নরওয়ের রূপকথা: নতুন বন্ধু মৌমাছি
জনি নামের ছোট্ট একটি ছেলেকে নিয়ে এই গল্প। কত আর তার বয়স? মাত্র ১৩ বছর। একটা বাড়িতে চাকরি করে সে। রাখাল বালকের কাজ। দিনভর খাটতে হয়। সকালবেলা ছাগলগুলোর দুধ দোহানোর কাজে সহায়তা করতে হয় তাকে। তারপর ওদের দূরের পাহাড়ের ঢালে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব। সেখানে দিনভর ছাগলগুলো চরে বেড়ায়। ঘাসপাতা খায়। সন্ধ্যা হওয়ার আগে আগেই ছাগল নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে জনি। রাতে আবার ছাগলের দুধ দোহানো হয়। তখনো এই কাজে সহায়তা করে রাখাল বালকটি।
ছাগলগুলো এমনিতে বেশ ভালো। জনির কথা মেনে চলে। সাধারণত উল্টাপাল্টা কিছু করে না। কিন্তু একদিন বিগড়ে গেল ওরা। সে এক বিরাট ঝামেলা। তা নিয়ে কত যে কাণ্ড! কত কেচ্ছা কেলেঙ্কারি! জনির তো মাথায় হাত। এত বড় সমস্যায় কখনোই পড়েনি সে। ছাগলগুলো হঠাৎই কেমন যেন বেয়াড়াপনা শুরু করে দিল। কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না ওদের। রাগে–দুঃখে জনির নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।
হয়েছে কি, ওই দিন দাদির শালগমবাগানের দরজাটা ছিল খোলা। কেউ হয়তো দরজাটা সময়মতো বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। তাতেই মহাসমস্যার সূত্রপাত। ছাগলগুলো করল কী, হুড়মুড় করে দৌড়ে ঢুকে গেল দাদির বাগানে। দরজা খোলা পেয়েছে যে। ঢুকেই তারা মহা আনন্দে শালগম বাগান সাবাড় করার কাজে লেগে গেল। জনি এই কাণ্ড দেখে হতবাক! সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন উপায়? দাদির বড় সাধের শালগমের খেত! ছাগলের দল কচমচ করে পাতা চিবাচ্ছে। দল বেঁধে তারা শালগমবাগানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
জনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
এই হতচ্ছড়া ছাগলের দল! বাঁচতে চাইলে শালগমগাছ খাওয়া বন্ধ কর। বাড়ি চল এক্ষুনি। কথা শোন বলছি। না শুনলে বেদম পিটুনি খাবি।
একটা বাঁশের কঞ্চি জোগাড় করে জনি। তারপর তাড়া দিল ছাগলগুলোকে। কোনো লাভই হলো না তাতে। জনিকে পাত্তাই দিল না ছাগলগুলো। পাত্তা দিতে বয়েই গেছে যেন। কঞ্চির পিটুনি দেওয়ার সুযোগই পেল না জনি। ছাগলগুলো এলোপাতাড়ি দৌড়াচ্ছে। নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে লাগল জনি। উহ, কতক্ষণ আর দৌড়ানো যায়। হতচ্ছাড়া ছাগলের দল থেমে নেই। কচকচ করে তারা শালগমের কচি সবুজ পাতা খেয়েই চলেছে, যেন বেহেশতি খাওয়া। খাওয়ার ধুম পড়ে গেছে। মুখ চলছে সমানে। বিশাল বাগান। মনে হচ্ছে, প্রতিটি গাছ সাবাড় না করা পর্যন্ত থামবে না ওরা। ভাব–লক্ষণ সে রকমই মনে হচ্ছে। জনি হতাশ। উদ্ভ্রান্ত। দস্যি ছাগলগুলোর সঙ্গে পেরে উঠছে না সে। ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে তাই। বিলাপ করে কাঁদতে থাকে সে। ওই সময় ওখান দিয়ে যাচ্ছিল একটা শিয়াল। কী ভেবে থমকে দাঁড়ায় প্রাণীটি। জনিকে জিজ্ঞেস করে,
কাঁদছ কেন বাছা? কী, হয়েছে কী তোমার?
জনি ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দেয়,
আর বোলো না ভাই। শয়তান ছাগলগুলোকে নিয়ে আর পারছি না। এক একটা যা ত্যাঁদড় হয়েছে না। দাদি আম্মার শালগমের বাগান ওরা উজাড় করে ফেলছে। কিছুতেই থামাতে পারছি না। অপমানে, রাগে, দুঃখে তাই কাঁদছি।
শিয়াল বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে,
ও আচ্ছা, এই ব্যাপার? তুমি বাছা এখানটায় চুপ করে বসে থাকো। আমি দেখছি, কদ্দুর কী করা যায়। ছাগল তাড়ানোর ভারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। বাগান থেকে ওদের হটিয়ে দিচ্ছি।
শিয়াল কাজে নেমে পড়ে। হক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া ডাক ছেড়ে ছাগল তাড়ানোর চেষ্টা শুরু করল সে। হৈ হৈ করে ছাগলের দল তাড়া করে বেড়ায় সে। দুষ্টু ছাগলগুলো তাড়া খেয়ে বাগানেই ছোটাছুটি করতে থাকে। শিয়াল তাদের নাগাল পায় না। ঘণ্টাখানেক শিয়ালে-ছাগলে হুটোপুটি চলল। শেষ পর্যন্ত বিফল হলো অভিযান। শিয়াল ক্লান্ত হয়ে পড়ল একপর্যায়ে। আর পারা যাচ্ছে না। যথেষ্ট দৌড়াদৌড়ি হয়েছে। ভাবছে সে, দু–দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যাক। চার পা, গোটা শরীর ব্যথা করেছে। এত জোরে কখনোই দৌড়ায়নি। তাই ক্লান্তিটা বেশি। ঝিমঝিম করছে মাথা। ব্যাপারটা যে অত কঠিন হবে, তা আগে আন্দাজ করা যায়নি।
জনি সব খেয়াল করল। শিয়াল ছাগলগুলোকে বশ করতে পারেনি। জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে বেচারি। এদিকে জনির ফোঁপানি থামেনি একটুও। ক্লান্ত–শ্রান্ত শিয়াল একপর্যায়ে জনির পাশে এসে বসে। নিজেও কান্না শুরু করে দেয়।
খানিক পর ওখানটায় এক কুকুরের আগমন। শিয়ালকে শুধায় সে—
কেন তোমরা কাঁদছ? ইশ, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছ দেখছি। কী হয়েছে, আমাকে একটু বলবে?
শিয়াল হুক্কা হুয়া বলে বিলাপ করে কেঁদে ওঠে। বলে—
আমি কাঁদছি, কারণ জনি কাঁদছে। ওর দুঃখে আমি সমব্যথী। জনি কাঁদছে, কারণ সে বদমাশ ছাগলগুলো তাড়াতে পারেনি। দাদির সাধের শালবাগান ওদের দ্বারা তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও ছাগলগুলোকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। মনের দুঃখে তাই কাঁদছি।
কুকুর কী যেন একটু চিন্তা করে। তারপর সবজান্তার মতো বলে,
ঘেউ ঘেউ। আমার মনে হয়, এই সমস্যাটার সমাধান আমি করতে পারব। এ নিয়ে তোমরা একটুও ভেবো না। চুপটি করে বসো। দ্যাখোই না কী করি।
কুকুর দৌড়াতে শুরু করল ছাগলের পালের পেছন পেছন। ছাগলগুলোও তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে থাকে। লাফানো না শুধু, রীতিমতো দৌড়ানো। শুরু হয় কুকুর-শিয়ালে দৌড়াদৌড়ির খেলা।
জোরেশোরে ছুটতে পারার জন্য কুকুরের সুনাম আছে। ছোট-বড় সক্কলেই জানে সেটা। কুকুর কিন্তু এই দফায় ফেল মেরে গেল। পারল না কিছু করতে। ছাগলগুলো এমন জোরে জোরে দৌড়াল যে কারও নাগালই পাওয়া গেল না।
কুকুর হতাশ, পরাজিত। বেজার মুখে রণে ভঙ্গ দেয় সে। অপমানের জ্বালায় মুখটা তার কাঁদো কাঁদো। শিয়াল ও জনির সঙ্গে সেও এসে যোগ দিল। শুরু করে দিল কান্নাকাটি। এখন ওরা তিনজন। সবাই মিলে কাঁদছে।
এমন সময় দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল এক খরগোশ। তিনজনার মিলিত কান্নার শব্দ সে শুনতে পেয়েছে অনেক দূর থেকে। কৌতূহল মেটাতে তাই চলে এসেছে ঘটনাস্থলে। এসে দ্যাখে অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড! বিচিত্র ব্যাপার। খরগোশ তার লম্বা দুটি কান খাড়া করে। সবার মিলিত কান্না মন দিয়ে শোনে। পিটপিট করে তাকিয়ে দ্যাখে, মড়াকান্না কাঁদছে তিনজনা। সে কৌতূহলী মুখ করে জানতে চায়—
বলি, এত কান্নাকাটির কী হয়েছে বাপুরা? কী এমন ঘটনা ঘটেছে যে এমন করে এতিমের মতো কাঁদতে হবে? তোমাদের আপনজন কেউ মারাটারা গেছে নাকি?
কুকুর ও শিয়াল কাতরকণ্ঠে জানায়,
জনি কাঁদছে বলে আমরাও কাঁদছি। জনি একটা মহাবিপদের মধ্যে আছে। দাদির শালগমের বাগান সাফ করে ফেলছে দস্যি ছাগলের দল। ও সেটা থামাতে পারেনি। বাড়ি ফিরলে বকাঝকা খেতে হবে। এমনকি মারধরও জুটতে পারে। তাই সে দিশেহারা হয়ে কান্নাকাটি করছিল। আমরাও ছাগল তাড়ানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সুবিধা করতে পারিনি। তাই আমরাও কাঁদছি।
খরগোশ এ কথা শুনে একটু গম্ভীর হয়ে যায়। মাথা চুলকে বলে—
ও আচ্ছা আচ্ছা। ব্যাপার তাহলে এই। আমি ভেবেছিলাম, কি–না–কি। ঠিক আছে, আমিও একটু চেষ্টা করে দেখি না কেন। আমাকে একটা সুযোগ দাও দিকি। কিছু যদি করা যায়। না পারলে আমিও তোমাদের সঙ্গে কান্নাকাটি করব। তোমাদের একজন সঙ্গী বাড়বে তাহলে।
সবাই ওর কথায় সায় দেয়। সমস্বরে বলে—
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই করো ভাই। এক্ষুনি যাও, কাজে লেগে পড়ো। ধাড়ি ছাগলগুলোকে আচ্ছামতো শাসানি দাও। ওদের ঠেঙাতে পারলে আমরা খুশি হব। তখন আমরা শান্তি পাব। সবার কান্নাকাটি তখন বন্ধ হয়ে যাবে। যে যার কাজে চলে যেতে পারব তখন।
খরগোশ তার গুরুত্ব ও মর্যাদা বুঝতে পেরে মনে মনে পুলকিত হয়। চোখেমুখে নকল এক রকমের গাম্ভীর্য এনে বলে—
বেশ তো। দেখিই না, পাজিগুলোকে সামলানো যায় কি না। সব কটিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেব শালগমের বাগান থেকে। তারপর আমরা সবাই মিলে ফুর্তি করব।
খরগোশ দেরি করে না এক মিনিটও। তক্ষুনি কাজে লেগে পড়ল। কিন্তু ছাগলগুলো মহা ধড়িবাজ। পুঁচকে একটা খরগোশকে তারা মানতে যাবে কোন দুঃখে? তাই থোড়াই কেয়ার করে। উল্টো খরগোশকে শিং দিয়ে গুঁতো মারে।
তারপর কী হলো? যা হওয়ার তা-ই হয়। খরগোশও ব্যর্থ হয় যথারীতি। সে খানিকটা আহত পর্যন্ত হয়েছে। শিংয়ের গুঁতো জীবনে আগে কখনো খায়নি। ছাগল তাড়ানোর কাজ সহজ না। নিতান্ত অনিচ্ছায় ক্ষান্ত দিতে হলো তাকে। না দিয়ে উপায়ও ছিল না। বাপ রে বাপ! এই অভিযানে যা মেহনত। রীতিমতো ঘেমে গেছে সে। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁ ক্লান্ত এখন। ছাগলগুলো বড্ড বেহায়া। তাদের কোনো ভাবান্তর নেই। শালগমবাগানের বারোটা বাজানোর কাজ চলতেই থাকে আগেকার মতো।
খরগোশ আর কী করে! অগত্যা সেও গিয়ে শামিল হলো ওই ছিঁচকাঁদুনে দলের সঙ্গে। কান্নাকাটি করা ছাড়া তারা করবেই–বা কী! তার ধারণাই ছিল না যে ছাগল তাড়ানোর কাজে এত ঝক্কি। এত ঝামেলা। গুঁতোও খেতে হয়!
২
সম্মিলিত কান্নাকাটি চলতে থাকে। ছাগল তাড়াতে গিয়ে সবাই বিফল হয়েছে। লজ্জায়, অপমানে, রাগে তারা কাঁদছে। এই সময় হঠাৎ কোত্থেকে যেন ভোঁ ভোঁ করে উড়তে উড়তে একটা পিচ্চি মৌমাছি এসে হাজির হয়। জনি, শিয়াল, কুকুর ও খরগোশের চারপাশ দিয়ে কয়েক চক্কর পাক খায় সে। একসঙ্গে এতজনকে কখনো কাঁদতে দেখেনি মৌমাছি। খুবই অবাক ব্যাপার। কী হয়েছে এখানে? ওরা কেন এমন সর্বহারার মতো কাঁদছে? বিষয়টা জানা দরকার।
জানবার জন্যই ওড়াউড়ি বন্ধ করে থামল সে। থেমেই প্রশ্ন করে কাঁদুনে পার্টিকে,
কী ব্যাপার? সবাই মিলে এমন বিলাপ করে কাঁদছ কেন? ঘটেছে কী? আমাকে একটু খুলে বলো না।
মৌমাছির মতো পুঁচকে একটা প্রাণী কী আর করতে পারে? তার দৌড় কতদূর পর্যন্ত? এমনটা ভেবে কেউই তার কথার জবাব দেয় না। জবাব দেওয়া যে আসলেই দরকার, সেটাও মাথায় আসে না কারোই।
মৌমাছি আবার তাড়া দেয়—
কী ব্যাপার? তোমরা কেউই আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না যে? কী হয়েছে একটু বলবে তো। হয়তো আমি তোমাদের কোনো কাজে লাগতেও পারি।
খরগোশ বেজার মুখে বলে—
ভাই রে, ঘটনা যা ঘটে গেছে এবং ঘটছে, তা বড়ই গুরুতর। তোমাকে বলে আর কী হবে? তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। সুতরাং বলে কোনো ফায়দা নেই। নিজের কাজে যাও বাছা, যেমনটা যাচ্ছিলে।
মৌমাছি গোঁ ধরে—
না না। নিজের কাজে আমি যাব, তবে একটু পরে। এখানে কী ঘটেছে, তা আমাকে বলতেই হবে। বলেই দ্যাখো না বাপু। শেষমেশ হয়তো তোমাদেরই লাভ হবে। আমাকে অত ফালতু আর অকাজের ভেবো না। ছোট হলেও কোনো কোনো ব্যাপারে আমার ক্ষমতা, ক্ষমতা অনেক। একটা পরীক্ষা নিয়েই দ্যাখো না কেন!
শিয়াল দোনোমোনো করে বলে—
আচ্ছা বেশ। শোনো তাহলে। সব কথা তোমাকে খুলে বলছি। শুনলেও তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। আমরা এতগুলো প্রাণী যে কাজটা পারিনি, তুমি পারবে কেমন করে?
মৌমাছি সবটা শুনে মন্তব্য করে—
এটা তেমন কোনো সমস্যাই না। মাত্র ১০ মিনিটের ব্যাপার। এর চেয়ে বেশি লাগবে না। এই সামান্যটুকু সময় তোমরা আমাকে দাও। সময়টা দিয়ে চুপচাপ বসে বসে মজা দেখো। সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি। তোমরা শুধু চেয়ে চেয়ে কীভাবে কী ঘটে, সেটা প্রাণভরে দ্যাখো। কাজ সমাধা হয়ে গেলে তোমরা অবশ্যই অবাক হবে। তারপর বলবে যে খুদে এই মৌমাছি নির্ঘাৎ ম্যাজিক জানে। না হলে এমন কঠিন একটা কাজ এত তাড়াতাড়ি এত সহজে ও কীভাবে করে ফেলল?
সহজে ও কীভাবে করে ফেলল?
মৌমাছি এক সেকেন্ডও দেরি করে না। কাজ শুরু করে দেয় ঝটপট।
কাজ অতটা জটিল নয়। কীভাবে কী করতে হবে, সে কৌশল বেশ ভালোমতোই জানা আছে তার। সে সোজা উড়ে যায় ছাগলের পালের যে দলনেতা, সেই ধাড়ি ছাগলটার কাছে। তার কানে ঢুকে পট করে হুল ফুটিয়ে দেয়। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে ধাড়ি ছাগল। মহা আতঙ্কিত হয়ে এলোপাতাড়ি লাফঝাঁপ করতে থাকে।
মৌমাছি কিন্তু ছাগলের কানের ভেতরেই বসে আছে। ভোঁ ভোঁ শব্দ করছে। বুড়ো ছাগলটা অবাঞ্ছিত এই উত্পাত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ মাথা ঝাঁকাচ্ছে। কিন্তু কিসের কী? মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই কোনো।
মৌমাছি এখন দ্বিতীয়বার হুল ফোটায়। ধাড়ি ছাগল মরণ চিত্কার দিয়ে হাত-পা ছুড়তে থাকে। মৌমাছি তখন অন্য কানে উড়ে গিয়ে হুল ফোটায়। ধাড়ি ছাগলের লাফানির চোটে দলের অন্য সব ছাগল হতভম্ব। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। ব্যাপার কী? মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। দলপতি ছাগল প্রাণ বাঁচাতে পড়ি মরি করে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। শালগমের বাগান পড়ে থাকে পেছনে। দলনেতা ঠিক করে, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। যতসব ঝামেলার উত্পত্তি এখানেই। মৌমাছি একের পর এক অন্যান্য ছাগলের কানেও হুল ফোটাতে থাকে। সব্বাই ছটফট করতে করতে বাগান ছেড়ে বেরোয়। অল্প দূরে একটা পুকুর আছে। সব ছাগল গিয়ে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাগান যখন একেবারেই ছাগল-শূন্য হয়ে পড়ে, মৌমাছির অভিযান শেষ হয় তখন। তার মুখে ফুটে ওঠে বিজয়ীর গর্বিত হাসি। এমন আনন্দ সে জীবনে আর কখনো পায়নি।
জনি এখন মহাখুশি। ছোট্ট মৌমাছির দারুণ কাজের তারিফ করে মুক্ত কণ্ঠে,
অজস্র ধন্যবাদ তোমাকে, প্রিয় মৌমাছি। আজ তুমি যা করে দেখালে, তার কোনো তুলনাই নেই। আমরা অবাক হয়েছি তোমার নৈপুণ্য দেখে। যেন ম্যাজিকই দেখালে। তোমার উপকার আমরা কোনো দিন ভুলব না। তোমার ওপর আমরা প্রথমটায় আস্থা রাখতে পারিনি। সে জন্য আমাদের দোষ ধরো না। নিজগুণে মাপ করে দিয়ো ভাই। আজ থেকে তুমি আমাদের বন্ধু হলে। পরম বন্ধু। মহাবিপদ থেকে তুমি আমাদের উদ্ধার করেছ। সেই ঋণ শোধ করার ক্ষমতা ও সাধ্য আমাদের কারোরই নেই।
শিয়াল, কুকুর, খরগোশও অনেক অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানায় ছোট্ট মৌমাছিকে। যে কাজটা তারা নিজেরা শত চেষ্টা করেও করতে পারেনি, এতটুকু ছোট্ট প্রাণীটি সেটা খুব সহজেই করে ফেলেছে। সত্যি, মৌমাছি একটা বাপের ব্যাটা। ওর এই ক্ষমতার কোনো নজির গোটা দুনিয়ায়ই বোধ করি নেই। প্রশংসা শুনে মৌমাছিও মহাখুশি। শুধু প্রশংসাই নয়, সবাই তার বন্ধু হয়ে গেছে এখন। সেটা বাড়তি পাওনা। আনন্দিত মনে ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে সে চলে যায় নিজের কাজে।
ভাষান্তর: হাসান হাফিজ
Post a Comment