গড়াই নদীর ইলিশ – মনোজিৎ কুমার দাস

গড়াই নদীর ইলিশ – মনোজিৎ কুমার দাস

কলকাতা থেকে কার্তিক সেন তাঁর জমিদারি সেরেস্তার নায়েবকে লিখেছেন — “শ্রাবণের শেষ দিকে জমিদারী কাচারিতে আসিতেছি। জানিপুরের ঘাটে বোট রেডি রাখিবে। খোকসা রেলস্টশনে রহমত ঘোড়াগাড়ি নিয়া যেন প্রস্তুত থাকে। কত তারিখে গোয়ালন্দ মেলে আসিবো তা পরের চিঠিতে জানাইতেচ্ছি। ”

এইটুকু পড়ে নায়েব মশাইয়ের যেন মাথাটা ঘুরে যাবার অবস্থা! দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রহমত পেয়াদার দিকে একবার তাকিয়ে আবার জমিদার বাবুর চিঠির বাকি অংশে চোখ রাখলেন। কার্তিক সেনের হাতের লেখা যেন ছাপার অক্ষরের মতো।

“ললিত, তুমি হয়তো এটা জেনে অবাক হচ্ছ এই ভেবে এ সময়ে কলকাতার বালিগঞ্জ ছাড়িয়া আমার মতো ফুলবাবু জলজঙ্গলে ঘেরা জমিদারির তদারক করিতে বাঙাল দেশে যাইতে মনস্থ করিতেছি কেন। তবে শোন, চক্রদহের মিলনবাবু ঘোড়ার রেস আমাকে এক হাত দেখানোর পর … তিনি আমাকে বললেন’ ঘোড়ার রেসে হারজিত্ আছে। মন খারাপ করিবেন না। আমি বর্ষার সময় আমার জমিদারিতে ফিরে যাব। বর্ষা শুরু হলে তো রেসকোর্সে ঘোড় দৌড় বন্ধ হয়ে যাবে। আসুন না কার্তিক বাবু বাঙাল দেশের বর্ষা দেখে আসবেন। আপনার নায়েব গোমস্তরা তো বাজার থেকে পদ্মার ইলিশ খাইয়েছে , গড়াই নদীর ইলিশ তো ওরা খাওয়ানি , আর সাংলে জালে গড়াই নদীতে ইলিশ ধরার কী যে আনন্দ ! শ্রাবণের শেষ দিকে জমিদারি দেখতে যাওয়ার কথা জানিয়ে নায়েবকে চিঠি দিন। আমিও থাকবো। আসুন গড়াই নদীতে ইলিশ ধরা যাব।’তাই আমি বর্ষাকালে আসিতেছি’।

জমিদার কার্তিক সেনের চিঠির সবটা পড়ে ললিত নায়েব বিড়বিড় করে বললেন, এ দেখছি বড় একটা ল্যাটা! রহমত নায়েব বাবুর কথা ভাল ভাবে বুঝতে না তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘জমিদার বাবুর কি লিহেছেন, খারাপ কিছু!’

“জমিদার আসছেন এ মাসের শেষ দিকে…..” বিরক্ত সহকারে ললিত নায়েব রহমতের কথার জবাব দেন।

“কী কন! নায়েব বাবু, তিন মাস তো হয়নি তিনি আসি গেলেন, আবার আসতিছেন ক্যানে বান বর্ষার মধ্যি! বানের জলে প্রিজ্জা গেরে ধানপান ধৌত হইছে ইবার, কনথিকে তারা নজরানা দিবেন!”

রহমতের কথা শুনে নায়েব মশাই পিয়াদার ওপর ঝামটা মেরে ওঠেন এই বলে, ” নিজের চরকায় তেল দাও গে , রহমত। জলবর্ষায় জমিদার বাবু এলে পাড়ে তোমার কাজ বেড়ে যাবেনে ভাবে দেখিছ। বাবু এবার গড়াই নদীতে ইলিশ শিকারে আসছেন।”

নায়েব বাবুর কথা শুনে রহমত বলে উঠল, “সে তো ভাল কতা ! হানুগাঙেও তো বেজায় বান ডাকিছে। সুদোর পুরের কফিল মোড়ল নাকি ছাকনা জালে হানুগাঙ থিকে ইলিশ ধরিছে গত পরশু।”

“তাতে অবাক হবার কী আছে! হানু গাঙ তো জলে কানায় কানায় ভরা, গড়াই থেকে ভাটির টানে ইলিশ এ গাঙে আসাটা বিচিত্র কী!”

ললিত নায়েব ভাবেন, কার্তিক সেন পদ্মার ইলিশের পাতুরি, সর্ষে ইলিশ খেয় রসনা তৃপ্ত করেন এখানে এলেনই। কলকাতায় গঙ্গার ইলিশে কী পদ্মা ইলিশের মতো স্বাদ আছে।গড়াই নদীর ইলিশে নানা ব্যঞ্জন খেলে কার্তিক সেন তো পাগলই হয়ে যাবেন। যাক, বাবু এবার বর্ষায় এলে গড়াইয়ের ইলিশ খায়িয়ে পাগল করে দেব। রহমত কালও এক টাকায় এক হালি গাড়াইয়ের ইলিশ কিনে এনেছে বাঞ্চা মাঝির কাছ থেকে। অবশেষে, কার্তিক সেন গড়াই নদীর ইলিশ শিকারের জন্যে এসে উপস্থিত হলেন। কার্তিক সেন এর আগেও গড়াই নদী পথে কলকাতা থেকে জমিদারি তদারকি এসেছেন, এবারই প্রথম বর্ষাকালে এখানে আসা। বর্ষাকালের প্রমত্তা গড়াইকে এবারই তিনি প্রথম দেখলেন। এবার যেন কার্তিক সেন গড়াই নদীকে অন্য দৃষ্টি দেখতে পেলেন। রহমত ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে খোকসা রেলস্টেশনে গোয়ালনন্দ মেইল আসার অপেক্ষায় ছিল। স্টেশনে ট্রেন ভিড়তে সে দূর থেকেই দেখতে পেল ফাস্ট ক্লাশ কামরার জানালা জমিদার মুখ চোখে পড়ল। রহমত জানিপুরের গড়াই নদীর ঘাট নৌকা রেডি করে রেখেছে। জানিপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে কুঠি বাড়ি বেশি দূর নয়। পদ্ম আর গড়াইয়ে মাঝামাঝি স্থানে শিলাইদহ। রবীন্দ্রনাথ বোটে যেমন পদ্মনদী দিয়ে চলতেন তেমন ভাবে গড়াই নদী দিয়েও। কার্তিক সেনে মনে পড়ল গীতাঞ্জলির অনেক কবিতা জানিপুর গড়াই নদীর ঘাটে বসে লিখেছিলেন। পাল তুলে দিলে ভাটির টানে ছুটতে খাকল। বাঁক ঘুরতেই কার্তিক সেনের চোখ পড়ল পাল তোলা অসংখ্য ডিঙ্গি নৌকা।

রহমত বলে উঠল, “দেখেন বাবু, নদীর বুকে কত ডিঙ্গি নৌকা। শাংলে জাল পানিতে ফেল জালের দড়ি বসে ধরে আছে, আর একজন বোইটা টানছে। ইলিশ জাল আটকালেই জাল টেনে তুলবে।”

জমিদার বাবু ইলিশ ধরার দৃশ্য দেখার জন্য নৌকার ছই এর ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। উজান ঠেলে আসা একটা নৌকার দিকে চোখ পড়তেই কার্তিক সেন দেখতে পেলেন দড়ি ধরে বসে থাকা লোকটা আস্তে আস্তে তার হাতে দড়ি টেনে তুলছে। সত্যিতো জালে আটকা পড়া বড় সাইজের একটা রূপোলি রঙের ইলিশ জাল থেকে ছাড়িয়ে নৌকার খোলের মাঝে ফেল দিয়ে লোকটা আবার তার জালটা জলে নামিয়ে দিতে দেখলেন। তিনি মনে ভাবলেন, কতবার জমিদার দেখতে এপথে নৌকায় গিয়েছি, এমনকরে ইলিশ ধরা দৃশ্য তো দেখিনি।

জমিদারবাবু বলেন, “রহমত, ওরা কি নৌকা থেকে ইলিশ বিক্রি করে? বিক্রি করলে কয়েকটা কিনে নেওয়া …”

“বলতিছেন কী! আমাগেরে কী কিনে খাতি হবি। রাতির বেলা আমি দুই হালি ইলিশ ধরিছি। তার থিকে এক হালি ইলিশ নায়েব বাবুকে দিছি।”

“তাই নাকি, রহমত।”

কার্তিক সেনকে নিয়ে রহমত কাচারি বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়াল সন্ধের আগেই। চক্রদহের জমিদার মিলন বাবু ও নায়েববাবু ঘাটে অপেক্ষা করছেন দেখে কার্তিক সেনের মনটা বেজায় খুশি। রাতে রহমতের দেওয়া ইলিশ মাছের নায়েব গিন্নির রান্ন করা নানা পদের ব্যঞ্জন থেয়ে কার্তিক সেন বেজায় খুশি হয়ে নায়েব বাবুকে বললেন গড়াই নদীর ইলিশের সাদই আলাদা। কার্তিক সেন যে কয়দিন কাছারি বাডি ছিলেন সেই কয়দিনই গড়াই নদীতে ইলিশ ধরতে গেলেন রহমতদের সাথে। সাথে মিলনবাবু আর নায়েব বাবুরা ছিলেন। তরতাজা ইলিশ ধরা পড়ল ও হালিহালি। নায়েব গিন্নির হাতের রান্না করা গড়াই নদীর ইলিশের পঞ্চ ব্যান্নন আর ইলিশের তেল থেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন জমিদার বাবু কার্তিক সেন। কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগে নায়েব বাবুকে কার্তিক সেন বলে গেলেন গড়াই নদীর ইলিশের স্বাদ নেওয়ার জন্য প্রতি বছরই বর্ষাকালে এখানে আসবেন।

No comments