একদিন নিশীথে – নন্দিনী অধিকারী
আজ ভোরবেলা থেকেই দরিয়ার হাওয়া বড় বেসামাল। সূর্য গা ঢাকা দিয়ে কোথায় লুকিয়েছে কে জানে! ডিসেম্বরের শেষে অসময়ের এই মনখারাপি বৃষ্টি বড়দিনের আনন্দ সবার মাটি করে দেবে।
মঞ্জু বিছানায় শুয়ে শুয়েই বাইরের ছবিটা পড়ে ফেলল। এমন ছাইরঙা দিনে জীবন বড় অনিশ্চিত, অনর্থক মনে হয়। একলা থাকার দুঃখটা আরো গাঢ় হয়ে চেপে বসে।
কোথায় যেন কি একটা পড়ে যাবার আওয়াজ হল না? বিছানা থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে জানলা একটু ফাঁক করতেই মঞ্জু দেখল, “হায় রে! টালির চালে রাখা টেরাকোটার কুঁকড়োটা হাওয়ার তোড়ে মাটিতে পড়ে ভেঙে চৌচির হয়ে গেল! কতদিনের জিনিস! সেই শ্বশুরের আমলের। আরো খারাপ হবার কি কি আছে কে জানে!
এই লাল ঝুঁটিওয়ালা মোরগ নাকি পোর্তুগালে সুখশান্তি, সম্মান, বিশ্বাসের প্রতীক। এমনটাই বলেছিল না পাত্রো? “খেয়াল করে দেখবে মঞ্জু, গোয়ার সব পোর্তুগীজ কাসায় এই মোরগ রাখা আছে। আমার বাবাও ঘরের চালে মোরগ রেখে সংসারের সুখশান্তি চাইত। কি হল শেষমেষ বলো? মিঞা বিবি দুজনেই দুম করে চলে গিয়ে আমাকে একলা করে দিল”, দম ফাটা হাসিতে গোরা সাহেবের মুখ লাল হয়ে যেত। এতে এত হাসির কি আছে ? হাসিতে লুকোনো কি কান্না রয়ে গেছিল অন্তরে?
মঞ্জু অতশত বুঝত না। তার বোঝার দরকারও ছিল না। তখন তার পাত্রো, তার বস অ্যান্টোনিও ফার্নান্ডেজ যা বলত তাই তার কাছে বেদবাক্য। সেই তো মঞ্জুর দেবতা! তার মা-বাপ। স্বয়ং গণপতিবাপ্পা, যীশু, ভগবান। সে দেবতা যা শিখিয়েছে, পড়িয়েছে তাই দিয়েই তো খুঁটে খাচ্ছে এখনো মঞ্জু। তবে দুনিয়াকে চিনতে, বুঝতে এই বয়সে বড় ঠোকর খেতে হয়। মাঝেমাঝেই মুখ থুবড়ে পড়ে, আবার অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ায়।
না আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। অনেক অর্ডার আছে কেকের। কালকে সকালের মধ্যেই সাপ্লাই দিতে হবে। কিন্তু বড়দিনের উৎসবে যা দুর্যোগ শুরু হয়েছে! এ যাবত দেখা শান্ত দরিয়া হঠাৎ ক্ষেপে উঠেছে! নারকেল গাছগুলো একযোগে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে বলছে, না না না। ঝোড়ো হাওয়ায় চার্চের ঘন্টা দ্রুত, ঘন ঘন বাজছে। যেন দমকলের বিপদঘন্টি। এই দুর্যোগে মার্থা আর আসতে পারবে বলে মনে হয় না। একলা হাতে আর কত কি করবে মঞ্জু?
বড়দিনের আগে ঘরদোর একটু সাজাবে না অর্ডারী কেক বানাবে? দোকানের, ক্যাফের মালিকদের বায়নাক্কার যেন আর শেষ নেই।
— নতুন কোনো টেস্ট, অন্যরকম ফ্লেভার আনো কেকে। খরিদ্দাররা সবসময় নতুন কিছু চাইছে।
— আরে বাবা ফ্লেভার কি গাছে ফলে? কত আর নতুন টেস্ট আনা যায়? এতদিনের ফার্নান্ডেজ বেকারীর নাম কি এবার আমার হাতে পড়ে ডুবতে বসেছে?
প্রমাদ গণে মঞ্জু। এইসময় পাত্রোর অভাব খুব বেশি করে বোধ করে।
— এতরকমের কেক তো এতদিন বানালাম। বড়দিনের প্লামকেকে আর মন ওঠেনা সবার। যীশুর জন্মদিনের কেক তৈরি করতে কত আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। কত পরিশ্রম তার।
পাত্রো বলত, “প্লামকেক হল ভগবানের প্রসাদ। যীশুর আশীর্বাদেই এই কেক এত সুস্বাদু, মধুর হয়ে ওঠে।”
বড়দিনের প্লামকেক আভেনে ঢোকানোর আগে ব্যাটারে ছুরি দিয়ে একটা ক্রশ আঁকত পাত্রো। তারপর নিজের বুকে ক্রশ চিহ্ন। গোটা ভিলায় তখন উৎসবগন্ধ। মাখন, দারচিনি, ছোট এলাচ, ভ্যানিলা, চকোলেটের খুশিমাখা আমেজে বড়দিন এগিয়ে আসত। টুনিবাল্ব, নকল ঘন্টা, মোমবাতি, ক্রীসমাস ট্রীতে আনন্দের সোনালি রূপোলি ঝিকিমিকি। কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব দিন! গভীর দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর উঠে আসে।
মনখারাপ হলেই মঞ্জু সমুদ্রের কাছে চলে যায়। তাদের কালেগাঁওয়ের মাটি একটুখানি ছুঁয়েই সরে গেছে সমুদ্র। ছবির মত ছোট্ট গাঁওয়ে পাহাড় এসে মিশেছে দরিয়ার জলে। সূর্যাস্তের রাঙা আলো, পূর্ণিমার ফুটফুটে জ্যোৎস্না নারকেলগাছের ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁকে আরো মোহময় হয়ে ওঠে। সন্ধ্যে নামার আগে সোনালি ডানার শঙ্খচিল বাতাস কেটে দূর আকাশে উড়ে বেড়ায়। নোনা হাওয়ায় ভেসে আসে মঞ্জুর পাত্রোর কণ্ঠস্বর।সেই উদাত্ত, ভরাট গলা যেন ধ্বনিত হয় গোটা সমুদ্রতটে।
— কিচ্ছু হারায় নি মঞ্জু। সব আছে। আমিও আছি তোমার পাশে। আগের মতই।
মঞ্জু সে গভীর, গম্ভীর আওয়াজ বুকের মধ্যে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। এ তার ঈশ্বরের আশ্বাসবাণী। আবার নতুন উদ্যমে কেক বানায়। কেকের স্বাদগন্ধ নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে। মার্থা চোখ গোল গোল করে গালে হাত দিয়ে বলে, — তোমার কি হল তাঈ? এই তো কাল অবধি মাথার যন্ত্রণা, মন খারাপ নিয়ে বসে ছিলে! কি যে তুমি সাঁঝের বেলা একলা দরিয়ার কাছে গিয়ে বসে থাকো? আমার এসব মোটেই ভালো লাগেনা বলে দিচ্ছি।
— তুই এসব কিছু বুঝবি না। আমার মন খারাপ থাকলে তোর দাত্তু এসে আমার সঙ্গে কথা বলে। আমাকে সাহস দেয়। আমার মন ভালো হয়ে যায়।
নে নে, এখন তাড়াতাড়ি হাত চালা। ময়দা ছেঁকেছিস? চিনিটা গুঁড়ো করলি? রোজমেরি শেষ হয়ে গেছে যে সেকথা খেয়াল আছে তোর। আজ পয়সা নিয়ে যাস। বাজার থেকে কিনে আনবি।
মার্থা ভাবে মঞ্জুর মাথাটা মাঝেমাঝে খারাপ হয়ে যায় বোধহয়। বড্ড ভালোবাসা ছিল তো দুজনের! সে কিছু বলেনা। চুপচাপ নিজের কাজ করে।
মার্থাকে হাতে ধরে বেকিংয়ের খুঁটিনাটি শেখায় মঞ্জু। যেমনটি তাকে শিখিয়ে ছিল পাত্রো। আজকাল মনে হয় সে সব যেন কোন গতজনমের কথা!
বারো বছরের মঞ্জু কাকার হাত ধরে ফার্নান্ডেজের ভিলায় এসেছিল। তখন সে কালোকোলো এক মেছোপেত্নী। খড়ি ওঠা রোগা, ডিগডিগে, অপুষ্ট শরীর। রুক্ষ চুল হাওয়ায় ওড়ে। আঁশটে গন্ধ জেলেবস্তিতে কাটছে তার স্যাঁতসেঁতে শৈশব। বাবা দরিয়ায় রাতে মাছ ধরতে যেত। একদিন সাগরে ঝড় উঠল। তার নৌকা আর ফিরে এল না। মায়েরও যে কি হল! বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বিছানা নিল। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় সেও মরে গেল। অনাথ মঞ্জু এসে উঠল কাকার সংসারে। সেখানে তখনি চার পাঁচটা আগ্রাসী মুখ খিদের জ্বালায় হাঁ হাঁ করছে। মেছুনি কাকির বাক্যিতে আঁশবটির ধার।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মঞ্জুর আধো ঘুমন্ত শরীরটাকে নড়া ধরে টেনে ওঠায় কাকি,”জাগপ, উঠপ মঞ্জু”। মঞ্জু চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে কাকির সঙ্গে বড়া দরিয়ার তীরে যায়। সেখানে ততক্ষণে ভিড়ে গেছে জেলেদের মাছ ভরা নৌকা। ফড়েদের চেঁচামেচি, ভীড়। মঞ্জু কাকির নির্দেশমত ছোট ছোট হাতে জাল থেকে ছটফট করা মাছ ছাড়ায়। খাবি খাওয়া মাছগুলো দেখে মঞ্জুর খুব কষ্ট হয়। সে আনমনা হয়ে পড়ে। কাকি তাড়া লাগায়। ঘরে ফিরে মঞ্জুর খুব খিদে পায়, “মাকা ভুখ লাগলীহ কাকি”।
সংসারে একটা হাঁমুখ কমাতে কাকা যশবন্ত মঞ্জুকে অ্যান্টোনিও ফার্নান্ডেজের ভিলায় দিয়ে আসে। মাছের জাল থেকে মুক্তি পায় জেলেদের মেয়ে। কাকা মঞ্জুর মাথায় হাত রেখে বলে, “মন খারাপ করিস না মা। আমি প্রতি মাসে তোকে একবার করে দেখে যাব।”
মাসের প্রথমে যশবন্ত অ্যান্টোনিওর কাছ থেকে মঞ্জুর মাইনে বাবদ টাকা নিয়ে চলে যায়। কখনো তাদের দেখা হয়। কখনো হয় না।
মঞ্জু তার পাত্রোর বাসন মাজে। ঘরদোর বাগান সাফ করে। তরকারিপাতি কেটেকুটে, মশলা বেটেবুটে রেখে দেয়। পাত্রো নিজেই রাঁধে আর কেক বানায়। হরেক কিসিমের কেক। কি তার সুগন্ধ! মঞ্জু বুক ভরে সে ঘ্রাণ টেনে নেয়। পাত্রো কেকের ছাঁট মঞ্জুর জন্যে রেখে দেয়।
রাতে ঘুমানোর আগে বালিশের নিচে রাখা বাপ্পার ছবি বার করে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বলে, “হে বাপ্পা, আমাকে আর বেঘর কোরো না। আমাকে এখানেই রাখো। এখানেই আমি ভালো আছি।”
ভালো তো আছেই মঞ্জু। দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায়। চুলে তেল পড়েছে। পরনের জামাকাপড় পেয়েছে। শরীরে চেকনাই এসেছে। বাড়ন্ত দেহ একটু একটু করে ভরাট হচ্ছে। নিজের একটা বিছানা, ঘর পেয়েছে মঞ্জু। নিজেদের নোংরা, দুর্গন্ধ জেলেবস্তি আর সাহেবদের বাগানঘেরা ছিমছাম পরিপাটি ভিলার মধ্যে কত তফাৎ!
মঞ্জু ভয় পায় শুধু লালমুখো গোরা সাহেবকে। তার বাজখাঁই গলার আওয়াজকে। কোনো দরকারে যখন পাত্রো “মঞ্জু উউ “বলে ডাকে, বারো বছরের কিশোরী মেয়েটা তখন ভয়ে কুঁকড়ে যায়। অ্যান্টোনিও মাঝেমাঝে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে পানাহারে বসে। হো হো হাসির ফোয়ারা ছোটে লিভিং রুমে। কে জানে কোন অজানা আশঙ্কায় মঞ্জুর বুক কাঁপতে থাকে। নিজের ঘরে গিয়ে সে বাপ্পার শরণ নেয়।
এই দূরত্ব, ভয় অবশ্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সমুদ্রের স্রোত যেমন তার সোনালী বালিকে ভিজিয়ে দেয়, তেমনি করে পাত্রো দ্য বস্ আর তার আশ্রয়ী মঞ্জুর সম্পর্ক ভিজে যাওয়া বালির মত নরম হতে থাকে।
একদিন অ্যান্টোনিও হঠাৎ মঞ্জুকে জিজ্ঞেস করে, “মঞ্জু তুমি লেখাপড়া কদ্দূর করেছ? আমার ব্যবসার কাজে খানিকটা সাহায্য করতে পারবে?”
মঞ্জু মাথা নিচু করে লজ্জায় ঘাড় নাড়ে। পা দিয়ে পায়ের পাতা ঘষে।
— এর মানেটা কি? পড়াশোনা কিচ্ছু জানো না তুমি? শোনো, কাল থেকে সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে আমার কাছে একঘন্টা করে পড়বে। তারপর অন্য কাজ। সকালের পড়া রাতে ঝালিয়ে নেবে।
মঞ্জু বাধ্য মেয়ে হয়ে পড়াশোনায় মন দেয়। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে থাকে জেলেপাড়ার গরীব মেয়ে মঞ্জুর জীবন। মঞ্জু কেক বানানোয় হাত পাকায়। অ্যান্টোনিও যত্ন করে তার ছাত্রীকে শেখায় বেকিংয়ের এবিসিডি।
কাজ করতে করতে, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে দুজনের গল্পগুজব হয়। অ্যান্টোনিও বলে, “আমার বাবা পোর্তুগাল থেকে সমুদ্র পেরিয়ে কতকাল আগে গোয়ায় এসে পৌঁছল। মশলার ব্যবসায় টাকা পয়সা করে এই ফার্নান্ডেজ কাসা বানাল। গোয়ার এই শান্ত জীবন, ইন্ডিয়ার মাটির টানে আর ফিরে যেতে পারল না নিজের দেশে। রোমান ক্যাথলিক ধর্মে মেয়েদের সমুদ্রযাত্রায় বিধিনিষেধ আছে। তাই এদেশের মেয়ে বিয়ে করে সংসার পাতল এখানেই। বাবার কেক বানানোর শখ ছিল। মা শিখে নিল বেকিং। নিজের ব্যবসা চালু করল। মায়ের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমিও কাজ শিখলাম। ব্যবসায় জড়িয়ে গেলাম। আমার দুর্ভাগ্য মা-বাবা আমাকে একা করে দিয়ে দুজনেই বড় তাড়াতাড়ি ওপরে চলে গেল।”
মঞ্জু অবাক হয়ে সবটা শোনে। সে আর নিজের কথা কি বলবে? শেয়াল কুকুরের মত জীবন ছিল তার। এখানে তার পাত্রোর আশ্রয়ে মানুষের মত বেঁচে আছে। মঞ্জুর চোখ দিয়ে জল গড়ায়। তার দরিয়ায় হারিয়ে যাওয়া বাপ, মৃত্যুশয্যায় মায়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ মনে পড়ে। কাকা-কাকির ঘরের নরকযন্ত্রণার কথা ভেবে শিউরে ওঠে। দুঃখ ভুলতে সে দৌড়ে আশ্রয় নেয় সেই নারকেল গাছে ঘেরা ছোট্ট সমুদ্রতটে। পঞ্চদশীর চাঁদ ষোড়শী মঞ্জুর মুখে কিরণ ছড়িয়ে দেয়। কাঁধে হঠাৎ একটা চাপ অনুভব করে সে। চমকে দেখে পিছনে দাঁড়িয়ে তার পাত্রো। ঠিক যেন গীর্জায় রাখা যীশু ভগবানের
মত তার হাসি হাসি, পবিত্র মুখ।
মঞ্জুকে আরো অবাক করে দিয়ে পাত্রো তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। তারপর তার হাত ধরে চুমু খেয়ে বলে, “আমাকে বিয়ে করবে মঞ্জু? আমি তোমার থেকে অনেকটা বড় তবু একসঙ্গে থাকতে থাকতে কখন যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানিনা।
মঞ্জু কি বলবে? সে তখন বাকরুদ্ধ। আকাশের চাঁদ বুঝি সোনালি বালিতে নেমে এসেছে। তার চোখে আবার অশ্রুধারা। এত সুখও কি কপালে সয়?
ধর্ম পরিবর্তন করে মঞ্জুর নতুন নাম হল এলিজা। গ্রামের ছোট্ট চার্চে পাদ্রী তাদের বিয়ে দিলেন। শপথবাক্য পাঠ করালেন। পাত্রো তার বন্ধুবান্ধবদের ডেকেছিল। তারাই বিয়ের সাক্ষী ছিল। ভোজ খেল। কাকাকাকিও আশীর্বাদ করে গেল।
সংসারেও তারপর থেকে সুখের সাগর। পাত্রোর কেকের ব্যবসাতেও চড়চড় করে উন্নতি। দুজনে মিলে আনন্দে বানাত ফ্রুটকেক, প্যাসট্রি, প্যাটিস, মাফিন, বান, ডোনাট। গোয়ার বিখ্যাত ব্যাবিঙ্কা, ডোডোল, পিনাকা। রবিবার সেজেগুজে দুজনে চার্চে যেত। মঞ্জু প্রতিদিন সন্ধ্যেয় বাড়িতে যীশুর সামনে একটি করে মোমবাতি জ্বালাত। তুলসীতলায় একটি করে প্রদীপ দেখিয়ে বলত, হে দেশবিদেশের ঠাকুর দেবতা।আমার সুখের সংসার যেন এমনি থাকে। ধর্ম বদলালেও মঞ্জু কোনদিন এলিজা হয়ে ওঠেনি। তার পাত্রো দ্য বসের কাছে সে চিরদিনই মঞ্জু।
মঞ্জু যীশুকে যেমন ভক্তিশ্রদ্ধা করত, তেমন গণপতি উৎসবে ভিলায় গণেশ প্রতিষ্ঠা করত। মাতোলি দিয়ে সাজাত গণেশের আসন। জেলেদের ঘরে তিনদিন পর গৌরী আসেন ছেলের টানে। মঞ্জু ভক্তিভরে মা ভবানীর জন্যে রাঁধত ভাকরি, কাঁকড়ার ঝোল, চাটনি, মাছের রওয়া ফ্রাই। অ্যান্টোনিও এসব দেখে হো হো করে হাসত। বলত, “ছেলে খাবে ফলমিষ্টি আর মা খাবে রসালো আমিষ! এ কেমন কথা”। তবে ঐটুকুই। সহজ, স্বচ্ছ ছিল তাদের দাম্পত্য। কাজেকর্মে, উৎসবে, আনন্দে তরতর করে কেটে যাচ্ছিল জীবন। প্রতি পূর্ণিমার রাতে তারা দুজনে হাতে হাত দিয়ে বসে থাকত সমুদ্রতটে। কোনো কথা বলত না। চাঁদ, তারা, নারকেলগাছ, হাওয়া, নোনাজল সাক্ষী থাকত তাদের ভালোবাসার।বিয়ের পরপর মঞ্জু কখনো উচ্ছল হয়ে তার পাত্রোর হাত ধরে টানত, — এসো না , এই চাঁদের আলোয় ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু এগিয়ে যাই। চলো না, খুব ভালো লাগবে।
অ্যান্টোনিও আপত্তি করত, — না মঞ্জু, রাতে এসব রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। আমরা কাল সকালে আসব সমুদ্রে স্নান করতে।
তাদের এই ঝলমলে সুখভরা সংসারে একমাত্র অ-সুখ ছিল পাত্রোর অতিরিক্ত মদ্যপান। মঞ্জু আপত্তি করত, — কেন এত মদ খাও? শরীর ভাঙছে তোমার পাত্রো। সে রঙ, সে জেল্লা আর নেই। মুখে তোমার কিসের কালো কালো ছাপ। ডাক্তার দেখাবে চলো।
ধোপে টিকত না মঞ্জুর কোনো ওজর আপত্তি। অ্যান্টোনিও তার স্বভাবসিদ্ধ হো হো হাসি হেসে বলত, — আরে কিচ্ছু হবে না মঞ্জু। কোন ছোটবেলা থেকে মদ আমার সঙ্গী। এখন কি এসব ছাড়তে পারি? কিচ্ছু হয়নি আমার।
কিন্তু যা হবার তাই হল। মদ ধীরে ধীরে শেষ করে দিয়েছিল অ্যান্টোনিওর লিভারকে। আনন্দের দিনগুলো যেন কেমন দ্রুত শেষ হয়ে গেল মঞ্জুর। তার আজকাল মনে হয় সে যেন তিনঘন্টার একটা হৈচৈ, আনন্দের সিনেমা দেখে হল থেকে বেরিয়ে এসেছে।
মারা যাবার আগে মঞ্জুর হাত ধরে তার পাত্রো বলে গেছিল, “কথা দাও, আমার চলে যাবার পরও তুমি আনন্দে থাকবে। বড়দিনে বাড়ি সাজাবে। তোমার গণপতিকে আনবে। কেক বানাবে। মার্থা রইলো তোমাকে সাহায্য করার জন্যে। যদি বেশি মনখারাপ হয়, দরিয়ার কূলে যেও। আমাকে ঠিক খুঁজে পাবে দেখো।”
মঞ্জু কোনদিন তার বস তার পাত্রোর কথা অমান্য করেনি। শেষের দিকে অ্যান্টোনিওর শরীর বেশি খারাপ হল। মার্থাকে রাখা হয়েছিল ব্যবসার কাজে সাহায্য করার জন্যে। সেই থেকে মার্থা প্রতিদিন আসে মঞ্জুর কাছে। সারাদিন বেকারির নানা কাজকর্ম দুজনে সামলায়। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে যায় মার্থা।
কিন্তু আজ কেন সবকিছু অন্যরকম? একলা হাতে বেকিংয়ের সব কাজ সামলে মঞ্জু তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালালো। যীশুর মূর্তির কাছে একটুকরো কেক রেখে মোমবাতি ধরিয়ে প্রার্থনা করল। বাড়িতে সাজানো সমস্ত টুনিবাল্বের আলো জ্বেলে দিয়ে সীবীচের দিকে পা বাড়ালো।
মেঘলা আবহাওয়ার মত তার মন আজ বড় ধূসর, উদাস। চলার গতি শ্লথ। ঝোড়ো হাওয়ায় কেটে কেটে যাচ্ছে গীর্জা থেকে ভেসে আসা ক্যারলের সুর। সমুদ্রের সবটুকু আজ বড় ধোঁওয়া ধোঁওয়া। দূরের পাহাড় ঝাপসা। দরিয়ার পানি কতদূরে সরে গেছে!
মঞ্জু কই আজ আর তার পাত্রোর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে না তো! ভিজে বালির ওপর দিয়ে সেই জেলের মেয়ে এক পা এক পা করে চলতে শুরু করল। আর কতদূরে গেলে পাত্রোর গলার আওয়াজ সে শুনতে পাবে? মঞ্জু এগিয়ে গেল। ঢেউ আরো পিছনে সরে গেল। এগিয়ে যেতে যেতে সেই ধোঁওয়া ধোঁওয়া সমুদ্রে সে যে কোথায় হারিয়ে গেল, কেউ তার আর কোনো খবর পেল না। ভিজে বালিতে মঞ্জুর পায়ের ছাপও একসময় মুছে গেল।
কালেগাঁওতে ফার্নান্ডেজ কাসা এখনো অতীতের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। ভিলা ঘিরে ঝোপঝাড়। সাপখোপের বাস। অনেকেই নাকি দেখেছে ক্রিসমাসের রাতে সেখানে এক অপার্থিব আলো জ্বলে ওঠে। বড়দিনের সেই সময়টাতেই প্লামকেকের উষ্ণ, স্বর্গীয় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পরিত্যক্ত ভিলার আশেপাশে। সবাই যে তা অনুভব করতে পারে এমনটা নয়। কেউ কেউ পারে!
Post a Comment