সামন্ত বাড়ি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

সামন্ত বাড়ি – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

বাড়িটার দিকে চোখ পড়লেই গা ছম ছম করে। সমস্ত দরজা-জানলার কবজাগুলো বোধ হয় ভেঙে গেছে। একটু বাতাস হলেই বিচিত্র শব্দ হয়। ক্যাঁচ কোঁচ ক্যাঁচ।

বাড়িটার আদিকালে কী রং ছিল বলা মুশকিল। এখন বাইরের আস্তরণ খসে পাঁজর-প্রকট চেহারা। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বট-অশত্থের চারা। ছাদের একদিকের কার্নিস সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।

সামনে অনেকখানি জায়গা। গাঁয়ের বুড়ো লোকেরা বলে একসময়ে খুব চমৎকার ফুলের বাগান ছিল। সামন্তরা দেশবিদেশ থেকে নানা জাতের ফুলের গাছ এনে লাগিয়েছিল।

এখন ফুলের গাছের একটিও অবশিষ্ট নেই। হতশ্রী চেহারা। ভেরাণ্ডা, ঘেঁটু আর আকন্দ গাছের রাজত্ব। দু-একটা ঘোড়া-নিমও আছে।

আগে এই বাড়ি জমজমাট ছিল।

সামন্তর দুই ছেলে, দুই বউ, একঘর নাতিপুতি। এ ছাড়া কর্তা আর গিন্নি তো ছিলই।

সাতদিনে প্রায় সবাই উজাড়।

সামন্তর ছোটো ছেলে বউ নিয়ে বিদেশে ছিল, তাই কেবল তারাই বাঁচল। বাকি সবাই কলেরায় খতম। সাতদিনে এগারো জন, চাকরবাকর নিয়ে।

শুধু সামন্ত বাড়িরই নয়, গাঁয়ের বহু বাড়িতেই এক অবস্থা।

মড়া পোড়াবার লোক নেই। ঘরে ঘরে মড়া পচতে লাগল। গন্ধে টেকা দায়। দিন-দুপুরে শেয়াল আর কুকুর আধমরাদের নিয়ে টানাটানি শুরু করল।

তারপর অনেক দিন কেটে গেছে, সামন্তর ছোটো ছেলে আর দেশে ফিরে আসেনি। বাড়ি অযত্নে, সংস্কারের অভাবে একটু একটু করে আজকের অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এদিক দিয়ে পারতপক্ষে কেউ হাঁটে না।

অবশ্য এটা ঠিক যাওয়া-আসার পথও নয়। কেবল শনি আর মঙ্গলবার যে দু-দিন হাটবার, হাটে যারা কমলপুর থেকে জিনিস নিয়ে আসে তারা সামন্ত বাড়ির পাশ দিয়ে ফেরে। কমলপুরে ফেরবার তাদের আর একটা পথ আছে। কিন্তু সে অনেক ঘুরপথ। প্রায় অর্ধেক গ্রাম ঘুরে যেতে হয়। তাদের ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সামন্ত বাড়ির পাশ দিয়ে তারা কোনোরকমে ছুটে পালায়। তবু কি নিস্তার আছে! সব কানে যায়।

হঠাৎ একতলার ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। জোর আলো নয়, নীলচে দীপ্তির মৃদু আলো। হা হা করে হাসির আওয়াজ শোনা যায়। সেই হাসি শুনলে সাহসী জোয়ানেরও বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়। অশরীরী হাসি। এ যেন কোনো মানুষের নয়। লোকেরা দু-কানে আঙুল দিয়ে প্রাণপণে জায়গাটা দৌড়ে পার হয়।

একবার বছর দুয়েক আগে সহদেব জেলে সাহস করে দাঁড়িয়ে পড়ে ব্যাপারটা দেখবার চেষ্টা করেছিল। ভাঙা পাঁচিল পার হয়ে একটু এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। গোঁ গোঁ শব্দ করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সঙ্গীরা কেউ এগিয়ে আসেনি।

পরের দিন সকালে তার আত্মীয়স্বজন এসেছিল। সহদেবের ঠোঁটের দু-পাশে ফেনার রাশ। দেহে এত তাপ যে হাত রাখা যায় না।

কোনোরকমে ধরাধরি করে সহদেবকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল।

তারপর সহদেব তিনদিন বেঁচে ছিল। এ তিনদিন চোখ খোলেনি। মাঝে মাঝে শুধু সারা দেহ কেঁপে উঠেছিল। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বর বের হয়েছিল— ‘ভূ-ভূত! ভূ-ভূ-ত!’

তারপর বহুদিন কেউ আর ওপথ দিয়ে চলেনি। ঘুরে অন্য পথ দিয়ে যাওয়া-আসা করত।

অনেক দিন পর আবার কিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। কিন্তু লোকেরা সন্ধ্যার আগেই সমান্ত বাড়ি পার হবার চেষ্টা করত।

সহদেব যে কী দেখেছিল, কেউ জানে না। জানবার কোনো উপায় ছিল না।

একবার কলকাতার এক ভদ্রলোক সামন্ত বাড়ি কেনবার জন্য এসেছিল। তার ইচ্ছা ছিল আশপাশের জমিতে ছোটোখাটো এক কারখানার পত্তন করবে আর বাড়িতে অফিস। তার সঙ্গে ম্যানেজার ছিল। দুজনে মিলে জমিজমা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল।

তাদের প্রথম সমস্যা হয়েছিল, সামন্ত বাড়ি যদি কেনাই ঠিক করে, তাহলে টাকাটা দেবে কাকে। প্রকৃত মালিক কে?

এক ভাগনে অবশ্য এসে খাড়া হয়েছে, কিন্তু সে প্রকৃত মালিক কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

কিন্তু কেনবার প্রশ্ন আর উঠল না।

বাগান পার হয়ে বাড়ির মধ্যে আসতে গিয়েই দুজনে থেমে গেল। একটা ঘোড়া নিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একটা কঙ্কাল! তার একটা হাত ধীরে ধীরে আন্দোলিত হচ্ছে। কাছে ডাকছে— এইরকম ভাব।

তারপর দুজনে আর দাঁড়াতে সাহস পায়নি। দ্রুতবেগে ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এসে পড়েছিল। কাঁটাগাছে দেহ ক্ষতবিক্ষত, পোশাক ছিন্নভিন্ন। বাড়ি কেনা তো দূরের কথা, তারা একেবারে স্টেশনে এসে থেমেছিল।

তারপর থেকে বাড়িটাকে কেউ আর সামন্ত বাড়ি বলত না, বলত— ভূতুড়ে বাড়ি।

সমস্ত গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে গেলে ভূতুড়ে বাড়ি থেকে আওয়াজ ভেসে আসত— খুট, খাট, খুট, খুট, খাট, খুট।

গ্রামের জনার্দন খুড়ো হাঁপানির জন্য রাতে ঘুমাতে পারতেন না। প্রায় সারা রাত দাওয়ায় বসে তামাক খেতেন। সেই শব্দ কানে যেতে বলতেন, ‘ওই ভূতের নাচ শুরু হল। ওদের গায়ে তো এক তিল মাংস নেই, কেবল হাড়সম্বল। তাই খুট খুট আওয়াজ হচ্ছে।’

কথাগুলো তিনি বলতেন দিনের আলোয় চণ্ডীমণ্ডপে বসে। গ্রামের আর পাঁচজন মুরুব্বির সামনে, ‘আরে বাপু, এরকম যে হবে, এ তো জানা কথা। নকুল সামন্তর বাড়ির কোনো মড়ার তো আর সদগতি হয়নি। করবে কে? তখন গাঁয়ের সব ঘরে এক অবস্থা। কে কাকে দেখে ঠিক আছে! মুখে জল দেবার যেমন লোক নেই, তেমনই মারা গেলে মুখে আগুন দেবার লোকেরও অভাব। সব মড়া ওই বাড়িতে পচেছে। কাজেই বাড়ির মায়াও ত্যাগ করতে পারছে না।’

মুখুজ্জেদের ত্রিলোচনদা বললেন, ‘এক কাজ করলে হয়—’

‘কী?

‘পাড়ার চাঁদা তুলে গয়ায় পিণ্ড দিয়ে এলে হয়।’

চাঁদার কথা শুনে হারু মজুমদার হঠাৎ, ‘কে রে? কে আম গাছে ঢিল ছোড়ে,’ বলে পালিয়ে গেলেন।

অন্য সবাই বললেন, উত্তম প্রস্তাব।

বিধুবাবু প্রশ্নের খোঁচা তুললন, ‘কিন্তু গয়া যাবে কে? তার খরচ?’

জনার্দন খুড়ো সে সমস্যারও সমাধান করে দিলেন, ‘কেন, পরাশর গার্ড রয়েছে। মাসে দু-বার সে গয়া যায়। তার হাতে টাকাটা তুলে দিলেই হয়।’

আর এক ঝামেলা। ওই বিধুবাবুই তুললেন, ‘কিন্তু পিতৃপুরুষের নামধাম কিছু তো জানা নেই, পিণ্ডদান হবে কী করে?’

‘আরে পুরোহিতকে মূল্য ধরে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। অন্য কারও পিতৃপুরুষ প্রক্সি দিয়ে দেবে। পিণ্ড দান নিয়ে কথা। প্রেতলোকে সবাই হাঁ করে আছে, একবার পিণ্ড পড়লেই দেখবেন ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে।’

তাই ঠিক হল। চাঁদাই তোলা হবে। কিন্তু কীভাবে? এখনই লোকের দরজায় খাতা নিয়ে ঘুরলে কেউই উপুড় হস্তও করবে না। পূজাপার্বণে দেখা গেছে বিশেষ চাঁদা ওঠে না। তবু সেখানে দেবদেবীর রোষের ব্যাপার আছে। এক্ষেত্রে সে সব আশঙ্কা নেই। সামন্তদের প্রেতাত্মা সামন্ত বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চড়াও হবে এমন সম্ভাবনা কম।

সকলে ভেবেচিন্তে স্থির করল, সংকীর্তনের দল বের করবে। গ্রামে এরকম দল ছিলই। তারাই কাপড় পেতে গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে।

তাই করল।

মোট উঠল তিন টাকা বাইশ পয়সা। দুটো শশা, একটা কাঁঠাল, গোটা পাঁচেক আম। তাও সেই বাইশ পয়সার মধ্যে দুটো দশ পয়সা আবার অচল।

গ্রামের মাতব্বররা যখন এ ব্যাপারে চিন্তিত, সেই সময়ে ঢাকের শব্দ কানে এল।

এখন আবার ঢাকের আওয়াজ কেন?

পালাপার্বণের সময় নয়। শীতলা, মনসা পূজা হলে মাতব্বররা আগেই জানতে পারতেন। সবাই উৎকর্ণ হয়ে রইলেন।

গোটা চারেক গোরুর গাড়ি আলের পথ ধরে চলেছে। ঢাকের শব্দ আসছে প্রথম গোরুর গাড়ি থেকে।

মাতব্বররা এগিয়ে গেলেন।

গোরুর গাড়ির ছই-এর ওপর কাগজ লটকানো। দি দিগ্বিজয় যাত্রা পার্টি। প্রোপ্রাইটর পশুপতি ধাড়া।

এক গ্রাম থেকে বায়না সেরে কালনা ফিরে যাচ্ছে। ঢাকের আওয়াজ হচ্ছে বিজ্ঞাপন। পথে যদি কেউ বায়না করে। জনার্দন খুড়োই বললেন, ‘এদের বায়না করলে হয়। আমোদপ্রমোদের ব্যাপারে তবু লোকে টাকা খরচ করে। আর এই অজ পাড়াগাঁয়ে কীই-বা আছে!’

বিধুবাবু হাত তুলে প্রথম গোরুর গাড়িটা থামালেন। বললেন, ‘প্রোপ্রাইটর কোথায়? দেখা করব।’

গাড়ি থেকে একটি কয়লার বস্তা নামল। মাথায় চার ফিট, করমচালাল দুটি চোখ, পরনে ফতুয়া, ধুতি হাঁটুর ওপর। হেঁড়ে গলা যথাসম্ভব মিহি করে বলল, ‘অনুমতি করুন আজ্ঞে। আমিই পশুপতি ধাড়া। প্রোপ্রাইটর, দি দিগ্বিজয় যাত্রা পার্টি।’

‘কোথা থেকে আসছেন?’

‘আসছি বীজপুর থেকে। মরবার সময় নেই। কেবল বায়নার পর বায়না। আমাদের মহীরাবণ বধ, সুরথ উদ্ধার, কুরুক্ষেত্র, কমলে কামিনী একেবারে বাছা বাছা পালা। লোকে এক রাতের জন্য বায়না করে নিয়ে যায়, সাত রাতের আগে ছাড়ে না।’

‘আপনাদের রেট কীরকম?’

পশুপতি ধাড়া এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘এখানে কোথাও বসবার জায়গা নেই আজ্ঞে? এসব বৈষয়িক কথাবার্তা এভাবে দাঁড়িয়ে—’

কাছেই একটা বট গাছ ছিল। তলায় লাল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। বিধুবাবু বললেন, ‘আসুন পশুপতিবাবু এখানে বসা যাক।’

সকলে বট গাছতলায় বসল।

‘আমাদের রেট আজ্ঞে দু-শো টাকা।’ পশুপতি কাজের কথা পাড়ল।

ত্রিলোচনবাবু চোখ কপালে তুললেন, ‘বলেন কী? এ টাকায় তো কলকাতার দল আনা যায়।’

পশুপতি ধাড়া দু-হাতে পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে বলল, ‘কলকাতার দল আর আমার দলে তফাতটা কোথায়? আপনারা পালা দেখুন তারপর টাকা দেবেন।’

অনেক দর কষাকষির পর এক-শো টাকায় রফা হল। এক-শো টাকা আর পালা ভালো লাগলে প্রোপ্রাইটরকে পান খেতে আরও দশ।’

পশুপতি ধাড়া হাঁক দিল, ‘বিজে, এই বিজে!’

সারসের মতন লম্বা, শীর্ণকায় এক ছোকরা লাফ দিয়ে গোরুর গাড়ি থেকে নামল, গজ গজ করতে করতে। ‘বিজে, বিজে, কেন আমার কি একটা ভালো নাম নেই?’

পশুপতি ধাড়া বলল, ‘বাবুদের খান কয়েক প্রোগ্রাম দিয়ে দে।’

শীর্ণকায় পকেট থেকে প্রোগ্রামের বান্ডিল বের করে গোটা চারেক প্রোগ্রাম বিলি করল।

পশুপতি ধাড়া সকলকে একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘ওতে আমাদের ঠিকানা আছে। একটা পোস্টকার্ড ফেলে দিলেই পেয়ে যাব। যেদিন আপনাদের দরকার তার অন্তত মাস খানেক আগে আমাকে জানাবেন, নইলে সম্ভব হবে না, বায়নার পর বায়না কিনা।’

জনার্দন খুড়ো বললেন, ‘আমরা এ মাসের শেষে, ধরুন সতেরোই রাত্রে চাই। শনিবার আছে, শহরে যেসব বাবুরা কাজ করে সবাই বিকেলে চলে আসবে। আসর ভরে যাবে। কোন পালাটা আপনাদের ভালো?’

‘বললাম যে আমাদের সব পালাই এসকেলেন্ট।’

‘এক্সসেলেন্ট।’ জনার্দন সংশোধন করে দিলেন।

‘ওই আজ্ঞে। আসরে বাবুরা বলেন কিনা। একটু থেমে পশুপতি ধাড়া আবার বলে, ‘কুরুক্ষেত্রই দেখুন তা হলে। আমার দুর্যোধনের পার্ট যারা একবার দেখেছে, তারা জীবনে ভুলবে না। আসরে হইচই পড়ে যায়।’

শীর্ণকায় বলল, ‘আর আমার ছিকেষ্ট? পার্ট দেখে কোতলপুরের বাবুরা একবার বাঁশ দিয়েছিলেন।’

‘বাঁশ? বাঁশ কেন?’ ত্রিলোচনবাবু ঊর্ধ্বলোচন হয়ে শুধান।

বিজে ব্যাখ্যা করল, ‘মানে বাঁশি তৈরি করার জন্য। সবাই বললে, এ একেবারে আসল ছিকেষ্ট। বাঁশি ছাড়া মানায় না।’

‘আঃ বিজে, ভদ্রলোকদের কথার মধ্যে তোর নাক গলাতে আসা কেন?’ পশুপতি বিরক্ত।

‘আবার বিজে! আপনি কি আমাকে বিজিতেন্দ্র মোহন বলে ডাকতে পারেন না?’

পশুপতি ধাড়া রুখে উঠল, ‘হ্যাঁ, ডাকব ওই নামে। আমার একে বাঁধানো দাঁত!’

‘ঠিক আছে আমাদের কী করতে হবে বলুন?’ জনার্দন বুড়ো মনে করিয়ে দিলেন।

পশুপতি বললে, ‘এই, খাতাটা গাড়ি থেকে নিয়ে আয়।’

শীর্ণকায় গাড়ির দিকে ছুটল।

ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে অনেক লোক নেমে দাঁড়িয়েছে। কেউ আলের ওপর। কেউ গাছের ছায়ায়। খেরো বাঁধানো লাল খাতা এল। গ্রামের তরফ থেকে জনার্দন খুড়ো সই করলেন। তখন পশুপতি ধাড়া বলল, ‘এবার কিছু অগ্রিম দিতে হবে আজ্ঞে।’

‘অগ্রিম?’

‘এই রেওয়াজ।’

গ্রামের মাতব্বররা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলেন। বিধুবাবু বললেন, ‘কার কাছে কত আছে?’

কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা হল। সেই পাঁচ টাকাই জনার্দন খুড়ো এগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘নিন, আগাম রাখুন।’

হাত থেকে টাকাটা নিয়ে পশুপতি ধাড়া বলল, ‘বড্ড কম হয়ে গেল আজ্ঞে। দলের বিড়ির খরচও হবে না।’

‘ঠিক আছে। বাকিটা যাত্রা শেষ হলে ভোর রাতে দেব।’

পশুপতি ধাড়া দু-হাত জোড় করে সকলকে নমস্কার করে উঠে পড়ল।

চারটে গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করল।

গ্রামের মাতব্বররা কোমর বেঁধে চাঁদা আদায় শুরু করল।

তারা ঠিক করেছিল, কোনোরকমে দেড়-শো টাকা যদি ওঠাতে পারে, তাহলে যাত্রা পার্টিকে এক-শো টাকা দিয়ে, পঞ্চাশ টাকা থাকবে পিণ্ডদানের জন্য।

বরাত ভালো, প্রায় দু-শো টাকা উঠে গেল।

প্রথমে অনেকেই ভেবেছিল, টাকা পয়সা দেবে না, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুনবে। তারপর শুনল কড়াকড়ি ব্যবস্থা হবে, বিনামূল্যে দেখার সুবিধা নেই। তা ছাড়া উদবৃত্ত অর্থ গয়ায় পিণ্ডদানে খরচ হবে, তখন আর কেউই দ্বিরুক্তি করল না।

জনার্দন খুড়ো প্রোপ্রাইটরকে পোস্টকার্ড ছেড়ে দিলেন।

যেখানে হাট বসে, বিলের ধারের মাঠ, সেখানটাই পরিষ্কার করা হল যাত্রার আসরের জন্য। পাড়ার উৎসাহী ছেলেরা গাছে গাছে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড আটকে দিল :

আসিতেছে, আসিতেছে, আসিতেছে!

বহুদিন পরে আনন্দ সংবাদ!

দি দিগ্বিজয় যাত্রাপার্টির যুগান্তকারী সৃষ্টি

‘কুরুক্ষেত্র’!!

আগামী সতেরই বৈশাখ, হাটতলার মাঠে।

সবই ঠিক হল, শুধু একটু ভয় ছিল। কালবৈশাখীর সময় ঝড়বৃষ্টি হলেই মুশকিল।

তবে একটা ভরসার কথা এই যে, এবার ঝড়বৃষ্টির জোর কম।

আসরের দিন তিনেক আগে পশুপতি ধাড়া একবার সরেজমিনে তদারকে এল।

পোস্টার দেখে একটু গম্ভীর। বলল, ‘সবই করলেন, প্রোপ্রাইটরের নামটা দিলেন না? দি দিগ্বিজয় যাত্রা পার্টির পরিচয়ই তো এই পশুপতি ধাড়া।’

তারপর যাত্রার আসর কোথায় হবে, কোথায় সাজঘর, সব দেখল। জনার্দন খুড়োকে বলল, ‘খাবার ব্যবস্থা কী হবে? আমাদের লুচি মাংস ছাড়া গলা খোলে না।’

জনার্দন খুড়ো পরিষ্কার বললেন, ‘লুচি মাংস পারব না। ঢালাও খিচুড়ির বন্দোবস্ত করব। তার সঙ্গে মাছ ভাজা। আপনাদের লোক ক-জন?’

‘তা সব নিয়ে সাতাশ-জন।’

‘ঠিক আছে, অসুবিধা হবে না। আরম্ভ করবেন ন-টায়?’

‘উঁহু ন-টায় নয়, দশটা। দশটা থেকে ভোর চারটে। একেবারে জমজমাট ব্যাপার। দেখবেন এই সময়ের মধ্যে লোকে হাঁ করতে ভুলে যাবে। বিশেষ করে মহামানী দুর্যোধনের পার্ট দেখে।’

‘দুর্যোধনের পার্ট কে করে?’

পশুপতি ধাড়া পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে হাসল। কোনো উত্তর দিল না।

সতেরোই বৈশাখ। রাত দশটায় যাত্রা আরম্ভ, সাতটা থেকে হ্যারিকেন হাতে লোক আসতে শুরু করল দলে দলে। ভিন গাঁয়ের লোকেরাও এসে ভিড় করল। তাদের আটকানো গেল না।

যাত্রার লোকেরা সাজতে শুরু করেছিল ছ-টা থেকে। নির্বিবাদে সাজবার জো আছে। গাঁয়ের ছেলের পাল সাজঘরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বিরক্ত করছিল। দুর্যোধনের গোঁফই পাওয়া গেল না। পাড়ার কোন ছেলে সরিয়ে ফেলেছিল। আবার গোঁফের ব্যবস্থা হল।

প্রায় সকলের সাজ হয়ে যেতে পশুপতি ধাড়ার খেয়াল হল, আরে বিজেটা গেল কোথায়; তার ছিকেষ্টর মেক-আপ বেশ টাইম নেবে।

খোঁজ, খোঁজ, এদিক-সেদিক সবাই খুঁজতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পর পাওয়া গেল। গাঁয়ের এক ছেলেই আবিষ্কার করল। এক পাকুড় গাছতলায় নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে।

পশুপতি ধাড়া প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে বিড়ি খাচ্ছিল, খবর শুনে তেতে লাল। বললে, ‘বালতি করে জল নিয়ে বিজেটার মাথায় ঢেলে দাও। নির্ঘাৎ গাঁজা টেনে মরেছে।’

জল ঢালতে হল না। দুঃশাসন আর ভীম তার দুটো হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে তুলল। বিজে জড়ানো গলায় বলল, ‘একী বাবা, স্বর্গেও অশান্তি? বিষ্টুর সঙ্গে একটু প্রাইভেট কথা বলছিলাম, তাতেও বাধা?’

অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বিজে ধাতস্থ হল। মেক-আপ নিতে বসে গেল।

দশটায় যাত্রা আরম্ভ হবার কথা, শুরু হল সাড়ে দশটায়।

যাত্রা বেশ জমে উঠেছিল। দুর্যোধন বার দুয়েক হাততালি পেল। তা পশুপতি ধাড়াকে মানিয়েছেও চমৎকার। বাজখাঁই গলায় খুব চেঁচাচ্ছে।

গোলমাল শুরু হল শ্রীকৃষ্ণ আসরে ঢুকতে। ঢোকা ঠিক নয়, শ্রীকৃষ্ণ শুয়েই ছিল। পায়ের কাছে অর্জুন, শিয়রে দুর্যোধন।

পালায় আছে শ্রীকৃষ্ণ কপট নিদ্রা ত্যাগ করে উঠে প্রথমে অর্জুনকে দেখতে পাবে, যদিও দুর্যোধন আগে থেকে বসে আছে।

কনসার্ট চলছে।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। শ্রীকৃষ্ণের ওঠার কোনো লক্ষণ নেই।

লোকেরা অধৈর্য হয়ে উঠছে।

দুর্যোধন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রমাদ গনল। কপট নয়, শ্রীকৃষ্ণের আসল নিদ্রা চলেছে! নাসিকা গর্জনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কনসার্টের জন্য সে আওয়াজ অবশ্য আসরে পৌঁছাচ্ছে না। কনসার্ট থামলেই শোনা যাবে।

ফিস ফিস করে দুর্যোধন বলল, ‘এই বিজে, বিজে, উঠবে না কি? লোক কতক্ষণ বসে থাকবে?’

শ্রীকৃষ্ণ গভীর নিদ্রামগ্ন।

দুর্যোধন আর পারল না। এভাবে চললে তো রাত কাবার হয়ে যাবে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটা আর হবে কখন? হাতটা বাড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণের ঘাড়ে মোক্ষম এক চিমটি কাটল সে।

‘ওরে বাপ, কী ছারপোকা! ঘুমোবার উপায় আছে!’ শ্রীকৃষ্ণ লাফ দিয়ে উঠল।

সারা আসর হেসে খুন।

দুর্যোধনবেশী পশুপতি ধাড়া পাকা অভিনেতা। মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল, ‘কেন পরিহাস করছেন যদুপতি, আমি আপনার দেহে অঙ্গ সঞ্চালন করছিলাম।’

কিন্তু যদুপতি তখন নেশায় মশগুল। বললে, ‘বাপস, ওর নাম অঙ্গ সঞ্চালন! আমার শরীরে কালসিটে পড়ে গেছে!’

আসর হেসে গড়িয়ে পড়ল।

এরপর সে দৃশ্য আর জমবার কথা নয়। কোনোরকমে শেষ করা হল।

সাজঘরে গিয়ে পশুপতি ধাড়া বিজের গলা টিপে ধরল, ‘তোকে আজ খুন করে ফেলব। কতদিন না বলেছি গাঁজা টেনে আসরে নামবি না। দিগ্বিজয় যাত্রা পার্টির একটা প্রেস্টিজ নেই?’

সবাই মিলে বিজেকে ছাড়িয়ে নিল। টিপুনির চোটে বিজুরও কিছুটা জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সে বলল, ‘আর এমনটি হবে না। দেখ না, সব সিন কেমন জমিয়ে দিই!’

তারপর গোটা দুয়েক সিন শ্রীকৃষ্ণ ভালোই করল।

এক জায়গায় একটু গোলমাল করে ফেলেছিল, কিন্তু সামলে নিয়েছে। সেই যেখানে অর্জুন মুহ্যমান, সামনে আত্মীয়কুটুম্ব দেখে কিছুতেই লড়াই করতে চাইছে না, আর শ্রীকৃষ্ণ তাকে উত্তেজিত করছে, তাতেও সফল না-হয়ে জ্ঞানের বাণী আওড়াবে, সেই দৃশ্যটায়।

অর্জুন তো যথারীতি একেবারে ঠান্ডা। গাণ্ডীব ফেলে দিয়ে হেঁটমুণ্ডে দণ্ডায়মান। তখন শ্রীকৃষ্ণ হাঁ করল। বিরাট এক হাঁ।

পালায় আছে, সেই হাঁ দেখে অর্জুন বিহ্বল। সৃষ্টি-লয় সবকিছু সেই মুখের গহ্বরে। সবকিছুর কারণ শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন নিমিত্ত মাত্র। এইখানে অর্জুনের বেশ লম্বা বক্তৃতা ছিল।

শ্রীকৃষ্ণ, ‘কী দেখছ?’ বলার পর অর্জুন ‘পোজ’ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল মুখের বিস্মিত ভঙ্গি করে। বিশ্বরূপ দর্শন করছে!

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের নেশা বোধ হয় তখনও পুরো কাটেনি। তাই সে আবার বলল, ‘কী দেখছ ধনঞ্জয়, টনসিল?’

বলেই তার চেতনা হল। সামলে নিয়ে নিজের পার্ট বলতে আরম্ভ করল। ভাগ্য ভালো, জোর বাজনা চলায় টনসিলটা আসরের কেউ শুনতে পেল না।

এ সিনটা উতরে গেল।

এরপর শ্রীকৃষ্ণের লম্বা বিরাম। দুর্যোধনের ঊরু-ভঙ্গের সিন, তাকে আসরে নামতে হবে। ভীমকে ইঙ্গিত করবে দুর্যোধনের ঊরুতে অন্যায়ভাবে গদা দিয়ে আঘাত করতে।

গরম পড়েছে অসহ্য। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। ময়ূরের পাখা লাগানো মুকুটটা খুলে রেখে বিজে একটা টুলের ওপর বসল। একটা হাতপাখা নিয়ে নিজেকে বাতাস করতে লাগল। ঠিক সেইসময়ে সামনে দ্রৌপদী। তার আর বিশেষ পার্ট নেই। একেবারে শেষ সিনে শুধু দাঁড়ানো। দ্রৌপদীর হাতে কলকে। শ্রীকৃষ্ণের দিকে ফিরে বলল, ‘হবে নাকি এক ছিলেম?’

বিজের মনশ্চক্ষে পশুপতি ধাড়ার মূর্তি ভেসে উঠল। সে মাথা নেড়ে বলল, ‘না ভাই, পার্ট গোলমাল হয়ে যাবে।’

দ্রৌপদী হেসে উঠল, ‘দূর চাষা কোথাকার! এতে পার্ট আরও খোলে। গলার আওয়াজ ভরাট হয়।’

‘তাই নাকি, তবে দাও, একটান টানি।’ বলে শ্রীকৃষ্ণ হাত বাড়িয়ে কলকেটা নিল।

এক টান নয়, বেশ কয়েক টান দিয়ে দ্রৌপদীকে যখন কলকে ফেরত দিল, তখন শ্রীকৃষ্ণের অবস্থা কাহিল। তার ধারণা হল, সে এ গাঁয়ের জমিদার। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তারই আনন্দের জন্য সখীরা নাচগান করছে।

বেশিক্ষণ চোখ খুলে থাকতেও পারল না। চোখ বুজে ফেলল।

হঠাৎ মনে হল কে যেন তাকে জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। অস্পষ্ট কার কণ্ঠস্বর। ‘এই বিজে, তোর সিন এসেছে রে। ঊরুভঙ্গের সিন।’

‘অ্যাঁ!’ বিজে চোখ খুলল।

‘নে ওঠ, গদাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’

ঠক, ঠকাস ঠক।

ভীম আর দুর্যোধন গদাযুদ্ধ চালিয়েছে। সেই সঙ্গে আস্ফালন।

এতক্ষণে বিজে উঠে দাঁড়াল। বিজেকে উঠে দাঁড়াতে দেখে যে ধাক্কা দিয়েছিল সে সরে গেল।

দাঁড়িয়ে উঠে বিজের মাথাটা বড়ো হালকা লাগল। মাথায় শিখিপুচ্ছসুদ্ধু মুকুট ছিল, সেটা খেয়াল হল। সামনে থেকে মুকুটটা তুলে নিয়ে মাথায় পরে শ্রীকৃষ্ণ দ্রুতপায়ে আসরে গিয়ে দাঁড়াল।

সঙ্গে সঙ্গে হা হা হো হো দর্শকদের মধ্যে যেন হাসির বন্যা বইতে লাগল। থামবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

এই ঘোরতর গদাযুদ্ধে হাসির কী খোরাক থাকতে পারে সেটা ভীম আর দুর্যোধনের কেউ বুঝতে পারল না।

গদাযুদ্ধটা খুব জমেছিল। আসর একেবারে নির্বাক। সূচ পড়লেও বুঝি শব্দ শোনা যেত।

কায়দা করে দুর্যোধন গদাটা তুলে কয়েক পা পিছিয়ে গেল হাসির কারণ জানবার জন্য। শ্রীকৃষ্ণের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দুর্যোধনের দুটো চোখ ছানাবড়ার সাইজ হয়ে গেল।

ছলনাময় শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। মাথায় প্লাস্টিকের বালতি।

যাত্রার শেষে মুখের রং তোলবার ব্যবস্থা। গোটা তিনেক বালতি বসানো ছিল। দরকারের সময় পুকুর থেকে জল নিয়ে আসতে হবে। নেশার ঘোরে শিখিপুচ্ছের মুকুট ভেবে বিজে নীল রঙের প্লাস্টিকের বালতিটা মাথায় পরেছে।

এই সিনে দুর্যোধনের দারুণ পার্ট। পশুপতি ধাড়া তিনবার যে মেডেল পেয়েছিল, এই সিনের জন্য। শ্রীকৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম অন্যায়ভাবে তার ঊরুভঙ্গ করবে, সেইসময় শ্রীকৃষ্ণের প্রতারক, মিথ্যাচারী, কপট, ঈশ্বর নামের কলঙ্ক প্রভৃতি বলে দুর্যোধন দীর্ঘ বক্তৃতা দেবে। সারা আসর হাততালিতে ফেটে পড়ে।

হতভাগা বিজের জন্য সব মাটি!

দুর্যোধন আর পারল না। গদা উঁচিয়ে বলল, ‘তবে রে কুষ্মাণ্ড, আজ তোর একদিন কী আমার একদিন! তোকে খুন করে ফাঁসি যাব!’

গদাটা তুলোর নয়। পশুপতি ধাড়া অনেক যত্ন করে কাঠের গদা তৈরি করিয়েছে। তার ওপর কালো রংয়ের প্রলেপ।

বিজে জানে, ওই গদার এক ঘা পিঠে পড়লে মেরুদণ্ড একেবারে ছাতু হয়ে যাবে।

বিজে ‘ওরে বাবারে, মেরে ফেলবে রে!’ বলে ঝাঁপ দিয়ে আসরে পড়ল। জনার্দন খুড়ো আর বিধুবাবু বসেছিলেন মঞ্চের আসনের দিকে। দুজনের মাঝখানে গড়গড়া। নলটা জনার্দন খুড়োর কোলের ওপর। বিজে গিয়ে পড়ল গড়গড়ার ওপর। গড়গড়া কাত। কলকে ছিটকে পড়ল বিধুবাবুর ফতুয়ার ওপর। তুবড়ির মতন আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল।

‘ওরে বাপস! বলে বিধুবাবু লাফাতে আরম্ভ করলেন। বিজে ততক্ষণে পগার পার!

পশুপতি ধাড়াও ছাড়বার পাত্র নয়। গদা ঘোরাতে ঘোরাতে সগর্জনে তার পিছনে ছুটল।

গাঁয়ের মাতঙ্গিনী দিদি তখন গোলমেলে ব্যাপার দেখে সরে পড়বার চেষ্টা করছিল। তার পক্ষে সরে পড়া একটু কষ্টকর। কারণ, ওজন প্রায় সাড়ে তিন মণ। রাস্তা দিয়ে গেলে দূর থেকে মনে হত যেন একটা জালা গড়াতে গড়াতে চলেছে। ছেলেরা একবার তাকে শহরে নিয়ে গিয়েছিল সিনেমা দেখানোর জন্য। কিন্তু টিকিট কেটে বিপদ। মাতঙ্গিনী একটা সিটে ধরে না। নানানরকম কসরত করা সত্ত্বেও। তারপর ম্যানেজারকে বলে একটা টুলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই মাতঙ্গিনীর সঙ্গে পশুপতি ধাড়ার ধাক্কা।

দুজনে দু-দিকে ছিটকে পড়ল!

ধুলো ঝেড়ে পশুপতি ধাড়া যখন উঠে বসল, তখন বিজে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। মাতঙ্গিনীর মুখ দিয়ে গালাগালির ফোয়ারা ছুটল, ‘মুখপোড়া, চোখের মাথা খেয়েছিস? ভীমের সঙ্গে লড়ছিলি, নেমে এসে মেয়েমানুষের সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা করে না? লড়বি তো আমাকেও একটা গদা দে, দেখি তোর কত হিম্মত!’

এসব কথা পশুপতি ধাড়া কানে নিল না। এখানে দেরি হলে বিজেটা চোখের আড়ালে চলে যাবে। গদা ঘোরাতে ঘোরাতে পশুপতি ধাড়া ছুটল।

বিজে দাঁড়িয়ে একটু দম নিচ্ছিল, হঠাৎ পশুপতি ধাড়াকে আসতে দেখে সে আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াল।

সামনেই সামন্ত বাড়ি।

ভিতর থেকে শব্দ আসছে খুট, খুট, খুট।

সামন্ত বাড়ির ভৌতিক ব্যাপার সম্বন্ধে বিজের কিছুই জানা ছিল না। সে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভাঙা পাঁচিলের মধ্যে দিয়ে ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

পিছনে গদা হাতে পশুপতি ধাড়া।

দরজাটা বোধ হয় ভেজানো ছিল। ঠেলতেই খুলে গেল।

এদিকে যাত্রার আসরে বিরজা মল্লিক বসেছিল। থানার অফিসার-ইন-চার্জ। অর্জুন, কুন্তী আর দ্রৌপদী তাঁকে এসে ধরল, ‘স্যার, বিজেকে বাঁচান! প্রোপ্রাইটর খেপলে জ্ঞান থাকে না। একেবারে খতম করে দেবে। আপনি দয়া করে উঠুন, স্যার!’

বিরজা মল্লিক উঠল। শুধু ওঠা নয়, ছুটতে আরম্ভ করল। বিরজা মল্লিক ছুটতে, যাত্রার আসরে পিছনে বসা দুজন পুলিশও ছুটল। স্যারের পিছনে ছোটা তাদের চিরকালের অভ্যাস।

সামন্ত বাড়ির সামনে এসে বিরজা মল্লিক একটু ইতস্তত করল, তারপর বিজে আর পশুপতিকে ঢুকতে দেখে, ঢুকে পড়ল। অগত্যা পুলিশ দুজনও।

বিজে ঢুকতেই দেখল সামনে একটা কঙ্কাল। কঙ্কালের দুটো চোখে আগুনের শিখা। কঙ্কাল ঠেলে বিজে পিছনে চলে গেল।

এদিকে বিজেকে দেখেই পশুপতি ধাড়া যে গদা ছুড়ে মেরেছে, সেটা তীব্রবেগে কঙ্কালের ওপর এসে পড়ল। কঙ্কাল গুঁড়িয়ে চূর্ণবিচূর্ণ।

এতক্ষণ ঘরের মধ্য থেকে যে খুটখাট শব্দ আসছিল, সেটা বন্ধ হয়ে গেল।

‘তুই কোথায় পালাবি দেখি। পাতালে ঢুকলেও তোকে আমি টেনে বের করব। তোর জন্য দি দিগ্বিজয় যাত্রাপার্টির ইজ্জত আজ ধুলোয় মিশেছে। তোকে শেষ করে তবে আমি অন্নজল স্পর্শ করব!’

এ ঘরে হ্যাজাকের আলো জ্বলছিল, চেঁচামেচি হতেই কে আলো নিবিয়ে দিল। সব অন্ধকার।

ভিতরে অনেকগুলো লোকের পায়ের শব্দ। মাঝে মাঝে পশুপতি ধাড়ার গদার আঘাত। সেই সঙ্গে আর্তনাদ, ‘ওরে বাবারে, গেলুম রে!’

বিরজা মল্লিক বিপদে পড়ল। বিজে হয়তো খুনই হয়ে গেল। পশুপতি ধাড়া যেভাবে গদা ঘোরাচ্ছে, কিছুই বিচিত্র নয়।

হঠাৎ তার নিজের কোমরে গোঁজা টর্চ আর রিভলবারের কথা মনে পড়ে গেল। এক হাতে টর্চ টিপল। অন্য হাতে রিভলবার বাগিয়ে ধরল। টর্চের আলোতে সব দেখে বিরজা মল্লিকের চক্ষুস্থির।

বিজে কোথাও নেই। গদার আঘাতে জনতিনেক লোক পড়ে আছে। তাদের পরনে কালো গেঞ্জি আর কালো পাজামা। পশুপতি ধাড়ার জ্ঞান নেই। সবেগে গদা ঘুরিয়ে চলেছে সে।

টর্চের আলো ঘুরিয়ে বিরজা মল্লিক এদিক-ওদিক দেখল।

এক কোণে কালো রঙের একটা মেশিন। পাশে ছোটো সাইজের অনেক বাক্স। গোলমেলে ব্যাপার বুঝতে বিরজা মল্লিকের একটুও দেরি হল না। লোকগুলোর দিকে রিভলবার লক্ষ করে বলল, ‘উঠে দাঁড়াও তিনজনে, যদি বাঁচতে চাও।’

তিনজনে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে মোটা লাঠি হাতে পুলিশ দুজনও এসে হাজির হয়েছে।

‘কীসের মেশিন ওটা?’

একজন ভীত কণ্ঠে বলল, ‘আজ্ঞে নোট ছাপাবার।’

‘ও, এখানে তাহলে নোট ছাপানো হয়। তাই লোককে ভূতের ভয় দেখিয়ে তাড়াবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কঙ্কালের চোখে লাল কাগজ আটকে ভয় দেখাবার চেষ্টা! জাল নোট ছাপাবার কারবার চলেছে।’

‘আমরা কিছু জানি না হুজুর, মালিক জানে।’

‘চোপরাও! এই, বাঁধো তিনজনকে পিছমোড়া করে।’

পুলিশরা এগিয়ে গিয়ে তিনজনকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলল। পশুপতি ধাড়া তখনও গদা ঘুরিয়ে চলেছে।

‘আঃ, কী হচ্ছে মশাই, গদা থামান!’ বিরজা মল্লিক কড়া ধমক দিল। পশুপতি থতমত খেয়ে গেল।

বিরজা মল্লিক এগিয়ে গিয়ে ছোটো বাক্সগুলো খুলল।

কোনোটাতে পাঁচ টাকার নোট, কোনোটাতে দশ। সবই অবশ্য জাল।

বিরজা বলল, ‘পশুপতিবাবু, আপনি এ সবের সাক্ষী। জবর একটা কেস পাকড়াও করা গেছে। কিন্তু আর একজন সাক্ষী পেলে হত। বিজুবাবু কোথায়?’

‘বিজেটাকে আমিও খুঁজে পাচ্ছি না।’ পশুপতির স্বীকারোক্তি।

বিরজা মল্লিক পশুপতি ধাড়ার কথায় চিন্তিত হয়ে পড়ল। ‘তাই তো, এ ঘরের একটাই তো দরজা। সে দরজা আগলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কোথায় যেতে পারেন বিজুবাবু?’

টর্চের আলো ঘরের চারদিকে ফেলে বিরজা মল্লিক চেঁচাল, ‘বিজুবাবু, কোথায় আপনি?’

ক্ষীণকণ্ঠ ভেসে এল, ‘এই যে আমি ওপরে।’

বিরজা মল্লিক চমকে উঠে টর্চের আলো ওপর দিকে ফেলে দেখল, কড়িকাঠে বাঁধা একটি দড়ি ধরে বিজে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে।

‘নেমে আসুন মশাই!’

‘কী করে নামব?’

‘যেভাবে উঠেছেন।’

‘কীভাবে উঠেছেন জানি না। গদার ভয়ে উঠে পড়েছি।’

এদিক-ওদিক দেখে বিরজা মল্লিক দেখতে পেল, জানলার পাশে মোটা একটা পাইপ ছাদ পর্যন্ত উঠেছে। বোঝা গেল, ভয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে এই পাইপ বেয়ে বিজে উঠে পড়ে ওই দড়ি আশ্রয় করেছে। বিরজা মল্লিক পুলিশদের দিকে ফিরে বলল, ‘এই, ওকে নামাবার ব্যবস্থা করো।

বিরজা মল্লিক তো বলে খালাস, কিন্তু কড়িকাঠ থেকে বিজেকে নামাবে কী করে?’

বুদ্ধি করে একজন পুলিশ মেশিনের ওপর উঠে পড়ল। আর একজন তাকে চেপে ধরল। মেশিনের ওপর দাঁড়ানো পুলিশ দুটো হাত বাড়িয়ে বলল, ‘নিন, ঝাঁপ দিন, কোনো ভয় নেই।’

বিজে চেঁচাল, ‘রাম, দুই, তিন।’

তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে একেবারে পুলিশের কোলে।

বিরজা মল্লিক বলল, ‘এই যে বিজুবাবু, আপনিও একজন সাক্ষী। এখানে একটা সই করুন।’

বিজে বলল, ‘আমার নাম বিজিতেন্দ্র মোহন নায়ক। কোথায় সই করতে হবে বলুন।’

পুলিশ দুজনকে সামন্ত বাড়িতে রেখে বিরজা মল্লিক তিনজনকে বেঁধে নিয়ে গেল। পিছন পিছন পশুপতি ধাড়া আর বিজে।

কিছুটা এসে পশুপতির খেয়াল হল, ‘আরে আমার গদাটা ফেলে যাচ্ছি যে। আমার এত সাধের গদা।’

বিজে বলল, ‘আর আমার শিখিপুচ্ছ, মানে প্লাস্টিকের বালতি।’

No comments