পুফি (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ

পুফি (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ

পুফি | মিসির আলি || Pufi by Humayun Ahmed

উৎসর্গ

নিষাদ তার নানাজানিকে ডাকে মহারাজ। মহারাজ বিড়াল দুচক্ষে দেখতে পারেন না। তার ফ্ল্যাটে পুফি নামে একটা বিড়াল ছিল তাকে তিনি অঞ্চল ছাড়া করেছেন। লাভ হয়নি, অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে বিড়াল তাঁর ঘরে ঢুকে। কেমন করে জানি তাকিয়ে থাকে।

বিড়াল বিদ্বেষী মহারাজা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী
শ্ৰদ্ধাভাজনেষু

ভূমিকা

শুরুতেই সাবধানবাণী, এটি কোনো শিশুতোষ বই না। পুফি নামের কারণে অভিভাবকরা অবশ্যই বিভ্ৰান্ত হয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের এই বই কিনে দেবেন না। পুফিতে এমন সব বিষয়ের অবতারনা করেছি যা থেকে শিশু কিশোরদের একশ হাত দূরে থাকা প্রয়োজন।

ব্যাখ্যার অতীত জগৎ আমার অতি প্রিয় বিষয়। পুফিকে নিয়ে ব্যাখ্যার অতীত গল্পই লিখতে চেষ্টা করেছি। আমার নিজের মাঝে মাঝে মনে হয়। আমরা যে জগতে বাস করছি সেটাইতো ব্যাখ্যার অতীত। বাইরে থেকে পুফি আনার প্রয়োজন কি? কথাটা ভুল না।

হুমায়ূন আহমেদ
দখিন হাওয়া।

আবুল কাশেম জোয়ার্দার

০১.

আবুল কাশেম জোয়ার্দার কোনো পশু-পাখি পছন্দ করেন না। ছোটবেলায় তাঁর বয়স যখন তিন, তখন এক ছাদে বসে পাউরুটি খাচ্ছিলেন। কথা নাইবার্তা নাই দুটো দাঁড়কাক তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা বসল। তার মাথায়, অন্যটা পাউরুটি নিয়ে উড়ে গেল। কাক শিশুদের ভয় পায় না। জোয়ার্দার চিৎকার করে অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত দাড়কাকটা গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথায় বসেই রইল। দুটা ঠোকর দিয়ে মাথা জখম করে দিলো। পাখি অপছন্দ করার জোয়ার্দার সাহেবের এটিই হলো শানে নজুল।

পশু অপছন্দ করার পেছনে কুচকুচে কালো রঙের একটা পাগলা কুকুরের ভূমিকা আছে। জোয়ার্দার তখন ক্লাস ফোরে পড়েন। স্কুল ছুটি হয়েছে, সবাই বাড়ি ফিরছে, হঠাৎ পাগলা কুকুরটা ছুটে এসে তাকে কামড়ে ধরল। সব ছাত্র দৌড়ে পালাল, শুধু একজন তাকে রক্ষা করার জন্য ছুটে এল। তার নাম জামাল, সে পড়ে ক্লাস ফাইভে। জামাল তার বই নিয়ে কুকুরের মাথায় বাড়ি দিতে লাগল। কুকুরটা তাকেও কামড়াল। জোয়ার্দার সাহেবের বাবা ছেলের নাভিতে সাতটা ইনজেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

জামালের কৃষক বাবার সেই সমৰ্থ্য ছিল না। তিনি ছেলের জন্য চাল পড়ার ব্যবস্থা করলেন। নবীনগরের পীর সাহেবের পানি পড়া খাওয়ালেন। পাগলা কুকুরের কিছু লোম তাবিজে ভরে জামালের গলায় বুলিয়ে দেওয়া হলো। চাল পড়া, পানি পড়া এবং তাবিজে কাজ হলো না। জামাল মারা গোল জলাতঙ্কে। শেষ পর্যায়ে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সে কুকুরের মতোই ঘড়ঘড় শব্দ করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলতে তুলতে মারা গেল।

জামালের মৃত্যুতে জোয়ার্দার সাহেবের মানসিক কিছু সমস্যা মনে হয় হয়েছে। বাড়িতে যখন কেউ থাকে না, তখন তিনি জামালকে চোখের সামনে দেখতে পান। জামাল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়, অনিকার খেলনা নিয়ে খেলে।

জোয়ার্দার সাহেবের বয়স বেড়েছে, জামালের বাড়েনি। মৃত্যু আশ্চর্য ব্যাপার। মানুষের বয়স আটকে দেয়।

অনিকা জোয়ার্দার সাহেবের একমাত্র মেয়ে। সে এবার ফাইভে উঠেছে। পড়াশোনায় সে অত্যন্ত ভালো। সে যে ইংরেজি স্কুলে পড়ে, তার প্রিন্সিপাল জোয়ার্দার সাহেবকে ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে লেখা We are proud to have your daught in our school…

জোয়ার্দার তার মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসেন। ভালবাসা প্ৰকাশ করতে পারে না। লজ্জা লজ্জা লাগে। জোয়ার্দার তা সঙ্গে গল্প করতে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করেন। অস্বস্তি বোধ করার সংগত কারণ আছে। মেয়ের কোনো প্রশ্নের জবাবই তিনি দিতে পারেন না। ছুটির দিনগুলো জোয়ার্দার সাহেবের দুঃশ্চিন্তায় কাটে। এই তা মেয়ে তাঁর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার করে। অনিল তখন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে। তিনি শুকনো মুখ করে বসে থাকেন। মাঝেমধ্যে স্ত্রীর দিকে তাকান। তাঁর স্ত্রী সুলতানা মেয়েকে ধমক দেন, খাওয়ার সময় এত কথা কিসের?

ধমকে কাজ হয় না। অনিকার ধারাবাহিক প্রশ্ন চলতেই থাকে। কিছু প্রশ্নের নমুনা।

বিদ্যুৎ চমকের সময় কী হয়, জান বাবা?

না তো।

ইলেক্টিক্যাল এনার্জি তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায় লাইট এনার্জি, সাউন্ড এবং হিট এনার্জি।

ভালো তো।

রিইনফোর্সড কংক্রিট করে বলে, জানো?

না।

সব বড় বড় বিল্ডিং রিইনফোর্স কংক্রিটে বানানো।

ও, আচ্ছা।

কংক্রিট কী জানো?

হুঁ।

বল তো কী?

ভাত খাওয়ার সময় এত কথা বলা ঠিক না।

ঠিক না কেন?

এতে হজমের সমস্যা হয়।

খাবার হজম করার জন্য আমাদের পাকস্থলীতে দুরকমের এসিড বের হয়। এদের নাম বলতে পারবে?

জোয়ার্দার সাহেবকে হতাশ গলায় বলতে হয়, না।

অনিকার ছনম্বর জন্মদিনে জোয়ার্দার ধাক্কার মতো খেলেন। তাঁর মেয়ে একটা বিড়ালের বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়ালের বাচ্চা কুচকুচে কালো। শুধু লেজটা শাদা। বিড়ালের মাথায় শাদা স্পট আছে!

বিড়াল কোলে অনিককে দেখে মনে হচ্ছে, এ মুহূর্তে তার মতো সুখী বালিকা কেউ নেই। সে বিড়ালের গালের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করছে।

বাবা, এর নাম পুফি। আমি জন্মদিনে গিফট পেয়েছি; বল তো বাবা, কে দিয়েছে?

জানি না।

ছোট মামা দিয়েছে।

জোয়ার্দার বিরক্ত গলায় বললেন, একে নিয়ে ছানাছানি করার কিছু নেই।

না কোন বাবা?

বিড়াল নানান ডিজিজ ছড়ায়।

অনিক বলল, বিড়াল কোনো ডিজিজ ছড়ায় না। বাবা। পশু ডাক্তার পুফিকে ইনজেকশন দিয়েছেন। তার নখ ছোট মামা নেইল কাটার দিয়ে কেটে দিয়েছে।

আজ মেয়ের জন্মদিন। কঠিন কোনো কথা বলা ঠিক না। জোয়ার্দার বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দাটা সুন্দর। চিকের পর্দা দিয়ে আলাদা করা। সুলতানা চারটা মানিপ্ল্যান্টের গাছ লাগিয়েছে। গাছগুলো বড় হয়ে গ্রিল বেয়ে উঠেছে। চিকের পর্দা না থাকলেও এখন চলে। তার পরও পর্দা খোলা হয়নি।

বারান্দাটা জোয়াদারের সিগারেট কর্নার। সারা দিনে গুনে গুনে তিনি পাঁচটা সিগারেট খান। কয় নম্বর সিগারেট কখন খাবেন, সব হিসাব করা। চতুর্থ সিগারেট সন্ধ্যা মিলাবার পর ধরাবার কথা। সন্ধ্যা মিলাতে এখনো অনেক বাকি। তার পরও জোয়ার্দার সিগারেট ধরালেন। বিড়ালের বাচ্চা তার মেজাজ নষ্ট করে দিয়েছে।

সুলতানা বারান্দায় ঢুকে বললেন, মুখ ভোঁতা করে এখানে বসে আছ কেন?

জোয়ার্দার স্ত্রীর কথার জবাব দিলেন না। সুলতানা বললেন, তুমি ড্রেস বদলাও, পায়জামা পাঞ্জাবী ইস্ত্রী করে রেখেছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।

দেরি হয়ে যাচ্ছে, মানে কী?

তুমি ভুলে গেছি? আনিকার জন্মদিনে রঞ্জু পার্টি দিচ্ছে। কেক আসবে সোনারগা হোটেল থেকে। খাবার আসবেত্ত্ব ঢাকা ক্লাব থেকে। একজন ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাবেন যাদুকর শাহীন না কি যেন নাম।

জোয়ার্দার বললেন, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। মনে হয়। জ্বর আসছে। সুলতানা স্বামীর কপালে হাত দিয়ে বললেন, জ্বরের বংশও নাই। তারপরেও মনের শান্তির জন্য একটা প্যারাসিটামল খাও।

জোয়ার্দার বললেন, প্যারাসিটামল আমি খাব, কিন্তু রঞ্জুর বাড়িতে যাব না। তাকে আমি পছন্দ করি না। এ কথা তোমাকে আগেও কয়েকবার বলেছি। আজ আবার বললাম।

সুলতানা কঠিন মুখ করে জোয়ার্দারের সামনে বসতে বসতে বললেন, কোন পছন্দ কর না?

কোনো কারণ ছাড়াই পছন্দ করি না। মানুষের পছন্দ অপছন্দের সব সময় কারণ লাগে না। তোমাকে আমি বলেছি কোনো কারণ ছাড়াই আমি বিড়াল অপছন্দ করি।

তুমি মেয়ের জন্মদিনে যাবে না?

জন্মদিন অন্য কোথাও হলে যাব।

রঞ্জর বাড়িতে যাবে না?

না।

বাসার সবাই কিন্তু যাচ্ছে। কাজের মেয়ে দুটাও যাচ্ছে।

যাক। আর শোনো, বিড়ালটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ওই বাড়িতে রেখে আসবে। তুমি জানো, জন্তু জানোয়ার আমি পছন্দ করি না।

তুমি কি মেয়ের জন্য কোনো গিফট কিনেছ?

না, ভুলে গেছি।

একজন কিন্তু মনে রেখেছে। বিশাল আয়োজন করেছে।

করুক। বিড়াল অবশ্যই রেখে আসবে। তার বাড়িতেই রেখে আসবে।

আমাকে বলছ কেন? তোমার মেয়েকে বলো। সেই সাহস তো নেই। কঠিন গলায় আমার সঙ্গে কথা বলবে, রঞ্জর সঙ্গে কথা বলবে মিনমিন করে আর মেয়ের সামনে তো ভিজা বেড়াল।

সবাই জন্মদিনে চলে যাওয়ার পর জোয়ার্দার লক্ষ্য করলেন, ওরা বিড়াল রেখে গেছে। বিড়াল সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন বহুকাল ধরে সে এখানেই বাস করে, সবকিছু তার চেনা। একবার লাফ দিয়ে টিভি সেটের উপর উঠল। সেখান থেকে নেমে সোফায় বসল। সোফা পছন্দ হলো না। সোফা থেকে নেমে মেঝেতে জোয়ার্দারের স্যান্ডেল কামড়া কামড়ি করতে লাগল। তিনি কয়েকবার হেই হেই করলেন পুফি স্যান্ডেল ছাড়ল না। স্যান্ডেল মুখে কামড় দিয়ে ধরে রান্না ঘরে চলে গেল।

জোয়ার্দার বুঝলেন তাঁকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই বিড়াল সুলতানা রেখে গেছে। টেলিফোন করে সুলতানাকে কঠিন কিছু কথা অবশ্যই বলা যায়। জোয়ার্দার তা করলেন না। নিজেই চা বানিয়ে বারান্দায় এসে বসলেন।

বিড়ালটা একটা তেলাপোকা ধরেছে। তেলাপোকা নিয়ে খেলছে। মাঝেমধ্যে ছেড়ে দিচ্ছে। তেলাপোকা প্রাণভয়ে কিছু দূর যাওয়ার পরই বিড়াল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। দৃশ্যটা দেখতে খারাপ লাগছে না। জোয়ার্দার অনুগ্রহ নিয়ে তেলাপোকা এবং বিড়ালের ঘটনা দেখছেন। ইংরেজিতে Cat and mouse game, বাগধারা আছে। কিন্তু বিড়াল তেলাপোকা নিয়ে কিছু নেই। তেলাপোকার ইংরেজি কী? জোয়ার্দার তেলাপোকার ইংরেজি মনে করতে পারলেন না। অনিকাকে জিজ্ঞেস করলেই সে বলে দেবে। মেয়েকে টেলিফোন করবেন, নাকি করবেন না। এ বিষয়ে মনস্থির করতে তার সময় লাগছে। তিনি কোনো সিদ্ধান্তই দ্রুত নিতে পারেন না।

অনিকাই তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝামেলা থেকে মুক্ত করল। সেই টেলিফোন করুল।

চিকন গলায় বলল, হ্যালো বাবা! মা তোমাকে বলতে বলল, টেবিলে তোমার জন্য খাবার ঢাকা দেওয়া আছে।

আচ্ছা।

মাংসটা মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিয়ো।

আচ্ছা। অনিক তেলাপোকার ইংরেজি কী?

তেলাপোকার ইংরেজি তুমি জানো না?

জানতাম, এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

তেলাপোকার ইংরেজি cockroach.

ও, আচ্ছা।

আরেকটা ইংরেজি আছে oil beetle, বাবা, টেলিফোন রাখি? একজন ম্যাজিশিয়ান এসেছেন। তিনি ম্যাজিক দেখাবেন।

মজা হচ্ছে মা?

খুব মজা হচ্ছে। মামা আমাকে একটা সাইকেলও দিয়েছেন। বাবা তুমি আমাকে সাইকেল চালানো শেখাবে।

আচ্ছা।

রাত ৯টায় জোয়ার্দার রাতের খাবার খেয়ে নেন। তিনি শরীরটাকে সুস্থ রাখুন বইয়ে পড়েছেন, দিনারের অন্তত দু ঘণ্টা পরে ঘুমাতে যেতে হয়। বইয়ের নিয়ম মেনে তিনি রাত এগারোটা পর্যন্ত জেগে থাকেন। এগারোটা পর্যন্ত জগতে হবে বলে তিনি প্রতি রাতেই একটা ছবি দেখেন। এগারোটা বাজা মাত্ৰই ডিভিডি প্লেয়ার বন্ধ করে দেন বলে কোনো ছবিরই তিনি শেষটা দেখতে পারেন না। ছবির শেষটা না দেখার সামান্য অতৃপ্তি নিয়ে তিনি ঘুমুতে যান। বালিশে মাথা ঠেকানো মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁর তের বছরের বিবাহিত জীবনে এই রুটিনের তেমন কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।

রাত ৮টা বাজে। বাড়িতে কেউ নেই বলেই মনে হয়, আগেভাগে খিদে লেগেছে। তিনি ঠাণ্ডা খাবার খেতে পারেন না। মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করার বিষয়টাও জানেন না। নানান বোতাম টিপা টিপি করতে হয়। টাইমার সেট করতে হয়। এর চেয়ে ঠাণ্ডা খাবার খাওয়াই ভালো। খাওয়ার টেবিলের কাছে গিয়ে তাকে থমকে দাড়াতে হলো। মাংসের বাটি উপুড় হয়ে আছে। টেবিলে মাংস ছড়ানো ভাতের বাটির ঢাকনা খোলা। প্লেটে মাংসের ঝোলমাখা বিড়ালের পায়ের ছাপ। ডালের বাটিতে মৃত তেলাপোকা ভাসছে। যে তেলাপোকা নিয়ে পুফি খেলছিল তাকেই এনে ডালের বাটিতে ফেলেছে। বদ বিড়ালের এই কান্ড।

জোয়ার্দার ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিয়ে টিভির সামনে বসলেন। ডিভিডির বোতাম চাপতেই ছবি শুরু হলো। মনে হয়, ভূত প্রেতের কোনো ছবি।

কবর খুঁড়ে কফিন বের করা হচ্ছে। গভীর রাত, কবরের পাশে লণ্ঠনের আলো ছাড়া কোনো আলো নেই। কবর খুঁড়ছে রূপবতী তরুণী এক মেয়ে। মেয়েটার মাথার চুল সোনালী।

জোয়ার্দার আগ্রহ নিয়ে ছবি দেখছেন। বিড়ালটাও তার মতো অগ্রহ নিয়ে ছবি দেখছে। সে বসেছে জোয়ার্দারের ডান পায়ের কাছে। ইচ্ছে করলেই প্ৰচণ্ড লাথি মেরে বিড়ালকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। তিনি শাস্তি দিচ্ছেন না। জমা করে রাখছেন। সব শাস্তি একসঙ্গে দেয়া হবে।

সুলতানা ফিরুক, স্বচক্ষে বিড়ালের কীর্তিকলাপ দেখুক, তারপর শাস্তি। শাস্তি হবে দীপান্তর। বস্তায় ভরে দূরে কোথাও নিয়ে ফেলে দিয়ে আসা।

বস্তা-শাস্তির কিছু নিয়ম কানুন আছে। বিড়ালের সঙ্গে গোটা দশেক ন্যাপিথেলিন দিয়ে বস্তার মুখ বন্ধ করতে হয়। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধে বিড়ালের ঘাণশক্তি সাময়িক নষ্ট হয়। তখন তাকে দূরে ফেলে দিয়ে এলে সে আর গন্ধ স্ট্রকে স্ট্রকে ঘরে ফিরতে পারে না।

কলিংবেল বাজছে। জোয়ার্দার উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর সঙ্গে বিড়ালও উঠে দাঁড়াল। গায়ের আড়মোড়া ভাঙিল। হাই তুলল, তারপর ও লাফ দিয়ে টিভি সেটের ওপর বসে পড়ল।

জোয়ার্দার দরজা খুললেন। অনিক বিড়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়ালের গালের সঙ্গে তার গাল লাগানো। এর মানে কী? অনিকা বিড়াল নিয়েই গিয়েছিল? তাহলে টিভির ওপর যে বিড়ালটা বসে আছে, সেটা কো থেকে এসেছে?

জোয়ার্দার দৌড়ে বসার ঘরে এলেন। সেখানে কোনো বিড়াল নেই। তিনি প্রতিটি ঘর খুঁজলেন, বিড়াল নেই।

সুলতানা বললেন, কী খুঁজছ?

কিছু না।

টেবিলে খাবার ছড়িয়েছ কেন?

জোয়ার্দার হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না।

সুলতানা বললেন, কাজটা কি তুমি আমার উপর রাগ করে করলে?

তা-না।

তুমি না যাওয়ায় রঞ্জু বেশ মন খারাপ করেছে। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সে আমাকে একটা শাড়ি দিয়েছে, তোমাকে একটা গরম চাদর দিয়েছে। পছন্দ হয়েছে কি-না দেখি।

পছন্দ হয়েছে।

না দেখেই বললে পছন্দ হয়েছে। গায়ে দিয়ে দেখ।

জোয়ার্দার চাদর গায়ে দিয়ে দরজা খুলে হঠাৎ বের হয়ে গেলেন। এমনও তো হতে পারে বেড়ালটা নিচে আছে। প্রতিটি ফ্ল্যাট বাড়ির গ্যারেজে কিছু বিড়াল থাকে। ড্রাইভারদের ফেলে দেয়া খাবার খেয়ে এরা বড় হয়।

গ্যারেজে কোনো বিড়াল পাওয়া গেল না।

এজি অফিস হলো ঘুষের কারখানা

জোয়ার্দার এজি অফিসে কাজ করেন। তার পোস্টের নাম অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার।

এজি অফিস হলো ঘুষের কারখানা। অর্থমন্ত্রী বা রাজস্ব বোর্ডের প্রধানের নিজের চেক পাস করতে হলেও ঘুষ দিতে হয়। টাকার পরিমাণের ওপর ঘুষের অঙ্ক নির্ধারিত। এজি অফিসের লোকজন অঙ্কে পাকা।

জোয়ার্দার সাহেব এই অফিসে হংস মধ্যে বক যথা, তিনি ঘুষ খান না। একবারই তিনি কিছুক্ষণের জন্যে ঘুষ নিয়েছিলেন- লাল রঙের একটা ফাউনটেনপেন। এই কলমের বিশেষত্ব হচ্ছে, রাতে কলমের গা থেকে আলো বের হয়। ঘরে বাতি না থাকলেও এই কলম দিয়ে লেখা যায়। অনিক এমন একটা কলম পেলে আনন্দে লাফালাফি করবে ভেবেই তিনি সহকমীর কাছে থেকে কলামটা নিলেন। সহকমীর নাম খালেক। সে বলল, স্যার, ফাইলটা রেখে গেলাম পাস করে দেবেন। পাটি ঝামেলায় আছে।

বিকেল ৪টা ২১ মিনিট পর্যন্ত ঝামেলায় পড়া পার্টির ফাইল হাতে নিয়ে বসে রইলেন। দুপুরে লাঞ্চ খেলেন না। বিকেল ৪টা ২৬ মিনিটে তিনি খালেককে ফাইল এবং কলম ফেরত দিলেন।

খালেক বলল, স্যার! আপনি আজিব মানুষ। কলামটা আপনি রেখে দেন, ফাইলে সই করার দরকার নাই। আমি অন্য ব্যবস্থা করব।

জোয়ার্দার বললেন, না।

খালেক নিজের মনে আবারও বলল, আজিব আদমি।

জোয়ার্দারকে আজব মানুষ ভাবার কোনো কারণ নেই। তাঁর চরিত্রে অদ্ভুত কিছু নেই। অফিস থেকে বেইলি রোডের বাসায় ফেরেন হেঁটে। বাসায় ফিরেই গোসল সেরে বারান্দায় বসে এক কাপ চা খান। চায়ের সঙ্গে দিনেয়। তৃতীয় সিগারেটটি খেতে হয়।

চা নিয়ে সুলতানা আসেন এবং প্রতিদিনের মতো জিজ্ঞেস করেন, চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে? বাসায় দিনাজপুরের চিড়া আছে। চিড়া ভেজে দেব?

তিনি বলেন, না।

মাখন মাখিয়ে টোস্ট বিসকিট দেব?

না।

রাতে কী খাবে?

যা রান্না হবে তাই খাব।

সুলতানা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন (সব দিন না, মাঝে মাঝে), তোমাকে বিয়ে না করে একটা যন্ত্র বিয়ে করলে আমার জীবনটা সুখের হতো। যন্ত্রে একবার চাবি দিয়ে দিলাম। যন্ত্র, তার মতো চলছে। আমাকে কিছু করতে হচ্ছে না।

সুলতানা লম্বা বাক্যালাপের দিকে গেলেই জোয়ার্দার সিগারেট ধরান। কথার পিঠে কথা বলার অভ্যাস জোয়ার্দারের নেই।

সন্ধ্যা মিলিয়েছে। জোয়ার্দার বারান্দায় বসে আছেন। চা এবং সিগারেট শেষ হয়েছে। দুপুরে লাঞ্চ করেননি বলে ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। আজ মনে হয় ৯টার আগেই খেতে হবে। এর মধ্যে রান্না হবে কি না কে জানে।

পুফিকে কোলে নিয়ে অনিকা বারান্দায় ঢুকল। জোয়ার্দারের সামনে বসতে বসতে উজ্জ্বল মুখে বলল, এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে বাবা, শুনলে তুমি চমকে উঠবে।

কী ঘটনা?

পুফি যাতে বাথরুম করতে পারে এই জন্যে আমি একটা প্লাস্টিকের থালায় বালি দিয়ে উত্তর দিকের বারান্দায় রেখেছি। এতেই কাজ হয়েছে। সে এখন তার বাথরুমে বাথরুম করে।

ভালো।

অদ্ভুত ব্যাপার না বাবা?

হুঁ।

আমার কী ধারণা জানো বাবা? আমার ধারণা, বিড়ালদের ভাষা আছে। তারা এ ভাষায় নিজেদের সঙ্গে কথা বলে।

হুঁ।

তুমি শুধু হুঁ হুঁ করছ, কথা বলছ না।

শরীরটা ভালো লাগছে না।

পুফিকে একটু কোলে নেবে? একটু কোলে নাও না, প্লিজ। ও তোমার কোলে যেতে চাচ্ছে। দেখো না, কেমন করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।

জোয়ার্দার দেখলেন বিড়ালটা সত্যি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

বিড়ালটার ডান চোখের ওপর কালো দাগ। তিনি যে বিড়ালটা দেখেছেন তার চোখের ওপর দাগ ছিল কি না। তিনি মনে করতে পারলেন না।

বাবা!

হুঁ।

আজ ক্লাসে খুব লজ্জার একটা ঘটনা ঘটেছে। বলব?

হুঁ।

মাকে বলেছিলাম। মা বলল, এ ধরনের পচা গল্প যেন আমি কখনো না করি। তুমি শুনবে?

তোমার মা যখন নিষেধ করেছে তখন থাক।

আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছে।

তাহলে বলো।

আমাদের ইংরেজি মিস আজ ক্লাসে ঢুকেই শব্দ করেছেন। আমরা সবাই চেষ্টা করেছি না হাসতে। তারপর মিসের করুণ মুখ দেখে হেসে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়েছি।

জোয়ার্দার বললেন, ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। শব্দ করেছেন মানে কী।

খারাপ শব্দ।

জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, শব্দের আবার ভালো খারাপ কী?

অনিকা বলল, বাবা, তুমি এত বোকা কেন? পুফির যত বুদ্ধি আছে তোমার তাও নেই। ম্যাডাম Fart করেছেন।

তার মানে কী?

অনিক বলল, এর মানে কী বলতে পারব না। তোমাকে ডিকশনারি এনে দিচ্ছি। ডিকশনারিতে দেখো।

অনিকা বাবার কোলে ইংরেজী ডিকশনারি দিয়ে গেল। জোয়ারদর্দার ডিকশনারি খুললেন। এই শব্দটা verb হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার Noun হিসাবে ব্যবহার করা হয়। verb হলো To let air from the bowels come out through the anus.

Noun হলো An unpleasant, boring and stupid person. জোয়ার্দারের মনে হলো তিনি এ রকমই একজন। বোরিং এবং স্টুপিড। তিনি পরপর দুবার বললেন, I am a fart. I am a big Fart.

রাতে জোয়ারদার একা খেতে বসলেন। খেতে বসে লক্ষ্য করলেন সবার মধ্যে গোপন একধরনের ব্যস্ততা। জোয়ারদার বললেন, তোমরা খাবে না?

সুলতানা বললেন, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। রঞ্জু আরেকটা নতুন গাড়ি কিনেছে। নাম আলফ্রাড। ৪০ লাখ টাকা দাম।

জোয়ারদার বললেন, ওর নতুন গাড়ি কেনার সঙ্গে তোমাদের না খাওয়ার কী সম্পর্ক?

রঞ্জু গাড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে। গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে।

ও, আচ্ছা।

আমরা কুমিল্লা চলে যাব। রাতে থাকব কুমিল্লা বার্ডে। ভোরবেলা ঢাকা রওনা হব। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে যাবে না।

না।

আমি কাজের মেয়ে দুটিকেও নিয়ে যাচ্ছি। সকাল ৮টা বাজার আগেই ঢাকা ফিরব। তোমার ব্রেকফাস্টের সমস্যা হবে না।

আচ্ছা।

জোয়ার্দার লক্ষ করলেন, কাজের মেয়ে দুটি বিপুল উৎসাহে সাজগোজ করছে। সুলতানা রাত কাটানোর জন্যে বাইরে কোথাও গেলেই কাজের মেয়ে দুটিকে নিয়ে যান।

মেয়ে দুটির বয়স ষোল, সতেরো। দুজন যমজ বোন। আগে নাম ছিল হাবীব, হামিদা। সুলতানা নাম বদলে রেখেছেন, তুহিন—তুষার। এরা সারাক্ষণ সাজগোজ নিয়ে থাকে। মেয়ে দুটি জন্ম থেকেই রূপ নিয়ে এসেছে। সুলতানা ঘষে মেজে এদের প্রায় নায়িকা বানিয়ে ফেলেছেন। লাক্স চ্যানেল আই সুপার ষ্টারে পাঠালে থার্ড বা ফোরথ হয়ে যেতে পারে।

অপরিচিত কেউ এলে সুলতানাকে জিজ্ঞেস করেন, এরা আপনার বোন নাকি?

সুলতানা চাপা আনন্দ নিয়ে বলেন, এই দুটাই আমার কাজের মেয়ে। এই তোরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গেস্টকে চা দিবি না?

গেস্ট খুবই লজ্জা পান। গেস্টদের লজ্জা সুলতানা উপভোগ করেন।

সুলতানা রাতে যখন থাকেন না, তুহিন-তুষারকে রেখে যেতে শঙ্কা বোধ করেন। পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করা আর শকুন বিশ্বাস করা একই। শকুন মারা গরু দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। পুরুষও মেয়েমানুষ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মৃত মেয়ে মানুষ দেখলেও ঝাঁপ দিবে।

রাতের খাবার শেষ করে ছবি দেখতে বসে জোয়ারদার লক্ষ্য করলেন বিড়ালটা তার চেয়ার ঘেঁষে বসে আছে। ওই দিনের সেই বিড়াল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একটা ছোট্ট প্ৰভেদ অবশ্য আছে। অনিকার বিড়ালটার ডান চোখের ওপর শাদা দাগ। এটার বা চোখের ওপর কালো শাদা। এমনকি হতে পারে এই বিড়ালটা অনিকার বিড়ালের যমজ? তুহিন তুষারের মত এরাও যমজ বোন। অনিকার বিড়ালের নাম পুফি। এটার নাম দেওয়া যেতে পারে কুফি।

জোয়ারদার বললেন, এই কুফি। কুফি।

বিড়াল ঘড়ি ঘড়ি শব্দ করল। নাম পছন্দ হয়েছে কী হয়নি বোঝা গেল না।

বিড়াল রহস্য নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। হুটহাট চিন্তায় কাজ হবে না। জোয়ার্দার ছবিতে মন দিলেন। মন বসছে না, তবুও জোর করে তাকিয়ে থাকা। ওয়েস্টার্ন ছবি। বন্দুক পিস্তলের ছড়াছড়ি। অনিকের ঘর থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল! এই শব্দে জোয়ার্দারের শরীর প্রায় জমে গেল। হাসির শব্দ তাঁর পরিচিত। জামালের হাসি। অনেক দিন পর খালি বাড়ি পেয়ে জামাল এসেছে। মাঝখানে অনেক দিন তিনি জামালকে দেখেন। নি। হয়ত আজ আবার দেখলেন।

তিনি এখন কী করবেন? ছবি দেখতে থাকবেন? নাকি উঠে পাশের ঘরে যাবেন?

জোয়ারদার উঠে দাঁড়ালেন।

জামাল বিড়ালটাকে নিয়ে খেলছে। টেনিস বল দূরে ছুড়ে মারছে। বিড়াল মাথা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বলটা জামালের কাছে নিয়ে আসছে। একেকবার বল আনছে আর জামাল বলছে, কুফি ভালো। কুফি ভালো।

এমন কি হতে পারে জামাল যে জগৎ থেকে এসেছে, কুফিও সেই জগৎ থেকে এসেছ? কুফি এ পৃথিবীর কোনো বিড়াল না।

জোয়ারদার কাপা কাপা গলায় বললেন, জামাল।

জামাল ফিরে তাকাল। জোয়ারৰ্দারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার খেলায় মগ্ন হয়ে গেল। জোয়ারদার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ছবি দেখতে গেলেন।

ছবির মূল নায়ককে এখন ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। ছবির মাঝখানে নায়ক ফাঁসিতে ঝুললে বাকি ছবি কিভাবে চলবে কে জানে?

জোয়ারদার ছবিতে পুরোপুরি মন দিতে পারছেন না। জামালের হাসি তাকে বারবার চমকে দিচ্ছে।

এর মধ্যে মোবাইল ফোন বাজছে। সুলতানা ফোন করেছেন। তার গলার স্বরে অপরাধী অপরাধী ভাব।

সুলতানা বলল, এই কী করছ?

ছবি দেখছি।

কী ছবি?

নাম বলতে পারব না। ওয়েস্টার্ন ছবি।

ছবিতে এখন কী দেখাচ্ছে?

বারের দৃশ্য। দুজন মগভর্তি করে বিয়ার খাচ্ছে।

বাচা একটা ছেলের হাসির শব্দ পাচ্ছি। সেও কি বারে?

জোয়ার্দার ইতস্তত করে বললেন, হঁ।

তোমাকে একটা জরুরি বিষয়ে টেলিফোন করেছি। রঞ্জু প্ল্যান চেঞ্জ

করেছে।

ও, আচ্ছা।

রঞ্জু ঠিক করেছে কুমিল্লা যাবে না। সরাসরি কক্সবাজার যাবে। সাইমন হোটেলে বুকিং দিয়ে ফেলেছে। ওযে কেমন পাগল টাইপ তুমিতো জান।

ভালো তো।

সুলতানা বললেন, কয়েক দিন একা থাকতে হবে, তোমার কষ্ট হবে, সরি। আমি রাজি হতাম না। তোমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়েছি। সে যে কী খুশি৷ আমি মনে হয় তোমার ছবি দেখায় ডিসটার্ব করছি।

হুঁ।

তাহলে রাখি?

আচ্ছা।

নিয়মের ব্যতিক্রম করে জোয়ার্দার পুরো ছবি দেখলেন। জামালের হাসির শব্দ এখনো পাওয়া যাচ্ছে। জোয়ার্দার ঘুমুতে গেলেন রাত ১২টায়।

জামাল এখন বিড়াল নিয়ে বিছানায় উঠেছে। খেলার ভঙ্গি পাল্টেছে। জামাল বিড়ালের সামনে কোলবালিশ ধরছে। বিড়াল বালিশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। কোলবালিশ থেকে বের হওয়া তুলা ঘরময় ছড়ানো।

জোয়ার্দার বিরক্ত মুখে বললেন, অন্য ঘরে যাও। আমি এখন ঘুমাব।

জামাল সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে চলে গেল। বিড়ালটা গেল জামালের পেছনে পেছনে।

বিড়াল এবং জামালের বিষয়টা নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলা জরুরী। এটা তার মানসিক রোগ। এইটুকু বুঝার বুদ্ধি তার আছে। মানসিক রোগের কোনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলাই ভাল। তার পরিচিত একজন আছে ডাক্তার শায়লা। সে বেশ বড় ডাক্তার। বিলেত বা আমেরিকা থেকে ডিগ্ৰী নিয়ে এসেছেন। এখন এ্যাপোলো হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান।

শায়লা তার দূর সম্পর্কের বোন।

ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে যখন আই এস সি পড়তো তখন শায়লার জোয়ার্দারের সঙ্গে বিয়ে পাকাপাকি হয়। পানচিনি হয়ে যায়। পানচিনি হবার পরদিন দুজন মিলে ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদীর পাশ দিয়ে পঁচিশ মিনিট হেঁটেছিলেন। শায়লা লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। কোন কথা না পেয়ে তিনি একবার বললেন, তোমার কি মিষ্টি পছন্দ?

নদীর পাড় দিয়ে হাঁটাহাটির পরদিন বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।

জোয়ার্দারের বড় মামা হৈচৈ শুরু করলেন। মেয়ে যার কাছে প্ৰাইভেট পড়ে তার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক। একবার সন্তান খালাস করিয়েছে। তার কাছে প্রমাণ আছে। ইত্যাদি।

জোয়ার্দার নির্বিরোধী ভীরু মানুষ। বিয়ে ভেঙ্গে যাবের পর সে কিন্তু ভাল সাহস দেখালো। সে শায়লার সঙ্গে দেখা করলো এবং বলল, বড় মামা খামাখা হৈচৈ করছেন। এটা তার স্বভাব। তুমি কিছু মনে করো না। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই। তুমি রাজি থাকলে চল কাজি অফিসে যাই বিয়ে করি।

শায়লা কঠিন গলায় বলল, না।

পুরানো দিনের কথা মাথায় রেখে লাভ নেই। শায়লার কাছে যাওয়া যায়। তিনিতো তার প্রেমিকার কাছে যাচ্ছেন না। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন।

ডাক্তারের ওয়েটিং লাউঞ্জ

ডাক্তারের ওয়েটিং লাউঞ্জে খানিকটা লজ্জিত এবং বিব্রত মুখে জোয়ার্দার বসে আছেন। তার কোলে এক প্যাকেট মাতৃভান্ডারের রসমালাই। হাতে সবুজ রঙের কার্ড সেখানে ইংরেজীতে লেখা Please wait.

এর নিচে লেখা 17.

তিনি অপেক্ষা করছেন। হাসপাতাল হচ্ছে মশা মাছি মুক্ত এলাকা। কিন্তু তার রসমালাইয়ের প্যাকেটের উপর স্বাস্থ্যবান দুটা নীল মাছি উড়াউড়ি করছে। রুগীদের কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে।

রসমালাই সঙ্গে করে আনা মস্ত বোকামী হয়েছে। তিনি সৌজন্য সাক্ষাতে আসেন নি। ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর রোগ নিয়ে পরামর্শ করতে এসেছেন।

ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট জোয়ার্দারের দিকে তাকিয়ে বলল, রেডি হয়ে যান। নেক্সট আপনি।

জোয়ার্দার ভেবে পেলেন না রেডি হবার মানে কি। উঠে দাড়াতে হবে। দরজার সামনে যেতে হবে?

ভিজিটের টাকা দিন। পনেরোশ টাকা। হাইট আর ওজন মাপুন। ব্লাড পেশার মাপুন।

হাতে কি?

মিষ্টির প্যাকেট।

মিষ্টির প্যাকেট টেবিলে রেখে ওজন মাপুন। মিষ্টির প্যাকেট কার জন্যে?

ডাক্তারের জন্যে। আপনারাও খাবেন।

এসিসটেন্ট মুখ বিকৃত করে বলল, ডাক্তারের জন্যে আনবেন ভিজিট। মিষ্টি লাউ কুমড়া এইসব না।

জ্বি আচ্ছা।

এখন ঢুকে পড়ুন।

ডাক্তারের ঘরগুলি আলো ঝলমলে হয়। রুগীর চোখ মুখ দেখতে হয়।

জিভ দেখতে হয়। অল্প আলোয় সম্ভব না। সাইকিয়াট্রিষ্টের ঘর বলেই হয়তো আলো কম। ডাক্তারী টেবিলের ওপাশে শায়লা বসে আছে। মানুষের চেহারায় বয়সের ছাপা পড়ে। জোয়ার্দার অবাক হয়ে দেখলেন শায়লার চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ পড়ে নি। আগে রোগা পটকা ছিল এখন স্বাস্থ্যু ভাল হয়েছে। গায়ের চামড়া উজ্জ্বল হয়েছে। রঙিন স্কার্কে শায়লার মাথার চুল পেছন দিক থেকে বাধা। তাকে খানিকটা ইরানি মেয়ের মতো লাগছে। ডাক্তার শায়লা বললেন, আপনার নাম জোয়ার্দার?

জ্বি।

কি প্রবলেম নিয়ে এসেছেন বলুন। গুছিয়ে বলার চেষ্টা করুন কিছু যেন বাদ না পড়ে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমাদের যখন গুছিয়ে কথা বলা দরকার তখন টেলিগ্রাফের ভাষায় কথা বলি। আর যখন সারা সংক্ষেপ বলা দরকার তখন পাঁচ শ, পৃষ্ঠার উপন্যাস শুরু করি। আপনি কিছু মনে করবেন। না। আমার ধুমপান করার অভ্যাস আছে। আমি সিগারেট টানতে টানতে আপনার কথা শুনিব। আপনার কোনো সমস্যা আছে?

জ্বি না।

জোয়ার্দারের বুক থেকে পাথর নেমে গেছে শায়লা তাকে চিনতে পারে নি। চিনতে না পারারই কথা। অল্প বয়সেই তার চুল পেকেছে। মাথায় টাক পড়েছে।

শায়লা সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন, চুপ করে আছেন কেন? সমস্যা বলুন।

আমার ঘরে একটা বিড়াল ঢুকে।

সমস্যা এই না। আরো আছে?

এইটাই সমস্যা।

ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন?

জ্বি।

একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে বিড়াল ঢুকা সমস্যা হবে কেন? এরা খাদ্যের সন্ধানে ঢুকবে। আরামের সন্ধানেও ঢুকবে। বিড়াল আরাম পছন্দ করে। সে কি মাঝে মধ্যে আপনার পাশে আরাম করে শুয়ে হাই তুলে?

জ্বি।

যখন টিভি চলে। তখন টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে?

জ্বি।

ব্যাপারটা যে খুবই স্বাভাবিক। আপনি বুঝতে পারছেন?

জ্বি।

এমন যদি হতো বিড়ালটা টিভি দেখতে দেখতে টিভির নাটক নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা শুরু করত তাহলে ছিল সমস্যা। তখন আমার কাছে আসার একটা অর্থ হতো। এখন আপনি এসেছেন। শুধু শুধু কিছু টাকা খরচ করবার জন্যে। চা বা কফি কিছু খাবেন। আমার এখানে চা-কফির ব্যবস্থা আছে।

না।

বিয়ে করেছেন নিশ্চয়ই?

জ্বি।

ছেলেমেয়ে কি?

একটাই মেয়ে। নাম অনিকা। আমি এখন যাই?

না। আমি একটা সিগারেট শেষ করেছি। দ্বিতীয় সিগারেট ধরাব। সেটা শেষ করব তারপর যাবেন।

জ্বি আচ্ছা।

শায়লা দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, হাস্যকর বিড়ালের গল্প নিয়ে আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন। এখন আমি সেই ব্যাখ্যা করব। দয়া করে লজ্জা পাবেন না।

আপনার খুবই ইচ্ছা করছিল আমার সঙ্গে দেখা করার। আপনি লাজুক মানুষ কোনো অজুহাত খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিড়ালের একটা গল্প অনেক চিন্তা ভাবনা করে বের করলেন। হয়েছে?

জোয়ার্দার মাথা নিচু করে থাকলেন। কিছু বললেন না। একবার ভাবলেন বলেন, বিড়ালের গল্পটা সত্যি। তারপর মনে হলো থাক।

শায়লা বললেন, আপনি যে মনে করে আমার জন্যে রসমালাই নিয়ে এসেছেন। এতে আমি বেশ অবাক হয়েছি। রসমালাইয়ের অংশটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আপনাকে নিয়ে ব্ৰহ্মপুত্রের পাড় ধরে হাঁটছি। লজ্জায় আমি অস্থির। হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই আপনি বললেন, তোমার কি মিষ্টি পছন্দ? আমি কোনো কিছু না ভেবেই বললাম, রসমালাই। রসমালাই কেন, কোনো মিষ্টিই আমার পছন্দ না।

জোয়ার্দার অস্বস্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, শায়লা যাই?

শায়লা হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে বললেন, আচ্ছা। আবার যদি কোনো কারণে আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে বা আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে, সরাসরি চলে আসবেন। বিড়ালের কাহিনী ফাদার কিছু নাই।

আচ্ছা।

সঙ্গে ট্রান্সপোর্ট আছে? ট্রান্সপোর্ট না থাকলে বলুন আমার গাড়ি পৌঁছে দেবে।

জোয়ার্দার বললেন, লাগবে না।

প্রচন্ড অস্বস্থি নিয়ে জোয়ার্দার বাড়ি পৌঁছলেন। দরজা খুলে বাড়িতে ঢোকার পর অস্বস্থি কাটল। খালি বাড়ি। বসার ঘরে বাতি জুলছে। সোফায় বিড়ালটা শুয়ে আছে। তাকে দেখে একবার মাথা তুলে আবার আগের অবস্থায় চলে গেল। মনে হয়। ঘুমাচ্ছে। টিভিতে হিন্দি সিরিয়েল হচ্ছে। সিরিয়ালে লম্বা গলার একটা মেয়ে সুন্দর করে কাঁদছে। তার সামনে কঠিন চেহারার একজন যুবা পুরুষ। সে মেয়েলি গলায় কথা বলছে।

টিভি কে ছেড়েছে? বিড়ালটা নিশ্চয়ই না। জামালের কান্ড। জামালের কথাটা শায়লার বলা উচিত ছিল। লাভ হতো না। বিড়ালের ব্যাপারটা শায়লা যে ভাবে উড়িয়ে দিয়েছে জামালেরটাও উড়িয়ে দিবে।

জোয়ার্দার ডাকলেন, জামাল?

জামাল জবাব না দিয়ে শোবার ঘরের মুখে এসে দাঁড়াল।

কখন এসেছিস?

জামাল জবাব দিল না হাসল। জোয়ার্দার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোদের দুজনকে নিয়ে বিরাট দুঃশ্চিন্তায় আছি। দেখা যাবে শেষটায় আমি পাগল হয়ে যাব। আমাকে পাবনা পাগলা গারদে নিয়ে আটকে রাখবে। পাগলা পারদ চিনিস?

জামাল না সূচক মাথা নাড়ল।

জোয়ার্দার উঠে পড়লেন। তাঁকে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। সহজ কোনো আইটেমে যেতে হবে। দুই মুঠ ভাত, এক মুঠ ডাল, এক চিমটি লবন আর একটা ডিম দিয়ে জাল। শেষটায় তেল দিয়ে বাগার।

জোয়ার্দার রান্না বসিয়েছেন। তার পাশে জামাল দাঁড়িয়ে আছে। সে উৎসুখ চোখে দেখছে। বিড়ালটা খাবার টেবিলে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

জোয়ার্দার জামালের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু খাবি?

জামাল না সূচক মাথা নাড়ল। জোয়ার্দার পুফির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কিছু খাবি? পুফি মাথা তুলে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নিলো।

টিভির সামনে বসে জোয়ার্দার রাতের খাবার খাচ্ছেন। জামাল তার পাশে বসেছে। পুফি তার পায়ের কাছে। টিভিতে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। আগুন জ্বলিছে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ে পড়ে আগুনে কি যেন দিচ্ছে। আগুন ধাপ করে বাড়ছে। আগুনের পাশে বসা স্বামী স্ত্রী দুজনই ভয় পেয়ে খানিকটা পিছাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখতে ভাল লাগছে।

মোবাইল টেলিফোন বাজছে। সিনেমাতেই মনে হয় বাজছে। একসময় বুঝা গেল সিনেমার না জোয়ার্দারের টেলিফোন বাজছে। তাকে উঠে টেলিফোন আনতে হলো না। পুফি লাভ দিয়ে উঠে দাতে কামড়ে ধরে টেলিফোন নিয়ে এলো। এইজাতীয় দৃশ্য বিদেশী সিনেমায় দেখা যায়। ঘরের বেড়াল খাওয়ানো এবং ঘুমানো ছাড়া কিছু করে না।

টেলিফোন করেছে অনিকা।

হ্যালো বাবা! বলতো আমরা কোথায়?

কক্সবাজারে।

হয় নি। দশে গোল্লা পেয়েছ। এখন আমরা সেন্টমার্টিন আইল্যান্ডে। মামা একটা জাহাজ ভাড়া করে আমাদের সেন্টমার্টিন নিয়ে এসেছে।

মজা হচ্ছে মা?

খুব মজা হচ্ছে। এখন আমরা বার বি কিউ করছি। নাও মার সঙ্গে কথা বলো।

সুলতানা বললেন, এই একটা ইন্টারেস্টিং খবর শোন, রঞ্জুর সেন্টমাটিনে একটা হোটেল আছে। নাম দিয়েছে Solid Rock সমুদ্রের পাশের বাড়ি নাম দিয়েছে Solid Rock, অদ্ভুত না?

হুঁ।

ওর কি চমৎকার চমৎকার আইডিয়া। সে যে সেন্টমাটিনে হোটেল বানিয়ে বসে আছে তাই জানতাম না। আমি এত অবাক হয়েছি। তুমি অবাক হও নি?

হুঁ।

এখন টেলিফোন রাখছি, পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে মাংস পুড়ে যাচ্ছে। যাই।

আচ্ছা আরেকটু ধর অনিকা কথা বলবে।

অনিকা। কি খবর মা?

তোমাকে ছাড়া এসেছি তো বাবা এই জন্যে আমার বেশি ভাল লাগছে। न्म।

কয়েকদিন পরতো চলেই আসবে।

বাবা শোনা। আমি ডাবের পানি দিয়ে গোসল করেছি।

কেন?

মা বলেছে ডাবের পানি দিয়ে গোসল করলে স্ক্রীন ব্ৰাইট হয়। এই জন্যে।

তোমার স্ক্রীনতো এমিতেই ব্ৰাইট।

আরো ব্ৰাইট হবে। আমি তখন চাঁদের মতো হয়ে যাবো। চাঁদের গা থেকে যেমন আলো বের হয় আমার গা থেকেও বের হবে।

ভালোতো।

বাবা। আমি টেলিফোন রাখছি। মা ডাকছে। মাকে সাহায্য করতে হবে।

জোয়ার্দার ঘুমুতে গেছেন। ঘুম যখন আসি আসি করছে তখন তাঁর মোবাইল বাজতে শুরু করেছে। তার মোবাইল ধরার কোনো ইচ্ছা ছিল না, পুফি কামড়ে মোবাইল নিয়ে এসেছে বলে অনিচ্ছায় ধরতে হলো।

হ্যালো! কে বলছেন!

আমার নাম করিম। আমি শায়লা ম্যাড়ামের এসিসটেন্ট। ম্যাডাম জরুরী ভিত্তিতে আপনাকে একটু দেখা করতে বলেছেন।

আমার টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছেন।

আপনিইতো আমাকে দিয়েছেন। টাকা দিয়ে যখন রশিদ নিলেন তখন টেলিফোন নাম্বারা এড্রেস সব দিলেন।

ও আচ্ছা।

আপনার পক্ষে কি এখন আসা সম্ভব? আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।

এখন সম্ভব না। আমি শুয়ে পড়েছি।

আগামীকাল কি আসতে পারবেন? সকাল দশটা থেকে এগারটা এই সময় ম্যাডাম বাসায় থাকেন।

কাল আমার অফিস আছে।

তাহলে রাতে চেম্বারে আসুন।

আচ্ছা।

রাত নটার দিকে এলেই হবে। রাত নটার পর ম্যাডাম আপনার জন্যে ফ্রি রাখবেন।

আচ্ছা।

জোয়ার্দার ঘুমিয়ে পড়লেন। করিম তারপরেও অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করল।

অফিস পাঁচটায় ছুটি হয়

অফিস পাঁচটায় ছুটি হয়। চারটা বাজতেই চেয়ার খালি হতে শুরু করে। যারা চক্ষুলজার কারণে বসে থাকে তারা ঘন ঘন হাই তুলতে থাকে। ফাইলপত্ৰ সব তালাবদ্ধ। টেবিল খালি। খালি টেবিলে সত্যি সত্যি মাছি ওড়ে। মাছি মারার ব্যাপারে কাউকে তেমন উৎসাহী মনে হয় না।

আজ অফিস খালি হওয়া শুরু হয়েছে তিনটা থেকে, কারণ আগামীকাল বুদ্ধপূর্ণিমার ছুটি। তা ছাড়া আকাশে ঘনকালো মেঘ। ঝড় বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বাসায় চলে যাওয়া ভালো।

জোয়ার্দার সাহেব গভীর মনোযোগে ফাইলে চোখ বোলাচ্ছেন। আকাশ মেঘে অন্ধকার বলে ধাতি জ্বলিয়েছেন। খালেক ঘরে ঢুকে বলল, স্যার, যাবেন না?

জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, কোথায় যাব?

বাসায় যাবেন। আর কোথায় যাবেন?

পাঁচটা তো এখনো বাজে নাই।

খালেক টেবিলের সামনে বসতে বসতে বলল, আকাশের অবস্থা দেখেছেন? বিরাট তুফান হবে। আগে আগে চলে যাওয়া ভালো।

জোয়ার্দার কিছু বললেন না। খালেক বলল, স্যার, একটা রিকোয়েস্ট করব। যদি অনুমতি দেন।

জোয়ার্দার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।

খালেক বলল, আজ আমার সঙ্গে আমার বাসায় চলুন। রাতে খাওয়াদাওয়া করবেন, তারপর আমি নিজে পৌঁছে দিব।

খালেককে অবাক করে দিয়ে জোয়ার্দার বললেন, আচ্ছা।

স্যার, তাহলে দেরি করে লাভ নেই। উঠে পড়ুন।

জোয়ার্দার বললেন, পাঁচটা বাজুক। অফিস ছুটি হোক।

ঠিক আছে, বাজুক পাঁচটা। আমি ক্যান্টিনে আছি। আপনার জন্য চা নাশতা কিছু পাঠাব?

না।

প্রবল বৃষ্টির মধ্যে জোয়ার্দার লাল রঙের প্রাইভেট কারে উঠলেন। খালেক বলল, পেছনের সিটে আরাম করে বসুন। আমি ড্রাইভারের সঙ্গে বসছি।

জোয়ার্দার বললেন, কার গাড়ি?

খালেক লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমার। মেয়ের স্কুল ডিউটি করতে হয়, এজন্য ধারাদেনা করে কিনে ফেলেছি। আমার স্ত্রী অবশ্যি এ গাড়িতে ওঠে না। তার ধারণা, এটা ঘুষের টাকায় কেনা। ইচ্ছা করলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আর্গুমেন্টে যেতে পারতাম। বলতে পারতাম, স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীর ভরণপোষণ। আমি সেই দায়িত্ব পালন করছি। কিভাবে করছি সেটা আমার ব্যাপার। তুমি আমার বিচারক না। আর্গুমেন্ট ঠিক আছে না। স্যার?

জোয়ার্দার জবাব দিলেন না। জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখতে লাগলেন। ভাল বৃষ্টি নেমেছে। জানালার কঁাচে ধুমধাম শব্দ থেকে মনে হয়, শীলও পড়ছে।

খালেকের ফ্ল্যাটবাড়ি ছবির মতো সুন্দর। বসার ঘরের টেবিলে। লাল টকটকে ফুলদানিতে ধবধবে সাদা গোলাপী। গোলাপের গন্ধে ঘর গন্ধময় হয়ে আছে। জোয়ার্দার বললেন, বাহ।

খালেক বলল, ঘর সাজানো আমার স্ত্রীর ডিপার্টমেন্ট। নিজের বাড়িতে যখন ঢুকি তখন মনে হয় নাটকের সেটে ঢুকে পড়েছি। বিশ্ৰী লাগে। নিজের ঘরে ঢুকব, জুতা খুলে একদিকে ফেলব, শার্ট আরেক দিকে ফেলব। তখনই না মজা।

খালেকের স্ত্রী শামা ঘরে ঢুকে জোয়ার্দারকে অস্বস্তিতে ফেলে বলল, আপনার মতো পুণ্যবান মানুষ আমার বাড়িতে, আজ আমার ঈদ। বলেই কদম বুসি করল। মেয়েটি শ্যামলা, অপরূপ মুখশ্ৰী। চোখ মায়ায় টলমল করছে।

জোয়ার্দার থতমত খেয়ে গেলেন। কী বলবেন ভেবে পেলেন না। কথার পিঠে কথা তিনি বলতে পারেন না।

খালেক বলল, স্যার রাতে খাবেন। ফ্রিজে কিছু আছে? না থাকলে ড্রাইভার পাঠিয়ে আনাও। বৃষ্টি বাদলার দিনে ইলিশ ফ্রাই জমবে। মোরগ পোলাও ইলিশ ফ্রাই।

শামা বলল, তোমার স্যার কে আমি আমার খাবার খাওয়াব। তোমার কিছু না।

জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, দুজনের খাবার আলাদা নাকি?

শামা বলল, জি। ওর ঈগারের খাবার আমি খাই না। বাবার কাছ থেকে আমি কিছু টাকা পেয়েছি। আমি ওই টকায় বাজার করি। ওর ফ্রিজ আলাদা। আমারটা আলাদা আমি নিজের খাবার নিজে খাই। আমার বাবাও ছিলেন। আপনার মতো সন্ন্যাসী টাই মানুষ। সেই অর্থে আমি সন্ন্যাসীর মেয়ে। আমি রান্নার জাগাড় দেখছি। তুমি তোমার স্যারের সঙ্গে গল্প করো। আধঘণ্টার মধ্যে নাশতার ব্যবস্থা করছি। স্যার, আপনি গোসল করবেন না?

জোয়ার্দার অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। অফিস থেকে ফিরে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করা তার অনেক দিনের অভ্যাস। অন্যের বাড়িতে নিশ্চয়ই এটা করা যায় না।

শামা বলল, স্যার, আমার বাবাকে দেখেছি অফিস থেকে ফিরেই অনেক সময় নিয়ে গোসল করতেন। তামার ধারণা, আপনিও তা-ই করেন।

জোয়ার্দার বললেন, হুঁ।

বাথরুমে সব কিছু আছে। আমি পরিষ্কার লুঙ্গি দিচ্ছি। আমার বাবার লুঙ্গি।

জোয়ার্দার বললেন, দরকার নাই।

শামা বলল, অবশ্যই দরকার আছে। আপনি বাথরুমে ঢুকুন, আমি নাশতার জোগাড় দেখি।

শামা চলে যেতেই খালেক বিরক্ত গলায় বলল, কথায় কথায় সন্ন্যাসী বাবা। সন্ন্যাসী বাবা। অস্থির হয়ে গেছি। কয়েকবার বলেছি তুমিও সন্ন্যাসী হয়ে যাও। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো গুহা খুঁজে বের করি, গুহায় দাখিল হয়ে যাও। গুহার ভেতর হাগা মুতা কর। জংলী মশার কামড় খাও। সন্ন্যাসী বাবার কাণ্ডটা শুনুন স্যার। ঢাকা শহরে দুটা বাড়ি, দুটাই দান করে দিয়েছে। একটা মাত্র মেয়ে সে কিছু পায় নাই। নগদ কিছু টাকা দিয়ে খালাস। সেই টাকার পরিমাণ কত তাও জানি না। আমি তো সন্ন্যাসী না। আমাকে বলবে কেন?

জোয়ার্দার কথা ঘোরাবার জন্য বললেন, আপনার মেয়ে কোথায়?

সে তার ছোট চাচার বাড়িতে। মেয়ের মধ্যেও সন্ন্যাসী ভাব দেখা দিয়েছে। আমি দুষ্ট লোক, আমার সঙ্গে কথা বলে না বললেই চলে। তার মা আমার গাড়িতে উঠে না বলে মেয়েও উঠে না। লোন করে গাড়ি কিনেছি, লোনের কাগজপত্ৰ দেখিয়েছি, তাতেও লাভ হয় নাই। স্যার, যান গোসল করে আসুন। আমার স্ত্রী একবার যখন মুখ দিয়ে গোসলের কথা বের করেছে। তখন গোসল করতেই হবে। বাথরুমে যদি না যান, বালতিতে করে পানি এনে মাথায় ঢেলে দেবে। সন্ন্যাসি বাবার মেয়ের নাড়ি নক্ষত্র আমি চিনি।

রাত নটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। শামা বলল, স্যার, আপনার কি পান খাওয়ার অভ্যাস আছে?

জোয়ার্দার বললেন, না।

শামা বলল, আপনার তো খালি বাসা। একা বাসায় থেকে কী করবেন? এখানে থেকে যান।

জোয়ার্দার মনে করতে পারলেন না তাঁর বাসা যে খালি এই খবর এদের দিয়েছেন কি না। দেবার তো কথা না।

শামা বলল, বাইরে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে স্যার, থেকে যান। গেস্ট রুম রেডি করে দিই?

খালেক বলল, স্যারের বাড়িতে কেউ নাই?

জোয়ার্দার বললেন, না। ওরা কক্সবাজার বেড়াতে গেছে। সেখান থেকে গেছে সেন্টমার্টিন। কাল পরশু চলে আসবে।

খালেক স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, স্যারের বাড়ি যে খালি এই খবর তুমি কিভাবে জানলে? স্যার তোমাকে বলেছেন? কখন বললেন?

শামা জবাব না দিয়ে উঠে গেল।

খালেক বিরক্ত গলায় বলল, বাড়িতে মহিলা পীর নিয়ে বাস করি। না বলতেই ঘটনা জানে। বাড়ি তো না, হুজরাখানা। স্যার বুঝলেন, মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে বনে জঙ্গলে চলে যাই।

শামা অনেক চেষ্টা করেও জোয়ার্দারকে থেকে যাবের জন্য রাজি করাতে পারল না।

খালেকের ড্রাইভার তাকে নামিয়ে দিতে গেল। বৃষ্টি তখনো পড়ছে। রাস্তাঘাটে পানি উঠে গেছে। গাড়ি কিছুদূর যাবের পরই ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলল, স্যার, একটা কথা বলি? যদি মনে কিছু না নেন।

বলো।

অপরাধ নিবেন না স্যার।

না অপরাধ নিব না।

রাস্তায় পানি উঠে গেছে। পানির ভিতর দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেলে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে যাবে। আমার চাকরি চলে যাবে।

আমি কি এখানে নেমে যাব?

নামলে ভালো হয় স্যার।

গাড়িতে কি ছাতা আছে?

জি िনা।

জোয়ার্দার বৃষ্টির মধ্যেই নেমে গেলেন। গাড়ি হুস করে তাকে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল। জোয়ার্দার মহা ঝামেলায় পড়লেন। চারদিক অন্ধকার। তিনি কোথায় আছেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। বৃষ্টিও নেমেছে আকাশ ভেঙে। তিনি ফুটপাত ধরে এগোচ্ছেন। কিছুদূর যেতেই রাস্তা দুই ভাগ হয়ে গেল। এখন তিনি কোন দিকে যাবেন? খালেকের ড্রাইভার তাকে নিতে কেন রাজি হলো না। তিনি বুঝতে পারছেন না। প্রচুর গাড়ি চলাচল করছে। একটা গাড়ি তো তার গা ঘেষে গেল। রাস্তার নোংরা পানিতে তিনি দ্বিতীয়বার মাখামাখি হয়ে গেলেন। রাস্তায় কোনো রিকশা নেই। রিকশা থাকলে জিজ্ঞেস করে জানা যেত। তিনি কোথায়, তাঁকে কত দূর যেতে হবে?

মিয়াঁও।

জোয়ার্দার চমকে তাকালেন। তার ডান দিকে পুফি। কুকুর যেমন লেজ উঁচু করে রাখে সেও লেজ উঁচু করে রেখেছে। মনে হয় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। বিড়াল হাঁটতে শুরু করেছে। তিনি বিড়ালের পেছনে পেছনে যাচ্ছেন। জোয়ার্দার নিশ্চিত এই বিড়াল তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। বিড়াল পানি পছন্দ করে না। কিন্তু এর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তিনি মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছেন, বিড়ালও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে ভালো হতো। কার সঙ্গে আলাপ করবেন? সবার সঙ্গে সব কিছু নিয়ে আলাপ করা যায় না। ডাক্তায় শায়লাতো পাত্তাও দিলো না। আজ রাত নটায় তার সঙ্গে দেখা করার কথা। লাভ কি। তাছাড়া যাবেনও বা কি ভাবে?

রাত এগারোটার দিকে জোয়ার্দার নিজ বাসার সামনে উপস্থিত হলেন। বিড়ালটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, থ্যাংক য়্যু। বলেই নিজের ওপর খানিকটা রাগ লাগল। বিড়াল থ্যাংক য়্যুর মর্ম বুঝবে না।

জোয়ার্দারের সারা শরীর কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে ছিল। তাকে দ্বিতীয়বার গোসল করতে হলো। এখন শুয়ে পড়ার সময়ঃ কিন্তু তিনি অভ্যাসবশে টিভির সামনে বসলেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে মহিষের মতো দেখতে কোনো এক প্রাণীর জীবনবৃত্তান্ত দেখাচ্ছে। তিনি আগ্রহ নিয়ে দেখছেন, বিড়ালটাও আগ্রহ নিয়ে দেখছে।

অনেকক্ষণ হলো টেলিফোন বাজছে। তার চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সারা শরীরে আলস্য। মনে হচ্ছে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়বেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় টেলিফোন ধরলেন। সুলতানী টেলিফোন করেছেন।

এই, টেলিফোন ধরছ না কেন? তিনবার কল করলাম।

জোয়ার্দার বললেন, হুঁ।

কী প্রশ্ন করেছি। আর কী উত্তর। হুঁ আবার কী? রাতে খাওয়াদাওয়া করেছ?

হুঁ।

হোটেলে খেয়েছ?

জোয়ার্দার আবারও বললেন, হঁ। ঝামেলা এড়ানোর জন্য হুঁ বলা।

কী দিয়ে খেয়েছ?

কৈ মাছ, মুরগির মাংস, ছোট মাছ, ঘি।

ঘি?

হুঁ। গরম ভাতে এক চামচ ঘি নিয়েছি।

হোটেলে ঘি দেয়? ঠিক করে বলো তো কোথায় খেয়েছ? তুমি আমার সঙ্গে লুকাছাপা করো, এটা আমি জানি। বলো কোথায় খেয়েছ?

জোয়ার্দার প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই পাশের ঘরে খিলখিল হাসির শব্দ হলো।

সুলতানা বললেন, হাসছে কে?

জোয়ার্দার জানেন কে হাসছে। খালি বাড়ি পেয়ে জামাল চলে এসেছে। বিষয়টা সুলতানাকে বলা অর্থহীন। কী বুঝতে কী বুঝবে।

এই কথা বলছি না কেন? কে হাসে?

কেউ না।

কেউ না মানে। আমি পরিষ্কার শুনছি। খালি বাড়ি পেয়ে কাকে তুমি নিয়ে এসেছ? মেয়েটার নাম কী? রাস্তা থেকে এনেছি? বেশ্যা মেয়ে? কত টাকা দিয়ে এনেছ?

জোয়ার্দার টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন। সুলতানার কথা শুনার চেয়ে জন্তুর কাণ্ড কারখানা দেখা যাক। এর মধ্যেও নিশ্চয়ই শিক্ষণীয় কিছু আছে। মহিষের মত জানোয়ারটার নাম জানতে পারলে ভাল হতো। অনিকা বলতে পারত।

টেলিফোন আবার বাজছে। বাজুক। ওই দিকে কান না দিলেই হলো।

জোয়ার্দার ঠিক করলেন, আজ আর বিছানায় যাবেন না। সোফাতেই ঘুমাবেন। জামালের লাফালাফিটা বাড়াবাড়ি রকমের। মাঝে মাঝে বিড়ালের মিয়াঁও শব্দও কানে আসছে। সেও যুক্ত হয়েছে জামালের সঙ্গে।

জোয়ার্দার সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। টিভি চ্যানেলের শব্দ। জামালের হৈচৈ, একটু পর পর টেলিফোনের বেজে ওঠা কিছুই তাঁর ঘুমের সমস্যা করল না। স্তবা অনেক দিন পর দুঃস্বপ্নটা দেখলেন।

কালো রঙের মাঝারি সাইজের চেয়েও ছোট একটা কুকুর তাকে কামড়ে ধরেছে। জামাল কুকুরটাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। একসময় কুকুরটা তাকে ছেড়ে জামালকে কামড়ে ধরল। জামাল বুকফাটা আৰ্তনাদ করল, বাজান, বাজানগো।

জোয়ার্দারের স্বপ্ন এ পর্যন্ত হয়। বাজান বাজান শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। আজ ঘুম ভাঙ্গল না। স্বপ্নটা চলতে থাকল। তিনি দেখলেন জামাল চার পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার পেট ফুলে আছে। পেটভৰ্তি কুকুরের বাচ্চা। পেটের চামড়া ভেদ করে বাচ্চাগুলো দেখা যাচ্ছে। কী ভয়ংকর দৃশ্য!

বাচ্চাগুলি কাঁদছে। কান্নার আওয়াজ টেলিফোনের রিং টোনের মত। জোয়ার্দার জাগলেন। কুকুরের বাচ্চা কাঁদছে না। টেলিফোন বাজছে। পুফি মোবাইল ফোন কামড়ে ধরে তার বিছানার কাছে বাসা। জামালকেও দেখা যাচ্ছে। সে জোয়ার্দারের পায়ের কাছে বসেছে। নিতান্ত অনিচ্ছার জোয়ার্দার টেলিফোন ধরলেন। নিশ্চয়ই সুলতানা চিৎকার চেচামেচি করে রাতের ঘুমের বারটা বাজিয়ে দেবে। জোয়ার্দার বললেন, সুলতানা বল কি বলবে।

অপরিচিত তরুণী কণ্ঠ বলল, আপনার স্ত্রীর নাম সুলতানা।

জোয়ার্দার বললেন, আপনি কে?

আমার নাম শায়লা। ডাক্তার শায়লা।

ও, আচ্ছা।

আজ আপনার আসার কথা ছিল।

জোয়ার্দার বললেন, ঝড় বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলাম।

বুঝতে পারছি। আমি অপেক্ষা করেছিলাম। ভাল কথা আপনার মামা কি বেঁচে আছেন?

কোন মামা?

শায়লা বললেন, যে মামার কারণে আমাদের বিয়েটা হয় নি।

ও বড় মামা। হ্যাঁ বেঁচে আছেন। প্যারালাইসিস হয়েছে। বিছানা থেকে নামতে পারেন না।

সরি টু হিয়ার দ্যাট। আপনি আপনার বড় মামার ঠিকানাটা আমাকে দেবেন। আমি তাকে একটা থ্যাংক য়্যু লেটার পাঠাব।

কেন?

উনার কারণে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় নি। নিজের মধ্যে প্রচন্ড জেদ তৈরী হয়েছিল। পড়াশোনা করেছি। রেজাল্ট ভাল করেছি। একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয় নি।

আপনার স্ত্রী কি হাউস ওয়াইফ।

জ্বি।

আপনার বড় মামা বাগড়া না দিলে আমাকেও বাকি জীবন হাউস ওয়াইফ হয়ে থাকতে হত। বৎসর বৎসর বাচা পয়দা করতাম। আমার কথা শুনে রাগ করছেন?

না।

আমার ধারণা আমি উল্টা পাল্টা কথা বলছি। নিজের উপর কনট্রোল নেই বলেই বলছি। আমি রাতে নিয়ম করে দুগ্লাস রেড ওয়াইন খাই। এই অভ্যাস বিদেশ থেকে Ph.D ডিগ্রির সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আজ আপনি না। আসায় খানিকটা মেজাজ খারাপ ছিল বলে হুইস্কি খেয়েছি। চার পেগ।

জোয়ার্দার বললেন, ও আচ্ছা।

শায়লা বললেন, নিজের উপর কনট্রোল নেই বলেই এত রাতে

আপনি ঘুমুতে যান। সরি ফর এভরিথিং।

জোয়ার্দার টেলিফোন পাশে রেখে ঘুমুতে গেলেন।

বাসার একি অবস্থা

বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলার ব্যবস্থা থাকলে সুলতানা চোখ কপালে তুলতেন না, ব্ৰহ্মতালুতে তুলে ফেলতেন। বাসার একি অবস্থা! প্রতিটি বালিশের তুলা ছেড়া। ঘরের মেঝেতে তুলার সমুদ্র। শুধু যে বালিশের তুলা বের করা হয়েছে তা না, লেপ নামিয়ে লেপের তুলাও বের করা হয়েছে।

তুহিন তুষার ঘটনা দেখে মজা পাচ্ছে। কানাকানি করছে; হাসি চ্যাপার চেষ্টা করছে। ইদানীং তারা অতি অল্পতেই মজা পায়।

অনিক ভীষণ অবাক। তার কোলে পুফি, পুফিও মনে হচ্ছে অবাক এবং ভীত। অনিক মারি দিকে তাকিয়ে বলল, বাসায় কি হয়েছে মা?

সুলতানা তিক্ত গলায় বললেন, তোমার বাবা লীলাখেলা করেছেন এগুলি লীলাখেলার আলামত।

অনিকা বলল, লীলাখেলা কি মা?

সুলতানা কঠিন গলায় বললেন, অকারণ কথা বলবে না। এখন আমার মাথা গরম। বিড়াল নিয়ে সামনে থেকে যাও। তুহিন তুষার তোমরাও সামনে থেকে যাও। খিকখিক করছ, কেন? খিকখিক করার মতো কিছু হয়েছে?

তুহিন তুষার তাদের ঘরে গেল। অনিকা গেল পেছনে পেছনে। লীলাখেলা ধ্যাপারটা কী জানতে হবে।

অনিকার প্রশ্নের জবাবে তুহিন বলল, খালুজান খালি বাড়ি পাইয়া এক মেয়েছেলে নিয়া আসছে। তার সাথে লটর পটার করছে। শুদ্ধ ভাষায় লক্টরপটিক্সারে কয় লীলাখেলা।

অনিক বলল, ঐ মেয়ে আমাদের বালিশ ছিঁড়েছে কেন?

তুষার বলল, শ‍ইল গরম হইছে। এই জন্যে বালিশ ছিঁড়ছে। শ‍ইল গরম হইলে মাথার ঠিক থাকে না। এখন বুঝছ?

অনিক কিছু না বুঝেই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।

সুলতানা জোয়ার্দারের অফিসে টেলিফোন করেছেন। এই মুহূর্তেই সব কিছুর ফয়সালা হওয়া উচিত।

সুলতানা প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, হ্যালো! হ্যালো।

জোয়ার্দার বললেন, তোমরা চলে এসেছ? সবাই ভালো? কারোর অসুখ বিসুখ হয় নিতে?

সুলতানা বললেন, এই মুহূর্তে তুমি বাসায় আসো।

অফিস ছুটি হবে পাঁচটায়। এই মুহুর্তে কিভাবে আসব?

আমি কোনো কথা শুনতে চাই না! তুমি আধঘণ্টার মধ্যে আসবে। এত চাকরি। যদি চলে যায় চলে যাবে।

রওনা হলেন। ফ্ল্যাট বাড়ির কোথায় কি হচ্ছে এই খবর দারোয়ানদের কাছে থাকবেই। তারা হচ্ছে ফ্ল্যাট বাড়িয় গেজেট।

গতকাল রাতে ডিউটি কার ছিল?

ম্যাডাম আমার।

তোমাদের স্যার কাল রাতে কখন বাসায় ফিরেছেন?

অনেক রাত করে ফিরেছেন। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফিরলেন। কাদায় পানিতে মাখামাখি।

তোমার স্যারের সঙ্গে যে মেয়েটা ছিল তার বয়স কত?

স্যারের সঙ্গে কোনো মেয়ে ছিল না।

তোমার নাম রশিদ না?

জি।

রশিদ আমার সঙ্গে টাল্টুবাজি করবে না। বুঝতে পারছি তোমাকে টাকা খাইয়েছে। কত টকা খাইয়েছে বলে। সে যদি পাঁচশ টাকা দিয়ে থাকে আমি দেব। হাজার। সত্যি কথা বলতে হবে।

রশিদ চুপ করে আছে। সুলতানা বললেন, এই নাও হাজার টাকার নোট। এখন বলো মেয়ে ছিল?

হুঁ।

কম বয়েসি মেয়ে?

হুঁ।

সারারাত ছিল?

হুঁ।

মেয়েটা দেখতে কেমন?

ভালো। দেখতে সৌন্দৰ্য আছে। তয় গায়ের রঙ শ্যামলা।

শ্যামলা রঙ আমি তোমার স্যারকে গিলায়ে খাওয়াব।

সুলতানী তাঁর ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হলেন।

অনিকা, তুহিন তুষারের ঘরে। ঘর ভেতর থেকে তালাবদ্ধ। অনিকা চোখ মুখ লাল করে বসে আছে। তুহিন তুষার তাকে লীলাখেলার মূল বিষয়টা বুঝাচ্ছে। বুঝাতে গিয়ে দুবোনই আনন্দ পাচ্ছে। অনিকা তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু খারাপ শব্দও শিখল। ভয়ে এবং আতঙ্কে অনিকার হাত পা কাঁপছে।

সুলতানা আবার টেলিফোন করলেন। জোয়ার্দারকে কঠিন গলায় বললেন, মেয়ের নাম কি বলো?

জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, কেমন মেয়ের নাম?

ন্যাক সাজছ? কোন মেয়ের নাম তুমি জানো না! সব বের করে ফেলেছি। দারোয়ান মেয়েকে দেখেছে।

ও আচ্ছা।

সুলতানা বললেন, ও আচ্ছা আবার কি। ও আচ্ছা তোমাকে গিলায়ে দিব। আজ শুধু বাসায় আসো। এখন বল মেয়ের নাম বল।

জোয়ার্দার কিছু না ভেবেই বললেন, শায়লা।

রাস্তার মেয়ে না-কি অন্য কিছু।

ডাক্তার।

ও আচ্ছা ডাক্তার। ডাক্তার মেয়ে সারারাত তোমার চিকিৎসা করেছে। চিকিৎসায় আরাম হয়েছে। শরীরের গরম কমেছে।

সুলতানা। এইসব কি বলছ।

এখনো কিছুই বলছি না। কিছুই করছিনা। আজ বাসায় ফিরে দেখা কি বলি আর কি করি।

সুলতানা তার ভাই রঞ্জকে খবর দিয়ে আনালেন। রঞ্জুর গায়ে এরশাদ সাহেবের সাফারি। বঁ হাতে কালো সিল্কের রুমাল। প্রচুর টাকা পয়সা হবার পর রঞ্জু ঘন ঘন নিজের লেবাস বদলাচ্ছ! কোনটাতেই তাকে মানাচ্ছেন না। লম্বাটে ঠোঁটের কারণে চেহারায় কিছুটা বাঁদর ভাব থেকেই যাচ্ছে।

রঞ্জু বলল, ঘটনা তো মনে হয ভয়ঙ্কর। বালিশ লেপ কাটাকুটির বিষয়টা বুঝা যাচ্ছে না। দুলাভাইয়ের মাথা ঠিক আছে তো?

সুলতানা বললেন, মাথা ঠিক না থাকলে এখন ঠিক হবে। মাথা ঠিক করার অষুধ দেয়া হবে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরুক। দেখ আমি কি করি।

শুরুতেই হৈচৈয়ে যাবে না বুবু। ঠাণ্ডা মাথায় ক্রস এগজামিন করবে।

সুলতানা বললেন, যে অবস্থা এই লোক করেছে তারপর কি আর মাথা ঠাণ্ডা থাকবে?

রঞ্জু বলল, কথাবার্তা কী হবে তা কাজের মেয়ে দুটির শোনা ঠিক হবে। না। আমি এই দুজনকে নিয়ে যাচ্ছি।

তোর যা ভালো মনে হয় কর।

অনিকা থাকুক তোমার সঙ্গে। তোমার মনের যে অবস্থায় একা না থাকাই ভালো। ডিসকাশন যখন শুরু হবে তখন অনিককে পাশের ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিলেই হবে। তোমাদের পুরো কথা বার্তার একটা অডিও রেকর্ড থাকা দরকার। আমার এই মোবাইলে চার ঘণ্টা অডিও রেকর্ড হয়। তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। তুমি সময় বুঝে বোতাম টেপে দিও।

জোয়ার্দার অফিস ক্যানটিনে বসে আছেন। তার সামনে হাফ প্লেট কাচি বিরিয়ানি। তিনি অর্ডার দিয়েছেন পাবদা মাছ, সবজি, ডাল। ক্যানটিনের বয় তাঁর সামনে কাঁচ্চি বিরিয়ানি রেখেই চলে গেছে। সে চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

খালেক এগিয়ে এল। তাঁর সামনের চেয়ারে বসতে বলল, স্যার আছেন।

কেমন?

ভালো।

একটা কথা বলেন তো স্যার। গত রাতে ড্রাইভার কি আপনাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল? নাকি বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে?

জোয়ার্দার জবাব দিলেন না। তিনি ক্যানটিনের বয়কে খুঁজছেন। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। খাবারটা বদলানো দরকার।

খালেক বলল, আমার বাসায় এই নিয়ে বিরাট ক্যাচাল। আমার স্ত্রী একশ ভাগ নিশ্চিত ড্রাইভার আপনাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। ড্রাইভারের কোনো কথাই শামা শুনবে না। ড্রাইভারের চাকরি নষ্ট হয়ে গেছে।

তাই নাকি?

ভালো একজন ড্রাইভার পাওয়া আর গুপ্তধন পাওয়া একই ব্যাপার। ঐ জিনিস শামা বুঝবে না।

আপনার ড্রাইভার খুব ভালো?

অবশ্যই ভালো। গাড়িটাকে সে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে। এক বছর হয়েছে গাড়ি কিনেছি, এখনো গাড়িতে দাগ পড়ে নাই। এখন আপনি কি স্যার দয়া করে আমার স্ত্রীকে বলবেন ড্রাইভার আপনাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। তাহলে গরিব কেচারার চাকরিটা থাকে, আমাকেও একজন ভালো ড্রাইভার হারাতে হয় না।

আচ্ছা আমি বলব।

আমি মোবাইলে শামাকে ধরে দিচ্ছি, আপনি একটু কথা বলুন। আমি জানি ড্রাইভার আপনাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। শ্যামা যখন বলছে তখন ঘটনা এটাই। শামা একটা কথা বলেছে আর কথাটা ঠিক হয় নাই তা হবে। না। পীর নিয়ে সংসার করি। যন্ত্রণার সীমা নাই। একজন পুরুষ মানুষের স্ত্রী প্রয়োজন, মহিলা পীর না। মহিলা পীর দিয়ে আমি কি করব? সকাল বিকাল কদমবুসি করব?

খালেক মোবাইলে ফোনে তাঁর স্ত্রীকে ধরে ফোন জোয়ার্দারের দিকে এগিয়ে দিলো। জোয়ার্দার ইতস্তত করে বললেন, শামা। একটা কথা।

শামা বলল, কি কথা বলতে চাচ্ছেন আমি জানি। আপনাকে কিছু বলতে হবে না। ড্রাইভারের চাকরি থাকবে। স্যার আপনি ভালো আছেন?

আমার ধারণা আপনি ভালো নেই। এক দিন আমার বাসায় আসবেন। আপনার সঙ্গে আলাদা কথা বলব।

আচ্ছা।

আজ কি আসতে পারবেন?

না।

জোয়ার্দার টেলিফোন রেখে দিলেন। খালেক বলল, স্যার আপনি তো মূল কথাটাই বলেন নাই।

জোয়ার্দার বললেন, বলেছি। ড্রাইভারের চাকরি থাকবে।

খালেক আনন্দিত গলায় বলল, বলেন কী? বড় বঁচা বঁটাচলাম।

জোয়ার্দার বাসায় ফিরেছেন। বাসা আগের মতোই লণ্ডভণ্ড অবস্থায় আছে।

মেঝেতে তুলা উড়ছে। সুলতানার প্রেসার অতিরিক্ত বেড়েছে বলে ডাক্তার এসে ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে শুইয়ে রেখেছেন। অনিকা আতংকে অস্থির হয়ে বিড়াল কোলে মায়ের পাশে বাসা।

রঞ্জু দুই কাজের মেয়েকে নিজের বাড়িতে রেখে আবার ফিরে এসেছে। এর মধ্যে তার পোষাকের পরিবর্তন হয়েছে। সে পরেছে প্রিন্স কোটি। গলায় বো টাই। তাকে হোটেলের বেয়ারার মতো লাগছে।

রঞ্জু বসার ঘরে। তার মুখ থমথম করছে। জোয়ার্দার বললেন, কেমন আছে রঞ্জ?

রঞ্জু বলল, আমি ভালো আছি। যদিও ভাল থাকার মতো অবস্থা আমাদের কারোরই নেই। আপনি এখানে বসুন।

বিচার সভা নাকি?

বিচার সভা হবে কি জন্যে? আপনার বিচার করার আমি কে? ঘটনা। কী বলুন তো। ঘর ভর্তি তুলা কেন?

বালিশ ছিঁড়ে তুলা বের হয়েছে।

বালিশ ছিঁড়েছে কে?

পুফি ছিঁড়েছে। অবশ্যি আমি তার নাম দিয়েছি কুফি। কুফি। একটা বিড়াল।

দুলাভাই! আপনি তো মানসিক রোগীর মতো কথা বলছেন। আপনার কথাবার্তা যে অসংলগ্ন এটা বুঝতে পারছেন?

হুঁ।

আপনি কিছু গোপন করতে চাইলে করবেন। আমাদের সবারই গোপন করার মতো কিছু না কিছু থাকে। বুবু বলেছিল। শায়লা নামের এক ডাক্তার মেয়েকে বাসায় নিয়ে রাত কাটিয়েছেন। শ্যামলা রঙ। কথাটা কি সত্যি?

জোয়ার্দার কিছু বলার আগেই সুলতানা ঝড়ের মতো উপস্থিত হলেন। অনিক এল তার পিছু পিছু। অনিক দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বাবার জন্যে তার খুব খারাপ লাগছে। সে জানে, বাবাকে মা বের করে দেবে। তার মা অনেকবার এই কথা অনিককে বলেছে। বাবা যাবে কোথায়?

রঞ্জু বলল, বুবু যা বলার ঠাণ্ডা গলায় বলে। তোমার শরীর খুবই খারাপ। প্রেসার অনেক হাই-এটা মনে রাখতে হবে।

সুলতানা বলল, আমি ওই বদমাইশ লোকের সঙ্গে কথাই বলব না। তুই বদমাইশটাকে চলে যেতে বল। এ বাড়িতে সে থাকতে পারবে না।

জোয়ার্দার বললেন, আমি যাব কোথায়?

সুলতানা বললেন, রঞ্জু তুই ওই বদমাইশটাকে বল সে কোথায় যাবে এটা তার ব্যাপার। তাকে এই মুহূর্তে ঘর থেকে বের হতে বল।

রঞ্জু বলল, আজকের রাতটা থাকুক। ঘটনা। কী আমরা জানি তারপর একটা ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

ঘটনা কি সবই জানা আছে। নতুন করে জানার কিছু নাই। তুই বদটাকে যেতে বল। আর যদি সে যেতে না চায় তাহলে কাজি ডেকে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন, এই মুহূর্তে।

জোয়ার্দার উঠে দাড়ালেন। তাকালেন মেয়ের দিকে। অনিকা চোখ মুছছে। সে এখন আর বাবার দিকে তাকাচ্ছে না।

সুলতানা বললেন, বদমাইশের কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা নে। চেক করে দেখ সেখানে শায়লা নামের ডাক্তার মাগির কিছু আছে নাকি। ফোন চালাচালি নিশ্চয়ই করে।

জোয়ার্দার পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে রঞ্জকে দিয়ে ঘর থেকে বের হলেন।

রাত অনেক হয়েছে। জোয়ার্দার সোহরাওয়াদী উদ্যানের একটা বেঞ্চে বসে আছেন। এ দিকটায় আলো নেই। অন্ধকার হয়ে আছে। কাছেই কোথাও রাতের ফুল ফুটেছে। তিনি ফুলের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছেন। প্রচণ্ড ক্ষুধায় তিনি অস্থির হয়ে আছেন। দুপুরে তঁর খাওয়া হয়নি। পাবদা মাছের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে টিফিনের টাইম শেষ হয়ে গেল। তাকে উঠে পড়তে হলো।

মিয়াঁও।

জোয়ার্দার চমকে তাকালেন। ঝোপের আড়ালে বিড়ালটা বসে আছে। জোয়ার্দার স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। একজন কেউ তো পাশে আছে। জোয়ার্দার বললেন, এই তোর খবর কী?

বিড়ালটা লাফ দিয়ে বেঞ্চে উঠে এল। জোয়ার্দার বললেন, তোর জন্যে ভালো বিপদে পড়লাম। বালিশ ছিঁড়ে তুলা বের না করলে এই বিপদে পড়তাম না।

মিয়াঁও।

এখন বল, কোথায় যাওয়া যায়। আমার ছোট বোন থাকে যাত্ৰাবাড়িতে। তার নাম ফাতেমা। একবার মাত্র গিয়েছি। বাড়ি খুঁজে বের করতে পারব না। ঠিকানাও জানি না।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। মেঘ তেমন নেই। বিদ্যুৎ যখন চমকাচ্ছে রাতে কোনো একসময় ঝড়-বৃষ্টি হবেই। জোয়ার্দার ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করছেন না। তিনি যেখানে বসে আছেন সেখানে ছাতার মতো আছে। তার প্রধান সমস্যা হলো ক্ষুধা। পাবদা মাছ দিয়ে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেতে পারলে হতো। জোয়ার্দার বিড়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কি খাওয়াদাওয়া করেছিস?

বিড়াল বলল, মিয়াঁও।

জোয়ার্দার শুয়ে পড়লেন। বিড়ালটা তার গাঘেষে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘের ওপর মেঘ জমছে। বৃষ্টি নামল বলে।

অনিকা মেয়েটার জন্যে খারাপ লাগছে বাসায় যে ঝামেলা যাচ্ছে এই ঝামেলায় বেচারা কি রাতে কিছু খেয়েছে? মেয়েটার তার বাবার সম্বন্ধে খুব খারাপ ধারনা হয়ে গেল। এটা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। মানুষ যা তাই।

জোয়ার্দার নিশ্চিত বাসার অবস্থা ঠিকঠাক হয়ে যাবে, তখন অনিকাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাবেন। অনিক জীব জন্তু দেখতে খুব পছন্দ করে।

রঞ্জু তার দুলাভাইয়ের মোবাইল সেই ঘাঁটাঘাটি করে একটি নাম্বার পেয়েছে যেখান থেকে রাত একটায় কল এসেছে। কথা হয়েছে এগারো মিনিট বাইশ সেকেন্ড।

রঞ্জু এই নাম্বারে টেলিফোন করল। বিনীত গলায় জানতে চাইল, হ্যালো আপনি কে জানতে পারি।

শায়লা বললেন, টেলিফোন আপনি করেছেন। আপনার জানার কথা কাকে কল করছেন।

এটা আমার দুলাভাইয়ের মোবাইল সেট। আপনি রাত একটায় তাকে টেলিফোন করেছেন।

শায়লা বললেন, উনি আমার পেশেন্ট। আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। অ্যাপায়েন্টটমেন্ট মিস করেছেন বলেই আমি কল করেছি। এত রাত হয়েছে বুঝতে পারি নি।

উনি আপনার পেশেন্ট?

জ্বি। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।

আমার দুলাভাই এর সমস্যাটা কি?

পেশেন্টের সমস্যাতে আপনাকে আমি বলব না।

আপনার নামটা কি জানতে পারি?

হ্যাঁ জানতে পারেন। আমার নাম শায়লা।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

রঞ্জু টেলিফোনের লাইন কেটে সুলতানাকে বলল, ঘটনাতো আসলেই খারাপ। শায়লা নামের মেয়েই টেলিফোন করেছিল।

বলিস কি?

রঞ্জু বলল, বুবু অস্থির হয়ে না। যা করার করা হবে। আমার উপর বিশ্বাস রাখি। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু।

পার্কে আরামের ঘুম

পার্কে আরামের ঘুম দিয়ে জোয়ার্দার ভোর ৬টার দিকে জাগলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন ঝাঁকে ঝাঁকে বুড়ো এবং আধাবুড়ো হাঁটাহাঁটি করছেন। অনেকের পরনে খেলোয়াড়দের মতো হাফপ্যান্ট। সাদা কেডস জুতা। উৎসব উৎসব ভাব। এক কোণায় টেবিল পাতা হয়েছে। টেবিলের পেছনে বাবরি চুলের এক ছেলে। সে পঞ্চাশ টাকা করে নিচ্ছে, সুগার মেপে দিচ্ছে। একজন ব্লাড প্ৰেশার মাপার যন্ত্র নিয়ে বসেছে। আরেকজনের কাছে ওজনের যন্ত্র। বুড়োদের দল স্বাস্থ্য রক্ষায় বের হয়েছে, এটা বুঝতে তাঁর সময় লাগল।

জোয়ার্দার আঙুল ফুটা করে সুগার মাপালেন। বাবরি চুল বলল, ফাস্টিং এ ফোর পয়েন্ট টু।

জোয়ার্দার বললেন, এটা ভালো না খারাপ?

কমতির দিকে আছে। আপনি কি ইনসুলিন নেন?

না।

জিটিটি করা আছে?

জিটিটি কী?

গ্রুকোজ টলারেন্স টেস্ট।

না।

প্রতি বুধবারে আমরা জিটিটির ব্যবস্থা রাখি। বুধবারে চলে আসবেন।

অবশ্যই আসব।

জোয়ার্দার প্ৰেশার মেপে জানলেন তাঁর নিচেরটা একটু বাড়তির দিকে, তবে ওপরেরটা ঠিক আছে।

ওপর-নিচ ব্যাপারটা তিনি বুঝলেন না। বোঝার ইচ্ছাও ছিল না। তিনি ওজন মাপলেন। তার ওজন পাওয়া গেল একাত্তর পাউন্ড। ওজনের সঙ্গে ভাগ্য পরীক্ষার কাগজও পাওয়া গেল। সেখানে লেখা অচিরেই লটারি কিং গুপ্তধন প্ৰাপ্তির সম্ভাবনা।

এক জায়গায় রং চা এবং ডায়াবেটিস বিস্কিট বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ টাকায় একটা ডায়াবেটিস বিস্কিট এবং এক কাপ চা। সবাই খাচ্ছে। তিনিও খেলেন। বুড়োদের সঙ্গে কিছুক্ষণ দীেড়ালেন। তার বেশ ভালো লাগলো। বুড়োদের সব আলোচনাই রাতের ঘুম, রক্তের সুগার এবং ব্লাড প্রেশারে সীমাবদ্ধ। তাদের জগৎ ছোট হয়ে এই তিনে এসে থেমেছে।

জোয়ার্দারের অফিসে যেতে আধাঘণ্টার মতো দেরি হয়ে গেল। তাকে এক জোড়া স্যান্ডেল। কিনতে হলো। রাতে তার স্যান্ডেল চুরি হয়েছে। চোর পকেটে হাত দেয়নি। মানি ধ্যাগ নিয়ে গেলে ভালো ঝামেলা হতো। চোর মানিব্যাগ কেন নিলো না জোয়ার্দার বুঝতে পারছেন না। মনে হয় এই চোর তেমন এক্সপার্ট না। কিংবা তার চাহিদা কম। সে অল্পতেই তুষ্ট।

অফিসে ঢুকে জোয়ার্দার লক্ষ্য করলেন, সবাই তার দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। তাদের তাকানোর ভঙ্গি থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। প্যান্টের জিপার খোলা থাকলে লোকজন এমন করে তাকায়। তার জিপার ঠিক আছে।

অফিসের পিয়ন হঠাৎ পা ছুঁয়ে তাকে সালাম করল। জোয়ার্দার বললেন, কী ব্যাপার?

স্যার, আপনার প্রমোশন হয়েছে। আপনি DGA হয়েছেন। জানেন না?

না তো। আমাকে এক কাপ চা দাও।

পিয়ন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জোয়ার্দার যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে ড্রয়ার খুলে ফাইল বের করতে লাগলেন। পিয়ন বলল, AG স্যারের সঙ্গে দেখা করবেন না?

দেখা করতে কি বলেছেন?

জি না।

তাহলে শুধু শুধু তাঁর সঙ্গে দেখা করব কেন?

স্যার মিষ্টি খাওয়াবেন না?

মিষ্টি খাওয়াব কেন?

এতবড় প্রমোশন পেয়েছেন মিষ্টি খাওয়াবেন না?

জোয়ার্দার মানি ব্যাগ খুলে একশ টাকার একটা নোট বের করলেন।

পিওন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

সুলতানার বাড়িতে হুলুস্থূল কাণ্ড।

অনিকা স্কুলে যায়নি। শুকনা মুখে বিড়াল কোলে ঘুরছে। রঞ্জু খবর পেয়ে ভোরে চলে এসেছে। বসার ঘরের সোফায় বসে কিছুক্ষণ পরপর বলছে,

Does not make any sense.

ঘটনা হচ্ছে সকালবেলা সুলতানা আবিষ্কার করেছেন তুহিন তুষারের ঘরের তিনটা বালিশ ছেড়া। ঘরময় তুলা উড়ছে। এই দুজন কাল রাতে ছিল না। রঞ্জু তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। এখন রঞ্জুর সঙ্গে ফিরেছে। তারা সব কিছুতে মজা পায়। এবারের ঘটনায় মজা পাচ্ছে না। তারা আতংকিত কারণ বালিশের ভেতর তাদের গোপন টাকা লুকানো ছিল। তুলার সঙ্গে টাকাও বের হয়েছে।

সুলতানা চায়ের কাপ হাতে ভাইয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, আমি যে ঘরে দুই চুন্নি পুষছি তা তো জানি না। এদের এক্ষুনি বিদায় করা দরকার। আট হাজার তিন শ টাকা পাওয়া গেছে।

রঞ্জু বিরক্ত গলায় বলল, মূল জিনিস নিয়ে আগে আলোচনা কর। টাকা চুরি তো মূল না। কাজের লোক কিছু টাকা এদিক-ওদিক করবে। এটা মেনে নিতে হবে। তোমরা অসাবধান থাকবে ঘরময় টাকা ছড়িয়ে রাখবে। চুরি তো হবেই। উঠানে ধান ছিটিয়ে রাখলে কাক আসে। আসে না?

হুঁ।

দোষ তো কাকের না। দোষ যে ধান ছিটিয়েছে তারা। চুরির প্রসঙ্গ আপাতত বাদ। ওদের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হবে। সেটাই ওদের শান্তি। এই দুজন চলে গেলে তোমার সংসার চলবে? কাজের মেয়ে পাওয়া আর ইউরেনিয়ামের খনি পাওয়া এখন সমান। বালিশ ছিঁড়ে তুলা কে বের করল এটা নিয়ে চিন্তা কর।

সুলতানা বললেন, ভূত না তো?

রঞ্জু বলল, কথায় কথায় ভূত-প্ৰেত নিয়ে আসবে না। ভূত-প্রেত আবার কী। আমার ধারণা, দরজা খুলে কেউ ঢুকেছে। তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য এই কাণ্ড করেছে। বালিশ ছিঁড়ে চলে গেছে।

কে ঢুকবে দরজা খুলে?

যার কাছে মেইন দরজা খোলার চাবি আছে সে ঢুকবে।

তোর দুলাভাইয়ের কথা বলছিস?

রঞ্জু জবাব দিল, না।

তোর দুলাভাইকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করব?

রঞ্জু বলল, করতে পারো। তবে টেকনিক্যালি জিজ্ঞেস করতে হবে। টেলিফোন তুলেই চিৎকার-চোঁচামেচি করলে তো হবে না। শায়লা মেয়েটি প্রসঙ্গে একটি কথাও বলবে না। আমি অলরেডি লোক লাগিয়েছি তারা পাত্তা লাগাবে।

সুলতানা বললেন, জিজ্ঞাসাবাদ যা করার তুই কর। আমি বাসায় আসতে বলি।

আসতে বললেই তো দুলাভাই ছুটে আসবেন না। অফিস ছুটি হলে তারপর হেলতে—দুলতে আসবেন।

জোয়ার্দরের সঙ্গে মোবাইল ফোন নেই। ফোন সিজ করা হয়েছে। সুলতানা বেশ ঝামেলা করেই অফিসের ল্যান্ডফোনে তাকে ধরলেন।

জোয়ার্দার বললেন, কেমন আছ?

সুলতানা বললেন, আমি কেমন আছি তোমার জানার দরকার নেই। তুমি এক্ষণ বাসায় আসো।

অফিস ছুটি হলেই আসব।

বাসায় বড় কোনো দুৰ্ঘটনা ঘটলেও তুমি অফিস করবে?

দুর্ঘটনা ঘটেছে?

তোমার সঙ্গে ইতিহাস কপচাতে পারব না। তোমার কাছে মেইন দরজা খোলার চাবি আছে কি না বলো।

চাবি আছে। এখন টেলিফোন রাখি। অফিসে কিছু ঝামেলা হয়েছে।

সুলতানা টেলিফোন রেখে গম্ভীর গলায় বললেন, রঞ্জু তুই যা ভেবেছিস তাই। তোর দুলাভাইয়ের কাছে মেইন দরজার চাবি আছে। কী অদ্ভুত মানুষ চিন্তা কর। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য চুপি চুপি ঘরে ঢুকেছে। বালিশ ছিঁড়ে তছনছ করেছে। এই লোক তো যেকোনো সময় আমাকে খুন করতে পারে। চুপি চুপি ঘরে ঢুকে খুন করে পালিয়ে গেল। কেউ কিছু জানল না।

রঞ্জু বলল, দুলাভাইয়ের যে অদ্ভুত মানসিকতা দেখছি। নাথিং ইজ ইম্পসিবল। তোমাকে বলতে আমার খারাপ লাগছে আমার ধারণা দুলাভাই মাথা খারাপের দিকে যাচ্ছেন।

সুলতানা বললেন, আমি তো এই লোকের সঙ্গে বাস করব না। আজ সে অফিস থেকে ফিরুক, তুই তার সঙ্গে ফয়সালা করবি। আমি অনিকাকে নিয়ে তোর বাড়িতে উঠিব।

আমার দিক থেকে কোনোই সমস্যা নেই।

অনিকা দরজার আড়াল থেকে সব কথা শুনছে। সেখান থেকেই ক্ষীণ গলায় বলল, বাবা একা থাকবে?

সুলতানা বিরক্ত গলায় বললেন, একা থাকবে কোন দুঃখে? রাস্তা থেকে মেয়ে ধরে আনবে। ঐ মেয়ের কোলে বসে বাকি জীবন কাটাবে।

রঞ্জু বলল, বাচ্চাদের সামনে এ ধরনের কথা বলা ঠিক না।

জোয়ার্দার সাহেবের অফিসে আসলেই ঝামেলা হচ্ছে। তার সিনিয়র সহকমী বরকতউল্লাহর মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। প্রমোশনের জন্যে তিনি অনেক ওপরের লেভেলে ধরাধরি করিয়েছেন। প্ৰধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব বরকতউল্লাহর আত্মীয়, সে বলেছে, বরকত ভাই, আপনি নাকে খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে ঘুমান। খাঁটি তেল আপনার সন্ধানে না থাকলে আমাকে বলুন, আমি ঘানি ভাঙা তেল এনে দেব। DGA আপনি হচ্ছেন। কলকাঠি যা নাড়ার তা নাড়া হয়েছে। এরচে বেশি নাড়লে কাঠি ভেঙ্গে যাবে।

আজ ভোরবেলা কলকাঠি নাড়ার ফলাফল দেখে বরকতউল্লা স্তম্ভিত। ঘণ্টা দুই ঝিম ধরে থাকার পর হঠাৎ তাঁর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি চিৎকার-চোঁচামেচি শুরু করলেন। অশ্রাব্য ভাষায় জোয়ার্দারকে গালাগালি।

নির্বোধি গাধা। শূন্য আই কিউ-এর একজন মানুষ। সে DGA হয় কিভাবে? ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া তো না, একে বলে হাতি ডিঙিয়ে কলা গাছ খাওয়া! আমি চুপচাপ বসে থাকব না। হাইকোর্টে মামলা করব। শালাকে আমি…।

বাকি কথা লেখা সম্ভব না। গালাগালি শোনার আনন্দের জন্য বরকতউল্লাহর অফিস রুমের সামনে ভিড় জমে গেল। গালাগালি করতে করতেই তাঁর স্ট্রোক হলো। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে তিনি মেঝেতে পড়ে গেলেন। অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।

ক্যান্টিনে জোয়ার্দার এক কোনায় বসে আছেন। তার এদিকে কেউ আসছে না। তবে ক্যান্টিনের বয় কয়েকবার এসে খোজ নিয়ে গেছে। তিনি সবজি, কৈ মাছ, ডালের অর্ডার দিয়েছেন। আজ মনে হয় দেরি হবে না।

খালেক ক্যান্টিনে ঢুকে সংকুচিত ভঙ্গিতে জোয়ার্দারের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার বসব?

জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, জিজ্ঞেস করেছেন কেন?

এত বড় অফিসারের সামনে বসাও তো একধরনের বেয়াদবি। স্যার, আমি আপনার প্রমোশনে অন্তর থেকে খুশি হয়েছি। শুধু আমি একা না, অনেকেই খুশি হয়েছে। ভাবিকে কি খবরটা দিয়েছেন?

না।

জানি উনাকে খবর দিবেন না। আপনি অতি আজব মানুষ। আজ বাসায় যাবের সময় অবশ্যই ভাবির জন্য কোনো উপহার কিনে নিয়ে যাবেন।

কী উপহার কিনব?

মেয়েরা শাড়ি পেলে খুশি হয়। জামদানি শাড়ি কিনে নিয়ে যাবেন।

এত টাকা সঙ্গে নাই।

আমার কাছ থেকে ধার নিয়ে কিনবেন। শাড়ি আমি পছন্দ করে দেব। স্যার, আপনার ক্রেডিট কার্ড নাই?

না।

আশ্চৰ্য! আজকাল তো ভিক্ষুকেরও ক্রেডিট কার্ড আছে। আচ্ছা আমি এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

লাগবে না।

লাগবে না মানে? অবশ্যই লাগবে। এখন তো আর লেবেনডিস ভাবে চললে হবে না। গাড়িতে যাওয়া-আসা করবেন। ভাবই অন্য রকম।

গাড়ি কোথায় পাব?

অফিসের গাড়ি। DGA-র গাড়ি আছে।

ও আচ্ছা।

জোয়ার্দার বাসায় ফিরলেন সন্ধায়। সুলতানার হাতে শাড়ি দিতেই সুলতানা তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, শাড়ি দিয়ে পার পেতে চাচ্ছ? লুচ্চা কোথাকার। এই শাড়ি রেখে দাও। রাস্তা থেকে যে মেয়ে আনবে তাকে দিয়ো। এখন সামনে বসো। তোমার সঙ্গে খুবই জরুরি কথা আছে। কথাগুলো আমি গুছিয়ে বলতে পারব না। কারণ তোমাকে দেখলেই রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। রঞ্জু তুই বল।

সুলতানা সামনে থেকে চলে গেলেন। রঞ্জু বলল, দুলাভাই! বুকুর মানসিক অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। প্ৰেশার ফ্ল্যাকচুয়েট করছে। আপনাকে দেখলে রেগে যাচ্ছে। আমার মনে হয় কিছুদিন আপনাদের আলাদা থাকা ভালো।

জোয়ার্দার বললেন, আচ্ছা।

বুবু কিছুদিন থাকুক আমার সঙ্গে।

থাকুক।

কী ঘটেছে আমি কিছুই জিজ্ঞেস করব না। আপনি কী নিজ থেকে কিছু বলবেন?

জোয়ার্দার বললেন, আমার মনটা খুব খারাপ। অফিস থেকে আসার পথে খবর পেয়েছি। বরকতউল্লাহ সাহেব মারা গেছেন।

বরকতউল্লাহ কে?

আমার একজন কলিগ। স্ট্রোক করে মারা গেছেন।

রাত এগারোটা। জোয়ার্দারের বাসা খালি। সবাই চলে গেছে। রাতের জন্য জোয়ার্দার চুলায় খিচুড়ি বসিয়েছেন।

ছাত্রজীবনে অনেকবার নিজে রান্না করেছেন। মাঝে মধ্যে এখনো রাধতে হয়। খিচুড়ি অখাদ্য হবে না। রান্নার শেষে এক চামচ ঘি দিতে পারলে ভালো হতো। তিনি ঘিয়ের কৌটা খুঁজে পাচ্ছেন না।

শোবারঘরে হুটোপুটির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিড়ালটা নিশ্চয় চলে এসেছে। বাসা যেহেতু খালি, জামালেরও আসার সম্ভাবনা।

জোয়ার্দার রান্নাঘর থেকেই লক্ষ্য করলেন কে যেন মন দিয়ে টিভি দেখছে। জামালের মতো না, বয়স্ক একজন মানুষ। জোয়ার্দার এগিয়ে গিয়ে দেখেন বরকতউল্লাহ বসে আছেন। এটা কী করে সম্ভব?

বরকতউল্লাহ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাল আছেন?

জোয়ার্দার তাকিয়েই আছেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। বরকতুল্লাহ বললেন, কাইন্ডলি চ্যানেলটা বদলে দিন।

আমাকে বলছেন?

আপনাকে ছাড়া আর কাকে বলব। আর কেউ কি এখানে আছে? আমি সারাজীবন বলেছি আপনি একজন নিৰ্বোধ। আমি যে একা বলেছি তা-না! সবাই বলেছে। তারপর প্রমোশন হয়ে গেল। আপনার। এর মানে কি জানেন?

না।

এর মানে হচ্ছে এ্যাডমিনস্ট্রেশন হায়ার লেভেল গর্ধভ চায়।

স্যার! আপনি যে মারা গেছেন এটা জানেন?

গর্ধভের মত কথা বলবেন না। যদি সম্ভব হয় এক কাপ কফি খাওয়ান।

গেস্টরুমটা দেখিয়ে দেই স্যার যদি ইচ্ছা করে গেস্ট রুমে ঘুমাবেন।

আমি কোথায় ঘুমাব এটা আমার মাথা ব্যথা আপনার না। You go to hell.

জোয়ার্দার মোটামুটি নিশ্চিত হলেন তার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। তার কোনো মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরী।

রসমালাই

জোয়ার্দার শায়লার সামনে সংকুচিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। শায়লা বললেন, রসমালাই এনেছেন?

জোয়ার্দার বললেন, না।

আনেন নি কেন? যতবার আমার এখানে আসবেন ততষ্কার রসমালাই আনতে হবে।

আচ্ছা আনব।

আমি রাত একটায় টেলিফোন করেছিলাম। এই নিয়ে কি বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?

না।

আপনার এক শ্যালকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তার কথা বার্তা কি রকম যেন লাগল। বাদ দিন ঐ প্রসঙ্গ। আপনার শরীর কেমন?

ভাল।

চা খাবেন?

না।

না বললে হবে না। আপনি যতবার আসবেন আমার সঙ্গে চা খেতে হবে।

জোয়ার্দার বললেন, আপনার ছেলে মেয়ে কি?

শায়লা চা বানাতে বানাতে বললেন, আমি বিয়ে করিনি। কাজেই ছেলেমেয়ের প্রশ্ন আসছে না। একটা মেয়েকে দত্তক নিয়েছি। তার নাম সুপ্তি। তিনমাস বয়সে দত্তক নিয়েছিলাম। দিনরাত ঘুমিয়ে থাকত বলে নাম দিয়েছিলাম সুপ্তি। এখন তার বয়স আট। দিনরাত জেগে থাকে। আপনি কি চায়ে চিনি খান?

খাই।

শায়লা বলল, ঝিম ধরে চা খাবেন না। চা খেতে খেতে গল্প করুন।

জোয়ার্দার বললেন, কারো পক্ষে কি মৃত মানুষকে দেখা, তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব?

আপনি মৃত কাউকে দেখছেন? তার সঙ্গে কথা বলছেন?

হুঁ। বরকতউল্লাহ সাহেব। আমাদের অফিসে কাজ করতেন। আমার সিনিয়ার ছিলেন। হঠাৎ হার্ট এটাকে মারা গেছেন।

মৃত মানুষটার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়?

আমার বাসায়। উনি বেশির ভাগ সময় সোফায় বসে টিভি দেখেন।

শায়লা বললেন, আপনার মোবাইলে কি ছবি তোলার অপসন আছে?

জানি না আছে কিনা। মোবাইল আমার সঙ্গে নেই। রঞ্জু নিয়ে নিয়েছে।

আরেকটা সেট কিনতে পারবেন না যেখানে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে।

খালেককে বললেই কিনে দেবে। সে এইসব ব্যাপারে খুবই দক্ষ।

শায়লা বললেন, ছবি তোলা যায়। এসব একটা মোবাইল সেট আপনি কিনবেন। বরকতউল্লাহ সাহেবের কয়েকটা ছবি তুলবেন। পারবেন না?

পারব।

বিড়ালটা কি এখানো আসে?

আসে।

সেই বিড়ালটার ছবি তুলবেন। আপনার মেয়ের কোলে যে বিড়াল থাকে তার ছবি তুলবেন।

আচ্ছা তুলব। এখন উঠি?

শায়লা বললেন, এখন উঠবেন না। আরো কিছুক্ষণ বসবেন। আমি ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিব। বক্তৃতাটা মন দিয়ে শুনবেন। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

শায়লা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমরা কঠিন নিয়মের এক জগতে বাস করি। নিয়মের সামান্য নড়াচড় হলেই জগৎ ভেঙ্গে পড়বে। জগৎকে পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে চলতে হয়। কোনো মৃত মানুষ যদি আপনার সঙ্গে বসে হিন্দী ছবি দেখে তাহলে পদার্থবিদ্যার সূত্র কাজ করবে না।

জোয়ার্দার ক্ষীণ গলায় বললেন, তাহলে কি আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?

শায়লা বলল, সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তবে আমি নিজে মনে করি আপনি অসম্ভব কল্পনা বিলাসী একজন মানুষ। যে কোনো বিষয় নিয়ে প্রচুর কল্পনা করেন বলে একসময় কল্পনাটা নিজের কাছে সত্যি মনে হতে থাকে। বুঝতে পারছেন?

হুঁ।

ভাবীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি রকম?

ভাল না।

সমস্যাটা কার? ভাবীর না আপনার?

আমার। সে আমার সমস্যাটা ঠিক বুঝতে পারছে না।

আপনি বুঝাবার চেষ্টা করছেন না বলেই বুঝতে পারছেন না। একবার ভাবীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসুন না। দুজনের সঙ্গে কথা বলি। আমার কাজটা তখন হবে ম্যারেজ কাউন্সিলারের।

আচ্ছা আমি নিয়ে আসব। অনিকাকেও নিয়ে আসব।

শায়লা বললেন, চেম্বারে আনার দরকার নেই। কোনো একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের লাঞ্চ করলাম।

জ্বি আচ্ছা। এখন কি আমি উঠিব?

উঠুন। বাসায় যাবেন?

জ্বি।

বাসায় গিয়ে যদি দেখেন বরকত সাহেব সোফায় শুয়ে আছেন, ছবি তুলতে ভুলবেন না।

ছবি কিভাবে তুলিব? মোবাইল ফোনতো কেনা হয় নি।

সরি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার কাছে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা আছে। অপারেশন খুব সহজ। টিপলেই ছবি। ক্যামেরাটা নিয়ে যান।

জ্বি আচ্ছা।

রাত একটা দশ। জোয়ার্দারের ঘুমাতে যাবের কথা। তিনি ঘুমাতে যাননি। বরকতউল্লাহর পাশে বসে আছেন। দুজনের দৃষ্টিই টিভির দিকে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির অনুষ্ঠান হচ্ছে। পেঙ্গুইন পাখি দেখাচ্ছে। পাখির একটা দল বরফের ওপর দাঁড়িয়ে। অন্য দল পানিতে। পানির দলটি বরফে উঠতেই বরফের দল নেমে যাচ্ছে। ওঠা-নামা চলছেই।

জোয়ার্দার একটু আগে খিচুড়ি খেয়েছেন। খিচুড়ি খেতে ভালো হয়েছে। ভদ্রতা করে তিনি বরকতউল্লাহকে খিচুড়ি খেতে বলেছিলেন। বরকতউল্লাহ জবাব দেননি। একজন মৃত মানুষ তার পাশে বসে আছে এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। জোয়ার্দাকে বললেন, চা খাবেন?

বরকতউল্লাহ না-সূচক মাথা নাড়লেন।

রাতে ঘুমাবেন? গোস্টরুম খালি আছে। গোস্টরুমে ঘুমাতে পারেন।

বরকতউল্লাহ মূর্তির মতো বসে রইলেন। তিনি ক্লাতে ঘুমাতে যাবেন এ রকম মনে হচ্ছে না। জোয়ার্দারের বাসা খালি। খালি বাসায় জামাল এবং বিড়ালটা চলে আসে। আজ তারা আসেনি। জোয়ার্দার টিভির অনুষ্ঠানের দিকে নজর দিলেন। পেঙ্গুইনরা এখন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ওপর প্রবল তুষারপাত হচ্ছে। জোয়ার্দার নিজের মনেই বললেন, ঘটনা কী?

বরকতউল্লাহ বললেন, এরা ডিম পাহারা দিচ্ছে।

জোয়ার্দার বললেন, ও আচ্ছা।

বরকতউল্লাহ বললেন, এসব প্রোগ্রাম মন দিয়ে দেখতে হয়।

জি জি।

ডিম পাহারা দিচ্ছে পুরুষ পেঙ্গুইনরা।

ও আচ্ছা।

ওদের সোসাইটিতে এটাই নিয়ম।

জোয়ার্দার বললেন, ইন্টারেস্টিং!

বরকতউল্লাহ বিরক্ত গলায় বললেন, ইন্টারেস্টিং কিছু না। প্রাণীদের ভিন্ন ভিন্ন নিয়মে চলতে হয়। আপনার টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন ধরুন। ফোন হাতের কাছে রাখতে হয়। ফোন ধরতে যাবেন, অনেকটা প্রোগ্রাম মিস করবেন।

তাহলে কি টেলিফোন ধরব না?

আপনার ইচ্ছা।

জোয়ার্দার ইতস্তত করে বললেন, আমি কি আপনার একটা ছবি তুলতে পারি।

বরকতউল্লাহ বিরক্ত মুখে বললেন, ছবি তোলার প্রয়োজনটা কি? একটা ছবি দেখছি তার মধ্যে বদারেশন। মোবাইলে ক্যামেরা আসায় এমন বাদারেশন হয়েছে সবাই ছবি তুলে।

জোয়ার্দার বললেন, স্যার আপনি বিরক্ত হলে ছবি তুলব না।

বরকতউল্লাহ বললেন, শখ করেছেন যখন তুলে ফেলেন। মাথার ডান দিক থেকে তুলবেন বঁদিকে চুল কম।

জোয়ার্দার ছবি তুললেন। আবার টেলিফোন বাজছে।

জোয়ার্দার টেলিফোন ধরার জন্য শোবার ঘরে গেলেন। টেলিফোন করেছেন সুলতানা। তার গলার স্বরে আতঙ্ক এবং হতাশা।

তুমি কি একটু আসতে পারবে?

কোথায় আসবে?

রঞ্জুর বাসায় আসবে। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। রঞ্জুর ড্রাইভার তোমাকে নিয়ে আসবে। একটা সমস্যা হয়েছে।

জোয়ার্দার বললেন, ও আচ্ছা।

সুলতানা বললেন, ও আচ্ছা। আবার কী? সমস্যাটা কি হয়েছে জানতে চাইবে না?

কী সমস্যা?

রঞ্জু তার বাসার বেডরুমে আটকা পড়েছে। বের হতে পারছে না।

দরজা লক হয়ে গেছে?

কী হয়েছে আমি জানি না, তোমাকে আসতে বলছি তুমি আসো।

আমি এসে কী করব? আমি তো চাবি বানানোর মিস্ত্রি না। এত রাতে চাবি বানানোর মিস্ত্রি পাওয়াও যাবে না।

তোমাকে আসতে বলছি তুমি আসো। আরো ঘটনা আছে।

আর কী ঘটনা?

রঞ্জুর সঙ্গে তুহিন-তুষারও আটকা পড়েছে। কেলেঙ্কারি ব্যাপার।

কেলেঙ্কারি ব্যাপার হবে কেন?

এত রাতে দুটা কাজের মেয়ে রঞ্জুর শোবার ঘরে। কেলেঙ্কারি না?

চা-কফি কিছু নিশ্চয়ই দিতে গিয়েছিল।

তোমাকে যুক্তি দিতে হবে না। তোমাকে আসতে বলছি আসো। গাড়ি এর মধ্যে পৌঁছে যাবের কথা। রাস্তা ফাঁকা।

জোয়ার্দার বললেন, আমার আসতে সামান্য দেরি হবে। টিভিতে পেঙ্গুইনদের ওপর একটা প্রোগ্রাম দেখছি। প্রোগ্রাম শেষ হলেই রওনা দেব। প্রোগ্রামের মাঝখানে উঠে গেলে উনি হয়তো রাগ করবেন।

উনিটা কে?

ইয়ে আমার এক সহকমী। হঠাৎ চলে এসেছেন।

তোমার কথাবার্তার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। এত রাতে বাসায় সহকর্মী?

জোয়ার্দার চুপ করে রইলেন।

শায়লা নামের ঐ মাগি চলে এসেছে?

না না, বরকতউল্লাহ সাহেব এসেছেন। আমার কলিগ।

গাড়ি পৌঁছামাত্ৰ তুমি গাড়িতে উঠবে। এ বিষয়ে আমি দ্বিতীয় কোনো কথা শুনতে চাই না।

আচ্ছা।

জোয়ার্দার বসার ঘরে ফিরে গেলেন। বরকতউল্লাহ তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি ইন্টারেস্টিং পার্টটাই মিস করেছেন। যেসব পেঙ্গুইন মায়েদের ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তারা অন্যের ডিম। চুরি করে।

বলেন কী!

চুপ করে বসে দেখুন। কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না।

জোয়ার্দার লজ্জিত গলায় বললেন, আমাকে রঞ্জুর বাসায় যেতে হবে। রঞ্জু হচ্ছে আমার শ্যালক। ও তার শোবার ঘরে আটকা পড়েছে। বের হতে পারছে না। মনে হয় তাকে দরজা ভেঙে বের করতে হবে। তার সঙ্গে দুটা কাজের মেয়েও আটকা পড়েছে।

বরকতউল্লাহ বিরক্ত গলায় বললেন, এত কথা বলছেন কেন? মন দিয়ে। একটা প্রোগ্রাম দেখছি।

সারি।

বরকতউল্লাহ জবাব দিলেন না। অপলক চোখে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখন পেঙ্গুইনরা দল বেঁধে কোথায় যেন যাচ্ছে।

জোয়ার্দার রঞ্জুর শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ানো। সুলতানা তার পাশে। সুলতানার চোখে পানি। তিনি একটু পর পর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। তাঁর পাশেই অনিকা পুফিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে সে থরথর করে কাঁপছে।

ঘরের ভেতর থেকে বিড়ালের তীক্ষ্ণ মিয়াঁও মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। জোয়ার্দার নিশ্চিত হলেন তাঁর কাছে যে বিড়াল আসে সেটাই রঙুর ঘরে। বিড়াল যতবার মিয়াঁও করছে ততবারই তুহিন-তুষার চেঁচাচ্ছে, ও আল্লাগো! ও আল্লাগো!

সুলতানা জোয়ার্দারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভ্যাবদার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু একটা করো।

কী করব?

দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করো।

আমি কিভাবে দরজা ভাঙব?

শাবল দিয়ে বাড়ি দিয়ে ভাঙো।

শাবল কোথায় পাবো?

রঞ্জু ঘরের ভেতর থেকে বলল, দুলাভাই ভাঙাভাঙিতে যাবেন না। ফ্ল্যাটের সব মানুষ ছুটে আসবে। কেলেঙ্কারি ব্যাপার হবে।

জোয়ার্দার বললেন, কেলেঙ্কারির কী আছে? তুমি আটকা পড়েছ এটা একটা সমস্যা এর মধ্যে কেলেংকারি কেন আসবে?

রঞ্জু হতাশ গলায় বলল, কেলেঙ্কারির কি আছে তা আপনি বুঝবেন না। এত বুদ্ধি আপনার মাথায় নাই।

জোয়ার্দার বললেন, তোমার ঘরে কি কোনো বিড়াল আছে?

হ্যাঁ আছে। পুফি হারামিটা কিভাবে যেন ঢুকেছে। আঁচড়াচ্ছে-কামড়াচ্ছে। ভয়ংকর অবস্থা।

জোয়ার্দার বললেন, পুফি না। এটা অন্য বিড়াল। এ বিড়ালটাকে মনে হয় আমি চিনি। পুফি অনিকার কোলে।

জোয়ার্দার দরজায় হাত রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। তুহিন-তুষার দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো। তুহিনের গায়ে শুধু পেটিকোট। তুষার সম্পূর্ণই নগ্ন।

সুলতানা জোয়ার্দারকে বললেন, তুমি অনিকাকে নিয়ে অন্য ঘরে যাও। রঞ্জুর সঙ্গে আমি একা কথা বলব। জোয়ার্দার মেয়ের হাত ধরে পাশের ঘরে ঢুকলেন।

রঞ্জু বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে। বিড়াল তাকেও কামড়েছে। শরীর রক্তাক্ত।

সুলতানা বললেন, মেয়ে দুটা তোর ঘরে কেন?

রঞ্জু বলল, বুবু শোনো। প্ৰায়োরিটি বলে একটা বিষয় আছে। তুমি প্ৰায়োরিটি বোঝে না। আমি ঘরে আটকা পড়েছি। দরজা খুলছে না। ঘরে ঢুকেছে একটা বুনো বিড়াল। আমাদের কামড়াচ্ছে, আঁচড়াচ্ছে। এ ঘটনা কেন ঘটল সেটাই প্ৰায়োরিটি বিবেচনা করা উচিত। মেয়ে দুটা আমার ঘরে কনে সেটা অনেক পরের আলোচ্য বিষয়।

সুলতানা বললেন, আমি এটাই আগে জানতে চাই।

আগে জানতে চাইলে বলি। মন দিয়ে শোনো। উত্তেজনা একটু কমাও। উত্তেজিত অবস্থায় মানুষ লজিক ধরতে পারে না। আমার লজিক তুমি ধরতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। রাত একটার দিকে পানির পিপাসা পেল। বিছানার কাছে জাগে পানি। পানি গ্লাসে ঢালতে গিয়ে দেখি পিঁপড়া ভাসছে। আমি তুহিনকে বললাম এক বোতল ঠাণ্ডা পানি দিতে। তুমি জানো, ওরা দুজন সব সময় একসঙ্গে চলে। দুই বোন পানির বোতল নিয়ে ঢুকেছে। বোতল রেখে চলে যাবে হঠাৎ দেখে দরজা লক হয়ে গেছে। এর মধ্যে জানালা দিয়ে ঢুকল বিড়াল। তোমার কাছে ঘটনা কি পরিষ্কার?

সুলতানা কিছু বললেন না।

রঞ্জু বলল, জগটা হাতে নিয়ে দেখো, জগের পানিতে পিঁপড়া ভাসছে। আর এই দেখো পানির বোতল। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না কাজের মেয়ে দুটিকে আমি অন্য উদ্দেশ্যে ডেকেছি। আমার রুচি এখনো এত নিচে নামে নি। এখন তুমি ঘর থেকে যাও। আমি ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা চিন্তা করি।

সুলতানা তুহিন-তুষারের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। দুই মেয়ে চৌকিতে জড়সড় হয়ে বসে ছিল। তারা সুলতানাকে দেখে মিইয়ে গেল। দুজনই তাকিয়ে আছে বিছানার চাদরের দিকে। কেউ চোখ তুলছে না।

সুলতানা বললেন, তোদের কী ঘটনা সবই রঞ্জু আমার কাছে স্বীকার করে পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে বলে আমি ক্ষমা করেছি। তোরাও নিজের মুখে যা ঘটেছে বলবি। তারপর পা ধরে ক্ষমা চাইবি। আমি ক্ষমা করে দেব। প্রথমে তুহিন বল।

তুহিন বিড়বিড় করে বলল, উনি যদি আমাদের বলে রাত একটার দিকে সবাই ঘুমায়ে পড়লে চলে আসবি। আমরা কি তখন বলতে পারি না। উনার একটা ইজ্জত আছে না? আপনারেই বা কিভাবে বলি। লজ্জার ব্যাপার। আপনার আপন ভাই।

প্রায়ই তার ঘরে যাস?

উনার এইখানে যখন থাকি তখন যাই।

তুষার এবার মুখ খুলল। সে নিচু গলায় বলল, আজ রাতে কোনো ঘটনা ঘটে নাই। আল্লাহর কিরা। আজ অন্য কারণে গেছি।

কারণটা কী?

তুষার বলল, আমাদের দুজনের পেটে সন্তান এসেছে। উনি বলেছেন, সন্তান খালাসের ব্যবস্থা করে দিবেন। কোনো সমস্যা হবে না। আজ রাতে ওই বিষয়ে আলাপ করতে উনি ডেকেছিলেন।

সুলতানা হতভম্ব হয়ে দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারা যে খুব লজ্জিত বা ভীত তাও মনে হলো না। তুহিনের ঠোঁটের কোনায় হাসির আভাসও চকিতের জন্য দেখা গেল।

জোয়ার্দারকে গাড়িতে করে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অনিকা ঘুমিয়ে পড়েছে। সুলতানা জেগে আছেন। তিনি বসে আছেন খাবার ঘরের চেয়ারে। তার হাতে চায়ের কাপ। তিনি কাপে চুমুক দিচ্ছেন না।

রঞ্জু এসে তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, বুকু চিন্তা করে কিছু পেয়েছ?

সুলতানা জবাব দিলেন না। রঞ্জু বলল, বুনো বিড়ালের বিষয়টা আমি বের করেছি। সে এসেছে পুফির খোজে। টম ক্যাট তো, এদের সঙ্গিনী দরকার। এ সময় এদের মাথাও থাকে গরম।

সুলতানা কঠিন চোখে তাকালেন। রঞ্ছ বলল, বাকি থাকল অটো সিস্টেমে দরজা লক হয়ে যাওয়া। এরও ব্যাখ্যা আছে। মেকানিক্যাল ফল্ট। ভোরবেলা একজন তালাওয়ালা আনিব সে পরীক্ষা করে দেখবে। চায়নিজ তালা কেনটাই ভুল হয়েছে। নেক্সট টাইম সিঙ্গাপুর গেলে তালা নিয়ে আসব। বুবু কথা বলছি না কেন? এত চিন্তিত হবার কিছু নেই। সব কিছুরই ব্যাখ্যা আছে।

সুলতানা বললেন, তুহিন-তুষার যে পেট বঁধিয়ে বসে আছে তার ব্যাখ্যা কী?

এইসব আবার কি বলছ?

তুই ভাল করে জানিস কি বলছি। রঞ্জু বলল, বুবু শোন। কাজের মেয়েরা প্রোগনেন্ট হয় ড্রাইভার, দারোয়নদের কারণে। দোষ দেয় বাড়ির কর্তাদের। উদ্দেশ্য হল বিপদে ফেলে টাকা পয়সা হাতানো। ড্রাইভার দারোয়ান শ্রেণীতো টাকা পয়সা দিতে পারবে না। হা হা হা।

সুলতানা বললেন, হা হা করবি না। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব বদ কোথাকার।

মেয়ের জন্মদিন

খালেক হাসিমুখে বলল, স্যার, আগামী পরশু আমার মেয়ের জন্মদিন।

জোয়ার্দার ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ও আচ্ছা।

খালেক বলল, স্যার, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আপনি প্রধান অতিথি।

জোয়ার্দার বিস্মিত গলায় বললেন, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকে?

প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি সবই থাকে।

জানতাম না তো।

খালেক বলল, অফিস ছুটি হলে আমি আপনাকে নিয়ে যাব। ঠিক আছে স্যার?

হুঁ।

জোয়ার্দার চাচ্ছেন যেন খালেক তাড়াতাড়ি এই ঘর ছেড়ে যায়। তার টেবিলের নিচে পুফি বসে আছে। এই দৃশ্য তিনি অন্যদের দেখাতে চান না। নানান প্রশ্ন করবে। সব মানুষের কৌতূহল এভারেস্টের চূড়ার মতো।

খালেক বলল, স্যার, আপনার এখানে একটু বসি? এক কাপ চা খেয়ে যাই।

জোয়ার্দার আমতা আমতা করে বললেন, একটা জরুরি কাজ করছিলাম।

তাহলে আর বিরক্ত করব না। পরশু দিন ছুটির পর আপনাকে নিয়ে যাব।

খালেক ঘর থেকে বের হতেই জোয়ার্দারের মন সীমান্য খারাপ হলো। তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন এ কারণেই খারাপ লাগছে। তিনি কোনো জরুরি কাজ করছেন না। প্রমোশন পাবার পর তার কাজ কমে গেছে। এসি ছেড়ে ঘর ঠাণ্ডা করে চুপচাপ বসে থাকাই এখন তাঁর প্রধান কাজ।

বিড়ালটা এক অর্থে তাঁর সময় কাটাতে সাহায্য করছে। কাল দুপুরের পর সে একটা ইদুরে ধরেছে। বিড়াল ইদুর ধরে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে না। অনেকক্ষণ তার সঙ্গে খেলে, তারপর মারে। এই কথা তিনি শুনেছেন, আগে কখনো দেখেননি। কালই প্রথম দেখলেন। ইদুরের বুদ্ধি দেখেও চমৎকৃত হলেন। বিড়ালের হাত থেকে একবার ছাড়া পেয়ে ভালো খেলা দেখাল। দৌড়ে সামনে যাচ্ছে হঠাৎ ১৮০ ডিগ্রি টার্ন নিয়ে উল্টা দৌড় শুরু করছে। বিড়াল বিভ্রান্ত। শেষ পর্যন্ত ইদুরটা পার্টিশনের একটা ফাক বের করে পালিয়ে গেল। বিড়াল হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল। জোয়ার্দার বিড়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকে বুদ্ধিতে হারিয়ে দিয়েছে। তোর মান খারাপ বুঝতে পারছি। হেরে গেলে সবার মন খারাপ হয়। আমি প্রায়ই বুদ্ধিতে আমার মেয়ের কাছে হেরে যাই। আমারও খানিকটা মন খারাপ হয়। আমার মেয়েকে তুই চিনিস? আনিকা তার নাম।

বিড়ালের মনে হয় কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। সে জোয়ার্দারের টেবিলের নিচে ঢুকে তার চোখের আড়াল হয়ে গেল। জোয়ার্দার অবশ্যি কথা বন্ধ করলেন না। চালিয়ে যেতে থাকলেন। তিনি বললেন, বেশি বুদ্ধি থাকা কোনো কাজের কথা না। এ জন্য বাংলা ভাষায় বাগধারা আছে অতি চালাকের গলায় দাঁড়ি। আমার শ্যালক রঙ্গুর অসম্ভব বুদ্ধি। অর্থাৎ অতিচালক। এ কারণেই তার গলায় দড়ি পড়েছে। বিরাট ঝামেলায় আছে। কী ঝামেলা সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না। আমার স্ত্রী তাকে নিষেধ করে দিয়েছে সে যেন বাসায় কখনো না আসে।

এই কুফি একটু বের হ! তোর ছবি তুলব। শায়লা তোর ছবি দেখতে চাচ্ছে। তোর কথা শায়লাকে বলেছি। সে বিশ্বাস করে না। ছবি দেখলে বিশ্বাস করবে।

কুফি আড়াল থেকে বের হলো। জোয়ার্দার তার বেশ কিছু ছবি তুললেন। সে আপত্তি করল না। জোয়ার্দার বললেন, বাড়িতে বিরাট ঝামেলা হচ্ছে। অফিসে আমি আরামে আছি।

কুফি বলল, মিয়াঁও।

বাড়ির ঝামেলাটা কি তা জানার কোনো আগ্রহ জোয়ার্দার বোধ করছেন না। সুলতানা তাকে জানাতে চাইছে না। কী দরকার জানার চেষ্টা করা?

ঝামেলাটা ঘটায় সুলতানার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কিছু উন্নতি হয়েছে। সুলতানা আগের মতো কথায় কথায় চেঁচিয়ে উঠছে না। এটা অনেক বড় ব্যাপার।

কাজের মেয়ে দুটো এখন বাসায় থাকছে না। অনিকার কাছে শুনেছেন তারা রঞ্জুর কাছে আছে। সুলতানা নতুন বুয়া রেখেছেন। তার নাম সালমা। দেখতে রাঙ্গুসীর মতো। তবে মেয়েটা কাজের। জোয়ার্দারের কখন কী লাগবে বুঝে গেছে। আগের দুজন সাজগোজ নিয়েই থাকত। সালমা সাজগোজের কী করবে? রাঙ্গুসীকে সাজতে হয় না।

কী ভাবছেন?

জোয়ার্দার চমকে উঠলেন। তাঁর টেবিলের পাশে আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নেবার জন্য একটা বেতের ইজিচেয়ার আছে। সেখানে বরকতউল্লাহ বসে আছেন। বিড়ালটা এখন বসেছে চেয়ারের নিচে। দুজনই তাকিয়ে আছে জোয়ার্দারে দিকে।

বরকতউল্লাহ বললেন, এসির টেম্পরেচার এত কম রেখেছেন! ঘরটা তো ডিপ ফ্রিজ হয়ে গেছে।

টেম্পারেচার কি বাড়িয়ে দেব?

না, থাক।

জোয়ার্দার বললেন, আপনার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

বরকতউল্লাহ বললেন, কোন ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না?

আপনি কোথেকে আসেন। কিভাবে আসেন।

এটা না বোঝার কী আছে?

আপনি যে মারা গেছেন এটা জানেন?

বরকতউল্লাহ বললেন, আপনার সমস্যা কি? উল্টা পাল্টা কথা বলছেন কেন?

জোয়ার্দার লজ্জিত গলায় বললেন, কিছু কি খাবেন? চা বা কফি।

না।

জোয়ার্দার বললেন, আমার ধারণা আমার মাথায় কোনো ঝামেলা হয়েছে।

বরকতউল্লাহ বললেন, হতে পারে। ভালো ডাক্তার দেখান। সাইকিয়াট্রিস্ট।

জোয়ার্দার বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন।

বরকতউল্লাহ বললেন, দেরি করবেন না। প্রথম অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসা করে কন্ট্রোল করা যায়। আমার ছোট বোন নাইমা ব্রেস্টট ক্যানসারে মারা গেল। শুরুতে ধরা পড়লে ব্রেস্ট ক্যানসার কোনো ব্যাপারই না। তিনটা ছোট ছোট বাচা নিয়ে তার স্বামী কী বিপদেই না পড়েছে।

বরকতউল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা যাই। কাজ করছিলেন, কাজের মধ্যে ডিসটর্ব করলাম।

বরকতউল্লাহ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। বিড়ালটাও পিছু পিছু গেল। কেউই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল না।

আমি অপেক্ষা করব

তিনি ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। তার সিরিয়াল এসেছে নয়। শায়লার এসিসটেন্ট করিম গলা নামিয়ে বলল, আপনার সিরিয়ালে ব্রেক করতে পারি। অন্যরা রাগ করবে। এইটাই সমস্যা।

জোয়ার্দার বললেন, আমি অপেক্ষা করব।

করিম বলল, একটা কাজ করি স্যার? সব রুগী বিদায় হবার পর আপনি যান। কথা বলার সময় বেশি পাবেন।

আমি যে সিরিয়াল পেয়েছি সেই সিরিয়ালেই যাব।

আজও মিষ্টি এনেছেন?

হুঁ।

ম্যাডাম কিন্তু মিষ্টি খান না।

তার মেয়েটা খাবে।

ম্যাডাম শাদী করেন নাই। মেয়ে কোথায় পাবেন।

উনার একটা পালক মেয়ে আছে সুপ্তি নাম। সুপ্তি খাবে।

কি যে কথা বলেন। উনার পালক মেয়ে টেয়ে কিছু নাই। একজন বুয়া আছে।

ও আচ্ছা।

নয়। নম্বার তার ডাক পড়ল না। অন্য রুগীরা যেতে থাকল। করিম গলা নামিয়ে বলল, আপনি এসেছেন ম্যাডামকে বলেছি। উনি বলেছেন। আপনাকে সবার শেষে পাঠাতে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

আমার কথাই ঠিক হয়েছে। তাই না। স্যার?

হুঁ।

চা-কফি কিছু খাবেন?

না।

জোয়ার্দার আগ্রহ নিয়ে ওয়েটিং রুমের লোকজন দেখছেন। রুণী হিসেবে তিনি শুধু একা এসেছেন, অন্য সবার সঙ্গে দুতিনজন করে এসিসটেন্ট। ষোল সতেরো বছরের একটি তরুণী মেয়ে এসেছে মনে হচ্ছে সেই রুগী। দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। সে তাঙ্কাচ্ছে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে। মধ্য বয়স্ক যে ভদ্ৰলোক মেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন। তিনি কিছুক্ষণ পর পর মেয়েটার হাত নামিয়ে দিচ্ছেন তাতে লাভ হচ্ছে না। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে মুখ ঢাকছে।

জোয়ার্দারের ডাক পড়েছে। তিনি ঘরে ঢুকতেই শায়লা বলল, রসমালাই আনেন নি?

জোয়ার্দার বললেন, এনেছি। আপনার এসিসটেন্টের কাছে দিয়েছি।

ভেরি গুড।

আপনার ক্যামেরাটাও নিয়ে এসেছি।

ছবি তুলেছেন?

জ্বি।

ছবি উঠেছে?

জ্বি উঠেছে।

শায়লা বিস্মিত হয়ে বললেন, দেখি ছবি?

জোয়ার্দার ছবি দেখাচ্ছেন। শায়লা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, সত্যি এক ভদ্রলোকের ছবি।

জোয়ার্দার বললেন, এটা বরকতউল্লাহ সাহেবের ছবি। উনি টিভি দেখছেন। উনার তিনটা ছবি তুলেছি। সব ছবি ডান দিক থেকে তুলতে হয়েছে। উনার মাথার বাঁ দিকে চুল কম। এই জন্যে।

শায়লা নিঃশ্বাস ফেললেন কিছু বললেন না। ছবি থেকে চোখ সরালেন না।

জোয়ার্দার বললেন, এটা কুফির ছবি; আমার কাছে যে বিড়ালটা আসে। আর এটা আমার মেয়ের কোলে পুফি। আমার মেয়ের নাম অনিকা। আপনাকে তার নাম বলে ছিলাম।

আমার মনে আছে। আপনি কি এই সব ছবি আর কাউকে দেখিয়েছেন?

না।

এই ছবি যে বরকতউল্লাহ সাহেবের এটা আমি বুঝাব কি ভাবে?

জোয়ার্দার বললেন, উনাকে চেনেন এমন যে কাউকে দেখালেই হবে। খালেক চিনবে।

খালেক কে?

আমাদের অফিসে কাজ করেন। আমার জুনিয়র কলিগ।

বরকত সাহেব কত দিন হল মারা গেছেন?

দুই সপ্তাহের বেশি হয়েছে।

শায়লা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, বিরাট সমস্যা হয়ে গেল।

জোয়ার্দার বললেন, কি সমস্যা?

শায়লা বললেন, ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়েছে। দিন তারিখ সব ছবিতে আছে। দুই সপ্তাহ আগে যিনি মারা গেছেন সেই লোক আপনার বসার ঘরে বসে টিভি দেখতে পারে না।

জোয়ার্দার বললেন, সেটা বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি বলেই আপনার কাছে এসেছি।

শায়লা বললেন, আপনি বুঝতে পারছেন না। আপনার বুঝতে পারার কথা না।

শায়লার ভুরু কুঁচকে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি গভীর সমুদ্রে °CछCछ्न्म।

জোয়ার্দার বললেন, আপনার এসিসটেন্ট করিম বলছিল। আপনার সুপ্তি নামের কোনো মেয়ে নেই।

শায়লা বলল, এই প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক আমি ছবিগুলি নিয়ে চিন্তা করছি। আপনার মেয়ের কোলে যে বিড়াল আর সোফায় শুয়ে থাকা বিড়ালতো একই বিড়াল।

দেখতে এক রকম মনে হলেও এক বিড়াল না। আমার মেয়ের বিড়ালটার নাম পুফি। পুফি খুবই শান্ত। আর এই বিড়ালটার নাম কুফি। এটা ভয়ংকর বিড়াল।

ভয়ংকর কোন অর্থে?

কুফি প্রায় আমার শ্যালকা রঞ্জকে আক্রমন করে। রঙুকে কুফির কারণে হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়েছে।

আমি আপনার শ্যালকের সঙ্গে কথা বলব। তার টেলিফোন নম্বর দেয়া যাবে না? এই নিন। কাগজ তার টেলিফোন নাম্বার ঠিকানা লিখে দিন।

জোয়ার্দার ঠিকানা লিখতে লিখতে বললেন, কুফি তুহিন তুষারকেও এটাক করেছিল।

ওরা কারা।

ওরা দুজন যমজ বোন। আমার বাসায় কাজ করতো। এখন অবশ্যি কাজ করে না।

শায়লা বললেন, আমি এই দুই বোনের সঙ্গেও কথা বলব।

দুই বোন রঞ্জুর বাসায় আছে। রঞ্জুর ঠিকানা লিখে দিয়েছি। আমি কি এখন চলে যাব?

শায়লা জবাব দিলেন না, তিনি একবার ছবি দেখছেন একবার জোয়ার্দারের দিকে তাকাচ্ছেন।

বাড়ির ছাদে শামিয়ানা

বাড়ির ছাদে শামিয়ানা টাঙিয়ে খালেক সাহেবের মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। কেক এসেছে হোটেল সোনারগা থেকে। গিফট রাখার জন্য একটা টেবিল সাজানো। টেবিলের পেছনে শুকনো মতো এক লোক খাতা-কলম নিয়ে বসে আছে। যে গিফট দিচ্ছে তার নাম ঠিকানা লিখে রাখছে।

জোয়ার্দার অস্বস্তিতে পড়েছেন। কারণ তিনি খালি হাতে এসেছেন। মেয়েটাকে পরে কিছু একটা কিনে দিতে হবে। মেয়ে কত বড় তাও জানেন না।

জোয়ার্দার খালেক বললেন, আপনার মেয়ে কোথায়? খালেক গলা নিচু করে বলল, বিরাট বেইজত হয়েছি স্যার। মেয়ের মা ঘুষের টাকার উৎসব করবে না বলে মেয়েকে নিয়ে দুপুর বেলায় কোথায় যেন গেছে। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে বলে বুঝতেই পারছি না তারা কোথায়।

জোয়ার্দার বললেন, এখন গেস্টদের কী বলবেন?

খালেক বলল, সুন্দর গল্প বানায়ে রেখেছি। গোস্টরা সবাই খুশি মনে খাওয়াদাওয়া করে বিদায় হবে। আপনাকে একটা কথা বলি স্যার, সুন্দর মিথ্যা কিন্তু সত্যের চেয়েও ভালো।

ছাদের এক কোনায় জোয়ার্দার বসে আছেন। গোস্টরা আসতে শুরু করেছে। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসছে। একজন ম্যাজিশিয়ান এসেছেন। ম্যাজিশিয়ানের সহকারী মেয়েটির পোশাক যথেষ্ট উগ্ৰ। জোয়ার্দারের মনে হলো, ঢাকা শহর অতিদ্রুত বদলাচ্ছে। অল্প কিছুদিন আগেও কোনো বাঙালি মেয়েকে এই পোশাকে ভাবা যেত না। খালেক হন্তদন্ত হয়ে আসছে।

স্যার, এক্ষুনি ম্যাজিক শুরু হবে। স্টেজের কাছে চলে যান।

আমি এখান থেকেই দেখব। ভালো কথা, আপনি কি বরকতউল্লাহ সাহেবের বোনকে চিনতেন?

অবশ্যই। উনি স্কুলশিক্ষিকা।

কত দিন আগে মারা গেছেন?

মারা যাননি তো। উনার নাম নাইমা। ইংরেজি একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

ও আচ্ছা।

স্যার, হঠাৎ উনার প্রসঙ্গ কেন?

জোয়ার্দার জবাব দিলেন না। নড়েচড়ে বসলেন। ম্যাজিক শো শুরু হয়েছে। ম্যাজিশিয়ানের সহকারী মিস পপি একটা কাঠের খালি বাক্স সবাইকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখালো। ম্যাজিশিয়ান সেই খালি বাক্সের ভেতর থেকে ধবধবে সাদা রঙের একটা কবুতর বের করলেন। জোয়ার্দার অস্পষ্ট স্বরে বললেন, অদ্ভুত! তাঁর দৃষ্টি বারবার মিস পপির দিকে চলে যাচ্ছে। এ রকম কেন হবে? জোয়ার্দার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ম্যাজিক দেখা যাচ্ছে না, ম্যাজিশিয়ানের কথা শুনে ম্যাজিক কল্পনা করে নেওয়া। ব্যাপারটা যথেষ্টই আনন্দদায়ক।

আমার হাতে আছে কিছু রিং। ভালো করে দেখুন। রিংগুলো স্টিলের তৈরি। কোনো ফাঁকফোকর নেই। এখন দেখুন। কিভাবে একটা রিংয়ের ভেতর অন্যটা ঢুকে যাচ্ছে।

জোয়ার্দার কল্পনায় দেখছেন। রিংগুলো শূন্যে ভাসছে। একটার ভেতর আরেকটা আপনা। আপনি ঢুকছে আবার বের হচ্ছে। ম্যাজিশিয়ানের চোখে কোনো বিস্ময় নেই। কিন্তু মিস পপি চোখ বড় বড় করে এই দৃশ্য দেখছে।

জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ করে জোয়ার্দারের বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। দরজা সুলতানা খুললেন, কিছুই বললেন না। এটা ম্যাজিকের মতোই বিস্ময়কর ঘটনা। স্বামী এত রাত করে ফিরলে বাঙালি সব স্ত্রীর প্রথম প্রশ্ন হবে, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে?

সুলতানা বললেন, রঞ্জুর কোনো খবর জানো?

না তো। ওর কী হয়েছে?

পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।

জোয়ার্দার বললেন, ও আচ্ছা। বাথরুমে কি টাওয়েল দেওয়া আছে? গোসল করব।

সুলতানা বললেন, এত বড় একটা ঘটনায় তোমার কোনো রি-অ্যাকশন নেই? একবারও জানতে চাইলে না কেন অ্যারেস্ট করেছে? তুমি কি এই জগতে বাস করো?

তুষার মারা গেছে। তার বোন পুলিশের কাছে উল্টাপাল্টা কি সব বলেছে।

মারা গেছে কিভাবে?

ক্লিনিকে অ্যাবরশন করা হয়েছিল, সেখানে মারা গেছে।

ও আচ্ছা।

সুলতানা বললেন, আবার ও আচ্ছা?

জোয়ার্দার বললেন, এক কাপ চা বানিয়ে দাও। চা খেয়ে গোসল করব।

থানায় যাবে না?

থাকায় যাব কেন?

আমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। টর্চার করছে কি না কে জানে। আর তুমি বলছি চা খেয়ে গোসলে যাবে।

আমি থানায় গিয়ে কী করব? র্যাব-পুলিশ এসব আমি খুব ভয় পাই। রঞ্জুর অনেক টাকা। সে টাকা খরচ করবে, পুলিশ তাকে ছেড়ে দেবে। টাকাওয়ালা মানুষের এ দেশে কোনো সমস্যা হয় না।

সুলতানা বললেন, তুমি একজন অমানুষ। আমার জীবনটা তুমি নষ্ট করেছ। আমি একা থাকব, কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকব না। দিস ইজ ফাইন্যাল।

জোয়ার্দার বললেন, আচ্ছা। তিনি বাথরুমে ঢুকলেন। সুলতানা টেলিফোন করলেন। থানায়। ওসি সাহেব বিনয়ী গলায় বললেন, রঞ্জু সাহেব তো কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন। আমরা দু-একটা প্রশ্ন করার জন্য ডেকেছিলাম। প্রশ্ন করেছি, উনি জবাব দিয়েছেন। তার কথাবার্তায় আমরা সন্তুষ্ট। তুহিন নামের একটা মেয়ের কথায় কিছু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল। এখন সব ঠিক আছে।

সুলতানা রঞ্জকে টেলিফোন করতে যাবেন তার আগেই রঞ্জু টেলিফোন করল। রঞ্জুর কাছে জানা গেল পুলিশকে সন্তুষ্ট করতে তার দুই লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এখন সব কিছু আন্ডার কনট্রোল।

জোয়ার্দার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে ভীত মুখে অনিক দাঁড়িয়ে আছে। অনিকার কোলে বিড়াল নেই। নতুন রাক্ষুসী চেহারার কাজের মেয়েটি এক কাপ চা দিয়ে গেছে। চা খেতে ভাল হয়েছে।

অনিকা বলল, বাবা তুমি ভালো আছ?

জোয়ার্দার হ্যা সূচক মাথা নাড়লেন।

অনিক গলা নিচু করে বলল, বাবা তুমি এই ফ্ল্যাটে কি কোনো মেয়েকে নিয়ে এসেছিলো? মেয়ের নাম শায়লা।

জোয়ার্দার বললেন, না।

আমি জানি। তোমার খুব ঝামেলা হচ্ছে তাই না বাবা?

হুঁ।

অনিক বলল, বাবা তোমার কি কোনো বিড়াল আছে? রঞ্জু মামা বলছিল তোমার নাকি একটা গুণ্ডা বিড়াল আছে।

জোয়ার্দার বললেন, আছে।

দেখতে পুফির মতো বাবা?

হুঁ।

বিড়ালটার কোনো নাম আছে?

আমি নাম দিয়েছি কুফি।

অনিকা বলল, নামটা বেশি ভালো হয় নি।

জোয়ার্দার বললেন, তুমি একটা নাম দিয়ে দাও।

অনিকা বলল, আমি নাম দিলাম পুফি টু। আমারটার নাম পুফি ওয়ান তোমারটা পুফি টু। নাম পছন্দ হয়েছে বাবা?

হুঁ।

সুলতানা বারান্দায় এসে দাড় কঠিন গলায় বললেন, মেয়ের কানে কি মন্ত্র দিচ্ছ?

জোয়ার্দার জবাব দিলেন না। চিন্তিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। অনিকা বলল, মা! তুমি শুধু শুধু বাবাকে বকা দিবে না। বাবাকে বকা দিলে পুফি টু এসে তোমাকে কামড় দিবে।

কি বললি? বাঁদর মেয়ে কি বললি তুই।

অনিকা কঠিন গলায় বলল, আমার সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলবে না। আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও পুফি টু তোমাকে কামড়াবে। পুফি টু ভয়ংকর রাণী।

শোবার ঘরের খাটে হেলান দিয়ে

রাত আটটা বাজে। মিসির আলি তার শোবার ঘরের খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। যথেষ্ট গরম পড়েছে কিন্তু মিসির আলির গায়ে হলুদ চাদর। তার ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মিসির আলির হাতে স্টিফান কিং এর ভৌতিক উপন্যাস নাম skeletion crew. তিনি অনেকখানি পড়ে ফেলেছেন। কিন্তু ভয়ের জায়গাগুলি ধরতে পারছেন না।

স্যার আসব?

মিসির আলি বই থেকে মুখ তুললেন। শ্যামলা চেহারার মধ্য বয়স্ক এক মহিলা দাঁড়িয়ে। মিসির আলি কিছু বললেন না।

আপনার বাইরের দরজা। হাট করে খোলা। কলিংবেল নেই বলে কড়া নেড়েছি। তারপর সাহস করে ঢুকে পড়লাম।

সাধারণত চাদরে পা ঢাকা থাকলে কেউ চাদর সরিয়ে পা বের করে সালাম করে না। এই মহিলা তাই করল।

মিসির আলি বললেন, আমি কি তোমাকে চিনি?

না স্যার।

তুমি যে ভাবে পা ছুঁয়ে সালাম করলে তা থেকে মনে হয়ে ছিল আমার ছাত্রী। ছাত্র ছাত্রীরাই এ ভাবে আমাকে সালাম করে। সালামের মধ্যে ভক্তির চেয়ে ভয় ভাব প্ৰবল থাকে।

আমার ছিল?

হ্যাঁ ছিল।

স্যার আমার নাম শায়লা। আমি ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিতে Ph.D করেছি। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড। এক সময় আপনি এই ইউনিভার্সিটিতেই পড়াশোনা করেছেন।

মিসির আলি বললেন, শুনে খুশি হলাম। আমার পি এইচ ডি ডিগ্রি নেই।

সবার এই ডিগ্ৰী লাগে না। স্যার। আপনার লাগে না।

মিসির আলি বললেন, শায়লা তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট ধরাও আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই।

তুমি টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে তৃষ্ণার্তের মত তাকাচ্ছ। একটু দ্রুত নিঃশ্বাস নিচ্ছ ইংরেজীতে একে বলে short breath. নিকোটিনে যারা অভ্যস্ত তাদের সিগারেট দেখলেই নিঃশ্বাস ঘন ঘন পড়তে থাকে।

শায়লা বলল, আমার বিষয়ে আর কি বলতে পারেন?

মিসির আলি বললেন, তুমি লেফট হ্যান্ডার।

শায়লা বলল, আমিতো এমন কিছু করি নি। যা থেকে বুঝা যাবে আমি লেফট হ্যান্ডার। আপনাকে সালাম করার সময়ও ডান হাতে সালাম করেছি।

মিসির আলি বললেন, তোমার বা হাতের আঙ্গুলো নিকোটিনের দাগ আছে। লেফট হ্যান্ডাররা বঁ হাতে সিগারেট খায়। তুমি শুধু যে নিকোটিনে আসক্ত তা-না, তুমি এলকোহলিক।

শায়লা হ্যান্ডব্যাগ খুলে সিগারেট বের করতে করতে বলল, আমি এলকোহলিক এটা ঠিকই ধরেছেন। কি ভাবে ধরেছেন জানতে চাচ্ছি না। জানা জরুরী না। আমি আপনার কাছ থেকে একটা বিষয় জানতে এসেছি। আমার নিজের না, আমার পেশেন্টের বিষয়। পেশেন্টের নাম আবুল কাশেম জোয়ার্দার। এজি অফিসের বড় কর্মকর্তা। পোষ্টের নাম ডেপুটি একাউন্টেন্ট জেনারেল। তিনি একজন মৃত মানুষকে তার ঘরে ঘুরা ফেরা করতে দেখে। এটা কি সম্ভব?

মিসির আলি বললেন, ভিজুয়েল হেলুসিনেশান অবশ্যই সম্ভব। অনেকেই মৃত মানুষকে দেখেছে তার সঙ্গে কথা বলেছে এমন বলে।

আমার পেশেন্ট মৃত মানুষের তিনটা ছবি তুলেছেন। মানুষটার নাম বরকতউল্লাহ। ছবিতে মৃত বরকতউল্লাকে দেখা যাচ্ছে আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখছে। স্যার এটা কি সম্ভব?

মিসির আলি বললেন, সম্ভব না। মানুষের ভ্ৰান্তি হয়। যন্ত্রের হয় না। মৃত মানুষের ছবি তোলা হয়েছে এমন গল্প শোনা যায় না। ট্ৰিক ফটোগ্রাফিতে কিছু ছবি তোলা হয়েছে। সবই লোক ঠকানো ছবি তাও প্রমাণিত হয়েছে। তোমার ছবিগুলি রেখে যাও দেখব।

এখান দেখবেন না।

এখন ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে না।

শায়লা বলল, পাঁচটা ছবি খামে ভর্তি করে রেখে যাচ্ছি।

মিসির আলি বললেন, তুমি না বললে তিনটা ছবি।

শায়লা বলল, বরকতউল্লাহ সাহেবের তিনটা ছবি। দুটা আছে বিড়ালের ছবি।

মৃত বিড়াল জীবিত হয়ে ঘুরছে তার ছবি।

শায়লা বলল, বিড়ালের কিছু রহস্য আছে। পরে বলব।

ঠিক আছে। পরে বললেও হবে।

শায়লা বলল, এই ভদ্রলোকের সমস্যা সমাধান আমার নিজের জন্যে খুব জরুরী। তিনি আমাকে বিরাট ধাঁধার মধ্যে ফেলেছেন। ঐ ভদ্রলোককে নিয়ে আমার খুবই ব্যক্তিগত একটা ঘটনা আছে; ঘটনাটা বলব?

মিসির আলি বললেন, আরেক দিন শুনব।

স্যার! আমি কি আজ চলে যাব?

মিসির আলি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।

স্যার আমি কি আরো কিছু সময় থাকতে পারি। কোনো কথা বলব না। চুপচাপ বসে থাকব।

বসে থাকতে চাচ্ছে কেন?

কোন কারণ নেই স্যার।

কারণ অবশ্যই আছে। মানুষ কারণ ছাড়া কোনো কাজই করে না। তুমি কেন বসে থাকতে চাচ্ছ তা আমি জানি।

শায়লা বলল, আপনি জানলে বলুন আমি শুনি। আমার নিজের জানা নেই।

মিসির আলি বললেন, তুমি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতে চাচ্ছ কারণ তুমি আশা করছি তুমি বসে থাকতে থাকতেই আজ ছবি দেখব।

শায়লা বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনি ছবিগুলি এখন দেখছেন না, পরে দেখবেন। এর পেছনেও নিশ্চয়ই কারণ আছে। কারণটা বলুন আমি চলে যাচ্ছি।

মিসির আলি বললেন, আমি তোমার উপর বিরক্ত বলেই এখন ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে না। ডক্টর অব ফিলসফি হয়ে বসে আছ আর বিশ্বাস করছ মৃত মানুষের ছবি তোলা হয়েছে। ছবিতে মৃত মানুষ টিভি দেখছে। হোয়াট এ নুইসেন্স।

শায়লা উঠে দাড়াল এবং লজ্জিত গলায় বলল, স্যার আমি সরি।

রাতের খাবার

জোয়ার্দার মেয়ের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে বসেছেন। সুলতানা বসেন নি। কিছুদিন ধরে তিনি স্বামীর সঙ্গে খেতে বসছেন না। অনিক বলল, আমি একটা ধাধা জিজ্ঞেস করছি জবাব দিতে পারবে?

জোয়ার্দার বললেন, না।

চেষ্টা করে দেখা। চেষ্টা না করেই বলছি, পারব না।

জোয়ার্দার বললেন, আমি চেষ্টা করলেও পারব না।

অনিক বলল,

নাই তাই খাচ্ছে থাকলে কোথায় পেতে
কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে।

জোয়ার্দার বললেন, পারব না মা।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে খাবার টেবিলের পাশে সুলতানা এসে দাঁড়ালেন। অনিকা বলল, এই ধাঁধাঁটার উত্তর তুমি দিতে পারবে?

সুলতানা বললেন, তোমার খাওয়া শেষ হয়েছে তারপরেও বসে আছ কেন? উঠে হাত মুখ ধোও, নিজের ঘরে যাও। কাল ছুটি আছে এক ঘণ্টা টিভি দেখতে পারবে।

অনিকা উঠে গেল। সুলতানা অনিকার চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব আশা করি সত্যি উত্তর দেবে।

জোয়ার্দার বললেন, আমি তো কখনো মিথ্যা বলি না। সুলতানা বললেন, শুরুইতো করলে মিথ্যা দিয়ে। এমন কেউ নেই যে মিথ্যা বলে না।

জোয়ার্দার হতাশ গলায় বললেন, কি জিজ্ঞেস করবে জিজ্ঞেস কর।

সুলতানা বললেন, মিথ্যা বলে পার পাবে না। আমার কাছে সব তথ্য প্রমাণ আছে। রঞ্জু লোক লাগিয়ে রেখেছিল। সে বের করেছে। ঐ মেয়েটার সঙ্গে যে তোমার বিয়ে হয়েছিল তা আমি জানি।

কোন মেয়েটা?

ন্যাকা সাজবে না। খবরদার ন্যাকা সাজবে না। শায়লা মাগির কথা বলছি।

এখন বুঝতে পারছি। গালাগালি করছ কেন? এটা ঠিক না।

তুমি যদি তার সাথে লটরপটির করতে পার আমি গালাগালি করতে পারি।

সুলতানা হাতে মোবাইল নিয়ে বসেছিলেন। মোবাইল বাজছে। তিনি মোবাইল হাতে উঠে গেলেন। যাবের আগে বলে গেলেন, হাত মুখ ধুয়ে বসার ঘরে বসে থাক। আমি আসছি।

টেলিফোন করেছে রঞ্জ। তার গলার স্বরে রাজ্যের ভয়! কথাও ঠিক মত বলতে পারছে না।

বুবু! একটু আসতে পারবে? আজকে মারাই যাচ্ছিলাম। চোখ গেলে ফেলতে চেয়েছিল। অনেক কষ্টে চোখ বাঁচিয়েছি।

কে চোখ গেলে ফেলতে চেয়েছিল?

দুলাভাই এর বিড়াল টা।

তোর দুলাভাই এর আবার কিসের বিড়াল।

রঞ্জু বলল, যে বিড়ালটা আমাকে কামড়ায় সেটা দুলাভাই এর বিড়াল।

তুই এখন কোথায়? স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। বুবু গাড়ি পাঠিয়েছি তুমি আসি। তোমার পায়ে পড়ি দুলাভাইকে সঙ্গে আনবে না।

জোয়ার্দার অনেকক্ষণ হল বসার ঘরে বসে আছেন। সুলতানা আসছে। না। এগারোটা বেজে গেছে এখন ঘুমুতে যাওয়া উচিত। তবে কাল ছুটির দিন কাজেই আজ একটু দেরীতে ঘুমুতে গেলেও ক্ষতি হবে না।

টিভি দেখতে দেখতে জোয়ার্দার ঘুমিয়ে পড়লেন।

রঞ্জু কেবিনে শুয়ে কাতড়াচ্ছে। বিড়াল তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কামড়েছে। সেলাই লেগেছে নয়টা। ডাক্তার তাকে সিডেটিভ ইনজেকশান দিয়েছেন।

সুলতানা হাসপাতালে পৌছে দেখেন রঞ্জু ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাত দিয়ে অদৃশ্য কিছু তাড়াবার চেষ্টা করছে।

টেলিফোনে ক্রমাগত ক্লিং হচ্ছে। জোয়ার্দারের ঘুম ভাঙ্গল রিং এর শব্দে।

হ্যালো কে?

আমি শায়ালা।

ও আচ্ছা।

জোয়ার্দার টিভির উপর রাখা ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত একটা দশ।

এতবার টেলিফোন করলাম টেলিফোন ধরছে না। প্রথমে তোমার মোবাইলে করেছি না পেয়ে শেষে ল্যান্ডফোনে।

জোয়ার্দার বললেন, আপনি কি প্রচুর এলকোহল খেয়েছেন।

শায়লা বলল, হ্যাঁ খেয়েছি। আমি পুরোপুরি ড্রাঙ্ক। সোজা বাংলায় মাতাল। মাতাল বলেই তুমি তুমি করছি।

শায়ালা কোনো সমস্যা?

হ্যাঁ সমস্যা। তোমার কারণে একজন আজ আমাকে চূড়ান্ত অপমান করেছে।

কে অপমান করেছে? সুলতানা?

না। মিসির আলি সাহেব। আপনার তোলা বরকতউল্লার ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। ছবিগুলি দেখতে বললাম। উনি দেখলেন না। বরং এমন কথা বললেন যেন আমি একজন মানসিক রুগী।

মিসির আলি সাহেব কে?

আছেন। একজন আপনি না চিনলেও চলবে।

শায়লা কাঁদছ কেন?

মাতাল হয়েছি। এই জন্যে কাঁদছি। আপনিতো মাতাল হননি। আপনি কেন আমাকে তুমি তুমি করছেন?

সরি।

আপনি আর কখনো আমার অফিসে আসবেন না।

আচ্ছা আর যাব না।

শায়লা টেলিফোন রেখে দিল।

রান্নাঘরে চায়ের কাপে

রান্নাঘরে চায়ের কাপে চামচ নাড়ার শব্দ হচ্ছে। বসার ঘরে অস্বস্থি নিয়ে বসে আছে শায়লা। সে ছবিগুলি নিতে এসেছে। তার ধারণা মিসির আলি ছবি দেখেন নি। এক সপ্তাহ পার হয়েছে এখনো ছবি না দেখা হয়ে থাকলে আর দেখা হবে না।

রান্নাঘর থেকে মিসির আলি বললেন, শায়লা তুমি চায়ে ক চামচ চিনি খাও।

দু চামচ।

মিসির আলি বললেন, ঘরে টেস্ট বিসকিট আছে। চায়ের সঙ্গে খাবে?

না স্যার।

মিসির আলি ট্রেতে দুকাপ চা এবং পিরিচে। কয়েকটা টেস্ট বিসকিট নিয়ে ঢুকলেন। শায়লার সামনে ট্রে রাখতে রাখতে বললেন, একটা টেস্ট বিসকিট খেয়ে দেখো ভাল লাগবে। টেস্ট বিসকিটের গায়ে পনির দেয়া আছে। পনিরের উপর এক ফোঁটা রসুনের রস। গাৰ্লিক টোস্ট উইথ চিজ। রান্নার বই এ পেয়েছি।

আপনি রান্নার বই পড়েন?

কেন পড়ব না? আমি রাঁধতে পারি না। কিন্তু রান্নার বই পড়তে ভালবাসি। তুমি কি জান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পার্ল এস বাকের চায়নীজ রান্নার উপর একটা বই আছে; আমি অনেক খোজ করছি কিন্তু বইটা পাচ্ছি না।

আপনার গার্লিক টোস্ট উইথ চীজ খুব ভাল হয়েছে।

মিসির আলি চায়ে চুমুক দিলেন। তিনি কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছেন।

শায়লা বাড়তি কৌতূহলের কারণ ধরতে পারছে না।

স্যার আপনি কি ছবিগুলি দেখার সময় পেয়েছিলেন?

মিসির আলি বললেন, তুমি যে দিন ছবিগুলি দিয়ে গেলে তার পর দিন ভোরবেলায় দেখেছি। এজি অফিসের সঙ্গে দুপুরবেলা যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে জানলাম বরকতউল্লাহ সাহেব জীবিত! প্রমোশন পেয়ে তিনি ডিএজি হয়েছেন।

শায়লা চায়ে চুমুক দিয়েছিল, মিসির আলির কথায় বিষম খেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, Oh God.

তোমার নিজের কি ধারণা জোয়ার্দার সাহেব কেন একজন জীবিত মানুষকে মৃত ঘোষণা করলেন?

স্যার আমার ধারণা তিনি আমার সঙ্গে দেখা করার অজুহাত হিসেবে এইসব গল্প করেন। উনার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কথাবার্তা অনেকদূর এগোনোর পর বিয়ে ভেঙে যায়। আমার প্রতি উনার আলাদা দুর্বলতা একটা কারণ হতে পারে।

তোমার কি ঐ ভদ্রলোকের প্রতি কোনো দুর্বলতা আছে?

না।

বিয়ে করেছ?

জ্বি-না।

বাড়িতে একা থাক?

জ্বি। আমি আর একটা কাজের মেয়ে।

জোয়ার্দার কি জানে তুমি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন কর?

জানেন না। আমি তাকে বলেছি যে একটি মেয়েকে আমি পালক নিয়েছি। ওর সঙ্গে দুষ্টামী করে আমার সময় কাটে।

মিথ্যা কথা কেন বলেছ?

যাতে সে কোনো রং সিগনাল না পায়; ভেবে না বসে তার সঙ্গে বিয়ে না হওয়ায় আমি মেয়ে দেবদাস হয়ে গেছি।

মিসির আলি বললেন, তাইতো হয়েছ। তুমি যখন হাইলি ইনটকসিকেটেড অবস্থায় থাক তখন কি জোয়ার্দারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ কর?

দুবার করেছি।

জোয়ার্দারের তোমার প্রতি কি মনোভাব তা আমি জানি না। তবে তুমি যে মহিলা দেবদাস তা আমি যেমন জানি তুমিও জান। রোগীর সমস্যা নিয়ে ছুটে এসেছ আমার কাছে।

শায়লা উঠে দাঁড়াল। আহত গলায় বলল, স্যার আমি যাব। চেম্বারের সময় হয়ে গেছে। ছবিগুলি দিন।

মিসির আলি বললেন, বসো। ছবি নিয়ে তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে। ছবিগুলি অত্যন্ত বিস্ময়কার!

বিস্ময়কর কোন অর্থে?

মিসির আলি বললেন, সব অর্থেই। তুমি বস আমি বলছি।

তিনি পড়ার টেবিলে ড্রয়ারে রাখা ছবিগুলি নিয়ে এলেন। অনিকার কোলের বিড়াল এবং আলাদা বিড়ালের ছবি শায়লার সামনে রাখতে রাখতে বললেন, বিড়াল দুটার মধ্যে তুমি কি কোনো পার্থক্য দেখছ?

শায়লা বলল, জ্বি না। দুটা একই বিড়াল।

মিসির আলি বললেন, একই বিড়াল না। একটার ডান চোখের উপর সাদা স্পট, অন্যটার বাঁ চোখের উপর শাদা স্পট। বিড়াল দুটার একে অন্যের মিরর ইমেজ। বাচ্চা মেয়েটার কোলের বিড়াল আয়নার সামনে যে বিড়াল দেখা যাবে অন্যটা সেই বিড়াল।

শায়লা বলল, ঠিক বলেছেন। আমার চোখে কেন পড়ল না?

তুমি ভাল করে তাকাওনি এই জন্যে চোখে পড়ে নি। এখন বরকতউল্লাহ সাহেবের একটা ছবি দেখাচ্ছি। এই দেখ। ছবিটিতে অতি অদ্ভুত একটা বিষয় আছে। এটা বের কর।

শায়লা বলল, স্যার আমি অদ্ভুত কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

মিসির আলি বললেন, বরকতউল্লা সাহেবের তিনটি ছবি আমাকে দিয়ে গেছ। এই একটাতে বরকতউল্লা সাহেবের পেছনের দেয়াল খানিকটা ছবিতে এসেছে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে। ক্যালেন্ডারের একটা কোনা ছবিতে এসেছে। ক্যালেন্ডারের কোনার দুটা তারিখই এসেছে উল্টা। এর অর্থ বরকতউল্লাহ সাহেবের মিরর ইমেজ আছে। এই ছবিতে।

শায়লা বিস্মিত গলায় বলল, এর মানে কি?

মিসির আলি বললেন, আমিও তোমার মতই ভাবছি, এর মানে কি?

শায়লা বলল, আমাকে দুদিন সময় দিন আমি ঘটনা বের করে ফেলব।

মিসির আলি বললেন, গুড লাক।

তার গলার স্বরে তেমন ভরসা নেই।

শায়লা এজি অফিসে। দুপুর একটা লাঞ্চ বিরতি। শায়লা খোজ নিয়ে জানল, জোয়ার্দার আজ অফিসে আসেন নি। সিক লিভ নিয়েছেন। বরকতউল্লাহ অফিসে আছেন।

সরকারি অফিসে টিলাঢালা ভাব থাকে। হুট হাট করে যে কোনো ঘরে যে কেউ ঢুকে যেতে পারে।

বরকতউল্লার ঘরের সামনে টুল পেতে বেয়ারা বসে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে শায়লা ঢুকে পড়ল। বেয়ারা কিছু বলল না, উদাস চোখে তাকিয়ে রইল।

বরকতউল্লার সামনে হটপটে দুপুরের খাবার। তিনি এখনো খাওয়া শুরু করেন নি। শায়লা বলল, আমি অসময়ে চলে এসেছি। তার জন্যে লজ্জিত। আমি আপনার এক মিনিট সময় নেব।

বলুন কি ব্যাপার।

শায়লা ব্যাগ থেকে তিনটা ছবি বের করে বরকতউল্লার সামনে রাখতে রাখতে বলল, এই ছবিগুলি নিশ্চয়ই আপনার।

হ্যাঁ।

ছবিগুলি কে তুলেছে?

বরকতউল্লাহ একটা ছবি হাতে নিয়ে বলল, কে তুলেছে বলতে পারছি না।

কোথায় তোলা হয়েছে তা বলতে পারবেন?

না।

আপনি কি আপনার অফিসের কলিগ জোয়ার্দার সাহেবের বাসায় কখনো গিয়েছিলেন?

না তো।

আপনার কাছ থেকে এক মিনিট সময় নিয়েছিলাম। এক মিনিটের বেশি হয়ে গেছে। এখন আমি যাই?

বরকতউল্লাহ বললেন, আপনি বসুন। আপনার পরিচয় দিন। হুট করে এসে কয়েকটা ছবি দেখিয়ে চলে যাবেন তাতো হবে না। ছবিগুলি কে তুলেছে?

শায়লা বলল, আমি একজন ডাক্তার। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি হল আমার বিষয়। আমার একজন পেশেন্ট আমাকে এই ছবিগুলি দিয়েছেন। আমি বিষয়টা অনুসন্ধান করছি।

আপনার কথাতো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি নিজেও এখন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি যাই।

শায়লা ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হল। তার পেছনে পেছনে বরকতউল্লাহ বের হলেন। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।

এজি অফিস থেকে জোয়ার্দারের বাসার ঠিকানা শায়লা নিয়েছে। ভর দুপুরে জোয়ার্দারের বাসায় উপস্থিত হওয়া কোন কাজের কথা না। শায়লা তাই করল।

অনেকক্ষণ বেল টেপার পর জোয়ার্দার নিজেই দরজা খুললেন, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শায়ালার দিকে।

শায়লা বলল, আপনি কি আমাকে চিনেছেন?

জোয়ার্দার বললেন, চিনব না কেন? তুমি আগের মতই আছ। শরীর সামান্য ভারি হয়েছে। আমার ঠিকানা কোথায় পেয়েছ।

আপনার অফিস থেকে ঠিকানা নিয়েছি।

আমি যে এজি অফিসে কাজ করি সেটা জান কি ভাবে?

শায়লা বলল, আমার শরীর খারাপ লাগছে, মাথা ঘুরছে। আমি কি আপনার বসার ঘরে কিছুক্ষণ বসতে পারি।

অবশ্যই পার। এসো।

আপনার স্ত্রী কিছু মনে করবেন নাতো?

জোয়ার্দার বললেন, শায়লা আমিতো বিয়েই করি নি। স্ত্রী আসবে কেত্থেকে?

শায়লা বিড়বিড় করে বলল, ও আচ্ছা আচ্ছা। আমি এক গ্রাস পানি খাব।

তুমি বস। আমি পানি আনছি। তোমাকে এ রকম বিধ্বস্ত লাগছে কেন? দুপুরে খেয়েছ?

না।

আমার সঙ্গে দুপুরে খেতে কোনো সমস্যা আছে?

না।

শায়লা বলল, আপনার মেয়ে অনিকা কোথায়?

জোয়ার্দার অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে একটু আগে বলেছি। আমি বিয়ে করি নি। এখন হঠাৎ মেয়ে প্রসঙ্গ তুললে কেন? আমি একা বাস করি। একাও ঠিক না। আমার একটা পোষা বিড়াল আছে।

শায়লা বলল, বিড়ালের নাম কি পুফি?

হ্যাঁ পুফি! বিড়ালের নাম জানলে কি ভাবে।

শায়লা জবাব দিল না। চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল। জোয়ার্দার বললেন, কোনো সমস্যা?

শায়লা বলল, হ্যাঁ সমস্যা বিরাট সমস্যা। আমার মাথা দপ দপ করছে। মাথায় পানি ঢালতে হবে। আপনার বাথরুমটা কি ব্যবহার করতে পারি।

অবশ্যই পার। এসে বাথরুম দেখিয়ে দিচ্ছি।

ড. শায়লার ডায়েরি

ড. শায়লার ডায়েরি।

ডায়েরি ইংরেজীতে লেখা। এখানে বাংলা ভাষ্য দেয়া হল। শুরুর দুটি fir, I am lost. I am totaly lost.

আমি তলিয়ে গেছি। পুরোপুরি তলিয়ে গেছি। আমার ব্রেইনের নিউরো ট্রান্সমিটার সিগন্যাল পাঠানোয় ভুল করছে কিংবা তথ্য গুছাতে পারছে না। সব এলোমেলো করে দিচ্ছে।

শারিরীক ভাবেও আমি ভেঙে পড়েছি। শরীরে প্রচুর এলকোহল নেবার পরও আমার ঘুম আসছে না। আমার ক্ষুধা কমে গেছে। তবে তৃষ্ণ বেড়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন পানি খাচ্ছি তাতেও শুকনা ভাব দূর হচ্ছে না। এই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভার্টিগো সমস্যা। সারাক্ষণ মনে হয়। চারপাশের সব কিছু ঘুরছে। চোখ বন্ধ করে রাখলেও এই ঘুর্ণন বন্ধ হয় না।

আমার জীবনের ঘটনা প্রবাহ ভালমত লিখে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী। কারণ আমার জীবনের ঘটনাবলি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমি নিজে ব্যাখ্যা করতে পারলে ভাল হত, তা পারছি না। বিশেষ বিশেষ সময়ে হাতীর পা কাদামাটিতে আটকে পড়ে মিসির আলি স্যারের পা এখন কাদাবন্দি। তিনি অবশ্যি পা টেনে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।

হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমি কি আর করতে পারি।

আমি দুজন জোয়ার্দারকে দেখলাম। এদের চেহারা এক, নাম এক, এমন কি টেলিফোন নাম্বার এক কিন্তু এই দুজন সম্পূর্ণ আলাদা। একজন বিয়ে করেছেন তার একটি মেয়ে আছে। মেয়েটির একটি পোষা বিড়াল আছে। বিড়ালটার নাম পুফি।

অন্যজন চিরকুমার। তবে তারও একটি বিড়াল আছে। বিড়ালটার নামও কুফি।

বরকতউল্লাহ নামের একজনকে আমি দেখলাম তারও মনে হয় দুটি সত্তা। এক জায়গায় তিনি মৃত অন্য জায়গায় তিনি জীবিত।

এই উদ্ভট হাস্যকর ব্যাপার কল্পকাহিনীর জন্যে ঠিক আছে। আমার জন্যে ঠিক নেই। আমি কল্পকাহিনীর কোনো চরিত্র না।

মিসির আলি স্যারুকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আমি কি পাগল হয়ে গেছি?

স্যার বললেন, এখনো হও নি। তবে সম্ভাবনা আছে।

সম্ভাবনা যে আছে তা আমার মত কেউ জানে না। জোয়ার্দারের সঙ্গে আমার বিয়ের পাকা কথা হয়েছিল তারপর কুৎসিত অজুহাতে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। তখন একবার আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। লোক লজ্জার ভয়ে দেশে আমার কোনো চিকিৎসা করা হয় নি। আমাকে ইন্ডিয়ার রাঁচিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

কাজেই পাগলামীর বীজ আমার মধ্যে আছে। এটা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, কখনো কখনো জাগে।

আমি আমার ব্রেইনের সিটি স্কেন করিয়েছি। মস্তিষ্কের কিছু জায়গায় অতিরিক্ত কর্ম ব্যস্ততা (super activity) দেখা গেছে। মৃগীরোগীদের মধ্যে এ রকম দেখা যায়। আমার কি বিশেষ কোনো ধরনের মৃগী রোগ হয়েছে? যখন রোগের আক্রমন হয় তখন আমি অন্য জোয়ার্দারকে দেখতে পাই?

আমি মাঝে মাঝেই এজি অফিসে যাই। কখনো সেখানে দেখি বরকতউল্লাহ সাহেব বেঁচে আছেন কখনো দেখি বরকতউল্লাহ সাহেব বেঁচে নাই। দুটি সম্পূৰ্ণ আলাদা এজি অফিস।

মিসির আলি স্যার বললেন, তুমি যে এজি অফিসে বরকতউল্লাহ জীবিত সেখান থেকে একটা খবরে কাগজ আনবে এবং যেখানে বরকতউল্লাহ সাহেব মৃত সেখান থেকে একটা খবরের কাগজ আনবে।

আমি তা করেছি। দেখা গেছে একটা খবরের কাগজ মিরর ইমেজ। পুরোটা উল্টা করে লেখা। আয়নার সামনে ধরলেই শুধু পড়া যায়।

এর মানে কি? আমি মিসির আলি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, একজন মানুষের পক্ষে কি একই সময় দুটি ভিন্ন সত্তায় যাওয়া যায়?

স্যার বললেন যাওয়া যায়। মনে কর তুমি স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নে তুমি জেগে৷ তোমার মার সঙ্গে গল্প করছি। এখন তোমার দুটি সত্তা হয়ে গেল। একটিতে তুমি ঘুমোচ্ছ একটিতে তুমি জেগে আছ।

আমি বললাম, একজন জোয়ার্দার সত্যি আছেন, আরেকজনকে আমি স্বপ্নে দেখছি এ রকম কি হতে পারে?

স্যার বললেন, হতে পারে। চিরকুমার জোয়ার্দার হয়তো তোমার ব্রেনের সৃষ্টি। তার প্রতি তীব্র আবেগের কারণে ব্রেইন এই খেলাটা খেলাচ্ছে তবে কিন্তু আছে।

কি কিন্তু?

মিরর ইমেজগুলি কিন্তু। তুমি খবরের কাগজের মিরর ইমেজ এনেছ এর অর্থ তুমি স্বপ্নের জগৎ থেকে একটা কাগজ নিয়ে এসেছি। এটা কোনো ক্রমেই সম্ভব না। প্রকৃতি এ ধরনের কিছু ঘটতে দেবে না।

আমি বললাম, স্যার আমি কি এই বিষয়টা জোয়ার্দারের সঙ্গে আলাপ করব?

স্যার বললেন, করতে পাের। দুই জোয়ার্দারের সঙ্গেই আলাপ করবে। কে কি ভাবে নিচ্ছে তা দেখবে। তোমার সমস্যা সমাধানের জন্যে এদেয়। দুজনেরই সাহায্য লাগবে।

এর মধ্যে চিরকুমার জোয়ার্দার এক রাতে তার সঙ্গে খেতে বলল। সে নিজেই রাধবে। একা থাকার কারণে তার রান্নার হাত না-কি খুলেছে। সন্ধ্যা মিলাবার পর পর তার বাসায় গেলাম। বেল টিপতেই বাচা একটা মেয়ে দরজা খুলল। তার হাতে বিড়াল।

আমি বললাম, তোমার নাম অনিক?

অনিকা বলল, হ্যাঁ। আর এর নাম পুফি।

তোমার বাবা বাসায় নেই?

না। মাকে নিয়ে নিউমার্কেট কাচা বাজারে গেছেন। আমাদের চাল শেষ হয়ে গেছে। এই জন্যে। আমরা মিনিকেট চাল খাই। আপনি মিনিকেট চাল চেনেন?

না।

মিনিকেট চাল কি ভাবে বানানো হয় তা জানেন?

না।

মোটা চালকে মেশিনে কেটে চিকন বানানো হয়। একে বলে মিনিকাট। মিনিকাট থেকে এসেছে মিনিকেট।

বাহ্‌ তুমিতো অনেক কিছু জান।

কুকুর এবং বিড়ালের মধ্যে তফাৎ জানেন?

কিছুটা জানি। তুমি কি জান বল শুনি।

কুকুরকে যখন খাবার দেয়া হয় তখন কুকুর ভাবে মানুষ আমাদের দেবতা। এই জন্যে মানুষ আমাদের খাওয়াচ্ছে। আর বিড়ালকে যখন খাবার দেয়া হয় তখন বিড়াল ভাবে আমরা মানুষের দেবতা এই জন্যে মানুষ আমাদের যত্ন করছে!

সুন্দরতো। কার কাছে শুনেছ?

আমাদের মিসের কাছ থেকে। মিসের নাম শিরিন। আমরা তাকে ডাকি বি শিরিন।

বি শিরিন কেন?

উনি বাঁটকুতো এই জন্যে বি শিরিন। বাঁটকু শিরিন থেকে বি শিরিন।

মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে আমার হৃদয় হাহাকারে পূর্ণ হল। এই চমৎকার মেয়েটাতো আমারো হতে পারত।

অনিকা বলল, আপনি কি বাবার জন্যে অপেক্ষা করবেন?

আমি বললাম, না। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাব।

চা খাবেন? আমি চা বানাতে পারি। বসার ঘরে বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি।

মেয়েটির বসার ঘরে বসলাম। এই ঘর আমি ছবিতে দেখেছি। দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে।

মোবাইল ফোনের ক্যামেরা অপসান দিয়ে ক্যালেন্ডারের ছবি তুললাম। ক্যালেন্ডারের লেখা ছবিতে উল্টা এল। মিরর ইমেজ। কি হচ্ছে এসব?

বাসায় ফিরে হুইস্কির বোতল খুলে বসলাম। পেগের পরে পেগ খাচ্ছি, নেশা হচ্ছে না।

রাত একটার দিকে আমার কাছে টেলিফোন এল। জোয়ার্দার টেলিফোন করেছে। সে বলল, আমি তোমার জন্যে রান্না করেছি। তুমি আসিনি কেন? কোন সমস্যা?

সমস্যাতো বটেই। এই সমস্যা আমি নিতে পারছি না। আমি কি করব তাও বুঝতে পারছি না। Is there any one who can help. God of God! Help me please.

মিসির আলি আতংকিত

মিসির আলি আতংকিত গলায় বললেন, তোমার একি অবস্থা! কি সর্বনাশ!

শায়লাকে চেনা যাচ্ছে না। তার ওজন কমেছে আঠারো পাউণ্ড। গালের হাড় বের হয়ে গেছে। চোখ গর্তে ঢুকে গেছে। চোখের চারদিকে কালি। শায়লা কাদো কাদো গলায় বলল, স্যার আমি কিছু খেতে পারছি না। রাতে ঘুমাতে পারছি না। আমার ভার্টিগো হয়েছে। চারদিকে সব কিছু ঘুরছে।

মিসির আলি বললেন, আমি পানিতে ভিজিয়ে টাওয়েল এনে দিচ্ছি। চোখের উপরে ভেজা টাওয়েল চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাক এবং মনে মনে বল, আমি ঠিক হয়ে গেছি। আমি ঠিক হয়ে গেছি। ভাটিগোর ক্ষেত্রে অটো সাজেশনে খুব ভাল কাজ করে।

স্যার আমার কোনো কিছুই কাজ করবে না। আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এই যন্ত্রণায় আমি থাকব না।।

কোথায় যাচ্ছ, কবে যাচ্ছ?

মঙ্গলবার বিকেলে আমার ফ্লাইট। যাচ্ছি ইংল্যান্ড। সেখানে আমার বড় চাচা আর চাচী থাকেন। তাদের সঙ্গে থাকব। সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাচ্ছি। তাতেও ভয় কাটছে না।

ভয় কাটছে না কেন?

আমার মনে হচ্ছে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে দেখব জোয়ার্দার আমাকে নিতে এসেছে। তার সঙ্গে বের হয়ে দেখব। আরেকজন জোয়ার্দার কালো বিড়াল কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মিসির আলি হেসে ফেললেন।

চোখে ভেজা টাওয়েল এবং সেলফ হিপনোসিসে কিছুটা কাজ হয়েছে। শায়লা আগের চেয়ে ভাল বোধ করছে। তার মাথাও ঘুরছে না।

মিসির আলি বললেন, তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কিছু তথ্যও জোগাড় করেছি।

শায়লা বলল, স্যার আমি এই বিষয়ে আর কোনো কিছুই শুনতে চাচ্ছি। না। আমি আপনার কাছে এসেছি বিদায় নিতে। আমি সব কিছু থেকে হাত ধুয়ে ফেলেছি।

মিসির আলি বললেন, তুমি চেষ্টা করলেও হাত ধুতে পারবে না। পালিয়ে গিয়েও লাভ হবে না।

পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমি করব কি?

Reality face করবে।

শায়লা বলল, কোনটা রিয়েলিটি? চিত্র কুমার জোয়ার্দার রিয়েলিটি না-কি স্ত্রী কন্যা নিয়ে নিয়ে যে জোয়ার্দার বাস করছে সে রিয়েলিটি?

তুমি দুজন জোয়ার্দারকে দেখছ তোমার কাছে দুজনই রিয়েলিটি। তোমার শুনলে ভালো লাগবে যে এরকম সমস্যায় তুমি একা পড় নি। অনেকেই পড়েছে।

শায়লা বলল, পাগলা গারদে যারা আছে তারা হয়ত পড়েছে। পাগলদের কাছে রিয়েলিটি বলে কিছু নেই। কিন্তু স্যার আমিতো পাগলা গারদের বাসিন্দা না।

মিসির আলি বললেন, পাগলা গারদের বাসিন্দা না হয়েও অনেকে রিয়েলিটি সমস্যায় পড়েছে। তিনটা ডকুমেন্টেড উদাহরণ আমি তোমাকে দিতে পারি।

শায়লা বলল, স্যার আমি কিছু শুনব না। ডকুমেন্টেড গল্প শুনেতো আমার সমস্যার সমাধান হবে না।

মিসির আলি বললেন, শুনতে না চাইলে শুনবে না। তবে আমি মনে করি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে রিয়েলিটির নতুন ব্যাখ্যা তোমার শোনা উচিত।

শায়লা হতাশ গলায় বলল, আচ্ছা আমি শুনছি। আপনি বলুন।

চা বানিয়ে আনি? চা খেতে খেতে শোন।

আচ্ছা। আর টোস্ট বিসকিট থাকলে আনুন। প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। গালিক টোস্ট উইথ চিজ।

টেস্ট বিসকিট নেই। তুমি তোমার ড্রাইভারকে পাঠাও তোমার জন্যে এক বাটি সুপ নিয়ে আসবে। তোমার খাওয়া দরকার।

শায়লা আধশোয়া হয়ে চেয়ারে বসা। তার চোখে ভেজা টাওয়েল। পুরো এক বাটি সুপ সে কিছুক্ষণ আগে খেয়ে শেষ করেছে। তার সামনে চায়ের কাপ। সে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে না।

মিসির আলি বললেন, তোমার যদি ঘুম পেয়ে থাকে তাহলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও।

শায়লা বলল, আমি ঘুমাব না। আপনি কি বলবেন বলুন। আমি মন দিয়ে শুনছি।

মিসির আলি বললেন, সারা পৃথিবীতেই গীর্জা হচ্ছে রেকর্ড কিপিং এর জায়গা এটাতো জান?

জানি। গীর্জা জন্ম মৃত্যুর রেকর্ড রাখে।

জন্ম মৃত্যু ছাড়াও বড় বড় ঘটনার রেকর্ডও রাখা হয়। ছয় শ বছর আগে একটা সুপার নোভার এক্সপ্লোশন হয়ে ছিল। রাতের বেলাতেও তখন পৃথিবীতে দিনের মত আলো থাকত। মনে হত আকাশে দুটি সূর্য। এই ঘটনাও আমরা পেয়েছি গীর্জার রেকর্ড থেকে। শায়লা! তুমি শুনছ না ঘুমিয়ে পড়েছ?

শায়লা মুখ থেকে টাওয়েল সরাল। সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, আমি খুব মন দিয়ে শুনছি।

মিসির আলি বললেন, রেকর্ড রাখার দায়িত্ব চার্চের ফাদারের তবে তিনি ছাড়াও কেউ যদি বিশেষ কোনো ঘটনা জানাতে চাইত তাও পারত।

১৮৬৭ সনে আমেরিকার মন্টানা ষ্টেটের চার্চে জন উইলিয়াম স্মীথ নামের এক ভদ্রলোক তার জীবনের একটি বিশেষ ঘটনা লিখে জমা দেন। ঘটনা তিনি যেভাবে লিখে গেছেন সেভাবে পড়ি। না-কি তুমি নিজে পড়বে।

আমি নিজে পড়ব।

মিসির আলি একটি বই এগিয়ে দিলেন। বইটির মাঝামাঝি জায়গায় পেজ মার্ক দেয়া আছে। বইটার নামে The Oxford book of the Supernatural লেখক D. J. Enright. বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯০২ সনে, প্রকাশক Oxford University Press.

জন উইলিয়াম স্মীথ লিখেছেন ইংরেজিতে। তার বাংলা ভাষ্য–

আমি জন উইলিয়াম স্টীথ। মন্টনার বনের ভেতর আমার একটা খামার বাড়ি আছে। তিনশ একর জমি ইজারা নিয়ে আমি এই বাড়িতে বাস করি। আমার সঙ্গি একটা কুকুর। কুকুরটার নাম লং টেইল। তার লেজ অস্বাভাবিক লম্বা বলেই এই নাম। আমি লগা হাউসে এক বাস করি। লগ হাউসহদের কাছে ॥হদ থেকে ট্রাউট মাছ ধরি। বনের ভেতরে শিকারের জন্যে প্রচুর প্রাণী আছে। একটা হরিণ মারলে অনেক দিন যায়।

আমি এক মানুষ আমার প্রয়োজন সামান্য। একদিনের কথা, মধ্য দুপুর। বনের ভেতর থেকে মৌচাক ভেঙ্গে লগা হাউসে ফিরছি। আমার সঙ্গে লিং টেইল নেই। সে খরগোস তাড়া করতে গিয়ে কাটা বিধে ব্যথা পেয়েছে। আমি মধু নিয়ে যাচ্ছি তার ক্ষত স্থানে লাগানোর জন্যে।

দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকে আমি হতভম্ব। সাত আট বছরের একটি কিশোৱী লং টেইলের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। অবিকল কিশোরীর মত দেখতে এক তরুণী ফায়ার প্লেসের সামনে কাঠ জড় করছে। এরা দুজন আমাকে দেখে অবাক হল না বা চমকাল না। মেয়েটি বলল, পাপা মধু এনেছ? লং টেইলের কাটা জায়গায় আমি মধু দিয়ে দেব।

এলিজাবেথের জন্যে ড্রেস কিনতে হবে।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে এলিজাবেথ নামের এই কিশোরী আমার মেয়ে। তরুণী আমার স্ত্রী এটা কি করে সম্ভব?

হলি ফাদার এবং হোলি ঘোস্টের নামে শপথ আমি যা লিখছি সবই সত্য। এর মধ্যে কোনো অতিরঞ্জন নেই।

অবিবাহিত মানুষের লগ হাউস আর বিবাহিত মানুষের লগ হাউসে কিছু পার্থক্য থাকে। এখন আমার লগ হাউস বিবাহিত মানুষদের ঘর ভর্তি মেয়ে এবং তার মেয়ের জিনিষ।

আমি এদের কাছে নিজের কথা কিছুই বললাম না। এদেরকে আমি সঙ্গে সঙ্গে গ্ৰহণ করে নিলাম। আমার স্ত্রীর নাম মার্থ। তার গর্ভে আমার একটি পুত্ৰ সন্তান হল। পুত্রের নাম দিলাম মার্শাল।

এক শীতের রাতের কথা। প্রচুর বরফ পড়ছে। মার্শাল তার বোনের কোলে এলিজাবেথ ফায়ার প্লেসে আগুন দিয়েছে। আগুনের পাশে লং টেইল থাবা মেলে বসে আছে। লং টেইল জীবনের শেষ প্রান্তে উপস্থিত।

সে মৃত্যুর অপেক্ষায়। আমার সঙ্গে শিকারে যাওয়া বন্দুক! আমি বন্ধুক নিয়ে বের হচ্ছি। ঘরে মাংস নেই। হরিণ পাওয়া গেলে হরিণের মাং বরফের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে হবে। শীতের খাদ্য সঞ্চয়।

মার্থী বলল, যে ভাবে বরফ পড়ছে তুমি যেও না। ফায়ার প্লেসের সামনে মার্শলিকে কোলে নিয়ে বস। এসো আমরা গল্প করি।

আমি তার কথা শুনলাম না। বন্দুক নিয়ে বের হলাম। একটা বন্য ছাগল মেরে ঘরে ফিরে দেখি কেউ নেই। শুধু লং টেইল মরে পড়ে আছে। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে না। আমার ছেলে মেয়ে এবং তাদের মার কোনো কাপড় চোপড়ও নেই। আমি ফিরে গেছি। অবিবাহিত পুরুষের জীবনে।

এর পত্নী আমি আর পরিবারের দেখা পাই নি। বৎসরের পর বৎসর অপেক্ষা করেছি। কোনো একদিন লগা হাউসে ঢুকে দেখব সবাই আছে।

শায়লা পড়া শেষ করে বলল, জন স্মিথের এই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা কি কেউ দিয়েছে?

মিসির আলি বললেন, একটা ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, জন স্মিথ ছিলেন নিঃসঙ্গ মানুষ। তিনি তার পরিবার কল্পনা করে নিয়েছেন। কল্পনাকেই রিয়েলিটি ভেবেছেন। এই রিয়েলিটির একটা নাম আছে SCR অর্থাৎ Self Created Reality.

শায়লা বলল, এই ব্যাখ্যা আমার কাছে যথেষ্টই যুক্তি যুক্ত মনে হচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, ভুল ব্যাখ্যা। লং টেইলের মৃত্যুর পর জন স্মিথ আরো নি:সঙ্গ হয়েছে। এই অবস্থায় কল্পনার পরিবার তার কাছে ফিরে আসার কথা কিন্তু আসে নি।

শায়লা চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, আমার ধারণা লং টেইল কুকুরটা জন স্মিথের ডাবল রিয়েলিটির সঙ্গে যুক্ত। কুকুর নেই ডাবলী রিয়েলিটিও নেই।

শায়লা বলল, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন জোয়ার্দারের পুফি বিড়ালটা তার ডাবল রিয়েলিটির সঙ্গে যুক্ত? পুফি না থাকলে ডাবল রিয়েলিটি থাকবে না?

ঢাকা শহর বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল

রঞ্জু সুলতানার ফ্ল্যাটে এসেছে। তার হাতে ব্যান্ডেজ, চোখের নিচে ব্যান্ডেজ। রঞ্জর ভাবভঙ্গিতে প্ৰবল অস্থিরতা। সুলতানা বললেন, তোকে আবার বিড়াল কামড়েছে?

হুঁ।

কখন কামড়েছে?

রাতে। চোখে আঁচড় দিতে চেয়েছিল। নখ দিয়ে থাবা দিতে গিয়েছে। আমি খপ করে পা চেপে ধরায় রক্ষা। অনিকা কোথায়?

স্কুলে।

তার বিড়ালটা আছে না?

আছে।

গুড ভেরি গুড। পুফি পুফি। কাম হিয়ার লিটল ডার্লিং।

পুফি ঘরে ঢুকল। সুলতানার পায়ের কাছে বসল। রঞ্জ বলল, বিড়ালটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে লক্ষ করেছ?

হ্যাঁ।

রঞ্জ বলল, এতদিন ধারণা ছিল দুলাভাইয়ের বিড়াল আমাকে কামড়ায়। ঘটনা তা না। কাল রাতে বুঝতে পেরেছি। পুফি আমাকে কামড়ায়। পুফিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে কনফার্ম হলাম। গত রাতে তার একটা পা ভেঙে দিয়েছি।

সুলতানা বললেন, পাগলের মত কথা বলছিস বিড়াল কেন? এই বিড়াল রাতে গুলশানে যায় তোকে কামড়ে ফিরে আসে?

রঞ্জু বলল, হ্যাঁ। বিড়াল কি ভাবে যায় কি ভাবে ফিরে আসে তা আমি জানি না। বিড়াল যে এই পুফি সে ব্যাপারে। আমি নিশ্চিত। তাকিয়ে দেখ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যাচ্ছে! কি ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে দেখা। মনে হচ্ছে না। এক্ষুনি আমার উপর ঝাপ দিয়ে পড়বে?

তোর ভাবভঙ্গি আমার কাছে ভাল লাগছে না। তুই করতে চাস কি?

খুন করতে চাই। মানুষ খুন না, বিড়াল খুন। বুরু বাসায় হাতুড়ি আছে? আমাকে একটা হাতুড়ি দাও।

তুই চুপ করে বোস। মাথা ঠাণ্ডা কর।

রঞ্জু বলল, মাথা ঠাণ্ডা করে তুমি বসে থাক। আমাকে আমার কাজ করতে দাও। আজ এই বিড়ালটা না মারলে সে আমার দুই চোখ তুলে নিবা। এটা কি ভাল হবে?

রঞ্জু খাবার ঘরে ঢুকল। তার হাতে মাংস কাটার বড় ছুরি। রঞ্জু মধুর গলায় ডাকল, পুফি পুফি! কাম হিয়ার লিটল ডার্লিং।

সন্ধ্যা থেকে ঢাকা শহরে বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া। বঙ্গোপসাগরে ডিপ্রেসন হয়েছে। মানুষ তার ডিপ্রেসন্ন অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে না, সাগর পাড়ে। সাগর তার ডিপ্রেসন্ন স্থলভূমিতে ছড়িয়ে দেয়।

নিশ্চয়ই কোথাও বড় ধরণের ঝড় হচ্ছে ন্যাশনাল গ্রিড ফেল করেছে। ঢাকা শহর অন্ধকারে ডুবে আছে।

শায়লা এই ঝড় বৃষ্টির রাতে জোয়ার্দারের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে কাল ইংল্যান্ড চলে যাবে। আজ এসেছে বিদায় নিতে। এখন মনস্বীর করতে পারছে না। ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢুকবে কি ঢুকবে না।

কিছুক্ষণ আগেও জেনারেটর চলছিল। এখন জেনারেটর বন্ধ। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। শায়লা দরজায় ধাক্কা দিল। মোমবাতি হাতে দরজা খুললেন জোয়ার্দার। বিস্মিত গলায় বললেন, আরো তুমি!

শায়লা বলল, আসব?

আসব মানে। অবশ্যই আসবে। ঝড়বৃষ্টির রাতে তোমাকে দেখে এত অবাক হয়েছি। আমার মন ভয়ংকর খারাপ ছিল এখন মন ভাল হতে শুরু করেছে।

মন খারাপ ছিল কেন?

আজ অফিস থেকে ফিরে দেখি আমার বিড়ালটা রান্নাঘরে ময়ে পড়ে আছে। কেউ একজন তাকে মেরে ফেলেছে।

মেরে ফেলেছে মানে?

একটা ছুরি দিয়ে পেটের নড়িতুড়ি বের করে দিয়েছে। বিড়ালটার পাশে রক্তমাখা ছুরি পড়ে আছে।

এই কাজটা কে করেছে?

জোয়ার্দার বললেন, আমিও তাই ভাবছি। আমি একা মানুষ। কেউ যে ঘরে ঢুকবে সেটা সম্ভব না। আমি নিজের হাতে ঘরে তালা দিয়ে গিয়েছি অফিস থেকে ফিরে তালা খুলেছি।

বাতাসের ব্যাপটায় মোমবাতি নিভে গেছে। জোয়ার্দার দেয়াশলাই খুঁজে পাচ্ছেন না। শায়লা বলল, দেশলাই পরে খুঁজবেন। আগে আমাকে কোথাও বসার ব্যবস্থা করে দিন। আমার খারাপ। ভার্টিগো সমস্যা। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা।।

জোয়ার্দার বললেন, হাত ধরে তোমাকে নিয়ে গেলে কি কোন সমস্যা হবে?

শায়লা বলল, না। সমস্যা হবে না। আপনি আমার হাত ধরুন।

বসার ঘরে জোয়ার্দার এবং শায়লা মুখোমুখি বসে আছে। ঘর অন্ধকার। তুমুল ঝড় শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুতের আলোয় শায়লার করুণ হতাশ চেহারা মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে।

জোয়ার্দার বললেন, তোমার শরীর এত খারাপ করেছে কেন?

শায়লা বলল, আপনার বিড়ালটার জন্যে। বিড়াল গেছে এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।

জোয়ার্দার বললেন, তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

শায়লা বলল, আমিও বুঝতে পারছি না।

জোয়ার্দার বললেন, তোমার গায়ে যে অনেক জ্বর এটা জান?

জানি।

এত জ্বর নিয়ে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ফিরবে কি ভাবে? গাড়ি এনেছ?

না। আমি এখানেই থাকব। আপনাকে আর চোখের আড়াল করব না। চোখের আড়াল করলে যদি অন্য রিয়েলিটিতে চলে যাই।

জোয়ার্দার বললেন, শায়লা! তোমার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না।

শায়লা বলল, জ্বরের ঘোরে। আমি ভুল বকছি। এই জন্যে আমার কথা বুঝতে পারছেন না। দয়া করে আপনি আমার হাত ধরে পাশে বসে থাকুন। আর আপনার যদি আমার হাত ধরতে লজ্জা লাগে তাহলে আমি হাত ধরে বসে থাকব। লজ্জা করার বিলাসিতা এখন আমার আর নেই।

জোয়ার্দারশায়লার পাশে এসে বসলেন। ঢাকা শহর বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল।

(সমাপ্ত)

No comments