বাড়িটায় কেউ যেয়ো না – অনীশ দেব

বাড়িটায় কেউ যেয়ো না – অনীশ দেব

জন্মদিন এমনিতেই বেশ ভালো ব্যাপার৷ কিন্তু তার সঙ্গে যদি ক্রিসমাসের বড়দিন জুড়ে যায় তা হলে তো ব্যাপক হইহই মাইন্ড ব্লোয়িং ফ্যান্টাস্টিক কাণ্ড৷ ঠিক সেটাই প্রত্যেক বছর হয় মধুমিতার জন্মদিনে৷ ওকে মা-বাবা থেকে শুরু করে ফ্রেন্ড সার্কলের সবাই বলে, ‘মিতা, তুই খুব লাকি—৷’

এতে লাকের কী আছে মধুমিতা জানে না, তবে এই পঁচিশে ডিসেম্বর জন্মদিন হওয়াটা ওর বেশ ভালো লাগে৷ এর সবচেয়ে বড় কারণ, ওর সবচেয়ে ক্লোজ তিনজন বন্ধু —মুনমুন, অভিলাষ আর আর্য—জন্মদিন কাম বড়দিন মানাতে সকাল দশটা-সাড়ে দশটাতেই এসে হাজির হয়৷

এবারের জন্মদিনেও তার হেরফের হয়নি৷ ওরা এসেছে গিফট নিয়ে৷ তারপর মধুমিতার ঘরে বসে চারজনে মিলে চলছে হা-হা হি-হি, আড্ডা, কেক, চা-কফি, আর নানারকম স্ন্যাকস৷ কোনও কিছুর দরকার হলেই মধুমিতা অভ্যেস মতো হাঁক পাড়ছে, ‘মাম, একবার এদিকে এসো—৷’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরের দরজায় ওর মা এসে হাজির৷ তখন মধুমিতা খুচরো ফরমাস ছুড়ে দেয়৷ সেটা শুনে মা ঠোঁটে হেসে চলে যান৷ মেয়েটা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চলল তবুও ছোটবেলার অভ্যেস গেল না৷ এক জায়গায় স্ট্যাচু হয়ে বসে শুধু ফরমাস আর ফরমাস!

সকাল থেকে আকাশে ছাই রঙের মেঘ৷ সূর্যকে লেপ চাপা দিয়ে দিয়েছে৷ ফলে শীতটা স্কোয়ার কি কিউব হয়ে গেছে৷ তার মধ্যেই মাঝে-মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷ এরপর কখন যে জোরে শুরু হবে কে জানে!

পরমেশ্বর—মানে, মধুমিতার ‘পমেশমামা’—এক টিপ জোয়ান মুখে দিয়ে চোখ বুজে চিবোতে-চিবোতে বললেন, ‘শোন মিতা, পৃথিবীর সব জায়গাতেই এমন দু-একটা বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে যেগুলোতে কেউ থাকে না৷ আর কেউ কখনও ওসব বাড়িতে যায়ও না….৷’

‘হন্টেড হাউস?’ মধুমিতা জানতে চাইল৷

‘ঠিক তেমন নয়—’ পমেশমামার চোয়াল নড়ছিল: ‘তবে হন্টেড হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে৷ কিন্তু কেউ সেখানে যায় না৷ মানে, ভয় পায়৷ অথচ বাড়িগুলো খুব ইন্টারেস্টিং৷’

ছোটবেলায় মধুমিতা ‘পরমেশ্বরমামা’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘পমেশমামা’ বলত৷ সেই থেকে ‘পরমেশ্বর’ ‘পমেশ’ হয়ে গেছে৷

জানলার বাইরে শীতের মেঘলা দুপুর৷ তার সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷ কিন্তু মেঘ-বৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে সকাল থেকেই মধুমিতাদের গল্প-টল্প চলছিল৷ সেইসব গল্পের মধ্যে ফেসবুক, ফেসবুকে আপলোড করা ফোটো, স্কুলের স্যার আর ম্যামদের ক্যারিকেচার—এসবের চর্চাই ছিল বেশি৷ দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়ির কাঁটা তার নিজের খেয়ালে ঘুরে চলেছিল৷ ঘুরতে-ঘুরতে বেশ খানিকটা বেলার দিকে পরমেশ্বরমামা এসে হাজির হলেন৷

‘কই রে, মিতা? কোথায় তুই?’ বাজখাঁই গলায় হাঁক পাড়তে-পাড়তে পমেশমামা ঢুকে পড়লেন মধুমিতাদের ঘরে৷ হাতে গিফটের প্যাকেট৷

পরমেশ্বর রেলে চাকরি করেন৷ ফলে তাঁকে মাঝে-মাঝে বদলি হতে হয়৷ এখন আছেন ধানবাদে৷ সময়-সুযোগ পেলে মধুমিতার জন্মদিনটায় এসে হাজিরা দেন৷ যেমন, এবারে এসে পড়েছেন৷

গিফটের প্যাকেট না খুলেই মধুমিতা বুঝতে পারল ওর ভেতরে কী আছে৷ বই৷ কারণ, পরমেশ্বর গিফট বলতে বই ছাড়া কিছু বোঝেন না৷

প্যাকেট খুলতেই বেরোল ভূতুড়ে বাড়ি নিয়ে লেখা কয়েকটা বাংলা আর ইংরেজি বই৷

ভূত আর ভূতুড়ে ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে পমেশমামার ইন্টারেস্ট মধুমিতার ভালো করেই জানা৷ সুযোগ পেলেই সেসব নিয়ে গল্প ফেঁদে বসেন৷ মামা সবসময় সেগুলো ‘সত্য ঘটনা’ বলেই পেশ করেন, কিন্তু মধুমিতার সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে৷ সন্দেহ থাক আর না-ই থাক, ‘সত্য ঘটনা’-গুলো ও শুনতে ছাড়ে না৷

ঘোর দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আবার শুরু হল গল্প৷ তবে এবার গল্পের বিষয় ‘ভূতুড়ে বাড়ি’৷ পমেশমামা একটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছেন৷ পাশের টেবিলে ছোট কাচের বাটিতে জোয়ান রাখা আছে৷ ভালো-মন্দ খাওয়া-দাওয়ার পর পমেশমামা বেশ কয়েক টিপ জোয়ান খাওয়া পছন্দ করেন৷

বিছানায় এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে ছিল মধুমিতারা চারজন৷ আর্যরূপ, অভিলাষ আর মুনমুন একটু অবাক চোখে মধুমিতার পমেশমামাকে দেখছিল৷

বেঁটে গোলগাল চেহারা৷ মাথায় টাক৷ চোখে চশমা৷ নাকের নীচে মোটাসোটা গোঁফ৷ বাইরে-বাইরে চাকরি করে গায়ের রং রোদে পোড়া৷

পমেশমামার গিফটের বইগুলো আর্যরা হাতে-হাতে নিয়ে দেখছিল৷ আর নিজেদের মধ্যে ভূতুড়ে বাড়ি নিয়ে কথাবার্তা বলছিল৷

তখনই পরমেশ্বর এক টিপ জোয়ান মুখে দিয়ে চোখ বুজে চিবোতে-চিবোতে বললেন, ‘শোন মিতা, পৃথিবীর সব জায়গাতেই…৷’

আর্যরূপ বলল, ‘আঙ্কল, একটা কথা বলছি—কিছু মাইন্ড করবেন না৷ ভূত ব্যাপারটাকে কিছুতেই লজিক দিয়ে দাঁড় করানো যায় না—কেউ তো এখনও পারেনি৷ তা হলে আপনিই বলুন, ভূতুড়ে, মানে, হন্টেড ব্যাপারটা লজিকের ওপরে দাঁড়াবে কেমন করে?’

আর্যরূপ বড় হয়ে সায়েন্টিস্ট হতে চায়৷ তাই সবসময় ‘লজিক-লজিক’ করে৷ সেজন্য মধুমিতার মাঝে-মাঝে বিরক্ত লাগে৷

পমেশমামা হেসে বললেন, ‘দ্যাখো আর্য, আমিও সবসময় লজিক আঁকড়ে চলতে ভালোবাসি৷ কিন্তু যখন সব লজিকই হাত তুলে দেয় তখন কী করব বলো তো! তখন তো শূন্যে ভাসতে থাকি৷ সে বড় গোলমেলে ব্যাপার…৷’

অভিলাষ হাঁ করে পমেশমামার কথাবার্তা শুনছিল৷ ওর ফরসা মুখে কেমন একটা কবি-কবি ভাব৷ ওর টানা-টানা চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, ও যেন একটা ঘোরের জগতে আছে৷

ও জিগ্যেস করল, ‘এরকম সিচুয়েশানে কখনও পড়েছেন নাকি, আঙ্কল?’

পরমেশ্বর ওর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন৷ মনে হল যেন দোটানায় পড়ে ভাবছেন৷ তারপর জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টির ঝালরের দিকে আনমনাভাবে চেয়ে রইলেন৷

অনেকক্ষণ পর বললেন, ‘হন্টেড ব্যাপারটা আমি লাইফে দু-চারবার দেখেছি৷ তবে তার মধ্যে একটা সিচুয়েশান সবচেয়ে সিরিয়াস ছিল৷ ব্যাপারটা আমার গায়ে দুটো পারমানেন্ট চিহ্ন রেখে গেছে…৷’

মামার মুখে এরকম কথা মিতা আগে কখনও শোনেনি৷ তাই ও অবাক হয়ে পমেশমামার দিকে তাকাল৷

‘না, এ ব্যাপারটা তোকেও কখনও বলিনি৷ ইন ফ্যাক্ট, কাউকেই বলিনি—৷’ হাফ শার্টের বাঁ হাতাটা ওপর দিকে তুলে ধরলেন পরমেশ্বর৷ চোখে পড়ল ইঞ্চি-তিনেক লম্বা একটা বীভৎস ক্ষতের দাগ৷ দাগটা বেশ চওড়া আর ক্ষতটা সেরে গেলেও সেখানে মাংস এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে৷

‘এটা হল একটা চিহ্ন—’ জামার হাতাটা টেনে নামিয়ে ঠিকঠাক করে পরমেশ্বর বললেন, ‘আর-একটা পারমানেন্ট চিহ্ন আছে আমার পিঠে৷ পিঠের ডানদিকে অনেকটা জায়গা পুড়ে গিয়েছিল৷ আমাকে নার্সিংহোমে বারোদিন থাকতে হয়েছিল৷ চোটটা খুব সিরিয়াস ছিল…৷’

মধুমিতা আবদারের গলায় বলল, ‘পমেশমামা, প্লিজ, এই স্টোরিটা আজ আমাদের চারজনকে শুনিয়ে দাও—৷’

‘স্টোরি নয় রে—’ একটু হেসে পরমেশ্বর বললেন, ‘একেবারে সত্যি ঘটনা৷ রিয়েল হন্টিং-এর কেস৷’ জানলা দিয়ে আবার তাকালেন বাইরে৷ কিন্তু কিছু দেখেও যেন দেখছিলেন না৷ বোধহয় ধীরে-ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন সেই ঘটনার সময়ে৷

মিতারা চারজন চুপ করে চেয়ে রইল পরমেশ্বরের মুখের দিকে৷

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়৷ বছর কুড়ি হবে৷ তখন আমার মাথায় টাক ছিল না৷ আমি সেসময়ে বিহারের রাখিতপুরে পোস্টেড৷ এখন অবশ্য জায়গাটা ঝাড়খণ্ডে পড়ে৷ ধানবাদ জংশন থেকে বালিয়াপুর হীরক রোড ধরে গাড়িতে গেলে রাখিতপুর মিনিট পঁয়ত্রিশের রাস্তা৷

ছোট্ট স্টেশন৷ একটাই প্ল্যাটফর্ম৷ সারাদিনে চারটে কি পাঁচটা গাড়ি দাঁড়ায়৷ সুতরাং, বুঝতেই পারছ—কাজ-টাজ বেশ কমই ছিল৷ সেসময়ে রাখিতপুরে স্টেশন- মাস্টারের কোনও কোয়ার্টার ছিল না৷ কাছাকাছি একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল—দুসরা৷ সেখানে যাদবদের বস্তিতে আমি একটা ঘরভাড়া পেয়ে গিয়েছিলাম৷ সেখানেই থাকতাম৷ নানান জনের খেতের শাকসব্জি সস্তায় পেতাম, পাতকুয়োর জল তুলে সেসব দু-বেলা রান্না করতাম৷ তার সঙ্গে রুটি আর অড়হড় ডাল বানিয়ে দিব্যি খেতাম৷ আর ফাঁকা সময় পেলে আমার বাড়িওয়ালা মহাবীর যাদবের সঙ্গে গল্প করতাম৷

এ ছাড়া মাঝে-মাঝে উত্তরদিকের মাঠ পেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে রাখিতপুরের সীমানা ছাড়িয়ে ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে চলে যেতাম৷ সেদিকে একটা জঙ্গলও ছিল৷ রাখিতপুরের মানুষজন সেখানে কাঠের সন্ধানে যেত৷ আর জঙ্গলের নেশা আমাকে যে টানত তার কারণ ছিল ফুল আর পাখি৷ যেসব ফুল আর পাখি সেখানে দেখতাম তাদের একটারও আমি নাম জানতাম না৷ কিন্তু ওদের রংচং আর মিষ্টি ডাক আমার মনে নেশা ধরিয়ে দিত৷

আমার গল্পটা সেই ‘দাওয়াই টাউন’-কে নিয়ে৷

‘দাওয়াই টাউন’-এর কথা আমি প্রথম শুনি মহাবীর যাদবের কাছে৷ একদিন রাতে বস্তিতে গানবাজনার মেহফিল বসেছিল৷ সপ্তাহে একটা দিন—শনিবার বা রোববার—হ্যাজাক লণ্ঠনের আলো জ্বেলে এরকম গানবাজনার আসর বসে৷ সেইসঙ্গে চাঁদা তুলে চাপাটি, ভুজিয়া, লিট্টি অথবা খিচুড়ি আর আলুভাজার ব্যবস্থা করা হয়৷ গানের সঙ্গে-সঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলে৷

সেইরকম এক গানবাজনার আসরে একদিন একটা অল্পবয়েসি ছেলেকে গান গাইতে দেখলাম৷ ছেলেটার গানের গলা বেশ ভালো৷ কিন্তু আমার চোখ টানল ওর গালের একটা লম্বা কাটা দাগ৷ দাগটা বাঁ-গালে রগের কাছ থেকে শুরু হয়ে গাল বেয়ে একেবারে গলা পর্যন্ত নেমে গেছে৷ দাগটা এমন যে, দেখলে যে-কেউ শিউরে উঠবে৷

আমারও একই অবস্থা হয়েছিল৷ হ্যাজাকের আলোয় দাগটা প্রথম চোখে পড়তে আমি রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলাম৷ মনে হচ্ছিল, ছেলেটার গালে কেউ নিষ্ঠুরভাবে তরোয়াল চালিয়ে দিয়েছে৷

আমি মহাবীরজীকে চাপা গলায় বলেছিলাম, ‘ওই ছেলেটা কে? ওর গালের ওই কাটা দাগটা দেখেছেন!’

‘হ্যাঁ—দেখেছি৷ লাস্ট এক সাল ধরেই দেখছি৷’ মহাবীরজী সুপুরি চিবোচ্ছিলেন৷ তার সঙ্গে সুগন্ধী কিছু বোধহয় মেশানো ছিল৷ নেশা ধরানো বেশ একটা মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছিল৷ জমিতে থুতু ফেলে তিনি বললেন, ‘ওর নাম মোহন৷ ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ ঢুকে ওর এই হাল হয়েছে…৷’

‘‘‘দাওয়াই টাউন’’ মানে?’

‘‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর কাহানি আপনাকে পরে শোনাব৷ ওখানে জিন আছে৷ ওখানে কারও না যাওয়াটাই ভালো৷ আমি তো সববাইকে মানা করি৷ আপনি রাখিতপুরে নতুন আছেন৷ কথা যখন উঠল তখন আপনাকে ভি বলে দিই: ওই এরিয়ায় আপনি কখনও যাবেন না—৷’

‘কিন্তু, মহাবীরজী, জায়গাটা তো আমি চিনিই না! তা হলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে?’ এ-ধরনের সাবধানবাণী শুনে আমার বেশ অবাকই লাগছিল৷ তা ছাড়া ভূত-প্রেত-এ বিশ্বাস আমার কোনও কালেই ছিল না৷ তবে বরাবরই আমার কৌতূহল একটু বেশি৷

‘চেনেন না, ঠিক আছে৷ কিন্তু যদি কখনও পথ ভুলে বেখেয়ালে চলে যান—তাই বলছি৷ অবশ্য ওখানে ওয়ার্নিং লাগানো আছে…৷’

‘তা ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ ঢুকে মোহনের গাল কাটল কেমন করে?’

‘জানি না৷ কেউই জানে না৷ কারণ, মোহন কাউকে বলেনি৷ জিগ্যেস করলে দুঃখ করে শুধু বলে, ‘‘ছোড়িয়ে ভাইয়া—মেরা নসিব…৷’’’

এর কিছুদিন পর মহাবীর যাদবের কাছ থেকে আমি ‘দাওয়াই টাউন’-এর কাহিনি শুনেছি৷

প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে রাখিতপুরের সীমানায় গরিবদের জন্যে একটা হাসপাতাল তৈরির বন্দোবস্ত করা হয়৷ একটা মাইনিং কোম্পানি নাকি গভর্নমেন্টের সাপোর্ট নিয়ে এটা তৈরি করতে নেমে পড়েছিল৷ তাতে কন্ডিশান ছিল, কোনও গ্রামে হাসপাতাল তৈরি করলে তবেই পাওয়া যাবে সরকারি ভর্তুকির টাকা৷

প্রায় দশ বিঘে জায়গা খুঁটি দিয়ে বাঁশ দিয়ে ঘেরা হল৷ তার মাঝামাঝি জায়গায় ছ’তলা হাসপাতাল বিল্ডিং তৈরি হল৷ আর বিল্ডিং-এর আশেপাশে বেশ কয়েকটা টিনের চালার ঘরও তৈরি করা হয়েছিল৷ স্টাফদের কোয়ার্টার৷

খুব কম পয়সায় চিকিৎসা করা যাবে বলে এলাকায় হ্যান্ডমাইক নিয়ে ভ্যান-রিকশা করে পাবলিসিটি করা হয়েছিল৷ মহাবীর যাদব এসব শুনেছে তার বাবার কাছে৷ সেসময়ে দুসরা গ্রামে একটা ছোটখাটো হাসপাতাল পাওয়া মানে ছিল হাতে স্বর্গ পাওয়া৷ সে-সুবিধে তো হলই, তার সঙ্গে বোনাস পাওয়ার মতো লোকাল ছ’-সাতজন লোকের চাকরিও হয়ে গেল সেখানে৷

হাসপাতালটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জনতা সেবাকেন্দ্র’৷ চিকিৎসার ব্যবস্থা সেখানে যে খুব ভালো লেভেলের ছিল তা নয়—বরং বলা যায় চলনসই, মামুলি৷ তবু কিছু না থাকার চেয়ে তো ভালো!

লোকাল লোকের কাছে ‘জনতা সেবাকেন্দ্র’-এর লোকাল নাম হয়ে গেল ‘দাওয়াই টাউন’৷ ব্যস, তারপর থেকে শান্ত গ্রামে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগল৷

এমনি করে বছর দুয়েক চলার পরই গোলমালটা হল৷ একটা আজব ঘটনা ঘটে গেল ওই হাসপাতালে৷ তারপর থেকে ওটার গায়ে ‘অভিশপ্ত’, ‘ভূতুড়ে’—এইসব দাগ লেগে গেল৷

প্রথমদিন মহাবীরজী ‘দাওয়াই টাউন’-এর পুরো গল্প আমাকে শোনাননি৷ সুপুরি চিবোতে-চিবোতে কাশির দমক আসায় বারকয়েক কাশলেন৷ তারপর কাশি সামলে হলদে ছোপ ধরা দাঁত বের করে হাসলেন: ‘চলুন—একদিন আপনাকে জায়গাটা চিনিয়ে দিই৷ তারপর ওই জিনিয়া টাউনের আশেপাশে বসে মউজ করে বাকি কাহানিটা আপনাকে শোনানো যাবে…৷’

তো তাই হল৷

রবিবার দুপুর বারোটা সাতের পর রাখিতপুরে আর কোনও ট্রেন দাঁড়ায় না৷ তাই আমার বলতে গেলে সোয়া বারোটার পর ছুটি৷ নিজের সাপ্তাহিক কাজকর্ম সেই দিনটাতেই আমি সেরে নিই৷ তো সেইরকম এক রবিবারে দুপুর আড়াইটের সময় মহাবীর যাদব আমার আস্তানায় এসে হাজির৷ আমি তখন খাওয়া-দাওয়া সেরে তক্তপোশে বডি ফেলে একটু জিরোনোর পদক্ষেপ নিচ্ছি৷

আমার নাম-ডাক শুনে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ দেখি মহাবীরজী দাঁড়িয়ে আছেন৷

মাথায় কদমছাঁট কাঁচাপাকা চুল, ভাঙা গাল, মোটা গোঁফ৷ কিন্তু তার মধ্যেও চোখ দুটোয় সরলতা মাখানো৷ এবং মুখে হাসি৷

মহাবীরজীর গায়ে হালকা নীলের ওপরে সাদা ডোরাকাটা একটা ফতুয়া, তার সঙ্গে সামান্য ময়লা হয়ে যাওয়া ধুতি৷ পায়ে চপ্পল৷ হাতে ছাতা৷ সে-ছাতার হ্যান্ডেল বেতের লাঠির তৈরি, মাথাটা বাঁকানো৷

‘চলুন, মাস্টারজী—‘‘দাওয়াই টাউন’’ দেখবেন চলুন…৷’

সঙ্গে-সঙ্গে বুকের ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা টের পেলাম৷

দু-দিন ধরে আকাশে মেঘ-মেঘ৷ মাঝে-মাঝে অল্পস্বল্প বৃষ্টি৷ তাই আমিও তৈরি হয়ে ছাতা নিয়ে বেরোলাম৷ আমার ছাতাটা অবশ্য ভাঁজ করা যায়৷

গাঁয়ের ছোট-ছোট ঘরগুলো পেরিয়ে আমরা চাষজমির এলাকায় এসে পড়লাম৷ এখানে-ওখানে কয়েকটা সাদা বক ওড়াউড়ি ঘোরাঘুরি করছে৷ জমি থেকে কীসব খুঁটে-খুঁটে খাচ্ছে৷ আলের ওপর দিয়ে সাবধানে হেঁটে দু-দুটো বড়-বড় খেত পেরিয়ে গেলাম৷ তারপরই বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে কলাবাগান৷ তার মধ্যে হেঁটে যাওয়ার সময় দুটো শেয়াল চোখে পড়ল৷ আমাদের দেখে ছুটে আড়ালে চলে গেল৷

পথ চলতে-চলতে মহাবীর যাদব রাখিতপুরের নানান কথা বলছিলেন৷ বলছিলেন এখানকার মানুষেরা বেশিরভাগই খুব ভালো৷ তবে সবাই খুব অভাবী৷ অভাবের চোটে কেউ-কেউ অসৎ পথেও নেমে গেছে৷ রাতের আঁধারে এ-খেত ও-খেত থেকে চাষের ফসল চুরি করে৷ কখনও বা এর মুরগি ওর ছাগল লোপাট করে মাংস-টাংস খায়৷ সেইজন্যে এখানে দু-চারটে কলকারখানা হলে ভালো হয়৷ এলাকার জোয়ানগুলো সেখানে নোকরি-ওকরি পেতে পারে৷

‘আমিও খোঁজখবর রাখছি—যদি কোনও বিজনেসম্যান এখানে টাকাপয়সা ইনভেস্ট করে কিছু একটা ছোটামোটা ইনডাস্ট্রি বানাতে চায়৷ সব জমিতে তো আর চাষবাস হয় না৷ যে-মাইনিং কোম্পানি এ-জমির মালিক তার ডিরেক্টরকে আমি চিনি৷ ধানবাদে ওনার বাড়ি৷ আমার সঙ্গে থোড়াবহত জানপহেচানভি আছে৷ দু-চারবার বাতচিত হয়েছে৷ যদি কেউ এ জমিন কেনার ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখায় তো আমি কানেকশন করিয়ে দেব৷’

কথা বলতে-বলতে আমরা পথ হাঁটছিলাম৷ বাতাস ভেজা৷ আকাশে মেঘ মাঝে-মাঝেই চাপা গরর-গরর শব্দ তুলছে৷ পায়ের নীচে ভেজা মাটি৷ আমি কলাগাছের ফাঁকফোকর দিয়ে দূরে নজর চালিয়ে দিচ্ছিলাম—যদি ‘দাওয়াই টাউন’-এর দু-এক চিলতে নজরে পড়ে৷ কিন্তু শুধুই গাছপালা চোখে পড়ছিল৷

কলাবাগান শেষ হতেই এপাশে-ওপাশে কয়েকটা বড়-বড় পুকুর দেখতে পেলাম৷ তার মাঝখান দিয়ে পথ এগিয়ে গেছে৷

মহাবীর যাদব জানালেন, এই পুকুরগুলোয় মাছ চাষ হয়৷ আবার সুখার সময়ে এইসব পুকুর থেকেই জল টেনে চাষজমিতে কাজে লাগানো হয়৷

সামনে বাঁ-দিকটায় বেশ কয়েকটা ছোট-বড় গাছপালা চোখে পড়ছিল৷ সেদিকে আঙুল দেখিয়ে মহাবীরজী বললেন, ‘এসে গেছি৷ ওই যে, ওই গাছপালাগুলোর ওপাশেই ‘‘দাওয়াই টাউন’’৷ আপনাকে আমি শর্টকাট রাস্তা দিয়ে নিয়ে এলাম…৷’

আর বড়জোর পাঁচ মিনিট কি সাত মিনিট লাগল৷ আমরা ‘দাওয়াই টাউন’-এর সামনে এসে পড়লাম৷

‘জনতা সেবাকেন্দ্র’ যখন গড়ে ওঠে তখন তাকে ঘিরে একটা টাউনশিপ মতন তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল৷ প্ল্যান ছিল, ধীরে-ধীরে ব্যাপারটাকে ঠিকঠাক চেহারায় নিয়ে যাওয়া যাবে৷ তা হলে বেশ কিছু স্টাফ হাসপাতাল এলাকাতেই থাকতে পারবে৷ আর তাতে স্টাফদের ডিউটি করতে সুবিধে হবে৷ তা ওই টাউনশিপের ভাবনাটা এলাকার লোকজনের মুখে-মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল৷ আর সে থেকেই হয়তো ‘জনতা সেবাকেন্দ্র’-এর নাম ‘দাওয়াই টাউন’ হয়ে গিয়েছিল৷

মহাবীর যাদব হাত তুলে ইশারা করে দেখালেন ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে: ‘ওই যে…৷’

মেঘলা আকাশের পটভূমিতে ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে তাকিয়ে চাইনিজ ইঙ্ক আর জল মিশিয়ে হ্যান্ডমেড পেপারে আঁকা ওয়াশের ছবি বলে মনে হল৷ আর বিচিত্র সেই ছবিটা যেন অন্য একটা মায়াবী জগৎ থেকে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে৷

ছ’তলা হাসপাতাল বিল্ডিংটা ভাঙাচোরা রংচটা৷ সারা গায়ে পোড়া কালো-কালো দাগ৷ লম্বা-লম্বা ফাটল অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছাদের দিক থেকে নেমে এসেছে নীচে৷ অথবা তার উলটোটাও হতে পারে৷

ফাটলগুলোর নানান জায়গা থেকে বট-অশ্বত্থ ইত্যাদি গাছ দিব্যি বেড়ে উঠেছে৷ এ ছাড়া ছাদেও বেশ কয়েকটা উলটো-পালটা গাছ গজিয়ে গেছে৷ হঠাৎ দেখলে মনে হবে, ছাদে কেউ বাগানচর্চা করেছে৷

বাড়িটায় অনেকগুলো জানলা—হাসপাতালে যেমনটা হয়৷ তবে সব জানলাই বন্ধ৷ ব্যতিক্রম হিসেবে বেশ কয়েকটা জানলার পাল্লা ভেঙে ঝুলছে—অথবা খসে পড়ে গেছে৷

বাড়িটার কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা টিনের চালার ঘর৷ তাদের চালগুলো সব জং ধরে খসে-খসে গেছে৷ কোথাও বা ইটের দেওয়াল হেলে পড়েছে৷ আর কোনও-কোনও দেওয়াল একেবারে ধসে গেছে—সময়ের চাপ সামলাতে পারেনি৷

‘দাওয়াই টাউন’ এলাকাটা এককালে খাটো পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল, কিন্তু এখন সেই পাঁচিলের সেরকম কোনও অস্তিত্ব নেই৷ শুধু কোথাও-কোথাও দু-চার লাইন ইট পাঁচিলের স্মৃতিকথা হয়ে আছে৷

‘দাওয়াই টাউন’-এর পেছনে বড়-বড় গাছের জঙ্গল৷ মহাবীরজী বললেন, ‘ও-জঙ্গলে শেয়াল, ভাম, নেকড়ে, বুনো কুকুর কিংবা চিতাবাঘ-টাঘও আছে বলে শুনেছি—কিন্তু আমি কখনও চোখে দেখিনি৷ গাঁয়ের লোক একটু রিসক নিয়েই ওখানে কাঠ-টাট কাটতে যায়…৷’

আমি ছ’তলা বাড়িটাকে দেখছিলাম৷ কেমন যেন একটা থমথমে চুপচাপ ব্যাপার৷ শুধুমাত্র ভূতুড়ে বদনামের জন্যে এতবড় একটা জায়গা বেকার পড়ে-পড়ে নষ্ট হচ্ছে! ফ্যাক্টরি-ট্যাক্টরি না হোক, অন্তত চাষবাস করেও তো জমিটা থেকে দু-চার পয়সা আয় হত!

সে-কথাই মহাবীরজীকে বললাম৷

মহাবীরজী মাথা নাড়লেন৷ পকেট থেকে ছোট ডিব্বা বের করে সুপুরির কুচি মুখে ফেললেন৷ তারপর: ‘পমেশজী, পহেলে পুরা স্টোরি তো সুন লিজিয়ে…৷’

‘পরমেশ্বরজী’ কথাটা উচ্চারণ করতে বেশ হোঁচট খেতে হয়৷ পরিচয়ের শুরু-শুরুতে মহাবীরজী নিজেই এ-কথা আমাকে বলেছেন৷ তাই মধুমিতার ‘পমেশমামা’-র মতো উনি আমাকে ‘পমেশজী’ করে নিয়েছিলেন৷

আমাকে হাত ধরে হালকা টান দিলেন৷ কাছেই একটা ভেঙে পড়া শুকনো গাছের গুঁড়ির খানিকটা অংশ কাত হয়ে পড়েছিল৷ বাকিটা লোকাল লোকজন কেটেকুটে নিয়ে গেছে৷ সেদিকে দেখিয়ে মহাবীর যাদব বললেন, ‘চলুন—ওখানে গিয়ে একটু বসি…৷’

তো আমরা সেখানে গিয়ে বসলাম৷ আমার চোখ বারবারই ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে চলে যাচ্ছিল৷

‘পমেশজী, আমাদের মহল্লায় দু-টাইপের লোক আছে৷ এক, যারা ভূত-জিন এসবে বিসোয়াস করে৷ আর একদল চোরি-ওরিতে বিসোয়াস করে৷ তাই অনেকে ‘‘দাওয়াই টাউন’’-কে ভয় পায়, ওটার কাছে যেতে চায় না৷ আবার কেউ-কেউ চোরি-ছুপে ওই হসপিটাল বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়ে, কাঠের টেবিল, চেয়ার, লোহালক্কড়, মেশিনপত্তর যা পারে চুরি করে৷ তারপর সেগুলো বিক্রিবাটা করে পয়সা কামায়…৷

‘আমার আইডিয়া, মোহন যাদবও সেরকম কিছু একটা করতে গিয়েছিল৷ ওর সেরকম আদত আছে৷ তো সেই চোরি-ওরি করতে গিয়ে গালে-গলায় চোট পেয়ে এসেছে—৷’

‘ওরকম চোট কী করে হল? কে ওকে মারল?’

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না—’ মহাবীরজীর তামাটে কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়লঃ ‘মোহনকে অনেকবার জিগ্যেস করেছি—কিন্তু ও ঝাড়াঝাপটা কোনও জবাব দেয়নি৷ ওই যে, সেদিন বললামঃ ‘‘মেরা নসিব৷’’’

‘আপনি কি ভূত, জিনে বিশ্বাস করেন?’

‘না—করি না৷ আমি চাই এলাকার তরক্কি৷ এলাকার উন্নতি হোক৷ যারা ওই হসপিটাল বিল্ডিং থেকে চুরিচামারি করে তারাই বেশি করে ভূত-জিনের কাহানি রটায়৷ যাতে ওদের কাম-কাজ শান্তিতে করতে পারে৷’

মহাবীরজী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন৷ তারপর মাথার পেছনে হাত বোলাতে- বোলাতে বললেন, ‘তবে, পমেশজী…আমার মনে হয় একটা কোনও বেহিসেবি ব্যাপার ওই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে৷’

‘কেন, এ-কথা মনে হয় কেন?’

আমি বুঝতে পারছিলাম, মহাবীরজী একটু দোটানায় ভুগছেন৷ কিন্তু কেন?

‘আট সাল আগে ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ দুটো মার্ডার হয়ে গিয়েছিল৷ ‘‘মার্ডার’’ বলছি বটে কিন্তু কোনও মার্ডারার ধরা পড়েনি৷ পুলিশ ওই জোড়া মার্ডারের কেস সলভ করতে পারেনি৷

‘যারা মার্ডার হয়েছিল তারা আমাদের বাজুওয়ালা বস্তিতে থাকত৷ ছোকরু আর মুন্না৷ দুজনেরই উমর এই ধরুন আটাশ কি তিরিশ হবে৷ ওরা চোরি করে পেট ভরাত৷ হ্যাঁ, ওদের পেশাই ছিল চুরি করা৷ মহল্লার সবাই এটা জানত, কিন্তু কিছু বলত না৷ কারণ, ওরা নিজেদের বা আশপাশের এরিয়ায় কোনও চুরিচামারি করত না৷ কাম-কাজ সারতে দূর-দূর চলে যেত৷ আমাদের সবার আইডিয়া, মুন্না আর ছোকরু ওই হসপিটালে চোরি করতে ঘুসেছিল৷ সেখানে হয়তো আরও একটা গ্যাং চোরি করতে ঘুসেছিল৷ তারপর এনকাউন্টার৷ ব্যস—মুন্না আর ছোকরু মার্ডার হয়ে গেল৷

‘হসপিটালের বাইরের জমিনে ওদের দুজনের ধুলোমাখা বডি পড়ে ছিল৷ কোনও ছুরি-টুরি বা ওই টাইপের কুছু দিয়ে মার্ডারার ওদের গলার নলি কেটে দিয়েছে৷

‘পুলিশ যেটুকু ছানবিন আর ইনভেস্টিগেশান করেছিল তাতে এইটুকু আইডিয়া করতে পেরেছিল যে, ছোকরু আর মুন্নার গলায় রামপুরিয়া চালানো হয়েছে অস্পাতালের ভেতরে৷ ওরা গলায় হাত চেপে ছুটে বেরিয়ে এসেছে বাইরে৷ বেশিদূর যেতে পারেনি —পড়ে গেছে মাঠের ওপরে৷

‘এরকম আইডিয়া করার কারণ, হসপিটালের ভেতরে লিফটের কাছে একটা জায়গায় অনেক রক্ত পড়ে ছিল, আর মাঠে যেখানে ওই চোর দুটোর বডি পাওয়া গিয়েছিল সেখানে সেরকম ব্লাড ছিল না৷ তা ছাড়া, ছোকরু আর মুন্নার ডানহাতে অনেক রক্ত লেগে ছিল৷ এর কারণ, পুলিশ বলেছে, ওরা বোধহয় গলায় হাত চেপে রক্ত আটকাতে কোশিশ করেছিল৷ শেষ পর্যন্ত আর পারেনি৷

‘ছোকরু-মুন্নার মার্ডারার আর ধরা পড়েনি, পমেশজী৷ তাই ওই খুনের জিম্মেদারি ওই ভূতুড়ে অস্পাতালের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আসলে ঠিক কী হয়েছিল কেউ জানে না৷’

মহাবীর যাদবের মুখে এসব কথা শুনতে-শুনতে আমি যেন একটা শেষ-নেই গর্তে তলিয়ে যাচ্ছিলাম৷ একটা অচেনা ভয় চাদরের মতো আমার গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল৷ আমি মোহন, ছোকরু আর মুন্নার কথা ভাবছিলাম৷ ভাঙাচোরা ভূতুড়ে হসপিটালটার ভেতরে কি কোনও ভয়ংকর হিংস্র খুনি লুকিয়ে আছে? কিন্তু এত বছর ধরে লুকিয়ে থাকাটা কঠিন শুধু নয়—অসম্ভবও৷

হসপিটালটার দিকে তাকালাম৷ মনে হল, পোড়া-পোড়া ফাটল ধরা ছ’তলা বাড়িটাকে ঘিরে যেন মেঘের হালকা আস্তর ভেসে বেড়াচ্ছে৷ পাখির মিষ্টি ডাক শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু মেঘলা দিনের সেই মিষ্টি ডাককে আমার কু-ডাক বলে মনে হল৷ সেই ডাক যেন বারবার বলছে, ‘বাড়িটায় কেউ যেয়ো না৷ বাড়িটায় কেউ যেয়ো না…৷’

টাউনের এলাকাটা যেখানে শুরু সেখানে একটা সাইনবোর্ডের মতো লাগানো আছে দেখলাম৷

মহাবীরজী বললেন, ‘আপনাকে যে বলেছিলাম ওয়ার্নিং লাগানো আছে—ওটাই সেই ওয়ার্নিং৷ সরপঞ্চ লাগানোর ব্যবস্থা করেছে৷ ওতে পাবলিককে হুঁশিয়ারি দেওয়া আছে৷’

আমি গাছের গুঁড়ির সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম৷ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে হসপিটাল-বাড়িটার দিকে চেয়ে রইলাম৷ আমি আগে কখনও কোনও হন্টেড হাউস —মানে, ভূতুড়ে বাড়ি—দেখিনি৷ তবে এটা মনে হল, যে-ছ’তলা বাড়িটা এত পুরোনো, বছরের পর বছর এত অবহেলায় পড়ে আছে, সেটার ‘ভূতুড়ে’ হওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই আছে৷ আর সেটাই আমার দেখা প্রথম ভূতুড়ে বাড়ি৷ যদিও তখনও সেটার ভূতুড়ে চরিত্র টের পাইনি৷ টের পাওয়ার পর বহুবার মনে হয়েছে, টের না পেলেই ছিল ভালো৷

পায়ে-পায়ে ‘দাওয়াই টাউন’-এর সীমানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ তোবড়ানো রং-চটা সাইনবোর্ডটা দুটো বাঁশের খুঁটিতে পেরেক ঠুকে আঁটা৷ জায়গায়-জায়গায় লেখার রং উঠে গেলেও সেটা পড়তে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না৷ ইংরেজি এবং হিন্দিতে লাল রঙে লেখা সাবধানবাণী:

image3.jpg
আমি বাড়িটাকে অনুভব করতে চাইছিলাম৷ অলৌকিক কিছু কি সত্যি-সত্যিই আছে ওই বাড়িটায়? যদি থাকে, তা হলে সেই ব্যাপারটা শুরু হল কেমন করে? কেউ কি মারা গেছে ওই হসপিটালে?

কিন্তু হসপিটালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে কোনও-কোনও রোগী মারা যেতেই পারে৷ ব্যাপারটা ব্যাড লাক হলেও বাস্তব৷ তা হলে কি কেউ অপঘাতে মারা গেছে ওখানে?

ফিরে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই মহাবীর যাদবের মুখোমুখি হয়ে গেলাম৷ উনি কখন যে গাছের গুঁড়ি ছেড়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাইনি৷

মহাবীরজী আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন৷ বোধহয় আমার মনের ভেতরটা পড়ে নিতে চাইছিলেন৷

আমি জিগ্যেস করলাম, ‘হঠাৎ করে হসপিটালটা ভূতিয়াঘর হয়ে গেল কেমন করে? সেই কাহানিটা তো বললেন না?’

মহাবীরজী ঠোঁটে হাসলেন—মেঘলা আকাশের মতন হাসি৷ ভিজে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ৷ তারপর ছাতার ডগাটা মাটিতে ঠুকলেন কয়েকবার৷ বোঝাই যাচ্ছিল, তিনি কিছু একটা ভাবছেন৷ হয়তো ভাবছেন, হসপিটালটার ভূতিয়াঘর হয়ে ওঠার কাহিনি আমাকে বলবেন কি বলবেন না৷

আকাশের মেঘ কখন যেন আরও ঘন হয়েছে৷ হসপিটালের মাথায় এখন শ্যামলা রঙের ছাতা৷ মেঘের গলাখাঁকারি শোনা গেল৷ কয়েকটা পাখি ডেকে উঠল কোথাও৷

‘বলব—সবই বলব৷’ মহাবীর যাদব আবেগমাখা চোখে তাকালেন আমার দিকেঃ ‘আর আমি না বললেও ভি আপনি জানতে পারবেন৷ মহল্লার কেউ না কেউ তো আপনাকে বলবে! তবে এখন—এই অস্পাতালের সামনে দাঁড়িয়ে সেই কাহানি বলতে ভালো লাগছে না৷ পরে বলব৷ এখন শুধু এটুকু শুনে রাখুন, ওই হাসপাতালে একটা হাদসা হয়েছিল, আমাদের গাঁয়ের প্রাইমারি ইস্কুলের সাতাশটা বাচ্চা-বাচ্চা ছেলে-মেয়ে মারা গিয়েছিল৷’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মহাবীরজী৷ হাসপাতালটার দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ ওঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল৷ আমি ওঁর বিষণ্ণ মুখের দিকে চেয়ে রইলাম৷

অনেকক্ষণ পর মানুষটা মুখ খুললেন, ‘পমেশজী, ওই সাতাশটা বাচ্চার মধ্যে আমার বহেন লছমিও ছিল৷ সেইজন্যেই আমি ভূতিয়াঘরের ভূত-পিরেতকে খতম করে এই টাউনের বদনাম হঠাতে চাই৷ সেটাই হবে আমার ছোটি বহেনকে ছিনিয়ে নেওয়ার বদলা৷ তাই আমি চাই এই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ কোনও ফ্যাক্টরি-উক্টরি হোক…৷’

আমি চুপ করে মানুষটাকে দেখতে লাগলাম৷ কল্পনায় দেখতে পেলাম, একটা বাচ্চা মেয়ে, টাউনের মাঠে ছুটোছুটি করে খেলছে৷ তার গায়ে স্কুলের ইউনিফর্ম৷ মাথার পিছনে একজোড়া ছোট্ট বিনুনি৷ তার ডগায় লাল ফিতের ফুল৷

লছমির ঠিক কী হয়েছিল এই হসপিটালে?

মহাবীরজী আমাকে বললেন, ‘চলুন, মাস্টারজী—ওয়াপস চলতে হ্যায়৷ এখুনি বারিশ এসে যেতে পারে…৷’

আর কোনও কথা না বলে আমরা ফেরার পথ ধরলাম৷

কয়েক পা এগোতে না এগোতেই আমাদের ছাতা খুলতে হল৷

এর দিন চার-পাঁচ পরেই মোহন যাদবের সঙ্গে আমার বেশ আলাপ হয়ে গেল৷ দিনটা ছিল শুক্রবার৷ বেলা এগারোটা হলেও আকাশ মেঘলা থাকায় সময়টা ভোরবেলা বলে মনে হচ্ছিল৷

আমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ মেঘলা আলো গায়ে এসে পড়ছিল৷ বেলা বাড়লেও আলো তেমন বাড়েনি৷ চারপাশে কেমন একটা মিঠে ব্যাপার ছড়িয়ে আছে৷

এই স্টেশনে একটাই প্ল্যাটফর্ম—তাও আবার কাঁচা, ইটের লাইনিং দিয়ে বাঁধানো৷ প্ল্যাটফর্মে বেশ কয়েকটা বড়-বড় গাছ৷ তাদের ছায়ার দৌলতে প্ল্যাটফর্মের মানুষজন একটু ছায়া-টায়া পায়৷

স্টেশনের গা ঘেঁষে একটা সরু খাল৷ তার দু’পাশে সবুজ গাছপালা৷ সেখানে সবসময়েই এ-পাখি সে-পাখি ওড়ে৷ আমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সবুজ আর পাখি দেখছিলাম৷ তখনই মোহনকে নজরে পড়ল৷

কেঁচোর মতো নেতানো স্পিডের একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন সোম-বুধ-শুক্র আমার স্টেশন হয়ে ধানবাদের দিকে যায়৷ বোধহয় সেই ট্রেনটা ধরার জন্যেই মোহন যাদব একটা ময়লা থলে হাতে ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে৷

আমিই এগিয়ে গিয়ে গায়ে পড়ে ওর সঙ্গে আলাপ জমালাম৷

মোহন দু-চারজন ছেলের সঙ্গে গল্প করছিল৷ গায়ে নীল আর সবুজে ছাপা একটা হাওয়াই শার্ট৷ পায়ে ময়লা খাকি প্যান্ট৷ গলায় কালো কারের মালা—তাতে ঝুলছে একটা মাদুলি৷ মাদুলিটা দেখতে ছোটখাটো ঢোলের মতো৷

মোহনের তামাটে রং, ছোট-ছোট চোখ, মাথায় লম্বা চুল৷ এক কানে একটা রুপোর মাকড়ি৷ আর গায়ে উৎকট ঘামের গন্ধ৷

‘মোহন, আমি এই ইস্টিশানের মাস্টারজী৷ তোমাদের বস্তিতে মহাবীরজীর ঘরে ভাড়া থাকি৷ আমার নাম পমেশ চৌধুরী…৷’

একটা আলতো নমস্কারে ও আমার নমস্কার ফিরিয়ে দিল৷ বলল, ‘হাঁ, মালুম হ্যায়—৷’

আমি মোহনের বাঁ-গালের কাটা দাগটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ মোহন আড়চোখে সেটা লক্ষ করছিল৷

আমি অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিলাম৷ ইতস্তত করে বললাম, ‘তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল৷ মানে…৷’

‘কী কথা?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল মোহন যাদব৷

আমি সাততাড়াতাড়ি একটা লাগসই জবাব খুঁজতে লাগলাম৷ ‘দাওয়াই টাউন’-এর ব্যাপারটার তত্ত্বতালাশ করতে চাইলে আগে মোহন যাদবের মুখ খোলানো দরকার৷

‘তোমার গানের গলা বিউটিফুল—৷’

এ-কথায় কাজ হল৷ মোহনের মুখে লাজুক ভাব ফুটে উঠল৷

আমি বললাম, ‘কলকাতার একটা ফাংশানে গান গাওয়ার ডাক পেলে তুমি যাবে?’

মোহনের মুখে আগ্রহ মেশানো একটা মোলায়েম ভাব ছড়িয়ে পড়ল৷

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—জরুর যাব, মাস্টারজী৷’

না, মোহনকে আমি ঠকাব না৷ সত্যি-সত্যিই কলকাতায় আমাদের পাড়ার ক্লাবের অ্যানুয়াল ফাংশানে ওকে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব৷ ওর গানের গলা সত্যিই চমকে যাওয়ার মতো৷

‘হ্যাঁ—সেটা নিয়েই তোমার সঙ্গে একটু কথা বলব৷ এখন তো হবে না—তুমি তো ট্রেন ধরবে…৷’

‘হাঁ, মাস্টারজী৷ আমার পিতাজীর জন্যে টাউন থেকে দাওয়াই নিয়ে আসতে যাচ্ছি৷ আমার পিতাজী গ্যাসট্রিকের খুব শকত পিসেন্ট৷ ট্রিটমেন্টের অনেক খরচা৷’ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল মোহন৷ তারপর নীচু গলায় বলল, ‘আমি তো বিকেলের মধ্যে ওয়াপস চলে আসব৷ তারপর আপনার ঘরে গিয়ে বাতচিত করতে পারি….৷’

আমি বললাম, ‘সেই ভালো৷ তবে আজ নয়—কাল৷ তুমি কাল সন্ধেবেলা সাড়ে ছ’টা কি সাতটায় আমার ঘরে এসো৷ এসব নিয়ে কাউকে কিছু এখন বোলো না—৷’

মোহন অনেকখানি ঘাড় কাত করল৷ বলল, ‘না, কাউকে কুছু বলব না…৷’

কাল ওকে আসতে বললাম, কারণ, রোববার সন্ধেটা আমি নিজের পছন্দের বইপত্র নিয়ে পড়াশোনার মধ্যে থাকি৷

এমন সময় দূরে দেখা গেল ট্রেন আসছে৷ তার হুইসলের শব্দ বাতাসে কেঁপে-কেঁপে কাছে এগিয়ে আসছে৷ ছোটবেলা থেকে এই শব্দটা আমার দারুণ প্রিয়৷ শুধু এই শব্দটা শোনার জন্যেই আমি বাড়ির কাছাকাছি রেল-স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম৷ মনে হত, এই মায়াবী শব্দটার পিঠে চড়ে আমি বহুদূর চলে যেতে পারি৷

বড় হয়ে ওঠার পরেও এই অলৌকিক টানটা এতটুকুও বদলায়নি৷ সেইজন্যেই রাখিতপুরের একঘেয়ে জীবনেও আমার হাঁপ ধরেনি৷

মোহন যাদব ট্রেনে উঠে চলে গেল৷ ওর এক সঙ্গী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে খইনি চাপড়াতে লাগল৷

ট্রেনটা ধীরে-ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছিল৷ তার কালো ধোঁয়া ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে৷

আমি আনমনা হয়ে সেসব দেখছিলাম৷ হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলঃ ‘পমেশজী…৷’

আমি চমকে ঘুরে তাকালাম৷

মহাবীর যাদব৷

আজ ওঁর মুখে সেই বিষণ্ণ ভাব নেই৷ বরং মানুষটাকে অল্পবিস্তর খুশি-খুশি বলেই মনে হল৷

‘মোহনের সঙ্গে বাতচিত করছিলেন? গাল-গলার ওই জখমি দাগ নিয়ে?’

আমি হেসে বললাম যে, ওই কাটা দাগ নিয়ে আমার যথেষ্ট কৌতূহল থাকলেও ওকে সে নিয়ে কিছু জিগ্যেস করিনি৷ বরং কলকাতায় আমাদের ক্লাবের ফাংশানে ও গান গাইতে রাজি আছে কি না সে-কথাই জানতে চাইছিলাম৷ ও রাজি আছে৷ আমি সামনের মাসে কলকাতায় যাব—তখন কথাবার্তা বলে সব ফাইনাল করে আসব৷ তা উনি অসময়ে স্টেশনে এসেছেন কেন?

মহাবীর যাদব বললেন, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল, মাস্টারজী৷’

‘চলুন—আমার ঘরে চলুন—৷’

‘আমার ঘর’ বলতে পাকা দেওয়াল, টিনের ছাউনি, একটা টেবিল, দুটো চেয়ার আর একটা লম্বা বেঞ্চি৷ রাখিতপুর টাইপের স্টেশনে স্টেশন মাস্টারের যেরকম টাইপের ঘর হওয়া স্বাভাবিক সেইরকম৷

মহাবীর বললেন, ‘না, না, তার দরকার নেই৷ একজনের সঙ্গে আপনার কথা করাব৷ ওই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর ব্যাপারে৷ ভদ্রলোক খুব রইস আদমি৷ মিস্টার মিসরা৷ কুমারডুবিতে ওনাদের মেডিসিন ফ্যাক্টরি আছে৷ তো মিসরাসাহেব ওই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ কিছু একটা করতে চান৷ লেকিন…৷’

‘লেকিন কী?’

‘মাস্টারজী, মিসরাসাহেব স্টেশনের বাইরে গাড়িতে আছেন৷ আপনি যদি বাইরে এসে ওনার সঙ্গে একটু বাতচিত করেন তো ভালো হয়৷ এখন তো আর টিরেন-উরেন কিছু নেই….৷’

আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ এর মধ্যে আবার আমি কেন!

সে-কথাই মহাবীরকে বললাম৷

‘দেখুন, আমি এখানে নতুন লোক৷ আগে-পিছে কিছুই জানি না৷ আপনারা লোকাল লোক—কথাবার্তা যা বলার আপনারাই বলুন৷ আমাকে আর এর মধ্যে জড়াবেন না…৷’

‘জড়াতাম না, পমেশজী৷ কিন্তু আমরা অনপঢ় গাঁওয়ার, আর আপনি লিখাপড়া জানা কোয়ালিফাই আদমি৷ তাই আমি চাই মিসরাজীর সঙ্গে কথা করার সময় আপনি থাকবেন৷ চিন্তা করবেন না—আমি আমাদের মুখিয়ার সঙ্গে কথা করে এ ব্যাপারে পারমিসশান নিয়ে নিয়েছি৷ এবার তো চলুন! মিসরাসাহেব অনেকক্ষণ ওয়েট করছেন…৷’

এরপর আর ওজর-আপত্তি চলে না৷ অগত্যা মহাবীরজীর সঙ্গে হাঁটা দিলাম স্টেশনের বাইরে৷

স্টেশনের বাইরেটা সাধারণত যেমন জমজমাট হয় এখানে ততটা নয়৷ তবে বেশ কয়েকটা খাবারের দোকান আর চায়ের স্টল আছে৷ এছাড়া ট্রেনের সময় ধরে দু-একটা ভ্যান-রিকশাও পাওয়া যায়৷

মহাবীরজীর সঙ্গে স্টেশনের বাইরে এলাম৷ আসার পথে তিনি বললেন, ‘মোহনের থেকে আপনিই কথা বের করতে পারবেন৷ আপনাকে ও বহত রিসপেক্ট করে…৷’

আমি অবাক হয়ে মহাবীরজীর মুখের দিকে তাকালাম: ‘কী কথা?’

‘ওই কাটা দাগের ব্যাপারটা…৷’

‘ও—৷’ বলে আমি চুপ করে গেলাম৷

স্টেশনের বাইরে অনেক ফাঁকা জায়গা৷ তার বেশিরভাগ ঘাসে ছাওয়া—বাকি জায়গায় দুটো ছোট-ছোট পুকুর৷ তা ছাড়া এদিকে-ওদিকে অনেক বড়-বড় গাছ৷ তাদের সবুজ পাতা বাতাসে দুলছে৷ আর সেইসব পাতার আড়াল থেকে ঘুঘু আর বসন্তবৌরি ডাকছে৷ কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ‘দাওয়াই টাউন’-এর কথা ভুলে গেলাম৷

স্টেশন এলাকা ছেড়ে বেরোতেই ঢালু কাঁচা পথ৷ সেই পথ ধরে নেমে আট-দশ পা গেলে সারি বেঁধে কয়েকটা দোকান৷ দোকানগুলো ছাড়িয়ে একটা টিউবওয়েল৷ সেখানে লোকজন বালতি আর কলসি নিয়ে জল ভরছে৷

টিউবওয়েলের পরে রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল৷ তার সামনের কাচে কোম্পানির নাম লেখা একটা নীল রঙের স্টিকার লাগানো৷

মহাবীরজী বললেন, ‘ওই যে, মিসরাসাহেবের জিপ৷ উনি জিপের ভেতরে বসে আছেন৷’

আমরা পায়ে-পায়ে টিউবওয়েলের কাছে যেতেই একজন বেঁটেখাটো লোক জিপের প্যাসেঞ্জার সিট থেকে রাস্তায় নেমে দাঁড়াল৷ ইনিই বোধহয় মিস্টার মিশ্র৷

কাছে যেতেই মহাবীর যাদব পরিচয় করিয়ে দিলেন৷

‘মিশ্র ল্যাবরেটরিজ প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের বিখ্যাত মেডিসিন কোম্পানির চেয়ারম্যান অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার বদ্রীনাথ মিশ্র৷

বদ্রীনাথজীর চোখে কালো ফ্রেমের চশমা৷ চেহারা বেশ মোটাসোটা৷ গাল দুটো ডুমো-ডুমো৷ ঠোঁটের ওপরে কাঁচাপাকা গোঁফ৷ মাথার চুল যথেষ্ট পরিমাণে তেল-টেল মেখে পেতে আঁচড়ানো৷ দু-চোখে মজাদার মেজাজের ছোঁওয়া৷

সাদা হাফ শার্ট কালো প্যান্টের ভেতরে গুঁজে পরেছেন৷ কোমরে বেল্ট বেঁধে নেয়াপাতি ভুঁড়িটিকে সামলে-সুমলে রেখেছেন৷

মিস্টার মিশ্রকে দেখে মোটেই কোনও হাই-ফাই কোম্পানির চেয়ারম্যান অথবা ম্যানেজিং ডিরেক্টর—কোনওটাই মনে হয় না৷ বরং ওঁর চেহারা আর চোখ-মুখ দেখে ফিল্মের কমেডিয়ান বলে মনে হয়৷

মিশ্রজী পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে বসালেন৷ আমাকে আর মহাবীরজীকে অফার করলেন৷

আমি হেসে জানালাম যে, ট্রেনের ধোঁয়াতেই আমি বুঁদ হয়ে আছি, অন্য কোনও ধোঁয়াতে তেমন মজা পাই না৷

মহাবীর যাদব সিগারেটের অফার অ্যাকসেপ্ট করলেন৷ মিশ্রসাহেব পকেট থেকে সোনালি লাইটার বের করে মহাবীরজীর সিগারেট ধরিয়ে দিলেন, তারপর নিজেরটা ধরালেন৷

বেশ মওজ করে ধোঁয়া ছাড়লেন দুজনে৷ সেই ধোঁয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বদ্রীনাথ মিশ্র৷ তারপর মহাবীরজীর দিকে নজর নিয়ে এসে ভুরু উঁচিয়ে হাত নেড়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা হবে?’

আমি বললাম, ‘স্টেশানে আমার ঘরটায় গিয়ে আমরা বসতে পারি—৷’

মহাবীর মিশ্রসাহেবকে অনুরোধ করলেন, ‘চলিয়ে না, স্যার…৷’

কিন্তু মিশ্রসাহেব কী ভেবে হাত নেড়ে বললেন, ‘নহি—হামে জরা জলদি ভি হ্যায়৷ ছোটাসা ডিসকাশন—এহিপে ডিসকাস কর লেতে হ্যায়…৷’

তো ওই জিপের পাশে দাঁড়িয়েই আমাদের কথাবার্তা হল৷ মিশ্রসাহেব আর মহাবীরজী একটু নীচু গলায় কথা বলছিলেন৷ ওঁদের ঢঙের ছোঁয়ায় আমারও গলার পরদা কখন যেন নেমে গেল৷

সত্যি-সত্যিই ছোট ডিসকাশন৷

মিশ্রসাহেবের সোজাসুজি বক্তব্য, ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভূতুড়ে বদনাম না হঠালে তিনি ওটা কিনতে পারবেন না আর ফ্যাক্টরি তৈরির জন্যে টাকাপয়সাও ইনভেস্ট করতে পারবেন না৷ কারণ, ফ্যাক্টরিতে লোকজন স্টাফ সব লাগালে তারা হয়তো ভূত-পিরেতের ভয়ে পালিয়েই যাবে৷ তখন মিশ্রজীর ইনভেস্ট করা কোটি-কোটি টাকার সত্যনাশ হবে৷ সুতরাং, আগে জায়গাটাকে শোধন করতে হবে৷ মহাবীরজী দায়িত্ব নিয়ে যদি সে-কাজ করে দিতে পারেন তাহলে ‘দাওয়াই টাউন’ কেনার ব্যাপারে মিশ্রসাহেব শান্তিতে এগোতে পারেন৷ জায়গাটাতে পুজো-পাঠ আর শোধনের কাজের জন্য যা খরচাখরচ হবে তার জন্যে মিশ্রজী এখনই পাঁচ হাজার টাকা দিতে রাজি আছেন৷

কথা বলতে-বলতে বদ্রীনাথ মিশ্র পকেট থেকে একশো টাকার নোটের গোছা বের করে ফেলেছেন এবং গুনতে শুরু করেছেন৷

আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে মহাবীর যাদবের দিকে তাকালাম৷ দেখলাম, ওঁর সরল চোখে লোভের চকচকে ছায়া৷

আমার মনে হচ্ছিল, এ-ব্যাপারটার মধ্যে না ঢুকলেই ভালো হত৷ কিন্তু এখন তো ফেরার পথ নেই!

বদ্রীনাথজীর হাত থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার সময় মহাবীর যাদব যা বললেন তাতে আমার ফেরার পথ আরও বন্ধ হয়ে গেল৷

‘আপনি চিন্তা করবেন না, মিসরাজী৷ মাস্টারজী আমার সঙ্গে আছেন৷ ওনার মতো পড়ালিখা আদমি সঙ্গে থাকলে আমি অনেক ভরোসা পাই৷ আমাদের মহল্লায় সবাই মাস্টারজীকে বহত রিসপেক্ট করে…৷’

বদ্রীনাথ মিশ্র আমার দিকে একবার দেখলেন৷ বোধহয় আঁচ করতে চাইলেন, ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভূতিয়াঘর বদনাম ঘোচানোর কাজে আমি পজিটিভ রোল প্লে করতে পারব কি না৷

আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, মহাবীর যাদবকে দেখে যতটা সহজ-সরল মনে হয় আসলে হয়তো ততটা নন৷ আরও মনে হল, মিশ্রসাহেব যদি ওই বিশাল জমিটা কিনে নেন, তাহলে মিডলম্যান হিসেবে মহাবীর যাদবেরও দশ-বিশ হাজার টাকা ইনকাম হয়ে যাবে৷

মহল্লার লোকজন যাতে ঝামেলা না করে সেইজন্যেই কি সবাই ‘রিসপেক্ট’ করে এমন একজনকে সঙ্গে চাইছেন মহাবীর?

আমার মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করতে লাগল৷ না, জমির দালালির টাকায় আমার কোনও আকর্ষণ নেই৷ তবে ওই ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভূত তাড়ানোর ব্যাপারে আমার যথেষ্ট আকর্ষণ এবং আগ্রহ আছে৷

কথাবার্তা শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ হাসিমুখে জিপে ওঠার সময় বদ্রীনাথজী মহাবীর যাদবের ডানহাতটা ধরে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘ওই জমিন যদি কিনে নিতে পারি তো আপনাকে একেবারে খুশ করে দিব৷ আপ বেফিকর রহিয়ে, মহাবীরজী—৷’

জিপ স্টার্ট দিল৷ ধুলো উড়িয়ে বদ্রীনাথ মিশ্র চলে গেলেন৷

মহাবীর যাদব মনের আনন্দ যেন আর চেপে রাখতে পারছিলেন না৷ আমার হাত ধরে আবেগমাখা গলায় বললেন, ‘আপনি সাথে থাকলে আমি অনেক জোর পাব, পমেশজী৷ জনতা সেবাকেন্দ্রের ওই ভূতিয়াঘর বদনাম—উও বদনাম য্যায়সে ভি হো মিটানা হি পড়েগা, কিঁউ?’

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘অবশ্যই—৷’

মহাবীর যাদব খুশি হলেও কেন জানি না, আমি খুব একটা খুশি হতে পারছিলাম না৷ ওই হাসপাতালটার ভেতরের নানান অজানা ভয় আমার বুকের ভেতরে আঁচড় কাটছিল৷ হিংস্র বাঘের নখের আঁচড়৷

‘দাওয়াই টাউন’-এর বদনাম ঘোচানোর ব্যাপারে মহাবীর যাদবের আগ্রহের একটা বড় কারণ হয়তো ওঁর বোন লছমি, কিন্তু তার পাশাপাশি লক্ষ্মীলাভের আগ্রহটাও বোধহয় বড় কম নয়৷ গতকাল হাবভাব আর কথাবার্তা শুনেই বুঝেছি বদ্রিনাথ মিশ্র যথেষ্ট বড়লোক এবং ‘দাওয়াই টাউন’-এর জায়গাটাতে উনি সিরিয়াসলি একটা ফ্যাক্টরি খুলতে চান৷

কিন্তু আমি যে জড়িয়ে পড়লাম সেটার কী করি!

ব্যাপারটা নিয়ে এ-কথা সে-কথা ভেবে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিলাম৷ তারপর হঠাৎ করেই ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বরে পড়লাম৷

সময়টা ফাল্গুন মাস হলেও বেশ কয়েকদিন ধরে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি! তাতেই হয়তো কোন এক ফাঁকে ঠান্ডা থাবা বসিয়ে দিয়েছে৷

এক দুপুরে চাদর মুড়ি দিয়ে খাটিয়ায় শুয়ে আছি, এমন সময় মহাবীরজী আমার আস্তানায় এলেন৷ বাইরে তখন ঘ্যানঘেনে বৃষ্টি চলছে৷

ওঁকে দেখে আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম৷ ঘরের একমাত্র মোড়াটা কাছেই ছিল৷ মহাবীরজীকে সেখানে বসতে বললাম৷

উনি সে-কথা না শুনে তক্তপোশে আমার পাশটিতে বসলেন৷ বললেন, ‘আজ কেমন আছেন?’

আমি অল্প হেসে বললাম, ‘কালকের চেয়ে বেটার…৷’

মহাবীরজী আমার গায়ে হাত দিয়ে জ্বর পরখ করলেন৷ বললেন, ‘এরকম বে-টাইমের বারিশ—মহল্লাতে অনেকেরই বোখার-উখার হচ্ছে৷ তা আপনি দাওয়াই নিচ্ছেন তো?’

ওঁকে জানালাম যে, আমার সঙ্গে সবসময় হোমিওপ্যাথিক ওষুধ থাকে—সেটাই রেগুলার চার্জ করছি…৷

মহাবীর যাদব খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিলেন৷ ওঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, উনি দূরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন৷

হঠাৎই আমার দিকে ফিরে তাকালেন মহাবীর৷ ওঁর চোখের দৃষ্টিটা কেমন অদ্ভুত লাগল৷ মনে হল, উনি আমাকে কিছু বলতে চান৷

কয়েক সেকেন্ড ওইরকমভাবে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, ‘পমেশজী, আজ লছমির জনমদিন৷ লছমি কেমন করে মারা গেল সেই কাহানিটা আজ আপনাকে বলব…৷’

আমি চুপ করে রইলাম৷ এরকম একটা মুহূর্তে কথা বলতে নেই৷ কথা বললে ওঁর ভাবনার সাবলীল স্রোত এলোমেলো হয়ে যাবে৷

‘লছমি আমার পেয়ারি বহেনা ছিল৷ সুন্দর, ফুটফুটে—যেন একটা কথা-বলা পুতুল…৷’

ঘটনাটা বহুকাল আগের৷ মহাবীর যাদবের বয়েস তখন ছিল তেরো কি চোদ্দো বছর৷ আর লছমির বয়েস? এগারো কি বারো৷ সময়টা ছিল বর্ষাকাল৷ ক’দিন ছাড়া-ছাড়াই ঘোর বৃষ্টি৷ আর মেঘ? মেঘের দল তখন টুয়েন্টি ফোর সেভেন আকাশের দখল নিয়ে নিয়েছে৷ সবসময়েই গুড়গুড় গুড়ুম-গুড়ুম চলছে৷ আর বিজলির তলোয়ার রাত নেই দিন নেই আকাশকে ফালা-ফালা করে চলেছে৷

এরকম একটা দুর্যোগের সময়ে আর-একটা দুর্যোগ নেমে এসেছিল রাখিতপুরে৷

মহাবীরজীদের মহল্লা থেকে কিলোমিটারটাক দূরে একটা প্রাইমারি স্কুল ছিল৷ সেই স্কুলে ক্লাস ফোর-এ পড়ত লছমি৷ স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়েছে বলে স্কুলের প্রেসিডেন্ট ভোজের আয়োজন করেছিলেন৷ সেই ভোজ খেয়ে স্কুলের অনেক ছেলেমেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল৷ পেট ব্যথা, গা গুলোনো, তার সঙ্গে পেটখারাপের সমস্যা৷ তো সাতাশজন ছেলেমেয়েকে ওই জনতা সেবাকেন্দ্রে ভরতি করা হয়েছিল৷ ওদের সবাইকে রাখা হয়েছিল পাঁচতলার চিলড্রেন্স ওয়ার্ডে৷

দু-দিন কাটতে না কাটতেই একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেল৷ এমন ঘটনা যার ওপরে কারও হাত ছিল না৷ সবটাই ওপরওয়ালার বিধান৷

সময়টা ছিল সন্ধেবেলা৷ তখন বোধহয় সাড়ে ছ’টা কি সাতটা হবে৷ আকাশে মেঘ-বৃষ্টি আর বজ্র-বিদ্যুতের রাজ যেমন চলছিল সেটা সেদিন বিকেলের পর যেন চার-পাঁচগুণ বেড়ে গিয়েছিল৷ মহল্লার সবাই আলোচনা করছিল যে, এরকম দুর্যোগের ঘনঘটা তারা বহু বছরের মধ্যে দেখেনি৷

ওই সাড়ে ছ’টা-সাতটার সময় একটা বাজ পড়ল৷ বাজ তো নয়, যেন অ্যাটম বোমা! আর তার আলো এমন ছিল যেন এক লক্ষ ওয়াটের ফ্ল্যাশগান ব্যবহার করে কেউ আকাশ থেকে আমাদের গাঁয়ের ফটো তুলল৷ সেই তীব্র আলোর টুকরো জানলা-দরজার ফাঁকফোকর আর ফাটল দিয়ে গাঁয়ের সবার ঘরের দেওয়ালে ঝলসে উঠল৷

বাজ পড়ার পরই অনেক মানুষ কৌতূহলে উঁকিঝুঁকি মারল বাইরে৷ তখনই দেখা গেল, জনতা সেবাকেন্দ্রের বিল্ডিংটা দাউদাউ করে জ্বলছে৷ মহাবাজ ভীষণ আক্রোশে ছোবল মেরেছে তার মাথায়৷

দুসরা গাঁয়ে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল৷ নিজেদের আত্মীয়স্বজন আর ছেলেমেয়ের চিন্তায় সবাই পাগলের মতো হয়ে গেল৷ বৃষ্টিতে ভিজেই সব ছুটল ‘দাওয়াই টাউন’-এর দিকে৷ মুখে বুকফাটা আর্তনাদ৷

সেসময়ে আবার একটা মহাবাজ পড়ল৷ ওই জনতা সেবাকেন্দ্রের বিল্ডিং-এই৷ আগুন আরও তেজিয়ান হয়ে উঠল৷ ছুটন্ত মানুষগুলো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ওরা আগুনের শিখা দেখতে পাচ্ছিল৷ বৃষ্টি সেই আগুনকে একফোঁটাও বাগে আনতে পারছিল না৷

অন্ধকারের মধ্যেই মানুষের দল আবার ছুটতে শুরু করল৷ ওদের চোখের জল বৃষ্টির জলে মিশে যাচ্ছিল৷ গায়ের জামাকাপড় ভিজে সপসপে৷ ছুটতে খুবই অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু তাও ওরা মরিয়া হয়ে ছুটছিল৷ তার সঙ্গে ছুটছিল ওদের কান্নাকাটি আর শোরগোল৷

ওরা যখন দলে-দলে ‘দাওয়াই টাউন’-এর কাছে এসে জায়গাটাকে ঘিরে দাঁড়াল, তখনই কোন এক ম্যাজিকে বৃষ্টিটা কমে গেল হঠাৎ৷ দাউদাউ আগুন আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল৷ ‘দাওয়াই টাউন’-কে ঘিরে কান্না আর হইচইয়ের রোল উঠল৷ দু-দশজন সাহসী লোক ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল বিল্ডিং-এর ভেতরে৷ কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত কোনও লাভ হয়নি৷

অ্যাক্সিডেন্টের পরে পুলিশ এসেছিল, দমকলের লোক এসেছিল, সরকারি দপ্তরের লোকজনও এসেছিল৷ প্রায় সাতদিন ধরে ওরা ছানবিন করেছিল৷ অনেক উন্ডেড মানুষকে ওরা চিকিৎসার জন্যে গোবিন্দপুর আর ধানবাদের দুটো হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল৷ তা ছাড়া অনেক লাশও উদ্ধার করেছিল৷

তার মধ্যে ছোটমাপের সাতাশটা লাশ ছিল৷ সরাসরি সবাইকে শনাক্ত করা না গেলেও লোকজনকে জিগ্যেস করে, নানান রেকর্ড ঘেঁটে ওই সাতাশ জনের পরিচয় মোটামুটিভাবে জানা গিয়েছিল৷ কিন্তু তাতে আর লাভ হল কী!

ইনভেস্টিগেশানে আরও অনেক কিছু জানা গিয়েছিল৷

প্রথমবার বাজ পড়তেই হসপিটালে আগুন ধরে গিয়েছিল৷ পাঁচতলা থেকে চারতলায় নামার সিঁড়ির অংশ বড়-বড় ফাটল ধরে ধসে পড়েছিল৷ বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে ছুটোছুটি করে লিফটে উঠতে যায়৷

হসপিটালে একটা প্রকাণ্ড মাপের লিফট ছিল৷ সেটা একইসঙ্গে ছিল পেশেন্ট পার্টি ওঠা-নামার লিফট আর মালপত্র, যন্ত্রপাতি, পেশেন্টসমেত স্ট্রেচার ইত্যাদি ওঠা-নামা করানোর সার্ভিস লিফট৷

লিফটটা ছিল বলতে গেলে জোব চার্নকের আমলের, ওঠা-নামা করার সময় প্রবল শব্দ হত, আর আরোহীরা নিজেরাই হাতল ঘুরিয়ে ওটাকে চালাত—কোনও লিফটম্যান ছিল না৷

তো ওই সাতাশটা ছেলেমেয়ে প্রাণের ভয়ে হুড়োহুড়ি করে সেই লিফটটায় উঠে পড়েছিল৷ হাতল ধরে এলোমেলো টানাটানি করে ওটাকে চালু করে দিয়েছিল৷ তারপর…৷

তারপর লিফট যখন সবে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে তখন দ্বিতীয় বাজটা পড়ে৷ তাতে নিশ্চয়ই লিফটে আগুন ধরে গিয়েছিল, কারণ ওই বন্ধ লিফটের ভেতরেই সাতাশটা ছেলেমেয়ের বডি পাওয়া গিয়েছিল৷

কী বীভৎস ব্যাপার! অথচ কারও কিছু করার ছিল না৷

ওইসব পোড়া বডিগুলোর মধ্যে একটা ছিল লছমির৷

লছমির কানে রুপোর মাকড়ি ছিল৷ ফোরেনসিক টিম জানিয়েছিল, ওই মাকড়িগুলো নাকি ট্রেস করা গিয়েছিল৷ রুপোর মেল্টিং পয়েন্ট ৯৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ তাই ওগুলো বেঁকেচুরে গেলেও গলে যায়নি৷

ব্যস, এই ঘটনার পর থেকে জনতা সেবাকেন্দ্র শেষ হয়ে গেল৷ ভূতিয়াঘর বলে দাগিও হয়ে গেল৷

তারপর থেকে বাড়িটাকে নিয়ে নানান জনে নানান কথা বলে৷

কেউ বলে, মাঝে-মাঝে নাকি বাড়িটায় আলো জ্বলতে দেখা যায়৷ আবার কেউ-কেউ ও-বাড়ি থেকে ছোট-ছোট ছেলেমেয়ের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনেছে বলে দাবি করেছে৷

রাখিতপুর এমনই একটা পিছিয়ে থাকা জায়গা যে, এখানে কোনও কিছুর গায়ে একবার দাগ লেগে গেলে সে-দাগ তোলা মুশকিল৷

‘…ওই বেঁকেচুরে যাওয়া মাকড়ি দুটো আমার কাছে এখনও আছে৷ ছোটবেলা থেকে দেখেছি, ওই মাকড়িগুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে আমার মা কী কান্নাটাই না কাঁদত৷ সেই কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেলতাম৷ সবই ভগবানের মরজি…৷’

লছমির মর্মান্তিক পরিণতির কথা বলতে-বলতে মহাবীর যাদব বারবার চোখ মুছছিলেন, নাক টানছিলেন৷ তারপর একসময় নিজেকে সামলে নিতে পারলেন৷ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন৷

কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, ‘‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর গায়ের দাগ তো তুলতে হবে৷ তার কিছু ব্যবস্থা করলেন?’

মহাবীরজী মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি একজন অচেনা মানুষ৷ লছমির কথা বলতে-বলতে তিনি কোথায় যেন ভেসে চলে গেছেন৷

অন্তত দশ সেকেন্ড পর আমার কথার খেই ধরতে পারলেন৷ তখন থেমে-থেমে নীচু গলায় বললেন, ‘আপনি তো জানেন, এ-গাঁয়ের উত্তরদিকে একটা ছোটামোটা শিবমন্দির আছে৷ ও-মন্দিরের পূজারি আছেন রামপরসাদ তিওয়ারি৷ তিওয়ারিজীকে আমি ব্যাপারটা খুলে বলেছি৷ বলেছি ওই দাগি অস্পাতালে ক্রিয়াকরম করে ওটার দাগ মেটাতে হবে৷ তার জন্য আমি পূজারিজীকে পানসো রুপেয়া দকশিনা দেব৷ আর মন্দিরে ডোনেসান দেব পানসো রুপেয়া৷

‘আমার কথায় তিওয়ারিজী রাজি হয়ে গেছেন৷ উনি দিন আর লগন বলে দেবেন—তো সেইদিন ঠিক টাইমে গিয়ে আমরা ও-বিল্ডিংটায় সব রুমে ঠাকুরমশাইকে দিয়ে পুজোপাঠ করিয়ে নেব৷ তখন লছমির আতমা শান্তি পাবে, মুক্তি পাবে৷ শুধু লছমি কেন, ওই বিল্ডিং-এর সব আতমাই মুক্তি পেয়ে যাবে৷ তখন ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর শাপ মুছে যাবে৷ আমার মনও শান্তি পাবে৷’

যে-শিবমন্দিরের কথা মহাবীর যাদব বলছেন, সেই শিবমন্দিরে আমি একবার পুজো দিতে গিয়েছিলাম৷ সেখানে হর-পার্বতীর মূর্তি রয়েছে৷ মন্দিরের পুরোহিত রামপ্রসাদ তিওয়ারিকে আমি দেখেছি৷ বয়েস বেশি নয়—বড়জোর চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে৷ ছিপছিপে লম্বা চেহারা৷ মাথায় কদমছাঁট চুল৷ পেছনদিকে জুতসই টিকি৷ পুজো করার সময় লক্ষ করেছি, রামপ্রসাদজী টিকিতে ফুল বেঁধে রাখেন৷ আর সবসময় ওঁর কপালে আঁকা থাকে চন্দনের আঁচড়৷

মহাবীরজী ‘ছোটামোটা’ বললেও মন্দিরটা দেখতে বেশ সুন্দর৷ মন্দিরের মাথায় লাল রঙের ত্রিশূল৷ ছোট্ট দরজার মুখে ওপর থেকে ঝোলানো পেতলের ঘণ্টা৷ মন্দিরের সামনে শান বাঁধানো চত্বর৷ পুজোর সময় ভক্তরা সেখানে বসে পুজো দ্যাখে, অন্যসময় নাম-গান শোনে৷

মন্দিরের দরজা থেকে হাতচারেক দূরে শানপাথরের ওপরে বসানো রয়েছে একটা ষাঁড়ের মূর্তি৷ মূর্তিটা মাপে ছোট, কালো পাথরের তৈরি—মন্দিরের মূর্তির দিকে চেয়ে ষাঁড়টা অলসভাবে বসে আছে৷

আমি মহাবীরজীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম৷ তা হলে ‘দাওয়াই টাউন’-এর বদনাম ঘোচাতে এগিয়ে যাব আমরা তিনজন—আমি, মহাবীর যাদব আর রামপ্রসাদ তিওয়ারি?

আমার মনটা একটু খচখচ করতে লাগল৷ আমাদের সঙ্গে মোহন যাদবকে নিলে হত না? ওর ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভেতরে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা আছে—সে চুরি করতে গিয়েই হোক, বা অন্য কোনও কু-কাজ করতে গিয়েই হোক৷ আমার মন বলছিল, মোহন আমাদের সঙ্গে গেলে ভালোই হবে৷ কিন্তু মোহন আমার সঙ্গে আর দেখা করতে আসেনি৷ মহল্লায় শুনলাম, ও ওর বাবাকে নিয়ে ধানবাদের কোন হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট করাতে গেছে৷ তা ছাড়া ওকে দেখে যেটুকু বুঝেছি, ও আমাকে এড়িয়ে চলার মতন ছেলে নয়৷

আমাকে অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থাকতে দেখে মহাবীর জিগ্যেস করলেন, ‘পমেশজী, কী ভাবছেন?’

‘মোহন যাদবের কথা ভাবছি৷ ওকে আমাদের সঙ্গে নিলে হয় না?’

কথাটা বলে মোহনকে সঙ্গে নিতে চাওয়ার কারণটাও খুলে বললাম৷

‘ও যদি রাজি হয় নিতে পারেন৷ আমার তাতে কুছু আপত্তি নেই৷ ছোকরা জোয়ান আছে৷ তা ছাড়া ওর সাহসও আছে—’ আপনমনে ওপর-নীচে মাথা নাড়লেন মহাবীরজী৷ তারপর: ‘আপনি মোহনকে একবার বলে দেখেন৷ আপনি বললে ও হয়তো রাজি হয়ে যাবে৷ ও গেলে খালি হাতে ফিরবে না৷ বদ্রীনাথজীর রুপেয়া থেকে মোহনকে হিস্যা ভি দেব আমি…৷’

মহাবীর যাদবের কথার মধ্যে ‘হিস্যা’ শব্দটা আমার কানে বাজল৷ কিন্তু এটা আমার মনে হচ্ছিল, ‘দাওয়াই টাউন’-এর ভূতুড়েপনার সত্যি-সত্যি এসপার-ওসপার হওয়া দরকার৷

আমার তখন বয়েস কম ছিল৷ তাই মনের যুক্তিবাদী অংশটা ছিল অনেক জোরালো৷ রাখিতপুরের লোকজন যতই ভূতিয়াঘরের ভূত সম্পর্কে গদগদ বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা দেখাক, আমি বিনা পরীক্ষায় ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নেব না৷ এখন এলাকার তিন-তিনজন মানুষ যখন ‘দাওয়াই টাউন’-এর বদনাম বিল্ডিং-এ অ্যাডভেঞ্চার করতে রাজি, তখন আমার আর দোষ কোথায়? এই সুযোগে ব্যাপারটার শেষ দেখে ছাড়া যাবে৷

আমি মহাবীরজীকে বললাম যে, দু-একদিনের মধ্যেই আমি মোহনের সঙ্গে কথা বলব৷ তারপর আমরা চারজনে—মানে, আমি, মোহন, মহাবীরজী আর রামপ্রসাদ তিওয়ারিজী—নিজেদের মধ্যে একটা গোল মিটিং সেরে নেব৷ মিটিং-এ রামপ্রসাদজী যে-দিনক্ষণ বলবেন আমরা সেই অনুযায়ী ‘দাওয়াই টাউন’-এ অপারেশান চালাব৷

মহাবীর যাদব আমার কথায় ঘন-ঘন ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন৷

বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে৷ যদিও আকাশের ছাই রং আরও গাঢ় হয়েছে৷

একদিন সন্ধেবেলা স্টেশান থেকে ফিরে দেখি মোহন যাদব আমার ঘরের দরজার পাশে একটা ধাপিতে বসে রয়েছে৷

তখন ক’টা বাজে? সাতটা পনেরো কি সাতটা কুড়ি৷

আমি আস্তানার কাছাকাছি আসতেই মোহন উঠে দাঁড়াল৷ আমার কাছে এসে চট করে ঝুঁকে পড়ল আমার পায়ের দিকে৷ হাত বাড়িয়ে দুটো হাঁটু পরপর ছুঁয়ে বলল, ‘পায় লাগু, মাস্টারজী—৷’

আমি ওকে প্রণামে বাধা দেওয়ার সময়ই পেলাম না৷ মহাবীর যাদবের কথা মনে পড়লঃ ‘মোহনের থেকে আপনি কথা বের করতে পারবেন৷ আপনাকে ও বহত রিসপেক্ট করে…৷’ সে-কথার শেষটুকু তো দেখছি সত্যি হল, কিন্তু সামনের অংশটুকু সত্যি হবে কি?

দেখা যাক৷ আজ আমি মোহনকে সোজাসাপটা জিগ্যেস করব৷ কারণ, ‘দাওয়াই টাউন’-এ হানা দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আর দেরি করা যাবে না৷ মহাবীর যাদব, আমি আর পূজারিজী তো তৈরি হয়েই আছি৷ শুধু মোহনের ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ জানতে পারলেই পূজারিজী দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলবেন৷

আমি দরজা খুলতে-খুলতে জিগ্যেস করলাম, ‘সেই যে আসবে বললে, তারপর তো উধাও হয়ে গেলে—!’

মোহন যাদব মাথা নীচু করে অপরাধীর গলায় বলল যে, ওর বাবা হঠাৎ খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাবাকে নিয়ে ও ধানবাদের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিল—আজ সকালেই ফিরেছে৷

‘এসো, ভেতরে এসো—’ ওকে ঘরের ভেতরে ডাকলাম: ‘তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে৷’

দেশলাই বের করে হ্যারিকেন জ্বেলে দিলাম৷ মোহনকে মোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বসতে বললাম৷ একটা তাক থেকে বিস্কুটের কৌটো পেড়ে নিয়ে চারটে বিস্কুট বের করলাম৷ দুটো মোহনকে দিয়ে দুটো আমি নিলাম৷ আমার কাছে অতিথি আপ্যায়নের এ ছাড়া কোনও ব্যবস্থা নেই৷

কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে গ্লাসটা মোহনের মোড়ার পাশে রাখলাম৷

মোহন যাদব কেমন যেন সঙ্কোচ পাচ্ছিল৷ বোধহয় ওর আর আমার জাতের তফাত নিয়ে ভাবছিল৷

জলের গ্লাসটা ওর নাগালে রাখতেই ও বলে উঠল, ‘মাস্টারজী, আপনি এত তকলিফ করছেন কেন? পানি তো ম্যায় খুদ লে সকতা থা—৷’

আমি ওকে স্নেহের ধমক দিলাম: ‘তুমি চুপ করো তো! যত্ত সব! নাও, বিস্কুট খাও—৷’

বিস্কুট খেতে-খেতে মোহন ইতস্তত করে বলল, ‘আপনি উস দিন কলকাত্তায় গানের কথা বলছিলেন…৷’

‘হ্যাঁ৷ এর মধ্যে আমি ট্রাঙ্ক-কল করে আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি৷ সামনের আগস্ট মাসে তুমি কলকাতায় যাচ্ছ—আমার সঙ্গে৷ সেখানে আমার বাড়িতে তুমি থাকবে৷ আমাদের ক্লাবের ফাংশানে গান গাইবে—তার জন্যে কিছু টাকাও পাবে—৷’

আমার কথা শেষ হতে না হতেই মোহন মোড়া থেকে ছিটকে এসে আমার পায়ের কাছে বসে পড়ল৷ ওর দেশোয়ালি ভাষায় কীসব বলতে লাগল৷

আমি হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠেই ‘কী করছ! কী করছ!’ বলে ওকে ধরে তুললামঃ ‘শোনো, মোহন৷ তোমার সঙ্গে আরও জরুরি কথা আছে…৷’

মোহন কৃতজ্ঞতায় বিহ্বল ভাবটা সামলে নিয়ে আবার মোড়ায় গিয়ে বসল৷ উৎসুকভাবে চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে৷

‘…আর পাঁচ-ছ’দিনের মধ্যেই আমরা ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ গিয়ে ঢুকছি৷ আমি, মহাবীর যাদবজী, ভোলেনাথের মন্দিরের পুরোহিত রামপ্রসাদ তেওয়ারিজী—আর তুমি৷’

‘আমি!’

‘হ্যাঁ—তুমি৷ ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এর ভূতিয়াঘর বদনাম খতম করতে হবে৷ তারপর ওই জমিতে কারখানা হবে৷ সেখানে তোমার এই গাঁয়ের ছেলেছোকরারা নোকরি পাবে—তুমিও পাবে৷’

মোহন আমাকে এ নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল৷ আমিও খোলাখুলি ওর সঙ্গে কথা বললাম৷

শেষে বললাম, ‘দ্যাখো, তোমার ওই ভূতুড়ে বাড়িতে ঢোকার এক্সপিরিয়েন্স আছে—তাই তোমাকে আমরা সঙ্গে চাইছি৷ তা ছাড়া তোমাকে কিছু টাকাও দেওয়া হবে৷’

কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর মোহন ঘাড় কাত করে জানাল, ও আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি৷

আমি এবার আচমকা প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার গলায় আর গালে এরকম বাজেভাবে কেটে গেল কেমন করে?’

মোহন কেমন থতমত খেয়ে গেল৷ তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘ছোড়িয়ে, মাস্টারজী৷ মেরা নসিব—৷’

হ্যারিকেনের আলো মোহনের গলায়, গালে আর থুতনিতে পড়েছিল৷ সেই অল্প আলোতেও কাটা দাগটা বীভৎস দেখাচ্ছিল৷ আর ওর মুখে যে একটা ভয়ের পরত নেমে এল, সেটাও বোঝা গেল৷

মোহন চুপ করে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল৷

‘মোহন, প্লিজ বলো৷ শংকর শম্ভুর কসম, তোমার এসব কথা আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না—কেউ না৷’

মোহন চুপ করে রইল৷

আমি মোহনকে বোঝাতে লাগলাম, আর বোঝাতে লাগলাম৷ বললাম যে, ওর ঘটনাটা জানতে পারলে ‘দাওয়াই টাউন’-এ যখন আমরা চারজন যাব তখন আমাদের কাজের সুবিধে হবে৷ মোহন কি চায় না, ‘দাওয়াই টাউন’ পুরো সাফ হয়ে গিয়ে সেখানে কলকারখানা তৈরি হোক?

বেশ কিছুক্ষণ পর মোহন যাদব আপনমনে ঘাড় নাড়ল৷ বিড়বিড় করে বলল, ‘হাঁ, মাস্টারজী—আপনি যেসব ফ্যাক্টরি-উক্টরির কথা বলছেন সেসব আমিও চাই৷ আমিও চাই যে, আমি দু-চার পয়সা কামাই—মহল্লার লোকজনের কাছ থেকে একটু ইজ্জত পাই৷ লেকিন…৷’

‘ওসব লেকিন-টেকিন শুনব না, মোহন—বলো…৷’ আমার কীরকম যেন একটা জেদ চেপে গিয়েছিল৷

মোহন গ্লাস থেকে ঢকঢক করে জল খেল৷ গ্লাসটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে হাত দিয়ে মুখ মুছল৷ তারপর কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বলছি, তবে সিরফ আপনার জন্যে৷ সুনেন, মাস্টারসাব, ও অস্পাতালে অনেক খারাপ জিন আছে…৷’

আমি আবার মোহনকে কথা দিলাম, ওর এই কাহিনি আমি কাউকে বলব না৷

প্রায় একবছর আগে মোহন ‘দাওয়াই টাউন’-এ ঢুকেছিল চুরি করতে৷ ও ছোকরু আর মুন্নার মার্ডারের ব্যাপারটা জানত৷ সেজন্যে মনে ওর ভয়ও ছিল৷ কিন্তু অভাব বড় বালাই৷ গান-টান গেয়ে প্রচুর তারিফ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু পয়সা পাওয়া যায় না৷ জোয়ান ছেলে হয়েও ও কোনও কাম-কাজ জোটাতে পারেনি, সেটাই ওর সবচেয়ে বড় অপরাধ৷ তার তুলনায় চোরি আর কী এমন বুরা কাম!

নানান লোকের কাছে মোহন শুনেছিল যে, ‘দাওয়াই টাউন’-এর ওই বিশাল বিল্ডিংটার ভেতরে অনেক দামি-দামি সামান আছে৷ বেঞ্চি, টেবিল, খাটিয়া ইত্যাদি হরেক ফার্নিচার থেকে শুরু করে প্রচুর ডাক্তারি যন্ত্রপাতি এখানে-সেখানে পড়ে আছে৷ এ ছাড়া কপাল ভালো থাকলে ওই অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া লোকজনের পোড়া গয়নার টুকরোটাকরাও মিলে যেতে পারে৷

‘তো একদিন দুপুরে আমি সবার চোখ এড়িয়ে ওই দাগি বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়ি৷ আপনার কাছে কবুল করছি যে, ছোটা-মোটা চোরি-ওরির অভ্যাস আমার বেশিদিন নয়—মাত্র পাঁচ-সাত বছরের৷ কী করব! পাপী পেট কা সওয়াল৷

‘চোরাই মাল উঠিয়ে আনার জন্যে আমার হাতে একটা বোরা ছিল৷ বোরা, মানে বস্তা৷ সেটা নিয়ে আমি তো সাফ ওই বিল্ডিং-এ ঢুকে গেলাম৷ উসকে বাদ…৷’

বিল্ডিংটায় ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে মোহন যাদবের নাকে এসেছিল পোড়া গন্ধ৷ আর একইসঙ্গে একটা অদ্ভুত জিনিস ও লক্ষ করেছিল: বিল্ডিং-এর ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ এটা মোহনের অবাক লেগেছিল, কারণ, ও দেখতে পেল, একতলার তিনটে জানলায় একটা করে পাল্লা নেই—কোনওটা খসে গেছে, আবার কোনওটা কবজা ভেঙে ঝুলে গেছে৷

সেইসব আধখোলা জানলা দিয়ে ঘরগুলোতে আলো ঢোকার কথা, অথচ সেরকম কোনও আলো চোখে পড়েনি ওর৷ চারপাশটা যেন মনে হচ্ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ আর সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে বিচিত্র সব ধাতব শব্দ আসছে৷ অথচ মোহন যখন বিল্ডিংটায় ঢোকে তখন এই শব্দগুলো ছিল না৷

মোহন অন্ধের মতো হাতড়ে-হাতড়ে কোনওরকমে চলাফেরার চেষ্টা করছিল৷ দু’বার হোঁচট খেয়ে পড়েও গেল৷ পড়ল লোহালক্কড়ের টুকরোর ওপরে৷ হাত-পা কয়েক জায়গায় কেটে-ছড়ে গেল৷ জ্বালা করতে লাগল৷ ওই অবস্থাতেই ও দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগল৷ কোনদিকে সিঁড়িটা? অন্ধকারে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না! একটা টর্চ সঙ্গে নিয়ে এলে খুব ভালো হত৷

অন্ধকারে হাতড়ে দু-চারটে লোহার টুকরো কুড়িয়ে নিল ও৷ বস্তার মধ্যে ঢোকাল৷ কিন্তু এগুলো বেচে আর ক’পয়সা হবে! হতাশ মোহন হঠাৎ দেখতে পেল, অন্ধকারে দুটো ছোট-ছোট আলো জ্বলছে—দুটোই লাল রঙের! একটা আলো তিরচিহ্নের মতো৷ আর তার ঠিক ওপরে একটা আলো ইংরেজিতে ‘চার’ সংখ্যাটা দেখাচ্ছে৷

আলোটা মোহনকে টানছিল৷ টানটা জোরালো কোনও চুম্বকের চেয়েও তীব্র৷ ভালো-মন্দ কিছু ভেবে ওঠার আগেই মোহনের পা চলতে শুরু করে দিয়েছিল৷ ভাঙাচোরা জিনিসের টুকরোটাকরা মাড়িয়ে, ঠোক্কর খেয়ে, হোঁচট খেয়ে মোহন সেই তিরচিহ্ন অথবা ‘চার’ সংখ্যাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল৷ ওর মাথায় কেমন যেন ঘোর লেগে গিয়েছিল৷ মনে হচ্ছিল, ওই লাল আলোর কাছে ওর যাওয়া চাই—ওটাকে ছোঁওয়া চাই৷

এইরকম একটা সময়ে ওর পিঠে কেউ যেন এক প্রচণ্ড আঘাত করল৷ মনে হল, একটা ভারী লাঠি অথবা লোহার রড কেউ বসিয়ে দিয়েছে পিঠে৷ মোহন মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে৷ যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল৷ ওর নাকে-মুখে ধুলো-ময়লা ঢুকে গেল৷ বস্তাটা ছিটকে গেল হাত থেকে৷

ও কোনওরকমে উঠে বসল৷ পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা৷ চারিদিকে তাকিয়ে লাল আলোয় লেখা তিরচিহ্ন অথবা সংখ্যাটাকে দেখতে পেল না৷ একটা চাপা গর্জন ওর কানে এল৷ চিতাবাঘ, নাকি নেকড়ের গর্জন?

মোহন ভয় পেয়ে গেল৷ চুরির লোভ পলকে মুছে গেল ওর মন থেকে৷ ওর মন তখন একটাই কথা বলছিল: ‘পালাও! পালাও!’

কিন্তু পালাবে কোনদিকে? দরজাটা যে ঠিক কোনদিকে সেটাই মোহনের গুলিয়ে গেছে৷

গর্জনটা শোনা গেল আবার৷ খুব চাপা৷ যেন একটা মোটরগাড়ির ইঞ্জিন ধিকিধিকি চলছে৷

মোহন উঠে দাঁড়াল৷ কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই পিঠের ব্যথাটা যেন বর্শার মতো বিঁধল৷ এদিক-ওদিক নজর চালিয়ে মোহন পাগলের মতো দরজাটা খুঁজতে লাগল৷ কোথায় দরজাটা? কোথায়?

গর্জনটা হঠাৎ বেড়ে উঠল৷ একটা ক্ষিপ্ত পশু যেন তেড়ে আসবে এখুনি৷ এই পোড়ো বিল্ডিংটায় কোনও পশু কি এসে আস্তানা গেড়েছে?

মোহনের সন্ধানী চোখ দরজাটা এবার খুঁজে পেল৷ ওই তো, আধভাঙা পাল্লার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আলো দেখা যাচ্ছে!

ও সেদিকে পা বাড়াতেই গর্জনটা বেড়ে উঠল৷ লোহায়-লোহায় ঠোকাঠুকির শব্দ হল ‘খটাং-খটাং’৷ আর কী যেন একটা বিদ্যুৎঝলকের মতো মোহনের গাল ছুঁয়ে গেল৷

তারপরই অসহ্য জ্বালা৷ গালে হাত চলে গেল ওর৷ গাল ভিজে, চটচট করছে৷

সেই হাত চোখের সামনে নিয়ে এসে কিছু দেখা না গেলেও ও বুঝতে পারল ওর হাত রক্তে ভেজা৷ ওর গাল আর গলা গড়িয়ে রক্ত পড়ছে৷ সেই সঙ্গে তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণা৷ বুক ধকধক করছে৷ গলা শুকিয়ে কাঠ৷

গালে হাত চেপে মোহন পাগলের মতো ছুটে যেতে চাইল দরজার দিকে৷ গাঢ় অন্ধকারে দরজার জ্যামিতিক চেহারার আলোর টুকরোটা যেন দিশাহীন সাগরে এক লাইট হাউস৷ কিন্তু ছুটে পালাতে গিয়ে কতবার যে হোঁচট খেল, উলটে পড়ল!

পা কেটে গেল কত জায়গায়, হাঁটু ছড়ে গেল, কিন্তু মোহন তাড়া খাওয়া নেড়ি কুকুরের মতো পৌঁছে গেল বিল্ডিং-এর দরজায়৷

তারপর গালে হাত চেপে বিল্ডিং-এর বাইরে৷

তখনও আকাশে বেশ আলো৷ সেই আকাশ আর গাছপালার দিকে তাকিয়ে আনন্দে কয়েকটা বড়-বড় শ্বাস নিয়েছিল ও৷ এখন ও বুঝতে পারছে, জীবন কত দামি! শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারাটা ওপরওয়ালার কত বড় আশীর্বাদ!

তারপর মোহন পাশের মহল্লায় ওর একজন চেনা কম্পাউন্ডার সত্যদেও দুবেকে দিয়ে গালের কাটা-ছেঁড়ার ট্রিটমেন্ট করায়৷ দুবেজী ওঁর সাধ্যমতো ট্রিটমেন্ট করলেও বীভৎস কাটা দাগটা থেকেই গেছে৷

ওর কাহিনি শেষ করে মোহন যাদব একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘মাস্টারজী, সবই আমার নসিব…৷’

আমি মোহনের গল্পটা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম৷ কেন জানি না মনে হল, যে-কাজে আমরা চারজন এগোচ্ছি সেই কাজটা খুব একটা সহজ হবে না৷

মোহনকে শুধু বললাম, ‘পরশু রাত আটটার সময় আমরা চারজন মিটিং-এ বসব৷ ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ রওনা হওয়ার আগে কয়েকটা ব্যাপার আমাদের নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে নেওয়া জরুরি৷ তুমি ঠিক আটটায় আমার ঘরে চলে আসবে৷’

মোহন ঘাড় কাত করল৷ তারপর আমাকে নমস্কার জানিয়ে চলে গেল৷ আমি অকারণেই ওর গালের কাটা দাগটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম৷

আজ ফাল্গুনী—মানে, বাসন্তী পূর্ণিমা৷

আমাদের পণ্ডিতজী রামপ্রসাদ তিওয়ারি আজকের দিনটাকেই অভিযানের পক্ষে মানানসই দিন বলে ঠিক করেছেন৷ আরও বলেছেন, বিকেল তিনটে একচল্লিশ মিনিট গতে শুভ সময়ের শুরু৷ তাই আমরা চারজনে সাড়ে তিনটের সময় ‘দাওয়াই টাউন’-এ এসে হাজির হয়েছি৷

রামপ্রসাদজী প্রথমে বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়লেন৷ তারপর কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘জয়-জয় শিবশম্ভু! হর হর মহাদেও!’

রামপ্রসাদজীর পরনে গেরুয়া৷ বাঁ-হাতে একটা বড় কমণ্ডলু, ডানহাতে একটা ছোট ত্রিশূল৷ কপালে চন্দন লেপা, টিকিতে বাঁধা আকন্দ ফুল৷ এ ছাড়া কোমরে গোঁজা রয়েছে টর্চ৷

মানুষটা রোগাসোগা হলে কী হবে, ওঁর সাহসের রীতিমতো প্রশংসা করতে হয়৷ সেই শুরু থেকেই বলে আসছেন, ‘আমার দেওতা শিবশম্ভুর চেয়ে শক্তিমান এই ত্রিভুবনে কেউ নেই৷ ভূতপিরেত সব আমার ভোলেনাথজীর নওকর৷ ওই ‘‘দাওয়াই টাউন’’-এ যত ভূত-জিন আছে সব শিবশম্ভুর নামে ভেগে যাবে৷ যারা যাবে না, তাদের ভোলেনাথজীর এই ত্রিশূল খতম করবে—’ বলে হাতের ত্রিশূলটাকে মাথার ওপরে উঁচিয়ে ধরেছেন পণ্ডিতজী৷

রামপ্রসাদজীর সাহস দেখে আমরা তিনজনে মনে খানিকটা সাহস পাচ্ছিলাম৷ তা ছাড়া পণ্ডিতজী আজকের এই অভিযানের জন্যে মন্দিরে দু-ঘণ্টার যজ্ঞ করেছেন৷ যজ্ঞের পর তিনি মহাদেবের মনের কথা শুনতে পেয়েছেন: আমাদের অভিযান সফল হবেই৷

বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্রোচ্চারণের পর পণ্ডিতজী গোটা বিল্ডিংটাকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করলেন৷ মন্ত্র বিড়বিড় করতে-করতে কমণ্ডলুর জল ছেটাতে লাগলেন৷ মন্ত্রের মধ্যে শুধু ‘জয়-জয় শিবশম্ভু’ অংশটুকু আমি বুঝতে পারছিলাম৷ পণ্ডিতজীর পেছন-পেছন আমরা তিনজনও বিল্ডিংটাকে ঘিরে হাঁটছিলাম৷

আকাশে মেঘ, তাই চারপাশটা কেমন গুমোট৷ একটা ফ্যাকাশে ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে৷ গোটা এলাকাটা কেমন নিঝঝুম চুপচাপ৷ কাছে-দূরে যেসব গাছপালা দেখা যাচ্ছে তাদের একটি পাতাও নড়ছে না৷ মনে হচ্ছে, ওরা দম বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখছে৷

ওরা ছাড়া আর কোনও দর্শক নেই—যদি দু-চারটে কাক, শালিখ, বুলবুল কিংবা ফিঙেকে আমরা হিসেবের মধ্যে না ধরি৷ যাদবদের মহল্লা আর তার আশপাশে মহাবীরজী আর রামপ্রসাদজী অনেক আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘দাওয়াই টাউন’-এর শান্তি-স্বস্ত্যয়নের সময় আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ হাজির থাকলে সমস্ত কাজ পণ্ড হয়ে যাবে৷ তাই কৌতূহল থাকলেও কেউ আসেনি৷

এই কাজে আমাদের সঙ্গে মোহন যাদবের থাকাটা ওর বৃদ্ধ মা-বাবা মোটেই পছন্দ করেননি—এমনকী ওঁরা অনেক কান্নাকাটিও করেছেন৷ কিন্তু মোহন ওর জেদে অনড়—আমাদের সঙ্গে জোট বেঁধে ‘দাওয়াই টাউন’-এর একটা এসপার-ওসপার ব্যবস্থা ও করবেই৷ এতে আমার মনে হয়েছে, গালের ওই কাটা দাগটার বদলা নেওয়ার এই সুযোগ ও ছাড়বে না৷

মোহনের গায়ে রুলটানা বাদামি ফতুয়া আর একটা কালো রঙের হাফপ্যান্ট৷ প্যান্টের পকেটে রয়েছে টর্চ৷ হাতে ফুটচারেক লম্বা একটা লোহার রড৷ চোয়াল শক্ত, নজর সতর্ক৷

মহাবীর যাদব পরেছেন মালকোঁচা মেরে ধুতি, আর তার ওপরে হাফহাতা শার্ট৷ আমি পরেছি সাধারণ বুশ শার্ট আর প্যান্ট৷

আমরা দুজনও নিরস্ত্র নই৷ আমাদের দুজনেরই হাতে রয়েছে শক্তপোক্ত বাঁশের লাঠি৷ এ ছাড়া আমরাও টর্চ রেখেছি সঙ্গে৷ মোহনের কাহিনি শোনার পর আমার মনে হয়েছিল, বিল্ডিং-এর ভেতরের ওই অদ্ভুত অন্ধকারের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে আমরা চারজনই সঙ্গে টর্চ রাখব৷ এ-কথা আমি মিটিং-এর সময় বলেছিলাম৷ তাই চারটে মাঝারি মাপের টর্চ আমরা কিনেছি৷

আমাদের এই অভিযানের জন্যে এ পর্যন্ত যা-যা খরচ হয়েছে তার সবটাই মহাবীর যাদব সামলেছেন৷ তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, বদ্রীনাথ মিশ্রর কাছ থেকে যে টাকা তিনি পেয়েছেন এই কাজের সমস্ত খরচ তিনি সেই টাকা থেকেই চালাবেন৷ এই সিদ্ধান্ত আমরা সবাই মেনে নিয়েছি৷

পণ্ডিতজীর মন্ত্র পড়ে বিল্ডিং প্রদক্ষিণের কাজ শেষ হলে আমরা বিল্ডিং-এর দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম৷

আমি হাতঘড়ির দিকে তাকালাম: চারটে বেজে পাঁচ মিনিট৷

তারপর মুখ তুললাম আকাশের দিকে৷ মনে হল যেন, মেঘের স্তর একটু বেশি গাঢ় হয়েছে৷ ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না৷

পণ্ডিতজী বিল্ডিং-এর দরজায় কমণ্ডলু থেকে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেন৷ বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়লেন৷ হাতের ত্রিশূলটা প্রথমে নিজের কপালে ঠেকিয়ে তারপর একে-একে আমাদের তিনজনের কপালে ঠেকালেন৷ প্রত্যেকবার ঠেকানোর সঙ্গে-সঙ্গে চাপা গলায় বললেন, ‘জয় শিবশম্ভু! জয় ভূতনাথ!’

তারপর আমাদের বললেন, ‘অব অন্দর চলিয়ে৷ ডরনেকি কোই বাত নহি৷ ভোলেনাথজী খুদ হামারে সাথ হ্যায়৷ জয় বাবা ভোলেনাথ!’

আমরা চারজনে সাবধানে পা ফেলে অভিশপ্ত বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লাম৷ ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে মহাবীর যাদব ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন৷ তারপর জড়ানো গলায় দু’বার ডুকরে উঠলেন, ‘লছমি! লছমি!’

আমি মহাবীরজীর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ ওঁর কাঁধে হাত রেখে সামান্য চাপ দিয়ে আলতো করে বললাম, ‘মহাবীরজী, আপনে দর্দকো কাবুমে রাখিয়ে…৷’ টের পেলাম, মহাবীর যাদবের শরীর থরথর করে কাঁপছে৷

দাগি বিল্ডিংটার ভেতরে ঢোকামাত্রই যে ব্যাপারটা আমাদের প্রথম ধাক্কা মারল, সেটা হল অন্ধকার৷

যেদিকে তাকাই সেদিকেই চাপ-চাপ অন্ধকার৷ মোহনের কথা মিলে যাচ্ছে অক্ষরে-অক্ষরে৷

রামপ্রসাদ তেওয়ারি আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, ‘জয়-জয় শিবশম্ভু!’

আমি চমকে উঠলাম৷ মহাবীর আর মোহনও বোধহয় চমকে উঠেছিল—অন্ধকারে ঠিক ঠাহর হল না৷ তেওয়ারিজীর চিৎকারের প্রতিধ্বনি ঘুরতে লাগল বাড়ির আনাচে-কানাচে৷

রামপ্রসাদজীর চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে ঝটাপটির শব্দ শোনা গেল৷ তারপর ডানার পতপত শব্দ৷ যেন অনেকগুলো পাখি দিশেহারা হয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে৷ দরজা আর জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে কয়েকটা কালো-কালো পাখিকে উড়ে যেতেও দেখলাম৷

রামপ্রসাদজী বললেন, ‘সবাই টর্চ জ্বালুন৷ একতলার ঘরগুলোয় শান্তির জল ছিটিয়ে ত্রিশূল ঠেকিয়ে পবিত্র করতে হবে…৷’

আমরা চারজনেই প্রায় একসঙ্গে টর্চের আলো জ্বাললাম৷ তখনই মনে হল, কারা যেন আলোর বৃত্ত থেকে একলাফে ছিটকে সরে গেল গাঢ় অন্ধকারে৷

মেঝেতে টর্চের আলো ফেলে আমরা কোনওরকমে এগিয়ে চললাম৷ মেঝেতে পড়ে আছে অজস্র পোড়া কাগজ, পুড়ে যাওয়া পরদার অংশ, তুবড়ে যাওয়া লোহার বালতি, বাটি, গ্লাস আর লোহার পাইপ৷ সেসব ডিঙিয়ে খুব সাবধানে পা ফেলে আমরা প্রথম ঘরটায় ঢুকলাম৷

ঘরটা আগুনে পুড়েও যেন পোড়েনি৷ দেওয়ালগুলো ভাঙাচোরা, ফাটল ধরা৷ সব জায়গায় ভুসোকালির ছোপ৷ তার ওপরে ধুলোর স্তর পড়েছে, দেওয়ালের কোণে মাকড়সা জাল বুনেছে৷ আর ঘরের এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা চেয়ার-টেবিল৷

এক কোণে একটা আলমারি৷ তার পাশে দেওয়ালের ব্র্যাকেটে ঝুলছে কয়েকটা আধপোড়া পোশাক৷ তার নীচে মেঝেতে পড়ে আছে দুটো স্টেথোস্কোপ৷ তাদের রবারের পাইপ গলে গেছে৷

হঠাৎ পোড়া গন্ধের ঝাপটা নাকে এল৷

অবাক হয়ে গেলাম৷ এত বছর পরেও এই পোড়া গন্ধ!

মহাবীর যাদব বললেন, ‘তাজ্জব ব্যাপার!’

মোহন যাদব বলল, ‘মাস্টারজী, আমি কিন্তু পোড়া গন্ধ পাইনি৷’

আমরা সবাই নীচু গলায় কথা বলছিলাম৷

রামপ্রসাদজী ওঁর মন্ত্র পড়া থামাননি৷ ওঁর স্বর সাগরের ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করছিল৷ টর্চের বিক্ষিপ্ত আলোয় দেখলাম, ওঁর বাঁ-হাতে কমণ্ডলু এবং টর্চ৷ ডান হাতে ত্রিশূল৷ সেই অবস্থাতেই মন্ত্র পড়তে-পড়তে শান্তির জল ছিটিয়ে চলেছেন৷

আমাদের চারটে টর্চ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে আলোর আঁকিবুকি কাটছিল৷ সেই আলোর আভায় দেখলাম, মহাবীরজী মাঝে-মাঝেই শার্টের খুঁট দিয়ে চোখ মুছছেন৷

হঠাৎই কানে এল এক অদ্ভুত শব্দ৷ জোরে-জোরে কেউ যেন শ্বাস নিচ্ছে৷ অনেকটা সাপের ফোঁসফোঁস শব্দের মতো৷

ভয় পেয়ে এপাশ-ওপাশ টর্চ ঘোরাতেই আওয়াজের কারণটা বোঝা গেল৷

আলমারির পায়া ঘেঁষে লেপটে আছে একটা মোটাসোটা চন্দ্রবোড়া সাপ৷ তার মাথাটা সামান্য উঁচু হয়ে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে৷ চোখ জ্বলজ্বল করছে৷ ফোঁসফোঁস শব্দে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে- সঙ্গে কালো নকশার আলপনা আঁকা শরীরটা একবার ফুলে উঠছে, একবার চুপসে যাচ্ছে৷

মোহন লোহার রড মাথার ওপরে তুলে সাপটার দিকে দু-পা এগিয়ে গেল৷

‘মোহনজী, রুক যাইয়ে!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন রামপ্রসাদ তেওয়ারি৷

মোহন যাদব থমকে দাঁড়াল৷

‘এ শিবজীর চেলা৷ শিবজী আমাদের সঙ্গে আছে৷ কোনও ভয় নেই৷’ বলে রামপ্রসাদ সাপটার কাছাকাছি এগিয়ে গেলেন৷ কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে দিলেন সরীসৃপটার গায়ে৷ আর আশ্চর্য! সাপটাও সড়সড় করে দেওয়ালের একটা বড় ফাটলে ঢুকে পড়ল৷

আবার সব চুপচাপ৷ শুধু আমাদের শ্বাস নেওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ তারই মধ্যে দূর থেকে ভেসে এল অনেকগুলো টিয়াপাখির ডাক—খোলা আকাশে টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে৷

টর্চের আলোয় অন্ধকার ঠেলে-ঠেলে সরিয়ে আমরা আর-একটা ঘরে ঢুকলাম৷ সেই ঘরেরও আধপোড়া ছন্নছাড়া দশা৷ আর তীব্র পোড়া গন্ধটা আমাদের নাকে লেগেই রইল৷

পণ্ডিতজী যখন শান্তির জল ছেটাচ্ছেন তখন হঠাৎই আমি একটা হালকা শব্দ পেলাম৷ শ্বাস-প্রশ্বাসের ফোঁসফোঁস শব্দ৷ আবার৷

শব্দটা যে বাকি তিনজনেও পেয়েছে সেটা বোঝা গেল ওদের টর্চের আলোর ঘোরাঘুরি দেখে৷ ওরা আবার কোনও সাপের খোঁজ করছে৷ আমিও আমার টর্চ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সাপের খোঁজ করতে লাগলাম৷

কিন্তু কোনও সাপই এবার আমরা খুঁজে পেলাম না৷ শুধু দুটো বড়-বড় মেঠো ইঁদুরকে ছুটে পালাতে দেখলাম৷

একটু পরে বুঝলাম, শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা আমাদের খুব কাছে হচ্ছে৷ বলতে গেলে শব্দটা প্রায় আমাদের ঘিরে রেখেছে৷

শুধু তাই নয়, শব্দটা মনে হচ্ছে অনেকের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ—একই ছন্দে, একই তালে শব্দটা ওঠা-নামা করছে৷ এবং সেই ছন্দ আর তাল মিলিয়ে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা আমাদের গায়ে এসে লাগছে৷

আমি ছাড়া বাকিদের গায়েও যে ওই কুবাতাস লাগছিল সেটা বোঝা গেল ওদের কথায়৷

মোহন খানিকটা বিহ্বল গলায় বলল, ‘মাস্টার সাব, একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগছে, টের পাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, টের পাচ্ছি—৷’

‘এটা কীসের বাতাস? কোথা থেকে আসছে?’ মহাবীর যাদব প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন৷

কী উত্তর দেব এসব প্রশ্নের! আমার মনে হচ্ছিল, অনেক অশরীরী যেন আমাদের খুব কাছে এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে৷ তারপর…৷

রামপ্রসাদ তেওয়ারি বোধহয় ভয় তাড়ানোর জন্যেই ‘জয় শিবশম্ভু!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন৷ তার প্রতিধ্বনি শোনা গেল কয়েকবার৷

ঠিক তখনই লোহার সঙ্গে লোহার সংঘর্ষের শব্দ পেলাম: ‘ঘটাং! ঘটাং!’

আমরা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেলাম৷ কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না৷

মোহন যাদব ভয়ের গলায় বলে উঠল, ‘মাস্টারসাব, কোই গড়বড়ি হো রহা হ্যায়৷ আমার তো কেমন লাগছে—৷’

আমি ওকে ভরসা দিয়ে বললাম, ‘ভয় পেয়ো না, মোহন—সব ঠিক আছে৷’

পোড়া গন্ধটা এমনভাবে আমাদের নাকে আসতে লাগল যে, মনে হল, আমাদের চারপাশে যেন আগুন লেগেছে—শুধু তাপ-উত্তাপের ব্যাপারটাই আমরা যা টের পাচ্ছি না৷

অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে-ফেলে একতলার আরও দুটো ঘরে মন্ত্র পড়ে শান্তির জল ছেটানো হল৷ তার মধ্যে একটা ঘর যথেষ্ট বড়, আর সেই ঘরে অনেকগুলো জং ধরা তোবড়ানো লোহার খাট দেখে মনে হল ঘরটা হসপিটালের কোনও ওয়ার্ড—মানে রুগিদের ঘর৷ সেই ঘরটায় কমণ্ডলুর জল ছেটানোর সময় একটা ডানাভাঙা গোলা পায়রা চোখে পড়ল৷ গায়ে টর্চের আলো পড়তেই পায়রাটা শরীর টেনে-টেনে একটা খাটের তলায় অন্ধকারে ঢুকে গেল৷

একটু এগোতেই দেখলাম, একটা দেওয়ালের কোণে অনেক পায়রার পালক ছড়িয়ে রয়েছে৷

মহাবীরজী ‘ইস-স’ বলে উঠলেন৷ তারপর চাপা গলায় আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘পমেশজী, দিনের বেলা এ-বাড়িটায় এত অন্ধকার কেন?’

আমি বললাম, ‘দাগি বিল্ডিং—তার মরজি সে-ই জানে৷’ একটু ঠাট্টা করার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু অন্ধকারের এই বিচিত্র ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল৷

‘ঘটাং! ঘটাং!’ শব্দটা আবার শুনতে পেলাম৷

‘কোথায় আওয়াজ হচ্ছে?’ মোহন যাদব৷

‘লিফটে আওয়াজ হচ্ছে নাকি?’ মহাবীর যাদব৷

‘চলুন—লিফটের কাছে গিয়ে দেখি…৷’ আমি৷

‘জয় শিবশম্ভু! চলিয়ে, লিফট কা পাস চলিয়ে৷ ইধর কা কাম হো গয়া—৷’ রামপ্রসাদ তেওয়ারি৷

আমরা সবাই লিফটের দিকে এগোলাম৷ মহাবীর যাদব টর্চের আলোয় পথ দেখাতে লাগলেন৷ বললেন, ‘আমার পেছন-পেছন আসুন…৷’

হোঁচট খেয়ে, ঠোকর খেয়ে আমরা আন্দাজে লিফটের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম৷ অবাক হয়ে দেখলাম, অন্ধকারের মধ্যে এক জায়গায় লাল আলো জ্বলছে৷ সেই আলো দিয়ে আঁকা রয়েছে একটা তিরচিহ্ন, আর একটা ইংরেজি সংখ্যা ‘চার’৷ তার মানে লিফটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা৷

টর্চের আলো সামনে ফেলতেই লিফটটা বেশ স্পষ্ট হল৷

লিফট তো নয়, এক প্রকাণ্ড লোহার খাঁচা৷ একটু আগের ‘ঘটাং! ঘটাং!’ শব্দ কি লিফটটা থেকেই হচ্ছিল? কিন্তু কী করে হবে? বিনা কারেন্টে লিফট নড়বে কেমন করে?

ঠিক তখনই মহাবীরজী অবাক হয়ে বললেন, ‘বিনা বিজলিতে এই লাল বাত্তি জ্বলছে কেমন করে?’

আমি ওঁকে ভরসা দেওয়ার জন্যে বললাম, ‘বোধহয় কোনওভাবে বিজলির কানেকশান থেকে গেছে—৷’

আমরা চারজনে বেশ বিমূঢ় অবস্থায় লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ওটার গায়ে টর্চের আলো বোলাতে লাগলাম৷ পোড়া গন্ধটা আমাদের নাকে আরও জোরালো হল৷ আমাদের ঘিরে থাকা শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ চলতে লাগল৷ ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা দিব্যি টের পাচ্ছিলাম৷ আমার গা শিরশির করছিল৷

টর্চের আলোয় লিফটটাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম৷

ইস্পাতের চাদর দিয়ে তৈরি প্রকাণ্ড মাপের একটা লোহার বাক্স৷ সেই চাদরে আবার নানান জোড়াতালি৷ কোথাও-কোথাও স্টিলের শিটের টুকরো নাট-বলটু দিয়ে অথবা ওয়েলডিং করে তাপ্পি মারা হয়েছে৷ ইস্পাতের চাদরের সারা গায়ে গুটি বসন্তের দাগের মতো ছোট-বড় চাকা-চাকা গর্ত—কোন এক অজানা কারণে টোল পড়ে গেছে৷ চাদরগুলো সব ঢেউ-খেলানো, উঁচু-নীচু৷ তার সারা গায়ে জং ধরা৷ সময় আর আগুন তার সব শক্তি, সব সৌন্দর্য শুষে নিয়েছে৷

লিফটের দরজা বলতে একটা ভাঙাচোরা তোবড়ানো জং ধরা কোলাপসিবল গেট৷ তার পাটিগুলোর বেশিরভাগই ক্ষয়ে-ক্ষয়ে খসে পড়ে গেছে৷

‘বাজ পড়ে আগুন লেগে গিয়েছিল বলে লিফটটার এই বুরা হাল৷ তারপর ত্রিশ-বত্রিশ সাল পেরিয়ে গেল…৷’ মহাবীরজী বললেন, ‘হসপিটালের সাতাশটা বাচ্চা এই লিফটের মধ্যেই খতম হয়ে গিয়েছিল৷ আমার বহিন…৷’ বলে ডুকরে উঠলেন মহাবীরজী৷ তারপর ‘লছমি! লছমি!’ বলে কাঁপা গলায় ডেকে উঠে কাঁদতে শুরু করলেন৷

‘রোনা-ধোনা বনধ৷’ ধমকে উঠলেন রামপ্রসাদ তেওয়ারি৷ তারপর: ‘জয় হো শিবশম্ভু!’ বলে হেঁকে উঠলেন৷ কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে দিলেন লিফটের গায়ে৷

গরম কড়াইয়ে জল ছিটিয়ে দিলে যেমন ‘ছ্যাঁক’ করে শব্দ ওঠে ঠিক সেরকম শব্দ শোনা গেল৷

আমি অবাক হয়ে লিফটের গায়ে টর্চের আলো ফেললাম৷ তিনটে টর্চের আলো লিফটের গায়ে ঘোরাঘুরি করছিল, তার সঙ্গে আমার চার নম্বর আলোটা যুক্ত হল৷ কিন্তু লিফটের গা থেকে বাষ্পের ধোঁয়া বেরোল কি না সেটা ঠিক ঠাহর হল না৷

মোহন ভয় পেয়ে গেল৷ বলল, ‘এসব কী হচ্ছে! ক্যায়সে হো রহা হ্যায়? কিঁউ হো রহা হ্যায়?’

আমি মোহনকে বকুনি দিলাম: ‘মোহন, তুমি কেন ভয় পাচ্ছ? আমাদের হাতে তো লাঠি আছে!’

মোহন চুপ করে গেল—যদিও ওর ভয় কমল কি না বোঝা গেল না৷

ঠিক তখনই ঠান্ডা বাতাসের শ্বাস-প্রশ্বাস আরও জোরালো হল৷ পোড়া গন্ধটা এত মারাত্মক বেড়ে গেল যে, মনে হল, আমরা শ্মশানে জ্বলন্ত চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ কিন্তু গায়ে কোনও আঁচ টের পাচ্ছি না৷

রামপ্রসাদজী বললেন, ‘চলুন, চলুন—ওপরে চলুন৷ বাকি ঘরগুলোয় কাজ শেষ করতে হবে—’ তারপর মহাবীর যাদবকে বললেন, ‘সিঁড়ি কোনদিকে?’

মহাবীর যাদব টর্চের আলো ফেলে সিঁড়ির দিকে এগোলেন৷ ওঁর পেছন-পেছন আমরা৷

সিঁড়িগুলোর অবস্থা শোচনীয়৷ রেলিং কোথাও আছে, কোথাও নেই৷ যেখানে রেলিং আছে সেখানেও জায়গায় জায়গায় জং ধরে খসে পড়ে গেছে৷ আর সর্বত্র ধুলো, ধুলো আর ধুলো৷ সিঁড়ির ধাপের বহু জায়গায় সিমেন্ট ভেঙে পড়েছে৷ কোথাও-কোথাও বড়সড় ফাটল৷ সিঁড়িতে পুরু ধুলো তো আছেই, তার সঙ্গে পড়ে আছে শুকনো গাছের পাতা, আধখাওয়া ইঁদুরের দেহ, পাখির পালক৷ পোড়া গন্ধটার সঙ্গে এখন কেমন একটা বোঁটকা দুর্গন্ধ মিশে গেছে৷

সিঁড়ি দিয়ে যখন আমরা উঠছি তখন হঠাৎই মেঘের ডাক শুনতে পেলাম৷ একইসঙ্গে শুনতে পেলাম লোহার ‘ঘট-ঘটাং’ শব্দ—বেশ কয়েকবার৷ মনে হল, কেউ যেন শব্দ করে নিজেকে জানান দিচ্ছে৷

মোহন বলল, ‘মাস্টারসাব, ইয়ে কেইসন আওয়াজ বা?’

‘ওসব আওয়াজে কান দিয়ো না৷ সাবধানে ওপরে ওঠো—৷’

মোহনকে সামাল দিলাম বটে, কিন্তু লোহায়-লোহায় সংঘর্ষের এই শব্দটা আমার মনে খচখচ করতে লাগল৷

দোতলায় উঠে আমরা একইভাবে টর্চের আলো ফেলে ঘর থেকে ঘরে ঘুরে বেড়ালাম৷ রামপ্রসাদ তেওয়ারি নির্ভয়ে শান্তি-স্বস্ত্যয়নের কাজ করতে লাগলেন৷ সেই সময়ে আমরা পরপর কয়েকবার মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম৷ একটু আগেও জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে তাকিয়ে যে আলোর জ্যামিতিক টুকরোগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম এখন সেসব উধাও৷ তা হলে বাইরের আকাশ কি মেঘে কালো হয়ে গেছে?

ঘরগুলোর কাজ সেরে আমরা কী মনে করে লিফটের দিকে এগোলাম৷ তা ছাড়া মহাবীর যাদব বারবার বলছিলেন, লিফটে ওঠার কোলাপসিবল দরজাগুলোও শোধন করা দরকার৷ তাই পায়ে-পায়ে আমরা পৌঁছে গেলাম লিফটের দরজার কাছে৷

কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার!

লিফটটা এসে দোতলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে! এবং দরজার পাশের প্যানেলে যে-লাল আলো জ্বলছে সেখানে ছবি সেই একই: তিরচিহ্ন এবং ‘চার’৷

মোহন আমার বাহু খামচে ধরল৷ আমি অন্ধকারে ওর হাতের ওপরে হাত রাখলামঃ ‘ভয় পেয়ো না৷ আমাদের কাজ শেষ হয়ে আসছে৷ আর বড়জোর আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট৷ তা ছাড়া আমরা তো তোমার সঙ্গে আছি, মোহন৷’

মোহন আমার হাতটা ছেড়ে দিল৷ আমার কথায় কতটুকু ভরসা পেল কে জানে!

আমি লিফটটার কথা ভাবছিলাম৷ ওটা চুপিচুপি দোতলায় উঠে এল কেমন করে! মান্ধাতার আমলের এইরকম বেঢপ চেহারার সার্ভিস লিফট ওঠা-নামা করলে অল্পবিস্তর শব্দ হওয়ার কথা৷ কিন্তু কোনওরকম শব্দ তো আমরা শুনিনি! শুধু ওই ‘ঘট-ঘটাং’ শব্দগুলো ছাড়া৷ কোনও লিফট ওঠা-নামা করলে এরকম যে শব্দ হয় সেটা আমার জানা ছিল না৷

দোতলার কাজ সেরে তিনতলা৷ তিনতলার পর চারতলা৷ এবং চারতলার পর পাঁচতলা৷ পাঁচতলা তো নয়, ‘মরণতলা’৷

এর মধ্যেই মেঘের গর্জন বাড়ছিল—বেশ ঘন-ঘন শোনা যাচ্ছিল৷ আর জানলার খোলা অংশ দিয়ে বাইরে তাকালে গাঢ় অন্ধকার৷ বিল্ডিং-এর ভেতরের চাপ-চাপ অন্ধকারের সঙ্গে সেই অন্ধকার যেন হাত মিলিয়ে নিয়েছে৷

পাঁচতলায় এসেই মহাবীর যাদব ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিলেন৷ শত সান্ত্বনাতেও সে-কান্না আর থামতে চায় না৷ কান্নার মাঝে-মাঝেই তিনি ‘লছমি! লছমি!’ বলে ডেকে উঠছিলেন৷

বাইরে যে বৃষ্টি নেমে গেছে সেটা বোঝা গেল বৃষ্টির শব্দে আর গন্ধে৷ আর এই পাঁচতলায় এসে পৌঁছানো মাত্র পোড়া গন্ধটা পাগলের মতো আমাদের জড়িয়ে ধরল৷

প্রথমেই দুটো ছোট-ছোট ঘর৷ ঘর না বলে ঘরের ধ্বংসাবশেষ বলাই ভালো৷ প্রথম ঘরটায় দুটো টেবিল, চারটে চেয়ার, একটা আলমারি, আর একটা র‌্যাক৷ সবগুলোই পোড়া এবং ভাঙাচোরা৷ ধুলোময় নোংরা মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছে৷ মাথার ওপরে একটা সিলিং ফ্যান—পুড়ে কালো হয়ে গেছে৷ তার ব্লেড তিনটে সাপের মতো এঁকেবেঁকে নীচের দিকে ঝুলছে৷

ঘরটা দেখে মনে হয়, এককালে ডাক্তার-নার্সরা এই ঘরে বসত৷

তার পাশের ঘরটা বোধহয় ওষুধপত্রের স্টোর রুম ছিল৷ কারণ, ঘরে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা তিনটে র‌্যাক৷ র‌্যাকে অনেক শিশি-বোতল আর প্যাকেট৷ কিন্তু তার বেশিরভাগই ভাঙাচোরা, পুড়ে কালো হয়ে গেছে৷ ঘরের সিলিং ফ্যানটারও অষ্টাবক্র দশা৷

ঘরটার মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ধুলোমাখা কাচের টুকরো আর নানান জিনিসপত্র৷ এক অদ্ভুত ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরের বাতাসে৷

দুটো ঘরেই মন্ত্রপূত শান্তির জল ছিটিয়ে দিলেন রামপ্রসাদজী৷ দ্বিতীয় ঘরটায় এসে আমাদের বললেন, ‘আপনারা সবাই শিবজীর নাম নিন৷ ইয়ে ভুলিয়েগা মত কে ভূত-পিরেত যো ভি হ্যায় সব শিবশম্ভুকা গুলাম হ্যায়৷ জয়-জয় শিবশম্ভু!’

রামপ্রসাদজীর জিগির শেষ হওয়ামাত্রই আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানটা ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ শব্দে ঘুরতে শুরু করে দিল৷

চমকে ওপরে তাকিয়ে দেখি, আঁকাবাঁকা পোড়া ব্লেডগুলো ঘোরার চেষ্টায় থরথর করে কাঁপছে৷

রামপ্রসাদজী ফ্যানটা লক্ষ্য করে শান্তির জল ছুড়ে দিলেন৷ কিন্তু ভয় পাওয়া মোহন যাদব একটা গালাগাল দিয়ে জ্যান্ত হয়ে ওঠা ফ্যানটার গায়ে মরিয়া শক্তিতে লোহার রডের এক ঘা বসিয়ে দিল৷ আমরা কেউ মোহনকে বাধা দেওয়ার কোনও সময়ই পেলাম না৷

যেটা আমাদের সবচেয়ে বেশি অবাক করল সেটা হল, রডের আঘাতের সঙ্গে-সঙ্গে যন্ত্রণার একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল৷ ঠিক কোথা থেকে সে-আর্তনাদ ভেসে এল সেটা আমরা কেউই ঠাহর করতে পারলাম না৷

রামপ্রসাদ তেওয়ারি আর মহাবীর যাদব প্রায় একইসঙ্গে মোহনকে ধমক দিলেন৷ মোহন মিনমিন করে বলল যে, ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷

ভয় কি আমরাও পাইনি? আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে৷

এরপর যে শব্দটা শুনতে পেলাম সেটা আরও রহস্যময়: ঘর থেকে কয়েকজন যেন ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল৷

আমরা টর্চের আলো এদিক-ওদিক ঘুরিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না৷ তখন নিজেদের মধ্যে এলোমেলো কথা বলতে লাগলাম৷ মোহন বলল, ‘চলুন, তাড়াতাড়ি কাজ সেরে আমরা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যাই—৷’

মহাবীরজী ওকে একটু ধমকের গলায় বললেন, ‘একা-একা যখন এই ভূতিয়াঘরে ঢুকেছিলে তখন ভয় পাওনি!’

‘আমি তো শুধু একতলায় ঢুকেছিলাম৷ আর এখন তো প্রত্যেকটা ঘরে ঢুকে-ঢুকে সবাইকে ডিসটার্ব করছি—৷’

‘সবাইকে মানে?’

‘সব আতমাদের৷ তার মধ্যে…তার মধ্যে আপকা বহিন ভি হ্যায়…৷’

মহাবীর যাদব কেঁদে ফেললেন এ-কথায়৷ বললেন, ‘আমি আমার বহিনের আতমার মুক্তি চাই…শান্তি চাই…৷’

আমি ওদের চুপ করতে বললাম৷ ওরা চুপ করে গেল৷ রামপ্রসাদজী সর্বক্ষণ বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে চলেছেন৷ তারই মধ্যে লোহার সঙ্গে লোহার সংঘর্ষের শব্দ শোনা যাচ্ছিল বারবার: ‘ঘট-ঘটাং, ঘট-ঘটাং…৷’

আমরা এবার আর-একটা ঘরে ঢুকলাম৷ ঢুকেই বুঝলাম সেটা পেশেন্টদের ওয়ার্ড৷ কারণ, এই প্রথম ফিনাইলের গন্ধ আমাদের নাকে ঝাপটা মারল৷ পোড়া গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়ে সেই গন্ধটা এমন দাঁড়াল যে, সেটাকে ঠিকঠাকভাবে বোঝানো বেশ কঠিন৷

টর্চের আলো ফেলে বুঝলাম ঘরটা মাপে অনেক বড়৷ দু’পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোহার খাট৷ তার বেশ কয়েকটা ভাঙা, বেঁকেচুরে গেছে৷ খাটের ওপরে গদিগুলো সব আধখাওয়া, ছেঁড়াখোঁড়া৷

টর্চের আলোয় কয়েকটা বড়সড় ইঁদুরকে ছুটে পালাতে দেখলাম৷

মহাবীরজী এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না—বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে শুরু করলেন৷

বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে৷ তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, মেঘের ‘গুড়-গুড়-গুড়-গুড়ুম’ আর বিদ্যুতের চমক৷ হঠাৎ করে আবহাওয়া এতটা খারাপের দিকে গেল কেমন করে?

কয়েকটা জানলার পাল্লা হয় ছিল না, অথবা খুলে গিয়েছিল৷ প্রবল বাতাসে জলের মিহি গুঁড়ো অন্ধকার ঘরের ভেতরে পাক খেতে লাগল৷ তারই মধ্যে বরফের মতো ঠান্ডা বাতাস আমাদের শরীরে নিয়মিত ছন্দে পড়তে লাগল৷

রামপ্রসাদজী চেঁচিয়ে বললেন, ‘হমে কুছ গড়বড় লগতা হ্যায়৷ ইয়ে ফ্লোর কা কাম জলদি-জলদি খতম করনা জরুরি হ্যায়—৷’ বলেই আর দেরি করলেন না, শান্তির জল ছেটাতে-ছেটাতে প্রায় দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিলেন৷

মোহন যাদব ভয় পেয়ে আমার হাত চেপে ধরল: ‘মাস্টারসাব, ফিরে চলুন৷ পণ্ডিতজী ঠিক বলেছেন৷ এই ফ্লোরে কিছু তো গড়বড় আছে! দেখছেন না, অচানক বৃষ্টি কীরকম জমিয়ে এল৷ তার সঙ্গে কীরকম মেঘ ডাকছে, বাজ পড়ছে!’

ওর কথা শেষ হতে না হতেই ‘কড়কড় কড়াৎ’ শব্দে বাজ পড়ল৷ আমরা তিনজনেই কেঁপে উঠলাম৷ তীব্র সাদা আলোয় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ রামপ্রসাদজী তখন আমাদের তিনজনের কাছ থেকে অনেকটা দূরে—দিশেহারাভাবে কমণ্ডলু আর টর্চ নিয়ে ঘরের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন৷

মহাবীর যাদব হঠাৎই একটা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া লোহার খাটের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন৷ ওঁর হাত থেকে লাঠি আর টর্চ খসে পড়ল৷ তারপর খাটে মাথা ঠুকতে লাগলেন আর ভাঙা গলায় কাঁদতে লাগলেন৷

‘লছমি! লছমি! এই বেডেই লছমি ছিল৷ ইসি বেডমেই উও থি, পমেশজী, ইসি বেডমে…৷’

আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷

হঠাৎই আমাদের টর্চের আলোয় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ধরা পড়ল৷

কালো কুয়াশার পিণ্ডের মতো কতকগুলো গাঢ় ছায়া ঘরের মধ্যে নড়ে বেড়াচ্ছে৷ কখনও ওরা এদিকে-ওদিকে ছুটে যাচ্ছে, কখনও লাফিয়ে উঠে পড়ছে লোহার খাটগুলোর ওপরে৷ কখনও বা একটা ছায়ার পিণ্ড আর-একটা পিণ্ডের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে৷

দুটো ছায়ার পিণ্ড আমার আর মোহনের কাছে এগিয়ে এসেছিল৷ মোহন ভয় পেয়ে ওগুলোর ওপরে লোহার রড চালিয়ে দিল৷ রড নেহাতই বাতাস কেটে একটা খাটে গিয়ে লাগল৷ আর মোহন ভয়ে চিৎকার করে উঠল৷

পরিস্থিতি আমারও ভালো ঠেকছিল না৷ তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যেতে পারলে হয়৷ বাইরের দুর্যোগের সঙ্গে হয়তো মোকাবিলা করা যায়, কিন্তু ভেতরের এই দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করব কেমন করে?

কী মনে হওয়ায় রামপ্রসাদ তেওয়ারির দিকে টর্চের আলো ফেললাম৷ এবং যা দেখলাম তাতে আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল৷ বরফজলের স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে৷

পাশবালিশের মতো কতকগুলো জমাট কুয়াশার পিণ্ড রামপ্রসাদজীর শরীরের সঙ্গে যেন লেপটে আছে৷ ওগুলো বোধহয় রামপ্রসাজীকে এলোমেলোভাবে ঠেলা মারছিল, কারণ, পণ্ডিতজীর শরীরটা টলে যাচ্ছিল বারবার৷ কিন্তু ওঁর সাহস সত্যিই প্রশংসা করার মতো৷ কারণ, ওই কুয়াশা-পিণ্ডগুলোর ধাক্কা সামলে পণ্ডিতজী ওগুলোর ওপরে কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে চলেছেন, শিবশম্ভুর নাম নিয়ে চলেছেন অবিরাম৷

আবার ভয়ংকর শব্দে বাজ পড়ল৷

সাদা আলো আর শব্দের পাশাপাশি আরও একটা বিপর্যয় ঘটে গেল৷ পাঁচতলার একটা অংশ ভেঙে পড়ল৷

টর্চের আলোয় একটু আগেই যেখানে দেওয়াল দেখতে পাচ্ছিলাম সেখানে এখন শূন্যতা আর ঝোড়ো বৃষ্টি৷ বৃষ্টির ঝাপট সাইক্লোনের মতো পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল ঘরের মধ্যে৷ ঠিক সেই সময়ে ‘ঘটাং! ঘটাং!’ শব্দ কানে এল৷ সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক সংকটের কাল৷

হঠাৎই আমার মনে হল, আর এক মুহূর্ত যদি এখানে অপেক্ষা করি তা হলে আমাদের সর্বনাশ হবে৷

মোহন যাদব আমার হাত জাপটে ধরল৷ ও ধুম জ্বরের রুগির মতো থরথর করে কাঁপছে৷

আমি চিৎকার করে মহাবীর যাদবকে ডাকলাম, ‘মহাবীরজী, জলদি আসুন—এবার পালাতে হবে—!’

মোহন ‘রামপরসাদজী! পণ্ডিতজী!’ বলে ডাকতে লাগল আতঙ্কে৷

মহাবীর যাদবও নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছিলেন, কারণ, আমার ডাকের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তিনি ছুট লাগালেন সিঁড়ির দিকে৷

আমি আর মোহনও দেরি করলাম না—ছুট লাগালাম ওঁর পেছন-পেছন৷ সেই অবস্থাতেই টের পেলাম, রামপ্রসাদ তেওয়ারিও আমাদের পেছনে ছুটে আসছেন৷

পোড়া গন্ধটা এখনও নাকে টের পাচ্ছিলাম, কিন্তু ঠান্ডা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাপারটা ঝড় আর বৃষ্টি চাপা দিয়ে দিয়েছে৷

ছুটে আমরা চারজনে যখন সিঁড়ির কাছে এসে পৌঁছলাম তখন আসল সর্বনাশটা দেখতে পেলাম৷ বাজ পড়ার দাপটে জরাজীর্ণ সিঁড়িটার পাঁচতলার প্রায় পুরো অংশটাই ধসে পড়েছে নীচে৷

আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ মহাবীর যাদবের টর্চ আর লাঠি কোথায় ছিটকে পড়ে গেছে কে জানে! তখনও মানুষটা কাঁদছে আর ওর বোনের নাম বিড়বিড় করছে৷

ভয়ংকর শব্দে বাজ পড়ল আবার৷

তখনই আমার চোখ গেল বেঢপ লিফটটার দিকে৷

ওটার দরজা খোলা৷ দরজার পাশে লাল আলোয় লেখা তিরচিহ্ন জ্বলছে৷ জ্বলছে ‘চার’ লেখাটাও৷ কিন্তু লিফটটা পাঁচতলায় কখন এল? কেমন করে এল?

লিফটের খোলা দরজাটা দেখে আমার মনে হল, ওটাই পালানোর একমাত্র পথ৷

‘ঘট-ঘটাং৷ ঘট-ঘটাং!’ শব্দ ভেসে এল ইস্পাতের বাক্সটার দিক থেকে৷ ওটা যেন আমাদের ডাকছে৷

নিশির ডাকের মতো একটা মায়া আমাকে জড়িয়ে ধরল৷ আমি ছুটলাম লিফটের দিকে৷ আমার পেছন-পেছন বাকি তিনজন৷

আমরা চারজন ঢুকে পড়তেই নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল লিফটের ভাঙা দরজা৷ এবং লিফটটা নিজে থেকেই চলতে শুরু করল৷

মোহন যাদব কাঁপা গলায় বলল, ‘ইয়ে সব কেয়া হো রহা হ্যায়? এই শয়তান লিফটটাকে কে চালাচ্ছে?’

আমি কোনও জবাব দিলাম না৷ টর্চের আলোয় লিফটটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম৷ এককথায় বলতে গেলে জং ধরা জরাজীর্ণ একটা লোহার বাক্স৷ চলার সময় ওটা থরথর করে কাঁপছে৷ ‘ঘট-ঘট-ঘটাং’ শব্দ হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে, এই বুঝি ইস্পাতের চাদরের জোড়াতালিগুলো খসে পড়বে—কিন্তু খসে পড়ছে না৷

লিফটটা কোন তলায় যাচ্ছে জানি না, তবে যাচ্ছে যে নীচের দিকেই সেটা টের পাচ্ছি৷

নানান ফ্লোরে যাওয়ার জন্যে লিফটের ভেতরে একটা বড়সড় পেতলের হাতল রয়েছে, কিন্তু ইন্ডিকেটর ল্যাম্পের কোনও প্যানেল নেই৷

লিফটটা মাপে প্রকাণ্ড৷ অন্তত পঁচিশ-তিরিশজন তার ভেতরে অনায়াসে এঁটে যাবে৷ আমরা চারজন জড়সড়ো হয়ে লিফটের মাঝখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম৷ এখন শুধু একটাই চিন্তা: কোনওরকমে এই বিল্ডিং-এর বাইরে বেরোতে পারলে হয়!

হঠাৎই আমরা চারজন কেমন যেন পিছিয়ে যেতে লাগলাম৷

‘কী হচ্ছে? কী হচ্ছে?’ বলতে-বলতে টের পেলাম সামনে থেকে চাপ আসছে—যেন আরও অনেক লোকজন গাদাগাদি করে উঠে পড়েছে লিফটে৷ আমি এপাশ-ওপাশ টর্চের আলো ফেললাম৷ এবং ভয়ে চমকে উঠলাম৷

তাল-তাল কুয়াশার পিণ্ড লিফটের মধ্যে হাজির হয়েছে৷ ওদের চাপে আমরা কোণঠাসা হয়ে গেছি৷

ওরা কারা? ওদের স্পর্শই বা কেন এত ঠান্ডা লাগছে শরীরে?

স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমি ভালোরকম ভয় পেয়েছিলাম৷ কিন্তু মোহন যাদবের মতো একজন শক্তসমর্থ যুবক আমার চেয়ে ভয় পেয়েছে অনেক বেশি৷ ও ভয়ে চোখ বুজে আমার ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে রয়েছে৷ ওর মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে৷

মহাবীরজীর দিকে টর্চের আলো ফেলে দেখি তিনি যেন দাঁড়িয়ে থাকা এক কাঠের পুতুল৷

রামপ্রসাদ তেওয়ারি তেমন একটা ভয় পেয়েছেন বলে মনে হল না৷ ওঁর ঠোঁটে সেই একই মন্ত্র—যে-মন্ত্রের ওপরে ওঁর ভরসা আছে, বিশ্বাসও আছে৷

এমন একটা সময়ে ‘কড়কড় কড়াৎ’ শব্দে ভয়ংকর এক বাজ পড়ল খুব কাছে৷ বাজের সাদা আলোর ঝলকানিতে কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধ হয়ে গেলাম৷ বাজের দুশো ডেসিবেল লেভেলের আওয়াজ আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দিল৷

কোথায় যেন আগুন ধরে গেল৷ খুব তীব্র পোড়া গন্ধ আসছে নাকে৷ কিছু পুড়ে যাওয়ার ‘চড়চড়’ শব্দ হচ্ছে কোথাও৷

হঠাৎই টের পেলাম লিফটের দেওয়ালটা উনুনে বসানো হট প্লেটের মতো গরম হয়ে উঠেছে৷ পিঠে যেন ছ্যাঁকা লাগছে৷

লিফটটা একতলায় নেমে গিয়েছিল৷ কিন্তু সেখানে না থেমে বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে আবার দুরন্ত গতিতে উঠতে শুরু করে দিল ওপরে৷ আমরা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করলাম৷

সে একটা সাংঘাতিক অবস্থা!

লিফটটা অসহ্য ঝাঁকুনি দিয়ে ওপরে উঠছে৷ কানফাটানো শব্দ হচ্ছে ‘ঘট-ঘট-ঘটাং’৷ সঙ্গে আমাদের ভয়ের চিৎকার৷

তার সঙ্গে হঠাৎই জড়িয়ে গেল চাপা কান্নার শব্দ৷ মিহি গলার আওয়াজে অনেকে মিলে কাঁদছে৷ আর্ত কলরোল ভেসে বেড়াচ্ছে লিফটের বদ্ধ বাতাসে৷

আমরা চিৎকার থামিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম৷ কারা কাঁদছে? কোথায় কাঁদছে?

মহাবীর যাদব আচমকা ‘লছমি! লছমি!’ বলে হাহাকার করে উঠলেন৷

কান্নার রোল ক্রমে জোরালো হতে লাগল৷ আমাদের ঘিরে সেই আর্ত শব্দতরঙ্গ লিফটের ভেতরে ঘুরপাক খেতে লাগল৷

প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আদিম লোহার খাঁচাটা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল৷ এবং পরক্ষণেই মাতালের মতো টলতে-টলতে প্রবল গতিতে নীচের দিকে ছুটে চলল৷

আমি চিৎকার করে বললাম, ‘লিফটটা একতলায় গেলেই আমাদের দরজা খুলে বাইরে লাফ মারতে হবে৷ যেমন করে হোক৷ তা না হলে আমাদের অবস্থা হবে ওই সাতাশটা বাচ্চার মতো…!’

‘সহি কহা হ্যায় মাস্টারজীনে৷ আপ সব রেডি হো যাইয়ে—৷’ রামপ্রসাদ তিওয়ারি বললেন৷

রেলগাড়ি শান্টিং-এর সময় যেরকম শব্দ হয় ঠিক সেরকম শব্দ তুলে লিফটটা একতলায় এসে বলতে গেলে আছড়ে পড়ল৷

আমরা চারজন একসঙ্গে কোলাপসিবল গেট ধরে টান মারলাম৷ গেট খুলল না৷ আবার টান মারলাম৷

লিফটের আঁচে শরীর ঝলসে যাচ্ছে৷ দরদর করে ঘামছি৷ আর কিছুক্ষণ এই অভিশপ্ত খাঁচায় বন্দি থাকলে আমরা সবাই পুড়ে শেষ হয়ে যাব৷ প্রাণপণ শক্তিতে ভাঙা কোলাপসিবল গেটটা ধরে আরও একবার টান মারলাম৷

তৃতীয়বারের চেষ্টায় গেটটা খুলে গেল৷

আমরা দরজা ডিঙিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ামাত্রই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷

আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ কানে তালা লেগে গেল৷ পেছনে তাকিয়ে দেখি লিফটটায় আগুন ধরে গেছে৷ ওটার দেওয়ালে তালি মারা ইস্পাতের পাতগুলো খসে-খসে পড়ছে৷

আমরা টর্চের আলোয় সদর দরজাটা দেখতে পেলাম৷ তা ছাড়া আগুনের আভাও আমাদের বাড়তি সাহায্য করল৷ একটুও দেরি না করে আমরা সদর দরজা লক্ষ্য করে ছুট লাগালাম৷

কিন্তু হঠাৎই দেখি দু-তিনটে লোহার পাত আমাদের পেছন-পেছন শূন্যে বাতাস কেটে ধেয়ে আসছে৷ শিকারি বাজ যেভাবে তিরবেগে ধেয়ে আসে৷

প্রাণ বাঁচাতে আরও জোরে ছুটতে শুরু করলাম৷ কিন্তু একটা উড়ন্ত ‘বাজপাখি’ মোহন যাদবকে ধরে ফেলল৷ সরাসরি ওর ঘাড়ে এসে আঘাত করল৷ একেবারে তরোয়ালের কোপের মতো৷

মোহনের দেহটা মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে৷

একপলকের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷

মোহনের মাথাটা কোনওরকমে দেহের সঙ্গে আটকে আছে৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফাটল ধরা ধূলিমলিন মেঝে৷ ওর চোখ দুটো মরা মাছের মতো চেয়ে আছে সিলিং-এর দিকে৷

কী মর্মান্তিক মৃত্যু!

প্রথমবারে মোহন যাদব বেঁচে গিয়েছিল৷ গাল আর গলায় কোপ লাগলেও সেরে উঠেছিল৷ সেদিন ও গাঢ় অন্ধকারে বুঝতে পারেনি কে বা কী ওকে আক্রমণ করেছে৷

ছোকরু আর মুন্নার রহস্যময় মৃত্যুর কারণও এবার বুঝতে পেরেছি আমি৷

লিফট! ওই অভিশপ্ত লিফট!

রামপ্রসাদজী আর মহাবীর যাদব দরজা পেরিয়ে বাইরে চলে গেছেন৷ কয়েক মুহূর্ত দেরি করায় আমি একটু পিছিয়ে রয়েছি৷ কিন্তু ছুটে চলেছি আবার৷ সেই অবস্থাতেই পেছনে তাকিয়ে দেখি, ছোট মাপের দুটো উড়ন্ত পাত ছুটে আসছে আমাকে লক্ষ্য করে৷ তাপে পাতদুটো লালচে হয়ে গেছে৷

ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম৷ পলকের মধ্যে বাইরের মাঠে চলে এলাম৷ কিন্তু আঘাত এড়াতে পারলাম না৷ একটা পাত চাপড়ের মতো এসে লাগল আমার পিঠে৷ আর দ্বিতীয়টা নিনজা স্টারের মতো আমার বাঁ-হাতের বাহুকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল৷

পড়ে যেতে-যেতে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিলাম৷ রক্তপাত, যন্ত্রণা সব ভুলে গিয়ে ছুটে চললাম৷ দেখলাম, আরও কিছুটা দূরে দুটো কালো ছায়া দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে৷ তাদের একজনের হাতে ত্রিশূল আর কমণ্ডলু৷

আকাশ অন্ধকার৷ ঘোর কালো মেঘ জমাট বেঁধে আছে আকাশ জুড়ে৷ বৃষ্টি পড়ছে, তবে তেমন জোরে নয়৷ বৃষ্টিতে মাঠটা কাদা-কাদা হয়ে গেছে৷

টের পেলাম, অভিশপ্ত বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসার পর আমার দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেছে৷

টলতে-টলতে হাঁপাতে-হাঁপাতে আরও কিছুটা ছুটে চলার পর পণ্ডিতজী আর মহাবীর যাদবের কাছে পৌঁছলাম৷ দেখলাম, ওঁরা দুজনেও হাঁপাচ্ছেন৷

আমরা কেউ কোনও কথা বলছিলাম না৷ বৃষ্টিতে ভিজছিলাম আর তাকিয়ে ছিলাম ছায়া রঙের ভাঙাচোরা বাড়িটার দিকে৷ ওটার দরজা দিয়ে আগুনের আভা চোখে পড়ছিল৷

আমি বাঁ-হাতের কাটা জায়গাটায় হাত চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম৷ জায়গাটা ভীষণ জ্বালা করছিল৷ আর পিঠটা যেন পুড়ে যাচ্ছিল৷

হঠাৎই একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমার চোখে পড়ল৷

‘ঘট-ঘট-ঘটাং’ করে প্রচণ্ড এক শব্দ ভেসে এল বাড়িটা থেকে৷ তারপরই আগুনের আভাটা আগুনের শিখা হয়ে গেল৷ জ্বলন্ত লিফটটা কীভাবে যেন চলে এসেছে সদর দরজার কাছে৷ তারপর…৷

তারপর যা হল, সেটা এত বছর পরেও বিশ্বাস হতে চায় না৷

পুরোনো বাড়ির দরজা ভেঙে জ্বলন্ত লিফটটা টলতে-টলতে বেরিয়ে এল দরজার বাইরে৷ লিফটের প্রবল ধাক্কায় ফ্রেমসমেত দরজাটা তো ভেঙে পড়লই, তার লাগোয়া দেওয়াল থেকে একগাদা ইট খসে গিয়ে এক প্রকাণ্ড হাঁ তৈরি হয়ে গেল৷

তারপর সেই ভয়ংকর লিফটটা আমাদের লক্ষ্য করে ছুটে আসতে লাগল৷

জলকাদা ভরা মাঠের ওপর দিয়ে টলতে-টলতে টাল খেতে-খেতে দানবের মতো প্রকাণ্ড জ্বলন্ত লিফটটা ছুটে আসছে৷ ওটার অভিঘাতে বৃষ্টির জল ছিটকে যাচ্ছে চারপাশে৷ বৃষ্টির ফোঁটা ওটার লাল গনগনে শরীরে পড়ামাত্রই হয়তো ‘ছ্যাঁক-ছোঁক’ শব্দ হচ্ছিল, কিন্তু ইস্পাতের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষের শব্দে সেই শব্দ কানে আসছিল না৷

আমরা ভয়ে ছুটতে শুরু করলাম আবার৷ তবে ‘আমরা’ মানে দুজন: আমি আর মহাবীর যাদব৷

পেছনে তাকিয়ে দেখি, রামপ্রসাদজী রুখে দাঁড়ানো যোদ্ধার মতো দু-পা ফাঁক করে ডানহাতে ত্রিশূল উঁচিয়ে মারমুখী ভঙ্গিতে ছুটে আসা লিফটটার জন্যে যেন অপেক্ষা করছেন৷ ছিপছিপে লম্বা মানুষটার শরীরের সমস্ত ভয়-ডর যেন উবে গেছে৷

‘জয়-জয় শিবশম্ভু!’ গর্জে উঠলেন রামপ্রসাদ৷ অন্ধকার আকাশ-বাতাস যেন কেঁপে উঠল৷ তারপর মানুষটা গরগর রাগে গলা ফাটিয়ে বললেন, ‘আ যা, শয়তান! তু শিবজী কো নহি মানতা? শিবজী তুঝে আভি নাশ করেঙ্গে৷ শিবজী কা পাওয়ার তুঝে নহি মালুম! আ যা…৷’

লিফটটা রামপ্রসাদজীর খুব কাছে এসে গিয়েছিল৷ আমি আশঙ্কা আর কৌতূহলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ এই পাগল পণ্ডিতজীকে এখন আমি কী করে বাঁচাই!

‘পণ্ডিতজী!’ চিৎকার করে ওঁকে ডাকলাম৷ কিন্তু তিনি ফিরেও তাকালেন না৷

মহাবীর যাদব তখন ‘দাওয়াই টাউন’-এর সীমানার বাইরে চলে গেছেন৷ সেখান থেকে বারবার ‘পমেশজী! পমেশজী!’ করে আমাকে ডাকছেন৷

অভিশপ্ত লিফটটা যখন পণ্ডিতজির বেশ কাছে এসে গেছে তখন তিনি ‘জয় শিবশম্ভু!’ বলে জ্বলন্ত লোহার বাক্সটাকে লক্ষ্য করে হাতের ত্রিশূল ছুড়ে দিলেন৷

পলকে এক বিস্ফোরণ ঘটে গেল৷ প্রচণ্ড শব্দে বোমার মতো ফেটে গেল লিফটটা৷ হাজার টুকরোয় চুরচুর হয়ে অসংখ্য আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে গেল বৃষ্টি-ভেজা বাতাসে৷ আর তার সঙ্গে শোনা গেল একরাশ বাচ্চার যন্ত্রণা ও বেদনা মেশানো কান্না৷ নিচু পরদায় শুরু হয়ে ক্রমশ উঠে গেল উঁচু গ্রামে৷ তারপর কেঁপে-কেঁপে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল৷

আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল৷

আমি আবার চিৎকার করে ডাকলাম, ‘পণ্ডিতজী! পণ্ডিতজী!’

রামপ্রসাদ তিওয়ারি থরথর করে কাঁপছিলেন৷ আমার ডাকে ফিরে তাকাতে গিয়ে তিনি বোধহয় মাথা ঘুরে খসে পড়ে গেলেন ভেজা মাটিতে৷

আমি ছুটে গিয়ে ওঁকে তুলে দাঁড় করালাম৷ টের পেলাম, ওঁর শরীরটা তখনও কাঁপছে৷ আমার বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে৷

মহাবীরজী ছুটে চলে এলেন আমাদের কাছে৷ আমার একটা হাত জাপটে ধরলেন৷

আমরা তিনজন পরস্পরকে ছুঁয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তাকিয়ে রইলাম হসপিটাল বিল্ডিংটার দিকে৷

আজ যতই ঝড়-বৃষ্টি হোক, কালকের নতুন সকালটা যেন অমলিন সুন্দর হয়৷

(সমাপ্ত)

No comments