দূরত্ব – মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি
“পা ছড়িয়ে আবার ভাত খাচ্ছিস মিতুল? দেখবি, এত দূরে বিয়ে হবে মায়ের মরার সময় দেখতে পাবি না।” মেজমা রান্নাঘরের একপাশে যেতে যেতে ডিঙি মেরে কি একটা জিনিস তুলে নিয়ে সাড়ে চার বছরের মিতুলের উদ্দেশ্যে কথাকটি বলে চলে গেলেন রান্নাঘর সংলগ্ন দাওয়ায়। যাকে কথাটি বলা হল, সে তৎক্ষণাৎ পা-টি গুটিয়ে নিয়ে চাপটিকেলে বাবু হয়ে বসল। যদিও মৃত্যু কি, মরার আগে পরে কি হয় সে জানে না, শুধু জানে মরলে আকাশের তারা হয়ে যায় সব্বাই। তখন রাতের আকাশে তাদের যারা আপনজন তারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আকাশের তারা দেখতে ভালই লাগে, কিন্তু কাছের মানুষ, বিশেষ করে মা তারা হয়ে গেলে তাঁকে আকাশে খুঁজতে মিতুলের ভাবনাতেও কান্না উথলে ওঠে। মিতুলের ভারি বিচ্ছিরি রোগ পা ছড়িয়ে খেতে বসা, বড় জেঠি অনেকক্ষণ ধরে গল্প বলতে বলতে মুখে গরাস ঢুকিয়ে দেয়, আর সে গরুর জাবর কাটার মতো চিবিয়েই যায়, চিবিয়েই যায়। গলাদ্ধকরণ আর হতে চায় না। রান্নাঘরেরই একপাশে হেঁসেল। রাতে বাচ্চা, বউদের এখানেই খাওয়া দাওয়ার পাট সারা। তার মাঝেই মেয়েদের পাঠ দেন কাকী জেঠিরা। ভাল মেয়েমানুষ হওয়ার পাঠ। পা ছড়িয়ে সেজদা, বড়দা, মেজদারা খেলে কোনো দোষ নেই, কারণ ওরা ব্যাটাছেলে। ওরা মায়ের কাছেই থাকবে, মরার সময় মুখে জল দেবে। আর মিতুল কিনা মেয়েমানুষ, তাই তার ছোট্ট পা-টি ছড়িয়ে খেলে তার এত দূরে বিয়ে হবে যে, মাকে দেখতে পাবে না। বাড়ি শুদ্দু সবাই জানে এই একটি জায়গায় চোখ ঘোরানো, মুখ ঘোরানো মিতুল ভারি জব্দ। এমনিতে এত বড় বাড়িতে কোথায় মা আর কোথায় মিতুল তার খোঁজ নেই। একগাদা কাকী, জেঠি, দিদি, ঠাকমা, পিসি, তুতো দাদার মধ্যে বড় হয়ে ওঠা বাচ্চাদের মায়ের গায়ে গায়ে থাকতে হয় না। সাকুল্যে দিনে হয়তো তিন চারবার মায়ের কাছে আসা হয়, আর রাতে মায়ের কোলটি ঘেঁষে শোয়া। তাও ভোর রাতে পাশ থেকে মা কখন টুক করে উঠে যায় টের পাওয়া যায় না। পূব আকাশের সুয্যি প্রথম যখন মিতুলের মুখে আলো ফেলে, মিতুল পাশে হাত বাড়িয়ে মাকে খোঁজে, আর পায় না, তখনই তীব্র চিৎকারে গোটা বাড়ি শব্দময় হয়ে ওঠে… মা-আ …। ঠাকমা হাঁক পেড়ে বলে, ” হারামজাদি চ্যাঁচাচ্ছিস কেন লা? ঘুমো। ভয় নেই। মা ফুল তুলতে গেছে। মরেনি।” এই বাড়ির এক দোষ, সব কথায় মরণ-কে টেনে আনা। মরণের পারে কি আছে না জানলেও এ বাড়ির ছোটরা ভেতরে ভেতরে ওই দূরত্বকে ভয় পেয়ে গুটিয়ে যায়, লক্ষ্মী হয়ে বসে।
ঝলমলে রোদ। নীল আকাশ মাথার উপর উপুড় হয়ে আছে। ছোট্ট পাহাড়ি নদীর ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে মিতুল। চতুর্দিকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ গাছালি। তা থেকে একটা বনজ গন্ধ। দূর পাহাড়ে বড় বড় গাছের সারি, আর নদীর ধারে ছোট ছোট গাছে সাদা সাদা অসংখ্য ফুল, কুর্চি ফুলের মত। “ছোটো বেলার নাকের নোলোক হত এই ফুলের পাপড়ি, জানো রাতুল!” রাতুলের মুখে স্মিত হাসি। বুঝল কি! এই কুর্চি ফুলের মহিমা! কোনো পুরুষই কি বোঝে! হয়তো আছে এক আধজন। যারা এই ফুলের পাপড়ির দুরত্ব অতিক্রম করতে পারেন, তবে তাঁরা নগণ্য। দুটি দেহ যখন আগ্রাসী আকাঙ্ক্ষায় একে অপরকে আঁকড়ে ধরে তখন ও কি সব দূরত্ব অতিক্রম করার উপায় থাকে? মিতুল মনে মনে হাসে। রাতুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ হাসির কি হল?”
“ও তুমি বুঝবে না” মিতুল জবাব দেয়।
“সত্যিই মেয়েরা কেন হাসে কেন কাঁদে বোঝা খুব কঠিন।”
রাতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে মিতুল। এ হাসিতে বুকের মধ্যে অনেকখানি লুকোনো বিষাদের মাখামাখি।
নামী স্কুলে ভর্তি হবার অজুহাতে চলে এল ওরা সাবেকি বাড়ি ছেড়ে। এটাই বলেছিল মিতুলের জেঠি কাকী। দোষ দিয়েছে ন-বৌকে ঘরভাঙানি বলে। বড় বাড়িতে থাকতে ন-বৌয়ের যাবতীয় দায়িত্ব ছিল শাশুড়ি ও দিদিশাশুড়ির দেখাশোনা করার। বিয়ের পর থেকেই সে এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। এখন সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসায় অশক্ত শাশুড়িদের দায়িত্ব অন্য বউদের ওপর বর্তাল। সেজন্য ন-বৌ হয়ে গেল ঘরভাঙানি। মিতুলের সামনেই ওরা ওর মাকে এসব বলত। প্রতি মাসে একবার করে বড়বাড়িতে যাওয়া হতই। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মিতুল বড়বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে সে বাড়ি আর চিনতে পারে না। বাড়ির সাবেক রান্নাঘরে ছোট ছোট পাঁচিল উঠে সাত টুকরো। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা দরজা দেওয়াল ভেঙে লাগানো হয়েছে। বাড়ি ঢুকতেই বড় জেঠি হাত ধরে টানে “আমার কাছে খাবি, সেজ, মেজ র কাছে খাবি না খবরদার।”
ছোট কাকী মায়ের হাত ধরে টেনে নিজের ঘরে টিভি দেখাতে নিয়ে যায়। বড় জেঠির কাছে কিছু খেলে মেজ জেঠি মুখ গোমড়া করে বলে, “আমার কাছে খাবি কেন? আমি যে গরিব!” মিতুলের বড় বড় চোখ বিস্ময়ে আরও বড় হয়ে যায়। সম্পর্ক গুলো সব তালগোল পাকিয়ে যায়। ঘোষেদের বাড়ি ছুটে যেতে গেলে মেজমা চোখ পাকিয়ে বলে, “ওদের বাড়ির সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক নেই আমাদের, ওদের বাড়ি যাবে না খেলতে।” ঘোষেদের ছোট ছেলে টুকুন মিতুলের বড় ভাল বন্ধু। কিন্তু এ বাড়ির বড় জেঠুর মেয়ে তুলিদিদি ও বাড়ির শুভদাদাকে পালিয়ে বিয়ে করার পর সব সম্পর্ক শেষ দুবাড়ির। উফ! বাড়ির বড় মানুষ গুলো এতো জটিল কেন হয়! জবাব পাওয়া দুষ্কর, তাই দূরত্ব বাড়ে, ফাটল তৈরী হয় নিঃশব্দে।
“মা, তুমি ডাইনিং টেবিলে বাবু হয়ে চেয়ারে বসে খাও কেন?” রুনি প্রায় জিজ্ঞেস করে। মিতুল বলে “এমনি” “অভ্যেস”। সেই রুনি এখন দেশের বাইরে। অনেক রাতে ফোন করে খবর নেয়, গল্প করে, নাতির সঙ্গে কথা বলায় মিতুল আর রাতুলের সঙ্গে। মিতুল রুনি কে পা ছড়িয়ে, পা মুড়ে কোনো ভাবেই খেতে শেখায় নি। কে জানে মিতুলের মরার আগে রুনি মুখে জল দেবে কিনা! সারাজীবন আঁকড়ে ধরে রাখতে চাওয়া মাকে যখন নার্সিং হোমে ভর্তি করা হল, মিতুল তো সবসময়ই ছিল পাশে পাশে। কিন্তু ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়া মাকে শেষ মুহুর্তে দেখতে পায় নি মিতুল, জল দেওয়াও হয় নি। সারাজীবন বাবু হয়ে খেতে বসেও নয়।
“ও তোতাপাখিরে, শিকল খুলে উড়িয়ে দেব, আমার মাকে যদি এনে দাও।” এই গান নির্মলা মিশ্রের গলায় শুনলেই হাউমাউ করে কাঁদত মিতুল ছোটবেলায়। বড় হয়ে আর কাঁদত না। সরে যেত। যাতে মায়ের সাথে দূরত্ব না বাড়ে।
এখনও স্বপ্নে মা আসে রোজ। জড়িয়ে ধরে গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। তখন আর মিতুলের মনেই থাকে না এ জগত আর ও জগতের মাঝখানে দূরত্ব অনতিক্রম্য। শুধু স্বপ্ন ভাঙলে অপেক্ষায় থাকে একটা সাঁকো পেরিয়ে যাবার, সাঁকোর ওপারে আসবে মা, তার হাত ধরে তারাদের দেশে নিয়ে যাবে বলে। আজ মিতুল বুঝতে পেরেছে কোন দূরত্বই আসলে দূরত্ব নয়, শুধু একটা চেষ্টা থাকলেই সব কাছের হয়ে যায়।
Post a Comment