পঞ্চভূত – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
মৃত্যুঞ্জয় ও শাশ্বতী—প্রেত দম্পতি। নিত্যানন্দ—জনৈক প্রেত। অবিনাশ—নবাগত প্রেত। অমরনাথ—মানুষ। স্থান—একটি পোড়ো বাড়ির এক কক্ষ। কাল–পূর্ণিমার সন্ধ্যা।
.
কক্ষটি প্রেতলোকের নীলাভ প্রভায় আলোকিত। আলোক তীব্র নয়, অথচ সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যায়। কেবল মেঝে হইতে এক হাত উচু পর্যন্ত অন্ধকার; তাই ঘরের আসবাবগুলি মনে হয় যেন অর্ধনিমজ্জিতভাবে মাথা জাগাইয়া আছে।
পিছনের দেয়ালের মাঝখানে একটি বড় জানালা। কবজা ভাঙিয়া যাওয়ার ফলে জানালার কবাট হেলিয়া খুলিয়া আছে; বাহিরে আবছায়া গাছপালার ভিতর দিয়া চন্দ্রোদয় হইতেছে। ভিতরে, জানালার দুই পাশে, খানিকটা সম্মুখ দিকে, দুইটি পুরানো ধরনের কৌচ। ঘরের ডান দিকের দেয়ালে একটি দরজা, কালো পর্দা দিয়া ঢাকা। বাঁ দিকের দেয়ালের গায়ে সেকেলে গঠনের একটি মেহগনি রঙের ড্রেসিং টেবিল। ঘরের প্রায় মাঝখানে সম্মুখের দিকে একটি ছোট গোলটেবিল ও দুটি চেয়ার রহিয়াছে। সব আসবাবের উপরেই ধূলার প্রলেপ; মনে হয়, দীর্ঘকাল এ ঘরে মানুষ পদার্পণ করে নাই।
ডান দিকের কৌচে শুইয়া শাশ্বতী ঘুমাইতেছে। শুইয়া আছে বলিয়া তাহাকে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে না। তাহার চেহারা মর্তলোকের কুড়ি বছর বয়সের মেয়ের মতো; পরনে নীলাভ শাড়ি। সে পাশ ফিরিয়া হাঁটু গুটাইয়া গালের তলায় করতল রাখিয়া ঘুমাইতেছে।
জানালার বাহিরে একটা পাপিয়া ডাকিয়া উঠিল—পিউ কাঁহা—পিউ কাঁহা—পিউ কাঁহা—
সে থামিতেই একটা পেঁচা ডাকিল-ঘুৎ-ঘুৎ—ঘুৎ!
শাশ্বতী ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া বসিল; এখন তাহার কোমর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা গেল। সে হাই তুলিয়া আড়মোড়া ভাঙিয়া পিছনে জানালার ধারে তাকাইল।
শাশ্বতী : ওমা! কত বেলা হয়ে গেছে—চাঁদ উঠেছে! কী যে আমার ঘুম, কিছুতেই সকাল সকাল ভাঙে না। (অন্য কৌচের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া) উনি কখন উঠে গেছেন। কি দুষ্টু! আমাকে না জাগিয়ে দিয়েই বেরিয়ে যাওয়া হয়েছে—
শাশ্বতী উঠিয়া অলসপদে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল; স্ত্রী-স্বভাববশত নিজের মুখখানি ভাল করিয়া দেখিয়া আঁচলে নাকের পাশ মুছিয়া খোঁপা খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।
শাশ্বতী : না, উনি এখুনি আবার ফিরে আসবেন। আজ দুজনে মিলে বেড়াতে যাব। কোথায় যাব! চাঁদে বেড়াতে যাব? হ্যাঁ, সেই বেশ হবে; অনেকদিন যাইনি—(সানন্দে গাহিয়া উঠিল)
আজ পূর্ণিমারই রাত রে
পাখির কূজনে আমরা দুজনে।
চাঁদের ঘাটে উঠব গিয়ে জ্যোৎস্না-সাগর সাঁৎরে–।
এই পর্যন্ত গাহিয়া বাকি গানটুকু গুন গুন করিয়া গুঞ্জন করিতে করিতে শাশ্বতী চুলের বিনুনী খুলিয়া আবার বাঁধিতে লাগিল। চাঁদ ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বে উঠিতেছে।
কালো পর্দা-ঢাকা দরজা দিয়া মৃত্যুঞ্জয় নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া দরজার সম্মুখে দাঁড়াইল। তাহার বয়স আন্দাজ ত্রিশ; গায়ে ধূসর রঙের পাঞ্জাবি। মুখ অত্যন্ত শুষ্ক ও বিষণ্ণ, যেন এইমাত্র কোনও গুরুতর দুঃসংবাদ শুনিয়াছে, কিন্তু শাশ্বতীকে তাহা বলিতে ভয় পাইতেছে। সে এক-পা এক-পা করিয়া শাশ্বতীর দিকে অগ্রসর হইল।
আয়নায় তাহাকে দেখিতে পাইয়া শাশ্বতী সকৌতুকে হাসিয়া উঠিল; খোঁপা জড়াইতে জড়াইতে বলিল—-
শাশ্বতী : এই যে—ফিরে আসা হয়েছে। একটি কোথায় পালানো হয়েছিল?—আজ কিন্তু চাঁদে বেড়াতে যেতে হবে, তা বলে দিচ্ছি—
মৃত্যুঞ্জয় শাশ্বতীর পিছনে দাঁড়াইয়া একবার অধর লেহন করিল, তারপর ভগ্নস্বরে বলিল—
মৃত্যুঞ্জয় : শাশ্বতী!
চমকাইয়া শাশ্বতী ফিরিয়া দাঁড়াইল। মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ দেখিয়া তাহার মুখেও উৎকণ্ঠার চকিত ছায়া পড়িল; সে মৃত্যুঞ্জয়ের একেবারে কাছে সরিয়া আসিয়া শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল—
শাশ্বতী : কী, কী হয়েছে গা?
মৃত্যুঞ্জয় শাশ্বতীর দুই কাঁধে হাত রাখিয়া একটু ম্লান হাসিল।
মৃত্যুঞ্জয় : আর কি! ডাক এসেছে।
শাশ্বতী : ডাক এসেছে!
মর্মান্তিক সংবাদে শাশ্বতীর মুখখানা যেন শীর্ণ হইয়া গেল। সে বিহ্বলভাবে কিছুক্ষণ মৃত্যুঞ্জয়ের মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া তাহার বুকের উপর মাথা রাখিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
মৃত্যুঞ্জয় : (বিষণ্ণকণ্ঠে) হ্যাঁ, ডাক এসেছে—যেতে হবে। আবার সেই মানুষ জন্ম—সেই ক্ষিদে-তেষ্টা, রোগ-যন্ত্রণা, টাকার জন্যে মারামারি কাড়াকাড়ি, অন্নের জন্যে হাহাকার
শাশ্বতী : বোলো না—বোলো না। (মুখ তুলিয়া) ওগো তুমি চলে যাবে, আমি একলা থাকব কি করে?
মৃত্যুঞ্জয় : কি করবে বল—উপায় তো নেই, নিয়তি—হয়তো তোমারও কোনদিন ডাক পড়বে, তুমি কোথাকার এক মানুষের ঘরে মেয়ে হয়ে জন্মাবে—
শাশ্বতী : (অবসন্নস্বরে) হয়তো তুমি জন্মাবে বাংলা দেশে, আমি জন্মাব তিব্বতে—কেউ কাউকে দেখতে পাব না। তুমি কোন্ একটা মেয়েকে বিয়ে করবে—
মৃত্যুঞ্জয় : আর তুমি কোন একটা তিব্বতী পরিবারে পাঁচ ভায়ের ঘরণী হয়ে বসবে—উঃ! ভাবলেও অসহ্য মনে হয়।
শাশ্বতী : (সবেগে মাথা নাড়িয়া) না না কক্ষনো না। আমি এইখানে, এই ঘরে তোমার জন্যে পথ চেয়ে থাকব। আমি মানুষ হয়ে জন্মাতে চাই না।
মৃত্যুঞ্জয় হতাশভাবে একটা চেয়ারে বসিল।
মৃত্যুঞ্জয় : আমিই কি চাই শাশ্বতী! স্থূল শরীরের বন্ধন থেকে একবার যে মুক্তি পেয়েছে, সে কি আর ফিরে যেতে চায়! ভেবে দেখ দেখি, কি সুখে আমরা আছি। শরীরের ক্ষুধা নেই অথচ তৃপ্তি আছে; বাসনা নেই প্রেম আছে, স্বাধীনতা আছে, অগাধ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আছে। এ ছেড়ে কি আবার ঐ অন্ধকূপে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে? কিন্তু উপায় যে নেই।
শাশ্বতী পিছন হইতে তাহার গলা জড়াইয়া লইল।
শাশ্বতী : এ জীবনের কেবল ঐ এক দুঃখ–কি জানি কবে ফিরে যেতে হবে। আমরা যেন জেলখানার পালিয়ে যাওয়া আসামী, মুক্তির মধ্যেও সদাই ভয়, কখন আবার ধরা পড়ব।
মৃত্যুঞ্জয় উঠিয়া শাশ্বতীর মুখোমুখি দাঁড়াইল।
মৃত্যুঞ্জয় : আর ভেবে কি হবে। যেতেই যখন হবে, তখন মন শক্ত করে তৈরি হওয়াই ভাল। তুমি আমাকে ভুলে যাবে না? আমার জন্যে অপেক্ষা করবে?
শাশ্বতী : ওকথা বলতে পারলে? ভুলে যাব! আমার মন দেখতে পাচ্ছ না? ভুলব না ভুলব না—যখনই ফিরে আসবে, যতদিন পরে ফিরে আসবে, তোমার শাশ্বতী তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে।
মৃত্যুঞ্জয় : (শাশ্বতীর চিবুক তুলিয়া) এই ঘরে?
শাশ্বতী : (মৃত্যুঞ্জয়ের বুকে মুখ গুঁজিয়া) হ্যাঁ—এই ঘরে। এ ঘর ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। মনে আছে, এই ঘরেই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়।
মৃত্যুঞ্জয় : হ্যাঁ, সে আজ কতদিনের কথা। মানবজন্ম থেকে মুক্তি পেয়ে শহরের বাইরে একটা নিরিবিলি আস্তানা খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম। এই বন বাদাড়ের মধ্যে বাড়িটা নজরে পড়ল; নেহাৎ ভাঙা বাড়ি নয়, অথচ লোকজনের যাতায়াত নেই– বাড়ির মালিক বাড়িতে তালা দিয়ে বিদেশে ব্যবসা করতে চলে গেছে। দেখেশুনে বেশ পছন্দ হল। ভেতরে ঢুকেই দেখি—তুমি। ঘরও পেলুম, মনের মানুষও পেলুম।
দুজনে কিছুক্ষণ অতীতের স্মৃতিতে নিমগ্ন হইয়া রহিল। বাহিরে পেঁচা ডাকিল-ঘুৎ-ঘুৎ। চাঁদ ইতিমধ্যে আরও একটু উপরে উঠিয়াছে।
দরজার উপর হঠাৎ ধাক্কা পড়িল; কণ্ঠস্বর শুনা গেল।
কণ্ঠস্বর : মৃত্যুঞ্জয়দা আছেন নাকি? আসতে পারি?
তাড়াতাড়ি বাহুমুক্ত হইয়া শাশ্বতী চোখ মুছিল; মৃত্যুঞ্জয় দ্বারের দিকে ফিরিল।
মৃত্যুঞ্জয় : কে—নিত্যানন্দ? এস।
নিত্যানন্দ প্রবেশ করিল। হালকা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পরা কুড়ি-একুশ বছরের যুবা; মুখে ছেলেমানুষী ও চটুলতা মাখানো; চটপটে দ্রুতভাষী রঙ্গপ্রিয়। সে দ্রুতপদে তাহাদের কাছে আসিয়া জিহ্বা ও তালুর সাহায্যে আক্ষেপসূচক চট্কার করিল।
নিত্যানন্দ : খোপের পায়রার মতো দুজনের কূজন-গুঞ্জন হচ্ছে! হরি হরি! ওদিকে যে সব গেল।
মৃত্যুঞ্জয় : কী গেল?
নিত্যানন্দঃ তোমাদের এই সাধের পায়রার খোপ—আর কি? আহা বৌদি, কত যত্ন করে বাসাটি বেঁধেছিলে—ছিনু মোরা সুলোচনে, গোদাবরী তীরে কপোত মিথুন যথা উচ্চ বৃক্ষ চুড়ে বাঁধি নীড় থাকে সুখে কিন্তু এবার বাসা ছাড়তে হল। বাজপাখি হানা দিয়েছে।
শাশ্বতী : ঐ তোমার দোষ, নিতাই ঠাকুরপো, হেঁয়ালিতে ছাড়া কথা কইতে পার না। সত্যি কি হয়েছে বল না ভাই।
নিত্যানন্দ : শুনবে? তবে এক কথায় বলছি। এই বাড়ির মালিক এতদিন পরে আবার বাড়ি ফিরে আসছে।
শাশ্বতী ও মৃত্যুঞ্জয় : (যুগপৎ) অ্যাঁ বল কি!
নিত্যানন্দ : তা নইলে আর এমন পূর্ণিমার ভর-সন্ধ্যেবেলা তোমাদের মিলন কুঞ্জে এসে বাগড়া দিলুম! কি আর বলব বৌদি, ভারি দুঃখ হচ্ছে। কোথাকার একটা চোয়াড়ে পাষণ্ড মানুষ এসে তোমাদের এমন বাস্তুভিটে থেকে উৎখাত করে দেবে। মানুষের সঙ্গে একবাড়িতে তোমরা তো আর। থাকতে পারবে না।
মৃত্যুঞ্জয় : কিন্তু তুমি এ খবর পেলে কোত্থেকে?
নিত্যানন্দ : জানোই তো রোজ সন্ধ্যেবেলা ইস্টিশানের বাদুড় বটে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা আমার অভ্যেস। গাড়ি আসে, যাত্রীরা ওঠা-নামা করে—দেখতে বেশ লাগে। আজও গিয়ে বসেছিলুম। গাড়ি এল; একটা লোক চোরের মতো গাড়ি থেকে নামল! দেখেই কেমন খটকা লাগল। —ঢুকে পড়লাম তার মনের মধ্যে। ঢুকে দেখি ও বাবা, মন তো নয়, একেবারে নরককুণ্ড।
শাশ্বতী : কি দেখলে?
নিত্যানন্দ : ব্যাটা এই বাড়ির মালিক। বিদেশে ব্যবসা করতে গিয়েছিল, সেখানে একটা লোককে খুন করে পালিয়ে এসেছে। মতলব, এই বাড়িতে লুকিয়ে থাকবে। ব্যাটাকে পুলিস খুঁজে বেড়াচ্ছে কিনা।
মৃত্যুঞ্জয় : কী সর্বনাশ! (শাশ্বতীর দিকে ফিরিয়া) শাশ্বতী—তুমি—
শাশ্বতী : না না, কক্ষনো না—আমি এ বাড়ি ছাড়ব না, আর ও লোকটার সঙ্গেও একবাড়িতে থাকতে পারব না। তোমরা যা হয় একটা উপায় কর।
নিত্যানন্দ : কিন্তু আর সময় নেই—এতক্ষণে ব্যাটা এসে পড়ল। (কান পাতিয়া) ঐ যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি না! হুঁ–এসেছে।
মৃত্যুঞ্জয় : তাই তো, এ আবার এক নতুন ফ্যাসাদ।
শাশ্বতী : (দুহাতে মুখ ঢাকিয়া) আমি পারব না—পারব না—
নিত্যানন্দ : (ক্ষণেক ঘাড় চুলকাইয়া) দ্যাখ, এক কাজ করা যাক। কজনে মিলে ব্যাটাকে ভয় দেখাই—তাহলে হয়তো পালাবে।
শাশ্বতী : (মুখ তুলিয়া সানন্দে) হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ!—এস, ভয় দেখাই। নিশ্চয় পালাবে তাহলে
দ্বারের কাছে খুট করিয়া শব্দ হইল। সকলে সেইদিকে চাহিয়া রহিল। চাঁদ এতক্ষণে জানালার মাথায় উঠিয়াছে। পেঁচা ডাকিল-ঘুৎ।
সন্তর্পণে কালো পর্দা সরাইয়া অমরনাথ মুণ্ড বাড়াইয়া চারিদিকে দেখিল। কিন্তু প্রেতলোকের দীপ্তি মানুষের নয়নগোচর নয়, সে অন্ধকারে কিছু দেখিতে পাইল না। তখন একটি বৈদ্যুতিক টর্চ জ্বালিয়া সে ঘরের চারিদিকে ফিরাইল। টর্চের আলো শাশ্বতী, মৃত্যুঞ্জয় ও নিত্যানন্দের গায়ে পড়িল, কিন্তু অমরনাথের মর-চক্ষে তাহারা ধরা পড়িল না। সে তখন আশ্বস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইল।
অমরনাথের বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ; লম্বা-চৌড়া অথচ ভারি ধরনের চেহারা। মাংসল মুখে বসন্তের দাগ, চুল উস্কখুস্ক; চোখের দৃষ্টি আশঙ্কা ও সতর্কতায় প্রখর। তাহার একহাতে ছোট হ্যাণ্ড-ব্যাগ অন্য হাতে টর্চ; পরিধানে ময়লা ধুতি ও গলাবন্ধ কালো কোট।
অমরনাথ : যাক, এতক্ষণে নিশ্চিন্দি। এখানে পুলিসের বাবাও খুঁজে পাবে না; এ বাড়িটা যে আমার তাই কেউ জানে না। (ঘরের চারিদিকে টর্চের আলো ফেলিয়া) যেমনটি পনের বছর আগে রেখে গিয়েছিলুম ঠিক তেমনটি আছে–(টর্চ নিভাইয়া) কি অন্ধকার! কিন্তু বেশীক্ষণ টর্চ জ্বালা চলবে না তাহলে সেল ফুরিয়ে যাবে। মোমবাতি বার করি!
অমরনাথ হাতড়াইয়া ঘরের মধ্যস্থিত টেবিলের দিকে অগ্রসর হইল; টেবিলের নিকটবর্তী হইয়া একটি চেয়ারে হোঁচট খাইয়া পতনোন্মুখ হইল। নিত্যানন্দ সজোরে হাসিয়া উঠিল।
নিত্যানন্দ : ব্যাটা রাতকানা-শুকনো ডাঙায় আছাড় খাচ্ছিল।
শাশ্বতী : মানুষগুলো তো অমনিই হয়—চোখ থাকতে দেখতে পায় না, কান থাকতে শুনতে পায় না—তবু বড়াই কত! গুমর করে বলে ওরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব!
অমরনাথ কিন্তু হাসি, কথা কিছুই শুনিতে পায় নাই। হোঁচটের তাল সামলাইয়া সে ব্যাগ ও টর্চ টেবিলের উপর রাখিল, তারপর ব্যাগ খুলিয়া একটি আধপোড়া মোমবাতি বাহির করিয়া জ্বালিল।
অমরনাথ : (টেবিলের উপর মোমবাতি বসাইয়া) জানালাটা খোলা রয়েছে কিন্তু এ সময় এ বনবাদাড়ে কেউ আসবে না। যদি বা আসে, ভাববে ভূতুড়ে বাড়ি-হা-হা-হা-
অদৃশ্য দর্শক তিনজনও হাসিল। অমরনাথ হাসিতে হাসিতে হঠাৎ থামিয়া গিয়া সচকিতভাবে চারিদিকে চাহিল।
অমরনাথ : ঠিক মনে হল কারা যেন আমার সঙ্গে সঙ্গে হাসছে বাড়িতে কেউ আছে নাকি?
নিত্যানন্দ : নাঃ—কেউ নেই! তুমি একা রাম-রাজত্ব করছ। ক্যাবলা কোথাকার!
অমরনাথ কিছুক্ষণ শরীর শক্ত করিয়া উৎকর্ণ হইয়া রহিল।
অমরনাথ : না—বোধ হয় প্রতিধ্বনি। জোরে হেসেছিলুম—
বাহিরে পাপিয়া ডাকিয়া উঠিল—পিউ কাঁহা—পিউ কাঁহা!
অমরনাথ নিশ্বাস ফেলিয়া নিশ্চিন্ত হইল।
অমরনাথ : আরে ছ্যাঃ, পাপিয়া ডাকছে—তাকেই হাসির আওয়াজ মনে করেছিলুম-হে-হে-হে-
গলার মধ্যে হাসিতে হাসিতে সে জানালার দিকে গেল; নিত্যানন্দের পাশ দিয়া যাইবার সময় নিত্যানন্দ তাহার হাসির সহিত সুর মিলাইয়া ব্যঙ্গস্বরে হাসিল—
নিত্যানন্দ : হে হে হে—
অমরনাথ জানালার নিকট গিয়া বাহিরে উঁকিঝুঁকি মারিল। চাঁদ জানালার উপরে উঠিয়া গিয়াছে—আর দেখা যায় না। অমরনাথ আশ্বস্ত মনে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কোটের বোতাম খুলিতে লাগিল।
অমরনাথ : জনমানব নেই। মিছে আঁৎকে উঠেছি। কথায় বলে, ঝোপে ঝোপে বাঘ, আমিও তাই দেখছি। না, আর ওকথা ভাবব না—একটু একটু ক্ষিধে পেতে আরম্ভ করেছে—ক্ষিধের আর অপরাধ কি? ভাগ্যে বুদ্ধি করে পাঁউরুটি এনেছি—তাই খেয়ে সোফায় লম্বা হয়ে তোফা ঘুমোনো যাবে।
শাশ্বতী : ওমা, কি ঘেন্না—আমার সোফায় ঘুমোবে!
অমরনাথ : (আত্মশ্লাঘার স্বরে) বুদ্ধি থাকলে কি না হয়! এই তো খুন করে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়লুম, ধরতে পারলে পুলিস?
নিত্যানন্দ : অগাধ বুদ্ধি তোমার।
শাশ্বতী : ঠাকুরপো, এবার আরম্ভ কর—আর সহ্য হচ্ছে না!
নিত্যানন্দ : এই যে—
সে গিয়া ফুৎকারে মোমবাতিটা নিভাইয়া দিল। অমরনাথ টেবিলের দিকে আসিতেছিল, থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।
অমরনাথ : এ কি! বাতি নিভে গেল যে—! (কাছে আসিয়া দেশলাই জ্বালিতে জ্বালিতে) কিন্তু হাওয়া তো নেই! (সভয়ে চারিদিকে চাহিয়া) গা ছমছম করছে। না, ওসব মনের ভুল। বোধ হয় ঘরটাতে অনেক খারাপ গ্যাস জমা হয়েছে—অনেকদিন বন্ধ আছে কিনা! ভূত-ফুৎ আমি মানি না।
নিত্যানন্দ : তা মানবে কেন? তোমার কত বুদ্ধি। বৌদি, তোমরাও এস, সবাই মিলে লাগা যাক—
অমরনাথ একটা চেয়ারে বসিয়া ব্যাগ খুলিতে প্রবৃত্ত হইল; তিনজনে তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল শাশ্বতী পিছনে, নিত্যানন্দ ও মৃত্যুঞ্জয় দুই পাশে। অমরনাথ ব্যাগ হইতে একটা আস্ত পাঁউরুটি বাহির করিয়া তাহাতে কামড় দিবার উপক্রম করিল, ঠিক এই সময় শাশ্বতী তাহার ঘাড়ে ফুঁ দিল। অমরনাথ রুটি হাতে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
অমরনাথ : কে! ঠিক যেন কে ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেললে। এ কি—এ সব কি? ঘরটা ভাল ঠেকছে না। চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে চারিদিকে কারা যেন রয়েছে। পালিয়ে যাব? কিন্তু পালিয়েই বা যাব কোথায়, বেরুলেই তো পুলিসে ধরবে। (ঘাড়ে হাত দিয়া) না—গ্যাস নিশ্চয়। কিংবা হয়তো আমার নার্ভ খারাপ হয়ে গেছে। না না, নার্ভ খারাপ হলে চলবে না। খাই, খেলে শরীর ঠিক হবে। খালি পেটে যত আপদ এসে জোটে–
দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া অমরনাথ পাঁউরুটি খাইতে লাগিল।
শাশ্বতী : উঃ কি বীভৎস! খাচ্ছে—খাচ্ছে—হাঁউ হাঁউ করে জানোয়ারের মতো খাচ্ছে। আমি ও দেখতে পারি না (মুখ ঢাকিল)
মৃত্যুঞ্জয় : মানুষ—এই মানুষ! রাশি রাশি খাচ্ছে—আর–ছি ছি!
নিত্যানন্দ : যাকগে যাকগে দাদা, ওসব নোংরা কথা যেতে দিন। এবার কি করা যায়? ব্যাটার নাক ধরে নেড়ে দিই।
অমরনাথ : (খাইতে খাইতে) কারা যেন ফিসফিস করে কথা কইছে। কল্পনা কল্পনা। মাথা গরম হয়েছে। খেয়েই শুয়ে পড়ি। উঃ, শুকনো রুটি চিবিয়ে গলা কাঠ হয়ে গেছে। একটু জল পাওয়া যেত!
নিত্যানন্দ : জলের ভাবনা কি চাঁদু, এক্ষুনি এনে দিচ্ছি
নিত্যানন্দ দ্বারের কাছে গিয়া পর্দার ওপারে হাত বাড়াইয়া এক গ্লাস জল আনিল, তারপর জলের গ্লাসটি অমরনাথের মাথার উপর ধরিয়া অল্প অল্প জল ফেলিতে লাগিল।
অমরনাথ : অ্যাঁ! (ঊর্ধ্বে চাহিয়া) এ কি—জল শূন্যে গেলাস!
রুটি ফেলিয়া দিয়া সে পিছু হটিয়া জানালার দিকে যাইতে লাগিল; নিত্যানন্দ গ্লাস তুলিয়া তাহার পিছে পিছে চলিল। শাশ্বতী মোমবাতিটা তুলিয়া লইয়া শূন্যে ঘুরাইতে লাগিল। মৃত্যুঞ্জয় টর্চটা লইয়া অমরনাথের ভয়বিহ্বল মুর্তির উপর আলো ফেলিল।
অমরনাথ : অ্যাঁ! বাতি শূন্যে ঘুরছে! টর্চ–! ওঃ!
অমরনাথের মুখ ভয়ে বিকটাকৃতি ধারণ করিল। সে হঠাৎ দুহাতে বুক চাপিয়া ধরিয়া গোঙানির মতো শব্দ করিতে করিতে বাঁ দিকের কৌচের পিছনদিকে পড়িয়া গেল। তাহার গোঙানি সহসা স্তব্ধ হইল।
কিছুক্ষণ তিনজনে নীরব; কেবল বাহিরে পেঁচা ডাকিল-ঘুৎ! শাশ্বতী বাতিটা টেবিলের উপর নামাইয়া রাখিল; মৃত্যুঞ্জয় টর্চ নিভাইল। নিত্যানন্দ একবার কৌচের পিছনে উঁকি মারিয়া মুখের একটা ভঙ্গি করিয়া টেবিলের কাছে আসিয়া জলের গ্লাস রাখিল। তিনজনে পরস্পর মুখের পানে তাকাইল।
নিত্যানন্দ : (একটু কাসিয়া) তাই তো! একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে যেন।
মৃত্যুঞ্জয় : হুঁ। এ আবার হিতে বিপরীত হল। মানুষকে যদি বা তাড়ানো যেত এখন আর
সকলে একসঙ্গে পিছনদিকে তাকাইল!
অমরনাথ কৌচের পিছন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইল; তারপর ঈষৎ টলিতে টলিতে টেবিলের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার চক্ষু ঢুলুঢুলু, যেন এইমাত্র ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়াছে।
তিনজনে তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল; নিত্যানন্দ মৃত্যুঞ্জয়কে ইঙ্গিতপূর্ণ কনুইয়ের ঠেলা দিল।
মৃত্যুঞ্জয় : কী! কেমন মনে হচ্ছে!
অমরনাথ হাই তুলিতে গিয়া থামিয়া গেল; তাহার চেতনা যেন সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়া আসিল। সে একবার সচকিতে তিনজনের দিকে তাকাইয়া ত্রস্তভাবে পিছু হটিল।
অমরনাথ : কে—-কে তোমরা?
নিত্যানন্দ : ভয় নেই—আমরা পুলিস নয়। দেখছেন না একজন মহিলা রয়েছেন।
অমরনাথ : তবে—তবে—কি চাই?
নিত্যানন্দ : কিছু না। আপনাকে শুধু জানাতে চাই যে, ব্যাপারটা একটু বেশী দূর গড়িয়েছে; এতদূর গড়াবে আমরা ভাবিনি।
অমরনাথ বুঝিতে পারে নাই, এমনিভাবে তাকাইয়া রহিল; তারপর ঈষৎ আশ্বস্তভাবে এক পা আগাইয়া আসিল।
অমরনাথ : মানে—ঠিক বুঝতে পারছি না।
মৃত্যুঞ্জয় : প্রথমটা অমনিই হয়। আপনি মুক্তি পেয়েছেন।
অমরনাথ : (সাগ্রহে) মুক্তি! মুক্তি পেয়েছি।
নিত্যানন্দ : (সহাস্যে) মানে–একেবারে মুক্তি পেয়েছেন। পটল তুলেছেন—শিঙে ফুঁকেছেন।
অমরনাথ : পাগল না ছন্ন। কে শিঙে ফুঁকেছে?
নিত্যানন্দ : আপনি—আপনি। এখনও ধরতে পারছেন না। এদিকে আসুন, স্বচক্ষে না দেখলে আপনার বিশ্বাস হবে না দেখছি।
অমরনাথকে লইয়া গিয়া নিত্যানন্দ কৌচের পিছনটা দেখাইল। অমরনাথ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া দেখিল, তারপর ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিল। তাহার চেহারা এই অল্প সময়ের মধ্যে কেমন যেন অন্যরকম হইয়া গিয়াছে। সে অন্যমনস্কভাবে ফুঁ দিয়া মোমবাতিটা নিভাইয়া দিল।
নিত্যানন্দ : কেমন? এবার বিশ্বাস হল?
অমরনাথ : (আত্মগতভাবে) আমি মরে গেছি। লাস পড়ে রয়েছে। আশ্চর্য! মরে গেছি—কিছুই তো তফাৎ বুঝতে পারছি না। না, না, বুঝতে পারছি—(তাহার মুখ উৎফুল্ল হইতে লাগিল) আর ভয় নেই—আর ভাবনা নেই—আর আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হবে না—দুই বাহু আস্ফালন করিয়া) আমি মরিনি-আমি বেঁচেছি—বেঁচেছি—
অমরনাথ আনন্দে লাফাইয়া লাফাইয়া নৃত্য করিতে লাগিল। সে দেখিতে পাইল না, এই অবকাশে আর একজন ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। তাহার দুশমনের মতো চেহারা, বড় বড় রক্তবর্ণ চক্ষু, মাথায় চুল যেন কোনও গাঢ় তরল পদার্থের সাহায্যে জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে। তাহার গায়ে একটা ছাই রঙের চাদর; দুই বাহু বুকের উপর আবদ্ধ।
অমরনাথের নৃত্য একটু শ্লথ হইতেই সে তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; জ্বলন্ত চক্ষে চাহিয়া দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল–
আগন্তুক : অমরনাথ, আমাকে চিনতে পার?
অমরনাথ প্রথমটা ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া পরে চিনিতে পারিয়া সভয়ে চিৎকার করিয়া উঠিল—
অমরনাথ : আঁ! এ সে অবিনাশ—ওরে বাবারে—
অমরনাথ ছুটিয়া পালাইবার চেষ্টা করিল; অবিনাশ তাহার পিছনে তাড়া করিল—ঘরময় দুজনের ছুটাছুটি চলিতে লাগিল। নিত্যানন্দ হাততালি দিয়া হাসিতে লাগিল।
অবিনাশ : আমাকে খুন করেছিলে—আমার টাকা নিয়ে পালিয়েছিলে—যাবে কোথায়—কেন খুন করেছিলে—
অমরনাথ : ওরে বাবারে—ওরে বাবারে—
এইভাবে ছুটোছুটি করিতে করিতে প্রথমে অমরনাথ ও তৎপশ্চাতে অবিনাশ দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল।
শাশ্বতী ও মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ পাশাপাশি চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, এই হুড়াহুড়িতে কোনও অংশ গ্রহণ করে নাই। নিত্যানন্দ কিন্তু মাতিয়া উঠিয়াছিল—সে মহোৎসাহে দ্বারের পানে যাইতে যাইতে বলিল—
নিত্যানন্দ : ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই! যাই রগড় দেখিগে—
সে দ্বার পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে এমন সময় মৃত্যুঞ্জয় পিছন হইতে বিষণ্ণ গম্ভীর কণ্ঠে ডাকিল—
মৃত্যুঞ্জয় : নিত্যানন্দ!
নিত্যানন্দ : (ফিরিয়া আসিয়া) কি দাদা?
মৃত্যুঞ্জয় একটু চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল
মৃত্যুঞ্জয় : তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আমার ডাক এসেছে।
নিত্যানন্দের হাসিমুখ মুহূর্তে ম্লান হইয়া গেল।
নিত্যানন্দ : ডাক এসেছে!
মৃত্যুঞ্জয় : হ্যাঁ—আবার যেতে হবে। সময়ও বেশী নেই। তোমাকে আর কি বলব, শাশ্বতী রইলো মাঝে মাঝে দেখাশুনা করো।
শাশ্বতী আঁচলে চোখ মুছিল। নিত্যানন্দ মুখে প্রফুল্লতা আনিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—
নিত্যানন্দঃ সে আর বলতে। তুমি কিছু ভেবো না দাদা, আমি আছি, যতদিন না ফিরে আসো আমি যক্ষের মতো বৌদিকে আগলে থাকব। ভগবান করুন যেন চটপট ফিরে আসতে পারো।
মৃত্যুঞ্জয় : কতদিনে ফিরব তা তো কিছু ঠিক নেই—
নিত্যানন্দ : কিছু বলা যায় না দাদা। আজকাল হতভাগা মানুষগুলোর মধ্যে যে রকম লড়াই বেধেছে কুরুক্ষেত্র তার কাছে ছেলেখেলা। মানুষ মরে উড়কুড় উঠে যাচ্ছে। শুধু কি যুদ্ধ–তার ওপর রকমারি রোগ—দুর্ভিক্ষ। ছেলে বুড়ো কেউ বাদ যাচ্ছে না। ভালয় ভালয় যদি চট করে টেসে যেতে পার, তবে আর তোমায় পায় কে!
মৃত্যুঞ্জয় : ঐ যা একটু ভরসা। —আচ্ছা, তাহলে
নিত্যানন্দ : এস দাদা। দুর্গা দুর্গা—হাসি মুখে যেন শিগগির ফিরে আসতে পার।
মৃত্যুঞ্জয় : শাশ্বতী— নিত্যানন্দ সরিয়া গিয়া দরজার কাছে দাঁড়াইল। মৃত্যুঞ্জয় ও শাশ্বতী বিদায়-বিধুর মুখে হাত ধরাধরি করিয়া পরস্পর মুখের পানে চাহিয়া রহিল।
এই সময় অবিনাশ ও অমরনাথ হাতে হাতে জড়াজড়ি করিয়া পরম বন্ধুভাবে প্রবেশ করিল।
নিত্যানন্দ : আরে গেল যা, ষণ্ডা দুটো আবার এসেছে। ইঃ—একেবারে গলাগলি ভাব। বলি, ব্যাপার কি?
অমরনাথ : আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। অবিনাশকে বিনাশ করে আমি ওর কতখানি উপকার করেছি, তা ওকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছি।
অবিনাশ : (গদগদ কণ্ঠে) অমরনাথ, তুমিই আমার যথার্থ বন্ধু। এখন থেকে দুজনে একসঙ্গে থাকব, তোমাকে একদণ্ড ছাড়ব না। স্যাওড়াতলার ঐ মজা কুয়োটার মধ্যে আমার আস্তানা দেখলে তো। কেমন, পছন্দ হয় না?
অমরনাথ : পছন্দ হয় না আবার। ঐ তো স্বর্গ—হমীন অস্তু হমীন অস্ত।
নিত্যানন্দ : আচ্ছা হয়েছে, এবার একটু থামুন। মৃত্যুঞ্জয়দার ডাক এসেছে। উনি এখুনি যাবেন।
অমরনাথ ও অবিনাশ সহানুভূতিপূর্ণ নেত্রে মৃত্যুঞ্জয়ের পানে চাহিয়া রহিল।
অমরনাথ : (সনিশ্বাসে) আহা বেচারা
তাহারা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। ঘরের মাঝখানে শাশ্বতী ও মৃত্যুঞ্জয় পূর্ববৎ বদ্ধবাহু হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ঘরের প্রেতদীপ্তি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হইয়া আসিতে লাগিল। মূর্তিগুলি অস্পষ্ট হইয়া ক্ৰমে গাঢ় অন্ধকারে মিশিয়া গেল। কিছু আর দেখা যায় না।
নিস্তব্ধ অন্ধকার। সহসা এই স্তব্ধতার মধ্যে বহুদূর হইতে অতি ক্ষীণ একটি শব্দ ভাসিয়া আসিল—সদ্যোজাত শিশুর কান্না।
১৬ ফাল্গুন ১৩৫১
Post a Comment