ভুতুড়ে কামরা – ইশতিয়াক হাসান

ভুতুড়ে কামরা – ইশতিয়াক হাসান

ভুতুড়ে কামরা

বিশেষ কোনো কামরাকে ঘিরেও ঘটতে থাকে ব্যাখ্যার অতীত নানান আজগুবি কাণ্ডকীর্তি। ‘ভুতুড়ে কামরা’য় পাবেন এসব কামরার কাহিনি ‘সব ভুতুড়ে’।

১. আলমারিতে কঙ্কাল

এই কাহিনিটি শুনিয়েছেন সিঙ্গাপুরের এক ব্যাংক কর্মকর্তা। তাঁর এক বান্ধবীর অভিজ্ঞতা এটা।

আমার বান্ধবী তার মার সঙ্গে থাকে। আন্টি আবাসিক একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দেখভাল করেন।

মধ্যবয়স্ক এক মহিলা ওখানের একটা কামরায় থাকতেন। একদিন হঠাৎ মারা গেলেন তিনি। কামরাটা পরিষ্কার করতে গিয়েই আলমারির মধ্যে একটা কংকাল আবিষ্কার করলেন আন্টি আর অন্যরা। কঙ্কালটা কীভাবে আসল সেখানে তা কেউই বলতে পারবে না।

এরপর থেকে মহিলাটির মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে ওই কামরাটা থেকে অদ্ভুত একটা বদ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। প্রথম বছর ওটার কারণ খুঁজতে আন্টি গিয়েছিলেন ভিতরে। কিন্তু ওটা এতটাই তীব্র যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় তার। কোনো মতে পালিয়ে বাঁচেন। পরের বছর থেকে গন্ধটা একটু হালকা হয়, কিন্তু মৃত্যুবার্ষিকীর দিন নিয়ম করে ওটার উপস্থিতিতে কোনো ছেদ পড়েনি।

গত বছর মহিলাটির মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে আমার বান্ধবী ওই কামরার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাবে এমন সময় মনে হলো পিছন থেকে তার নাম ধরে ডাকছে কেউ। কণ্ঠটা তার মায়ের আর ওটা আসছে ওই ভুতুড়ে কামরাটার ভিতর থেকে!

কিন্তু সে নিশ্চিত মিনিট কয়েক আগেও তার মা ছিলেন নীচের তলায়। আবার বান্ধবীটির নাম ধরে ডাকল। সন্দেহ নেই। কামরাটার ভিতর থেকেই আসছে ওটা। ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে। তাকে যেন কেউ টেনে নিয়ে চলেছে। যতই কাছে যাচ্ছে গন্ধটা তত তীব্র হচ্ছে। এসময়ই শুনল তার মা তাকে ডাকছেন। কণ্ঠটা চড়া আর পরিষ্কার।

তবে আসছে নীচের তলা থেকে!

সঙ্গে সঙ্গে ঘোর কেটে গেল। দৌড়ে নীচে নেমে মাকে সেখানে পেল। তাকে ঘটনাটা খুলে বলতেই দারুণ একটা ধাক্কা খেলেন। তবে যতটা না ভয় পেলেন তার চেয়ে বেশি রেগে গেলেন। কিন্তু অশরীরীর বিরুদ্ধে কী-ই বা করার আছে তাঁর।

যতদূর বোঝা যাচ্ছে মৃত মহিলাটি সেদিন ওই কামরার মধ্যে ঢুকাতে চেয়েছিল আমাকে। আমার বান্ধবীটি আমাকে বলল, ভাগ্য ভাল। একেবারে ঠিক সময়ে মা আমাকে ডাকটা দিয়েছেন।

২. রুশ ভূত

এবার যে কাহিনিটি বলব এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন মি. ডব্লিউ. ডি. এডিসন। আর এটা তিনি পাঠান মি. ডব্লিউ. টি. স্টিডকে, যিনি এটা প্রকাশ করেন বর্ডারল্যাণ্ডে।

১৮৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়াতে মি. এডিসনের বাসায় ঘটনাটি ঘটে। মাত্র সপ্তাহ পাঁচেক আগে তাঁদের প্রথম সন্তানটি পৃথিবীতে এসেছে। তাই ড্রইং রুমে পাতা একটা বিছানায় আপাতত ঠাই হয়েছে এডিসনের। খুব একটা বড় না হলেও বাসাটা বেশ খোলামেলা আর আলো-বাতাস ঢোকার বেশ ভাল সুযোগ আছে।

ঘটনার রাতে দশটার একটু পর পরই বিছানায় চলে গেলেন এডিসন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তলিয়ে গলেন গভীর ঘুমে। সাধারণত সকাল পর্যন্ত টানা ঘুম হয় তাঁর। তবে এই রাতে স্বপ্নহীন ছোট্ট একটা ঘুমের পরেই জেগে উঠলেন। কেন যেন মনে হয়েছে কেউ মাম ধরে ডেকেছে তাঁকে। উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ভেবে চিন্তাটা ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবেন এমন সময় আবার শুনলেন শব্দটা। ফিসফিস করে সত্যি কেউ তার ডাক নাম ধরে ডাকছে, উইলি। এখন যে নার্সটি বাচ্চাটার দেখাশুনা করে আর শোবার ঘর লাগোয়া ডাইনিংয়ে থাকে, কয়েক দিন হলো সে অসুস্থ। গত সন্ধ্যায়ও তার স্ত্রী এডিসনকে ডেকে নিয়ে গেছেন সাহায্য করার জন্য। কাজেই যখন ফিসফিস শব্দটা শুনলেন প্রথমেই তার মনে হল, ওহ! বাবুটা যন্ত্রণা করছে আবার।

কামরাটায় জানালা আছে তিনটা। আকাশে চাদনেই তবে তারারা ঝলমল করছে। এদিকে তুষার পড়ার কারণে এতে প্রতিফলিত আলোও আছে। কাজেই ঘরের ভিতরটা অন্ধকার বলা যাবে না।

মাথা ঘুরিয়ে বিছানার কিনারায় একটা নারী মূর্তি আবিষ্কার করলেন এডিসন। কোনো ধরনের চিন্তা ছাড়াই ধরে নিলেন ওটা তার স্ত্রী।

কী ঘটনা? জানতে চাইলেন।

কিন্তু ছায়ামূর্তিটা নীরব আর স্থিরই রইল। ইতোমধ্যে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে এডিসনের। লক্ষ করলেন, নারীদেহটার কাঁধ আর মাথা ধূসর একটা শালে ঢাকা। তারচেয়ে বড় কথা কাঠামোটা তাঁর স্ত্রীর তুলনায় আরও বেঁটে। একদৃষ্টিতে ছায়ামূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভাবছেন কে হতে পারে এটা?

এবার এখানকার ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী চাও?

কিন্তু উত্তর মিলল না। এসময়ই মনে হলো এটা মনে হলো তাঁদের কাজের মেয়েটা। ওর ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়াবার বদভ্যাস আছে। এডিসনের শয্যার কাছেই একটা টেবিল আছে। ছায়ামূর্তিটার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই ম্যাচবাক্সটা নেওয়ার জন্য টেবিলের কাছে পৌঁছলেন। ম্যাচবাক্সটা হাতে নিলেন। কিন্তু কাঠিটা জ্বালার আগেই তাকে চমকে দিয়ে কাঠামোটা যেন মেঝে থেকে শূন্যে উঠে গেল। তারপর পিছু হটতে হটতে কামরার শেষ প্রান্তের জানালাটার দিকে সরে পড়ল। ধীরে ধীরে মলিন হতে হতে জানালায় যখন পৌঁছল, ঝাপসা একটা ধূসর অবয়বে পরিণত হয়েছে। ম্যাচের কাঠি ধরাতে ধরাতে পুরোপুরি অদৃশ্য হলো। মোমবাতি জ্বেলে লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন এডিসন। ওটা লাগানো। ড্রইং রুমের পাশেই একটা সাজঘর আছে। কামরা দুটোকে আলাদা করেছে কেবল একটা পর্দা। এই কামরাটাও খালি, আর দরজাটার দোর আটকানো।

রীতিমত বিস্মিত হয়ে গেছেন এখন এডিসন। চোখ ডললেন কয়েকবার। এসময়ই প্রথমবারের মত একটা কথা খেয়াল হলো তাঁর, কাঠামোটা একটু অস্পষ্ট ছিল। এদিকে একমাত্র তার স্ত্রীই তাকে উইলি নামে ডাকেন, আর কেবল তিনিই নামটা ইংরেজ উচ্চারণে বলেন। আরেকবার ভালমত ড্রইং রুম আর সাজঘরটা পরীক্ষা করলেন। তারপর দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। এবার স্ত্রীর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতলেন। বাচ্চাটা কাঁদছে আর তাঁর স্ত্রী সজাগই আছেন। আস্তে আস্তে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন। তাঁর স্ত্রী, বেশ সাহসী মহিলা-এটা জানা থাকায় পুরো ঘটনাটি খুলে বললেন তাকে। শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তারপর জানতে চাইলেন তিনি কি কামরাটায় ফিরতে ভয় পাচ্ছেন কিনা? এডিসনও বেশ সাহসী মানুষ। কাজেই এখনই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখলেন না। কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের কামরায় ফিরে এলেন। খুব শান্তভাবে পুরো বিষয়ুটা নিয়ে ভাবলেন। কিন্তু এটার কোনো ব্যাখ্যা বের করতে পারলেন না। এদিকে দু-চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। মোমবাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

আবারও স্বপ্নহীন ছোট্ট একটা ঘুমের পর জেগে উঠলেন। এবার তার মুখটা মাঝখানের জানালার দিকে। ওটার কাছেই আবার দেখলেন ছায়ামূর্তিটাকে। বাইরে থেকে আসা আলোর পটভূমিতে বেশ কালো মনে হলো কাঠামোটাকে।

তড়িঘড়ি ম্যাচের জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে টেবিলটাকেই উল্টে দিলেন। মোমবাতি, চাবি, ঘড়িসহ আরও নানান জিনিসপত্র নিয়ে বিকট শব্দে মাটিতে পড়ল ওটা। তবে তাঁর চোখ সেই গাঢ় কাঠামোটার দিকেই। তারপরই লক্ষ করলেন, জিনিসটা যাই হোক, এই মুহূর্তে সরাসরি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এক মুহূর্ত পরে দরজার দিকে যাবার পথও আটকে দেবে। আঁধারে অজানা একটা জিনিসের মুখোমুখি হওয়া মোটেই আনন্দের বিষয় নয়। মুহূর্তের মধ্যে বিছানার চাদরটা তুলে দুই কোনা দুই হাত দিয়ে ধরলেন শক্ত করে। তারপর সরাসরি ছায়ামূর্তিটার দিকে লাফ দিলেন। ভাবছেন চাদরটা দিয়ে ওটার মাথা, চোখ-মুখ ঢেকে ফেলে আক্রমণের প্রথম ঝাপটাটা সামলাবেন। পর মুহূর্তেই জানালার সামনের একটা সোফার ওপর গিয়ে পড়লেন। হাতদুটো গিয়ে ঠেকল জানালার গরাদে। তারপরই আঁতকে উঠলেন। ওটাকে অতিক্রম করে গেছেন। ছায়ামূর্তি এখন তার পিছনে। ঝটিতি ঘুরে দাঁড়ালেন। পরমুহূর্তেই গাঢ় অন্ধকারের একটা জালে যেন আটকা পড়লেন। ওটাকে স্পর্শ করা যায় না। আবার একই সঙ্গে এতটাই ঘন যে মনে হলো যেন তার ওপর ভারি একটা কিছু চড়ে বসেছে। চারপাশ থেকে প্রচণ্ড একটা চাপ অনুভব করলেন। নড়তে-চড়তে পারছেন না একটুও। বিছানার চাদরটা তার বাম বাহুতে ঝুলছে, আর ডান হাত মুক্ত। কিন্তু ওজনদার কিছু একটা যেন ওটাকে চেপে ধরেছে। সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে চাইলেন। মনে হলো যেন তার জিভটা শুকিয়ে গেছে, আর কয়েক ইঞ্চি পুরু হয়ে তালুতে আটকে গেছে। একটা শব্দও বের হলো না মুখ থেকে। তারপরই প্রচণ্ড চেষ্টার পর কিছু একটা বের হলো মুখ দিয়ে। আধা প্রার্থনা, আধা ভয়মিশ্রিত অসংলগ্ন কিছু শব্দ ওগুলো। সমস্ত মানসিক আর শারীরিক শক্তি এক করে শেষ চেষ্টা চালালেন। এতেই ভয়াল ওই জিনিসটার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন। পরের কয়েক সেকেণ্ডে দরজার নাগাল পেলেন, ওটা খুলে বের হয়ে আসতে পারলেন বারান্দায়। নিজের হৃৎপিণ্ড বাড়ি খাওয়ার ধপ ধপ শব্দ শুনতে পাচ্ছেন পরিষ্কার। ভয়টা দূর হয়ে গেল মন থেকে। তবে মনে হলো যেন জীবন বাঁচাতে মাইলের পর মাইল দৌড়েছেন। আর একটু সুযোগ পেলেই ওটা তাঁকে শেষ করে দিত।

আবার স্ত্রীর কামরার সামনে চলে এলেন। আওয়াজ শুনে বুঝলেন জেগে আছেন তিনি আর বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। দরজা ধাক্কাতেই তিনি খুলে দিলেন। এডিসনের চেহারার হালই তার কাছে পরিষ্কার করে দিল কিছু একটা ঘটেছে। মুখ দিয়ে ফোটায় ফোঁটায় ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, চুল ভেজা। আর কয়েক গজ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাঁর হৃৎপিণ্ডের দ্রিম দ্রিম।

সেই রাতে কী ঘটেছে তার কোনো ব্যাখ্যা এডিসন বের করতে পারেন নি কখনই। তবে ঘটনাটা যখন তাদের আগে এই বাড়িতে যারা ছিলেন তাঁরা শুনলেন তখন একটা ঘটনা বললেন। এক রাতে বাড়িতে আসা এক অতিথির এই কামরায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ওই ভদ্রলোক কামরাটায় থাকতে অস্বীকার করে বলেছিলেন ওটা ভুতুড়ে।

৩. ভয়াল মুখ

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের দারুণ গরম একটা দিন। হঠাৎই কর্ডোভার বেলমিজ গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে খুব শশারগোল শোনা গেল। এই এলাকাটা পড়েছে স্পেনের আন্দালুসিয়া প্রদেশে। বুড়ি দাদি ফিলোমেনা রান্না করছেন। রান্নাঘরের মেঝের ওপর বসে আছে ছেলে-মেয়েরা। আপাত কোনো কারণ ছাড়াই যেন তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল আর নিজেদের মধ্যে চিৎকারচেঁচামেচি জুড়ে দিল। মেজাজ খিচড়ে গেল বুড়ি দাদির। রাগত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ হৈচৈ বাধিয়ে দিলি কেন?

বাচ্চারা উত্তর দিল না। তবে আঙুল দিয়ে রান্না ঘরের মেঝে দেখিয়ে দিল। ফিলোমেনা যখন দেখলেন ওগুলোকে তখন রক্ত জল হয়ে গেল তার, মুখে ফুটে উঠল আতংকের রেখা। একটার পর একটা বেশ অনেকগুলো মুখ গজিয়ে উঠছে গোলাপি মেঝেতে।

ছেলে-মেয়েগুলোকে সাহস দেওয়ার জন্য একটা ডাস্টার তুলে মুখগুলো মোছা শুরু করলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু তো হলোই না, উল্টো চোখ বড় বড় করে এভাবে হাসির ভঙ্গি করল মুখগুলো, যে সবচেয়ে সাহসী মানুষেরও আত্মা শুকিয়ে যাবে।

দেরি না করে বাড়িটা খালি করে সরে পড়লেন ওর বাসিন্দারা। আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। প্রশাসনের কর্মকর্তা আর পুলিশ পিলে চমকে দেওয়া এই ঘটনার তদন্ত শুরু করলেন। কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও এই মুখগুলোর আবির্ভাবের কোনো বাস্তবসম্মত কারণ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলেন। অতএব বাড়ির মালিককে নতুন একটা মেঝে বানানোর পরামর্শ দিলেন তাঁরা। পুরো মেঝে খুঁড়ে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে তারপর নতুন মেঝে বনাননা হলো। এবার রেহাই মিলবে অদ্ভুতুড়ে এই মুখেদের কবল থেকে, এই ভেবে নিশ্চিন্ত হলেন সবাই। কয়েকটা দিন শান্তিতেই কাটল। তারপর একের পর এক নতুন সব চেহারা ভেসে উঠতে লাগল নতুন মেঝেতে।

আবার ডাক পড়ল তদন্ত কর্মকর্তাদের। এবার গোটা এলাকাটা গভীর করে খুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন তাঁরা। এবার কিন্তু বেশ কিছু সমাধি পাওয়া গেল এখানকার মাটির নীচে। ধরে নেওয়া হলো মধ্যযুগে একটা গোরস্থান ছিল জায়গাটা। আবারও নতুন একটা মেঝে বানানো হলো। পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে নতুন নতুন মুখ আবির্ভূত হতে লাগল মেঝেতে। এখন এমনকী মুখগুলো পুরুষ না মহিলার এটাও বোঝা যাচ্ছে।

বাড়িটাতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে অদ্ভুত এই ঘটনার রহস্য উদ্ধারে জোর তদন্ত শুরু হলো। এমনকি মৃদুতর শব্দও রেকর্ড করার জন্য অত্যাধুনিক আর স্পর্শকাতর সব যন্ত্রপাতি পাতা হলো। ফলাফল পেতেও দেরি হলো না। গোটা এলাকটাতে অবাক করা কণ্ঠ, গোঙানি আর অপরিচিত ভাষায় কথা রেকর্ড করা হলো।

এবার এসব অতৃপ্ত আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা করলেন গ্রামবাসীরা। আর এরপরই বন্ধ হয়ে গেল ভৌতিক সব মুখ দেখা দেওয়া। অনেক বিশেষজ্ঞই পরে বেলমিজ গ্রামের এই আশ্চর্য ঘটনা তদন্ত করে দেখেছেন। তাঁরা সবাই একমত হয়েছেন এর পিছনে কোনো ধরনের ছলচাতুরি বা মানুষের হাত ছিল না।

৪. রক্তচিহ্ন

এবারের অভিজ্ঞতাটি চার্চ অভ ইংল্যাণ্ডের এক যাজকের। তিনি তখন ইতালির ফ্লোরেন্সে ব্রিটিশ দূতাবাসের গির্জার যাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁর মুখ থেকেই শুনব কাহিনিটি।

১৮৫৬ সালে স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমুদ্রতীরবর্তী একটা জায়গায় ছুটি কাটাচ্ছি। এসময়ই ব্যক্তিগত একটা কাজে তিন-চারদিনের জন্য তাদের ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আগস্টের আট তারিখ সন্ধ্যায় অপ্রত্যাশিত এক অতিথি হিসাবে একটি বাড়িতে হাজির হলাম। এই বাড়ির যিনি কর্তা তাঁর সঙ্গে কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছে আমার। আর ওই মুহূর্তে কোনো একটি কারণে আমার বোনও ওই বাড়িতেই থাকছে।

পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেছে। তারপর আবার ভ্রমণে ক্লান্ত। খাওয়া-দাওয়া শেষে দেরি না করে বিছানায় চলে গেলাম। অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। তিন-চার ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম আসছে না দেখে খুব একটা অবাক হলাম না। কারণ অপরিচিত জায়গায় কখনওই ভাল ঘুম হয় না আমার। আরও কিছুক্ষণ ঘুমাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দিনের পরিকল্পনা সাজাতে লাগলাম মনে মনে। এভাবে কিছুটা সময় পার হলো। তারপরই হঠাৎ খেয়াল করলাম কামরায় একটা আলো দেখা যাচ্ছে। ঘুরেই একটা নারীর অবয়ব দেখতে পেলাম। আরেকটা বিষয় লক্ষ করলাম এসময়ই। যে আলোয় নারীটিকে দেখেছি সেটা যেন কোনো উৎস ছাড়া আপনা আপনি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। স্থির দৃষ্টিতে কাঠামোটার দিকে তাকালাম। কিন্তু অবয়বটা পরিষ্কার হলো না। একটু দূরত্ব পেরিয়ে যেভাবে এসেছে সেভাবে হঠাৎ অদৃশ্য হলো।

শুরুতে আমার মনে হলো এর মধ্যে কোনো কৌশল খাটানো হয়েছে। বিছানা থেকে নেমে একটা বাতি জ্বাললাম। দেখলাম শোবার কামরাটার দরজা আটকানোই আছে। সাবধানে দেয়ালগুলো দেখতে লাগলাম, যদি গোপন কোনো দরজা থাকে। কিন্তু এ ধরনের কিছু খুঁজে পেলাম না। পর্দা সরিয়ে, জানালার পাল্লা খুলে দেখলাম। কিন্তু বাইরেটা নিশ্ৰুপ আর অন্ধকার। চাঁদও নেই আকাশে। বিছানায় ফিরে বিষয়টি নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম। কী দেখলাম? আর এটা কেনই বা আমার সামনে হাজির হলো?

সকালে ঘুম থেকে উঠে পোশাক পরে আমার বোনকে কী দেখেছি তা খুলে বললাম। সে জানাল বাড়িটার ভুতুড়ে বলে বদনাম আছে। এখানে একটা খুন হয়। তবে সে যতদূর জানে, আমি যে কামরাতে ছিলাম তাতে খুনটা হয়নি। সেদিন এই বাড়ি ছাড়ার সময় আমার বোনকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালাম, রহস্যটা ভেদ করার জন্য যতটুকু সম্ভব সে করবে।

বুধবার সকালে বোনের একটা চিঠি পেলাম। এতে জানাল আমি চলে আসার পর আরও খোঁজখবর নিয়েছে সে। আর জানতে পেরেছে যে কামরাটায় আমি ছিলাম খুনটা হয়েছে সে কামরাতেই। আরও বলল, আগামীকাল আমার এখানে আসার পরিকল্পনা করেছে। আর আমাকে সে রাতের ঘটনাটি বিস্তারিত লিখে রাখার পাশাপাশি ওই কামরাটার একটা নকশা এঁকে, যেখান থেকে রহস্যময় কাঠামোটা দেখা দেয় আর অদৃশ্য হয় সে জায়গা দুটো চিহ্নিত করে রাখার অনুরোধ করল।

দেরি না করে তার কথামত কাজ করলাম। পরদিন যখন এল, জানতে চাইল আমি কী তার অনুরোধ মত কাজ করেছি। কিনা? জবাবে ড্রইং রুমের টেবিলের ওপর রাখা কাগজটার দিকে ইশারা করে বললাম, হ্যাঁ, এখানেই ঘটনার বর্ণনা আর কামরার নকশাটা আছে।

বোন যখন ওটা পরীক্ষা করতে এগোল তখন বাধা দিয়ে বললাম, তোমার যা বলার আছে খুলে না বলে ওটার দিকে তাকিয়ো না। কারণ ওটা পড়ে অবচেতনভাবেই তোমার কাহিনিটার মধ্যে রং চড়িয়ে ফেলবে।

এবার সে জানাল, যে কামরাটায় আমি রাত কাটিয়েছি তার গালিচাটা উঠিয়ে দেখেছে। মেঝের একটা নির্দিষ্ট অংশে খুন হওয়া মানুষটির রক্তের চিহ্ন পেয়েছে সে। আমার অনুরোধে কামরাটার একটা নকশা এঁকে যেখানে-যেখানে রক্তের ছোপ আছে তা চিহ্নিত করল। এবার আমার আর বোনের আঁকা নকশা দুটো মিলালাম। কী আশ্চর্য! বোনের নকশায় যেখান থেকে রক্তের চিহ্ন শুরু আর শেষ দেখানো হয়েছে এর সঙ্গে আমার নকশায় দেখানো মহিলার মূর্তিটা দেখা দেওয়ার আর অদৃশ্য হওয়ার জায়গা একেবারেই মিলে গেছে।

৫. কাটামুণ্ডু

মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটে আয়ারল্যাণ্ডের ডাবলিনের উত্তর অংশে। দুইশো বছরের বেশি আগের কথা। তরুণ এক সরকারী কর্মকর্তাকে ডাবলিনে পাঠানো হয়। ভদ্রলোক একটা বাড়ি ভাড়া করেন নিজের আর পরিবারের জন্য। শুরুতেই স্ত্রী আর দুই সন্তানকে ওখানে পাঠিয়ে দেন। কয়েক দিন পর নিজে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন।

একজন নার্স আর ছেলেমেয়ে দুটোসহ তাঁর স্ত্রী ওখানে গিয়ে দেখলেন বাড়িটাতে একজন বুড়ো আয়া ছাড়া আর কেউ নেই। তারা এখানে পৌঁছার একটু পরেই আয়াটি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনতে নার্স বাড়ি থেকে বের হয়। কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরে এসে মহিলাটির কাছে জানতে চায় বাচ্চারা ঠিক আছে কিনা। কারণ ভুভুড়ে দুটো কাঠামো দরজার দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখেছে সে। মহিলাটি জানালেন তার ধারণা বাচ্চারা ভালই আছে। কিন্তু তাদের কামরাটায় গিয়ে দেখলেন দুটো বাচ্চারই গলা কেটে রেখে গেছে কেউ। খুনিকে কখনওই খুঁজে বের করা যায়নি। এমনকী কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে তারও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। হতভাগী মা পাগল হয়ে যান বাচ্চাদের শোকে। বলা হয় এর পরে অনেক বছর পর্যন্ত এই বাড়িটাতে ঢুকলেই অজানা একটা আতংক আর অস্বস্তি পেয়ে বসত লোকেদের। এমনকী যে কামরাটায় হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে। তার জানালায় নাকি মাঝেমাঝেই দেখা যেত ছোট্ট দুটো মাথা।

৬. পর্দার ফাঁকে কার মুখ?

শ দেড়েক বছর আগের ঘটনা এটি। একটি স্কুল ঘরে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা হয় এক পাদ্রীর। তিনি ছিলেন ডাবলিনের একটা গির্জার যাজক। কিন্তু ভদ্রলোক থাকতেন বাবা-মার সঙ্গে শহর থেকে বেশ দূরে, মালাহাইডের দিকে। কখনও কখনও দেখা যেত সন্ধ্যায় কোনো কাজ পড়ে গেছে তার কিংবা কোনো সভায় উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। এদিকে তাদের বাড়িটা বেশ দূরে। তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থাও এখনকার মত উন্নত হয়নি। কাজেই সে বিশেষ দিনগুলোতে একটা স্কুল ঘরে রাত কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে যান। বিশাল, আসবাবশূন্য এই কামরাটিতেই সাধারণত সভাগুলো হয়। যেহেতু মাঝেমাঝে রাত কাটাতে হয় কামরাটায়, তাই এক পাশে নিজের শোবার জন্য একটু জায়গা আলাদা করে নিলেন। একটা দণ্ড টাঙিয়ে এর মধ্যে দুটো পুর্দা ঝুলিয়ে দিলেন, টান দিলে মাঝখানে এসে মিলে যায় পর্দ দুটো।

এক রাতে একটা সভা শেষে খালি স্কুলঘরটার দরজার খিল আটকে দিলেন যাজক। তারপর বিছানায় গেলেন। চন্দ্রালোকিত রাত হওয়াতে ভিতরের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

বিছানায় যাওয়ার একটু পরেই অদৃশ্য কিছু একটার উপস্থিতি অনুভব করলেন। পরমুহূর্তেই পর্দা দুটো নড়তে দেখলেন, যেন ওপাশ থেকে কেউ গুডলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারপরই আতংকে শিউরে উঠলেন, এক জোড়া হাত ওপাশ থেকে পর্দা টানছে। পর্দা দুটো মাঝখানে এসে মিলল। এবার একটু ফাক হলো ওগুলো, আর এর মাঝখানে উঁকি দিল ভয়ঙ্কর একটা মুখ। ওটার চেহারায় এমন একটা পৈশাচিক ভঙ্গি আর নির্দয় দৃষ্টি খেলা করছে যে, গা কাঁটা দিয়ে উঠল যাজকের। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকল মুখটা, তারপর পর্দার আড়ালে সরে পড়ল। পর্দা দুটোও জোড়া লেগে গেল আবার। যাজক বেশ সাহসী মানুষ। ওটা অদৃশ্য হতেই বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে পুরো কামরা তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। যা ভেবেছেন, কাউকে পেলেন না। যত দ্রুত সম্ভব কাপড় পরে এখান থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর অন্ধকারে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন। এই স্কুল ঘরে আর কখনও রাত কাটাননি তিনি।

No comments