শার্লক হোমস: দ্য রেড-হেডেড লিগ
গত বছর শরতের ঘটনা। গিয়েছিলাম বন্ধু শার্লক হোমসের সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখি লালমুখো, মোটাসোটা এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপে মগ্ন ও। লোকটার মাথার চুল আগুনের মতো লাল। আমাকে দেখে হোমস সহাস্য বলল, ‘সময়মতো চলে এসেছ, ওয়াটসন। বসো।’
তারপর নতুন মক্কেলকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি মি. জ্যাবেজ উইলসন, দারুণ একটা কেস নিয়ে এসেছেন। এমন অদ্ভুত, অস্বাভাবিক ঘটনার কথা ইদানীংকালে আর শুনিনি। যাকগে, মি. উইলসন, দয়া করে গোটা ব্যাপারটা আরেকবার গোড়া থেকে বলুন। ডা. ওয়াটসনও শুনে নিল, আমিও কাহিনিটা বিশ্লেষণ করে নিলাম।’
বুক ফুলিয়ে একটা নিশ্বাস ফেললেন আমাদের মক্কেল। তারপর একটা ময়লা, দুমড়ানো খবরের কাগজ বের করলেন কোটের পকেট থেকে। ওটা হাঁটুর ওপর মেলে ধরে একটা বিজ্ঞাপন দেখতে লাগলেন।
ভদ্রলোকের পোশাক–আশাক, হাবভাবে একটা জাঁক আছে। সাধারণ ইংরেজ ব্যবসায়ীদের মতোই। পরনে ধূসর ডোরাকাটা ট্রাউজার। ময়লা বোতামখোলা কালো ফ্রক-কোট। আর পেতলের ভারী অ্যালবার্ট চেইন লাগানো ওয়েস্টকোট। একটা ফুটো করা চৌকো ধাতুর মুদ্রা ঝুলছে ওয়েস্টকোট থেকে।
আচমকা আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে হোমস বলল, ‘মি. উইলিয়ামস একসময় প্রচুর পরিশ্রম করতেন। নিয়মিত নস্যি নেন। উনি ফ্রিম্যাসন। চীনেও গিয়েছিলেন। ইদানীং বেশ লেখালেখি করছেন। ব্যস, আমিও এর বেশি আন্দাজ করতে পারছি না।’
ওর কথা শুনে চমকে উঠলেন মি. উইলসন। সবিস্ময় বললেন, ‘আপনি এসব জানলেন কী করে, মি. হোমস? সত্যিই আমি একসময় প্রচুর পরিশ্রম করতাম। প্রথম জীবনে জাহাজে ছুতার মিস্ত্রির কাজ করেছি।’
—আপনার হাতই জানিয়েছে,’ জবাব দিল হোমস, ‘আপনার ডান হাতটা বাঁ হাতের চেয়ে বড়। ওই হাত দিয়ে আপনি কাজ করেছেন, তাই ওটার পেশি বেড়েছে বেশি।
—কিন্তু নস্যি, ফ্রিম্যাসন—ওসব?
—নস্যি তো নাক দেখলেই বোঝা যায়। আর ফ্রিম্যাসন বুঝলাম আপনার ব্রেস্টপিন দেখে।
—লেখার ব্যাপারটা?
—আপনার ডান হাতার কাফটা পাঁচ ইঞ্চিজুড়ে চকচক করছে। আর লেখার সময় বাঁ হাতের কনুইয়ের যেখানটা টেবিলের ওপর রাখতে হয়, ওখানে কালচে দাগ পড়ে গেছে। ডান কবজিতে একটা মাছের উল্কি আঁকিয়েছেন। মাছের আঁশগুলো বিশেষ কৌশলে লাল রং করা। কৌশলটা কেবল চীনারাই ব্যবহার করে। তা ছাড়া আপনার ঘড়ির চেইনে লটকানো চীনা মুদ্রাটাও গলা ফাটিয়ে জানান দিচ্ছে, চীনের জল-হাওয়া খেয়ে এসেছেন আপনি।
হোমসের ব্যাখ্যা শুনে চমৎকৃত হলেন মি. জ্যাবেজ উইলসন। তারপর খবরের কাগজের একটা কলাম দেখিয়ে বললেন, ‘এই দেখুন, এই বিজ্ঞাপন থেকেই সব গোলমালের শুরু।’
ভদ্রলোকের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলাম আমি:
‘লালচুলো সংঘের প্রতি,
যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী প্রয়াত এজেকিয়াহ হপকিনসের উইল অনুসারে লালচুলো সংঘে আরেকটি সদস্যপদ শূন্য হয়েছে। সব চালচুলোকে নামমাত্র কাজের বিনিময়ে সপ্তাহে চার পাউন্ড বেতন দেওয়া হবে। আবেদনকারীকে সুস্থ দেহ-মনের অধিকারী হতে হবে। বয়স হতে হবে একুশের বেশি। চুলের রং লাল হওয়া আবশ্যক। এসব শর্ত যাঁরা পূরণ করবেন, তাঁরা সবাই এ পদ পাওয়ার যোগ্য। আবেদনপত্র নিয়ে সোমবার বেলা এগারোটায়, ফ্লিট স্ট্রিটের সাত নম্বর পোপস কোর্টে ডানকান রসের সঙ্গে দেখা করুন।’
‘এ কেমনতর পাগলামি?’ পড়া শেষ করে হতভম্ব হয়ে বললাম আমি।
শরীর দুলিয়ে হেসে উঠল হোমস। বলল, ‘একটু বেখাপ্পা ব্যাপার, তা–ই না? মি. উইলসন, এবার বাকি ঘটনা বলুন। ডাক্তার, তার আগে কাগজটার নাম আর তারিখ একটু বলো তো।’
—দ্য মর্নিং ক্রনিকল। দুই মাস আগের তারিখ—২৭ এপ্রিল ১৮৯০।
—বেশ। এবার বলুন, মি. উইলসন।
‘আমার একটা ছোটখাটো বন্ধকি কারবার আছে।’ কপালের ঘাম মুছে বলতে শুরু করলেন জ্যাবেজ উইলসন, ‘শহরের কাছেই, কোবার্গ স্কয়ারে। ছোট ব্যবসা। কোনোমতে খাওয়া-পরা চলে যায় আরকি। এককালে দুজন সহকারী ছিল, এখন আছে মোটে একজন। ওকেও ঠিকমতো রাখতে হলে অনেক টাকা মাইনে দিতে হতো। কিন্তু কাজ শেখার জন্যে অর্ধেক মাইনেতে চাকরিতে থেকে গেল ও।’
‘ছোকরার নাম কী?’ জানতে চাইল হোমস।
—ভিনসেন্ট স্পল্ডিং। বয়স একেবারে কম নয়। তবে ঠিক কত, তা বলা শক্ত। বেশ চটপটে। চাইলেই আরও উন্নতি করতে পারবে। আমি যে বেতন দিই, তার দ্বিগুণ কামাতে পারবে। কিন্তু স্পল্ডিং ওই বেতনেই সন্তুষ্ট। চমৎকার ছেলে। তবে ছোট্ট একটা দোষও আছে ওর। ছেলেটা ফটোগ্রাফি বলতে পাগল। যখন–তখন কাজ শিকেয় তুলে ক্যামেরা নিয়ে ছোটে। আর ফিরে এসেই খরগোশের মতো সেঁধিয়ে যায় মাটির নিচের ঘরে, ফটোগুলো ডেভেলপ করতে।
—এখনো কাজ করছে আপনার ওখানে?
—হ্যাঁ। ও ছাড়া একটা মেয়েও থাকে। রান্নাবান্না করে, ঘরদোর পরিষ্কার রাখে। আমি বিপত্নীক, ছেলেপুলেও হয়নি। এই তিনজন মিলে বেশ শান্তিতে ছিলাম। তারপর আট সপ্তাহ আগে একদিন বিজ্ঞাপনটা নিয়ে হাজির স্পল্ডিং। আফসোস করতে করতে বলল, ‘মি. উইলসন, আমার মাথার চুলগুলো লাল হলে বড় ভালো হতো!’
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ব্যাপারটা কী? তখন বিজ্ঞাপনটা দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখুন, লালচুলো মানুষদের জন্যে চাকরি খালি হয়েছে একটা। আমার চুলের রংটা লাল হলে আবেদন করতাম। সবাই কিন্তু দরখাস্ত করতে পারবে না। লন্ডনের খাস বাসিন্দা হতে হবে। এজেকিয়াহ হপকিনস নামের এক খ্যাপা আমেরিকান কোটিপতির মাথার চুল ছিল আগুনলাল। তাই লালচুলো লোকেদের জন্য দরদ ছিল তার। আপনি কিন্তু আবেদন করতে পারেন, মি. উইলসন।’
দেখতেই পাচ্ছেন, আমার মাথার চুল আগুনের মতোই লাল। কদিন ধরে ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। তাই লোভে পড়ে দোকানপাট বন্ধ করে ছুটলাম ফ্লিট স্ট্রিটে। স্পল্ডিংকেও নিলাম সঙ্গে।
জায়গামতো গিয়ে তো আমার মাথা ঘুরে গেল মি. হোমস। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম—সবদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। যার চুলে এতটুকু লালের ছোঁয়া আছে, সে-ই এসে হাজির হয়েছে চাকরির আশায়।
ভিড় দেখে আমি আশা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু স্পল্ডিং দমল না। ধাক্কা-গুঁতো মেরে ভিড় ঠেলে এক্কেবারে অফিসঘরের সামনে নিয়ে হাজির করল আমাকে। ঠেলেঠুলে আমাকে ঢুকিয়ে দিল অফিসে।
এই পর্যন্ত বলে দম নেওয়ার জন্য থামলেন মি. উইলসন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন:
—অফিসের ভেতর এক জোড়া কাঠের চেয়ার-টেবিল ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না। টেবিলের পেছনে বসে ছিলেন একজন লালচুলো। বেশ অমায়িক সুরে কথা বলতে লাগলেন ভদ্রলোক।
ঘুরে-ফিরে দেখতে লাগলেন আমাকে। হঠাৎ লাফিয়ে এসে আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘একটু সতর্ক হলে আশা করি কিছু মনে করবেন না।’
এই বলে আচমকা আমার চুল ধরে মারলেন হ্যাঁচকা টান। যন্ত্রণায় আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ভদ্রলোক এবার চুল ছেড়ে দিয়ে লজ্জিত গলায় বললেন, ‘মাফ করবেন, নকল চুল কি না দেখে নিলাম। কারণ দু-দুবার পরচুলা পরে ঠকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল আমাদের।’
এই বলে জানালার সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে জানিয়ে দিলেন, লোক পাওয়া গেছে, আর কাউকে লাগবে না। ভদ্রলোক এবার নিজের পরিচয় দিলেন, ‘আমার নাম ডানকান রস। মি. হপকিনস যে টাকা রেখে গেছেন, আমিও সেখান থেকে পেনশন পাই। তা কবে থেকে চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন?’
জবাব দিলাম, একটু ঝামেলা আছে। ছোটখাটো একটা ব্যবসা আছে আমার।
স্পল্ডিং বলে উঠল, ‘ব্যবসা নিয়ে আপনি ভাববেন না মি. উইলসন। ওটা আমি আপনার হয়ে চালিয়ে নিতে পারব।’
এখানে ডিউটি করতে হবে কতক্ষণ? জানতে চাইলাম আমি।
—দশটা থেকে দুটো।
বন্ধকি কারবার চলে সাধারণত সন্ধ্যার দিকে। সকাল থেকে দুপুর অবধি আমার কোনো কাজ থাকে না। সেই ফাঁকে বাড়তি কামাই হলে ভালোই হয়। স্পল্ডিং ভালো মানুষ, ব্যবসা ঠিকমতোই সামলাতে পারবে।
ভেবেচিন্তে বললাম, বেতন কত?
—সপ্তায় চার পাউন্ড।
—কাজটা কী?
—তেমন কিছু না। পুরো সময়টা আপনাকে অফিসে, অন্তত এই বাড়িতে থাকতে হবে। এখান থেকে এককদম নড়লেও চাকরি নট হয়ে যাবে। এখান থেকে বেরোলেই চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করা হবে। কোনো অজুহাতেই বেরোনো চলবে না।
—আচ্ছা। মেনে নিলাম শর্ত। তা কাজ কী করতে হবে?
—এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা দেখে নকল করবেন। ব্যস, আর কিছু না। কালি, কলম, ব্লটিং পেপার আপনি নিয়ে আসবেন। চেয়ার-টেবিল আমরা দেব। কাল থেকে আসতে পারবেন?
—নিশ্চয়ই। জবাব দিলাম আমি।
সব ঠিকঠাক করে আনন্দে আটখানা হয়ে বাড়িতে ফিরলাম। পরদিন সকালে কালির বোতল, কলম আর কাগজ নিয়ে রওনা দিলাম পোপস কোর্টের দিকে।
গিয়ে দেখি মি. ডানকান রস সব প্রস্তুত করে রেখেছেন। A অক্ষর থেকে শুরু করিয়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। সেদিন ছুটি দিলেন দুপুর ঠিক দুটোর সময়। খুব প্রশংসা করলেন আমার কাজ দেখে
এভাবেই চলতে লাগল দিনের পর দিন। শনিবারে ম্যানেজার এসে এক সপ্তাহের বেতন চারটে স্বর্ণমুদ্রা দিলেন। পরের সপ্তাহেও তা-ই। তারপরের সপ্তাহেও রোজ সকাল দশটায় গিয়ে হাজিরা দিই অফিসে, ফিরি বেলা দুটোয়। ধীরে ধীরে মি. ডানকান রসের অফিসে আসা কমতে লাগল। শেষে তাঁর আসাই বন্ধ হয়ে গেল। তারপরও আমি কাজ চালিয়ে গেলাম।
আট সপ্তাহ কেটে গেল এভাবে। তত দিনে একটা তাক প্রায় ভরে উঠেছে আমার লেখায়। তারপর হঠাৎ একদিন শেষ হয়ে গেল সব।
‘শেষ হয়ে গেল?’ অবাক হয়ে বলল হোমস।
—হ্যাঁ, স্যার। আজ সকালের ঘটনা। সকাল দশটায় অফিস করতে গিয়ে দেখি, দরজায় তালা মারা। তার গায়ে একটা নোটিশ ঝোলানো। এই নিন, নিজেই পড়ে দেখুন।
নোটবই আকৃতির একটা চৌকোনা সাদা কার্ডবোর্ড এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। তাতে লেখা:
‘লালচুলো সংঘ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো
৯ অক্টোবর ১৮৯০’
বিজ্ঞপ্তি পড়ে হোমস বলল, ‘এই নোটিশ দেখার পর কী করলেন?’
—খোঁজ নিলাম আশপাশের অফিসগুলোয়। কেউ কিছু জানে না। শেষে বাড়ির মালিকের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, লালচুলো সংঘের কী হয়েছে। শুনে তো তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। এ রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম বাপের জন্মে শোনেননি। ডানকান রসের নামটাও শোনেননি জীবনে। তখন বললাম, চার নম্বর ঘরের ভদ্রলোকের কথা বলছি।
—ওহ, লালচুলো লোকটা তো? ওনার নাম তো উইলিয়াম মরিস। সলিসিটর। নিজের অফিসের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আমার ঘরটা ভাড়া নিয়েছিলেন। উনি তো গতকালই চলে গেছেন।
—ওকে কোথায় পাব, বলতে পারেন?
—১৭ নম্বর কিং এডওয়ার্ড স্ট্রিটে ওর নতুন অফিস।
ভদ্রলোকের কথা শুনে ছুটলাম ওখানে। কিন্তু গিয়ে দেখি, ঠিকানাটা ভুয়া। বাড়িতে ফিরে স্পল্ডিংয়ের পরামর্শ চাইলাম। ও কোনো উপায় বাতলাতে পারল না। শুধু বলল অপেক্ষা করতে। কিন্তু ওর পরামর্শ ভালো লাগল না। শুনেছি, বিপদে পড়লে মানুষকে সাহায্য করেন আপনি। তাই চলে এলাম আপনার কাছে।
‘ভালো করেছেন, ’ বলল হোমস। ‘সব শুনে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠানটার বিরুদ্ধে আপনার কোনো অভিযোগ থাকা উচিত নয়। আপনার পারিশ্রমিক কিন্তু ঠিকই মিটিয়ে দিয়েছে ওরা।’
‘তা ঠিকই বলেছেন,’ বললেন মি. উইলসন। ‘তবু লোকগুলোর পরিচয় জানতে চাই আমি। এত টাকা খরচ করে অমন আজব তামাশাই বা কেন করল?’
‘ওসব জানার চেষ্টা করব আমরা,’ ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করল বন্ধুবর। ‘কিন্তু আরেকটা প্রশ্নের জবাব দিন। বিজ্ঞাপনটা প্রথম যে দেখিয়েছিল, সেই ভিনসেন্ট স্পল্ডিং আপনার এখানে কত দিন ধরে কাজ করছে?’
—মাস চারেক হবে।
—ছেলেটাকে পেলেন কোথায়?
—কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। ওটা দেখে আবেদন করেছিল।
—ও ছাড়া আর কেউ দরখাস্ত করেনি?
—আরও অন্তত ডজনখানেক আবেদন পড়েছিল।
—এতজনের মধ্য থেকে ওকে নিলেন কেন?
—সবচেয়ে কম মাইনে চেয়েছিল বলে।
—অর্ধেক মাইনেতে, না?
—হ্যাঁ।
—এই ভিনসেন্ট ছোকরাটা দেখতে কেমন?
—ছোটখাটো, গাট্টাগোট্টা গড়ন। চটপটে। বয়স বছর ত্রিশের কম না। দাড়ি-গোঁফের চিহ্নও নেই মুখে। কপালে একটা অ্যাসিডে পোড়া সাদা দাগ আছে।
শুনতে শুনতে উত্তেজনায় টান টান হয়ে বসল হোমস। ‘মিলে যাচ্ছে। ওর কানের লতিতে রিং পরানোর মতো ফুটো আছে কি না, খেয়াল করেছেন?’
—আছে, স্যার। ছেলেবেলায় নাকি এক জিপসি ওর কান বিঁধিয়ে দিয়েছিল।
‘লোকটা এখনো আপনার চাকরি করছে?’ প্রশ্ন করল হোমস।
—হ্যাঁ। ওকে দোকানে বসিয়েই তো আপনার কাছে এলাম।
—আপনার অনুপস্থিতিতে কাজকর্ম ভালোমতো করে তো?
—হ্যাঁ, করে।
—আচ্ছা, সব শুনলাম। আজ শনিবার। সোমবারের মধ্যেই আশা করি আপনার সমস্যার একটা সুরাহা করতে পারব।
ভদ্রলোক চলে গেলে হোমস বলল, ‘ওয়াটসন, একটু ভাবতে হবে। আগামী পঞ্চাশ মিনিট কোনো কথা বোলো না।’
কিন্তু খানিক বাদেই হোমস হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলল, ‘চলো, বিকেলে সেন্ট জেমস হলে ঘণ্টাকয়েক বাজনা শুনে আসা যাক।’
পাতালরেলে চেপে অল্ডার্সগেট পর্যন্ত গেলাম আমরা। সেখান থেকে খানিকটা পথ হেঁটে পৌঁছুলাম স্যাক্স-কোবার্গ স্কয়ারে। জায়গাটা খুব নোংরা আর ঘিঞ্জি।
কোনার দিকে, একটা বাড়িতে বাদামি রঙের বোর্ডের ওপর লেখা, ‘জ্যাবেজ উইলসন’। ওখানেই আমাদের লালচুলো মক্কেলের ব্যবসা চলে। তীক্ষ্ণ চোখে বাড়িটা দেখতে লাগল হোমস। রাস্তা ধরে, মোড় পর্যন্ত এগিয়ে গেল ও। তারপর আবার ফিরে এল দোকানের সামনে। খানিক বাদে হাতের লাঠিটা দোকানের সামনের ফুটপাতে জোরে জোরে ঠুকল কয়েকবার। এবার দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল পাল্লা। দাড়ি-গোঁফ কামানো স্বাস্থ্যবান চেহারার এক যুবক উঁকি দিল। ভেতরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাল আমাদের। হোমস ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘ভেতরে যাব না। স্ট্র্যান্ডে যাওয়ার রাস্তাটা কোন দিকে, বলতে পারেন?’
‘ডানে গিয়ে তিন নম্বর মোড় ধরবেন, এরপর বাঁয়ে চতুর্থ মোড়।’ ঝটপট পথের হদিস জানিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল সে।
ফিরে এসে হোমস বলল, ‘ধুরন্ধর ছোকরা। ওর সম্পর্কে আগেও শুনেছি।’
—বোঝাই যাচ্ছে, লালচুলো সংঘের রহস্যের সঙ্গে ছোকরার সম্পর্ক আছে, বললাম আমি। তা পথের হদিস জানতে চাইলে কেন? ওর চেহারা দেখার জন্যে?
—নাহ।
—তাহলে?
—ওর ট্রাউজারের হাঁটু দুটো দেখতে।
—কী দেখলে? আর পেভমেন্টে লাঠিই বা ঠুকলে কেন?
—এখন দেখার সময়, ডাক্তার, কথা বলার নয়। সামনের রাস্তা দেখা হয়েছে, এবার চলো পেছনে যাই।
স্কয়ারের পেছনের রাস্তার চেহারা একেবারে উল্টো। সর্বক্ষণ পথচারী আর আর যানবাহনের ভিড়ে জমজমাট রাজপথটি।
এককোণে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল হোমস, ‘একটু ভালোমতো দেখে নিই। ওই তো তামাকের দোকান মর্টিমার্স। এরপর খবরের কাগজের দোকান, সিটি অ্যান্ড সাবার্বান ব্যাংকের কোবার্গ শাখা, নিরামিষ রেস্তোরাঁ আর ম্যাকফারলেন ক্যারিজ-বিল্ডিং ডিপো। চলো, ডাক্তার, কাজ শেষ।’
এরপর সারাটা বিকেল কাটল সেন্ট জেমস হলে বাজনা শুনে। অনুষ্ঠান শেষে হোমস বলল, ‘রাত দশটায় চলে এসো। বড় একটা অপরাধ ঘটতে চলেছে। যদিও আজ শনিবার হওয়ায় একটু ঝামেলা হলো। তবে সময়মতো ঠেকাতে পারব আশা করি। ও হ্যাঁ, তোমার আর্মি রিভলভারটা নিয়ে এসো।’
কথা শেষ করেই চট করে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল ও।
রাত দশটার দিকে আমি পৌঁছে গেলাম বেকার স্ট্রিটে। দেখি, দোরগোড়ায় দুটো এক্কাগাড়ি দাঁড়িয়ে। বন্ধুর ঘরে ঢুকে দুজন লোকের দেখা পেলাম। একজনকে চিনি। অফিশিয়াল পুলিশ এজেন্ট পিটার জোনস। দ্বিতীয়জন অপরিচিত। লম্বা, রোগাটে। পরনে দামি ফ্রক-কোট।
‘এই তো আমাদের দল পুরো হয়ে গেল!’ আমাকে দেখে সহাস্য বলল হোমস। তাকের ওপর থেকে নিজের ভারী হান্টিং ক্রপটা হাতে নিল। ‘ওয়াটসন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মি. জোনসকে তো চেনোই। আর ইনি মি. মেরিওয়েদার। আজ রাতের অভিযানে আসছেন আমাদের সঙ্গে।’
‘দেখবেন, পণ্ডশ্রম যেন না হয়,’ বললেন মি. মেরিওয়েদার।
‘মি. হোমসের ওপর নিশ্চিন্তে ভরসা রাখতে পারেন, স্যার,’ জোরগলায় বললেন মি. জোনস।
‘আজ রাতে আপনার একটা বিশাল উপকার হবে, মি. মেরিওয়েদার,’ হোমস বলল। ‘আর, মি. জোনস, তুমি পাবে এমন একজনকে, যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছ বহুদিন ধরে।’
‘জন ক্লে,’ বললেন মি. জোনস। ‘চোর, খুনি, দাঙ্গাবাজ, জালিয়াত। ওকে হাতকড়া পরানোর জন্য পাগল হয়ে আছি আমি। এই জন ক্লে কিন্তু কোনো আলতু-ফালতু লোক নয়। ওর দাদা ছিল রয়্যাল ডিউক। নিজেও পড়াশোনা করেছে ইটন আর অক্সফোর্ডে। অসম্ভব ধুরন্ধর লোক। ওর পিছে ছুটে মরাই সার হয়েছে, নাগাল আর পাইনি।’
‘আজ রাতে আশা করি ধরতে পারব,’ হোমস বলল। ‘দশটা বাজে। চলো, বেরিয়ে পড়ি।’
গাড়িতে উঠে কোনো কথা বলল না হোমস। লন্ডনের অগুনতি গ্যাসজ্বলা রাস্তার গোলকধাঁধা পেরিয়ে, গাড়ি পৌঁছে গেল ফ্যারিংটন স্ট্রিটে।
‘এসে গেছি,’ এতক্ষণে মুখ খুলল শার্লক হোমস। ‘মি. মেরিওয়েদার একটা ব্যাংকের ডিরেক্টর। কেসটার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত।’
বলতে বলতে স্যাক্স-কোবার্গ স্কয়ারের পেছনের সেই রাস্তায় পৌঁছে গেলাম আমরা। গাড়ি ছেড়ে, সরু একটা পথ পেরোলাম মি. মেরিওয়েদারের পিছু পিছু। একটা পার্শ্বদরজার সামনে থামলেন ভদ্রলোক। দরজাটা খুলে দিলেন, আমরা ভেতরে ঢুকলাম।
সামনে একটা ছোট করিডর। তার শেষ মাথায় ভারী লোহার দরজা। একটু থেমে একটা লন্ঠন জ্বালালেন মি. মেরিওয়েদার। তারপর মাটির সোঁদা গন্ধওয়ালা অন্ধকার প্যাসেজ ধরে এগিয়ে চললেন। তৃতীয় একটা দরজা খুলে আমাদের নিয়ে ঢুকলেন একটা পাতালঘরে। কামরাটা ব্যাংকের ভল্ট। ঘরভর্তি থরে থরে সাজানো বড় বড় কাঠের বাক্স আর ক্রেট।
‘ওপর থেকে বোধ হয় ভল্টটাকে ভাঙা যাবে না, কী বলেন!’ লন্ঠন উঁচু করে মন্তব্য করল হোমস।
‘নিচ থেকেও পারবে না।’ বলেই মেঝের পাথরে হাতের ছড়ি ঠুকলেন মি. মেরিওয়েদার। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন, ‘আরে! ফাঁপা শোনাচ্ছে কেন?’
‘চুপ! আস্তে কথা বলুন।’ ধমকে উঠল হোমস। ‘চোর ধরার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বেন দেখছি। একটা বাক্সের ওপর বসে থাকুন। টুঁ শব্দ করবেন না।’
ধমক খেয়ে মুখ গোমড়া করে একটা বাক্সের ওপর বসে পড়লেন ভদ্রলোক। হোমস এবার লন্ঠন আর আতশ কাচ নিয়ে উবু হয়ে বসে পড়ল মেঝের ওপর।
কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে বলল, ‘ঘণ্টাখানেক সময় আছে। জ্যাবেজ উইলসন ঘুমিয়ে কাদা না হওয়া পর্যন্ত ওরা কাজে নামবে না। ডাক্তার, আমরা এখন কোথায় আছি, বুঝতে পারছ তো? লন্ডনের একটা বড়সড় ব্যাংকের সিটি শাখার ভল্টে। মি. মেরিওয়েদার এই ব্যাংকের ডিরেক্টর বোর্ডের চেয়ারম্যান। এবার উনিই বলবেন, লন্ডনের সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীরা কেন লেগেছে এই ভল্টের পেছনে।’
‘সোনার জন্য,’ নিচু গলায় বললেন ব্যাংক ডিরেক্টর।
—সোনা?
—হ্যাঁ, সব ফরাসি সোনা। আগেও বেশ কয়েকবার আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, এগুলো চুরির চেষ্টা করা হতে পারে। কয়েক মাস আমাদের পুঁজি বাড়ানোর দরকার হয়েছিল। তাই ব্যাংক অব ফ্রান্স থেকে তিরিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ধার করি। কিন্তু টাকার বাক্সটা আর খোলার দরকার হয়নি। টাকাগুলো যে এখনো ভল্টেই আছে, সেটা কীভাবে যেন জানাজানি হয়ে গেছে। আমি যে বাক্সটার ওপর বসে আছি, দুই হাজার স্বর্ণমুদ্রা আছে তার মধ্যে। একটা ব্রাঞ্চ অফিসে যতটা রাখা যায়, আমাদের সঞ্চিত সোনা এখন তার চেয়ে অনেক বেশি।
‘এবার আমাদের পরিকল্পনাটা ঠিক করে ফেলা যাক,’ ভদ্রলোকের কথা শেষ হতেই বলল হোমস। ‘আশা করছি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘটনা ঘটে যাবে। তার আগে কালো লন্ঠনটা পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া দরকার। শত্রুপক্ষ অত্যন্ত ভয়ংকর আর ধুরন্ধর। এখন আলো জ্বেলে রাখা নিরাপদ নয়। এবার যার যার অবস্থান বেছে নেব। আমি থাকব এই বাক্সের পেছনে। আপনারা ওগুলোর পেছনে গিয়ে লুকান। আমি ওদের ওপর আলো ফেললেই ঘিরে ফেলবেন। ওয়াটসন, ওরা গুলি করলে তুমিও নির্দ্বিধায় গুলি চালাবে।
একটা কাঠের বাক্সের আড়ালে গিয়ে বসে পড়লাম আমি। রিভলভারটা কক করা অবস্থায় হাতের নাগালে রাখলাম। হোমস লন্ঠনটা ঢেকে দিল। নিশ্ছিদ্র আঁধারে ডুবে গেল পাতালঘর।
হোমস ফিসফিস করে বলল, ‘পালানোর রাস্তা কিন্তু একটাই—আমাদের মক্কেলের বাড়ির ভেতর দিয়ে স্যাক্স-কোবার্গ স্কয়ারে। জোনস, যেভাবে বলেছিলাম, সেইমতো ব্যবস্থা করেছ তো?’
—নিশ্চয়ই। একজন ইন্সপেক্টর আর দুজন অফিসার রেখেছি সামনের দরজায়,’ জবাব দিলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা।
‘খুব ভালো,’ সন্তুষ্ট হলো হোমস।
সময় যেন আর কাটে না। ঠায় বসে থাকতে থাকতে হাত-পা অসাড় হওয়ার জোগাড়। হঠাৎ একটা আলোর ঝিলিক লাগল চোখে।
প্রথমে পাথরের ওপর একটা হলদেটে ক্ষীণ আলোর রেখা। ক্রমে রেখাটা লম্বা হতে লাগল। তারপরই হঠাৎ একটা ফাটল দেখা দিল মেঝেতে। সেখান দিয়ে বেরিয়ে এল একটা ফ্যাকাশে সাদা মেয়েলি হাত। মিনিটখানেক ওভাবেই রইল হাতটা। তারপর সুড়ুত করে নিচে ঢুকে গেল আবার। তার খানিক বাদেই খসখস, ঠনঠন আওয়াজ তুলে মেঝের একটা পাথর উলটে পড়ল। সেখানে তৈরি হলো একটা চারকোনা গর্ত। চারদিকে লন্ঠনের উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ল সেখান থেকে।
খানিক বাদেই বাচ্চা ছেলের মুখের মতো একটা মুখ উঁকি দিল সেই গর্ত দিয়ে। অতি সন্তর্পণে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাঁচড়ে–পাচড়ে ওপরে উঠে এল সে। তারপর গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে টেনে তুলল হালকা-পাতলা গড়নের একটা মানুষকে। বিষণ্ন চেহারার লোকটার চুল আগুনের মতো লাল।
‘সব ঠিক আছে,’ ফিসফিসিয়ে বলল প্রথমজন। ‘বেলচা আর বস্তাগুলো দাও।’ সহসা থমকে গেল সে। পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে সর্বনাশ! পালাও, আর্চি, পালাও!’
হোমস ততক্ষণে লাফ দিয়ে লোকটার কলার চেপে ধরেছে। দ্বিতীয় তস্কর লাফিয়ে পড়েছে গর্তের মধ্যে। তার শার্ট চেপে ধরেছিলেন জোনস, কিন্তু লাভ হলো না। ফড়ফড় করে শার্টের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে রয়ে গেল তার হাতে। শার্টের মালিক উধাও হয়ে গেল গর্তের ভেতর। এদিকে পকেট থেক পিস্তল বের করে ফেলেছে প্রথমজন। সেটার ওপর আলোর ঝলকানি পড়তেই হোমসের হান্টিং ক্রপ ছোবল মারল তার কবজিতে। সঙ্গে সঙ্গে ঠকাস করে মেঝেতে ছিটকে পড়ল রিভলভারটা।
‘তেড়িবেড়ি করে লাভ নেই, জন ক্লে,’ হিমশীতল কণ্ঠে বলল হোমস। ‘তোমার খেল খতম।’
‘তা-ই তো দেখছি,’ শান্ত গলায় জবাব দিল তস্কর। ‘তবে আমার বন্ধুকে ধরতে পারেননি। ওর শার্টের লেজটাই কেবল পেয়েছেন।’
—চিন্তা কোরো না, ওর জন্যও তিনজন দাঁড়িয়ে আছে সুড়ঙ্গের ও মাথায়।
—বাহ! আয়োজন করেই কাজে নেমেছেন দেখছি। আপনার প্রশংসা করতে হয়।
‘তোমারও প্রশংসা না করে পারছি না,’ হোমস বলল। ‘লাল চুলের আইডিয়াটা দুর্দান্ত।’
ঝটপট এগিয়ে এসে লোকটার হাতে হাতকড়া পরিয়ে ফেললেন জোনস। তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ভল্ট থেকে।
এদিকে মি. মেরিওয়েদার গদগদ কণ্ঠে বারবার হোমসকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন।
পরদিন সকালে লাল চুল রহস্যের ব্যাখ্যা দিল শার্লক হোমস।
‘ওয়াটসন, আমি কিন্তু প্রথম থেকেই বুঝতে পারছিলাম, লালচুলো সংঘের অদ্ভুত বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে, এনসাইক্লোপিডিয়া নকলের অজুহাতে রোজ চার ঘণ্টা একটা ঘরে বসিয়ে রাখার উদ্দেশ্য একটাই—সাদাসিধে বন্ধকি কারবারিকে কিছু সময়ের জন্য বাড়ির বাইরে রাখা।
‘এক জোচ্চোর লালচুলো সংঘের অফিস বসাল, আরেক জোচ্চোর লোকটাকে আবেদন করতে রাজি করাল। দুজন মিলে বেচারিকে গোটা সপ্তাহটা সরিয়ে রাখল বাড়ির বাইরে। ভদ্রলোকের সহকারীটি অর্ধেক বেতনে চাকরি করছে শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গিয়েছিলাম, এর পেছনে কোনো ধান্ধাবাজি রয়েছে।’
‘ধান্ধাবাজিটা ধরলে কীভাবে?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘মি. উইলসনের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, ব্যবসাটাও ছোট। কাজেই বাড়ির মধ্যে তেমন ধনদৌলত নেই, যার জন্যে এমন ব্যাপক আয়োজন আর টাকা খরচ করবে চোরের দল। তাহলে আসল ঘাপলাটা কী?
‘তখনই মনে পড়ল সহকারীটির ফটোগ্রাফির শখের কথা। ছেলেটা যখন-তখন মাটির তলার ঘরে সেঁধায় ফটো ডেভেলপ করতে। তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে শুরু করল। চেহারার বর্ণনা শুনেই বুঝলাম, ওই ছোকরা লন্ডনের কুখ্যাত অপরাধী জন ক্লে।
‘এরপর মনে প্রশ্ন জাগল, দুই মাস ধরে রোজ চার ঘণ্টা করে মাটির তলার ঘরে কী করেছে ব্যাটা? নিশ্চয়ই অন্য একটা বাড়িতে যাওয়ার জন্য সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে।
‘সত্যতা যাচাই করতে তোমাকে নিয়ে গেলাম ঘটনাস্থলে। সেখানে গিয়ে পথের ওপর লাঠি ঠুকে জানতে চেষ্টা করলাম, সুড়ঙ্গটা কোন দিকে গেছে, বাড়ির সামনে না পেছনে। নিরেট আওয়াজ শুনেই বুঝলাম, সামনে নয়। তখন ঘণ্টা বাজালাম। কর্মচারীটি বেরিয়ে এল। দেখলাম, মাটি লেগে রয়েছে ওর দুই হাঁটুতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে বসে মাটি খুঁড়লে ট্রাউজারের যা অবস্থা হয়, ঠিক তা-ই হয়ে রয়েছে।
‘এরপর জানা দরকার ছিল, সুড়ঙ্গটা গেছে কোন দিকে। মোড় ঘুরে, বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখলাম, সাবার্বান ব্যাংকটা আমাদের মক্কেলের বাড়ির লাগোয়া। তখনই বুঝে গেলাম, কী ফন্দি আঁটছে ব্যাটা। তোমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে সোজা চলে গেলাম স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর ব্যাংক ডিরেক্টরের কাছে।’
‘কিন্তু তুমি জানলে কী করে যে ওরা সেদিনই আসবে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘সংঘ তুলে দেওয়ার নোটিশ দেখে। সংঘ উঠিয়ে দেওয়ার অর্থ, মি. উইলসনকে বাড়ি থেকে সরিয়ে রাখার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। অর্থাৎ সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়ে গেছে, এবার শুধু সোনাগুলো লুট করবে। আর কাজটা যত তাড়াতাড়ি সারা যায়, ততই ভালো। দেরি হলে সুড়ঙ্গের ব্যাপারটা ধরা পড়ে যেতে পারে, কিংবা সোনাগুলোও ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। কাজটার জন্য শনিবার রাতই সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ, রোববার ব্যাংক বন্ধ। তাই শনিবার চুরি করলে পালানোর জন্যে দুটো দিন হাতে পাওয়া যাবে। এসব ভেবেই শনিবারে ফাঁদটা পাতলাম।’
‘দারুণ দেখিয়েছ, বন্ধু!’ হোমসের ব্যাখ্যা শেষ হলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলাম।
‘এসব কেসই তো আমাকে একঘেয়েমির হাত থেকে বাঁচায়,’ হাই তুলে বলল হোমস। ‘মনটা খারাপ লাগছে, এমন কেস আবার কবে পাব, কে জানে!’
মূল গল্প: আর্থার কোনান ডয়েল
রূপান্তর: মারুফ হোসেন
Post a Comment