটির বেশি সন্তান নেয়া যাবে না। আইন কঠিন। সেই একটি সন্তান সবাই চায় পুত্র। কন্যা নয়। যাদের ভাগ্যে কন্যা জোটে, তারা কপাল চাপড়ায় এবং অন্যের পুত্রসন্তানদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। দুঃখজনক পরিস্থিতি! এই পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। আলট্রাসনোগ্রাফির কারণে গর্ভবতী মায়েরা আগেই জেনে যাচ্ছেন সন্তান ছেলে না মেয়ে। যখনই জীনছেন মেয়ে, গর্ভ নষ্ট করে ফেলছেন। পরের বার যদি পুত্র হয় তখন দেখা যাবে।
গর্ভ নষ্ট বিষয়ে কঠিন আইনকানুন না হলে এক সন্তানের দেশ মহান চীন আগামী একশ’ বছরের নারীশূন্য হয়ে যাবার সম্ভাবনা।
.
স্বর্গ মন্দির (Temple of Heaven)
চীনা সম্রাটরা নিজেদের স্বর্গের পুত্র ভাবতেন। ধুলোমাটির পৃথিবীতে তাদের আসতে হয়েছে ‘প্রজা’ নামক একটা শ্ৰেণীর দেখভালের জন্যে। স্বর্গের পুত্ররা প্রার্থনা করবেন, সেই প্রার্থনা গ্রাহ্য হবে না এটা কেমন কথা?
স্বর্ণ মন্দিরে ভালো ফসল যেন হয় তার জন্যে প্রার্থনা করা হতো। সমস্যা হচ্ছে, স্বর্গ পুত্র প্রার্থনা করছেন তারপরও প্রার্থনা গ্রাহ্য হচ্ছে না, ফসল নষ্ট হচ্ছে, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে, এটা কেমন কথা!
স্বর্গ পুত্রদের কাছে এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর আছে। প্রার্থনায় কোনো একটা ত্রুটি হয়েছে। নিয়মকানুন ঠিকমতো মানা হয় নি।
১৯৯৮ সালে UNESCO স্বর্ণ মন্দিরকে World Heritage–এর আওতায় নিয়ে আসে। প্রসঙ্গক্রমে বলি, পাঠকরা কি জানেন বাংলাদেশের একটা জায়গা UNESCO’র World Heritage–এর লিস্টে আছে? যারা জানেন তারা তো জানেনই। যারা জানেন না তাদের জন্যে একটা কুইজ।
হঠাৎ বাংলাদেশের প্রসঙ্গ কেন নিয়ে এলাম? স্বর্গ মন্দির, মিং রাজার কবরখানা নিয়ে ভালো লাগছে না। একটা দেখলেই সব দেখা হয়ে গেল। সব প্রসাদের একই ডিজাইন। একটাই বিশেষত্ব তার বিশালত্ব। সম্রাটরা কখনো ছোটো কোনো চিন্তা করতে পারেন না। আমার প্রাসাদ হবে সবচে’ বড়। দেখে যেন সবার পিলে চমকে যায়। চীনের ডায়ানেস্টিরা পিলে চমকানোর ব্যবস্থাই করেছেন। এর বেশি কিছু না।
রাজা-বাদশার ভোগ বিলাসের আয়োজন দেখে আমি মুগ্ধ হই না, এক ধরনের বিতৃষ্ণা অনুভব করি। এক যুগ আগে যখন চীনে প্রথম এসেছিলাম, তখন মিং সম্রাটের বালিশের মিউজিয়াম দেখেছিলাম। ঘুমুবার সময় তাঁর কয়টা বালিশ লাগত তার সংগ্রহ। এর মধ্যে পিরিচের সাইজের দু’টা গোলাকার বালিশ দেখে প্রশ্ন করেছিলাম-এই বালিশ দুটা কেন?
গাইড বলল, সম্রাটের কানের লতি রাখার বালিশ।
আমি মনে মনে বললাম, মাশাল্লাহ। সম্রাটের কানের লতির গতি হোক। আমি এর মধ্যে নেই।
.
শিক্ষার জন্যে সুদূর চীনে যাও
আমাদের নবী (স.)-র কথা। একজন মওলানা আমাকে বলেছিলেন-এই শিক্ষা ধর্ম শিক্ষা। অন্য কোনো শিক্ষা না। মওলানাকে বলতে পারি নি যে, চীনে ইসলাম ধর্ম গিয়েছে নবীজির মৃত্যুর পর। ধর্ম শিক্ষার জন্যে চীনে যেতে হলে অন্য কোনো ধর্ম শিক্ষার জন্যে যেতে হয়।
যাই হোক, প্রথমবার চীনে গিয়ে একটা মসজিদে গিয়েছিলাম। মসজিদের ভিজিটার্স বুক আছে। ভিজিটার্স বুকে নাম সই করতে গিয়ে দেখি, বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবও এই মসজিদ দেখেছেন এবং সুন্দর সুন্দর কথা লিখেছেন।
মসজিদেরই ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তাঁর দু’টা নাম-একটা চায়নিজ নাম, অন্যটা মুসলমান নাম। যখন নামাজ পড়ান বা ধর্মকর্ম করেন, তখন চায়নিজ নাম ব্যবহার করেন।
ইসলাম ধর্মে জীবজন্তুর ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার অনুমতি নেই। কিন্তু চায়নিজ মসজিদের দেয়ালে এবং মসজিদের মাথায় ড্রাগন থাকবেই। চায়নিজ মুসলমানদের এই বিষয়ে ছাড় দেয়া হয়েছে কিনা জানি না।
নবীজি শিক্ষার জন্যে সুদূর চীনে যেতে বলেছিলেন। আমার ধারণা দূরত্ব বোঝানোর জন্যে তিনি চীনের নাম করেছেন। তবে আক্ষরিক অর্থে বলে থাকলেও চীনের উল্লেখ ঠিক আছে।
প্রাচীন চীন ছিল উদ্ভাবনের স্বর্গভূমি। কম্পাস চীনের আবিষ্কার। বারুদ, কাগজ, ছাপাখানা।
যখন এই লেখা লিখছি, তখন বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে। কেউ কি জানে ফুটবল চীনাদের আবিষ্কার? সং ডায়ানাষ্টির সম্রাট টাইজু ফুটবল খেলছেন এই তৈলচিত্রটি পাঠকদের দেখার জন্যে দেয়া হলো। ফুটবলের তখন নাম ছিল কু জু (Ju ju) অর্থ Kick ball,
আরো দুঃসংবাদ আছে। গলফও চাইনিজদের আবিষ্কার করা খেলা। গলফের নাম [Chui Wan) (মারের লাঠি), চুই ওয়ান খেলার আরেক নাম বু ডা (bu da)। এর অর্থ হাঁট এবং পেটাও।
এক হাজার বছর আগে চায়নিজ কবি ওয়াং জিয়ানের (টেং ডায়ানেস্টি) কবিতায় বু ডু খেলার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা আধুনিককালের গলফ।
দাবা চায়নিজদের আবিষ্কার করা খেলা। ভারতীয়রাও অবশ্যি এই খেলা আবিষ্কারের দাবিদার।
প্রথম ক্যালকুলেটার চায়নিজদের। নাম এ্যাবাকাস। হট এয়ার বেলুন, প্যারাসুট চায়নিজদের কীর্তি।
অঙ্কে ডেসিমেল সিস্টেম এখন সারা পৃথিবীতেই ব্যবহার করা হয়। কম্পিউটারে ব্যবহার করা হয় বাইনারি সিস্টেম। ডেসিমেল সিস্টেম এখন ভাল ভাত, অথচ মানবজাতিকে দশভিত্তিক এই অঙ্কে আসতে শতবৎসর অপেক্ষা করতে হয়েছে। নিওলিথিক সময়ে (৬০০০ বছর আগে এই ডেসিমেল সিস্টেম চায়নিজরা জানত এবং ব্যবহার করত। সাংহাই শহরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া পটারিতে ১০,২০ ৩০ এবং ৪০ সংখ্যার চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা সেই সময়ের মানুষের ডেসিমেল সিস্টেমের জ্ঞানের কথাই বলে।
সিসমোগ্রাফ কাদের আবিষ্কার চায়নিজদের আবার কার? প্রাচীন সিসমোগ্রাফের একটি ছবি পাঠকদের কৌতূহল মেটানোর জন্যে দেয়া হলো। এই
আবিষ্কার করা হয় Han dynasty–র সময়।
এবার আসি ধাতু বিদ্যায়।
আকর থেকে লোহা এবং লোহা থেকে ইস্পাত চায়নিজদের আবিষ্কার। তামা এবং পরে ব্রোঞ্জও তাদের।
মাটির নিচ থেকে পেট্রোলিয়াম বের করা এবং ব্যবহার করার পদ্ধতিও তাদের আবিষ্কার। তারাই প্রথম খনি থেকে কয়লা তোলা শুরু করে।
ও সিল্কের কথা তো বলা হলো না। সিল্ক চায়নিজদের। চা চায়নিজদের। চা শব্দটাও কিন্তু চাইনিজ। চিনিও চাইনজিদের।
আমি আমার এই লেখার শিরোনাম দিয়েছি মহান চীন’! চীনকে মহান চীন বলছি চীনাদের এই আশ্চর্য উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্যে। চীন একটি বিশাল দেশ এই জন্যে না। চীনে গ্রেটওয়াল আছে এই জন্যেও না।
আমি লেখক মানুষ। বই ছাপা হয়। যে কাগজে লিখছি সেই কাগজ চায়নিজদের আবিষ্কার। যে ছাপাখানায় বই ছাপা হয়, সেই ছাপাখানাও তাদের আবিষ্কার। চীনকে মহান চীন না বলে উপায় আছে।
চীনে গিয়েছিলাম রাইটার্স ব্লক কাটাতে। সেই ব্লক কীভাবে কাটল সেটা বলে চীন ভ্রমণের উপর এলোমেলো ধরনের লেখাটা শেষ করি।
চীন ভ্রমণের শেষদিনের কথা। সবাই আনন্দ-উল্লাসে ঝলমল করছে। আজ শেষ মার্কেটিং। যে জিনিস আজ কেনা হবে না সেটা আর কোনোদিনও কেনা হবে na। ভোর আটটা বাজার আগেই সবাই তৈরি। আমি হঠাৎ বেঁকে বসলাম। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আজ আমি কোথাও যাব না। (আমার একটা বইয়ের নাম।)
শাওন বলল, যাবে না মানে?
আমি বললাম, যাব না মানে যাব না।
কেন?
আমার ইচ্ছা।
কী করবে? সারাদিন হোটেল বসে থাকবে?
হ্যাঁ।
তুমি হোটেলে বসে থাকার জন্যে এত টাকা খরচ করে চীনে এসেছ?
হ্যাঁ।
তুমি কি জানো, তুমি না গেলে তোমার সফরসঙ্গীরা কেউ যাবে না? সবাই যার যার ঘরে বসে থাকবে।
কেউ ঘরে বসে থাকবে না। সবাই যাবে। দুইশ ডলার বাজি।
আচ্ছা ঠিক আছে, সবাই যাবে। কিন্তু মন খারাপ করে যাবে। তুমি শেষ দিনে সবার মন খারাপ করিয়ে দিতে চাও?
মাঝে মাঝে মন খারাপ হওয়া ভালো। এতে লিভার ফাংশন ঠিক থাকে।
তুমি না গেলে আমিও যাব না।
তুমি থাকতে পারবে না। হোটেলে আমি একা থাকব।
শাওনের গলা ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে। তার দিকে তাকালেই চোখের পানি দেখা যাবে। আমি আবার চোখের পানির কাছে অসহায়। কাজেই তার দিকে না তাকিয়ে চোখ-মুখ কঠিন করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে প্রায় ছুটেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আমি ব্যাগ খুলে কাগজ কলম বের করলাম। লিখতে শুরু করলাম। আমার রাইটার্স ব্লক কেটে গেছে। কলমের মাথায় ঝর্ণাধারার মতো শব্দের পর শব্দ আসছে। কী আনন্দ! কী আনন্দ! একসময় চোখে পানি এসে গেল। কিছুক্ষণ লেখার পর পাতা ঝাপসা হয়ে যায়। চোখ মুছে লিখতে শুরু করি।
কতক্ষণ লিখেছি জানি না। একসময় বিস্মিত হয়ে দেখি, শাওন আমার পেছনে? সে কি হোটেল থেকে যায় নি! সারাক্ষণ কি হোটেল ঘরেই ছিল? আমার কিছুই মনে নেই।
আমি লজ্জিত গলায় বললাম, হ্যালো।
সে বলল, তোমার রাইটার্স ব্লক কেটে গেছে, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
সে বলল, আমি কী সুন্দর দৃশ্যই না দেখলাম! একজন লেখক কাঁদছে আর লিখছে। কাঁদছে আর লিখছে।
খুব সুন্দর দৃশ্য?
আমার জীবনে দেখা সবচে’ সুন্দর দৃশ্য।
আমি বললাম, নিষিদ্ধ নগরীতে তুষারপাতের চেয়েও সুন্দর?
একশ’গুণ সুন্দর।
আমি অবাক হয়ে দেখি, তার চোখেও অশ্রু টলমল করছে।
চীন ভ্রমণে আমার অর্জন একজন মুগ্ধ তরুণীর আবেগ এবং ভালোবাসার শুদ্ধতম অশ্রু। মিং রাজাদের ভাগ্যে কখনো কি এই অশ্রু জুটেছে? আমার মনে হয় না।
Post a Comment