বিহার মন্ত্রীর সান্ধ্য বিহার – শিবরাম চক্রবর্তী
সেবার পুজোর সেই বিহারেই যেতে হলো আবার।
ভূমিকম্পের পর থেকে বিহারের নাম করলেই আমার হৃৎঙ্কম্প হয়।
আর্থাকোয়েক আর হার্টফেল নোটিশ না দিয়েই এসে পড়ে, আর নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতে কাজ সেরে চলে যায়।
তুমি হয়তো বলবে, ও-দুটোরই দরকার আছে। প্রাচীণ বাড়ি-ঘর যেমন শহরের বুকে কদর্যতা, তেমনি সেকেলে শহর-টহর পৃথিবীর পিঠে আর্বজনা–ভূপৃষ্ঠ থেকে ওরা কি সহজে সরতে ভূমিকম্প না থাকলে? এতো আর এক আধখানা পুরানো ইমারত নয় যে, মেরামত করে টরে বদলে ফেলবে? একে তো সারিরে সরানো যায় না, সরিয়ে সারাতে হয়–আর ভেঙ্গে গড়বার জন্য শহরকে–শহর সরিয়ে ফেলা কি চারটিখানি কথা?
তারপর হার্টফেল হ্যাঁ–ওটাও সেকেলে লোকদের জন্যই, তুমি বলবে। নিজের হৃদয়ের কাছে হেলাফেলা না পেলে বুড়ো মানুষরা কি মরতে চাইতো সহজে? আধমরা হয়েও আধাখাচরা জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকতো–বলবে তুমি।
তুমি তো বলেই খালাস, কিন্তু আমি যে নিজেকে যথেষ্ট সেকেলে মনে করতে পারছিনে, নতুবা বিহারে পা বাড়াতে আর কি আপত্তি ছিল আমার? হৃৎকম্প থেকে হৃঝম্প একটার থেকে আরেকটার কতখানি বা দুরত্ব?
যাক–সেই বিহারেই যেতে হলো বেড়াতে।
গেছলাম যেখানে, জায়গাটার নাম করব না, আমার পিশেমশাই সেখানে দারোগা আর হাসপাতালে ডাক্তার হচ্ছেন সাক্ষাৎ আমার মেসোমশাই।
দারোগার দোর্দন্ড প্রতাপে যারা রোগা হয়ে পড়ে, অচিরাৎ ডাক্তারের কবলে তাদের আসতে হয়; কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে তারা কোথায় যায়, ডাকঘরে খবর নিয়েও তার হদিশ মেলে না। অর্থাৎ তারা একেবারে সুদূরপরাহত হয়ে যায়। রোগী আর রোগ দুজনকেই যুগপৎ আরোগ্য করার দিকে কেমন যেন একটা গো আছে মেলোমশায়ের।
পই পই করে বলে দিয়েছিলেন মা-মরে গেলেও ওষুধ খাসনে। হাজার অসুখ করলেও মেলোমশায়ের কাছে যাসনে।
আর পিসেমশাই? তার কাছে গেছি কি, অমনি তিনি ছাতুখোর পাহারাওয়ালাদের দিয়ে আমাকে পিসে ফেলে আরেক প্রস্থ ছাতু বানিয়ে থানায় পুরে রাখবেন আমায়, কিন্তু এসে দেখলাম। যতটা ভয় করা গেছল, ততটা না; তেমন মারাত্মক কিছু না। মেশোমশায়ের তো মায়ার শরীর, রোগযন্ত্রনা রুগীর যদি বা সয়, ওঁর আদপেই সহ্য হয় না, রোগের যাতনা লঘু করতে গিয়ে রুগীকেই লাঘব করে ফেলেন তিনি–আর পিশেমশাই? সারা পৃথিবীটাই তার কাছে মায়া! দুনিয়াটাই জেলখানা তাঁর কাছে। তাই দুনিয়াটাকেই জেলখানায় পুরতে পারলে তিনি বাঁচেন।
তবে আমার অন্তত ভয়ের কিছু ছিল না কোনো পক্ষ থেকেই। আমার প্রতি ভয়ানক অমায়িক ওরাঁ দুজনেই। দু-একদিনেই ভুব ভাব জমে গেল আমাদের।
একদা পড়ন্ত বিকেলে হাসপাতালের ডাক্তারখানায় বসে মেসোমশায়ের সঙ্গে খোস গল্প করছি, এমন সময় এক খোট্টই মার্কা রুগী আস্তে আস্তে এসে হাজির হোলো সেখানে। দেখলেই বোঝা যায়, দেহাতী লোক, যন্ত্রনাবিকৃত মুখ। এসেই বিরাট সেলাম ঠুকলো মেসোমশাইকে।
মেশোমশাই তাকে আমলই দিলেন না। তোর মনে থাকবার কথা না তুই আর তখন কতটুকু! তবে তোর মাকে জিজ্ঞেস করিস। অনেকরকম খোস দেখেছি, সারিয়েছিও, কিন্তু সে কি খোস রে বাবা–!
সে খোস-গল্পের স্বয়ং আমি জড়িত, তা আমার ভালো লাগবার কথা নয়। আমি তেমন উৎসাহ দেখাই না; কিন্তু মেসোমশাইকে উৎসাহ দেখাতে হয় না।
যেন আমাদের দেখোস। কত বৈদ্য-হাকিম হদ্দ হয়ে গেল। কিন্তু সারিয়েছিল কে তোর সেই খোশ-পাঁচড়া? শুনি? এই শৰ্মাই! সবে তকন মেডিকেল কলেজ ঢুকেছি–তখনই। তুই মরিস খোসের জ্বালায়, আর আমার মরি খোশবুর জ্বালায়–!
খোশবু কি মেশোমশাই? অনুসন্ধিৎসু হতে হয়, জেনারেল নলেজের পরিধি বাড়াবার প্রায়স পাই।
তোর সেই খোস পচে গিয়ে কী গন্ধই না বেরিয়েছিল, বাপস! আমি যতই বোঝাই তোর মাকে যে আগে আম ডাসা থাকে, তারপর পাকে, তারপর পচে, তারপরে শুকোয়, তারপরেই তো হয় আমসি–তখনই হলো গিয়ে আমের আরাম! আমাশা সারাতেও সেই কথা। তোর মা ততই বলেন, ছেলেটাকে তুমিই সারালে সনাতন! আরো বাপ, বলল যে সারালে, তা না সারলে। আর সারলে কি এক হোলো? দুটো কি এক ক্রিয়াপদ? আকারের তফাৎ নেই দুজনের?।
তবে সারালো কিসে? এবার আর নিজের খোস গল্পে সাগ্রহে যোগ না দিয়ে পারি না।
সারলো যেমন করে যাবতীয় ঘা সারে–যেমন করে ডাক্তারী-মতে সরিয়ে থাকি আমরা। খোস পচে হলো শোষ, শোষ থেকে হলো কাবাঙ্কল–তারপরে সারলো, সহজেই সারলো, শুকিয়ে গিয়ে সেরে গেল শেষে। সারবেই, ও তো জানা কথা, কলেরা হলেই আমাশা সেরে যায়–সারছে না আমাশা–কলেরা করে দাও, তারপর তখন নুনজল দাও ঠেসে। হামেশাই এই করে সারাচ্ছি–আরে, চিকিচ্ছে কি চারটিখানি কথা? হয় এম্পার, নয় ওস্পার! ডাক্তারকে ধরে দুর্গা বলে ঝুলে পড়তে হয়।
তা বটে।
সারানোর পদ্ধতিই এই। বাতের কি কোনো চিকিচ্ছে আছে? মানে, সোজাসুজি চিকিছে? উঁহু! কেবল পক্ষাঘাত হলেই বাত সারে। তারপর পক্ষাঘাতের ওষুধ হলোগে ম্যালেরিয়া। জ্বরের যা কাঁপুনি বাপু, সাতখানা কম্বল চাপা দিলেও বাগ মানে না, লাফিয়ে ওঠে রোগী। আর যাঁহাতক লাফানো, তাঁহাতক পক্ষাঘাত–সারা!
কিন্তু ম্যালেরিয়া থেকে গেল যে?
পাগল! জ্বর সারাতে কতক্ষণ? দুশো গ্রেন কুইনিন ঠেসে দাও, একদিনেই দুশ্মে। তারপর আর দেখতে শুনতে হবে না–
কিন্তু ম্যালেরিয়া আবার সময়মত পাওয়া গেলে হয়! আমি সন্দেহ প্রকাশ করি।
আরে, ম্যালেরিয়ার আবার অভাব আছে এদেশে? এনোফিলিস তো চারধারেই কিলবিল করছে। ডাক্তারের চেয়ে তাদের সংখ্যা কি কিছু কম, তুই ভেবেছিস? তবু যদি বিহারের এ-অঞ্চলে নিতান্তই না মেলে, পক্ষাঘাতের রুগীকে আমি চেঞ্জে পাঠিয়ে দিই বর্ধমানে! আমার কাত হয়ে রুগী যে বাত সারিয়ে ফিরে এসেছে বর্ধমান থেকে! তবে–
অকস্মাৎ থেমে যান মেসোমশাই। তারপর কতিপয় হ্রস্ব-নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলেন–কতক আর ফেরেনি রে! তাদের শেষটা নিউমোনিয়া ধরে গেল কিনা!
ও! নিউমোনিয়া হলে বুঝি আর সারে না মেসোমশাই? আমার কৌতূহল হয়। না কি, টাইফয়েড হলে তবেই তা সারবার?
মেসোমশাই নিরুত্তর।
গোদ কিংবা গলগন্ড হলে সারে বুঝি?
মেসোমশাই মাথা নেড়ে বাধা দেন।
তবে কি–তবে কি–সর্দিগর্মিই হওয়া চাই?
উঁহই। হার্টফেল হলে তবেই সারে নিউমোনিয়া। বলেই মেসোমশাই গম্ভীর হয়ে যান বেজায়।
তাহলে তো মারাই গেল? গেল নাকি? আমার সংশয় ব্যক্ত হয়।
গেলই তো! মেসোমশাই কোপান্বিতি হন–যাবেই তো! যত সব আনাড়িকেষ্ট বর্ধমানের! কেন যে রুগীদের নিউমোনিয়া হতে দ্যায় ভেবেই পাই না। সারানো না যাক, নিউমোনিয়ার প্রতিষেধক ছিল তো!
ছিলো! প্রতিষেধক থাকতে বেচারা বেতো-রুগীরা মারা গেল অমন বেঘোরে? বলেন কি মেসোমশাই? আমি প্রায় লাফিয়ে উঠি। ছিলো প্রতিষেধক?
ছিলোই তো! ম্যালেরিয়া থেকে কালাজ্বর করে দিতে পারতো! কালাজ্বরের তো ভালো চিকিচ্ছেই রয়েছে। ইউরিয়া স্টিবামাইন! আমাদের উপেন ব্রহ্মচারীর বের করা। নেহাৎপক্ষে যক্ষ্মা তো ছিল–যক্ষ্মা হলে আর নিউমোনিয়া হয় না। হাতি যেখান দিয়ে যায়, ইঁদুর কি সে-ধার মাড়ায় রে? ঘোড়া যেখানে ঘাস খায়, বাছুর কি সে জায়গা ঘেঁসে কখনো?
আমি একটু হতাশ হয়েই পড়ি। কিন্তু যক্ষ্মা হলে আর কি হোলো! যক্ষ্ম কি সারে আর?
সারে না আবার! তেমন গা ঝেড়ে বসন্ত হয়ে গেলে যক্ষ্মা তো যক্ষ্মা, যক্ষ্মার বাবা অবদি সেরে যায়! পকসের জার্মের কাছে লাগে আবার যক্ষ্মার ব্যসিলি :!
বসন্ত! শুনে আরো দমে যাই আমি।-–বসন্ত কি ইচ্ছে করলেই হয় সবার?
আলবৎ হয়–হবে না কেন? মেসোমশাই বেশ জোরালো হয়ে ওঠেন–টিকে না নিলেও হবে। আর টিকে যদি নিয়েছে, তাহলে তো কথাই নেই।
সেই পাগড়ি-পরা লোকটি এতক্ষণ অস্ফুট কাতরোক্তি দিয়ে মেলোমশায়ের মনোযোগ আকর্ষণের দুশ্চেষ্টা করছিল, এবার যে অর্ধস্ফুট হয়ে ওঠে–বাবুজি!
মেসোমশাই কিন্তু কর্ণপাত করেন না–এসব তথ্য বুঝতে হলে ডাক্তার হওয়া লাগে। তাই তো ডাক্তার হতে বলছি তেকে। বলি যে, ডাক্তারি পড় বোকাঁচন্দর।
মেসোমশায়ের আদুরে ডাকে আমার রোমাঞ্চ হয়।
আমপনার চিকিচ্ছে তো খাসা মেসোমশাই, ওষুধ খর্চা হয় না! রোগ দিয়েই রোগ সারিয়ে দ্যান! যাকে বলে রোগারোগ্য, বাঃ!
বিলক্ষণ! ওষুধ দিয়েই তো সারাই বিনা ওষুধে কি সারে? কিন্তু ওষুধের কাজটা হোলো কি? আরেকটা ব্যামো দেহে ঢুকি য়ে তবেই না একটা সারানো। উকিলদের যেমন! আরেকটা মামলার পথ পরিষ্কার করে, তাহলেই তাদের একন্ন মেটে! আমাদের ডাক্তারদেরও তাই! ওষুধ দিয়ে আনকোরা একটা ব্যারামের আমদানি না করলে কি–
দেহাতী লোকটির দেহ হঠাৎ যেন কুঁকড়ে যায়। তার আর্তনাদে আমাদের আলোচনা ব্যাহত হয়। বাবুজী হম মর গিয়া!
মেসোমশাই চটেই যান–ক্যা হুয়া, হুয়া ক্যা?
বহুৎ শির দুখাতা, আউর পিঠমে ভি দরত—
আভি কেয়া? কল ফজিরমে আও! যো বখৎ হাসপাতাল খুলা রহতা–
নেই বাবুজি, মর যায়গা, গোড় লাগি। হামারা বোখার ভি আগয়ী–
কাকুতি-মিনতিতে মেশোমশাই ঈষৎ টলেন। থার্মোমিটারটা বার করেন; কিন্তু থার্মোমিটারের কাঠিটাকে খাপ থেকে বার করার কথা তিনি বিস্মৃত হন, খাপ-সমেত সমস্তটাই অবহেলাভরে দ্যান বেচারার বগলে ভরে।
তারপর সখাপ সেটাকে বগল থেকে বহিষ্কৃত করে সামনে এসে মনোযোগ সহকারে কি যেন পাঠ করেন। অতঃপর ওঁর মন্তব্য হয়–হুঁম বোঘর ভি হুয়া জারাসে!
প্রয়োজন ছিল না, তবু আমিও কিঞ্চিৎ ডাক্তারি বিদ্যা ফলাই–হুয়া বই কি! জারা লাগতি তো? জারা জারা?
মেসোমশাই ছাপানো ফর্মে খস খস করে দুলাইন ঝেড়ে দ্যান। ও প্রেসকৃপসন আমিও লিখে দিতে পারতুম! ব্যবস্থাপত্রের বাঁধা গৎ আমার জানা। আমার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে ডিসপেনসিং রুমের প্রকাণ্ড কাঁচের জার এবং তার আভ্যন্তরীণ অদ্বিতীয় মহৌষধ যার রঙ কখনো লাল, কখনো বেগুনী, কখনো বা ফিকে জরদা। সর্দি-কাশি কি পেটব্যাথা, পিত্তশুল কি পিলে জ্বর, জরবিকার কি গলগণ্ড–যারই রুগী আসুক না কেন, সবারই সে এক দাবাই, সর্বজীবে সমদৃষ্টি সমদৃষ্টি মেলোমশায়ের, ভদ্রলোকে এক কথায় মত একমাত্র ব্যবস্থা।
পিঠে দারদওয়ালার বেলাও অবশ্য তার অন্যথা হয়নি, সেই একমাত্র ওষুধের একমাত্রা বা একাধিক নিশ্চয়ই তিনি বরাদ্দ করে দিয়েছেন– অকাতরেই। সে-বেচারা চিরকূট নিয়ে দাবাইখানার দিকে এগুতেই আমিও মেলোমশায়ের কাছ থেকে কেটে পড়ি। ডাক্তারি-বিদ্যা এক ধাক্কায় অনেকখানি হজম করা সহজ নয় আমার পক্ষে।
হাওয়া টাওয়া খেয়ে ফিরতে একটু রাতই হয়। পিসেমশায়ের নিকটে যাই–রাত্রের আহারটা তার আস্তানাতেই চলে কিনা! ইয়া ইয়া মাছ, মুরগী আর পাটা কোত্থেকে না কোত্থেকে প্রায় প্রত্যহই জুটে যায় পিসেমশায়ের পয়সা খরচ করে কিনতে হয় না। নৈশপর্বটা আমাদের জোরালো হয় স্বভাবতঃই।
থানায় পৌঁছেই দেখি, সেখানেও এসে জুটেছে সেই পাগড়ি-পরা লোকটা। আড়াই মাইল দুরে কোথায় তার আত্মীয়ের বাড়ি কি চুরি গেছে না কোন হাঙ্গামা হয়েছে তারই তদন্তে নিয়ে যেতে চায় পিসেমশাইকে। পিসেমশাই তাকে খুব বকেছেন, ধমকেছেন দাবড়ি দিয়েছেন হাজতে পোরাবার ভয় দেখিয়েছেন–কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা, দারোগা দেখে সহজে রেগো হবার পাত্র না। পিসেমশাই রাত্রে এক পা নড়তে নারাজ, অগত্যা, সেই পাগড়ি পরা দশটা টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়েছে, তখন তিনি কেসটা কেবল ডারেরীতে টুকে নিয়ে প্রস্তুত হয়েছেন। এখানে আসা অবধি বরাবর আমি লক্ষ্য করেছি, পিসেমশায়ের বামহাত দক্ষিণের জন্যে ভারি কাতর–বেশ একটু উদ্ব্যগ্র বললেই হয়–আর দক্ষিণহাত কি ইতর, কি ভদ্র–সবার প্রতি স্বভাবতঃই কেমন বাম–সবাইকে গলহস্ত দেবার জন্যে সর্বদাই যেন শশব্যস্ত হয়ে আছে।
ডায়েরী লেখা শুরু করেন পিসেমসাই। নামধাম জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁর প্রশ্ন হয়–কেয়া কাম করতে হো?
মন্ত্ৰীকা কাম।
কেয়া? মিস্ত্রীকা কাম? কনটাকে চাগিয়ে নেন পিসেমশাই।
নেহি নেহি, জি! মিস্ত্রী নেহি–মন্ত্রী!
সমঝ গিয়া! পিসেমশাই লিখে নেন তাঁর ডায়েরীতে। আমাকে বলেন–আমরা যাদের মিস্তির বলি এইসব দেহাতী লোকেরা তাদেরই মন্ত্রী বলে, বুঝেচিস? লেখাপড়া জানে না তো, অকাট মুখখু, আবার সমসকত করে বলা হচ্ছে?
মন্ত্রীকা কাম…।
তারপর পাগড়ি পরার দিকে ফেরেন?
সমঝ গিয়া! কেয়া মন্ত্রী? রাজমন্ত্রী, না ছুতোর-মন্ত্রী?
রাজমন্ত্রী! বিরক্ত হয়েই বুঝি জবাব দ্যায় পাগড়ি-পরা।
ওই যো-লোক দেশকো ইমারত বনা? বাঁশকো ভারা বাঁধতে মাথপর ইঁটকো বোঝা লোক উপর উঠতা–? পিসেমশাই প্রাঞ্জল ব্যাখা দ্বারা পরিষ্কাররূপে প্রাণিধান করতে চান।
জি হ্যাঁ,! বহুত ভারী বোঝা! সায় দ্যায় সে।
উসি ব্যাস্তে তুমারা শির দুখাতর? নেহি জি? আমি জিজ্ঞাসা করি। এতক্ষণে ওর দাবাইখানা যাবার কারণ আমি টের পাই।
পিঠমে ভির দরদ! সে বলে একটু মুচকি হেসে। উসি বাস্তে।
পিসেমশাই তার জেরা চালিয়ে যান–উঠনেকা বখ? কভি কভি গিরভি যাতা উলোক–ঐ রাজমন্ত্রী লোক? কেয়া নেহি?
ঠিক হ্যায়। পাগড়ি পরা ঘাড় নাড়ে।–কভি কভি।
বহুৎ ধ্বস্তাধস্তি, বিস্তর বাদানুবাদের পর ডায়েরী লেখা শেষ হয়! লোকটা চলে গেলে পিসেমশাই নোটখানা খুলে দ্যাখেন, পরীক্ষা করেন আসল কি জাল।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন তিনি–না, আসলই বটে, তবে চোরাই কিনা কে জানে! কোনো মিনিস্টারের পকেট মেরে আনা নয় তো?
কি করে জানলেন? শার্লক হোমসের জুড়িদার বলে সন্দেহ হয় আমার পিসেমসাইকে।
ক্যাবিনেটেরে একজনের নামের মত নাম লেখা নোটের গায়ে। তবে নাও হতে পারে। এসব তো এধারের বাজার-চলতি চালু নাম, অনেক ব্যাটারই এমন আছে।
সকালবেলায় খাওয়াটা মেলোমশায়ের বাড়িতেই হয় আমার। রাত্রের গুরুভোজনের পর ঘুম থেকে উঠে পিসেমশায়ের সঙ্গে একচোট দাবা খেলে স্নান টান সেরে যেতে প্রায় বারোটাই বেজে যায়।
আজ গিয়ে দেখি মাসীমা বিচলিত ভারী। মেসোমশাই হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে সেই যে সাত সকালে হাসপাতালে গেছেন, ফেরেননি এখনো। কারণ জিজ্ঞাসা করি।
মাসীমা বলেন–কাল বিকেলে হাসপাতালে কে একটা উটমুখো এসেছিল না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তখন ছিলাম তো। কে এক রাজমিস্ত্রী না ছুতোরমিস্ত্রী!
সেই সর্বনেশের কাণ্ড দয়াখো! টেবিলের ওপর খোলা চিঠিটার দিকে দৃকপাত করেন মাসীমা–খুব বিরক্তিভরেই।
আগাপাশতলা পড়ে দেখি চিঠিটা বিহারের জনৈক মন্ত্রী লিখছেন–নামটা নাই করলাম–লিখেছেন অনেক কথাই। তিনি জানিয়েছেন যে, থার্মোমিটারের খাপের, যে কোনো নামী মেকারের যত দামী জিনিসই হোক না কেন, বগলে গলিয়ে দিলেই কিছু জ্বার-উত্তোলনের ক্ষমতা জন্মে না, বরং তাকে বগলদাবাই করাই এক বিড়ম্বনা। উপরন্তু আরো বিশেষ করে এই কথাও তিনি জানাতে চেয়েছেন যে, সবাই হচ্ছে চিকিৎসকের ধর্ম; যখন, যে সময়ে, যে অবস্থাতেই রোগার্ত আসুক না কেন, তাকে সুস্থ না করা পর্যন্ত ডাক্তার তটস্থ থাকবেন, তা সে রুগী ইতরই হোক, কি দ্রই হোক! গরীবই হোক, আর বড়লোকই হোক; সরকারী ভারী চাকুরেই হোক কি সে বেসরকারী ভবঘুরেই হোক;
তা ছাড়া আরো তিনি বলেছেন : আমরা–সরকারী কর্মচারীরা, তা মন্ত্রীই হই, কি ডাক্তারই হই; দারোগা হই; দারোগা হইয়া বা পাহারাওয়ালাই হই; ভুলেও যেন কখনো না মনে ভাবি যে, আমরাই জনসাধারণের মনিব। জনসাধারণেরই নিছক খাই, তাদের সেবার জন্যেই আছি, আমরা তাদের ভৃত্য মাত্র।
ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ সদুপদেশের পর তাঁর সার কথাটি আসে সর্বশেষে। নিজের দুরবস্থা তো তিনি স্বচক্ষেই কাল দেখে গেছেন হাসপাতালের আর সব রুগীরা কিভাবে আছে, তাদের দুর্দশা পর্যবেক্ষণ করতে আজ স্বয়ং তিনি সেই তিনিই আসবেন…ছদ্মবেশে নয় অবিশ্যি এবার–ভদ্রবেশে প্রকাশ্যরূপে!
ছুটি হাসপাতালে।
গিয়ে দেখি বিপর্যয় ব্যাপার! বেজায় হৈ হৈ, ভারী শশব্যস্ততা সবদিকে। প্রেসকৃপশন সব পালাটানো হচ্ছে, বদলানো হচ্ছে খাতা-পত্ৰ, রঙ-বেরঙের ভালো ভালো দাবাই পড়ছে রুগীদের শিশিতে। মিনিস্টার আসছেন হাসপাতাল পরিদর্শনে! বহুরূপী সেজে নয়–দস্তুরমত সরকারী কেতায়! অফিসিয়াল ভিজিট–যা তা না!
কাজেই, নিঃশ্বাস ফেলবার ফুরসৎ নেই মেলোমশায়ের। হাসপাতালের কায়েমী রুগীদের অনেক করে জপানো হচ্ছে চিকিৎসার কিরকম সুব্যবস্থা করা হয় এখানে ওদের। ঘণ্টায় ঘন্টায় কি সব সুপাচ্য ও সুপৃথ্য ওদের দেওয়া হয়। এই যেমন–আঙ্গুর-বেদনা, সাগু-মিছরি, দুধ-বার্লি, মাখন পাউরুটি, সূপ-সুরুয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনাস্বাদিত তালিকা মুখস্থ করতে করতে হাঁপ ধরে যাচ্ছে, নাভিশ্বাস উঠছে বেচারাদের, মনে মনে তারা গাল পাড়ছে মিনিস্টারকে।
ওদের মধ্যে দু-একজন আবার হয়তো যুধিষ্ঠির সেজে বসেছে, তারা দাবি করেছে, শুধু শুধু মিথ্যেকথা বলা তাদের ধাতে পোষাবে না, উপরোক্ত খাদ্যখাদ্যগুলি বস্তুত যে কি চীজ, কেবল কানে শুনে সঠিক ধারণা করা যায় না, এমন কি চোখে দেখাও যথেষ্ট নয়, চোখে দেখার দরকার। ঐ তালিকা মনে রাখবার মতো মুখস্থ করতে হলে সত্যি সত্যিই ওদের মুখস্থ করে দেখতে হবে। তাদের সত্যবাদিতার পরাকাষ্ঠা বজায় রাখতে রান্নার তোড়জোড় করতে হয়েছে। নাজেহাল হয়ে পড়েছেন মেসোমসাই।
ডাক্তারখানায় তো এই দৃশ্য! সেখানে থেকে সটান ছুটি থানায়। সেখানে আবার কি দুর্ঘটনা, কে জানে।
গিয়ে দেখি পিসেমশাই তো মাথা হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। তিনিও পেয়েছেন এক চিঠি।
চিঠির আসল মর্ম–আসল মর্ম তিনিই জানেন কেবল! কাউকে জানতে দিচ্ছেন না তিনি। দাবাবোডেরা তাঁর পাশেই গড়াগড়ি যাচ্ছে, তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের মতই তার মুখ বেশ থমথমে। কার সাধ্য, তার কাছে ঘেঁসে! মনে হয় কে যেন মশাই! পিসে ফেলেছে আমার পিসেমশাইকে—আপাদমস্তক–একেবারে পা থেকে শিরোপা অব্দি।
ওধারে হাসপাতালে ভূমিকম্প দেখে এলাম, এখানে যা দেখছি, তাতে তো হৃঙ্কম্পের ধাক্কা!
পিসেমশায়ের এক দাবা, আর সেসোমশায়ের একমাত্র—দাবাই–এসে অবধি কেবল এই দেখছি এঁদের দুজনের। এই দিয়েই এতদিন এখানকার সবাইকে ওঁরা দাবিয়ে এসেছেন; কিন্তু আজ যেন ওঁরাই দাবিত–নিজের চালে নিজেরাই মাত হয়ে গেছেন কিরকমে! ওঁদের কাত দেখে আমারো ভারী রাগ হয়–কিন্তু কার ওপর যে বুঝতে পারি না সঠিক!
ভূমিকম্পেরই দেশ বটে বিহার! ছোটখাটো ভুমিকম্প যেখানে সেখানে যখন তখন লেগেই রয়েছে ও অঞ্চলে আজকাল!
Post a Comment