ভুখা মানুষের কোনো পাপ নাই – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

ভুখা মানুষের কোনো পাপ নাই – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

সাধুচরণের সুদিনের মুখে টেপি যদি খাণ্ডবদাহনে যোগ দেয় তবে সে যে নাচার! পরান কর্তা যা সামলাতে পারবে, কেশব কর্তা যা সামলাতে পারবে তার পক্ষে সেটা যে বড় ধুনদুমার কাণ্ড। দুটো পেটে দিতে পারা যার একমাত্র দায় আর রাতে ধর্মপত্নীর পাছার কাপড় সরিয়ে হাত দেবার মধ্যে জীবনের সর্ব সুখ সার করে যে পড়ে আছে তারে কেন ঝামেলায় ফেলা। লপ্তের কাজ থেকে তাকে যে বাদ দেওয়া হল সেটাও এক ষড়যন্ত্র কি না কে জানে!—রাজি হও সাধু। রাজি হলেই হয়ে যাবে।

রাজি হইটা কি করে! টেপি আপনার বাড়ি পড়ে থাকলে, আমার চলে কি করে। জিগাই টেপিরে, কি কয় শুনি!

কয়ে দেখ। রাজি কি না।

একদিন গিয়ে সাধুচরণ বলেও এসেছিল, রাজি না। তিন বাড়ির কাজ করে আপনার বাড়ি এক ফাঁকে কাজ সামলে সুমলে দিতে পারবে বলেছে! তার বেশি পারবে না। দিনভর এক ভাতারি, কম্ম লয় তার।

কেশবের সঙ্গে টেপির লীলার কথা মনে কর কেউ জানে না! এসব হবে না। সমাজে বাস করতে হলে, এসব চলবে না এখানে। টেপিরে কয়ে দিও। পঞ্চায়েতে নালিশ এয়েছে। পরান কর্তা বলতে এসে রুখে উঠেছিল।

নালিশ! কে করল নালিশ! সাধুরও মাথা কম গরম না তখন।

তা বলব কেন সাধু। জেনে রাখ আর চেপে চুপে রাখা যাবে না।

বলেন না, কে নালিশ দিল! কার গতরে জ্বালা ধরাল টেপি।

কিন্তু পরান কর্তা বলতে সাহস পায় নি।

যার নামই বলুক তার যে রক্ষা থাকবে না, পরান সেটা ভালই বোঝে। কেশব তার বাড়িতে গিয়েই হামলা শুরু করে দিতে পারে। কোন শুয়োরের বাচ্চার কাজ টেপি কি করে না করে—তোর এত মাথা ব্যথা কেন। খেতে দিস, পরতে দিস টেপিরে কলঙ্কে জড়ালে, কার পাছায় কত গু আছে টেনে বের করব। কেশব সব জানে। বোঝে, বলে না। যখন বলে, দরজা ধরে টান মারে।

সেই সাধুচরণ এখন জনাইর আশায় আছে—ফিরে এসে কি খবর দেয়। এসেই টেপিকে কেশব কর্তা ঘরে দেখতে পায়নি, টেপিকে যে পরান টোপ দিয়েছে ত শুনে গুম মেরে গেছিল। পরানের সঙ্গে একটা জায়গায় কেশব কর্তার বড় খামতি কেশবের পয়সা, বানের জলের মত। কেশব দাঙ্গাবাজ মানুষ, কিছু রাখতে শেখেনি। টাকা হাতে এলেই ফুর্তি ফার্তা করে দু-দিনের মধ্যে উড়িয়ে দেওয়া চাই। আর রাখবেটা কোথায়! বাড়ি ঢুকতে পারে না। জননী মুখ দর্শন করবে না। দাঙ্গাবাজ, খুন রাহাজানির আসামী হলে যা হয়। দাদারা কেশব গেলেই মুখ ভার করে থাকে। দিদিরা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। দিনকে দিন বড় একা হয়ে যাচ্ছেন কর্তা। এখানটাতেই কর্তার জন্য সাধুচরণের টান ধরে যায়।

আর পরান অন্য মানুষ। কেবল রাখতে শিখেছে। সেই কবে থেকে। লক্ষ্মীকে হেলা ফেলা করতে নাই সে জানে। বিশ বাইশ বছর আগে মিলের বদলি তাঁতি এখন পঞ্চায়েত প্রধান। পার্টি করলে কত সুবিধা। মিলে একবার তেনার শুধু মুখখান দেখিয়ে এলেই চলে। প্রভাবশালী মানুষকে কে না ভয় পায়। মিলের চাবিকাঠি এখন তার হাতে। ইচ্ছে করলেই দরজা বন্ধ করে দিতে পারে, খুলে দিতে পারে। চতুর মানুষ। রাস্তাঘাট মেরামত থেকে খাল ডোবা খনন, শ্যালো বসানোতে কত টাকা! সাধুচরণের মতো কত হা-অন্ন মানুষ আছে—যারা টিপ ছাপে পরান কর্তার তফিল ভরে দিয়ে আসতে রাজি।

দে ছাপ দে। এইখানে। ভালো করে দে। ধর চার টাকা। চারটাকাই দাম দিলাম। কথা বাড়াস না।

কথা বাড়ানো যায় না। বাড়ালে মরণ। মাস্টার রোলে আর পরদিন নাম পাওয়া যাবে না। সারাদিন কোদাল কুপিয়ে চার চারটা টাকা এক কেজি গম তাও হাতছাড়া। নালিশ দেবার লোক নাই। পার্টি ফাণ্ড আছে। কে সামলায়। পরান কর্তার এক কথা।

সাধুচরণ বোঝে সংসারে চতুর লোকেরাই এখন পার্টি করে। একখান ছত্র হল গে এই পার্টি। ছায়া দেবে, আখের দেবে, পাকা দালান, কোঠা করে দেবে ভটভটিয়া দেবে। পরান কর্তার ভটভটিয়া চড়ে একবার শহরে গিয়েছিল। শাঁ শাঁ করে ঠাণ্ডা হাওয়ায় চুল উড়িয়ে দিচ্ছে।—ভালো করে ধর সাধু। পড়ে যাস না।

আসলে ভালো করে ধরাই হল দুনিয়ার সেরা কাজ। যে যত ধরতে পারে, তার আখের তত খোলতাই। কেশব এখন কোথায় আছে কে জানে। অন্ধকারে সাইকেল নিয়ে চৌধুরি মামার বাড়ি যাবার রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে নেই ত! বড় ডর লাগে। যদি ক্ষেপে গিয়ে টেপির গলা টিপে ধরে—বল মাগি পরানের বাড়িতে তর ময়ফেল কেন! বারে বারে বারণ করেছি না—ও একটা পাষণ্ড আছে, তরে দিয়ে কি কু-কর্ম করাবে তুই জানিস! হেন কাজ নাই পারে না। আমি যে একখান ষণ্ড, তারও চক্ষু লজ্জা আছে। পরানের তাও নাই। থাকলে গরিব গুরবোর পয়সা মেরে পাকা বাড়ি হাঁকাতে পারে। খুনী। আস্ত খুনী। আমি আর কি—ওটা এক ধর্মের ষণ্ড। খাবে মুড়াবে, ল্যাদাবে, তবু সবাই পূজা করবে। তুই তার বাড়ি মারাতে গেলি কেন, বল, বল মাগি। কি সুমধুর কাব্য ঝুলে ওখানটাতে বল!

সাধুচরণ ভাবল তা সুমধুর কাব্যই বটে—দু-খান রাজভোগ। পরানের বাড়িতে না গেলে ও দুটো আনত কি করে। একবার ইচ্ছা হয়েছিল সে নিজেও গিয়ে বাড়ির কোনা খামচায় বসে থাকে। অথবা কলাপাতা কেটে এক কোনায় বসে পড়ে—কিন্তু ল্যাটা হল টেপি, বাপের ইজ্জত সে না বুঝলেও ঠাকুরদার ইজ্জত কত বোঝে। তার ছেলে পাত পেতে বসে আছে দেখলে ক্ষেপে যেতে পারে টেপি। সে ভয়েই সে-দিকটায় মাড়াতে আর সাহস হয় নি। ব্যাপারে বাড়ির শুধু গান মাইকে বাজবে—বড় লোকের বেটিলো, লম্বা লম্বা চুল…

সাধুচরণ একটাই প্রশ্ন করেছিল, চার টাকা কর্তা। অবশ্য কর্তা সামনে থাকে না। তার লোক থাকে। তার সাকরেদ এখন আকছার জুটে যাচ্ছে। মধু কৈবর্তর ছাওয়ালডা তার এখন এক নম্বর সাকরেদ। লম্বা উঁচু দশাসই জোয়ান। মিলের এক নম্বর তাঁতি। তার বাপ পান বিক্রি করত বাজারে। বাপের নসিব দেখে বুঝেছিল, ওতে হবার লয়। পান বেচে খায় কান্ত মুদি, মুদি হতে হয়, অমন একখান মুদি যার কপালে জমিদারি লেখা থাকে। দিন কাল পাল্টে গেছে—কৈবর্তর ছাওয়াল টের করতে পেরেই পরান কর্তার ল্যাংবোট হয়ে গেল। তার পক্ষ হয়ে লড়ছে।

এই লড়ালড়িটা শেষ পর্যন্ত তার নসিব নিয়ে শুরু হবে বুঝতে পারে নি সাধুচরণ। প্রশ্ন করার ছক কোথায় পেলে সাধু! এত করে লোকটা, দিন নাই রাত নাই, চান খাওয়া নাই, ভটভটিয়া নিয়ে ছোটাছুটি—দেখছ না রাস্তাঘাট, কয়লার ঘ্যাঁস ফেলে কি কইরে দিয়েছেন। বর্ষায় আর কাদা ভাঙতে হয় না, পরান দাদা না থাকলে এত সব হত কোথা থেকে। টাকা নিয়ে প্রশ্ন করছ! বেইমান! বেইমান আর কাকে বলে!

সাধু কাচুমাচু গলায় বলেছিল, কথা ছেল ছ টাকা।

কার কথা?

লোকজনে কয়।

লোকজনের কথা ছাড়ান দাও। দিনকাল ভালো না। দেবে কোত্থেকে সরকার। বাড়ন্ত সব। যা পাচ্ছ নিয়ে নাও, পরে তাও জুটবে না।

যে আজ্ঞে। দেন তবে।

দিয়েছিল চারটাকা, এক কেজি গম। লপ্তে লপ্তে পেয়ে আসছিল কাজ। তখনও পরান কর্তার মর্জি ঠিক ছেল—গোল পাকাল তার বড় কন্যে টেপি। টেপি রাজি হচ্ছে না। সারাদিন সেই বা একটা বাড়িতে আটকা পড়ে থাকে কি করে। কাজ কামের সুখ্যাতি আছে টেপির। উঠতি বয়স। আগুন হয়ে আছে। খাটাখাটনিতে তার দম আটকে যায় না। পরান কর্তার কন্যেরা বড় হয়ে গেছে। গিন্নিমা এক হাতে পেরে ওঠে না। শরীরও দুবলা হয়ে গেছে। নিত্য অসুখ। টেপির মতো যদি একখান পুষ্ট গাভী থাকে তবে বাড়ির শোভা বাড়ে। কিন্তু কন্যে রাজি না হলে করেটা কি! আজ বাড়িতে ভোজ আছে বলে, লোভে পড়ে গেছে। ভোজ ত রোজ থাকে না। কর্তার যে টেপিকে রোজ দরকার। কন্যা মাথা পাতছে না। লিষ্টিতে নাম না দেখে ফিরে এয়ে বুঝেছে—গোলযোগটা কোথায়! এদিকে কন্যের পীরিতের মানুষ কেশব কর্তাও হাজির। তার হয়েছে মরণ। খিদে তিষ্টা পর্যন্ত সে ভুলে গেছে।— ও জনাইরে বাপ তোর কি ফিরতে ইচ্ছে হয় না। খাণ্ডব দাহনের আর কত বাকি বলে যা! কেশব কর্তা টেপির খোঁজে বাইর হইছে।

সহসা মনে হল কেশবের, অন্ধকারে তাকে কেউ অনুসরণ করছে। সে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। সতর্ক থাকতে হয়। নিশাচর সে। অনেক দূর থেকেও টের পায় কোনো শ্বাপদ এগিয়ে আসছে কিনা তার দিকে। তার চোখ নীল না লাল। তার জিভ লক লক করছে কি না। সে গন্ধ শুঁকে সব টের পায়। ঘাড়ের উপর কেউ যেন মারাত্মক কিছু সব সময় তুলে ধরে আছে। পুলিশ দারোগার ভয় তার নেই। যদিও মাঝে মাঝে আত্মগোপন করতে হয়, সেটা ঝড়ের মুখে পড়ে না যাওয়ার জন্য। দ্বারকা দাসের আড়তের মামলাটায় তাকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা পরানের কাজ। পরান চক্রবর্তী বুঝে ফেলেছে, কেশবকে এখন সরিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ এই একটা কাঁটা ঝুলে আছে। এমন কি যা লোক, তাকে পেটি মেরে উড়িয়েও দিতে পারে।

তার শক্রপক্ষ প্রবল। কেশব অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখল। সামনে সেই বাড়িটা। চৌধুরী মামার বাড়ি। এখানে এসে থাকত নবীন বলে একটা লোক। তার বৌ মেয়েরা আছে এখনও। নবীন নেই। আসানসোল থেকে পার্টি এসে খবর দিয়েছিল, লোকটা খোচর। লোকটার অপকীর্তির কথা বলেছিল। লোকটার জন্য দলের তিন তিনজন ঘাটের মুখে থুবড়ে পড়ল। কেশবের কাছে এসেছিল, বিহিত করতে। সে বলেছিল, আমি সব ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে দিয়ে হবে না।

হবে না বললেই কে শোনে! তার উপর চাপ বাড়ছিল।

সে সোজা কথা বলে দিয়েছিল, হবে না। হবে না এইজন্য যে সে এই জায়গাটায় মাঝে মাঝে এসে আত্মগোপন করে থাকে। টেপি নামে একটা মেয়ে তখন তার ভাত জল দেয়। এমন একটা আশ্রয় সে ভাঙতে চায় না।

তবু লোকটা খুন হল। সে না করলেও যাদের করার কথা তারা করে গেল। এই মামলাতেও তাকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একটা লোকের উপর এত মামলা থাকলে সে যায় কোথায়! পনের বিশটা মামলা ঝুলে আছে। সেদিন সে ধোলাই খেয়েছে খাগড়ার ঘাটে। খুনই করে ফেলত, চেনা লোক বের হয়ে পড়ায় গাড়িতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। হাসপাতালেও সে বেঁচে উঠত না। টেপির রাত দিন সেবা শুশ্রূষা তাকে ফের নিরাময় করে তুলেছে। সেই থেকে টেপির প্রতি তার কেমন একটা অধিকার জন্মে গেছে যেন। এতটা পথ শহর থেকে সাইকেল মেরে এসে বাড়িতে না দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়।

টেপির জন্য সে ঘোরাঘুরি করে ঠিক, কিন্তু টেপি যা পছন্দ করে সে তার বাইরে পারতপক্ষে যেতে চায় না। এক নম্বর টেপিকে সে সিনেমা দেখার জন্য পয়সা দেয়। সপ্তাহে একদিন টেপি সিনেমায় যাবেই। এটা সে করত না। তারকের মার শোষণপ্রণালী তাকে টেপির জন্য সিনেমার পয়সা বরাদ্দ করতে বাধ্য করেছে। এক কড়াই সেদ্দ কাপড় ধুয়ে দেবার বিনিময়ে টেপিকে তারকের মা সিনেমায় নিয়ে যাবে এমন কড়ারের কথা শুনতেই সে বলেছিল, দেখো বৌদি, মেয়েটা বোকা আছে। এতগুলান কাপড় নিয়ে সে যাবে মাঠের পুকুরে। ধোবে, শুকাবে। খেতে দেবে না।

তারকের মা বলেছিল, ঠাকুরপো তুমিও যেমন। দানধ্যান করে বেড়াও—তোমার কি! দাদাত তোমার মাস তোলা পাঠায়, চলে কি করে। তোমার দাদা কি মানুষ না অপদেবতা। তার বৌ হয়ে এর চেয়ে বেশি দিই কি করে। আর ওতেই রাজি হয়ে যাবে। সিনেমার নেশা, নেশা যার আছে সে বোঝে।

এতো একটা সকাল লেগে যাবে সব কাপড় কাচতে।

তখনও টেপির সঙ্গে তার তেমন জানাজানি হয় নি। গোয়ালজানের সেনবাবুকে খুন করার দায়ে তার উপর শমন ঝুলছে। তার সব ডেরার খবর পুলিশের জানা হয়ে গেছিল। কাজেই নতুন ডেরার খোঁজে তারকের মার কাছে এসে ওঠা। স্বাধীন রমণী। এক ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে থাকে। জাঠতুতো দাদার স্ত্রী। দাদা কনট্রাকটারের কাছে কাজ করে। বাইরে বাইরে থাকে। জেঠিমাকে তিষ্ঠোতে দেয় নি। ঘরছাড়া করেছে। জেঠি থাকে ছোট কাকার বাড়ি। দাদাকে সেখানে আলাদা মাসোহারা পাঠাতে হয়। আর এমন একখান চোপা তারকের মার যে, কেউ শাসন করতে সাহসই পায় না। সে এখানে এসে উঠেছিল এসব বুঝে শুনেই। জলের মতো টাকা খরচ করে, মাংস, পলান্ন একেবারে পাখা গজিয়ে গেলে যা হয়। তারকের মা খরচের বহর দেখে, মজে গিয়েছিল। তখন টেপির স্তন বেশ বড় হয়ে উঠছে। সে এসে তারকের মার কাজে সাহায্য করতে লেগে গেল। চোখাচোখি হয়। ধার আছে চোখে। সেই মামলা থেকে আর এক মামলা, আর সেই থেকে ফাঁক পেলেই নতুন ডেরায় এসে ওঠা। তারকের মা তাকে একখান ঘর ছেড়ে দেয়। তার সাঙ্গপাঙ্গরা দু-একবার ঘুরে গেছে। কিন্তু টেপিকে যেদিন থেকে সিনেমার জন্য পয়সা দিতে শুরু করল, সেদিন থেকেই একটা অলিখিত চুক্তি হয়ে গেল ভোগের।

প্রথম দিনের কথাবার্তা এমন, এই তোর নাম কি?

যান ঠাকুর! বলেই মুখ ঝামটা দিয়ে টেপি সরে গেছিল।

বা সুন্দর পাছা। ফ্রক গায়। চোখে কাজল লতা। কপালে টিপ। সবই গাছপালা শস্য ক্ষেতের মতো সবুজ হয়ে আছে। সে ডেকে বলেছিল এই শোন না। তুই কার মেয়ে?

বাবার নাম সাধুচরণ মণ্ডল।

কোথায় থাকিস?

টিকটিকি পাড়া।

তোর বাবা কি করে?

মুনিষ খাটে। আপনাগ দেশের লোক আমরা।

এক গ্লাস জল খাওয়াতে পারবি।

হুঁ পারব।

খুব ঠাণ্ডা চাই। কল থেকে নিয়ে আয়।

তারকের মার কল নাই। কল আছে ধন জেঠির বাড়িতে। ছোট কাকার বাড়িতে। তারকের মার সঙ্গে দুটো বাড়ির ঝগড়া। ঠাণ্ডা জল খাওয়াতে হলে দীনবন্ধুর বাড়ির পাশের কলটায় যেতে হবে। টেপি দৌড়ে গিয়েছিল, জল এনে দিয়ে আবার ঘরের ও-পাশে চলে গিয়ে তারকের মাকে বলেছিল, আমি যাই বৌদি।

চা হচ্ছে। এক কাপ খাবি না।

চায়ের নাম শুনে যেতে পারে না। তারকের মা এই ফাঁকে কিছু কাজ করিয়েও রাখল।—যা ত এক কলসি জল নিয়ে আয়। টেপি জল আনতে গেল।—যা ত গরুটা মাঠে আছে। নিয়ে আয়।

টেপি গরু নিয়ে এল। জল দেখাল। বলেছিল, বৌদি ঘরে তুলে দেব। না গাছে বেঁধে রাখব।

বাইরে বেঁধে রাখ। তারক এসে তুলবে।

এক কাপ চায়ের বিনিময়ে টেপি কত কাজই না দ্রুত সেরে ফেলল। ঘর ঝাঁট দিল। আলনা গুছিয়ে দিল। টেপির হাতটান নেই। তবে খাদ্যবস্তু সামনে থাকলে নাকি রাখা যায় না। টেপির সম্পর্কে এই ধরনের একটা বড় কলঙ্কের কথা প্রথম সেদিন কেশব শুনতে পায়। তা লোভে পড়ে যেতে পারে খাদ্যবস্তুর। কারণ যে এক কাপ চা খাবে বলে এত কাজ করে দিতে পারে, সে ফাঁক পেলে খাদ্যবস্তু হাপিজ করবে বেশি কি। দু নম্বর এই চা খাওয়ার জন্য কেশব একটা টাকা বরাদ্দ করে ফেলল।

গরিব মানুষের যা হয়, কাঙালপনা খুব। কেশব জানে সে দেখতে ভারি সুপুরুষ। গায়ের রঙ ঈষৎ হরিদ্রাভ। এই হরিদ্রাভ কথাটা সে তার ঠিকুজি থেকে পেয়েছে। সেখানে জাতকের বর্ণনায় এসব কথা লেখা আছে। চুল ঘন। দশাসই লম্বা চেহারা। মুখে সব সময় তার এক ধরনের ক্রোধ ঝুলে থাকে। ফলে তাকে নাকি খুব রাগী দেখায়। এটা সেও বোঝে। সংসারে কোথাও টান বোধ করে না। বাড়ি সে ঢুকতে পায় না। কারণ দাদারা তার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। সে তো নিজের জন্য কিছু করেনি। একটাই খুন তাকে করতে হয়েছে।

কেউ যেন হাত তুলে ডাকে তখন…কে…শ…ব।

দাদারে।

দাদারে বলে ডাকলে সে কেমন এখনও ছেলে-মানুষ হয়ে যায়।

সেজদা আর সে পিঠপিঠি। বাবার মুদির দোকান খাগড়ার বাজারে। চার পাঁচজন লোক রেখে কাজ। সকাল হলেই মা তাকে বিছানা থেকে তুলে দিত। সে যেত সেজদার সঙ্গে বাবার দোকানে। নতুন বাজার পার হয়ে যেত। মহাকালী পাঠশালা পার হয়ে যেত। দোকানে গেলে বাবা বাজারের টাকা দিতেন। দু-ভাই বাজার করে ফিরত। লিচুর দিনে লিচু, আমের দিনে আম আসত ব্যাগ ভর্তি। দুপুরে গঙ্গায় সাঁতার কাটতে যেত। ভরা বর্ষায় গঙ্গা পার হয়ে যেত। চারপাশে মানুষজন, সবই কত প্রিয় ছিল তার। কতদিন শহর থেকে রিক্স করে বাবার সঙ্গে জ্যাঠাদের দেখতে এয়েছে। গাছে গাছে নানারকম ফল ধরে থাকে। এটা নেয়, ওটা পেড়ে নেয়—চঞ্চল প্রকৃতির সে। কেউ কখনও কিছু দেবে না বলে নি। চারপাশে যখন যেভাবে হাত বাড়িয়েছে পেয়ে গেছে। বড় টান ছিল বংশের প্রতি। জ্যেঠা-জেঠিমাদের প্রতি। সে আরও বড় হয়ে স্কুল পালাতে শিখল। তার পড়াশোনা একদম ভালো লাগত না। মা তাকে পড়াতে বসার জন্য দোতলায় সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে রাখত। কিন্তু বাইরে যে তাকে কে টানে! দিদিরা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, বড়দা কলেজে যায়—তাকে নিয়ে মার ভারি ভাবনা—কি যে হবে! কেশব এসব ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাসল। এখন সেই মা তাকে দেখেও যেন দেখে না। কতবার যে সে মাকে দেখবে বলে, নতুন বাজারের দিকে সাইকেল চালিয়ে যায়—মা যদি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে—এত কাছে থেকেও সে কতকাল যেন তার মাকে দেখে না। বড় দূরের হয়ে গেছে সে।

ওর বুক বেয়ে দীর্ঘশ্বাস ওঠে।

তারকপুরের মাঠ পার হয়ে রাস্তাটা এখানে বাঁক খেয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সব পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু এই অঞ্চলে ঘর বাড়ি বানিয়েছে। এই পথ ধরেই টেপি ফিরবে। এখান থেকে পরান চক্রবর্তীর বাড়ির সব দেখা যায়। টুনি আলো জ্বলছে, গাছে, দেওয়ালে দরজায়। যেন একখান ইন্দ্রপুরী। টেপিকে রাস্তায় ধরবে বলে অপেক্ষা করছে। সে একটা তালগাছের পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেলখানা জঙ্গলের মধ্যে ঢোকানো। যেই যাক রাস্তা ধরে তাকে দেখতে পাবে না। টেপি পরানের বাড়িতে সারাদিন ধরে কি করছে! কেমন সংশয় তার! এই সংশয় থেকেই সে যত কুকর্ম করে ফেলে।

আর এ সময়েই মনে হল, আবার কেউ তাকে দূর থেকে দেখছে। সে তখন চুপচাপ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ঝোপ থেকে যেন উঠে গলা বাড়িয়ে কেউ তাকে দেখে আবার ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তার মুখটা এমনিতেই গম্ভীর হয়ে আছে। ভেতরটা জ্বলছে, তার উপর কেউ যদি অনুসরণ করে তবে ভয়ের। ভাগ নিয়ে তার সঙ্গে এখন আর কারো বিবাদ নেই। কোনো বচসা হয় নি। বলতে গেলে সে লাইন ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু মুশকিল, সে ছেড়ে দিলেই লোকে তাকে ছাড়বে কেন! কেউ তাকে বিশ্বাস করে কোনো কাজ দেয় না। যার যত ঠ্যালা তাকে সামলাতে হয়। কাজ উদ্ধার হলে যৎকিঞ্চিৎ তার ইনাম। তার মাস্তানি স্বভাবটার জন্যই যেন তার এখন যত জ্বালা। একবার কেউ কাতর গলায় এসে বললে, না-ও করতে পারে না। জমির সীমানা নিয়ে গণ্ডগোল, চাঁদা আদায় নিয়ে গণ্ডগোল—সর্বত্র তার ডাক পড়ে। সেও অবাক হয়েছে, গেলেই সব কিছু জলের মতো সোজা সরল হয়ে যায়। তার কথাবার্তা নাকি খুব ট্যারা। সে নাকি কখনও সহজ ভাবে কথা বলতে পারে না। চোখ ভাটার মতো ঘোরে এবং রক্তবর্ণ। পরান চক্রবর্তী মারদাঙ্গায় তাকে দু-বার কাজে লাগিয়েছে। সে পরানের কাজটাজ উদ্ধার করে দেয়। খয়রতির টাকার হিসাব ঠিক রাখতে পারেনি। সরকারি লোক এসে ধরে ফেলেছে। পরানের দরকার পড়েছিল তাকে। হুমকি দিয়ে সে সই আদায় করে দিয়েছিল। পরান তাকে খাল কাটার ছোট একটা কন্ট্রাকটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সে ওখানে কারো পয়সা মারে নি। তার হিসেবের লাভের চেয়ে এক পয়সাও বাড়তি টাকা সে নেয় নি। কারণ তার মনে হয়েছে, সৎভাবে কাজ করলে সে আরও কাজ পাবে। কিন্তু পায় নি। পরান তাকে ঘোরাচ্ছে।

সহসা পাশের ঝোপ জঙ্গল নড়ে উঠল সে চিৎকার করে উঠল, কে কে? কে ওখানটায়। ট্যাঁক থেকে সাঁ করে কিছু একটা বের করে চেপে ধরল!

জনাই বলল, আমি জনাই কেশবদাদা। ভয় লাগছিল, আপনি না আর কেউ!

টেপির ছোটভাই জনাইটাও যে এখানে জঙ্গলে দেখছি ওঁৎ পেতে আছে।

তুই কী করতে?

বাপ বুলল, আপনি কোনদিকে গেছেন দেখতে।

টেপি ফিরেছে।

হ্যাঁ।

যা। কখন ফিরল, আমি তো দাঁড়িয়ে আছি সেই কখন থেকে।

জনাই ভাবল, মিছে কথা হয়ে যেতে পারে। কেশব দাদার চণ্ড রাগ মাথায় উঠে গেলে, মতিস্থির রাখতে পারে না। সে বলল, ফিরে যাবার কথা। আমাকে একটা মিষ্টি দেছিল, নিয়ে গেছি। আবার এনে দেবে বলে বসে আছি। কিন্তু, আসছে না।

কেশব বলল, আমি জানি ফিরে যায় নি। তুই যা তো। একবার খবর দিয়ে আয় তোর দিদিকে, আমি দাঁড়িয়ে আছি। শিগগির আসতে বল।

জনাইর এখন আর ভয়ডর নেই। একটা লোককে অন্ধকারে খুঁজে বেড়াতে গেলে একেবারে দৌড়ে তার কাছে যাওয়া যায় না। দেখতে হয় সেই লোকটা না অন্য কেউ। রাতে কত রকমের জিন-পরী হেঁটে বেড়ায়। ঝোপ জঙ্গলে উঁকি দিয়ে থাকে। সে অনেকক্ষণ থেকে একটি ছায়ার মতো কিছু দেখেও সহসা কাছে যেতে সাহস পায় নি। কে কে বলে চিৎকার না করলে সে বুঝতেই পারত না কেশবদাদা দিদির জন্য অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সে ভেবেছিল ঝুমিদের বাড়ি গেছে—সেখানে সে খোঁজ করতে গিয়ে ধমক খেয়ে ফিরেছে। ঝুমির মা বলেছে, আমাদের বাড়ি আসবে কেন। আসে নি। জনাইও বোঝে কেশবদাদা যার বাড়িতে যায় তারই দুর্নাম ছড়ায়। কেউই চায় না কেশবদাদা কারো বাড়িতে ঢুকুক। তার খোঁজে কারো বাড়ি গেলে রাগ করতেই পারে। তারপর সে দিদির আশায় জঙ্গলে ওঁৎ পেতে বসে থেকেছে। কখন দিদি আবার অন্ধকারে ঢুকে ফিস ফিস গলায় ডাকবে—ও জনাই, জনাইরে! এই নে। পালা।

সে বলল, দেখে আসব বলছেন!

তাই তো বললাম।

সে দৌড় লাগাল।

রাস্তাটা সামনে টাল খেয়ে নিচে নেমে গেছে। তারপর পরান চক্রবর্তীর বাড়ির সামনে বেলগাছটার কাছে গিয়ে রাস্তাটা উঁচু হয়েছে। জনাই কিছুটা যেতেই অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। কেশব সাইকেলটা বের করে হাঁটা দিল। জনাই ফেরার সময় এ রাস্তাতেই ফিরবে। কিছুটা এগিয়ে থাকার জন্য যেন হাঁটা। কখন থেকে পরান চক্রবর্তীর বাড়িতে উঠে গেছে টেপি কে জানে। ভালো খাবারের লোভ থাকলে মেয়েটার বড় সেখানে ঘুর ঘুর করার স্বভাব। এই লোভে ফেলে কত লোক যে টেপিকে কত রকমের কাজ করিয়ে নেয়। খাটতেও পারে দস্যির মতো। মা মাসি ডেকে সবাইকে সহজে আপনও করে নিতে পারে। টেপির অনেক সদগুণ শুধু খাবারের লোভে নষ্ট হয়ে যায়। পেট ভরে খেতে পেলে, ওর এতটা বোধহয় লোভ থাকত না। টেপির জন্য সে কেমন বড় আবেগ বোধ করে। এটাও তার নেই। তার সেজদা খুন হওয়ার পর এসব বোধ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছিল। টেপির সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের পর আবার তার কেন জানি ভালোভাবে বাঁচার একটি স্পৃহা ধীরে ধীরে ভেতরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।

আর তখনই দেখল, অন্ধকারে জনাই ছুটে আসছে। হাঁপাচ্ছে। প্যান্টটা হড় হড় করে কোমর থেকে নেমে যাচ্ছিল, সেটা এক হাতে ধরে চিৎকার করে উঠল, দিদিরে আটকে রেখেছে পরান কর্তা।

মাথা গরম মানুষের যা হয়, কেশব দু-লাফে এগিয়ে যাবার আগে বলল, আটকে রেখেছে কেন।

জানি না। বলছে মিষ্টির হাঁড়ি চুরি করেছে দিদি। না দিলে আসতে দেবে না। শাসাচ্ছে, বল কোথায় রাখলি। পুলিশে খবর দেবে বলছে।

শালা। মুখ থেকে তার এমন কুবাক্য বের হতেই সে বুঝল, মাথা তার ঠিক নেই। সাইকেলটা জনাইকে দিয়ে বলল, ধর। দেখছি শুয়োরের বাচ্চা, হারামি কি করে আটকে রাখে।

তখনই মাইকে সেই গানটা ঘুরে ফিরে বাজছে—বড় লোকের বিটিলো, লম্বা লম্বা চুল, অ্যামনে মাথায় বিনধে দেব লাল গেঁদা ফুল।

কেশব বেল গাছটার নিচে গিয়ে এক-বার দম নিল। তারপর ব্যাপারে বাড়িতে ঢুকে হাঁকড়াল, পরানদা আছ!

কে!

আমি শালা যম আছি। তোর দাদাকে ডাক।

পরান জানালা দিয়ে দেখল মূর্তিমান শয়তানের মতো হ্যাজাকের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে কেশব।

সে গলা খাঁকারি দিয়ে বের হয়ে এল। চারপাশে সাঙ্গপাঙ্গরা। বলল, আয় ভাই। তুই! এখানে! তোর কথা সকালে মনে হয়েছে। তোকে বলতে পারি নি। কোথায় থাকিস! ছেলের অন্নপ্রাশন। দুটো খেয়ে যাবি।

মুখ গোমড়া। থাম, শালা শুয়োরের বাচ্চা বললেও লোকটার মাথা গরম হয় না। সে বলল, টেপিকে আটকে রেখেছ কেন। ও কী করেছে?

আর বলিস না ভাই। ভাঁড়ার থেকে সব চুরি। মিষ্টির হাঁড়ি নেই। সব হাতের কাজ। তোরা নিজের লোক হয়ে যদি এমন করিস!

ছেড়ে দাও। ও নিয়েছে কি করে জানলে?

কে নিতে আসবে বল? গোনাগুনতি সব। এত রাতে পাব কোথায়?

আগে ছেড়ে দাও বলছি।

না ছাড়লে কি করবি? পরান দেখল তার সাঙ্গপাঙ্গরা ঠিকই আছে।

কেশব বলল, কেন মিছিমিছি হুজ্জোতি করছ দাদা। ছেড়ে দাও। লাইন ছেড়ে দিয়েছি। নয়ত, বলে সে দাঁড়াল না। কোনদিকে আছে খুঁজতে বাড়ির ভেতর ঢুকতে চাইলে—ওর কলার চেপে ধরল কেউ।

কেশব মাছি তাড়াবার মতো হাত ছাড়িয়ে দিতে গেল। বুঝল, তাকে বেশ শক্ত করে ধরে রেখেছে। ছাড়াতে পারছে না। সে চিৎকার করে উঠল, কি হচ্ছে এটা।

পরানও চায় না, ব্যাপারে বাড়িতে মারদাঙ্গা হোক। সে বলল, এই ছেড়ে দে। শোন ভাই, তুই দুটো খেয়ে যাবি।

কেশব শুধু বলল, কোথায় টেপি!

ছেড়ে দিচ্ছি। তবে এটা তোর ভালো কাজ হচ্ছে না।

শুয়োরের বাচ্চা, ভালোমন্দ তুই বুঝিস! যা বলছি কর। আসলে কেশব জানে এটাই তার শেষ অস্ত্র। দাবড়ানির কাছে সবাই জুজু।

কিন্তু এটা কি হচ্ছে! পেছন থেকে কিছু লোক তাকে জাপ্টে ধরছে কেন! তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে কেন। সে চারপাশ তাকিয়ে দু-হাত তুলে সহসা ক্ষেপা মোষের মতো তেড়ে গেল। আর কখন সে নিজেও জানে না, শক্ত মতো জিনিসটা কার পেটে সে ঢুকিয়ে ছুটছে। শেষবারের মতো সে তাকাল—হল্লা চিৎকার, মানুষজন সব ছুটে আসছে পেছনে। অন্ধকারে সেই সাইকেলটা নিয়ে জনাই দাঁড়িয়ে। শুধু বলল, পালাচ্ছি। তোর দিদিকে বলিস বেঁচে থাকতে। আমি আবার ঠিক আসব।

সেই ফাঁকে টেপিও পালিয়েছে। অন্ধকার জঙ্গল থেকে হাঁড়িটা নিতে ভোলে নি। যখন পরান চক্রবর্তীকে নিয়ে সাঙ্গপাঙ্গরা হাসপাতাল যাচ্ছে, তখন টেপি, সাধুচরণ, জনাই, তার মা, জঙ্গলে বসে অন্ধকারে গবাগব রসগোল্লা সাঁটাচ্ছিল। মুখের মধ্যে একটার পর একটা—বিষম খেল সাধুচরণ—টেপি বাপের মাথায় ফুঁ দিয়ে বলল, রাক্ষসের মতো খাচ্ছিস। বিষম লেগে মরবি যে বাপ।

সেই বিষম খাবার মুখেও সাধুচরণের চৈতন্য ঠিক আছে—জলদি সাবাড় কর। হাড়িটা খালের জলে ফেলে দে। চুরি চামারির কোনো চিহ্ন রাখতে নেই। বাবুজনেরা কায়দাটা ভালো জানে।

বৌ বলল, মরণ! হাঁড়িটা কত কাজে আসবে!

সাধু হাত চাটছিল। জনাই হাত ঢুকিয়ে রস তুলে নুয়ে খাচ্ছে। টেপির সারাদিন খাটাখাটনি গেছে। কাজের বাড়ির জল, বাটনা, সকাল থেকে সন্ধে কোমর ধরে আছে। সেও শেষবেলায় খেয়ে পেল্লায় উদগার তুলল একটা। সারাদিন ভুখা থাকার পর এই আহার পরম তৃপ্তির। মাথা ঠাণ্ডা। ফিস ফিস গলায় জঙ্গলের মধ্যে কথাবার্তা, পরান কর্তা শেষ।

জনাই ছেলেমানুষ। তার পাপবোধ প্রখর। সে শুধু বলল, বাপ পাপ হবে না?

সাধুচরণ কেমন স্থবির গলায় বলল, ভুখা মানুষের কোনো পাপ নাই হে ভগবান।

No comments