সুলতান হানিফের রত্নভাণ্ডার – অনিল ভৌমিক

সুলতান হানিফের রত্নভাণ্ডার – অনিল ভৌমিক

সেদিন ভোর থেকে জোর বাতাস ছুটেছে। ফ্রান্সিসদের জাহাজের পালগুলো ফুলে উঠেছে। আকাশ মেঘলা তবে বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। জোর হাওয়ায় সমুদ্রের বিরাট বিরাট ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে জাহাজের গায়। জাহাজের জোর দুলুনির মধ্যে ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। জাহাজের কাজ সহজ নয়। ডেক ধোয়া মোছা। বাতাসের গতি বুঝে পাল ঘোরানো। রান্নার জায়গা খাবারের জায়গা পরিষ্কার রাখা। প্রায় পঁচিশ তিরিশজনের রান্না করা চার বেলা খাবার তৈরি করা। কাঠের বাসনটাসন ধোয়া। দু’চারজন অসুস্থ বন্ধু থাকেই। তাদের জন্যে পথ্যর ব্যবস্থা। চিকিৎসা। শুশ্রূষা। শুশ্রূষার কাজটা মারিয়াকেই করতে হয়। এর মধ্যেই দিক ঠিক রেখে ফ্লেজার আর শাঙ্কো দু’জন মিলে জাহাজ চালায়। জাহাজের পালের মেরামতির কাজও চালাতে হয়। এ ভাবেই দিন কাটে ভাইকিংদের। এর মধ্যেই জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ডেকএ উঠে আসে সবাই। নাচগানের আসর বসে মাঝে মাঝে। সুকণ্ঠী সিনাত্রা ওদের দেশের চাষীদের, ভেড়াপালকদের, মাঝিদের গান গায়। শাঙ্কো খালি পীপেয় থাবড়া দিয়ে দিয়ে তাল দেয়। দু’চারজন কাঠের ডেক-এ থপ্ থপ শব্দ তুলে নাচে। সেই নাচে ফ্রান্সিসকে মারিয়াকেও অংশ নিতে হয়। নাচগান জমে ওঠে। একসময় নাচগান শেষ হয়। ক্লান্ত ভাইকিংরা অনেকেই ডেক-এই এখানে-ওখানে শুয়ে পড়ে। বাকিরা কেবিনঘরে ফিরে আসে। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই দিনরাত কাটে ভাইকিংদের।

এরমধ্যে ওদের নিজেদের মধ্যেও ঝগড়াঝাটি হয়। ঝগড়া বাড়াবাড়ি হলে ফ্রান্সিসের শরণাপন্ন হয় ওরা। ফ্রান্সিস বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঝগড়া মিটিয়ে দেয়। জাহাজে ফ্রান্সিসের কথাই শেষ কথা। ঝগড়া মিটে যায়। বন্ধুরা পরস্পর হাত ধরে ঝগড়া মিটিয়ে নেয়। ফ্রান্সিসকে ওরা বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ফ্রান্সিসের নির্দেশ মেনে চলে। ফ্রান্সিসের কড়া নির্দেশ–যত ঝগড়া হোক মনমালিন্য হোক মারামারি করা চলবে না। ভাইকিং বন্ধুরা ফ্রান্সিসের নির্দেশ মেনে চলে। তাই পরস্পরে মারামারির মত কোন ঘটনা ঘটে না। সবাই শান্তিতে থাকে।

দিন যায় রাত যায়। জাহাজ চলেছে। দিন দশ পনেরো হয়ে গেল ডাঙার দেখা নেই। মাস্তুলের মাথায় বসে পেড্রো দিন রাত নজর রাখে। ওর নজর–কোন জলদস্যুদের জাহাজ আসছে কিনা আর ডাঙা দেখা যায় কিনা।

একদিন দুপুরে ফ্রান্সিসদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সবে শেষ হয়েছে। ওরা শুনল পেড্রোর চিৎকার করে বলাভাই সব–ডাঙা দেখা যাচ্ছে। হ্যারি তখন ডেক এই ছিল চেঁচিয়ে বলল–কোনদিকে? পেড্রো ডানদিকে দেখিয়ে গলা তুলে বলল–ডানদিকে? হ্যারি ডানদিকে চোখ কুঁচকে তাকাল। দুপুরের উজ্জ্বল রোদে সমুদ্রতীর দেখল। একটা বন্দর বলেই মনে হল। দুটো জাহাজ নোঙর করা। তারপর টানা বালি-ঢাকা জমি। আরো কয়েকজন ভাইকিং বন্ধুও জাহাজের রেলিঙ ধরে দাঁড়াল। বন্দর বালি-ঢাকা প্রান্তর দেখল।

হ্যারি দ্রুত পায়ে ফ্রান্সিসের কেবিনঘরে নেমে এল। বন্ধ দরজা খুলে ফ্রান্সিস তখনই বেরিয়ে এল। বলল পেড্রোর কথা শুনেছি। চলো–কোথায় এলাম দেখি। মারিয়াও চলো। ফ্রান্সিস বলল।

তিনজনে জাহাজের ডেক উঠে এল। ততক্ষণে জাহাজ ডাঙার অনেক কাছে চলে এসেছে। ফ্রান্সিসরা রেলিঙ ধরে দাঁড়াল। তখনই দেখল সেই বালি ঢাকা প্রান্তরের বাঁ দিক থেকে একদল যোদ্ধা খোলা তরোয়াল আর বর্শা হাতে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে। তাদের তরোয়ালে দুপুরের রোদ পড়েঝিকিয়ে উঠছে। তাদের গায়ে কালোকাপড়ের পোশাক। তখনই ডানদিক দিয়ে দেখা গেল আর একদল যোদ্ধা খোলা তরোয়াল বর্শা নিয়ে ছুটে আসছে। তাদের পোশাক নানা রঙের। সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দু’দল যোদ্ধা পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হল লড়াই। তরোয়ালে তরোয়ালে বর্শায় বর্শায় ঠোকাঠুকিরশব্দ শুরু হল। সেইসঙ্গে চিৎকার আহতদের গোঙনি আর্তস্বর। দেখতে দেখতে হ্যারি বলল ফ্রান্সিস আমরা এক লড়াইয়ের মধ্যে এসে পড়লাম। আমরা কী করবো?

–নীরব দর্শক। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

–জাহাজ ঘোরাতে বল। এখানে নামবো না আমরা। মারিয়া বলল।

লড়াইয়ের শেষটা দেখি। এই লড়াইয়ে তো আমরা জড়াবোনা। ফ্রান্সিস বলল।

—তবে আর এখানে থাকবো কেন? হ্যারি বলল।

–এটা তো জানতে হবে কোথায় এলাম। ফ্রান্সিস বলল।

–এই লড়াইয়ের পরিবেশে? হ্যারি একটু অবাক হয়েই বলল।

-আরে বাবা-লড়াই তো একসময়ে থামবে। কোন পক্ষ তেজিতবে? তাদের কাছেই জানবো। ফ্রান্সিস বলল।

বড্ড বেশি ঝুঁকি নিচ্ছো ফ্রান্সিস। এই দুই দলের তোক কারা কেমন আমরা জানি না। যারা জিতবে তাদেরও পরিচয় আমরা জানি না। তাদের কাছে সব জানতে গেলে বিপদেও পড়তেপারি। হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ। বিপদ হতে পারে। তবে খোঁজ খবরটা সাবধানে নিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যারি আর কোন কথা বলল না।

মারিয়া বলে উঠল–এসব মারামারি কাটাকাটি আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। আমি চললাম। মারিয়া চলে গেল।

লড়াই ততক্ষণে শেষের দিকে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে রঙ-বেরঙের পোশাকপরা যোদ্ধারা হেরে যাচ্ছে। ওদের সংখ্যা কমে আসছে। তখনও অক্ষত থাকা তারা অনেকেই ছুটে পালাচ্ছে। কালো পোশাকপরা যোদ্ধারা তাদের ধাওয়া করছে। যোদ্ধাদের পায়ের চাপে ধূলোবালি উড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রঙবেরঙের পোশাকপরা অনেকেই মারা গেল নয়তো আহত হয়ে বালির ওপর পড়ে রইল। এ লড়াই শেষ। কালো পোশাকপরা যোদ্ধারা সোৎসাহে খোলা তরোয়াল শূন্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিজয় উল্লাসে মাতল। তারপর পশ্চিমমুখো যেতে লাগল। বোঝা গেল–ওদিকেই রঙবেরঙের পোশাকপরা যোদ্ধাদের দেশ।

লড়াই থেমে গেছে। কিন্তু যুদ্ধে যে কালোপোশাকপরা যোদ্ধাদের জয় হল তারা তো চলে গেল। ওদেরসঙ্গে কথা বলার জন্য তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে আমাদের জাহাজ এখানেই থাকবে? হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস ঘাড় কাত করে বলল।

বিকেল হয়ে এল। বিজয়ী যোদ্ধাদের কোলাহল আর শোনা যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস হ্যারি নিজেদের কেবিনঘরে ফিরে এল। ভাইকিংবন্ধুরা যারা রেলিং ধরে লড়াই দেখছিল তারাও অনেকে নিজেদের কেবিনঘরে নেমে এল। কয়েকজন অবশ্য ডেক-এই বসে রইল।

মারিয়া ডেক-এ উঠে এল। আবার সূর্যাস্ত দেখতে মারিয়া প্রতিদিন ডেক-এ উঠে আসে। পশ্চিমের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পশ্চিমের আকাশে হালকা মেঘের গায়ে নানা রঙের খেলা চলেছে। একসময় সব রঙ মিলিয়ে গিয়ে আকাশে গভীর কমলা রঙ ছড়িয়ে পড়ল। একটা বিরাট কমলা রঙের থালার মত সূর্য দিগন্তে নেমে এল। সূর্য অস্ত গেল। বেশ কিছুক্ষণ পশ্চিম আকাশে কমলা রঙ ছড়িয়ে রইল। আস্তে আস্তে সেই রঙ মুছে গেল। সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এল। মারিয়া কেবিনঘরে চলে এল।

ফ্রান্সিস কেবিনঘরের কাঠের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বিছানায় বসেছিল। মারিয়া মোমবাতি জ্বালতে গেল। ফ্রান্সিস বলে উঠল–অন্ধকারই থাক। আলো জ্বেলো না। মারিয়া আর আলো জ্বালল না। বিছানায় বসতে বসতে মারিয়া বলল–ডাঙায় নামবেনা?

–হ্যাঁ। নামতে তো হবেই। তবে এখন নয়। কাল সকালের খাবার খেয়ে নামবো। ফ্রান্সিস বলল।

–এখানে তো দেখলাম দুই দলে লড়াই চলছে। এই পরিবেশে নামাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

–উপায় নেই। খোঁজ খবর করতেই হবে।

–বিপদে পড়বে না তো।

বিপদ তো যে কোন মুহূর্তে হতে পারে। বিপদের আশঙ্কাটা বড় করে দেখলে তো হাত পা ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকতে হয়।

তাতে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে না। ধরো–কোনরকম খোঁজখবর করলাম না। জাহাজ যেদিকে খুশি চলল। তাহলে কি কোনদিন স্বদেশে পৌঁছতে পারবো? উল্টে আরো বড় বিপদে পড়বো। কাজেই খোঁজ খবর নিয়ে দিক ঠিক রেখে জাহাজ চালাতে হবে। বিপদের আশঙ্কায় চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। বিপদ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। বিপদের কথা ভেবে লাভ নেই। তাতে মন দুর্বল হয়ে পড়ে। মনটা শান্ত রাখতে হবে। –ফ্রান্সিস বলল।

–আমি আর কী বলবো। তুমি তোমার মতোই চল। মারিয়া বলল।

–তোমার অভিমান হল। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–না-না। অভিমান হতে যাবে কেন। মারিয়া বলল।

–যাক গে–এসব নিয়ে তুমি ভেবো না। তুমি খুশি থাকো।

–ঠিক আছে। মারিয়া বলল

এবার আলো জ্বালো। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া বিছানা থেকে উঠে মোমবাতি জ্বালল। ঘরে আলো ছড়ালো। ফ্রান্সিস মোমবাতির আলোর দিকে তাকিয়ে একইভাবে বসে রইল।

রাত বাড়ল। সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিল। তারপর কেবিন ঘরে ডেক-এর ওপরে সবাই শুয়ে পড়ল। সারাদিন গরমের পর এখন সমুদ্রের জলেভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটেছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ল।

তখন গভীর রাত। শাঙ্কো ডেক-এর ওপর হালের কাছে ঘুমিয়ে ছিল। গভীর ঘুম। হঠাৎ কীসের খোঁচা লেগে ঘুম ভেঙে গেলো ও ধড়মড় করে উঠে বসল। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় দেখল কালো পোশাকপরা একজন যোদ্ধা ওর বুকের ওপর তরোয়াল চেপে ধরেছে। ও চারপাশে তাকাল। দেখল একদল কালো পোশাক পরা যোদ্ধা বন্ধুদের ঘিরে ধরেছে। সবার হাতে খোলা তরোয়াল। কয়েকজনের বর্শা। এই কালো পোশাকপরা যোদ্ধাদের শাঙ্কো দেখেছে লড়াই করতে আর লড়াইয়ে জিতে উল্লাস প্রকাশ করতে। তারপর পশ্চিমমুখো চলে যেতে। তাহলে ওরাই ফিরে এসে ওদের জাহাজ দখল করেছে।

ওরা জনকয়েক সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেছে। ততক্ষণে। উদ্দেশ্য কেবিনঘরের বন্ধুদের বন্দী করা। এখন তাকিয়ে, তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায় নেই। নিরস্ত্র ওদের আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছু করার নেই।

কিছু পরে ফ্রান্সিসরা নিচের কেবিনঘর থেকে ডেক-এ উঠে এল। প্রত্যেকের পেছনে একজন করে কালো পোশাকপরা যোদ্ধা। মারিয়াও রেহাই পেল না। তাকেও উঠে আসতে হল।

ফ্রান্সিসদের সবাইকে ডেকএ বসানো হল। কালো পোশাকপরা যোদ্ধারা ওদের চারপাশ থেকে ঘিরে দাঁড়াল। যোদ্ধাদের মধ্যে থেকে একজন রোগা লম্বা যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এল। শরীরের তুলনায় ভারি গলায় বলল–তোমাদের দলনেতা কে? ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। বলল–আমি। যোদ্ধাটি ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করল

–তোমাদের পরিচয় বলো। ভাঙা ভাঙা পোতুর্গীজ ভাষায় বলল।

–আমরা ভাইকিং। বিদেশি। ফ্রান্সিস বলল।

–এখানে এসেছো কেন? যোদ্ধাটি জিজ্ঞেস করল।

–এমনি। এ বন্দর সে বন্দর ঘুরে এখানে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।

উঁহু। তোমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। যোদ্ধারা বলল।

–আমাদের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।

–ধনসম্পদ লুঠ করা। তোমরা লুঠের দল। যোদ্ধাটি বলল।

আমরা লুঠেরা হলে বেশকিছু সম্পদ আমাদের জাহাজে থাকতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।

–থাকতে পারে বৈ কি। যোদ্ধাটি বলল।

তাহলে জাহাজ তল্লাশী নিন। ফ্রান্সিস বলল।

–সে তো নেবই যোদ্ধাটি বলল।

–কিছুই পাবেন না। কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া। ফ্রান্সিস বলল।

–দেখা যাক। যাক গে–তোমাদের বন্দী করা হল। যোদ্ধাটি বলল।

–কেন? আমরা কী এমন অপরাধ করেছি? ফ্রান্সিস বলল।

–যে সব আমাদের রাজা আনোতার বুঝবেন। সকালে তোমাদের রাজসভায় নিয়ে যাওয়া হবে। রাজা আনোতারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আশা কম। তোমাদের বন্দী করেই রাখা হবে। যোদ্ধাটি বলল।

–আপনার পরিচয় জানতে পারি? ফ্রান্সিস প্রশ্ন করল।

–নিশ্চয়ই। আমি রাজা আনোতারের সেনাপতি। সেনাপতি বলল।

–ও। তা এখন আমাদের নিয়ে কী করবেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–এখন তোমাদের এখানেই রাখা হবে। তারপর তল্লাশী চলবে। সেনাপতি বলল।

–বেশ। আপনার মর্জি। ফ্রান্সিস বলল।

সেনাপতি ছ’সাতজন যোদ্ধার একটা দল করল। হুকুম দিল জাহাজ লুঠ করো। যোদ্ধাদের দলটি সিঁড়ি দিয়ে নিচে কেবিনঘর গুলোর দিকে ছুটল। ওরা তল্লাশী শুরু করল।

পূবের আকাশে কমলা রঙ ধরল। অল্পক্ষণের মধ্যে সূর্য উঠল।

তল্লাসী শেষ। তল্লাশী চালাচ্ছিল যারা তারা ফিরে এল। একজন যোদ্ধা একটা রুমালে বাঁধা কিছু সোনার চাকতি সেনাপতিকে দিল। রুমালটা মারিয়ার।

–তেমন কিছু পেলেন? ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল।

না। সেনাপতি মাথা নাড়ল।

–তাহলেই বুঝতে পারছেন যে আমরা লুঠেরার দল নই। ফ্রান্সিস বলল।

–ঠিক আছে। আগে রাজসভায় চল। সেনাপতি বলল।

ফ্রান্সিসের পাশেই মারিয়া বসেছিল। মৃদুস্বরে বলল–আমার বড় পছন্দের রুমালটা।

–দুঃখ করো না। ওর বদলে পাঁচটা ভালো রুমাল কিনে নিও। ফ্রান্সিসও মৃদুস্বরে বলল। তারপর হ্যারির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল–মারিয়ার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। স্বর্ণমুদ্রাগুলো ও লুকিয়ে রেখেছিস বলেই দুতিনবার আমাদের জাহাজ লুঠ হলেও ঐ স্বর্ণমুদ্রাগুলোর হদিস কেউ পায় নি। এবার মারিয়া একটু অভিমানের সুরে বলল–আমি আর একটা বুদ্ধিমতীর মত কথাও বলেছিলাম।

–হুঁ। তুমি এখান থেকে চলে যেতে বলেছিলে। ফ্রান্সিস বলল।

–এবার বোঝ–আমার মতটা ঠিক ছিল কিনা। মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ কিন্তু লড়াইয়ে জিতে যোদ্ধার দল চলে গিয়েছিল। ওরা ফিরে এসে আমাদের জাহাজ দখল করবে অতটা ভাবি নি। ফ্রান্সিস বলল।

–সেটাই তো হল। মারিয়া বলল।

–ঠিক আছে। দেখা যাক এরা আমাদের নিয়ে কী করে? ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস এবার ভাবলো একটা খোঁজখবর করতে হবে। ও সেনাপতির কাছে এগিয়ে এল। বলল–একটা খবর জানতে চাইছিলাম।

–কী খবর? সেনাপতি ফ্রান্সিসদের দিকে ফিরে তাকাল।

–এটা কি একটা দেশের অংশ নাকি একটা দ্বীপ! ফ্রান্সিস বলল।

দ্বীপনয় এটুকু বলতে পারি। কারণ পশ্চিমমুখো আমরা যতদূর গেছি শেষ পাইনি। সেনাপতি বলল।

–এই দেশের নাম কী? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

বাতোরিয়া। এখানকার রাজা ছিল পাকার্দেন। তাকে লড়াই করে হারিয়ে আমাদের রাজা আনোতার এই বাতোরিয়ার রাজা হয়েছেন। সেনাপতি বলল।

–তাহলে আপনাদের অন্য এক রাজত্ব ছিল। ফ্রানিস বলল।

–হ্যাঁ। ঐ যে দক্ষিণদিকে পাহাড় দেখছো ঐ পাহাড়ের ওপারে আছে ভিঙগার দেশ। ওটাই আমাদের দেশ। এখন ঐ ভিঙ্গার দেশ আর এই বাতোরিয়া দুই দেশেরই রাজা হলেন আনোতার।

–রাজা পাকার্দেনকে তো বন্দী করা হয়েছে। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

নিশ্চয়ই। তার দেহরক্ষীদেরও বন্দী করা হয়েছে। সেনাপতি বলল।

–তাদের কোথায় বন্দী করা হয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।

–ঐ পাহাড়ের নিচে কয়েদঘরে। সেনাপতি বলল।

–তাহলে আমাদেরও ওখানেই বন্দী করে রাখা হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ। আর কথা নয়। রাজধানীতে চলল। সব দেখবে জানব। এখন তোমাদের রাঁধুনিদের বলো সকালের খাবার তৈরি করতে। সকালের খাবার খেয়ে আমরা রাজবাড়িতে যাবো। সেনাপতি বলল।

–বেশ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর রাঁধুনি বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললসকালের খাবার তৈরিকর। তিনজন রাঁধুনি বন্ধু উঠেদাঁড়াল। রসুইঘরে যাবে বলে নিচে নামার সিঁড়ির দিকে চলল। খোলা তরোয়াল হাতে তিনজন যোদ্ধাও ওদের পাহারা দেবার জন্য সঙ্গে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সকালের খাবার তৈরি হয়ে গেল। সবাইকে খেতে দেওয়া হল। খাওয়া শেষ হল। সেনাপতিরআদেশে সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের পাহারা দিয়ে জাহাজ থেকেপাতা পাটাতন দিয়ে তীরেনামানো হল। পাহারা দিয়ে ফ্রান্সিসদের নিয়ে পশ্চিমমুখো চলা শুরু হল।

বালি ভর্তি এলাকা দিয়ে চলল সবাই। কিছুদূর যেতে বালির এলাকা শেষ। শুরু হল মাটির রাস্তা। একসময় দূর থেকে রাজধানীর বাড়িঘর দেখা গেল। বাড়িঘর সব পাথর বালি আর কাঠের। পাহাড়ের নিচে বনভূমি। সহজেই কাঠ পাওয়া গেছে। বাড়িগুলোর ছাউনি লম্বা শুকনো ঘাস আর পাতার।

অন্যবাড়িগুলোর তুলনায় একটা বেশ বড় লম্বাটে বাড়ি। বোঝা গেল রাজবাড়ি। ফ্রান্সিসরা সেই বাড়ির প্রধান দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।

সেনাপতি ফ্রান্সিসদের নিয়ে রাজসভায় ঢুকল। প্রহরীরা মাথা নুইয়ে সেনপাতিকে সম্মান জানাল। ফ্রান্সিস দেখল কাঠের সিংহাসনের গদীতে রাজা আনোতার বসে আছে। অসম্ভব মোটা। মুখে অল্প দাড়ি গোঁফ। মাথায় চৌকোনো সোনার গিল্টিকরা মুকুট। কুঁতকুঁতে চোখ।

তখন বিচার চলছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই বিচার শেষ হল। বিচার প্রার্থীরা চলে গেল। দোষী লোকটিকে দুজন প্রহরী হাতে দড়ি বেঁধে নিয়ে চলে গেল।

রাজার সিংহাসনের দুপাশে দুটো ছোট কাঠের আসন। তাতে গদী পাতা। সেনাপতি রাজার সম্মুখে গিয়ে মাথা একটু নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে পাশের আসনে গিয়ে বসা অন্য আসনে বৃদ্ধ মন্ত্রী বসেই ছিল।

ফ্রান্সিস ভালো করে রাজা আনোতারকে দেখল কুঁকুঁতে চোখে রাজা ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টি কুটিল। একে অতবড় মুখমণ্ডল তার ওপর ঐ দৃষ্টি। ফ্রান্সিস বুঝল লোকটা ধুরন্ধর, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী।

বিচারপর্ব শেষ। সেনাপতি আসন থেকে উঠে দাঁড়াল। আঙ্গুল দিয়ে ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে দেশীয় ভাষায় কী সব বলে গেল। সেনাপতির কথা শেষ হলে রাজা আনোতার। একটু হেসে ভাঙা ভাঙা পোতুর্গীজ ভাষায় বলল–শুনলাম তোমরা ভাইকিং। এখানে নাকি বেড়াতে এসেছে।

–ঠিক বেড়াতে নয়। তবে কোন উদ্দেশ্য নিয়েও আসি নি। নানা দ্বীপ ঘুরে এখন নিজেদের দেশে ফিরে যাচ্ছিলাম। ফ্রান্সিস বলল।

–কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তোমরা এখানে এসেছো। রাজা আনোতার বলল।

–না। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এখানে আসি নি। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।

–ঠিক আছে। সে সব পরে ভেবে দেখছি। এখন তোমাদের বন্দী করা হল। রাজা আনোতার বলল।

–কিন্তু আমরা তো আপনার বা আপনার দেশের কোন ক্ষতি করিনি। ফ্রান্সিস বলল।

–ক্ষতি করতে পারো এটা ধরে নিয়েই তোমাদের বন্দী করা হচ্চে। রাজা বলল। তারপর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল। –এটা কে? কথাটা শুনে ফ্রান্সিসের ভীষণ রাগ হল। কিন্তু সেই ভাবটা গোপন করে বলল–এটা নয় ইনি–ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী।

রাজকুমারী তো রাজপ্রাসাদে থাকে। রাজা বলল।

–না। ইনি আমাদের সঙ্গে থাকতেই ভালোবাসেন। ফ্রান্সিস বলল।

–যাক গে যার যেমন অভিরুচি। এবার সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বলল–এদের কয়েদঘরে ঢোকান। পরে ভেবে দেখছি এদের নিয়ে কী করা যায়।

ফ্রান্সিস বুঝল রাজা ওদের কোন কথাই শুনবে না। কিন্তু মারিয়ার কথাটা ভাবতে হয়। তাই ও বলল আমরা না হয় কয়েদ ঘরেই রইলাম। কিন্তু একটা অনুরোধ রাজকুমারীকে রাজবাড়ির অন্দরমহলে রাখুন।

তিনি তো আর আমাদের ফেলে রেখে পালাতে পারবেন না।

–কিন্তু তাকেও তো বন্দী হয়েই থাকতে হবে। রাজা বলল।

অন্তঃপুরে বন্দী করেই রাখুন। কয়েদ ঘরের কষ্ট ওঁর সহ্য হবেনা। ফ্রান্সিস বলল।

–ওসব পরে হবে। এখন তো কয়েদ ঘরে থাকুক। রাজা বলল।

ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। বুঝল বলে লাভ নেই।

সেনাপতি ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসদের হাঁটতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা সেনাপতির পেছনে পেছনে চলল।

সবাই রাজবাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসদের দেখতে স্থানীয় অধিবাসীরা প্রায় ভিড় করে এল। বোঝা গেল ফ্রান্সিসদের দেখতেই ভিড়। সবাই বেশিঅবাক হলে মারিয়াকে দেখে। মারিয়ার পোশাক দেখে।

সবার আগে সেনাপতি চলল পাহাড়ের দিকে। তার যোদ্ধারা ফ্রান্সিসদের ঘিরে নিয়ে চলল যাতে কেউ পালাতে না পারে। যেতে যেতে হ্যারি ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল– ফ্রান্সিস আবার সেই কয়েদঘরেই বন্দী হতে চলেছি।

–ভেবো না। ঠিক সময় সুযোগমত পালাবো। আমার শুধু একটাই চিন্তা মারিয়া এই কয়েদঘরের কষ্টকর জীবন কতদিন মেনে নিতে পারবে। ফ্রান্সিস চিন্তিত স্বরে বলল।

তুমি কালকেই রাজা আনোতারের সঙ্গে কথা বলা। যে করে হোক রাজকুমারীকে অন্য কোথাও রাখতে রাজাকে অনুরোধ কর।

–ঠিক বুঝতে পারছি না রাজা আনোতার রাজি হবে কিনা। ফ্রান্সিস বলল।

–বলে তো দেখে। হ্যারি বলল।

–হুঁ। বলতে হবেই ফ্রান্সিস বলল।

পাহাড়ের নিচেই বনভূমি। খুব গভীরবননয়। ছাড়া ছাড়া গাছগাছালি জংলা ঝোঁপঝাড়। সে সবের মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা পথ। বনের সেই পথ ধরে চলল সবাই।

কিছু পরে একটা লম্বাটে ঘরের সামনে এসে সেনাপতি দাঁড়িয়ে পড়ল। বোঝা গেল এই ঘরটাই কয়েদঘর। ঘরের ছাউনি শুকনো ঘাস পাতার। ঘরের দরজার সামনে বর্শা হাতে দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে। সেনাপতিকে দেখে দুজনে মাথা একটুনুইয়ে সম্মান জানাল। একজন প্রহরী কোমরের কাপড়ের ফেট্টিতে ঝোলানো চাবি বের করে লোহার দরজাশব্দ করে খুলে দিল। সেনাপতি ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা একে একেঘরটায় ঢুকল।

ঘরের মেঝেয় শুকনো ঘাস লতাপাতা বিছানো দেখা গেল আগে থেকেই বেশ কিছু বন্দী শুয়ে আছে। ঘরের দেয়াল এবড়ো খেবুড়ো পাথরের। ঘরটার ওপর দিকে একটা ফোকরমত। ওটাই জানালা। বাইরের যেটুকুআলোহাওয়া ঐ পথ দিয়েই আসছে ফ্রান্সিসরা কেউ কেউ বসল, কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস দেয়ালে ঠেসান দিয়ে বসল। রাজকুমারী ফ্রান্সিসদের পাশে এসে বসল। ফ্রান্সিস ভাবছিল রাত পাহারার জন্যে পেড্রো কেবলা উচিত ছিল। পেড্রোনজর রাখলে। এভাবে বিনা লড়াইয়ে বন্দী হতে হত না।

একটু চুপ করে থেকে মারিয়া বলল–আমাকে তাহলে এখানেই থাকতে হবে।

-না-না। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–তোমাকে অন্য কোথাও রাখার জন্য রাজাকে। অনুরোধ করবো।

–কোন দরকার নেই। আমি এখানেই তোমাদের সঙ্গে থাকবো। মারিয়া বলল।

–তা হয় না। এই বদ্ধ ঘরে এভাবে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাতে আমাদের বিপদই বাড়বে। ফ্রান্সিস বলল।

-তোমরা এত কষ্ট সহ্য করে থাকবেআর আমি থাকতে পারবোনা? মারিয়া বলল।

–না পারবে না। কাল সকালে রাজার সঙ্গে দেখা করবো। ফ্রান্সিস বলল।

রাজাকে দেখে আমার ভালো লাগে নি। লোকটা দাম্ভিক। মারিয়া বলল।

–শুধু দাম্ভিক নয় তার চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু উপায় নেই। ওর মন রেখে কথা বলতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

সিনাত্রা ফ্রান্সিসের কাছে সরে এল। বেশ ভীতস্বরে বলল–রাজা আমাদের মেরে ফেলবে না তো?

–অত ভয় পেও না। আমাদের মেরে ফেলে রাজার কী লাভ। লাভের জন্য তো আমাদের জাহাজ তল্লাশীই করেছে। কয়েকটা সোনার চাকতি ছাড়া কিছুই পায় নি। কাজেই রাজা মিছিমিছি আমাদের মেরে ফেলবে না। তবে আমাদের বন্দী করে রাখবে। তারপর কিছুদিন যাক। দেখা যাক আমাদের নিয়ে কী করে। সিনাত্রা আর কিছু বলল না। ? তবে ওর মন থেকে ভয় গেল না।

দুপুর হল। দুজন প্রহরী লম্বাটে শুকনো পাতা নিয়ে ঢুকল। সবার সামনে পাতা পেলে দিল। দুজনে মিলে তাতেখাবার দিল। আধপোড়া রুটি আর পাখির মাংস। ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা চেটেপুটে খেল। কেউ কেউ বাড়তি খাবারও নিল। খাওয়া শেষ হলে ঘরের কোনায়। মাটির পাত্রে রাখা জল খেল। প্রহরীরা এঁটো পাতা নিয়ে চলে গেল। পাখির মাংস সুস্বাদু। ওরা খেয়ে তৃপ্ত হল। এবার শুয়ে বসে রইল ওরা।

ফ্রান্সিস শুয়ে পড়েছিল। মৃদুস্বরে ডাকল হ্যারি। হ্যারি এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল আগে থেকে যে বন্দীরা ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলো তো। ওরা কারা। কেনই বা ওদের বন্দী করা হয়েছে-খবর নাও।

আগে থেকে যারা বন্দী ছিল হ্যারি তাদের কাছে গেল। ও কিছু বলার আগে ঐ বন্দীদের একজন যুবক দেশীয় ভাষায় হ্যারিকে কিছু বলল। হ্যারি বুঝল না। তাই ও মাথা নাড়ল। যুবকটি এবার ভাঙা ভাঙা পোর্তুগীজ ভাষায় বলল–আমার নাম বিন্তানো। তোমার নাম কী? হ্যারি বলল-হ্যারি।

তোমরা বিদেশি। বিন্তানো জানতে চাইল।

হ্যাঁ। রাজা তোমাদের বন্দী করেছে কেন?

শত্রুতা শত্রুতা। এটাই আমাদের দেশ বাতোরিয়া রাজা আনোতারের দেশ হচ্ছে। ঐ পাহাড়ের ওপাশে। রাজা আনোতার ধূর্ত ফীবাজ নিষ্ঠুরও। হঠাৎ আমাদের দেশ আক্রমণ করে জয় করেছে। এখন দুই দেশেরই রাজা হয়ে বসেছে। বিন্তানো বলল।

–তোমাদের দেশের রাজা? তিনি কোথায়? হ্যারি প্রশ্ন করল।

বিন্তানো চোখের ইঙ্গিতে দেখালে ঠেস দিয়ে বসা একজন দাড়ি গোঁফওয়ালা রোগাটে চেহারার লোককে দেখাল। হ্যারি দেখল লোকটির পরনে দামি কাপড়ের পোশাক। লোকটি চুপ করে বসে আছে।

–উনিই তোমাদের রাজা?

–হ্যাঁ রাজা পাকোর্দো আমরা কয়েকজন তার দেহরক্ষী। বিন্তানো বলল।

–তোমাদের সেনাপতি? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

লড়াইয়ে মারা গেছেন। এখন আমরা অবাক হবো না যদি রাজা আনোতার আমাদের রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেক্ষেত্রে আমরাও যে কজন আছিমৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বাঁচবো না। আমরাও বিন্তানো বলল।

রাজাসহ তোমাদেরও মৃত্যুদণ্ড দেবে কেন? ফ্রান্সিস বলল।

–রাজা আনোতার সব পারে। লড়াইয়ে হেরে গেছি কাজেই আমাদের জীবনের কোন দাম নেই। বিন্তানো বলল।

–তোমাদের রাজা পাকোর্দো কেমন মানুষ? ফ্রান্সিস বলল।

–দেবতা–দেবতা। প্রজারা তাকে দেবতার মত ভক্তি করে আবার বন্ধুর মত ভালোবাসে। আজকে উনি এই জঘন্য কয়েদঘরে বন্দী হয়ে আছেন এটা জেনে আমাদের বুক ভেঙে যাচ্ছে। বিন্তানো বলল।

লড়াইয়ে হারজিৎ আছেই। ওসব ভেবে কী হবে। হ্যারি বলল।

–তোমরাও রেহাই পাবে বলে মনে হয় না। বিন্তানো বলল।

–আমরা তার আগেই পালাবো। হ্যারি বলল।

–পারবে? বিন্তানো একটু অবিশ্বাসের সুরে বলল।

–পারতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–সেই চেষ্টাই করতে হবে। এখানে পড়ে থাকলে আমরা কেউ বাঁচবো না। এবার বিন্তানো মারিয়াকে দেখিয়ে বলল–ইনি কে?

–আমাদের দেশের রাজকুমারী। হ্যারি বলল।

–রাজা আনোতার কেমন মানুষ বোঝ। উনি মহিলা। রাজকুমারী। তাকেও এই কয়েদঘরে বন্দী করে রেখেছে। বিন্তানো বলল।

–তোমাদের রানিকে কী করেছে? হ্যারি জানতে চাইল।

–অন্দরমহলে বন্দী করে রেখেছে। বিন্তানো বলল।

রাজকুমারীকে নিয়েই আমাদের সমস্যা। উনি সুস্থ থাকতে থাকতে। তাকে নিয়ে পালাতে হবে। হ্যারি বলল।

পারবে পালাতে? এত প্রহরী সৈন্যসামন্ত। সবার চোখে ধূলো দিয়ে পালানো সম্ভব? বিন্তানো বলল।

–আমাদের দলনেতার নাম ফ্রান্সিস। ও অনেক অঘটন ঘটাতে পারে। কত গুপ্ত ধনভাণ্ডার ও খুঁজে বের করেছে। বুদ্ধি খাটিয়ে পরিশ্রম করে। তা ছাড়া এরকম পাহারার মধ্যেও আমরা অনেকবার পালিয়েছি। দেখো–ঠিক পালাবো। হ্যারি বলল।

–তাহলে তো ভালোই একসঙ্গে আমরাও পালাতে পারবো। বিন্তানো বলল।

–সেই উপায়টাই এখন ভাবতে হবে। হ্যারি বলল।

হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে ফিরে এল। বিন্তানের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে বলল। ফ্রান্সিস রাজা পাকোর্দোর দিকে তাকাল। রাজার মাথার চুল উস্কোখুস্কো। রোগাটে মুখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট চিহ্ন। চোখের কোল বসে গেছে। পরনে দামি পোশাক ময়লা। দু’চোখ বুজে চুপচাপ বসে আছেন। রাজা ফ্রান্সিসের পরিচিত কেউ নন। তবু রাজার এই দুরবস্থা দেখে ফ্রান্সিস। তাঁর প্রতি গভীর সহানুভূতি বোধ করল।

পরদিন সকালের খাবার খাওয়া সবে শেষ হয়েছে–দুজন প্রহরী কয়েদঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। একটু গলা চড়িয়ে বলল–রাজা পাকোর্দো বেরিয়ে আসুন। আমাদের মাননীয় রাজা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। প্রহরী দরজা খুলে দিল। ফ্রান্সিস দরজার কাছে গিয়ে বলল–আমরা দু’জন রাজা আনোতারের সঙ্গে দেখা করবো।

-কেন বলো তো? প্রহরী জানতে চাইল।

বিশেষ দরকার। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–বেশ। চলো প্রহরী বলল।

রাজা পাকোর্দোর সঙ্গে ফ্রান্সিস আর হ্যারি বেরিয়ে এল। তিনজনে প্রহরীদের সঙ্গে রাজ বাড়ির দিকে চলল।

রাজ সভায় খুব ভিড় ছিল না। রাজা আনোতার রাজা পাকোর্দোর জন্যে অপেক্ষা করছিল। রাজা পাকোর্দোকে দেখে কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল–এই যে রাজা পাকোর্দো। আসুন–আসুন। রাজা পাকোর্দো কোন কথা বললেন না।

–তা কয়েদঘরে থাকতে কোন অসুবিধে হচ্ছেনা তো? সেই একইভাবে হেসে বলল।

–না আমি ভালো আছি। রাজা পাকোর্দো বললেন।

–এটা মিথ্যে বললেন। কয়েদঘরের ঐ পরিবেশে কেউ ভালো থাকে না। রাজা আনোতার বলল।

–না আমি ভালো আছি। আমার থাকা খাওয়ার ভালোমন্দ বোধটা একটু কম? রাজা পাকোর্দো বললেন।

–তার মানে আপনি সবরকম অবস্থাতেই খুশি। রাজা আনোতার বলল।

–হ্যাঁ। কোনকিছুর বিরুদ্ধেইআমার কোন অভিযোগ নেই। রাজা পাকোর্দোর বললেন।

আপনি রাজা না হয়ে সাধুসন্ন্যাসি হলে ভালো করতেন। রাজা আনোতার বলল।

–রাজা হয়েও সাধু সন্ন্যাসীর মত থাকা যায়। তার জন্যে বনে জঙ্গলে যেতে হয়। রাজা পাকোর্দো বললেন।

–এইজন্যেই আপনি লড়াইয়ে হেরে গেলেন। রাজা আনোতার বলল।

–তাতে আমার দুঃখ নেই। শুধু একটাই দুঃখ আমার সুখী প্রজারা আপনার মত একটা পাষণ্ডের হাতে পড়ল। রাজা পাকোর্দো বললেন।

রাজা আনোতার একলাফে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলে উঠল আপনার এত সাহস আমাকে পাষণ্ড বললেন।

–আপনি আমার বন্দী সৈন্যদেরও হত্যা করেছেন। এ ধরণের কাজ একমাত্র পাষণ্ডরাই। করে রাজা পাকোর্দো বললেন। রাজা আনোতার সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল সেনাপতি এটাকে চাবুক মারুন। সেনাপতি একজন প্রহরীকে ইঙ্গিত করল। প্রহরী চাবুকহাতে এগিয়ে এল। তারপর রাজা পাকোর্দোর পিঠে চাবুকমারল। রাজা পাকোর্দোর শরীরটা কেঁপেউঠল। পর পর কয়েকটা চাবুকের মার খেয়ে রাজা পাকোর্দো বসে পড়লেন। মাথা নিচু করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলেন। রাজা আনোতার হাত তুলে প্রহরীকে থামতে ইঙ্গিত করল। প্রহরী চাবুক গুটিয়ে সরে দাঁড়াল।

এবার রাজা আনোতার বলল–যাক গে ভবিষ্যতে সাবধানে কথা বলবেন। এখন যে জন্যে আপনাকে ডেকেছি সেটা বলছি। শুনেছি আপনার যথেষ্ট ধনসম্পদ আছে।

সেই ধন সম্পদ আমার পৈতৃক ধনসম্পদ। রাজা পাকোর্দো বললেন।

–সেই ধনসম্পদের জন্যে আপনার রাজকোষাগার তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় নি। এখন বলুন কোথায় রেখেছেন সেসব। রাজা আনোতা বলল।

–আমি জানি না রাজা পাকোর্দো মাথা নাড়লেন।

–নিশ্চয়ই জানেন। আমার আক্রমণের খবর পেয়ে সে সব কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। রাজা আনোতার বলল।

–বললাম তো আমি কিছুই জানিনা। রাজা পাকোর্দো বলল।

–আপনি সে সব ধনভাণ্ডারের কোন খোঁজই রাখতেন না। রাজা আনোতার বলল।

না। রাজা পাকোর্দো বললেন।

–কেন? রাজা আনোতার বলল।

–সে সব আমার পিতার ধনভাণ্ডার। আমার নয়। ঐ ধনভাণ্ডারের ওপর আমার বিন্দুমাত্র লোভও ছিল না। রাজা পাকোর্দো বললেন।

–তাহলে সে সবের খোঁজ রাখতো কে? রানি? রাজা আনোতার প্রশ্ন করল।

–না। মন্ত্রী মশাই। তিনিই যেসব দেখাশুনো করতেন। মন্ত্রী মশাইকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারেন। রাজা পাকোর্দো বললেন।

কিন্তু এখানেই হয়েছে সমস্যা। আপনি জানেন না যে আপনার মন্ত্রী মশাই গতরাতে ফুয়েন্ত সরোবরে জলে ডুবে মারা গেছেন। রাজা আনোতার বলল।

রাজা পাকোর্দো চমকে উঠলেন। তারপর বললেন–যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি বোধহয় তিনি সহ্য করতে পারেন নি। রাজা পাকোর্দো বললেন।

–যে কারণেই হোক। আর কেউ কি সেই ধনভাণ্ডারের খোঁজ রাখে?

জানি না। রাজা পাকোর্দো বললেন।

মিথ্যে কথা। রাজা আনোতার চিৎকার করে বলল। তারপর ক্রুদ্ধ স্বরে বলল চাবুকের মার পড়লে বলতে বাধ্য হবেন।

–চেষ্টা করে দেখতে পারেন। রাজা পাকোর্দো বললেন।

–ঠিক আছে। আমি নিজে কয়েকদিন চেষ্টা করে দেখি। রাখা আনোতার বলল—

দেখুন চেষ্টা করে। রাজা পাকোর্দো বললেন।

রাজা আনোতার এবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। বলল–তোমরা এসেছো কেন?

–একটা অনুরোধ জানাতে। ফ্রান্সিস বল।

বলো। রাজা বলল।

আমাদের সঙ্গে আমাদের দেশের রাজকুমারী রয়েছে। কয়েদঘরের ঐ পরিবেশ তার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। তাকে অন্য কোথাও বন্দী করে রাখুন। রাজ অন্তঃপুরে হলে ভালো হয়। ফ্রান্সিস বলল।

–এটা পরে ভেবে দেখছি। এখন আমি গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধারে ব্যস্ত থাকবো। রাজা আনোতার বলল।

–বেশ পরেই দেখবেন। রাজা আনোতার প্রহরীদের ইঙ্গিত করল। প্রহরীরা এগিয়ে এল। বলল–চলো সব।

রাজা পাকোর্দোর সঙ্গে ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরে ফিরে এল। ঘরে ঢুকে রাজা পাকোর্দো বসলেন। তারপর আস্তে কাত হয়ে শুয়ে পড়লেন। পিঠে চাবুকের ক্ষত। চিৎ হয়ে শুতে পারলেন না। পাথরের দেয়ালে পিঠ দিয়েও বসতে পারলেন না।

ফ্রান্সিস ভেন-এর কাছে এল। বলল ভেন-রাজা মশাইয়ের পিঠে চাবুক মারা হয়েছে। কী করা যায়?

কী করবো বলো। সঙ্গে তো ওষুধ নেই। কোমরের ফেট্টি থেকে কিছুটা কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে রাজকুমারীকে দাও। জলে ভিজিয়ে সেই কাপড়ের টুকরো যেন রাজার পিঠে বুলিয়েদেনাকষ্ট কমবে।

মারিয়া ফ্রান্সিসের পাশেই বসেছিল। সব শুনে বলল–আমি–সব করছি। মারিয়া নিজের ঝুল পোশাক থেকে কাপড় ছিঁড়ে নিল। তারপর জলে ভিজিয়ে নিয়ে রাজার কাছে এসে বলল–মান্যবর রাজা–আপনার পিঠে জল ঝুলিয়ে দিচ্ছি। আমাদের বৈদ্যি বলছে এতে আপনার যন্ত্রণা একটু কমবে।

–বেশ। রাজা উঠে বসলেন। মারিয়া রাজার পোশাকটা পেছন দিকে তুলল। চাবুকের স্পষ্ট দাগ। রাজা নিঃশব্দের কী কষ্ট সহ্য করছেন সেটা মারিয়া বুঝতে পারল। ও রাজার জন্যে গভীর সহানুভূতি বোধ করল। আস্তে আস্তে ভেজা কাপড়ের টুকরোটা পিঠে বুলিয়ে দিতে লাগল। রাজার মুখ থেকে মৃদু গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এল। সেই শব্দ শুনে ফ্রান্সিস স্থির থাকতে পারল না। কয়েদঘরের দরজার কাছে গেল। একজন প্রহরীকে ডাকল। প্রহরী কাছে এলে বলল–রাজা পাকোর্দো খুব অসুস্থ। একজন বৈদ্যকে আসতে বলো।

–আমাদের রাজার হুকুম না হলে বৈদ্যকে ডাকা চলবে না। প্রহরী বলল।

–ঠিক আছে। তোমাদের সেনাপতির সঙ্গে কথা বলতে চাই তাকে ডাকো।

–তিনি কি আসবেন? প্রহরী বলল।

–একবার বলে তো দেখো৷ বলবে যে একজন বিদেশি ডাকছে।

–হুঁ। প্রহরীটি চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সেনাপতি এল। দরজায় মুখ রেখে বলল–কে ডাকছিলে?

আমি। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। বলল–চাবুকের মারে রাজা আনোতার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার চিকিৎসা প্রয়োজন।

–দেখি রাজাকে বলে। তবে রাজা চিকিৎসার অনুমতি দেবেন বলে মনে হয় না। সেনাপতি চলে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। কিন্তু সেনাপতি ফিরে এল না। ফ্রান্সিস বুঝল রাজা চিকিৎসার কোন ব্যবস্থাই করবেনা। ফ্রান্সিস ভেন-এর কাছে এল। বলল–ভেন রাজার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না?

দাঁড়াও। এখানে তো গাছগাছালি আছে। আমি দেখছি। ভেন লোহার দরজায় মুখ চেয়ে বাইরের জঙ্গলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস ওর পাশে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ কী দেখে ভেন বলে উঠল–পেয়েছি। ফ্রান্সিস বলল কী পেয়েছো?

–ওষুধ। ভেন বলল। তারপর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল

–ঐ যে চেস্টনাট গাছটা দেখছ তার পেছনে দেখ একটা ছোট গাছ। হাত চারপাঁচ লম্বা। ঐ গাছের শেকড়টা চাই। দেখ প্রহরীদের দিয়ে গাছটা আনতে পারো কিনা।

ফ্রান্সিস একজন প্রহরীকে ইশারায় ডাকল। বলল–একটা উপকার করবে ভাই?

–সেনাপতিকে ডাকতে যেতে পারবো না। প্রহরী বলল।

না না। অন্য ব্যাপার বলছি। ফ্রান্সিস এবার আঙ্গুল তুলে সেই ছোট গাছটা দেখালো। বলল ঐ গাছটার শেকড় সুদ্ধ তুলে এনে দাও।

প্রহরী অবাক। বলল–ঐ গাছটা দিয়ে কী করবে?

দাঁত মাজবো। নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।

–না না। পারবো না। প্রহরী মাথা নেড়ে বলল।

ফ্রান্সিস ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–একটা সোনার চাকতি দাও তো। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে একটা সোনার চাকতি বের করে দিল। ফ্রান্সিস সোনার চাকতিটা প্রহরীকে দেখিয়ে বলল–এবার পারবে? সোনার চাকতিটা প্রায় কেড়ে নিয়ে প্রহরী একগাল হাসল। বলল– এটা এমন কী কাজ? ও চলে গেল। একটু পরেই গাছটা শেকড় সুদ্ধ উপড়ে নিয়ে এল। দেখে ভেন বলল–ভাই শুধু শেকড়টা কেটে দাও।

বেশ। প্রহরী তরোয়াল বের করল। গাছের গোড়ার কাছে কেটে শেকড়টা দিল। ভেন শেকড়টা নিয়ে ঘরের ভেতরে এসে বসল। শেকড়ে আটকে থাকা মাটি ঝেড়ে ঝুড়ে ফেলে ফ্রান্সিসকে বলল–এই শেকড় চিবিয়ে ছিবড়েটা রাজার পিঠে মারের জায়গা গুলোয় চেপে লাগিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমার দাঁত তো অত শক্ত নয়।

–ঠিক আছে। আমি চিবিয়ে ছিবড়ে করে দিচ্ছি। ফ্রান্সিস হাত বাড়াল

–কিন্তু এর রস পেটে গেলে মৃত্যু হতে পারে। ভেন বলল।

কিচ্ছু ভেবো না। আমি সাবধান থাকবো। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া পাশেই ছিল। ও ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলনা-না। তুমি এটা করতে পারবে না।

–কাউকে তো চিবোতেই হবে–ফ্রান্সিস বলল–কিছু ভেবো না। এ এমন একটা কঠিন কাজ নয়।

–চিবিয়ে ছিবড়েটা বেরকরেদাও। তারপর ভালো করে মুখটা ধুয়ে ফেলো। ভেন বলল।

ফ্রান্সিস শেকড়টা মুখে ঢোকাল। চিবোতে লাগল। বেশ তেতো স্বাদ। মুখ কুঁচড়ে চিবোতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ছিবড়ে মত হল। ফ্রান্সিস সেটা বের করে ভেন-এর হাতে দিল। ভেন ছিবড়েটা আমার পিঠে চেপে চেপে দিতে লাগল। রাজা একবার ঝাঁকিয়ে উঠলেন। তারপর চুপ করে রইলেন। ফ্রান্সিস কাঠের গ্লাসে জল নিয়ে বারকয়েক কুলকুচি করে মুখ ধুয়ে ফেলল। কোন বিপদ হল না।

–মোক্ষম ওষুধটা পেয়েছি। রাজা দু’তিন দিনের মধ্যে সুস্থ হবেন। ভেন বলল। উদ্বিগ্ন মারিয়া এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। বলল–ভেন ফ্রান্সিস এখন সব খেতে পারবে তো?

–হ্যাঁ রাজকুমারী। আর কোন বিপদ নেই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ভেন বলল।

–তোমার শরীর ভালো আছে তো? মারিয়া ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করেন।

–হ্যাঁ হ্যাঁ। শুধু মাথাটা একটু ঘুরছে। ফ্রান্সিস বলল।

–ওটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। ভেন বলল। এতক্ষণে রাজা ফ্রান্সিদের দিকে তাকালেন। আস্তে আস্তে বললেন–আমি তোমার নাম জানি না। কী বলে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো তাও বুঝে উঠতে পারছি না। আমাকে সুস্থ করবার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করলে না। তুমি সত্যিই মহৎ।

–এটা মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি আমার কর্তব্য। আপনি দ্রুত সুস্থ হোন এটাই এখন চাই। ফ্রান্সিস বলল।

রাজা আর কিছু বললেন না। চুপ করে কাত হয়ে শুয়ে পড়লেন।

কয়েকদিনের মধ্যেই রাজা পাকোর্দো সুস্থ হলেন। পিঠের ঘা শুকিয়ে গেল।

এর মধ্যে রাজা আনাতোর রাজা পাকোর্দোকে রাজসভায় ডেকে পাঠিয়েছিল। বলেছিল–এখন কেমন আছেন?

ভালো–রাজা পাকোর্দো বলেছিলেন।

–আবার যদি চাবুকের ঘা খেতে না চান তো এখনও বলুন সেই ধনভাণ্ডার কোথায় রেখেছেন। রাজা আনোতার বলেছিল। না।

–আমি তো বলেছি এই ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। যিনি জানতেন সেই মন্ত্রী মশাই তো মৃত। এই বাতোরিয়া দেশ তো এখন আপনার দখলে। বিনা বাধায় তল্লাশী চালান। রাজা পাকোর্দো বলেছিলেন।

-কিন্তু কিছু একটা সূত্র তো চাই। রাজা আনোতার বলেছিল।

–আমি আপনাকে কোন সূত্র দিতে পারবো না। রাজা পাকোর্দো বলেছিলেন।

–আচ্ছা মন্ত্রীমশাই কেমন মানুষ ছিলেন? রাজা আনোতার জানতে চাইল।

–সৎ পরিশ্রমী অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আবার একই সঙ্গে সরল স্নেহশীল। প্রজাদের নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতেন। তাকে কখনও ক্রুদ্ধ হতে দেখি নি। নিজে সংসারটংসার করেন নি। তার একমাত্র চিন্তাই ছিল প্রজাদের মঙ্গল সাধন। আমি সবসময় তার পরামর্শ নিয়েই রাজকার্য করেছি। রাজা পাকোর্দো বলেছিলেন।

–আচ্ছা রাজকার্যে সাহায্য করা ছাড়া তিনি আর কী করতেন? রাজা পাকোর্দো একটু থেমে বললেন–শুনলে আশ্চর্য হবেন–অবসর সময়ে তিনি ছবি আঁকতেন।

–আঁ? অবাক কাণ্ড। রাজা আনোতার বলেছিলেন।

–হুঁ। অবাক হবারই কথা। রাজা পাকোর্দো বলেছিলেন।

–কীসের ছবি আঁকতেন? মানুষ জীবজন্তু? রাজা আনোতার বলেছিলেন।

না প্রকৃতির ছবি। ফুয়েন্তসরোবরআর তার চারপাশের বনজঙ্গল, পাহাড়, আকাশ এই সময়ের ছবি। রাজা পাকোর্দো বলল।

দুই রাজার এই কথোপকথনের দিন ফ্রান্সিস রাজসভায় উপস্থিত ছিল। মন্ত্রীমশাই ছবি আঁকেন একথা শুনে ও নিজেও কম অবাক হয় নি। মৃতমন্ত্রী মশাইয়ের প্রতি ওর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

সেদিন দুই রাজার এই পর্যন্তই কথাবার্তা হয়েছিল। ফ্রান্সিসের একটা লাভ হয়েছিল সেদিন। রাজা আনোতার মারিয়াকে অন্তঃপুরে থাকার অনুমতি দিয়েছিল। মারিয়া অবশ্য যেতে চাইছিল না। ফ্রান্সিস হ্যারি দুজনে মিলে অনেক বুঝিয়ে টুঝিয়ে ওকে যেতে বাধ্য করেছিল। আসলে ফ্রান্সিসরা এত কষ্ট করে এই কয়েদঘরে পড়ে থাকবে আর ও রাজ অন্তঃপুরের সুখ স্বাচ্ছন্দের মধ্যে থাকবে এটাও মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু ফ্রান্সিসদের পেড়াপেড়িতে শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হল। ফ্রান্সিসরা নিশ্চিন্ত হল।

দিন যায় রাত যায়। ফ্রান্সিস রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারে না। একমাত্র চিন্তা কী করে এই কয়েদঘর থেকে পালানো যায়। এই নিয়ে হ্যারির কথা হয়।

ওদিকে রাজা আনোতার রাজা পাকোর্দোর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ধনভাণ্ডারের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে। চারপাশের বনজঙ্গলপাহাড়। ফুটন্ত সরোবরের আশেপাশে অন্বেষণকারী দল পাঠাচ্ছে। নিজের অন্তঃপুর অস্ত্রাগার সৈন্যাবাস সর্বত্র খোঁজ করে বেড়াচ্ছে তার বাছাই করা আট দশ জন সৈন্য। কিন্তু গুপ্তধনভাণ্ডার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মাঝে মাঝেই রাজা পাকোর্দোকে রাজসভায় ডেকে পাঠায়। তর্জন গর্জন করে। চাবুকের মারের ভয় দেখায়। রাজা পাকোর্দো নির্বিকার। এককথাইবিরক্তির সঙ্গে বারবার বলেন– আমি কিছুই জানি না। যিনি জানতেন তিনি মৃত।

রাজঅন্তঃপুরে রাজার শয়নকক্ষে মন্ত্রী মশাইয়ের আঁকা তিনটে ছবি আছে। তিনটে ছবিতেই শুধু গাছপালা পাহাড় আকাশের ছবি। সন্দেহ নেই ছবিগুলো সুন্দর। রাজা আনোতার সময় পেলে ছবিগুলো দেখে। ছবি দেখে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না। সে রেগে গিয়ে ছবি তিনটে নামিয়ে বস্তাবন্দী করে মালখানা ঘরে রেখে দিয়েছে।

মন্ত্রীর বাড়িতেও তার আঁকা কয়েকটা ছবি ছিল। সেগুলোকেও রাজা আনোতার আনাল। দেখল ছবিগুলি সেই পাহাড় ঝর্ণা নীল আকাশে আকাশে সাদা মেঘ ভেসে চলেছে পাখি উড়ছে। ক্রুব্ধ রাজা সেই ছবিগুলোও মালখানাঘরে পাঠিয়ে দিল।

মন্ত্রীমশাইয়ের ছবি আঁকার ব্যাখ্যাটা ফ্রান্সিসকে খুব কৌতূহলী করল। রাজকার্যে সাহায্যের ফাঁকে ফাঁকে একজন ব্যস্ত মন্ত্রী ছবি আঁকে এ তো অদ্ভুত ব্যাপার। এই সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য সেদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পর শাঙ্কোকে বলল–বিন্তানোকে আমার কাছে আসতে বললো।

–কেন বলো তো? হ্যারি জানতে চাইল।

দরকার আছে। ফ্রান্সিস বলল।

শাঙ্কো গলা চড়িয়ে ডাকল। বিন্তানো একবার এখানে এসতো। বিন্তানো ওদের কাছে এল। ফ্রান্সিস বলল বিন্তানো–একটা ব্যাপারে তোমার কাছে কিছু জানতে চাইছি।

–বেশ বলো। বিন্তানো বলল।

বংশানুক্রমে রাজা পাকোর্দো যে ধনসম্পদ পেয়েছিল যে সম্পর্কে তুমি কিছু জানো। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–কী যে বলো। সেই ধনসম্পদ সম্বন্ধেরাজা পোতার্দোর নিজেরই কোন আগ্রহ ছিল না আর আমি কী জানবো। বিন্তানো বলল।

–আমার কেমন মনে হচ্ছে মন্ত্রীমশাই যেভাবেই হোক কোন সূত্র নিশ্চই রেখে গেছেন। ফ্রান্সিস বলল।

–হয়তো। তবে তার হদিশ করবোকে? সেই ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী সেই রাজা আনোতারেরই তো কোন হুঁশ নেই। তুমি আমি ভেবে কী করবোর বিন্তানো বলল।

–আচ্ছা মন্ত্রীমশাই কীসের ছবি আঁকতেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

সাদা চামড়ার ওপর বিন্তানো বলল।

–রং দেবেন কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।

–গাছের ফল, ছাল, গাছের শেকড়টেকগুঁড়ো করে। বেশ কিছু রং আমিই তৈরি করে দিয়েছিলাম। আসলেমন্ত্রীমশাইকেআমি খুব শ্রদ্ধাকরতাম। উনি আমাকেও খুব ভালোবাসতেন। ছবি আঁকারসময় বেশকয়েকবারতঁরসঙ্গী হয়েছিআমি। পাখি, প্রাণি বা মানুষ এসব আঁকতেন না। শুধু চোখ মেলে দেখা প্রকৃতি-পাহাড় সরোবর বনজঙ্গল আকাশ।

-হ্যাঁ শিল্পীর মেজাজ বোঝা দায়। আচ্ছা আঁকা ছবি গুলো তিনি কী করতেন? ফ্রান্সিস প্রশ্ন করল।

রাজা পাকোর্দোকে তিনটি ছবি দিয়েছিলেন। রাজা যত্ন করে তার শয়নকক্ষে টাঙিয়ে রেখেছেন। কয়েকটা ছবি তার বাড়িতে টাঙিয়ে ছিলেন। খুব বেশি ছবি আঁকেন নি। একটা ছবিই অনেকদিন ধরে আঁকতেন। বিন্তানো বলল।

–মন্ত্রীমশাইয়ের আঁকা ছবিগুলো দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–বোধ হয় দেখতে পাবেন না। বিন্তানো বলল।

–কেন? ফ্রান্সিস বলল।

–রাজা আনোতার সব ছবি মালখানা ঘরে বস্তাবন্দী করে রেখে দিয়েছে। বিন্তানো বলল।

–তার উপযুক্ত কাজই করেছে। ছবির কদর বোঝার মত মানুষ সে নয়। কথায় কথায় চাবুক চালায় এ কেমন রাজা? ফ্রান্সিস বলল।

–তা তো বটেই। বিন্তানো বলল।

যাক গে–রাত হল। শুয়ে পড়ো। ফ্রান্সিস বলল।

বিন্তানো চলে গেল।

শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস তুমি মন্ত্রীমশাই তাঁর আঁকা ছবি এসব নিয়ে ভাবছো কেন?

–মনটা কখনও শূন্য রাখতে নেই। কিছু না কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। হ্যারি পাশেই শুয়ে ছিল। হেসে বলল–ফ্রান্সিস গুপ্তধনের সংবাদ পেয়েছ। ওর এত আগ্রহের কারণ ওটাই এখন ঐ নিয়ে ভাববে।

না না হ্যারি। আমি এখন পালানোর উপায় ভাবছি। মন্ত্রীমশাইছবি গুপ্ত ধনভাণ্ডার এসব পরে ভাববো। ফ্রান্সিস বলল।

–একটা কাজ তো করতে পারো ফ্রান্সিস শাঙ্কো বলল–রাজা আনোতারকে বলো তুমি গুপ্তধন খুঁজে উদ্ধার করে দেবে এবং একটা স্বর্ণমুদ্রাও নেবেনা। তুমি বললেই রাজা আনোতার রাজি হবে। আমরাও মুক্তি পাবো।

-অসম্ভব। রাজা আনোতার অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। একজন মানুষ গুপ্তধন উদ্ধার করে দেবে কিন্তু বদলে কিছুই নেবে না–এমন মানুষও আছে রাজা আনোতার সেটা বিশ্বাসই করবে না।

তুমি বিশ্বাস করাতেই পারবেনা। ভাববে অন্য বদমতলব আছে। ফ্রান্সিস বলল।

তুমি ঠিকই অনুমান করেছে। হ্যারি বলল।

নাও শুয়ে পড়ো সব। রাত জাগা চলবে না। ফ্রান্সিস কথাটা বলে শুয়ে পড়ল।

–বলছো বটে কিন্তু তুমি অনেক রাত অব্দি জেগে জেগে থাকো। হ্যারি বলল।

–তুমি টের পাও? ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–তুমি আমার বাল্যবন্ধু। তোমাকে আমি ভালো করেই চিনি। মাথায় চিন্তা নিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারো না। হ্যারি বলল।

–তা যা বলেছে। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

ফ্রান্সিসদের বন্দীজীবন কাটতে লাগল। ফ্রান্সিস মাঝে মাঝেই কয়েদঘরটা ঘুরে দেখে যদি কোনভাবে পালানো যায়। কিন্তু পাথর চাপিয়ে চাপিয়ে তৈরি ঘর বেশ মজবুজ। পাথরের দেয়াল ভাঙার বা সরাবার কোন উপায় নেই। ওপরের ছাউনিও পাথর চাপা দিয়ে মজবুত করা।

সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর শাঙ্কো ফ্রান্সিসদের কাছে এল। ফিসফিস্ করে বলল–পালাবার উপায় বের করেছি। ফ্রান্সিস বলল কী উপায়?

–ঐ যে জানালার মত ফোকরটা ঐ পর্যন্ত ওঠার ব্যবস্থা করেছি। ওটাতে পা রেখে ছাউনি সরিয়ে ঘরের ওপরে উঠতে পারবো। তারপর বুদ্ধি করে পালানো। শাঙ্কো বলল।

ফ্রান্সিস চোখ বুজে একটু ক্ষণ ভাবল। তারপ রবলল—আমার ছক ভাবা হয়ে গেছে। তোমাকে ছাউনি দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে প্রহরীদের কোমর থেকে চাবি বের করে নিয়ে দরজা খুলবে। আমরা পালাবো। তবে তুমি একা এতসবপারবেনা। বিনেলোকেসঙ্গে নেবে। মোট কথা নিঃশব্দে সব কাজ সারতে হবে। আজ রাতেই লেগে পড়ো। তার আগে দেখে এসো ক’জন প্রহরী রয়েছে। শাঙ্কো উঠে গেল। দরজার কাছে গিয়ে দেখে এসে বলল–মাত্র দু’জন।

–হাতে কী? ফ্রান্সিস প্রশ্ন করল।

বর্শা। শাঙ্কো বলল।

–এতে তোমাদের সুবিধেই হবে। দু’জনকে কবজা করা সহজ। কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর। রাত বাড়লে কাজে লাগা। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো বিনেলোর কাছে গেল। কী করতে হবে ফিস্ ফিস্ করে বলল। দু’জন শুয়ে পড়ল। বিশ্রাম চাই।

রাত বাড়ল। শাঙ্কো উঠে পড়ল। বিনেলোও সজাগ ছিল। উঠে দাঁড়াল। শাঙ্কো দরজার কাছে গেল। লোহার গরাদের ফাঁকদিয়ে দেখল–একজন প্রহরী একটা কাঠের পাটাতনের ওপর বসে আছে। বোঝাই যাচ্ছে ঝিমোচ্ছে। অন্যজন দাঁড়িয়ে আছে।

শাঙ্কো সরে এলো। জানালার মত ফোকরটার একেবারে নিচেদাঁড়াল। তারপর পাথরের অল্প খাজে পা রাখল। তারপর উঁচু দিকে ছোট হাতলটায় একটা পা রেখেই এক ঝটকায় ফোকরটা ধরে ফেলল। নিচের দিকে তাকিয়ে ফিফিরে বলল-বিনেলো–এইভাবে ওপরে উঠে আসবে। এবার শাঙ্কো শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জানালামত ফোকরটায় উঠে বসল। হাতের কাছেই ঘরের ছাউনি। ও ছাউনি ঠেলল। বেশ ভারি। বোঝা গেল ওখানে পাথরের চাপা দেওয়া। তিনচারবার জোরে ঠেলে ঠেলে পাথর চাপা সরাল। মাথা ঢুকিয়ে দিল ঘাসপাতার ছাউনি দিয়ে। ছাউনি থেকে ওর মাথা বেরিয়ে এল। গাছের কাটা ডালের বুনানীতে হাত রাখল। পরে ওটা ধরে ছাউনির ওপর উঠে এল।

ওদিকে বিনোলো শাঙ্কোর দেখাদেখি নিজেও ছাউনির ওপর উঠে এল। সাবধানে কোন শব্দ না করে দু’জনে ছাউনির ওপরে উঠে এল। শাঙ্কো ফিফিস্ করে বলল দাঁড়ানাটাকে আমি ধরব। বসে ঝিমোচ্ছে ওটাকে তুমি ধরবে। নিজের কোমরের ফেট্টি খুলতে খুলতে বলল–কোমরের ফেট্টি খুলে ওটা দিয়ে মুখ চেপে দরজার গরাদের সঙ্গে বেঁধে ফেলবে। মুখে যেন কোনরকম শব্দ না করতে পারে।

ফেট্টি খুলে হাতে নিয়ে দু’জনে নিচে তাকাল। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সবই দেখা যাচ্ছিল। শাঙ্কো চাপাস্বরে বলল ঝপাও। দুজনেই দু’জন প্রহরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’জন প্রহরীর হাত থেকেই বর্শা ছিটকে গেল। দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল। শাঙ্কো এক প্রহরীর মুখে ফেট্টির কাপড় চেপে ধরল। দেখাদেখি বিনোলাও তাই করল। ওরা চেঁচিয়ে উঠতে পারল না। শাঙ্কো ঐ প্রহরীকে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ঘরের দরজার কাছে নিয়ে এল। তার মুখ চেপে ফেট্টির কাপড়টা দরজার লোহার গরাদের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। প্রহরীটির গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুলোনা। শাঙ্কোর দেখাদেখি বিনোলাও অন্য প্রহরীটিকে একইভাবে এ বাঁধল। প্রহরীটির মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বেরুতে লাগল। শাঙ্কো তার গালে বিরাশি # সিক্কা ওজনের এক চড় কষাল। গোঙানি বন্ধ হল।

শাঙ্কো দ্রুত প্রহরীটির কোমরে ঝোলানো চাবির গোছাটা খুলে নিল। চাপাস্বরে বলল– চাবিটা দেখাও। প্রহরীটি চাবিটি দেখিয়ে দিল। মুখে উ-উ শব্দ করল। শাঙ্কো চাপাস্বরে ধমক দিল–চোপ। শব্দ বন্ধ হলেও বুঝল শব্দ বন্ধনা করলে আবার চড় খেতে হবে।

শাঙ্কো ছুটে গিয়ে দরজার তালা খুলে ফেলল। চাপা স্বরে বলল–বেরিয়ে এসো সবাই। বন্ধুরা ছুটে এসে খোলা দরজার বাইরে চলে এল। রাজা পাকোর্দো শুয়ে ছিল। ফ্রান্সিস তার কাছে গিয়ে ফিসফিস্ করে বলল–উঠে আসুন। দরজা খোলা। রাজা উঠে বসলেন। তখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। ততক্ষণে সবাই বাইরে চলে এসেছে। এখন রাজা আর ফ্রান্সিস বেরিয়ে এলেই হয়।

ফ্রান্সিস রাজাকে হাত ধরে বাইরে নিয়ে এল।

সময় নেই। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলে উঠল– পাহাড়ের দিকে সবাই ছোটো–জলদি।

উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় চারদিকে দেখা যাচ্ছে। সবাই ছুটল। রাজা পাকোর্দোও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটলেন।

অল্পক্ষণের মধ্যেই সবাই বনভূমির কাছে চলে এল। বনভূমিতে ঢুকে পড়ল। পাহাড়ের ওপারেই রাজা আনোতারের ভিঙ্গার রাজত্ব। এখন রাজা আনোতার তো এখানকার রাজত্ব দখল করে এখানেই সৈন্যদের নিয়ে আছে। এখন তার রাজত্বে বোধহয় অল্প যোদ্ধাই আছে। কাজেই বিপদের সম্ভাবনা কম। ফ্রান্সিস বনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এসব ভাবছিল। আরো ভাবছিল ওরা পালিয়েছে এটা রাজা আনোতার কিছুক্ষণের মধ্যে জানতে পারবে। ওরা এই বনের দিকেই পালিয়েছে। তাও জানতে পারবে। নিশ্চয়ই ফ্রান্সিসদের খুঁজে বের করতে বনের মধ্যে তার যোদ্ধাদের পাঠাবে। ফ্রান্সিসদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ওরা নিরস্ত্র। ঐ যোদ্ধাদের মুখোমুখি হওয়া চলবে না। নিরস্ত্র অবস্থায় সবাইকে মরতে হবে। একমাত্র উপায়–আত্মগোপন করে থাকা। কিন্তু ও জানেনা পাহাড়ের ওপারে। বনাঞ্চল আছে কিনা।

বনের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে সবাই হাঁপাচ্ছে তখন। কেউ বেশি হাঁপাচ্ছে কেউ কম। ছুটতে ছুটতে ফ্রান্সিস বিন্তানোকে জিজ্ঞেস করল–পাহাড়ের ওপারে তো রাজা আনোতারের রাজত্ব।

-হ্যাঁ। বিন্তানো ছুটতে ছুটতে বলল।

–ওপারে পাহাড়ের নিচে বনাঞ্চল আছে? ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ। বিন্তানো বলল।

–পাহাড় পার হয়ে ওখানেই আমরা গা ঢাকা দেব। ফ্রান্সিস বলল।

পাহাড়ের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–পাহাড় পেরিয়ে ওপারে যাবো। ছোটো সবাই।

পাহাড়ের চড়াইয়ে উঠতে লাগল সবাই। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–যতটা সম্ভব গাছগাছালি ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে থেকে ওঠো সবাই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের ওপর উঠল সবাই। ফ্রান্সিস পেছন ফিরে তাকাল। দেখল দূরে হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে রাজা আনোতারের সৈন্যরা এই পাহাড়ের দিকেই আসছে।

এবার পাহাড় থেকে নামা শুরু হল। যতটা সম্ভব দ্রুত সবাই নামতে লাগল। রাজা পাকোর্দো বয়স্ক মানুষ। আহত তিনি বেশহাঁপাতে লাগলেন। ফ্রান্সিস তাকে মাঝে মাঝেই ধরছিল। সাহায্য করছিল তাকে নামতে।

পাহাড় থেকে নামল সবাই। কম বেশি সবাই হাঁপাচ্ছে তখন।

নিচে গভীর বনভূমি ফ্রান্সিস সবাইকে ডানদিকে গভীর বনের দিকে নিয়ে গেল। একটা বিরাট উঁচু গাছের নিচে সবাইকে দাঁড় করাল। বলল–এখানেই আশ্রয় নেব আমরা। এটাই হবে আমাদের গোপন আস্তানা। একটু ফাঁকা জায়গাটা। একটু ঘাসে ঢাকা জমি। কেউ কেউ ঘাসের ওপর বসে হাঁপাতে লাগল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। রাজা পাকোর্দো ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লেন। খুব পরিশ্রান্ত। ফ্রান্সিস বলল–সবাইবিশ্রাম নাও। কেউ কোন শব্দ করো না। রাজা আনোতারের সৈন্যরা আমাদের খুঁজবে। তবে খুঁজে পাবে না। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে যা করবার করবো।

সবাই চুপ করে শুয়ে বসে। চারদিক নিস্তব্ধ শুধু গাছের ডালে পাতায় বাতাসের শো শোঁ শব্দ।

হঠাৎ কিছু দূরে রাজা আনোতারের সৈন্যদের হাঁক ডাক শোনা গেল। তারপরই চারদিকে স্তব্ধতা।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সৈন্যদের হাঁকডাকআরো দূরে শোনা গেল। বোঝা গেল হতাশ সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছে।

ভোর হল। ফ্রান্সিসরা শুয়ে বসে আছো। তখনও বনতলের অন্ধকার কাটেনি।

কিছুক্ষণ পরে আবছা আলো ছড়াল বনতলে।

তখন কম বেশি সবাই ক্ষুধার্ত। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস খাবারের ব্যবস্থা তো করতে হয়।

–হ্যাঁ। কিন্তু এখন নয়। দুপুরের খাবার জোগাড় করে যেতে হবে। এখন এই বনেই ফলমূল খুঁজতে হবে। সবাইকে বলে সেটা। হ্যারি উঠে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল ভাইসব কাছাকাছি ফলমূল খুঁজে পাও কিনা দেখো। তবে বেশিদূর যাবেনা। গাছের ডাল ঝোঁপের গাছ ভেঙে ভেঙে যাবে, যাতে এখানে পথ চিনে ফিরে আসতে পারো। ভাইকিং বন্ধুরা উঠে দাঁড়াল। বনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ফলমূল নিয়ে ফিরে এল। সবাইকে ফলমূল ভাগ করে দেওয়া হল। ফলমূল খেয়েই খিদে মেটাতে হল।

–ফ্রান্সিস দুপুরের খাবারের কী হবে? শাঙ্কো বলল।

-বনের ওপারেই তো রাজা আনোতারের ছেড়ে আসা রাজত্ব ভিঙ্গার। ওখানকার রাজবাড়িতে ঢু দিতে হবে। বেশির ভাগ সৈন্যই এখন রাজা পাকার্তোর রাজত্বে। এখানে রাজবাড়িতে প্রহরীর সংখ্যাও বেশি থাকবে না। বিনা রক্তপাতে রাজবাড়ি থেকে খাবার চুরি করে আনতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–পারবে? প্রহরীদের নজর এড়িয়ে? শাঙ্কো বলল।

-পারতে হবে। বুদ্ধিকরে। খাবার জোগাড় করতেই হবে যে ভাবে হোক। না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বো। ফ্রান্সিস বলল।

দেখ চেষ্টা করে। হ্যারি বলল।

দুপুর হল। ফ্রান্সিস ঘাসের ওপর শুয়ে খাবার চুরির উপায় ভাবছিল। এবার উঠে দাঁড়াল। ডাকল শাঙ্কো বিনেলো এসো। শাঙ্কো বিনোলা উঠে এল।

–চলো রাজবাড়ি থেকে খাবার চুরি করতে হবে। এছাড়া খাবার জোগাড় করার অন্য কোন উপায় নেই। ফ্রান্সিস বলল।

বেশ চলো। শাঙ্কো বলল।

শাঙ্কো বিনোলোক নিয়ে ফ্রান্সিস চলল। গাছগাছালির নিচে দিয়ে ঝোঁপঝাড় ঠেলে ভেঙে বনের মধ্যে দিয়ে তিনজনে চলল।

একসময় বনভূমি শেষ হল। বনের গাছের আড়াল থেকে দেখল বনভূমির খুব কাছেই বড়বাড়িটা। বোঝা গেল ওটা রাজাবাড়ি। রাজবাড়ি ছাড়িয়ে পাথরের বাড়িঘরদোর। রাজা আনোতারের প্রজাদের বসতি এলাকা। সামনে একটা ঘাসে ঢাকা মাঠমত। তারপরেই সৈন্যাবাস। লম্বাটানা বাড়ি। এদিকটা সৈন্যবাসের পেছন দিক। পেছনের জানালাগুলো খোলা। সব দেখে ফ্রান্সিস বলল–একটা লম্বা গাছের ডাল ভেঙে আনো। বিনেলো বাঁ পাশে তাকাতেই একটা লম্বা গাছ পেল। ছোট ছোট ডালওয়ালা। ও ছুটে গিয়ে গাছটা টানতে লাগল। কিন্তু গাছটা টেনে তুলতে পারল না। আস্তে ডাকল শাঙ্কো। শাঙ্কো ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। দুজনে মিলে কয়েকটা হ্যাঁচকা টান দিতেই গাছটা উঠে এল। গাছটা ফ্রান্সিসের কাছে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস গাছের শেকড় থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলল। মাথার কাছে ছোট ডালটা ভাঙল। একটা আঁকশির মত হল। শাঙ্কো বলল

–এই আঁকশি দিয়ে কি করবে?

সৈন্যবাসের জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখ। ফ্রান্সিস বলল।

–দেখছি তো ফ্রান্সিস বলল।

–দেয়ালে আনোতারের সৈন্যদের পোশাক ঝুলছে। ফ্রান্সিস বলল।

–হা হা। কালোরঙের পোশাক বুকে হলুদ রঙ।

–আঁকশে দিয়ে তিনটে পোশাক টেনে আনবো। সেসব পোশাক পরে রাজবাড়ির রসুইঘরে থাকো। তারপর–হ্যাঁ শাঙ্কো সোৎসাহে বলে উঠল-সাবাস ফ্রান্সিস।

–খুব সহজে কাঠের ডেকচিতে বড় থালায় খাবার নিয়ে চম্পট। ফ্রান্সিস বলল।

এখন কী করবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।

লক্ষ্য কর–সৈন্যাবাসের জানালার কাছে পৌঁছতে হলে একটা ছোট মাঠমত পার হতে হবে। এই মাঠটা আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে পার হতে হবে। নইলে জানালা দিয়েই সৈন্যরা আমাদের দেখতে পাবে।

ফ্রান্সিস মাঠের লম্বা লম্বা ঘাসের ওপর হামা দিয়ে বসল। তারপর দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে একটা জানালার দিকে লক্ষ্য রেখে চলল ঐ জানালা দিয়েই দেয়ালে ঝোলানো পোশাক দেখা যাচ্ছিল।

অল্পক্ষণের মধ্যেইফ্রান্সিস জানালাটার কাছে পৌঁছল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ঘরটায় কারো সাড়াশব্দ নেই। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে আঁকশিটা ঢুকিয়ে দিল। সন্তর্পণে একটা ঝোলানো পোশক টান দিয়ে নামল। সাবধানে পোশাকটা টেনে বাইরে নিয়ে এল। একইভাবে তিনটে পোশাক সাবধানে নিয়ে এল। পোশাক ফকে নিচে মেঝেয় পড়ে গেলে শব্দ হবে তাই খুব সাবধানে পোশাক তিনটে নিয়ে এল। তারপর পোশাকগুলো পিঠে রেখে হামাগুড়ি দিয়ে চলে এল মাঠেরঘাসগুলো লম্বা ও হওয়ায় ফ্রান্সিসেরশরীরেরঅনেকটাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। এতে ফ্রান্সিসেরসুবিধেই হল।

তিনজনে পোশাকগুলো নিয়ে বনের আড়ালে চলে গেল। তিনজনেই নিজেদের পোশাকের ওপর কালো পোশাক পরে নিল।

ওরা বনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। চলল রাজবাড়ির দিকে।

রাজবাড়ির সদর দেউড়ির কাছে এসে দেখল মাত্র একজন পাহারাদার বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে। রাজা আনোতার এখানে নেই। কাজেই পাহারার কড়াকড়ি নেই। ফ্রান্সিসরা প্রহরীর সামনে দিয়েই রাজ বাড়ির আর এক পাশে চলে এল। ফ্রান্সিস দূরত্বটা হিসেব করে দেখল রাজবাড়ি থেকে বনভূমির দূরত্ব খুবই কম। এই দূরত্ব দ্রুত ছুটে পার হতে বেশি সময় লাগবেনা।

একপাক রাজবাড়িটা ঘুরে এল। কিন্তু রসুই ঘরটা কোথায় বুঝে উঠতে পারল না। এবার বড় দেউড়ির সামনে এল। দেউড়ি দিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। প্রহরীটি ওদের একবার দেখল শুধু। কিছু বলল না।

রাজবাড়িতে ঢুকেই ডানদিকে মন্ত্রণাকক্ষ। বাঁহাতি একটা গলিমত। ফ্রান্সিস বুঝল সোজা গেলে রাজসভা ঘর পড়বে। ও বাঁ দিকের গলিপথটা দিয়ে ঢুকে চলল। কিছুদূর গিয়ে গলিপথটা ডানদিকে চলে গেছে। সেই গলিপথে ঢুকতেই নাকে ঘিসলার গন্ধ লাগল।

ফ্রান্সিস হেসে মৃদুস্বরে বলল–রান্নাঘর সামনেই।

ডানহাতি একটা দরজা তিনজনই রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। বিরাট উনুন জ্বলছে। তিনজন রাঁধুনি রান্না করছে। একজন রাঁধুনি ওদের দেখে বলল–যাও। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবেশনকারী খাবার নিয়ে যাবে।

–আমাদের খুব তাড়া। রাজার হুকুম এক্ষুণি পেয়েই আমাদের পাহাড়ের ওপারের বাতারিয়ায় যেতে হবে।

–তাহলে পেছনের রসুইঘরে বসে খেয়ে নাও। আমরাই খেতে দেব। রাঁধুনি বলল।

–তাহলে তো ভালোই হয় ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিসরা পাশের রসুইঘরে ঢুকল। দেখল দুটো বিরাট থালাভর্তি রুটির স্তূপ। একটা বড় কাঠের ডেকচিও রয়েছে। একজন রাঁধুনি এল। দেয়ালে আটকানো একটা লম্বা কাঠের পাটাতনে রান্না করা খাবার রাখা। রাঁধুনি একটা হাতা নিয়ে এসেছিল। পাটাতনের একপাশে রাখা লম্বা শুকনো পাতা নিয়ে পেতে দিল। রাঁধুনি দ্রুতহাতে চারটে করে রুটি পাতার ওপর রাখল। ফ্রান্সিস চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে পেছন দিকে একটা হুড়কো লাগানো দরজা দেখল। বলল–একটু হাত ধোবো যে। রাঁধুনি জলের বিরাট জালাটা দেখিয়ে বলল–গ্লাসে করে জল নিয়ে এসো। ফ্রান্সিসরা কাঠের গ্লাসে জল নিয়ে এল। রাঁধুনি ততক্ষণে পেছনের দরজাটার হুড়কো খুলে দিয়েছে। বলল–এই দরজার বাইরে গিয়ে হাত ধুয়ে এসো। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে দরজার বাইরে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল–হাত কুড়ি দূরে বন শুরু হয়েছে। হাতমুখ ধুতে ধুতে ও মৃদুস্বরে বলল–এই দরজা দিয়েই আমরা পালাবো। হাত বাড়ানো দূরত্বে বনের আড়াল পাবো।

– রসুই ঘরে ফিরে এসে খেতে বসল। রাঁধুনি ততক্ষণে মাংসের ঝোলও পাতায় ঢেলে দিয়ে গেছে। ফ্রান্সিসরা গোগ্রাসে খেতে লাগল।

রাঁধুনি চলে গিয়েছিল। ফিরে এল। ফ্রান্সিস বলল–আর একদফা রুটি মাংস দাও। আমাদের ওতেই হবে। তোমাকে আর আসতে হবে না। রাঁধুনি আর একদফা খাবার দিয়ে চলে গেল। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল–আর দেরি নয়। দু’জনে, দুটো রুটির থালা নাও। আমি মাংসের ডেকচিটা নিচ্ছি।

তিনজনে দ্রুত সব খাবার নিয়ে পেছনের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস উঁকি দিয়ে দেখল রাজবাড়ির সামনের মাঠ ফাঁকা মাঠে কোন সৈন্য নেই। চাপাস্বরে বলল ছোটো-জঙ্গলের দিকে। তিনজন ছুটে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

তিনজনেই হাঁপাচ্ছে তখন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলল তিনজন। একটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে সেইবিরাট গাছটা দেখতে পেল। গাছের নিচে এল। খাবার নিয়ে তিনজনকে আসতে দেখে বন্ধুরা মৃদুস্বরে আনন্দধ্বনি তুলল–ও–হো–হো।

সবাই ক্ষুধার্ত খাবারের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজা পাকোর্দোও গেলেন। হেসে ফ্রান্সিস বললেন–তোমরা যে অক্ষত দেহেফিরে আসতে পেরেছো এতেই আমি খুশি।

খাওয়া-দাওয়া শেষ। সন্ধ্যা হয়ে এল।

ফ্রান্সিস ঘাসের ওপর শুয়ে ছিল। হ্যারি ওর কাছে এল। বলল ফ্রান্সিস কী করবে এখন? এখানে আত্মগোপন করে কতদিন থাকবে? প্রত্যেকদিন দু’বেলা খাবার জোগাড় করতে পারবেনা।

উঁহু। এভাবে থাকা চলবে না। আশ্রয় চাই, খাদ্য চাই। ভুলে গেলে চলবে না। মারিয়া বন্দিনীজীবন কাটাচ্ছে। তাকেও মুক্ত করতে হবে।

–সেই জন্যেই বলছিলাম যা করার তাড়াতাড়ি কর। হ্যারি বলল।

–শোন–রাজা আনোতারের এই রাজত্বে এখন বেশ কিছু সৈন্য আছে। রাজা পাকোর্দোর রাজত্ব থেকে ওরা এখানে ফিরে এসেছে। লড়াই করে এই সৈন্যদের হারিয়ে এই ভিঙ্গার রাজত্ব দখল করতে হবে।

–কিন্তু আমাদের তো একটা তরোয়ালও নেই। হ্যারি বলল।

যারা ফিরে এসেছে তারা তো তরোয়াল নিয়েই ফিরেছে। তরোয়ালি বর্শায় এখানকার অস্ত্রাগারে জমা রেখেছে। ফ্রান্সিস বলল।

-হ্যাঁ। তা রেখেছে। হ্যারি বলল।

–আমরা সেইঅস্ত্রাগার লুঠকরবো। অস্ত্র নিয়ে ওদের আক্রমণ করবো। ফ্রান্সিস বলল।

–অস্ত্রাগার লুঠ করতে পারবো? হ্যারি সংশয় প্রকাশ করলে।

–পারতেই হবে। আমার ছক ভাবা হয়ে গেছে। আজ রাতেই কাজে নামবো। নিরস্ত্র অবস্থায় এভাবে আত্মগোপন করে উপবাস করে পড়ে থাকা চলবে না। এই বনভূমি তো বিরাট এলাকা নিয়ে নয়। আজ হোক কাল হোক ওরা আমাদের ঠিক এই বনে খুঁজে বের করতে পারবে। তখন নিরস্ত্র অসহায় আমরা কেউ ওদের হাত থেকে বাঁচবো না। কাজেই আমাদেরই অস্ত্র জোগাড় করে আগে আক্রমণ করতে হবে ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে আজ রাতেই কাজে নামাবে? হ্যারি জানতে চাইল।

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। একটু গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–ভাইসব–রাতে খাওয়া জুটবে না। এটা জেনে নিজেদের তৈরি রাখো। রাতে কেউ ঘুমিয়ে পড়বে না। মান্যবর রাজা আপনিও ঘুমুবেন না। বেশ রাত হলে আমরা এখানে রাজা আনোতারের সৈন্যদের সৈন্যবাস আক্রমণ করবো।

–কিন্তু ফ্রান্সিস আমরা তো নিরস্ত্র। বিনেলা বলল।

লুঠ করবো। তারপর অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করবো। তখন ওরা ঘুমে অচেতন থাকবে। আমরা লাথি দিয়ে বন্ধ দরজা ভেঙে ঢুকবো। ওদের তৈরি হতে সময় দেব না। ঠিক এভাবেই আমরা ওদের বন্দী করবো। আমরা সব ছকের কথা বললাম। এটাকে কাজে পরিণত করার দায়িত্ব তোমাদের। আমার কথা শেষ। এবার তোমরা বিশ্রাম কর। ফ্রান্সিস বসে পড়ল। তারপর হ্যারিকে ডেকে বলল, হ্যারি রাজা পাকোর্দোর দুজন দেহরক্ষীকে আমার কাছে নিয়ে এসো। হ্যারি চলে গেল। একটু পরেই দুজন দেহরক্ষীকে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস ওদের জিজ্ঞেস করল–রাজা জানি না। তবে রাজবাড়ির সঙ্গেই অস্ত্রাগার এটা জানি। আর একজন বলল-বোধহয় দক্ষিণ দিকের ঘরটাই অস্ত্রঘর। ঘরটা দখল করা যাবে। প্রহরী কেমন থাকে?

–অস্ত্রাগার বলে কথা। দু’চারজন প্রহরী তো থাকবেই একজন বলল।

হুঁ তা থাকবে–ফ্রান্সিস বলল–ঠিক আছে। তোমরা তরোয়াল পাবে। লড়াইয়ের জন্যে তৈরি থেকো।

–বেশ। দেহরক্ষী দুজন চলে গেল।

রাতে তো পেট ভরে খাবার জুটবে না। দুপুরের যেটুকু খাবার বেঁচে ছিল তাই সবাই ভাগ করে খেল। তারপর শুয়ে পড়ল।

রাত একটু গম্ভীর হতে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। একটু গলা চড়িয়ে বলল–সবাই তৈরি হও। চলো।

সবাই উঠে দাঁড়াল। লড়াই করতে যাচ্ছে এতেই ভাইকিংদের আনন্দ। শুয়ে বসে সময় কাটানো ওদের ধাঁতে সয় না।

বনের মধ্যে দিয়ে সবাই রাজবাড়ির দিকে চলল। বন শেষ হয়ে আসতে ছাড়া ছাড়া ছাড়া গাছের বন শুরু হল।

এখানে ওখানে ডালপালার ফাঁক দিয়ে ভাঙা চাঁদের আলো পড়েছে। আস্তে আস্তে সবাই বনের ধারে চলে এল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল-থামো। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল।

ফ্রান্সিস বন থেকে বেরিয়ে এল। চাঁদের আলোয় দেখল রাজবাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা ঘরের সামনে কালো হলুদ পোশাক পরা দুজন প্রহরী প্রহরারত। ফ্রান্সিস ভাবল– যাক দু’জন প্রহরী। পরাভব জানানো সহজ হবে। ও ফিরে এসে শাঙ্কো আর বিনেলোকে বলল–শাঙ্কো–ছোরা ছুঁড়ব। বিনেলো অন্য কাকে কবজা করবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সারতে হবে। কোনরকম শব্দ যেন না হয়।

তিনজনে বন থেকে বেরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে প্রহরীদের কাছাকাছি চলে এল। শাঙ্কো হঠাৎ দাঁড়িয়ে জামার তলা থেকে ছোরা বের করে ছুঁড়ে মারল। ছোরাটা একজন প্রহরীর ডান কাঁধে বিধে গেল। সে তরোয়াল ফেলে দিয়ে কাধ চেপে বসে পড়ল। ফ্রান্সিস এক লাফ এগিয়ে গিয়ে তরোয়ালটা তুলে নিল। অন্য প্রহরীটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। বিনেলো ততক্ষণে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সে এই অতর্কিত আক্রমণে টাল সামলাতে পারল না। মাটিতে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস তরোয়াল হাতে ওর সামনে এসে দাঁড়াল। চাপাস্বরে বলল তরোয়াল ফেলে দাও। কোন শব্দ করবে না। প্রহরীটি বোকার মত তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস তাড়া দিল জদি। প্রহরীটি উঠে বসে তরোয়ালটা ফেলে দিল। বিনেলা সঙ্গে সঙ্গে তরোয়ালটা তুলে নিল। ফ্রান্সিস তরোয়াল উঁচিয়ে বলল তোমরা শব্দ করলেই মরবে। আমরা অস্ত্রাগার লুঠ করবো। কেউ বাধা দিতে এলে মরবে। তারপর শাঙ্কোকে বলল–শাঙ্কো বন্ধুদের ডাকো। বলবে সবাই যেন নিঃশব্দে আসে। রাজাকে অপেক্ষা করতে বলবে। উনি যেন না আসেন।

শাঙ্কো বনের দিকে চলে গেল। একটু পরেই বন্ধুরা আর রাজার দেহরক্ষীরা যতটা দ্রুত সম্ভব ছুটে এল। আহত প্রহরীটির কোমরেঅস্ত্রাগারের দরজার তালার চাবি ঝুলছিল। ও কাঁধ থেকে ছোরাটা খুলে মাটিতে ফেলে দিল। শাঙ্কো দ্রুত ছোরাটা তুলে নিল। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে ওর কোমর থেকে চাবিটা নিয়ে নিল। তারপর অস্ত্রাগারের তালা খুলতে গেল। ফ্রান্সিস আর বিনেলো খোলা তরোয়াল হাতে প্রহরী দু’জনের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

শাঙ্কো তালা খুলে ফেলল। বন্ধুরা দ্রুত ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। স্তূপ করে রাখা তরোয়াল বর্শার থেকে তরোয়াল-বর্শা তুলে নিল। তারপর বাইরে চলে এল।

ফ্রান্সিস প্রহরী দুজনকে বলল–অস্ত্রঘরে ঢোকো। প্রহরী দুজনকে অস্ত্রঘরে ঢোকানো হল। শাঙ্কো তালা লাগিয়ে দিল।

এবার ফ্রান্সিস বলল–সৈন্যবাসে চলো। লাথি মেরে দরজা ভেঙে ঢোকো। সৈন্যদের হাতে অস্ত্র নেই। সবকটাকে বুন্দী কর। কেউ যেন পালাতে না পারে।

সবাই দ্রুত সৈন্যবাসের দিকে ছুটল। বারান্দা পার হয়ে ঘরগুলোর দরজায় লাথি মারতে লাগল। দরজা ভেঙে যেতে লাগল। ঘুমন্ত সৈন্যরা উঠে দেখল উদ্যত তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে সব সৈন্যকে সামনের মাঠে নিয়ে আসা হল। মাঠে বসিয়ে দেওয়া হল।

শাঙ্কো ততক্ষণে সৈন্যবাস থেকে লম্বা দড়ি নিয়ে এল। ছোরা দিয়ে দড়ি টুকরো টুকরো কাটল। সৈন্যদের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দেওয়া হল।

তখন ভোর হয়ে গেছে। সকালের রোদ পড়েছে বনভূমিতে, রাজবাড়িতে মাঠে।

রাজা পাকোর্দো ফ্রান্সিসের কাছে এলেন। বললেন–এদের বন্দী করলে। কিন্তু আমাদের বিপদ এখনও কাটে নি।

–তা ঠিক। ওরা আমাদের আক্রমণ করবেই। তবে সংখ্যায় ওরা বেশি হবে না। ফ্রান্সিস বলল।

একটু বেলা হল।

ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ডেকে বলল–রাজবাড়িতে যাও? রাঁধুনিদের বলো সবাইকে সকালের খাবার দিতে। গতরাতে তো আমরা আধ পেটাও খাইনি।

শাঙ্কো রাজবাড়ির দিকে চলে গেল। রাঁধুনীকে বলে এল।

কিছুক্ষণ পরে রাঁধুনিরা আর দু’তিনজনকে নিয়ে এল। সবার হাতে কাঠের হাঁড়ি কাঠের থালায় রুটি। বন্দী সৈন্যদের সঙ্গে ফ্রান্সিসরাও খেতে বসে পড়ল। ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা গোগ্রাসে খেতে লাগল। রাজা পাকোর্দো অবশ্য ফ্রান্সিসদের সঙ্গে খেলেন না। উনি রাজবাড়িতে চলে গেলেন।

সকালের সবজির ঝোল রুটি খাওয়া শেষ হল।

হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–ফ্রান্সিস আমাদের কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকলে চলবেনা।

–সেটা ভেবেছি। রাজা আনোতারের সঙ্গেও কিছু সৈন্য রয়েছে। তারা নিশ্চয়ই এখানে আসবে। তাদের সঙ্গে শেষ লড়াইটা তে লড়তে হবে। এখন অপেক্ষা কখন ওরা আক্রমণ করে।

ফ্রান্সিস এবার গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–শেষ লড়াইটা এখনও বাকি। রাজা আনোতারের বাকি সৈন্যরা আমাদের নিশ্চয়ই আক্রমণ করবে। সবাই তৈরি থেকো। কেউ তরোয়াল বর্শা হাত ছাড়া করবে না। আক্রান্ত হলে যাতে সঙ্গে সঙ্গে রুখে দাঁড়াতে পারো।

সবাই বুঝল বিপদ এখনও কাটেনি। লড়াই এখনও শেষ হয়নি।

বন্ধুরা কয়েকজন বন্দীদের পাহারায় রইল। বাকিরা সৈন্যাবাসের খালি ঘরগুলোয় গিয়ে বসে রইল। সবাইবিশ্রাম করতে লাগল। বন্দীরা আশায় রইলওদের রাজা আনোতার নিশ্চয়ই ওদের সাহায্য করতে সৈন্য নিয়ে আসবে। সময় বয়ে যেতে লাগল।

তখন সবে দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে। বনের দিকে হৈহল্লা শোনা গেল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–তৈরি হও। রাজা আনোতার সৈন্যদের নিয়ে আসছে।

একটু পরেই বনের আড়াল থেকে রাজা আনোতার বেরিয়ে এল। হাতে খোলা তরোয়াল। পেছনে কুড়ি পঁচিশ জন যোদ্ধা। সবার হাতেই খোলা তরোয়াল। রাজা মাঠের দিকে তাকিয়ে তার বন্দী যোদ্ধাদ্রের দেখে থমকেদাঁড়াল। রাজা ধরে নিয়েছিল এখানকার যোদ্ধাদের সাহায্য পাবে। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হল। রাজা আনোতার ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে। সে তার সৈন্যদের থামতে ইঙ্গিত করল।

ফ্রান্সিস রাজা আনোতারের দিকে এগিয়ে গেল। গলা চড়িয়ে বলল–দেখতেই পাচ্ছেন আমরা বন্দী নই। হাতে অস্ত্রও আছে। লড়াই হলে আপনারা পরাজিত হবেন। ভেবে দেখুন কী করবেন। বন্দীদশা মেনে নেবেন না লড়াই করবেন?

লড়াই করে তোমাদের এদেশ থেকে তাড়াবো। রাজা আনোতার যেন গর্জে উঠল।

–ঠিক আছে। লড়াইটা হোক। ফ্রান্সিস তরোয়াল উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল ভাইসব আক্রমণ করো। ভাইকিং বন্ধুরা আর দেহরক্ষীরা তরোয়াল বর্শা হাতে ছুটে গিয়ে রাজা আনোতারের সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাঠের ধারে শুরু হল লড়াই। তরোয়াল বর্শার ঠোকাঠুকিরশব্দআর্তস্বর চিৎকার গোঙানিরশব্দ উঠল। ফ্রান্সিস বিপক্ষের কয়েকজন যোদ্ধাকে আহত করে রাজা আনোতারের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজা আনোতার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর ফ্রান্সিসকে আক্রমণ করল। ফ্রান্সিস এদিক ওদিক সরে গিয়ে রাজাকে ক্লান্ত করতে লাগল। রাজা ফ্রান্সিসের ফন্দী ঠিক বুঝতে পারল না। ঘুরে ঘুরে তরোয়াল চালাতে লাগল। একসময়ে তারোয়াল মাটিতে ঠেকিয়ে হাঁফাতে লাগল। ফ্রান্সিস তেমন ক্লান্ত হয়নি। ও এই সুযোগ ছাড়ল না। দ্রুত পাক খেয়ে রাজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজা ফ্রান্সিসের তরোয়ালের মার ঠেকাতে ঠেকাতে পিছু হটতে লাগল। রাজা আনোতার মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে। ফ্রান্সিস দু-তিন বার দ্রুত তরোয়াল চালিয়ে রাজার বুকেরওপর দিয়ে তরোয়াল সজোরে টেনে নিলে। রাজারবুকেরকাছে পোশাক দু ফালি হয়ে গেল। কাটা জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিসও হাঁপাচ্ছে তখন। রাজা। ফ্রান্সিসেরনিপুণ হাতে তরোয়াল চালানো দেখে বুঝল এবার এরহাত থেকেরক্ষা নেই। ফ্রান্সিস হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–আপনার সৈন্যদের লড়াই থামাতে বলুন। অযথা প্রাণহানি আমরা চাইনা। এর পরেও লড়াই চালালে আপনারা কেউ বেঁচে থাকবেন না।

রাজাকে এভাবে আহত হতে দেখে তার সৈন্যরা লড়াইয়ের উদ্যম হারিয়ে ফেলল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ভাইকিংদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তাদের অনেকেই মারা গেছে নয়তো মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ওরা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–ভাইসব আর হত্যা নয়। লড়াই বন্ধ কর। ভাইকিংরা লড়াই থামিয়ে একই দূরে সরে গেল। কিন্তু তরোয়াল নামাল না কেউ। দেখতে লাগল রাজা আনোতার কী করে।

রাজা আনোতার হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। তার পোশাক রক্তে ভিজে উঠেছে। যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে উঠছে। ডান হাত তুলে কাতরস্বরে বলে উঠল-লড়াই নয়। রাজার সৈন্যরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–তোমরা অস্ত্র ত্যাগ কর। আপত্তি করলে মরতে হবে।

রাজা আনোতারের সৈন্যরা তরোয়াল মাটিতে ফেলে দিল। শাঙ্কো আর সিনাত্রা এগিয়ে গিয়ে তরোয়ালগুলো তুলে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস উচ্চস্বরে বলল–সবার হাত বেঁধে দাও। বিনেলা ছুটে গিয়ে দড়ি নিয়ে এল। দড়ি টুকরো করে রাজা আনোতারের সব সৈন্যের হাত বেঁধে দেওয়া হল। তারপর আগের বন্দীদের সঙ্গে বসিয়ে রাখা হল। রাজা আনোতারের হাত বাঁধতে গেলে ফ্রান্সিস হাত নেড়ে মানা করল।

তখনই দেখা গেল রাজা পাৰ্বর্দো এইদিকেআসছেন। উনিফ্রান্সিসেরকাছেএলেন। বললেন– তোমার জন্যেই আমি মহাবিপদ থেকেজ্জার পেলাম। তোমার কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম।

–রাজা আনোতার তার সৈন্যসহ পরাজয় স্বীকার করেছে। আমরাও ওদের বন্দী করে রেখেছি। এবার আপনি এদের নিয়ে যা করবার করুন। আমি বলি রাজা আনোতারসহ সব সৈন্যকে এদেশ থেকে তাড়ান। এই দেশেরও রাজা হোন আপনি। ফ্রান্সিস বলল।

–না। তা হয় না। এই দেশ রাজা আনোতারেরই থাক। সবাইকে মুক্ত করে দাও। আমি আমার দেশে চলে যাবো। রাজা পাতার্দো বললেন।

–বেশ। আপনি যা চান। আমি রাজা আনোতারের সঙ্গে কথা বলছি। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস রাজা আনোতারের কাছে এল। বলল

–রাজা পাকোর্দো চান আপনার রাজত্ব আপনারই থাকুক। উনি নিজের রাজ্যে চলে যাবেন। আমরাও আমাদের জাহাজে ফিরে যাবো। কিন্তু আপনাদের মুক্তি দেবার একটা শর্ত আপনাকে মানতে হবে।

–কী শর্ত? রাজা আনোতার বলল।

আপনি ভবিষ্যতে কক্ষণো রাজা পাকোর্দোর রাজত্ব আর আক্রমণ করবেন না। ফ্রান্সিস বলল।

–ভবিষ্যতের কথা কী করে বলি। রাজা আনোতার বলল।

–তাহলে আপনাদের সবাইকে কয়েক ঘরে বন্দী করে আমরা কয়েদঘরের দরজা পাথর চাপা দিয়ে বন্ধ করে চলে যাবো। অনাহারে তৃষ্ণায় কয়েকদিনের মধ্যেই আপনারা সবাই মারা যাবেন। ভেবে দেখুন–শর্ত মানবেন না অবধারিত মৃত্যু মেনে নেবেন? ফ্রান্সিস বলল।

রাজা আনোতার একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল–ঠিক আছে। তোমার শর্তই মেনে নিলাম।

এবার বৈদ্যকে ডেকে চিকিৎসা করান। ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল। রাজা একবার ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাল। কিছু বলল না।

ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ডাকল। শাঙ্কো কাছে এলে বললসবাইকে মুক্ত করে দাও। রাজা আনোয়ারের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।

শাঙ্কো আর বিনেলা গিয়ে বন্দীদের হাতে বাঁধা দড়ি কেটে দিতে লাগল। বন্দীরা মুক্ত হয়ে সৈন্যাবাসে চলে গেল।

ফ্রান্সিস রাজা পাকোর্দোর কাছে এল। বলল–এখন কী করবেন?

আমি আমার রাজত্বে ফিরে যাবো। এখানে একমুহূর্তও থাকবোনা। রাজা বললেন।

–বেশ। আমরাও আপনার সঙ্গে ফিরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–কেউ অস্ত্র ত্যাগ করবেনা। অস্ত্র হাতেই ফিরবো আমরা। সবাই তৈরি হও।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই রাজা পাকোর্দোর কাছে এসে দাঁড়াল। রাজা পাকোর্দোবনভূমির দিকে চললেন। পেছনে তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসরা।

বনে ঢুকল সবাই। বিকেল হয়ে এসেছে। বনতল বেশ অন্ধকার। গাছগাছালির নিচে দিয়ে বোনঝাড় পার হয়ে সবাই পাহাড়টার দিকে চলল।

পাহাড়ের নিচে এল সবাই। তারপর চড়াই বেয়ে পাহাড়ের ওপর উঠে এল। পাহাড় থেকে একে একে নেমে আবার বনভূমিতে ঢুকল। বনভূমি পারহয়ে যখন রাজার পাকোর্দোর রাজবাড়ির সামনে এল তখন বেশ রাত। রাজা পাকোর্দো রাজবাড়িতে ঢুকলেন। তার দেহরক্ষীরাও তার সঙ্গে গেল।

রাতের খাবার খাওয়া হয়নি। সবাই ক্ষুধার্ত।

শাঙ্কো রাজবাড়িতে ঢুকে রান্নাঘরে গেল। রাঁধুনিরা তখনও মেঝেয় বিছানা পেতে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। শাঙ্কো ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তাদের ঘুম ভাঙল। বলল–রাজার সঙ্গে আমরা ফিরে এসেছি। এখনও রাতের খাওয়া জোটেনি। শিগগির যা পারো বেঁধে দাও। অগত্যা ঘুম ভেঙে রাঁধুনিদের উঠতে হল। ওরা রান্না চাপাল।

ফ্রান্সিসরা সৈন্যাবাসের ঘরে গিয়ে ঢুকল। সবাই বেশ ক্লান্ত। শুয়ে পড়ল কেউ কেউ। বাকিরা বসে। কখন রান্না হয়।

তখনই মারিয়া ছুটতে ছুটতে এল। ফ্রান্সিসদের কাছে এল। ফ্রান্সিসকে বলল–তোমাদের কোন ক্ষতি হয়নি তো?

–না-না। শুধু দুজন বন্ধু আহত হয়েছে। আজ তো রাত হয়ে গেছে। কালকে বৈদ্য ডেকে চিকিৎসা করাব।

–তাহলে কাল খাওয়াদাওয়া সেরে চলো জাহাজে ফিরে যাই। মারিয়া বলল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–অত তাড়া কীসের? দু’একটা দিন থাকি না।

তার মানে কোন গুপ্তধনের খোঁজ করবে। মারিয়া বলল।

হা। ঠিক ধরেছো। একটু ধৈর্য ধরো। আর কটা দিন। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–গুপ্তধনের ভূত যখন তোমার মাথায় ঢুকেছে তখন তোমাকে আটকাবে কে। মারিয়া বলল।

রাজবাড়িতে তো আরামেই আছো। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–তা আছি। তবু দেশে ফিরে যাওয়া–মারিয়া আর কিছু বলল না।

–ঠিক আছে। মাত্র তো কয়েকটা দিন। ফ্রান্সিস বলল।

–আমিও তোমার সঙ্গে গুপ্তধন খুঁজতে যাবো। মারিয়া বলল।

–বেশ। যেও। রাতের খাবার খেয়েছো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–হা হা। মারিয়া বলল।

–তাহলে এখন ঘুমুতে যাও। কাল সকালে এসো। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ। মারিয়া উঠে দাঁড়াল। তারপর রাজবাড়িতে ফিরে গেল।

কিছুক্ষণ পরে রাঁধুনিরা খাবর টাবার নিয়ে এলো। ফ্রান্সিসরা পাতা পেতে খেতে বসল। গরম গরম মাংসের ঝোল রুটি। ক্ষুধার্ত সবাই খেতে লাগল। খেতে খেতে হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস তাহলে দিন কয়েক এখানে থাকবে?

–হ্যাঁ। শুনেছো তো–এখানকার মন্ত্রীমশাই কিছু ধনসম্পদ গোপনে কোথাও রেখে গেছেন। সেসব উদ্ধার করবো।

–কিছু সূত্র পেলে? হ্যারি প্রশ্ন করল।

–এখনও তেমন দরকারি সূত্র কিছু পাইনি। কালকে সকাল থেকে লাগতে হবে। এখন বিন্তানোকে চাই। ফ্রান্সিস বলল।

–ঐ তো চিন্তানো আমাদের সঙ্গেই খাচ্ছে। হ্যারি বিন্যানোকে দেখিয়ে বলল। ফ্রান্সিস বিন্তানের দিকে তাকিয়ে বলল–বিন্তানো খাওয়া সেরে একবার আমার কাছে এসো। খেতে খেতে বিন্তানো মাথা কাত করল।

খাওয়া শেষ করে বিন্তানো ফ্রান্সিসের কাছে এল।

–কী ব্যাপার বলো তো? ও জানতে চাইল।

–তোমাদের মন্ত্রীমশাই এক ধনভাণ্ডার এই রাজ্যেই কোথাও গোপনে রেখে গেছেন যার খোঁজ রাজা পাকোর্দো বা রানি কেউ রাখেন না। হ্যারি বললো।

–হ্যাঁ। তবে রাজা পাকোর্দো সেই ধনভাণ্ডার খোঁজার কোন চেষ্টাই করেননি। এই রাজা পাকোর্দো এক অদ্ভুত ধরনের মানুষ। বিন্তানো বলল।

যাক গে। আমি সেই ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করবো। ফ্রান্সিস বলল।

–রাজা আনোতারও অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোন হদিশই করতে পারেনি। বিন্তানো বলল।

–রাজা আনোতার মাথা মোটা লোক। ওর বুদ্ধিতে কুলোয় নি। ফ্রান্সিস বলল। –তুমি পারবে? বিন্তানো বলল।

–চেষ্টা তো করি। যাকগে তুমি রাজা পাকোর্দোর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসো– আমরা রাজবাড়িরসব জায়গা খুঁজবো।

–বেশ। আমি রাজার অনুমতি নিতে যাচ্ছি। বিন্তানো বলল।

বিন্তানো চলে গেল। তখনই।

পরদিন সকালে মারিয়া এল। বলল–সকালে গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজতে বেরুবে। বলেছিলে।

–হ্যাঁ যাবো। আমরা রাজবাড়ীর অন্দরমহলে যাবো। বিন্তানো রাজার অনুমতি নিয়ে এসেছে।

মারিয়া আর হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস চলল। যেতে যেতে মারিয়াকে বলল–রানি আর অন্দরমহলের স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে জানবে অন্দরমহলের কোথাও গুপ্ত গর্ভঘর আছে কিনা। অথবা অব্যবহার্য কোন ঘরটর আছে কিনা।

–আচ্ছা। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল।

ফ্রান্সিস! ডাক শুনে ফ্রান্সিস পিছু ফিরে তাকাল। দেখল বিন্তানো আসছে। বিন্তানো এগিয়ে এসে বলল–আমি তোমাদের সঙ্গে গেলে সব দেখতে টেখতে তোমাদেরসুবিধে হবে।

–বেশ। চলো। ফ্রান্সিস বলল।

রাজবাড়িতে ঢুকল সবাই। অন্দরমহলের দরজায় দাঁড়ানো প্রহরীকে হ্যারি বলল রানিমাকে খবর দাও–আমরা বিদেশিরা এসেছি। প্রহরী চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে বলল–আপনারা আসুন।

ফ্রান্সিসরা অন্দরমহলে ঢুকল। খুব দামি আসবাবে অন্দরমহল সজ্জিত নয়। তবে যা কিছু আছে সেসব খুব সাজানো গোছানো। সুন্দর রুচির পরিচায়ক। শয়ন কক্ষগুলো দাসীদের ঘর ছক্কাপাঞ্জা খেলার ঘর–সব দেখল ফ্রান্সিসরা। ফ্রান্সিস বিশেষ করে পাথরের পাটা দিয়ে তৈরি দেয়ালগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। তখনই দেখল রাজার শয়নকক্ষের দেয়ালের একটা জায়গায় পরপর তিনটে পেরেক পোঁতা। পেরেকগুলোর নিচে আবছা চৌকোনো দাগ। ফ্রান্সিস বুঝল এখানে কিছুটাঙানো ছিল। এখন নেই।

জায়গাটা ভালো করে দেখতে দেখতে ফ্রান্সিস বলল

–বিন্তানো–এখানে এই তিনটে জায়গায় নিশ্চয়ই কিছু ছিল। –

-ঠিকই ধরেছে। এখানে তিনটে ছবি টাঙানো ছিল। বিন্তানো বলল।

কী ছবি? ফ্রান্সিস প্রশ্ন করল।

–মন্ত্রীমশাইয়ের আঁকা তিনটে ছবি। বিন্তানো বলল।

কী আঁকা ছিল সেই ছবিগুলোয়? ফ্রান্সিস বলল।

–মন্ত্রীমশাই যেমন আঁকতেন। বন-জঙ্গল, পাহাড় ঝর্ণা–এসব। বিন্তানো বলল।

–সেই ছবিগুলো এখন কোথায়? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

-সব ছবি মালখানা ঘরে। আগের রাজা আনোতার সব ছবি বস্তাবন্দী করে মালখানা ঘরে রেখে দিয়েছে। বিন্তানো বলল।

–সেই মালখানা ঘর কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।

–ডানদিকে। শেষ ঘরটা। বিন্তানো বলল।

–চলো। ঐ ঘরটা দেখবো। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে মশাল লাগবে। ঘুপচি ঘর। আমি প্রহরীদের কাছ থেকে মশাল জ্বালিয়ে আনছি। বিন্তানো বলল।

–তাই আনো। ফ্রান্সিস বলল। বিন্তানো মশাল আনতে চলে গেল। একটু পরেই। দুটো জ্বলন্ত মশাল নিয়ে এল। ফ্রান্সিসকে একটা মশাল দিল।

সবাই ডানদিকে চলল। বেশ কিছুটা যেতে দেখা গেল ডানদিকে একটা ঘর। বেশ বড় ঘর। পাথরের দরজা ভেজানো। ফ্রান্সিস ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলল। ভেতরে ঢুকল সবাই। বাইরে থেকে ঘরটা যতটা বড় মনে হয়েছিল ভেতরে ঢুকে দেখা গেল ঘরটা তার চেয়েও বড়। মশালের আলোয় দেখা গেল ভাঙা আসবাবপত্র ভাঙা তরোয়াল বর্শা মাকড়শার জাল। একটা নাক চাপা গন্ধ। একপাশে দেখা গেল কাপড়ের বস্তা রাখা। বিন্তানো বলল–এই বস্তাগুলোয় বোধহয় ছবিগুলো রাখা হয়েছে।

ফ্রান্সিস হাতেধরা মশালটা হ্যারির হাতে দিয়ে বলল–বস্তার কাছে মশালটা ধরো। ফ্রান্সিস বস্তাগুলোর কাছে এল। মশালের আলোয় দেখল বস্তুগুলোর মুখ বাঁধা নেই। ফ্রান্সিস টেনে টেনে ছবিগুলো বের করতে লাগল। গুণে দেখল ছটা ছবি আছে। ফ্রান্সিস বলল–বিন্তানো মন্ত্রীমশাইর সব ছবিই কি এখানে আছে?

হ্যাঁ। এই রাজবাড়িতে ছিল তিনটে ছবি। বাকি তিনটে ছিল মন্ত্রীমশাইর বাড়িতে। একটা ছবিই তিনি বেশিদিন ধরে আঁকতেন। তাই ছবির সংখ্যা বেশি নয়। বিন্তানো বলল।

এবার ফ্রান্সিস একটা ছবি বের করল। চামড়া মেশানো কাগজের ওপর ছবিগুলো আঁকা। চারপাশ কাঠের টুকরো দিয়ে বাঁধানো। ফ্রান্সিস ছবিটা ভালোভাবে দেখল। সত্যিই .. গাছ লতাপাতা ফুল আর পাহাড় আঁকা। ফ্রান্সিস সব ছবিগুলোই একে একে দেখল। একটা ছবিতে ঝর্ণা আঁকা আছে। দুটো ছবিতে বনের মাথায় পাখি উড়ছে এরকম আছে। ফ্রান্সিস ছবিগুলো আবার দেখল। নিসর্গ চিত্র। এর মধ্যে কোন সূত্র পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। মনের আনন্দে আঁকা এক শিল্পীর ছবি।

সবাই ছবিগুলো দেখল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে বলল–মারিয়া তুমি তো ছবি বোঝ। তোমার কাছে কেমন লাগছে ছবিগুলো।

–বেশ উঁচু মানের ছবি। মন্ত্রীমশাই নিঃসন্দেহে একজন যথার্থ শিল্পী ছিলেন। ছবিগুলোতে খুব বেশি রঙ ব্যবহার করা হয়নি। শুধু সবুজ নীল আর লাল। পাহাড়ের মাথায় সূর্যাস্তর লাল সূর্য আর মেঘ আঁকা হয়েছে। অন্য কোন ছবিতে লাল রঙ ব্যবহার করা হয় নি। কিন্তু আমি বলছি এই রঙগুলো উনি পেলেন কোথায়?

বিন্তানো বলল–গাছ-গাছালির রস সবুজ পাথর ফলের রস এসব থেকেই উনি রঙ তৈরি করে নিতেন। এই কাজে কখনো সখনো মন্ত্রী মশাইকে আমিও সাহায্য করেছি।

–হুঁ–ফ্রান্সিস বলল–ছবিগুলো নিয়ে চলো। পরে ভালোভাবে দেখতে হবে।

সবাই মালখানা ঘর থেকে ছবিগুলো নিয়ে বেরিয়ে এল। মশাল নিভিয়ে ফেলা হল।

বেরিয়ে আসার আগে ফ্রান্সিস রাজার শয়নকক্ষে ঢুকল। দেখল রাজা একটা চামড়া এ মেশানো লম্বা কাগজ পড়ছেন। ফ্রান্সিস বলল–ভেতরে আসবো? রাজা কাগজ রেখে উঠে বসলেন। বললেন–এসো এসো। ফ্রান্সিস রাজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল–মাননীয় রাজা-আপনার এই ঘরের দেয়ালে তিনটে চতুষ্কোণ ছাপ দেখলাম। কী ছিল ঐ তিনটে জায়গায়?

–মন্ত্রীমশাইয়ের আঁকা তিনটে ছবি পেরেকে ঝোলানো ছিল। অনেকদিন ছিল। তাই পাথরের দেয়ালে ছাপমত পড়ে গেছে। রাজা বললেন।

–আমরা মালখানাঘর থেকে বস্তাবন্দী করে রাখা ছবিগুলোনিয়ে এসেছি। অনুরোধ কোন তিনটে ছবি টাঙানো ছিল যদি দয়া করে দেখিয়ে দেন। কথাটা বলে ফ্রান্সিস ছবিগুলো তুলে তুলে রাজাকে দেখাতে লাগল। রাজা তিনটে ছবি দেখালেন।

–ঠিক এই তিনটে ছবিই? ফ্রান্সিস প্রশ্ন করল।

–হা হা। তিনরাত তো ছবিগুলো দেখতাম। ভুল হবে কী করে। রাজা বললেন।

ফ্রান্সিস বিন্তানোকে বলল–ছবি তিনটে যেখানে ঝোলানো ছিল সেভাবে ঝুলিয়ে দাও। বিন্তানো ছবি তিনটে নিয়ে পেরেকে ঝুলিয়ে দিল। ফ্রান্সিস দেখল একটা ছবিতে শুধু গাছপালা ফুল। অন্যটায় একটা ঝর্ণাআঁকা চারপাশে গাছপালা ফুল। অন্যটায় পাহাড়ের পেছনে লাল সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গাছপালা ফুল।

–তাহলে বাকি ছবিগুলো মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়িতে ছিল। তাই না বিন্তানো?

-হ্যাঁ। মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়িতে ঐ তিনটে ছবি আমি দেখেছি অনেকদিন। ফ্রান্সিস মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগল। ছবিগুলোর রঙ খুব উজ্জ্বল নয়। কিন্তু মঙগুলো বেশ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। রঙগুলো অনুজ্জ্বল হওয়ায় কেমন যেন স্বপ্নে দেখা গাছ লতাপাতা ফুল পাহাড় মনে হচ্ছে।

–ম্যান্যবর রাজা–আমরা তাহলে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।

–এসো। রাজা বললেন। তারপর কাগজটা পড়তে লাগলেন।

ফ্রান্সিরা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। সৈন্যাবাসের দিকে আসতে আসতে হ্যারি বলল–এবার কী করবে?

–দুপুরে খেয়েদেয়ে বনভূমি পাহাড়ের দিকে যাবো। মন্ত্রীমশাই কোন কোন জায়গার ছবি এঁকেছিলেন সেটা মেলাবো। ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে বনপাহাড় এলাকায় যাবে? বিন্তানো জানতে চাইল।

-হ্যাঁ। তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে। ছবির সঙ্গে ঐ এলাকা মেলাবো। তুমি সঙ্গে থাকলে সুবিধে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–আমিও যাবো। মারিয়া বলল।

–নিশ্চয়ই যাবে। ফ্রান্সিস বলল।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারল ফ্রান্সিসরা বিন্তানো আর মারিয়া এল। ফ্রান্সিসরা চলল বনভূমি আর পাহাড়ের দিকে।

বনের মধ্যে ঢুকল সবাই। বনতলে অন্ধকার। গাছের গুঁড়ি এড়িয়ে ঝোঁপ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলল সবাই।

একটা অল্প ফাঁকা জায়গায় এল সবাই। সামনের দিকে তাকিয়ে বিন্তানো বলল– এখানে বসে মন্ত্রীমশাই ছবি এঁকেছিলেন। ফ্রান্সিস ভালো করে তাকিয়ে দেখল সমানে গাছগাছালি লতাপাতা। গাছে গাছে জড়ানোলতাগাছগুলোয় সুন্দর ঘন নীল রঙের ফুল ফুটে আছে। ফ্রান্সিস চিন্তা করে দেখল এমনি গাছলতার ফুল মন্ত্রীমশাই এঁকেছেন। বিন্তানো এগিয়ে চলল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। একটা খাদের কাছে এল। খাদের ধারে এসে বিন্তানো বলল–এখানে বসেও মন্ত্রীমশাইছবি এঁকেছেন। ফ্রান্সিস সামনের দিকে বেশ মনোযোগের সঙ্গে তাকাল। দেখল গাছগাছালির পেছনে পাহাড়ের মাথাটা দেখা যাচ্ছে। গাছগুলো হলুদ ফুলে ফুলে ছাওয়া। ফ্রান্সিস চিন্তা করল মন্ত্রীমশাইয়ের একটা ছবির কথা। বুঝল এমনি দৃশ্যই দেখেছে একটা ছবিতে।

আবার চলল সবাই। তখনই জলে ছড়িয়ে পড়ার মৃদুশব্দ শুনল। বেশ কিছুটা এগোতেই দেখল একটা ঝর্ণ। কালচে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ঝর্ণার জল গড়িয়ে নামছে। এখন জলের শব্দ স্পষ্ট। ঝর্ণার দু’ধারে ফার্ন গাছের ঝোঁপ। ফ্রান্সিসের মনে পড়ল ঝর্ণা আঁকা ছবিটা। এখানেও বড়বড় গাছ রয়েছে। তবে ফুল নেই কোথাও। দূরে পাহাড়ের মাথাটা অনেক বড় দেখাচ্ছে। পাহাড়ের মাথার দিকে সূর্য। সূর্য অস্তগামী। এই ছবিটাও ফ্রান্সিসের মনে পড়ল।

বন শেষ। তারপরেই কালচে পাথরের পাহাড় শুরু। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল– এদিকে আর গাছগাছালি নেই।

–ঠিকই ধরেছো-বিন্তানো হেসে বলল–শুধু পাহাড় মন্ত্রীমশাই কখনও আঁকেন নি। শুধু গাছপালা ঝর্না ফুল এসব এঁকেছেন। তবে পাহাড়ের দিকে বসে এদিকে তাকিয়ে বনের ছবিও এঁকেছিলেন।

চলো। দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিসরা বিন্তানোর পেছনে পেছনে চলল। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বিন্তানো চলল। একজায়গায় এসেওপরের দিকে উঠতে লাগল কিছুটা উঠতেই দেখা গেল পাথরের একটা বড় চাই। অঙ্ক আঙ্গুল দিয়ে চাইটা দেখিয়ে বিন্তানো বলল–ঐ চাইটার ওপর উঠতে হবে।

–হ্যারি–তোমরা থাকো। আমি উঠছি। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিস পাথরের চাইয়ের খাঁজ ধরে ধরে উঠতে লাগল। বিন্তানো কিন্তু উঠল না। এটা দেখে মারিয়া বলল–তুমি উঠলে না?

আগে তো উঠেছি। তাই আর উঠলাম না। বিন্তানো বলল। কিন্তু মারিয়া অত সহজভাবে ব্যাপারটা নিল না। ও দুশ্চিন্তায় পড়ল। ততক্ষণে ফ্রান্সিস পাথরের চাইটার ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে। মারিয়া চিৎকার করে ফ্রান্সিসকে সাবধান করতে গেল। তখনই পাথরের চাইটা জোরে নড়ে গেল। ফ্রান্সিস টাল সামলাতে পারল না। পা হড়কে চাইটার পেছনে পড়ে গেল। সেইসঙ্গে কিছু পাথরের টুকরো ধুলো ঝুরঝুরু করে পড়ল। একটু পরেই মারিয়া চিৎকার করে ডাকল ফ্রান্সিস। তারপর ঐ চাইটার পেছন দিকে ছুটল। কিন্তু দ্রুত যাবে কী করে? ছোট ছোট পাথরের চাই ছড়ানো। তার মধ্যে দিয়েই মারিয়া টাল সামলে নিল। হ্যারি সম্বিত ফিরে পেল। সেও চলল ওদিকে। শুধু বিন্তানো দাঁড়িয়ে রইল। পাথরের ছোট ছোট চাইয়ের ওপর পা রেখে রেখে টাল সামলাতে সামলাতে বেশ কিছুক্ষণ পরে দুজনে ওপারে পৌঁছল। দেখল একটা বুনো জংলা গাছের ঝোঁপের ওপর ফ্রান্সিস কাত হয়ে পড়ে আছে। কাছে এসে দেখল ফ্রান্সিসের কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে। ফ্রান্সিস চোখ বুজে পড়ে আছে।

মারিয়া কেঁদে ফেলল। ছুটে গিয়ে ফ্রান্সিসের মাথা কোলে তুলে নিয়ে বসে পড়ল। ভীতস্বরে ডাকল–ফ্রান্সিস–ফ্রান্সিস–হ্যারিও ততক্ষণে এসে পড়েছে। ফ্রান্সিস চোখ মেলে তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসল।

-খুব লেগেছে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

–মাথাটা–ঘুরছে। ম্লান হেসে ফ্রান্সিস বলল।

মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে ওর পোশাকের নিচে লম্বালম্বি ছিঁড়ে ফেলল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের মাথায় বাঁধতে লাগল। ফ্রান্সিস চোখমুখ কুঁচকে বলল লাগছে। এবার মারিয়া সাবধানে বাঁধতে লাগল। বাঁধা শেষ হল। ফ্রান্সিসের বোধহয় একটু কষ্ট কমল। ও আস্তে আস্তে উঠতে গেল।

–এখন উঠো না। একটু শুয়ে থাকো হ্যারি বলল।

–ঝোঁপটা থাকায়–চোটটানইলে হাত পা ভাঙতো। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।

–ঠিক আছে। একটু বিশ্রাম নাও। হ্যারি বলল।

–না-না–গায়ে তেমন লাগেনি। ফ্রান্সিস বলল।

–তবু একটু পরে ওঠো। মারিয়া বলল।

–বেশ। ফ্রান্সিস শুয়ে রইল। একটু পরে বলল–বিন্তানো কোথায়?

–ও আসেনি। হ্যারি বলল।

–হুঁ। ফ্রান্সিস শুয়ে রইল। মারিয়া হ্যারি বসে রইল।

এবার ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তখনও ওর শরীরটা অল্প অল্প কাঁপছে। বলা যায় একেবারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচলোও। একেবারে মৃত্যু না হলেও হাত পা ভেঙে চিরদিনের জন্যে পঙ্গু হয়ে যেত।

মারিয়া তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–আমি সুস্থ। কেঁদো না। মারিয়া হাতের উল্টো পিঠে দু’চোখ মুছে বলল–হাঁটতে পারবে?

মনে হয়–পারবো। কথাটা বলে ফ্রান্সিস একবার টাল নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। হ্যারি ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরে চলল। হ্যারি শরীরের দিক থেকে বরাবরই দুর্বল। ও কি পারে ফ্রান্সিসের শরীরের ভার সামলাতে? তবু টান নিতে নিতে চলল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনজনে পাথরের চাইটার পেছন থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।

আশ্চর্য! বিন্তানো নেই। হ্যারি আশা করেছিল বিন্তানো এসে ফ্রান্সিসকে ধরলে ফ্যান্সিসকে বাকি পথটা সাবধানে নিয়ে যাওয়া যাবে। হ্যারি এদিক ওদিক তাকিয়ে বার বার ডাকতে লাগল–বিন্তানো-বিন্তানো। নাঃ। বিন্তানো এই তল্লাটেই নেই। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল

–এই সন্দেহ আমি আগেই করেছিলাম।

–কী সন্দেহ? তার মানে–মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ। বিন্তানো জানতো ঐ পাথরের ওপর দাঁড়ানো বিপজ্জনক। ফ্রান্সিস বলল।

–বিন্তানো সব জেনেশুনে–হ্যারিকথাটা শেষ করতে পারল না। ফ্রান্সিস বলল

–হ্যাঁ বিন্তানো মন্ত্রীমশাইয়ের ছবি সম্বন্ধে এমন কিছুজানে যা ও আর কাউকে জানাতে চায় না। আমার খোঁজখবরের নমুনা দেখেও বুঝতে পেরেছেআমি ঠিকপথে এগোচ্ছি। তাইও আমাকে মেরে ফেলতে বা আহত করতে চেয়েছিল যাতে আমি খোঁজাখুঁজি করতে না পারি।

-আশ্চর্য! আমরা এতটুকু বুঝতে পারি না। হ্যারি বলল–এরমধ্যে ওকে শাস্তি পেতে হবে।

–ঠিক আছে। যা করার ঠিক করবো। ফ্রান্সিস বলল।

ওরা বনে ঢুকল। গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে ফ্রান্সিস বনের মধ্যে দিয়ে চলল। হ্যারি বেশ কষ্ট করে ফ্রান্সিসকে ধরে ধরে নিয়ে চলল।

বনের বাইরে মাঠে এসে ওরা যখন পৌঁছলো তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে।

ওরা সৈন্যাবাসের ঘরে ঢুকতে বন্ধুরা প্রায় ছুটে এল। সবাই জানতে চায় ফ্রান্সিস কিভাবে আহত হল। হ্যারি আস্তে আস্তে সব বলতে লাগল। ফ্রান্সিস ততক্ষণে ঘাসপাতার বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

মারিয়া ভেনএর কাছে ছুটে এল। বলল–ফ্রান্সিস আহত। কপাল কেটে গেছে। একটা কিছু করুন।

কী করবো রাজকুমারী। আমার ওষুধ টষুধ সবই তো জাহাজে। আপাতত একটা কাজ করুন। শুনলাম তো পড়ে গিয়ে লেগেছে। এক কাজ করুন। গায়ে হাতে পায়ে। জলে ভেজা ন্যাকড়া বুলিয়ে দিন। কষ্ট অনেকটা কমবে।

–বেশ। তাই করছি। মারিয়া বলল।

–বলছিলাম–রাজা পাকোর্দোর সঙ্গে তো ফ্রান্সিসের সম্পর্ক খুব ভালো। রাজাকে বললে তার বৈদ্য এসে ওষুধ দিয়ে যেতে পারবে। হ্যারি বলল।

হ্যাঁ। এটা করা যায়। আমি নিজে রাজাকে বলতে যাবো। মারিয়া বলল।

মারিয়া ফ্রান্সিসের কাছে এল। নিজের পোশাকের ঝুল থেকে আরো কাপড় ছিঁড়ল। একটা কাঠের গ্লাসে জল নিয়ে এল। তারপর ন্যাকড়া ভিজিয়ে ফ্রান্সিসের সারা গায়ে আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়ে রইল।

এবার মারিয়া হ্যারিকে ডাকল। বলল হ্যারি-ফ্রান্সিসের গায়ে হাতে পায়ে জলে ভেজা ন্যাকড়াটা বুলিয়ে দাও। আমি বৈদ্য ডাকার ব্যবস্থা করছি।

–বেশ। আপনি যান। ফ্রান্সিস বলল।

মারিয়া রাজার সঙ্গে দেখা করতে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে রাজবৈদ্য এল। ফ্রান্সিসকে পরীক্ষা টরীক্ষা করে কপালে ওষুধ লাগাল। শরীরেও মাখবার ওষুধ দিয়ে গেল। ওষুধ পড়ায় ফ্রান্সিস একটু সুস্থবোধ করল। চুপ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি–বিন্তানোকে দেখেছো?

না। হ্যারি মাথা নেড়ে বলল।

–একটু রাজবাড়িতে যাও। ওকে খুঁজে বের কর। তারপর ধরে নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।

–ও যদি আসতে না চায়? হ্যারি বলল।

–জোর করে নিয়ে আসবে। ফ্রান্সিস বলল।

–ওসব জোরাজুরি–আমি পারবো না। বরং শাঙ্কো আর বিনেলো যাক।

-ঠিক আছে। তুমি ওদের দুজনকে ডাকো। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যারি দু’জনকে ডেকে নিয়ে এল। ওরা আসতে ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি বিন্তানোকে ধরে আনতে যাচ্ছে। যদি বিন্তানো আসতে না চায় শাঙ্কো তুমি ছোরা দেখিয়ে ওকে নিয়ে আসবে।

শাঙ্কো আর বিনেলোকে নিয়ে হ্যারি চলল রাজবাড়ির দিকে।

ওরা রাজবাড়ির রাজসভাঘর এঘর ওঘর খুঁজলো। কোথাও বিন্তানোকে পেল না। খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরের পাশের রসুইঘরে গেল। দেখল কাঠের লম্বা পাটাতনে বসে বিন্তানো খাবার খাচ্ছে। হ্যারি ওর সামনে এসে দাঁড়াল। খেতে খেতে বিন্তানো মুখ তুলে বলল–কী ব্যাপার?

–তোমাকেই খুঁজছিলাম। ফ্রান্সিস তোমাকে ডেকেছে। আমাদের সঙ্গে চলো। হ্যারি বলল।

–আমি কী করে যাবো? আমার অনেক কাজ। রাজা খবর পেয়েছিল। তার বেশ কিছু সৈন্য বনে পাহাড়ে আত্মগোপন করে আছে। তাদের আনতে যেতে হবে। রাজার হুমুক। বিন্তানো খেতে খেতে বলল।

তার আগে ফ্রান্সিসের কাছে চলো। হ্যারি বলল।

না না। রাজার হুকুম। বিন্তানো বলল।

হ্যারি ডাকল– শাঙ্কো। শাঙ্কো জামার তলায় হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা বের করল। ছোরাটা বিন্তানোর পিঠে চেপে ধরে শাঙ্কো বলল–তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতেই হবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। বিন্তানো এতটা ভাবেনি। ও বোকাটে মুখে শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে রইল। শাঙ্কো তাড়া লাগালজলদি খেয়ে নাও। বিন্তানো বুঝল এ বড় কঠিন ঠাই। ওকে মেরেই না ফেলে। ও হাপুস্ হুপুস করে খেয়ে নিল। হাতমুখ ধুয়ে বলল–বেশ চলো।

বিন্তানোকে নিয়ে ফিরে এসে ওরা দেখল ফ্রান্সিস শুয়ে আছে। ওদের দেখে ফ্রান্সিস উঠে বসল। বলল–বিন্তানো–দুর্ঘটনার পরে আমি বেঁচে আছি মরে গেছি–এসব না দেখেই পালিয়ে এলে কেন?

–ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। বিন্তানো বলল।

–যদি বলি তুমি ভালো করেই জানতে ঐ পাথরের চাইটা নড়বড়ে। যে কেউ ওটায় উঠলে টাল সামলাতে পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।

-না-না। আমি জানতাম না। বিন্তানো জোরে মাথা নেড়ে বলল।

–না বিন্তানো-তুমি জানতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মন্ত্রীমশাই নিশ্চয়ই তার গুপ্ত। ভাণ্ডারের কিছু হদিশ তোমাকে দিয়ে গেছেন। ফ্রান্সিস বলল।

-না-না। আমি কিছু জানি না। মন্ত্রীমশাই এই ব্যাপারে আমায় কিছু বলে যান নি। বিন্তানো একইভাবে বলল।

উঁহু। তুমি জানো ফ্রান্সিস বলল।

–বললাম তো–ফ্রান্সিস ওকে কথাটা শেষ করতে দিল না। বলে উঠল

কথা বাড়িও না। ঐ ছবিগুলো সম্বন্ধে মন্ত্রীমশাই নিশ্চয়ই তোমাকে কিছু বলে গেছেন।

–বলেছিলেন–তবে তেমন কিছু না।

–তেমন কিছু কিনা সেটা আমি বুঝবো। তুমি বলো–মন্ত্রীমশাই কী বলেছিলেন?

কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন–আমার আঁকা ছবিগুলো সাংকেতিক।

–সাংকেতিক–এই শব্দটাই বলেছিলেন?

–হ্যাঁ।

–কোন বিশেষ একটা ছবি না সব ছবি?

–তা তো বলতে পারবো না।

–কাজেই বোঝা যাচ্ছে–ছবিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমি আগেই ভেবেছিলাম। এবার নিশ্চিত হলাম। যাক গে বিন্তানো-জেনে রাখো তোমার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক শেষ। তোমাকে আমি আর বিশ্বাস করি না। একটা কথা–এই গুপ্ত ধনভাণ্ডার আমি উদ্ধার করবোই। রাজাকে বলে তোমাকে তার কিছু অংশ দিতাম। সেটা আর তোমার ভাগ্যে জুটল না। তুমি যাও। আর কক্ষণো আমাদের কাছে এসো না। বিন্তানো আর কোন কথা বলতে পারলো না। আস্তে আস্তে চলে গেল।

–ছবিগুলো আবার ভালো করে দেখতে হবে। মেলাতে হবে বাস্তব বনের দৃশ্যগুলোর সঙ্গে। সব রহস্যের সমাধান আছে ঐ ছবিগুলোরই মধ্যে। ফ্রান্সিস বলল।

–এতগুলো ছবির মধ্যে থেকে সূত্র পাবে কী করে? হ্যারি জানতে চাইল।

–সেটা ছবিগুলো বাছাই করে হিসেব করতে হবে। সেইজন্যেই ছবিগুলো ভালোভাবে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

পরের দিন সকালে ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল-চলো। রাজবাড়িতে যাবো। ছবিগুলো ওখানেই রাখা হয়েছে।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি রাজসভায় যখন পৌঁছল তখন রাজসভায় বিচার চলছে।

–একটু অপেক্ষা করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

বিচারের কাজ চলল। একসময় বিচার শেষ হল। রাজা পাকোর্দো ফ্রান্সিসকে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস এগিয়ে গিয়ে মাথা একটু নিচু করে সম্মান জানিয়ে বলল– মান্যবর রাজা–আমরা মন্ত্রীমশাইয়ের আঁকা ছবিগুলো আমাদের ঘরে নিয়ে যাবো। ছবিগুলো ভালো করে দেখতে চাই।

–বেশ তো। রাজা বললেন। তারপর একজন প্রহরীকেইশারায় ডাকলেন। ফ্রান্সিসকে বললেন–প্রহরী যাচ্ছে। ওই ছবিগুলো তোমাদের ঘরে পৌঁছে দেবে।

ফ্রান্সিস হ্যারি রাজবাড়ির বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে প্রহরী ছবিগুলো নিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা ওকে নিয়ে চলল।

ফ্রান্সিসদের ঘরে ছবিগুলো রেখে প্রহরী চলে গেল। ফ্রান্সিস ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল। তুমি তিনখানা ছবি নাও। হ্যারিকে বলল–তুমি একটা নাও। বাকি দুটো আমি নিচ্ছি। এবার চলো–বন পাহাড়ের দিকে।

ছবি নিয়ে বনভূমিতে ঢুকল তিনজনে।

আগের দিন দেখা জায়গাটায় এল। ফ্রান্সিস দৃশ্যটার সঙ্গে ছবিগুলো মেলাতে মেলাতে একটা ছবি মেলাল। হিসেব করে দেখল ছবিটা মন্ত্রীমশাইর বাড়িতে ছিল।

আবার চলল তিনজনে। গতকালের জায়গায় এল। ছবি মেলাল। মন্ত্রীর বাড়িতে রাখা ছবিটা মিলল।

এমনি করে ঝর্নার কাছে এল। ছবি মিলিয়ে দেখল দুটো ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এই দুটো ছবি রাজার শয়ন কক্ষের দেয়ালে টাঙানো ছিল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে–এই তিন নম্বর ছবিটা মিলল না। এটাও রাজার শয়নকক্ষেটাঙানো ছিল। ফ্রান্সিস ছবিটা। নিয়ে আরো বাঁদিকে সরে এল। আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য প্রায় মাথার ওপর। যদি সূর্যটাকে পাহাড়ের গায়ে নামিয়ে ভাবা যায় অর্থাৎ অস্ত যাচ্ছে এরকম ভাবা যায় তাহলে মিলে যাচ্ছে। তখনই ভালোভাবে মেলাতে গিয়ে দেখল পাহাড়ের নিচে একটা গুহামত। কিছু গাছ ডালপাতার আড়াল দেখা যাচ্ছে। খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু ছবিতে সেটা আঁকা নেই। ফ্রান্সিস একটু আশ্চর্যই হল। মন্ত্রীমশাই এত নিখুঁত গাছডালপালা পাহাড়ের অংশ নীল আকাশ পাখি এঁকেছেন অথচ ঐ অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে গুহামুখটা সেটাই আঁকেন নি। কী করে এই ভুলটা হল? তাহলে কি উনি গুহামুখটা দেখতে পাননি? অথবা ইচ্ছে করেই ওটা বাদ দিয়েছেন। বাদ দিয়ে থাকলে কেন বাদ দিয়েছেন? ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–পাহাড়ের গায়ে একটা অস্পষ্ট গুহামুখ। হ্যারি ভালো করে তাকাল। সত্যিই তো! একটা গুহামুখ। তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। হ্যারি বলল–হ্যাঁ। তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা।

–অথচ ছবিতে ঐ গুহামুখটা নেই। প্রশ্ন হ’ল–কেন নেই? ফ্রান্সিস বলল।

–মন্ত্রীমশাই তো বৃদ্ধই ছিলেন। নজরে পড়েনি হয়তো। হ্যারি বলল;

উঁহু। ব্যাপারটা অত সহজ সরল নয়। বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যেই ওটা আঁকেন নি। সামান্য ফুল পাখি বাদ যায় নি আর ঐ গুহামুখটা বাদ যাবে? ফ্রান্সিস বলল।

–এই ব্যাপারটা তো রাজা পাকোর্দোর নজর পড়ার কথা। হ্যারি বলল।

নজরে পড়ে নি। কারণ উনি ছবিটা আমার মত মিলিয়ে দেখেন নি। ভুলে যেও না মন্ত্রীমশাই তাঁর ছবিগুলো সম্পর্কে বলেছিলেন–তার ছবিগুলো সাংকেতিক। কোন সংকেত না দেওয়াও এক ধরনের সংকেত। চলো ঐ গুহামুখটা দেখবো। ফ্রান্সিস বলল।

তিনজনে গাছপালা বুনো ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে চলল। একটু পরেই গুহামুখে এসে দাঁড়াল। গুহামুখ খুব বড় নয়। মাথা নিচু করে একজন মানুষ ঢুকতে পারে এমন।

ফ্রান্সিস গুহামুখের দিকে চলল। হ্যারি বলে উঠল সাবধান ফ্রান্সিস—অচেনা অজানা গুহা। ফ্রান্সিস মুখ ফিরিয়ে বলল কিন্তু দেখতে তো হবে–গুহাটা কত লম্বা। ভেতরেও কী আছে।

ফ্রান্সিস পায়ে পায়ে মাথা নিচু করে গুহার মধ্যে ঢুকল। বাইরের উজ্জ্বল রোদ থেকে গুহায় একটু ঢুকে দেখল শুধু অন্ধকার। এবড়ো খেবুড়ো গুহার গায়ের আভাস। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে অস্পষ্ট দেখল গুহাটা খুব বড় নয়। আর একপা ফেলতেই পায়ের নিচে কী কিলবিল করে উঠল। সাপ! ফ্রান্সিস লাফ দিয়ে সরে এল। ভাগ্য ভালো। কামড়ায় নি।

ফ্রান্সিস গুহা থেকে বেরিয়ে এল। হ্যারিদের কাছে এল। বলল–গুহাটা বেশি বড় নয়। ভেতরে সাপের গায়ে পা দিয়েছিলাম। যাকগে মশাল ছাড়া কিছুই দেখা যাবে না।

তখনই হঠাৎ পেছনে ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ হল। সঙ্গে কার আর্তস্বর। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে পেছনে লাফ দিয়ে এক বুনো ঝোঁপের ওপর পড়ল। তারপর যে গাছের ডাল ভেঙে ঝুলছিল আর এক লাফে সেখানে গিয়ে পড়ল। আলো অন্ধকারে দেখল বিন্তানো চিৎ হয়ে পড়ে আছে। শাঙ্কো ওকে টেনে তুলল। বিন্তানো চোখমুখ কুঁচকে বলল–কোমরে বড্ড লেগেছে।

–আমরা কী করি তাই দেখতে গাছে উঠেছিলে–তাই না? শাঙ্কো বলল।

–হ্যাঁ। খুব আক্কেল হয়েছে। বিন্তানো বলল।

–ফ্রান্সিসের কাছে চলো। শাঙ্কো বলল।

শাঙ্কো বিন্তানোকে ধরে ধরে ফ্রান্সিসের কাছে নিয়ে এল। শাঙ্কো বলল–এই যে বিন্তানো। আমাদের ওপর নজরদারি চালাতে গিয়ে গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়েছে।

–বিন্তানো কী শাস্তি চাও? ফ্রান্সিস বলল।

যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে আমার। কোমরটা বোধহয় ভেঙেই গেছে।

-ঠিক আছে ঐ ভাঙা কোমর নিয়ে যাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দু’টো মশাল নিয়ে এসো।

–বেশ। যাচ্ছি। কিন্তু মশাল নিয়ে কী করবে? বিন্তানো জানতে চাইল।

–এই গুহায় ঢুকবো। ফ্রান্সিস বলল।

–সর্বনাশ। এই গুহায় সাপের আড্ডা। এই গুহার ত্রিসীমানয় কেউ আসেনা। বিন্তানো বলল।

–ঠিক আছে। তুমি মশাল চকমকি পাথর নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ। যাচ্ছি। তবে কোমরের যা অবস্থা। বিন্তানো বিরসমুখে বলল।

-ওটাই তোমার শাস্তি। যাও। ফ্রান্সিস বলল।

বিন্তানো বিড়বিড় করে আপনমনে বকতে বকতে চলে গেল। ফ্রান্সিসরা এখানে ওখানে পাথরের ওপর বসে রইল।

বিন্তানো যখন মশাল নিয়ে ফিরে এল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। বিন্তানো দু’টো মশাল ফ্রান্সিসের হাতে দিয়ে একটা পাথরের ওপর বসে হাঁফাতে লাগল। মুখ কুঁচকে কোমরের ব্যথা সহ্য করতে লাগল।

শাঙ্কো চকমকি পাথর ঠুকে মশাল জ্বালল। ফ্রান্সিসকে একটা মশাল দিল। অন্যটা নিজে নিল।

এবার দুজনে মশাল হাতে গুহার মধ্যে ঢুকল। একটা কেমন ঠাণ্ডা হাওয়া গুহার মধ্যে থেকে ছুটে এল। ফ্রান্সিসের শরীরটা একটু কেঁপে উঠল।

বেশ কিছুটা যেতেই চোখের সামনে এক অদ্ভুত দৃশ্য। ফ্রান্সিস থমকে দাঁড়াল। পেছনে শাঙ্কোকে হাত দিয়ে থামাল। সামনেই একটা অমসৃন পাথরের বেদী মত। কত বিচিত্র রঙের সাপ ছোটবড় সাপ এদিক ওদিক কিলবিল করছে। নড়ছে জড়াজড়ি করছে ফণা তুলছে। মশালের আলো পড়ে সাপগুলোর গায়ের আঁশ চক্করছে। আরও আশ্চর্য ছোট চত্বরটা জুড়ে ছড়ানো হীরে মুক্তো। মণিমানিক্য গয়না গাটি। ওগুলোর মধ্যে দিয়েই সাপগুলো যেন খেলে বেড়াচ্ছে।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল

–শাঙ্কো–মন্ত্রীমশাই এখানেই এই ধনসম্পদ গোপনে রেখেছিলেন।

–তাহলে এটাই সেই গুপ্ত ধনভাণ্ডার? শাঙ্কো মৃদুস্বরে বলল।

–হ্যাঁ। ছবিতে কোন সংকেতনা দিয়েই এই সংকেত দিয়ে গিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।

কী করবে এখন? শাঙ্কো প্রশ্ন করল।

–সাপ তাড়াবার ব্যবস্থা করতে হবে। বাইরে চলো। ফ্রান্সিস বলল।

দু’জনে গুহা থেকে বেরিয়ে এল। হ্যারি সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল কিছুহদিশ পেলে?

–হ্যাঁ। এই গুহাতেই আছে গুপ্তধন। কিন্তু তা উদ্ধার করতে এখনও কিছু কাজ বাকি। চলো-বেশ কিছু শুকনো কাঠ জোগাড় করতে হবে।

একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে বিন্তানো এগিয়ে এল। বলল–গুপ্তধন এখানেই আছে?

-হ্যাঁ। তবে এখনো হাতের নাগালের বাইরে। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিসরা মশাল পাথরের খাঁজে রেখে বনের মধ্যে ঢুকল। গাছের শুকনো ডালপাতা জোগাড় করে নিয়ে এল। গুহার মুখে জড়ো করল। মশালের আগুনে ডালপাতায় আগুন জ্বালল। তারপর সেসব গুহার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। আগুনে ধোঁয়ারও সৃষ্টি হল। গুহা ধোঁয়ায় ভরে গেল। সেইসঙ্গে আগুনও ছড়াল। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো–গুহামুখ থেকে সরে এসো।

দুজনেই একটু দূরে সরে এল। ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাপগুলো কিলবিল করতে করতে বেরিয়ে আসতে লাগল। হ্যারি আর বিন্তানো অবাক। এত সাপ? সাপগুলো এদিক ওদিক পালিয়ে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক সাপ বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস তবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর বলল–হ্যারি তোমার কোমরের ফেট্টিটা খোল। হ্যারি খুলে দিল। ফেট্টিটা নিয়ে বলল শাঙ্কো এবার গুহার মধ্যে চলো। বোধ হয় সব সাপ পালিয়েছে।

তিনজনে গুহারমধ্যে ঢুকল। বিন্তানোও খোঁড়াতে খোঁড়াতেওদের পেছনে পেছনে চলল।

গুহায় ঢুকে ফ্রান্সিস মশালের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে ভালো করে দেখল। না। কোন সাপ নেই। হ্যারি আর বিন্তানো অত সোনা পান্না হীরে চুনি দেখে হতবাক।

ফ্রান্সিস বেদীটার কাছে গেল মশালটা হ্যারির হাতে দিল তারপর ফেট্টির কাপড়টা পাতলা। সোনার চাকতি হীরে মুক্তো চুনি পান্না সব কাপড়টায় ভরল। কাপড়ের মুখটা বাঁধল। একটা বোঁচকামত হল। শাঙ্কো বাঁ হাতে মশালটা নিয়ে বোঁচকাটা ডানহাতে ঝুলিয়ে নিল।

সবাই গুহা থেকে বেরিয়ে এল। বনের মধ্যে ঢুকল। চলল প্রায় অন্ধকার পথ বনতল দিয়ে। সঙ্গে বিন্তানো।

বন থেকে যখন বেরিয়ে এল তখন সন্ধে হয়ে গেছে। দুপুরে খাওয়া হয় নি। সবাই ক্ষুধার্ত। শাঙ্কো বলল–এখন কী করবে?

–আগে খেয়ে নি। ভীষণ খিদে পেয়েছে। তারপর রাজার কাছে যাবো। বিন্তানকে বলল–তুমিও আমাদের সঙ্গে খেয়ে নাও।

ঘরে ঢুকতে বন্ধুরা হৈ হৈ করে উঠল। তাদের প্রশ্ন ছিল না খেয়ে এতক্ষণ কোথায় ছিলে তোমরা। রাজকুমারী সেই তোমরা বেরিয়ে যাবার পর এসেছেন। এখনও কিছুই মুখে দেননি।

–মারিয়া তুমি খেয়ে নিলে পারতে। ফ্রান্সিস বলল।

–উপবাসী তোমরা কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছো আর আমি পেট ভরে খাবো?

–ঠিক আছে। আমাদের সঙ্গে খাবে চলো। ফ্রান্সিস বলল।

–কিন্তু গুপ্ত ধনভাণ্ডারের কোন হদিশ পেলে? মারিয়া জানতে চাইল।

ফ্রান্সিস হেসে বলল–শাঙ্কো বোঁচকা খোল।

শাঙ্কো হাতের বোঁচকাটা ঘাসপাতার বিছানায় রাখল। গিট খুলে কাপড়টা খুলে দিল। একসঙ্গে সেই সোনার চাকতি হীরে মুক্তো দেখে সবাই হতবাক। কিছুক্ষণ সবাই চুপ। সিনাত্রা একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে ধ্বনি তুলল–

-ও-হো-হো। সবাই ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো।

ফ্রান্সিস শাঙ্কোরা খাওয়া দাওয়া সেরে নিজেদের ঘরে এল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। তারপর উঠে বসল। বলল–হ্যারি চলো–রাজা পাকোর্দোকে তার প্রাপ্য দিয়ে আসি। কাল সকালেই আমরা জাহাজে ফিরে যাবো।

ফ্রান্সিস হ্যারি চলল রাজবাড়ির দিকে। সঙ্গে ধনভাণ্ডারের বোঁচকা নিয়ে শাঙ্কোও চলল।

সদর দেউড়িতে পাহারারত প্রহরীকে হ্যারি বলল–যাও। রাজাকে গিয়ে বলো বিদেশিরা এসেছে। দেখা করতে চায়। বিশেষ প্রয়োজন।

প্রহরী চলে গেল। কিছু পরে ফিরে এসে বলল–মন্ত্রণাঘর খুলে দিয়েছি। আপনারা বসুন। মান্যবর রাজা আসছেন।

ফ্রান্সিসরা রাজবাড়িতে ঢুকেমন্ত্রণাকক্ষে এল। একটা পাথরের টেবিল ঘিরেআসনপাতা। একজন প্রহরী একটা মশাল জ্বেলে রেখে গেল। ফ্রান্সিসরা আসনে বসল। শাঙ্কো বোঁচকাটা টেবিলের ওপর রাখল।

কিছুক্ষণ পরে রাজা ঢুকলেন। বললেন–আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো?

–হ্যাঁ। কালকে সকালে আমরা আমাদের জাহাজে ফিরে যাচ্ছি।

–বেশ। তোমরা আমার জন্যে যা করেছে তা আমি কোনদিন ভুলবো না।

–মান্যবর রাজা–মন্ত্রীমশাই যে ধনরত্ন গোপনে রেখেছিলেন তা আমরা উদ্ধার করেছি।

বলল কি। এ তো সত্যিই সুসংবাদ। রাজা একটু আশ্চর্য হয়েই বললেন। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ইঙ্গিত করল। শাঙ্কো গিট খুলে কাপড়টা টেবিলে পেতে দিল। সোনা হীরে মনিমুক্তো গয়নাগাটি ছড়ানো কাপড়ের ওপর। রাজা পাকোর্দো কিছুক্ষণ অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন–এত দামি জিনিস। আমি কল্পনাও করি নি। যা হোক–তোমরা কষ্ট করে উদ্ধার করেছো–তোমাদেরও তো কিছু দিতে হয়।

–আমাদের দশটা সোনার চাকতি দিন তাহলেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–না-না। এত সামান্য–রাজা বললেন।

–না। এর বেশি কিছু চাই না। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ। তোমরা যেমন চাও। রাজা কুড়িটা সোনার চাকতি দিলেন। ফ্রান্সিস আর আপত্তি করল না।

ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বলল–তাহলে আমরা যাচ্ছি।

ফ্রান্সিসরা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। নিজেদের ঘরে এল।

রাত হচ্ছে। মারিয়া আর রাজবাড়িতে গেল না। ফ্রান্সিসদের সঙ্গে থেকে গেল।

ভোর হল। সবাই উঠে পড়ল। সবাই তৈরি হতে লাগল।

সকাল হল। সকালের খাবার এল। খেয়ে দেয়ে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মাঠ পার হয়ে বনভূমিতে ঢুকল। চলল সমুদ্রের দিকে।

একটু বেলায় জাহাজঘাটে পৌঁছল। ফ্রান্সিস রাঁধুনি বন্ধুদের ডেকে বলল–রান্না শুরু কর। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে জাহাজ ছাড়বো। রাঁধুনি বন্ধুরা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। কয়েকজন পালের দড়িফড়ী বাঁধতে লাগল।

দুপুরের খাওয়া শেষ হতে জাহাজের নোঙর তোলা হল। জাহাজ ছেড়ে দেওয়া হল। জাহাজ চলল সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে।

দুপুর থেকেই আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছিল। ঝড়ের পূর্বাভাস। ভাইকিংরা জাহাজেই ঘুরে বেড়ায়। আকাশের মতিগতি ওরা ভালো বোঝে। মেঘে সূর্য ঢাকা পড়ে গেল। প্রায় অন্ধকার হয়ে এল চারদিক।

শুরু হল মেঘগর্জন। সেইসঙ্গে কালো আকাশ চিরে বিদ্যুতের ঝলকানি।

ফ্রান্সিস ডেক-এর ওপর উঠে এল।

গলা চড়িয়ে বলল, ভাইসব। সামাল। ঝড় আসছে। ততক্ষণে ভাইকিংরা জাহাজের পাল নামিয়ে ফেলেছে। ফ্লেজার দৃঢ় হাতে জাহাজের হুইল চেপে ধরেছে। মাস্তুলের ওপর থেকে পেড্রো নেমে এসেছে। নীচের দাঁড়ঘর থেকে দাঁড়ীরা ডেক-এ উঠে এসেছে। মাস্তুল আর হালে বাঁধা দড়িদড়া টেনে ধরে সবাই প্রস্তুত হতে হতেই প্রচণ্ড বেগে ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্রান্সিসদের জাহাজের ওপর। শুরু হল ভাইকিংদের সঙ্গে ঝড়ের লড়াই। তখনই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। ফুঁসে উঠতে লাগল সমুদ্রের ঢেউ।

আজ আর মারিয়ার সূর্যাস্ত দেখা হল না।

ঝড় চলল। উঁচু উঁচু ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে ভেঙে পড়তে লাগল। প্রচণ্ড দুলুনির মধ্যেও ভাইকিংরা দড়িদড়া টেনে ধরে জাহাজ ভাসিয়ে রাখল।

প্রায় আধঘণ্টা ধরে ঝড়ের ঝাপটা চলল। তারপরই আকাশের কালো মেঘ উড়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্তাচলগামী সূর্য দেখা গেল। ঝড়ের ঝাপটার বেগ কমল। ডেক-এর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ভাইকিংরা যেন স্নান করে উঠেছে। কেউ কেউ এখানে-ওখানে বসে রইল। কেউ কেবিনে গেল ভেজা পোশাক পাল্টাতে।

ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে এল। বলল, দিক ঠিক রাখতে পেরেছ?

অসম্ভব। ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ যে কোনদিকে চলেছে বুঝতে পারছি না।

তাহলে যে কোনো ডাঙায় জাহাজ ভেড়াও। সেখানে খোঁজ নিতে হবে কোথায় এলাম। মোটামুটি উত্তরদিকটা ঠিক রাখার চেষ্টা করো।

দেখি, ফ্লেজার বলল।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলছে। মাস্তুলের ওপরে পেড্রো নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ডাঙার দেখা নেই।

আট-দশদিন কেটে গেল। কিন্তু কোথায় ডাঙা? ফ্রান্সিসরা চিন্তায় পড়ল। কোথায় চলেছে জাহাজ? বন্ধুরা ফ্রান্সিসের কাছে আসে। আশঙ্কা প্রকাশ করে। বলে, লোকবসতি থেকে আমরা অনেক দূরে কাথাও চলে এসেছি।

-না। এখনও সেটা বল যায় না। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলে। ফ্রান্সিসের কথার প্রতিবাদ করে না ওরা। কিন্তু মন থেকে বিপদের আশঙ্কা যায় না।

ডাঙার দেখা নেই। ফ্রান্সিসের বন্ধুদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলল।

সেদিন বিকেলে নজরদার পেড্রো মাস্তুলের ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ডাঙা, ডাঙা দেখা যাচ্ছে। শাঙ্কো ডেকএই বসেছিল। ছুটে রেলিঙের কাছে গেল। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দেখল সত্যিই ডাঙা, তবে গাছপালায় ভরা। খুব সম্ভব জঙ্গল। তা হোক, শক্ত মাটি তো বটে। বন্ধুরা এসে ভিড় জমাল। সবাই খুশি। ডাঙার দেখা পাওয়া গেছে।

শাঙ্কো ছুটল ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। ফ্রান্সিসেরও দুশ্চিন্তা কম ছিল না। একটু পরেই ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে এল। পেছনে মারিয়া আর হ্যারি। জঙ্গল এলাকা পার হয়ে জাহাজ তখন একটা ছোট বন্দরের কাছে এসেছে। ফ্রান্সিস হারির দিকে তাকিয়ে বলল, যাক ডাঙার দেখা মিলল। ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে এল। বলল, এই ছোট বন্দরেই জাহাজ ভেড়াও। দেখা যাককোথায় এলাম?

দেখা গেল বাড়ি-ঘরদোর জাহাজঘাট থেকে বেশ দূরে।

কী করবে? হ্যারি জানতে চাইল।

রাতে আর যাব না। রাতের অচেনা অজানা জায়গায় গিয়ে বিপদে পড়েছি। ভোর হোক। তখন যাব খোঁজ করতে। ফ্রান্সিস বলল।

আবার একদিন দেরি হবে। মারিয়া বলল।

জোরে জাহাজ চালিয়ে একদিন পুষিয়ে নেব। ফ্রান্সিস উত্তর দিল।

জাহাজঘাটে নোঙর ফেলা হল। রাতের খাওয়া সেরে সবাই শুতে গেল। শাঙ্কো কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ডেক-এই শুয়ে পড়ল। আকাশের চাঁদের আলো অনুজ্জ্বল। চারধার মোটামুটি আবছা দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের জোর হাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। সারাদিনের রোদে পোড়া শরীর আরাম পেল। শাঙ্কো আর বন্ধুরা ঘুমিয়ে পড়ল।

তখন শেষ রাত। হঠাৎ বর্শামুখের খোঁচা খেয়ে শাঙ্কোর ঘুম ভেঙে গেল। দেখল উদ্যত বর্শা হাতে দু’তিনজন কালো মানুষ। তাদের সারা শরীর ভেজা। বোঝা গেল সাঁতরে এসে জাহাজে উঠেছে। অন্য বন্ধুদেরও বর্শা দিয়ে খোঁজা দিতে লাগল তারা। সকলের ঘুম ভেঙে গেল। ওরা উঠে বসল। কালো বর্শাধারীরা সংখ্যায় দশ-বারো জন। বর্শাধারীদের মধ্যে থেকে একজন মোটা মতো লোক এগিয়ে এল। দাঁত বার করে হেসে বলল, আমরা তোমাদের জাহাজ লুঠ করতে এসেছি। তোমাদের দেখেই বুঝতে পারছি এখানে দামি কিছু পাব না। তবু সোনার মুদ্রা-টুদ্রা যা পাব তাতেই আমাদের লাভ। তাছাড়া পোশাক-টোশাক তো আছেই।

পোশাক-আসাকও লুঠ করবে? শাঙ্কো অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।

যা পাওয়া যায়। লোকটি বলল। বোঝা গেল লুঠেরার দলের সর্দার এই লোকটিই।

নাও, যার কাছে আছে বের করো শিগগিরি। সর্দার তাগাদা লাগাল।

ভাইকিংরা বাধা দিতে পারল না। নিরস্ত্র অবস্থায় এখন লড়াইও করা যাবে না। যে যার ফেট্টি থেকে খুচরো মুদ্রা ডেক-এর ওপর ঠকঠক করে ফেলতে লাগল। সর্দারের সঙ্গীরা তা কুড়িয়ে নিল। শাঙ্কো ফেট্টি থেকে একটা সোনার চাকতি ফেলল। ঠক করে চাকতির শব্দ হল। সর্দার সঙ্গে সঙ্গে শাঙ্কোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শাঙ্কোর কোমরের ফেট্টি খামচে? ধরতেই আর একজন শাঙ্কোকে পেছন থেকে চেপে ধরল। সর্দার একটানে শাঙ্কোর কোমরের ফেট্টি খুলে ফেলল। ঠক ঠক শব্দে আরও কয়েকটা সোনার চাকতি পড়ল। সর্দার নিজেই সেগুলো কুড়িয়ে নিল। হেসে বলল, এই তো, কে বলল যে তোমরা গরিব?

ওপরের ডেক-এ যখন লুঠ চলছে তখন ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ও বুঝল ওপরে কিছু একটা ঘটছে। বিছানার নীচ থেকে একটানে তরোয়াল বের করে সিঁড়ি দিয়ে ডেক এ উঠে এল ফ্রান্সিস। দেখল বর্শা হাতে একদল লোক। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল, জাহাজ লুঠ করতে এসেছে। একজন বর্শার ফলাটা শাঙ্কোর পিঠে চেপে ধরল। শাঙ্কো আর কিছু বলল না। অন্য এক লুঠেরা ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়ল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে সিঁড়ির কয়েক ধাপ নীচে নেমে এল। বর্শাটা সিঁড়ির ওপর গেঁথে গেল।

ফ্রান্সিস একা লড়াই করতে ভরসা পেল না। সর্দার গলা তুলে বলল, কেউ কথা বললেই মরবে। দুজন বর্শাধারী দুজন ভাইকিং-এর বুকে বর্শারফলা চেপে ধরল। ফ্রান্সিস বুঝল এদের কথা মতো চলতেহবে। নইলে বন্ধুরা মরবে। ও ডেক-এ উঠে এল। হাতের তরোয়াল ডেক এর ওপর ফেলে দিল। বলল, আমরা লড়াই করবনা, তোমরা লুঠপাট করে চলে যাও।

সর্দার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, নীচে চল্।

ওরা পাঁচজন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। কেবিন ঘরগুলোয় ঢুকতে লাগল। শোরগোলে ভাইকিংদের ঘুম ততক্ষণে ভেঙ্গে গেছে। সর্দার তাদের সতর্ক করে বলল, চুপচাপ সব বসে থাকো। ভাইকিংরা চুপ করে বিছানায় বসে রইল। চলল পোশাক লুঠ। ভাইকিংরা বিছানায় বসে অবাক চোখে দেখতে লাগল।

ফ্রান্সিস বেরোবার সময় কেবিন ঘরের দরজা খুলে রেখে বেরিয়েছিল। সর্দার খোলা দরজা পেয়ে ঢুকে পড়ল। তখন মারিয়া ঘুম ভেঙে বিছানায় বসে আছে। মারিয়াকে দেখে সর্দার বুঝল এখানে কিছু গয়নাগাটি পাওয়া যাবে। ও বর্শাটা মারিয়ার দিকে তাক করে বলল, সব গয়নাগাটি দিয়ে দাও।

আমি তো বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে আসিনি যে গয়নাগাটি পরে আসব। মারিয়া বেশ ঝাঝের সঙ্গে বলল।

সর্দার বিশ্বাস করল না। কড়া গলায় শাসাল, কথা বাড়িও না। যা আছে দাও নইলে মরতে হবে।

মারিয়া এবার ভয় পেল। যেভাবে বর্শা তাক করে আছে, একটু এদিক ওদিক দেখলে ছুঁড়ে মারতে পারে।

ফ্রান্সিস কোথায়? মারিয়া জিগ্যেস করল। সর্দার বুঝল তরোয়াল হাতে লোকটাই ফ্রান্সিস। বলল, ওপরের ডেক এ। আমার চারজন সঙ্গী ওকে ঘিরে আছে। আর কথা না। গয়নাগাটি দাও।

মারিয়া আর কিছু বলল না। বিছানার ধারে রাখা চামড়ার ঝোলাটা বের করল। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে গয়নার কাঠের বাক্সটা বের করে আনল। বাক্সটা এগিয়ে ধরে বলল, এই নাও। কাউকে হত্যা করতে পারবে না। সর্দার খুশির হাসি হেসে বলল, না না। আমাদের দামি জিনিস পেলেই হল। মানুষ মারব কেন? তারপর জিগ্যেস করল আর কিছু নেই?

না। আমার কাছে আর কিছু নেই।

সর্দার কথা বাড়াল। গয়নার বাক্সটা বগলে চেপে বেরিয়ে গেল।

পোশাক লুঠ শেষ করে সঙ্গীরা ডেক-এ উঠে এল। সর্দারও এল। দুজন গিয়ে পাটাতন ফেলল।

পাতা পাটাতন দিয়ে লুঠেরার দল দ্রুত নেমে গেল। তারপর পাটাতনটা জলে ফেলে দিল। তখনই সূর্য উঠল। ভোরের আলোয় দেখা গেল ওরা ডানপাশের জঙ্গলের দিকে চলেছে।

ততক্ষণে ভাইকিংরা খোলা তরোয়াল হাতে ডেক-এ উঠে এসেছে। পাটাতন নেই, পাঁচ-সাতজন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তরোয়াল দাঁতে চেপে ধরা। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বাধা দিতে গেল, বিপদ বাড়িও না। চলে এসো। ওরা শুনল না। তীরভূমিতে উঠে লুঠেরার দলের দিকে ছুটল। কিন্তু ধরবার আগেই জঙ্গলে ঢুকে পড়ল দলটা। ভাইকিংরা জঙ্গলের কাছে গিয়ে থমকে গেল। এই জঙ্গলের মধ্যে কোথায় খুঁজবে লুঠেরাদের? ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল। দলের মধ্যে বিস্কো ছিল। সে বলল, আমরা সংখ্যায় কম। এখন। জঙ্গলে ঢোকা নিরাপদ নয়। ফিরে চলল। তবু কয়েকজন জঙ্গলে ঢুকতে চাইল। বিস্কো বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওদের সামলাল।

বিস্কোরা ফিরে এসে দেখল শাঙ্কোরা পাটাতন জল থেকে এনে পেতে দিয়েছে। তারা জাহাজের ডেক-এ উঠে আসতেই ফ্রান্সিস বলল, আর এক মুহূর্তও এখানে নয়। আবার একদল লুঠেরা এসে হাজির হবে। তখন সমস্যা বাড়বে। পাল তুলে দাও। নোঙর তোলো। দাঁড়ঘরে যাও। ফ্লেজার জাহাজ ছাড়ো।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ আবার ভাসল। সমুদ্র এখন অনেকটা শান্ত। ফ্রান্সিস ফ্লেজারকে বলল, উত্তরদিক ঠিক রেখে চালাও।

ঢেউ ভেঙে জাহাজ এগিয়ে চলল। দুদিন পরে একটা বন্দরের কাছে এল। জাহাজটা। তখন বেলা হয়েছে।

হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল, একটা বন্দর দেখা যাচ্ছে। কী করবে?

জাহাজ বন্দরে ভেড়াতে বলো। দেখি খোঁজখবর করে।

ফ্লেজার জাহাজঘাটে জাহাজ ভেড়াল। শাঙ্কো নোঙর ফেলল। ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে এল। দেখল জাহাজঘাটে আরও কয়েকটা জাহাজ নোঙর করা। বড় বন্দর। বাড়ি-ঘরদোর, লোকজন আছে। বাজার এলাকায় লোকজনের ভিড়। সকলেই কালো। বোঝা গেল এখানে কালো মানুষদেরই বসতি।

হ্যারি জিগ্যেস করল, নামবে?

হ্যাঁ, উত্তর দিল ফ্রান্সিস, দুপুরের খাওয়া সেরে যাব। রাতে খোঁজখবর করতে গেলে বিপদ হতে পারে।

আমি যাব?

না। শাঙ্কোকে নিয়ে আমি নামব।

বন্ধুরা নেমে একটু ঘুরে বেড়াতে চাইছিল, হ্যারি বলল।

না, আবার কোনো বিপদে পড়বে। তখন ওদের বাঁচাতে আমাদের কয়েকজনকে ছুটতে হবে। আমি আর শাঙ্কো গেলেই হবে।

দুপুরের খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো কোমরে তরোয়াল গুঁজে জাহাজ থেকে নামল।

বেশ কিছু গাছের নীচে বাজার বসেছে। ফ্রান্সিস লক্ষ করল, প্রথম গাছটার নীচে কোমরেতরোয়াল গোঁজা কয়েকজন কালো যোদ্ধা। যোদ্ধারা ওদের দুজনকে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ফ্রান্সিস বিপদ আঁচ করল। কিন্তু এখনই ফিরে যেতে গেলে বিপদ বাড়বে।

ফ্রান্সিস বাজারের কাছে এল। একজন বৃদ্ধ কেনাকাটা সেরেফিরছিল। বৃদ্ধটি ফ্রান্সিসদের দেখে হাসল। ফ্রান্সিস একটু অবাকই হল। বৃদ্ধটি হাসল কেন? ও বৃদ্ধের কাছে গেল। জিগ্যেস করল, আমাদের দুজনকে দেখে হাসলেন কেন?

তোমরা বিদেশি, তাই দেখে। বৃদ্ধ আবার হাসল।

হাঁ, আমরা বিদেশি। এই বন্দরের নাম কী? শাঙ্কো বলল।

ত্রিম্বা।

এখানকার রাজা কে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

রাজা নেই। তবে শ’ দেড়েক বছর আগে এক সুলতান ছিল। সুলতান হানিফ।

মুসলিম রাজা? ফ্রান্সিস অবাক।

হ্যাঁ। কিছুদুরে সুলতানের বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ।

খুব বড়লোক ছিল বুঝি? কৌতূহল বাড়তে থাকে ফ্রান্সিসের।

হ্যাঁ। তার স্বর্ণভাণ্ডারের কথা লোকে এখনও বলে।

এখান থেকে পোর্তুগাল কত দূরে?

তা বলতে পারব না। গরিব মানুষ। দেশ বিদেশে ঘুরব সাধ্য নেই। বৃদ্ধ উত্তর দিল।

তবু কিছু তো ধারণা আপনার আছে?

হবে উত্তরমুখো কোথাও।

ঠিক আছে। এটুকু জানলেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।

ওদের কথা শেষ হতে না হতেই গাছের নীচে দাঁড়ানো যোদ্ধার দল ওদের কাছে এল। একজন রোগাটে চেহারার যোদ্ধা জিগ্যেস করল, কী কথা হচ্ছিল তোমাদের?

এখান থেকে পোর্তুগাল কতদূর সেটাই জানতে চেয়েছিলাম। শাঙ্কো বলল।

তোমরা বিদেশি? যোদ্ধাটি জানতে চাইল।

হ্যাঁ। আমরা ভাইকিং। শাঙ্কো বলল।

লুঠেরার জাত। যোদ্ধা যুবকটি হেসে বলল।

লোকে বলে বটে। কিন্তু আমরা লুঠেরা নই। বরং আগের বন্দরে একদল লুঠেরা আমাদের জাহাজ লুঠ করেছে। ফ্রান্সিস ওদের কথোপকথনে যোগ দিল।

তোমরা এখানে এসেছ কেন? যোদ্ধা যুবকটি বলল।

আমাদের দেশ মানে ইউরোপ কতদূর সেটা জানতে। ফ্রান্সিস বলল।

তরোয়াল এনেছ কেন?

যদি হঠাৎ আক্রান্ত হই তাহলে লড়াই করব বলে, ফ্রান্সিস বলল।

আমাদের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে পারবে?

তোমাদের সঙ্গে লড়াই করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই। ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে তরোয়াল ফেলে দাও। যোদ্ধাটি বলল।

বেশ, আমরা আমাদের জাহাজে ফিরে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস জানাল।

না। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে তরোয়াল খুলে বলল, আমাদের সঙ্গে লড়াই করো। যদি তারপরেও বেঁচে থাকো তবে জাহাজে ফিরে যাবে।

আমরা দুজনমাত্র। লড়াই করবনা। ফ্রান্সিস বলল।

কাপুরুষ! তাচ্ছিল্যে মুখ বাঁকাল যোদ্ধাটি।

বিনা কারণে রক্তপাত আমরা চাই না। ফ্রান্সিস বলল।

তোমাদের বন্দী করা হল। চলো আমাদের সঙ্গে।

কোথায়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

আমাদের দলপতির কাছে। দলপতি কী হুকুম করে দেখো। যোদ্ধাটি ওদের বলল।

কিন্তু আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি। এবার শাঙ্কো উত্তর দিল।

সেসব দলপতি বুঝবে। এখন চুপচাপ আমাদের সঙ্গে চলো।

ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল, ওদের বাধা দিতে যাওয়া বোকামি হবে।

কথাটা ও নিজেদের ভাষায় বলল। ফলে যোদ্ধারা কিছু বুঝল না। যে ওদের সঙ্গে কথা বলছিল সেই যোদ্ধাটি বেশ চড়াগলায় হুকুম করল, তরোয়াল ফেলে দাও।

ফ্রান্সিস বলল, শাঙ্কো, তরোয়াল ফেলে দাও। শাঙ্কো তবু ইতস্তত করছিল, যোদ্ধাটি শাঙ্কোর মাথার ওপর তরোয়াল উঁচিয়ে ধরল। এবার শাঙ্কো তরোয়াল ফেলে দিল।

একজন যোদ্ধা তরোয়াল দুটো তুলে নিল।

যোদ্ধাদের পেছনে পেছনে যেতে যেতে ফ্রান্সিস শাঙ্কো দেশীয় ভাষায় বলল, অতজনের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে আমাদের জীবন বিপন্ন হবে। দেখা যাক ওদের দলপতি কী বলে?

বাজার এলাকা ছাড়িয়ে লালচে ধুলোর পথ। মাঝে মাঝে সমুদ্রের দিক থেকে জোর হাওয়া আসছে। লালচে ধুলো উড়ছে। চোখ-মুখ ঢেকে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট পাহাড়।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পরে ফ্রান্সিসরা দেখল সামনে একটা বড় বাড়ি। বাড়িটা তৈরি পাথর আর কাঠ দিয়ে। তার পাশেই একটা ছোট সম্পূর্ণ ঘর।

শাঙ্কো মৃদুস্বরে বলল, পাশেরটা নিশ্চয়ই কয়েদঘর।

হুঁ। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। কিছু বলল না।

বড় ঘরটার দরজা খোলা। সেই রোগা যোদ্ধাটি বলল, ভেতরে ঢোকো ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো ঘরটায় ঢুকল। বাইরের চড়া রোদ থেকে এসে প্রথমে কিছুই দেখতে পারছিল না। চোখে অন্ধকারসয়ে আসতে দেখল, একজন বয়স্ক লোক একটা কাঠের আসনে বসে আছে। আশ্চর্য! এই কালো লোকদের দেশে বয়স্ক লোকটি শ্বেতকায়। বোঝাই যাচ্ছে এ দলপতি। দলপতি ফ্রান্সিসদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মোটা গলায় বলল, তোমরা বিদেশি?

আপনিও তো বিদেশি। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ। পোতুর্গীজ। আমার নাম এন্তানো। তোমরা? দলপতির প্রশ্ন।

আমরা ভাইকিং। আমার নাম ফ্রান্সিস।

তোমাদের বদনাম আছে। এন্তানো বলল।

জানি। আমরা তার পরোয়া করি না। ফ্রান্সিস গলায় জোর দিয়ে বলল।

তুমি দেখছি বেশ তেজি। ভালো।

ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না।

কিন্তু তোমাদের তো বিশ্বাস নেই।

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল।

অবিশ্বাসের কোনো কাজ তো আমরা করিনি। এবার বলল শাঙ্কো।

তাছাড়া আমরা এখানে থাকতে আসিনি। ফ্রান্সিস যোগ করল।

আসার সময় তো একটা ছোট পাহাড় দেখেছ?

হ্যাঁ দেখেছি। পেছন দিকে। ফ্রান্সিস বলল।

ঐ পাহাড় থেকে কত যে চুনিপান্না মূল্যবান পাথর পেয়েছি। দেখবে?

না। ওসব দেখে কী হবে? ফ্রান্সিস বলল।

ঐ চুন্নিপান্না সব বিক্রি করে দেব। তারপর দেশে ফিরে গিয়ে রাজার হালে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।

এসব আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা শুনে কী করব? ফ্রান্সিস বলল।

এইজন্য শুনবে যে তোমরা সেই দামি পাথর চুরি করতে এখানে এসেছ।

ফ্রান্সিস অবাক। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। শাঙ্কো বলে উঠল–আপনার দামি পাথরের কথা আমরা এই প্রথম শুনলাম।

উঁহু। এন্তানো হাসল, তোমরা সব খোঁজখবর নিয়েই এসেছ।

এ আপনার অন্যায় দোষারোপ ফ্রান্সিস প্রতিবাদ করে উঠল।

তোমরা জাহাজে চড়ে এসেছ? এন্তানো জানতে চাইল।

হ্যাঁ, ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল।

বাজারে একজন বুড়োর কাছে এসব খবর পেয়েছে। এন্তানো আবার হাসল।

আমরা খোঁজ নিচ্ছিলাম–শাঙ্কো বলতে গেল। এন্তানো ডান হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল। বলল, এই ত্রিম্বার সর্বত্র আমার চর আছে। আমি এখানে বসে থাকি, কিন্তু এই তল্লাটের সব খবর রাখি।

ফ্রান্সিস বুঝে উঠতে পারল না। কী বলবে তবে এটা বুঝল যা-ই বলুক না কেন এন্তানো ওদের চোর অপবাদ দেবেই। তার ওপর জলদস্যু বলে ওদের বদনাম তো আছেই। তাই ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। এন্তানো রোগা যোদ্ধাটির দিকে তাকাল। বলল, ওদের কয়েদঘরে নিয়ে যাও। শাঙ্কো মৃদুস্বরে দেশীয় ভাষায় বলল, আবার কয়েদঘর। ফ্রান্সিসও সেই ভাষায় বলল, উপায় নেই। ও যা বলে সে ভাবেই চলতে হবে।

পালাব না? শাঙ্কো জানতে চাইল।

সব দেখে বুঝে তবে। এখন চলো, বলে এগোল ফ্রান্সিস।

রোগা যোদ্ধাটির পেছনে পেছনে ওরা চলল। ওদের অনুমান ঠিক! সেই পাথরের ঘরের শক্ত কাঠের দরজার সামনে আনা হল ওদের। তিনজন প্রহরী দাঁড়িয়ে। তারা ঘরের তালা খুলে দরজা খুলে দিল। ফ্রান্সিসরা ঢুকল।

ঘর অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার বাড়ল। ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে রইল।

আস্তে আস্তে অন্ধকার চোখে সয়ে এল। ওরা দেখল মেঝেয় শুকনো ঘাস বিছানো। আর তিন-চারজন কালো মানুষ বন্দী সেখানে। তারা ফ্রান্সিসদের একবার শুধু দেখল। বুঝল না দলপতি নিজে শ্বেতাঙ্গ হয়ে সেই সাদা মানুষদেরই বন্দী করল কেন?

ফ্রান্সিস বিছানো ঘাসে শুয়ে পড়ল। আবার কয়েদঘরের একঘেয়ে অসহ্য জীবন! কিন্তু কিছুই করার নেই। দরজার দিকে তাকাল। পালাবার ছক কষতে হলে ঘরের সব কিছু ভালোভাবে দেখতে হয়। ঘরটায় কোনো জানালা নেই। দরজায় কিছু ফঁকফোঁকর করা। ওখান দিয়েই যা আলো-বাতাস আসছে।

একজন বন্দী ফ্রান্সিসকে জিগ্যেস করল, তোমরা তো দলপতি বিন্তোনের মতো সাদা মানুষ। তোমাদের বন্দী করল কেন?

আমরা নাকি এন্তানোর দামি পাথর চুরি করতে এসেছি।

আমাদেরও চোর বলেছে। বন্দী করেছে। পালাতে হবে। কালো যুবকটি বলল।

দেখো চেষ্টা করে পারো কিনা। ফ্রান্সিস বলল।

পরদিন সকালে ওদের সামান্য খাবার দিল। সবজির ঝোল আর একটা করে পোড়া রুটি। শাঙ্কো প্রতিবাদ করল, এত কম খাবার দিলে হবে? এই খেয়ে কি খিদে মেটে?

সেটা দলপতিকে বলো। তার হুকুমেই দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশনকারী বলে চলে গেল।

একটু বেলায় কয়েদঘরের দরজা খুলে গেল। এক প্রহরী ঢুকে জিগ্যেস করল, ভাইকিং কারা?

আমরা দুজন। শাঙ্কো বলল।

চলো, দলপতি ডেকেছে।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এল। চলল প্রহরীদের প্রহরায় এন্তানোর ঘরের দিকে।

আধো-অন্ধকার ঘরে ঢুকল দুজনে। এন্তানো সেই একইভাবে কাঠের আসনে বসে আছে। ওদের দেখে হেসে বলল, কেমন আছ তোমরা?

ভালো নেই। আধপেটা খেতে হচ্ছে শাঙ্কো জানাল।

ঠিক আছে। খাবারের পরিমাণ বাড়ানো হবে। এন্তানো বলল। তারপর যোগ করল, তোমাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আছে।

আপনার চরেরা বলেছে বোধহয়? ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ। তাছাড়া যে বুড়োটার সঙ্গে তোমরা কথা বলেছিলে তাকেও নিয়ে আসা হয়েছিল। সে বলেছে, তোমরা নাকি সুলতান হানিফের গুপ্ত স্বর্ণভাণ্ডারের কথা জানতে চেয়েছিলে?

মিথ্যে কথা। আমরা জানতে চেয়েছিলাম পোর্তুগাল কতদূর। ফ্রান্সিস বলল।

উঁহু, এন্তানো মাথা নাড়ল। তোমরা সুলতান হানিফের গুপ্ত স্বর্ণভাণ্ডারের কথা জানতে চেয়েছিল।

আমরা এই প্রথম সুলতান হানিফের নাম জানলাম। বৃদ্ধ এটুকু বলেছিল যে, দেড়শো দু’শো বছর আগে এখানে একজন সুলতান রাজত্ব করে গেছেন। সুলতানের স্বর্ণভাণ্ডার নিয়ে আমরা কিছুই জানি না। ফ্রান্সিস বলল।

বিশ্বাস হচ্ছে না। এন্তানো মাথা নাড়ল।

ঠিক আছে সেই স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করে দেব। ফ্রান্সিস বলল।

এন্তানো বেশ চমকে উঠল, দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে আমি সেই স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারিনি। আর তুমি কালকে এসে বলছ পারবে!

হ্যাঁ, পারব, ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে জানাল। শাঙ্কো একবার ফ্রান্সিসের প্রতিজ্ঞাদৃঢ় মুখের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস এখনই এতটা নিশ্চিত হচ্ছে কেন? মৃদুস্বরে সে বলল, এতটা নিশ্চিত হয়ো না।

উপায় নেই। মুক্তি পেতে হবে। ফ্রান্সিসও তেমনি মৃদুস্বরে বলল।

বিস্ময়ের বদলে এন্তানের মনে এবার উঁকি দিল সন্দেহ। সে বলল, তোমরা স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করে সব সোনা নিয়ে পালিয়ে যাবে!

একটা সোনার টুকরোও নেব না। ফ্রান্সিস তাকে অভয় দিল।

এবার শাঙ্কো ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল, এই বন্ধু অনেক গুপ্ত ধনভাণ্ডার বুদ্ধি খাটিয়ে পরিশ্রম করে উদ্ধার করেছে। আপনি ওকে বিশ্বাস করতে পারেন।

বেশ! দেখো চেষ্টা করে। এন্তানো অবিশ্বাসের সুরে বলল।

আমি সুলতান হানিফের কথা, স্বর্ণভাণ্ডারের কথা বিস্তৃতভাবে জানতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।

তাতে লাভ?

এইসব ইতিহাসের মধ্যেই থাকে গুপ্তধনের সূত্র। আপনি বলুন। ফ্রান্সিস বলল।

এন্তানো বলতে শুরু করল, সুলতান হানিফের জন্ম পারস্যে। ভাগ্যান্বেষণে মিশরে আসে। সেখান থেকে জাহাজে করে এখানে। পথে জলদস্যুদের পাল্লায় পড়ে। জাহাজ। লুঠ হয়। হানিফ সেই জলদস্যুদের দলে ঢুকে পড়েছিল। সেই দস্যুরা বেশ কিছু জাহাজ লুঠ করেছিল। লুণ্ঠিত বেশ কিছু জাহাজ লুঠ করেছিল। লুণ্ঠিত সোনা-হীরে মণি-মুক্তো লুকিয়ে রাখার জন্য দ্বীপ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হানিফ চোরের ওপর বাটপাড়ি করল।

কী রকম! ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

একদিন গভীর রাতে জাহাজে রাখা ধনসম্পত্তি সব চুরি করে একটা নৌকায় চড়ে পালিয়ে গিয়েছিল হানিফ। সমুদ্রের উঁচু উঁচু ঢেউয়ের সঙ্গে লড়ে একসময় এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল। বেশ অর্থ ব্যয় করে ঐ পাহাড়ের নীচে বিরাট বাড়ি তৈরি করেছিল, এখন সেটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আর নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করে দিল। এখানকার কালো অধিবাসীরা ওকে স্বীকারও করে নিয়েছিল।

তারপর? ফ্রান্সিস বলল।

সুলতান হানিফের ইচ্ছে হল, সে আরো ধনী হবে। সোনার ভাণ্ডার গড়ে তুলবে। উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে এখানকার কিছু বলশালী যুবকদের নিয়ে সে একটা লুঠেরার দল গড়ে তুলল। শক্তপোক্ত একটা জাহাজও কিনল।

তারপর এই সুমদ্রে যাতায়াতকারী জলদস্যুদের জাহাজ আক্রমণ করতে লাগল। জলদস্যুদের হারিয়ে দিয়ে সে তাদের ধনসম্পদ লুঠ করতে লাগল। যাত্রীবাহী জাহাজও ও বাদ গেল না। দিনে দিনে তার সংগ্রহ করা সোনা বেড়েই চলল।

এন্তানো থামল। তারপর আবার বলতে লাগল–এ কাহিনীর সঙ্গে আমার এক পূর্বপুরুষ জড়িয়ে আছে। তিনিও এন্তানো নামে পরিচিত ছিলেন। আসলে আমরা পূর্বপুরুষদের নাম বহন করি কিনা, তাই।

বলেন কি? আপনার এক পূর্বপুরুষ জলদস্যু ছিল? ফ্রান্সিস একটু অবাক হয়েই বলল।

হ্যাঁ। সেই এন্তানো জলদস্যুদের দলে ঢুকেছিলেন। পরে ক্যাপ্টেন হয়ে ছিলেন।

অনেকে কিন্তু বংশের সঙ্গে জলদস্যুদের সম্পর্ক স্বীকার করে না। ফ্রান্সিস বলল।

আমি স্বীকার করি। যা সত্য তা জানাতে লজ্জা বা ভয় করি না।

ঠিক আছে। বলুন ফ্রান্সিস বলল।

সুলতান হানিফ একদিন ক্যাপ্টেন এন্তানোব জাহাজ আক্রমণ করে বসল। আর সেটাই হল মস্ত ভুল। ক্যাপ্টেন এন্তানের জলদস্যুরা ছিল অভিজ্ঞ যোদ্ধা। সংখ্যাতেও বেশি। হানিফ হার স্বীকার করতে বাধ্য হল। কিন্তু তাকে বন্দী করা গেল না। বন্দিত্বের অপমান এড়াতে সে তরোয়াল বিঁধিয়ে আত্মহত্যা করল। তার স্বর্ণভাণ্ডার গুপ্তই রয়ে গেল। এন্তানো থামল।

ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, সুলতান হানিফ কি কোনো সূত্র রেখে যাননি?

সূত্র বলতে যা বোঝায় তেমন কিছুনয়। এসব কাহিনি আমাদের পরিবারে অনেকদিন যাবৎ চলে আসছে।

তা থেকে কিছু জানা আছে আপনার? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

হ্যাঁ, একটা ব্যাপার জানি। কিন্তু সেটা কোনো সূত্র কিনা বলতে পারবনা।

তবু আপনি বলুন। ফ্রান্সিস আগ্রহী হল।

সুলতান হানিফ আত্মহত্যা করলে তার পোশাক তল্লাশি করেছিলেন আমার পূর্বপুরুষ এক ক্যাপ্টেন এন্তানো পেয়েছিলেন একটা সাদা চামড়ার টুকরো। তাতে গোলমতো আঁকাবাঁকা রেখা। দুর্বোধ্য।

ফ্রান্সিস বেশ চমকে উঠল। সেই চামড়ার টুকরোটা কোথায়?

আমার কাছেই আছে। ওটা দেখেই তো সন্ধান চালিয়েছিলাম।

ওটা দেখতে পারি?

দেখতে দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু স্বর্ণভাণ্ডারের সন্ধান পেলে সব আমার। তুমি কিন্তু কিছুই পাবে না। এন্তানো বলল।

আমি তো আগেই বলেছি। স্বর্ণভাণ্ডারের ওপর আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই।

বেশ। তাহলে দেখো। এই বলে এন্তানো পোশাকের ভেতর থেকে চামড়ার টুকরোটা বের করে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস দেখল একটা কালচে হয়ে যাওয়া চামড়ার টুকরো। একপিঠে আঁকাবাঁকা গোলমতো দাগ। নীচে মনে হল মাত্র দুটো শব্দ আরবী অক্ষরে লেখা।

নীচে কী লেখা? ফ্রান্সিস দেখতে দেখতে বলল।

একজন আরবদেশীয় লোককে দিয়ে পড়িয়েছিলাম, সে বলেছিল ওতে নাকি দুটো শব্দ লেখা–সূর্য দর্শন।

এই আঁকাবাঁকা রেখাগুলো কী মনে হয় আপনার? ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল।

গুহামুখ এন্তানো বলল।

ঐ পাহাড়ে তাহলে একটা গুহা আছে।

হ্যাঁ। আর আছে একটা হ্রদমতো।

হ্রদ? পাহাড়ের মধ্যে? ফ্রান্সিস একটু অবাকই হল।

হ্যাঁ। প্রকৃতির খেয়াল। এন্তানো বলল।

সব দেখতে হবে। নকশাটা আমি রাখব?

ঠিক আছে। ওটা হারিও না যেন।

না-না। আমি যত্ন করে রেখে দেব। এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। কোনোমতেই হারানো চলবে না। কিন্তু একটা কথা, কয়েদঘরে বসে তো এই নকশার রহস্য সমাধান করা যাবে না। আমাদের চলাফেরায় স্বাধীনতা দিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

তোমরা যদি স্বর্ণভাণ্ডার খোঁজার নাম করে পালিয়ে যাও! এন্তানো বলল।

সঙ্গে দুজন সশস্ত্র প্রহরী দিন। তাহলে নিরস্ত্রআমরা পালাতে পারবনা, প্রস্তাব দিল ফ্রান্সিস।

বেশ। তাহলে দুজন নয়, তিনজন সশস্ত্র প্রহরী তোমাদের পাহারা দেবে।

তাহলে আজ দুপুর থেকেই কাজে নামব। ফ্রান্সিস বলল।

কোনো আপত্তি নেই। প্রহরীদের বলে দিচ্ছি। এন্তানো বলল।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো দুপুরে খেতে বসল। এবেলা খাবারের পরিমাণ বেশি। ফ্রান্সিস হাসল। শাঙ্কো বলল, তুমি হাসছ?

খাবার কত বাড়িয়ে দিয়েছে দেখেছ! সোনার লোভ বড় সাংঘাতিক।

তুমি এত নিশ্চিত হয়ে বললে, না পারলে ভীষণ বিপদে পড়ব।

আগে সব দেখি শুনি। এই চামড়ার টুকরোয় আঁকা নকশার রহস্যের সমাধান নিশ্চয়ই করতে পারব। তাহলেই সুলতান হানিফের স্বর্ণভাণ্ডার হাতের মুঠোয়।

আজ থেকেই কাজ শুরু করবে?

হ্যাঁ। দেরি করব না। আমাদের দেরি দেখলে বন্ধুরা চিন্তায় পড়বে। ফ্রান্সিস খেতে খেতে বলল।

খাওয়া শেষ হলে একজন প্রহরী এগিয়ে এল। সে বলল, চলো। তোমরা নাকি সোনা খুঁজতে যাবে? আমরা তিনজন তোমাদের পাহারা দেব।

হ্যাঁ। সেই কথাই হয়েছে। দুটো মশাল নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।

দুজনে কয়েদঘরের বাইরে বেরিয়েএল। সবাই পাহাড়মুখো চলল। প্রহরীর একজনের হাতে দুটো নেভানো মশাল।

পাহাড়ের কাছে এসে গুহামুখটা দেখতে পেল ফ্রান্সিস। সে কোমরের ফেট্টিতে গোঁজা চামড়ার টুকরোটা বের করল। গুহামুখের সঙ্গে মেলাল। মাথা নেড়ে বলল, এন্তানো ভুল দেখেছে। গুহামুখের সঙ্গে আঁকাবাঁকা রেখার কোনো মিল নেই।

তাহলে এই আঁকাবাঁকা রেখা কীসের? শাঙ্কো জানতে চাইল।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।

প্রহরীর একজন চকমকি ঠুকে মশাল দুটো জ্বালাল। তারা সবাই ঢুকল অন্ধকার গুহার ভেতরে। মশালের আলোয় দেখল চারপাশে এবড়ো-খেবড়ো পাথর। ছাদ এত নিচু যে মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। কিছুটা গিয়েই অবশ্য ছাঁদ উঁচু হল। তখন সোজা হয়ে ওরা এগিয়ে চলল।

হঠাইআলোর ঝলকানি। সামনেই একটা ছোট জলাশয়। এটাকে বলা যায় না। তেমন বড় কিছুনয়। জলাশয়েরতীরেদাঁড়িয়ে ওপরেতাকাতেইফ্রান্সিস অবাক। ওপরটায় বেশকিছুটা জায়গা জুড়ে ফঁকা। আকাশ দেখা যাচ্ছে। সূর্য অবশ্য সরে গেছে। তবে তার আলো আসছে। তাই জলাশয় এলাকাটা মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওপর থেকে কি অতীতে কখনও বিরাট পাথরের চাই ভেঙে পড়েছিল? তাই কি ওপরটা ফঁকা? ফ্রান্সিসের ভাবনার মধ্যে শাঙ্কো বলে উঠল, গুহা তো এরপরেই শেষ। এখানে কিআর কিছু দেখার আছে?

না। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, এবার পাহাড়ের ওপরটা দেখব, চলো।

শাঙ্কো প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে বলল, চলো, ওপরে ওঠা যাক।

সবাই গুহা থেকে বেরিয়ে এল। তারপর পাথরে পা রেখে রেখে ওপরে উঠতে লাগল। বেশ কিছুটা উঠতেই সেই ফাঁকা জায়গাটায় এল। ফ্রান্সিস পাথরে ভর রেখে ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নীচে জলাশয়টার দিকে তাকাল। জলাশয়টা মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উঠে আসবে হঠাৎ জলাশয়ের চারপাশের পাড়টা কেমন পরিচিত মনে হল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে কোমরের ফেট্টিতে গোঁজা চামড়ার টুকরোটা বের করল। আঁকাবাঁকা রেখা।

আশ্চর্য! জলাশয়ের পাড়ও তো এমনি আঁকাবাঁকা। ও আবার পাথরে ভর রেখে ফাঁকা জায়গাটায় ঝুঁকে পড়ল। জলাশয়ের আঁকাবাঁকা পাড়টা দেখল। নকশার সঙ্গে মেলাল। হুবহু এক। জলাশয়টির পাড়ই নকশাটাতে আঁকা হয়েছে। ও গলা চড়িয়ে ডাকল, শাঙ্কো। শাঙ্কো তখন আরও ওপরে উঠতে যাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের কাছে এসে বলল, কী ব্যাপার? ফ্রান্সিস ওর হাতে নকশাটা দিল। বলল, ঝুঁকে পড়ে নীচের জলাশয়টার দিকে তাকাও। দেখ ওটার আঁকাবাঁকা পাড়ের সঙ্গে নকশার আঁকাবাঁকা রেখা মেলে কিনা!

শাঙ্কো পাথরে ভর রেখে ফাঁকটার মধ্যে দিয়ে জলাশয়টার দিকে তাকাল। তারপর নকশাটা বের কর জলাশয়ের আঁকাবাঁকা পাড়ের সঙ্গে মেলাল। ও অবাক হয়ে গেল। দুটো হুবহু মিলে যাচ্ছে। শাঙ্কো লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধ্বনি তুলল, ও–হো–হো

ফ্রান্সিস হেসে ভাইকিংদের ভাষায় বলল, ঐ জলাশয়েই আছে সুলতান হানিফের গুপ্ত স্বর্ণভাণ্ডার।

–কিন্তু সূর্য দর্শন? শাঙ্কো জানতে চাইল।

তার মানে সূর্য যখন মাথার ওপরে আসবে, উজ্জ্বল রোদ পড়বে, নীচে জলাশয় স্পষ্ট দেখা যাবে। ফ্রান্সিস বলল।

তাহলে কী করবে এখন?

ফিরে যাব। এখন সূর্য সরে গেছে।

জলাশয়ের জলে স্পষ্ট কিছুই দেখা যাবে না। কাল জলাশয়ে নামব যখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর থাকবে।

ফিরে আসার সময় ফ্রান্সিস একজন প্রহরীকে বলল, তোমাদের দলপতি এন্তানো তো আমাদের জাহাজে যেতে পারবে না। অথচ প্রায় কুড়ি হাত লম্বা শক্ত দাঁড় চাই। তোমরা দিতে পারবে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কয়েদঘরেই দড়ি রাখা আছে। প্রহরীটি জানাল।

প্রহরীদের সঙ্গে ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরে ফিরে এল।

শাঙ্কো, দেখো তো এখানে দড়ি আছে কিনা। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়তে পড়তে বলল। শাঙ্কে এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে দড়ি পেল। দড়িটা টেনেটুনে বুঝল শক্ত দড়ি। ওরা অভিজ্ঞ, সহজেই দড়ি কত শক্ত বুঝতে পারে।

পরদিন দুজনে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। তারপর প্রহরীদের পাহারায় ওরা যখন জলাশয়ের ধারে পৌঁছল তখন সূর্য প্রায় মধ্যগগনে।

ওরা অপেক্ষা করতে করতেই সূর্য ফাঁকা জায়গাটার মাথায় এল। চড়া রোদ পড়ল জলাশয়ে।

শাঙ্কো দড়ি চেপে ধরল। ফ্রান্সিস দড়ি ধরে ধরে জলাশয়ে নামল। জলের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারদিক।

এবার চিন্তা–কোথায় থাকতে পারে সেই গুপ্তস্বর্ণভাণ্ডার ফ্রান্সিস এবড়ো খেবড়ো পাথুরে দেওয়ালের গায়ে হাত দিয়ে দেখে দেখে খুঁজতে লাগল কোনো গোপন গহ্বর পায় কিনা।

হঠাৎ কী যেন সাঁৎ করে সরে গেল।

ফ্রান্সিস ঘুরে তাকাল। হাঙর! ভীষণভাবে চমকে উঠল ফ্রান্সিস। দড়ি ধরে সে মারল এক হঁচকা টান। ওপরে শাঙ্কো তার সংকেত পেয়ে তাড়াতাড়ি দড়িটা গোটাতে শুরু করল। ফ্রান্সিস দড়িটা দু’পায়ে জড়িয়ে ধরল, ফলে দড়ির সঙ্গে সেও উঠতে লাগল ওপরে। ওদিকে হাঙরটা ছুটে আসছে। ফ্রান্সিস প্রায় তখন পৌঁছে গেছে। সে এক লাফ দিয়ে পাড়ে উঠে পড়ল। ভয়ে উত্তেজনায় সে তখন হাঁপাচ্ছে।

কী হল, লাফিয়ে উঠে পড়লে যে? শাঙ্কোর স্বরে রাজ্যের বিস্ময়।

হাঙর, কোনো রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দিল ফ্রান্সিস।

বলো কী? এখানে! শাঙ্কো স্তম্ভিত।

হ্যাঁ। দেখছো না সমুদ্র একেবারে পাহাড়ের ধারেই। নিশ্চয় এই জলাশয়ের সঙ্গে সমুদ্রের যোগ আছে।

নির্ঘাত আছে, নইলে এখানে হাঙর আসবে কোথা থেকে? তা এখন কী করবে?

আবার নামব। হাঙরটাকে মারতে হবে। প্রহরীদের কাছ থেকে একটা তরোয়াল চেয়ে আনো।

শাঙ্কো প্রহরীদের কাছে গিয়ে হাঙরের ব্যাপারটা বলল। শুনে তারাও কম আশ্চর্য হল না। তারপর যখন শুনল ফ্রান্সিস তরোয়াল নিয়ে জলে নামবে তখন তাদের মুখে আর কথা যোগায় না। এই বিদেশিটা জলের মধ্যে একা হাঙরের সঙ্গে লড়াই করবে? সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে একজন তার তরোয়াল তুলে দিল শাঙ্কোর হাতে।

তরোয়াল পেয়ে আবার ডুব দিল ফ্রান্সিস। আস্তে আস্তে নামতে লাগল নীচে। দাঁত দিয়ে তরোয়াল চেপে ধরে আছে। ওই তো হাঙরটা! দড়ি ছেড়ে এবার হাত ও পায়ে আস্তে জল ঠেলে এক জায়গায় স্থির হয়ে রইল সে। ভয়াল বিভীষিকা তার চারপাশে ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে এক কোনার দিকে গিয়েই সেটা ছুটে এল ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে। হাঙরটা যে এভাবে আক্রমণ করবে ফ্রান্সিস সেটা আগেই আঁচ করেছিল তাই সে দ্রুত জল ঠেলে আরও কিছুটা নীচে নেমে গেল। তরোয়াল নিল হাতে। হাঙর তখন তার মাথার ওপর এসে গেছে। ফ্রান্সিস শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে তরোয়ালটা হাঙরের পেটে ঢুকিয়ে দিল। নরম শরীর ভেদ করে সেটা প্রায় অর্ধেকটা ঢুকে গেল। জল উঠলো লাল হয়ে। ফ্রান্সিস তরোয়াল টেনে বার করেই দড়ি ধরে ঝকানি দিতে শুরু করল। শাঙ্কো তৈরি ছিল। তাড়াতাড়ি দড়ি টেনে ফ্রান্সিসকে তুলে নিল ওপরে।

হাঙরটা মরেছে? শাঙ্কো জিগ্যেস করল।

এখুনি মরবে। ওর হৃৎপিণ্ড ফুটো করে দিয়েছি। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস বলল।

এখন কি ফিরে যাবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।

ফ্রান্সিস ওপারের দিকে তাকাল। সূর্য সরে গেছে। তবে উজ্জ্বল রোদ এখনও আসছে। –না আবার নামব। এখনও আলো আছে। ফ্রান্সিস বলল।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে ফ্রান্সিস আবার দড়ি ধরে জলে নামল। নীচে নামতেই দেখল তিনটে হাঙর ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা বড়, দুটো ছোট। মৃত হাঙরের চিহ্নমাত্র নেই। ওরা খেয়ে ফেলেছে।

ফ্রান্সিসকে আবার ওপরে উঠে আসতে হল। শাঙ্কো বলল, কী হল, উঠে এলে যে?

ফ্রান্সিস বলল তিনটে হাঙর এসেছে। এখন আর নামা যাবে না। আলোও কমে আসছে। ফিরে চলো। কালকে এ সময় আসতে হবে।

দড়ি তুলে নিয়ে ওরা ফিরল।

জলের লাল রং দেখে প্রহরীরা বুঝেছিল হাঙরটা তরোয়ালের ঘা খেয়ে মারা গেছে। ওরা বেশ সমীহ নিয়ে ফ্রান্সিসকে দেখতে লাগল। একা একটা তরোয়াল দিয়ে হাঙর মেরে ফেলল?

বিকেলের দিকে এন্তানো কয়েদঘরের দরজার কাছে এল। ফোকর দিয়ে তাকিয়ে বলল, ওখানে জলে নাকি হাঙর আছে।

হ্যাঁ। একটাকে মেরেছি। এখনও তিনটে আছে। ফ্রান্সিস বলল।

বুঝেছি। সমুদ্রের সঙ্গে এই জলাশয়ের যোগ আছে। একটা সুড়ঙ্গ মতো আছে সমুদ্রের দিক থেকে।

এটা আগে বলেননি।

তুমি ঐ জলাশয়ে নামবে তা তো আমি জানতাম না। যাক গে, স্বর্ণভাণ্ডারের হদিস পেলে কিছু?

এখনও সন্ধান পাইনি। কালকে যাব। দেখি।

দেখো চেষ্টা করে। তোমাদের মাংস-টাংস খেতে দিতে বলেছি। এন্তানো হেসে বলল।

হ্যাঁ। এখন খাবারটাবার ভালোই পাচ্ছি। শাঙ্কো বলল।

এন্তানে চলে গেল।

ফ্রান্সিস ডাকল, শাঙ্কো!

বলো। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।

এন্তানো ভালো করেই জানে ঐ জলাশয়ে হাঙর আসে। হয়তো সারা পাহাড় খুঁজেছে। কোনো হদিস না পেয়ে কতকটা আন্দাজে ঐ জলাশয়ে লোকজন নামিয়েছিল। হাঙরের মুখ থেকে কেউ বেঁচে ফেরেনি। এন্তানো সব জানে। শুধু জানে না গুপ্ত স্বর্ণভাণ্ডার কোথায় আছে। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।

পরেরদিন ফ্রান্সিসরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। আবার প্রহরীদের পাহারায় চলল পাহাড়ের দিকে।

গুহার কাছে এসে এবার ফ্রান্সিস ভালোভাবে চারদিকে দেখল। পাহাড়ের বাঁপাশ পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। সুড়ঙ্গ থাকলে ওখানেই আছে। ডানপাশে সুলতান হানিফের বাড়ির ধ্বসস্থূল্প।

ওরা গুহায় ঢুকল। মাথা নিচু করে কিছুটা জায়গা পার হল। সামনেই জলাশয়। এখানে আলো আছে।

শাঙ্কো দড়ির একটা মাথা জলে ফেলে অন্য মাথাটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস দড়ি ধরে বলল, শাঙ্কো, তুমি একা ঠিক পারবেনা। ওদেরও সময়মতো দড়ি ধরে টানতে বলো।

শাঙ্কো প্রহরীদের কাছে ডাকল। তিনজন এগিয়ে এলে শাঙ্কো বলল, আমি বললে দড়ি ধরে টানতে শুরু করবে।

আবার তোমার বন্ধু হাঙরের পাল্লায় পড়বে নাকি? একজন প্রহরী বলল

দেখা যাক। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল। তারপর দড়ি ধরে জলে নামল। সূর্যের আলো তখন সরাসরি জলাশয়ের ওপর পড়ল। ফ্রান্সিস ডুব দিয়েই দেখল হাত কয়েক দূরে হাঙর তিনটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দড়িতে হ্যাঁচকা টান দিল। চারজন মিলে দড়ি টানতে লাগল। ফ্রান্সিস এবার বেশ দ্রুতই উঠে এল।

এখনও হাঙর আছে? শাঙ্কো জানতে চাইল।

হ্যাঁ। তিনটেই আছে।

কী করবে?

ওগুলোকে এখান থেকে তাড়াতে হবে।

কী করে?

ফ্রান্সিস শক্ত পাথরের ওপর শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, ভাবছি।

কিছু পরে ফ্রান্সিস উঠে বসল। বলল, ছক কষা হয়ে গেছে। ও একজন প্রহরীকে বলল, আমরা তো বন্দী। তুমি বাজার এলাকা থেকে মাংস নিয়ে এস।

কীসের মাংস?

শুয়োর, ঘোড়া, ভেড়া–যে কোনো মাংস। তিনটে ঠ্যাং আনবে। ফ্রান্সিস বলল।

দাম? প্রহরী হাত বাড়াল।

শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে একটা স্বর্ণমুদ্রা দিল। প্রহরীরা স্বর্ণমুদ্রা দেখে একটু অবাকই হল। একজন প্রহরী চলে গেল।

ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে প্রহরী তিনটে ভেড়ার ঠ্যাং নিয়ে এল। ফ্রান্সিস ঠ্যাং তিনটে নিয়ে বলল, চলো, সমুদ্রের দিকে যাব।

সবাই চলল। পাথরের ওপর পা রেখে রেখে সবাই সমুদ্রের ধারে এল। সমুদ্রের ঢেউ পাহাড়ের গায়ে ভেঙে পড়ছে। জল ছিটকে উঠছে। ফ্রান্সিস ঠ্যাং তিনটে কোমরে গুজল।

তারপর জলাশয় কোন দিকটায় সেটা বুঝে নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জলের তলাটা মোটামুটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল পাথরের গা। ডুব সাঁতার কাটতে গিয়ে হঠাৎই দেখল একটা প্রায় গোল মুখমত। ও বুঝল এখান দিয়েই সুড়ঙ্গের শুরু। জলের ওপর ভেসে উঠল ফ্রান্সিস। একটু দুরেই প্রহরীরা আর শাঙ্কো দাঁড়িয়ে আছে। বুকভরে দম নিয়ে ফের ডুব দিল। প্রায় অন্ধকার গুহামুখ দিয়ে ঢুকে পড়ল। দুত জল ঠেলে ডুব সাঁতার দিয়ে সুড়ঙ্গের অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর কোমরের ফেট্টি থেকে তিনটে ঠ্যাং বের করে একটু দূরে দূরে ঠ্যাংগুলো সুড়ঙ্গের এবড়ো-খেবড়ো মেঝেয় রেখে দিল।

দম ফুরিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস দ্রুত ডুবসাঁতার কেটে সুড়ঙ্গমুখে ফিরে এল। তারপর জল ঠেলে ওপরে ভেসে উঠল খোলা হাওয়ায়। মুখ হাঁ করে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল সে।

একটু ধাতস্থ হতে ধীরে সাঁতার কেটে তীরের দিকে এগিয়ে গেল ফ্রান্সিস। তীরের পেছল পাথরে পা রেখে রেখে উঠে এল।

ফ্রান্সিস, ঠ্যাং তিনটে কী করলে? শাঙ্কো বলল।

সুড়ঙ্গের মধ্যে রেখে এসেছি মাংসের গন্ধে এবার হাঙর তিনটে ওখানে চলে আসবে। তখন জলাশয় নিরাপদ। চলো, গুহার মধ্যে যাই। মাথার ওপর সূর্য থাকতে থাকতে জলাশয়ে নেমে খোঁজ শেষ করতে হবে।

সবাই গুহামুখ দিয়ে আবার জলাশয়ের কাছে এলো।

একটু বিশ্রাম করে নাও। শাঙ্কো বলল।

না-না, আলো চলে যাবে। শাঙ্কো বলল।

আবারও ফ্রান্সিস দড়ি ধরে জলাশয়ের জলে নামল। জলের মধ্যে দেখল হাঙর তিনটে নেই। দেরি করা যাবে না। যদি ওরা মাংস খাওয়া শেষ করে ফিরে আসে।

ফ্রান্সিস জল ঠেলে একেবারে নীচে নেমে এল। পাথুরে দেয়াল ধরে ধরে ডুব সাঁতার দিয়ে চলল।

না! পাথর ছাড়া কিছু নেই।

জল ঠেলে ওপরে উঠল। হাঁ করে শ্বাস ফেলল। দম নিল। আবার ডুব দিল। এবার অন্যদিকে। হাতড়ে চলল পাথরের দেয়াল।

হঠাৎ একটা প্রায় চৌকোনো পাথর হাতে ঠেকল। ফ্রান্সিস পাথরটা ধরে টানল। নড়ল পাথরটা। আবার প্রাণপণ জোরে টানল। চৌকোনা পাথর সবটা খুলল না।

খোঁজ পেলে? শাঙ্কো বলে উঠল।

প্রায়।

দম নিয়ে আবার ডুব দিল ফ্রান্সিস দ্রুত চৌকোনা পাথরের কাছে এল। আবার প্রাণপণে টানল। পাথরটা এবার খুলে এল। প্রায় অন্ধকার খোদল একটা। ভালো করে তাকাতে দেখল খোদলভর্তি সোনার চাকতি। অল্প আলোতেও চকচক করছে। ও দ্রুত হাতে দু’মুঠো সোনার চাকতি তুলে নিল। কোমরের ফেট্টিতে চেপে চেপে খুঁজতে খুঁজতে ওপরে উঠে আসতে লাগল।

দম ফুরিয়ে এসেছে। দ্রুত জল ঠেলে ওপরে উঠে আসতে লাগল। তখনই আবছা দেখল বড় হাঙরটাকে।

ফ্রান্সিস চমকে উঠল। হাঙরটা যে ছুটে আসছে! দড়িতে জোর হ্যাঁচকা টান দিল সে। ওপর থেকেশাঙ্কো আর প্রহরীরা দড়ি ধরে প্রাণপণে টেনে ওকে তুলতে লাগল। হাঙরও ধেয়ে আসছে পিছন পিছন। একেবারে শেষ মুহূর্তে তার দাঁতের ঘষা লাগল ফ্রান্সিসের হাঁটুতে। মাংস খুবলে এল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।

ততক্ষণে ওরা জল থেকে টেনে তুলে ফেলেছে ফ্রান্সিসকে। ফ্রান্সিস পাড়ে উঠে শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো ঝুঁকে পায়ের ওপর পড়ল। দরদর করে রক্ত পড়ছে ক্ষত দিয়ে। ফ্রান্সিস ডান হাতটা কপালের ওপর রেখে যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগল।

শাঙ্কো নিজের কোমরের ফেট্টি খুলে ফেলল। ছোরাটা পড়ে গেল। খুঁড়িয়ে নিয়ে কোমরে গুঁজে নিল। পাথরের ওপর টং টং শব্দ করে সাত-আটটা স্বর্ণমুদ্রা পড়ে গেল। একটা গড়িয়ে গেল জলে। শাঙ্কোর সেদিকে খেয়াল নেই। ও ক্ষতস্থানে ফেট্টিটা চেপে .. ধরল। রক্ত পড়া একটু বন্ধ হল। শাঙ্কো এবার ফেট্টিটা হাঁটুতে জড়িয়ে শক্ত করে বাঁধল। ফ্রান্সিস একটু ককিয়ে উঠল। শাঙ্কো গড়িয়ে পড়া সোনার চাকতি কটা কোমরে গুজল।

শাঙ্কোর আর জিগ্যেস করতে মন হল না ফ্রান্সিস স্বর্ণভাণ্ডারের খোঁজ পেয়েছে কিনা। সে তখন আহত ফ্রান্সিসকে নিয়ে উদ্বেগে কাতর। প্রহরীরাও এই আকস্মিক ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।

শাঙ্কো কোলের ওপর ফ্রান্সিসের মাথা তুলে নিল। ফ্রান্সিস চোখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করছে। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের মাথায় হাত বুলোতে লাগল। মুখে কথা নেই। প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। তবুওর চোখ দিয়ে জল পড়ল না। ও কাঁদলে ফ্রান্সিসের মন দুর্বল হয়ে পড়বে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টি থেকে তিনটে সোনার চাকতি বের করল। হেসে আস্তে আস্তে দুর্বলস্বরে বলল, শাঙ্কো, সুলতান হানিফের–স্বর্ণভাণ্ডারের সন্ধান-পেয়েছি।

ওসব কথা থাক। এখন কোনো কথা বলো না। কষ্ট বাড়বে। অশ্রুরুদ্ধ স্বরে শাঙ্কো বলল।

চোখ খুলে ফ্রান্সিস ওপরের ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকাল। মৃদুস্বরে বলল, সূর্যদর্শন।

শাঙ্কো আস্তে আস্তে বলল, জাহাজে চলো। ফ্রান্সিস আস্তে মাথা নাড়ল। বলল, না। এন্তানোর কাছে চলে। স্বর্ণভাণ্ডারের হদিসটা দিয়ে আসি।

বেশ চলো। হেঁটে যেতে পারবে? শাঙ্কো বলল।

দেখি। চেষ্টা করি। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে উঠে বসল। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের ডান হাতটা নিজের কাঁধে তুলে নিল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর ওপর ভর দিয়ে আস্তে আস্তে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল।

সবাই চলল। গুহার-এবড়ো-খেবড়ো মেঝের ওপর দিয়ে আহত ফ্রান্সিসের হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। শাঙ্কো প্রহরীদের বলল, ভাই তোমরাও ওকে ধরো। প্রহরীরা দুজন এগিয়ে এল।

ফ্রান্সিসকে নিয়ে সবাই আস্তে আস্তে গুহা থেকে বেরিয়ে এল। চলল এন্তানোর বাড়ির দিকে।

বেশ সময় লাগল ওদের পৌঁছতে কয়েদঘরের সামনে এলে একজন প্রহরীকে ফ্রান্সিস বলল, এন্তানোকে খবর দাও। প্রহরীটি চলে গেল।

এন্তানো প্রহরীটির কাছেই সব শুনেছিল। প্রায় ছুটে এল।

ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সব চলল। এন্তানো খুব খুশি। এবার শাঙ্কো বলল, আমরা জাহাজে ফিরে যাব। আপনার দুজন প্রহরীকে সঙ্গে যেতে বলুন।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। এন্তানো বলে উঠল। যে দুজন প্রহরী ফ্রান্সিসকে ধরে ধরে নিয়ে এসেছিল তাদের বলল, ওদের জাহাজে পৌঁছে দিয়ে এসো।

ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টি থেকে বেশ কিছু সোনার চাকতি আস্তে আস্তে বের করল। সেগুলো এন্তানোর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, এই নিন। এন্তানো লাফিয়ে এগিয়ে এল। শাঙ্কোও পোশাকের মধ্যে থেকে স্বর্ণমুদ্রাগুলো রেখে সোনার চাকতিগুলো এন্তানোর হাতে দিল। এন্তানো খুশিতে প্রায় লাফাতে লাগল।

ফ্রান্সিসকে ধরে ধরে সবাই চলল। জাহাজঘাটের দিকে। ফ্রান্সিস খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলল।

পথে শাঙ্কো লক্ষ্য করল ফ্রান্সিসের পায়ে বাঁধা ফেট্টির কাপড়টা রক্তে ভিজে উঠেছে। রক্ত-পড়া বন্ধ হয়নি।

শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রহরীদের বলল, কাঁধে করে নিয়ে চলো। বেশ রক্ত পড়ছে। হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া চলবে না। রক্ত পড়ে ও দুর্বল হয়ে পড়বে।

না না, হেঁটে যেতে পারব। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।

চুপ করে থাকো। শাঙ্কো প্রায় ধমকের সুরে বলল। তিনজনে ফ্রান্সিসকে কাঁধে তুলে নিল।

শেষ বিকেলে জাহাজঘাটে পৌঁছল ওরা। পাটাতন দিয়ে উঠছে, হ্যারি রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। ও চেঁচিয়ে উঠল, এসো সবাই। ফ্রান্সিস আহত।

বন্ধুরা ছুটে এল ডেক-এ। হ্যারির কথা মারিয়া অস্পষ্ট শুনল। ও বুঝল না ঠিক কী হয়েছে। ও এ সময় সূর্যাস্ত দেখতে যায়। তাই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। তখনই ফ্রান্সিসের বন্ধুদের গুঞ্জন শুনল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আহত ফ্রান্সিসকে কাঁধে নিয়ে বন্ধুরা দরজার সামনে এল। মারিয়া কেমন বিমূঢ় হয়ে গেল। বন্ধুরা ফ্রান্সিসকে বিছানায় শুইয়ে দিল। এতক্ষণে ফ্রান্সিসের রক্তমাখা দেখে মারিয়া হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।

ফ্রান্সিস তাকে অভয় দিয়ে বলল,

কেঁদো না। সামান্য কেটেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যাব। এ কথায় মারিয়া সান্ত্বনা পেল না। ও একইভাবে কাঁদতে লাগল।

ততক্ষণে শাঙ্কো ভেনকে ডেকে এনেছে। ভেন ওর বদ্যি-ঝোলা ওষুধ বয়াম নিয়ে এসে লেগে পড়ল ফ্রান্সিসের চিকিৎসায়। শাঙ্কো, বিস্কো, সিনাত্রা ফ্লেজার, আর সব বন্ধুরা নিশ্চুপ হয়ে দেখতে লাগল। মনে মনে বিশ্বাস, ভেন থাকতে ফ্রান্সিসের বিপদ হবে না। ও ঠিক সেরে উঠবে। সূর্য বিদায় নিলেও কাল নতুন আশার আলো নিয়ে সে উদয় হবে। বন্ধুরা সব নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল।

No comments