মমিনুলের তৃতীয় চোখ – নিয়াজ মেহেদী
আরশিদহ হাইওয়ে থানাটা বহুকাল ধরে নির্জন। আশপাশের দু-চার কিলোমিটারের মধ্যে জনবসতি নেই। সেধে পোস্টিং নিয়ে এখানে কেউ আসতে চায় না। লাভের মধ্যে আছে দুই চোখ ভরতি করে সবুজ দেখার স্বাধীনতা। সেটাও সপ্তাহখানেক পর একঘেয়ে হয়ে যায়। তখন সময় কাটানো কঠিন।
মানুষ এখন প্রচণ্ড শহরমুখী। হর্নের বিচ্ছিরি শব্দ ও মৌমাছির গুঞ্জনের মতো মানুষের কোলাহল শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে। বিশুদ্ধ বাতাস ঠিক সহ্য হয় না। অথচ এই রকম খোলামেলা পরিবেশে একদিন কনস্টেবল মমিনুল বড় হয়েছিল।
ডিউটিতে বসে আশ্চর্য হয় সে। এখন ফাল্গুন মাস। আবহাওয়া এখনো তেতে ওঠেনি। আরামদায়ক বাতাস বইছে সর্বদা। শরীরে লাগলে খুব ভালো লাগে। সন্ধ্যা নামছে। বাইরে পাখিরা ডাকাডাকি করছে। ডাক শুনে প্রতিটা পাখিকে আলাদা করতে পারে মমিনুল। দোয়েল, চড়ুই, বুলবুলি, বউ কথা কও, ফিঙে—সব কটিকে। চাকরিতে ঢোকার পর আট বছর মমিনুলের খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। ঢাকায় পোস্টিং ছিল। দম ফেলার সময় পর্যন্ত নেই। ডিউটিতে যাওয়া-আসা করতে করতে চোখের নিমেষে আটটা বছর বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছে। আশ্চর্য, এই আট বছরে এক দিনও পাখির ডাক শুনতে পায়নি সে।
থানায় সে ছাড়া আর কেউ নেই। একটা বড় দুর্ঘটনার কথা শুনে অফিসার-ফোর্স সবাই গোড়দহে ছুটে গেছে। এখন ঈদের সময়, হুড়মুড় করে বাড়িতে ছুটছে সবাই। দেশের এ–প্রান্ত থেকে ও–প্রান্তে পরিযায়ী পাখির মতো শুধুই মানুষের আনাগোনা চলছে। এক মিনিটের দেরিও কারও সইবে না।
রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল মমিনুল। ছায়া লম্বা হতে শুরু করেছে। থানার ভেতরের প্রকাণ্ড অশ্বত্থগাছটায় রাজ্যের পাখি এসে বসেছে। দিনের শেষে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। এই সময় প্রচুর ভুট্টা হয়। পাখিদের পেট ভুট্টাদানায় বোঝাই। চমৎকার একটা দিনের পর তারা বিদায় জানাচ্ছে ডুবন্ত সূর্যটাকে।
মমিনুলের বাড়ি পাশের জেলায়। এই এলাকার পরিবেশ তার হাতের তালুর মতো চেনা। ফাঁকা জায়গায় সন্ধ্যা নামতে সময় লাগে। সূর্য অনেকক্ষণ নাছোড়বান্দার মতো দিগন্তে আটকে থাকে। কমলা আলো মুছে গিয়ে তারপর ধীরে ধীরে আঁধার নামে। একা একা এসব দেখতে মমিনুলের মন্দ লাগে না। গত আট বছরে সে এত কিছু দেখার সময় পায়নি। ঢাকায় দিনরাত সমান। অবসর সময় যা পাওয়া যায়, তা–ও কেড়ে নেয় মুঠোফোনের স্ক্রিন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মমিনুল ফোন বের করে আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। থানায় ফোনের নেটওয়ার্ক খুব দুর্বল। আদ্যিকালের মতো অনেক হ্যালো হ্যালো করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। ফোনটাকে সে এখন শুধু সময় দেখার জন্য ব্যবহার করে।
হাওয়া বইবার শব্দে মমিনুলের ঘোর ভাঙল। থানার আশপাশে চরাচরজুড়ে ভুট্টার খেত। দূর থেকে শনশন শব্দ করে বাতাস কাছে আসে। এক মানুষ উঁচু ভুট্টার গাছগুলো বাতাসে দোল খেতে খেতে পরস্পর ঠোকাঠুকি করে। নাচের পুতুলের মতো মাথা নেড়ে আবার স্থির হয়ে যায়।
মমিনুল থানার সব কটি লাইট জ্বালিয়ে দিল। বাইরে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। কপাল ভালো, বিদ্যুৎ এখনো যায়নি। থানার অর্ধেক অংশজুড়ে দুর্ঘটনায় পতিত বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ভটভটি ও মোটরসাইকেলে বোঝাই। ছিঁচকে চোরেরা সুযোগ পেলে এটা-ওটা চুরি করার ফিকির খোঁজে। লোডশেডিংয়ের সময় ওদের কাজটা সহজ হয়।
সহকর্মীদের এখনো দেখা নেই। বোধ হয় গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেকার দিয়ে গাড়ি টেনে থানায় নিয়ে আসতে হবে। উঠানে পড়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে মমিনুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই গাড়িগুলো এককালে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াত। ড্রাইভারের বড় আদরের ছিল। কত যত্ন করে সেগুলো ধোয়া হতো। কত মানুষ কত স্বপ্ন নিয়ে এই সব গাড়িতে চড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কত বড় লক্ষ্মী ছিল এই গাড়িগুলো। শুধু একমুহূর্তের ভুলে তারা আজ এই গাড়ির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। চাকার হাওয়া কবেই বেরিয়ে গেছে। মসৃণ চকচকে শরীরে মরিচার ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছে। কত যত্নে ঝেড়েপুছে রাখা গাড়িগুলোতে আজ সাপখোপের আড্ডা।
সাপের কথা স্মরণ হতে মমিনুল শিউরে উঠল। সে সাপ ভয় পায়। শীতের শেষে সাপেরা ইঁদুরের গর্ত থেকে কিলবিল করে বেরিয়ে এসেছে। রোদের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে অলসের মতো পড়ে থাকে। মেঠো ইঁদুর খাবারের লোভে থানার আশপাশে ঘুরঘুর করে। তাদের পেছন পেছন সাপও চলে আসে। প্রায়ই টিকটিকিখেকো হেলে সাপ ঢুকে পড়ে ব্যারাকের ভেতর। হেলে সাপ নির্বিষ, মমিনুল জানে। তবু সাপ তো, দেখলে গা শিউরে ওঠে।
থানা ভবনের দরজায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মমিনুল বসল। কে যেন ওয়্যারলেস সেট টেবিলের ওপর ফেলে গেছে। সেখান থেকে কিছুক্ষণ একটানা অস্পষ্ট স্বর শোনা গেল। দুর্ঘটনা হাইওয়ে থানার জন্য খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ছোটখাটো ঠোকাঠুকি প্রতিদিন হয়েই থাকে। আজ বোধ হয় বড় কিছু হয়েছে। সিভিল পোশাকে একদল ক্যারম খেলছিল। ঘুঁটি বোর্ডে ফেলে রেখে তারা চলে গেছে। থানার যে যেখানে ছিল, সবাই ১০ মিনিটের নোটিশে ছুটে বেরিয়ে গেছে। তাড়াহুড়া দেখে ঘটনার খবর জিজ্ঞেস করার সাহস মমিনুল পায়নি।
আঁধার এরই মধ্যে জমাট বেঁধেছে। প্রাচীরের ওপাশ থেকে জোনাকির দল গুটি গুটি করে উড়ে থানার ভেতর ঢুকতে শুরু করেছে। দিবাচর পাখির ডাক থেমে গেছে। এখন কেবল প্যাঁচা ও নিশাচর পোকামাকড়ের ডাক শোনা যাচ্ছে। মমিনুল অভিভূতের মতো জোনাকির দলের দিকে তাকাল। আলো ক্রমাগত জ্বলছে ও নিভছে। শত সহস্র জোনাকির আলোয় পরিত্যক্ত যানবাহনগুলো হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মমিনুল সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
মমিনুলকে বিস্মিত করে দিয়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। এমন নয় থানায় কখনো লোডশেডিং হয় না। মাঝেমধ্যেই হয়। পল্লীবিদ্যুতের আওতাধীন এলাকায় লোডশেডিং অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। তখন ওসি সাহেবের নির্দেশে নিমেষের মধ্যে গর্জে ওঠে জেনারেটর। আজ ওসি সাহেব থানায় নেই। জেনারেটর অপারেটরও নেই। অফিসের গ্যারেজে মমিনুল জেনারেটরটি দেখেছে। কিন্তু কীভাবে, কোন চাবি দিয়ে সেটা চালাতে হয়, তা সে জানে না। মমিনুল রাইফেল শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
আলো চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আরও নিবিড় হয়েছে। রাতচরা শব্দগুলো আরও প্রকট হয়েছে। ধীরে ধীরে শব্দের গুঞ্জন বাড়তে শুরু করল। মনে হলো একদল লোক হেঁটে এসে থানার ভেতর ঢুকছে। মমিনুল চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়াল। রাইফেল গেটের দিকে তাক করে কাঁপা গলায় চিৎকার করে বলল, ‘দাঁড়ান! আপনারা কারা?’
কোনো জবাব এল না। শব্দটাও কমল না। গুঞ্জন ধীরে ধীরে হাটের হট্টগোলে রূপ নিল। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে এদিক-ওদিক আলো ফেলে দেখল মমিনুল। জনমানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। তারপরও কোথায় থেকে যেন মানুষের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।
মমিনুলের দুই হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে। ডিউটি শুরুর আগে চায়নিজ রাইফেলে ১০টি গুলি লোড করেছে সে। আরও ১০টি তার কোমরের পাউচে রয়েছে। জীবন থাকতে সে কাউকে থানায় অনুপ্রবেশ করতে দেবে না। কিন্তু লোকগুলো কারা? সে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না কেন?
থানার প্রাচীরের বাইরে যত দূর চোখ যায়, শুধু ভুট্টার খেত। হাইওয়ে এমনিতে মোটামুটি ব্যস্ত। আজ বিকেল থেকে যানবাহনের চাপ কম। সন্ধ্যার পর থেকে একটা মোটরসাইকেল যাওয়ার শব্দও মমিনুল পায়নি। তাহলে অতগুলো মানুষ কীভাবে এল? হেঁটে নিশ্চয়ই নয়। আজকাল গ্রামের মানুষও বেশি দূরের পথ হেঁটে যায় না।
হু হু করে প্রবল বাতাস বইতে শুরু করল। মমিনুল লক্ষ করল, চারদিকে ভুট্টাগাছগুলো বাতাসে সরসর করে কাঁপছে। বাতাসের লক্ষ্য এখন থানা। শব্দ করতে করতে প্রাচীর পর্যন্ত এসে বাতাস আটকে যাচ্ছে। শুধু অশ্বত্থগাছটির পাতা বাতাসে অল্পস্বল্প কাঁপছে।
মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে মমিনুল অফিসের ভেতর ঢুকল। কাঁপা হাতে মুন্সির টেবিলের ড্রয়ার খুলল। যা ভেবেছিল তাই, একটা টর্চলাইট রাখা আছে। টর্চলাইট হাতে নিয়ে মমিনুলের সাহস দ্বিগুণ হয়ে গেল। প্রথমে সে সুইচ টিপে দেখে নিল আলো জ্বলে কি না। সুইচ টিপতেই উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল। মুন্সি গোছানো মানুষ। সে বিকল টর্চ ড্রয়ারে রাখার মানুষ নয়।
একবুক সাহস নিয়ে মমিনুল বাইরে বেরিয়ে এল। তার ডান হাতে রাইফেল, বাঁ হাতে টর্চ। বাইরের গুঞ্জন ফিসফাসে রূপ নিয়েছে। মমিনুল আলো জ্বালিয়ে ইতিউতি তাক করতেই সব নীরব হয়ে গেল। পিনপতন নীরবতার মধ্যে সে শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে লাগল। তার হৃদয় যেন বুক ছেড়ে গলায় উঠে এসেছে।
বুট মচমচ করে হাঁটতে হাঁটতে মমিনুল গেটের দিকে এগিয়ে গেল। আরেকটু সামনে অশ্বত্থগাছটা। তার নিচে গাড়িদের গোরস্তান। গত ১০ বছরে দুর্ঘটনার শিকার সব গাড়ি সেখানে রাখা আছে।
গেটের কাছে কেউ নেই। বাইরে ভুট্টাক্ষেতের গভীরে বেশি দূর টর্চের আলো যায় না। যত দূর দেখা গেল সব স্বাভাবিক। মানুষ দূরের কথা, একটা শিয়ালেরও দেখা নেই। দেখেশুনে মমিনুল থানায় ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছে, এমন সময় একপশলা প্রবল বাতাসে অশ্বত্থগাছটা কেঁপে উঠল। বাতাসের ধাক্কায় ইট বিছানো রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল মমিনুল। হাতের টর্চটি ছিটকে পড়ল ১০ হাত দূরে। কিছুক্ষণ জ্বলানেভা করতে করতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল সেটা।
মানুষের গুঞ্জন হঠাৎ বেড়ে গেল। তারা যেন প্রাচীরের ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেয়াল টপকে থানার ভেতরে ঢুকবে। রাস্তার ওপরে বসে মমিনুল আগন্তুকদের অপেক্ষা করতে লাগল। তার রাইফেল নিলিং লোডিং পজিশনে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে রাখা। অনাহূত লোক থানায় ঢোকার চেষ্টা করলে গুলি করবে।
মমিনুলের তর্জনী রাইফেলের ট্রিগারে ছিল। কিন্তু তারপর যে ঘটনা ঘটল, তার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ট্রিগারে তার তর্জনী অসাড় হয়ে গেল।
প্রাচীর টপকে দলে দলে লোক থানার ভেতর ঢুকল। থানার ১২ ফুট উঁচু প্রাচীর তারা অবলীলায় পার হতে লাগল। শুধু পুরুষ নয়, দলে আছে নারী, শিশু ও বয়স্করাও। তাদের শরীর চাঁদের আলোর মতো জ্বলজ্বল করছে। কোনো রক্তমাংসের মানুষের শরীর অত উজ্জ্বল হয় না। মমিনুলকে ফিরেও দেখল না তারা। ব্যস্ত হয়ে উঠে বসল একটা বাসে।
পরিত্যক্ত বাসে আলো জ্বলে উঠল। যেন এখনি ছেড়ে যাবে এমনভাবে হেলপার ডাকাডাকি করতে লাগল। ছোট্ট একটা শিশু কাঁদছিল। তার জন্য চিপসের প্যাকেট কিনে আনার জন্য হন্তদন্ত হয়ে নেমে গেলেন বাবা। ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার জন্য বাসে উঠেছে তরুণী। তার চোখে মুক্তার মতো টলোমলো করছে অশ্রু। হাতঘড়িতে ব্যস্ত হয়ে সময় দেখতে থাকা একটা লোক দ্রুত গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে ডাকাডাকি করতে লাগল। বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে বাসে উঠেছে এক ফেরিওয়ালা। ছোট শিশুরা কৌতূহল নিয়ে একবার তাকে, একবার মা-বাবাকে দেখছে। খাবারের ব্যাগ শক্ত করে ধরে আছেন এক বৃদ্ধ। বোধ হয় নাতনিকে দেখতে যাচ্ছেন। এক ভদ্রমহিলা ছেলেকে ফোন করে বলছেন, ‘আমি বাসে উঠে পড়েছি। কাছাকাছি এসে ফোন দেব। তুই এসে আমাকে নিয়ে যাস।’
মমিনুলের হাত থেকে রাইফেল খসে পড়ল। সে মোহাবিষ্টের মতো বাসের ঘটনা দেখতে লাগল। এরা কেউ জীবিত মানুষ নয়। ছায়া ছায়া চাঁদের আলোর মতো তাদের শরীর। বহুদিন আগে কোনো এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। আজ তারা আবার ফিরে এসেছে। রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে আসেনি, এসেছে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর অতৃপ্ত বাসনা পূরণ করার জন্য। এখনো জানে না, তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে ভয়ানক সড়ক দুর্ঘটনা।
মমিনুল টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। ভয়ের সমস্ত ধাপ অতিক্রম করে বাসের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। ড্রাইভার অন্যমনস্ক হয়ে দাঁতে নখ কাটছে। কে যেন তাকে বারবার ফোন করছে। সে ফোন বাজতে দেখে আর তুলছে না। টিকিট চেকার হাসিমুখে টিকিট চেক করছে। ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সিটের তরুণ একটা গান চালাতে বলল। একবার থমকে গিয়ে ড্রাইভার সিডি প্লেয়ার চালু করল। গান বাজতে থাকল, ‘তুজঝে নারাজ নাহি জিন্দেগি হ্যায়রান হুঁ ম্যায়…।’
ধীর পায়ে বাসে উঠে পড়ল মমিনুল। সাবধানে হাঁটছে যেন কারও সঙ্গে ধাক্কা না লাগে। ওরা সবাই নিজের জগতে ডুব দিয়ে আছে। কেউ তাকে দেখছে না। ৩২ সিটের বাস। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাত্রীতে বোঝাই। তারপরও বাসের গায়ে চাপড় মেরে হেলপার লোক ডাকাডাকি করছে।
বাসভর্তি কত রকম মানুষ! শিশু আছে, তরুণ-তরুণী আছে, বয়স্করা আছেন। কত স্বপ্ন নিয়ে তারা বাসে উঠেছে। ঘুণাক্ষরেও কেউ জানে না, এটাই তাদের শেষ যাত্রা। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস ছেড়ে দেবে। তারপর ঘটবে প্রচণ্ড দুর্ঘটনা।
শেষ সারির ঠিক সামনের সারিতে গিয়ে মমিনুল থমকে দাঁড়াল। কাঁচাপাকা চুলের একটা ধবধবে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা লোক উদাসীনের মতো বাইরে তাকিয়ে আছেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য যেন অধীর হয়ে আছেন। তাঁকে দেখে মমিনুলের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। হাত-পা নিঃসাড় হয়ে আসতে লাগল। সে অস্ফুট স্বরে ডাকল, ‘আব্বা।’
সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। মমিনুলকে তিনি দেখেননি। সাড়া দিয়েছেন টিকিট চেকারের ডাকে। পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে ওই তো টিকিট বের করে আনলেন। মমিনুলের চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। আজ বহু বছর পর বাবাকে সে চোখের সামনে দেখতে পেয়েছে। অবিকল সেই চোখ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, পরিষ্কার সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে বাবা তার সামনে এসে হাজির হয়েছেন।
ড্রাইভার ঘন ঘন হর্ন দিচ্ছে। হেলপার বাসের গায়ে বারবার চাপড় মেরে যাত্রীদের তাড়া দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস ছেড়ে দেবে। মমিনুল ব্যস্ত হয়ে তার বাবাকে ডাকতে লাগল।
‘আব্বা, আব্বা নেমে আসেন। এই গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করবে।’ মমিনুল অনুনয় করে বলল।
বাবা একমুহূর্ত মমিনুলের দিকে তাকালেন। পরক্ষণে সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছেলেকে দেখতে যাচ্ছি বুঝলেন। আমার ছেলে পুলিশ কনস্টেবল। এবার ঈদে বাড়ি ফিরতে পারেনি। বুকটা খুব খালি খালি লাগছে। এই দেখেন, ওর মা ব্যাগ ভর্তি করে পিঠা বানিয়ে দিয়েছে।’
মমিনুলের দুই চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। তার হাত-পা অবশ হয়ে গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর কত দিন এই মুহূর্তটা সে কল্পনা করেছে। আবার কখনো বাবাকে দেখতে পেলে কী কী বলবে মনে মনে অনেকবার ভেবেছে। আজ এই অপার্থিব রাতে চোখের সামনে আট বছর আগে মরে যাওয়া বাবাকে দেখে তার চিন্তাশক্তি জট পাকিয়ে গেল। বাবাকে বলবে বলে ভেবে রাখা কথাগুলো কিছুতেই মনে পড়ল না।
ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। একটু একটু করে গাড়িটা সামনে এগোতে শুরু করেছে। মমিনুল লাফ দিয়ে তার বাবার হাত ধরতে গেল। ধরতে পারল না। বাবা রক্তমাংসের মানুষ নন, তাঁর শরীর ছায়া ছায়া একরকম অনুজ্জ্বল আলো দিয়ে গড়া। মমিনুলের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। এমন সময় পেছন থেকে টিকিট চেকার মমিনুলকে দেখে গর্জে উঠল, ‘এই আপনার টিকিট দেখান। আপনার টিকিট কোথায়?’
মমিনুল কোনো জবাব না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। গতিজড়তার ধাক্কায় সে টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। একটা সিট ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। এইবার মমিনুলের বাবা তাকে দেখতে পেলেন। আদরমাখা পরিষ্কার গলায় বললেন, ‘বাবা মমিন, তোর এখনো যাওয়ার সময় হয়নি। তুই নেমে যা।’
বাসভর্তি সব যাত্রী তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল। তারা একযোগে স্লোগানের মতো করে বলল, ‘নেমে যাও, নেমে যাও।’
প্রচণ্ড এক ধাক্কায় মমিনুল বাস থেকে ছিটকে পড়ল। তার হাত-পায়ের চামড়া ছড়ে গেছে। কিন্তু একটুও যন্ত্রণা অনুভব করল না। মাটিতে শুয়ে থেকে দেখল বাসটা চলতে চলতে থানার প্রাচীর ভেদ করে ভুট্টাক্ষেতের গভীরে মিলিয়ে গেল। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
টর্চের আলো মুখে পড়লে মমিনুলের জ্ঞান ফিরল। ওসি সাহেব তার মুখে টর্চ ধরে রেখেছেন। মুন্সি ঝুঁকে পড়ে তার পালস মাপার চেষ্টা করছে। থানার অন্য অফিসার ও ফোর্স গোল হয়ে তাকে দেখছে। ওসি সাহেব চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘নেশাটেশা করেছ নাকি? এখানে এভাবে শুয়ে আছ কেন? ওই বাসটা গেল কোথায়? তোমাদের পাহারায় রেখে আমি একমুহূর্তও নিশ্চিন্তে থাকতে পারি না।’
মমিনুল দেখল বাসটা নেই। তার জায়গায় রেকার দিয়ে টেনে আনা নতুন একটা মুখ তোবড়ানো বাস শোভা পাচ্ছে। বাসের ভেতর অনেকগুলো ছায়ামূর্তি হাতড়ে হাতড়ে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। মমিনুল বাদে অন্য কেউ তাদের দেখতে পেল না।
Post a Comment