অন্য মুখ – মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী

অন্য মুখ – মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী

জাহ্নবী আজ চারদিন হল মেডিকেয়ার নার্সিং হোমে ভর্তি। মধ্য চল্লিশের জাহ্নবী খুবই শক্তপোক্ত মহিলা। একটু অসুখে কাতর হয়ে পড়ার মেয়ে নয়। কিন্তু মঙ্গলবার স্কুল থেকে ফিরে কাজের মেয়েটা চা করে দিল, সোফায় বসে চা টা আরাম করে খেতে খেতেই বুকে হাল্কা একটা ব্যথা অনুভব করল।

প্রথমে পাত্তাই দেয় নি জাহ্নবী, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথাটা চিনচিনে থেকে প্রবল আকার ধারন করলো। ডাক্তারবাবু এসে ব্যথা কমানোর ওষুধ, ইঞ্জেকশন সব দিলেন কিন্তু তাতেও কমল না, তখন বাধ্য হয়ে নার্সিং হোমে আনতে হল জাহ্নবীকে।

সারাদিন অসংখ্য কাজের মধ্যে থাকা জাহ্নবীর এখন কোনো কাজ নেই। ডাক্তাররা খুঁজে চলেছেন কি কারণে এই বুকে ব্যথা, আর না খুঁজে পেয়ে একগাদা স্যালাইন, আ্যন্টিবায়োটিক, পেন কিলার ফুটিয়ে চলেছে অনবরত।

জাহ্নবীর হাজব্যান্ড, দুই মেয়ে, কলিগ, আত্মীয় স্বজন সকলেই আসছে, খবর নিচ্ছে, কিন্তু কারণ খুঁজে না পেলে ডাক্তাররা ছুটি দিতে নারাজ। অগত্যা নার্সিংহোমই এখন জাহ্নবীর ঠিকানা। স্যালাইনের সুঁচ ফোটানোর কষ্টটা ছাড়া জাহ্নবী খুব খারাপ নেই। ওষুধের জন্যে বুকে ব্যথাটা আর নেই। এ ক’দিনে স্যালাইনে খানিকটা অভ্যেস হয়ে গেছে।

জাহ্নবীর বেডটা ফিমেল ওয়ার্ডের একদম শেষ সারিতে বিরাট জানলার পাশে, জানলার ওপারে বিরাট অংশ জুড়ে বড় বড় গাছের বাগান, যেটি এই নার্সিং হোমের নিজস্ব বাগান। এখন এত বড় বড় গাছ আর দেখাই যায় না। আম, কাঁঠাল, নারকেল, পেঁপে, কলা আরও নানা রকম গাছ। যে রাতে ভীষণ ব্যথা নিয়ে জাহ্নবী ভর্তি হল, সেই রাত কেটে ভোরের যে গোলাপি সূর্যটা সিস্টার তাকে ডেকে দেখাল, আর তাকে অন্যমনস্ক করে দিয়ে একটা কড়া ইঞ্জেকশন ফুঁড়ে দিল, জাহ্নবী একটা উহ্ করতেও পারলো না। অবাক চোখে ওই গাছের ওপরে হালকা গোলাপি আলোর কারুকাজ দেখতে দেখতে পরম করুণাময় কে প্রণাম জানাল, তাকে আর একটা সুন্দর সকাল দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

জাহ্নবীর পাশের বেডেই রয়েছেন একজন বৃদ্ধা। তার পাশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা। বিপরীত দিকে একজন মহিলা, যিনি দেড়মাস ধরে ওই বেডটাকেই নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছেন। অজানা কি জ্বরে ভুগছেন তিনি। এত দিন একটা ঘরে প্রায় বন্দি জীবন কিন্তু মুখে একটু বিরক্তি ভাব নেই, যেন এটাই স্বাভাবিক এই ভাবে ওয়ার্ডের মধ্যে ঘুরে বেড়ান। সকলের সঙ্গে গল্প করে, ইয়ার্কি করে দিব্যি আছেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে এভাবে মানিয়ে নিলে বেঁচে থাকাটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

সকালের চা নিয়ে গড়গড় করে ট্রলি এল। আয়াদিদি হাসিমুখে সবার চাহিদা অনুযায়ী কাউকে লাল চা, কাউকে দুধ চা, কাউকে চিনি ছাড়া চা, বিস্কুট হাতে তুলে দিল। দুজন পেশেন্টকে সব খাইয়ে দিতে হয়, সুতরাং তাদের খাইয়ে তারা নিজেদের চা নিয়ে চুমুক দিয়ে আহ্ বলতে না বলতেই একজন বেডপ্যান চাইল। সসব্যস্ত হয়ে চা ফেলে ছুটল বেডপ্যান দিতে। বেচারা যখন হাত ধুয়ে আবার চা হাতে পেল তখন আর তা চা নেই জল হয়ে গেছে। জাহ্নবীর খুব দুধ চা ভাল লাগে কিন্তু ডাক্তারবাবুর কড়া হুকুম দুধ চা খাওয়া যাবে না। জাহ্নবী করুণ মুখে লিকারে চুমুক দিচ্ছে আর পাশের বেডের অষ্টআশি বছরের বুড়ির দুধ চায়ের দিকে টুকুর টুকুর তাকাচ্ছে, সেই দৃষ্টি দেখে আয়াদিদির কি দুঃখ! “আহা গো! বৌদি দুধ চা ভালবাসে, আর সেই দুধ চা ই বন্ধ! ভেবোনা বৌদি তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, আবার দুধ চা খেতে পারবে। আর শোনো বৌদি, দুধ চা তো খুব ভালো জিনিস নয়, তাই তোমার শরীর খারাপ হতে পারে, তাই তোমার লিকার খাওয়াই ভাল।” এগুলো বলে জাহ্নবীর মাথার চুলটা আঁচড়ে দিতে লাগলো। জাহ্নবী ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে মমতা টুকু নিজের গায়ে মেখে নিল, এই আয়াদিদির সকালের চা টুকুও জোটে নি, কিন্তু কোনো অনুযোগ নেই। বরং দিদিমণি জাহ্নবীকে বাচ্চা মেয়ের মত করে বোঝাচ্ছে।

বোঝার অনেকটাই বাকি ছিল জাহ্নবীর। তার পাশের বেডে যে অষ্টআশির বৃদ্ধা রয়েছেন তাঁর ছুটি হল। বৃদ্ধার প্রায় ষাটের কাছাকাছি মেয়ে এল নিতে। এসেই খোঁজ করলো মায়ের নাইটিটার। খোঁজ খোঁজ… কোথাও পাওয়া যায় না তার মায়ের নাইটি। মেয়ে তো ক্রমে তেতে উঠছে, এমন সময় একটি আয়াদিদি নোংরা ফেলার বাস্কেট থেকে একটি ময়লা কিটকিটে ছেঁড়া নাইটি এনে দেখাল তাকে, মেয়ে এক গাল হেসে বলল, “এই তো পাওয়া গেছে, দিয়ে দিন ওটা” বলে প্যাকেটে পুরে নিল। সকলে স্তব্ধ। শুধু সিস্টার আর আয়াদিদিদের চোখে সামান্য হাসির ঝিলিক। এরপর মাকে তুলতে গিয়ে দুজন আয়া, দুজন ওয়ার্ড বয় খুব সাবধানে আসতে আসতে তুলছে, যাতে বৃদ্ধার না লাগে। মেয়ে বলে উঠল, “সব বদমাইশি, মা এরকমই জ্বালায়, সব পারে বুড়ি, এই বাড়ি যাবে, আর ইচ্ছে করে আমাকে জ্বালাবে। “কেউ একটা কথাও বললো না এর উত্তরে। মাকে নিয়ে গেল মেয়ে।

আয়ারা ফিরে এলে একজন সিস্টার জিজ্ঞেস করলো, “কিছু দিল?” এটা সবার জানা যে চলে যাবার সময় দিদিদের হাতে পেশেন্ট পার্টি খুশী হয়ে কিছু দেয়। আয়াদিদির সপাট উত্তর, “ও ওর মাকে দেখুক, তাহলেই হবে, আমাদের কিছু দিতে হবে না”। জাহ্নবী এত দিন ভাবতো ছেলেরা বাপ মাকে না দেখলেও মেয়ে ঠিক দেখে, কিন্তু জীবন তাকে অন্য শিক্ষা দিল আজ।

স্যালাইন বড্ড কষ্ট দিচ্ছে, হাত ফুলে যাচ্ছে। সিস্টার, আয়া মাঝে মাঝেই আইসপ্যাক লাগিয়ে দিচ্ছে, তাও কমছে না। রাউন্ডে জাহ্নবীর ডাক্তারবাবুকে কষ্টের কথা বলতে ডাক্তার বাবু হেসে বললেন, “এমা আপনি এখনো সেলফিই তো তোলেন নি স্যালাইনের বোতলের সঙ্গে, এখন তো খোলা যাবে না, আগে সেলফি নিয়ে নিন।” হাসাহাসিতে কষ্টটা খানিক কমে গেল বোধহয়।

২৩২নং বেডের আজ ছুটি হবার কথা কিন্তু মেডিক্লেমের কি জটিলতার জন্যে আজ যেতে পারে নি। ওর ছেলে এসে নানাভাবে বোঝাচ্ছে যে কাল নিয়ে যাবে, কিন্তু ভদ্রমহিলা কেঁদেই চলেছেন বাড়ি যেতে পারবেননা বলে। ছেলে চোখ মুছিয়ে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বোঝাচ্ছে। ব্যাপারটা একটু হাস্যকর হলেও মা-ছেলের এই সম্পর্ক দেখতে ভারি ভাল লাগছে।

জাহ্নবীর উল্টোদিকের বেডের মহিলা ভারী খিটকেল। কারো সঙ্গে কথা বলে না। হাসে না। লুস মোসনের জন্যে ভর্তি হয়েছে। হাঁটতে পারলেও প্রতিবার বেডপ্যান চাইছে। আয়ারা যদি বলে, চলুন না বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে বলছে, তাহলে নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছি কেন? এগুলো তোমাদেরই করার কথা। অদ্ভুত মানুষ। যা খেতে দিচ্ছে সব খাচ্ছে, অথচ লুস মোসনের জন্যে ভর্তি!

জাহ্নবীর পাশের বেডটা খালি হয়েছিল। আবার ICU থেকে ৯২ বছরের একজন এলেন। ফর্সা টুকটুকে বৃদ্ধা। পড়ে গিয়ে চোট পেয়ে এখানে আগমন। একজন সিস্টার ওষুধ দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ও দিদা পড়ে গেলে কি করে?” দিদার উত্তর, “কি করবো মা, পেয়ারা গাছের ডাল থেকে পড়ে গেলাম। অনেক পেয়ারা হয়েছে পাকা পাকা, কেউ পেড়ে দেয় না, তাই উঠেছিলাম।”

বৃদ্ধার ছেলে বিকেলে দেখতে এলে তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, “বাড়িতে পেয়ারা গাছই নেই, মা নিজের ছোটো বেলার কথা বলেছে, আমাকে কখনো বাবা, কখনো কাকা বলে ডাকে, ছেলে বলে চিনতে পারে না”। দুপুর বেলা খাবার এলে বুড়ি দিদাকে খাইয়ে দিল একজন আয়া। দিদার খুব একটা খাবার ইচ্ছে ছিল না তাও একটু জোর করেই খাইয়ে দিল। খাবার পরেই তিনটি ক্যাপসুল পর পর। ব্যস, তার কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হল বমি আর নিঃশ্বাসের কষ্ট। জাহ্নবীর মনে হলো, এই বুঝি দিদা শেষ হয়ে গেল, মনে মনে ঠাকুরের নাম করে বলতে লাগলো,” হে ঠাকুর, একেবারে পাশের বেড, মারা গেলে খুব খারাপ হবে, রাতে ঘুমোতে পারবো না, চোখের সামনে মৃত্যু দিও না ঠাকুর।”

ভাগ্যক্রমে তখনও ডাক্তার বসু ছিলেন, অন্য ওয়ার্ড থেকে তখনই চলে এলেন। তারপর তিনজন সিস্টার, দুজন আয়া, আর একজন ডাক্তার সবাই মিলে পিঠ চাপড়ে, অক্সিজেন দিয়ে বুড়ি দিদাকে ফিরিয়ে নিয়ে এল। জাহ্নবীও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভাবল, রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারবে।

সারা সন্ধে বৃদ্ধা ভালই রইলেন, মেয়ে এসে দেখে গেল, বুড়ি চিনতেও পারল না। মেয়েও এ ব্যাপারে অভ্যস্ত। কাল জাহ্নবীর ছুটি। রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। ওদিকে ঈশ্বরও মুচকি হাসলেন। বিরানব্বই বছরের বুড়ির নাকে যে এত জোর তা কে জানতো! এমন নাক ডাকা শুনে কে বলবে বুড়ি দুপুরে প্রায় শেষ হয়েই যাচ্ছিল আর কি! আসলে জাহ্নবী ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছিল যে তার পাশের বেডে কেউ যেন না মরে, ঈশ্বর সেটা শুনেছেন, তাই রাতের প্রতি মুহুর্তে দিদা জাহ্নবীকে অভয় দান করে বলেছেন, “ওরে মেয়ে ভয় পাস না, আমি বেঁচে আছি, ভীষণ ভাবে বেঁচে আছি।”

No comments