মড়া – বাণী বসু

মড়া – বাণী বসু

বড় কৌটোর মধ্যে মেজ কৌটো, তার মধ্যে সেজ কৌটো, তার মধ্যে ন’, তারও মধ্যে কোণে সেই এক রকমের এক ম্যাজিক চীনে কৌটো আছে না? খুলতে খুলতে খুলতে খুলতে শেষমেশ এক ফোঁটা এক কৌটো বেরোয় তার ঢাকনি খোলে কি খোলে না, যদি বা খোলে তার মধ্যে কিছু আছে কি নেই, শুধু চোখে ঠাহর হয় না। ঠিক তেমনি কাসুন্দের মাঠ, মাঠের মধ্যে বাগান, বাগানের মধ্যে বাড়ি, বাড়ির মধ্যে ঘর, ঘরের মধ্যে লাবণ্য, লাবণ্যর বুকের মধ্যে কুঠরি। কুঠরির মধ্যে সতিকার লাবণ্য থাকে কি থাকে না লাবণ্য নিজেই জানে না। দরকার মতো ভেতর থেকে মরা সোনার জোড়াচুড়ি পরা নীল শিরা ওঠা সাদা সাদা দুখানা হাত বেরিয়ে আসে। কাজ সারা হলে হাত দুখানি গুটিয়ে-সুটিয়ে আবার কুঠরি সই হয়।

বাইরের দিক দিয়ে একটি ছেলে একটি বউ আর এতখানিক এক বাচ্চা আসা-যাওয়া যাওয়া-আসা করে। ছেলেটিকে আপিসের ভাত দেয় বউ, দিয়ে নিজে খায়, বাচ্চাটিকে খাওয়ায়। তারপর ওইদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। সাইকেল রিকশায় বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে উভয়ে ইস্টিশানের পথ ধরে। অনেকখানি রাস্তা।

দিনমান শুনসান। মাঠের মধ্যে কত্তকালের বাগানবাড়ি। জন নেই, মনিষ্যি নেই, কে-ই বা আসবে আর কেনই বা আসবে? কারোই তো এদানি দরকার পড়ে না বিয়েতে ছিরি গড়বার কি পিঁড়ে আলপনা দেবার মচ্ছবের লাফরা রাঁধবার কি ষোড়শের দান সাজাবার! নেই কাজ তো খই ভাজ এ-হেন লোকই বা কই যে কেউ একজন যে-কেউ একমুখ আহ্লাদে হাসি হেসে ভেতর দালানে এসে উঠবে, লৌকিকতার সন্দেশটি খেয়ে গেলাসের জল নিজ হাতে গড়িয়ে নিতে হবে, এঁটো রেকাবি গেলাস দাওয়ার তলায় নিজ হাতে নামিয়ে রাখতে হবে একথা জেনেও? লাবণ্য তো এঁটোকাঁটা কুঁজোয় হাত দেবে না, লৌকিকতার থালা গেলাসগুলি ছুঁলেও অবেলায় চান করে মরতে হবে। সুতরাং দিনমান শনশনে হাওয়ায় দরজা নড়ে, জানলা নড়ে, পুরনো কবজায় তেল না দেওয়া গরুর গাড়ির চাকার আওয়াজ ওঠে। গরমের দিনে মাঠের বুক থেকে ভাপ ওঠে, ধুলোর ঝড় ওঠে, কুঠরির চারপাশে পেতনির কান্নার মতো শব্দ করে করে ঘোরে। শীতের দিনে রুখুরুখু উত্তুরে বাতাস দেয়। বাড়ির ঝনকাঠটার সুদ্ধু চোখ শুকোয়, মুখ শুকোয়, ঠোঁট ফাটে, বুক ফাটে। আওয়াজে ভয় পেয়ে কোণের ঘর থেকে একটি রুগীমানুষ জড়ানো গলায় ডাক পাড়তে থাকে, ডাকতে ডাকতে গাল পাড়ে। গালিগালাজে জীবনভর অভ্যেস, গালিতে এযাত্রা আর কুলুবে না বুঝে শেষে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদে। ঘরের মধ্যে থেকে একচোখ ঠাণ্ডা চাউনি দিয়ে লাবণ্য রুগীর শয্যাটুকু দেখে। হাত বাড়িয়ে উত্তুরে জানলাগুলি বন্ধ করে দেয়। দেওয়া হলে হাত দুটি গুটিয়ে-সুটিয়ে আবার যেখানকার জিনিস সেখানে।

মাঠের এপারে যদি বাড়ি তো ওপারে পেছন বাগে দেখো এক পড়ো পাঁচিল। পাঁচিলের ওধারে কাদের জমি। দেখেও না, শোনেও না, আসা-আসির তত্ত্বতালাশির বালাই নেই। জমি ভরে শনশনিয়ে চিরণ গাছ, গাব গাছ, মহানিম, কদম্ব, পুটুস ঝাড়। শেয়ালকাঁটা, পাথরকুচি। গাছে গাছ, লতায় পাতায় গাছে আগাছায় জড়াজড়ি। রাজ্যির আবর্জনা সাতখানা পাড়ার লোক এইখানে বে-ওয়ারিশ জমি পেয়ে ফেলে যায়। ফুটো হাঁড়ি, মেটে-কলসী, ডেও-ঢাকনা, ল্যাজামুড়ো ভাঙা কল। উলুরিধুলুরি কাঁথা মাদুর, কহতব্য নয় এতো জঞ্জাল। সব জঞ্জালই শেষে মাটিতে টেনে নেয়। নিয়ে তার ওপরে এটা ওটা সেটার চারা বানায়। কিসের চারা? দেশঘরের লোকজন দু-বেলা তাদের নিয়ে ঘর করলেও নাম-ধাম জানে না, ধার ধারে না। উদ্ভিদবিদ্যার লোক পাতা দেখে, ফুল ছিঁড়ে, ফল চিরে, বিদঘুটে এক বিদেশি নামের নামতা হাঁকতে পারে, তাতে কার দরকার? ভাঙা পাঁচিলের একধারে রিকশা ভাগাড়, আর একদিকে গুটিকয় গোটা রিকশার আস্তাবল। খান দু-চার হোগলার ঘর গেরস্তি। নি-মালিক ভাঙা পাঁচিলে বছর ভর ঘুঁটে ভট্‌ভট্ করে। গোবরের সঙ্গে মাটি, তার সঙ্গে বিচালি মিশিয়ে খাস্তা খাস্তা নানখাটাই সদৃশ ঘুঁটে গড়ে পাঁচ আঙুলের ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া থাবায় রামধনিয়ার বউ জান্‌কি বাই। আপাতত জান্‌কিও নেই। বাইও নেই। ঘুঁটেউলি। এক পা গোবর, এক হাত খাড়ু, লাল-নীল-বেগনি-সবুজ ছাপের কাপড় খালি গায়ে জড়িয়ে, গলায় ইয়ামোটা রুপোর হাঁসুলি, বহু সেই ডাকেই বহুত খুঁশি আছে। হাঁ! তার রুখুসুখু লাল চুলের খাঁজে খাঁজে ধুলো, মোটাসোটা মুখের ভাঁজে হাসি ধরে না।

খুব ভোরে বরফ-ঠাণ্ডা পাতকোর জলে চান সেরে নেয় লাবণ্য। ধোপাবাড়ির কাচা কস্তাপেড়ে শাড়িখানা ঘরের কলে জলকাচা করে কুঁচিয়ে আলনায় রাখা থাকে। ভিজে কাপড়ে শানের মেঝেতে গোটা গোটা পায়ের জলছাপ ফেলতে ফেলতে ঘরে গিয়ে সেই শাড়িখান আদুল গায়ে জড়ায়, পুব আকাশে রঙছোপ লাগবার আগেই ফুলতোলাটি সারতে হবে নইলে ফুলের ওপর শিশির শুকিয়ে যাবে, আকাশের জলে ধোয়া ফুল ব্যাভার না করা মানে আধোয়া, অশুদ্ধ ফুলে পুজো করা। অমন পুজো কি না কল্লেই নয়? তা ছাড়া মোটাসোটা লাটিমের মতো এক ন্যাদশ বাচ্চা আছে। উঠলেই খলখলিয়ে গাছ ছোঁবে, ফুল ছোঁবে। লাবণ্যর কাপড়চোপড় হাত-পা, হাড়-চামড়া, বাগানের মাটি, ঘরের শান, সবসুদ্ধ এড়া বাসি হয়ে যাবে। তাই এই পাখ ডাকার আগে ঊষা ভোরে ফুল কটি পেতলের সাজিতে তুলে ফেলা। লাবণ্যর পুজোর সময় ঠাকুর ঘরের আগল দেয়া থাকে। সারা বাড়ি তোলপাড় করে এই সময়ে জাম্বো, এত্তখানি বাচ্চাটা। করে-টরে ঠাকুরঘরের দরজায় কান পেতে হাসে। এত শয়তান! ‘মা শোনো, বাবা শোনো, ঠাকুম পুজো করছে না হাতি করছে। কার সঙ্গে ঝগড়া করছে দ্যাখো।’ বউটি বকে। বকে-টকে কূল না পেলে শেষে কুতূহলী হয়, দরজায় কান পেতে সেও দাঁড়িয়ে পড়ে। বাস্তবিক! কথা পস্ট বোঝা যায় না। কিন্তু যে লাবণ্যর সারাদিন মুখে রা থাকে না ঠাকুরঘরের মাঝ-মধ্যিখানে সে যেন কার-না-কার সঙ্গে ধুন্ধুমার ঝগড়া লাগিয়েছে। এ তো আর সেকাল নয় যে, বউ বিশ্বাস করে বসবে যে ঠাকুরঘরের বালগোপাল কি রক্ষেকালী জ্যান্ত হয়েছেন, আর তাঁরই সঙ্গে মানুষটির ভাবের বচসা!

‘পরন্তপ! পরন্তপ!’ ফল-বাতাসা নিতে সরু গলায় ডাক দেয় লাবণ্য সারা দিনের মধ্যে এই একটিবার। ভেতরবাড়ি থেকে বারবাড়িতে সে ডাক পৌঁছুতে সময় লাগে। রাঁধতে রাঁধতে বউটি এসে দাঁড়ায়। জাম্বো এসে চট করে পা ছুঁতে যায়। —‘ছুঁসনে, ছুঁসনে, যাঃ। ছুঁলি তো? কি বেয়াড়া ছেলের রীত বাবা, বাসি হেগো মানবে না, চোপর দিন আগাড়ে-ভাগাড়ে ঘুরছে।’ গজগজানি ক্রমে বেড়ে যেতে থাকলে বউটি বলবে—‘আপনার পুজো তো সারাই মা, চান করে ছুঁয়েছে বই তো নয়, আর ছোঁয়াও তো নয়, পেসাদ খেয়ে পেন্নাম। ওরও তো সাধ যায়!’

লাবণ্য রাগের গলায় বলে—‘চান করা তো কি! বাসি কাপড়ে আলনা থেকে জামা-কাপড় নিয়ে কলঘরে যায়নি?’

বউ বলে—‘না তো মা, আমিই তো কাচা-কাপড়ে দিয়ে এলুম।’

—‘তোমার ঘরে বিছানা পাতা আছে না? যে ঘরে চোপর দিন বাসি বিছানা, ছাড়া-কাপড়, সিগ্রেটের এঁটো ছাইদান সে ঘরের কাচা কাপড় কি আদপেই কাচা কাপড় বউমা! সে যাক। ছুঁয়েছে তো ছুঁয়েছে এখন আর পেসাদ খাবো না।’

বউটি বলে—‘কোন ভোরে উঠেছেন মা, এখুনি তো আবার রুগী নিয়ে পড়তে হবে। কিছু মুখে দেবেন না? ছি, ছি জাম্বো, কি করলি বল তো?’

উদাস গলায় লাবণ্য বলে—‘বকো না ছেলেমানুষ। একটা দিন একটু বেলা করে খেলে আমার পেট ক্ষয়ে যাবে না। যাও, কাজে যাও।’

বললে পেত্যয় যাবে না। রোগা হাড়ে ওই অতখানি রুগীটিকে লাবণ্য একলা সামলায়। মানুষটি রোগে ভোগে এখন ঝরে গেছে, সেকথা ঠিক। কিন্তু হাড়ের কাঠামোখানা যাবে কোথায়? আড়ে দীঘে সে তত পেল্লাই? তার ওপর অঙ্গ পড়ে গিয়ে কবজায় কবজায় জং ধরে গেছে। অঙ্গগুলির মধ্যে সাড় যেমন নেই তেমন প্রাণটিও তো নেই! মরা হাত-পায়ের ওজন কি কম? লোকটির মা এই ক’ বছর আগেও বেঁচেছিল। ডাক্তারের ঘরের মেয়ে, লাবণ্যকে বুঝ দিত ‘ভয় কি বউ? বাঁ অঙ্গ গেলে বাঁচে না, পৈতে কাটার মতো বাঁড়ে ডাইনে পড়লে ক’ ঘণ্টাতেই রুগী সাবাড়, কিন্তু ডান অঙ্গ পড়লে তোমার রুগী টিকবে বছরের পর বছর, বছরের পর বছর। কতো পুণ্যি করবে, করো না।’

তা সেই পুণ্যিই আজ এগার বচ্ছর করছে লাবণ্য। পুজোটি সেরে রুগীর ঘরে ঢোকে। এককালের তাপের দাপের মানুষটি তখন হাঁ করে বাঁ কাতে ঘুমোচ্ছে, মুখের দু কষ বেয়ে লাল গড়িয়ে গড়িয়ে বালিশ আধভিজে। তার ওপর ভিন ভিন করছে পুঁয়ো মাছি। বেড়প্যান, চান করার গামলা, গরম জলের বালতি, বোরিকের পাউডার, ফতুয়া, লুঙি—সব যোগাড়-যন্তর সারা হলে লাবণ্য গলা খাঁকারি দেয়। তারপর মানুষটিকে চাগিয়ে ধরে কাজকর্ম সারে। এ সময়ে তার মুখের ভাব পাথরের ঠাকুরের মতো হয়ে যায়।

সাতকোশ আটকোশ রিক্‌শা চালিয়ে এসে গরমের দিনে গামছাখানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খাচ্ছে রামধনিয়া।

—‘বহু, এ বহু, রুটি গড়বি নাই? ডাল পাকাবি নাই?’

জান্‌কি তখন মনের সুখে ঘঁটে দেওয়া শেষ করে গুল দিচ্ছে। আশপাশের বাড়ির অর্ডারি গুল। কয়লার ঘেঁস, পড়ো জমির মাটি, ঘন থকথকে ফ্যান, মেখে মেখে ছোট্ট ছোট্ট গুল। ধাঁই ধাঁই করে আঁচ উঠবে, সাঁই সাঁই করে রুটি ফুলবে। হাজার গুলে পাঁচ টাকা রেট। জান্‌কির খানা-পাকানোয় মন নেই। যত গুল দেবে তত টাকা, যত ঘুঁটে দেবে তত টাকা, তত খাড়ু, তত ছাপের কাপড়, তত কাচের চুড়ি। দেশে ঘরে জোওয়ার আছে, ড়হর আছে, মকাই আছে, খাও না। রামধনিয়া বেশি গালিগালাজ করলে এক সময় জান্‌কি বোম্বাই ফজলির মতো মুখখানা ঘুরিয়ে হাতের কয়লা, গোবর পাছ-কাপড়ে মুছে টিউকলে হাত ধোয়, মুখ ধোয়, চুলের খাঁজ থেকে চারটি উকুন বার করে টিপ করে ধরে মারে। তারপর কানা-উঁচু কলাইয়ের সানকিতে ছাতু মাখতে বসে।

ঠিক দুপুরবেলা লাবণ্যর তিনবারের চান সারা। সকালে পুজোর আগে একবার, রুগী চান করানোর পর গু-মুতের ছোঁয়া দেহখানিকে ঝামা দিয়ে ঘষে ঘষে দুবার, ভাত খাওয়া সকড়ি কাপড়টি ছাড়ার পর তিনবার। সেরে লাবণ্য যখন ঘরে ওঠে তখন মাথার ওপর তিনটি-চারটি চিল ঘোরে, ঘুরে ঘুরে কিসের নেশায় অনেক ওপরে উঠে যায়, লাবণ্যর লম্বা গরাদের জানলার ফ্রেমে কাটাকুটি খেলতে থাকে, চিলের হ্রেষা অনেক মিটার উঁচু শূন্যের পাহাড় থেকে ঝাঁপ খায়, ভাসতে ভাসতে সোজা পৌঁছে যায়, লাবণ্যর বুকের কুঠরিখানিতে। লাবণ্য একখানা রাক্ষুসে-ঢেউ সুমুদ্দুরে কলার ডোঙার মত ওলট-পালট খায়। ভাসতে ভাসতে কোত্থেকে কোথায় চলে যায়, সে কি জন্মের আগের দেশ? না মরণের পরের? অ্যাত্তো বড় সুমুদ্দুরে হায় এইটুকুনি প্রাণ! ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল? সাদার, ওপর হলুদ টিপ টিপ খুকু-ফ্রক, পাঁকের মত নরম, ঠাণ্ডা, আস্তে আস্তে শক্ত কাঠ হয়ে যায়, ভাসতে ভাসতে অকুল সমুদ্দুরে কোথায় যে চলে যায় এলোচুল আধপোড়া শিশুর মড়া এক! শীতদুপুরের ঘুমের চটকা মাছির ভ্যানভ্যানানিতে ভেঙে যায়। লাবণ্যর শুকনো চোয়ালে চোখের জলের নুনটুকু শুকিয়ে আছে, তারই ওপর মাছির লালচ। তারই জন্য লাবণ্যর সমুদ্দুরের শেষটুকু দেখা হল না। উঁচু হাড়ে চাপড় মেরে ভুরু কুঁচকে লাবণ্য বলে ‘মর মর, গুয়োর বেটা মর।’ পরক্ষণেই আকাশমুখো হয়ে বলে ওঠে—‘ষাট, ষাট, ষাটের বাছা ষাট!’

যে ছেলেটির ঘরে বিছানা থাকায়, ছাইদানি থাকায় ঘরটি চিরজন্মের মতো বাসি এঁটো হয়ে গেছে সেটি লাবণ্যরই সন্তান। তবে অভ্যাসের সন্তান। সন্তান বস্তুত অনেক প্রকার। বিস্ময়ের, আনন্দ-আকাঙক্ষার, আগ্রহ ও বাঞ্ছার, তারপর অভ্যাসের, উদাসীনতার। পরন্তপ তাই তার বাপ-মা’র অভ্যাসের সন্তান। কিন্তু যতই হোক পুরুষ ছেলে তাই সাতটির পর আটটিতেও পরন্তপের ঠাকুমা পুজো দিয়ে ঘটাপটার অন্নপ্রাশন করলে। মা-ঠাকুমার দু-তিন আলমারি কাপড়-চোপর, তিন চারখানা বিছানা বালিশ ওইটুকু ছেলে তার দাদাদেরই মতো হুলুট থুলুট করতে থাকায় লাবণ্য, তখন উত্তর-তিরিশ ধমকালে, ছেলের বাবার কাছ থেকে চোপ্, ঠাকুমার কাছ থেকে চোখ রাঙানি খেয়ে-টেয়ে, ভুরু কুঁচকে ঘর ঝাড় দিতে চলে গেল।

চার-পাঁচটি ছেলে-মেয়ে উড়ো খইয়ের মতো দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে, কে কোথায়, কমনে অতশত লাবণ্যর আজকাল হুঁশ থাকে না। তাদের বাপের, তাদের ঠাকুমার থাকুক গিয়ে। ঠিকুজি, কুলুজি, জ্ঞাত-গোত্তর, আর পারি না বাবা! মাঝে মাঝে এসে সব হাঁকডাক করে নিজেদেরই গরজে। ছেলে ক’টির হাঁকডাকে লাবণ্য আজকাল ঘাবড়ায় না, বাড়িটি তার স্ত্রীধন এবং সে কাগজ আলমারির ভেতর খোপে ভেলভেট বাক্সয় তোলা আছে এইটুকু বুঝে। মেয়েগুলি বলে, ‘মা আমাদের দেখতে পারে না।’ আরও বলে তাদের দারুণ জামাইরা, বৌরাও ‘অমন মা জন্মে দেখিনি।’ লাবণ্যর কানে এসব কথা যায় কি না যায় বলা যায় না। কারণ তার ভেতর বাড়ির নিরমিষ্যি হেঁসেলে সে প্রাণ গেলেও কারুকে ঢুকতে দেবে না। এসো, থাকো, খাও, মাখো। সব ওদিকে। এদিক পানে ঘেঁষতে এসো না। মেজ মেয়ে অন্নপূর্ণা বলে—‘মা আমি চান করে, খেঁটের কাপড় পরে আজ তোমার রান্নাটা করে দিই’? মা শুধু ভুরু কুঁচকে তাকায়। মনে মনে বলে—‘মরি মরি! এতো ভাগ্যি আমার কোথায় ছিল মা এতগুলি দিন! বলি খেঁটের কাপড় যে পরবে, তোমার শরীরের কাঠামোখানি শুদ্ধু যে অশুদ্ধু ম্লেচ্ছসঙ্গ করে করে সে কথা কি মনে রেখেছ মা? মেজ জামাই, যার সুটপরা গায়ে গোবরগোলা গঙ্গাজল ঢেলে দিয়েছিল লাবণ্য মুরগী খেয়ে আসায়, সে আসে না যদিও।

বর্ষার বিকেলে কাসুন্দের মাঠ যখন জটাইবুড়ি হচ্ছে ধীরে, সন্ধে যেন ঘোলা জল, বাতাস যেন ধোঁয়া, মাটি থেকে আঁশ গন্ধ, যখন জান্‌কি হাঁকে—‘মায়ি, হে মায়ি। ঘুঁটে লিবি নাই? সুখা ঘুঁটে!’ কুঠরি থেকে লাবণ্য কচ্ছপের মতন মুখ বাড়িয়ে দেখল পরন্তপের বউ এখনও আপিস করে ফেরেনি। ঘুঁটেউলি ঘুঁটে সাজাতে আরম্ভ করে দিয়েছে—‘গিনতি্ করে লিন মা। দো…চার…ছে… আঠ…।’

জানকির কোমরের কাছে এক কন্যে।

—‘অ বউ, তোর কোমরের কাছে ঘুনশির মতো ওটা কে রে?’

—‘হমার নাৎনি আছে মা।’

—‘তোর আবার মেয়ে কবে হল যে নাতনি?’

—‘হাঁ মা। দেহাতে থাকে, ঢোলিসাকারা, মন্‌হরপট্টিয়া, মায়ি। খরা হল, হাঁতিয়া হল না, ঘঁনুয়া ধান ভি উঠল না-ই। গরমেন্টের ডোল ভি মিলল নাই। পাঁচটা, ছেটা আন্ডা বাচ্চা, ইটাকে হমার পাস ভেজ দিয়েছে। হাঁ!

—‘কি নাম রে?’

—‘হ্যাঁরে, নাম বোল্ না তেরি। এ মায়ি বহুত্ দোয়া আছে।’

কন্যেটি ক্রমশই জান্‌কির বিশাল কোমরের পেছনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে।

—‘ও নুকুচ্ছে কেন রে বউ? থাক বাবা, নাম জিজ্ঞেস করব না আর, নুকুস নি।’ জান্‌কির কোমরের পেছন থেকে মিহি গলায় আওয়াজ আসে—‘সোনবত্তিয়া’

—‘কি বললি? কি পাতিয়া?’

—‘সোনবত্তিয়া, সোনাবাতি হুজুর,’ জান্‌কির হাসি রুপোর হাঁসুলি অব্দি ছড়িয়ে যাচ্ছে, ‘বাপে কালো, মায়ে কালো, বিটিয়া গোরী মায়ি, ইসলিয়ে সোনাবাত্তি।’

দুপুর দুটোর সময় খিড়কির দুয়ারে, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে বাঁকারির মতো পলকা পিঠখানা উঁচু করে অতঃপর লাবণ্য ডাকে—‘সোনাবাতি! এই সোনাবাতি!’ …‘সোনবত্তিয়া রে-এ-এ!’ জান্‌কির বাজখাঁই গলার ডাক লাবণ্যর মিহি ডাকের সঙ্গে মিলেমিশে যায়, ঠিক যেন মাঝদুপুরে নি-হাওয়ার দেশ থেকে চিলের ডাক ঝাঁপ খেয়ে পড়ছে কাসুন্দের মাঠে। ক্রমেই জোরালো হচ্ছে, গাছ-পালায় ধাক্কা খেতে খেতে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে দূরে-দূরান্তরে। আনাচ-কানাচ সব ভরে যাচ্ছে। সোনবত্তিয়া… সোনাবাত্তি রে-এ-এ-। হাওয়ার সমুদ্র থেকে জলের সমুদ্র, বহু দুঃখের জল যা স্বপ্নের ফেরে বারংবার দেখা যায়, সেই জলের উথাল ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে একখানি ছোট্ট ডিঙি শেষ পর্যন্ত ডাঙায় এসে লাগে। ছোট্ট লাফ লাফিয়ে নামে একটি এক বুক আগ্রহ আকাঙক্ষা ও ভালোবাসার সন্তান।

ঘুঁটেউলির গোরী নাতনী ফণিমনসার বিপজ্জনক ঝোপের আড়াল থেকে মুখটা একবার বাড়ায় একবার লুকোয়, একবার বাড়ায় একবার লুকোয়। তারপর খিলখিল হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। কলাইয়ের থালায় লাবণ্য তার নিরমিষ্যি হেঁসেলের যাবতীয় রান্না ধরে দিয়েছে। ডালের সঙ্গে চচ্চড়ি তার সঙ্গে ঘণ্ট তার সঙ্গে তেঁতুলের টক মেখে তাগাড় করে ফেলে সোনাবাতি, ছোট ছোট মুঠিতে তুলে কব্‌জির কাছ থেকে খায়। কিছুক্ষণ হাঁ করে দেখে লাবণ্য। মাথার ওপর মাটিমাখা, চুল দেখে। ময়লা মাখা টিকটিকে মুখখানি দেখে, পিঠ ছেঁড়া ফ্রকটি দেখে আগাগোড়া। তারপর কি জানি কি মনে করে খিড়কির কপাট তুলে দিয়ে ফিরে যায়। মানুষটি বোধহয় হাতের কাছে ঘণ্টি টিপে ডাকছে।

ছুটি কাটাতে এসে বড় তিনটি ছেলে বউ, দুটি মেয়ে, একটি জামাই, তাদের ছেলে-মেয়েরা দূর থেকে গড় করল, কারণ লাবণ্যর পা গাড়ির কাপড়ে ছুঁতে মানা। চিবুক ছুঁয়ে লাবণ্য বলল—‘আহা থাক, থাক ভালো আছো তো সব? তোমাদেরই ঘর, তোমাদেরই বাড়ি, তোমরাই দেখে-শুনে করে কম্মে নাও গে।’ ছেলে-মেয়ে-বউরা এ ওর মুখে চায়, ও এর মুখে চায়। লাবণ্যর গালের হাড়ে এবার মাস লেগেছে, কণ্ঠা ঢাকে ঢাকে। মেয়ে বউদের করে-কম্মে নিতে বললেও লাবণ্য বড়ি দেয়, আচার মাখে, পিঠে-পুলির নারকেল কোরে, কিসের সঙ্গে কি মিশিয়ে অদ্ভুত সোয়াদের সব দিশি রান্না রাঁধে, তার গন্ধে নাতি-নাতনিদের লাল ঝরে, কাসুন্দের মাঠ দিয়ে পথচলতি লোক চমকে চমকে বাতাস শোঁকে, হাত পাখার হাওয়া দিয়ে দিয়ে রুগী মানুষের বিছানা থেকে লাবণ্য মাছি তাড়ায়। মেয়েরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, ছেলেগুলি নিশ্চিন্তে পায়ের ওপর পা দিয়ে কেউ পান চিবোতে চিবোতে, কেউ সিগরেট ফুঁকতে ফুঁকতে, যার যে রকম নেশা, দুপুর ঘুম ঘুমোয়।

ধাক্কা দেওয়া শান্তিপুরী শাড়ি পরেছে লাবণ্য অনেকদিন পর। মুখে জর্দাপান দিয়ে দুপুরের জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে। ছোট ছোট ধুলোর ঘূর্ণি উঠছে মাঠে, পাঁচিলের ঘুঁটের ওপর ধুলোর সর, তিড়িংবিড়িং বিড়িং নাচছে শালিখ, একটা দুটো তিনটে চারটে। নোদল গোদল হেঁটে বেড়াচ্ছে গোলা পায়রা। কি খুঁটে খাচ্ছে তা সে-ই জানে, গাছের ডালে ঘুঘুর গলায় রামধনু চিকমিক করছে, ওপর ডালে দুপুর কাক, সহসা ডাকছে না, মাঝে মধ্যে আকাশপানে গলা তুলে হাঁ এর মধ্যের টুকটুকে লাল রং বার করে বলে উঠছে খ্যা খ্যা, খ্যা-অ্যা। গলা দিব্যি সুরে বলছে। ধুলোর মধ্যে সবুজ কাচের চুড়ি দুলিয়ে, ছেঁড়া ফ্রক ঘুরিয়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে সোনাবাতি। পিঠে বোতাম নেই। সোনারঙের পিঠের ওপর অনেকদিনের নোংরার জালি। সোনারঙের জট পাকানো চুলগুলি কিলবিল করছে মাথাময়। পান চিবোতে চিবোতে জর্দার রসে নেশা ধরে। ডলপুতুল নিয়ে লাবণ্য কখনও বুকে আঁকড়ায়, কখনও বালিশে শোয়ায়, রান্নাবাটি নিয়ে সারা দুপুর খেলে, আবার মাথার চুল সামনে ঝুলিয়ে হাতের ওপর চাবির গোছা নিয়ে এতোল বেতোল, তামাক তে তোল করে। লাবণ্যর চারপাশে খেলে বেড়ায় সাদা ফ্রক, হলুদ টিপ-ছাপ, ছোট ছোট চুলে, হলুদ কিলিপ, খিলখিলিয়ে হাসে। লাবণ্য ঘুমচোখে আলমারি খুলে সেই ফ্রকটি বার করে, সেই পুতুলটি বার করে, করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। সোনাবাতি প্রথম হেমন্তের দিনে সে বছর গোটাগুটি একটি ফ্রক পায়। একটি পুতুল পায়। একটি নীল গলাবন্ধ সোয়েটারসুদ্ধু পেয়ে যায়।

কাসুন্দের মাঠের দিন এ শীতে অন্য রকম। রাতও তেমন রাত নয়। গভীর রাত পর্যন্ত তাসখেলা চলে। এই সেদিন সত্যনারায়ণের শিন্নি হল। চরণামিত্তির খেয়ে, শান্তির জল নিয়ে লাবণ্য নিজের হাতে কাঠের হাতায় শিন্নি ঘুঁটল। দুপুরবেলা বাপের ঘরে বসে গপ্প করছে বৌ-ঝি’রা। মানুষটি কথা বলতে পারে না, চেয়ে চেয়ে দেখে। চোখের কোলে খুশি। লাবণ্য কুঠরি থেকে বেরিয়ে এসেছে। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে কাজ, নাতি-নাতনিদের গল্প বলা… ‘দত্যি ছিল সত্যি সত্যি?’

‘—রাক্ষসে আর দৈত্যে কি তফাৎ দিদুম?’

‘—বাপরে! কি একটা তফাৎ? রাক্ষসের দাঁত দু পাশ থেকে হাতির মতন বেরিয়ে থাকে। দত্যির দাঁত মুখের মধ্যে নুকুনো। রাক্ষসের মাথায় দুটো শিং। দত্যির মাথায় একটা। শিং ঢাকতে দত্যি কান মাথা ঢাকা টুপি করে, মানুষের মধ্যে বড়সড় মানুষটা সেজে ঘুরে বেড়ায়।

—‘ও ঠাকুম, রাক্কসের গায়ে বেশি জোর না খোক্কসের?’

—‘বলা কঠিন বাপু, তবে খোক্কসের পা ছিনে-পড়া, রাক্ষসের পা গোদা গোদা, ভীমের গদার মতো, এখন বুঝে দ্যাখো।’

বহুদিন আগেকার হাওয়া-খাওয়া পোর্সিলেনের মেমপুতুল, কুকুর নিয়ে বেড়াতে যাওয়া সাহেবপুতুল ক্রূসের ওপর যিশুপুতুল, কাচের টাঙাগাড়ি, পুতুলের জুতো, যক্ষির ধন সব লাবণ্য বার করে দেয়। মায়েরা বলে—‘সাবধানে খেলো, মায়ের যতুকের জিনিস সব।’ কোন কোন মা আবার ছেলেমেয়ের অনেক আপত্তি ও কান্নাকাটি সত্ত্বেও সে-সব পুতুল তোয়ালে মুড়ে সুটকেসে তুলে রাখে। এসব জিনিস আর আজকাল পাওয়া যায় না। অ্যান্টিক হয়ে গেছে। জামাইরা বোদ্ধার গলায় বলাবলি করে। কে কি বলল, কার জিনিস কম্‌নে রাখল, লাবণ্যর আর হুঁশ নেই। কদ্দিন আর জিনিস তাংড়াবে? জিনিস বলতে এক আলমারি দুর্মূল্য সেকালের কাচ পাথরের পুতুল, কাঠের, লোহার খেলনা সব, ন্যাপথলিন কালো জিরে-শুকনো লংকা দিয়ে জিইয়ে-রাখা ছোট ছোট কাপড়জামা। লেপ কাঁথা, তা ছাড়া আলমারির গুপ্ত খোপে ছোট ছোট চুড়ি-বালা-মটরমালা-আংটি মাদুলি। যার জিনিস তার ছাড়া কারও অঙ্গে ওঠেনি। খাওয়া-দাওয়ার পর সকড়ি-কাপড় ছাড়ার হাঙ্গামা লাবণ্য এদানি করছে না। দুপুরঘুমের স্বপ্নটুকু লেপে পুঁছে একাকার। দরজার হুড়কো তুলে দিয়েই জানলার কপাট খুলে দেয়। ছিট ছিট ফ্রক। নীল সোয়েটার ভাঙা রিক্‌শার খোঁদলে পুতুলের সংসার পেতেছে। রামধনিয়া ডাকে—এ সোনাবাত্তি, পানি দিবি নাই?’ জান্‌কি হাঁকে—‘সোনাবাত্তিয়া-আ আটা ডল্‌বি নাই?’ সাড়া মেলে না। কেমন নিবিড় নিশ্চিন্দি খেলা দেখো! খাওয়া নেই দাওয়া নেই। সারা দিন গুলি খেলা-ঘুড়ি খেলা…পুতুল খেলা। পুতুলের বালিশ-বিছানা, তোষক মশারি সুদ্ধু মায়ির সাবেকি আলমারির গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসেছে। এ মায়ি বহুত্ দোয়া আছে। হাঁ! টই-টই করে শীতের মাঠ চষে বেড়ায় দুখানি পাতলা পাতলা খালি পা। খালিপায়ে ঘুণ্টি দেওয়া লাল জুতুয়া দেখতে সাধ যায়। গোলাপি মোজা। গোলাপি টুপি, কান-ঢাকা ডগা উঁচু, কানাঅলা, কতরকম, কত্তরকম দেখতে সাধ যায়। লাবণ্য জানলার গরাদ ধরে সারা দুপুর একবার পরায়, একবার খোলে। একবার খোলে, একবার পরায়। তার গলা ধরে মিষ্টি মিষ্টি দুটি হাত সারা দুপুর দোল খায়, শুকনো গালে, কপালে, চিবুকে মিটি দেয়। লাবণ্য স্বপ্নহীন অঘোর ঘুমে ঢলে পড়ে, ঠোঁটের কোণা চিকমিক করে।

হিম ক্রমেই জমাট হচ্ছে। মাঠের মাঝে মাঝে জমাট হিমের হিমপাহাড়। অনেক বেলা করে রোদ উঠছে। বড়ি শুকোতে চায় না, আচার ভটভট করে, জামা-কাপড়ে স্যাঁতা লেগে যায়, বর্ষার দিনের মতো জুতোয় ছাতা ধরে যায়, এতো আঠা হাওয়ায়। ঘরের মধ্যে মালসা-আগুন, তবু রুগী নাকের জলে চোখের জলে। রুগীর আর দোষ কি। তার ধাইটিই তো জ্বরে কাবু। জবুথবু। ভোরের চানে ঠাণ্ডা লেগে বুকে সর্দি। ঘঙ্ ঘঙ্ খক্ খক্। রুগীটি বুঝি দেখাশোনার অভাবে বুড়ো গাছের শেষ পাতাটির মতো ঝরে খসে গেল। ডাক্তার এসে লাবণ্যর বুকে নল বসাচ্ছে। লাক্ ডুপ্ লাব্ ডুপ্ দিব্যি উঠছিল। উঠতে উঠতে হঠাৎ-হঠাৎ ফ্যাঁস্ করে কেমনতরো একটা বেখাপ্পা আওয়াজ উঠছে। মুড়ি-সুড়ি দিয়ে কড়া কড়া ওষুধ গিলে কাঠের মতো পড়ে থাকে লাবণ্য। দুবেলা গরম গরম সুরুয়া খায় চুপচাপ। জামাই চলে গেছে। ছেলেগুলিও গেছে। মেয়ে বউগুলি সব যায়নি। বাড়িতে দুটি রুগী। পরন্তপের বউ একলা ক’দিক সামলায়? তার ওপর আবার চাকুরে মানুষ!

তা শীতের বুড়ির মাথার খেয়াল! মাথার পোকা নড়ল তো ঝপ্ করে কাঁথা কম্বল নামিয়ে দেবে, আবার পোকা ঘুমোল তো মিঠে আঁচে সেঁকে সেঁকে তুলবে মাটির তাওয়ায় মাঠের মাটি। তাই একদিন বাদুলে কাঁদুনে ঠাণ্ডার জলো পর্দাখান টান মেরে সরিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশ লম্ফ দিয়ে নামে। ঘাসের শিশিরে ফুরফুরে সব হালকা মেঘের ছায়া পড়ে। গায়ের ব্যথা মরেছে, কাশি ধরেছে, জ্বর নেমেছে। লাবণ্য বুঝি এবারের ধাক্কা সামলে নিল।

—‘পায়ের দিকের জানলাটুকু খুলে দাও তো মা…’

‘—উত্তুরে জানলা যে মা, হাড়অব্দি হিম হয়ে যাবে…।’

—‘তা হোক দাও গে একবার, ঘরে কদ্দিনের স্যাঁতা…।’

জানলার কপাট খুলতেই ভলকে ভলকে রোদ এসে ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়, হাউ-হাউ আওয়াজ ঢোকে পিছু পিছু। কিন্তু রোদের তেজে তার বঁটিতে আর শান নেই। টলর্ টলর্ পায়ে লাবণ্য গরাদ ধরে দাঁড়ায়। চিরণ গাছের মাথায় একটা বাদামি চিল, গোদা লোমশ পায়ের থাবা থেকে সদ্য-মারা মেঠে ইঁদুর ঝুলছে। ফেলে-যাওয়া কাকের বাসাখান দোল খাচ্ছে পাতাঝরা নিমের শুকনো-শাকনা ডালে। পড়ো পাঁচিলের গায়ে জান্‌কি দেখো একমনে থাবড়া থাবড়া গোবর মেরে যাচ্ছে। রামধনিয়ার মুখে চুট্টা। কাঁধে, গামছা। জাড়ের দিনে ধূপে বসে আয়েস করছে দুপুরবেলা। এখন সোয়ারি লিবে নাই। আপিস-টাইমে ঠিকঠাক টিশনে হাজিরা দিবে। ওই তো জান্‌কি উঠল, মাথায় বিঁড়ে, তার ওপর ঝাঁকা, তার ওপর থাক থাক ঘুঁটে। চালির ওপর টাল করে রাখবে আপাতত। আষ্টেপিষ্টে শুখা হোক এখন। ধাঁইধাঁই করে আঁচ উঠবে, শাঁই শাঁই করে রুটি হোবে। ইদিক-উদিক তাকিয়ে অসুখে ভাঙা সরু গলায় লাবণ্য ডাকে—‘সোনাবাতি, সোনাবাতি রে-এ-এ—।’ জান্‌কির মাকড়ি-পরা চওড়া-চওড়া কানে মায়ির ডাক ঠিকঠাক পৌঁছে গেছে। ঝাঁকা সামনে দোতলার জানলার দিকে এক চোখ তুলছে দ্যাখো। —‘সোনাবাত্তি চলি গেলো হুজুর। ই মওশুম মকাই হঁলো, বুঁট হঁলো, খেতিতে কাম করবে মায়ি। ইন্ডাসে ঢেঁকুলে পানি ঢালবে, মকাই কাটবে, মসুরি কাটবে, সাঁড়ি হোবে, চুঁড়ি হোবে। বাপে এলো, চলি গেলো…ঘুঁটিয়া লিবি মায়ি? হেই মা আ!’

জানলার গরাদ থেকে মরাসোনাপরা নীলশির-ওঠা রোগা রোগা হাত দুখানি শীতের শেষ পাতার মতো ঝরে যায়। টলর-টলর পায়ের বিছানায় এসে বসে লাবণ্য।

আট ভাজাসমেত চায়ের বাটিটি বিকেলে পরন্তপের বউ নিয়ে এলে নিম্নরূপ কথোপকথন হয়—

‘চায়ের বাটি মাজলো কে?’

—‘ঝি!’

—‘সেই বাগ্‌দি বেটি? ক’মাস আগে যে বাউনের ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে গিছল?’

—‘সেই তো আছে মা এখনও!’

—‘বাগ্‌দি-বেটির মাজা বাটি কি আদপেই মাজা বাটি বউমা? তাতে কি শুদ্ধু জল দিয়ে হেঁসেলে তুলতে মনে ছিলো?’

বউ চুপ।

—‘রোগে মানুষ অদড় হলে তবে তাকে ছত্তিশ জাতের ছোঁয়া-ন্যাপা নিয়ে জয়-জয় করতে হবে? এ কি অসৈরন কাণ্ড মা!’

আওয়াজ পেয়ে মেয়ে, দুটি বউ এসে দাঁড়ায়, দুপুর-শো-এ তারা কাছের হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল।

—রাস্তার কাপড়েই সব ভেতরে এসে ডাঁড়ালে? কেন, দোরে ডাঁড়াতে কি হয়েছিল?’

গনগনে মুখে লাবণ্য কুলুঙ্গিতে গঙ্গাজলের ঘটি খোঁজে, গোবরমেশানো শুদ্ধির জল খোঁজে, কোষার মধ্যে বিল্বপত্র ডোবায়। শীতের আসন্ন সন্ধ্যায় সমস্ত মানুষজন, বিছানা বালিশ, চালিতে তোলা অতিরিক্ত লেপ-কম্বল, চেয়ার-টেবিল, আলমারি-খাট, মায় বাড়ির দরজা-জানলা, দেয়াল-মেঝে, কড়ি-বরগা সব কিছুর ওপর সে ডিঙি মেরে মেরে গঙ্গাজল ছিটোতে থাকে। ‘নমঃ শিবায়, নমঃ শিবায়, এ কি অসৈরন কাণ্ড মা?’ ছিটিয়ে-টিটিয়ে লাবণ্য হাত গুটোয়, পা গুটোয়, মাথাটি শুদ্ধু কাছিমের মতো গুটিয়ে নেয়, তারপর হাত-পা, মুণ্ডহীন একখানা সৃষ্টিছাড়া ধড় অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে তার বুকের ভেতরের, ভেতরের ভেতরের কুঠরিখানিতে যেখানেও আবার সত্যিকার লাবণ্য থাকবে কি থাকবে না সে কথা স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না।

No comments