আয়না – আন্তন চেখভ

আয়না – আন্তন চেখভ

নববর্ষের প্রাক্কাল। নেলি একজন জমিদার ও সেনাধ্যক্ষের যুবতী সুন্দরী মেয়ে। এক সময় রাতদিন বিয়ের স্বপ্নে অর্ধর্নিমিলিত ক্লান্ত চোখে সে তার রুমের আয়নার দিকে চেয়ে থাকতে অভ্যস্ত ছিল। সে ফ্যাকাশে, উত্তেজিত চোখে নিশ্চুপভাবে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকত।

সরু করিডোরে সারিসারি মোমবাতি, মোমবাতির আলো তার মুখে, হাত দুখানা আর শরীরের উপর প্রতিফলিত হত। অসীম ধূসর সমুদ্রের উপরে মেঘের আস্তরণ। তরঙ্গায়িত সমুদ্র দ্বীপ্তি ছড়ায়, আর মাঝে মাঝে সূর্যের আলো পড়ে সমুদ্রের পানি রঙিন হয়ে উঠে।

সেদিনের জমিদার ও সেনাধ্যক্ষের যুবতী সুন্দরী মেয়ে নেলি’র সঙ্গে যে মানুষটির বিয়ে হয় সে ছিল তার স্বপ্ন ও আশা ভরসার ভাগ্যনিয়ন্তা। তার স্বামীর চোখ দুটোয় মোহময়তার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত। নেলি’র স্বামী ছিল তার স্ত্রী নেলি’র ব্যক্তিগত জীবনের সুখ শান্তি, আশা ভরসা পূর্ণ করার উদ্গাতা। নেলি’র জীবনটা তার প্রিয়তম স্বামীর জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছিল।

নেলি তার প্রিয়তম স্বামীর রোগ মুক্তির জন্য শত চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে না পারায় নেলি আজ হতভাগা। আজও সে আয়নার সামনে বসে তার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। নেলি’র প্রাক বিবাহিত জীবনে আয়নার সামনে বসে স্বপ্ন আর বাসনার অভিব্যক্তি প্রকাশ আর বর্তমানে আয়নার সামনে বসে কল্পনায় দেখার মাঝে যোজন যোজন ফারাক।

নেলি’র প্রাক বিবাহিত জীবনে আয়নার সামনে বসে কল্পনায় চোখের সামনে ভেসে উঠত ভদ্রসভ্য হাসিখুশি মুখের একজন সুদর্শন মানুষের মুখ, নেলি পরম সুখ সম্বন্ধে সচেতন! এক সময় নেলি তার কাঙ্খিত মানুষটির কন্ঠস্বর যেন শুনতে পেল এবং তারপর সে নিজেকে দেখতে পেল তার সঙ্গে একই ছাদের নিচে শুয়ে আছে।

নেলি’র প্রিয়তম স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে নেলি তাকে সুস্থ করে জন্য হিমশীতল রাতের আঁধারে ডাক্তারের সন্ধানে বের হল।

শীতের রাতে নেলি চরমভাবে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার জন্য ডিস্ট্রিক্ট ডক্টর স্টেপান লুকিটচকে আনতে ঘোড়ার গাড়িতে ডাক্তারের দরজায় হাজির হল। ডাক্তারের বাড়ির গেটের পেছনে একটা বয়স্ক কুকুর কর্কশ কন্ঠে থেকে থেকে ঘেউ ঘেউ করছে। ডাক্তারের বাড়ির জানালাগুলো অন্ধকারে ঢাকা। সর্বত্র নীরবতা বিরাজ করছে।নেলি ফিসফিস করে বলল, ‘ঈশ্বরের দোহাই, ঈশ্বরের দোহাই।’ অবশেষে গার্ডেনের গেট শব্দ করে খুলে গেলে নেলি ডাক্তারের রাধুনীকে দেখতে পেল। ‘এটা ডাক্তারের বাড়ি?’ ‘হ্যাঁ, তার মনিব ঘুমাচ্ছেন।’ তার মনিব জেগে না উঠেন এই ভয়ে সে তার জামার হাতার মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল। ‘তিনি এই মাত্র জ্বরে আক্রান্ত রোগীগুলোকে দেখে বাড়ি ফিরে ঘুমুতে গেছেন, আর বলে গেছেন তাকে যেন জাগানো না হয়।’ নেলি যেন তার কথা শুনতেই পেল না। তার পাশাপাশি হেঁটে নেলি ডাক্তারের ঘরের কাছে হাজির হল।

অন্ধকারে ঘেরা অপরিচ্ছন্ন রুমগুলো পেরোনোর সময় দুই তিনটে চেয়ার উল্টিয়ে ফেলে অবশেষে ডাক্তারের রুমে পৌছাল। ডাক্তার স্টেপান লুকিটচ গায়ের কোট খুলে রেখে পোশাক পরেই বিছানো হাতের উপর মাথা রেখে বিছানায় শুয়ে মুখ দিয়ে নি:শ্বাস নিচ্ছেন। তার পাশে নিষ্প্রভ আলো জ্বলছে। নেলি একটি কথাও না বলে ডাক্তারের পাশে বসে কাঁদতে শুরু করল। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার স্বামী অসুস্থ।’

ডাক্তার স্টেপান লুকিটচ হাতের উপর থেকে মাথা সরিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে আগন্তুকের দিকে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে রইলেন।

‘আমার স্বামী অসুস্থ!’ নেলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে চলল। ‘ঈশ্বরের দোহাই, তাড়াতাড়ি করে আমার সঙ্গে আসুন। ইতস্তত করবেন না!’

‘ওহ!’ ডাক্তার হাত নেড়ে বললেন।

‘দুই এক মিনিটের মধ্যে আসুন, তা না হলে আমার স্বামীকে বাঁচানো যাবে না।, ঈশ্বরের দোহাই।’ নেলি চোখেমুখ ফ্যাকাশে, ক্লান্তির ছাপ সারা শরীরে। চোখের জল মুছতে মুছতে সে তার স্বামীর অসুস্থতার বিবরণ দিচ্ছি। তার মনে আতঙ্কের আভাস। তার কষ্ট দেখে পাথরও যেন গলে যাবার মত অবস্থা। কিন্তু ডাক্তারের মন কিন্তু গলছে না! সে নেলি’র দিকে চেয়ে হাতটা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘আগামীকাল যাব।’

‘অসম্ভব!’ নেলি চিৎকার করে কেঁদে বলল ‘আমি জানি আমার স্বামী টাইফয়েড এ আক্রান্ত হয়েছেন! কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনাকে তার দেখা প্রয়োজন!’ ডাক্তার বলে উঠলেন। ‘আমি গত তিন সপ্তাহ টাইফয়েড এ আক্রান্ত রোগী দেখার জন্য বাইরে ছিলাম, তাই আমি এখন নিজেই বড় ক্লান্ত — আমিও সেখান থেকে টাইফয়েড জ্বরে বিকারে আক্রান্ত হয়েছি!’

নেলি’র চোখের সামনেই ডাক্তার নিজে তাপ থার্মোমিটার দিয়ে মেপে বললেন, ‘আমার শরীরের তাপ বেশি — বসে থাকাতেই কষ্ট পাচ্ছি, তাই আমি যেতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি এখন শুয়ে পড়বো।’ কথাটা শেষ করে ডাক্তার শুয়ে পড়লেন।

‘আমি কিন্তু আপনার উপরই ভরসা করছি।’ নেলি হতাশার সঙ্গে আকুতি জানিয়ে আবার বলল, ‘আমি আপনাকে পায়ে পড়ছি! সদয় হয়ে আমাকে সাহায্য করেন! একটু কষ্ট করে আপনি আমার সঙ্গে আসেন। আমি আপনার ন্যায্য ফিস দেব, ডাক্তার সাহেব! প্রিয় ডাক্তার সাহেব! — কেন আমি আপনাকে এতটা অনুরোধ করছি বুঝতে পারছেন না!’ নেলি হতাশাগ্রস্ত হয়ে তড়িত বেগে বেডরুম থেকে বের হয়ে গেল।

সে ডাক্তারকে কেন এত অনুনয়বিনয় করছিল তার কারণ —। নেলি ভাবল, ডাক্তার জানেন না তার স্বামী তার কাছে কতটা প্রিয়, তার অসুস্থার জন্য সে কতটা অসুখী, ডাক্তার তার অসুস্থার কথাকে আমলই দিল না। সে এখন কি করবে। নেলি স্টেপান লুকিটচ এর কন্ঠস্বর শুনতে পেল। ‘আপনি জেমস্টোভ ডাক্তারের কাছে যান।’

‘তার কাছে যাওয়া অসম্ভব! তিনি এখান থেকে বিশ মাইল দূরে থাকেন। এখন আমার কাছে সময় অতি মূল্যবান। ঘোড়াগুলো বড়ই ক্লান্ত। আমরা তিরিশ মাইল দূর থেকে আপনার কাছে এসেছি। এখান থেকে জেমস্টোভ ডাক্তারের কাছে যাওয়া আমাদের সম্ভব নয়! স্টেপান লুকিটচ, আপনি আমাদের কথা বিবেচনা করে এই কাজটি করুন, আমাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে আমাদের সঙ্গে আসুন।’

‘আপনি তো আমার কথা বুঝছেন না — আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে — হাত কাঁপছে — আপনি আমার কথা বুঝতে পারছে না। আমাকে একা থাকতে দিন!’

‘আপনি কিন্তু আমার সঙ্গে যেতে দায়বদ্ধ! আপনি আমার অসুস্থ স্বামীকে দেখতে যেতে অস্বীকার করতে পারেন না! এটা আপনার অহংবোধ! একটা মানুষ তার প্রতিবেশির জন্য আত্মত্যাগ করতে দায়বদ্ধ থাকে আর আপনি একজন ডাক্তার হয়ে আমার স্বামীর বিপদে আমার সঙ্গে যেতে অস্বীকার করছেন। আমি আপনার বিরুদ্ধে কের্টে মামলা রজু করব।’ নেলি অনুভব করল, সমস্ত রকমের ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে সে ডাক্তারকে মিথ্যা ভয় দেখাচ্ছে।

শুধুমাত্র তার স্বামীর জীবন রক্ষার জন্য সে ডাক্তারকে অপমান করছে । নেলি’র ভয় ভীতিমূলক কথা শুনে ডাক্তার এক গ্যাস ঠান্ডা পানি পান করে ভাবলেন, মহিলাটি একজন অজাত বেজাতের ভিখারিনীর মত আচরণ করছে তার সঙ্গে —। অবশেষে ডাক্তার মত পরিবর্তন করে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে বসে তার জামা, প্যান্ট ও তার কোটের দিকে তাকালেন।

‘এগুলো এখানে!’ নেলি কান্না জড়িত কন্ঠে বলল। ‘এগুলো আপনাকে পরিয়ে দিতে আমি সাহায্য করছি। পোশাক পরে আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আমি আপনাকে উপযুক্ত ফিস দেব — আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব —।

কিন্তু কেন এত দু:শ্চিন্তা! ডাক্তার কোট পরার পর আবার বসে পড়লেন। নেলি তাকে তুলে ধরে টানতে টানতে হলরুমে দিয়ে এল। তারপরও ডাক্তার তার ওভারকোট পরতে ইতস্তত করতে শুরু করলেন। তার মাথার ক্যাপ খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে ডাক্তারকে নিয়ে নেলি ঘোড়ার গাড়িতে উঠলো। এখন তাদেরকে তিরিশ মাইল গাড়ি চালিয়ে তার স্বামীর কাছে পৌঁছে ডাক্তারকে দেখাতে হবে।

চারদিক রাতের আঁধারে থিক থিক করছে। মুখ তো দূরের কথা একজন আর জনের হাতটা পর্যন্ত দেখতে পারছে না — শীতের ঠান্ডা বাতাস বইছে। বরফ পড়ায় গাড়ির চাকা আটকে যাচ্ছে। কোচম্যান থেকে থেকে গাড়ি থামাচ্ছে এবং গাড়ি থেকে নেমে বরফ সরিয়ে দিচ্ছে। সারা রাস্তাই নেলি ও ডাক্তার নীরবে বসে আছে। ভীতিজনক অবস্থা হলেও ঠান্ডা ও অন্ধকারের দিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই।

‘গাড়ি থামাও গাড়ি থামাও!’ নেলি ড্রাইভারকে বলে উঠলো। ভোর পাঁচটায় ক্লান্ত দেহে ঘোড়াগুলো তাদের গাড়িকে নেলিদের উঠোনে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নেলি’র চোখে পড়লো তার বাড়ির পরিচিত গেটগুলো, কপিকলওয়ালা কূপ আর অশ্বশালার লম্বা সারি। অবশেষে সে বাড়ি পৌঁছাল।

‘এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন, আমি এখনই ফিরে আসছি।’ নেলি স্টেপান লুকিটচকে ডাইনিং রুমের সোফায় বসার ব্যবস্থা করে বললেন। ‘সামান্য একটু সময় বসুন, আমি এর মাঝে দেখে আসি তিনি এখন কী অবস্থায় আছেন।’ নেলি তার স্বামীর কাছ থেকে ফিরে এসে ডাক্তারকে সোফাতে শুয়ে পড়তে দেখলেন। তিনি সোফায় শুয়ে বিড়বিড় করতে শুরু করলেন।

‘ডাক্তার, প্লিজ! — ডাক্তার!’ ।

‘কে? ডোমনা!’ স্টেপান লুকিটচ মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন। ‘আপনি কাকে ডাকছেন?’

‘তারা মিটিং এ বলেছিল — ভাস্সোভ — কে? — কী?’

ডাক্তারে কথা শুনে নেলি আতঙ্কিত হয়ে ভাবল, — ডাক্তারও কি বিকারের ঘোরে বকছেন। এখন সে কী করবে?

‘এখন তাহলে আমাকে অবশ্যই ডাক্তার জেমস্টোভ কাছে যেতে হবে।’

তারপর আবার অন্ধকার, ঠান্ডা হাওয়া, বরফাবৃত্ত বিশ্বচরাচর। নেলি’র শরীর মনে ক্লান্তি। বিপর্যস্ত প্রকৃতিতে কোন শিল্প সৌন্দর্য নেই, নেই প্রকৃতিতে ভোগান্তি থেকে মুক্তির অবলম্বন। তারপর নেলি ধূসর পটভূমিকার পেছনে দেখতে পেল তার স্বামী কেমন ভাবে প্রত্যেক বসন্তকালে ব্যাংকে দাদন রাখা অর্থের সুদ দিচ্ছেন। তার স্বামীর ঘুম আসে না, তার নিজেরও ঘুম আসে না। তাদের মস্তিষ্কে ব্যথা থাকলে কিভাবে চিন্তাভাবনা করবে!

নেলি তার ছেলেমেয়েদের দেখতে পেল। প্রচন্ড ঠান্ডা, জ্বর, ডিপথেরিয়া, স্কুলের খারাপ রেজাল্ট। পাঁচ ছয়টা লক্ষণের মধ্যে একটিতে অবধারিত মৃত্যু। ধূসর পটভূমি মৃত্যুর স্পর্শ বিহীন ছিল না। একজন স্বামী ও একজন স্ত্রী একই সঙ্গে মারা যেতে পারে না। একজন বেঁচে থাকলে আর একজনের কবর দিতে পারে। নেলি তার স্বামীকে মৃতবৎ দেখতে পেল। এই ভয়ঙ্কর ঘটনা তার কাছে বেদনা অনুষঙ্গে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সে হলরুমে দেখতে পেল কফিন, অনেকগুলো মোমবাতি ইত্যাদি।‘এ সব কেন এখানে?’ নেলি তার স্বামীর পান্ডুর বর্ণে মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল। তার স্বামীর সঙ্গে কাটানো অতীত জীবনের কথাকে তার মনে হওয়াটা তার কাছে একটি নির্বোধের কান্ড! কিছু একটা নেলি’র হাতে এসে পড়লে সেই ধাক্কায় সে মেঝেয় পড়ে গেল। মেঝে থেকে উঠার চেষ্টা করতেই সে দেখতে পেল একটা আয়না তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। অন্য একটি আয়না টেবিলের উপর রয়েছে। সে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল একটা ফ্যাকাশে অশ্রসিক্ত মুখ। এখন আর পেছনে ধূসর রঙের পটভূমি নেই। ‘আমি অবশ্যই ঘুমিয়ে পড়ব।’ নেলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল।

অনুবাদ : মনোজিৎকুমার দাস

No comments