অযান্ত্রিক – সুবোধ ঘোষ

অযান্ত্রিক – সুবোধ ঘোষ

বিমলের একগুঁয়েমি যেমন অব্যয়, তেমনি অক্ষয় তার ঐ ট্যাক্সিটার পরমায়ু। সাবেক আমলেরএকটা ফোর্ড, প্রাগৈতিহাসিক গঠন, সর্বাঙ্গে একটা কদর্য দীনতার ছাপ। যে নেহাত দায়ে পড়েছে বা জীবনে মোটর দেখেনি, সে ছাড়া আর কেউ ভুলেও বিমলের ট্যাক্সি ছায়া মাড়ায় না। দেখতে যদি জবুথবু, কিন্তু কাজের বেলায় বড়ই অদ্ভুতকর্মা বিমলের এই ট্যাক্সি বড় বড়চাঁইগারির পক্ষে যা অসাধ্য, তা ওর কাছে অবলীলা। এই দুর্গম অভ্রখনি অঞ্চলের ভাঙাচোরা ভয়াবহ জংলীপথে, ঘোর বর্ষার রাতে, যখন ভাড়া নিয়ে ছুটতে সব গাড়িই নারাজ, তখন সেখানে অকুতোভয়ে এগিয়ে যেতে পারে শুধু বিমলের এই পরম প্রবীণট্যাক্সিটি। তাই সবাই যখন জবাব দিয়ে সরে পড়ে, একমাত্র তখনি শুধু গরজের খাতিরে আসে তার ডাক, তার আগে নয়।

ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে সারি সারি জমকালো তরুণ নিউ মডেলের মধ্যে বিমলের বুড়ো ফোর্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমোয়, জটায়ুর মতো তার জরাভাব নিয়ে। বাস্তবিক বড় দৃষ্টিকটু। তালিমারা হুড, সামনের আর্শিটা ভাঙা, তোবড়ানো বনেট, কালিঝুলি মাখা পরদা আর চারটে চাকার টায়ার পটি লাগানো; সে এক অপূর্ব শ্রী। পাদানিতে পা দিলে মাড়ানো কুকুরের মতো ক্যাঁচ করে আর্তনাদ করে ওঠে। মোটা তেলের ছাপ লেগে সিটগুলো এত কলঙ্কিত যে, সুবেশ কোনো ভদ্রলোককে পায়ে ধরে সাধলেও তাতে বসতে রাজি হবে না। দরজাগুলো বন্ধ করতে বেশ বেগ পেতে হয়, আর যদিও বন্ধ হলো তো তাকে খোলা হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য। সিটের ওপর বসলেই উপবেশকের মাথায় আর মুখে এসে লাগবে ওপরের দড়িতে ঝোলানো বিমলের গামছা, নোংরা গোটা দুই গেঞ্জি আর তেলচিটে আলোয়ান।

বিমলের গাড়ির দূরায়ত ভৈরবহর্ষ শোনামাত্র প্রত্যেকটি রিকশা সভয়ে রাস্তার শেষ কিনারায় সরে যায়। অতি দুঃসাহসী সাইকেলওয়ালারা বিমলের ধাবমান গাড়ির পাশকাটিয়ে যেতে বুক কাঁপে। রাত্রির অন্ধকারে একেকবার দেখা যায় দূর থেকে যেন একটা একচক্ষু দানব অট্টশব্দে হা হা করে তেড়ে আসছে; বুঝতে হবে ঐটি বিমলের গাড়ি। একটি হেডলাইটের আলো নির্বাণপ্রাপ্ত।আলগা আলগা শরীরের গাটগুলো যেকোনো সময়ে বিস্ফোরণের মতো শতধা হয়ে ছিটকে পড়তে পারে।

সবচেয়ে বেশি ধুলো ওড়াবে, পথের মোষ ক্ষ্যাপাবে আর কানফাটা আওয়াজ করবে বিমলের গাড়ি। তবু কিছু বলবার জো নেই বিমলকে। চটাং চটাং মুখের ওপর দুকথা উল্টো শুনিয়েদেবে মশাই বুঝি কোনো নোংরা কম্ম করেন না, চেঁচান না, দৌড়ান না? যত দোষ করেছে বুঝি আমার গাড়িটা।

কত রকমই না বিদ্রূপ আর বিশেষণ পেয়েছে এই গাড়িটা বুড়া ঘোড়া, খোঁড়া হাঁস, কানা ভঁইস! কিন্তু বিমলের কাছ থেকে একটা আদুরে নাম পেয়েছে এই গাড়ি জগদ্দল। এ নামেই বিমল তাকে ডাকে, তার ব্যস্ত-ত্রস্ত কর্মজীবনে সুদীর্ঘ পনেরোটি বছরের সাথী এই যন্ত্রপশুটা, বিমলের সেবক বন্ধু আর অন্নদাতা।

সন্দেহ হতে পারে, বিমল তো ডাকে, কিন্তু সাড়া পায় কি? এটা অন্যের পক্ষে বোঝা কঠিন। কিন্তু বিমল জগদ্দলের প্রতিটি সাধ-আহ্লাদ, আবদার-অভিমান এক পলকে বুঝে নিতে পারে।

‘ভারি তেষ্টা পেয়েছে, না রে জগদ্দল? তাই হাঁসফাঁস কচ্ছিস? দাঁড়া বাবা দাঁড়া।’ জগদ্দলকে রাস্তার পাশে একটা বড় বটগাছের ছায়ায় থামিয়ে কুয়ো থেকে বালতি ভরে ঠাণ্ডা জল আনে, রেডিয়েটরের মুখে ঢেলে দেয় বিমল। বগ বগ করে চার-পাঁচ বালতি জল খেয়ে জগদ্দল শান্ত হয়, আবার চলতে থাকে।

এ ট্যাক্সি মালিক ও চালক বিমল স্বয়ং। আজ নয়, একটানা পনেরো বছর ধরে।

স্ট্যান্ডের এক কোণে তার সব দৈন্য আর জরাভার নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে বুড়ো জগদ্দল। পাশে হাল-মডেল গাড়িটার সুমসৃণ ছাইরঙা বনেটের ওপর গা এলিয়ে বসে পিয়ারা সিং বিমলকে টিটকারি দিয়ে কথা বলে, -’আর কেন, এ বিমলবাবু? এবার তোমার বুড়িকে পেনশন দাও।’

‘-হুঁ, তারপর তোমার মতো একটা চটকদার হাল-মডেল বেশ্যে রাখি।’ বিমল সটান উত্তর দেয়। পিয়ারা সিং আর কিছু বলা বাহুল্য মনে করে; কারণ বললেই বিমল রেগে যাবে, আর তার রাগ বড় বুনো ধরনের।

কার্তিক পূর্ণিমায় একটা মেলা বসবে এখান থেকে মাইল বারো দূরে,সেখানে আছে নরসিংহ দেবের বিগ্রহ নিয়ে এক মন্দির। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের যাত্রীর ভিড়। চটপট ট্যাক্সিগুলো যাত্রী ভরে নিয়ে হুস হুস করে বেরিয়ে গেল। শূন্য স্ট্যান্ডে একা পড়ে থেকে শুধু ধুঁকতে লাগল বুড়ে জগদ্দল। কে আসবে তার কাছে, যার ঐ প্রাগৈতিহাসিক গঠন আর পৌরাণিক সাজসজ্জা?
গোবিন্দ এসে সমবেদনা জানিয়ে বলল, -কি গো বিমলবাবু, একটাও ভাড়া পেলে না?
-না।
-তবে?
-তবে আর কি? এর শোধ তুলব সন্ধেয়। ডবল ওভারলোড নেব, যা থাকে কপালে।
‘আমিও যন্ত্র। বেঙ্গলি ক্লাব বলেছে ভালো।’ বিমল খুশি হয়ে মনে মনে হাসে।
কিন্তু জগদ্দলও যে মানুষেরই মতো, এ তত্ত্ব বেঙ্গলি ক্লাব বোঝে না, এইটেই দুঃখ। এই কম্পিটিশনের বাজারে, এসব শিকরে-বাজের ভিড়ে এই বুড়ো জগদ্দলই তো দিন গেলে নিদেন দুটি টাকা তার হাতে তুলে দিচ্ছে! আর তেল খায় কত কম। গ্যালনে সোজা বাইশটি মাইল দৌড়ে যায়। বিমল গরিব, জগদ্দল যেন এই সত্যটুকু বোঝে।

আরবি ঘোড়ার মতো প্রমত্ত বেগে জগদ্দল ছুটে চলেছে রাঁচীর পথে। শাবাশ তার দম, দৌড় আর লোড টানার শক্তি। কম্পমান স্টিয়ারিং হুইলটাকে দুহাতে আঁকড়ে ও বুক ঠেকিয়ে বিমল ধরে রয়েছে। অনুভব করছে দুঃশীল জগদ্দলের প্রাণস্ফূর্তির শিহর। কনকনে মাঘী হাওয়া ইস্পাতের ফলার মতো চামড়া চেঁছে চলে যাচ্ছে। মাথায় জড়ানো কম্ফোটারটা দুকানের ওপর টেনে নামিয়ে দিল বিমল; বিমলের বয়স হয়েছে, আজকাল ঠাণ্ডাফাণ্ডা সহজে কাবু করে দেয়।

সম্মুখে পড়ল একটা পাহাড়ি ঘাট। এই সুবিসর্পিত চড়াইটা জগদ্দল রুষ্ট চিতাবাঘের মতো একদমে গোঁ গোঁ করে কতবার পার হয়ে গেছে। সেদিনও অভ্যস্ত বিশ্বাসে ঘাটের কাছে এসে বিমল চাপল এক্সিলেটর পুরো চাপ। জগদ্দল ৫০ গজ এগিয়ে খং খং করে কঁকিয়ে উঠল। যেন তার বুকের ভেতর কয়টা হাড় সরে গিয়েছে। উৎকর্ণ হয়ে বিমল শুনল সে আওয়াজ! না ভুল নয়, সেরেছে জগদ্দল! পিস্টন ভেঙে গেছে!

কয়দিন পরে মাঝপথে এমনি আকস্মিকভাবে বিয়ারিং গলে গিয়ে একটা বড় রিজার্ভ নষ্ট হয়ে গেল। তারপর একটা না একটা উপসর্গ লেগেই রইল। এটা দূর হয় তো ওটা আসে। আজ ফ্যানবেল্ট ছেঁড়ে, কাল কারবুরেটারে তেল পার হয় না, পরশু প্লাগগুলো অচল হয়ে পড়ে শর্ট সার্কিট হয়।

এত বড় বিশ্বাসের পাহাড়টা শেষে বুঝি টলে উঠল। বিমল কয়দিন থেকে অস্বাভাবিক রকমের বিমর্ষ। এদিক সেদিক ছুটোছুটি করে বেড়ায়। জগদ্দলেরও নিয়মভঙ্গ হয়েছে, স্ট্যান্ডে আসা বাদ পড়ছে মাঝেমধ্যে। উৎকণ্ঠায় বিমলের বুক দুর দুর করে। তবে কি শেষে সত্যিই জগদ্দল ছুটি নেবে?

-’না, আমি আছি জগদ্দল; তোকে সারিয়ে টেনে তুলবই, ভয় নেই। মোটরবিশারদ পাকা মিস্ত্রী বিমল প্রতিজ্ঞা করে।

কলকাতায় অর্ডার দিয়ে প্রত্যেকটি জেনুইন কলকব্জা আনিয়ে ফেলে বিমল। নতুন ব্যাটারি, ডিস্ট্রিবিউটর, অ্যাঙ্লে, পিস্টন সব আনিয়ে ফেলল। অকৃপণ হাতে শুরু হলো খরচ; প্রয়োজন বুঝলে রাতারাতি তার করে জিনিস আনায়। রাত জেগে খুটখাট মেরামত, অর্থাভাব বেচে ফেলল ঘড়ি, বাসনপত্র, তক্তপোশটা পর্যন্ত।

সর্বস্ব তো গেল, যাক। পনেরো বছরের বন্ধু জগদ্দল এবার খুশি হবে, সেরে উঠবে। খুব করা গেছে যা হোক; এবার নতুন হুড, রং আর বার্নিশ পড়লে একখানি বাহার খুলবে বটে! বিমলের কল্পনা যেন নিজেরই খুশিতে বিমলের মনের ভেতর হাসতে থাকে।

রাত-দুপুরে জগদ্দলকে গ্যারেজে বন্ধ করার সময় বিমল একবার আলো তুলে দেখে নিল। খুশি উপচে পড়ল তার দু চোখে! এই তো বলিহারি মানিয়েছে জগদ্দলকে। কয়দিনের অক্লান্ত সেবায় জগদ্দলের চেহারা ফিরে গেছে; দেখাচ্ছে যেন একটি তেজি পেশীওয়ালা পালোয়ান। এক ইশারায় দঙ্গলে ভিড়ে যেতে প্রস্তুত। হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ল বিমল। বড় পরিশ্রমের চোট গেছে কয়দিন। কিন্তু কী আরামই না লাগছে ভাবতে জগদ্দল সেরে উঠেছে; কাল সকালে সগর্জনে নতুন হর্নের শব্দে সচকিত করে জগদ্দলকে নিয়ে যখন স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াবে বিমল, বিস্ময়ে হতবাক হবে সবাই, আবার জ্বলবে হিংসেতে।

হঠাৎ বিমলের ঘুম ভেঙে গেল। শেষ রাত্রি তবু নিরেট অন্ধকার। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসল বিমল-জগদ্দল ভিজছে না তো! গ্যারেজের টিনের ছাদটা যা পুরনো, কত ফুটো ফাটাল আছে কে জানে! কোন ফাঁকে ইঞ্জিনে জল ঢুকলে হয়েছে আর কি! বডির নতুন পালিশটাকেও স্রেফ ঘা করে দেবে।

কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে নিয়ে গ্যারেজে ঢুকে বিমল প্রায় চেঁচিয়ে উঠল আরে হায়! হায়! ছাদের ফুটো দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টির জল ঝড়ে পড়ছে ঠিক ইঞ্জিনের ওপর। দৌড়ে শোবার ঘর থেকে বিমল নিয়ে এলো তার বর্ষাতিটা; টেনে আনল বিছানার কম্বল শতরঞ্জি চাদর।

ইঞ্জিনের ভেজা বনেটটা মুছে ফেলে কম্বলটা চাপিয়ে দিল তার ওপর বর্ষাতিটা! শতরঞ্জি আর চাদর দিয়ে গাড়িটার সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়ে নিজেও ঢুকে পড়ল ভেতরে; নতুন নরম গদিটার ওপর গুটিসুটি হয়ে বিমল শুয়ে পড়ল; আরামে তার দুচোখে যেন ঘুমের ঢল নেমে এলো।

পরদিনের ইতিহাস। স্ট্যান্ডের উদগ্রীব জনতা জগদ্দলকে ঘিরে দাঁড়াল, যেন একটা অঘটন ঘটে গেছে। স্তুতিমুখর দর্শকেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল বিমলের অপূর্ব মিস্ত্রি-প্রতিভার নিদর্শন। বিমলও টেনে টেনে কয়েকবার হাসল। কিন্তু কেমন যেন একটু অস্বচ্ছ সে হাসি, একটা শঙ্কার ধূসর স্পর্শে আবিল।

কেন? বিমলের মনের ভেতরে বেদনা ছড়ায় একটা সন্দেহ। জগদ্দল চলছে ঠিকই, কিন্তু কইসেই স্টার্টমাত্র শক্তির উচ্চকিত ফুকার, সেই দর্পিত হ্রেষাধ্বনি আর দুরন্ত বনহরিণের গতি? শহর থেকে দূরে একটা মাঠের ধারে গিয়ে বিমল বেশ করে জগদ্দলকে পরীক্ষা করে দেখল।
‘-চল বাবা জগদ্দল! একবার পক্ষিরাজের মতো ছাড় তো পাখা!’ বিমল চাপল এক্সিলেটর!
নাঃ, বৃথা, জগদ্দল অসমর্থ।
ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড প্রতিটি গিয়ার পর পর পাল্টে টান দিল বিমল। শেষে রাগ চড়ে গেল মাথায় ’চল, নইলে মারব লাথি।’
অক্ষম বৃদ্ধের মতো জগদ্দল হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে চলতে থাকে।
-’আদর বোঝে না, কথা বোঝে না, শালা লোহার বাচ্চা, নির্জীব ভূত’ বিমল সত্যি সত্যি ক্লাচের ওপর সজোরে দুটো লাথি মেরে বসল।

বিমলের রাগ ক্রমেই বাড়ছে, সেই বুনো রাগ। আজ শেষ জবাব জেনে নেবে সে! জগদ্দল থাকতে চায়, না যেতে চায়? অনেক তোয়াজ করেছে সে, আর নয়।

রাগে মাথাটা খারাপই হয়ে গেল বোধ হয়। বিমল ঠেলে ঠেলে প্রকাণ্ড সাত-আটটা পাথর নিয়ে এলো। ঘামে ভিজে ঢোল হয়ে গেল পরিশ্রান্ত বিমলের খাকি কামিজ। এক এক করে সব পাথর গাড়িতে তুলে দিল। একেই বলে লোড! এই লোড জগদ্দলকে আজ টানতে হবে; দেখা যাক, জগদ্দলের সেই শক্তি আছে, না চিরকালের মতো ফুরিয়ে গিয়েছে।

‘চল।’ জগদ্দল চলল; গাঁটে গাঁটে আর্তনাদ বেজে উঠল ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে। অসমর্থ আর পারবে না জগদ্দল এ ভার বইতে!

এবার বিমল নিশ্চিন্ত। জগদ্দলকে যমে ধরেছে। এ সত্যে আর সন্দেহ নেই। এত কড়া কলিজা জগদ্দলের, তাতেও ঘুণ ধরল আজ। কৃতান্তের ডাক, আর রক্ষে নেই, এবার দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামবে। শেষ কড়ি খরচ করেও রইল না জগদ্দল।

আমি শুধু রৈনু বাকি… পরিশ্রান্ত বিমল মনে মনে যেন বলে উঠল। কিন্তু আমারও তো হয়ে এসেছে। চুলে পাক ধরেছে, রগগুলো জোঁকের মতো গা ছেয়ে ফেলেছে সব। সেদিনের আর বেশি দেরি নেই, যেদিন জগদ্দলের মতো এমনি করে হাঁপিয়ে আর খুঁড়িয়ে আমাকেও বাতিল হয়ে যেতে হবে।

বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে চুপ করে জগদ্দলের দিকে তাকিয়ে থাকে বিমল। মনের ভেতরে যেন একটা শূন্যতার আক্ষেপ ছটফট করতে থাকে। ‘জগদ্দল আগেই যাবে বলে মনে হচ্ছে, তারপর আমার পালা! যা জগদ্দল, ভালো মনেই বিদেয় দিলাম। অনেক খাইয়েছিস, পরিয়েছিস, আর কত পারবি? আমার যা হবার হবে।’ যা কোনোদিন হয়নি, তাই হলো। ইস্পাতের গুলির মতো শুকনো ঠাণ্ডা বিমলের চোখে দেখা দিল দু ফোঁটা টলমলে উষ্ণ জল।

ফিরে এসে বিমল জগদ্দলকে গ্যারেজের বাইরে বেলতলায় দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল। পেছন ফিরে আর তাকাল না। সোজা গিয়ে উঠোনে বসে পড়ল, সামনে রাখল দু বোতল তেজালো মহুয়া।

একটি চুমুক সবে দিয়েছে, শোনা গেল কে ডাকছে বিমলবাবু আছ! গোবিন্দের গলা। গোবিন্দ এলো, সঙ্গে একজন মাড়োয়ারি ভদ্রলোক।
-আদাব বাবুজি।
-আদাব, কোন গাড়ির এজেন্ট আপনি? বিমল প্রশ্ন করল। গোবিন্দ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল গাড়ির এজেন্ট নন উনি; পুরনো লোহা কিনতে এসেছেন কলকাতা থেকে। তোমার তো গাদাখানেক ভাঙা এক্সেল আর রিমটিম জমে আছে। দর বুঝে ছেড়ে দাও এবার।

বিমল খানিকক্ষণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। ভবিতব্যের ছায়ামূর্তি তার পরম ক্ষুধার দাবি নিয়ে ভিক্ষাভাণ্ডটি প্রসারিত করে আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
এমনিতে ফিরবে না সে, শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা চাই। ব্যাপারটা বুঝল বিমল।
-হ্যাঁ আছে পুরনো লোহা, অনেক আছে, কত দর দিচ্ছেন?
-চৌদ্দ আনা মণ বাবুজি, মাড়োয়ারির ব্যগ্র জবাব এলো। লড়াই লেগেছে, এই তো মওকা, ঝেড়েপুছে সব দিয়ে ফেলুন বাবুজি।
-হ্যাঁ সব দেব। আমার ঐ গাড়িটাও দেব। ওটা একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। হতভম্ব বিন্দ শুধু বলল সে কি গো বিমল বাবু?

নেশা ভাঙল এক ঘুমের পর। তখনো রাত, বিমল আর এক বোতল পার করে শুয়ে পড়ল।

ভোর হয়ে এসেছে। থেকে থেকে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বিমলের। বাইরে জাগ্রত পৃথিবীর সব কোলাহল থেকে উপচে পড়ছে শুধু একটি শব্দ, বিমলের কানের কাছে আছড়ে পড়ছে ঠং ঠং ঠকাং ঠকাং। মাড়োয়ারির লোকজন ভোরে এসেই বিমলের গাড়ি টুকরো টুকরো করে খুলে ফেলেছে।

শোক আর নেশা। জগদ্দলের পাঁজর খুলে পড়ছে একে একে। বিমলের চৈতন্যও থেকে থেকে কোন অন্তহীন নৈঃশব্দের আবর্তে যেন পাক দিয়ে নেমে যাচ্ছে অতলে। তারপরই লঘুভার হয়ে ভেসে উঠছে ওপরে। এরই মাঝে শুনতে পাচ্ছে বিমল, ঠং ঠং ঠকাং ঠকাং, ছিন্নভিন্ন ও মৃত জগদ্দলের জন্য কারা যেন কবর খুঁড়ছে। ঠং ঠং ঠকাং ঠকাং, যেন অনেক কোদাল আর অনেক শাবলের শব্দ।

No comments