দ্বিতীয় মানব – হুমায়ূন আহমেদ

দ্বিতীয় মানব – হুমায়ূন আহমেদ

০১. চৈত্র মাসে মানুষের মেজাজ এমনিতেই খারাপ থাকে

চৈত্র মাসে মানুষের মেজাজ এমনিতেই খারাপ থাকে। ঠাণ্ডা ধরনের মানুষের বেলাতেও দেখা যায়—রোদ চড়তে থাকে, তাদের মেজাজও চড়তে থাকে। সেই হিসাবে মাহতাব উদ্দিন সাহেবের মেজাজ তুঙ্গস্পর্শী হবার কথা। কারণ আজ চৈত্রের তৃতীয় দিবস, সময় দুপুর, ঝাঁঝালো রোদ উঠেছে। এবং মাহতাব সাহেব এমনিতেই রাগী মানুষ। ধমক না দিয়ে কথা বলতে পারেন না।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে মাহতাব উদ্দিন সাহেবের মেজাজ ঠাণ্ডা। তিনি প্রায় তিনি প্রায় হাসি-হাসি মুখে বসার ঘরে খবরের কাগজ হাতে বসে আছেন। তাঁর সামনে টেবিলে চা। টেবিলের ওপাশে বসার ঘরের মাঝামাঝি নীল লুঙ্গি পরা অত্যন্ত বলশালী একটা লোক খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোটার গভর্তি ঘন লোম। বিশাল মুখমণ্ডল। মনে হচ্ছে গত সাতদিন সে দাড়ি কামায়নি। মুখভৰ্তি খোচা খোচা দাড়ি। সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের আঙুলের দিকে।

মাহতাব উদ্দিন লোকটির দৃষ্টি অনুসরণ করে তার পায়ের আঙুলের দিকে তাকালেন। থ্যাবড়া থ্যাবড়া পায়ের মোটা মোটা আঙুল। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল এবং তার পরেরটা সে হারমোনিয়ামের রিডের মতো ওঠানামা করাচ্ছে। মাহতাব উদ্দিন বললেন, তোমার নাম কী?

লোকটা তার পায়ের আঙুলের নাচানাচি দেখতে দেখতে বলল, খলিলুল্লাহ। দশজনে খলিল বইল্যা ডাকে।

তোমার নাম খলিলুল্লাহ?

জ্বে।

খালি গায়ে ঘুরছ কেন?

গরম লাগে।

আমার সামনে থেকে যাও। গেঞ্জি, সার্ট বা ফতুয়া যে-কোনো একটা কিছু গায়ে দিয়ে আসে। কখনো খালি গায়ে থাকবে না। খালি গায়ে বাড়ির ভেতর ঢোকা বিরাট অসভ্যতা। আমার বাড়িতে অসভ্যতা করা যাবে না।

জ্বে আইচ্ছা।

খালি পায়েও থাকবে না। সবসময় স্যান্ডেল পরে থাকবে।

খলিলুল্লাহ বিড়বিড় করে বলল, স্যাভেল নাই।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, আপাতত সার্ট গায়ে দিয়ে আসসা। স্যান্ডেল বিষয়ে পরে কথা হবে। জ্বে আইচ্ছা।

রাগে মাহতাব উদ্দিনের গা জ্বলে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি মুখ হাসি-হাসি করে রেখেছেন। কারণ, তিনি তার মেয়ে টুনটুনিকে গতকাল রাত এগারোটায় কথা দিয়েছেন—আগামী সাতদিন তিনি রাগারাগি করবেন না, কাউকে ধমক দেবেন। না, এমনকি কঠিন কথাও হাসিমুখ ছাড়া কখনো বলবেন না।

এই প্ৰতিজ্ঞা রাখা মাহতাব সাহেবের জন্যে অত্যন্ত কঠিন। তিনি অসম্ভব রাগী মানুষ। অল্পতেই তাঁর মেজাজ খারাপ হয়। তাঁর কপালটা এরকম যে মেজাজ খারাপ হবার মতো ঘটনা কিছুক্ষণ পরপর তাঁর চোখের সামনে ঘটে।

আজ ছুটির দিন। তিনি মোটামুটি ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে চা খাচ্ছেন। টুনটুনিকে নিয়ে গুলশানের এক আইসক্রিমের দোকানে যাবেন। ফেরার পথে টুনটুনি বারিধারা থেকে তার দুই বান্ধবীকে নিয়ে বাড়িতে আসবে। তিন বান্ধবী ছাদের সুইমিংপুলে লাফালাফি ঝাপঝাপি করবে। সকাল থেকেই সুইমিংপুলে পানি দেয়া হচ্ছে। আনন্দময় ছুটির দিন। এর মধ্যে উপস্থিত হয়েছে খলিলুল্লাহ। চাকরির সন্ধানে মাহতাব সাহেবের দেশের বাড়ি থেকে এসেছে।

চাকরির সন্ধানে দেশ থেকে লোকজন আসাই মেজাজ খারাপ হবার মতো ঘটনা। ঢাকা শহরের পথে-ঘাটে চাকরি পড়ে থাকে না। কেউ এলো, পথ থেকে একটা চাকরি কুড়িয়ে তার হাতে দিয়ে দেয়া হলো, হাসিমুখে চাকরি নিয়ে সে বাড়ি চলে গেল। ঘটনা সেরকম না। বিএ, এমএ পাস ছেলে শুকনা মুখে পথেঘাটে ঘুরছে। চাকরির সন্ধানে দেশ থেকে আসা লোকজনদের মাহতাব সাহেব কঠিন ধমক দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিদায় করেন। খলিলুল্লাহর ব্যাপারে এটা করতে পারছেন না। কারণ, তিনি টুনটুনিকে কথা দিয়েছেন আগামী এক সপ্তাহ কারো সঙ্গে রাগারাগি করবেন না। মুখ হাসি-হাসি করে রাখবেন।

মাহতাব সাহেব মুখ হাসি-হাসি করেই রেখেছেন। প্রচণ্ড রাগ নিয়েও মুখ হাসি-হাসি করে রাখা একটি কষ্টকর প্রক্রিয়া। তাঁকে এই কষ্টকর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। কতক্ষণ যেতে পারবেন সেটা হলো কথা।

খলিলুল্লাহ আবার ঢুকছে। সে লুঙ্গির উপর একটা চকচকে হলুদ সার্ট পরে এসেছে। গলায় মাফলারের মতো ভেজা গামছা পেঁচানো। মাহতাব সাহেব তাকে গলায় গামছা পরতে বলেন নি। মনে হচ্ছে গলায় গামছা পরাটাকে সে সাজসজ্জার অংশ হিসেবে নিয়েছে।

আমার কাছে চাকরির সন্ধানে এসেছ?

খলিলুল্লাহ কিছু বলল না। আগের মতো পায়ের বুড়ো আঙুল ওঠানামা করাতে লাগল। তবে এখন সে দুটো পায়ের বুড়ো আঙুলই নাচাচ্ছে।

দেশের বাড়িতে কী কাজ করতে?

মাটি কাটতাম।

মাটি কাটা ছাড়া আর কোনো কাজ জানো?

জ্বে না।

মাটি কাটা বন্ধ করে ঢাকায় এসেছ কেন?

খলিলুল্লাহ জবাব দিল না। তার দৃষ্টি পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে।

মাহতাব সাহেব বললেন, ঢাকা শহরে মাটি কাটার কাজ নেই। শহরে মাটিই নেই, কাটবে কীভাবে? ঢাকা শহর হলো ইট-সিমেন্টের। ইট-সিমেন্ট কাটতে পারো?

জ্বে না।

তাহলে তো আর করার কিছু নেই। বাড়ি চলে যাও।

জ্বে আইজা। চইল্যা যাব।

মাহতাব সাহেব খুবই বিস্মিত হলেন। বাড়ি চলে যাবার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে ঘাড় কাত করে বলছে-জে আইচ্ছা। এইসব ক্ষেত্রে নানান অনুনয় বিনয় চলে। ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে আছি-এ জাতীয় কথাবার্তা বলা হয়। কেউ এক কথায় বাড়ি চলে যেতে রাজি হয় না।

বাড়িতে যে যাবে যাবার ভাড়া আছে?

জ্বে না।

যাবে কীভাবে?

হাঁটা পথে।

হাঁটা পথে মানে কি হেঁটে হেঁটে?

জ্বে।

হেঁটে হেঁটে চলে যেতে পারবে?

জ্বে। হাঁইটা আসছি। হাঁইটা যাব।

নেত্রকোনা থেকে ঢাকা হেঁটে এসেছ?

জ্বে।

কত ঘণ্টা লেগেছে?

ঘণ্টার হিসাব করি নাই। সকালে রওনা দিলে পরের দিন দুপুরের মইধ্যে যাওয়া যায়।

সারাদিন সারারাত হাঁটতে হবে?

জ্বে।

শোন খলিলুল্লাহ, তোমার হেঁটে যাবার কোনো দরকার নেই। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে। তারপরে আমার কেয়ারটেকার আছে, তার কাছ থেকে বাস-ভাড়া নিয়ে চলে যাও। কেয়ারটেকারের নাম বারেক মিয়া।

জ্বে আইচ্ছা।

দেশের বাড়িতে তোমার আছে কে?

কেউ নাই। আমি একলা।

বাড়িঘর আছে?

জ্বে না।

বাড়িঘর নাই ঘুমাও কোথায়?

এর-তার বাড়ির উঠানে শুইয়া থাকি। মাঝে মইদ্যে মসজিদে ঘুমাই।

ঠিক আছে এখন যাও। দুপুরে চলে যাবে।

জ্বে আইচ্ছা।

খলিলুল্লাহ পা ছুঁয়ে সালাম করতে এলো। মাহতাব সাহেব বললেন, সালাম করতে হবে না। খলিলুল্লাহ সালাম না করে উঠে দাঁড়াল। মাহতাব সাহেব বললেন, আমার বাড়িতে চাকরির গাছ নেই যে গাছ ভর্তি চাকরি ফল ফলে আছে। তোমরা কেউ আসবে আর আমি বঁাশ দিয়ে চাকরি ফল পেড়ে তোমাদের হাতে একটা করে ধরিয়ে দেব। কাঁচা পাকা ফলের মতো, কোনোটা কাঁচা চাকরি, কোনোটা পাকা চাকরি। বুঝতে পেরেছ কী বলছি?

খলিলুল্লাহ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমি চাকরির জন্যে আসি নাই।

মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, চাকরির জন্যে আসোনি তাহলে কীসের জন্যে এসেছ? ঢাকা শহর দেখতে? চিড়িয়াখানা, এয়ারপোর্ট দেখে বেড়াবে? না-কি চিকিৎসার কোনো ব্যাপার। পেটেব্যথার চিকিৎসা?

খলিলুল্লাহ সার্টের পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিল। মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কী?

হেডমাস্টার সাব একটা পত্র দিয়েছেন।

মাহতাব সাহেব ভুরু কুঁচকালেন। এই আরেক সমস্যা, গ্রাম থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চিঠি দিয়ে পাঠাচ্ছে—অমুকের চিকিৎসা করাতে হবে। তমুকের মেয়ের বিবাহ, সাহায্য লাগবে। হেডমাস্টার সাহেব জাতীয় মানুষরা চিঠি দিয়েই খালাস। মাহতাব চিঠিতে চোখ বুলালেন—

জনাব মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী,

আসসালাম। আমি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার হাবীবুর রহমান। আপনার সঙ্গে পরিচয় হইয়াছিল, সম্ভবত আপনার ইয়াদ আছে। আপনার মতো বিশিষ্ট মানুষ আমার মতো নাদানকে মনে রাখবেন ইহা আমি আশা করি না। যা হউক, পত্ৰবাহক খলিলুল্লাহকে আপনার নিকট পাঠাইলাম। সে বছর তিনেক আগে মাটি কাটা শ্ৰমিকদলের সহিত আমাদের অঞ্চলে উপস্থিত হয়। এলজিআরডির রাস্তার কাজ সম্পন্ন হইবার পর সমস্ত শ্রমিকদল বিদায় হইয়া গেলেও খলিলুল্লাহ থাকিয়া যায়। সারাদিন কাজ-কাম করিয়া সে গ্রামবাসী কারো একজনের উঠানে শুইয়া ঘুমাইত। সে কিছুদিন আমার বাড়িতেও ছিল। এই সময় তাহার কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা আমার চোখে পড়ে।

অল্প কথায় বলিতে গেলে আমি বিস্ময়াভিভূত। আপনারা শহর অঞ্চলে বাস করেন। জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আপনারা এইসব জিনিসের মূল্য বুঝিবেন বিধায় তাহাকে আপনার নিকট পাঠাইলাম। যদি অপরাধ হয় নিজগুণে ক্ষমা করিবেন। পত্রের ভুল-ত্ৰুটি মার্জনীয়।

আরজগুজার
হাবীবুর রহমান

মাহতাব সাহেব খলিলুল্লার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই চিঠিতে কী লেখা তুমি জানো?

জ্বে না।

পড়তে জানো না?

জ্বে না।

চিঠিতে লেখা তোমার কী সব ক্ষমতা না-কি আছে। কী ক্ষমতা?

আমি জানি না।

মাটি কাটার বাইরে আর কিছু করতে পারো?

খলিলুল্লাহ বলল, কলের জিনিস ফইড় করতে পারি।

কলের জিনিস ফইড় করতে পারো মানে কী?

খলিলুল্লাহ বিভ্রান্ত হয়ে গেল। মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ। এখন সামনে থেকে যাও।

খলিলুল্লাহ বলল, জ্বে আইচ্ছা। স্যারের চিঠিটা কি ফিরত নিয়া যাব?

চিঠি ফেরত নিতে হবে না। চিঠি থাক। তুমি ফেরত যাও।

জ্বে আইচ্ছা।

মাহতাব সাহেবের মনে হলো, খলিলুল্লাহ বেশ আনন্দের সঙ্গেই ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তার চেহারা এবং কথাবার্তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে সে অতি নির্বোধ একজন মানুষ। অতি নির্বোধদের কর্মকাণ্ডে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকে গ্রামের মানুষদের কাছে নির্বোধের অস্বাভাবিকতাকে মনে হয় বিরাট কিছু। খলিলুল্লাহর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কুমিল্লা শহরে এরকম এক অর্ধউন্মাদ নির্বোধ নিয়ে কম নাচানাচি হয়নি। তার বিরাট ভক্ত দল জুটে গেল। সবার মুখে পিরপাগলা, পির-পাগলা। তিনি নিজেও একদিন পির-পাগলাকে দেখতে গেলেন, পির পাগলা ফোৎ করে না থেকে সর্দি ঝেড়ে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, চেটে খেয়ে ফেল। তিনি হতভম্ব। পির-পাগলাকে ঘিরে যারা বসেছিল তাদের একজন বলল, ভাইসাব চোখ বন্ধ করে টান দিয়ে খেয়ে ফেলেন। আপনার গতি হয়ে যাবে।

মাহতাব সাহেব ঘড়ি দেখলেন। টুনটুনিকে নিয়ে বের হবার কথা। সে এখনো তার ঘর থেকে বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সমস্যা হয়েছে। টুনটুনি বলে গিয়েছিল, দুই মিনিটের মধ্যে নামছি বাবা। দু মিনিটের জায়গায় কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে। বান্ধবীদের নিয়ে সুইমিংপুলে ঝাঁপাঝাঁপির প্রোগ্রাম হয়তো বাতিল হয়ে গেছে। টুনটুনির বেশির ভাগ প্রোগ্রাম শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে যায়। সে তখন তার ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একা বসে থাকে।

টুনটুনি নামটা শুনলে মনে হয় সে নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে, বয়স চার কিংবা পাঁচ। আসলে টুনটুনির বয়স এই নভেম্বরে তেরো হবে। সে হেলিক্রস স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। সায়েন্স গ্রুপ। পৃথিবীর সমস্ত বাবা-মা যে আদর্শ সন্তানের কথা ভাবেন টুনটুনি সেরকম একজন। টুনটুনির স্বভাব-চরিত্রে কোনো ক্রটি আছে কিনা এটা ধরার জন্যে যদি কোনো তদন্ত-কমিশন বসে এবং হাইকোর্টের কোনো বিচারপতি যদি তদন্ত-কমিশনের চেয়ারম্যান হন তাহলেও কোনো ত্রুটি ধরা পড়বে না।

বাবা-মারা চান তাদের ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো হোক। টুনটুনি তাদের সেকশানের ফার্স্ট গার্ল। এসএসসি পরীক্ষায় এই মেয়ে যে স্ট্যান্ড করবে এ বিষয়ে শিক্ষকরা একশ ভাগ নিশ্চিত।

বাবা-মার স্বপ্ন তাদের ছেলেমেয়ে শুধু পড়াশোনা না, অন্য বিষয়েও ভালো করবে। গান-বক্তৃতা-নাটক-লেখালেখি। টুনটুনি চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। আঠারো বছর হবার আগে রেডিও বা টেলিভিশনে এনলিস্টেড হবার নিয়ম নেই বলে সে এনলিস্টেড না। টেলিভিশনের নতুন কুঁড়িতে সে রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছে।

গান ছাড়াও সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় টুনটুনি একটা জিনিস শিখেছে, তার নাম ম্যাজিক। তার জন্মদিনে সে একটা বই পেয়েছিল, বইটার নাম 1001 Tricks। বই পড়ে-পড়ে হাত সাফাইয়ের এই বিদ্যা সে নিখুঁত আয়ত্ত করেছে। একটা আস্ত পেনসিল নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া, কয়েন শূন্যে ভ্যানিস করে দিয়ে অন্যের কান থেকে বের করা, দড়ি কেটে জোড়া লাগানো এই ম্যাজিকগুলি সে চমৎকার করে দেখাতে পারে। তাদের আমেরিকান ক্লাস টিচার (মিস এলেন) একবার টুনটুনির নাকের ফুটো দিয়ে পেনসিল ঢোকানোর ম্যাজিক দেখে Stop it! বলে এমনভাবে কেঁপে উঠলেন যে চেয়ার নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন। বহুগুণে গুণবতী হওয়া সত্ত্বেও টুনটুনির কোনো বন্ধু নেই। তার ক্লাসের মেয়েরা তার সঙ্গে গল্প বলার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ বোধ করে না। তাদের জন্মদিনে সবার দাওয়াত হয়—টুনটুনির কথা সবাই ভুলে যায়। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে দুজন দুজন করে গ্রুপ। দেখা গেল টুনটুনিকে নিয়ে কেউ গ্রুপ করতে চাচ্ছে না। ফিজিক্স টিচার মিসেস রিতা বললেন জেসমিন (টুনটুনির ভালো নাম জেসমিন চৌধুরী) তোমার সঙ্গে কেউ আসতে চাচ্ছে না কেন? টুনটুনি ধরা গলায় বলল, কিছু হবে না ম্যাডাম।

কিছু হবে না মানে? তুমি একা কাজ করবে?

টুনটুনি বলল, আমাদের ক্লাসে odd number student। একজনকে তো একা থাকতেই হবে।

টুনটুনির খুবই মন খারাপ হলো। মন খারাপ হলে সে মন ভালো করার জন্যে কিছু কাজ করে। যেমন, মনে-মনে ইকরি মিকরি ছড়া বানায়। এই কাজটা সে খুব ছোটবেলায় করত, তখন দ্রুত মন ভালো হয়ে যেত। এখন আর এত দ্রুত মন ভালো হয় না, তবু হয়।

আজ এই মুহূর্তে টুনটুনির মন খুবই খারাপ। তার দুবান্ধবীর একজন। (তিতলী) বলেছে পিয়াল যদি যায় আমি অবশ্যই যাব। পিয়ালকে তার বাসা থেকে তুলে আমাকে তুলে নিয়ে যেও। পিয়াল বলেছে—আমি যাব না। আমার পেটব্যথা। আমি বিছানা থেকেই নামব না।

পিয়ালের কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কারণ কথা বলার সময় পিয়াল হাসছিল। প্রচণ্ড পেটব্যথা নিয়ে কেউ খিলখিল করে হাসতে পারে? টুনটুনির ধারণা তিতলী এবং পিয়াল দুজনে যুক্তি করে কাজটা করেছে। শুরুতেই তারা না বললেই পারত।

টুনটুনি মন খারাপ ভাবটা কাটাবার জন্যে ইকড়ি মিকড়ি ছড়া বানাচ্ছে।

ইকড়ি মিকড়ি ইকড়ি মিকড়ি।
এসেছে তিলী ফিকড়ি ফিকড়ি।
পিয়ালও এসেছে, পা তুলে বসেছে।
ব্যথা তার উঠেছে চিকড়ি চিকড়ি।
ইকড়ি মিকড়ি ইকড়ি মিকড়ি।

টুনটুনির দরজায় টোকা পড়ল। টুনটুনি বলল, কে?

মাহতাব উদ্দিন বললেন, দরজা বন্ধ করে বসে আছিস কেন রে মা? যাবি না?

টুনটুনি বলল, প্রোগ্রাম ক্যানসেল হয়েছে বাবা।

ক্যানসেল হলো কেন? বান্ধবীরা আসবে না?

না।

তারা না এলে না আসবে, আমি আর তুই আমরা দুজনে মিলে পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করব।

আমার আজ আর পানিতে নামতে ইচ্ছে করছে না।

দরজা খোল তো।

টুনটুনি দরজা খুলল। মাহতাব উদ্দিন মেয়ের বিষন্ন মুখ দেখলেন। তাঁর মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। মা-মরা এই মেয়েটির মন খারাপ হলে তাঁর নিজের মাথা এলোমেলো লাগে।

টুনটুনি।

বলো।

চৈত্রের দুপুরে পিতা-কন্যা পানিতে ভাসছে—এর আনন্দই অন্যরকম। মন খারাপ করে বসে থাকিস না, সুইমিং কস্টিউম বের কর।

টুনটুনি বলল, ঠিক আছে বের করছি।

মাহতাব সাহেব মেয়ের খাটে বসতে বসতে বললেন, তুই শুনে খুশি হবি যে আজ এখন পর্যন্ত আমি কারো সঙ্গে রাগারাগি করিনি। খলিলুল্লাহর সঙ্গে হাসি-হাসি মুখে কথা বলেছি।

খলিলুল্লাহ কে?

গ্রাম থেকে একজন এসেছে। নেত্রকোনা থেকে সরাসরি হেঁটে ঢাকায় চলে এসেছে।

কী জন্যে এসেছে? চাকরির জন্যে না সাহায্য?

কী জন্যে এসেছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। হেডমাস্টার সাহেব চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন তার না-কি বিশেষ কিছু ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা পরীক্ষা।

কী ক্ষমতা?

জানি না তোমা কী ক্ষমতা। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেও বলতে পারে না। সে বলল ফইড করতে পারে। ফই কী জিনিস কে বলবে।

টুনটুনি বলল, বাবা আমি উনার সঙ্গে কথা বলব।

মাহতাব সাহেব বললেন, কোনো দরকার নেই। যন্ত্রণা বাড়াবি না।

টুনটুনি বলল, দরকার আছে। তুমি তাকে আমার ঘরে পাঠাও।

সে হয়তো এতক্ষণে চলে গেছে।

চলে গেলে তাকে আবার ব্যবস্থা করো। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। প্লিজ। তার সঙ্গে কথা বলার পর তোমাকে নিয়ে পানিতে নামব।

টুনটুনির মুখ থেকে বিষাদ ভাবটা চলে গেছে। আগ্রহ এবং উত্তেজনায় টুনটুনির চোখ চকচক করছে। মাহতাব উদ্দিনের মনে হলো—অতি নির্বোধ একজন মানুষের কল্যাণে কিছুক্ষণের জন্যেও যদি তাঁর মেয়েটার মন ভালো হয় তাতে ক্ষতি কিছু নেই। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। খলিলুল্লাহ চলে গিয়ে থাকলে তাকে ফেরত আনার জন্যে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত লোক পাঠাতে হবে।

টুনটুনি বলল, আপনার নাম খলিলুল্লাহ?

খলিলুল্লাহ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার দৃষ্টি সুইমিংপুলের পানির দিকে। মানুষের বাড়ির ছাদেও যে দিঘি থাকতে পারে এই ধারণা সম্ভবত তার নেই। খলিলুল্লাহর চোখেমুখে চাপা উত্তেজনা। সে এক মুহূর্তের জন্যেও সুইমিংপুলের পানি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারছে না।

টুনটুনি কথা বলার জন্যে খলিলুল্লাহকে ছাদে নিয়ে এসেছে। বাবার সামনে কথা বলতে সে হয়তো অস্বস্তি বোধ করবে এই ভেবে মাহতাব সাহেবকে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে। টুনটুনি বসেছে সুইমিংপুলের উঁচু পাড়ে। খলিলুল্লাহ তার সামনেই দাঁড়ানো।

বাবা বলছিল আপনার না-কি কী ক্ষমতা আছে। কী ক্ষমতা? আমাকে বলুন। আমাকে বলতে কোনো সমস্যা নেই। আমি ছোট মানুষ তো। ছোট মানুষকে যে-কোনো কিছু বলা যায়।

খলিলুল্লাহ টুনটুনির কথার উত্তরে কিছু বলল না। আগের মতোই পানির দিকে তাকিয়ে রইল।

টুনটুনি বলল, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। রিলাক্সড হয়ে বসুন।

খলিলুল্লাহ বসল না। টুনটুনি বলল, আমারও কিন্তু ক্ষমতা আছে। আমি কী করতে পারি জানেন? আমি একটা পিংপং বলকে দুটা বানাতে পারি। আবার একটা বল শূন্যে ভ্যানিস করে দিতে পারি। দেখবেন?

খলিলুল্লাহ হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। টুনটুনি ব্যাগে করে ম্যাজিক দেখানোর জিনিস নিয়ে এসেছিল। একটা পিংপং বল দুটা করার ম্যাজিক খুব সহজ ম্যাজিক। তবে যারা ম্যাজিকের কৌশল জানে না তারা খুবই অবাক হয়। টুনটুনি আগ্রহ নিয়ে ম্যাজিকটা দেখাল। একটা পিংপং বল দুটা হয়ে যাচ্ছে। আবার একটা বল শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। খলিলুল্লাহ অবাক হয়ে ম্যাজিকটা দেখল। টুনটুনি বলল, আপনি কি এরকম পারেন?

জ্বে না।

তাহলে কী পারেন?

কলের জিনিস ফইড় করতে পারি।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। কলের জিনিস কী? আর ফইডইবা কী?

একটা নষ্ট কলের জিনিস দেন, আমি ফইড় করব।

আমি তো আপনার কথাই বুঝতে পারছি না। কলের জিনিস ফইড় করা ছাড়া আর কী পারেন?

পানির খেলা পারি।

পানির খেলাটা কী?

পানির মইধ্যে থাকতে পারি।

পানির মধ্যে তো সবাই থাকতে পারে। আমি একবার সন্ধ্যাবেলায়। সুইমিংপুলে নেমেছিলাম, রাত এগারোটায় উঠেছি। তারপর আমার অবশ্যি জ্বর এসে গিয়েছিল।

খলিলুল্লাহ নিচু গলায় বলল, পানির মইধ্যে নাইম্যা আমার খেলাটা দেখাই? দেখাইলে বুঝবেন। না দেখাইলে বুঝবেন না।

সুইমিংপুলে নামতে চান?

খলিলুল্লাহ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। টুনটুনি বলল, আপনি সুইমিংপুলে নামলে বাবা খুব রাগ করবেন।

তাইলে থাউক।

টুনটুনি বলল, পানির খেলাটা কী রকম? একরোবেটিক কিছু?

খলিলুল্লাহ বলল, না দেখলে বুঝবেন না। দেখলে মজা পাইবেন। সবেই মজা পায়।

আপনার এই খেলা দেখলে সবাই মজা পায়? জ্বে পায়।

টুনটুনির খুবই ইচ্ছা করছে পানির খেলাটা দেখতে। খেলাটা সত্যি সত্যি যদি খুব মজার হয় তাহলে সেও শিখে নিতে পারবে। এই খেলা দেখিয়ে অন্যদের অবাক করে দিতে পারবে। লোকটা যদি সাবান দিয়ে গোসল করে তারপর পানিতে নামে তাহলে কি বাবা খুব বেশি রাগ করবেন?

এই খেলা দেখাতে আপনার কতক্ষণ লাগবে?

আপনে যতক্ষণ বলবেন ততক্ষণ দেখাব।

আচ্ছা বেশ, দেখান আপনার খেলা। বেশিক্ষণ দেখাতে হবে না, অল্প কিছুক্ষণ দেখালেই হবে। পানিতে নামার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে-গায়ে সাবান মেখে খুব ভালো করে গোসল করতে হবে। ডান দিকের হলুদ দরজাওয়ালা ঘরটায় শাওয়ার আছে, সাবান আছে। ভালো করে গোসল করে নিন। শাওয়ার কী করে ছাড়তে হয় জানেন?

জ্বে না।

আসুন আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। আরেকটা কথা, আপনি পানিতে নামার সময় বাবা যদি হঠাৎ ছাদে এসে দেখে ফেলেন তাহলে তিনি খুবই রাগারাগি করবেন। কাজেই আপনি আপনার খেলাটা দ্রুত দেখিয়ে উঠে পড়বেন। ঠিক আছে?

খলিলুল্লাহ ঘাড় কাত করে হাসল। এই প্রথম মনে হলো বাচ্চা মেয়েটার কথাবার্তায় সে খুব মজা পাচ্ছে।

টুনটুনি ভেবেছিল পানির খেলাটা খুব জটিল কিছু হবে। বাস্তবে দেখা গেল ব্যাপারটা জটিল কিছু না। পানিতে হাত-পা ছড়িয়ে ডুবে থাকা। টুনটুনিদের সুইমিংপুলে পানি বেশি নেই। সবচে গভীর জায়গাটা মাত্র পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। অগভীর জায়গাটা সাড়ে তিন ফুট। খলিলুল্লাহ নামের লোকটা অগভীর জায়গায় হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। পরিষ্কার পানিতে তার চোখমুখ দেখা যাচ্ছে। টুনটুনি প্রথমে ভাবল যে সে পানির নিচে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, হাসছে—এটাই বোধহয় খেলা। খেলাটা যে এরচেয়েও অনেক বেশি জটিল এটা বুঝতে তার কিছুক্ষণ সময় লাগল। যখন সে বুঝতে পারল তখন বুকে ধাক্কার মতো লাগল। মানুষ দুএক মিনিটের বেশি পানির নিচে থাকতে পারে না। খলিলুল্লাহ পানির নিচে অনেকক্ষণ হলো আছে। সেই অনেকক্ষণ মানে কতক্ষণ। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট না তার চেয়েও বেশি? এটা কী করে সম্ভব? এটা কি ম্যাজিকের কোনো কৌশল?

সিড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সুইমিং কস্টিউম পরে মাহতাব সাহেব আসছেন। তিনি টুনটুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, খলিলুল্লাহর সঙ্গে তোর ইন্টার কি শেষ হয়েছে?

টুনটুনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

মাহতাব সাহেব বললেন, লোকটার ক্ষমতার কোনো নমুনা দেখেছিস। ফইড় খেলা দেখিয়েছে?

টুনটুনি কিছু বলল না।

মাহতাব সাহেব বললেন, সে গেছে কোথায়?

টুনটুনি আঙুল দিয়ে সুইমিংপুলের পানি দেখিয়ে চাপা গলায় বলল, বাবা, লোকটা খুব কম করে হলেও দশ মিনিট হলো পানিতে ডুবে আছে।

মাহতাব সাহেব ঘড়ি ধরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সুইমিংপুলের পাশে বসে রইলেন। এক পলকের জন্যেও খলিলুল্লাহর মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরালেন না। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিটে তিনি ছটা সিগারেট খেয়ে ফেললেন। এক সময় হাত ইশারা করে খলিলুল্লাহকে পানি থেকে উঠতে বললেন। সে খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে এলো।

মাহতাব সাহেব শীতল গলায় বললেন, তুমি নিচে যাও। আজ আর তোমার দেশের বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই।

খলিলুল্লাহ বলল, জে আইচ্ছা!

মাহতাব উদ্দিন টুনটুনির দিকে তাকিয়ে আছেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। টুনটুনি কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। সে বাবার কাছ থেকে শুনতে চায়। মাহতাব সাহেব সপ্তম সিগারেটটা ধরালেন। টুনটুনি বলল, তুমি অনেকগুলি সিগারেট খেয়ে ফেলে।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, হুঁ।

টুনটুনি বলল, সুইমিংপুলে নামবে?

মাহতাব উদ্দিন বললেন, না।

আজ খুব গরম পড়েছে তাই না বাবা?

হুঁ।

টুনটুনি বলল, সবচে গরম কোন মাসে পড়ে বাবা? চৈত্র মাসে না ভাদ্র মাসে?

জানি না।

পিতা-কন্যা এমনভাবে কথা বলছে যেন কিছুক্ষণ আগে সুইমিংপুলে কোনো ঘটনা ঘটেনি। যেন দুজনই ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চায়। টুনটুনি বলল, আবহাওয়াটা কেমন যেন ভারি হয়ে আছে। বাবা, একটা জোকস বলে।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, একটা অফিসে টেলিফোন এসেছে। অফিসের বসকে টেলিফোনে চাইছে। বসের সেক্রেটারি বলল, আপনি কে বলছেন পরিচয় দিন, স্যার যার তার সঙ্গে কথা বলেন না। টেলিফোনের ওপাশ থেকে ভারি গলা শোনা গেল, আমি অনেক উপরের লোক। তোমার বসকে দাও।

আপনি কি কোনো মন্ত্রী?

না, আমি তারও উপরে?

আপনি কি প্রধানমন্ত্রী?

আরে না, আমি তারও উপরে।

বলেন কী? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন না তো?

তারও উপরে?

বলেন কী? আপনি কি আল্লাহ?

আরে না তারও উপরে।

আল্লাহর উপরে তো কেউ না।

আমি সেই কেউ না।

গল্প শুনে টুনটুনি খিলিখিল করে হাসছে। মাহতাব উদ্দিন বললেন, তোর হাতে পিংপিং বল না? দেখি পিংপং বলের খেলাটা আরেকবার দেখা তো।

টুনটুনি দেখাল। একটা বল দুটা হয়ে যাচ্ছে। দুটা বল একটা হচ্ছে।

তোর হাত তো খুব চালু হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে একেবারে প্রফেশনাল। নতুন কী জাদু শিখলি?

টুনটুনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, বাবা আমরা দুজনাই ভান করছি যেন এখানে কিছুই হয়নি। কোনো ঘটনা ঘটে নি। সব স্বাভাবিক। কিন্তু দুজনই খলিলুল্লাহর ঘটনা দেখে ধাক্কার মতো খেয়েছি। এই বিষয়ে কিছু বলে।

চিন্তা করছি।

চিন্তা করে কিছু পাচ্ছ না?

একটা জিনিস পাচ্ছি—এরকম কিছু ঘটতে পারে না। মানুষ স্থলচর প্রাণী। উভচর প্রাণী না। বেঁচে থাকার জন্যে মানুষকে প্রচুর অক্সিজেন নিতে হয়। এই অক্সিজেন সে বাতাস থেকে নেয়। পানিতে যে সব প্রাণী বাস করে তাদেরও অক্সিজেন লাগে। তারা সেই অক্সিজেন পানি থেকে নেয়। মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই এক ঘণ্টা পানিতে বসে থাকা সম্ভব না।

খলিলুল্লাহ কীভাবে থাকল।

সে কোনো একটা কৌশল করেছে। সে কৌশল আমরা ধরতে পারছি না। ডুবুরিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির নিচে থাকে। তারাও কৌশল ব্যবহার করে। অক্সিজেন মাস্ক পরে থাকে। খলিলুল্লাহ যে কৌশল ব্যবহার করেছে সেটা অপ্রকাশ্য কৌশল। আমরা তা বুঝতে না পেরে হকচকিয়ে গেছি। কোনো কিছু দেখে হকচকিয়ে গেলেই যে জিনিসটা সত্যি তা কিন্তু না। আমরা যখন স্টেজে ম্যাজিক-শো দেখতে যাই তখন কী দেখি? তখন দেখি জাদুকর জুয়েল আইচ ইলেকট্রিক করাত দিয়ে একটা মেয়েকে কেটে দুভাগ করছেন। ঘটনাটা সবার চোখের উপর ঘটলেও ঘটনা সত্যি না।

তোমার ধারণা খলিলুল্লাহ যা দেখিয়েছে তা সত্যি না?

না।

তাহলে সে এটা কীভাবে করেছে?

জানি না কীভাবে করেছে। আমি চিন্তা করছি।

উনাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়?

জুয়েল আইচকে যদি জিজ্ঞেস করি, আপনি কীভাবে করাত দিয়ে কেটে একটা মেয়েকে দুভাগ করেন, তিনি কী উত্তর দেবেন? উত্তর দেবেন না। খলিলুল্লাহ উত্তর দেবে না। আমি অবশ্যই খলিলুল্লাহকে প্রশ্ন করব। তবে আঁটঘাট বেঁধে প্রশ্ন করব। তখন উত্তর দেয়া ছাড়া তার অন্য উপায় থাকবে না।

আঁটঘাট কীভাবে বাঁধবে?

জানি না কীভাবে বাঁধব। চিন্তা করছি।

টুনটুনি হঠাৎ হেসে ফেলল। মাহতাব সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, হাসছিস কেন?

তুমি খুবই ঘাবড়ে গেছ বাবা। তোমার চোখমুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। তোমাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে আমার হাসি পাচ্ছে।

মাহতাব উদ্দিন অষ্টম সিগারেটটা ধরিয়ে চিন্তিত মুখে টানতে লাগলেন। সেদিন বিকেলেই তিনি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাবীবুর রহমান সাহেবের কাছে চিঠি দিয়ে লোক পাঠালেন। তিনি লিখলেন–

জনাব হাবীবুর রহমান

শ্ৰদ্ধাভাজনেষু,

আপনার চিঠি পেয়েছি। যার মারফত চিঠি পাঠিয়েছেন সে আমার বাড়িতেই আছে। তার কিছু ক্ষমতার কথা আপনি বলেছেন। কী ধরনের ক্ষমতা তা ব্যাখ্যা করেন নি। দয়া করে বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে লিখে জানাবেন, তাহলে আমার অনুসন্ধান করতে সুবিধা হবে। লোকটির পূর্ণ ইতিহাসও জানাতে চেষ্টা করবেন। ইতিহাস বলতে আমি তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, আচার ব্যবহারের কথা বলছি। আমি তাকে তার বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি—সে বলেছে সে কলের জিনিস ফইড় করতে পারে। ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয় নি। আপনি এ বিষয়ে যা জানেন তা আমাকে জানাবেন। খলিলুল্লাহর দেশের বাড়ি কোথায়, তার আত্মীয়স্বজন কে আছে তাও জানাবেন। আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা আছে। সময় সুযোগমতো ইনশাল্লাহ সাক্ষাৎ হবে। আপনি ভালো থাকবেন।

বিনীত
মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী

মাহতাব উদ্দিন চিঠি লিখলেন, টুনটুনি লিখল ডায়েরি। তার একটা ডায়েরি আছে। নীল মলাটের ডায়েরিটার নাম দুঃখ ডায়েরি। তার জীবনে দুঃখ বা কষ্টের কিছু ঘটলে সে এই ডায়েরিতে তা লিখে রাখে। লাল মলাটের ডায়েরির নাম আনন্দ ডায়েরি। আনন্দময় ঘটনাগুলি এই ডায়েরিতে লেখে। তিন নম্বর ডায়েরিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি থাকে। এই ডায়েরিতে সে লিখল—

আলেকজান্ডার বেলায়েভের একটি উপন্যাসের নাম উভচর মানুষ। আমি যে কয়টি ভালো উপন্যাস পড়েছি এটা তার একটা। বইটা কিছুদিন আগেও আমার কাছে ছিল। এখন হারিয়ে গেছে। বইটির নায়ক উভচর মানুষ। সে স্থলেও থাকতে পারে আবার পানিতেও থাকতে পারে। প্রথমবার বইটি পড়ে বইয়ের নায়কের দুঃখে খুব কেঁদেছিলাম। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম যেন আল্লাহ আমাকে উভচর মানুষ বানিয়ে দেন। খুবই মজার ব্যাপার, আমাদের বাড়িতে এখন একজন উভচর মানুষ বাস করে। এই মানুষটার নাম খলিলুল্লাহ। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে থাকতে পারে। মানুষটা সম্পর্কে আমরা কেউ কিছু জানি না। তবে খুব শিগগিরই আমি জেনে ফেলব। আমি বিশটি প্রশ্ন তার জন্যে তৈরি করছি। প্রশ্নগুলো তৈরি হয়ে গেলেই আমি তাঁকে প্রশ্ন করব এবং উত্তরগুলিও লিখে ফেলব। লোকটি যদি সত্যি উভচর হয় তাহলে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে হৈচৈ পড়ে যাবে। তবে আমার বাবার ধারণা লোকটা কোনো একটা কৌশল করে পানির নিচে থাকে। জাদুর কৌশলের মতো কোনো কৌশল। বাবার ধারণাও ঠিক হতে পারে। বাবা খুবই বুদ্ধিমান একজন মানুষ।

হাবীবুর রহমান সাহেব চিঠির জবাব পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন–

জনাব মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী,

আসসালাম। লোক মারফত আপনার পত্ৰ পাইয়াছি। আপনার কুশল জানিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছি। আমার নিজের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো যাইতেছে না। বৃদ্ধ বয়সের নানান আধি ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিছুদিন যাবৎ প্রস্রাবে সমস্যা হইতেছে। প্রস্রাবের সময় খুব জ্বালাপোড়া করে। স্থানীয় ডাক্তার চিকিৎসা করিতেছেন। তেমন ফল পাইতেছি না। তিনি ঢাকায় বড় ডাক্তার দেখাইবার জন্য পরামর্শ দিতেছেন। ঢাকায় আমার চেনা-জানা কম। এখন আপনি একমাত্র ভরসা। আপনার মতো মানুষের সহায়তা পাইলে আমার মতো নাদানের জন্য অত্যন্ত উপকার হয়। হোটেলে থাকিয়া চিকিৎসার ব্যয় সঙ্কুলান আমার জন্যে অসম্ভব ব্যাপার। বিষয়টি আপনার গোচরে আনিলাম। এখন আপনার মর্জি।

খলিলুল্লার বিষয়ে আসি। আপনি লিখিয়াছেন নষ্ট কল ফইড় করিতে পারি এই বাক্যটির অর্থ আপনি উদ্ধার করতে পারিতেছেন না। ফইড় নেত্রকোনার আঞ্চলিক শব্দ। এর অর্থ ঠিক করা। খলিলুল্লাহ যন্ত্রপাতি ঠিক করতে পারে। যদিও কলকবজার বিষয়ে সে কিছুই জানে না। ট্রানজিস্টার রেডিওর সমস্যা সে ধরিতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করতে পারে। আমার বাসায় একটি ১৪ ইঞ্চি টিভি দীর্ঘদিন অকেজো পড়িয়া ছিল। নেত্রকোনা শহরে রেডিও-টিভি সারাই-এর দোকানে পাঠাইয়াও ফয়দা হয় নাই। সেই টিভিও খলিলুল্লাহ ঠিক করিয়া দিয়াছে। এই কাজটি সে কীভাবে করে তা এক বিরাট রহস্য। আল্লাহপাকের জগৎ রহস্যময়। তিনি একেকজন মানুষকে একেক ক্ষমতা দিয়া পঠাইয়াছেন। খলিলুল্লাহর যন্ত্রপাতি ঠিক করিবার এই আশ্চর্য ক্ষমতা আপনি নিজে পরীক্ষা করিলে খুবই মজা পাইবেন। খলিলুল্লাহ বিষয়ে এরচে বেশি কিছু আমি জানি না। অবশ্য সেইভাবে খোঁজ-খবরও নেই নাই। যদি বলেন অনুসন্ধান করিব। অনুসন্ধানে ফল হইবে কিনা জানি না। বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি স্কুলের পুকুরে দীর্ঘ সময় পানিতে ডুবিয়া থাকিবার খেলা দেখাইয়াও সে অনেকের প্রশংসা কুড়াইয়াছে।

পত্র এইখানে শেষ করিতেছি। আপনি আমার জন্যে দোয়া করিবেন। দয়াময়ের নিকট আপনার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করি।

আরজগুজার
হাবীবুর রহমান বিএ বিটি
অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার
নীলগঞ্জ হাইস্কুল

পুনশ্চ : আমার বড় বৌমা মুসাম্মাদ দিলশাদ খানম খলিলুল্লাহ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানে। সে তার শাশুড়ি আম্মাকে বলিয়াছে যে খলিলুল্লাহ সম্পর্কে সে খুব আশ্চর্যজনক কিছু কথা জানে। সে সব কথা প্রকাশ করা সমীচীন নহে।

বড় বৌমা সন্তান-সম্ভবা। এখন বাপের বাড়িতে আছে। আপনি আগ্রহী হইলে বড় বৌমার নিকট তথ্য সংগ্রহ করিয়া আপনাকে পাঠাইতে পারি।

টুনটুনি দশটি প্রশ্ন এবং তার উত্তর জোগাড় করেছে। কিছু কিছু উত্তরের সঙ্গে তার মন্তব্যও আছে। টুনটুনির প্রশ্নোত্তর পর্ব এই রকম

১ম প্রশ্ন : আপনার নাম কী?

উত্তর: আমার নাম খলিলুল্লাহ। লোকে আমারে ডাকে

খলিল। কেউ কেউ ডাকে খইল্যা।

মন্তব্য: এই প্রশ্নটি করা ঠিক হয় নি। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। শুধু জানি না যে, তাকে কেউ কেউ খইল্যা ডাকে। খইল্যা নিশ্চয়ই আপমানসূচক ডাক।

২য় প্রশ্ন : আপনার দেশের বাড়ি অর্থাৎ গ্রামের বাড়ি কোথায়?

উত্তর: জানি না তো মা। আমি ছোট থাইক্যা ভাইস্যা বেড়াইন্যার দলে।

মন্তব্য : লোকটার কথা থেকে মনে হচ্ছে কিছু লোকজন আছে যারা ভেসে বেড়ায়। যাযাবররা ভেসে বেড়ায়। তারা কোথাও বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে পারে না। বেদেরাও ভেসে বেড়ায়। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে যাযাবর হতে ইচ্ছা করে।

৩য় প্রশ্ন : আপনি কি লেখাপড়া জানেন?

উত্তর: না।

৪র্থ প্রশ্ন : স্বরে অ, স্বরে আ, ক, খ, জানেন না?

উত্তর: না।

মন্তব্য : আমি ঠিক করেছি তাকে লেখাপড়া শেখাব। আমার ধারণা তিনি খুব অল্প সময়ে লেখাপড়া শিখতে পারবেন।

৫ম প্রশ্ন : আপনি পানির নিচে কতক্ষণ থাকতে পারেন? আপনার সর্বোচ্চ রেকর্ড কী?

উত্তর: পানির ভিতরে ঢুকলে সময়ের হিসাব থাকে না। যতদিন থাকতে বলেন থাকতে পারব।

মন্তব্য : লোকটা বলে কী? সে কি আসলেই উভচর মানব। আমার খুবই অবাক লাগছে।

৬ষ্ঠ প্রশ্ন : বেঁচে থাকার জন্যে মানুষকে নিশ্বাস প্রশ্বাস নিতে হয়। তার অক্সিজেন প্রয়োজন। আপনি অক্সিজেন কোথায় পান?

উত্তর: অক্সিজেন জিনিসটা কী আমি জানি না তো আম্মা।

৭ম প্রশ্ন : পানিতে আপনি নিশ্বাস নেন না?

উত্তর: জ্বে না। নিশ্বাস বাতাসে নিতে হয়। পানির মধ্যে নিতে হয় না। নাক দিয়া ঢুকলে মাথাত যন্ত্ৰণা হয়।

৮ম প্রশ্ন : আপনি যে পানিতে থাকতে পারেন এটা কখনবুঝতে পারলেন।

উত্তর: খুবই ছোট সময়ে। পুসকুনিত হাত ধুইতে গিয়া পানিতে পইড়া গেছিলাম। তারপর দেখি খুবই মজা। সারা দিঘি ঘুইরা বেড়াইছি। এই দিকে সবেই ভাবছে আমার মৃত্যু হয়েছে। পানিত জাল ফালাইছে। হিঃ হিঃ হিঃ।

৯ম প্রশ্ন : আপনি যে দীর্ঘ সময় পানিতে থাকতে পারেন এটা নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় নি? পত্রিকায় লেখালেখি হয় নি?

উত্তর: ইস্কুলের পিছনের পুসকুনিতে দুইবার খেলা দেখাইছি। ম্যালা লোকজন হইছিল। চেয়ারম্যান সাব আমার লেখা দেইখ্যা খুশি হইয়া আমারে রুপার মেডেল দিছিল। মেডেল হারাইয়া ফেলছি।

১০ম প্রশ্ন : এটাকে খেলা বলছেন কেন?

উত্তর: আ গো, এইটা তো খেলাই। ডুব দিয়া কে কতক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারে—এই খেলা সব সময় খেলা হয়। অন্যরা কম পারে, আমি বেশি পারি।

টুনটুনি ঠিক করেছে খলিলুল্লাকে নিয়ে সে স্ক্র্যাপ বুকের মতো বানাবে। খলিলুল্লাহর সংক্ষিপ্ত জীবনী থাকবে। তার ছবি থাকবে। প্রশ্নোত্তর থাকবে। তার ওজন, উচ্চতা, চোখের মণির রঙ, সবই থাকবে। খলিলুল্লাহকে সে কী ডাকবে তা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেছে। আগে ঠিক করেছিল সে খলিল ভাই ডাকবে। কিন্তু খলিলুল্লাহ তাকে আম্মাজি ডাকছে। মা নিশ্চয়ই ছেলেকে ভাই ডাকতে পারে না।

০২. মাহতাব উদ্দিন সাহেবের দুটা অফিস

মাহতাব উদ্দিন সাহেবের দুটা অফিস। একটা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায়, অন্যটা বাদামতলীতে। তিনি সম্প্রতি ইটের ভাটা বসিয়েছেন। ইট বানানোর এই ব্যবসা খুবই লাভজনক বলে কাছাকাছি নতুন অফিস নিয়েছেন। অফিস বুড়িগঙ্গার পাশে। অফিস ঘরটা দোতলা। উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। চারদিকে প্রচুর লোকজন, ভিড়, হৈচৈ এর মধ্যে মাহতাব উদ্দিনের অফিস ঘরটা নির্জন।

মাহতাব সাহেব সময় পেলেই এই অফিসে বিশ্রাম নিতে আসেন।

তিনি যে ঘরে বসেন সেখান থেকে বুড়িগঙ্গা দেখা যায়। পুরনো দিনের ভারি একটা ইজিচেয়ার জানালার কাছাকাছি রাখা আছে। তিনি ইজিচেয়ারে শুয়ে বুড়িগঙ্গায় নৌকা চলাচল দেখেন।

আজও তিনি ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি অবশ্যি বুড়িগঙ্গার দিকে না। খলিলুল্লাহর দিকে। খলিলুল্লাহকে একটা কাজ দেয়া হয়েছে। নষ্ট টিভি ঠিক করেতে দেয়া হয়েছে। মাহতাব উদ্দিন তাকিয়ে আছেন। তীক্ষ্ণচোখে।

খলিলুল্লাহর হাতে যন্ত্রপাতি বলতে একটা বড় স্কু ড্রাইভার। টিভিটা রাখা হয়েছে টেবিলে। সে কাজ করছে দাঁড়িয়ে। অতি দ্রুত সে টিভির যন্ত্রপাতি খুলে ফেলছে। টেবিল ভর্তি হয়েছে নানান ধরনের স্কুতে। একেক ধরনের স্কু একেক জায়গায় রাখা উচিত। তা সে করছে না। সব এক জায়গায় রেখেছে। কোন স্কু কোথায় বসবে এটা সে মনে রাখবে কী করে কে জানে। এটা নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। এটা তার ব্যাপার।

মাহতাব সাহেব বললেন, খলিলুল্লাহ, টিভি কীভাবে কাজ করে তুমি জানো?

খলিলুল্লাহ বলল, জ্বে না।

একটা যন্ত্র সম্পর্কে তুমি কিছু জানোনা, যন্ত্রটা ঠিক করবে কীভাবে?

খলিলুল্লাহ জবাব দিল না।

টিভিটা ঠিক করতে কতক্ষণ লাগবে?

খলিলুল্লাহ বলল, ঠিক হয়ে গেছে।

মাহতাব সাহেব বললেন, ঠিক হয়ে গেছে।

খলিলুল্লাহ বলল, জ্বে হয়েছে।

এখন কানেকশান দিলে টিভি চলবে?

জ্বে চলবে।

মাহতাব সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, যদি না চলে আমি কানে ধরে তোমাকে একশ বার ওঠবস করা।

খলিলুল্লাহ অবাক হয়ে বলল, আমারে কানে ধইরা উঠবস কেন করাইবেন?

আমার সময় নষ্ট করেছ এই জন্যে। আমার সময়ের দাম আছে। যাই হোক টিভির স্কুগুলো লাগাও। এখানে ডিশের লাইন আছে কানেকশান দাও। তারপর কানে ধরে ওঠবস করার জন্যে তৈরি হয়ে যাও।

জ্বে আইচ্ছা।

আমি পুরস্কার যেমন দিতে পারি, শাস্তিও দিতে পারি। যদি দেখি সত্যি সত্যি টিভি ঠিক হয়েছে তাহলে তোমার জন্যে পুরস্কার আছে।

স্যার, আমার পুরস্কার লাগবে না।

না চাইলেও পুরস্কার দেয়া হবে। শাস্তির ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। শাস্তি না চাইলেও পাবে।

টিভির স্কু লাগানো হয়েছে। খলিলুল্লাহ বলল, কাউরে যন্ত্রটা চালু করতে বলেন।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, কাউকে চালু করতে বলতে হবে কেন? তুমি চালু কর। It is your duty.

খলিলুল্লাহ বলল, আমি যন্ত্র চালাইতে পারি না। ফইড় করতে পারি।

মাহতাব উদ্দিনকে কফির মগ এনে দেয়া হয়েছে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে তিনি টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর বাড়ির কেয়ারটেকার বারেক কানেকশান দিচ্ছে। একটু দূরে মেঝেতে গম্ভীর মুখে বসে আছে খলিলুল্লাহ। তার দৃষ্টি টিভি স্ক্রিনের দিকে না। তার দৃষ্টি তার নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। সে এখনো তার দুআঙুল নাচাচ্ছে।

টিভি-পর্দায় সুন্দর ছবি আসছে। শব্দ আসছে। বারেক কৌতূহলী হয়ে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। মাহতাব উদ্দিন তাকিয়ে আছেন খলিলুল্লাহর দিকে। যে নষ্ট টিভিটা ঠিক করেছে তার তো অন্তত একবারের জন্যে হলেও টিভি সেটের দিকে তাকানোর কথা। সে তাকাচ্ছে না। সে মুগ্ধ হয়ে নিজের বুড়ো আঙুলই দেখছে। মাহতাব উদ্দিন বারেকের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, বারেক, তুমি খলিলুল্লাহকে বাসায় নিয়ে যাও। দারোয়ানকে বলে দাও।

সে যেন বাসা থেকে বের হতে না পারে। তাকে ঘরে আটকে রাখো।

বারেক হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

মাহতাব সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, এই টিভি সেটটা কোনো মেকানিকের কাছে নিয়ে যাও। তাকে বলে এখান থেকে কোন আইসি খুলে রাখতে যেন টিভি সেটটা অচল হয়ে যায়। আইসি খুলে রাখার পর সেটটা বাসায় নিয়ে যাবে।

ঠিক আছে স্যার।

কী বলেছি বুঝতে পারছ?

পারছি।

কী বললাম, রিপিট করো।

বারেক বলল, খলিলুল্লাহকে বাসায় নিয়ে যাব। দারোয়ানকে বলব সে যেন বাসা থেকে বের না হতে পারে। টিভি সেটটা মেকানিকের কাছে নিয়ে যাব। মেকানিককে বলব একটা আইসি খুলে রাখতে। নষ্ট টিভিটাও বাসায় নিয়ে যাব।

ঠিক আছে। খলিলুল্লাহকে আমার কাছে পাঠাও।

খলিলুল্লাহ সামনে এসে দাঁড়াল। মাহতাব সাহেব বললেন, তোমাকে পুরস্কার দেব বলেছিলাম। পুরস্কার দিচ্ছি। বারেক তোমাকে দোকানে নিয়ে যাবে। সার্ট, প্যান্ট, স্যান্ডেল কিনে দেবে। নাপিতের দোকানে গিয়ে ভালোমতো চুলদাড়ি কাটবে। এই হলো পুরস্কার। বিড়ি সিগারেট খাও?

জ্বে না।

মাহতাব সাহেব মানিব্যাগ খুলে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করতে করতে বললেন, টাকাটা রাখো। তোমার হাতখরচ। যে কদিন তুমি আমার এখানে থাকবে পাঁচশ টাকা করে প্রতিদিন পাবে। মাটি কেটে দিনে কত করে পেতে?

আশি টাকা রোজ।

আশি টাকা রোজের জায়গায় তুমি পাচ্ছ পাঁচশ টাকা রোজ। এটা ভালো না?

জ্বে।

সাভারে আমার একটা বাগানবাড়ি আছে। সেখানে বড় পুকুর আছে। তোমাকে পুকুরে নামাব। দেখতে চাই তুমি কতক্ষণ পুকুরে ডুবে থাকতে পারো।

জ্বে আইচ্ছা।

চা বিকিট কিছু খাবে?

জ্বে না।

আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও।

খলিলুল্লাহ চলে গিয়েছে। মাহতাব সাহেব একা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। অফিসের প্রচুর কাজ জমে আছে। কাজ করতে ইচ্ছা করছে না। মাথার ভেতর। খলিলুল্লাহর ব্যাপারটা ঘুরপাক খাচ্ছে। ইলেকট্রনিক্সের কিছুই জানে না একটা লোক ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি ঠিক করে ফেলবে এটা হতে পারে না। অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া একটা মানুষ পানির নিচে শুয়ে থাকবে এটা হতে পারে না। প্রকৃতি মানুষকে সেভাবে বানায় নি। খলিলুল্লাহ মানুষ না, অন্যকিছু। সেই অন্যকিছুটা কী? মানুষ তার সমাজে মানুষের রূপে অন্যকিছু পছন্দ করে না। | এমনকি পাগলদেরকেও তারা চিকিৎসার নাম করে আলাদা সরিয়ে রাখে। খলিলুল্লাহ যদি সেরকম অন্যকিছু হয় তাকেও আলাদা সরিয়ে রাখতে হবে। মানুষের সমাজে তাকে থাকতে দেয়াটা বিরাট বোকামি হবে। এত বড় বোকামি আর যেই করুক তিনি করতে পারেন না। খলিলুল্লাহর ব্যাপারটা কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে ভালো হতো। এমন কেউ যে সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারবে। বেশিরভাগ মানুষ শুরুতেই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। যখন বুঝতে পারে তখন আর সমস্যা হাতের মুঠোয় থাকে না। হাতের মুঠো থেকে বের হয়ে যায়।

মাহতাব সাহেব মোবাইল টেলিফোন হাতে নিলেন। জালালের সঙ্গে কথা বলবেন। তার টেলিফোন নাম্বার মনে নেই, তবে জোগাড় করা সমস্যা হবে না। জালাল খাঁ তার কলেজ-জীবনের বন্ধু। বই পড়া তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তার সকাল শুরু হয় হাতে একটা বই নিয়ে। রাতে যখন ঘুমুতে যায় তখনো হাতে বই থাকে। চাকরি বাকরি নিলে পড়াশোনার সময় কমে যাবে এই যুক্তিতে সে চাকরিই নিল না। অবশ্যি যে পরিমাণ টাকাপয়সা তার বাবা মা তার জন্যে রেখে গেছে তাতে জালাল খাঁর পরের তিন পুরুষেরও কিছু করতে হবে না। এখানেও শুভংকরের ফাঁকি, জালাল বিয়েই করে নি।

তার টেলিফোন নাম্বার পাওয়া গেল। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর তাকে ধরা গেল। মাহতাব বললেন, জালাল, কেমন আছিস?

জালাল শুকনো গলায় বললেন, ভাল।

মাহতাব সাহেব বললেন, কী করছিস?

পড়ছি। আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনি কে?

আগে বল কী পড়ছিল, তারপর বলব আমি কে?

ফাইবার অপটিক্সের উপর একটা পপুলার বই।

বইটা কেমন লিখেছে?

মোটামুটি। তথ্য কম, বর্ণনা বেশি। লেখক খুব সহজ ভাষায় জটিল জিনিস বলতে গিয়ে লেজে-গোবরে করে ফেলেছেন। বেশি সহজ হয়ে গেছে। নিউজ পেপারের সায়েন্স আর্টিকেল হয়ে গেছে।

খটমট কিছু না হলে তোর ভালো লাগে না?

তা-না। আমি আপনাকে এখনো চিনতে পারছি না। দয়া করে নামটা বলুন।

মাহতাব।

জালাল খাঁ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ও আচ্ছা, তুই? টুনটুনি কেমন আছে? ও আমাকে একটা জটিল প্ৰশ্ন করেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম বই দেখে প্রশ্নের উত্তর দেব। বাসায় এসে প্রশ্নটা ভুলে গেছি। টুনটুনিকে একটু জিজ্ঞেস করতো প্রশ্নটা কী?

তাকে জিজ্ঞেস করতে পারব না, সে আশেপাশে নেই। আমি অফিস থেকে টেলিফোন করছি। তুই কি আজ সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসতে পারবি?

কেন?

অদ্ভুত এক হিউম্যান স্পেসিমেন দেখবি।

সব হিউম্যান স্পেসিমেনই তো অদ্ভুত।

এ একটু বেশি অদ্ভুত। সে নষ্ট কলকবজা ফইড় করতে পারে।

মানে কী?

যে-কোনো ইলেকট্রনিক্সের জিনিস ঠিক করতে পারে।

সে তাহলে ভালো একজন ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনিয়ার। এতে অদ্ভুতের কী আছে!

তার কোনো ডিগ্রি নেই।

এটাও কোনো ব্যাপার না। নিজে নিজে পড়াশোনা করে মানুষ অনেকদূর উঠতে পারে।

সে পড়াশোনাও জানে না।

অনেক ভালো মিস্ত্ৰি আছে পড়াশোনা জানে না।

জালাল শোন, আমি যার কথা বলছি সে মাটিকাটা শ্ৰমিক। তার হাতে যেকোনো জটিল যন্ত্র দিলে সে কীভাবে কীভাবে সেটা ঠিক করে ফেলে। শোনা কথা না। আমার নিজের দেখা। তার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। সে কোনোর ওস্তাদের সঙ্গে কখনো এ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করে নি। তার সঙ্গে কোনো এমিটার, ভোল্টামিটার নেই। সে কাজ করে তার দুটা হাত দিয়ে।

তা কী করে হবে?

আমিও বলছি—তা কী করে হবে। কিন্তু হচ্ছে। সমস্যাটা এইখানেই। তোর সামনে আমি পরীক্ষাটা করতে চাই। তোর সামনে আমি একটা নষ্ট টিভি সারাতে দেব।

নষ্ট টিভি সারানোর দরকার কী? আমি এক কাজ করি, বেশকিছু আইসি নিয়ে আসি, তার মধ্যে একটা আইসির লজিক গেট থাকবে নষ্ট। সে আইসিগুলি হাতে নিয়ে বলুক কোনটা নষ্ট।

তুই যেটা ভালো বুঝিস। আমি ঠিক সন্ধাবেলা ততকে নিয়ে যেতে গাড়ি পাঠাব।

গাড়ি পাঠাতে হবে না।

অবশ্যই পাঠাতে হবে। গাড়ি না পাঠালে তুই ভুলে যাবি।

মাহতাব সাহেব ইজিচেয়ার ছেড়ে টেবিলের কাছে চলে এলেন। হাবীবুর রহমানকে আরেকটা চিঠি পাঠাতে হবে। আজ দিনে দিনে লোক মারফত চিঠি পাঠিয়ে দিতে হবে। যে চিঠি নিয়ে যাবে সে-ই উত্তর নিয়ে আসবে। দেরি করা যাবে না। মাহতাব সাহেব নিজের ভেতর চাপা অস্থিরতা অনুভব করছেন। মনে হচ্ছে প্রেসার বেড়েছে। ডাক্তার ডেকে প্রেসার ছাপানো দরকার। তিনি বেল টিপে ডাক্তারকে খবর দিতে বললেন। ডাক্তার আসতে আসতে দ্রুত চিঠি লিখে ফেললেন।

জনাব হাবীবুর রহমান সাহেব,

আপনি লিখেছেন আপনার বড় বৌমা খলিলুল্লাহ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানে। আমি নিজে আপনার বড় বৌমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।

আপনি চিকিৎসার জন্যে যে-কোনো সময় ঢাকা আসতে পারেন। বাকি ব্যবস্থা আমি করে দেব।

বিনীত
মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী

যা ভেবেছিলেন তাই। প্রেসার বেড়েছে ১৩০/১০০। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন।

মাহতাব সাহেব বললেন, না।

বিলাক্সেন ট্যাবলেট খেয়ে রেস্ট নিন।

মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আমি রেস্টেই আছি।

০৩. টুনটুনি মুগ্ধ গলায় বলল

টুনটুনি মুগ্ধ গলায় বলল, খলিল ভাই, আমি তো আপনাকে চিনতেই পারি নি। খলিলুল্লাহ টুনটুনিকে আম্মাজি ডাকলেও টুনটুনি ঠিক করেছে তাকে সে খলিল ভাই ডাকবে।

খলিলুল্লাহ লজ্জিত গলায় বলল, নাপিতের কাছে গেছিলাম। চুল কাটছি। শেভ হইছি।

যে সবুজ সার্টটা পরেছেন সেই সার্টেও আপনাকে দারুণ মানিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে আপনার বয়সও অনেক কমে গেছে। এখন আপনাকে দেখে কেউ বলবে না যে আপনি একজন মাটি-কাটক। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ইউনিভার্সিটিতে পড়েন।

খলিলুল্লাহ মাথা নিচু করে হাসল। টুনটুনি বলল, আপনাকে এখন আর খলিলুল্লাহ নামে মানাচ্ছে না। আপনার জন্যে নতুন একটা নাম বের করতে হবে।

কী নাম?

চিন্তা করছি, সুন্দর কোননা নাম মাথায় আসলেই সেই নাম আপনাকে দিয়ে দেব। ঠিক আছে?

ঠিক আছে আম্মাজি।

দুটা নাম এই মুহূর্তে মাথায় এসেছে। দুটা নামের শুরুই অ দিয়ে। একটা হলো অরণ্য, আরেকটা অমিয়। এর মধ্যে আপনার কোন্টা পছন্দ?

আম্মাজি, আপনার যেটা পছন্দ আমার সেইটাই পছন্দ।

আমার পছন্দ অরণ্য। এখন থেকে আপনার নাম খলিলুল্লাহ না, এখন থেকে আপনার নাম অরণ্য।

জ্বি আইচ্ছা।

অরণ্য নামের মানে জানেন?

জ্বে না।

অরণ্য নামের অর্থ হলো—বন, জঙ্গল, Forest। আর অমিয় নামের অর্থ হলো সুধা। বরিষে অমিয় ধারা। সুধা বৰ্ষণ হচ্ছে। কী বলছি কিছু বুঝতে পারছেন?

জ্বে না।

অরণ্য ভাইয়া শুনুন, নাম বদলের সঙ্গে সঙ্গে কথাবার্তা বলার ভঙ্গিও বদলাতে হবে। যার নাম অরণ্য, সে নিশ্চয়ই গ্রাম্য ভাষায় কথা বলবে না। এখন থেকে শুদ্ধ শহুরে ভাষায় কথা বলবেন।

জ্বে আইচ্ছা।

জ্বে আইচ্ছা না। বলুন জ্বি আচ্ছা। আইচ্ছা থেকে ইবাদ দিন।

খলিলুল্লাহ বলল, জ্বি আচ্ছা।

টুনটুনি বলল, ছাদে চলুন। আমি স্ক্র্যাপ বুক বানাচ্ছি, সেখানে ছবি থাকবে। আপনার বায়োডাটা থাকবে। আপনার ছবি তুলতে হবে।

জ্বি আচ্ছা!।

টুনটুনি গম্ভীর গলায় বলল, আপনার নাম কী?

খলিলুল্লাহ শুদ্ধ বাংলায় বলল, আমার নাম অরণ্য।

ছবি তোলার পর কী হবে জানেন?

না।

লেখাপড়া সেশন। আপনাকে অক্ষর শেখাব। ঠিক আছে?

হুঁ।

দুটা বা তিনটা অক্ষর মিলে মিশে যখন শব্দ হবে তখন খুব মজা পাবেন। উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। একটা অক্ষর হলো ক, একটা ল। এই দুটা অক্ষর মিলে মিশে হয় কল।

খলিলুল্লাহ বলল, কলা কীভাবে হয়?

টুনটুনি অবাক হয়ে বলল, বা আপনার তো ভালো বুদ্ধি। আকার বলে আমাদের বাংলা ভাষায় একটা জিনিস আছে। যে-কোন অক্ষরের সঙ্গে আকার যুক্ত হলে আ এসে লাগে। লর সঙ্গে আকার যুক্ত হলে হয় লা। বলুন দেখি ক এর সঙ্গে আকার যুক্ত হলে কী হয়?

কা।

এই তো পেরেছেন। এখন বলুন কলা কীভাবে হবে?

ক, আর সঙ্গে ল, ল-এর সঙ্গে আকার।

আপনি খুব দ্রুত লেখাপড়া শিখতে পারবেন। এখন চলুন ফটোসেশনে।

ফটোসেশন কী?

ফটোসেশন হলো ছবি তোলার কর্মকাণ্ড। আমার হাতে যে ক্যামেরাটা দেখছেন এই ক্যামেরাটা সাধারণ ক্যামেরা না। এর নাম ডিজিটাল ক্যামেরা। আমার একটা ম্যাকিনটস কম্পিউটার আছে। ডিজিটাল ক্যামেরায় আপনার ছবি তুলে কম্পিউটারের মেমোরিতে দিয়ে দেব। দেখতে আপনার খুব মজা লাগবে। আপনি যে সবুজ সার্ট পরে আছেন ইচ্ছা করলেই আমি ছবিতে সবুজ সার্টের রঙ বদলে দিতে পারব। আপনার চোখের কালো মণিগুলি নীল করে ফেলতে পারব।

চোখের মণি নীল করলে কী হয়?

আমার কাছে খুব ভালো লাগে। মনে হয় খানিকটা সমুদ্র চোখে চলে এসেছে। আমার মার চোখের মণির রঙ ছিল হালকা নীল।

খলিলুল্লাহ ছবি তোলার জন্যে সুইমিং পুলের পাশে চেয়ারে বসেছে। টুনটুনি চোখের সামনে ক্যামেরা ধরেছে। অটো ফোকাস ক্যামেরা। ক্যামেরা নিজেই ফোকাল লেংথ ঠিক করে জানান দেবে—সব ঠিক আছে, সাটারে চাপ দাও। ক্যামেরায় সবুজ বাতি জ্বলছে। টুনটুনি সাটারে টিপ না দিয়ে বিস্মিত হয়ে বলল-আশ্চর্য তো আপনার চোখের মণি হালকা নীল। আমি আগে কেন লক্ষ করি নি? আমার ধারণা ছিল আপনার চোখের মণি কালো। এখন দেখছি নীল।

খলিলুল্লাহ হাসছে। টুনটুনি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় খলিলুল্লাহর দশটা ছবি তুলল।

০৫. চিঠি পড়তে পড়তে

চিঠি পড়তে পড়তেই মাহতাব সাহেবের মাথা ব্যথা ফিরে এল। চোখ টনটন করতে লাগল। আজ কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি কি বেশি টেনশান করছেন? বাড়াবাড়ি ধরনের এই টেনশানের মানে কী?

মাহতাব সাহেব টেলিফোন হাতে নিলেন। জালাল খাঁর সঙ্গে কথা বললে যদি টেনশান কিছু কমে। সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। জালাল নিজে টেনশানমুক্ত জীবনযাপন করে। যে নিজে টেনশানমুক্ত জগতে বাস করে সে অন্যদের টেনশান দূর করতে পারে না।

হ্যালো জালাল?

হ্যাঁ। কে?

চিনতে পারছি না কে?

না।

আমি মাহতাব।

ও আচ্ছা তুই। তোর টেলিফোন পাব এটা আমি ভাবছিলাম। অরণ্যের খবর কী?

জানি না কী খবর। তাকে তালাবন্ধ করে রেখেছি।

সে-কী! কেন?

আমি তার ব্যাপারে কনফিউজড।

কনফিউজড হলেই তাকে তালাবন্ধ করে রাখতে হবে? তুই একটা কাজ কর। তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে।

অসম্ভব! তাকে আমি হাতছাড়া করব না।

জালাল খাঁ হেসে ফেললেন। মাহতাব বললেন, তুই হাসছিস কেন?

তুই অসম্ভব রকম টেনস্ হয়ে আছিস এই জন্যে হাসছি। আমার ধারণা তোর প্রেসার বেড়েছে। ড্রপ বিট হচ্ছে। তুই একজন ডাক্তার ডেকে আন।

জালাল শোন, আগামী বৃহস্পতিবারে তোর কি অবসর আছে?

আমার সব দিনই অবসর, আবার সবদিনই ব্যস্ততা।

বৃহস্পতিবারটা তুই অবশ্যই অবসর রাখবি। আমার বাগানবাড়িতে যাবি। সেখানে খলিলুল্লাহকে নিয়ে জটিল একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।

তুই বারবার তাকে খলিলুল্লাহ বলছিস কেন? টুনটুনি তার নাম দিয়েছে। অরণ্য। তাকে অরণ্য ডাকবি। মাহতাব শোন, আমি তোর এই অদ্ভুত মানুষ নিয়ে ভাবছি। কিছু পড়াশোনা করছি। আমার ধারণা সে Homo superior।

Homo superior কী?

ডারউইনের এডভালিউশনের ধারায় মানুষের পরের বিবর্তন হলো Homo superior |

ভালো করে বুঝিয়ে বল।

বুঝিয়ে বলার সময় এখনো আসে নি। যখন সময় আসবে তখন বুঝিয়ে বলব। মাহতাব, আমি টেলিফোন রাখলাম। পড়ার মাঝখানে কেউ টেলিফোন করলে আমার খুবই বিরক্তি লাগে।

মাহতাব সাহেব খানিকটা বিব্রত গলায় বললেন, তোকে একটা হাস্যকর প্রশ্ন করছি, তুই কিন্তু হাসবি না।

জালাল খাঁ বললেন, তুই কন্ট্রাডিকটরি কথা বলছিস। হাস্যকর কথা বলবি অথচ আমি হাসতে পারব না? আচ্ছা চেষ্টা করব না হাসতে, বল কী কথা?

এমন কি হতে পারে যে খলিলুল্লাহ আসলে মানুষ না। জিন।

জিন?

হ্যাঁ, জিন।

মাটির কলসিতে যারা বন্দি থাকে তারপর ধোয়া হয়ে বের হয় সেরকম কিছু?

মাহতাব বিরক্ত গলায় বললেন, তুই আমার কথাগুলি ফানের দিকে নিয়ে যাচ্ছিস। আমি ফান করছি না।

জালাল খাঁ বললেন, তোর ঘরে কি ঘুমের ওষুধ আছে?

আছে।

কয়েকটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে তুই ঘুমিয়ে পড়। আমি ভোরবেলা তোর সঙ্গে কথা বলব। সকালে তুই আরেকটা কাজ করবি—অরণ্যকে কোনো এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি। ডাক্তার তার ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করবে, ইসিজি নেবে। ডাক্তার যখন বলবে অরণ্যের ব্লাড গ্রুপ ও পজিটিভ তখন নিশ্চয়ই ভাববি না যে অরণ্য মানুষ না জিন। জিনদের ও পজিটিভ ব্লাড গ্রুপ থাকার কথা না।

খলিলুল্লাহর ব্লাড গ্রুপ ও পজিটিভ তোকে কে বলল?

কেউ বলেনি, কথার কথা বলছি। তুই কি আর কিছু বলবি?

না।

আমি কি টেলিফোন নামিয়ে রাখতে পারি?

মাহতাব সাহেব কিছু বললেন না। জালাল খাঁ টেলিফোন নামিয়ে রাখার পরেও তিনি বেশ কিছু সময় রিসিভার কানে নিয়ে বসে রইলেন।

ঘড়িতে এখন এগারোটা বাজে। টুনটুনির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। বাতি নিভিয়ে বিছানায় যাওয়া যাবে না। মাহতাব সাহেব দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেকেন্ডের কাটা নড়ার কট কট শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি যে উত্তেজিত এই কট কট শব্দ তার প্রমাণ। উত্তেজিত হলেই সেকেন্ডের কাঁটা নড়ার কট কট শব্দ তিনি শুনতে পান। ঘড়িটি কি দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেলবেন?

এখন বাজছে এগারোটা এক। আশ্চর্য, মাত্র এক মিনিট পার হয়েছে? সময় কি থমকে গেছে? মাহতাব সাহেবের মনে হচ্ছে তিনি অনন্তকাল ধরে বসে আছেন। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার কট কট শব্দ শুনছেন।

টুনটুনি খলিলুল্লাহর ঘরে বসে আছে। সে বসেছে চেয়ারে। খলিলুল্লাহ দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে আছে। টুনটুনি বলল, আপনাকে যে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে এতে কি আপনার খারাপ লাগছে?

না।

খারাপ লাগছে না কেন?

আম্মাজি, আমার কোনো কিছুতেই খারাপ লাগে না।

আমাকে আপনি আম্মাজি ডাকেন কেন?

খলিলুল্লাহ জবাব দিল না, হাসল।

আপনার মা কি দেখতে আমার মতো ছিলেন।

আমার মায়ের কথা আমার মনে নাই।

মাকে কখনো দেখেন নি?

মনে নাই।

আপনার বাবাকে আপনি দেখেছেন?

মনে নাই।

আপনার কিছুই মনে নাই এটা কেমন কথা?

আম্মাজি, আমার একবার খুব কঠিন অসুখ হয়েছিল। অসুখের পর আগের কথা সব ভুলে গেছি।

কী অসুখ হয়েছিল?

মাথায় যন্ত্রণা হয়েছিল। এমন যন্ত্রণা যার কোনো মা-বাপ নাই। তখন চোখের সামনে শুধু কলকজা দেখতাম।

স্বপ্নে দেখতেন?

স্বপ্নে দেখতাম না বাস্তবে দেখতাম সেটা খেয়াল নাই। শুধু দেখতাম কলকবজা। বড় কষ্ট করেছি। অসুখ অনেকদিন ছিল।

এখন সেই স্বপ্ন দেখেন না?

না, এখন অন্য কিছু দেখি।

কী দেখেন?

খলিলুল্লাহ জবাব দিল না। হাসল। টুনটুনি বলল, আজ আমার খুব মন খারাপ।

খলিলুল্লাহ বলল, কেন মন খারাপ? আজ আমার মায়ের মৃত্যুদিন। বাবা দিনটার কথা ভুলে গেছেন। আজ তোমার মায়ের মৃত্যুদিন।

হ্যাঁ। আপনার যেমন আপনার মায়ের কথা কিছু মনে নেই আমারও আমার মায়ের কথা কিছু মনে নেই। আমার যখন দুবছর বয়স তখন আমার মা মারা যান। দুবছর বয়সের স্মৃতি মানুষের মাথায় থাকে না।

তোমার বাবা আর বিয়ে করেন নি?

বিয়ে করেছিলেন। নতুন মা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। চিটাগাং থেকে ঢাকা আসার পথে রোড এক্সিডেন্ট হয়। ড্রাইভার এবং মা দুজনই মারা যান। বাবা আহত হয়েছিলেন। অনেক দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

টুনটুনি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আসল মার কথা আমার মনে নেই, কিন্তু নতুন মার কথা মনে আছে। উনি আমাকে খুব আদর করতেন। আমার টুনটুনি নাম উল্টো করে আমাকে ডাকতেন নিটুনটু। আচ্ছা আপনি ঘুমান, আমি উঠি। আপনার ঘর আমি তালাবন্ধ করে রাখব, আপনি রাগ করবেন না।

আমি রাগ করব না।

আপনার যদি কখনো মনে হয় আপনি এখানে থাকবেন না, পালিয়ে যাবেন-তাহলে আমাকে বলবেন, আমি গভীর রাতে এসে তালা খুলে দেব। আপনি বাড়ির পেছনে চলে যাবেন, সেখান থেকে দেয়াল টপকে পালিয়ে যাবেন। পারবেন না?

হ্যাঁ পারব।

টুনটুনি খলিলুল্লাহর দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।

মাহতাব উদ্দিন ঘুমুতে গেলেন রাত একটায়। ঘুমুতে যাবার আগে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে একটা ডরমিকাম খেলেন। সাত মিলিগ্রামের ডরমিকম, নিশ্চিন্ত ঘুমের জন্যে যথেষ্ট। ঘুমের ওষুধ খাবার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যাবার নাকি নিয়ম নেই। পাঁচ দশ মিনিট পরে যেতে হয়। শরীর বিলাক্স করার জন্যে সামান্য হাঁটাহাঁটি করতে হয়। বিছানায় যাবার ঠিক আগে আগে এক কাপ গরম দুধ এবং এক গ্লাস হিম শীতল পানি খেতে হয়। তিনি সবই করলেন কিন্তু তার ঘুম এলো না। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা প্রথমে দেয়ালে তারপর দেয়াল থেকে তার মাথার ভেতরে কট কট করতে লাগল। তিনি বিছানা থেকে উঠে ঘড়ি নামিয়ে তার ব্যাটারি খুলে রাখলেন। তারপরেও সেকেন্ডের কাটার কটকটানি বন্ধ হলো না। মাথার ভেতর কট কট করতেই থাকল।

তাঁর ঘুম এলো ফজরের নামাজের পর। ঘুমের মধ্যে তিনি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘুম ভাঙতেই চারদিকে লালাভ আলো দেখতে পেলেন। সেই সঙ্গে শো শোবিজ বিজ শব্দ। ব্যাপারটা কী জানার জন্যে চারদিকে তাকাচ্ছেন, হঠাৎ চোখ পড়ল ঘরের মেঝের দিকে। ঘরের মেঝেটা বদলে গেছে। এটা এখন আর মেঝে না, গলিত লাভার মতো হয়ে গেছে। লাভা ফুটছে। বুদবুদ ভাঙছে। সেখান থেকেই বিজ বিজ শব্দ হচ্ছে। ঘটনা কী? তিনি কি কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে আগ্নেয়গিরির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন? তিনি আতঙ্কে অস্থির হয়ে খাটে উঠে বসলেন এবং লক্ষ করলেন তার রট আয়রনের খাটের পায়া জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভাতে গলে গলে যাচ্ছে তিনি দ্রুত নেমে যাচ্ছেন লাভা সমুদ্রে। যে দিকে চোখ যাচ্ছে গলন্ত লভা।

শোঁ শোঁ শব্দ আসছে। শব্দটা হচ্ছে ঠিক মাঝখানে। কোনো একটা ঘটনা সেখানে ঘটছে। ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা। মাহতাব সাহেব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা বের হয়ে আসছে। একটা মানুষের মাথা। মানুষটা কে? খলিলুল্লাহ? হ্যাঁ খলিলুল্লাহই তো। মাহতাব সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, কী চাও তুমি, কী চাও?

মানুষের মাথার মুখ হা হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, আমি কিছু চাই না।

চলে যাও তুমি, চলে যাও।

কোথায় চলে যাব?

যেখান থেকে এসেছ সেখানে চলে যাও।

যাব কীভাবে? আপনি তো আমাকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন!

মাহতাব সাহেব স্বপ্নের ভেতর চেঁচাচ্ছেন টুনটুনি, চাবি দিয়ে তালা খুলে দে। চলে যাক। এ যেখান থেকে এসেছে সেখানে চলে যাক।

মাহতাব উদ্দিনের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন তাঁর সারা শরীর ঘামে ভেজা।

০৬. টুনটুনি তার ম্যাকিনটস কম্পিউটারের সামনে

টুনটুনি তার ম্যাকিনটস কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। সে খুব অবাক হয়ে কম্পিউটারের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। পর্দায় অরণ্যর ছবি। স্ক্র্যাপ বুক বানানোর জন্যে সে ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলি কম্পিউটারে ঢুকিয়েছে। আগে তোলা ছবি এবং পরে তোলা ছবি পাশাপাশি দেখে তার খুবই অবাক লাগছে। প্রথমদিকে তোলা ছবিগুলির সঙ্গে শেষের দিকে তোলা ছবির বড় অমিল আছে। চোখের মণির রঙে অমিল। প্রথম যে ছবিগুলি তোলা হয়েছিল সেখানে চোখের মণির রঙ কালো। এখনকার ছবিতে হালকা নীল।

মানুষের চোখের মণির রঙ কি পাল্টাতে পারে? অসম্ভব। মানুষ গিরগিটি না যে রঙ পাল্টাবে। তাহলে কি ডিজিটাল ক্যামেরায় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে? সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কারণ টুনটুনির মনে আছে সে খালি চোখে দেখেছে। অরণ্যের চোখের রঙ হালকা নীল।

যদি দেখা যায় যে মানুষটা ইচ্ছামতে চোখের মণির রঙ পাল্টাতে পারে তাহলে মন্দ হয় না। টুনটুনির ইচ্ছা করছে অরণ্যকে জিজ্ঞেস করতে। সেটা সম্ভব না, কারণ টুনটুনির বাবা অরণ্যকে লোক দিয়ে সাভার পাঠিয়ে দিয়েছেন। কেন পাঠিয়েছেন বলেন নি। জিজ্ঞেস করার পরেও বলেন নি। শুধু বাবাকে খুব চিন্তিত মনে হয়েছে। তিনি অরণ্যকে নিয়েই চিন্তিত এটা বোঝা যাচ্ছে। কারণ তিনি টুনটুনিকে ডেকে বলেছেন, তুমি যখন-তখন খলিলুল্লাহর ঘরে যাবে না।

টুনটুনি বলেছে কেন যাব না?

আমি নিষেধ করছি সেই জন্যে যাবে না।

তুমি নিষেধ করছ কেন?

নিষেধ করছি কারণ তুমি একটি অল্পবয়েসী মেয়ে। হুটহাট করে একটা যুবক ছেলের ঘরে কেন ঢুকবে?

বাবা অরণ্য কিন্তু আমাকে মা ডাকে।

সে তোমাকে মা ডাকুক, খালা ডাকুক, দাদি ডাকুক কিছু আসে যায় না। আমি তোমাকে যেতে নিষেধ করছি, তুমি যাবে না।

রেগে যাচ্ছ কেন বাবা?

রেগে যাচ্ছি না। আমার যা বলার আমি সহজভাবেই বলছি।

তুমি মোটেই সহজভাবে কিছু বলছ না। তোমার গলার স্বর নিচু, এটা ঠিক আছে। কিন্তু রাগে তোমার হাত-পা কাঁপছে। তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। আমার ধারণা তুমি অসুস্থ। তুমি কি দয়া করে একজন ডাক্তার দেখাবে?

মাহতাব সাহেব জবাব দেন নি। তিনি মেয়ের সামনে থেকে সরে গিয়েছেন। তার কিছুক্ষণ পরই ডাক্তার আসতে দেখে টুনটুনি ভাবল বাবা তার নিজের জন্যে ডাক্তার এনেছেন। দেখা গেল ঘটনা তা না। ডাক্তার অরণ্যের জন্য এসেছে। ব্লাড প্রেসার মাপছে, রক্ত নিচ্ছে। নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে।

টুনটুনি নিশ্চিত তার বাবা অরণ্যকে নিয়ে খুবই চিন্তিত। টুনটুনি চিন্তিত হবার মতো কিছু দেখছে না। মানুষটা রহস্যময় এবং বিস্ময়কর। কিন্তু চিন্তিত হবার মতো না। মানুষ চিন্তিত হবে হিংস্ৰ জন্তু দেখে। দুষ্ট মানুষ দেখে। অরণ্য হিংস্ৰ জন্তু না। দুষ্ট মানুষও না।

টুনটুনি অরণ্যের ছবির প্রিন্ট আউট দিয়েছে। কালার প্রিন্টার থেকে ছবি প্রিন্ট হচ্ছে। কী সুন্দর ছবি!

মাহতাব উদ্দিন তাঁর সাভারের বাগানবাড়ির পুকুর পাড়ে বসে আছেন। তাঁর পাশে জালাল খাঁ বসে আছে। পুকুর পাড়ে দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই। মাহতাব উদ্দিন কঠিন নিষেধ জারি করেছেন পুকুর পাড়ে যেন কেউ না আসে। পুকুরে খলিলুল্লাহকে নামানো হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ হলো সে ডুব দিয়েছে। এখনো ভাসে নি। মাহতাব উদ্দিন বললেন, জালাল দেখ তো কতক্ষণ পার হয়েছে।

জালাল খাঁ বললেন, সতেরো মিনিট।

সতেরো মিনিট একটা মানুষ ডুব দিয়ে আছে। পানিতে নামানোর সময় একটা হাফপ্যান্ট পরে নেমেছে। এখনো ভেসে ওঠে নি। তোর কাছে কি কোন ব্যাখ্যা আছে?

না।

কোনো ব্যাখ্যা নেই?

না।

কোনো মানুষের পক্ষে কি এই কাজটা করা সম্ভব?

জালাল খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন, মানুষের ক্ষমতা সীমাহীন। তার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব, কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া বাচা সম্ভব না।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, লোকটা অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে আছে?

জালাল খাঁ বললেন, হ্যাঁ।

মাছ যেমন পানি থেকে অক্সিজেন নেয় সে কি এইভাবে নিচ্ছে না?

না।

কীভাবে বুঝলি না?

অক্সিজেন নিলে তাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়তে হতো। তা সে করছে না। যদি করত পানিতে বুদবুদ দেখা যেত। পানিতে বুদবুদ দেখছি না। আরেকটা সম্ভাবনা আছে।

কী সম্ভাবনা?

আমাদের অরণ্য যদি তার শারীরবৃত্তীয় সমস্ত কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখে তাহলে অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়বে না।

সেটা কি সম্ভব?

প্রাচীন মুনিঋষিরা করতে পারতেন বলে বইপত্রে পড়ি। যোগীসাধকরাও না-কি পারেন। তবে আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না। তোমার এই স্পেসিমেন আর যাই হোক কোনো মুনিঋষি না, যোগীসাধকও না।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, সে কে?

জালাল খাঁ বললেন, জানি না। আমি একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি।

কী হাইপোথিসিস?

এখনো তেমন কিছু দাঁড় করাতে পারি নি, ভাবছি। আমাদের এগোতে হবে লজিকের মাধ্যমে। প্রসেস অব এলিমিনেশন পদ্ধতিতে।

জালাল খাঁ সিগারেট ধরালেন। ঘড়ি দেখলেন। পঁচিশ মিনিট পার হয়েছে। মানুষটা এখনো পানিতে ডুব দিয়ে আছে। মাহতাব উদ্দিন বললেন, প্রসেস অব এলিমিনেশনটা কী?

জালাল খাঁ বললেন, প্রথমে আমাদেরকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে অরণ্য নামের জিনিসটি মানুষ না অন্য কিছু। যদি মানুষ হয় তাহলে এক ধরনের যুক্তি আর যদি অন্য কিছু হয় তাহলে অন্য ধরনের যুক্তি।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, অন্য কিছুটা কী হতে পারে?

রোবট হতে পারে।

রোবট?

হ্যাঁ, রোবট। দেখতে মানুষের মতো। কথাবার্তা মানুষের মতো। যেহেতু রোবট, তার অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে না। সে পানির নিচে যতক্ষণ ইচ্ছা থাকতে পারবে।

তোর ধারণা সে রোবট?

আমার কোনো ধারণা নেই। প্রসেস অব এলিমিনেশনের ভেতর দিয়ে যেতে হলে প্রথমে তাকে রোবট ভাবতে হবে। তারপর যুক্তি দিয়ে দেখাতে হবে সে রোবট না। তখন রোবট ক্যাটাগরি বাদ পড়বে।

মাহতাব উদ্দিন ছোন্ত নিশ্বাস ফেলে বললেন, সে রোবট না। তার ব্লাড টেস্ট করা হয়েছে। ব্লাডের গ্রুপ 0 পজেটিভ। ইউরিন, স্টুল সব একজামিন করা হয়েছে, ইসিজি করা হয়েছে, প্রেশার মাপা হয়েছে, এক্স-রে নেয়া হয়েছে। সব কিছুই সাধারণ মানুষের মতো, শুধু হার্ট সামান্য এনলার্জড।

জালাল খাঁ বললেন, তাহলে তাকে বরং মানুষ হিসেবে ধরে নিয়ে এগোতে থাকি। ধরা যাক সে মানুষ, তবে অস্বাভাবিক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ। Homo superior.

মাহতাব উদ্দিন বললেন, Homo superior ব্যাপারটা কী? তুই আগেও একবার বলেছিস।

জালাল খাঁ বললেন, জন বেরেসফোর্ড নামের একজন লেখক The Hampdensire Wonder নামে একটা বই লিখেছিলেন। বইটা ১৯১১ সনে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বই-এ তিনি Homo superior-এর কথা প্রথম বলেছেন। তার ধারণা পৃথিবীর বর্তমান মানবসম্প্রদায়ের পরিবর্তে নতুন মানবসম্প্রদায় চলে আসবে। তারা দেখতে মানুষের মতো হলেও তাদের থাকবে অস্বাভাবিক ক্ষমতা। এরাই পৃথিবী শাসন করবে। এরাই গ্রহ-নক্ষত্র জয় করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।

এরা আসবে কোত্থেকে?

মিউটেশনের মাধ্যমে মানুষের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে Homo superior তৈরি হবে। এরা হলো কার্টুনে দেখা কল্পনার Superman।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ? বিবর্তিত হয়ে মানুষ এরকম হবে?

জালাল খাঁ বললেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদের সমস্যা হচ্ছে এই থিওরি অতীতের বিবর্তনের ধারা বলতে পারে কিন্তু ভবিষ্যতে কী বিবর্তন হতে যাচ্ছে তা বলতে পারে না। মানুষের ডিএনএ-র পরিবর্তনটা কীভাবে হবে ডারউইনের থিওরি সেটা বলছে না। হঠাৎ করে একজন Homo superior তৈরি হবে না-কি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এদের দেখা যাবে তা কেউ বলতে পারছে না।

জালাল, তোর ধারণা খলিলুল্লাহ নামের মাটিকাটা কুলি একজন Homo superior?

হতে পারে। তার অস্বাভাবিক ক্ষমতা তো চোখের সামনে দেখছি। যন্ত্রপাতির উপর তার কী পরিমাণ দখল সেটাও দেখতে পাচ্ছি।

আমাদের এখন করণীয় কী?

আমাদের করণীয় একটাই–অরণ্যের সঙ্গে কথা বলা। তার সাহায্য নিয়েই বের করা সে কে? তার DNA-র সিকোয়েন্সগুলি কী তা জানা। যে পড়াশোনা জানে না তাকে পড়াশোনা শেখাননা। সে যদি Homo superior হয় তাহলে মানবসম্প্রদায়ের অর্জিত জ্ঞানের সবটুকু সে নিজের ভেতর অতি দ্রুত নিতে পারবে।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, কতক্ষণ পার হয়েছে দেখ তো?

এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট।

তাকে কি ডেকে তুলব না সে আরো কিছুক্ষণ পানিতে থাকবে?

জালাল খাঁ বললেন, থাকুক পানিতে। আমাকে তুই একটা কাগজ কলম দে। তাকে যে সব প্রশ্ন করব তা লিখে ফেলি। থাক কাগজ কলম লাগবে না। জালাল খাঁ পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। মাহতাব উদ্দিনও তাকিয়ে আছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। পুকুরের পানি শান্ত। সেখানে কোনো আলোড়ন নেই।

০৭. মাহতাব উদ্দিন সাহেবের বাগানবাড়ি

জালাল খাঁ মাহতাব উদ্দিন সাহেবের বাগানবাড়ির বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন। তাঁর সামনে বেতের চেয়ারে খলিলুল্লাহ বসে আছে। সব মিলিয়ে পানিতে দুঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিট ছিল। এক ঘণ্টা হলো সে পানি থেকে উঠে এসেছে। সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়া করে সে এসে বসেছে বসার ঘরে। জালাল খাঁ তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান। মাহতাব উদ্দিনেরও এই আসরে থাকার কথা ছিল। তাঁর হঠাৎ প্ৰবল মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বলে তিনি অন্য একটা ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তাঁর মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। হঠাৎ হঠাৎ মাইগ্রেনের ব্যথা উঠে তাঁর জগৎ সম্পূৰ্ণ এলোমেলো করে দেয়। আজকের মাথা ব্যথার ধরন সেরকম।

জালাল খাঁ অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন আছ?

অরণ্য বলল, ভালো আছি।

পানির নিচে থাকতে কেমন লাগে?

ভালো লাগে।

শুকনায় থাকতে ভালো লাগে না-কি পানিতে থাকতে ভালো লাগে?

দুটাই ভালো।

তোমাকে আমি কিছু প্রশ্ন করব, জবাব দেবে?

জ্বি, দেব।

তোমার কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা যে আছে এটা তুমি জানো?

আগে জানতাম না। এখন জানি।

তুমি পানিতে ডুবে থাকতে পারো এটা দেখলাম। এছাড়া আর কী পারো? শূন্যেও ভেসে থাকতে পারো?

পারি।

জালাল খাঁ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো বললেন, তুমি শূন্যে ভেসে থাকতে পারো?

পারি।

তাহলে ভেসে দেখাও।

এখন পারব না।

কখন পারবে?

যখন আশেপাশে কেউ থাকে না তখন পারি।

কতক্ষণ ভেসে থাকতে পারো?

অনেকক্ষণ পারি।

তুমি কে এটা বললা।

আমি জানি না আমি কে।

তোমার কি জানতে ইচ্ছা হয় তুমি কে?

না।

কিন্তু আমি জানতে চাই তুমি কে? তুমি আমাকে সাহায্য করো। তুমি সাহায্য করলেই আমি তোমার ব্যাপারে জানতে পারব। তুমি সাহায্য না করলে পারব না। আচ্ছা শোননা, তুমি কি রোবট?

রোবট কী?

রোবট হলো যন্ত্ৰমানব। যাদের ক্ষুধাতৃষ্ণা নেই, আবেগ নেই। তোমার ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে?

আছে।

আবেগ আছে? কষ্ট পেলে কাঁদো?

না।

কষ্ট পেলে কাঁদো না? কখনো তোমার চোখে পানি আসে নি?

একবার এসেছে।

সেটা কখন?

আম্মাজি তার মার কথা বলছিল। তার মাকে সে কখনো দেখে নাই। মার কথা বলতে গিয়ে সে এত মন খারাপ করল যে আমার চোখে পানি এসে গেল।

এর অর্থ হচ্ছে তোমার আবেগ আছে। আচ্ছা, তুমি তোমার বাবা-মাকে মনে করতে পারো? তারা কোথায়?

জানি না।

বাবা-মার কথা কিছুই জানোনা?

আমার কিছু মনে নাই। একবার আমার খুব বড় অসুখ হয়েছিল। অসুখ হবার পর অসুখের আগের সবকিছু ভুলে গেছি।

কী অসুখ হয়েছিল? মাথায় যন্ত্রণা।

দুঃস্বপ্ন দেখতাম।

কী দুঃস্বপ্ন?

নানান রকম কলকজা ঘুরছে। অদ্ভুত অদ্ভুত যন্ত্র। অসুখের সময় বড় কষ্ট করেছি।

জালাল খাঁ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যন্ত্রের কথায় মনে পড়ল তুমি নষ্ট যন্ত্রপাতি ঠিক করতে পারে। এই প্রমাণ আমরা দেখেছি। যে নষ্ট যন্ত্র ঠিক করতে পারে সে যন্ত্র বানাতেও পারে। তুমি যন্ত্র তৈরি করতে পারবে?

কী যন্ত্র?

আমাদের জানা নেই এমন।

আপনি বলেন কী যন্ত্র বানাতে চান।

জালাল খাঁ আগ্রহ নিয়ে বললেন, একটা টাইম মেশিন কি বানোননা যায় এইচ জি ওয়েলস-এর টাইম মেশিন।

সেই মেশিনে কী হয়?

সেটা একটা অদ্ভুত মেশিন। এই মেশিনে করে মানুষ অতীত থেকে বর্তমানে আসতে পারে। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে যেতে পারে।

আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

জালাল খাঁ উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে এমন ভঙ্গিতে বলা শুরু করলেন যেন টাইম মেশিন বানাতে পারে এমন একজন ইনজিনিয়ার ভার সামনে বসে আছে। ব্যাপারটা শুধু বোঝানোর অপেক্ষা, বোঝানো হয়ে গেলে টাইম মেশিন তৈরি হয়ে যাবে। তাৎক্ষণিক ডেলিভারি।

মেশিনটা হবে এরকম—মনে করে আমি মেশিনটায় বসলাম, সুইচ টিপলাম। অমনি আমি চলে গেলাম অতীতে, যখন আমার বাবার বয়স মাত্ৰ সাত বছর।

এই যন্ত্র তৈরি করা যাবে না।

কেন তৈরি করা যাবে না?

নিয়মের মধ্যে পড়বে না।

কিসের নিয়ম?

জগতের নিয়ম। এই যন্ত্র তৈরি হলে জগতের নিয়মে গণ্ডগোল হয়ে যাবে। জগতের নিয়মে গণ্ডগোল হয় এমন কিছু জগৎ তৈরি করতে দেয় না।

জালাল খাঁ নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। টাইম মেশিন ফিজিক্সের সূত্র গ্রহণ করে না। ধররা আমি যদি অতীতে ফিরে গিয়ে আমার সাত বছর বয়সী বাবাকে মেরে ফেলি তাহলে কী হবে? তাহলে আমি কীভাবে বেঁচে থাকব? আমার বাবাই তো সাত বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি বড় হয়ে বিয়ে করতে পারেন নি। কাজেই আমার জন্ম হয় নি। তাহলে আমি কোত্থেকে এলাম?

অরণ্য এক দৃষ্টিতে জালাল খাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চাপা কৌতূহল। যেন সে কিছু বলতে চায়। জালাল খাঁ বললেন, তুমি কিছু বলবে?

আমি আম্মাজির জন্যে একটা যন্ত্র বানাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

কার জন্যে যন্ত্র বানাবে, টুনটুনির জন্যে?

জি।

কী যন্ত্র?

আম্মাজি এই যন্ত্রে তার মায়ের কথা শুনতে পাবে। অনেক কাল আগে যে সব কথা বলেছিল সে সব কথা।

কীভাবে?

মানুষের কথা নষ্ট হয় না। মানুষের কথা থেকে যায়। ঘরের দেয়ালে থাকে, বাতাসে থাকে। সেখান থেকে কথা বের করে আনা যাবে।

কীভাবে?

সেটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আপনাকে বোঝাতে পারব না।

যন্ত্রটা তৈরি করতে তোমার কী লাগবে?

কলমের মতো একটা যন্ত্র যে আপনার আছে সেটা লাগবে। আরো কিছু জিনিস লাগবে।

তোমার যা যা লাগবে সবই আমি জোগাড় করে দেব। তুমি যন্ত্রটা বানাও। আমরা এই যন্ত্রের নাম দেব Past Rocorder, PR। বাংলায় তার নাম হবে অতীত-কথন। আচ্ছা তুমি কি যন্ত্রটা একা একা তৈরি করতে পারবে? তোমাকে সাহায্য করার লোক লাগবে না?

আমাকে সাহায্য করার লোক আছে। কোথায় আছে?

অরণ্য জবাব দিল না। চুপ করে বসে থাকল। সে এখন তাকিয়ে আছে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। বুড়ো আঙুল উঠানামা করছে।

জালাল খাঁ তার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি কে?

অরণ্য বলল, আমি জানি না আমি কে? বলেই সেও জালাল খাঁর দিকে ঝুঁকে এসে বলল, আপনি কি জানেন আপনি কে? জালাল খাঁ হতাশ গলায় বললেন, আমিও জানি না আমি কে।

০৮. চিকিৎসার জন্যে ঢাকা

হাবীবুর রহমান সাহেব চিকিৎসার জন্যে ঢাকা চলে এসেছেন। খালি হাতে আসেন নি-তিন কেজি মাষকলাইয়ের ডাল, পাঁচ কেজি কালিজিরা পোলাওয়ের চাল, দুটা বিশাল সাইজের মিষ্টিকুমড়া নিয়ে এসেছেন। তিনি হাত বাড়িয়ে মাহতাব সাহেবের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। হ্যান্ডশেকের পর কোলাকুলি করলেন। মাহতাব সাহেবের বাড়িঘর দেখে বেচারা পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছেন। এই জিনিস তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। বসার ঘরের মেঝের অর্ধেকটা মার্বেলের, বাকি অর্ধেক মনে হচ্ছে কাচের, নিচ থেকে সবুজ আলোর আভা আসছে। হাবীবুর রহমান সাহেব বললেন, ভাইসাহেব, ভালো আছেন?

মাহতাব উদ্দিন বললেন, ভালো আছি।

যাকে পাঠিয়েছিলাম, খলিলুল্লাহ, সে কেমন আছে?

সেও ভাল আছে।

তার মাধ্যমেই আপনার সঙ্গে পরিচয়, জগতের কী অদ্ভূত লীলা।

অদ্ভূত লীলা তো বটেই!

জনাব, আপনি বলেছিলেন আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।

মাহতাব উদ্দিন শুকনো গলায় বললেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা অবশ্যই করা হবে। আপাতত বিশ্রাম করুন। আপনাকে গেস্টম দেখিয়ে দেবে।

শুকরিয়া। জনাব, খলিলুল্লাহর সঙ্গে একটু কথা বলি। সে আছে কোথায়?

সে ভালো মতেই আছে। তার সঙ্গে আপনার কথা বলার প্রয়োজন দেখছি। না।

না না, কোনো প্রয়োজন নাই। সে থাকবে তার মতো। আমি থাকব আমার মতো। আমার খুবই ভালো লাগছে যে আপনার আশ্রয়ে এসে দরিদ্র মানুষটার একটা গতি হয়ে গেল। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আমরা উপলক্ষ মাত্র। জনাব, কেবলা কোনদিক? তিন ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়েছে। মাগরেবের ওয়াক্তও হয়ে গেছে।

আপনি আপনার ঘরে যান। কেবলা কোনদিকে তা আপনাকে দেখিয়ে দেবে জায়নামাজ এনে দেবে।

জায়নামাজ আমার সঙ্গেই থাকে জনাব। জায়নামাজ আর কোরান শরিফ। এই দুটা জিনিস ছাড়া আমি ঘর থেকে বের হই না। ছোটবেলার অভ্যাস।

মাহতাব উদ্দিন বসার ঘর থেকে বের হলেন। এখন সন্ধ্যা হয় হয়। বাসায় যখন থাকেন সন্ধ্যাবেলা ছাদে হাঁটাহাঁটি করেন। সূর‍্যাস্ত দেখেন। গ্রামে সূর‍্যাস্ত দেখার একরকম আনন্দ। শহরে দালানকোঠার ঘরে খলিলুল্লাহকে নিয়ে আসা হয়েছে। এই ঘরটিও তালাবন্ধ। তাতে খলিলুল্লাহর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সে নিজের মনেই আছে। এই ঘরটা বেশ বড়। ঘরের মেঝেতে পাটি বিছানো। পাটিভর্তি হাজারো খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি। দুটা কম্পিউটারের মাদারবোের্ড। একটা মনিটর। ইলেকট্রিকের তার। সোল্ডারিং গান। খলিলুল্লাহ যা যা চেয়েছে জালাল খাঁ খবই জোগাড় করে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে ইলেকট্রনিকের দোকানে ছেড়ে দিয়েছেন। সে যা যা চেয়েছে সবই তাকে দেয়া হয়েছে। প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের একটা মোমের টুকরার উপর জিনিসগুলি বসেছে। মোমের টুকরাটি মনে হয় মূল বেস। প্রতিদিন তাকে প্রচুর বরফ দিতে হচ্ছে। বরফ কী জন্যে লাগছে কে জানে। বরফের আপাতত কোনো ব্যবহার দেখা যাচ্ছে না।

মাহতাব উদ্দিন খলিলুল্লাহর ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। জানালায় টোকা দিয়ে বললেন, কেমন আছ খলিলুল্লাহ?

খলিলুল্লাহ মুখ তুলল না। কাজ করতে করতেই বলল, ভালো আছি।

যন্ত্র তৈরি হচ্ছে?

জ্বি।

এই যন্ত্রে অতীতের কথা শোনা যাবে?

জ্বি। শুধু কথা শোনা যাবে না। ছবিও দেখা যাবে।

বলো কী! ছবিও দেখা যাবে?

জ্বি। যন্ত্রটা এই ঘরে ফিট করা হয়েছে, কাজেই এই ঘরে পনেরো বিশ কুড়ি বছর আগে কী হয়েছিল সেটা দেখা যাবে।

এমন যন্ত্র সত্যি তৈরি হবে?

জ্বি হবে। হবে না, হয়েছে। আমি পরীক্ষাও করেছি।

মাহতাব উদ্দিন আগ্রহের সঙ্গে বললেন, পরীক্ষায় কী দেখলে?

দেখলাম এই ঘরে একজন মহিলাকে তালাবন্ধ করে রাখা হতো। মহিলার চোখ নীল।

তাই দেখলে?

জ্বি।

খুব ভালো যন্ত্র। পুরোপুরি তৈরি হোক, তারপর আমাকে খবর দিও। আমি এসে দেখে যাব।

জ্বি আচ্ছা।

অন্ধকারে কাজ করছ কীভাবে?

আমার অসুবিধা হয় না।

অসুবিধা না হলে তো ভালোই।

মাহতাব উদ্দিন আবার হাঁটতে শুরু করলেন। পুরোপুরি অন্ধকার না হওয়া। পর্যন্ত তিনি ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হটলেন। এশার নামাজের। আজানের পর তিনি নিচে নামলেন। আজ সারাদিন টুনটুনির সঙ্গে দেখা হয় নি মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। বারেক খবর দিয়েছে টুনটুনির জ্বর। চারদিকে ভাইরাস ফিভার হচ্ছে। টুনটুনিকেও কোনো একটা ভাইরাসে ধরেছে কিনা কে জানে।

টুনটুনি ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল। মাহতাব উদ্দিন ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। টুনটুনি চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার চোখ লাল। মাহতাব উদ্দিন বললেন, জ্বর কি খুব বেশি রে মা?

টুনটুনি বাবার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাকে অরণ্যের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছ না কেন? তাকে নিয়ে ছাদের চিলেকোঠায় আটকে রেখেছ। আমাকে কেউ ছাদে যেতে দিচ্ছে না।

মাহতাব সাহেব বললেন, খলিলুল্লাহ হোর জন্যে কী একটা যন্ত্র বানাচ্ছে। যন্ত্রটা পেয়ে তুই খুব সারপ্রাইজড হবি। সেই সারপ্রাইজটা যেন নষ্ট না হয় সে জন্যেই তোকে যেতে দিচ্ছি না।

যন্ত্রটা দিয়ে কী হয়?

কী হয় আগে বললে তো সারপ্রাইজ থাকবে না।

টুনটুনি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, বাবা, মানুষকে তালাবন্ধ করে রাখতে তুমি খুব মজা পাও—তাই না?

তার মানে?

চিলেকোঠার ঐ ঘরে তো তুমি আমার মাকেও তালাবন্ধ করে রাখতে।

মাহতাব সাহেব শান্ত গলায় বললেন, টুনটুনি, তোমাকে আমি বলেছি তোমার মা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাকে তালাবন্ধ করে রাখা ছাড়া আমার দ্বিতীয় পথ ছিল না।

টুনটুনি তাকিয়ে আছে। তার চোখ রক্তাভ।

মাহতাব সাহেব বললেন, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আর কিছু বলতে চাও?

টুনটুনি বলল, না।

রাত একটা।

মাহতাব উদ্দিন তাঁর ঘরে বসে আছেন। তার সামনে মাথা নিচু করে বারেক দাঁড়িয়ে আছে। মাহতাব সাহেব বললেন, হাবীবুর রহমান সাহেবকে কাল ভালো ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করবে।

বারেক বলল, জ্বি করব।

মাহতাব উদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে শান্ত গলায় বললেন, খলিলুল্লাহর একটা ব্যবস্থা আজ রাতেই করতে হবে। কী ব্যবস্থা বুঝতে পারছ?

পারছি।

আর যাই করে তাকে পানিতে ফেলবে না। পানিতে ফেলে কিছু করা যাবে না। এ অন্য জিনিস।

বারেক চাপা গলায় বলল, স্যার এই বিষয় নিয়া আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না। আমাদের ইটের ভাটা আছে।

ঠিক আছে, এখন যাও।

রাত দুটা কুড়ি মিনিটে খলিলুল্লাহকে হাত-পা বেঁধে ইটের ভাটায় ফেলে দেয়া হলো।

রাত দুটা পঁচিশ মিনিটে টুনটুনির জ্বর খুব বাড়ল। গা দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হচ্ছে। মাহতাব উদ্দিন মেয়েকে বাথটাবে শুইয়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি নিয়ে ডাক্তার আনতে ছুটে গেলেন। জ্বরের ঘোরে টুনটুনি পানির নিচে চলে গিয়েছে। তখন খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো। টুনটুনি লক্ষ করল সে পানির নিচে ডুবে থাকতে পারছে, তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সে একসঙ্গে অসংখ্য নারী পুরুষের গলা শুনছে। সবাই বলছেটুনটুনি, দ্বিতীয় মানব সম্প্রদায়ের জগতে স্বাগতম। তুমি এখন আমাদের একজন।

(সমাপ্ত)

No comments