রোবট আলভিন ও কাচ্চি বিরিয়ানি – নিশাত সুলতানা

রোবট আলভিন ও কাচ্চি বিরিয়ানি – নিশাত সুলতানা

টানা কয়েক মাস অপেক্ষার পর অবশেষে কুকিং রোবট ‘আলভিন’ আজই ডিএইচএলে রুমিদের বাসায় পৌঁছেছে। সেই কবে রুমির বাবা, মির রেজা রোবটটি অর্ডার দিয়েছিলেন চীনা কোম্পানি ডিনোভা থেকে! রোবটটি বাংলাদেশে পৌঁছাতে প্রায় তিন মাস সময় লেগে গেল। তবু ভালো যে রোবটটি শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছে। রুমি, মির রেজার একমাত্র মেয়ে, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আজ রুমি ভীষণ খুশি! জীবনে এই প্রথমবার আনন্দের কোনো ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছে সে। রুমি লক্ষ করেছে, বাসায় যেকোনো ভালো ঘটনার সময় সে স্কুলে থাকে। এটা নিয়ে রুমির দুঃখের সীমা নেই।

রুমির মা ফারজানা খান, মাস ছয়েক হলো দেশের বাইরে আছেন। অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করছেন তিনি। রান্নার কাজটি যে এত কঠিন, সেটা ফারজানা খান দেশে থাকতে মির রেজা কখনোই বোঝেননি। তবে রুমি নিয়মিতই মাকে সাহায্য করত। ফারজানা খান অনেকবার মির রেজাকে বলেছিলেন কিছু রান্না শিখে নিতে। কিন্তু মির রেজার এককথা, ‘চাপ নিয়ো না প্লিজ। প্রয়োজন হলে ইউটিউব দেখে রান্না শিখে নেব।’ ফারজানা চলে যাওয়ার পর মাসখানেক ইউটিউব দেখে রান্নার চেষ্টাও করেছিলেন মির রেজা। কিন্তু কয়েক দিনেই হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। ভিডিও ছেড়ে রান্না করতে গেলে দেখা যায় সব উপকরণ হাতের কাছে নেই। বারবার ভিডিও থামিয়ে উপকরণ জোগাড় করতে ভীষণ বিরক্ত লাগে। আরেকটি যন্ত্রণা হলো, এই সব রেসিপি কিছুতেই মনে থাকে না তাঁর। বাড়িতে রান্নার জন্য একজন সাহায্যকারী নেওয়ারও চেষ্টা করেছেন খুব। কিন্তু সে আরেক বিড়ম্বনা। সাহায্যকারীরা এক দিন এলে তিন দিন আসেন না। আবার এই নিয়ে কিছু বললেই পরদিন থেকে কাজে আসাই বন্ধ করে দেন তাঁরা। সব সমস্যার সমাধানে একটি কুকিং রোবট কেনারই সিদ্ধান্ত নিলেন মির রেজা।

রোবটে কানেকশন দেওয়ার সময় রুমিদের সে কী উত্তেজনা! অতি গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা দেখতে ভিডিও কলে আছেন রুমির মা। কানেকশন দিতেই রোবট পোঁ পোঁ শব্দ করতে লাগল আর রোবটের মাথার ওপর ছোট্ট অ্যানটেনায় লাল বাতি জ্বলে উঠল। এরপর রোবটটি জোরে মোচড় দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হ্যালো স্যার। আই অ্যাম আলভিন, দ্য কুকিং রোবট। হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু কুক?’ রোবট সাড়া দিচ্ছে দেখে সবার সে কী উত্তেজনা! রুমির বাবা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘বয়েলড ওয়াটার প্লিজ।’ আলভিন বড় বড় পা ফেলে থপথপ করে রান্নাঘরের দিকে এগোতে লাগল। আর রুমিরা ছুটল রোবটের পেছন পেছন রান্নাঘরের দিকে।

হঠাৎ রান্নাঘরের দরজায় চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল আলভিন। মির রেজার মনে পড়ল, রোবটে রান্নার ইনপুট দিতে হবে। রান্নার রেসিপি ইনপুট না দিলে রোবট রান্না করবে কীভাবে! দ্রুত রোবটের মেমোরিতে ইনপুট দিলেন তিনি। আর তক্ষুনি কাজ শুরু করল আলভিন। সহজ রেসিপি দিয়েই শুরু হলো প্রথম দিন। আলভিন আলুভর্তা, ডিমভাজি আর ডাল রান্না করে চমকে দিল।

এক মাস হতে চলল আলভিন রুমিদের বাসায় এসেছে। এই এক মাসে আলভিন রুটি বানানো থেকে শুরু করে মাছের ঝোল, চচ্চড়ি, ভর্তা, ভাজি, শুঁটকি, খিচুড়ি, বিরিয়ানিসহ অনেক রান্না শিখে ফেলেছে। আরও শিখেছে বার্গার, পিৎজা আর পাস্তা বানানো। আলভিনকে নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটছে রুমিদের।

হঠাৎ একদিন কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা হলো রুমির। কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না তো কম ঝক্কির কাজ নয়। এত্ত এত্ত উপকরণ লাগে! কাচ্চি রান্নার মসলা বাসায় থাকলেও টক দই আর খাসির মাংস বাসায় ছিল না। তাই মির রেজা ঝটপট অনলাইনে টক দই আর খাসির মাংসের অর্ডার দিলেন। সব উপকরণ বাসায় এলে রান্না শুরু করল আলভিন। কাচ্চি রান্না শেষ হতে না হতেই রান্নার সে কী ম–ম গন্ধ! আলভিনের সব রান্নাই অসাধারণ। তবে কাচ্চি রান্নার জবাব নেই। এমন মজাদার কাচ্চি এর আগে কখনো খায়নি রুমিরা। পেট পুরে কাচ্চি খেল তারা। পেট পুরে খাওয়ার পর অবশিষ্ট কাচ্চি ফ্রিজে রেখে দিল তারা পরদিন খাবে বলে।

পরদিন ফ্রিজ থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি বের করতে গিয়ে ঘটল এক আজব ঘটনা। ফ্রিজ থেকে কাচ্চির বাক্স বের করে মির রেজা দেখলেন, বাক্স পুরো খালি। একটি দানাও নেই সেখানে। তাজ্জব ব্যাপার! মির রেজা রুমিকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কাচ্চি খেয়েছে কি না! রুমি বলল, ‘না বাবা। আমি খাইনি।’ তাহলে কাচ্চি খেল কে?

পরদিন ঘটল আরও অবাক করা ঘটনা। রুমিকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসতেই মির রেজা টের পেলেন, বাসায় আবার কাচ্চি রান্না হয়েছে। অবাক কাণ্ড! আলভিনের তো মাছের ঝোল রান্না করার কথা। কোথাও কি তাহলে ভুল হয়েছে তার? নিশ্চয়ই কাচ্চি রান্নার নির্দেশনা পাল্টাতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। যা–ই হোক, ভুল হয়ে একদিকে ভালোই হয়েছে। প্রায় অর্ধেক সসপ্যান কাচ্চি বিরিয়ানি সাবাড় করে দিলেন তাঁরা। এরপর বেশ ভালো একটা ঘুম দিলেন। ঘুম থেকে উঠে আলভিনকে চা বানানোর নির্দেশ দিতে রান্নাঘরে যেতেই চোখ কপালে উঠল মির রেজার। রান্নাঘরে রাখা কাচ্চি বিরিয়ানির সসপ্যান পুরো খালি। মির রেজা এইবার বুঝে গেলেন, কাচ্চির গায়েব হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই হাত আছে আলভিনের। খুব সম্ভবত কাচ্চির স্বাদের প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু সে কী করে সম্ভব! রোবটরা খেতে পারে নাকি! আর খেলে তো টয়লেট হওয়ার কথা। কিন্তু আলভিন টয়লেটে যাচ্ছে এমন দৃশ্য তো দেখা যায়নি! তার মানে সে হয়তো কাচ্চির পুরোটাই হজম করে ফেলছে! প্রমাণের অপেক্ষায় থাকলেন মির রেজা। আর বাসায় কাচ্চি রান্নার কোনো উপকরণ যেন না থাকে, সেটিও নিশ্চিত করলেন তিনি।

পরদিন আরও বিস্মিত হওয়ার পালা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই কাচ্চি রান্নার প্রায় সব উপকরণসহ হোম ডেলিভারি এল। মির রেজা তো অবাক! জানতে চাইলেন, ‘কে অর্ডার করেছে এসব?’ ডেলিভারম্যান একগাল হেসে তাকে একটি নম্বর দেখাল। কী আশ্চর্য! নম্বরটি তো রুমির। এদিকে রুমি বলছে সে কিছুই জানে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আলভিনই রুমির মুঠোফোন থেকে অনলাইনে জিনিসগুলো অর্ডার করেছে। চিন্তিত মুখে মির রেজা টাকা দিয়ে ডেলিভারিম্যানকে বিদায় দিলেন।

রান্নাঘরে কাচ্চি রান্নার উপকরণগুলো রাখতেই অদ্ভুত চঞ্চলতা দেখা গেল আলভিনের মধ্যে। সে দ্রুত কাচ্চি রান্না শুরু করে দিল। মির রেজার স্পষ্ট মনে আছে, তিনি আলভিনকে রুটি আর সবজি রান্নার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ তিনি দেখলেন, রোবটের নির্দেশনা স্ক্রিনে রুটি–সবজির পরিবর্তে ‘কাচ্চি বিরিয়ানি’ উজ্জ্বল লাল রঙে হাই প্রায়োরিটি হিসেবে জ্বলজ্বল করছে।

অবশেষে বিরিয়ানি খেতে গিয়ে ধরা পড়ল আলভিন। রুমিই প্রথম টের পেল বিষয়টা। পড়ার ফাঁকে চিপসের প্যাকেট নিতে রান্নাঘরে ঢুকতেই থমকে গেল সে। রুমি দেখল, আলভিন তার যান্ত্রিক শরীরের চেম্বারে থাকা একটি চামচ দিয়ে দিব্যি পাতিল থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি নিয়ে খাচ্ছে। বিরিয়ানি তো বটেই, মাংসের হাড়হুড্ডি পর্যন্ত সে চিবিয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে। রুমি দ্রুত তার বাবাকে ডেকে আনল। এবার তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না, কাচ্চি নিয়ে অদ্ভুতুড়ে সব কাণ্ডের পেছনে রয়েছে আসলে আলভিন। পরের দিনগুলোয়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকল। তবে ভালো ব্যাপার হলো, আলভিনের রান্না করা কাচ্চি বিরিয়ানি বাজারের যেকোনো কাচ্চি বিরিয়ানির চেয়ে ভালো। আর আলভিন কখনো পাতিল সাবাড় করে কাচ্চি খায় না। সে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণেই কাচ্চি খায়।

রোবটের কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ার বিষয়টি ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলল মির রেজাকে। তিনি রোবট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ডিনোভাকে বিষয়টি জানালেন। ডিনোভা উত্তরে জানাল, এমন আজব ঘটনা তারা এর আগে কখনো শোনেনি। তারা মির রেজাকে অনুরোধ করল, তিনি যেন আলভিনকে খুব দ্রুত তাদের কাছে ফেরত পাঠান। তারা বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে চায়। এমনকি তারা আলভিনকে কেনার পুরো টাকাও ফেরত দিতে প্রস্তুত।

আলভিনকে ফেরত পাঠানোর কথা শুনে ভীষণ মন খারাপ হলো রুমির। মির রেজারও ভালো লাগছে না কিছু। আলভিনের কাচ্চি খাওয়ার বিষয়টি রহস্যময় বটে, তবে আলভিন তাঁদের জীবনকে সহজ করেছিল। আলভিনের রান্না অসাধারণ! কেমন মায়া পড়ে গেছে আলভিনের ওপর। এমন রোবটকে ফেরত পাঠানো যায়?

‘আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমরা আলভিনকে সঙ্গে নিয়ে একটা কাচ্চি বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট দিতে পারি না?’ ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে বললেন রুমির মা। ‘দারুণ আইডিয়া! এভাবে তো ভেবে দেখিনি,’ বললেন মির রেজা। তাঁরা ঠিক করলেন, আলভিনকে তাঁরা ফেরত পাঠাবেন না ডিনোভার কাছে। বরং কাচ্চি বিরিয়ানির একটা দোকান দেবেন; যেখান থেকে আলভিনের অসাধারণ কাচ্চি বিরিয়ানির স্বাদ পাবে সবাই। রুমি চট করে রেস্টুরেন্টের নামটিও ঠিক করে ফেলল। রেস্টুরেন্টের নাম, ‘দ্য রোবটস কাচ্চি হাউস’।

No comments