মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

১. নৌকায় উঠার মুখে ছোট্ট দুর্ঘটনা

নৌকায় উঠার মুখে ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটল, শেফার চোখ থেকে চশমা খুলে পানিতে পড়ে গেল। শেফার মাইয়োপিয়া, চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখে না। সে একবার ভাবল, ‘মা আমার চশমা’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে সবার পিলে চমকে দেবে। সে তা করল না, যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে নৌকায় উঠে এল। চশমা পানিতে পড়ে যাবার ব্যাপারটা এখন কাউকে না-জানানোই ভালো। বাবা হুট করে রেগে যাবেন। সবার সামনে বকা শুরু করবেন। দেলোয়ার ভাইকে এই ঠাণ্ডার মধ্যে পানিতে নামতে হবে। কী দরকার? জায়গাটা শেফা চিনে রেখেছে। একসময় চুপিচুপি এসে পানি থেকে তুলে নিলেই হবে। চশমাটা যেখানে পড়েছে সেখানে হাঁটু পানিও হবে না। আর যদি হয় অসুবিধা হবে না। শেফা সাঁতার জানে। এই বছরই মাদার’স ক্লাব থেকে সাঁতার শিখেছে।

শেফা খুব সাবধানে পা ফেলে এগুচ্ছে। বেশি হাঁটাহাটি করা যাবে না। শেষে কোনোকিছুতে পা বেধে হুড়মুড় করে পানিতে পড়ে যাবে। চশমা ছাড়া সব কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। বাবাকে দেখাচ্ছে খড়ের গাদার মতো। হলুদ কোটটা পরায় এমন লাগছে। খড়ের গাদার মাথায় লাল রঙ-করা হাঁড়ি বসানো। লাল হাঁড়িটা হচ্ছে বাবার মাথার লাল ক্যাপ।

শেফা তার বড় বোন মীরার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল। এক বসায় নৌকা প্রায় কাত হয়ে গেল। মীরা তার দিকে তাকাল সরু চোখে। মীরার মাথায় নীল স্কার্ফ। শীতের জন্যে কান ঢেকে স্কার্ফ পরেছে। স্কার্ফের জন্যেই বোধ হয় তাকে দেখাচ্ছে বিদেশিনী মেয়েদের মতো। যেন ইউরোপের কোনো মেয়ে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে। বাংলাদেশের নোংরা থেকে নিজেকে আলাদা রাখার জন্যে শরীর শক্ত করে এক কোনায় বসে আছে। মীরার হাতে একটা বই। শেফা বাজি রেখে বলতে পারে যে নৌকা ছাড়ামাত্র মীরা আপা বই পড়তে শুরু করবে এবং অবশ্যই অবশ্যই বাবার কাছে বকা খাবে। বাবার কাছ থেকে বকা না-খেয়ে আজ পর্যন্ত তারা কোনো বেড়ানো শেষ করেনি। বেশির ভাগ সময় সে বকা খায়। আজ নিশ্চিতভাবে মীরা আপার টার্ম।

শেফা খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, আপা তোর হাতে কী বই?

মীরা জবাব দিল না।

শেফা আবারো বলল, বইটার নাম কী?

মীরা বিরক্ত গলায় বলল, সবসময় ঝামেলা করিস কেন? বইয়ের নাম দিয়ে করবি কী? তুই কি কখনো বই পড়িস? আর শোন্ গায়ের উপর এসে বসছিস কেন? নৌকায় কি আর জায়গা নেই যে আমার কোলে এসে বসতে হবে?

শেফা সরে বসল।

মীরা বলল, তুই অন্য কোথাও গিয়ে বস তো। তোকে অসহ্য লাগছে।

‘কেন অসহ্য লাগছে?’

‘জানি না কেন লাগছে, প্লিজ তুই আমার পাশে বসবি না।’

শেফা উঠে দাঁড়াল। নৌকার অন্য মাথায় যাওয়া যায়। অনেকটা জায়গা হাঁটতে হবে। নৌকার ভেতরটা কেমন খোপ খোপ। নিশ্চয়ই ধাক্কা টাক্কা খাবে। শেফার বুক সামান্য ধুকধুক করছে। তার চোখে চশমা নেই বাবা ধরে ফেলবে নাতো? ধরতে না-পারার সম্ভাবনাই বেশি। বাবা হয়তো তার মুখের দিকে ভালো করে তাকাবেই না। শেফার ধারণা কেউ তার মুখের দিকে ভালো করে তাকায় না। একবার তার নাকের ডগায় ফোঁড়ার মতো হল। নাক ফুলে হাতির শুঁড়ের মতো হয়ে গেল, তাও বাসার কেউ ধরতে পারল না। শুধু স্কুলের অঙ্ক মিস বলল, শেফা তোর নাকে কী হয়েছে? মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়, তোর দেখি নাক ফুলে পেপে গাছ হয়ে গেছে।

শেফার বাবা সুপ্রিম কোর্টের জাজ আজহার সাহেব মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার কাছে চলে আয়। বাবার পাশে বসতে শেফার মোটেই ইচ্ছা করছে না। বাবার পাশে বসা মানেই জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শোনা। বেড়াতে এসেও জ্ঞানীকথা শোনার কোনো মানে হয় না। কোনো উপায় নেই। শেফার মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে জ্ঞানীকথা শোনার জন্যে।

শেফা বাবার পাশে বসল। মেয়ের পিঠে হাত রেখে খুশি-খুশি গলায় বললেন, কিরে শেফা একসাইটিং লাগছে না? এ রিয়েল জার্নি বাই কান্ট্রি বোট। আগে রচনা লিখেছিস মুখস্থ করে। এখন লিখতে পারবি অভিজ্ঞতা থেকে।

শেফার মোটেই একসাইটিং লাগছে না। বাবাকে খুশি করার জন্যে বলল, দারুণ লাগছে বাবা।

আজহার সাহেব হাসিমুখে বললেন, তোরা তো গ্রামে আসতেই চাস না। বলতে গেলে তোদের জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। এখন মনে হচ্ছেনা, না এলে বোকামি হত?

‘হুঁ মনে হচ্ছে। না এলে খুব বোকামি হত।’

‘গ্রামের এই সৌন্দর্যের কোনো তুলনা আছে? কোনো তুলনা নেই। ফার ফ্রম দি মেডিং ক্রাউড। কীরকম ফ্রেশ বাতাস দেখেছিস? ওজন ভর্তি বাতাস। ঢাকায় এ-রকম বাতাস কোথায় পাবি? ঢাকার বাতাস মানেই কাৰ্বন—মনক্সাইড। ফুসফুসের দফারফা। জখম হওয়া ফুসফুস ঠিক করার জন্যে আমাদের মাঝে মাঝে গ্রামে আসা দরকার।’

‘ঠিক বলেছ বাবা।’

ঠিক এই মুহূর্তে তার চশমাটার জন্যে শেফার খুব আফসোস হচ্ছে। এখন একটা মজার দৃশ্য হচ্ছে। চশমা না-থাকার কারণে শেফা দৃশ্যটা ভাসা-ভাসা দেখতে পাচ্ছে। ভালোমতো দেখতে পারলে খুব মজা হত। তার মা মনোয়ারা নৌকায় উঠছেন। তাঁকে সাহায্য করছেন দেলোয়ার ভাই। মনে হচ্ছে সার্কাসের কোনো খেলা হচ্ছে। দড়ির উপর হাঁটার রোমাঞ্চকর খেলা। নদীর পার থেকে নৌকার গলুই পর্যন্ত দুটা বাঁশ ফেলা আছে, বাঁশে পা দিয়ে নৌকায় উঠতে হয়। দেলোয়ার ভাই দুহাতে মার ডান হাতটা ধরে টানছেন। মনে হচ্ছে বালির বস্তা টেনে আনছেন। আর মা এমনভাবে দুলছেন যে মনে হচ্ছে তাঁর খুব ইচ্ছা নদীতে পড়ে যাওয়া। দেলোয়ার ভাই থাকতে মা একা-একা নদীতে পড়ে যাবে তা হবে না। দেলোয়ার ভাইও অতি অবশ্যই মা’র সঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দেবে। তাতে মজা ভালোই হবে। শুধু শেফার চশমা যেখানে পরেছে, দুজন মিলে সেখানে না-পড়লেই হল।

মনোয়ারা বেগম নৌকায় উঠে তৃপ্তির হাসি হাসছেন। তিনি আজ শাড়ি পরেননি। মীরার একটা কামিজ পরেছেন। টকটকে লাল রঙের কামিজটা আঁট হয়ে গায়ে বসে গেছে। শুরুতে তাঁর একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছিল এখন আর লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। শাড়ি পরে নৌকায় উঠানামা খুব ঝামেলা। তিনি বড় মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন, আদুরে গলায় বললেন, ‘বুঝলি মীরা, আরেকটু হলে পড়েই যেতাম। দেলোয়ার গাধাটা দেখছে আমার ব্যালান্সে সমস্যা হচ্ছে তার পরেও হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে। মানুষ এমন গাধাও হয়।

মীরা কিছু বলল না। মনোয়ারা মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, চা খাবি? ফ্লাস্কে চা নিয়ে এসেছি।

মীরা বলল, না।

‘জিজ্ঞেস কর তো তোর বাবা খাবে কি না।’

মীরা বিরক্তমুখে বলল, তুমি জিজ্ঞেস কর। আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন?

‘তুই জিজ্ঞেস করলে অসুবিধা কী?’

‘আমি শুধু শুধু জিজ্ঞেস করব কেন? এমনতো না তোমার ল্যারেনজাইটিস হয়েছে, কথা বলা ডাক্তারের নিষেধ।’

মনোয়ারা বিস্মিত হয়ে বললেন, রেগে যাচ্ছিস কেন?

মীরা বলল, মা তুমি দয়া করে আমার পাশে বসবে না। তুমি বোধহয় জানো না যে তোমার গা থেকে কাদামাটি টাইপ একটা গন্ধ আসে, আমার মাথা ধরে যায়।

মনোয়ারা আহত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মীরা বলল, ঠিক আছে বসে পড়েছ যখন বোস। শুধু সারাক্ষণ ‘চা খাবি? কলা খাবি? সন্দেশ খাবি?’ এইসব করতে পারবে না। আমি কিছুই খাব না। সকাল থেকে আমার বমি আসছে। আমি যে-কোনো মুহূর্তে বমি করব। এইজন্যেই আমার পাশে বসতে নিষেধ করছি।

‘শরীর খারাপ?’

মীরা শীতল গলায় বলল, শরীর ঠিক আছে। মা শোনো, ‘শরীর খারাপ নাকি, জ্বর নাকি, কাশি হচ্ছে নাকি?’ এইসবও জিজ্ঞেস করতে পারবে না।

মনোয়ারা দুঃখিত গলায় বললেন, আচ্ছা যা তুই একা-একা বস। আমি চলে যাচ্ছি।

মুখে বললেও তিনি চলে গেলেন না। কোথাও বেড়াতে গেলে বড়মেয়ের সঙ্গে থাকতে তাঁর খুব ভালো লাগে। দুজনে মিলে গুটুর গুটুর করে কথা বলেন। মেজাজ ভালো থাকলে মীরা চমৎকার গল্প করে। আজ বোধহয় মেয়েটার মেজাজ ভালো নেই। মনোয়ারা ধরে নিলেন নৌকা ছাড়লেই মীরার মেজাজ ভালো হবে।

আজহার সাহেব বললেন, সবাই ঠিকঠাক বসেছ তো। ছাতা নেয়া হয়েছে? নদীর উপর রোদ বেশি লাগে। পানিতে রোদটা রিফ্লেক্ট করে এইজন্যে বেশি লাগে। দেলোয়ার কোথায়? দেলোয়ার?

দেলোয়ার ভীত গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, চাচাজি আমি এইখানে।

দেলোয়ার আজহার সাহেবের গ্রামের বাড়ির কেয়ার টেকার। সে তার শহরবাসী হাইকোর্টের জাজ সাহেব চাচাকে যমের মতো ভয় পায়। তার প্রধান চেষ্টা আজহার সাহেবের চোখের আড়ালে থাকা। সেটা মোটেই সম্ভব হয় না। আজহার সাহেব প্রতি পাঁচ মিনিটে একবার দেলোয়ারকে খুঁজেন। অকারণেই খুঁজেন।

‘দেলোয়ার।’

‘জ্বি চাচাজি।’

‘ছাতা নিয়েছ?’

দেলোয়ারের মুখ শুকিয়ে গেল। ছাতার কথা তার একবারও মনে হয়নি।

‘কী ব্যাপার ছাতা নাওনি?’

‘জ্বি না। একদৌড় দিয়া নিয়া আসি? যাব আর আসব।’

আজহার সাহেব রাগী-রাগী গলায় বললেন, ছাতার কথা মনে করা উচিত ছিল। যাই হোক নৌকা ছাড়তে বল। ভবিষ্যতে এই জাতীয় ভুল করবে না।

মনোয়ারা বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাই না। ছায়া ছায়া ভাব। তুই চা খাবি?

‘না।’

‘কচুরীপানার ফুল কত সুন্দর দেখেছিস। ফুলের মধ্যে ময়ুরের পাখার মতো ডিজাইন।’

মীরা কিছু না বলে বই খুলল। মা’র আহ্লাদী তার অসহ্য লাগছে। মীরার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মা খুকি-খুকি ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠবে, ওমা কী সুন্দর একটা বক। মীরা দেখ দেখ বক দেখ। তোর বাবাকে বল্ বকটার একটা ছবি তুলতে। বাবাও সঙ্গে সঙ্গে বকের ছবি তোলার প্রস্তুতি নেবেন। তখন দেখা যাবে সব এসেছে ক্যামেরা আসে নি। বাবা শুরু করবেন তার বিখ্যাত চিৎকার, ক্যামেরা কেন কেনা হয়েছে? শো-কেসে সাজিয়ে রাখার জন্যে? প্রয়োজনের সময় যে জিনিসটা পাওয়া যাবে না তার দরকার কী? ফেলে দিলেই হয়। বাড়িতে পৌছে প্রথম যে কাজটি করবে তা হল ক্যামেরা পুকুরে ফেলবে।

নৌকা চলতে শুরু করেছে। নদীর নাম সোহাগী। বেশ বড় নদী তবে শীতকাল বলে পানি কম। আজহারউদ্দিনের চোখেমুখে তৃপ্তির ভঙ্গি। যা দেখছেন তাতেই মুগ্ধ হচ্ছেন। তাঁর হাতে ফোকাস ফ্রি ক্যামেরা। কিছুক্ষণ পরপরই তিনি ক্যামেরা চোখের সামনে ধরছেন তবে ছবি তুলছেন না।

শেফা খুবই অস্বস্তি বোধ করছে কারণ তার বাথরুম পেয়েছে। এই কথাটা কাউকে বলা যাবে না। বাবা শোনামাত্র চেঁচিয়ে বলবেন, ঘর থেকে বেরুবার সময় বাথরুম করে বের হতে পারনি? ক্লাস টেনে উঠেছ, তুমিতো আর বাচ্চা মেয়ে না। এখন এই নদীর মধ্যে বাথরুম করবে কীভাবে। যতসব ন্যুইসেন্স।

শেফা খুবই চিন্তিত বোধ করছে। একবার বাথরুম পেয়ে গেলে খুব সমস্যা। মাথার মধ্যে শুধু বাথরুম ঘুরতে থাকে আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। নদীর পাড়ে সুন্দর একটা মাটির ঘর দেখা গেল। ঘর থেকে একটা মেয়ে বের হয়ে অবাক হয়ে নৌকা দেখছে। শেফার মনে হল মেয়েটা কত সুখী। সে নৌকায় নেই। ঘরে আছে। বাথরুম পেলেই বাথরুম করতে পারবে। শেফা বলল, বাবা আমরা নৌকায় কতক্ষণ থাকব?

আজহার সাহেব বললেন, অনেকক্ষণ থাকবরে মা। সাধ মিটিয়ে নৌকা ভ্রমণ। তোর ভালো লাগছে না?

শেফা শুকনো গলায় বলল, ভালো লাগছে।

‘তোরা শহরবাসী হয়ে গাছপালা ভুলে গেছিস। বল্‌ দেখি ঐটা কী গাছ?’

‘জানি না বাবা।’

‘মীরা তুই বলতে পারবি?’

‘না।’

‘মনোয়ারা তুমি পারবে? ‘

‘শ্যাওরা গাছ।’

‘রাইট— এটাই হল বিখ্যাত শ্যাওরা গাছ।’

শেফা বলল, বিখ্যাত কেন?

আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, বিখ্যাত কারণ গ্রামের মানুষদের ধারণা শ্যাওরা গাছে ভূত থাকে। এই গাছগুলি লোকালয়ে হয়ও না। জংলামতো জায়গা ছাড়া শ্যাওরা গাছ হয় না। গাছের পাতাগুলিও খুব ঘন। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। চাঁদের আলো যখন পড়ে তখন পাতার কারণে মনে হয় ভূত-প্রেত বসে আছে।

শেফা উঠে দাঁড়াল। বাবার জ্ঞানীকথা শুরু হয়ে গেছে। তার অসহ্য লাগছে। বাথরুমের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে জ্ঞানীকথা শুনতে ভালো লাগে না। অনেকক্ষণ নৌকায় থাকতে হবে শুনে তার বাথরুম আরো বেশি লাগছে। কিছু একটা করা দরকার। চুপিচুপি মাকে বলা যায় না। না, মাকে বললে হবে না। বলতে হবে আপাকে। আপা একটা ব্যবস্থা করবেই।

আজহারউদ্দিন বললেন, ‘শেফা যাচ্ছিস কোথায়?’

‘মা-র কাছে যাচ্ছি বাবা।’

‘মা-র কাছে যেতে হবে না। চুপ করে বস তো। চলন্ত নৌকায় হাঁটাহাঁটি করবি না। ব্যালেন্স হারিয়ে পানিতে পড়ে যাবি।’

শেফা বসে পড়ল। আজহারউদ্দিন ডাকলেন, মীরা 1

মীরা চমকে তাকাল। বাবা ডাকছেন। ডাকার ভঙ্গি ভালো না। খুবই গম্ভীর স্বর। নিশ্চয়ই বাবা কোনো কারণে রেগেছেন। এখন রাগের প্রকাশটা হবে। খুব বিশ্রীভাবে হবে বলাই বাহুল্য।

‘কী পড়ছিস?’

‘বই।’

‘বই যে পড়ছিস সেতো দেখতেই পাচ্ছি। গল্পের বই?’

‘না, জোকস-এর একটা বই।’

‘এত ঝামেলা করে নৌকা নিয়ে বের হয়েছি কি জোকস-এর বই পড়ার জন্যে?’

‘সরি।’

‘আমি সকাল থেকে লক্ষ্য করছি তুই মুখ ভোঁতা করে বসে আছিস। কারণটা কী?

মীরা কিছু বলার আগেই মনোয়ারা শঙ্কিত গলায় বললেন, ওর শরীর ভালো না। জ্বর।

‘জ্বরটর কিছু না, ও ইচ্ছা করে এ-রকম করছে। আমি গত দুদিন ধরে ওকে লক্ষ্য করছি। এ-রকম একটা ভাব করছে যেন নির্বাসনে এসেছে। হোয়াই? বেড়াতে যেতে হলে নেপালে যেতে হবে? সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে? নিজের দেশে বেড়ানো যায় না? মীরা, তুই অন্যদিকে তাকিয়ে আছিস কেন? তাকা আমার দিকে।’

মীরা বাবার দিকে তাকাল।

‘জোকস-এর বইটা নদীতে ফেলে দে। ফেল বললাম। দ্যাটস এন অর্ডার।’

মীরা বইটা নদীতে ফেলে দিল। বই টুপ করে ডুবল না। ভেসে রইল। দেলোয়ার দুঃখিত চোখে বইটার দিকে তাকিয়ে আছে। আজহারউদ্দিন গম্ভীর গলায় ডাকলেন, দেলোয়ার।

দেলোয়ার ভীত গলায় বলল, জ্বি চাচাজী।

‘নৌকা ঘুরাতে বল্। আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। বাড়িতে ফিরে যাই। মেয়েরা জোকের বই পড়ুক।’

দেলোয়ারকে কিছু বলতে হল না। মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে ফেলল। শেফা খুব খুশি। সব খারাপ জিনিসেরই একটা ভালো দিক আছে। বাবা আপার ওপর রাগ করল বলেই তারা এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারছে, নয়তো দুপুর পর্যন্ত বাথরুম চেপে নদীতে নদীতে ঘুরতে হত। শেফা মনে মনে বলল, আপা থ্যাংকস। আপার জন্যে শেফার বেশ মন খারাপ লাগছে। এতগুলি মানুষের সামনে বেচারি বকা খেল।

মনোয়ারা পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে আজহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, এই তুমি চা খাবে? ফ্লাস্কে করে চা এনেছিলাম।

আজহার সাহেব বললেন, না।

মনোয়ারা মীরার দিকে তাকিয়ে বললেন, চা খাবি? খেয়ে দেখ ঠাণ্ডার মধ্যে চা খেতে ভালো লাগবে। কাপে ঢেলে দেই?

মীরা বলল, মা তুমি একটু সরে বসো তো, আমি বমি করব।

বলতে বলতেই সে হড় হড় করে বমি করল। মনোয়ারা মেয়েকে ধরতে এগিয়ে এলেন। মীরা বলল, মা প্লিজ কাছে এসো না।

শেফার এখন বাবার জন্যে খারাপ লাগছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে আপাকে বমি করতে দেখে বাবার মন খারাপ হয়েছে। অকারণে অসুস্থ মেয়েকে এতগুলি মানুষের সামনে বকা দেয়া হল। শেফার ধারণা বাবার খুব ইচ্ছা করছে বড় মেয়ের কাছে যেতে। চক্ষুলজ্জার জন্যে পারছেন না। শেফা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, আহা চক্ষুলজ্জার মতো অতি সামান্য কারণে মানুষ কত ভালো কাজ করতে পারে না। সে নিজেও পারে না। একবার স্কুল ছুটির পর শেফা গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিল। শাহবাগের মোড়ে সিগন্যালে গাড়ি থামল। বুড়ো এক ভিক্ষুক তার জানালার সামনে মাথা নিচু করে খুবই মিষ্টি গলায় বলল, সুন্দর আফা, একটা টেকা দিবেন? চা খামু। তার কথা বলার ধরন, তার হাসি, শেফার এত ভালো লাগল, কিন্তু চক্ষুলজ্জার জন্যে টাকাটা বের করতে পারল না। উল্টা কঠিন গলায় বলল, যাও মাফ কর। ‘মাফ কর’ বললে যে-কোনো ভিখিরি রাগ করে। এই বুড়ো রাগ না করে ঠিক আগের মতো মিষ্টি করে হাসল। তারপরই চলে গেল অন্য গাড়ির কাছে। শেফার খুবই ইচ্ছা করছিল ভিখিরিটাকে ডাক দিয়ে আনে। ড্রাইভার চাচাকে প্রায় বলেই ফেলছিল, ওকে ডাক দিন তো। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলা হল না। এই বুড়ার কথা শেফার মাঝে মাঝেই মনে হয়।

.

মীরা তার ঘরে শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ, কিন্তু সে জেগে আছে। যেই তাকে দেখবে সেই ভাববে সে গভীর ঘুমে। ঘুমিয়ে থাকার অভিনয় মীরা খুব ভালো পারে। মনোয়ারা এসে সাবধানে গায়ে চাদর টেনে দিলেন। ঘুমন্ত মানুষের গায়ে চাদর টানলে তারা হঠাৎ যেমন কিছু নড়াচড়া করে সেও তাই করল। এবং নিজের অভিনয় প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হল। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। ঘরে হারিকেন দেয়া হয়েছে। হারিকেনের আলোয় ঘরটা আরো অন্ধকার লাগছে। এই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে। পল্লী বিদ্যুত। পল্লী বিদ্যুতের নিয়ম হল রাত দশটার পর কারেন্ট আসে। বাকি রাতটা মিটিমিটি করে বাতি জ্বলে সকালবেলায় আর কারেন্ট নেই। মানুষজন এতেই খুশি। গ্রামে ইলেকট্রিসিটি আছে এই আনন্দই তাদের রাখার জায়গা নেই। দেলোয়ার তাকে বলছিল, বুঝছেন আপামণি শহর বন্দরে যেমন ঘনঘন কারেন্ট যায়, আমাদের এইখানে যায় না। দশটা-এগারোটার সময় বিদ্যুত আসে। একবার আসলে আর যাওয়া—যাওয়ি নাই। সক্কালবেলায় যাবে। তাও বেলা উঠলে

মীরা বলল, আপনাদের তো খুবই সুবিধা।

দেলোয়ার সবক’টা দাঁত বের করে বলল, বিদ্যুতের সুবিধা আমাদের আছে এইটা অস্বীকার যাবে না।

দেলোয়ার লোকটাকে মীরার পছন্দ হয়েছে। খুব হাসিখুশি। শুধু একটা সমস্যা যখন-তখন হুট করে ঘরে ঢুকে পড়ে। মেয়েদের ঘরে যে যখন-তখন ঢোকা যায় না এই ব্যাপারটা বোধহয় জানে না। তাকে জানিয়ে দিতে হবে। কিছুক্ষণ আগে দেলোয়ার ঘরে ঢুকেছিল। মীরা খুব সাবধানে চোখ ফাঁক করে তাকিয়ে রইল। যাতে দেলোয়ার ধরে নেয় সে ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত মেয়ের ঘরে ঢুকে পুরুষরা বিচিত্র সব আচরণ করে। এই লোকটাও সে-রকম কিছু করে কি না তাই মীরার দেখার ইচ্ছা। হয়তো কাছে আসবে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে। কিংবা খুব সাবধানে গায়ের কাপড়টা ছুঁয়ে দেখবে। অতিরিক্ত রকমের সাহসী হলে গালে হাত দেবে। দেলোয়ার অবশ্যি তেমন সাহসী না। ভয়েই মানুষটা ছোট হয়ে গেছে।

দেলোয়ার ঘরে ঢুকে অভদ্র ধরনের কিছুই করল না। মীরার দিকে তাকাল পর্যন্ত না। মীরার পায়ের কাছের জানালা বন্ধ করে দিল। কয়েকটা ঝাঁকি দিয়ে টেবিলে রাখা হারিকেনের তেল পরীক্ষা করল। তারপর যেমন হুট করে এসেছিল তেমনি হুট করে চলে গেল। যত ভালো আচরণই করুক দেলোয়ার যেন ভবিষ্যতে ঘরে না ঢোকে এই ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তার আপামণি ডাক বন্ধ করতে হবে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসী একটা মানুষ তাকে আপামণি ডাকবে কেন? মীরার বয়স মাত্র একুশ। লোকটা অশিক্ষিত মূর্খ হলে একটা কথা ছিল। তাতো না। বি. এ. পাশ। একটা গ্রাজুয়েট ছেলে চাকর স্বভাবের হয়ে গেছে কী করে? অবলীলায় ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। খালিগায়ে বালতি করে পানি নিয়ে আসছে। চোখে চোখ রেখে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। কথাও বলছে চাকরদের মতো মিনমিন করে।

মনোয়ারা মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে ট্রে। ট্রেতে দু কাপ চা। এক গ্লাস পানি। পিরিচে কয়েকটা তিলের নাড়ু। বড় মেয়ের সঙ্গে বসে চা খাওয়া মনোয়ারার খুব পছন্দের একটা ব্যাপার। মনোয়ারা মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, মীরা ঘুমুচ্ছিস?

মীরা উঠে বসতে বসতে বলল, দিলে তো ঘুম ভাঙিয়ে।

‘সন্ধ্যাবেলা ঘুমুতে নেই, শরীর খারাপ করে। নে তোর জন্যে চা এনেছি। কুলি করে চা খা।’

‘কুলি ফুলি করতে পারব না। দাও চা দাও।’

‘শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে রে মা?’

‘হুঁ লাগছে।’

‘তোর বাবার উপর খুব রাগ করেছিস না?’

‘খুব না, সামান্য করেছি।’

‘তোকে বকা দিয়ে তোর বাবাও খুব মনে কষ্ট পাচ্ছে। একটু পরপর জিজ্ঞেস করছে তোর শরীর কেমন।’

‘বাবাকে বলেছ যে আমার শরীর এখন ভালো?’

‘না বলিনি। একটু কষ্ট পাক। যখন-তখন সবার সামনে বকাঝকার অভ্যাস যদি কমে।’

‘বাবার শখের নৌকাভ্রমণ নষ্ট করলাম।’

‘নষ্ট করবি কেন? নৌকাতো ঘাটেই বাঁধা আছে। কাল যাওয়া যাবে।’

‘বাবার পরিকল্পনা জানো মা? আমরা ক’দিন গ্রাম থাকব?’

‘কোর্ট তো উইন্টারের বন্ধ। ক’দিন যে থাকে।’

‘ছ’দিন থেকেই আমার অসহ্য লাগছে। বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যায় না? একটু বলে দেখ না।’

‘এখন বলা যাবে না। আরো কয়েকটা দিন থাক। তোর গ্রাম ভালো লাগে না?’

‘না মা, লাগে না। গ্রামে আসা মানেই গাদা-গাদা গরিব মানুষ দেখা। সারাক্ষণ এরা আমাদের দেখছে আর মনে মনে ভাবছে আহা এরা কত সুখী। আমার খুবই অস্বস্তি লাগে।’

‘মানুষজনের কথা বাদ দে। গ্রাম দেখতে কত সুন্দর। গাছপালা, নদী I তোদের এই বাড়িটারও কত সুন্দর। কত বড় দোতলা বাড়ি। বাড়ির সঙ্গে বাঁধানো পুকুর। কত সুন্দর ফলের বাগান। ‘

‘মা চুপ করো তো। ভাঙা বাড়ি—সাপের আড্ডা। মজা এক পুকুর।’

মনোয়ারা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমার কাছে খুব ভালো লাগে। আমি ঠিক করেছি তোর বাবা রিটায়ার করার পর এখানে এসে থাকব।

‘ঢাকার বাড়ি কী করবে?’

‘তোদের দু-বোনকে দিয়ে দিব। আমরা বুড়োবুড়ি থাকব গ্রামে।’

‘বলতে ভালো লাগে। বুড়োবুড়ি হও তখন দেখবে আর গ্রামে থাকতে ইচ্ছা করবে না। আর তখন গ্রামে থাকা ঠিকও হবে না। তোমাদের তখন দরকার সার্বক্ষণিক মেডিকেল কেয়ার। গ্রামে ডাক্তার কোথায়? প্র্যাকটিক্যাল হতে হবে মা। পথের পাঁচালীর গ্রাম বইএ পড়তে ভালো। থাকার জন্যে ভালো না।

মনোয়ারা উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর সবসময়ই ভালো লাগে। আজ বেশিক্ষণ কথা বলতে পারছেন না। তাঁকে রান্নাঘরে যেতে হবে। তাঁর শাশুড়ি আজিদা বেগম ঝাল পিঠা বানাচ্ছেন। তিনি চান বৌ পিঠা বানানো দেখুক। শিখতে চাইলে শিখুক।

মীরা বলল, উঠছ কেন মা। বোস না।

‘বসতে পারব না। শাশুড়ি আম্মা পিঠা বানাচ্ছেন তাঁর কাছে বসতে হবে।’

‘শাশুড়ি আম্মা বলতে বলতে বিনয়ে ভেঙে পড়ে যাচ্ছ কেন মা। তাও যদি তোমার আপন শাশুড়ি হত। বাবার সৎ মা। তোমার সৎ শাশুড়ি।’

‘হোক সৎ শাশুড়ি। কেমন আদর সবাইকে করে সেটা দেখবি না! গ্রামের বাড়ির জন্যে তোর বাবা এত যে ব্যস্ত তার প্রধান কারণ উনি। তোর বাবা গ্রামে আসে মায়ের আদর নেবার জন্যে।

‘আদর নেবার এই ব্যাপারটাও আমার কাছে খুব হাস্যকর লাগে। বুড়ো একজন মানুষ নলা বানিয়ে মুখে ভাত তুলে দেয়া। ছিঃ দেখলেই আমার গা ঘিন ঘিন করে। সৎ দাদীকে বলো তো মা এই কাণ্ডগুলি যেন উনি আমাদের চোখের আড়ালে করেন।’

মনোয়ারা লজ্জিত গলায় বললেন, গ্রামের আদরতো এইরকমই। পুরো প্লেটের ভাত তো আর খাওয়ান না, এক-দুটা নলা মুখে তুলে নেন। নিজের ছেলেপুলে হয়নি। তোর বাবা ছিল তাঁর চোখের মণি। মীরা, তুই কি পিঠা খাবি? আনব তোর জন্যে?

‘ঝাল পিঠা আমি খাই না। তাছাড়া আমার শরীর ভালো লাগছে না। রাতে আমি কিছুই খাব না। মা শোনো, তুমি কি একটা কাজ করবে?’

‘কী কাজ।’

‘দেলোয়ার লোকটাকে বলবে সে যেন হুটহাট করে আমার ঘরে না ঢোকে। সন্ধ্যাবেলা ঘুমুচ্ছি, হুট করে ঘরে ঢুকে পড়ল।’

‘গ্রামের ছেলে তো। এই ব্যাপারগুলি জানে না।’

‘তুমি কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন মা। তুমি তাকে বলে দেবে সে যেন আমার ঘরে এইভাবে না ঢোকে।’

‘আচ্ছা আমি বলে দেব।’

‘সে আমাকে আপামণি ডাকে। অসহ্য। তাকে বলবে যেন আপামণি না ডাকে।’

‘আচ্ছা।’

‘মা তোমার সঙ্গে আরেকটা শেষ কথা। আমি যে নৌকায় বলেছিলাম তোমার গা থেকে কাদামাটির গন্ধ আসে। আসলেই আসে।’

‘ও আচ্ছা।’

‘কিন্তু এই গন্ধটা যে আমার কী ভালো লাগে তুমি জানো না। তুমি রাতে ঘুমুতে যাবার আগে তোমার গায়ের গন্ধ আমাকে দিয়ে যাবে। ব্লাউজ খুলে আমি তোমার বুকে নাক ঘষব।’

মনোয়ারা বিরক্ত মুখে বললেন, ‘তুই কী যে হচ্ছিস!’ তাঁর বিরক্তির অভিনয়টা তেমন ভালো হল না। তাঁর মুখ আনন্দে ঝলমল করতে লাগল।

বারান্দায় দেলোয়ার একটা মাটির মালশা নিয়ে আসছে। মালশা থেকে ঝুকা ঝুকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়ায় দেলোয়ার চোখ মেলতে পারছে না, এমন অবস্থা। মনোয়ারা বললেন, মালশায় কী দেলোয়ার?

দেলোয়ার লজ্জিত হয়ে বলল, ‘ধূপ চাচীআম্মা।’ তাকে যে-কোনো প্ৰশ্ন করলেই সে খানিকটা লজ্জা পায়।

‘ধূপ জ্বালিয়েছ কেন?’

‘মশার খুব উপদ্রব। আপামণির ঘরে ধোঁয়া দিব।’

মনোয়ারা খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, মেয়েদের ঘরে ঢোকার সময় দরজা ধাক্কা দেবে, কেমন?

দেলোয়ার লজ্জায় প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে বলল, জ্বি আচ্ছা।

‘ধোঁয়া না দিলেও হবে। এরা শহরের মেয়ে, ধোঁয়া পছন্দ করবে না।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘শীতের মধ্যে পাতলা একটা শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুরছ কেন? শীত লাগে না? তোমার গরম কাপড় আছে?’

‘জি।’

‘গরম কিছু পরবে। তোমাকে দেখে তো আমারই শীত লাগছে। শেফাকে দেখেছ? শেফা কোথায়?’

‘ছোট আপামণি পুকুরঘাটে।’

‘আশ্চর্য তো, রাতের বেলা সে পুকুরঘাটে কী করে? ওকে ঘরে আসতে বল।’

‘জ্বি আচ্ছা চাচীজী।’

দেলোয়ার মালশা নিয়ে অতি দ্রুত পুকুরঘাটের দিকে রওনা হল। মনোয়ারা রান্নাঘরের দিকে চললেন। তাঁর রান্নাঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। পুকুরঘাটের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে।

এই বাড়ির পুকুরঘাটটা মনোয়ারার খুব পছন্দ। ছোট্ট বাঁধানো ঘাট, যেন বাড়ির বৌ-ঝিদের জন্যেই করা হয়েছে। বারোয়ারি ব্যাপার না। বিশাল এক কামরাঙ্গা গাছ ঘাটের ওপর ছায়া ফেলেছে। মনোয়ারার ধারণা পৃথিবীর সবচে সুন্দর গাছ কামরাঙ্গা গাছ। কী অদ্ভুত তার চিরল চিরল পাতা।

শেফা চোখমুখ শক্ত-শক্ত করে ঘাটে বসে আছে। চোখমুখ শক্ত করার কারণ একটু আগেই সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। ভূতের ভয়। তার মন খুব খারাপ ছিল বলে সে একা-একা ঘাটে এসে বসেছিল। বসার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গা ছমছম করতে লাগল। মনে হল সে একা না, তার আশেপাশে আরো কেউ আছে। একজন তো মনে হল ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে। সেই একজন অল্পবয়েসী একটা ঘোমটা-দেয়া বউ। তার শাড়ির শব্দ, হাতের চুরির শব্দ পর্যন্ত শেফা পেতে শুরু করল। মনে হচ্ছে এই মেয়েটার মতলব ভালো না, সে এসে শেফার পাশে বসবে। ঘোমটার ভেতর দিয়ে তার দিকে তাকাবে এবং একসময় হাত ধরে টানতে টানতে পানিতে নিয়ে যাবে। ঠিক এ-রকম একটা গল্প সে দেব সাহিত্য কুটিরের বইএ পড়েছিল। সেই গল্পেও গ্রামের পুকুরঘাট থেকে বাচ্চা একটা ছেলেকে ঘোমটা-পরা বউ ভুলিয়ে ভালিয়ে পানিতে নিয়ে ডুবিয়ে মারে।

শেফার বুক ধকধক করছে। চিৎকার করে কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ওপর তার প্রচণ্ড রাগও হচ্ছে। কেন সে একা-একা ঘাটে এল, কী দরকার ছিল। শেফার মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখনি মালশা হাতে দেলোয়ার চলে চল। এত শাস্তি শেফা তার জীবনে পায় নি। ও না, ভুল হয়েছে। এ-রকম শাস্তি শেফা আরেকবার তার জীবনে পেয়েছিল। সেটা খুবই গোপন ব্যাপার কাউকে বলা যাবে না।

‘ছোট আপা, চাচীজী যেতে বলেছে।’

শেফা পা দোলাতে দোলাতে বলল, বলুক।

দেলোয়ার বলল, একা একা বসে আছেন, ভয় লাগে না?

‘ভয় লাগবে কেন? একা একা বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে। দেলোয়ার ভাই, শুনুন। আপনাকে থ্যাংকস দেয়া হয়নি। মেনি থ্যাংকস। চশমার জন্যে।’

দেলোয়ার হাসল। অন্ধকারে তার হাসি দেখা গেল না। দেলোয়ারের ধারণা সে তার জীবনে এমন সরল সাদাসিধা মেয়ে দেখেনি। আজ সকালে নৌকায় উঠতে গিয়ে মেয়েটার চোখ থেকে চশমা পরে গেল। মেয়েটা তা নিয়ে একটা শব্দ করল না। বোঝা যাচ্ছে সে তার বাবার ভয়ে চুপ করেছিল।

দুপুরবেলা দেলোয়ার নদীতে নেমে চশমা উদ্ধার করে। মেয়েটাকে চশমাটা দেয়ার পর সে চশমা রেখে পরতে পরতে বলে—আচ্ছা ঠিক আছে। যেন সে জানতই দেলোয়ার চশমা নিয়ে আসবে। চশমার জন্যে ধন্যবাদটা এই মেয়ে এখন দিচ্ছে।

‘দেলোয়ার ভাই।’

‘জ্বি।’

‘দুপুরবেলা আপনি যখন আমাকে চশমাটা দিলেন তখন আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। আপনি যে নদীতে চশমা পড়াটা লক্ষ্য করেছেন আমি বুঝতে পারি নি। আপনি বোধহয় আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারেননি যে আমি ভয়ংকর অবাক হয়েছি। বুঝতে পেরেছিলেন?’

‘না।’

‘আমার হচ্ছে স্টোন-ফেস। আমার চেহারা দেখে কেউ বুঝতে পারে না, আমি অবাক হচ্ছি না-কি দুঃখিত হচ্ছি। না-কি খুশি হচ্ছি। আমার ফেস এক্সপ্রেশন লেখ।’

‘ও আচ্ছা।’

‘এক্সপ্রেশন লেখ ফেস মানুষের কখন হয় জানেন?’

‘জ্বি না।’

‘যদি চোখ ছোট হয়, ঠোঁট মোটা হয় এবং গালের চামড়া শক্ত হয় তাহলে ফেস এক্সপ্রেশন লেখ হয়ে যায়। কারণ হচ্ছে মানুষের এক্সপ্রেশন হল চোখে আর ঠোঁটে।’

‘ও।’

‘বেশিরভাগ সময় আমি মন খারাপ করে থাকি ফেস এক্সপ্রেশন লেখ বলে কেউ বুঝতে পারে না। আজ সারাদিন আমার খুবই মন খারাপ ছিল।’

‘কেন?’

‘চশমাটা নদীতে পড়ে গেল। সারাদিন চশমা ছাড়া ঘুরছি অথচ কেউ বুঝতেই পারছে না। মা, বাবা, আপা কেউ একবার বুঝতেও পারল না যে আমার চশমা হারিয়েছে। অথচ আপার গালে যদি একটা মশাও কামড় দিত, সবাই বুঝতো। মা চমকে উঠে বলত—কী সর্বনাশ তোর গায়ে কি মশা কামড়েছে। বাবা বলত, মীরা মা তোমার লাল দাগ কিসের। আমার বেলা ঠিক উল্টা। আমার যদি ড্রাকুলার মতো দুটা দাঁত বড় হয়ে ঠোঁটের বাইরেও চলে আসে কেউ বুঝবে না। সবাই ভাববে জন্ম থেকেই আমার দাঁত এ-রকম।’

‘ছোট আপা চলেন ঘরে যাই, চাচীজী ডাকেন।

‘ডাকুক আমি ঘরে যাব না। আপনার কাজ থাকলে আপনি চলে যান। আপনি যদি ভাবেন একা থাকলে আমি ভয় পাব—আপনি খুবই ভুল করছেন। আর আপনি যদি আমার সঙ্গে বসে গল্প করতে চান গল্প করতে পারেন।’

দেলোয়ার বসল। ভেতরে ভেতরে সামান্য উসখুস করতে লাগল। ঘরে খাওয়ার পানি আছে কি-না বুঝতে পারছে না। এই গ্রামে একটা টিউবওয়েল দিয়ে ভালো পানি আসে—মুনশিবাড়ির টিউবওয়েল। বাকি সবগুলিতে আয়রন। পানি কিছুক্ষণ রাখতেই লাল হয়ে যায়। ভাবে, আর দুই কলসি পানি এনে দিতে হবে।

‘দেলোয়ার ভাই!’

‘জ্বি।’

‘এই পুকুরে মাছ আছে?’

‘পোনা ছাড়া হয় না। তবে মাছ আছে। পুরানা পুকুর তো, বিরাট বিরাট মাছ আছে। ঘাই দেয়।’

‘ঘাই দেয় মানে কী? ‘

‘পানির মধ্যে শব্দ করে। জানান দেয়।’

‘কাল আমাকে একটা বঁড়শি এনে দেবেন আমি মাছ ধরব।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন একবার বড়শি দিয়ে একটা টেংরা মাছ ধরেছিলাম। টেংরা মাছটার রঙ ছিল সবুজ আমার পরিষ্কার মনে আছে। বড় আপা কী বলে জানেন? বড় আপা বলে—মাছ ধরার এই ব্যাপারটা নাকি আমার স্বপ্নে ঘটেছে। কারণ মাছ কখনো সবুজ হয় না।’

‘টেংরা মাছের শরীরে সবুজ দাগ থাকে।’

‘আমার মাছটা পুরোটাই ছিল সবুজ।’

‘ও আচ্ছা।’

‘দেলোয়ার ভাই!’

‘জ্বি।’

‘আমার শেফা নামটা কি আপনার পছন্দ?’

‘জ্বি পছন্দ। খুব সুন্দর নাম।’

‘মোটেই সুন্দর নাম না। খুব খারাপ নাম। শেফা মানে জানেন?’

‘না।’

‘শেফা মানে হল আরোগ্য। আমাকে দেখলেই লোকজনের আরোগ্যের কথা মনে হবে। সেখান থেকে মনে হবে অসুখের কথা।’

‘আমার সে-রকম মনে হচ্ছে না।’

‘ঢাকায় গেলে অনেক ক্লিনিকের নাম দেখবেন—শেফা নার্সিং হোম। শেফা ক্লিনিক। বিশ্রী ব্যাপার।

‘ছোট আপা আমি যাই, আমার পানি আনতে হবে।’

‘কাল মনে করে আমার বঁড়শি আনবেন।’

‘জ্বি আচ্ছা। কিন্তু বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরলেও এই পুকুরের মাছ খেতে পারবেন না।’

‘খেতে পারব না কেন?’

‘আপনার দাদা এই পুকুরের মাছ তাঁর বংশের কারোর খাওয়া নিষিদ্ধ করে গেছেন। অন্যরা খেতে পারবে। কিন্তু তার বংশের কেউ খেতে পারবে না।’

‘সেকি! কেন?’

‘আমি জানি না ছোট আপা।’

‘আমার বাবা কি কারণটা জানেন?’

‘জানতে পারেন। বেশিক্ষণ থাকবেন না আপা। ভয় পেতে পারেন।’

‘শুধু শুধু ভয় পাব কেন?’

শেফা ভয় পাচ্ছে। দেলোয়ার ভাই চলে যাবার পর থেকে ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। মস্ত বড় বোকামি হয়ে গেছে। তার উচিত ছিল দেলোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে চলে যাওয়া। এই পুকুরের মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ। নিশ্চয়ই এরও ভয়ংকর কোনো কারণ আছে। আচ্ছা ভূত-প্রেত এরা কি মাছ খায়? শেফার মাথার উপরের কামরাঙ্গা গাছের পাতা দুলছে। শেফা আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেল। বাতাস নেই, কিচ্ছু নেই, পাতা দুলছে কেন?

২. আজহার সাহেব রোদের আশায়

আজহার সাহেব রোদের আশায় বারান্দায় বসে আছেন। রোদ উঠছে না। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে। এমন ঘন যে দশহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। তাঁর ইচ্ছা মেয়েদের নিয়ে বাগানে বসে খেজুরের রস খাবেন। নিজের গাছের রস। কলসি ভর্তি রস দেলোয়ার নামিয়ে এনেছে। সেই রস কাপড়ের ছাঁকনিতে ছাঁকা হচ্ছে। রসের মিষ্টি গন্ধটাও মনে হয় শীত বাড়িয়ে দিচ্ছে। গন্ধের সঙ্গে কি শীতের সম্পর্ক আছে? রঙের সঙ্গে যে সম্পর্ক আছে তা তিনি জানেন। কিছু রঙকে বলাই হয় উষ্ণ রঙ, ওয়ার্ম কালার—যেমন লাল, হলুদ। কিছু রঙ আবার ঠাণ্ডা রঙ —যেমন নীল।

মনোয়ারা চায়ের মগ নিয়ে বারান্দায় এলেন। আজহার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কই শেফা আর মীরাকে বলেছ?

মনোয়ারা কুণ্ঠিত গলায় বললেন, ওরা আসবে না।

‘আসবে না কেন? বাগানে বসে খেজুরের রস খাবে কত ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। টাটকা রস। ঢাকায় এই জিনিস পাবে কোথায়?’

‘মীরা শুয়ে আছে। ওর শরীর ভালো যাচ্ছে না।’

‘সবসময় এক অজুহাত দিও না। শরীর ভালো যাচ্ছে না মানে কী? এমন একটা ভাব সে ধরে আছে যেন তাকে আন্দামান দ্বীপে এনে ফেলা হয়েছে।’

মনোয়ারা বললেন, ওরা ওদের মতো করে থাকুক। চল আমরা দুজন বাগানে যাই। যাবে? দাঁড়াও আমি একটা চাদর নিয়ে আসি।

আজহার সাহেব হ্যাঁ না কিছু বললেন না। তাঁর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভেবে রেখেছেন রস খাবার পর মেয়েদের নিয়ে হাঁটতে বের হবেন। উত্তর বন্ধে মটরশুঁটির ক্ষেতের দিকে যাবেন। দেলোয়ার সঙ্গে যাবে। দেলোয়ারের সঙ্গে থাকবে কেরোসিনের চুলা এবং পানি গরম করার পাত্র। মটরশুঁটির ক্ষেতে বসে মটরশুঁটি সিদ্ধ ক্বা হবে। তারপর খোসা ছাড়িয়ে মটরশুঁটি খাওয়া।

আজহার সাহেবের দাদা মুনশি হেলালউদ্দিন এই বাগান করেছিলেন। মুনশি হেলালউদ্দিন মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। এক রাতে স্বপ্নে তিনি কয়েকটা রোগের ঔষধ পেয়ে যান। শিক্ষার পাশে-পাশে লোকজনদের অষুধ দেয়া শুরু করেন। কামেলা রোগের অষুধ এবং সূতিকার অষুধ। তাঁর যখন খুব নাম-ডাক হল, দূরের গ্রাম থেকে বোতল নিয়ে অষুধের জন্য লোকজন আসতে শুরু করল, তখন তিনি হঠাৎ চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন। তাঁকে নাকি অষুধ না-দিতে স্বপ্নে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অষুধ নিতে এসে লোকজন ফেরত যেতে শুরু করল। এতে তাঁর নাম আরো ছড়িয়ে পড়ল। লোকজনের ভিড় বেড়ে গেল। তার কিছুদিন পর গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল মুনশি হেলালউদ্দিন পীরাতি পেয়েছেন। `শুধু যে পীরাতি পেয়েছেন তাই না, তাঁর পোষা দুটা জ্বীনও আছে। রাতে দরজা বন্ধ করে তিনি জ্বীনদের সঙ্গে কথা বলেন। জ্বীনদের সঙ্গে জিকির করতে বসেন। নতুন পীর সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ এবং পানিপড়া নেবার জন্যে দলে দলে লোক আসতে লাগল। তিনি পানিপড়া এবং তাবিজ দিতে শুরু করলেন। অবিবাহিত মেয়েদের দিতেন সূতাপড়া। কালো রঙের সূতায় ফুঁ দিয়ে দিতেন। সেই সূতা খোঁপায় চুলের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হত। সূতা বাঁধার দশদিনের ভেতর বিয়ের সম্বন্ধ আসত। নিয়ম হচ্ছে প্রথম যে-সম্বন্ধ আসবে সেখানেই মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। খোঁপায় সূতা বাঁধা অবস্থায় আসা সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেয়া যাবে না।

মুনশি হেলালউদ্দিন পীরাতি করে অনেক টাকাপয়সা জমিজমা করেছিলেন। তিনিই প্রথম এই অঞ্চলে পাকা বাড়ি তোলেন। বাড়ির নাম হয়ে যায় পীরবাড়ি।

হেলালউদ্দিন সাহেবের শেষ জীবন সুখের হয়নি। মাথাখারাপের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। রাতে বা দিনে কখনোই ঘুমাতে পারতেন না। শেষ রাতের দিকে কিছুক্ষণের জন্যে ঝিমুনি আসত, তিনি চোখ বন্ধ করেই সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠতেন। সবার ধারণা তাঁর পোষা দুটা জ্বীন বিগড়ে গিয়েছিল। তারাই তাঁকে যন্ত্রণা করত। জ্বীন দুটার একটার নাম হবিব আর একটার নাম জাবির। দুজনের বয়সই চারশ’র উপর। দুটাই অবিবাহিত। এদের বাড়ি কোহকাফ নগরে। এদের মধ্যে একজন জ্বীন (হবিব) আগে হিন্দু ছিলেন পরে মুসলমান হয়েছেন।

লোকশ্রুতি হল মুনশি হেলালউদ্দিন মৃত্যুর সময় ইচ্ছা করে জ্বীন দুটাকে আজাদ করে যাননি। তারা পীরবাড়িতেই আটকা পড়ে আছে। আমৃত্যু তাই থাকবে। গ্রামের অনেক লোক পীরবাড়ির ছাদে দুটা আগুনের হলকাকে নাচানাচি করতে দেখেছে। কেউ কেউ এখনো দেখে।

মনোয়ারা এবং আজহার সাহেব খেজুরের রসের গ্লাস হাতে নিয়ে মুনশি হেলালউদ্দিন সাহেবের শখের বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আম-কাঁঠালের বাগান, মাঝখানে কয়েকটা জলপাই গাছ আছে। জলপাই গাছের জায়গাটা আসলেই সুন্দর। জলপাই গাছের শুকনো পাতার রঙ গাঢ় লাল। শুকনো পাতা পড়ে গাছের নিচটা এমন হয়েছে যে মনে হয় কেউ লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। দু বছর আগে সবচে বড় জলপাই গাছের গুঁড়ি আজহার সাহেব বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। এখন তিনি সেই বাঁধানো গাছের নিচে বসে আছেন।

মনোয়ারা বললেন, প্রায় দশ বছর পর খেজুরের রস খাচ্ছি।

আজহার সাহেব বললেন, খেতে কেমন লাগছে?

মনোয়ারা মুগ্ধ গলায় বললেন, ভালো। খুবই ভালো। বলতে বলতে আগ্রহ নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিলেন। আসলে তাঁর মোটেই ভালো লাগছে না। কেমন বমি চলে আসছে, গন্ধটাও খারাপ– কেমন পচা-পাতা পচা-পাতা গন্ধ।

স্বামীকে খুশি করার জন্যে রস খেয়ে মুগ্ধ হবার অভিনয় তাঁকে করতে হচ্ছে। একজন আদর্শ মহিলাকে অভিনয় করায় অত্যন্ত পারদর্শী হতে হয়। তাদের জীবনের একটা বড় অংশ কাটে আনন্দিত এবং মুগ্ধ হবার অভিনয় করে।

শুকনো পাতা মাড়িয়ে দেলোয়ার আসছে। দেলোয়ারের গায়ে মাপে বড় হলুদ রঙের একটা কোট। কোটটা আজ সকালেই মনোয়ারা দেলোয়ারকে দিয়েছেন। আজহার সাহেবের কোট। পুরানো হলেও এখনো ভালো। দেলোয়ারের হাতে কেরোসিনের চুলা, এলুমিনিয়ামের একটা কড়াই। মটরশুঁটি সিদ্ধ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে সে এসেছে।

‘চাচাজী চলেন যাই।’

আজহার সাহেব বললেন, দেলোয়ার থাক বাদ দাও।

মনোয়ারা বললেন, বাদ থাকবে কেন? চল আমরা দুজন যাই।

‘মেয়েরাই ব্যাপারটা এনজয় করত, ওরা যখন যেতে চাচ্ছে না তখন থাক। দেলোয়ার তুমি চলে যাও।’

দেলোয়ার চলে গেল। চাচাজীর সামনে থেকে যে সে সরে পরার সুযোগ পেয়েছে তাতেই সে খুশি। আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মা নাস্তা বানাচ্ছেন, তুমি মাকে সাহায্য কর। আর আমার জন্যে এখানে চা পাঠিয়ে দিও।

‘রোদ ওঠেনি। তুমি কুয়াশার মধ্যে একা বসে থাকবে? ঠাণ্ডা লাগবে তো। ঘরে চলে এসো।’

‘কুয়াশা থাকবে না, রোদ উঠবে।’

মনোয়ারা চলে গেলেন। বাগানে একা-একা হাঁটতে আজহার সাহেবের খারাপই লাগছে। মটরশুঁটি খাবার আইডিয়াটা ভালো ছিল। মেয়েরা রাজি হল না। মেয়েরা অনেক দূরে সরে গেছে। গ্রামের মধ্যে বন্ধুবান্ধব নেই, টেলিফোন নেই, টিভি নেই, মিউজিক সিস্টেম বা শপিং নেই, কাজেই তিনি ধারণা করেছিলেন তারা কাছাকাছি আসবে। বাধ্য হয়েই বাবার সঙ্গে কিছু সময় কাটাবে। তিনি তাদের সঙ্গে নানান গল্প-গুজব করবেন। ওরা কী ধরনের গল্প পছন্দ করে তা তিনি জানেন না। মামলার কিছু ইন্টারেস্টিং গল্প আছে, সেইসব গল্প করা যেতে পারে। স্টেট ভার্সেস শিউলি রানীর মামলাটা তাদের পছন্দ হবার কথা। এই মামলাটায় কিছু অস্বাভাবিক এবং নোংরা ব্যাপার আছে। এই ব্যাপারগুলি বাদ দিয়ে বলতে হবে। মামলার যেদিন রায় হয় তার আগের দিন শিউলি রানী হঠাৎ ঘোষণা দিল সে আসলে নারী না, পুরুষ এবং বিজ্ঞ আদালতকে বলল তাকে ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর জন্য। আদালত স্তম্ভিত। কারণ শিউলি রানী বিবাহিতা, তার দুটা ছেলে আছে। স্বামী জীবিত… . এই গল্প এদের পছন্দ না হয়েই পারে না।

চায়ের কাপ হাতে শেফা আসছে। এক হাতে চায়ের কাপ অন্য হাতের পিরিচে দুটা ভাপা পিঠা। মেয়েকে দেখে আজহার সাহেবের মনখারাপ ভাবটা দূর হয়ে গেল। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, গুড মর্নিং মা। শেফা বলল, গুড মর্নিং। তোমার জন্যে চা আর পিঠা নিয়ে এসেছি।

‘খুব ভালো করেছিস।’

‘চা মনে হয় আনতে আনতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তোমাদের গ্রামে এত শীত কেন বাবা?’

‘তোমাদের গ্রাম বলছিস কেন? এটাতো তোরও গ্রাম। তোর গ্রাম কি আলাদা? মীরার ঘুম ভাঙে নি?’

‘ভেঙেছে। চা খেয়ে আবার লেপের ভেতর ঢুকে গেছে। আপা বলেছে রোদ না উঠলে সে লেপ থেকে বের হবে না।’

‘তোর রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?’

‘ঘুম ভালো হয়েছে। তবে ঘুমুতে গেছি অনেক রাতে।’

‘কেন?’

‘কাল শোয়া নিয়ে খুব সমস্যা হয়েছে। প্রথমে গেলাম আপার সঙ্গে ঘুমানোর জন্যে। আপা রাজি হল না। তারপর একা-একা ঘুমুতে গেলাম। প্ৰায় ঘুম চলে এসেছে তখন দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খুলে দেখি দাদীমা, উনি না-কি আমার সঙ্গে ঘুমুবেন। দাদীমা অনেক রাত জেগে গল্প করলেন।’

‘তাহলে তো ভালোই মজা হয়েছে।’

‘খুবই মজা হয়েছে বাবা।’

শেফার আসলে কোনোই মজা হয় নি। দাদীমা রাতে একফোঁটা ঘুমায়নি, সারাক্ষণ কথা বলেছে। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেছেন যে শেফা হতভম্ব। যেমন হঠাৎ শেফার বুকে হাত দিয়ে বলেছেন—‘কিরে বেটি দুধ এত ছোট ক্যান?’ শেফা প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, দাদীমা যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বললেন-—

হরিণ সুন্দর চোখে
নারী সুন্দর বুকে।

শেফা বলল, দাদীমা গায়ে হাত দিও না। কাতুকুতু লাগে। তিনি কুটকুট করে হাসতে হাসতে বললেন, জামাটা খোল্‌ বুক কেমন দেখি।

কী আশ্চর্য কথা। এইসব তো আর কাউকে বলা যায় না। বলা ঠিকও হবে না। দাদীমা কিছু উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করলেও মানুষটা খুবই ভালো। শেফার তাকে মোটামুটি পছন্দ হয়েছে।

‘দাদীমার সঙ্গে কী গল্প হল রে শেফা?’

‘অনেক গল্প হয়েছে। বেশির ভাগ গল্পই দাদাজানকে নিয়ে। দাদাজান নাকি তারজন্যে একেবারে পাগল ছিল। তিনি চোখের আড়াল হলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতেন। বাইরের লোকজন এসেছে দাদাজানের সঙ্গে কথা বলতে, তখনো নাকি দাদীজানকে খুব কাছেই পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এমন জায়গায় দাঁড়াতে হত যেন পর্দার নিচে দিয়ে দাদাজান তাঁর পা দেখতে পান কিন্তু বাইরের লোকজন কিছু দেখতে পায় না। বাবা এইসব কি সত্যি?

‘হুঁ সত্যি। বাবা স্ত্রৈণ প্রকৃতির ছিলেন। আমার মা অত্যন্ত ভাগ্যবতী।’

‘এইরকম ভাগ্যবতী হলে আমি বিষ খেয়ে মরে যাব। একটা পুরুষ সারাক্ষণ চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ভাবতে তো কুৎসিত লাগছে। ছিঃ।’

আজহার সাহেব হেসে ফেললেন। শেফার কথাবার্তা তাঁর ভালো লাগছে। মেয়েটা তো বেশ মজা করে কথা বলে।

‘বাবা!’

‘উঁ।’

‘দাদাজান নাকি মৃত্যুর আগে-আগে ঘোষণা করেছিলেন এই পুকুরের মাছ তার বংশধরেরা কেউ খেতে পারবে না। তাদের জন্যে পুকুরের মাছ নিষিদ্ধ।’

‘তা বলেছিলেন।’

‘কেন বলেছিলেন?’

‘তাতো মা জানি না। বাবা মারা যাবার সময় আমি গ্রামে ছিলাম না। আমি থাকলে জিজ্ঞেস করতাম।’

‘তুমি এই পুকুরের মাছ খাও না?’

‘আমি কি এখানে থাকি যে মাছ খাব?’

‘মাছ যদি মারা হয় তুমি খাবে?

‘কী দরকার? একজন মানুষ মৃত্যুর আগে একটা কথা বলে গেছে। কথাটা মানতে অসুবিধা কী?’

‘আমি ঠিক করেছি বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরব। তারপর নিজেই মাছ রান্না করব। সবাইকে খাওয়াব। তোমাকেও খাওয়াব।’

আজহার সাহেব হাসলেন। রোদ উঠেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কেটে গেছে। চারদিক ঝকঝক করছে। কুয়াশায় ভেজা গাছের পাতায় আলোর ঝলমলানি।

আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, শেফা যা মীরাকে ডেকে নিয়ে আয়। রোদ উঠেছে। তোদের দুই বোনকে আমি অদ্ভুত একটা কাহিনী বলব— স্টেট ভার্সাস শেফালি রানীর বিখ্যাত মামলা। ইংরেজের আমলের মামলা। কোলকাতা হাইকোর্ট থেকে শেষপর্যন্ত প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গিয়েছিল। যেমন সেনসেশনাল মামলা, তেমনি সেনসেশনাল রায়। যা মীরাকে ডাক।

‘ডেকে লাভ হবে না বাবা। আপা আসবে না।’

‘আসবে না কেন? ‘

‘আসবে না কারণ তার আসলে খুব মন খারাপ।’

‘কেন?’

‘যেদিন আমরা এখানে আসব, তার আগের দিন সাবের ভাইয়ের সঙ্গে আপার খুব ঝগড়া হয়েছে।’

‘সাবের ভাই মানে কি লম্বা ছেলেটা?’

‘হ্যাঁ। আমি ডাকি লম্বু ভাইয়া। আপা তাতে রাগ করে।’

‘সাবের ছেলেটার সঙ্গে মীরার ঝগড়া হয়েছে? তোকে বলেছে?’

‘তুমি পাগল হয়েছ বাবা? আপা আমাকে কিছু বলবে? টেলিফোনে ঝগড়া হল তো, আমি আড়াল থেকে শুনলাম। টেলিফোন শেষ করে দরজা বন্ধ করে আপার যে কী কান্না। হাউ মাউ করে কেঁদেছে।

‘তোর মা জানে?’

‘মা ভাব করে সে কিছুই জানে না। আসলে সবই জানে।’

‘আমাকে তো কিছু বলে নি।’

‘তোমাকে কেন বলবে?’

‘আমাকে বলবে না কেন? আমি কি বাইরের কেউ যে আমাকে কিছু বলা যাবে না?’

তুমি ঘরের হলেও তুমি হচ্ছ পুরুষমানুষ। পুরুষমানুষকে সবকিছু বলা যায় না।’

‘ঝগড়া হয়েছে ভালো কথা। এই বয়সে ক্লাস-ফ্রেন্ডদের মধ্যে ঝগড়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই বলে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে হবে?’

‘কাঁদতে হলে তো দরজা বন্ধ করেই কাঁদতে হবে। দরজা খোলা রেখে কে কাঁদবে? বাবা আমি যাচ্ছি।’

‘বোস আরেকটু। স্টেট ভার্সেস শেফালি রানীর গল্পটা শুনবি?’

‘না। মামলা মোকদ্দমার গল্প শুনতে আমার ভালো লাগে না বাবা।’

‘না-শুনেই কীভাবে বুঝলি ভালো লাগে না?‘

‘না-শুনেই আমি বুঝতে পারছি—খুবই বোরিং গল্প। তোমার বেশিরভাগ গল্পই বোরিং, মামলার গল্প আরো বেশি বোরিং। বাবা আমি যাচ্ছি।’

আজহার সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন। কিছুক্ষণ আগে রোদ উঠেছে, এরমধ্যেই রোদ কেমন কড়া হয়ে গেছে। সুঁচের মতো গায়ে রোদ বিঁধে যাচ্ছে।

মীরা বারান্দায়। রোদে পা মেলে সে মোড়ায় বসে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ শুকনো লাগছে। তারপরও মনোয়ারা বারান্দায় এসে মীরাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কী সুন্দরই না মেয়েটাকে লাগছে! ইন্দ্রাণীর মতো লাগছে। এই মেয়েটা তার বাবার মতো সুন্দর হয়েছে। শেফা বেচারি তার বাবার কিছুই পায়নি। কেমন ভোঁতা নাক মুখ। গায়ের রঙটা পেলেও তো কাজ হত। মীরা মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, মা তুমি এই ভয়ংকর কাণ্ডটা কী করে করলে?

মনোয়ারা বিস্মিত হয়ে বলল, আমি কী করেছি?

‘দেলোয়ার নামের লোকটাকে সঙ সাজানোর বুদ্ধি তোমাকে কে দিল? লুঙ্গির উপর হলুদ একটা কোট পরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে যে সার্কাসের ক্লাউনের মতো লাগছে সে বুঝতেও পারছে না। মনে হচ্ছে মহাখুশি।

‘গ্রামের মানুষ অল্পতেই খুশি হয়।’

‘মা প্লিজ লোকটাকে বলো সে হয় কোট খুলে ফেলুক, কিংবা লুঙ্গির বদলে

প্যান্ট পরুক। প্যান্ট না থাকলে বাবার একটা প্যান্ট দাও। ক্লাউন যখন সাজবে পুরোপুরি সাজুক।’

‘হাতমুখ ধুয়েছিস? নাশতা দেব?’

‘কী নাশতা?’

‘ভাপা পিঠা।’

‘ভাপা পিঠা খাব না। পরোটা ভেজে দিতে বল।’

‘পরোটা ভেজে দিচ্ছি। একটা পিঠা খেয়ে দেখ, খেতে ভালো হয়েছে। ‘যত ভালোই হোক খাব না। মিষ্টি-কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। ‘

মনোয়ারা চলে যাচ্ছিলেন। মীরা বলল, মা আরেকটা জরুরি কথা শুনে যাও।

‘কী কথা?’

‘আমি নেত্রকোনা যাব। গাড়িটা নিয়ে যাব। দেলোয়ারকে বল সে যেন আমার সঙ্গে যায়।’

‘নেত্রকোনা কীজন্যে?’

‘আমার কাজ আছে।’

‘ঢাকায় টেলিফোন করবি?’

‘হুঁ। আমাকে টেলিফোন করতেই হবে।’

‘তোর বাবা রাগ করবে।’

‘রাগ করলে তুমি রাগ সামলাবে। আমাকে যেতেই হবে মা।’

‘তোর সমস্যাটা কী?

‘আমার সমস্যা ভয়াবহ।’

‘ভয়াবহ মানে কী? আমাকে বলা যায়?’

‘আজ যদি টেলিফোনে সাবেরকে পাই তাহলে তোমাকে সমস্যাটা বলব।’ মনোয়ারা বললেন, মীরা তুই এক কাজ কর। তোর বাবা বাগানে আছে। তার কাছে গিয়ে বোস। আমি তোর নাশতা সেখানে দিচ্ছি।

‘কেন?’

‘বেচারি একা বসে আছে। তুই পাশে গিয়ে বসলে খুশি হবে। তখন তোর নেত্রকোনা যাওয়া সহজ হবে। তোর বাবা রাগ করবে না।’

মীরা গম্ভীর হয়ে বলল, মা তুমি সবকিছু নিয়ে কৌশল কর, প্যাঁচ খেলো, এইটাই আমার খারাপ লাগে। তোমার মাথার মধ্যে সবসময় কৌশল খেলা করে। তুমি সহজ সাধারণভাবে কিছু করতে পার না কেন?

‘সংসার ঠিকঠাক রাখতে হলে কৌশল লাগেরে মা। এখন বুঝবি না—আরো বয়স হোক তখন বুঝবি।’

‘বয়স আমার কম হয় নি—একুশ।’

‘একুশ একটা বয়স হল?’

মীরা বাগানের দিকে রওনা হল। তার মেজাজ খারাপ। মা’র ওপর রাগ লাগছে। তার নেত্রকোনা যাবার মতো সাধারণ একটা ব্যাপারেও মা একটু প্যাঁচ খেলবে।

আজহার সাহেব তাঁর বড় মেয়েকে দেখে এত খুশি হলেন যে তাঁর প্রায় চোখে পানি এসে যাবার মতো ব্যাপার হল। তিনি উজ্জ্বল গলায় বললেন, কেমন চনমনে রোদ উঠেছে দেখেছিস মা?

মীরা বলল, হ্যাঁ। এখনতো রীতিমতো গরম লাগছে। সকালে দেখলাম কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর এখন রোদ ঝাঁ-ঝাঁ করছে। বাবা শোনো, আমি একটু নেত্রকোনা যাব। আমাকে ঢাকায় টেলিফোন করতে হবে। গাড়িটা নিয়ে চলে যাই? দেলোয়ার সঙ্গে থাকবে, বাবা আমি কি যাব?

আজহার সাহেব বললেন, যা। রাস্তা খানিকটা ভাঙা আছে, সাবধানে চালাবি। আরেকটা কথা, দেলোয়ার বয়সে তোর চে বড়। দেলোয়ার না বলে দেলোয়ার ভাই বল্। খুশি হবে। নাশতা করেছিস?

‘না। মা এখানে নাশতা নিয়ে আসবে।’

‘ভেরি গুড। খোলামেলা জায়গায় বসে নাশতা খাবার মজাই অন্যরকম।’

‘নাশতার প্লেটে পাখি ইয়ে না করে দিলেই হল।’

আজহার সাহেব হো হো করে হেসে ফেললেন। তাঁর হাসি আর থামছেই না। মীরা ভেবে পাচ্ছে না সে এমন কী কথা বলেছে যে বাবার হাসি থামছে না।

মনোয়ারা নাশতা নিয়ে এলেন। তিনি আজহার সাহেবের জন্যে আরেক কাপ চা নিয়ে এসেছেন।

আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মনোয়ারা বললেন, এই শোনো মীরার ঢাকায় একটা টেলিফোন করা দরকার। ওদের পরীক্ষা নিয়ে কি জানি ঝামেলা আছে। সেই সম্পর্কে খোঁজ নেয়া। দেলোয়ারকে বলে দেই সঙ্গে যাক। নেত্রকোনা থেকে আমারো দু-একটা জিনিস আনানো দরকার। মীরা গেলে আমার জন্যেও ভালো। মীরা দেখেশুনে আনতে পারবে।

মীরার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। মা অকারণে এত কাঁদুনি গাইছে কেন?

.

শেফা খুব আয়োজন করেই মাছ মারতে বসেছে। পুকুরপাড়ে তার জন্যে বড় একটা শীতলপাটি বিছানো হয়েছে। শেফা যে জায়গায় বসেছে সেখানে রোদ আসে বলে বাঁশের মাথায় ছাতা বাঁধা হয়েছে। তার হাতে দুটা বঁড়শি আছে। এর মধ্যে একটা আবার হুইল বঁড়শি। হুইল বঁড়শি কী করে টানতে হয় শেফা জানে না। সাধারণ বঁড়শি টানার নিয়মও জানে না। শুধু এইটুকু জানে ফাত্না পানির নিচে তলিয়ে গেলে হ্যাঁচকা টান দিতে হয়। শেফা ঠিক করে রেখেছে যদি হুইলের বঁড়শির ফাত্না ডুবে যায় তাহলে সে বাবা বলে বিকট চিৎকার দেবে। বাকি যা করার বাবা করবেন। দেলোয়ার ভাই থাকলে হত, তিনি মীরা আপার সঙ্গে নেত্রকোনা গিয়েছেন। শেফার তাদের সঙ্গে যাবার ইচ্ছা করছিল। ইচ্ছাটা সে প্রকাশ করেনি, কারণ ইচ্ছে করলে লাভ নেই। মীরা আপা তাকে নেবে না।

আজহার সাহেব মেয়ের বড়শি ফেলা দেখতে এলেন। তাঁর খুবই মজা লাগছে। বোঝা যাচ্ছে তাঁর ছোট মেয়েটা গ্রাম পছন্দ করতে শুরু করেছে। তিনি মনেপ্রাণে চাচ্ছেন মেয়েটার ছিপে একটা মাছ ধরুক। ধরবে বলে মনে হয় না, প্রাচীন পুকুরের বুড়ো মাছগুলি ধুরন্ধর প্রকৃতির হয়—এরা সহজে ধরা দেয় না। তিনি খুশি-খুশি গলায় বললেন, তোর পাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকলে তোর কি খুব অসুবিধা হবে?

শেফা বলল, অসুবিধা হবে না। শুধু নাক ডাকতে পারবে না। তোমার নাক ডাকার শব্দে মাছ পালিয়ে যেতে পারে।

‘নাক ডাকব না, শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব। মাছ ধরার একটা মন্ত্র আছে— মাঝে মাঝে মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দিতে হয়।’

‘মন্ত্রটা কী?’

‘আমি ভুলে গেছি। দেলোয়ার জানতে পারে। ওকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিস।

আজহার সাহেব নিজেই বালিশ নিয়ে এলেন। বালিশে মাথা রেখে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লেন।

তাঁর হাতে কয়েকটা পেপারব্যাক। ছুটি কাটাবার সময় তিনি সঙ্গে বেশকিছু বই নিয়ে আসেন। ভাবেন ছুটির মধ্যে আরাম করে বই পড়া যাবে। কখনোই পড়া হয় না। আশ্চর্য ব্যাপার হল যখন ব্যস্ততা থাকে চরমে তখনই বই পড়া হয়। অবসর সময় কখনোই পড়া হয় না। বই পড়তে গেলেই হাই উঠে ঘুম পায়। এখনো তাই হচ্ছে—হাই উঠছে। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। চেষ্টা করেও খোলা রাখা যাচ্ছে না। আজহার সাহেব বইয়ের লেখার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন লেখার অর্থ উদ্ধার করতে পারছেন না।

বইটা খুবই হাসির হবার কথা, একটুও হাসি আসছে না—

“There Were Four of us Gorge, and William Samuel Harris, and Myself, and montmoremcy. We were sitting in my room, smoking, and talking about how bad we were bad from a medical point of view I mean, of course.. …”

আজহার সাহেব হাই তুলতে তুলতে ভাবছেন—বাক্যগুলি এত লম্বা কেন? বাক্যের শেষের দিকে এলে শুরুটা মনে থাকে না। লোকজন হাসবে কখন?

.

দেলোয়ারের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করেছে। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মীরা! বাচ্চা একটা মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, কোনোরকম ভুল করছে না। গাড়ি চালাতে চালাতে আবার তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, প্রয়োজনমতো হর্ন দিচ্ছে—কী আশ্চর্য! শুধু যে দেলোয়ার বিস্মিত হচ্ছে তা না, যে দেখছে সে-ই অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। বিড়বিড় করে কী সব বলছে।

‘দেলোয়ার সাহেব।’

‘জ্বি।‘

‘লোকজন কী অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছে—লক্ষ্য করেছেন?’

‘জ্বি।’

‘একটা শিম্পাঞ্জি গাড়ি চালিয়ে গেলে লোকজন যেভাবে তাকে দেখত—আমাকে সেইভাবেই দেখছে। নিজেকে শিম্পাঞ্জি শিম্পাঞ্জি মনে হচ্ছে। আর আপনাকে মনে হচ্ছে শিম্পাঞ্জি ট্রেইনার। ট্রেইনার শব্দের মানে জানেন তো?’

‘জ্বি জানি, শিক্ষক।’

‘সরি, ট্রেইনার শব্দের মানে তো আপনি জানবেনই। আপনি যে বি. এ. পাশ এই তথ্য মনে থাকে না। বি. এ.-তে আপনার রেজাল্ট কী ছিল?’

‘থার্ড ক্লাস।’

‘থার্ড ক্লাসের জন্যেই বোধহয় কোথাও কোনো চাকরিটাকরি পাচ্ছেন না, তাই না?’

‘জ্বি না। চেষ্টা করি নাই।’

‘চেষ্টা করেননি কেন?

‘যা আছি তো ভালোই আছি। মাস শেষে চাচাজী এক হাজার টাকা দেন। আমি একা মানুষ। আমি চলে গেলে চাচাজীর বিষয়সম্পত্তি দেখবে কে। বিশ্বাসী মানুষ পাওয়া যায় না।’

‘আপনি কি খুব বিশ্বাসী মানুষ?’

‘জ্বি।‘

‘আপনি বাবার বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন?’ দেলোয়ার উত্তর দিল না। এই মেয়েটা কথাবার্তা কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা অসম্ভব বুদ্ধিমতী। এই ধরনের বুদ্ধিমতী মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা সাবধানে বলতে হয়।

‘দেলোয়ার সাহেব। ‘

‘জ্বি।’

‘নেত্রকোনায় কি রেডিমেড প্যান্টের দোকান আছে?’

‘জ্বি আছে।

‘আপনি দয়া করে নেত্রকোনায় পৌঁছেই একটা প্যান্ট কিনে নেবেন।’

‘সঙ্গে টাকা আনি নাই।‘

‘টাকা আমি দেব। আপনি লুঙ্গিটার উপর কোট পরেছেন, আপনাকে সার্কাসের ক্লাউনের মতো লাগছে।’

‘আপামণি লুঙ্গি বদলায়ে পায়জামা পরেছি। চাচিজী লুঙ্গি বদলাতে বললেন, এইজন্যে বদলেছি। আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেন নাই।’

‘পায়জামার উপর কোট আরো জঘন্য। আপনি অবশ্যই একটা রেডিমেড প্যান্ট কিনবেন এবং শুনুন, একজোড়া জুতাও কিনবেন। আমি টাকা দেব।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘আমার কথায় আশা করি কষ্ট পাচ্ছেন না?’

‘জ্বি না।’

‘আপনি তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—বাবার ঘরবাড়ি বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনাই আপনার জীবনের ব্রত?’

‘চাচাজীর জন্যে কিছু করতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার।’

‘কেন? বাবা বড় মানুষ বলে? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলে? লোকজনের কাছে বলতে পারবেন— আমি একজন বিচারপতির বিষয় দেখাশোনা করি—এই কারণে?’

‘জ্বি না। উনি আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন।’

‘অত্যধিক স্নেহ করলেও তার মধ্যে বাবার স্বার্থ আছে। আপনাকে তাঁর দরকার। আপনি না থাকলে তাঁর গ্রামের এই বিরাট বিষয়সম্পত্তি বারো ভূতে লুটে খেত।’

দেলোয়ারের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়ে তার বাবাকে এমন ছোট করে দেখছে কেন? আজহার সাহেব কেমন মানুষ সেটাতো এই মেয়েটারই সবচেয়ে বেশি জানার কথা। এই মানুষটা তাঁর গ্রামের জন্যে কী করেনি? মেয়েদের স্কুল বানিয়ে দিয়েছে, ছেলেদের স্কুল বানিয়ে দিয়েছে। নিজের খরচে রাস্তা ঠিক করে দিয়েছে। ডিপ টিউবওয়েল কিনে দিয়েছে। গ্রামের যে-কোনো মানুষ বিপদে পড়ে তার কাছে গিয়ে কখনো খালিহাতে ফেরেনি I

‘দেলোয়ার সাহেব।’

‘জ্বি।’

‘আপনি কি আমার কথায় মন খারাপ করেছেন?’

‘জ্বি করেছি। চাচাজীকে আমি অনেক বড় চোখে দেখি।’

‘কিন্তু আমি কি কথাগুলি ভুল বলেছি? আপনাকে বাবা যে স্নেহ করেন সেই স্নেহ কি স্বার্থজড়িত স্নেহ না?’

‘জ্বি না। আমার একবার খুব অসুখ হয়েছিল। খারাপ ধরনের জন্ডিস। আমাকে নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করল। জীবনের আশা ছেড়েই দিলাম। তখন স্যার খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে নেত্রকোনা হাসপাতালে আমাকে দেখতে এলেন। আমার অবস্থা দেখে মনে খুবই কষ্ট পেলেন।’

‘কী করে বুঝলেন—মনে কষ্ট পেয়েছেন?’

‘চাচাজীর চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। চোখের পানি মুছে বললেন—দেলোয়ার তোর এ কী অবস্থা। চাচাজী কখনো আমাকে তুই বলেন না। সব সময় তুমি বলেন। সেদিনই প্রথম তুই বললেন।’

‘আপনি কী করলেন?’

‘আমি চাচাজীরে বললাম, চাচাজী আপনি যদি আমার কপালে হাত রেখে আল্লাহপাকের কাছে একটু দোয়া করেন, আমি ভালো হয়ে যাব।’

‘বাবা তাই করলেন?’

‘জ্বি, তিনি কপালে হাত রেখে দোয়া করলেন। সন্ধ্যাবেলা দোয়া করলেন—এশার ওয়াক্ত থেকে শরীর ভালো হতে শুরু করল। রুচি চলে গিয়েছিল, যা খেতাম বমি করে দিতাম। রুচি ফিরে এল। রাতে নার্সকে বললাম—সিস্টার হিদল ভর্তা দিয়ে একটু ভাত খেতে ইচ্ছা করছে।’

‘কী ভর্তা?’

‘হিদল ভর্তা। হিদল হল পুঁটিমাছের একরকম শুঁটকি, অনেকে বলে চেপা শুঁটকি।

‘হিদল ভর্তা দিয়ে ভাত খেলেন?’

‘জ্বি। ভরপেট ভাত খেলাম। পরদিন সকালে শরীর সুস্থ। সুস্থ হবে জানা কথা। পীর বংশের মানুষ। পীরাতি চাচাজীর মধ্যেও আছে। চাচাজী নিজে তা জানেন না।

‘আমিওতো পীর বংশের বড় মেয়ে—আমার মধ্যে নাই?’

‘জ্বি আপনি আপনার মধ্যে আছে।’

‘কী করে বুঝলেন?

‘বোঝা যায়।’

.

টেলিফোন-পর্ব শেষ করে ফেরার পথে মীরা খুব হাসিখুশি রইল। মজার মজার গল্প করতে লাগল। কিন্তু দেলোয়ারের মনে হল—মেয়েটার মন খুবই খারাপ হয়েছে। অতিরিক্ত হাসিখুশির ভাব যতই দেখাক না কেন মেয়েটা খুবই কষ্ট পাচ্ছে।

‘দেলোয়ার সাহেব।’

‘জ্বি।’

‘প্যান্ট এবং জুতাজোড়া আপনার পছন্দ হয়েছে তো?’

‘জ্বি হয়েছে।’

‘মানুষ হিসেবেও আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। এখন যদি আপনি লুঙ্গির উপর কোট পরে ঘুরেন আপনাকে আগের মতো খারাপ লাগবে না।‘

দেলোয়ার হঠাৎ বলে ফেলল, আপামণি আপনার মনটা কি খারাপ? মীরা বলল, হ্যাঁ আমার মনটা খুব খারাপ। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমি কাঁদতে পারছি না।

দেলোয়ার লক্ষ্য করল মীরার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেছে। চোখের পানি টপ টপ করে পড়ছে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে। দেলোয়ার সঙ্গে সঙ্গে খতমে ইউনুছ পড়া শুরু করল। এই দোয়া এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়ে আল্লাহপাকের কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। সে খতম শেষ করে আল্লাহপাককে বলবে—মেয়েটার মনটা তুমি ভালো করে দাও আল্লাহ্। তুমি গাফুরুর রাহিম, তোমার রহমতের কোনো শেষ নাই। তোমার রহমতের দরিয়া থেকে একফোঁটা রহমত মেয়েটাকে তুমি দাও। এতে তোমার রহমতের দরিয়ার কোনো ক্ষতি হবে না।

মীরা বলল, দেলোয়ার সাহেব। আমি কাঁদছি আমার দুঃখে, আপনার চোখে পানি কেন?

৩. মীরা না-ফেরা পর্যন্ত

মীরা না-ফেরা পর্যন্ত মনোয়ারা চাপা উদ্বেগ নিয়ে ছিলেন। মেয়েরা বড় হবার পর এই সমস্যা তাঁর হয়েছে। ঘরের বাইরে যাওয়া মানেই উদ্বেগ। মনোয়ারার এই উদ্বেগ নানান ভাবে প্রকাশিত হয়— তাঁর মাথায় যন্ত্রণা হয়, কোনো কাজে মন রাখতে পারেন না। ইদানীং আরেকটি উপসর্গ যুক্ত হয়েছে—শ্বাস কষ্ট। বড় বড় করে নিশ্বাস নিলেও বুক ভরে না। মনে হয় ফুসফুসের একটা বড় অংশে বাতাস পৌঁছাতে পারছে না। ফাঁকা হয়ে আছে। মনোয়ারার ধারণা মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে যাবার পর তাঁর এই সমস্যা থাকবে না। তিনি আরাম করে বাকি জীবন নিশ্বাস নিতে পারবেন।

নেত্রকোনা থেকে ফেরার পর মেয়েকে দেখে তাঁর ভালো লাগল। বেশ হাসি খুশি মেয়ে। কয়েকদিন ধরে মীরার মুখে যে অন্ধকার ভাব ছিল তা নেই। বরং খানিকটা ঝলমলে ভাব চলে এসেছে। অবশ্যি এটা অভিনয়ও হতে পারে। তাঁর বড় মেয়ে অভিনয় ভালো জানে। ছোটটা একেবারেই জানে না।

মনোয়ারা মীরাকে বললেন, কোনো সমস্যা হয়েছিল?

মীরা হাসল। হাসতে হাসতে বলল, কোনো সমস্যা হয়নি।

‘মেয়েমানুষ গাড়ি চালাচ্ছে এটা দেখে লোকজন মজা পায়নি?’

‘খুব মজা পেয়েছে।’

‘ঢাকায় লাইন পেতে সমস্যা হয়নিতো?’

‘উহুঁ! প্রথম রিঙেই সাবের টেলিফোন ধরল এবং আমার গলা চিনতে পারল না। বলল আপনি কে বলছেন?’

‘তাহলে সাবের সঙ্গে কথা হয়েছে?’

‘হয়েছে।’

‘ও ভালো আছে তো?’

‘ভালোই আছে তবে ওর মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। গলা কেমন যেন ভারী ভারী শুনাল। কিংবা উল্টোটাও হতে পারে। হয়তো আমার গলা শুনেই সে তার নিজের গলা ভারী করে ফেলল।’

মীরা হাসছে, মনোয়ারা চলে যাচ্ছেন। মনোয়ারার মুখেও হাসি।

মীরা ভাবছে, একটা পরিবারে মায়ের ভূমিকা খুবই অদ্ভুত। পরিবারের যে—কোনো সদস্য যখন হাসে, মা’কে হাসতে হয়। পরিবারের যে-কোনো সদস্য যখন দুঃখিত হয়, মাকে দুঃখিত হতে হয়। এটা হল পরিবারের দাবি। পরিবার এমন অন্যায় দাবি মা ছাড়া অন্য কারো ওপর করে না।

মীরা ডাকল, মা শুনে যাওতো।

মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলেন। সাবেরের সঙ্গে মীরার সমস্যাটা কী? কীভাবে তা মিটমাট হল এটা জানা মনোয়ারার খুব শখ। তিনি নিজ থেকে জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। এখন মনে হচ্ছে মীরাই বলবে।

‘মা শোনো তোমাকে খুব জরুরি একটা কথা বলব। ভংয়কর জরুরি।’

‘চল বাগানে যাই। ‘

‘বাগানে যেতে পারব না। এখানেই বলি। কথাটা হচ্ছে—আমি জানতে পেলাম দাদীজান নাকি আজ রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাবে। এটা যেন না ঘটে তুমি দেখবে।

‘এটা তোর জরুরি কথা?

‘হ্যাঁ এটা আমার জরুরি কথা। দাদীজান কাল রাতে ঘুমিয়েছেন শেফার সঙ্গে এবং তাকে নাকি বলেছেন—তিনি এক রাতে শেফার সঙ্গে ঘুমাবেন, আর এক রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাবেন। এইভাবে চলতে থাকবে এটা শোনার পর থেকে আমার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।’

‘হাতপা ঠাণ্ডা হবার কী আছে? দাদী নাতনির সঙ্গে ঘুমবে না!’

‘না ঘুমবে না। অবশ্যই আমার সঙ্গে না। একটা লেপের নিচে আমি আর দাদীজান। উনার হাড্ডি-হাড্ডি পা উনি আমার গায়ে তুলে দেবেন। তাঁর শরীর থেকে আসবে শুকনা গোবরের গন্ধ। অসহ্য। মা তুমি যেভাবেই হোক আমাকে বাঁচাও।’

মনোয়ারা চিন্তিত মুখে বললেন, উনি তোর সঙ্গে ঘুমুতে চাইলে আমি না করব কীভাবে?

‘এইসব প্যাচাল বুদ্ধি তোমার খুব ভালো আছে। তুমি একটা বুদ্ধি বের কর। বিনিময়ে আমি তোমার সব কথা শুনব। তুমি যদি বল আমাকে বাবার সঙ্গে বসে গল্প করতে হবে তাতেও রাজি আছি।

মনোয়ারা বিরক্ত হয়ে বললেন, ফাজলামি ধরনের কথা বলিস না। বাবার সঙ্গে গল্প করবি না তো কার সঙ্গে গল্প করবি?

মীরা হাসতে হাসতে বলল, মা তুমি কি জানো যে বাংলাদেশে প্রথম দশজন সেরা বিরক্তিকর গল্প-কথকদের মধ্যে বাবা আছেন? হি হি হি।

.

সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আজহার সাহেব তাঁর মেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন। মনোয়ারা চা নিয়ে ঢুকলেন। মীরা তাঁর মাকে চোখে-চোখে বলল, মা আমাদের বাঁচাও। মনোয়ারা হাসলেন এবং তিনিও গল্প শুনতে বসলেন। ঢাকায় থাকার সময় সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করা প্রায় কখনোই হয় না। শেফা বসবে টিভির সামনে, এক্স ফাইল বা কিছু দেখবে। মীরা থাকবে তার ঘরে, তার দরজা থাকবে বন্ধ। বন্ধ-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে সিডির গানের শব্দ ভেঙে ভেঙে আসবে। তার দরজায় ধাক্কা দিলে সে বিরক্ত গলায় বলবে, পরে আসো তো মা। এখন দরজা খুলতে পারব না।

আজহার সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্ত গলায় বললেন, শীতের সন্ধ্যায় আনন্দময় ব্যাপার হচ্ছে গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রিলাক্স করা। শীত যত বেশি পড়বে রিলাক্সেশন তত বেশি হবে। বরফের দেশে কী হয় দেখ। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। ঘরের ভেতরে ফায়ার-প্লেসে কাঠ পুড়ছে। কাঠের গনগনে আগুন। সেই আগুনের পাশে গোটা পরিবার জড়ো হয়েছে। আগুন তাপাতে তাপাতে কফি খাচ্ছে।

শেফা বলল, কফি খাচ্ছে না বাবা, মদ খাচ্ছে।

আজহার সাহেব বললেন, এটা মা তুমি একটা ভুল কথা বললে। ইংরেজি ছবি দেখে-দেখে তোমার এই ধারণা হয়েছে। আসলে ওরা মদ্যপান কম করে। বরং আমি দেখি বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের মধ্যে এটা অনেক বেশি। অর্থবিত্তের প্রমাণ হিসেবে মদ্যপানকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মদ্যপান হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ট্যাটাসের অংশ।

শেফা গম্ভীর হয়ে বলল, বাবা তোমায় সাধারণ কথাও বক্তৃতার মতো কেন? মনোয়ারা হেসে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গেই হাসি বন্ধ করে বললেন, এই শোনো তুমি একটা মজার গল্প আমাদের শুনাও তো।

‘মজার গল্প?’

‘হ্যাঁ মজার গল্প। তোমার মেয়েদের ধারণা তুমি মজার গল্প জানো না।’

‘মজার গল্প মানে কি স্ট্র্যাঞ্জ গল্প?—আচ্ছা শোনো নেদারল্যান্ডের এবোরজিনদের একটা অদ্ভুত কাস্টমের কথা বলি। নেদারল্যান্ডের এক প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী আছে, তাদের অদ্ভুত সামাজিক কিছু নিয়মকানুন আছে। তাদের মধ্যে একদল আছে যাদের বলা হয় Sin eater. সিন ইটার মানে হল পাপ-খাদক। তারা অন্য মানুষদের পাপ খেয়ে ফেলে।’

মনোয়ারা বললেন, ও মাগো। কী বলছ তুমি! পাপ খাবে কীভাবে?

মনোয়ারার এত বিস্মিত হবার কারণ নেই। তিনি এই গল্প এর আগে তিনবার শুনেছেন। তিনি বিস্মিত হচ্ছেন গল্প জমিয়ে দেবার জন্যে।

আজহার সাহেব বললেন, মনে কর কেউ মারা গেল। তখন করা হয় কি, মৃত ব্যক্তিকে নগ্ন করে মাটিতে শুইয়ে রাখা হবে। তার শরীরে নানান খাদ্যদ্রব্য সাজিয়ে রাখা হবে। তারপর খবর দেয়া হতে Sin eaterদের। Sin eaterরা আসবে, তারা চেটেপুটে মৃতদেহের উপর থেকে খাবারদাবারগুলি খেয়ে ফেলবে। বিশ্বাস করা হয় যে তারা খাবারদাবারের সঙ্গে মৃতব্যক্তির সব পাপও খেয়ে ফেলবে। মৃত ব্যক্তি হয়ে যাবে পুরোপুরি নিষ্পাপ এবং সে সরাসরি স্বর্গে চলে যাবে। আর Sin eaterরা যাবে অনন্ত নরকে।

শেফা এবং মীরার ভেতর গল্প শুনে কোনো ভাবান্তর হল না, কিন্তু মনোয়ারা চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। ঘেন্না-মেশানো গলায় বললেন—তওবা আসাতাগফিরুল্লা, বলে কী?

আজহার সাহেব উৎসাহিত হয়ে দ্বিতীয় গল্প শুরু করতে যাবেন, তখন দেলোয়ার ঢুকে খবর দিল স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে এসেছেন। আজহার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন। স্কুলের মাস্টাররা প্রতিদিন সন্ধ্যাতেই এ-বাড়িতে আসছেন। মুগ্ধ হয়ে আজহার সাহেবের গল্প শুনছেন। আজহার সাহেব তাদের সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দময় কিছু সময় কাটাচ্ছেন।

আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খুশি-খুশি গলায় বললেন, মনোয়ারা বাইরে চা-টা পাঠাবার ব্যবস্থা কর। আর শোনো এদের একবেলা আমি খাওয়াতে চাই। পোলাও টোলাও কর। বেচারারা এই শীতের রাতে দূর দূর থেকে আসে। এত রাতে না-খেয়ে ফেরত যায়। খারাপ লাগে।

মনোয়ারা বললেন, তারা আসে তোমার গল্প শুনতে। গল্প শুনতে পাচ্ছে এতেই তারা খুশি।

‘তা ঠিক। তবুও এক রাতে ভালো করে এদের খাওয়াব। আগামীকাল রাতে খেতে বলি কেমন?’

‘আচ্ছা বলো।’

‘গরুর মাংস দিয়ে তুমি যে একটা প্রিপারেশন কর—মঙ্গোলিয়ান বিফ, ঐটা করতে পার কিনা দেখ তো। এরা গ্রামে পড়ে আছে, নতুন কিছু খেতে পারলে খুশি হবে।’

‘দেখি পারি কি না।’

আজহার সাহেব চলে যেতেই মীরা বলল, মা, তুমি কি দাদীজানকে সামলেছ? আশা করি তিনি আমার সঙ্গে ঘুমুতে আসবেন না। উনাকে বলে দিয়েছ তো মা।’

‘এখনো কিছু বলি নাই। কীভাবে বলব সেটাই বুঝতে পারছি না।’

‘তোমাকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দেই?’

‘দে’

‘আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে ঘুমুতে আস। তাছাড়া এম্নিতেই আমার শরীরটাও ভালো লাগছে না। জ্বর-জ্বর লাগছে। আমার তোমার সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে। তুমি আমার সঙ্গে ঘুমুতে এলে দাদীজান বাধ্য হয়ে শেফার সঙ্গে ঘুমুবেন। প্রবলেম সলভড।’

শেফা বলল, আজ রাতের প্রবলেম নাহয় সলভড হল, কাল কী করবে? মা কি রোজ তোমার সঙ্গে ঘুমুবে?

মীরা বলল, কালকেরটা কাল দেখা যাবে। আগে বর্তমানের সমস্যা মিটুক। ভবিষ্যতের সমস্যা ভবিষ্যতে মেটানো হবে। We Live in Present, we do not live in future. তোর মাছ মারা কেমন হয়েছে?

‘ভালো হয়নি।’

‘শখ মিটছে কি-না বল্। শখ মিটলেই হল।’

‘মাছ মারতেই পারলাম না, শখ মিটবে কীভাবে?’

‘কাল আবার বসছিস?’

‘হুঁ। তুমি কি আমার সঙ্গে বসবে আপা?’

‘না।’

‘প্লিজ আপা তুমি বোস, তোমার তো ভাগ্য ভালো। আমার ধারণা তুমি থাকলেই মাছ ধরা পড়বে।’

‘আমার ভাগ্য ভালো?’

‘অবশ্যই ভালো। মা, আপার ভাগ্য ভালো না?’

মনোয়ারা হাসিমুখে বললেন, দুজনের ভাগ্যই ভালো।

শেফা বলল, জন্মের সময় আল্লাহ যদি রিপোর্ট-কার্ডের মতো একটা কার্ডে আমাদের ভাগ্য লিখে দিয়ে দিত তাহলে খুব ভালো হত। রিপোর্ট-কার্ড দেখে আমরা আগেভাগে সব জানতাম।

মনোয়ারা বললেন, তুই এমন মজা করে কথা বলা কোত্থেকে শিখেছিস?

শেফা বলল, বাবার কাছ থেকে শিখেছি মা। বাবার কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে গল্প করলে গল্পগুলি বোরিং হয়। আমি গল্প করার সময় সেইটা বাদ দিয়ে গল্প করি।

মীরা হেসে ফেলল। মনোয়ারা হাসতে শুরু করলেন। শুধু শেফা গম্ভীর হয়ে রইল। গম্ভীর হয়ে থাকলেও তার খুব মজা লাগছে। দরজায় দেলোয়ারকে দেখা গেল। তাকে দেখাই যাচ্ছে না। নতুন প্যান্ট, জুতা, তার ওপর হলুদ কোট।

শেফা ফিসফিস করে বলল, ও মাই গড। দেলোয়ার ভাইকে কীরকম সঙের মতো লাগছে দেখেছ মা? মনে হচ্ছে না সার্কাসের জোকার, এক্ষুনি ডিগবাজি—খেয়ে কোনো খেলা দেখাবে?

মনোয়ারা বললেন, চুপ কর।

‘উনাকে আগের মতো লুঙ্গি গেঞ্জি পরে থাকতে বলি মা?’

মনোয়ারা কিছু বলার আগেই দেলোয়ার বলল, ছোট আপা শুনে যান। শেফা উঠে গেল। দেলোয়ার বলল, ভালো খবর আছে আপা। টিভি জোগাড় হয়েছে।

‘টিভি দিয়ে লাভ কী হবে, কারেন্ট নেই। রাত এগারোটার পর কারেন্ট এলে টিভি কী দেখব?’

‘ব্যাটারি এনেছি। গাড়ির ব্যাটারিতে চলবে।’

‘একসেলেন্ট। আমার ঘরে ফিট করে দিন।’

‘আমি তো ফিট করা জানি না। মিস্ত্রি নিয়ে আসছি।’

‘নিয়ে এসেছেন তো সময় নষ্ট করছেন কেন? লাগিয়ে দিন।’

‘চাচাজী রাগ করবেন নাতো?’

‘কী অদ্ভুত কথা! বাবা রাগ করবে কেন? ঢাকায় কি আমি টিভি দেখি না? সারাক্ষণই দেখি।’

‘তবু চাচাজীর একটা অনুমতি

‘আচ্ছা যান অনুমতি আমি নিয়ে নেব।’

শেফা অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছে। টিভির অন্য কোনো প্রোগ্রাম না দেখলেও এক্স ফাইল না-দেখলে শেফার চলে না। আজ এক্স ফাইল আছে। দেলোয়ার ভাইকে সন্ধ্যাবেলা শুধু জিজ্ঞেস করেছিল—আশেপাশের কোনো বাড়ি আছে যাদের টিভি আছে? আমাকে এক্স ফাইল দেখতে হবে। দেলোয়ার ভাই টিভিই জোগাড় করে ফেলেছে। মানুষটা কাজের আছে। শুধু একটু জোকার টাইপ।

‘দেলোয়ার ভাই।’

‘জ্বি।’

‘কোট প্যান্ট পরে আপনার কেমন লাগছে?’

‘জ্বি ভালো লাগছে। একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছে।’

‘লজ্জা-লজ্জা লাগছে তাহলে পরে আছেন কেন?’

‘জুতা আর প্যান্ট বড় আপা কিনে দিয়েছেন। না পরলে মনে কষ্ট পাবেন।’

‘উনি মোটেই কষ্ট পাবেন না। আপনার যদি লজ্জা-লজ্জা লাগে আপনি খুলে ফেলুন।’

‘বড় আপার মনটা কি এখন ভালো?’

‘খুবই ভালো। মন খারাপ হবে কেন? দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করছেন কেন? এক্স ফাইল শুরু হয়ে যাবে তো।’

দেলোয়ার কাঁচুমাচু মুখে বলল, চাচাজীর কাছ থেকে যদি অনুমতিটা নিয়ে দেন। টিভি দেখে হঠাৎ যদি রেগে যান।

‘আচ্ছা আমি এক্ষুনি অনুমতি এনে দিচ্ছি। আপনি মিস্ত্রি নিয়ে আমার ঘরে চলে যান। এমন জায়গায় টিভি ফিট করবেন যেন আমি বিছানায় শুয়ে-শুয়ে দেখতে পারি।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

শেফা বসার ঘরের দিকে যাচ্ছে।

সে ঘরে ঢুকল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। আজহার সাহেব গল্প করছেন, সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। আজহার সাহেবের সেই পুরানো গল্প। নেদারল্যান্ডের সিন ইটারদের কাণ্ডকারখানা।

হেডমাস্টার সাহেব বললেন, স্যার কী বললেন? নগ্ন শরীরে খাদ্যবস্তু সাজিয়ে রাখে?

‘জ্বি।’

‘শবদেহ যদি স্ত্রীলোকের হয়?’

‘সবার জন্যই একই অবস্থা।’

‘হেডমাস্টার সাহেব শিউরে উঠলেন। অতিথিরা কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার বললেন, অতি বর্বর জাতি।

আজহার সাহেব বললেন, প্রাচীন জাতিগুলোর মধ্যে এইজাতীয় অনেক বিচিত্র বিশ্বাস প্রচলিত। আফ্রিকার রেইন ফরেস্টে এই প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী আছে তারা তাদের মৃত আত্মীয়স্বজন কবর দেয় না বা দাহ করে না। খেয়ে ফেলে।’

‘কী বললেন স্যার, খেয়ে ফেলে?’

‘হ্যাঁ খেয়ে ফেলে। তারা বিশ্বাস করে এতে মৃত আত্মার সদগতি হয়।’

‘আমরা তো স্যার সেই তুলনায় ভালো আছি।’

‘হ্যাঁ আমরা ভালোই আছি। আমাদের সভ্যতা তো অতি প্রাচীন। তার পরেও সতীদাহের মতো কুৎসিত প্রথা ছিল। ছিল না? ওরা যা করছে মৃত মানুষদের নিয়ে করছে আর আমরা জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরে ফেলছি।’

এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার সাহেব মুগ্ধ গলায় বললেন, স্যার আপনি এত বিষয় জানেন, এত সুন্দর করে গল্প করেন এটা একটা অবিশ্বাস্য বিষয়। আপনার গল্প শোনা ভাগ্যের ব্যাপার। সন্ধ্যার পর আর ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে না। স্যার হয়তো খুবই বিরক্ত হন।

‘বিরক্ত হব কেন?’

‘স্যার বিরক্ত হন আর নাই হন আমরা না-এসে পারব না।’

‘অবশ্যই আসবেন। ভালো কথা, আগামীকাল রাতে আপনারা আমার সাথে চারটে ডালভাত খাবেন।’

‘ছিঃ ছিঃ স্যার কী বলেন! আপনি আমাদের মেহমান। কোথায় আমরা খাওয়াব তা না …।’

‘কী আশ্চর্য, আমি এই গ্রামের ছেলে না? আপনারা চারটা ডালভাত অবশ্যই খাবেন।’

শেফা এখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। আড়াল থেকে এদের কথাবার্তা শুনতে তার খুব মজা লাগছে। তার বাবার মহাবিরক্তকর গল্পগুলিও যে লোকজন এত আগ্রহ করে শুনতে চায় এটা শেফার ধারণারও বাইরে ছিল। গ্রামের এই মানুষগুলো কি বোকা নাকি?

আসলে এক ভদ্রলোক আজ দেরি করে এসেছেন। তিনি কবিরাজ শশাঙ্ক কালো। তাঁর নেত্রকোনায় দোকান আছে। দোকান এখন ছেলে দেখাশোনা করে। তিনি বাড়িতে থাকেন। খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে তিনি ঢুকলেন এবং হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে রাগী-রাগী গলায় বললেন, হেডমাস্টার সাহেব কাজটা আপনি কী করলেন? আমাকে না নিয়ে চলে আসলেন। আমি কাল বলেছিলাম না, আসার সময় আমাকে নিয়ে আসবেন। আমি সন্ধ্যা থেকে কাপড় পরে বসা।

হেডমাস্টার সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, একদম ভুলে গেছি।

‘তাতো ভুলে যাবেনই। দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে উল্টা আমি আপনার খোঁজে গিয়ে শুনি আপনি সন্ধ্যার সময় চলে গেছেন।

‘আসছি বেশিক্ষণ হয়নি, এইতো কিছুক্ষণ। আমার কথা বিশ্বাস না হয় স্যারকে জিজ্ঞেস করেন।’

আজহার সাহেব হাস্যমুখে দুই বন্ধুর ঝগড়া সামাল দেন। তাঁকে আবারো পাপ ভক্ষকদের গল্প নতুন করে শুরু করতে হয়। যারা গল্পটা আগে শুনেছেন তারাও সমান আগ্রহ নিয়ে দ্বিতীয়বার গল্পটি শুনেন। হেডমাস্টার সাহেব আগেরবার গল্পের ঠিক যে-জায়গায় বলেছিলেন ‘শবদেহ যদি স্ত্রীলোকের হয়?’—এবারো ঠিক সেই জায়গায় আঁৎকে উঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার শবদেহ যদি স্ত্রীলোকের হয়? তখনো কি এই অবস্থা।’ যেন তিনিও এই প্রথমবারের মতো গল্পটা শুনছেন।

শেফা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবার গল্প শুনতে তার ভালো লাগছে। এখন তার ধারণা হয়েছে যে তারা আগ্রহ নিয়ে বাবার গল্প শোনে না বলেই বাবার গল্পগুলি তত ভালো হয় না। এরা আগ্রহ নিয়ে শুনছে বলে ভালো হচ্ছে।

আজহার সাহেব হঠাৎ গল্প থামিয়ে বললেন, দরজার পাশে কে?

শেফা বলল, বাবা আমি।

‘কী করছ মা?’

‘বাবা তোমার গল্প শুনছি।’

হেডমাস্টার সাহেব অত্যন্ত সাধু ভাষায় বললেন, মা এইসব গল্প তোমার শোনার উপযুক্ত নয়। গল্পগুলি পরিণত মানসিকতার মানুষদের জন্যে। মা তুমি চলে যাও। যদি সম্ভব হয় চাচাদের জন্যে একটু চা পাঠাও।

আজহার সাহেব বললেন, কফি খাবেন না-কি?

‘কফির ব্যবস্থা আছে?’

‘জ্বি আছে।’

‘তাহলে স্যার একটু বড়লোকি জিনিস খেয়ে দেখি।’

শেফা কফির কথা বলতে চলে গেল। এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার সাহেব বললেন, স্যারের দুটা মেয়েই অত্যন্ত ভালো। ভালো হবে জানা কথা। যেমন গাছ তেমন তার ফল।

আজহার সাহেব বললেন, সামান্য ভুল করলেন মাস্টার সাহেব। খুব ভালো গাছের ফল হয় না। যেমন ধরুন সেগুন গাছ, শাল গাছ…।

উপস্থিত শ্রোতারা আজহার সাহেবের জ্ঞানের কথায় আবারো অত্যন্ত চমৎকৃত হন। আজহার সাহেব পাপ-ভক্ষকদের গল্পের শেষাংশ শুরু করলেন—শ্রোতারা তাঁর দিকে ঝুঁকে এল।

৪. মনোয়ারা বড় মেয়ের সঙ্গে

মনোয়ারা বড় মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন। আজ রাতে মনে হয় জমিয়ে শীত পড়েছে। লেপের নিচেও শরীর গরম হচ্ছে না। মীরার শীত সহ্য হয় না। সে লাল টকটকে স্কার্ফে মাথা কান ঢেকে শুয়েছে। ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। বারান্দায় একশ ওয়াটের বাতি জ্বলছে। যদিও তেমন আলো হচ্ছে না। ঘরের ভেতরে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলছে না। ঘরে হারিকেনের আলো। মীরার কাছে না-কি হারিকেনের আলো অনেক আপন লাগে।

মনোয়ারা লেপের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বললেন, আজ মাঘ মাসের কত তারিখ বলতে পারবি?

মীরা বলল, পারব, ন’ তারিখ।

‘মাঘ মাসের অমাবস্যায় সবচে শীত পড়ে। আজ কি অমাবস্যা?

‘অমাবস্যা না মা, কাল রাতেই না তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুকিদের মতো চেঁচিয়ে বললে, ওমা কী সুন্দর চাঁদ! বাবাকে খুশি করার জন্যে বললে। বাবাও সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে গেল, কারণ তাঁর গ্রামের চাঁদ সুন্দর।’

মনোয়ারা বিরক্ত গলায় বললেন, তোর ধারণা আমি যা করি সব তোর বাবাকে খুশি করার জন্যে?

‘হ্যাঁ আমার তাই ধারণা। আগের জন্মে তুমি কী ছিলে জানো মা? আগের জন্মে তুমি ছিলে কোনো মহারাজার প্রধান চাটুকার। ইয়েস ম্যান। এই জন্মেও সেই স্বভাব রয়ে গেছে।’

‘চুপ করবি?’

‘না চুপ করব না। তোমার উপর আমার খুব রাগ লাগে মা। তোমার কোনো স্বাধীন সত্তা কেন থাকবে না।’

‘আমার স্বাধীন সত্তা নেই?’

‘না নেই। এই যে আমি বললাম, তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাও—ওমনি তুমি বাবাকে ছেড়ে চলে এলে যদিও তোমার মন পড়ে আছে বাবার কাছে। দুজনে শুয়ে থাকতে, বাবা বস্তাপচা কোনো বোরিং গল্প শুরু করত। তুমি রোমাঞ্চিত ।এবং শিহরিত হবার ভান করতে। তুমি হঠাৎ করে মরে গেলে বাবার কী হবে তাই ভাবছি।’

মনোয়ারা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, মানুষটা অচল হয়ে পড়বে।

মীরা বলল, মোটেই অচল হবে না। পুরুষমানুষ কখনো অচল হয় না।

মেয়ের কঠিন কঠিন কথা শুনতে মনোয়ারার ভালো লাগছে না। অনেক দিন পর তিনি বড় মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন। কোথায় গভীর রাত পর্যন্ত দুজনে মিলে মজা করে গল্প করবেন, তা না মেয়ে কঠিন কঠিন সব কথা বলা শুরু করেছে। মনোয়ারার ইচ্ছা করছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে থাকতে—সাহসে কুলুচ্ছে না। মেয়ে হয়তো রেগে যাবে। বড় হলে মেয়েরা খুব আশ্চর্যরকম ভাবেই বদলে যায়। মীরা যখন ছোট ছিল তাকে জড়িয়ে ধরে না থাকলে ঘুমুতে পারত না। শুধু যে জড়িয়ে ধরা তা না, তার হাতের মুঠিতে মনোয়ারার শাড়ির আঁচল ধরা থাকত। রাতে বাথরুমে যাওয়াও সমস্যা। মেয়ের হাত থেকে শাড়ির আঁচল খুলতে গেলেই মেয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত।

মনোয়ারা নিজের মনে ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, খুব শীত লাগছে। শরীর গরম হচ্ছে না। মনে হচ্ছে লেপের ভেতর কেউ বরফ-গলা পানি ঢেলে দিয়েছে।

মীরা বলল, এক কাজ কর মা। আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকো।

মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর কাছে আসতেই আমার ভয় লাগে মা। তুই আমার শরীরে গোবরের গন্ধ, ঘাসের গন্ধ এইসব নাকি পাস।

মীরা হাসতে হাসতে বলল, তোমাকে রাগাবার জন্যে বলি মা। তোমার গায়ে খুব সুন্দর গন্ধ। সুন্দর না——টাটকা গন্ধ।

‘টাটকা গন্ধ আবার কী?’

‘নতুন বই খুললে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় তেমন গন্ধ।’

‘তোর অদ্ভুত কথাবার্তার আমি কিছুই বুঝি না। আমার গায়ে বইএর গন্ধ আসবে কেন? বইএর সঙ্গে কি আমার কোনো সম্পর্ক আছে? তোর বাবার গা থেকে বইএর গন্ধ এলেও একটা কথা ছিল। সে দিনরাত বই নিয়ে থাকে। তোর এখানে আসার সময় দেখেছি এত মোটা এক বই নিয়ে বসেছে। আমি বললাম, শুয়ে পড়। রাত হয়েছে। সে বলেছে দুটা পাতা পড়েই শুয়ে পড়বে। আমার ধারণা এখনো বই পড়ছে।’

‘মা যাও দেখে আস বাবা এখনো বই পড়ছে কি-না। যদি দেখ এখনো পড়ছে তাহলে হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দেবে। এবং চেক করবে পায়ে মোজা পরেছে কি-না।’

মীরা কথাগুলি বলল ঠাট্টা করে কিন্তু মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নেমে গেলেন। মীরা উঠে বসল। সে অবাক হয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে আছে। মনোয়ারা মেয়ের দিকে ফিরলেন না বলে মেয়ের অবাক দৃষ্টি দেখলেন না।

.

আজহার সাহেব সত্যি সত্যি বই পড়ছেন। স্ত্রীকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হলেন না। তিনি জানতেন মনোয়ারা আরেকবার খোঁজ নিতে আসবেন। ঘরের দরজা খুলে রেখেছেন এইজন্যেই। মনোয়ারা হাত থেকে বই নিয়ে নিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, রাত একটা বাজে। এই বয়সে অনিয়ম করা একদম ঠিক না। দরজা লাগাও, দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়।

‘তোমরা অনিয়ম করতে পারবে আর আমি পারব না?’

‘আমরা কী অনিয়ম করছি?’

‘এই যে মেয়ের সঙ্গে ঘুমুতে যাচ্ছ। সারা রাত গল্প করবে। করবে না?’

‘না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, গিয়েই শুয়ে পড়ব।’

‘আমার উপর মীরার যে রাগ ছিল, সেটা কি একটু কমেছে?’

‘তোমার উপর রাগ থাকবে কেন?’

‘মীরার হাত থেকে বই নিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম।’

‘কী যে তুমি বল। এইসব কি সে মনে করে রেখেছে? মেয়েটা তোমাকে কী যে পছন্দ করে যদি জানতে তাহলে আজেবাজে প্রশ্ন করতে না।’

‘খুব পছন্দ করে?’

‘মুখে বলে না কিন্তু

‘কে বেশি পছন্দ করে—মীরা না শেফা?

‘দুজনই তোমার জন্যে পাগল, তবে আমার ধারণা তোমার দিকে মীরার টানটাই বেশি। আমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। মীরাই আমাকে পাঠাল দেখে আসার জন্যে তুমি এখনো বই পড়ছ কি-না। আমাকে বলল, তুমি অবশ্যই বাবার হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে বাবাকে শুইয়ে দেবে। বাবা মোজা পরেছে কি-না দেখবে। ভালো কথা, তুমি মোজা পরেছ?’

‘হুঁ।’

‘এসো দরজা বন্ধ কর। আমি চলে যাব।’

আজহার সাহেব বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, সারাক্ষণ বকাবকি করি, তারপরেও মেয়ে দুটা আমাকে এত পছন্দ করে কেন এই রহস্যটাই বুঝলাম না।

আনন্দে আজহার সাহেবের চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তাঁর চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। পৃথিবীর দশজন সুখী মানুষের তালিকা করা হলে তাঁর নাম সেই তালিকায় থাকবে। উপরের দিকেই থাকবে।

.

মনোয়ারা মেয়ের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, কিরে তুই বসে আছিস কেন?

মীরা হাসিমুখে বলল, তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে বসে আছি।

‘আমার তো ঘুম আসছে।’

‘ঘুম এলে ঘুমিয়ে পড়। সারাদিন পরিশ্রম করেছ। ছোটাছুটি-রান্নাবান্না।‘

মনোয়ারা লেপের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে হালকা গলায় বললেন, সাবের ছেলেটার সঙ্গে তোর কি ঝগড়া টগড়া হয়েছে?

‘না। আমার সঙ্গে কারোর ঝগড়া হয় না।’

‘মাঝে মাঝে ঝগড়া হওয়া ভালো। ঝগড়া হচ্ছে ঝড়ের মতো—ঝড়ে যেমন ধুলা ময়লা উড়ে যায়, ঝগড়াতেও মনের ধুলা ময়লা উড়ে যায়।’

‘মা প্লিজ জ্ঞানের কথা বলবে না। বাবার সঙ্গে থেকে তোমারও দেখি জ্ঞানের কথা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।’

‘আচ্ছা আমি আর কোনো কথাই বলব না। তুই গল্প কর আমি শুনি। বসে আছিস কেন? আয় শুয়ে শুয়ে গল্প করি।

‘তুমি শুয়ে থাকো। আমি বসে বসে গল্প করি। একটা শর্ত আছে মা।’

‘কী শর্ত?’

‘গল্পটা শেষ করেই আমি ঘুমুতে যাব।’

‘কি যে তোর পাগলের মতো কথা। গল্প শেষ করে ঘুমুতেই তো যাবি জেগে বসে থাকবি না-কি?’

‘আমি জেগে বসে না-থাকলেও তুমি থাকবে। এবং আমার ধারণা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার চেষ্টা করবে। দয়া করে এই কাজটা করবে না।’

মনোয়ারা বিস্মিত হয়ে বললেন, কী এমন গল্প?

‘গল্পের শুরুটা ইন্টারেস্টিং শেষটা তেমন ইন্টারেস্টিং না। মা শুরু করব?’

‘হ্যাঁ শুরু কর।’

‘তুমি কিন্তু গল্পের মাঝখানে একটা কথাও বলবে না। হ্যাঁ, হু বলারও দরকার নেই। আসলে আজ যে আমি তোমাকে আমার সঙ্গে ঘুমুতে বলেছি— এই গল্পটা করার জন্যেই বলেছি।’

মনোয়ারা উঠে বসলেন। তাঁর বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে। সামান্যতেই আজকাল তাঁর এই সমস্যা হয়। মেয়ে একটা গল্প বলবে, সেই গল্পের ভনিতা শুনেই তাঁর বুক ধড়ফড় করবে কেন?

‘মা শোনো, গল্পটা খুব সাধারণ। আমি এক মিনিটেও বলতে পারি আবার ইচ্ছা করলে এক ঘণ্টা লাগিয়েও বলতে পারি…’

‘এক মিনিটে বলতে হবে না। তুই সময় নিয়ে বল।’

‘তোমাকে তো বলেছি মা গল্পের মাঝখানে ইন্টারেন্ট করতে পারবে না। একটি কথাও না। বুঝতেই পারছ গল্পটা আমাকে নিয়ে। বুঝতে পারছ না?’

‘হ্যাঁ বুঝতে পারছি।’

মীরা হেসে ফেলে বলল, এই তো মা তুমি কথা বললে। শর্ত কী ছিল তুমি কথা বলতে পারবে না।

‘আর বলব না। তুই এত প্যাচাচ্ছিস কেন?’

‘আচ্ছা যাও আর প্যাচাব না—গল্পটা আমাকে আর সাবেরকে নিয়ে। আমার ক্লাসের যে ক’টা ছেলেকে আমি অপছন্দ করতাম তার মধ্যে সাবের একজন। তাকে অপছন্দ করার অনেক কারণ আছে। তার সবকিছুই সস্তা। কথাবার্তা সস্তা, রসিকতাগুলি সস্তা। সবকিছুতেই চালবাজি। গ্রাম থেকে যারা হঠাৎ করে ইউনিভার্সিটিতে আসে তাদের মধ্যে এই ব্যাপারটা খুব দেখা যায়। অতিরিক্ত অতিরিক্ত স্মার্টনেস দেখাতে চেষ্টা করে। ক্লাস চলার সময় লুকিয়ে সিগারেট টানার মধ্যে অনেক বাহাদুরি। আমার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় ধমকের মধ্যে। একদিন হ্যান্ডব্যাগ খুলে দেখি—ব্যাগের ভেতর দুটা গোলাপ ফুল। স্কচ টেপ দিয়ে গোলাপ ডাঁটার সঙ্গে একটা চিরকুট। সেখানে লেখা— বলুনতো কে?

আমি ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র তাকে ধরলাম এবং কঠিন গলায় বললাম, আপনার কি ধারণা লুকিয়ে মেয়েদের ব্যাগে ফুল রেখে দেয়া বিরাট পৌরুষত্বের কাজ?

সে আমতা আমতা করে রসিকতার লাইন ধরতে চেষ্টা করল। আমি ধমক দিয়ে বললাম, আপনার সস্তা রসিকতাগুলি অন্যদের জন্যে রেখে দিন। আমার জন্যে না।

‘দামী কোনো রসিকতা যদি মাথায় আসে তাহলে কি করতে পারি?’

আমি বললাম, হ্যাঁ পারেন। রসিকতা আমি পছন্দ করি। তবে আপনি যা করেন তার নাম ছ্যাবলামি। ছ্যাবলামির মধ্যে কোনো স্মার্টনেস নেই।

আমি ভেবেছিলাম তার সঙ্গে এটাই হবে আমার শেষ কথা। তা হল না, কারণ সে আমাকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় রসিকতা শুরু করল। সবাইকে বলে বেড়াল—আমি তার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি যদি আমার ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা না চাই তাহলে সে চুল দাড়ি কিছুই কাটবে না। যেদিন আমি ক্ষমা চাইব সেদিনই সে চুল দাড়ি কাটবে। আমি ব্যাপারটাকে মোটেই পাত্তা দিলাম না। সে সত্যি সত্যি চুল দাড়ি কাটা বন্ধ করে দিল এবং দেখতে দেখতে তার চেহারা কিম্ভূত কিমাকার হয়ে গেল। ব্যাপারটাতে ক্লাসের সবাই খুব মজা পেতে লাগল। শুধু যে ছাত্ররা মজা পেল তা না, টিচাররাও মজা পেলেন। একদিন ক্লাসে মোতালেব স্যার বললেন, সাবের তোমার এই অবস্থা কেন? সন্ন্যাস নিয়েছ?

সাবের সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জ্বি না স্যার। আমার দাড়ি গোঁফ হচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। ক্লাসের একজন আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। সে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত দাড়িগোঁফ কাটব না।

স্যার বললেন, প্রতিবাদের এই প্রক্রিয়া খারাপ না। অহিংস পদ্ধতি। আমার মতে যার কারণে এই ঘটনা তার ক্ষমা চাওয়া উচিত।

স্যারের কথা শেষ হওয়া মাত্র সব ছাত্র-ছাত্রী একসঙ্গে আমার দিকে তাকাল। স্যারের জানতে বাকি রইল না কার কারণে এই প্রতিবাদ। তারপর থেকে ক্লাসে এসেই তিনি সাবেরকে জিজ্ঞেস করেন—এখনো ক্ষমা চায়নি? সবাই হো হো করে হেসে উঠে। কিছুক্ষণ হাসাহাসির পর ক্লাস শুরু হয়। গল্পটা কেমন লাগছে মা? ইন্টারেস্টিং না?

‘হ্যাঁ ইন্টারেস্টিং।’

‘তারপর একদিন আমি মহাবিরক্ত হয়ে ভাবলাম—তাকে বলব দাড়িগোঁফ কামিয়ে ভদ্র হতে। ক্লাসে তাকে কিছু বলা যাবে না। আমাকে সাবেরের সঙ্গে কথা বলতে দেখলেই চারদিকে হাসাহাসি হয়ে যাবে। আমি ঠিক করলাম একদিন তার বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলব।’

‘সাবের হলে থাকে না?’

‘মহসিন হলে তার সীট আছে কিন্তু সে হলে থাকে না। তার বড় মামার বাড়িতে থাকে—পাহারাদার।’

‘পাহারাদার মানে?’

‘ওর মামা উত্তরায় একটা বাড়ি করেছেন। বাড়ি করার পর পর ফ্যামিলি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছেন। সেই বাড়ির জন্যে দারোয়ান আছে। তারপরেও তিনি সাবেরকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন মাঝে মাঝে গিয়ে দেখেশুনে আসতে। সাবের পুরোপুরি স্থায়ী হয়ে গেছে।’

‘তুই সেই বাড়িতে একা-একা গেলি?’

‘হ্যাঁ। বাবার গাড়ি নিয়ে গেলাম। সে আমাকে দেখেই বলল—আপনি এসেছেন এই যথেষ্ট। আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনি পাঁচটা মিনিট বসুন। আমি সেলুন থেকে দাড়িগোঁফ ফেলে দিয়ে আসছি। আপনাকে চা দিয়ে যাবে। চা খেতে যতক্ষণ লাগে।’

‘আমি বসলাম। চা খেলাম। সে দাড়িগোঁফ কামিয়ে ভদ্র হয়ে ফিরে এল। আমরা মিনিট পাঁচেক কথা বললাম। সে-ই হড়বড় করে কথা বলল, আমি শুনলাম। যখন চলে আসছি তখন সে বলল, চল তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। তুমি একা-একা এতদূর যাবে।’

‘তুমি করে বলল?’

‘হ্যাঁ তুমি করে বলল। অতিরিক্ত স্মার্টনেস দেখাতে হবে তো। তাও ভাগ্যবান সে আমাকে তুমি বলছে। অন্য মেয়েদের তুই করে বলে।’

‘বলিস কী!’

‘আঁৎকে উঠার কিছু নেই মা। বর্তমানে ইউনিভার্সিটির এটাই চল। যাই হোক সে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল –আমি এখন একা-একা যাব? তুমি আমাকে এগিয়ে দাও। তার এই কথাটা কেন জানি আমার খুব ভালো লাগল।’

‘তুই তাকে এগিয়ে দিলি?’

‘হুঁ দিলাম।’

‘তারপর?’

‘তারপর হঠাৎ একদিন দেখি আগে তার যেসব ব্যাপার অসহ্য লাগত সেগুলি ভালো লাগতে শুরু করেছে। তার সস্তা রসিকতায় সবচে আগে আমি হাসতে শুরু করেছি। আমার ব্যাগে অজান্তে গোলাপফুল ঢুকিয়ে রাখলে আমার অসম্ভব ভালো লাগে। তার হাতে লেখা ছোট ছোট চিরকুটগুলি আমি জমিয়ে রাখি। যতবার পড়ি ততবারই আমার ভালো লাগে। চোখে পানি এসে যায়। আমি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তার সঙ্গে ঘুরতে শুরু করলাম। রমনা পার্কে এবং চন্দ্রিমা উদ্যানে ছেলেমেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে গুটুর গুটুর করে গল্প করছে এই দৃশ্য আমার সব সময় অসহ্য লাগত। সেই ব্যাপারগুলি আমি নিজেই করতে লাগলাম এবং একসময় খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে তার উত্তরার বাসায় যেতে শুরু করলাম। নির্জন বাড়িতে আমরা দুজন সময় কাটাতে লাগলাম।’

মনোয়ারা নিচু গলায় বললেন, কাজটা ঠিক হয়নি।

মীরা তীব্র গলায় বলল, কেন ঠিক হবে না? আমি তাকে পছন্দ করি। সে আমাকে করে, আমরা একসঙ্গে সময় কাটালে অসুবিধা কী?

‘ভুল করে ফেলতে পারিস তো মা সেইজন্যে বলছি।’

মীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। মা’র দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বলল, তুমি যে ভুলের কথা বলেছ সেই ভুলই করেছি। যখন করেছি তখন ভুল মনে হয়নি। তখন মনে হয়েছে যা করছি ঠিক করছি। শুদ্ধতম কাজটি করছি। এখন বুঝতে পারছি। এখন বুঝে তো কোনো লাভ নেই মা। যে ভুল করা হয়েছে সে ভুল শুদ্ধ করার আর উপায় নেই।

মনোয়ারা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, তার মানে?

মীরা ক্লান্ত গলায় বলল, সবই তো বললাম মা। এর পরেও মানে জানতে চাচ্ছ কেন? তুমি কি দেখছ না এখন আমার শরীর খারাপ। আমি কিছু খেতে পারি না। যা খাই বমি হয়ে যায়। আমি পর পর দুটা সাইকেল মিস করেছি।

মনোয়ারা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মীরা বলল, আমি সাবেরকে সব জানিয়েছি। শুরুতে সে বলেছে আমি যখন বলব তখনি সে আমাকে বিয়ে করবে। এখন বলছে তা সম্ভব না। তার মাথার উপর অনেক দায়িত্ব। পাশ করে চাকরিবাকরি না-করা পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না। আমাকে বলছে কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এইসব নাকি এখন কোনো ব্যাপারই না। মা শোনো তুমি এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকো না। আমি ভয়ংকর একটা ঘটনা খুব স্বাভাবিকভাবে বলে ফেললাম। এ ছাড়া আমার উপায়ও ছিল না। তোমাকে সব বলে ফেলার পর আমার খুব শান্তি লাগছে। আমি গত দুমাসে আরাম করে রাতে ঘুমুতে পারিনি। আমি নিশ্চিত আজ আমার খুব ভালো ঘুম হবে।

মনোয়ারা বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। মীরা বুঝতে পারল না। তিনি কী বলেছেন তা জানতেও চাইল না। সে বিছানায় শুয়ে গলা পর্যন্ত লেপ টানতে টানতে বলল, মা আমি দুটা জিনিস ঠিক করেছি। এক, আমি কখনোই কোনো অবস্থাতে সাবেরকে বিয়ে করব না। সে যদি কুকুরের মতো এসে আমার পা চাটতে শুরু করে তাহলেও না। দুই, আমি আমার পেটের সন্তানটি নষ্ট করব না। আমি তাকে আমার মতো করে বড় করব।

মীরা চোখ বন্ধ করে ফেলল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল।

৫. পুকুরে ছিপ ফেলা হয়েছে

পুকুরে ছিপ ফেলা হয়েছে।

আজকের আয়োজন ব্যাপক। দেলোয়ার সকালবেলাতেই পানিতে নেমেছে। মাছের চার দিয়েছে। কচুরিপানা সরিয়ে ছিপ ফেলার জায়গা করেছে। চাচাজী মাছধরা দেখতে আসতে পারেন ভেবে তাঁর জন্যে বেতের চেয়ার এনে রেখেছে। চেয়ারের সামনে চা-কফি রাখার জন্যে টেবিল আনা হয়েছে। আয়োজন দেখে শেফার খুব ভালো লাগছে। সে সকাল থেকেই ভাবছে দেলোয়ার ভাইকে ভালো কোনো উপহার দিতে হবে। সে আজ যেমন খুশি হয়েছে, উপহার পেয়ে দেলোয়ার ভাইও যেন তেমন খুশি হয়। খুশিতে খুশিতে কাটাকাটি।

মাছের মন্ত্র পড়ে ছিপে ফুঁ দেয়া হল। মন্ত্রটা পড়তে হল শেফাকেই। যে বর্শেল মন্ত্র তাকেই পড়তে হবে। অন্য কেউ পড়লে হবে না। মন্ত্রটা বেশ বড়, শেফা কাগজে লিখে নিয়েছে। কারণ মন্ত্র একবার পড়লেই হবে না। বার বার পড়তে হবে। ফানা নড়লেই মন্ত্র পড়ে পানিতে তিনবার টোকা দিতে হবে। মন্ত্রটা এ রকম,

(মাছ মন্ত্ৰ)

আয় জলি বাঁয় জলি
জলির নামে মন্ত্র বলি।
হাঁটু পানিতে রক্ষা-কালি।
রক্ষাকালির নয় দরজা।
মাছের রাজা জামজা।
মীর পীরের দোহাই লাগে
সুতার আগায় মাছ লাগে।

মাছের মন্ত্র পড়তে শেফার লজ্জা-লজ্জা লাগছে। বড় আপা দেখে ফেললে খুব হাসাহাসি করবে। ভাগ্যিস আপা এখন নেই। শুরুতে একবার এসে আয়োজন দেখে গেছে। আবার হয়তো আসবে। টোপে মাছ ঠোকরাবার সময় না এলেই হয়। আপার সামনে মন্ত্র পড়াই যাবে না। খেপিয়ে মারবে। তাকে দেখলেই সুর করে বলবে, আয় জলি বাঁয় জলি। জলির নামে মন্ত্ৰ বলি …।

দেলোয়ার পুকুর থেকে উঠে এল। সে শীতে হি হি করে কাঁপছে। সারা শরীর কাদায়-শ্যাওলায় মাখামাখি। মালকোঁচা মেরে লুঙ্গিপরা। পা ভর্তি লোম। দেখতে বিশ্রী লাগছে।

দেলোয়ার লুঙ্গি ছেড়ে দিল। তার মুখ হাসি-হাসি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে পানিতে নামা খুব আনন্দের ব্যাপার এবং শীতে থরথর করে কাঁপাও আনন্দময়।

শেফা বলল, দেলোয়ার ভাই, মাছের মন্ত্র কি সত্যি কাজ করে?

‘অবশ্যই কাজ করে। আজই প্রমাণ পাবে।’

‘মন্ত্র পড়ার সময় যদি কোনো ভুল হয় তখন কী করব?’

‘তখন আবার পড়বে।’

‘মন্ত্রের ব্যাপারটা বড় আপাকে বলবেন না। বড় আপা শুনলে খুব হাসাহাসি করবে।’

‘না কাউকে বলব না।’

‘ছিপ ফেলবেন কখন?

‘পরে ফেলব। পানিতে ‘লারা’ পড়েছে। পানি ঠাণ্ডা হোক। .

‘পানি ঠাণ্ডা হতে কতক্ষণ লাগবে?’

‘ঘণ্টা দুই লাগবে। তোমার কাজকর্ম থাকলে সেরে আস।’

‘না আমার কোনো কাজ নেই, আমি এখানেই থাকব। ছিপ ফেলার পর থেকে আপনি কিন্তু আমার সঙ্গে থাকবেন। কীভাবে ছিপে হ্যাঁচকা টান দিতে হয় আমি জানি না।’

‘কোনো চিন্তা নাই আমি থাকব।’

‘দেলোয়ার ভাই আমি আপনাকে একটা গিফট দিতে চাই, কী গিফট দেব বলুনতো। কী আপনার পছন্দ?’

‘আমার গিফট লাগবে না।’

‘লাগবে। অবশ্যই লাগবে। আপনার সবচে পছন্দের জিনিস কী আমাকে বলবেন। আমার নিজের অনেক জমানো টাকা আছে। ঈদের সময় সালাম করে আমি যত টাকা পাই সব জমিয়ে রাখি।’

‘কত টাকা জমেছে?’

‘কত জমেছে সেটা বলব না। জমা টাকার পরিমাণ বললে জমা টাকা কমে যায়। টাকার উপর চোখ লাগেতো এইজন্যে কমে যায়।’

‘তাহলে বলার দরকার নেই।’

‘ঠিক আছে আপনাকে বলে ফেলি। আমার মোট টাকা হল ছয় হাজার সাতশ পঁচিশ।’

‘অনেক টাকা।’

‘কী গিফট আপনার পছন্দ আমাকে বলবেন—আমি ঢাকায় গিয়েই আপনাকে কিনে পাঠাব। আর মুখে বলতে যদি লজ্জা লাগে তাহলে কাগজে লিখে দেবেন।’

‘আচ্ছা।

‘আপনিতো দেখি শীতে কাঁপছেন। যান ঘরে গিয়ে কাপড় বদলান। আর শুনুন দেলোয়ার ভাই, আমার জন্যে যে আপনি এত কষ্ট করেছেন For that many thanks. অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

‘আগে মাছ ধরা পড়ুক তারপর ধন্যবাদ দিও।’

‘মাছ ধরা না পড়লেও ধন্যবাদ।’

শেফা প্রবল উত্তেজনা অনুভব করছে। সে নিশ্চিত যে আজ মাছ ধরা পড়বে। সে পুকুরপাড়ে বসে রইল। তার হাতে মন্ত্রলেখা কাগজ। ছিপ ফেলতে দেরি আছে-এর মধ্যে মন্ত্রটা মুখস্থ করে ফেলতে হবে। মাছ যখন টোপ খাবে তখন হৈচৈএর মধ্যে কাগজ বের করে সে হয়তো মন্ত্র পড়তেই ভুলে যাবে। মুখস্থ করে রাখাটা ভালো।

মীরাকে আসতে দেখে শেফা মন্ত্রের কাগজ হাতে লুকিয়ে ফেলল। কামিজে পকেট থাকলে ভালো হত। কাগজটা কামিজের পকেটে লুকিয়ে ফেলা যেত। এখন রাখতে হচ্ছে হাতে। মেয়েদের ড্রেসে পকেট থাকে না কেন ভেবে তার সামান্য মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সবার কি ধারণা ছেলেদেরই শুধু পকেটে রাখার জিনিস থাকবে, মেয়েদের থাকবে না? মেয়েদের শাড়িতেও আসলে পকেটের সিস্টেম থাকা দরকার।

মীরা এসে বেতের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, এখনো পুকুরপাড়ে?

শেফা বলল, হুঁ।

শেফার একটু মন খারাপ লাগছে কারণ মীরাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। খয়েরি রঙের মতো পচা রঙের একটা শাড়িতে মানুষকে এত সুন্দর লাগে? আপার প্রতি একটু ঈর্ষা ভাব হচ্ছে। এটা খারাপ। নিজের বোনকে ঈর্ষা করতে নেই। শেফার মনে হল তার মনটাই ছোট। বাংলাদেশে তার মতো ছোটমনের মেয়ে বোধ হয় কেউ নেই। যেভাবেই হোক মনটা বড় করতে হবে।

‘আপা তোমাকে অপ্সরীর মতো লাগছে।

‘কিসের মতো লাগছে?’

‘অপ্সরীর মতো।’

‘ছিঃ অপ্সরীর মতো লাগবে কেন? অপ্সরী কী তুই জানিস?’

‘না। অপ্সরী কী?’

‘অপ্সরী হচ্ছে স্বর্গের প্রসটিটিউট। প্রসটিটিউট শব্দের মানে জানিস তো?’

শেফা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। প্রসটিটিউট শব্দের মানে সে জানে। বেশ্যা শব্দের মানে জানে। খানকি মাগী শব্দের মানেও জানে। আসলে সে বোধ হয় একটা খারাপ মেয়ে। খারাপ মেয়ে বলেই খারাপ খারাপ শব্দের মানে জানে। অপ্সরী শব্দটা এত খারাপ জানলে সে এই শব্দ কখনোই বলত না। ক্লাসের কত সুন্দরী মেয়েকে সে অপ্সরী বলেছে। ভাগ্যিস ওরাও শব্দটার আসল মানে জানে না। অপ্সরী বলতে ওরা খুশিই হয়েছে।

মীরা বলল, তুই কি লজ্জা পেয়ে গেলি নাকি?

শেফা না-সূচক মাথা নাড়ল। যদিও সে খুবই লজ্জা পেয়েছে।

‘মাছ মারা কখন শুরু হবে?’

‘কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। আজ আমার ছিপে বিশাল একটা মাছ ধরা পড়বে।’

‘কে বলেছে? দেলোয়ার সাহেব?’

‘কেউ বলেনি আমি জানি।’

‘এক হাজার টাকা বাজি তোর ছিপে কোনো মাছ ধরা পড়বে না।’

‘কত টাকা বাজি?’

‘এক হাজার এক টাকা। যা এক টাকা বাড়িয়ে দিলাম।’

‘আচ্ছা যাও বাজি।

‘বাজিতে হারলে ক্যাশ দিতে হবে। তোর সঙ্গে ক্যাশ আছে তো?’

‘আছে।’

‘ভেরি গুড, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টাইম। পাঁচটার মধ্যে মাছ ধরা না পড়লে তুই গুণে গুণে এক হাজার এক টাকা দিবি।‘

‘আচ্ছা। তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন?’

‘আমাকে খুশি খুশি লাগছে?’

‘হ্যাঁ লাগছে। সুন্দরও লাগছে আবার খুশি খুশিও লাগছে।’

‘আমি খুশি এইজন্যেই খুশি খুশি লাগছে। যে খুশি তার চেহারায় আলাদা সৌন্দর্য চলে আসে এইজন্যে সুন্দর লাগছে।

মীরা উঠে দাঁড়াল। শেফা মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। আপা চলে গেলেই ভালো। সে মন্ত্রটা মুখস্থ করে ফেলতে হবে—

আয় জলি বাঁয় জলি
জলির নামে মন্ত্র বলি।

জলিটা কী? জল? জলের নামে মন্ত্র বলা হচ্ছে? আচ্ছা এই মন্ত্রে যে জায়গায় মাছের কথা বলা হয়েছে সেখানে সে যদি মাছ না বলে ‘কচ্ছপ’ বলে তাহলে কি মাছের বদলে কচ্ছপ ধরা পড়বে? সে যদি বলে,

মীর পীরের দোহাই লাগে
সুতার আগায় কচ্ছপ লাগে।।

দেলোয়ার ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে এবং একদিন কচ্ছপের নাম বলে মন্ত্রের জোরটা পরীক্ষা করতে হবে।

.

আজহার সাহেব তার প্রিয় জায়গায় বসে আছেন। জলপাই গাছের বাঁধানো বেদীতে। একটু আগে কোকিল ডাকছিল। কোকিলের ডাক শুনে তাঁর মনটা খারাপ হয়েছে এই ভেবে যে দুই মেয়ের কেউ তার পাশে নেই। মেয়েরা থাকলে কোকিলের ডাক শুনিয়ে দিতেন। ঢাকা শহরে পাখির ডাক মানে তো কাকের ডাক। কোকিলের ডাক এরা তো বোধহয় শুনেইনি।

আজহার সাহেব দেখলেন মীরা তাঁর দিকে আসছে। ইস মেয়েটা যদি আর দশ মিনিট আগে আসত। তবে কোকিলটা আশেপাশেই আছে, আবারো নিশ্চয়ই ডাকবে।

মীরা বাবার পাশে এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, বাবা এই জায়গাটা কি তোমার খুব পছন্দের?

আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বলর্লেন, ‘হুঁ। মা তুই দশ মিনিট আগে এলে ভালো হত।’ আজহার সাহেব সাধারণত মেয়েদের তুমি বলেন। তাঁর মন যখন দ্রবীভূত থাকে তখনই শুধু তুই বলেন।

‘দশ মিনিট আগে এলে কী হত?’

‘কোকিলের ডাক শুনিয়ে দিতাম। ঢাকা শহরে এই জিনিস কোথায় পাবি?’

‘কী বলছ তুমি বাবা। সব কোকিল তো ঢাকা শহরে।’

‘তার মানে?’

‘ঢাকা শহর ভর্তি কাক। কোকিলদের ডিম পাড়তে হয় কাকের বাসায়। কাজেই কোকিলদের ভালো না লাগলেও তারা এখন ঢাকা শহরে বাস করে।

আজহার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তোর কথাতো মা ফেলে দিতে পারছি না।

‘ফেলে দিও না, তোমার ব্যাগে ভরে রেখে দাও।’

মীরা বাবার পাশে বসল। তার মুখ হাসি-হাসি। আজহার সাহেব মেয়েকে এমন হাসিখুশি অবস্থায় কখনো দেখেন নি। তাঁর খুবই ভালো লাগল। মেয়েটা কোনো একটা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, এখন মনে হয় সমস্যাটা কেটে গেছে। প্রথম যৌবনের সমস্যা অবশ্যি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হুট করে সমস্যাগুলি আসে আবার হুট করে চলে যায়।

‘মীরা!’

‘জ্বি বাবা।’

‘আজ মনে হয় তোর মনটা খুব ভালো।’

‘আমার মন সব দিনই ভালো থাকে। আমি ভাব করি যে মন খারাপ।’

‘কেন?’

‘এম্নি।’

‘গত কয়েকদিন তোকে দেখে আমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তোর মা’কে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি মীরার কী হয়েছে।’

‘মা কী বলেছে?’

‘সে জবাব দেয়নি। পাশ কাটিয়ে গেছে।’

মীরা হাসতে হাসতে বলল, পাশ কাটানোর ব্যাপারে মা খুব ওস্তাদ।

আজহার সাহেব সিগারেট ধরালেন। সিগারেট তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তবে একটা প্যাকেট সব সময় সঙ্গে রাখেন—হঠাৎ হঠাৎ খুব ইচ্ছা হলে সিগারেট ধরান। এখন খুব ইচ্ছা হচ্ছে। মীরা বলল, বাবা তুমি আমাকে কতটুকু পছন্দ কর?

আজহার সাহেব বললেন, এটা আবার কেমন প্রশ্ন। পছন্দ কি দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায় যে মেপে বলে দিলাম এতটুকু পছন্দ। পছন্দ কোয়ান্টিফাই করা যায় না।

‘তারপরও বলা যায়। উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যায়। আচ্ছা তোমার জন্যে ব্যাপারটা সহজ করে দিচ্ছি। তুমি একদিন লোকমুখে জানতে পারলে যে আমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছি তখন কী করবে?’

‘বিশ্বাস করব না। আমি তো আমার মেয়েকে চিনি। মানুষের কথায় আমি বিশ্বাস করব কেন?

‘আচ্ছা ধর আমিই তোমাকে বললাম। বললাম যে বাবা আমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছি। তখন তুমি কী করবে? আমাকে ঘৃণা করবে?

‘ঘৃণা করব কেন? পাপকে ঘৃণা করতে হয়, পাপীকে না।’

‘এইসব হল বইএর বড় বড় কথা। বইএর কথা পড়তে ভালো লাগে। বইএর বাইরে আর ভালো লাগে না। আমি একটা খুন করে ফেললাম তারপর ও তুমি আমাকে ঘৃণা করবে না?’

আজহার সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। দীর্ঘ বক্তৃতার প্রস্তুতি নিয়ে বললেন, সব কিছুই নির্ভর করছে অবস্থার উপর। খুন কেন করলি, কোন্ অবস্থায় করলি তার উপর। নিউ ইংল্যান্ডে একটা খুনের মামলা হয়েছিল। চাক্ষুষ সাক্ষী ছিল তারপরেও খুশি বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। মামলাটা পুরোপুরি আমার মনে নেই। যতটুকু মনে আছে তোকে বলি। ভেরি ইন্টারেস্টিং।

‘প্লিজ বাবা মামলার গল্প শুরু করবে না।’

‘মামলার গল্প শুনতে ভালো লাগে না?’

‘অসহ্য লাগে বাবা। বমি এসে যায়।’

‘অসহ্য লাগবে কেন? মানুষের জীবনের বিচিত্র অংশটা ধরা পড়ে কোর্টে। মানুষের চিন্তাভাবনা, কর্মকাণ্ড যে কোন্ পর্যায় যেতে পারে তা… .

আজহার সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না। কোকিল ডেকে উঠল। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বললেন, কোকিলের ডাক শুনলি?

‘হ্যাঁ শুনলাম।’

‘পাখিদের মধ্যে কোন্ পাখির ডাক তোর সবচে ভালো লাগে?’

‘কোনো পাখির ডাকই ভালো লাগে না। পাখিরা ডাকাডাকি করে পাখিদের জন্যে। মানুষের তা ভালো লাগার কোনো কারণ নেই।’

‘ঘুঘুর ডাক তোর কাছে ভালো লাগে না?’

‘না। তুমি এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার তাকানো দেখে মনে হচ্ছে ঘুঘুর ডাক ভালো না-লাগাটা বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ?’

আজহার সাহেব হেসে ফেললেন। মেয়ে দুটাই দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। নিজের মেয়ে বলে এখন আর তাদের মনে হয় না। মনে হয় অন্য বাড়ির মেয়ে। বেড়াতে এসেছে। মীরাকে দেখে কে বলবে ঐতো সেদিন তার জন্ম হল। তাঁর তখন কোর্টে কঠিন এক মামলা। মনোয়ারার ব্যথা শুরু হয়েছে—তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এই খবর পেয়েছেন কিন্তু কোর্ট ফেলে হাসপাতালে যেতে পারছেন না। মামলায় কী হচ্ছে না-হচ্ছে সেদিকেও মন দিতে পারছেন না। বিশ্রী অবস্থা। কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা চলে গেলেন মেডিকেল কলেজ। মনোয়ারা আছে নয় নম্বর কেবিনে। হাসপাতালে গিয়ে জানা গেল তাদের কোনো নয় নাম্বার কেবিনই নেই। এই নাম্বারে কেবিন নেই শুধু তাই না, মনোয়ারা নামে কোনো পেশেন্টই ভর্তি হয়নি। হাসপাতাল থেকেই বাসায় টেলিফোন করলেন। কেউ টেলিফোন ধরছে না। রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না।

আজহার সাহেব পুরানো কথা ভেবে আবারো রোমাঞ্চিত হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মীরা তোর জন্মের সময়ের ঘটনা মনে আছে? সিরিয়াস কাণ্ড।

মীরা বলল, প্লিজ বাবা সিরিয়াস কাণ্ডের গল্প এখন শুরু না করলে ভালো হয়। কতবার যে শুনেছি। মাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হলি ফ্যামিলিতে, তুমি উপস্থিত হয়েছ ঢাকা মেডিকেলে।

মীরা উঠে দাঁড়াল। আজহার সাহেব বললেন, উঠছিস কেন বোস না গল্প করি।

‘উহুঁ। তোমার ভাবভঙ্গি ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তুমি বাসি গল্প শুরু করবে।’

‘তোর মাকে পাঠিয়ে দে।’

মীরা চলে যাচ্ছে। আজহার সাহেব মমতা নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। পুরানো দিনের কথা মনে হয়ে তাঁর ভালো লাগছে। Old is gold. অতীতের গল্প হিরন্ময়। মনে করলেই ভালো লাগে। তিনি শেষ পর্যন্ত ঠিক হাসপাতালে পৌঁছলেন রাত আটটা বেজে দশ মিনিটে। লজ্জিত ভঙ্গিতে ন’ নম্বর কেবিনে ঢুকলেন। কেন দেরি হল মনোয়ারা বলতে যাবেন তার আগেই তোয়ালে দিয়ে জড়ানো মীরাকে নার্স তাঁর কোলে তুলে দিতে দিতে বলল, আপনার প্রথম সন্তান মেয়ে, আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবান। আর দেখুন কী টুকটুকে মেয়ে।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে গভীর আনন্দে আজহার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। খুবই অস্বস্তির ব্যাপার, তাঁর কোলে মেয়ে। দুটা হাতই বন্ধ। এদিকে চোখে পানি। হাত দিয়ে যে চট করে চোখের পানি মুছে ফেলবেন সে উপায় নেই। নার্স তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।

.

মনোয়ারা শোবার ঘরের খাটে বসে আছেন। সারারাত তাঁর একফোঁটা ঘুম হয়নি। ঘুমের চেষ্টাও করেননি। মীরা ঘুমিয়েছে, তিনি তার পাশে জেগে বসেছিলেন। শেষরাতে বিছানা থেকে নামলেন। বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে রইলেন। যখন আকাশে আলোর আভা দেখা গেল তখন তাঁর মনে হল, তিনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন। মীরা তাঁর সঙ্গে রসিকতা করেছে। তাঁকে প্রচণ্ড ভয় পাইয়ে মজা দেখেছে। এর বেশি কিছু না। মীরার এই স্বভাব আছে। ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় সে স্কুল থেকে টেলিফোন করে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মা খুব খারাপ খবর আছে। আমাকে প্রমোশন দেয়নি।

তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, সেকি!

‘তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম, আমার অঙ্ক আর ইংরেজি পরীক্ষা ভালো হয়নি। এখন দেখলাম দুটাতেই ফেল মার্ক।’

‘তুই কী বলছিস!’

‘হেডমিসট্রেস আপা তোমাকে আসতে বলেছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। মা তুমি আপাকে রিকোয়েস্ট করে আমাকে নাইনে তোলার ব্যবস্থা কর। একই ক্লাসে দুবছর থাকলে আমি মরে যাব।’

‘তুই কি সত্যি ফেল করেছিস?’

‘হ্যাঁ সত্যি।’

মনোয়ারা শুনলেন মীরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি বললেন, তুই কাঁদিস না। আমি এক্ষুনি আসছি।

তিনি স্কুলে গিয়ে শুনলেন মীরা পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। ক্লাসের মেয়েরা সবাই ধরেছে চাইনিজ খাবার জন্যে। মীরা এইজন্যেই মাকে খবর দিয়ে এনেছে।

কাল রাতে যে ঘটনার কথা বলল, তাঁর কাছে মনে হচ্ছে এটাও মীরার বানানো। অবশ্যই বানানো। তিনি শুধু শুধুই এমন দুশ্চিন্তা করছেন।

মনোয়ারা ফজরের নামাজ পড়লেন। তাঁর মন অনেকখানি শান্ত হল। তিনি আবারো এসে বারান্দায় বসলেন, তখন মনে হল মীরা যা বলছে সবই সত্যি। তার কথার একবর্ণও বানানো না। এই মহাবিপদে তিনি কী করবেন?

মীরার বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাঁর পরামর্শ চাইবেন? এটা সম্ভব না। ঘটনা শুনে মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল করে মারা যাবে। তার হার্টের অসুখ আছে। এসকিমা না কী যেন বলে। ডাক্তার সিগারেট খেতে মানা করে দিয়েছে। ফ্যাটি খাবার মানা করেছে। এমন একজন অসুস্থ মানুষকে এতবড় কথা বলা যায় না। যে মেয়েকে নিয়ে তাঁর এত অহংকার সেই অহংকার নষ্ট তিনি করতে পারেন না। ব্যাপারটা তাঁকেই সামাল দিতে হবে। কীভাবে সামাল দেবেন?

একটাই পথ। ছেলেটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। বিয়ে হলে সব ঝামেলা শেষ। মীরার বাবা হুট করে মেয়ের বিয়েতে রাজি হবে না। তাছাড়া ক্লাসফ্রেন্ডের সঙ্গে বিয়ে। ছেলে চাকরি-টাকরি কিছু করে না, ছাত্র। গ্রাম থেকে এসেছে, পারিবারিক অবস্থাও নিশ্চয়ই খারাপ। এটা মনোয়ারা সামাল দিতে পারবেন। তাঁর সেই ক্ষমতা আছে। যেভাবেই হোক সামাল দেবেন। কোনো একটা কৌশল করে করতে হবে। অবশ্যি কৌশলের দরকারও নেই। তিনি যদি কোনো রাতে ঘুমুতে যাবার সময় কাঁদো-কাঁদো গলায় বলেন তুমি কি আমার একটা কথা রাখবে? মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে বলবে, অবশ্যই রাখব। তোমার কোনো কথাটা আমি রাখিনি?

তখন চোখে পানি এনে বলতে হবে, কথাটা কিন্তু অন্যায়। তোমার উপর জোর খাটানো হবে।

মানুষটা তখন বলবে, কী যন্ত্রণা! কাঁদতে শুরু করলে কেন? কী চাও বল। যা বলবে তাই হবে।

মীরা বলছে ছেলেটা রাজি না। এটা কোনো ব্যাপার না। ছেলে ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন। তাকে বুঝাবেন। দরকার হলে ছেলের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলবেন। প্রয়োজনে তাদের পায়ে ধরবেন। তাঁকে তার পারিবারের সম্মান রক্ষা করতে হবে। তাঁর মেয়ের সম্মান রক্ষা করতে হবে।

মনোয়ারা চেয়ার থেকে উঠে রান্নাঘরে গেলেন। দুকাপ চা বানালেন। মীরার বাবাকে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আজই রাজি করিয়ে ফেলতে হবে, দেরি করা যাবে না।

আজহার সাহেব ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে স্ত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুবই খুশি হলেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, রাতে একফোঁটা ঘুমাওনি তাই না? চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী করেছ সারারাত? মেয়ের সঙ্গে গুটুর-গুটুর গল্প?

মনোয়ারা ক্ষীণস্বরে বললেন, হুঁ।

‘তোমরা মা মেয়ে সারারাত হেসে কী গল্প কর? একবার গোপনে তোমাদের কথাবার্তা শুনতে হবে। ওয়াটার গেট টাইপ ব্যবস্থা। হা হা হা।’

‘চায়ে চিনি টিনি লাগাবে কি-না দেখ।’

আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, চিনি টিনি কিছুই লাগবে না। অসাধারণ চা হয়েছে। আচ্ছা বেহেশতে চা পাওয়া যাবে কি-না জানো? বেহেশতে অনেক খাবারদাবারের কথা বলা হয়েছে। চায়ের কথা বলা হয়নি। চা না-পাওয়া গেলে আমার জন্যে সমস্যা।

মনোয়ারা বললেন, তুমি কি নিশ্চিত তুমি বেহেশতে যাবে?

আজহার সাহেব বললেন, তোমার কারণে নিশ্চিত। তুমি বেহেশতে যাবে এবং বেহেশতের গেটে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বলবে আমি মীরার বাবাকে ছাড়া ঢুকব না। কাজেই আমাকে নিয়ে আসা হবে। আমি তোমার সাহায্য নিয়ে বেহেশতে ঢুকব, তারপর কিন্তু আমাকে ছুটি দিতে হবে! সাতটা হুরকে নিয়ে আমার কিছু বিশেষ পরিকল্পনা আছে। হা হা হা।

মনোয়ারা কিছুই বলতে পারলেন না। দুঃখী দুঃখী চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

.

বেলা প্রায় এগারোটা। বাড়ি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মনোয়ারা চুপচাপ বসে আছেন। রাতে লোকজন খেতে আসলে ছোট আয়োজন করতে হবে। তারো আগে সাবেরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মীরাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নেত্রকোনা চলে যাবেন। টেলিফোন করে ছেলেকে এখানে চলে আসতে বলবেন। তারপর তিনি যা বলার বলবেন।

মনোয়ারা আজহার সাহেবের খোঁজে বাগানে এসেছেন। তিনি যে নেত্রকোনা যাবেন তা বলা দরকার। সাবের ছেলেটাকে এখানে খবর দিয়ে আনবেন সেই ব্যাপারটা সম্পর্কেও ধারণা দিয়ে রাখা দরকার।

আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, এসো। তোমার অবস্থাতো দেখি কাহিল। হাঁটতেও পারছ না। একরাত না ঘুমিয়েই এই অবস্থা। চোখের নিচে কালি পড়ে কী হয়েছে।

মনোয়ারা বললেন, আমি একটু নেত্রকোনা যাব। তোমার গাড়িটা নিচ্ছি।

আজহার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, বিশ্রী অভ্যাসটা ছাড় তো। তোমার গাড়ি আবার কী? বল আমাদের গাড়ি। হঠাৎ নেত্রকোনা কেন?

‘রাতে তুমি লোকজন দাওয়াত করেছ ওরা খাবে। নিজের হাতে কয়েকটা জিনিস কিনব। ভাবছি খাসির মাংস রান্না করব।’

‘চল আমি তোমার সঙ্গে যাই।’

‘না তুমি থাকো। তুমি চলে গেলে শেফা একেবারে একা থাকবে। আমি মীরাকে সঙ্গে নিচ্ছি।’

‘শেফা একা এটা ঠিক না, দেলোয়ার আছে।’

‘কী বল তুমি। দেলোয়ারের হাতে মেয়ে রেখে আমি চলে যাব না-কি? তুমি থাকো।

‘আচ্ছা যাও থাকলাম। তোমার অতিরিক্ত প্রটেকটিভ নেচার এই যুগে অচল। প্রটেকটিভ নেচার সামান্য কমাতে হবে। যুগ বদলে যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।’

মনোয়ারা স্বামীর পাশে বসতে বসতে বললেন, মীরার কোনো বন্ধু যদি এখানে বেড়াতে আসে তুমি রাগ করবে? ক্লাসফ্রেন্ড।

‘সাবেরের কথা বলছ? লম্বা ছেলেটা!’

‘হুঁ। সাবেরের খুব শখ মীরার গ্রামের বাড়ি দেখা। ওর শখ দেখে আমি কথায় কথায় বলে ফেলেছি আমরা গ্রামের বাড়িতে গেলে তোমাকে খবর দেব, চলে এসো।’

আজহার সাহেব বললেন, ক্লাসফ্রেন্ডদের সঙ্গে মেলামেশা একটা পর্যায় পর্যন্তই ভালো। এর বেশি ভালো না। মীরার কি ইচ্ছা ছেলেটা আসুক?

‘ওর ইচ্ছাও নেই অনিচ্ছাও নেই। আমি ভাবছিলাম মীরার কয়েকজন ক্লাসফ্রেন্ড এসে যদি হৈ চৈ করে যায় মীরার ভালো লাগবে।

‘কয়েকজন আসবে?’

‘সাবের যখন আসতে চেয়েছিল তখন আমি বলেছিলাম তোমরা কয়েক বন্ধু মিলে চলে এসো। মীরার গ্রামের বাড়ি খুব সুন্দর। তোমাদের ভালো লাগবে। ওদের আবার পাখি শিকার খুব শখ।’

‘পাখিতো শিকার করতে পারবে না। আইন করে নিষেধ করা আছে। যা হোক, আসুক পাখি দেখিয়ে আনব।’

‘তুমি যে গ্রামে স্কুল-টুল দিয়েছ, মীরা বড়গলায় বন্ধুদের সেইসব বলেছে। ওরা দেখতে খুব আগ্রহী।’

আজহার সাহেব উৎসাহিত গলায় বললেন, আসুক না—অসুবিধা কী? দেলোয়ারকে বল দক্ষিণের দুটা ঘর ঠিকঠাক করে দিতে। একটা কম্বল আছে না? কজন আসবে?

‘এখনো জানিনা। নেত্রকোনায় গিয়ে টেলিফোন করব। বেশি না আসাই ভালো। এত বিছানা কোথায়? হয়তো দেখা যাবে সাবের একাই আসবে। ওর আগ্রহই বেশি।’

‘আসুক দলবল নিয়েই আসুক। বিছানার ব্যবস্থা করা যাবে। তুমি নেত্রকোনা যখন যাচ্ছ দুটা সিঙ্গেল লেপ নিয়ে এসো।’

আজহার সাহেব হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো বোধ করলেন। কয়েকজন ছেলে আসবে হৈ চৈ করবে, ভালো তো। ওদের নিয়ে খেজুরের রস খাওয়া যাবে। ক্ষেতে বসে মটরশুঁটি সেদ্ধ খাওয়া হবে। পুকুরে জাল ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। শহরের ছেলে জাল ফেলে মাছ মারা নিশ্চয়ই দেখেনি। তারা নিজেরাই নিশ্চয়ই পুকুরে নেমে যাবে। ছবি তুলতে হবে। প্রচুর ছবি তুলতে হবে।

‘মনোয়ারা! তুমি যখন যাচ্ছ দু’টা ফিল্ম নিয়ে এসো। ছেলেরা এলে অনেক ছবি তোলার ব্যাপার আছে।’

মনোয়ারা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে তাঁর ভালোমানুষ স্বামীর কাছ থেকে বিদেয় নিলেন। এখন কথা বলতে হবে মীরার সঙ্গে। মীরা প্রথমে বেঁকে যাবে। বেঁকে গেলে হবে না।

.

মীরা কঠিন গলায় বলল, তুমি সাবেরের সঙ্গে কথা বলতে চাও?

‘হ্যাঁ।’

‘কেন?’

‘কেন মানে কী? এতবড় একটা ব্যাপার, আমি কথা বলব না?’

‘তোমার ব্যাপারতো মা না। আমার ব্যাপার। আমি কথা যা বলার বলেছি। ওর সঙ্গে কথা বলাবলির আর কিছু নেই।

মনোয়ারা নিজের অজান্তেই মেয়ের গালে প্রচণ্ড চড় বসালেন। মীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালো। তার চোখে গভীর বিস্ময়। মা তার গায়ে হাত তুলতে পারে এটা সে কখনো ভাবেনি।’

‘মা আমাকে মারলে কেন?’

‘তুমি এমন কিছু করনি যে তোমার গালে চুমু খেতে হবে।’

‘আমাকে মারতে হবে এমন কিছুও আমি করিনি।’

মনোয়ারা মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মীরা মাকে নিয়ে খাটের উপর পড়ে গেল। খাটের কোনা লেগে মীরার ঠোঁট কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। মীরা হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে আছে। মীরা খুবই অবাক হয়ে বলল, মা তুমি আমাকে মারছ?

‘হ্যাঁ মারছি। আমি তোকে খুন করে ফেলব।’

‘বেশতো খুন কর। খুন করে ডেডবডি বস্তায় ভরে পুকুরে পানিতে ডুবিয়ে দাও।’

‘একটা কথা না। তুই আমার সঙ্গে আয়। এখন থেকে আমি যা বলব তাই করবি।’

মীরা শোবার ঘর থেকে মা’র পেছনে পেছনে বারান্দায় এল। বারান্দায় দেলোয়ার ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে মীরার দিকে একবার তাকিয়েই চট করে চোখ নামিয়ে নিল। মনোয়ারা হিংস্র ভঙ্গিতে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কী চাও?

দেলোয়ার ক্ষীণস্বরে বলল, কিছু চাইনা চাচীজী।

‘ড্রাইভারকে বল, আমি নেত্রকোনা যাব।’

‘চাচীজী আমি সাথে যাব?’

‘হ্যাঁ তুমি সঙ্গে যাবে।’

দেলোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। বড় আপার ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। খয়েরি শাড়িতে রক্তের দাগ ভরে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। এই তথ্যটা চাচীজীকে জানানো দরকার কিন্তু তার সাহসে কুলাচ্ছে না।

মনোয়ারা বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? কথা কী বলছি কানে যাচ্ছে না?

দেলোয়ার ছুটে বের হয়ে গেল।

মীরা বলল, মা তুমি পাগলের মতো আচরণ করছ। পাগলের মতো আচরণ করতে হলে আমি করব। তুমি করছ কেন? আমি তো স্বাভাবিক আছি।

‘তুই স্বাভাবিক আছিস কারণ তুই কী করেছিস বুঝতে পারছিস না। বুঝতে পারলে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়তি।’

‘তুমি কি চাও আমি পুকুরে ঝাঁপ দেই? বল তুমি চাও?’

‘গলা উঁচু করে কথা বলবি না। খবরদার গলা উঁচু করবি না। কেউ যেন কিছু না জানে।’

‘মা তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।’

‘আমার মাথা ঠিক আছে। কতটা ঠিক আছে জানতে চাস? প্রয়োজনে আমি নিজের হাতে ইঁদুর-মারা বিষ গুলে তোকে খাওয়াব। আমার হাত কাঁপবে না। যা ঘরে যা, কাপড় বদলে আয়।’

মীরা ঘরে ঢুকল। মনোয়ারা মেয়ের পেছনে পেছনে ঢুকলেন। তাঁকে হিংস লাগছে। তাঁর ঠোঁটে ফেনা জমে আছে। মা’র দিকে তাকিয়ে মীরার বুক কাঁপতে লাগল। এই মাকে সে চেনে না। এই মা তাকে সত্যি সত্যি ইঁদুর-মারা বিষ কিনে খাওয়াতে পারে।

গাড়িতে মনোয়ারা সারাপথ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন। তাঁর নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। বমি ভাব হচ্ছে। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় নেমে তিনি বমি করলেন। সঙ্গে পানি আনা হয়নি। কুলি করা হল না। মুখ ধোয়া হল না।

দেলোয়ার একবার বলল, চাচীজী দৌড় দিয়া পানি নিয়া আসি।

মনোয়ারা বললেন, কিচ্ছু আনতে হবে না।

তিনি রাস্তার পাশের ডোবার কাছে নেমে গেলেন। ডোবার নোংরা পানি মুখে দিলেন। মাথায় দিলেন। ড্রাইভার এবং দেলোয়ার দুজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

দেলোয়ারকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পেয়েছে। মীরাও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। সে একবার শুধু বলল, মা তোমার শরীরটা কি খুব খারাপ লাগছে? মনোয়ারা মেয়ের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছু বললেন না। মীরা লক্ষ্য করল তার মা’র চোখ লাল হয়ে আছে। গাড়িতে ওঠার সময় চোখ লাল ছিল না। এখন চোখ লাল।

গাড়িতে উঠে মনোয়ারা বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। দেলোয়ারের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। নানান ধরনের কথা। এখানকার এম. পি. কেমন এম. পি., রাস্তাঘাটের এই অবস্থা ঠিক করছে না। বর্ষাকালে মাঠগুলি কি পানিতে ডুবে যায়? এখানে হাটবার কবে? পরের হাটে দেলোয়ার যেন খুঁজে দেখে ভেড়া পাওয়া যায় কি-না। তাঁর ছোটবেলা থেকে শখ তিন-চারটা বাচ্চাওয়ালা একটা মা ভেড়ার।

নেত্রকোনা শহরে পৌঁছেই তিনি দেলোয়ারকে বললেন, বাবা তুমি আমাকে আগে একটা টেলিফোন করার ব্যবস্থা করে দাও। কয়েকটা জরুরি টেলিফোন করব আর এই ফাঁকে তুমি ভালো দেখে দুই কেজি খাশির গোশত কিনবে। সিনা আর রান মিলিয়ে কিনবে। যদি টক দৈ পাওয়া যায় তাহলে এক হাঁড়ি টক দৈ কিনবে। টক দৈ না পাওয়া গেলে এক বোতল ভিনিগার। ভিনিগার কী জানো তো? সিরকা। এর সঙ্গে অবশ্যই তুমি ইঁদুর মারার যে অষুধ আছে র‍্যাটম! র‍্যাটম কিনবে। ইঁদুর মারার অষুধ পাওয়া যায় না?

দেলোয়ার বলল, জ্বি পাওয়া যায়।

‘দু প্যাকেট র‍্যাটম কিনবে। ঘরে খুব ইঁদুরের উপদ্রব। রাতে এরা বড় যন্ত্রণা করে। এক কাজ কর। আমরা গাড়িতে বসছি, তুমি আগে র‍্যাটম নিয়ে এসো তারপর টেলিফোন করতে যাব। ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে যাও। তাকে এককাপ চা খাইয়ে আনো। সারা রাস্তা ঝিমুচ্ছিল।’

দেলোয়ার ড্রাইভারকে নিয়ে চলে গেল। মনোয়ারা আগের মতো সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে পরে আছেন। তাঁর বুকের ব্যথাটা বেড়েছে।

মীরা মা’র কাণ্ডকারখানা কিছু বুঝতে পারছে না। মা এমন করছে কেন? তাকে কি র‍্যাটম দিয়ে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে? ভয় দেখাবার কিছু কি আর এখন আছে? টেলিফোনে মা কী বলবে তাও সে বুঝতে পারছে না। মা’র যা অবস্থা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একটা কথাও তো বলতে পারার কথা না। মীরা লক্ষ্য করল তার মা’র চোখ এখন আরো লাল হয়েছে। মনে হচ্ছে তাঁর চোখ উঠেছে। মীরা বলল, মা তুমি আমাকে এখানে আসতে বলছ আমি এসেছি। তুমি টেলিফোন করতে চাচ্ছ, কর। তুমি টেলিফোনে তাকে পাবে না।

‘পাব না কেন?’

‘এখন প্রায় একটা বাজে। এই সময় সে বাসায় থাকে না। টেলিফোনটা উত্তরার বাসায়।’

‘কখন সে বাসায় থাকে, কখন থাকে না—সব তোর মুখস্থ। মীরা শোন তাকে যদি টেলিফোনে না-পাওয়া যায় তাহলে তোকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব।’

‘আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে?’

‘হ্যাঁ ঢাকায় যাব। দেলোয়ারকে দিয়ে তোর বাবার কাছে চিঠি লিখে যাব যে আমার হঠাৎ শরীর খারাপ করেছে। ডাক্তার আমাকে এক্ষুনি ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেছে বলে তুই আমাকে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিস। তোর বাবা দুশ্চিন্তা করবে—করুক দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তার সে দেখেছে কী? দুশ্চিন্তার তো সবে শুরু।

মা যে এই কাজটা করবে তা মীরা বুঝতে পারছে। মা গাড়ি নিয়ে বের হবার সময়ই তৈরী হয়ে এসেছে।

মীরা বলল, মা তোমাকে একটা কথা বলি।

‘বল্।’

‘তোমার ভাবভঙ্গি দেখে আমার ভয় লাগছে। তুমি একা টেনশানটা নিতে পারছ না। তুমি এক কাজ কর, বাবাকে সব জানাও। যা করার বাবা করুক।’

‘তুই আমাকে উপদেশ দিবি না। তোর উপদেশগুলি তুই নিজের জন্যে জমা করে রাখ। তোর বাবাকে আমি কিছুই জানাব না। তোকে বিষ খাইয়ে যদি মেরেও ফেলতে হয় তাও জানাব না। মরা মেয়ের জন্যে সে কষ্ট পেলে পাবে–তুই যে কাণ্ড করেছিস সেই ঘটনা জানার কষ্ট আমি তাকে দেব না। ‘

মীরা বলল, মা তোমাকে সরল সাদাসিধা মেয়ে জানতাম। তুমি মোটেই তা না। তুমি ভয়ংকর একটা মানুষ।

মনোয়ারা শান্ত গলায় বললেন, আমি যে কত ভয়ংকর সেই সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাও নেই

‘একটা কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ মা। আমি তোমার মেয়ে। আমিও কিন্তু ভয়ংকর। কে জানে হয়তোবা তোমার চেয়েও ভয়ংকর।’

ড্রাইভার এবং দেলোয়ার ফিরে এসেছে। দেলোয়ারের হাতে কালো পলিথিনের একটা প্যাকেট। মনোয়ারা বললেন, পেয়েছ?

দেলোয়ার ভীত স্বরে বলল, জ্বি।

‘ক’ প্যাকেট এনেছ?’

‘চার প্যাকেট। চার প্যাকেট কিনলে পাইকারি রেট দেয়।’

‘ভালো করেছ।’

চাচীজীকে তার খুবই ভয় লাগছে। চাচীজীর উপর জ্বিনের আছর হয়নি তো। হবিব নামে যে জ্বিনটা এ বাড়িতে থাকে সে বড়ই দুষ্ট।

মনোয়ারা বললেন, মোতালেবকে চা খাইয়েছ?

দেলোয়ার জবাব দেবার আগেই মোতালেব বলল, জ্বি আম্মা।

‘ঘুম কেটেছে?’

‘জ্বি।

‘মোতালেব শোন। আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। বুকে ব্যথা হচ্ছে। আমাকে ঢাকা যেতে হতে পারে। গাড়ির চাকা টাকা সব ঠিক আছে?’

‘স্পেয়ার চাকা লিক আছে।’

‘আমরা টেলিফোন করার ফাঁকে গাড়ির যা ঠিকঠাক করার করে নাও।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

.

আই এস ডি লাইন হওয়ায় খুব সুবিধা হয়েছে। তিন বারের চেষ্টাতেই লাইন পাওয়া গেল। টেলিফোন ধরল সাবের। মীরার কথা ঠিক হয়নি। সাবের বাসাতেই ছিল। মীরা টেলিফোন রিসিভার মা’র দিকে বাড়িয়ে দিল। মনোয়ারা সহজ ভঙ্গিতে রিসিভার হাতে নিলেন। মফস্বলের টেলিফোন অফিস কখনো নিরিবিলি থাকে না। এখানেও নেই। ছোট্ট একটা ঘরের একদিকে মীরা এবং মনোয়ারা—অন্যদিকে টেবিল চেয়ার পেতে এক বুড়ো ভদ্রলোক বসে আছেন। মাথা নিচু করে ফাইলে কী সব লিখছেন।

মীরা নিচু গলায় বলল, মা আমি কি উনাকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্য ঘরে যেতে বলব?

মনোয়ারা বললেন, না কিছু বলতে হবে না।

ওপাশ থেকে সাবের বলল, হ্যালো হ্যালো। কে কথা বলছেন?

মনোয়ারা সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, কে সাবের?

‘জ্বি।’

‘আমি মীরার মা কথা বলছি।’

‘স্লামালিকুম।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম, তুমি ভালো আছ?’

‘জ্বি ভালো।’

‘এদিকে মীরার শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে, প্রচণ্ড জ্বর। কথা ছিল নেত্রকোনায় এসে সে তোমার সঙ্গে কথা বলবে। জ্বরের জন্যে আসতে পারেনি বলেই আমি কথা বলছি।’

‘জ্বি বলুন।’

‘তুমি কি একটু আসতে পারবে?’

‘কোথায়?’

‘মীরার গ্রামের বাড়ি। বেড়ানোর জন্যে জায়গাটা খুব সুন্দর, তোমার পছন্দ হবে।’

‘জ্বি না। ঢাকায় আমার অনেক কাজ।’

‘মীরা বলছিল তোমার সঙ্গে তার কিছু জরুরি কথা আছে।’

‘ঢাকায় যখন আসবে তখন কথা বলব।’

‘মীরাকে দেখে মনে হয় সে কোনো ভয়াবহ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সমস্যাটা কী তা কি তুমি জানো?’

‘আমি জানি না।’

‘তুমি জানো না, নাকি জেনেও দায়িত্ব অস্বীকার করতে চাচ্ছ?’

‘আপনি কী বলছেন আমি বুঝতেই পারছি না।’

‘তুমি বুঝতেই পারছ না?’

‘জ্বি না। তা ছাড়া লাইনে ডিস্টার্ব হচ্ছে। কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না।’

‘আমি অবশ্য তোমার কথা পরিষ্কার শুনতে পারছি। যাই হোক আমি কিছু কথা তোমাকে বলছি তুমি মন দিয়ে শোন। আমি তোমার জন্যে গাড়ি পাঠাচ্ছি। সন্ধ্যার দিকে গাড়ি পৌঁছে যাবে।’

‘হ্যালো শুনুন। গাড়িটাড়ি পাঠাবেন না। বিকাল সাড়ে তিনটার সময় আমি দেশে চলে যাচ্ছি। আমার মা খুব অসুস্থ। মাকে দেখতে যাব।’

‘আমি আমার কথা শেষ করে নেই তারপর তুমি যদি অসুস্থ মাকে দেখতে যেতে চাও দেখতে যাবে। অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়াই তো উচিত। আমি কী বলছি মন দিয়ে শোন। সন্ধ্যার মধ্যে তোমার কাছে গাড়ি যাবে। তুমি গাড়িতে করে চলে এসো। তুমি যদি সঙ্গে কোনো বন্ধু-বান্ধব আনতে চাও তাদেরও নিয়ে এসো…’

‘আমি শুধু শুধু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গ্রামে আসব কেন?’

‘আমি মনে করছি তোমার এখানে আসা দরকার। এখানে এলে মঙ্গল ছাড়া তোমার কোনো অমঙ্গল হবে না। না এলেই বরং অমঙ্গলের সম্ভাবনা।’

‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’

‘শুধু শুধু তোমাকে কেন ভয় দেখাব। যারা ভয় পাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকে তারা সবকিছুতেই ভয় পায়। দড়ি দেখলে ভাবে সাপ। সুতা দেখলে ভাবে সুতা সাপ। তবে বাবা শোন, তোমাকে ভয় দেখাতে চাইলে আমি অবশ্যই ভয় দেখাতে পারি। আমি যদি চাই রাত আটটার মধ্যে তুমি এখানে উপস্থিত থাকবে—তোমাকে থাকতেই হবে। তুমি মীরার সরলতা দেখবে, তার ক্ষমতা দেখবে না, তাতো হবে না।’

‘খালাম্মা আপনি রেগে যাচ্ছেন।’

‘বাবা আমি রাগছি না। যে মেয়ে সমস্যায় পড়েছে তার মা রাগতে পারেন না। আমি মোটেই রাগছি না। মীরার বাবা যখন সবকিছু শুনবেন তখন তিনি রাগ করবেন। তাঁর রাগ চণ্ডাল রাগ। সেই রাগকে আমি প্রচণ্ড ভয় করি। আমি চাই না তাঁর কানে ব্যাপারটা যাক। তোমার এবং মীরার মঙ্গলের জন্যেই এটা চাই না।’

‘আপনার কথাবার্তা শুনে আমি খুবই অবাক হচ্ছি—আসলে আমি কিছুই জানি না।’

‘কিছু না জানলে জানবে। জানার জন্যেই আসতে বলছি। এখন আমি তোমার সঙ্গে লাভক্ষতির একটা আলাপ করব। এই আলাপটা মন দিয়ে শোন। লাইনে ডিস্টার্ব হচ্ছে না তো? পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছ?’

‘জি পাচ্ছি।’

‘আমার দু’টাই মেয়ে। আমাদের যা বিষয়সম্পত্তি আছে সবই এদের। বাংলাদেশের হিসেবে মীরার বাবা শুধু সম্মানিত মানুষই নন, বিত্তবান মানুষও। ঢাকা শহরে কলাবাগানে আমাদের চারতলা একটা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ি তুমি ।দেখনি। ভাড়া দেয়া আছে। এ ছাড়াও মীরার বাবা দু’ মেয়ের নামে গুলশানে তিনহাজার স্কয়ার ফিটের দু’টা এপার্টমেন্ট কিনে দিয়েছেন। দু’টি মেয়ের জন্যেই দশ লক্ষ টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা আছে।

‘আপনি আমাকে এইসব কেন বলছেন বুঝতে পারছি না।’

‘তোমাকে বলছি কারণ মীরা তোমাকে অসম্ভব পছন্দ করে। যদি কোনো কারণে সে তোমাকে হারায় সেটা সে সহ্য করতে পারবে না।’

‘আমার হারাবার কথা উঠছে কেন? আমি তাকে বলেছি আমরা দু’জনই এখন ছাত্র। তারপর একটা প্ল্যান করে …’

‘আমি সেই সময়টা মীরাকে দিতে পারছি না। মীরার দাদীজানের বয়স আশির উপরে। তিনি গুরুতর অসুস্থ। আমরা মূলত গ্রামে এসেছি তাঁকে দেখতে। তিনি নাতজামাইয়ের মুখ দেখতে চাচ্ছেন।’

‘আপনি কি সত্যি সত্যি বিয়ের কথা ভাবছেন?’

‘মিথ্যামিথ্যি বিয়ের কথা কেউ ভাবে না। বিয়ের কথা যদি ভাবে, সত্যি বিয়ের কথাই ভাবে। যাই হোক তুমি ভেবো না যে তুমি এখানে আসবে আর জোর করে তোমাকে বিয়ে দেয়া হবে। আমি চাই মীরার দাদীজান তোমাকে দেখুন। তারপর আমরা পারিবারিক ভাবে আলাপ-আলোচনা করব। তোমার মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করব।’

‘আমার বাবা বেঁচে নেই। আমার গার্জিয়ান হচ্ছেন আমার বড় মামা।’

‘আমরা তোমার মার সঙ্গে আলাপ করব, তোমার মামার সঙ্গে আলাপ করব। আমি কথা যা বলার বলে ফেলেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে হবে। অসুস্থ মেয়ে ফেলে এসেছি। তুমি কি আর কিছু জানতে চাও?’

‘মীরা আপনাকে কী বলেছে?’

‘মীরা আমাকে কিছুই বলেনি। সে অত্যন্ত চাপা-স্বভাবের মেয়ে। তাকে মেরে ফেললেও তার পেট থেকে কোনো কথা বের করা যাবে না। তাকে হঠাৎ দেখছি সে খুব টেনশানে করছে। জানি না কী কারণ তার মাথায় ঢুকে গেছে যে তুমি তাকে ছেড়ে যাচ্ছ। আমার মেয়ের টেনশান আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। আমি তোমাকে যা বললাম, মেয়ের টেনশান কমানোর জন্যেই বললাম। আশা করি তুমি আমার উপর রাগ করোনি।’

‘জ্বি না রাগ করব কেন? রাগ করার মতো তো আপনি কিছু বলেননি।’

‘আচ্ছা বাবা রাখি। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘আমি আসতে পারব কি পারব না এখনো বলতে পারছি না। মা অসুস্থ তো।

‘বুঝতে পারছি। তুমি ভাবো। ভেবেটেবে সিদ্ধান্ত নাও। কোনো সিদ্ধান্তই হুট করে নিতে নেই। সিদ্ধান্ত যত ছোটই হোক তার জন্যে চিন্তার সময় দিতে হয়। রাখি কেমন?’

‘খালা স্লামালিকুম।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম।’

মীরা এতক্ষণ অবাক হয়ে মা’র দিকে তাকিয়েছিল। এখন সে চোখ নামিয়ে নিল। মনোয়ারা বললেন, খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মা দেখ তো আমার জন্যে একগ্লাস পানি জোগাড় করা যায় কিনা।

মা’র গলা আগের মতো হয়ে গেছে। এই কণ্ঠস্বর মমতা এবং ভালোবাসায় আর্দ্র। মীরার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। সে বলল, মা তোমার কি জ্বর আসছে। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।

মনোয়ারা ক্লান্ত গলায় বললেন, বুঝতে পারছি না।

‘বুকে ব্যথা হচ্ছে?

‘হ্যাঁ।’

‘বেশি ব্যথা হচ্ছে?

‘না বেশি না। আমি একগ্লাস পানি খাব। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে।

মীরা পানির সন্ধানে বের হল।

মনোয়ারা উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলেন তাঁর মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে এক্ষনি মেঝেতে পড়ে যাবেন। চেয়ারের হাতল ধরে তিনি নিজেকে সামলালেন। তাঁর উচিত বসে পড়া। তিনি বসলেন না, প্রায় টলতে টলতে বের হলেন।

.

উত্তেজনায় শেফার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। তার শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি সে কেঁদে ফেলবে। আসলেই তার কান্না আসছে। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে শক্ত করে কামড়ে ধরে সে কান্না থামাচ্ছে। কান্না থামানোর এটা তার পুরানো কৌশল। তার ছিপে মাছ ধরা পড়েছে। এমন সময় মাছটা ধরল যখন আশেপাশে কেউ নেই। অল্পক্ষণ আগেও আজহার সাহেব ছিলেন। তিনি বললেন, মা আমি একটু হেঁটে আসি কেমন? শেফা চাচ্ছিল তার বাবা পাশে থাকে, তারপরেও বলল, আচ্ছা। আজহার সাহেব চলে যাবার পর শেফা হঠাৎ দেখে তার দু’টা ছিপের দু’টা ফাত্নার একটা নেই। সত্যি সত্যি নেই। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি যে মাছ টেনে ফাত্না পানির নিচে নিয়ে গিয়েছে। সে চিন্তিত মুখে ফাত্না খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন হঠাৎ মনে হল মাছ টোপ গিলেনি তো! কী সর্বনাশ মাছ-মন্ত্র তো পড়া হয়নি।

সে তিনবার মাছ-মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দিল। আর তখনি শিঁশিশি ধরনের শব্দ হল। মাছ সুতা টানছে। হুইল-বড়শির হুইল ঘুরছে। শেফার বুক ধক করে উঠল। সে ডাকল, বাবা বাবা।

তখন মনে হল বাবা নেই, একটু আগে উঠে গেছেন। সে কী করবে। বঁড়শি হাতে নিয়ে হ্যাঁচকা টান দেবে? না শুধু বঁড়শি শক্ত করে ধরে বসে থাকবে। বড় মাছ যদি হয় তাকে সুদ্ধ টেনে পানিতে নিয়ে যাবে নাতো?

শেফা কাঁপতে কাঁপতে বঁড়শি ধরল। আর তখন অন্য ফাত্নাটাও পানিতে ডুবে গেল। শেফা কী করবে। মাছ-মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দেবে কী করে? তার হাত বন্ধ। মাছ সুতা টানছে। শিশিশি শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাছটার ভয়ংকর শক্তি। ছিপ ধরে বসে থাকা যাচ্ছে না। রাক্ষুসী মাছ নাতো? মানুষ গিলে খেয়ে ফেলতে পারে এমন কোনো রাক্ষসী মাছ! পুরানো দিঘিতে এ-রকম মাছ থাকতেও তো পারে। পানির অনেক নিচে এরা মাটির মাছ উপর শুয়ে থাকে। এদের একেকটার বয়স দুশ তিনশ বছর। এদের হা প্রকাণ্ড। শরীর লোহার মতো শক্ত। এরা প্রচণ্ড রাগী। বেশিরভাগ সময় এরা ঘুমিয়ে থাকে। যে .তাদের ঘুম ভাঙায় তাকে তারা কিছুতেই ক্ষমা করে না।

নানান ফন্দি-ফিকির করে এরা তাকে পানিতে নিয়ে যায়। তারপর খুবলে খুবলে চোখ খেয়ে ফেলে। এইসব কথা শেফাকে কেউ বলেনি। তার মনে হচ্ছে।

হুইলের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শেফার শরীর কাঁপছে। বুক ধক ধক করছে। আর কিছক্ষণ এ-রকম চললে শেফা মনে হয় টেনশানে মরেই যাবে। এমন অবস্থায় হঠাৎ সুতা টানা বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। পৃথিবী যেন হঠাৎ শব্দহীন হয়ে গেল। আশ্চর্য গাছের পাতাও পড়ছে না।

এ-রকম কীভাবে হয়। পৃথিবী এমন শব্দহীন হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। ভৌতিক কিছু।

শেফা কাঁদো-কাঁদো গলায় ডাকল, বাবা।

শেফাকে ভীষণ চমকে দিয়ে শেফার ঠিক পেছন থেকে আজহার সাহেব বললেন, কী হয়েছে মা?

‘মাছ টোপ খেয়েছে।’

‘মাছ টোপ খেয়েছে খুব ভালো কথা। তুই এমন ছটফট করছিস কেন?’

‘কেমন জানি লাগছে।’

‘কেমন লাগালাগির কিছু নেই। মাছটা এখন খেলিয়ে তুলতে হবে। সুতা ছাড়তে হবে। দেখি ছিপটা আমার হাতে।’

‘না তোমার হাতে দেব না। তুমি আমাকে বলে দাও কী করতে হবে। যা করতে বলবে তাই করব। সুতা কীভাবে ছাড়তে হয়?’

শেফার কথা শেষ হবার আগেই মাছ আবার সুতা টানা শুরু করল এবং প্রথমবারের মতো তাকে দেখাও গেল। সে পানি ছেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠল।

আজহার সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, একি! এ তো বিরাট মাছ! এই মাছ ধরে রাখা তোর-আমার কর্ম না। এক্ষুনি সুতা ছিঁড়ে ফেলবে।

শেফা বলল, তুমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না বাবা। আমাকে কী করতে হবে বল।

‘কী করতে হবে আমি নিজেওতো জানি না।‘

শেফা ছিপ ধরে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে তাকে-সুদ্ধ টেনে পানিতে ফেলে দেবে। আজহার সাহেব মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। উত্তেজনায় তাঁরও শরীর কাঁপছে। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, যেভাবেই হোক মাছটাকে খেলিয়ে ডাঙায় তুলতে হবে। আরো সুতা ছাড়তে হবে।

শেফা বলল, আর কীভাবে সুতা ছাড়ব?

আজহার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আমি নিজেওতো মা তোর মতই আনাড়ি। অবশ্যি আমার নিজেকে ওল্ড ম্যান দ্য সি’র ফিসারম্যানের মতো লাগছে। ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি পড়েছিস?

‘এই সময় পড়াশোনার কথা বলবে নাতো বাবা, ভালো লাগছে না।’

‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা অসাধারণ উপন্যাস।’

‘বাবা তুমি সবসময় বিরক্ত কর কেন?’

‘নোবেল প্রাইজ পাওয়া উপন্যাস।’

‘বাবা প্লিজ।’

‘শেফা আমি এক কাজ করি। আমি বরং পুকুরে নেমে পড়ি। আমি দেখেছি ছিপে বড় মাছ ধরা পড়লে একজন পুকুরে নামে।’

‘তাহলে তুমি নেমে পড়। কথা বলে সময় নষ্ট করছ কেন?’

‘তুই ছিপ শক্ত করে ধরে থাক।’

‘আমি ধরে আছি।’

আজহার সাহেবের গায়ে শীতের কাপড়। কাশ্মিরি কাজ-করা লাল সোয়েটার।

তিনি সেই কাপড়েই পানিতে নেমে পড়লেন।

.

মনোয়ারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। গাড়ির সীটে আধাশোয়া হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর মাথায় সবসময় ঘোমটা দেয়া থাকে, এখন ঘোমটা নেই। শাড়ির আঁচল সরে গেছে। জানালা খানিকটা খোলা। শীতের বাতাসে তাঁর মাথায় কাঁচাপাকা চুল উড়ছে। মীরার মনে হল জানালাটা বন্ধ করা দরকার। মা’র ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। আবার মনে হচ্ছে এই ভালো, বদ্ধ বাতাসে না-থেকে খোলা বাতাসে থাকাই ভালো। ঘুম ভালো হবে। মা’র ঘুম দরকার। আজ রাতেও মা নিশ্চয়ই ঘুমুবে না। সারারাত জেগে থাকবে। এবং তার শরীর ভয়ংকর খারাপ করবে।

মীরা মা’র একটা ব্যাপারে মুগ্ধ। সে কখনো চিন্তাও করেনি তার মা এই ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে এবং এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে। পরিস্থিতি মানুষকে তৈরী করে। কথাটা বোধহয় ঠিক। পরিস্থিতি যখন পাল্টে যায় তখন মানুষ পাল্টে যায়। মুরগি জবে করার দৃশ্য দেখে যে মানুষ ভয়ে ভিরমি খায় সে-ই ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে। তখন তার হাত কাঁপে না। মানুষ জলের মতো। পাত্রের সঙ্গে সঙ্গে সে তার আকার বদলায়।

বাড়ির পরিস্থিতি বদলে গেছে, মা বদলে গেছেন। বাবা নতুন পরিস্থিতির খবর জানেনও না। তিনি যখন জানবেন তিনি বদলে যাবেন। শেফা বদলাবে। দেলোয়ার বদলাবে। এখন দেলোয়ার ভীত মুখে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে। তার কোলে পানি-ভর্তি জেরিকেন। এক-একবার গাড়ি ঝাঁকুনি খাচ্ছে— জেরিকেনের পানি তার গায়ে পড়ছে। সে নির্বিকার। দেলোয়ার পানি সঙ্গে নিয়েছে যদি যাবার পথেও চাচীজী বমি করেন। পানির অভাবে যেন তাঁর অসুবিধা না হয়। দেলোয়ার একটু পরপর ঘাড় ঘুরিয়ে মনোয়ারাকে দেখছে। মীরার মনে হল দেলোয়ার বিড়বিড় করে মাঝে মাঝে কী যেন বলছে। জানতে ইচ্ছা করছে। পরিস্থিতি আগের মতো থাকলে সে জিজ্ঞেস করত, দেলোয়ার সাহেব বিড়বিড় করছেন কেন?

আচ্ছা এই মানুষটাকে সে দেলোয়ার সাহেব ডাকে, না দেলোয়ার ভাই ডাকে? আশ্চর্য, মনে পড়ছে না। তার নিজের মাথাও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মাথা এলোমেলো হতে দেয়া যাবে না। খুব ভয়াবহ সময় তার সামনে। সবচে ভয়ংকর সম্ভবত আজ রাতটাই। এই রাত পার করতে পারলে বাকি জীবন সুখে-দুঃখে কেটে যাবে। আজ রাত তার জন্যে কালরাত। সব মানুষের জীবনে একটা কালরাত থাকে। লখিন্দরকে যে রাতে সাপে কাটল সে রাতটা ছিল বেহুলার কালরাত।

বেহুলার চেয়ে সে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বেহুলা তার কালরাতের খবর আগেভাগে জানত না। সে জানে। না, ভুল ভাবা হচ্ছে। বেহুলা জানত তার মহাবিপদের কথা। সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সে লোহার বাসর-ঘর করেছিল। তাতে লাভ হয়নি। চুলের মতো কালনাগিনী কোন্ এক ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল।

মীরা তার কালরাতের জন্যে যত প্রস্তুতিই নিক, কোনো এক ফাঁকফোকর দিয়ে কালনাগিনী ঢুকে পড়বে। নিয়তি এড়ানো যাবে না। নিয়তি মেনে নিতে পারলে খুব ভালো হত। সব দায়দায়িত্ব নিয়তির হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ানো যেত। মুশকিল হচ্ছে নিয়তির হাতে মীরা নিজেকে ছাড়তে পারছে না। নিয়তি বেহুলার জন্যে সত্যি, তার জন্যে সত্যি না।

গাড়ি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল। ঘুম ভেঙে মনোয়ারা অসহায় গলায় বললেন, কী হয়েছেরে মীরা?

ড্রাইভার বলল, কিছু না আম্মা। চাকা পাংচার। রাস্তা এমন জঘন্য।

মনোয়ারা বললেন, চাকা বদলাতে কতক্ষণ লাগবে?

‘দশ মিনিট।’

‘তাড়াতাড়ি বদলাও। আমাদের বাড়িতে রেখে তুমি ঢাকা যাবে।’

ড্রাইভার জবাব দিল না। সে গাড়ি থেকে নেমে চাকা বদলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেলোয়ার তার পাশে। দেলোয়ারের হাতে এখনো পানি-ভর্তি জেরিকেন। সে মনে হয় কোনো অবস্থাতেই এটা হাতছাড়া করবে না।

মীরা বলল, মা তোমার কি ঠাণ্ডা লাগছে? জানালার কাচ পুরোপুরি উঠিয়ে দেব?

মনোয়ারা বললেন, আমাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই নিজের কথা ভাব।

মনোয়ারা আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মীরা গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল। মীরা নিজেকে নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু ভাবতে চাচ্ছে না। আগেভাগে ভেবে কিছু হবে না। সময় হোক। শুধু একটা ব্যাপার ঠিক রাখতে হবে—কী করবে?

এটা ঠিক করা আছে। এ নিয়ে আর ভাবাভাবির কিছু নেই। সাবের নামের মানুষটাকে সে বিয়ে করবে না। এবং…

নাহ্ এবং কী তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না। বাবার সঙ্গে মীরার কথা বলা দরকার। বাবাকেও খোলাখুলি সব জানানো দরকার। তিনি মনে কতটা কষ্ট পাবেন বা না পাবেন তা নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নেই। মীরাকে দেখতে হবে তার নিজের জীবন।

বাবাকে কথাগুলি কীভাবে বলা যায়? কথাগুলি ইংরেজিতে শুরু করা যেতে পারে। ইংরেজিতে বলার একটা সুবিধা হচ্ছে, মনে হয় সে তার নিজের সমস্যার কথা বলছে না। অন্য কারো সমস্যার কথা বলছে।

বাবা, I want to discuss something with you. Please spare me few minutes.

না ভালো লাগছে না। কথাগুলি বাংলাতেই বলতে হবে।

‘বাবা আমি একটা ভয়ংকর বড় ভুল করেছি। ভুল যখন করেছি তখন আমার কাছে ভুল মনে হয়নি এবং এখনো মনে হচ্ছে না। তবে ভুলতো বটেই। এই ভুলের জন্যে তোমরা আমাকে শাস্তি দিতে চাও দাও। কিন্তু আমার জীবনটা যেহেতু আমার, আমি সেই জীবন কীভাবে যাপন করব তা ঠিকও করব আমি। এই ব্যাপারে তোমরা জোর খাটাতে পারবে না।’

বাবা তখন নিশ্চয়ই খুবই বিস্মিত হয়ে বলবেন– এ-রকম বক্তৃতার ভাষায় কথা বলছিস কেন রে? ব্যাপারটা কী?

ব্যাপারটা শোনার পর বাবা কীভাবে রিএক্ট করবেন? আগেভাগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। মা এত কাছের, সেই মা যে এমন করবে তাতো মীরা বুঝতে পারে নি। মীরার আশা ছিল—আর কেউ না হোক, মা অন্তত তার সমস্যা কিছুটা হলেও মীরার মতো করে দেখবে। মা শুধু মা না, একই সঙ্গে মেয়ে। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের জন্যে কোনোরকম সহানুভুতি বোধ করবে না?

.

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মনোয়ারা জেগে উঠেছেন। তাঁর চোখ এখনো লাল। কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছেন বলে লাল ভাব আরো বেড়েছে।

মীরা বলল, মা তোমার শরীরটা একটু ভালো লাগছে?

মনোয়ারা জবাব দিলেন না এবং মেয়ের দিকে ফিরলেনও না। তিনি তাকিয়ে আছেন তাঁর ডানদিকে। দৃষ্টি জানালার বাইরে-—ফসল কাটা খোলা প্রান্তর। দেখার কিছু নেই।

মীরা বলল, মা একটা ক্যাসেট চালালে তোমার কি খুব অসুবিধা হবে?

মনোয়ারা মেয়ের দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে বিস্ময়। এমন একটা ভয়ংকর সময়ে মেয়েটা ক্যাসেটে গান দিতে চাচ্ছে? তার মানে কি এই যে ভয়ংকর ব্যাপারটা তার গায়ে লাগছে না! সে কিছু বুঝতেই পারছে না। তাঁর ধারণা ছিল তিনি তাঁর পরিবারের মানুষগুলিকে চেনেন। এখন মনে হচ্ছে চেনেন না।

ড্রাইভার গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে ক্যাসেট বের করে চালিয়ে দিল। গান হচ্ছে। মীরা চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। মনোয়ারা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। ফুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ে। ফুলের সঙ্গে এই মেয়ের উপমা দেয়া ঠিক হচ্ছে না। আরেকটা ব্যাপারে মনোয়ারা খুব অবাক হচ্ছেন—গান শুনতে তাঁর নিজেরো ভালো লাগছে। শুধু ভালো না, বেশ ভালো লাগছে। তিনি নিজেও চোখ বন্ধ করলেন। গান হচ্ছে। যে গাইছে তার গলাটাও তো খুব মিষ্টি। বন্যা না-কি? মনোয়ারার ইচ্ছা করছে মীরার কাছে নামটা জানতে। তিনি অবশ্যি জানতে চাইলেন না। চোখ বন্ধ করলেন।

‘হেথা যে গান গাইতে আসা আমার
হয়নি সে গান গাওয়া।
আজো কেবলি সুর সাধা, আমার
কেবল গাইতে চাওয়া।’

শেফা ভেবে পাচ্ছে না কেন তার ভাগ্যটা এত খারাপ? পৃথিবীতে নিশ্চয়ই তারচে অনেক খারাপ ভাগ্যের মেয়ে আছে—তবে শেফার ধারণা বাংলাদেশে তারচে খারাপ ভাগ্যের মেয়ে আর নেই।

আজ সে এতবড় একটা মাছ ধরে ফেলেছে। আর আজই কি-না বাড়িতে কেউ নেই। সে, বাবা আর দাদীজান। দাদীজানের সকাল থেকে দাঁতব্যথা বলে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। তারপরও তিনি এসে দেখেছেন এবং শেফাকে হতভম্ব করে বলেছেন—মাছটা তো খারাপ না।

এতবড় একটা মাছ দেখে একজন মানুষ কী করে বলে—মাছটাতো খারাপ না। দাদীজান কি আশা করেছিলেন সে ছিপ দিয়ে তিমিমাছের সাইজের একটা কাতল মাছ ধরবে?

মাছের গায়ে হাত রেখে শেফা বসে আছে। আজহার সাহেব এই অবস্থায় মেয়ের ছবি তুললেন। এটা নিয়ে শেফার মনে অশান্তি। বাবা একেবারেই ছবি তুলতে পারেন না। শাটার টেপার সময় বাবার হাত কাঁপবেই। শুধু যে হাত কাঁপে তাই না, তিনি ফ্রেমও কেটে ফেলেন। ছবি প্রিন্ট হবার পর দেখা যায় মাথা অর্ধেকটা কাটা। কিংবা একটা হাত বাদ পড়েছে। আপা এখন থাকলে কত ভালো হত। সে কখন আসবে কে জানে।

আজহার সাহেব বললেন, কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে আছিস। যা গোসল করে কাপড় বদলা।

শেফা বলল, উহুঁ আপা আসুক তারপর। বাবা তুমি এই মাছটা খাবে তো? ‘খাব না কেন?’

‘আমি রান্না করব।’

‘তুই কি রান্না করতে পারিস!’

‘দাদীজানের কাছে শিখে নেব।’

‘ভালো তো। ঠিক আছে তুই রান্না কর। আমি তোকে সাহায্য করব।’

‘তোমাকে সাহায্য করতে হবে না। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আমি যা করব নিজে নিজে করব। মাছ মারলেও একা একা মারব। রান্না করলে ও একা একা রান্না করব।’

আজহার সাহেব হাসছেন। মেয়েটার অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হচ্ছে তিনি এই গ্রহের সবচে সুখী মানুষ।

শেফা বলল, বাবা তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এমন বিশ্রীভাবে হাসছ কেন? তুমি এখন যাওতো বাবা, আমি কাজ করছি।

‘কাজ করছিস কোথায়, তুইতো মাছের গাছে হাত রেখে বসে আছিস।’

শেফা আসলেই কাজ করছে। মনে মনে ক্লাসের বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখছে। তার চারজন অতি প্রিয় বান্ধবী আছে। সবার কাছে আলাদা আলাদা চিঠি যাবে। চিঠির সাথে মাছের একটা করে ছবি দিতে পারলে ভালো হত। সেটা সম্ভব হবে না। ছবি প্রিন্ট করাতে হবে ঢাকায় গিয়ে। তাছাড়া বাবা ছবি যা তুলেছে—হয়তো দেখা যাবে ছবিতে সে আছে, মাছটা নেই।

“তুই শুনে খুবই মজা পাবি যে আমি আমাদের গ্রামের বাড়ির পুকুরে একটা মাছ ধরে ফেলেছি। মাছটা কত বড় বললে, তুই ভাববি গুল মারছি। বাবাকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে রেখেছি। তোকে ছবি দেখাব। ছবি দেখলেই বুঝবি। প্রথম যখন ছিপে টান পড়ল, আমি ভাবলাম …”

উহু চিঠিটা ভালো হচ্ছে না। আরো গুছিয়ে আরো সুন্দর করে লিখতে হবে।

মাছটা ধড়ফড় করছে। মাছটার দিকে তাকিয়ে শেফার এখন কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। আহারে বেচারা! পানির নিচে সে হয়তো ছেলেমেয়ে নিয়ে কত সুখে ছিল। সে কি কোনোদিন ভেবেছিল শেফা নামের একটা মেয়ে তাকে মেরে ফেলবে? মাছটার ঠোঁটে বঁড়শি বিঁধে আছে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। মাছটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিশ্চয়ই তীব্র ঘৃণা নিয়েই তাকাচ্ছে।

৬. মনোয়ারা দরজা জানালা বন্ধ করে

মনোয়ারা দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। বাড়ি ফিরে তিনি একবার বমি করেছেন। মুখ ধোয়ার জন্যে কলপাড়ে যেতে গিয়ে মাথাঘুরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছেন।

আজহার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার কী হয়েছে?

মনোয়ারা বললেন, বুঝতে পারছি না। মাথা ঘুরছে।

‘সেকি!’

‘নিশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে।’

‘নেত্রকোনায় যাওয়াই তোমার ঠিক হয়নি। অসুস্থ শরীর নিয়ে গিয়েছ— গাড়ির ঝাঁকুনি, পেট্রলের ধোঁয়া। এসো বিছানায় শুয়ে থাক।’

‘বিছানায় শুয়ে থাকলে হবে কীভাবে? রাতে মেহমান খাবে।’

‘সেটা আমি দেখব। দেলোয়ারকে নিয়ে যা পারি করব। তুমি শুয়ে থাক। ঘণ্টাখানিক ঘুমাও—দেখবে ভালো লাগবে।

‘আমার ঘুম আসবে না।’

‘আমি ঘুম আনার ব্যবস্থা করছি।’

‘ঘুম কি তোমার কোর্টের পেশকার যে তুমি ডাকলেই চলে আসবে?’

‘আসে কি না দেখ।’

আজহার সাহেব নিজেই দরজা জানালা বন্ধ করলেন। পর্দা টেনে দিলেন। মশারি ফেলতে গেলেন। মনোয়ারা বিরক্ত গলায় বললেন, দিনের বেলা মশারি খাটাচ্ছ কেন?

‘মশা আছে। তোমার যখন ঘুম আসতে ধরবে তখন কানের কাছে যদি একটা মশা গুনগুন করে ওঠে তাহলেই ঘুম শেষ। আমি এমন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি যেন সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি ঘুমাতে পার। তুমি লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। আমি আসছি।’

‘আর কিছু বাকি আছে?’

‘লেবুর শরবত বানিয়ে আনছি। বিশেষ উপায়ে বানানো লেবুর শরবত। একগ্লাস খেয়ে শুয়ে পড়বে, দশ মিনিটের মধ্যে ঘুম আসবে। পরীক্ষিত অষুধ।’

মনোয়ারা বললেন, তোমার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কিছু কথা আছে।

‘তুমি ঘুম থেকে ওঠো তারপর জরুরি কথা শুনব। এখন আমি লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি। আমি তোমাকে রেসিপি শিখিয়ে দিচ্ছি—কড়া ধরনের ইনসমনিয়াতে রেসিপিটা ট্রাই করবে। খুব মিষ্টি দিয়ে একগ্লাস শরবত বানাবে। দু’টা মাঝারি সাইজের লেবু কচলে রস দেবে। কাগজি লেবু না। সামান্য একটু লবণ দেবে। দুই-তিন দানার বেশি না। দু’টা শুকনা মরিচ পুড়িয়ে পোড়া মরিচটা শরবতের সঙ্গে মেশাবে। ঢক ঢক করে পুরোটা খেয়ে বিছানায় যাবে।’

‘আনো তোমার লেবুর শরবত।’

আজহার সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে লেবুর শরবত বানাতে গেলেন। মনোয়ারা খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বুকের ব্যথা এখনো আছে তবে মাথা ঘোরানোটা নেই। মনোয়ারা ঠিক করলেন লেবুর শরবত খেয়ে তিনি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবেন। একটা ব্যাপার নিয়ে ভালোমতো চিন্তা করা দরকার। মীরার বাবাকে কি সবকিছু জানাবেন? এখন তাঁর মনে হচ্ছে জানানো উচিত। এতবড় দায়িত্ব একা-একা তাঁর পক্ষে নেয়া সম্ভব না। তার শাশুড়িকেও জানানো দরকার। পুরানো দিনের মানুষদের মাথা খুব ঠাণ্ডা থাকে। জটিল ধরনের সমস্যা তাঁরা খুব সহজ সমাধান দিতে পারেন।

দরজা ঠেলে শেফা ঢুকল। সে চিন্তিত মুখে বলল, মা তোমার কী হয়েছে? ‘শরীরটা খারাপ করেছে।’

‘জ্বর?’

‘না জ্বর না। এম্নি শরীর খারাপ।’

‘মাছটার ওজন কত জানো মা? সাত কেজি। দেলোয়ার ভাই দাঁড়িপাল্লা এনে মেপেছেন। পুরোপুরি সাত কেজি না। সাত কেজির সামান্য কম। দুইশ গ্রাম বা ধরো দুইশ পঞ্চাশ গ্রাম।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

‘মাছটা আমি আর বাবা, আমরা দু’জন মিলে রান্না করছি।’

‘ভালো কথা, রান্না কর।’

‘আপার সঙ্গে মাছ মারা নিয়ে বাজি ছিল। আপা বাজির টাকা দিয়ে দিয়েছে। এক হাজার এক টাকা।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। এক মাছ নিয়ে আর কত কথা বলবে। আমি তো ঘরে পা দেবার পর থেকে শুনছি মাছ, মাছ, মাছ। মাছ ছাড়াও তো জগতে অনেক ব্যাপার আছে। আছে না? একটা কিছু মাথায় ঢুকে গেলে ভাঙা রেকর্ডের মতো সেটাই বাজাতে হবে?’

‘আই এ্যাম সরি।’

‘সরি বলে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই, দয়া করে যাও। যেমন ভূতের মতো চেহারা তেমন ভূতের মতো আচরণ। মাছ, মাছ, মাছ। কান ঝালাপালা করে দিলে তো।’

‘মা আমি তো বলেছি আই এ্যাম সরি। আর কখনো মাছ নিয়ে কথা বলব না।’

‘বলবে না কেন? অবশ্যই বলবে। শুধু কথা বলা না, মাছ কোলে নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে থাক। রান্না করার কোনো দরকার দেখি না। যাও তোমার আপাকে আসতে বলো, একগ্লাস পানি আর একটা চামচ নিয়ে যেন আসে।’

শেফা ঘর থেকে বের হয়ে এল। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না থামাবার চেষ্টা করছে। তাকে অনেকক্ষণ কান্না চেপে রাখতে হবে। আপাকে খবর দিতে হবে, তারপর নির্জন কোনো জায়গায় গিয়ে কাঁদতে হবে। তার সব বন্ধুরাই খুব কান্না পেলে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কাঁদে। সে তা পারে না। বাথরুমে সে যতবার কাঁদতে গেছে ততবার আয়নার দিকে চোখ পড়েছে। আয়নায় চোখ পড়তেই মনে হয়েছে—অন্য আরেকটা মেয়ে তার কান্না দেখছে।

.

আজহার সাহেবের বানানো লেবুর শরবত মনোয়ারা সবটাই খেয়ে ফেললেন। স্বামীকে খুশি করার জন্যে খাওয়া। দীর্ঘদিন এই জাতীয় কাজ করতে করতে ব্যাপারটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে। চা খেতে ইচ্ছা করছে না—আজহার সাহেব বললেন, খাও এককাপ চা। স্বামীকে খুশি করার জন্যে খেলেন। টিভিতে শুকনা ধরনের কোনো আলোচনা হচ্ছে। আজহার সাহেব বললেন, এই শুনে যাওতো। লোকটা তো ইন্টারেস্টিং কথা বলছে। দেশের ইকনমিক প্রবলেমটার মূল জায়গায় হাত দিয়েছে—এসো দেখে যাও। কুৎসিত সেই প্রোগ্রাম তিনি হাসিমুখে দেখেছেন।

‘শরবতটা খেতে ভালো না?’

‘না ভালো না। তোমাকে খুশি করার জন্যে খেলাম।’

আজহার সাহেব বিস্মিত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মনোয়ারা ক্লান্ত গলায় বললেন, এই জীবনে আমি বেশির ভাগ কাজই তোমাকে খুশি করার জন্যে করেছি।

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ তাই। তোমার পছন্দকে আমি নিজের পছন্দ করে নিয়েছি। আমার কষ্ট হয়েছে কিন্তু করেছি।’

আজহার সাহেবের বিস্ময় আরো বাড়ল। মনোয়ারার কথার ধরন তিনি বুঝতে পারছেন না। তার কী হয়েছে?

মনোয়ারা বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বোস।

আজহার সাহেব বসলেন। মীরা গ্লাস-ভর্তি পানি এবং চামচ নিয়ে উঁকি দিল। মনোয়ারা বললেন, তুই একটু পরে আয়। আমি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলছি।

আজহার সাহেব বললেন, কথা বলার দরকার নেই তুমি রেস্ট নাও।

‘রেস্ট তো নেবই। কথা বলতে ইচ্ছা করছে, কথা বলে নেই। আমার যখন তোমার কথা শুনতে ইচ্ছা করে না তখনো তো কথা শুনি। খুব মন দিয়ে শুনি। যেখানে হাসার কথা সেখানে হাসি। যেখানে দুঃখিত হবার দরকার সেখানে দুঃখিত হই।’

‘হঠাৎ এইসব কী ধরনের কথা শুরু করলে?’

‘তোমাদের গ্রামের বাড়িতে আমার একেবারেই আসতে ইচ্ছা করছিল না। বড় আপার ছেলেটা চিকিৎসার জন্যে বাইরে যাবে। সে মনে হয় বাঁচবে না। আমি চেয়েছিলাম কয়েকটা দিন বড় আপার কাছে থাকতে। কিন্তু তা করিনি তোমাকে খুশি করার জন্যে গ্রামে এসেছি। হৈ চৈ করছি। মজা করছি।’

‘আমাকে বললেই তো হত।’

‘বলেছিলাম। তুমি মুখে হ্যাঁ না কিছুই বলনি, কিন্তু খুব বিরক্ত হয়েছিলে। কাজেই আমি হাসিমুখে তোমার সঙ্গে এসেছি। কেন জানো?’

‘কেন?’

‘সংসারটাকে ঠিক রাখার জন্যে, সুন্দর রাখার জন্যে। যেন যেই দেখে সেই ভাবে—আহা এরা কী সুখেই না আছে! বড় আপা যতবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে ততবারই বলে—মনোয়ারা আমি তোর কাছে আসি সুখ দেখার জন্যে। তোর সুখ দেখে মন ভরে যায়।

‘সুখ দেখে কেউ যদি খুশি হয় সেটা কি দোষের?’

‘না দোষের না। আনন্দের।’

‘সংসারটা সুখের করার চেষ্টাটা কি দোষের?’

‘না দোষের হবে কেন? তবে মেকি চেষ্টাটা দোষের।’

আজহার সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তোমার চেষ্টা মেকি?

‘শুধু আমার না। আমাদের সবার চেষ্টাই মেকি।’

‘মনোয়ারা তোমাকে একটা কথা বলি। যে-কোনো কারণেই হোক আজ তুমি উত্তেজিত। উত্তেজিত অবস্থায় তুমি কী বলছ না বলছ নিজেই জানো না।’

‘জানব না কেন? খুবই জানি। তবে আমি উত্তেজিত না। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলছি।’

‘সব কথা আজই বলতে হবে কেন?’

‘আজই বলতে হবে কারণ সুখী-সুখী খেলা আর আমার ভালো লাগছে না।’

আজহার সাহেব একদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। মনোয়ারা চোখের লাল ভাব আরো বেড়েছে এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আসলে মনোয়ারা কাঁদছেন। কান্নাটাকে কান্না মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে চোখের কোনো অসুখ।

মনোয়ারা বললেন, তোমাকে খুবই জরুরি কিছু কথা বলব। মন দিয়ে শোন।

আজহার সাহেব বললেন, জরুরি কথাটা পরে শুনি।

‘না পরে শুনবে না। এখনি শুনবে। তোমার বড় মেয়ের একটা ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। মেয়ে এখন পেট বাধিয়ে ফেলেছে।’

‘কী বলছ তুমি?’

‘খুব খারাপভাবে বলছি। খারাপ জিনিস খারাপভাবেই বলতে হয়।’

আজহার সাহেবের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। তিনি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মনোয়ারা তাঁর হাত ধরে টান দিয়ে আগের জায়গায় বসিয়ে কঠিন গলায় বললেন—কোনো চিৎকার করবে না। কোনো হৈ চৈ না। তারচে বড় কথা আমার মেয়েকে একটা কথা বলবে না। আমার মেয়ের সম্মান আছে। সে জলে ভেসে আসেনি।

‘সম্মান? তোমার মেয়ের সম্মান?’

‘হ্যাঁ সম্মান। সে ভুল করেছে। এ যুগে মেলামেশার যে বাড়াবাড়ি তাতে ভুল হতেই পারে। এই ভুলের কারণে তার সম্মান সারাজীবনের জন্যে নষ্ট হবে কেন?’

‘তুমি তাকে সাপোর্ট করছ? তুমি?’

‘হ্যাঁ আমি। কারণ আমার কাজই হচ্ছে সাপোর্ট করা। তুমি যখন ভুল কর তখন ভুল জেনেও ভুলটাকে সাপোর্ট করি। করি না?’

‘আমি ভুল করি?’

‘অবশ্যই কর। তুমি ফেরেশতা না—মানুষ। এবং সাধারণ মানুষ। তুমি তো ভুল করবেই। এখন সেইসব নিয়ে কথা বলব না। এখন কথা বলব মীরার ভুল নিয়ে। তুমিতো জাজ সাহেব। মেয়ের বিচার কর।’

‘মেয়ের বিচার করব?’

‘হ্যাঁ মীরা ভার্সাস আজহার পরিবার, ফৌজদারি মামলা।’

‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

‘হয়তো হয়েছে। মাথা খারাপ না হলে সত্যিকথা বলা যায় না। সত্যি যখন বলছি তখন মনে হয় মাথা খারাপই হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে এখন কী করবে বল।’

‘ওকে এক্ষুনি বাড়ি থেকে চলে যেতে বল। এই মুহূর্তে। আমি যেন ওর মুখ না দেখি। আমি আর কোনো দিনও এই মেয়ের মুখ দেখতে চাই না।’

‘খুব ভালো কথা। মেয়েকে ডেকে ‘রায়’ শুনিয়ে দাও। আর দেলোয়ারকে বল তাকে যেন রেলস্টেশনে নিয়ে ট্রেনে তুলে দেয়। সে কি এক বস্ত্রে যাবে, না একটা স্যুটকেস সঙ্গে নিতে পারবে?’

আজহার সাহেব একদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর হাত কাঁপছে। মনে হচ্ছে তিনি চোখেও ঝাপসা দেখছেন মনোয়ারার মুখ কেমন যেন অস্পষ্ট লাগছে।

মনোয়ারা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, যা করবে নিজের সম্মান বজায় রেখে করবে। লোকজন যেন কানাকানি না করে। আচ্ছা শোন, মেয়েকে গলা টিপে মেরে দড়ি দিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে দিলে কেমন হয়? আমরা আত্মহত্যা বলে প্রচার করে দেই। তোমার কি ধারণা এতে সব দিক রক্ষা হয়?

আজহার সাহেব আবারো উঠে দাঁড়াতে গেলেন, মনোয়ারা তাঁকে ধরে বসিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বললেন—না তুমি উঠবে না। তুমি জাজ সাহেব, রায় না দিয়ে আমি তোমাকে উঠতে দেব না।

আজহার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, তুমি যা ভালো বোঝ কর।

‘আমার উপর দায়িত্ব?’

‘হ্যাঁ।’

‘এই দায়িত্ব সবসময় মেয়েদেরই নিতে হবে কেন? ছেলেরা কেন নেবে না? ছেলেরা কি পৃথিবীতে এসেছে গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানোর জন্যে?’

‘আমাকে এইসব কেন বলছ?’

‘জানি না কেন বলছি। আসলেই,তো তোমাকে না জানালেই হত। আনন্দের ব্যাপারগুলি তোমাকে জানানো যায়। সমস্যাগুলি কেন জানবে? মেয়েকে ক্লিনিকে নিয়ে ঝামেলা মুক্ত করে আনব, তুমি কিছুই জানবে না। তুমি কফি খেতে খেতে মেয়েদের সঙ্গে পাপ-খাদকের গল্প করবে। একসময় মেয়ের বিয়ে হবে। তুমি মেয়ে জামাইকে গ্রামের বাড়ি দেখাতে আনবে। তুমি তোমার এক জগতে কী সব মহৎ কর্ম করেছ তা দেখাবে।’

‘মনোয়ারা তুমি ঠিক করে বল। তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর।’

‘তোমাকে ঘৃণাও করি না আবার ভালোওবাসি না।’

‘ভালোবাস না?’

‘না। এত অবাক হয়ে তাকাচ্ছ কেন? আমি যা করি তার নাম অভিনয়। ভালোবাসার অভিনয়। তুমিও তাই কর। ‘আমাদের গাড়ি’

‘আমাদের বাড়ি’ এইসব বলে এমন ভাব করি যেন একজন আরেকজনের প্রেমে হাবুডুব খাচ্ছি। আসল ব্যাপার তা না। তুমি এখন যাও—তোমার পাথরের মতো মুখ দেখতে ভালো লাগছে না। তুমি গিয়ে রান্না-বান্নার জোগাড় দেখ। রাতে মাস্টারসাহেবরা খাবেন। তাদের কী গল্প করবে তাও ঠিক করে রাখো। পাপ-খাদকদের গল্পটা আবারো করতে পার। অনেক গল্পের মধ্যে তোমার এই গল্পটা হল কুমিরের বাচ্চা। বার বার দেখানো যায়।’

আজহার সাহেব ঘর থেকে বের হবার পর পরই মীরা পানির গ্লাস এবং চামচ নিয়ে ঢুকল। সে দেখল মা ঘুমিয়ে পরেছেন। সে মাকে জাগাল না। ঘর থেকে বের হয়ে এল।

৭. সন্ধ্যা হয়ে এসেছে

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

শেফা একা একা পুকুরপাড়ে বসে আছে। সে খুব ভয় পেয়েছে। একটু আগে সে ভয়ংকর একটা দৃশ্য দেখে এসেছে। দাদীজানের ঘরে বাবা বসে আছেন। বাবা হাউমাউ করে কাঁদছেন। দাদীজান বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এর মানে কী? কী হয়েছে? কাকে সে জিজ্ঞেস করবে। পুকুরপাড়ে সে কাঁদার জন্যে এসেছিল। এখন তার একটুও কান্না পাচ্ছে না। তার হাত পা কাঁপছে।

কামরাঙ্গা গাছ ভর্তি পাখি। বেশির ভাগই টিয়াপাখি। এরা চুপচাপ থাকে, হঠাৎ হঠাৎ সবাই একসঙ্গে ডেকে ওঠে এবং শেফা ভয়ংকর চমকে উঠে।

শেফার ভয়-ভয় করছে। সন্ধ্যাবেলা পুকুরপাড়ে একা একা থাকা ঠিক না। অশরীরা এই সময় নেমে আসে। কিন্তু শেফা কোথায় যাবে? মা শোবার ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে। মায়ের ভয়ংকর কিছু হয়েছে এটা সে বুঝতে পারছে। এই ভয়ংকর কিছুটা কী?

বড় আপারও ভয়ংকর কিছু হয়েছে। বড় আপা বারান্দায় চেয়ারে রসে আছে। তার চেহারা পর্যন্ত বদলে গেছে। তার ঠোঁট কীভাবে যেন কেটেছে। মাছের ঠোঁট বড়শি লেগে যেভাবে কেটেছিল অবিকল সেইভাবে কেটেছে। সেই ঠোঁট ফুলে কী বিশ্রী হয়েছে। বড় আপা ঠোঁটে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে কী অদ্ভুত ভাবেই না বসে আছে। শেফা দুবার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল কিন্তু শেফা নিশ্চিত যে আপা তাকে দেখতে পায়নি।

কী হচ্ছে এ বাড়িতে! মাছটা মারা ঠিক হয়নি। মনে হয় মৃত মাছটার অভিশাপ লেগে গেছে। মাছটা বেঁচে থাকলে শেফা অবশ্যই মাছটাকে পুকুরে ফেলে দিত।

‘ছোট আপা!’

শেফা চমকে তাকাল। দেলোয়ার ভাই সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। শেফার অবস্থাও কি তার আপার মতো হয়েছে। একটা মানুষ হেঁটে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়াল তারপরও শেফা তাকে দেখতে পেল না। মানুষটা যখন কথা বলল, তখনি শুধু দেখল।

‘দেলোয়ার ভাই আমার খুব মনটা খারাপ।’

‘বুঝতে পারছি।’

‘কী হয়েছে আপনি কি কিছু জানেন?’

‘জানি না ছোট আপা। তবে যাই হোক সমস্যা থাকবে না। সব আগের মতো হয়ে যাবে?’

‘কেন?’

‘চাচাজীর উপর আল্লাহপাকের খাস রহমত আছে। পীর বংশের মানুষ। উনার পীরাতিও আছে। আর আমি নিজেও দোয়া করতেছি—একটা খতম শুরু করেছি।’

‘আপনার উপর কি আল্লাহপাকের রহমত আছে?’

‘না। আমি কে,আমি কেউ না। তারপরেও দোয়া করতে দোষ নাই।’

‘আমার ধারণা আপনি খুবই ভালো মানুষ। আমি যখন বড় হব তখন আপনার মতো একজন মানুষকে বিয়ে করব।’

‘আপনি রাগ করেননি তো?’

‘না।’

‘আপনার মতো গরিব-টরিব ধরনের কাউকেই বিয়ে করতে হবে। কারণ আমার চেহারাতো ভালো না।’

‘তোমার চেহারা ভালো না কে বলেছে?’

‘আমি জানি।’

‘না তুমি জানো না।’

‘দেলোয়ার ভাই।’

‘বল।’

‘আপনি আমার জন্যেও দোয়া করবেন যেন আমার খুব ভালো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। নিজের বিয়ের জন্যে নিজে দোয়া করতে লজ্জা লাগে। তারপরও গত শবেবরাতে আমি দোয়া করেছি।’

‘আল্লাহপাক তোমার দোয়া কবুল করেছেন।’

‘কী করে বুঝলেন?’

‘কিছু কিছু জিনিস বোঝা যায়। আমিও আজ মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে দোয়া করব যেন এমন একজনের সঙ্গে তোমার বিবাহ হয় যে সারাজীবন তোমাকে মাথায় করে রাখে।

‘থ্যাঙ্ক য়্যু। থ্যাংক য়্যু ভেরি মাচ।’

দেলোয়ার হাসছে। মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে তার দোয়া করার কথা কিন্তু সে এখনই দোয়া করে ফেলল—’চাচাজীর চেয়ে একশ গুণ ভালো একটা ছেলের সঙ্গে যেন ছোটআপার বিবাহ হয়। হে পারোয়ারদেগার। হে দিনদুনিয়ার মালিক, হে রহমানুর রহিম, গরিবের এই দোয়াটা তুমি কবুল কর। আমিন।’

.

সন্ধ্যা মিলিয়েছে।

মীরার দাদীমার নামাজে দাঁড়ানোর কথা। তিনি নামাজে দাঁড়াননি। ছেলের মাথায় পানি ঢালছেন। শেফা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আজহার সাহেব তাঁর মাকে চিনতে পারছেন না, ছোট মেয়েটাকেও চিনতে পারছেন না। তিনি নিজের মনে খুব উৎসাহ নিয়ে গল্প করে যাচ্ছেন –নেদারল্যান্ডে এক আদিবাসীগোষ্ঠী আছে, যাদের বলা হয় পাপভক্ষক, Sin eaters. এরা মানুষের পাপ খেয়ে ফেলতে পারে। কেউ যখন মারা যায় পাপভক্ষকদের খবর দেয়া হয়। এরা দলবেঁধে এসে মৃত মানুষটার সব পাপ খেয়ে মানুষটাকে নিষ্পাপ করে ফেলে।

.

মীরা মা’র ঘরে ঢুকল। ক্ষীণ স্বরে ডাকল, মা।

মনোয়ারা জেগে উঠলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় তাঁর সবকিছু যেন কেমন এলোমেলো লাগছে। তিনি উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক দেখছেন।

মীরা নিচুগলায় প্রায় ফিসফিস করে বলল, মা তুমি একটু আস।

‘কেন?’

‘বাবা কেমন যেন ছটফট করছেন। দাদীজান বাবার মাথায় পানি ঢালছেন। বাবা মরে যাচ্ছে মা।’

মনোয়ারা উঠে বসলেন। মীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা তুমি বাবাকে শান্ত কর। আর শোন—র‍্যাটমের যে-প্যাকেটগুলি আছে, আমাকে দাও। আমি খাব। তোমাদের এই কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না মা।

মনোয়ারা বললেন, ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি বেঁচে আছি না! আমার এত কষ্টের সংসার আমি জলে ভেসে যেতে দেব না। আয় কাছে আয়, আদর করে দেই।

মীরা মাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, মা আমি আরেকটা অন্যায় করেছি। ড্রাইভার চাচাকে ঢাকা যেতে দেইনি।

মনোয়ারা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ভালো করেছিস। ঐ ছেলেকে আমার দরকার নেই। আয় তোর বাবার কাছে যাই।

(সমাপ্ত)

No comments