রেফ্রিজারেটর – নীরজ গুহ

রেফ্রিজারেটর – নীরজ গুহ

সকাল থেকে সারা বাড়ি মুখর হয়ে আছে। বাড়িতে আজ রেফ্রিজারেটর আসছে। তাতে নাকি জল ঠান্ডা হবে কুলফি বরফ হবে আরও কত কি। পল্টু ও অনান্য ভাই বোনদের ইস্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গেছে। মা,জ্যাঠাইমা,কাকিমা সকাল সকাল চান করে পুজো-আচ্চা সেরে তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করার কাজে ব্যস্ত।

জ্যাঠা মশাই আর বাবা, কাকারা পরিষ্কার লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বগলে পাউডার মেখে রেডি। এই এলো বলে। পল্টু এর মধ্যেই সদর দরজার পাশে কাঠের বিশাল মিটার বক্সের ওপর বসে পড়েছে ,কারণ এইখান দিয়েই তো তার প্রবেশ ঘটবে। বেলা বেড়ে ওঠে । সবাই অধীর অপেক্ষায়। পাড়ার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি শান্তিদাও এসে উপস্থিত। ফাইনালি সব দেখে নিচ্ছে। বুক পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে নীল মাথাওয়ালা স্ক্রু ড্রাইভার। একটু উনিশ বিশ হলে আর রক্ষে নেই বড় বাবুর বকুনির হাত থেকে। সামনের কালোয়ারদের বস্তিতে সীতারাম আর রাজারাম লোহা পেটানো বন্ধ করে খৈনি ডলছে।

ওরাও খবর পেয়েছে ঠান্ডা মেশিনের। ঝর্ণার মা বাসন মেজে ঘরে ফেরার পথে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পল্টু ওই মিটার বক্সের ওপরে বসে খোলা সদর দরজা দিয়ে সব দেখছে।

এমন সময় সোরগোল উঠলো, ঐ ঢুকেছে ঐ ঢুকেছে। হ্যাঁ, সত্যি। গলি দিয়ে ঠ্যালাগাড়িটা সদরের সামনে এসে থামলো, আর তাতে চিৎ হয়ে ভীষ্ম পিতামহের মত শুয়ে ঘিয়ে রঙের অনেক প্রতীক্ষার রেফ্রিজারেটর।

গাড়ি থামিয়ে ঠ্যালাওয়ালা রা গামছা দিয়ে ঘাড় মুখ মুছে নিচ্ছে। তারপর দুজনে বিড়ি ধরিয়ে একটু বিশ্রাম । পল্টু সব দেখছে উত্তেজিত হয়ে।
এবার আরও দুজন কুলি এলো। বোধহয় শান্তি দা কাছের বাজার থেকে ধরে এনেছে।
সামালকে সামালকে বলে মাঝে মাঝে হুঙ্কার উঠছে জ্যাঠার মুখ থেকে।
-এই শান্তি , হতভাগা দাঁড়িয়ে না থেকে একটু হাত লাগা না।
-কোথায় ধরবো বড় বাবু? এই এই ছোট জায়গাতে?
-তক্ক করিসনা,তক্ক করিসনা। ধর ঠিক করে।

যাই হোক, অনেক হিসেব নিকেশ করে বসবার ঘরে তিনি সোজা হয়ে এলেন। পল্টু এতক্ষনে নেমে দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পাশের রান্না ঘরের জানলায় তিন জোড়া চোখের উৎসুক চাহনি। পল্টু সব দেখছে। না, এখনো সব শেষ হয়নি। এরপর ঘরে ঢুকলো নীল রঙের প্রায় দু ফুট উঁচু চৌকো এক চারপেয়ে। এর ওপর নাকি মেশিনকে বসানো হবে। পল্টুরা কিন্তু এর মধ্যেই হিসেব কষে নিয়েছে এতো উঁচু হলে তো মেশিনের দরজায় হাত পৌঁছবে না।

যাই হোক , কুলিরা তাদের পাওনা গন্ডা আর বখশিশ নিয়ে তর্কাতর্কি শেষে বিদায় নিয়েছে। এবার কানেকশন।

শান্তি দা মেঝেতে বসে মেশিনের পেছনে বসে তার খুঁজছে আর বাবা, জ্যাঠা, আমরা সবাই শান্তি দার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। চোখে সবার কি হয় কি হয় ভাব। কারণ শান্তি দা মেশিন চালালেই সবাইয়ের শান্তি।

সব রেডি। পল্টু দেখছে। এইবার সুইচ দেবার পালা। শান্তি দার হাত এবার সেই বিশাল সাদা চিনে মাটির ওপরে কালো বেকালাইটের সুইচের দিকে। হটাৎ ভুচ করে শব্দ আর ফ্ল্যাশ। ফিউজ আর জ্যাঠা র চিৎকার, দিলি তো হতভাগা সব বারোটা বাজিয়ে? শান্তিদাও থতমত। একটু সামলে নিয়ে উত্তর দেয়, কিছু হয়নি বড়বাবু। এই ‘নেগেটিব পজিটিব’ টা এট্টু এক হয়ে গিয়েছে। ও একুনি ঠিক করে দিচ্ছি। জ্যাঠা র হুঙ্কার, হতভাগা তোর ‘নেগেটিব পজিটিব’ এক করে দেব যদি মেশিন খারাপ হয়।

যাই হোক, ওই কথায় আছে না, সব ভালো যার শেষ ভালো। সব শেষে চালু হলো মেশিন। প্রথমে উচ্চাঙ্গ সংগীতের মত আলাপ,ঘ্যাট ঘ্যাট ঘ্যাট ঘ্যাট তার কিছু পর আসল গান গুড় গুড় গুড় গুড়। বাবা মেশিনের যেমন দশাসই চেহারা তেমনই তার গুরু গম্ভীর স্বর।

এবার জ্যাঠা র প্রস্থান , সিনে বাবার প্রবেশ। ফরমান এলো জেঠিমা আর মায়ের কাছ থেকে। এটা হবে শুধুই নিরামিষ মেশিন। এতে কোনো আমিষের প্রবেশ নিষেধ। গোপালের দুধ, ফল, আর আমাদের জল থাকবে।

আর আইসক্রিম?পল্টুর প্রশ্ন।

সে, পরে দেখা যাবে। জ্যাঠাই মার উত্তর ,আর মাকে প্রশ্ন, হ্যাঁরে মেজো আইসক্রিম তো নিরামিষ না কি? হ্যাঁ দিদি। ওতো দুধ দিয়েই হয়।

ধীরে ধীরে বছর গড়িয়ে চললো।

একে একে কালের নিয়মে সবাই ঠান্ডা হয়ে পরপারের যাত্রী হয়ে এগিয়ে গেল।

পল্টুর চুলে পাক। মেশিনের হৃদপিণ্ডের গতিও হয়ে পড়েছে শ্লথ। এতগুলো বছর সবাইকে ঠান্ডা রেখে নিজে এখন মাঝে মাঝেই গরম হয়ে উঠছে। মানে তারও বিদায়ের পালা উপস্থিত। মেশিনের সেই চৌকিও এখন বিবর্ণ। তার নিচে স্থান নিয়েছে আলু পিঁয়াজের ধামা। পল্টু দেখছে।

কিছুদিন পরে পল্টুর জোয়ান ছেলের তোড়জোড়। নতুন ফ্রিজ আসছে বাড়িতে। পাড়ার কোন মিষ্টির দোকানে কথা হয়ে গিয়েছে। তারা আগ্রহী পুরোনো ফ্রিজ নিতে , তবে কোনো দাম দেবে না। তাতেই রাজি ছেলে। কারণ এই গন্ধমাদন না সরালে নতুন ফ্রিজ রাখবে কোথায়? এটা তার বউ এর যুক্তি। পল্টু এবারও শুধু দর্শক। স্মৃতি হাতড়াতে ব্যস্ত।

অবশেষে এলো সেইদিন । কোমরে দড়ি বেঁধে যেমন করে আসামীকে নিয়ে যায় ঠিক তেমন ভাবেই পাঁচ ছ’জন কুলি ডেকে হুড় হুড় করে টেনে নিয়ে বিদেয় করা। পল্টু শুধু বলতে গিয়েছিল ‘আস্তে ‘ না, বলেনি, মুখ দিয়ে কথা বের হয়নি । আজও পল্টু সেই প্রথম দিনের মতোই নীরব দর্শক।

আজ পল্টু অনেক দিন পর কালিকা মিষ্টান্ন ভান্ডারে এসেছে। কোনে পড়ে আছে মেশিন কোনো শান্তির আশায়।

ঘরে এসেছে রিপন স্ট্রিটের মেম দের মতো সরু সরু ঠ্যাং নিয়ে ধবধবে সাদা পেন্ট করা এক ফ্রিজ। নাম , himalux। পল্টু দেখছে , দেওয়ালে বেঁকে যাওয়া জ্যাঠা ,বাবাদের ছবি। কঠোর দৃষ্টি তাঁদের।

No comments