ঠনঠনিয়া পান্থনিবাস – শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
‘যাবি নাকি রে?’
ট্র্যাভেলিং ব্যাগে কাপড় ভরতে ভরতে দীপকে বললেন নান্টু মামা। দীপ অবশ্য যেতে পারে। স্কুল বন্ধ। গরমের ছুটি চলছে। ১০-১২টা দিন অনায়াসে কোথাও ঘুরে আসতে পারে।
কিন্তু নান্টু মামার সঙ্গে কোথাও যেতে চাইলে একটু ভাবতে হবে। মামা মোটামুটি জনপ্রিয় লেখক। মাকসুদ মাহমুদ নামে লেখেন। ছোটদের জন্য কয়েকটা গোয়েন্দা উপন্যাস লিখে নাম কিনেছেন। গড়পড়তা লেখকেরা যা হন, একটু আলাভোলা, একটু খেয়ালি—মামাও ঠিক তেমন। বাসে করে কোথাও গেলে দেখা যাবে, মামা ওকে ফেলেই নেমে গেছেন। এর পরও কৌতূহল তড়পায় দীপের মনে।
মামাকে দীপ শুধায়, ‘তা—যাচ্ছ কোথায় মামা?’
মামা ব্যাগের চেইন টেনে দিতে দিতে বলেন, ‘সে রকম বিখ্যাত কোনো জায়গা নয় ওটা। সাদামাটা একটা গ্রাম। লোকে বলে ভুতুড়ে জায়গা। আজগুবি সব কাণ্ড ঘটে সেখানে।’
মামার কথার ঢঙে একটা শিহরণ অনুভব করে দীপ। জানতে চায়, ‘এত জায়গা থাকতে ভুতুড়ে গ্রামে কেন?’
মামা বলেন, ‘এবার ভাবছি একটা ভৌতিক উপন্যাস লিখব। এ জন্য রসদ নিতে যাব।’
দীপ বলে, ‘তা—ওই গ্রামে পথেঘাটে ভূত ঘুরে বেড়ায় নাকি?’
মামা বলেন, ‘না গেলে বুঝব কী করে? এ জন্যই তো যাওয়া।’
দীপ আর থাকতে পারে না, রাজি হয়ে যায়—যাবে। দীপ জানে, ভূত বলে আসলে কিছু নেই। এ যুগে ক্লাস নাইনে পড়া কোনো ছেলে ভূত বিশ্বাস করে না। মামা যাবেন স্রেফ ভুতুড়ে পরিবেশটা দেখতে। এর মধ্যে কাল্পনিক কিছু চরিত্র যোগ করে বানিয়ে ফেলবেন একটা রোমাঞ্চকর কাহিনি। আর সে কাহিনি পড়ে ফড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবে পাঠকের গায়ের রোম।
দীপও চটপট ওর ব্যাগটা গুছিয়ে তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু মা বাধা হয়ে দাঁড়ান। ভাইয়ের ওপর ঝাল ঝাড়তে থাকেন তিনি। বলেন, ‘কিরে নান্টু, প্রতিবার এসে একটা ঝামেলা না পাকালে বুঝি ভালো লাগে না তোর?’
মামা মাথা চুলকে বলেন, ‘বা রে, আমি আবার কী করলাম?’
মা বলেন, ‘তুই নিজের দিকেই যেখানে খেয়াল রাখতে পারিস না, সেখানে ওকে নিতে চাচ্ছিস কেন?’
মামা হেসে বলেন, ‘কী যে বলো না, আপা! নিজের খেয়াল রাখার মতো যথেষ্ট বড় হয়েছে ও। এখন অন্যের ওপর ভরসা না করলেও চলে। কিরে ভাগনে, ঠিক বলেছি কি না?’
দীপ জোর দিয়ে বলে, ‘একদম ঠিক।’
মামা বলেন, ‘দেখেছ, ও নিজেই কতটা আত্মবিশ্বাসী। এর পরও ছেলেকে যদি ঘরের ভেতর আটকে রেখে ঘরকুনো বানাতে চাও, বানাও। আমার কী?’
পাশের ঘরে, দরজার ঠিক ওপাশে বসে পত্রিকা পড়ছেন বাবা। এঘরের সব কথা শুনতে পাচ্ছেন। মামার কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন তিনি। মাকে বললেন, ‘নান্টু তো ঠিকই বলেছে। গরমের ছুটি এখন। ঘরে বসে না থেকে বাইরে কোথাও ঘুরে আসুক না। এখন থেকে বাইরে কোথাও যেতে না দিলে তো সত্যিই ঘরকুনো হয়ে যাবে। পরে দেখবে একা চলতে পারছে না।’
ব্যস, অনুমতি মিলে গেল। সকাল ১০টার দিকে মামার সঙ্গে বাসা থেকে বের হলো দীপ। নান্টু মামার দুটো মুঠোফোন সেট। একটা দীপকে দিলেন তিনি। মামার কাছ থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে যোগাযোগ করা যাবে।
রিকশায় বাস টার্মিনালে যেতে যেতে ওই গ্রাম সম্পর্কে দীপকে খানিকটা ধারণা দিলেন মামা। সবই শোনা কথা। পরিচিত এক লোকের কাছে গ্রামের কিছু চটকদার গল্প শুনে সেখানে যাওয়ার আগ্রহ জন্মেছে মামার। রাজা মিয়া নামের সে লোক মামার বিরাট এক ভক্ত। তিনি আবার ওই গ্রামেরই মানুষ। তাঁর আমন্ত্রণেই মামার এই তোড়জোড়।
গ্রামটার নাম ঠনঠনিয়া। এই জেলা শহর থেকে অনেক দূরে। যেতে হয় ভেঙে ভেঙে। লোকাল বাসে যেতে হয় ৩০ কিলোমিটারের মতো। তারপর টেম্পোতে ১০ কিলোমিটার। শেষে রিকশা।
বাস বলতে মুড়ির টিন। বৈশাখের গরমে তেতে আছে। তিন মিনিটে মামা-ভাগনের ঘাম ছুটে গেল। চালক ইঞ্জিন চালু করে বসে রইলেন নির্বিকার। যাত্রীর চাপে বাস ফেটে পড়ার জোগাড়। এর পরও হেলপার বাস চাপড়ে হাঁকতে লাগল, ‘আহেন ভাই, আহেন। এহনই বাস ছাইড়া দিব।’
গরমে ত্যক্ত-বিরক্ত যাত্রীদের বকাঝকায় একসময় বাস ছেড়ে দিলেন চালক। মিনিট দশেক পর চওড়া বড় সড়ক ছেড়ে উপজেলা সদরের রাস্তা ধরল বাস। খানাখন্দে ভরা রাস্তা। ঝক্কর-ঝক করে টক্কর খেতে খেতে যেতে লাগল লক্কড় মার্কা গাড়ি। সামনের সিটের পিঠের ওপর থাকা লোহার ডান্ডা শক্ত করে ধরে বসে রইল দীপ। মামা কিন্তু নির্বিকার। এই ঝক্কি যেন তাঁর কাছে ডালভাত।
দুপুরের দিকে উপজেলা সদরে পৌঁছাল বাস। বাসস্ট্যান্ডের কাছে বড় একটা বাজার। বাসের ঝাঁকুনিতে সকালের নাশতা সব হজম। মামাকে সে কথা বলতে হলো না। ওকে নিয়ে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন একটা ভাতের রেস্তরাঁয় ঢুকলেন তিনি। কই মাছের ঝোল দিয়ে পেট ভরে খেল ওরা। রেস্তোরাঁর এক বেয়ারাকে দিয়ে এক খিলি পান আনিয়ে আয়েশ করে চিবোতে লাগলেন মামা। ঠিক এ সময় রিংটোন শোনা গেল মামার মুঠোফোনের। ওপাশ থেকে বোনের একগাদা বকুনি হজম করতে হলো তাঁকে। বারবার ফোন করেও সাড়া পাচ্ছেন না তিনি। মামা বোঝালেন, আসলে গাড়ির শব্দে রিংটোন শুনতে পাননি। দীপের মা জেনে নিলেন তাঁদের এখনকার অবস্থান। দীপের সঙ্গে কথাও বললেন তিনি। ওরা যেখানে গিয়ে উঠবে, তার ঠিকানা জানাতে পইপই করে বলে দিলেন মা।
দীপ জানতে চাইল, ‘ওই গ্রামে গিয়ে আমরা কি তোমার ওই ভক্তের বাড়িতে গিয়ে উঠব, মামা?’
মামা জানালা গলে পিচিক করে পানের রস ফেলে বললেন, ‘তা কেন? আমরা উঠব গিয়ে ঠনঠনিয়া পান্থনিবাসে।’
দীপ কিছু বুঝতে না পেরে বলল, ‘সেটা আবার কী?’
‘আরে, সেখানেই তো আসল মজা! জানিস, ওই গ্রামে ছায়ার মতো একটা কুকুর ঘুরে বেড়ায়। বিশাল এক লাল কুকুর।’
কেউ কুকুরের কথা বললে বন্ধু তাওসিফদের জার্মান শেফার্ডের কথা মনে পড়ে যায় দীপের। বাপ রে, কী পিলে চমকানো ডাক! দীপ একটা ঢোক গিলে বলে, ‘মামা, ওটা কি যখন-তখন সবাইকে আক্রমণ করে বসে নাকি?’
‘চমকটা তো এখানেই। কেউ খুব বিপদে পড়লে কুকুরটা হঠাৎ করে হাজির হয়। বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কেউ জানে না কোত্থেকে আসে, কোথায়ই বা যায়? এমন আরও কিছু ঘটনা ঘটে ওই গ্রামে।’
মামার কথায় রহস্যের আভাস। পরিষ্কার করে কিছু বললেন না। দীপও আর চাপাচাপি করল না। ভাত খাওয়ার পর আয়েশে পেয়েছে ওকে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। কেউ বালিশ পেতে দিলে এখানেই ঢলে পড়বে ও। মামা মুঠোফোনে রাজা মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে রাস্তাঘাট সম্পর্কে আরও ভালো করে জেনে নিলেন। তাঁর কথার ঢঙে বোঝা গেল, তিনি যাচ্ছেন বলে রাজা মিয়া খুব খুশি।
আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা হলো দুজন। এবারের যান টেম্পো। ভরদুপুর বলে হয়তো যাত্রী কম। কিন্তু বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়াল প্রচণ্ড গরম আর রাজ্যের ধুলো। গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত রুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে বসে রইলেন মামা-ভাগনে।
একটা বাজারের ভেতর গিয়ে থামল টেম্পো। বাজারটা উপজেলা সদরের মতো জমজমাট নয়। বেশির ভাগই মুদি দোকান। কিছু সস্তা খেলনা ও প্রসাধনীর দোকানও আছে। দীপকে নিয়ে একটা জলখাবারের দোকানে গেলেন মামা। পেঁয়াজু আর চা খেতে খেতে একটু জিরিয়ে নিলেন দুজন।
দোকান থেকে বেরিয়ে ওরা অবাক। সারা আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে। অথচ দোকানটায় ঢোকার আগে ঝলমলে রোদ ছিল। কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। দীপকে তাড়া দিলেন মামা, ‘শিগগির একটা রিকশা নিয়ে রওনা হতে হবে। ঝড় শুরু হয়ে গেলে এখানেই আটকা পড়ে যাব।’
ঝাঁকড়া একটা বটগাছের নিচে জড়ো হয়ে আছে কয়েকটা রিকশা। বটগাছের নিচ থেকে পুব দিকে চলে গেছে সুরকি-ঢালা পথ। রিকশাওয়ালারা জানাল, এটাই ঠনঠনিয়া যাওয়ার পথ। কিন্তু একজনও যেতে রাজি নয়। সবার এককথা—আগে ঝড়ের ঝাপটা কেটে যাক। তারপর যাবে তারা।
কিন্তু এই বাজারে আশ্রয় নেওয়ার মতো জুতসই জায়গা নেই। ঝড় সে রকম থাবা বসাতে পারলে সব সমান করে দেবে। এর চেয়ে বরং রিকশায় করে যদি কিছু দূর গিয়ে মজবুত কোনো ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া যায়, কালবৈশাখীর ঝাপটা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
এমন একটা দোনোমনার মধ্যেই হালকা বাতাস উঠে গেল। বট পাতায় মর্মর ধ্বনি তুলল ঢেউখেলানো মাতাল বাতাস। সে বাতাসের দাপটে ধুলোর লঘু নৃত্য শুরু হলো বটতলায়। রিকশাওয়ালাদের মধ্যে ফুটে উঠল আতঙ্ক। রিকশা নিয়ে যে যার মতো পালাতে লাগল। মামা খপ করে তাগড়া এক রিকশাওয়ালাকে আটকালেন। বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে বললেন, ‘ঠনঠনিয়া যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের কেবল কাছেপিঠে আশ্রয় নেওয়ার মতো জুতসই একটা জায়গায় নামিয়ে দাও। পুরো ১০০ টাকা পাবে।’
এতে রাজি হলো রিকশাওয়ালা। এখানে একটা খেপে ৬০-৭০ টাকা বাগাতে পারলেই তারা অনেক খুশি, আর তো ১০০ টাকা! দীপকে তাড়া দিলেন মামা, ‘নে নে, উঠে পড়। আর দেরি নয়।’
দীপ লাফ দিয়ে উঠে পড়ল রিকশায়। হাওয়ার বেগ বাড়ছে। বাড়ছে গাছের পাতাগুলোর সরসর শিহরণ। একই সঙ্গে বাড়ছে ধুলোর দাপট। মামা তড়িঘড়ি রিকশায় উঠতে গিয়ে আটকে গেলেন। তাঁর এক পা রিকশার পাদানিতে, আরেক পা মাটিতে।
দীপ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মামা উদ্বেগ নিয়ে বললেন, ‘এই রে, মোবাইল সেটটা তো বুঝি ওই পেঁয়াজুর দোকানে ফেলে এসেছি। তুই একটু বোস। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’
এই বলে সেই দোকানের দিকে ছুটলেন মামা। শিগগির তিনি হারিয়ে গেলেন ধুলোর রাজ্যে।
দীপ পড়ে গেলে দোটানায়। একবার ইচ্ছা করল মামার পেছনে ছুট দিতে, কিন্তু পা দুটো সাড়া দিল না। ধুলোর আলোড়ন বেড়েই চলেছে। চোখের সামনে উড়ছে কাগজ আর পলিথিনের টুকরা। উড়তে উড়তে গোত্তা খাচ্ছে খড়কুটোর মতো হালকা জিনিস। এই প্রচণ্ড আলোড়নের মধ্যেই ক্ষণে ক্ষণে চমকাচ্ছে বিজলি।
কড়-কড়-কড়াৎ! আকাশ কাঁপিয়ে বাজ পড়ল কোথাও। রিকশাওয়ালা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘মা গো, কত্ত বড় ঠাডা! বাতাসে তো মনে অয় রিকশাডাই উইড়া যাইব! কী যে করি!’
এমন সময় ধুলোর একটা ঘূর্ণি সবেগে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে আসতে লাগল। মামা যেদিকে ছুটে গেছেন, ঠিক সেদিক থেকে আসছে। ভয়ার্ত কণ্ঠে দোয়া পড়তে লাগল রিকশাওয়ালা। আতঙ্কে দীপের মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। ঘূর্ণিটা রিকশার সামনে এসে দিক বদলে একদিকে চলে গেল। শোঁ শোঁ করে মিলিয়ে যেতে লাগল দূরে। মোহাবিষ্ট হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল দীপ।
হালকা একটা ঝাঁকুনিতে আচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল দীপের। মামা এসে বসেছেন পাশে। ফোঁস করে আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল ও। মামা আরেকটু দেরি করলে দম বন্ধ হয়ে যেন মারাই যেত।
রিকশাওয়ালাকে ব্যস্ত কণ্ঠে তাড়া দিলেন মামা, ‘হুঁ, আর দেরি নয়। জলদি চলো, ভাই।’
মামার কথা শেষ হতে না-হতে চলতে শুরু করল রিকশা।
দুই
দেখতে দেখতে গতি বেড়ে গেল রিকশার। কুঁজো হয়ে গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে প্যাডল মারছে রিকশাওয়ালা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া। মামার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল দীপ। টের পেল, মামাও ভীষণ ভয় পেয়েছেন। আতঙ্কে হিম হয়ে গেছে তাঁর গা।
ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে এবার মিতালি গড়ল বৃষ্টি। হাওয়া বাড়ছে, বাড়ছে বৃষ্টির ছাট। বৃষ্টিতে টাপুর-টুপুর ছন্দ নেই, বুনো একটা গোঙানি। শিগগিরই ধুলো মরে গেল। কেটে গেল হাওয়ার ঝাঁজালো ভাব। তবে দুর্ভোগ থেকে রক্ষা নেই। হাওয়াটা বরং এখন ধারালো হয়েছে, যেন ছুরির ফলার মতো গায়ে আঁচড় কাটছে হিমেল বাতাস।
এর মধ্যে আলো নিভে আঁধারে ভরে গেছে চারদিক। কে বলবে এখন মাত্র বিকেল! হঠাৎ গোঁ-গোঁ করে একটা আওয়াজ উঠল। কে যেন সজোরে টান মারল রিকশাটাকে। পরমুহূর্তে রিকশাটা যেন হাওয়ায় ভর করে উড়ে চলল। আঁধারে চারপাশটা দেখা যাচ্ছে না। এর পরও বিজলির চমকে দীপ যা দেখতে পেল, মাথাটায় খুব জোরে একটা চক্কর দিয়ে উঠল। মাটির অনেক ওপর দিয়ে শূন্যে ভেসে যাচ্ছে রিকশা, যেন হাওয়াই গাড়িতে করে অচিন কোনো দেশের দিকে উড়ে চলেছে ও।
হ্যাঁ, এটা কাল্পনিক কিছু হলে মজাই লাগত দীপের। অন্য রকম একটা রোমাঞ্চ থাকত এতে। কিন্তু যা ঘটছে, কল্পনার লেশমাত্র নেই এতে। এটা জলজ্যান্ত বাস্তব।
রিকশাওয়ালার কোনো দিকে খেয়াল নেই। সাঁই সাঁই করে প্যাডল মেরে চলেছে সে। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে শরীর এমনভাবে কুঁজো হয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে না সিটে কেউ আছে। দীপের পাশে মামারও কোনো সাড়া নেই। বিজলি চমকে এক পলক তাঁর চেহারাটা দেখে নিল ও। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এল দীপের। জ্বলজ্বলে অপার্থিব এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন মামা।
আবার সশব্দে বাজ পড়ল কোথাও। বাঁ দিকে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা ঝাঁকড়া গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। দীপের মনে হলো, ওদের রিকশাটা সামনে কোথাও কোনো বাড়ির দেয়াল বা গাছে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খাবে। মায়ের শেখানো দোয়াটা মনে পড়ে গেল দীপের। ঘোর বিপদের সময় এই দোয়া পড়লে রক্ষা পাওয়া যায়।
চোখ বুজে কাঁপা কণ্ঠে দোয়া পড়তে শুরু করল দীপ। গলা শুকিয়ে গেছে। কথা বের হতে চাইছে না। তবু দীপ থামল না। দোয়া পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক ভাবালুতার ভেতর হারিয়ে গেল ও।
ঝুপ! প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনির ভেতর দিয়ে থামল রিকশা। চোখ মেলে দীপ আবিষ্কার করল রিকশা থেকে পড়ে কাদাপানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ও। গায়ে অবশ্য আঘাত লাগেনি। তবে বাঁ চোখে কাদাপানি গিয়ে ভয়ানক জ্বালা হচ্ছে। ঝোড়ো বাতাস কমে গিয়ে জোর বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির পানিতে চোখের কাদাপানি ধুয়ে নিল দীপ। কিন্তু মামা কোথায়?
উঠে দাঁড়িয়ে বিজলির আলোতে মামাকে খুঁজল দীপ। নেই। বেমালুম হাওয়া। তবে কি মামাও পড়ে আছেন কোথাও? রিকশাটা স্থির হয়ে আছে রাস্তায়। পাশে রিকশাওয়ালা। বিজলির আলোতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। এর পরও দীপের মনে হলো, তার দেহটা বেশ খাটো হয়ে গেছে। ভারি অদ্ভুত তো!
পা টেনে টেনে আরেকটু কাছে গেল দীপ। জানতে চাইল, ‘মামাকে দেখেছেন?’
জবাব না দিয়ে কেশে উঠল রিকশাওয়ালা। আবদ্ধ পাইপ থেকে হঠাৎ করে ধোঁয়াটে বাষ্প বের হওয়ার মতো একটা শব্দ। এ সময় বেশ বড় করে বিদ্যুৎ চমকাল। দীপ পরিষ্কার দেখতে পেল, রিকশাওয়ালার মাথা নেই। স্রেফ মুণ্ডুহীন ধড় একটা!
দীপ এমন ভয় পেল, যেন ওর চোখ দুটো এখনই ঠিকরে বের হবে কোটর থেকে। মনে হলো, পা দুটো যেন চেপে ধরেছে কেউ। এর মধ্যেও পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল ও। তারপর ঝেড়ে মারল দৌড়।
অন্ধকারে একটা মেঠোপথ ধরে ছুটছে দীপ। বৃষ্টিভেজা পিছল পথ। যেকোনো মুহূর্তে সড়াৎ করে পিছলে পড়ে বড় ধরনের আঘাত পেতে পারে ও। দিগ্ভ্রান্ত হয়ে কোনো গাছের সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু সে ভয় এখন তুচ্ছ।
ছুটতে ছুটতে সত্যিই আশার আলো দেখতে পেল দীপ। ওই তো, একটুখানি আলো দেখা যাচ্ছে। ওটা নিশ্চয়ই কোনো বাড়ি। পথ যেন ফুরাতে চায় না। এর পরও ফুরাল। অনেক পুরোনো একটা দোতলা বাড়ি। জীর্ণ অবস্থা। সামনে দুমড়ে তেরছা হয়ে আছে রংচটে যাওয়া একটা সাইনবোর্ড। ঘন ঘন বিজলির চমক সাইনবোর্ডের লেখা পড়ে নিতে সাহাঘ্য করল। দীপ বানান করে পড়ল, ‘ঠনঠনিয়া পান্থনিবাস’।
হ্যাঁ, মামা তো তখন এই নামই বলেছেন। এখানেই থাকার কথা বলেছেন। আরে, ওই তো বড় ঘরটায় মামাকে দেখা যাচ্ছে! ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ল সে ঘরে।
বড় করে দম নিয়ে হাঁপাতে লাগল দীপ। একটু ধাতস্থ হয়ে ঝাল ঝাড়ল মামার ওপর। বলল, ‘তুমি একটা কংস মামা!’
‘বেশ চটেছিস দেখছি!’
‘চটব না? তুমি নিষ্ঠুর না হলে আমাকে এই ঘোর বিপদের মধ্যে ওভাবে ফেলে আসতে পারতে না।’
মামা মোটেও বিচলিত হলেন না। সহজ সুরে বললেন, ‘আরে, তোকে খঁুজতে খঁুজতেই তো এখানে আসা। চল ওখানটায় বসি।’
একটা টেবিলে গিয়ে বসল দুজন। দীপ এরই মধ্যে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে। একটা রেস্তোরাঁয় আছে ওরা। সেকেলে পরিবেশ। গুমোট গরমের মধ্যে বৃষ্টি পড়েছে বলেই হয়তো ছাতলার ঝাঁজালো গন্ধ। রেস্তোরাঁর কোথাও বাতি জ্বলছে না। অথচ অদ্ভুত একটা নীলাভ আলো ফুটে আছে। কোত্থেকে আসছে এই আলো?
মামাকে সে কথা শুধানোর আগেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল, কী খাবি?’
‘আগে এক গ্লাস পানি।’
‘এই, কে আছ, এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।’
গামছা ঢাকা এক মূর্তি এসে পানির গ্লাস রাখল টেবিলে। দীপ বড় বড় চোখ করে মামাকে বলল, ‘জানো, ভয়ংকর এক কাণ্ড ঘটেছে!’
‘কী?’
‘আমাদের ওই রিকশাওয়ালার মাথা নেই।’
‘এ্যাঁ, বলিস কী?’
‘হ্যাঁ, আমি পরিষ্কার দেখেছি!’
সামনে দাঁড়ানো পরিচারক তার গামছা সরিয়ে খ্যাঁরখেঁরে গলায় বলল, ‘দ্যাহো তো—এই রহম কি না!’
দীপ দেখে সেই মুণ্ডুহীন রিকশাওয়ালা ওর সামনে দাঁড়িয়ে। বিকট এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাল ও। ঠিক এ সময় দরজায় এসে দাঁড়াল বিশাল এক লাল কুকুর। প্রচণ্ড শব্দে ডেকে চলল কুকুরটা। প্রথমে ছাদের নিচ থেকে খসে পড়ল এক টুকরা পলেস্তারা। দেয়ালগুলোতে ফাটল ধরতে লাগল। ঝুরঝুর করে পলেস্তারা খসেই চলল। সব শেষে হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়তে লাগল বাড়ি।
তিন
নান্টু এদিকে ভাগনের চিন্তায় দিশেহারা। কালকের রাতটা বাজারের এক দোকানে নরকযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পার করেছেন। ঝড়ে বাজারের চার-পাঁচটা দোকান বিধ্বস্ত হয়েছে। তিনি যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটা ধসে না পড়লেও অক্ষত নেই। এসব নিয়ে অবশ্য তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁর মাথায় এখন চক্কর দিচ্ছে ভাগনের দুশ্চিন্তা। কোথায় আছে দীপ?
কাল বিকেলে মুঠোফোন সেট নিয়ে ফিরে দেখেন, রিকশাটা নেই। রিকশাওয়ালা পড়ে আছে ধুলোর ওপর। জ্ঞান নেই। অনেক চেষ্টার পর জ্ঞান ফেরে তার। কিন্তু রিকশা কোথায়, দীপ কোথায়—কিছুই বলতে পারেনি। দীপের সঙ্গে মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো ফল হচ্ছে না। রিং হচ্ছে, ধরছে না। রাজা মিয়াকে ফোনে সব বলে দীপের খোঁজে লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। নিজেও খুঁজে বেড়াচ্ছেন আশপাশে। আপাকে এখনো এসব বলেননি তিনি।
কাল ছিল ভয়াল এক দিন। বহু বছর আগে এই দিনে এ অঞ্চলে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গিয়েছিল। ঠনঠনিয়া পান্থনিবাস বিধ্বস্ত হয়ে মারা গিয়েছিল অনেক লোক। শোনা যায়, এখনো মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে এই দিনটাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে পান্থনিবাস। ঘটে ভুতুড়ে সব কাণ্ড।
মুঠোফোনে রিং হচ্ছে। ধরতেই শোনা গেল রাজা মিয়ার কণ্ঠ। ১৩-১৪ বছরের এক কিশোরকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। ফরসা, সুন্দর চেহারা। একটা কুকুর তাকে এনে ফেলে গেছে বাজারে। পরনে লাল টি-শার্ট, জিনসের প্যান্ট। নান্টু বুঝলেন, ও দীপ ছাড়া আর কেউ নয়।
Post a Comment