নগ্ন নির্জন রাত – অনীশ দেব

নগ্ন নির্জন রাত – অনীশ দেব

‘যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে

অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখি নি,…’

.

এ-গল্প আমি শুনেছি রিমকির কাছে। ডাক নাম রিমকি, আর পোশাকি নাম রূপশ্রী। আমার বড়দার মেয়ে সোনালির সঙ্গে রিমকি কলেজে পড়ত। এরকম সবুজ মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি—সবসময় টগবগ করে ফুটছে। যদি কখনও জিগ্যেস করতাম, ‘এত এনার্জি তুই পাস কোথা থেকে?’ তাতে হেসে গড়িয়ে পড়ত মেয়েটা। বলত, ‘মহাকাশ থেকে, কাকু, মহাকাশ থেকে!’

সূর্যের ভেতরে যেমনটা হয়, ওর ভেতরেও বোধহয় ক্রমাগত নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া হয়ে টন-টন হাইড্রোজেন বদলে যাচ্ছে হিলিয়ামে, আর তৈরি হচ্ছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি।

একটা সময়ে আমি বড়দার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতাম। তখন রিমকি প্রায়ই আসত সোনালির কাছে। আর আমার ভূতচর্চার কথা শুনে এক-একদিন এসে ভূতের গল্প শোনার আবদার ধরত।

ভূত-প্রেতের গল্প ও শুনতে চাইত কেন সেটা আমি প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। গল্প শেষ হলেই ও বলে উঠত, ‘কী দারুণ বোগাস টু-স্টোরি! কাকু, সত্যি করে বলুন না, মিথ্যেকে সত্যিতে কনভার্ট করার চেষ্টা করে আপনার কী লাভ!’ এবং তারপরই খিলখিল করে হাসি।

এইসব হাসি আর গল্পের মাঝেই চলত সরষের তেল দিয়ে মুড়ি-বাদাম-পেঁয়াজ-কাঁচলঙ্কা মেখে খাওয়া, আর বউদির তৈরি করে দেওয়া চা।

রিমকির সেই বয়েসের মুখটা বেশ মনে পড়ে। ফরসা লম্বাটে মুখ। টানাটানা চোখ। বাঁ-কানের নীচে একটা বড় তিল। কপালে কালো টিপ। পরনে উজ্জ্বল রঙের ঝলমলে চুড়িদার।

আমার বয়েসটা যদি বছর পনেরো-ষোলো কম হত তা হলে অবশ্যই আমি রিমকির প্রেমিক হতে চাইতাম। ও পাত্তা না দিলেও ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সত্যিই এরকমটা ভাবতাম। বেশ বুঝতাম, রিমকির মধ্যে এমন একটা টান আছে যে, যে-কোনও পুরুষই ওকে ভালোবাসতে চাইবে।

ভূত যে নেই, এ-কথা প্রমাণ করতে রিমকি প্রায়ই মহাতর্ক জুড়ে দিত আমার সঙ্গে। অনেক সময় বউদি আর সোনালিও ওর দলে যোগ দিত।

আমি ওকে শুধু বলতাম, ‘রূপশ্রী, যেদিন তোমার হাড়ে-হাড়ে অভিজ্ঞতা হবে, সেদিন বুঝবে আমার গল্পগুলো বোগাস ট্রু-স্টোরি, না শুধু ট্রু-স্টোরি।’

সত্যি, বয়েসের সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের কত ধ্যান্ধারণা বদলে যায়! যাকে চিরকাল ‘নেই’ বলে ভেবে এসেছি তাকে ‘আছে’ বলে মেনে নিই। যেসব ঘটনা একসময় ‘হয় না, হতে পারে না’ বলে বিশ্বাস করতাম, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সে-বিশ্বাস কেমন বদলে যায়—তখন মনে হয়, ‘হয়, হতেও পারে।’

কিন্তু আমি কখনওই চাইনি, মর্মান্তিক কোনও অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে রিমকির বিশ্বাস বদলে যাক।

অথচ তাই হয়েছিল।

প্রায় বারো বছর পর একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যেতেই বদলে যাওয়া রিমকিকে আমি চিনতে পারলাম। ওর টগবগে সবুজের ওপরে যেন সন্ধ্যার শান্ত ছায়া নেমে এসেছে।

একপাশে সরে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলার পর একটু সহজ হয়েছিল রিমকি। নরম গলায় বলেছিল, ‘কাকু, শেষ পর্যন্ত আপনিই জিতলেন।’

তারপর ওর গল্পটা আমাকে বলেছিল রিমকি—পুরোনো রিমকির ভাষায় ‘বোগাস ট্র-স্টোরি’। আর নতুন রিমকির ভাষায়? কী জানি!

শুরুর কবিতার লাইন দুটোও ওরই মুখে শোনা—গল্প বলার সময় গুনগুন করে আবৃত্তি করেছিল ও। শুনে আমার মনে হয়েছিল, গল্পের সব কথা যেন ওই মারাত্মক দুটো লাইনের মধ্যেই বলা হয়ে গেছে।

রিমকি আমাকে বলেছিল…।

আমি বাড়িতে পা দেওয়ামাত্রই একেবারে হইহই শুরু হয়ে গেল।

সুকান্তি একেবারে চেঁচিয়েই উঠল, ‘মা, মা, মঙ্গলগ্রহ থেকে রূপশ্রী এসেছে। শিগগির নেমে এসো!’

দোতলা থেকে নামতে-নামতে পিসিমা বলে উঠলেন, ‘রূপশ্রী আবার কে!’

‘রূপশ্রী মানে রিমকি। ভুলেও তো আমাদের বাড়িতে আসে না, তাই বললাম মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছে। ও এখন কথায়-কথায় হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াচ্ছে—বিগ বস। আমাদের আর পাত্তা দেবে কেন! দেখলে না, অত করে আসতে বললে, ছোড়দির বিয়েতেও এল না!’

আমি সুকান্তিকে ধমকে উঠলাম, ‘তুই থামবি! নাকে অক্সিজেনের নল গুঁজে নে—নইলে বকবক করে হাঁফিয়ে পড়বি।’

পিসিমা ততক্ষণে নীচে নেমে এসেছেন।

পরনে সাদা থান, গলায় সরু চেন, হাতে দু-গাছা চুড়ি, চোখে চশমা। মাথার চুলে বেশ পাক ধরেছে। বয়েস কত হবে এখন? মনে-মনে হিসেব করলাম। ষাট পেরিয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। অথচ টকটকে ফরসা রং এতটুকু মলিন হয়নি। এখনও দারুণ সুন্দরী। ঠিক যেন দেবীপ্রতিমা। শুনেছি, পিসেমশাই পিসিমার রূপ দেখেই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সে-কথা বুড়ো বয়েসেও বারবার বলতেন। আরও বলতেন, পিসিমা আগে চলে গেল সে-কষ্ট তিনি সইতে পারবেন না। ভগবান বোধহয় পিসেমশাইয়ের মনের কথা শুনতে পেয়েছিলেন। তাই সময় হওয়ার অনেক আগেই ওঁকে ডেকে নিয়েছেন।

‘রিমকিকে রূপশ্রী বললে কখনও চিনতে পারি!’ পিসিমা হেসে বললেন। তারপর আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘কী রে, ইতির বিয়েতে এলি না কেন?’

আমি কাঁধের ব্যাগটা বাঁ-হাতে সামলে ঝুঁকে পড়ে ঢিপ করে পিসিমাকে একটা প্রণাম করলাম।

পিসিমা আমার চিবুক ছুঁয়ে নিজের ঠোঁটে সে-আঙুল ছোঁয়ালেন : ‘ইতি বারবার তোর কথা বলছিল…।’

‘কী করব, পিসিমা। একটা কনফারেন্সে ব্যাঙ্গালোর যেতে হয়েছিল।’

সুকান্তির দুই দিদিঃ বড়দি শ্রুতি, আর ছোড়দি ইতি। শ্রুতিদি নাকি অনেকদিন আগেই পিসিমাকে জানিয়ে দিয়েছে ও বিয়ে করবে না। কেন তা খুলে বলেনি। পিসিমাই আমাকে এ-কথা বলেছিলেন। তখন পিসিমার মুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল পিসিমা সবই জানেন, কিন্তু আমাকে বলতে চাইছেন না। পরে অবশ্য কানাঘুষোয় আমি অনেকটাই জেনেছি।

ইতি আমার চেয়ে বছরতিনেকের বড়। আর সুকান্তি আমার পিঠোপিঠি। তাই সুকান্তির সঙ্গেই আমার আড্ডা বেশি জমে। পিসিমা সবসময় সবাইকে বলেন, ‘রিমকি আর সুকান্তি এক জায়গায় হলেই সেখানে হইহই করে হাট বসে যায়। কী করে যে ওরা এত বকবক করতে পারে সে ওরাই জানে।’

আমাকে সঙ্গে নিয়ে সুকান্তি আর পিসিমা দোতলায় উঠল।

উঠেই দেখি, বাঁ-দিকের বড় বেডরুমটায় শ্রুতিদি বিছানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। দক্ষিণের খোলা জানলা দিয়ে ছুটে আসা এলোমেলো বাতাস খবরের কাগজের পৃষ্ঠাগুলোকে পাগল করে দিচ্ছিল। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রুতিদির চুল উড়ছিল। শ্রুতিদি কাগজের পৃষ্ঠাগুলোকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিল।

আমাকে দেখে কাগজ থেকে মুখ তুলে সামান্য হাসল শ্রুতিদি : ‘কীরে, রিমকি, কেমন আছিস?’

ওকে দেখে মনে হল ভোরবেলাতেই স্নান সেরে নিয়েছে।

শ্রুতিদি পিসিমার মুখ পেয়েছে। ফরসা রোগা। দেখলে একটু অসুস্থ বলে মনে হয়। আগে এরকম ছিল না। বোধহয় কানাঘুষোয় শোনা সেই বিচ্ছিরি ব্যাপারটার পর এরকম হয়ে গেছে। সব ব্যাপারেই কীরকম যেন ঠান্ডা—উৎসাহ উদ্দীপনার ছিটেফোঁটা নেই কোথাও।

আমি বললাম, ‘তুমি কেমন আছ?’

আবার সামান্য হাসি। তারপর ইতির বিয়েতে না-আসা নিয়ে আর-এক প্রস্থ অনুযোগ।

ঘরে ঢুকে সবে একটা চেয়ারে বসে হাঁফ ছেড়েছি, পিসিমা বললেন, ‘এবার তোকে ছাড়ছি না—দু-চারদিন থেকে যেতেই হবে। সুকান্তি রথীনকে আর শোভাকে ফোন করে খবর দিয়ে দেবে।’

আমি হেসে বললাম, ‘আমার উত্তর শুনলে তোমরা ফ্ল্যাবারগাস্টেড হয়ে যাবে।’

‘ফ্ল্যাবারগাস্টেড মানে কী রে?’ সুকান্তি জিগ্যেস করল।

‘এও জানিস না! হতবাক, হতভম্ব।’

পিসিমা বললেন, ‘তা হতবাক হয়ে যাওয়ার মতো উত্তরটা শুনি।’

‘আমি তোমাদের এখানে দু-চারদিন থাকতেই এসেছি। দেখছ না, ব্যাগটা কী ভারী!’

উত্তর শুনে সুকান্তি আর পিসিমা একেবারে ছেলেমানুষ হয়ে গেল। হওয়ারই কথা। কারণ, আমার ছোটবেলা-বড়লোকের অনেকটা সময় শ্রীরামপুরে পিসিমাদের বাড়িতেই কেটেছে। আজ বুঝতে পারি, আমি যে ‘আমি’ হয়ে উঠেছি, তার জন্যে পিসিমা-পিসেমশাইয়ের কাছে অনেক ঋণ রয়ে গেছে আমার।

তাই ওদের সঙ্গে-সঙ্গে আমিও ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম।

শ্রুতিদি একটু অবাক হয়ে তিনটে পাগলকে দেখছিল।

হঠাৎই একটা গ্যালপিং ট্রেন ছুটে গেল সামনের রেল-লাইন দিয়ে। পিসিমাদের পুরোনো বাড়ির জানলা-দরজা মিহি শব্দ তুলে কাঁপতে লাগল।

ট্রেনের এই কু-ঝিকঝিক শব্দ আমার বালিকা বয়েসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তখন পুজোর ছুটি আর গরমের ছুটি মানেই শ্রীরামপুরে পিসিমাদের বাড়ি। আর ট্রেনের কু-ঝিকঝিক।

পিসিমাদের বাড়িটা রাইল্যান্ড রোডের ধারে। বোধহয় একশো কি দেড়শো বছরের পুরনো। পিসেমশাই এটা কেনার পর জোড়াতালি দিয়ে সারিয়ে-টারিয়ে নিয়েছেন। একতলায় একটা ঘর আর কলতলা-বাথরুম। দোতলায় দুটো ঘর আর পশ্চিমে রেল-লাইনের দিকে একটা টানা বারান্দা। আর একেবারে কোণের দিকে একটা আধুনিক ছাঁদের বাথরুম পিসেমশাই তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন।

আমি হাত-মুখ ধুয়ে শাড়ি-টাড়ি ছেড়ে এলাম।

পিসিমা চা করে দিলেন। তারপর ইতিদির বিয়ের গল্প শুরু হল। কোন বাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল, খাওয়া-দাওয়ার মেনু কীরকম হয়েছিল, বাসী বিয়ের দিন কী-কী মজা হয়েছিল, শয্যা তোলার সময় ভালোমানুষ বরের কাছ থেকে কীভাবে চাপ দিয়ে কড়কড়ে পাঁচশো টাকা আদায় করা হয়েছিল, এইসব।

এর কিছু-কিছু আমি ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে বাবা-মায়ের কাছে শুনেছি। কারণ, ওরা বিয়েতে এসেছিল। তবুও আর-একবার শুনতে খারাপ লাগছিল না।

আমাদের কথাবার্তা হাসি-ঠাট্টায় শ্রুতিদি ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসছিল। ছোট বোনের বিয়ে নিয়ে নানান কথা বলছিল। তারপর একসময় আমাকে বিয়ের ফটো দেখতে বসল।

এসেছিলাম সেই সকাল আটটায়। কখন যে বেলা বারোটা বেজে গেছে কারও খেয়ালই নেই।

পিসিমা একবার সুকান্তিকে বলেছিলেন, ‘তুই আজ অফিসে বেরোবি না?’

সুকান্তি হেসে উঠে বলল, ‘পাগল হয়েছ, মা! অ্যাদ্দিন পর রিমকি এসেছে আর আমি অফিস যাব! প্রণয়কে বলে দেব, ও খবর দিয়ে দেবে। আমার যা ছুটি পাওনা আছে তাতে দু-চারদিন ডুব মারাটা কোনও ব্যাপার না।’

পিসিমা আমাকে স্নান করতে যাওয়ার তাড়া দিতেই সুকান্তি বলল, ‘না, মা। খাওয়ার দেরি আছে। তোমরা বসে গল্প করো—আমি মাংস কিনে নিয়ে আসি। বটতলায় গেলে পেয়ে যাব। আমি তো জানি, রিমকি ছোটবেলা থেকেই মাংসাশী প্রাণী।’

সুকান্তি চলে যেতেই পিসিমা আমার অফিসের কথা শুনতে চাইলেন। বিজ্ঞাপন কোম্পানির ধরন-ধারণ পিসিমার একেবারেই অচেনা। তাই বাচ্চা ছেলেকে বোঝানোর মতো করে আমি সব বোঝাতে লাগলাম। বললাম, বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলোর মধ্যে কী কম্পিটিশান। কেন আমাকে কলকাতা ছেড়ে বারবার বাইরে দৌড়োতে হয়।

শ্রুতিদি আমার কথা খুব মন দিয়ে শুনছিল। শোনার পর বলল, ‘তোকে আমার হিংসে হচ্ছে, রিমকি। তোর মতো লাইফ আমার খুব পছন্দ।’

পিসিমা একবার অদ্ভুত চোখে বড় মেয়ের দিকে তাকালেন।

আমি শ্রুতিদিকে বললাম, শ্রুতিদি, সবই নদীর এ পার কহে…। সত্যিকারের সুখ-শান্তি বলতে যা বোঝায় সেটা কারওর নেই। ওটা শুধু খুঁজে বেড়ানোর জিনিস—কখনও পাওয়া যায় না।’

শ্রুতিদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আমার হঠাৎই বেশ খারাপ লাগছিল।

খটাখট শব্দে একটা লোকাল ট্রেন চলে গেল।

খোলা জানলা দিয়ে লাইনের ধারের গাছপালা দেখা যাচ্ছিল। কাছেই ইলেকট্রিকের তারে দুটো শালিক বসে রয়েছে। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছিল। জোরালো রোদে কয়েকটা পাতা আয়নার মতো চকচক করছিল।

পিসিমা বললেন, ‘শ্রুতিকে কত বলি, টিউশনি কর—ও করতে চায় না।’

‘টিউশনি আমার ভাল্লাগে না।’ শ্রুতিদি বলল।

আমি ওকে বললাম, ‘তোমার তো আঁকার হাত ভালো ছিল। হাতের কাজটাজ কিছু করতে পারো…বাটিকের কাজ…।’

শ্রুতিদি মলিন হাসল। ছোট্ট করে ‘হুঃ…’ শব্দ করল।

এরপর গল্প আর তেমন জমল না। আমি স্নান করার তোড়জোড় শুরু করলাম। পিসিমাও রান্নাবান্নার ব্যাপারটা দেখতে চলে গেলেন।

রাতে সবাই মিলে একসঙ্গে যখন খেতে বসেছি, তখন পিসিমা সুকান্তিকে বললেন, ‘কীরে, কী ঠিক করলি? তুই কি তা হলে একতলায় ঘরে শুবি? আর রিমকি তোর ঘরে শোবে?’

সুকান্তি খেতে-খেতে মায়ের দিকে তাকাল। জড়ানো গলায় বলল, ‘আমাকে সব লটবহর নিয়ে তা হলে নীচে নামতে হবে। তা ছাড়া আমার ব্যাচিলার্স ডেন কি রিমকির ভালো লাগবে?’ একটু হাসল সুকান্তি।

আমি সাত-তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘একতলায় শুতে আমার কোনও প্রবলেম নেই, পিসিমা।’

‘না, তা না….যদি ভয়-টয় পাস….।’

আমি হাসলাম : ‘চোর-ডাকাত হলে ভয় পেতেও পারি। তা ছাড়া আবার ভয় কীসের! আমার একা-একা শোওয়ার অভ্যাস আছে।’

সুকান্তি খাওয়া-থামিয়ে বলল, ‘রিমকির আই. কিউ. দিন-দিন কমে যাচ্ছে। মা চোর-ডাকাতের ভয়ের কথা বলছে না—বলছে গোস্ট প্রবলেমের কথা।’

‘ভূতের ভয়!’ আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না : ‘পিসিমা, সত্যি….ভূত বলে কিছু থাকলে তবে না তাকে ভয় পাব! ভূত হচ্ছে বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্যে বড়দের তৈরি একটা মিথ—মিথ্যেও বলতে পারো। আমি তো আর বাচ্চা নই!’

শ্রুতিদি কেমন অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছিল। ওর বলা সকালের কথাটা মনে পড়ল : তোকে আমার হিংসে হচ্ছে, রিমকি।

সুকান্তি পিসিমাকে বলল, ‘রিমকি একটুও বদলায়নি। সেই ছোটবেলার মতোই—ঝাঁসি কি রানি। কী বল, রিমকি!’

আমি বললাম, ‘তুই ছোটবেলা থেকে যা কুঁড়ে! তুই কখনও নিজের আস্তানা ছাড়বি! বিছানায় পাশ ফিরতে হলেও তো মাকে ডাকিস পাশ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে।’

সুকান্তির সঙ্গে লাঠালাঠি করতে-করতেই খাওয়া শেষ হল।

এরপর শুতে যাওয়ার পালা। সুকান্তি বলল, ‘দাঁড়া, তোর জন্যে ক’টা ম্যাগাজিন নিয়ে আসি—।’

আমি বললাম, দরকার নেই—আমার সঙ্গে বই আছে, কিন্তু ও শুনল না। ওর ঘরে গেল ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে আসতে।

দোতলার বড় ঘরটায় পিসিমা আর শ্রুতিদি শোয়। তার পাশের ছোট ঘরটায় সুকান্তি। ওর ঠিক নীচেই আমার জন্যে বরাদ্দ করা ঘরটা। এমনিতে ওটা বন্ধই পড়ে থাকে—ইতিও ওখানে শুত না। পিসেমশাই বেঁচে থাকতে ঘরটা ব্যবহার হত। এককালে ছিল বৈঠকখানা—পরে পিসেমশাইয়ের শোওয়ার ঘর। ঘর ছাড়া বাকিটা পুরোনো ধাঁচের বারান্দা, কলতলা আর বাথরুম।

খাওয়া-দাওয়ার পর পিসিমাদের সঙ্গে বসে আর-এক প্রস্থ গল্প, আর কিছুটা সময় টিভি দেখলাম। তারপর হাই উঠতে লাগল।

পিসিমা বললেন, ‘আজকের মতো ঢের হয়েছে। এবারে শুতে যা—।’

সুকান্তি ম্যাগাজিনগুলো হাতে নিয়ে আমাকে খোঁচা দিল : ‘চল, তোকে সি অফ করে আসি।’

একতলার ঘরের দরজায় এসে ও বলল, ‘ঢুকেই বাঁ-দিকে সুইচবোর্ড—তুই তো জানিস। আর বাথরুম…।’

আমি ম্যাগাজিনগুলো ওর হাত থেকে নিয়ে বললাম, ‘মায়ের কাছে মাসির গল্প করিস না। গুডনাইট। কাল সকাল-সকাল উঠবি—আমাকে এসকর্ট করে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে যাবি, সানরাইজ দেখাবি।’

ও ভুরু উঁচিয়ে বলল, ‘এটা কি পুরী নাকি! এখানে সানরাইজ রান্নাঘরের তাকে পলিপ্যাকে পাওয়া যায়।’ হাসল সুকান্তি। তারপর গলাটা সিরিয়াস করে বলল, ‘সত্যি তুই ভয় পাবি না তো!’

আমি হালকা গলায় বললাম, ‘পেলে তোকে ডাকব।’

‘তা হলে গলা ফাটিয়ে চেঁচাবি…জানিস তো আমার স্লিপ খুব ডিপ।’

ও চলে গেল।

আমি ঘরের আলো জ্বেলে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলাম। সাবধানের মার নেই ভেবে খিল আর ছিটকিনি—দুটোই এঁটে দিলাম। তারপর ম্যাগাজিনগুলো বিছানায় রেখে ঘরের এক কোণে গিয়ে শাড়ি ছেড়ে নাইটি পরে নিলাম।

ঘরে আলো বলতে একটিমাত্র টিউব লাইট। আর আসবাবপত্র বলতে একটা ছোট কাঠের আলমারি, একটা টেবিল, একটা চেয়ার, একটা বুককেস, আর একটা ছোট খাট। আলমারির মাথায় পুরোনো আমলের টুকিটাকি জিনিস—তার মধ্যে একটা পেতলের দোয়াত আর একটা পেতলের ফুলদানি। তবে এত ময়লা হয়ে গেছে যে, পেতলের বলে আর বোঝা যায় না।

ঘরে তিনটে জানলা : একটা ভেতরের কলতলার দিকে, আর দুটো রেল-লাইনের দিকে। তিনটে জানলাতেই শক্তপোক্ত গ্রিল লাগানো।

বিছানায় গা ঢেলে দিতেই এক অদ্ভুত তৃপ্তি পেলাম—যেন কেউ আমার জন্যে পালকের কোল পেতে দিয়েছে। অথচ বিছানাটা নিতান্তই মামুলি।

সামান্য আড়মোড়া ভেঙে একটা ফিল্ম ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিলাম। ব্যাগে আরভিং ওয়ালেসের ‘সিনস অভ ফিলিপ ফ্লেমিং’ রয়েছে, কিন্তু সেটা আর বের করতে ইচ্ছে করল না।

রাতে বই পড়া আমার বহুদিনের অভ্যেস। তাই ক্লান্ত লাগলেও ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ বোলাতে লাগলাম। বহুদিন সিনেমার খবর নেওয়া হয় না। তাই ম্যাগাজিনটা পড়তে খারাপ লাগছিল না।

মাঝে-মাঝে ট্রেন ছুটে যাওয়ার শব্দে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎই একটা ট্রেন চলে যাওয়ার পর কে যেন আলতো করে আমার নাম ধরে ডাকল।

‘রূপশ্রী…।’

আমি চমকে উঠলাম। চোখ ফেরালাম দরজার দিকে। দরজায় ছিটকিনি, খিল সব ঠিকঠাকই আছে।

সুকান্তি কি দরজার বাইরে থেকে আমাকে ডাকল! কিন্তু ডাকটার ধরন যেন কেমন অদ্ভুত। কেউ যেন ভীষণ আহ্লাদ করে আমার নামটা উচ্চারণ করেছে।

বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত একটা বাজতে মিনিট পাঁচ-সাতেক বাকি। এ-সময়ে সুকান্তি কেন আমাকে ডাকতে আসবে! নাকি ও ঝাঁসির রানির সাহস পরীক্ষা করে দেখতে চায়।

ম্যাগাজিনটা মাথার কাছে রেখে আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। একটু সতর্কভাবে দরজার কাছে গেলাম। দরজার পাল্লার জোড়ের কাছে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘কে? সুকান্তি?’

উত্তরে কোনও সাড়া পেলাম না। তবে মনে হল যেন কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আবার প্রশ্ন করলাম আমি, ‘কে? কে?’

কোনও উত্তর নেই।

পিসিমাদের সদরে গ্রিলের দরজা বসানো। তার ঠিক পরেই একটা ভারী কাঠের দরজা। দরজাগুলো তালা-খিল-টিল দিয়ে ঠিকঠাক বন্ধ থাকে। এ ছাড়া বাইরে থেকে উটকো লোক ঢুকে পড়ার কোনও পথ নেই। তিনতলার ছাদের দরজাতেও বরাবর রাতে খিল এঁটে দেওয়া হয়।

সুতরাং কিছুক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভীষণ বোকা-বোকা লাগল। মনে হয় আমার নাম ধরে কেউ ডাকেনি। ম্যাগাজিনের দিকে মনোযোগ থাকায় আমি হয়তো ভুল শুনেছি। সামান্য এই কারণে যদি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করি, তা হলে সুকান্তি টিটকিরি দিয়ে আর টিকতে দেবে না।

চুপচাপ বিছানায় ফিরে এলাম। ছোট টেবিলটায় জলের জগ আর গ্লাস রাখা ছিল। সেদিকে চোখ পড়তেই পলকে তেষ্টা পেয়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে চলে গেলাম টেবিলের কাছে। গ্লাসে জল ঢেলে প্রাণভরে তেষ্টা মেটাতে গিয়েও থেমে গেলাম। বেশি জল খাওয়া ঠিক হবে না। কারণ, রাতে আর বাথরুমে বেরোতে চাই না।

গলাটা সমান্য ভিজিয়ে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিলাম। অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরের ভেতরে। আন্দাজে ভর করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাইরের ঝোপঝাড় থেকে রাত-পোকার ডাক কানে আসছিল।

চোখটা একটু সয়ে আসতেই রেল-লাইনের দিকের খোলা জানলা দুটোর দিকে নজর পড়ল। ঘরের তুলনায় অন্ধকার সেখান খানিকটা যেন কম। কালো আকাশ, দু-একটা তারা, আর গাছ-গাছালির কয়েকটা ডালপালা অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।

আর-একটা ট্রেন ঝমাঝম করে ছুটে গেল। তারপরই যেন চারিদিক চুপচাপ হয়ে গেল। বাতাসে নড়ে ওঠা পাতার খসখস শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।

হঠাৎই ডাকটা শোনা গেল আবার।

‘রূ-প-শ্রী…।’

আবেগ থরথর গলায় ভীষণ চাপা ফিসফিসে স্বরে আমার নাম ধরে ডেকে উঠল কেউ।

না, এবারে শুনতে আমার কোনওরকম ভুল হয়নি। তিনটে অক্ষরকে আলাদাভাবে টেনে-টেনে উচ্চারণ করেছে সে। ভালোবাসার জ্বরে বেপথু কোনও রোমান্টিক কণ্ঠস্বর।

পিসেমাশইয়ের গলা এটা নয়। তা ছাড়া তিনি অপঘাতে মারা যাননি যে ভূত-প্রেত হয়ে উপোসী ভালোবাসা নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন।

তা হলে এমন করে কে ডাকছে আমায়!

আমি বিছানায় কাঠ হয়ে শুয়ে রইলাম। যেন সামান্য নড়াচড়া করলেই অতল খাদে পড়ে চিরকালের মতো তলিয়ে যাব।

এইভাবে কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পর ভাবতে শুরু করলাম, ঘরের আলোটা জ্বেলে দেব কি না। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে আমার—স্বীকার করতে লজ্জা নেই—বেশ ভয়-ভয় করছিল। অথচ আমার মনের একটা অংশ ভেতর থেকে বারবার আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করছিল যে, ভূত বলে কিছু নেই। যারা ভূতের ভয় পায় ভূতেরা তাদের দেখা দেয়। কিন্তু আমার মনের বাকি অংশ কিছুতেই সেসব যুক্তি মানতে চাইছিল না।

ঠিক তখনই ‘খুট’ করে একটা শব্দ হল। যেন কেউ ঘরের দরজা খুলল। অন্ধকারে বাইরে থেকে ছুটে আসা বাতাসের ঝাপটাও টের পেলাম আমি। অথচ একটু আগেই দেখেছি দরজায় খিল-ছিটকিনি ভালো করেই আঁটা রয়েছে।

আমি শুয়ে-শুয়েই ঘামতে শুরু করলাম। অথচ মাথার ওপরে সিলিং পাখা একই তালে ঘুরে চলেছে। এরপর কি আমি অজ্ঞান হয়ে যাব!

দরজার শব্দ হল আবার। তারপর অতি সাবধানে খিল লাগানোর শব্দ, ছিটকিনি আঁটার শব্দ।

তার মানে। কেউ কি ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা আবার বন্ধ করছে! অসম্ভব!

নিজেকে বারবার বললাম, এ-সময় মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার। অযথা ভয় পাওয়ার কোনও মানে হয় না। কারণ, ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই। কিচ্ছু নেই।

যুক্তি দিয়ে সবই বুঝতে পারছিলাম, অথচ ভীষণ ভয় করছিল।

আমার খুব কাছে কে যেন নিঃশ্বাসে ফেলল। তারপর পা ফেলে হেঁটে বেড়ানোর অস্পষ্ট শব্দ পেলাম।

আমার চোখ খুব একটা কাজ করছিল না। তবে নাক আর কান দ্বিগুণ সজাগ ছিল। হয়তো সেইজন্যেই পারফিউমের হালকা গন্ধটা টের পেলাম।

এই পারফিউম আমি ব্যবহার করি না। কিন্তু কেন জানি না মনে হল, এটা পুরুষদের পারফিউম। আর গন্ধটা আমাকে যেন টানছিল, নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল।

ঠিক তখনই একটা জমাট ছায়া জানলার চৌকো ফ্রেমে দেখতে পেলাম—তবে মাত্র একপলকের জন্যে। তারপরই ওটা আলমারির দিকে সরে গেল।

এবার আমি চিৎকার করতে চাইলাম, কিন্তু ভোকাল কর্ড স্ট্রাইক করে বসল।

আশ্চর্য! যখন আমি চিৎকার করতে পারতাম তখন লজ্জায় সঙ্কোচে চিৎকার করতে চাইনি। আর এখন প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইছি অথচ পারছি না।

হঠাৎই মনে হল আমার বিছানার খুব কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে—ঝুঁকে পড়েছে আমার শরীরের ওপরে। পারফিউম ছাড়া আমি যেন একটা উগ্র পুরুষালি গন্ধ পাচ্ছি। একই সঙ্গে পায়রার বুকের পালকের মতো নরম আলতো একটা ছোঁয়া আমাকে অবশ করে দিল। হাতে, পায়ে, গলায়, বুকে। টিভি চালিয়ে তার স্ক্রিনের খুব কাছে হাত নিয়ে গেলে যেরকম অনুভূতি হয়, এ-ছোঁয়া ঠিক সেইরকম।

আমার ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে তীব্র হুইসল দিয়ে ঝমাঝম শব্দে একটা ট্রেন ছুটে গেল।

আর সঙ্গে-সঙ্গে তাল কেটে গিয়ে সব ওলটপালট হয়ে গেল। পলকে পারফিউমের গন্ধ, অলৌকিক ছোঁয়া—সব উধাও। আমার ঘুমের ঘোরও কেটে গেল। গলা পর্যন্ত যে-ভয় উথলে উঠেছিল সেটা থার্মোমিটারের পারার মতো দ্রুত নামতে লাগল।

প্রচণ্ড এক চেষ্টায় বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম আমি। হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় আলোর সুইচ জ্বেলে দিলাম।

ঘরে কেউ নেই।

ঘরটা শেষ যেমনটি দেখেছিলাম ঠিক তেমনটিই আছে।

হঠাৎই আমার চোখ গেল ঘরের দরজার দিকে।

দরজার খিল-ছিটকিনি দুটোই খোলা। দরজার পাল্লা দুটো ইঞ্চিদুয়েক ফাঁক হয়ে আছে।

তা হলে কি ঘরে চোর ঢুকেছিল! কিন্তু বাইরে থেকে তো খিল-ছিটকিনি খোলা অসম্ভব!

দরজা আবার ভালো করে বন্ধ করে খিল আর ছিটকিনি এঁটে দিলাম। পাল্লাদুটো বারকয়েক টেনেটুনে দেখলাম ঠিক আছে কি না। তারপর বিছানায় ফিরে এলাম।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সওয়া তিনটে।

শরীর আর বইছিল না। আলো জ্বেলে রেখেই শুয়ে পড়লাম। কারণ, আলো নিভিয়ে দিলে আমার আর কিছুতেই ঘুম আসবে না।

দুমদুম করে দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছিল।

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। হাতঘড়িটার দিকে তাকালাম। ন’টা বাজতে দশ মিনিট বাকি। জানলার দিকে তাকিয়েও বোঝা যাচ্ছে বেলা অনেক হয়ে গেছে।

দরজায় আবার ধাক্কা পড়ল। সেই সঙ্গে সুকান্তি আমার নাম ধরে ডাকল : ‘রিমকি! রিমকি! ওঠ, ওঠ—ন’টা বাজে! তুই বলে মর্নিং ওয়াকে যাবি, সানরাইজ দেখবি!’

আমি সাড়া দিলাম : ‘খুলছি, খুলছি! এক মিনিট…।’

এক মিনিটের কম সময়েই পোশাক পালটে টুথব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে দরজা খুলে দিলাম।

‘কাল রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারিসনি নাকি!’

আমি জড়ানো গলায় বললাম, ‘না।’

তখনই ও দরজার কাছ থেকে জ্বলন্ত টিউব লাইটটা দেখতে পেল।

‘কী রে, সারা রাত আলো জ্বেলে ঘুমিয়েছিলি নাকি!’

‘হ্যাঁ। আলো-পাখা অফ করে দে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে ওপরে যাচ্ছি। গিয়ে সব বলছি। পিসিমাকে বল চা করতে—।’

ওপরে গিয়ে চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়েই আমি বললাম। ‘পিসিমা, কিছু মাইন্ড কোরো না। তোমাদের ওই একতলায় ঘরটা কিন্তু হন্টেড।’

‘হন্টেড মানে! ঠিক কী বলতে চাইছিস?’ সুকান্তি জিগ্যেস করল।

আমি চায়ের কাপে আর-একটা লম্বা চুমুক দিয়ে নির্বিকারভাবে বললাম, ‘হন্টেড মানে হন্টেড। ওই ঘরটায় ভূতের উপদ্রব আছে। আমাকে আগে বলিসনি কেন!’

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।

পিসিমা, শ্রুতিদি, সুকান্তি—সবাই বেশ ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। পিসিমা আর শ্রুতিদি তো মনে হল আমার কথায় বেশ ভয় পেয়ে গেছে। আর সুকান্তি আমাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল। বুঝতে চাইছিল আমি সত্যি-সত্যি ভূতের কথা বলছি, নাকি ঠাট্টা করছি।

কিছুক্ষণ পর সুকান্তি মুখ নীচু করে মিনমিন করে বলল, ‘না…মানে… ভাবিনি যে, এখনও ও-ঘরটায় কোনও প্রবলেম হতে পারে।’ মুখ তুলে পিসিমার দিকে তাকাল ও : ‘মা, তুমি তো জানো, ছোড়দির বন্ধু ঈশিতা তো এসে রাতে ও-ঘরে ছিল। তখন তো কিছু হয়নি! তারপর…।’

লক্ষ করলাম, শ্রুতিদির চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। আর পিসিমাও কেমন যেন অস্বস্তি পেয়ে এক মুখে ওর মুখে চাইছেন।

সুকান্তি আমার কাছে ঝুঁকে এসে জানতে চাইল : ‘তুই ঠিক কী দেখেছিস বল তো! কী হয়েছে কাল রাতে?’

‘কী আবার হবে! একটা লোক ঢুকে পড়েছিল আমার ঘরের ভেতরে। অথচ রাত্তিরে শোওয়ার আগে খিল-ছিটকিনি ঠিকমতোই এঁটে দিয়েছিলাম।’

আমি চা খেতে-খেতে পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম।

জানলা দিয়ে রোদ-ঝলমলে দিন দেখা যাচ্ছে। চারপাশে কোথাও অশরীরী—অলৌকিকের ছায়ামাত্র নেই। এই পরিবেশে কাল রাতের ব্যাপার-স্যাপারগুলো বলতে গিয়ে আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। মনে হল, এমন তো নয় যে, বাইরে থেকে কায়দা করে একতলার ঘরটার খিল-ছিটকিনি খোলা যায়! তা হলে কোনও বদমাশ লোক চুরি বা অন্য কোনও বদ মতলবে বাইরে থেকে খিল-ছিটকিনি খুলে মাঝরাতে ঘরে ঢুকে পড়েছে! তারপর ট্রেনের আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে পালিয়েছে।

সে-কথাই সুকান্তিকে বললাম।

সুকান্তি মানতে চাইল না। বলল, ‘না রে, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। ঘরটা বোধহয় সত্যি-সত্যিই হন্টেড। তোর আগে আরও দুটো এরকম কেস হয়েছে।’

‘কীরকম, শুনি—।’

এবার পিসিমা মুখ খুললেন : ‘জয়তীকে তুই চিনবি না। আমার ননদের বড় মেয়ে। বছর পাঁচেক আগে ও ওয়ালশ হসপিটালে ওর এক আত্মীয়কে দেখতে এসেছিল। কী একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল যেন। তখন ও আমাদের বাড়িতে এসে থেকেছিল। রাতে নীচের ওই ঘরটায় শুয়েছিল। ও কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়েছিল—।’

‘কী দেখেছিল রাতে?’ আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল।

পিসিমা শাড়ির আঁচলে হাত মুছলেন। তারপর বললেন, ‘দাঁড়া, ভাতটা একবার দেখে আসি। আঁচটা কমিয়ে দিয়ে আসি।’

পিসিমা উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।

একটু পরেই ফিরে এসে বলতে শুরু করলেন।

‘রাত কত হয়েছিল জয়তীর খেয়াল নেই। তবে খুব গভীর রাত নিশ্চয়ই। হঠাৎই ও দেখল রেল-লাইনের দিকে একটা জানলার গ্রিলের বাইরে একটা ছায়া। চুপচাপ দাঁড়িয়ে যেন ওকে লক্ষ করছে।

‘জয়তী প্রথমটায় ভেবেছে চোর-ছ্যাঁচড় হবে। ও চিৎকার করতে যাবে, ঠিক তখনই দ্যাখে ছায়াটা গ্রিল ভেদ করে ঘরে ঢুকে পড়ল—ঠিক একতাল মাখনের মতো। জয়তী আর চিৎকার করতে পারেনি। ও কাঠ হয়ে শুয়ে ছায়াটাকে লক্ষ করতে চেষ্টা করছিল।

‘তখন শুক্লপক্ষ ছিল। তাই আবছা হলেও লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিল জয়তী। লোকটা ওর বিছানার ধার ঘেঁষে পায়চারি করছিল। জয়তী ওর নিঃশ্বাসের শব্দ পেয়েছিল। একটা সেন্টের গন্ধ পেয়েছিল। তারপর… তারপর…।’

সুকান্তি আচমকা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মা, আমি একটু বাজারে বেরুচ্ছি। আচ্ছা, কাঁচালঙ্কা কি ফুরিয়ে গেছে, না আছে?’

‘একশো নিয়ে আসিস।’

সুকান্তি একটা গানের কলি ভাঁজতে-ভাঁজতে বেরিয়ে গেল।

আমি পিসিমার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

‘সুকান্তির সামনে পরের কথাগুলো বলতে অসুবিধে হত…।’ পিসিমা বললেন, ‘ও অবশ্য জানে—তাই আমার অসুবিধেটা বুঝতে পেরে চলে গেল। তোরা মেয়ে, তোদের সামনে বলা যায়…।

‘এরপর লোকটা জয়তীর গায়ে হাত দিয়েছিল। ওর…ওর…এত…এত ভালো লেগেছিল যে, ও মুখ ফুটে বারণ করতে পারেনি।’ পিসিমা চোখ নামালেন। ওঁর মুখে লালচে ভাব ফুটে উঠল।

শ্রুতিদিরও দেখলাম কান-টান লাল হয়ে গেছে। অনধিকারী ভালোবাসায় তৃপ্তি পাওয়া নিশ্চয়ই অন্যায়। কিন্তু শরীর যে সবসময় মনের কথা মানতে চায় না!

‘এইসব করতে-করতেই লোকটা বিড়বিড় করে কবিতার মতো কী একটা আবৃত্তি করেছিল। জয়তী দু-চারটে লাইন মনে করে আমাকে বলেছিল, কিন্তু আমার ঠিক মনে পড়ছে না। শুরুটা এইরকম ছিল : ”যে আমাকে চিরদিন…”। তারপর কী যেন—।’

শ্রুতিদি হঠাৎ বলে উঠল, ”’যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে / অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখি নি, / সেই নারীর মতো”…তারপর খানিকটা ঝাপসা, মনে পড়ছে না…তারপর আবার ”আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা, / আর তুমি নারী—/ এই সব ছিল সেই জগতে একদিন।”’

আমি অবাক হয়ে শ্রুতিদিকে দেখছিলাম। ও থামতেই বলে উঠলাম, ‘নামটা তোমার শ্রুতির বদলে শ্রুতিধর হলে মানানসই হত।’

শ্রুতিদি হাসল।

পিসিমা আবার বলতে শুরু করলেন।

‘তারপর ছায়াটা আলমারির কাছে যায়। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কীসব করতে থাকে। তারপর চলে আসে টেবিলের কাছে। সেখানে ঝুঁকে পড়ে খানিক সময় কাটিয়ে দেয়। জয়তী ভেবেছিল, লোকটা বোধহয় টেবিলের ড্রয়ারটা খোলার চেষ্টা করছে। যাই হোক, এরপর ছায়াটা চলে যায় আলমারির পেছনে। একদিক দিয়ে ঢুকে আর-একদিক দিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর আবার ফিরে আসে জয়তীর কাছে। আবার ওইসব শুরু করে দেয়। জয়তী যখন নেশার ঘোরে প্রায় তলিয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎই সামনের লাইন দিয়ে কানফাটানো শব্দ করে একটা ট্রেন ছুটে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে জয়তীর সেন্স ফিরে আসে। ও চেঁচিয়ে ওঠে। তখন অন্ধকার ছায়াটা যেন হাওয়ায় ভেসে জানলার গ্রিল ভেদ করে পলকে পালিয়ে যায়।’

পিসিমার গল্প শেষ হতেই আমি হেসে বললাম, ‘ভূত নয়, পিসিমা—চোর। খুব বদ টাইপের চোর। তোমাদের থানায় ইনফর্ম করা উচিত ছিল। লোকটা আলমারি খোলার চেষ্টা করে পারেনি। টেবিলের ড্রয়ারটাও খুলতে পারেনি। তখন তোমার ঘুমন্ত রিলেটিভকে নিয়ে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছে। ইস, আমি যদি কাল সময়মতো চেঁচিয়ে উঠতে পারতাম। তা হলে সুকান্তি লোকটাকে পাকড়াও করে কষে ধোলাই দিতে পারত—।’

পিসিমা মাথা নাড়লেন : ‘না রে, চোর-টোর নয়। পাঁচ-সাত বছর ধরে লোকটা একই বাড়িতে একই ঘরে একই কাজ করে চলেছে—এ কখনও হয়! কই, পাড়ার আর কারও বাড়িতে তো কখনও এরকম শুনিনি! তা ছাড়া জানলার গ্রিলের মধ্যে দিয়ে লোকটা ঘরে ঢুকল কেমন করে, আবার পালালই বা কেমন করে! আর কাল রাতে বাইরে থেকে তোর ঘরের দরজার খিল-ছিটকিনি খুলল কেমন করে, বল!’

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর জেদি গলায় বললাম, ‘তুমি যে এত জোর দিয়ে বলছ, তুমি নিজে কখনও ভূতটাকে চোখে দেখেছ!’

পিসিমা পলকে কেমন উদাস হয়ে গেলেন। খোলা জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলেন কিছুক্ষণ। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কেমন এক অদ্ভুত গলায় বললেন, ‘না, আমি দেখিনি। প্রথমবার এরকম ঘটনা শোনার পর আমি একা ও-ঘরে অনেক রাত কাটিয়েছি, কিন্তু কেউ আসেনি। আমাদের অনেক রিলেটিভ ও-ঘরে রাত কাটিয়েছে, কিন্তু কোনও প্রবলেম হয়নি। অবশ্য তারা বেশিরভাগই পুরুষ ছিল—আর দু-একজন বয়স্কা মহিলা। তাদের বেলা ওই নিশিকুটুম্ব দেখা দেয়নি। দ্বিতীয়বার সে দেখা দিল জয়তীর বেলায়। তখন জয়তী তোর মতোই—দেখতে-শুনতে সুন্দর, অল্প বয়েস। আমার মনে হয়, অল্পবয়েসি সুন্দরী মেয়েদের দিকে এই ভূতটার আলাদা কোনও টান আছে। ওদের প্রাণপণে ভালোবাসতে চায়। নইলে কেউ ওরকম করে! ওরকম কবিতা বলে!’

আমি ঠোঁট টিপে চোখ কপালে তুলে কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। তারপর মাথা নেড়ে বললাম, ‘তুমি যতই বলো, পিসিমা, আমি ঠিক যেন ফুললি কনভিন্সড হাতে পারছি না।’

এবার শ্রুতিদি জবাব দিল, ‘তুই তখন থেকে এরকম জেদ ধরে আছিস কেন, রিমকি। শুরুতে তুই-ই তো বললি ঘরটা হন্টেড। তা ছাড়া মা এই যে বলল, ছায়াটা আলমারির পেছনে ঢুকে গেল—একদিক দিয়ে ঢুকে আর-একদিন দিয়ে বেরিয়ে এল—এটা কি কোনও মানুষের পক্ষে ইমপসিবল নয়?’

‘কেন, ইমপসিবল কেন!’

‘আলমারির পেছনেই তো দেওয়াল। সেখানে দু-ইঞ্চিও ফাঁক নেই! তা হলে একটা গোটা মানুষ ঢুকবে কেমন করে!’

আমি দমে গেলাম।

শ্রুতিদি বলেই চলল, ‘তোকে তো লোকটা টাচ করেছিল। ওটা কোনও মানুষের ছোঁয়া? তুই বল! তখন তোর মন-শরীর অবশ হয়ে যায়নি?’ একটু চুপ করে থেকে শ্রুতিদি আবার নীচু গলায় বলল, ‘ভাগ্যিস ট্রেনটা এসে গিয়েছিল…নইলে আরও বাজে কিছু হতে পারত!’

তার মানে! আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। কাল রাতে ঝমাঝম শব্দে ট্রেন ছুটে গেছে বলে আমি বাজে কিছু হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছি! পিসিমাদের ওই রিলেটিভ—জয়তী—সে-ও একইরকমভাবে বেঁচে গেছে!

শ্রুতিদি এত সব জানল কেমন করে! কী করে মনে রাখতে পারল কবিতার ওই রোমান্টিক লাইনগুলো!

শ্রুতিদির মুখ থমথম করছিল।

আমি জিগ্যেস করলাম, ‘তুমি এত সব জানলে কেমন করে?’

শ্রুতিদির চোখে জল এসে গেল পলকে। মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে ও উঠে দাঁড়াল। তারপর বলতে গেলে ছুট-পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

আমি খানিকটা অবাক হয়ে পিসিমার দিকে তাকালাম।

পিসিমা মাথা নীচু করে বসেছিলেন। সেই অবস্থাতেই বললেন, ‘শ্রুতিকে দিয়ে ব্যাপারটা শুরু হয়। তার আগে কখনও কিছু হয়নি। সে-রাতেও ও একা শুয়েছিল ওই ঘরে। সেদিনটা আবার বাংলা বনধ ছিল। তাই কোনও ট্রেন চলেনি। অশরীরী সেই প্রেতটা সেদিন আর মাঝপথে থামেনি। ওর…ওর…সাধ মিটিয়ে তারপর উধাও হয়ে গেছে…।’

আমি পাথর হয়ে গেলাম। আমি এসব কী শুনছি।

পিসিমা কেঁদে ফেললেন : ‘সেদিন থেকে শ্রুতি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। পরে…পরে…ওকে মানসিকভাবে সুস্থ করার জন্যে নকল অ্যাবরশন করাতে হয়। তোকে আমি লজ্জায় এ-কথা আগে বলিনি।

তা ছাড়া কেউই তো এসব কথা বিশ্বাস করবে না। সবই আমাদের কপাল…।

‘জয়তীর ব্যাপারটার পর এত বছর পার হয়ে গেছে…তাই ভেবেছিলাম ঘরটার দোষ কেটে গেছে। এখন দেখছি যায়নি। আমাদের হয়তো বাড়িটাই ছেড়ে দিতে হবে…।’

শ্রুতিদির বিয়ে না করার কারণ হিসেবে কানাঘুষোয় কিছু-কিছু শুনেছিলাম। ভেবেছিলাম, আর-পাঁচটা ঘটনার মতোই ওর লাভার ওকে বিপদে ফেলে পালিয়েছে। কিন্তু এখন পিসিমার মুখে এসব কথা শোনার পর সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল।

আমি কল্পনায় এক অতৃপ্ত প্রেমিককে দেখতে পাচ্ছিলাম—যার বয়েস একশো, দুশো, তিনশো কি চারশো বছর। যার ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা আজও মেটেনি। এককালে সে হয়তো এইখানেই থাকত। পাগলের মতো আকুল ভালোবাসা নিয়ে কারও জন্যে অপেক্ষা করত।

আমি চোখ বুজে ফেললাম। পায়রার বুকের নরম পালক আমার শরীরে বিলি কাটতে লাগল। আমি একটা চেনা পারফিউমের গন্ধ পেলাম।

ঠিক তখনই পশ্চিমের রেল-লাইন ধরে ঝমঝম শব্দে একটা ট্রেন ছুটে গেল। তার হুইসলের শব্দটা আমার বুকের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে গেল।

No comments