সমুদ্রের স্বাদ – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সমুদ্রের স্বাদ – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সমুদ্র দেখিবার সাধটা নীলার ছেলেবেলার! কিছুদিন স্কুলে পড়িয়াছিল। ভূগোলে পৃথিবীরস্থলভাগ আর জলভাগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। কিন্তু তার অনেক আগে হইতে নীলা জানিতপৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। সাত বছর বয়সে বাবার মুখে খবরটা শুনিয়া কী আশ্চর্যই সে হইয়া গিয়াছিল। এ কি সম্ভব? কই, সে তো রেলে চাপিয়া কত দূরদেশে ঘুরিয়াআসিয়াছে, মামাবাড়ি যাইতে সকালবেলা রেলে উঠিয়া সেই রাত্রিবেলা পর্যন্ত ক্রমাগত হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিতে হয়, কিন্তু নদীনালা খালবিল ছাড়া জল তো তার চোখে পড়ে নাই।

চারিদিকে মাঠ, মাঝে মাঝে জঙ্গল, আকাশ পর্যন্ত শুধু মাটি আর গাছপালা।

তারপর কতভাবে কত উপলক্ষে ছাপার অক্ষর, মুখের কথা আর স্বপ্নের বাহনে সমুদ্র তার কাছে আসিয়াছে। বলাইদের বাড়ির সকলে পুরী গিয়া কেবল সমুদ্র দেখা নয়, সমুদ্রের স্নান করিয়া আসিল। কলিকাতায় সাহেব-কাকার ছেলে বিনুদা বিলাত গেল_ সমুদ্রের বুকেই নাকি তার কাটিয়া গেল অনেকগুলি দিন। সমুদ্রের জল মেঘ হইয়া নাকি বৃষ্টি নামে, মাছ-তরকারিতে যে নুন দেওয়া হয় আর থালার পাশে একটুখানি যে নুন দিয়া মা দুবেলা ভাত বাড়িয়া দেন, সে নুন নাকি তৈরি হয় সমুদ্রের জল শুকাইয়া! সারাদিন গরমে ছটফট করিবার পর সন্ধ্যাবেলা যে ফুরফুরে বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য তারা ছাদে গিয়া বসে, সে বাতাস নাকি আসে সোজা সমুদ্র হইতে!

‘সমুদ্দুর বুঝি দক্ষিণ দিকে বাবা?’

‘চারিদিকে সমুদ্দুর আছে। দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর_ আমাদের খুব কাছে।’ ঠিক। ম্যাপে তাই আঁকা আছে। কিন্তু চারদিকে সমুদ্র? উত্তর দিকে তো হিমালয় পর্বত, তারপর তিব্বত আর চীন! ম্যাপটা আবার ভালো করিয়া দেখিতে হইবে।

‘আমায় সমুদ্দুর দেখাবে বাবা?’

বাবা অনেকবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, এবারো দিলেন। সমুদ্র দেখার আর হাঙ্গামা কী? একবার তীর্থ করিতে পুরীধামে গেলেই হইল, সুবিধামতো একবার বোধ হয় যাইতেও হইবে। নীলার মার অনেক দিনের সাধ।

কিন্তু কেরানির স্ত্রীর সহজ সাধও কি সহজে মিটিতে চায়! অনেক কষ্টে এক রকম মরিয়া হইয়া একটা বিশেষ উপলক্ষে স্ত্রীর সাধটা যদি-বা মেটানো চলে, ছেলেমেয়ের সাধ অপূর্ণই থাকিয়া যায়।

রথের সময়ে যে ভিড়টাই হয় পুরীতে, ছেলেমেয়েদের কি সঙ্গে নেওয়া চলে? তাছাড়া, সকলকে সঙ্গে নিলে টাকায়ও কুলায় না। ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনাই বা করিবে কে? নীলাকে সঙ্গে না নেওয়ার আরো কারণ আছে।

‘না গো, বিয়ের যুগ্যি মেয়ে নিয়ে ওই হট্টগোলের মধ্যে যাবার ভরসা আমার নেই। ‘বিয়ের যুগ্যি মেয়ে কিন্তু বিয়ের অযুগ্যি অবুঝ মেয়ের মতো কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোখ ফুলাইয়া ফেলিল। কয়েকদিন চোখের জলের নোন্তা স্বাদ ছাড়া জিভ যেন তার ভুলিয়া গেল অন্য কিছুর স্বাদ। মা-বাবা তীর্থ সারিয়া ফিরিয়া আসিলে কোথায় হাসিমুখে তাঁদের অভ্যর্থনা করিবে, তীর্থযাত্রার গল্প শুনিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিবে, একটি প্রশ্ন করিয়াই নীলা কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিল।

‘সমুদ্দুরে চান করেছ বাবা?’

গাড়ি হইতে নামিয়া সবে ঘরে পা দিয়াছেন, নীলার বাবা বসিয়া বলিলেন, ‘করেছি রে, করেছি। একটু দাঁড়া, জিরিয়ে নেই, বলবখন সব।’

কী বলিবেন? কী প্রয়োজন আছে বলিবার? নীলা কি পুরীর সমুদ্র-স্নানের বর্ণনা শোনে নাই? বলাইদের বাড়ির তিনতলার ছাতে উঠিয়া চারিদিকে যেমন আকাশ পর্যন্ত ছড়ানো স্থির অনড় রাশি রাশি বাড়ি দেখিতে পায়, তেমনি সীমাহীন জলরাশিতে বাড়ির সমান উঁচু ঢেউ উঠিতেছে নামিতেছে আর তীরের কাছে বালির উপর আছড়াইয়া পড়িয়া সাদা ফেনা হইয়া যাইতেছে, এ কল্পনায় কোথাও কি এতটুকু ফাঁকি আছে নীলার? কেবল চোখে দেখা হইল না, এই যা। বাপের আদূরে মেয়ে সে, অন্তত সকলে তাই বলে, তার সমুদ্র দেখা হইল না, কিন্তু বাপ তার সমুদ্র দেখিয়া, স্নান করিয়া ফিরিয়া আসিল। নীলা তাই কাঁদিয়া ফেলিল।

বাবা তাড়াতাড়ি আবার প্রতিজ্ঞা করিলেন, ‘পুজোর সময় যেমন করে পারি তোকে সমুদ্র দেখিয়ে আনব নীলা, ধার করতে হলে তাও করব। কাঁদিস নে নীলা, সারারাত গাড়িতে ঘুমোতে পাই নি, দোহাই তোর, কাঁদিস নে।’

সমুদ্র দেখাইয়া আনিবার বদলে পূজার সময় নীলাকে কাঁদাইয়া তিনি স্বর্গে চলিয়া গেলেন। বলাই বাহুল্য যে, এবার সমুদ্র দেখা হইল না বলিয়া নীলা কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোখ ফুলাইয়া চোখের জলের নোন্তা স্বাদে আর সবকিছুর স্বাদ ডুবাইয়া দিল না, কাঁদিল সে বাপের শোকেই। কেবল সে একা নয়, বাড়ির সকলেই কাঁদিল। কিছুদিনের জন্য মনে হইল, একটা মানুষ, বিশেষ অবস্থার বিশেষ বয়সের বিশেষ একটা মানুষ, চিরদিনের জন্য নীলার মনের সমুদ্রের মতো দুর্বোধ্য ও রহস্যময় একটা সীমাহীন কিছুর ওপারে চলিয়া গেলে, সংসারে মানুষের কান্না ছাড়া আর কিছুই করিবার থাকে না।

ছেলেবেলা হইতে আরো কতবার নীলা কাঁদিয়াছে। বাড়ির শাসনে কাঁদিয়াছে, অভিমানে কাঁদিয়াছে, খেলার সাথীর সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ায় কাঁদিয়াছে, পেটের ব্যথায় ফোঁড়ার যাতনায় কাঁদিয়াছে, সমুদ্র দেখার সাধ না মেটায় কাঁদিয়াছে, অকারণেও সে দু-চারবার কাঁদে নাই এমন নয়। এমন কষ্ট হয় কাঁদিতে! দেহের কষ্ট, মনের কষ্ট। শরীরটা যেন ভারি হইয়া যায়, জ্বর হওয়ার মতো সর্বাঙ্গে অস্বস্তিকর ভোঁতা টনটনে যাতনা বোধ হয়, চিন্তা জগৎটা যেন বর্ষাকালের আকাশের মতো ঝাপসা হইয়া যায়, একটা চিরস্থায়ী ভিজা স্যাঁতসেঁতে ভাব থমথম করিতে থাকে। শরীর ও মন দুরকম কষ্টেরই আবার স্বাদ আছে বৈচিত্র্যহীন আলুনি ও কড়া নোন্তা স্বাদ।

স্বাদটা অনুভব করিবার সময় নীলার লাগে এক রকম, আবার কল্পনা করিবার সময় লাগে অন্যরকম রক্তের স্বাদের মতো। ছুরি দিয়া পেন্সিল কাটিতে, বঁটি দিয়া তরকারি কুটিতে, কোনো কিছু দিয়া টিনের মুখ খুলিতে, নিজের অথবা ভাইদের আঙুল কাটিয়া গেলে তার প্রচলিত চিকিৎসার ব্যবস্থা অনুসারে নীলা কাটাস্থানে মুখ দিয়া চুষিতে আরম্ভ করে রক্তের স্বাদ তার জানা আছে।

নীলার বাবার মৃত্যুর পর সকলে মামাবাড়ি গেল। বিয়ের যুগ্যি মেয়েকে সঙ্গে করিয়া অতদূর মফস্বলের ছোট শহরে যাওয়ার ইচ্ছা নীলার মার ছিল না। তিনি বলিলেন, ‘আর কটা মাস থেকে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে গেলে হত না দাদা? একটা ছোটখাটো বাড়ি ঠিক করে নিয়ে’ মেজ মামা বলিলেন, ‘মাথা খারাপ নাকি তোর? অরক্ষণীয়া নাকি মেয়ে তোর? বাপ মরেছে, একটা বছর কাটুক না।

‘ও!’ বলিয়া নীলার মা চুপ করিয়া গেলেন।

কেবল তাই নয়, শহরে তাদের দেখাশোনা করিবে কে, খরচ চালাইবে কে? মামারা তো রাজা নন। সুতরাং সকলে মামাবাড়ি গেল। সকালে গাড়িতে উঠিয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত হু হু করিয়া চলিলে সেখানে পৌঁছানো যায়। স্থানটির পরিবর্তন হয় নাই, অনেক কালের ভাঙা ঘাটওয়ালা পানাভরা পুকুরটার দক্ষিণে ছোট আমবাগানটির কাছে নীলার দুই মামার বাড়িখানিরও পরিবর্তন হয় নাই। কেবল মামারা, মামিরা, আর মামাতো ভাইবোনেরা এবার যেন কেমন বদলাইয়া গিয়াছে। কোথায় সেই মামার বাড়ির আদর, সকলের আনন্দ-গদগদ ভাব, অফুরন্ত উৎসব? এবার তো একবারও কেউ বলিল না, এটা খা, ওটা খা? তার বাবার জন্য কাঁদাকাটা শেষ করিয়া ফেলিবার পরেও তো বলিল না! একটু কাঁদিবে নাকি নীলা, বাবার জন্য মাঝে মাঝে যেটুকু কাঁদে তারও উপরে মামাবাড়ির অনাদর অবহেলার জন্য একটু বেশিরকম কান্না?

কিছুকাল কাটিবার পর এ বিষয়ে ভাবিয়া কিছু ঠিক করিবার প্রয়োজনটা মিটিয়া গেল, আপনা হইতে যথেষ্ট কাঁদিতে হইল নীলাকে। ছেঁড়া ময়লা কাপড় তো নীলা জীবনে কখনো পরে নাই; গোবর দিয়া ঘর লেপে নাই, পানাপুকুরে বাসন মাজে নাই; কলসি কাঁখে জল আনে নাই, বিছানা তোলা, মসলা বাটা, রান্না করা লইয়া দিন কাটায় নাই, এমন ভয়ানক ভয়ানক খারাপ কথার বকুনিও শোনে নাই। হায়, একটু ভালো জিনিস পর্যন্ত সে যে খাইতে পায় না, এমনিই তার শরীরের নাকি এমন পুষ্টি হইয়াছে যে কোনো ভদ্রঘরের মেয়ের যা হয় না, হওয়া উচিত নয়! কিন্তু তারই না হয় অভদ্ররকমের দেহের পুষ্টি হইয়াছে, তার ভাইবোনেরা তো রোগা, মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে ওরাও একটু দুধ পায় না কেন, পিঠা-পায়েসের ভাগটা ওদের এত কম হয় কেন? এমন ভিখারির ছেলের মতো বেশ করিয়া তার ভাই দুটিকে স্কুলে যাইতে হয় কেন? মামাদের জন্য ভাইরা যে তার দুবেলা খাইতে পাইতেছে, স্কুলে পড়িতে পাইতেছে, এটা নীলার খেয়ালও থাকে না, মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে নিজের ভাইবোনদের আহার-বিহারের স্বাভাবিক পার্থক্যটা তাকে কেবলি কাঁদায়। বড়মামি বলেন, ‘বড় তো ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে তোমার ঠাকুরঝি?’

মেজ মামি বলেন, ‘আদর দিয়ে দিয়ে মেয়ের মাথাটি খেয়েছ একেবারে।’

নীলার মা বলেন, ‘দাও না তোমরা ওর একটা গতি করে, মেয়ে যে দিন দিন কেমনতরো

হয়ে যাচ্ছে?’

পাত্র খোঁজা হইতে থাকে আর নীলা ভাবিতে থাকে, বিবাহ হইয়া গেলে সে আবার শহরের সেই বাড়ির মতো একটা বাড়িতে গিয়া থাকিতে পাইবে, সকলের আদর-যত্ন জুটিবে, অবসর সময়ে বলাইদের মতো কোনো প্রতিবেশীর তিনতলা ছাদে উঠিয়া চারিদিকে বাড়ির সমুদ্র দেখিতে পারিবে, বলাইয়ের মতো কারো কাছে সমুদ্রের গল্প শোনা চলিবে?

ইতিমধ্যে ম্যালেরিয়ায় ভুগিতে ভুগিতে নীলার একটি ভাই মরিয়া গেল। নীলার মা কী একটা অজানা অসুখে ভুগিতে ভুগিতে শয্যা গ্রহণ করিলেন। বড়মামার মেজ মেয়ে সন্তান প্রসব করিতে বাপের বাড়ি আসিয়া একখানা চিঠির আঘাতে একেবারে বিধবা হইয়া গেল। পানাভরা পুকুরটার অপর দিকের বাড়িতেও একটি মেয়ে আরো আগে সন্তানের জন্ম দিতে বাপের বাড়ি আসিয়াছিল, একদিন রাতভর চেঁচাইয়া সে নিজেই মরিয়া গেল। আমবাগানের ওপাশে আট-দশখানা বাড়ি লইয়া যে পাড়া, সেখানেও পনের দিন আগে-পিছে দুটি বাড়ি হইতে বিনাইয়া বিনাইয়া শোকের কান্না ভাসিয়া আসিতে শোনা গেল।

তারপর একদিন অনাদি নামে সদর হাসপাতালের এক কম্পাউন্ডারের সঙ্গে নীলার বিবাহ হইয়া গেল। সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া সকলেই একরকম স্বীকার করিল যে, ধরিতে গেলে নীলার বিবাহটা মোটামুটি ভালোই হইয়াছে বলা যায়। মেয়ের তুলনায় ছেলের চেহারাটাই কেবল একটু যা বেমানান হইয়াছে। কচি ডাল ভাঙিয়া ফেলিলে শুকাইয়া যেমন হয়, কতকটা সেইরকম শুষ্ক ও শীর্ণ চেহারা অনাদির, ব্রণের দাগ-ভরা মুখের চামড়া কেমন মরা-মরা, চোখ দুটি নিষ্প্রভ, দাঁতগুলি খারাপ। এদিকে মামাবাড়ির অনাদর অবহেলা সহিয়া এবং বাবা ও ছোটভাইটির জন্য কাঁদিয়াও নীলার চেহারাটি বেশ একটু জমকাল ছিল, একটু অতিরিক্ত পারিপাট্য ছিল তার নিটোল অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির গঠন-বিন্যাসে।

কিছু বলিবার নাই, কিছু করিবার নাই, মুখ বুজিয়া সব মানিয়া লইতে হইল নীলার। বিশেষ আর এমন কী পরিবর্তন হইয়াছে জীবনের? বাস কেবল করিতে হয় অজানা লোকের মধ্যে, যাদের কথাবার্তা চালচলন নীলা ভালো বুঝিতে পারে না; আর রাত্রে শুইয়া থাকিতে হয় একটি আধ-পাগলা মানুষের কাছে, যার কথাবার্তা চালচলন আরো বেশি দুর্বোধ্য মনে হয় নীলার। কোনোদিন রাত্রে সংসারের সমস্ত কাজ শেষ হওয়ার পর ছুটি পাইয়া ঘরে আসিবামাত্র অনাদি দরজায় খিল তুলিয়া দেয়, হাত ধরিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে কী যে সে বলিতে আরম্ভ করে, নীলা ভালো বুঝিতেই পারে না। কেবল বুঝিতে পারে, আবেগে উত্তেজনায় অনাদি থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, চোখের দৃষ্টি তার উদ্ভ্রান্ত। মনে হয়, নীলার আসিতে আর একটু দেরি হইলে সে বুঝি বুক ফাটিয়া মরিয়াই যাইত! কোনো দিন ঘরে আসিয়া দেখিতে পায় অনাদির মুখে গভীর বিষাদের ছাপ, স্তিমিত চোখে দৃষ্টি আছে কি না সন্দেহ। ঘুম আসে নাই, রাত্রি শেষ হইয়া আসিলেও ঘুম যে আজ তার আসিবে না, নীলা তা জানে, কিন্তু হাই সে তুলিতেছে মিনিটে মিনিটে।

কী বলিবার আছে, কী করিবার আছে? হয় দাঁতের ব্যথা, নয় মাথা ধরা, নয় জ্বরভাব, অথবা আর কিছু অনাদিকে প্রায়ই রাত জাগায়, অন্যদিন সে রাত জাগে নীলার জন্য। সুযোগ পাইলে নীলা চুপি চুপি নিঃশব্দে কাঁদে। সজ্ঞানে মনের মতো স্বামীলাভের তপস্যা সে কোনোদিন করে নাই, কী রকম স্বামী পাইলে সুখী হইবে, কোনোদিন এ কল্পনা তার মনে আসে নাই, সুতরাং আশাভঙ্গের বেদনা তার নাই। আশাই সে করে নাই, তার আবার আশাভঙ্গ কিসের? অনাদির সোহাগেই সোহাগ পাওয়ার সাধ মিটাইয়া নিজেকে সে কৃতার্থ মনে করিতে পারিত, উত্তেজনা ও অবসাদের নাগরদোলায় ক্রমাগত স্বর্গ ও নরকে ওঠানামা করার যে চিরন্তন প্রথা আছে জীবনযাপনের, তার মধ্যে নরকে নামাকে তুচ্ছ আর বাতিল করিয়া দিয়া সকলের মতো সেও একটা বিশ্বাস জন্মাইয়া নিতে পারিত যে স্বর্গই সত্য, বাকি সব নিছক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু স্বামীই তো মেয়েদের সব নয়, গত জীবনের একটা বড় রকম প্রত্যাবর্তন তো নীলা আশা করিয়াছিল, যে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে শহরে তাদের সেই আগেকার বাড়িতে থাকা, সকলের না হোক অন্তত একজনের কাছে সেইরকম আদর-যত্ন পাওয়া, অবসর সময় বলাইদের মতো কোনো প্রতিবেশীর তিনতলা বাড়ির ছাদে উঠিয়া চারিদিকে বাড়ির সমুদ্র দেখা আর বলাইয়ের মতো কারো মুখে আসল সমুদ্রের গল্প শোনার মোটামুটি একটা মিল আছে।

এখানে নীলাকে বিশেষ অনাদর কেউ করে না, লজ্জায় কম করিয়া খাইলেও মামাবাড়ির চেয়ে এখানেই তার পেটভরা খাওয়া জোটে; এখানে তাকে যে দয়া করিয়া আশ্রয় দেওয়া হয় নাই, এখানে থাকিবার স্বাভাবিক অধিকারই তার আছে, এটা সকলে যেমন সহজভাবে মানিয়া লইয়াছে, সে নিজেও তেমনি আপনা হইতে সেটা অনুভব করিয়াছে। মামাবাড়ির চেয়েও এখানকার অজানা অচেনা নরনারীর মধ্যে ঘোমটা দেওয়া বধূজীবন যাপন করিতে আসিয়া নীলা তাই স্বস্তি পাইয়াছে অনেক বেশি। তবু একটা অকথ্য হাতাশার তীব্র ঝাঁজালো স্বাদ সে এখন অনভব করিয়াছে এখানে। গুমরাইয়া গুমরাইয়া এই কথাটাই দিবারাত্রি মনের মধ্যে পাক খাইয়া বেড়াইতেছে যে সব তার শেষ হইয়া গিয়াছে, কিছুই তার করার নাই, বলার নাই, পাওয়ার নাই, দেওয়ার নাই_ সানাই বাজাইয়া একদিনে তার জীবনের সাধ, আহ্লাদ, সুখ, দুঃখ, আশা, আনন্দের সমস্ত জের মিটাইয়া দেওয়া হইয়াছে।

‘কাঁদছ নাকি? কী হয়েছে?’

‘কাঁদি নি তো।’

কাঁদিতে কাঁদিতেই নীলা বলে সে কাঁদে নাই। জানুক অনাদি, কী আসিয়া যায়? কাঁদা আর না-কাঁদা সব সমান নীলার। নীলার কান্নার মৃতসঞ্জীবনী যেন হঠাৎ মৃতপ্রায় দেহে মনে জীবন আনিয়া দিয়াছে এমনিভাবে অনাদি তাকে আদর করে; ব্যাকুল হইয়া জানিতে চায়, কেন কাঁদিতেছে নীলা, কী হইয়াছে নীলার? এখানে কেউ গালমন্দ দিয়াছে? মা-বোনের জন্য মন কেমন করিতেছে? অনাদি নিজে না জানিয়া মনে কষ্ট দিয়াছে তার? একবার শুধু মুখ ফুটিয়া বলুক নীলা, এখনই অনাদি প্রতিকারের ব্যবস্থা করিবে!

কিন্তু কী বলিবে নীলা, বলার কী আছে? সে কি নিজেই জানে, কেন সে কাঁদিতেছে? আগে প্রত্যেকটি কান্নার কারণ জানা থাকিত, কোন কান্না বকুনির, কোন কান্না অভিমানের, কোন কান্না শোকের, আর কোন কান্না সমুদ্র দেখার সাধের মতো জোরালো অপূর্ণ সাধের। আজকাল সব যেন একাকার হইয়া গিয়াছে। কান্নার সমস্ত প্রেরণাগুলি যেন দল বাঁধিয়া চোখের জলের উৎস খুলিয়া দেয়।

সেদিন অনাদি ভাবে, কান্নার কারণ অবশ্যই কিছু আছে, নীলা মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিল না। পরদিন আবার তাকে কাঁদিতে দেখিয়া সে রীতিমতো ভড়কাইয়া যায়, কান্নার কারণটা তবে তো নিশ্চয়ই গুরুতর! আরো বেশি আগ্রহের সঙ্গে সে কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করে এবং

কিছুই জানিতে না পারিয়া সেদিন তার একটু অভিমান হয়। তারপর দুদিন নীলা কাঁদে কি না সে জানে না, দাঁতের ব্যথা আর মাথার যন্ত্রণায় বিব্রত থাকায় অনাদি টের পায় না। পরদিন আবার নীলার কান্না শুরু হইলে রাগ করিয়া অনাদি বলিল, ‘কী হয়েছে, যদি নাই বলবে, বারান্দায় গিয়ে কাঁদো, আমায় জ্বালিও না।’

এতক্ষণ কাঁদিবার কোনো প্রত্যক্ষ কারণ ছিল না, এবার স্বামীর একটা কড়া ধমক খাইয়া নীলা অনায়াসে আরো বেশি আকুল হইয়া কাঁদিতে পারিত, কিন্তু ধমক খাওয়া মাত্র নীলার কান্না একেবারে থামিয়া গেল।
‘দাঁত ব্যথা করছে তোমার?’
অনাদি বলিল, ‘না।’
‘মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে?’
‘না।’

‘তবে?’ নীলা যেন অবাক হইয়া গিয়াছে। দাঁতও ব্যথা করিতেছে না, মাথার যন্ত্রণা নাই, কাঁদিবার জন্য তবে তাকে ধমক দেওয়া কেন, বারান্দায় গিয়া কাঁদিতে বলা কেন? দাঁতের ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা না থাকিলে তো তার প্রায় নিঃশব্দ কান্নায় অনাদির অসুবিধা হওয়ার কথা নয়

তারপর ধমক দিয়া কয়েকবার নীলার কান্না বন্ধ করা গেল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরে ধমকেও আর কাজ দিল না। মাঝে মাঝে তুচ্ছ উপলক্ষে, মাঝে মাঝে কোনো উপলক্ষ ছাড়াই নীলা কাঁদিতে লাগিল। মনে হইল, তার একটা উদ্ভট ও দুর্নিবার পিপাসা আছে, নিজের নাকের জল চোখের জলের স্রোত অনেকক্ষণ ধরিয়া অবিরাম পান না করিলে তার পিপাসা মেটে না।

তারপর ক্রমে ক্রমে অনাদি টের পাইতে থাকে, বৌয়ের তার কান্নার কোনো কারণ নাই, বৌটাই তার ছিঁচকাঁদুনে, কাঁদাই তার স্বভাব।

অনাদির মা-ও কথাটায় সায় দিয়া বলেন, ‘এদ্দিন বলি নি তোকে, কী জানি হয়তো ভেবে বসবি আমরা যন্ত্রণা দিয়ে বৌকে কাঁদাই, তোর কাছে বানিয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলছি বড্ড ছিঁচকাঁদুনে বৌ তোর। একটু কিছু হল তো কেঁদে ভাসিয়ে দিলে। আগে ভাবতাম, বৌ বুঝি বড্ড অভিমানী, এখন দেখছি তা তো নয়, এ যে ব্যারাম! আমাদের কিছু বলতে কইতে হয় না, নিজে নিজেই কাঁদতে জানে। ওবেলা ও-বাড়ির কানুর মা মহাপ্রসাদ দিতে এল, বসিয়ে দুটো কথা বলছি, বৌ কাছে দাঁড়িয়ে শুনছে, বলা নেই কওয়া নেই ভেউ ভেউ করে সে কী কান্না বৌয়ের! সমুদ্দুরে চান করার গল্প থামিয়ে কানুর মা তো থ বনে গেল।

যাবার সময় চুপি চুপি আমায় বলে গেল, বৌকে মাদুলি তাবিজ ধারণ করাতে। এসব লক্ষণ নাকি ভালো নয়।’

অনাদির মা কান পাতিয়া শোনে, দরজার আড়াল হইতে অস্ফুট একটা শব্দ আসিতেছে।

‘ঐ শোন। শুনলি?’

বাহিরে গিয়া অনাদি দেখিতে পায়, দরজার কাছে বারান্দায় দেয়াল ঘেঁষিয়া বসিয়া নীলা বঁটিতে তরকারি কুটিতেছে। একটা আঙুল কাটিয়া গিয়া টপ্টপ্ করিয়া ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়িতেছে আর চোখ দিয়া গাল বাহিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে জল। মাঝে মাঝে জিভ দিয়া নীলা জিভের আয়ত্তের মধ্যে যেটুকু চোখের জল আসিয়া পড়িতেছে সেটুকু চাটিয়া ফেলিতেছে।

No comments