চিলেকোঠা – তৌফির হাসান উর রাকিব
অপেক্ষা ব্যাপারটা ঠিক উপভোগের বিষয় নয়, আর রবির কাছে সেটা রীতিমতো অসহ্য। চিরকালই চঞ্চল স্বভাবের ছেলে সে, ধীরস্থির হয়ে কোনো কাজ করাটা তার ধাতে নেই। এ জন্য প্রায়ই তাকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যদিও এতে তার স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি এতটুকুও।
এই যেমন এখন, নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা আগে হাজির হওয়ার মাশুল গুনতে হচ্ছে তাকে। অপেক্ষা করতে হচ্ছে, কখন ডাক আসে ডা. নোরার চেম্বার থেকে।
ডা. নোরা, একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। মনোবিজ্ঞানের ওপর বেশ কয়েকটা বিদেশি ডিগ্রি আছে তাঁর। ওগুলোর নামগুলোও বেশ কঠিন, উচ্চারণ করতে রীতিমতো দাঁত ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। প্রতিদিন দশজনের বেশি রোগী দেখেন না নোরা। আর ভাগ্যের ফেরে সর্বশেষ নম্বরটিই জুটেছে রবির কপালে।
ডা. নোরার অ্যাসিস্ট্যান্ট একাধিকবার রবিকে বলে দিয়েছিল, সন্ধ্যা ছয়টার আগে তার সিরিয়াল আসার কোনো সুযোগ নেই; বরং আরও দেরি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। মানসিক সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের কার কতক্ষণ সময় লাগবে, তা কি আর আগে থেকে ঠাওর করা যায়?
তবু স্বভাবসুলভ চপলতায় কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাড়ে পাঁচটায় এসে হাজির হয়ে গেছে রবি। যদিও এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, কাজটা মোটেও ঠিক করেনি সে। ছয়টার পর এলেই ভালো করত।
ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে একটা লম্বামতন বারান্দা আছে। এতে দর্শনার্থীদের বসার জন্য এক সারি প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। দেয়ালের ধারে, একেবারে শেষ মাথার চেয়ারটায় হাত–পা ছড়িয়ে বসে আছে রবি। চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা খেলা করছে তার।
দুই
‘আমি ভয় পাই,’ মৃদুস্বরে বলল রবি। ডা. নোরার মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে সে। তাকিয়ে আছে ডাক্তারের ভাবলেশহীন চেহারার দিকে।
‘কম আর বেশি ভয় আমরা সবাই পাই। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়,’ নোরা বললেন। ‘তা আপনার ভয় পাওয়ার কারণটা কী?’
কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করল রবি। ‘আমি জানি, আমার ব্যাপারটা কোনো মানসিক সমস্যা নয়। আমি পাগল নই। তবু কেন যে আপনার এখানে এলাম, সেটা আমি নিজেও জানি না।’
‘মানসিক সমস্যা থাকা মানেই কিন্তু পাগল হয়ে যাওয়া নয়,’ শান্ত স্বরে বললেন নোরা। ‘তা ছাড়া কখনো কখনো মন খুলে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারলে অস্থিরতা অনেকটুকু কমে যায়। কিংবা বিশেষ কারও সামান্য একটু কাউন্সেলিংই হয়তো মনের ভার লাঘব করে সঠিক পথনির্দেশনা দিতে পারে মানুষকে। তাই আমায় সবকিছু খুলে বলুন। শ্রোতা হিসেবে আমি কী ভাবছি না–ভাবছি, কিংবা আমার পেশা কী, সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই আপনার।’
তাঁর কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হলো রবি। তার চেহারার বিব্রতভাব অনেকটাই কেটে গেল। ‘ঘটনার সূত্রপাত সপ্তাহ দুয়েক আগে। হঠাৎই দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করি আমি। অথচ এর আগে ঘুমের কোনো সমস্যাই ছিল না আমার। বিছানায় শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়তাম, এরপর একঘুমে রাত কাবার। স্বপ্ন-টপ্ন বিশেষ একটা দেখতাম না। কিন্তু আচমকাই সবকিছু বদলে গেল। দুঃস্বপ্নগুলো মাঝরাতেই ঘুম ভেঙে দিতে শুরু করল। একবার ঘুম ভাঙার পর সারা রাত আর একটুও চোখের পাতা এক করতে পারি না আমি, কিছুতেই আর ঘুম আসে না। বিছানায় গড়াগড়িই কেবল সার হয়। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আমাকে। ভোরের আলো ফোটার আগপর্যন্ত আর ভয়টা থেকে মুক্তি মেলে না আমার। এখন আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছেন, কী নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি আমি?’
মুখে কিছু না বলে কেবল হ্যাঁ–সূচক মাথা দোলালেন নোরা।
‘আমি দেখি, আমার ঘরের প্রতিটি আসবাবের প্রাণ আছে, ওরা নিথর কোনো জড়বস্তু নয়! আঁধার ঘনালেই ওদের ভিতর প্রাণসঞ্চার ঘটে, আর একেকটা জিনিস পরিণত হয় একেকটা জীবন্ত বিভীষিকায়। তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করতে পারে, কথা বলতে পারে, এমনকি চিৎকারও করতে পারে। তাদের প্রত্যেকের গলার স্বর আলাদা। তাদের চিন্তাচেতনা, কথা বলার ধরন, এমনকি আবেগের প্রকাশও স্বতন্ত্র। কেবল একটা ব্যাপারেই তারা এককাট্টা—তাদের অভিপ্রায়। তারা কেউই চায় না, আমি তাদের সঙ্গে একঘরে থাকি! তারা চায়, আমি যেন দূরে কোথাও চলে যাই। তবে ঘরের একটা জিনিসেও যেন হাত না দিই। ওরা যেমন আছে তেমনই থাকবে, শুধু আমিই যেন না থাকি! প্রথম প্রথম ওরা এলোপাতাড়ি হুমকি দিত। তবে শেষমেশ আমাকে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে ঘরটা ছাড়ার জন্য। আর আজই তার শেষ দিন। ওরা প্রত্যেকেই আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছে, আজকের পরও যদি আমি ঘর না ছাড়ি, আমাকে এর জন্য চরম মূল্য চুকাতে হবে। এখন আপনিই বলুন, দুই সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে এমন স্বপ্ন দেখলে কীভাবে একজন মানুষ ভালো থাকে? ভয় পাওয়াটা কি খুবই অস্বাভাবিক?’
মাথা নাড়লেন নোরা। ‘মোটেও অস্বাভাবিক নয়, খুবই স্বাভাবিক। যে কেউ এমন পরিস্থিতিতে ভয় পাবে।’
রবিকে স্বাভাবিক হতে খানিকটা সময় দিলেন তিনি। খেয়াল করেছেন, কথা শেষ হলেও এখনো অল্প অল্প কাঁপছে সে।
‘আচ্ছা, দুঃস্বপ্নগুলো কি কেবল রাতেই দেখেন? নাকি দিনে ঘুমালেও হানা দেয় ওরা?’ হালকা স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন নোরা।
জবাব দেওয়ার আগে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিল রবি। ‘দিনে দেখিনি কখনো। আসলে দিনে ঘুমানোর সুযোগই হয় না আমার। সপ্তাহে ছয় দিন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। সাতসকালে বেরিয়ে, ফিরি সন্ধ্যার পর। আর ছুটির দিনটা বন্ধুদের সঙ্গে কাটাই অথবা সপ্তাহের জমানো নিজস্ব টুকিটাকি কাজগুলো সেরে নিই। এই যেমন আজ আপনার এখানে এলাম।’
‘বেশ। বুঝলাম,’ মাথা দোলালেন নোরা। ‘অফিসে অথবা অফিসের বাইরে, কোনো কিছু নিয়ে মানসিক চাপের মধ্যে নেই তো আপনি?’
আবারও কিছুক্ষণের বিরতি নিল রবি। ‘উঁহু। এই মুহূর্তে আমার জীবন কোনো ক্রিটিক্যাল ফেজ অতিক্রম করছে না। চাকরিটা পরিশ্রমের হলেও ওটা নিয়ে সন্তুষ্ট আমি। আমার যা যোগ্যতা, তাতে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করাটাও বোকামি। অফিসের সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো আমার। বসও আমাকে বেশ পছন্দ করেন বলেই জানি। অফিসের বাইরেও কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলায় নেই আপাতত।’
‘বাসায় কে কে থাকেন আপনার সঙ্গে?’
‘আসলে একাই থাকি আমি এখানে। একটা দোতলা বাড়ির চিলেকোঠায়। মা–বাবা গ্রামে থাকেন, শহরে আসতে চান না। তাই নিজের জন্য কোনোমতে চলনসই একটা আশ্রয় খুঁজে নিয়েছি আরকি। তা ছাড়া যে আয় করি, তা দিয়ে বিলাসবহুল জীবন কাটানোর কথা কল্পনাও করা যায় না। তবে তা নিয়ে কোনো আফসোস নেই আমার, আমি মোটেও অসুখী নই।’
‘সুখ ব্যাপারটা আসলে নিজের কাছে। আপনার চাহিদাকে আপনি যত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, আপনার প্রাপ্তিকে যত বেশি উপভোগ করতে পারবেন, আপনি তত বেশি সুখী হবেন। আপনি বলছিলেন, আপনি একটা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকেন। তো ওখানে আলো-বাতাস ঠিকঠাক পান তো? মানে বলতে চাচ্ছি, পরিবেশটা স্বাস্থ্যকর তো? এমন অনেক ঘিঞ্জি এলাকা আমার চেনা, যেখানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয় আলোর জন্য। আর খোলা হাওয়ার কথা তো ভাবাই বৃথা।’
‘না, না। আমার ঘরটা মোটেও তেমন নয়। আসলে নামে চিলেকোঠা হলেও ঘরটার আকার বেশ বড়। অ্যাটাচড বাথরুম আছে। আশপাশে বড় কোনো ইমারত না থাকায় আলো-বাতাস বেশ ভালোই পাওয়া যায়।’
‘সম্প্রতি বাসার কাছাকাছি এমন কোনো কলকারখানা কি গড়ে উঠেছে, যেটা বাজে গ্যাস কিংবা দুর্গন্ধ উৎপন্ন করে? আজকাল তো হরহামেশাই আবাসিক এলাকায় ফ্যাক্টরি দেখতে পাচ্ছি। নিয়ম না মানাটাই এখন এ দেশের মানুষের জন্য নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘উঁহু। তেমন কোনো কারখানা চোখে পড়েনি ইদানীং ওই এলাকায়। বাজে কোনো গন্ধ কিংবা গ্যাসও নাকে এসেছে বলে মনে পড়ছে না। আসলে বাসাটা শহর থেকে খানিকটা দূরে কিনা, তাই পুরোপুরি দূষিত হওয়ার সুযোগ পায়নি এখনো। শহরের চৌহদ্দিতে কে একজন ব্যাচেলরকে ঘর ভাড়া দেবে, বলুন? এই শহরে ব্যাচেলর হিসেবে ঘর ভাড়া পাওয়া আর চাঁদে যাওয়ার টিকিট পাওয়া একই ব্যাপার। দুটোর কোনোটাই আমার ভাগ্যে নেই। মেস করে একগাদা লোকের সঙ্গে থাকতে ইচ্ছা করে না। প্রাইভেসির জলাঞ্জলি দিতে ঘোর আপত্তি আমার। সবকিছু মিলিয়েই শহর থেকে খানিকটা দূরে বাসা ভাড়া নিয়েছি।’
‘ভালো। নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে ঝাঁকের কই না হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আচ্ছা, আপনার ঘরে এখন যেসব আসবাব আছে, সেগুলোর সঙ্গে কি আপনার কোনো বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে আছে? কোনো দুঃখের স্মৃতি? অথবা এমন কিছু, যা আপনাকে বিশেষ কোনো মুহূর্তের কথা মনে করিয়ে দেয়?’
খানিকক্ষণ ইতস্তত করল রবি। কথাটা কীভাবে বলবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। ‘সত্যি বলতে, ওগুলোর একটাও আমার নয়। তাই ওগুলোর সঙ্গে জড়ানো কোনো রকম স্মৃতি থাকার সুযোগই নেই আসলে। আমি যাওয়ার আগে থেকেই ওগুলো ঘরটায় ছিল।’
‘ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনার কথা। একটু ক্লিয়ার করুন, প্লিজ।’
‘আমার আগে যিনি ওই ঘরটায় থাকতেন, জিনিসগুলো আসলে তাঁরই। চলে যাওয়ার সময় ওগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যাননি তিনি। আসলে নিজেও তিনি গায়েব হয়ে গেছেন কাউকে কিছু না বলেই।
‘একদিন সকালে নিয়মমাফিকই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু রাতে আর ঘরে ফেরেননি। সেই যে উধাও হলেন, এর পর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজই পাননি বাড়ির মালিক।
‘চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি তিনি, কিন্তু শেষতক ভাড়াটে ভদ্রলোকের কোনো হদিস বের করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। ভদ্রলোক যেন পুরোপুরি বাতাসে মিলিয়ে গেছেন!
‘একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, কারও সঙ্গেই খুব একটা কথা বলতেন না। কাউকে কখনো তাঁর কাছে আসতেও দেখা যায়নি। দেশের বাড়ির যে ঠিকানা তিনি দিয়েছিলেন, ওটাও ছিল ভুয়া। ওই নামের কাউকেই চিনতে পারেনি এলাকার লোকজন।
‘নিজে গায়েব হয়ে বাড়ির মালিককে অথই সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বাড়িভাড়া দিয়েই সংসারের জন্য অন্নের সংস্থান করতে হয় বেচারাকে। অনির্দিষ্টকাল ঘরটা ফাঁকা রাখার কোনো উপায় নেই তাঁর। তবু মাস তিনেক অপেক্ষা করেছেন তিনি। তারপরই কেবল টু-লেট নোটিশ ঝুলিয়েছিলেন সদর দরজায়। তবে ঘরের মালামালগুলো ফেলে দেননি কিংবা বিক্রি করে দেননি তিনি। যেন ওই হারিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক কখনো ফিরে এলে তাঁর মালসামান কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিতে পারেন।
‘আমাকে ঘরটা ভাড়া দেওয়ার সময় এটাই ছিল একমাত্র শর্ত। নিজের মালামাল আনা চলবে না আমার, আপাতত ওগুলোই ব্যবহার করতে হবে।
‘জানেনই তো, এই শহরে ঘরভর্তি মালামালসহ বাসা বদলানোটা কতটা ঝক্কির কাজ। তাই আমিও নির্বিবাদে শর্তটা মেনে নিয়েছিলাম। নিজের যা কিছু ভাঙাচোরা মালপত্র ছিল, পানির দরে বেঁচে দিয়ে একেবারে ঝাড়া হাত-পা নিয়ে উঠে পড়েছিলাম ওই চিলেকোঠায়। এ ছাড়া আমার নিজের জিনিসপত্রের চেয়ে ওই ভদ্রলোকেরগুলো অনেক বেশি উন্নত মানের। শর্তটা মেনে নেওয়ার এটাও একটা কারণ বটে,’ হাসতে হাসতে কথা শেষ করল রবি।
বক্তা ও শ্রোতা—হাসছেন দুজনই। আলাপচারিতার এ পর্বটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
‘এতক্ষণে আপনার সমস্যাটার একটা সম্ভাব্য কারণ পাওয়া গেল,’ হেসে বললেন নোরা।
‘বলেন কী! জলদি খোলাসা করুন, প্লিজ,’ কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে এল রবি।
‘মানুষের অন্যতম দুর্বল একটি বৈশিষ্ট্যের নাম মায়া। অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোর্স এটি, যা পিছুটান তৈরি করে, সামনে এগোতে বাধা দেয় মানুষকে। মায়ার বন্ধন ছিন্ন করতে নিজের ওপর অনেকখানি জোর খাটাতে হয়, যা প্রায়ই হয়ে ওঠে বেদনাদায়ক। মানুষ এই মায়া কেবল অন্য মানুষদের প্রতিই অনুভব করে, ব্যাপারটা এমন নয়। যেকোনো স্থান, যেকোনো জড়বস্তুর ওপরও জন্মাতে পারে মায়া।
‘কোথাও বেশি দিন থাকলে, জায়গাটার প্রতি আমাদের মায়া পড়ে যায়। কোনো জিনিস অনেক দিন ধরে ব্যবহার করলে সেটার প্রতিও আমরা একধরনের মায়া অনুভব করি। তাই পুরোনো জিনিসপত্র আমরা চট করে ফেলে দিতে পারি না, আমাদের কষ্ট হয়। নতুনকে আমরা স্বাগত জানাই ঠিকই, তবে পুরোনোর প্রতি হৃদয়ের টানটাও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাদের হারানোর ভয়টা আমাদের মর্মযাতনার কারণ হয়।
‘আপনার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটছে এখন। বর্তমান ঘরের আসবাবগুলো আপনার অনেক বেশি পছন্দ হয়ে গেছে। আপনার অবচেতন মন নিজের অজান্তেই সেগুলোকে আপন করে নিয়েছে। তাই তাদের প্রতি মায়ার টানটাও বেশ জোরালো। কিন্তু সচেতন আপনি জানেন, ওগুলো আপনার নয়। ওগুলোর মালিক অন্য কেউ, যেকোনো সময় হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে জিনিসগুলো। তাই আপনার নিজের ভেতরে একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
‘ওদের হারানোর ভয়টা আপনার অবচেতন মনে আগে থেকেই ছিল। কিন্তু কোনো কারণে আচমকা সেই ভয়টা বেড়ে গেছে বহুগুণে। আপাতদৃষ্টে কোনো সাধারণ ঘটনা, কিংবা দৈনন্দিন আলাপচারিতার কোনো নির্দোষ সংলাপই এ ক্ষেত্রে ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে বলে আমার ধারণা। আর এর পর থেকেই আপনার মধ্যে তৈরি হয়েছে একধরনের ঘোর। আর সেটাই দুঃস্বপ্ন হয়ে প্রতিনিয়ত আপনাকে তাড়িয়ে বেরাচ্ছে এখন।
‘আমার মনে হয়, শুধু রাতে নয়, দিনে ঘুমালেও স্বপ্নটা আপনি দেখতে পাবেন। কারণ, কেবল ঘুমের সময়ই আপনার অবচেতন মন সচেতন আপনার ওপর আধিপত্য করার সুযোগ পায়। রাত কিংবা অন্ধকারের সঙ্গে আদৌ এর কোনো সম্পর্ক নেই।’
তিন
ঠিক কী কারণে অমন গভীর ঘুমটা চট করে ভেঙে গেল, রবি নিজেও তা জানে না। তবে আজ সত্যিই কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেনি সে। নিস্তব্ধ রাতে ঘড়ির কাঁটার একঘেয়ে শব্দটাও অনেক বেশি জোরালো শোনাচ্ছে।
বালিশের পাশে রাখা মোবাইলে সময় দেখল রবি। রাত দুটো বাজে। সকাল হতে এখনো ঢের দেরি।
এতটা সময় অযথা জেগে থাকার কোনো মানে হয় না। তাই এক গ্লাস পানি খেয়ে আবারও শুয়ে পড়বে বলেই মনস্থ করল সে।
রাতে ঘুম ভাঙলে বড্ড পানি পিপাসা পায় তার। তাই পানির জগ আর গ্লাসটা সব সময় হাতের নাগালেই রাখে সে। খাটের পাশে ছোট্ট একটা টি-টেবিল। তার ওপরই রাখা থাকে ওগুলো।
পাশ ফিরে গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়েই রীতিমতো আঁতকে উঠল রবি। ঘরের মাঝখানে খানিকটা উবু হয়ে ওটা কে বসে আছে? হাত-পাগুলো অমন অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দোলাচ্ছে কেন লোকটা? ঘরেই–বা ঢুকল কেমন করে?
‘তোকে এখান থেকে চলে যেতে বলেছিলাম,’ ফিসফিস করে বলে উঠল লোকটা। যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে তার কণ্ঠস্বর।
আতঙ্কে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হলো রবির। গায়ের সব কটা লোম দাঁড়িয়ে গেল মুহূর্তেই। প্রাণপণে চিৎকার করার জন্য মুখ খুলল সে। ঠিক তখনই আবিষ্কার করল, নড়ছে না আর লোকটা এখন, পুরোপুরি স্থির হয়ে আছে!
মনে খানিকটা সাহস সঞ্চার করতে অনেকটা সময় লেগে গেল রবির। তবে শেষতক নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল সে।
প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা তার বয়সী একজন তরুণ যদি রাত-দুপুরে ভূতের ভয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে, সবার সামনে মুখ দেখাতে পারবে আর? লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবে না?
খানিকটা মনোবল ফিরে পেতেই এক দৌড়ে দেয়ালের সুইচ বোর্ডের কাছে চলে গেল সে। উজ্জ্বল আলো নিমেষেই ঘরের সব অন্ধকার ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল।
কোথায় লোক, কোথায় কী! ঘরের মাঝখানে ওটা তো একটা কাঠের চেয়ার!
কিন্তু লাখ টাকা বাজি রেখে বলতে পারে রবি, কিছুক্ষণ আগেও ওটা দেখতে ঠিক এ রকম ছিল না। আর ফিসফিস করে দেওয়া হুমকিটাও সে ভুল শোনেনি।
চট করে ব্যাপারটা মাথায় এল তার। চেয়ারটা ঘরের মাঝখানে এল কী করে? ওটা তো সব সময় ঘরের কোণায় রিডিং টেবিলটার পাশে থাকে। আজ ঘুমানোর সময়ও ওখানেই ছিল ওটা। তাহলে?
কাছে গিয়ে ভালো করে ওটাকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল রবি। উঁহু, কোনো পরিবর্তন নেই, যেমন ছিল তেমনই আছে ওটা। তবু ভয়টা পুরোপুরি কাটল না তার।
শেষমেশ দরজা খুলে ওটাকে ছাদের এক কোনায় রেখে এসে তবেই সে শান্ত হলো। সকালে ভেবে দেখবে, কী করা যায় ওটাকে নিয়ে।
আবার বিছানায় সে ফিরল ঠিকই, কিন্তু ঘরের বাতিটা জ্বালানোই রইল। অন্ধকারে ঘুমানোর সাহস নেই আর।
বেশ কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না। তার চোখের পাতা দুটোও ভারী হয়ে এল। পাশ ফিরে আরও খানিকটা আরাম করে শুতে গেল সে। আর ঠিক তখনই দপ করে নিভে গেল বাতিটা!
চমকে ওঠল রবি। লোডশেডিং? কিন্তু ফ্যানটা তো দিব্যি ঘুরছে! বাইরের ল্যাম্পপোস্টের বাতি থেকে হালকা আলো আসছে জানালার ফাঁকফোঁকর গলে। লাইটটা কি তাহলে ফিউজ হয়ে গেল?
‘কেউ আজ তোকে বাঁচাতে পারবে না আমাদের হাত থেকে। খোদার দরবারে তোর মরণ লেখা হয়ে গেছে। আজ আর তোর কোনো নিস্তার নেই,’ আচমকা শোনা গেল ভয়াল এক কণ্ঠস্বর।
ঘরের বদ্ধ বাতাসে বার কয়েক প্রতিধ্বনি তুলল বাক্যটা।
নিখাদ আতঙ্কে কেঁপে ওঠল রবির সারা শরীর। ঘরের আবছা অন্ধকারে যা দেখছে সে, তার নিজের কাছেই সেটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে এখন। স্বপ্ন কেমন করে সত্যি হয়?
আলনাটা আর সাধারণ কোনো আলনা নেই এখন! অসংখ্য ডানাবিশিষ্ট অতিকায় এক পাখি হয়ে গেছে ওটা। পরিপাটি করে সাজানো কাপড়গুলো যেন একেকটা দুর্বিনীত পাখা, পতপত শব্দে উড়ছে ওগুলো। মাটি থেকে ফুটখানেক ওপরে ভাসছে এখন আলনাটা। নিঃসন্দেহে ওটাই বলেছে একটু আগে শোনা কথাটা।
কম্পিত হাতেই মোবাইলের টর্চটা জ্বালাল রবি, আলো ফেলল ওটার গায়ে। প্রত্যাশা ছিল, ভয়ানক কিছু একটা দেখতে পাবে। কিন্তু ভীষণ অবাক হতে হলো তাকে। আলনাটা যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে, এতটুকুও রদবদল হয়নি ওটার!
আশ্চর্য! সবই কি হ্যালুসিনেশন?
তবে কাছে গিয়ে ভালোমতো পরীক্ষা করতেই খুঁতটা ধরা পড়ল তার চোখে। আলনাটা নিজের জায়গা থেকে বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছে। মেঝেতে স্পষ্ট ফুটে আছে বালির দাগ।
তবে এটা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবনাচিন্তা করার অবকাশই পেল না রবি। খটখট শব্দে পিলে চমকে উঠল তার।
প্রচণ্ড বেগে নড়ছে খাটটা! যেন ভয়াবহ কোনো ভূমিকম্প সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওটার ওপর। পরক্ষণেই শোনা গেল তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠস্বর, ‘মরবি তুই আজ। মরবি…’
ঝট করে ওটার ওপর টর্চের আলো ফেলল রবি। কাঁপুনির চোটে মোবাইলটা হাতে ধরে রাখতেই বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
আলো পড়তেই নড়াচড়া থেমে গেল খাটটার। যেন চিরকাল এভাবেই স্থির পড়ে ছিল ওটা!
ভয়ানক বিপদে পড়েছে, এটা বুঝতে বাকি রইল না রবির। সিদ্ধান্ত নিল, কাল সকালেই বাসাটা ছেড়ে দেবে। আজ রাতটা কোনোরকমে পার করতে পারলেই হয় কেবল।
অ্যাডভান্সের টাকা যদি ফেরত না-ও পাওয়া যায়, তাতেও কিছু যায় আসে না তার। জীবনের চেয়ে টাকা বড় নয়।
কিন্তু রাতটা কাটাবে কীভাবে? সকাল অবধি এমন অত্যাচার সহ্য করা রীতিমতো অসম্ভব।
পরক্ষণেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার। চেয়ারটার মতো সবকিছু ঘরের বাইরে রেখে এলে কেমন হয়? ছাদে রেখে আসার পর থেকে ওটা আর কোনো রকম ঝামেলা করেনি।
সব মালপত্র সরাতে অনেক পরিশ্রম হবে, হয়তো মিনিট বিশেক সময়ও লেগে যাবে। তবে আরামে কাটিয়ে দেওয়া যাবে বাকি রাতটা। ভোর হতে এখনো অনেকটা সময় বাকি।
কাজে নেমে পড়ল রবি। প্রথমেই ঘরের জানালাগুলো খুলে দিল। বাইরের সোডিয়াম বাতির হলদে আলোয় ঘরের অন্ধকার অনেকটাই কেটে গেল। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে রাখার ঝামেলাটা আর পোহাতে হলো না তাকে।
একে একে ঘরের সবকিছু বাইরে রেখে আসতে শুরু করল সে। একা করার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য কাজ, কিন্তু রবি নিরুপায়। পুরো ঘরটা ফাঁকা করতে তার হিসাবের চেয়ে মিনিট পাঁচেক সময় বেশিই লাগল। তবে তাতে কিছু যায় আসে না তার। কাজটা শেষ করা গেছে, এটাই স্বস্তি।
এখন অন্তত শান্তিতে কিছুক্ষণ ঘুমানো যাবে।
মেঝেতে একখানা চাদর বিছিয়ে এতেই শুয়ে পড়ল সে। ক্লান্ত শরীর, চোখের পাতা বুজে আসতে সময় লাগল না।
সবে চোখ দুটো বন্ধ করেছে কি করেনি, আবারও শোনা গেল কলজে কাঁপানো এক কণ্ঠস্বর, ‘সময় শেষ।’
চমকে জেগে উঠল রবি। কে কথা বলছে? ঘরে তো একটা কিছুও অবশিষ্ট নেই আর!
খিক খিক হাসির শব্দে ওপরে তাকাতে বাধ্য হলো রবি। সঙ্গে সঙ্গেই আতঙ্কে জমে বরফ হয়ে গেল তার পুরো শরীর। চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
মাথার ওপর সবেগে ঘুরছে সিলিং ফ্যানটা। আর ঠিক তার মাঝখানের জায়গাটায় ফুটে উঠেছে ভয়াল একখানা চেহারা! তার দিকে তাকিয়ে হাসছে সেটা।
ফ্যানটার কথা মনেই ছিল না রবির। আগের ভাড়াটের এই একটা জিনিসই এখনো রয়ে গেছে ঘরে!
ঝট করে উঠে দাঁড়াল রবি। দৌড়ে পালাতে চাইল ঘরের বাইরে। তবে তাকে সে সুযোগ দেওয়া হলো না!
আচমকা খুলে গেল ফ্যানের সব কটা পাখা। প্রচণ্ড বেগে সেগুলো ধেয়ে গেল রবির দিকে। ধারাল ব্লেডের উপর্যুপরি আঘাতে নিমিষেই চিরে ফালাফালা হয়ে গেল তার গোটা দেহ।
কেবল একবারই গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর সুযোগ পেল রবি। নীরব রাতে সেই চিৎকারটা অনেক দূর থেকেও স্পষ্ট শোনা গেল। বহু মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল রবি!
লেখা: তৌফির হাসান উর রাকিব
Post a Comment