অদৃশ্য মানুষ – আলী ইমাম
বছরের এ সময়টাতে বাতাস এখানে খুব অশান্ত হয়ে ওঠে। দুপুরের পর থেকেই বইতে থাকে ঝড়ো হাওয়া। অবিরাম তুষার কণা ঝরতে থাকে। লোকজন এখন সহজে ঘরের বাইরে আসে না। কখনও সামুদ্রিক ঝড়ের মতো মনে হয় আবহাওয়াটাকে । ইংল্যান্ডের এ অঞ্চলের গ্রামগুলোতে তাই বেশির ভাগ লোকজন বছরের এ সময় ঘরে আগুন জ্বেলে বসে থাকে। গ্রামের হাটগুলোতে তখন প্রচুর বুনো তিতির পাখি বিক্রি হতে দেখা যায়। লোকজন ঘরে বসে তিতিরের ঝলসানো মাংশ খেতে পছন্দ করে ।
এ রকম এক শীতার্ত সন্ধেবেলায় ইপিং গ্রামের সরাইখানার সামনে একটি অদ্ভুত ধরনের লোক এসে দাঁড়াল। লোকটির সমস্ত শরীর ব্যান্ডেজে মোড়া। মুখটাও ব্যান্ডেজ দিয়ে পেঁচানো। গ্রামের কুকুরগুলো ওই। লোকটিকে ওভাবে দেখে চিৎকার করছিল। সরাইখানাটি চালান মিসেস হল। তিনি কুকুরগুলোর চিৎকার শোনেন। তার কাছে মনে হয় কুকুরগুলো যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ডাকছে । কাঠের বারান্দায় মানুষের উঠে আসার শব্দ। এই রকম তুষার ঝরা সন্ধেবেলায় আবার কে এলো।
মিসেস হল বাতি হাতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন । দেয়ালে তার ছায়া কাঁপছে। বিচিত্র ধরনের সেই আগন্তুককে দেখে মিসেস হল-এর শরীর কেমন যেন শিরশির করে উঠল। আগন্তুকের মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ব্যান্ডেজে ঢাকা।
আমার জন্যে একটি থাকার ঘর দিন। নিরিবিলি দিকে দেবেন। ঘরে যেন আগুনের ব্যবস্থা থাকে। প্রচণ্ড শীত পড়েছে এবার।
আসুন।
মিসেস হল আগন্তুককে কোণার ঘরটিতে নিয়ে যান।
আশা করি এই ঘরটি আপনার নিশ্চয়ই পছন্দ হবে। আপনি এবার বিশ্রাম নিন। আমি আপনার জন্যে গরম স্যুপ নিয়ে আসছি।
আগন্তুক ঘরে ঢোকে।
কিছুক্ষণ পর মিসেস হল ধোঁয়া ওঠা স্যুপের একটি বাটি নিয়ে প্রবেশ করেন। ঘরে ঢুকে একটু বিস্মিত হন মিসেস হল। আগন্তুক তখনও ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মাথা অনাবৃত। সমস্ত মুখমণ্ডল ব্যান্ডেজে ঢাকা। স্যুপের বাটিটিকে টেবিলে রেখে মিসেস হল বলেন, আমি জানতাম না যে আপনি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। আপনি এতটা আহত।
আগম্ভক বলে, আমি এখানে এসেছি নিরিবিলিতে আমার গবেষণার কাজ চালাতে। আমি চাইব না কেউ আমাকে অযথা বিরক্ত করুক। আমার কাজে কোনো রকমের ব্যাঘাত ঘটাক। আগামীকাল ভোরে আমার মালপত্র এখানে এসে পৌছাবে।।
মিসেস হল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার কাছে লোকটিকে কেমন যেন অস্বাভাবিক ধরনের বলে মনে হলো
পরদিন সকালে লোকটির মালপত্র এসে হাজির হলো সরাইখানাতে। লোকটি বেরিয়ে এলো তার ঘর থেকে। বেয়ারাকে বলল মালগুলো তার ঘরে নিয়ে যেতে। লোকটিকে দেখেই কোথেকে একটা কুচকুচে কালো কুকুর তীব্র বেগে ছুটে এলো। এসে লোকটির বাঁ পায়ে কামড় বসাল। তারপর লোকটির প্যান্টের এক টুকরো ছিড়ে নিয়ে দৌড়ে পালাল। ঘটনাটি ঘটে গেল আকস্মিক সরাইখানার বেয়ারারা তখন অবাক হয়ে বলাবলি করছিল লোকটির পোশাকের নিচে কোনো শরীরের অংশ দেখা যায়নি। সেখানে ছিল শূন্য জায়গা।
রাতের বেলায় মিসেস হল আগন্তুকের ঘরে গেলেন খাবার নিয়ে। আসার শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল আগন্তুক। মিসেস হল চমকে দেখলেন লোকটির চোখের কোটরে ঘন অন্ধকার । তাড়াতাড়ি লোকটি তার চশমা পরে নিল।
আমি ভেবেছিলাম আপনি দরজায় টোকা দিয়েছেন।
আমি ঠিকই টোকা দিয়েছি। কিন্তু আপনি গবেষণার কাজে এত ব্যস্ত ছিলেন যে সে শব্দ বোধ হয় শুনতে পাননি।
দেখুন, আমার গবেষণার কাজটি বেশ জরুরি। একটু বাঁধা পেলেই আমার বেশ অসুবিধে হয়।
মিসেস হল তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ইপিং গ্রামের লোকজন সরাইখানার সেই রহস্যময় আগন্তুককে নিয়ে বেশ কৌতূহলী ছিল। তাকে সরাইখানার বাইরে আসতে বেশি দেখা যেত না । দিনরাত সে ঘরের ভেতরে দরজা বন্ধ করে গবেষণার কাজ করত। এর মধ্যে কয়েক মাস কেটে গেছে।
ইপিং গ্রামের একজন প্রবীণ চিকিৎসক একদিন লোকটির সঙ্গে পরিচয় হতে এলো। চিকিৎসক সরাইখানার বেয়ারাদের কাছে শুনেছিল তারা নাকি দেখেছে লোকটির বাঁ পায়ের নিচে হাড় মাংশের কোনো চিহ্ন নেই। কথা শোনার পর থেকেই ওই বিচিত্র লোকটির প্রতি তার কৌতূহল বেড়েছিল। সরাইখানার কোণার ঘরটির সামনে এসে প্রবীণ চিকিৎসক দরজায় টোকা দিলেন। দরজা খুলে গেল। সামনে সেই ব্যান্ডেজ ঢাকা মুখ। স্বল্প আলো তাকে রহস্যময় দেখাচ্ছে।
শুনলাম আপনি গবেষণা করছেন। তাই আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে এলাম।
আগন্তুক তখন করমর্দনের জন্যে পকেট থেকে হাত বের করল। চিকিৎসক বিস্মিত হয়ে দেখলেন তার সামনে শুধু কোটের হাতাটি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে কোনো রকমের হাত নেই।
এ কি! আপনার হাত কই?
এই যে।
আগন্তুক তখন তার হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে চিকিৎসকের নাকের ডগাটা ছুঁয়ে দিল। চিকিৎসক নাকের ডগায় তখন শীতল আঙ্গুলের স্পর্শ অনুভব করলেন। কিন্তু কোনো হাতকে দেখতে পেলেন না। তার শরীর ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। একী ভুতুড়ে কাণ্ড। তিনি তখন দৌড়ে পালালেন।
এর কিছুদিন পর সরাইখানার এক ঘর থেকে এক থলি টাকা চুরি হলো । সে ঘরের দরজাটি ছিল খোলা।
একদিন মিসেস হল সেই রহস্যময় আগন্তুকের ঘরে তার খোঁজে গেলেন। ঘরটি খোলা। আগন্তুককে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এদিক ওদিকে তাকালেন মিসেস হল। হঠাৎ দেখা গেল একটি মাথার টুপি শূন্যে ভাসছে। একটি কাঠের চেয়ার মেঝে থেকে শূন্যে উঠে গেল। তারপর তার দিকে ছুটে এলো। যেন তাকে কেউ চেয়ার দিয়ে আঘাত করতে চাইছে। মিসেস হল দারুণ ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। অমনি ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। মিসেস হল শুধু আতঙ্কিত মুখে বিড়বিড় করে বললেন, শয়তান, আমার সরাইখানার আসবাবপত্রে শয়তান এসে ভর করেছে। অশুভ আত্মা এসেছে এখানে।
মিসেস হল ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত পাহারায় রইলেন। দুপুরের দিকে দেখা গেল আগন্তুক তার কোণার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। সিঁড়ি দিয়ে নামল। মিসেস হল বললেন, কী আশ্চর্য, আপনি ভেতরে! আমি তো ভেবেছিলাম যে আপনি বাইরে গিয়েছেন। আপনি ঘরে এলেন কখন? কারণ যারা এই সরাইখানায় থাকে তারা সবাই একই দরজা দিয়ে আসে। আপনি কী করে এলেন তা আমি জানতে চাই।
মিসেস হলের প্রশ্নে আগন্তুক রেগে গেছে বোঝা গেল।
আপনি বোধ হয় ধারণা করতে পারেননি আমি কে বা কি। দেখুন। তাহলে আমি কি।
এ কথা বলে আগন্তুক তার মাথার টুপিটি তুলে ধরল। তার চোখ থেকে চশমা সরাল। সঙ্গে সঙ্গে মিসেস হল অবাক বিস্ময়ে দেখলেন ওই চোখের জায়গাটি শূন্য। মাথার স্থানে বিরাট গর্ত। আগন্তুক তার মুখে বাঁধা ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল। চড়চড় করে খুলে যেতে লাগল পেঁচানো বাঁধন। ব্যান্ডেজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল কোট-প্যান্ট পরা একটি মাথাহীন দেহ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ রকম অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সরাইখানার বাকি লোকজন ভয়ে চিৎকার করতে লাগল। মিসেস হল ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। একজন গিয়ে পুলিশকে ডেকে আনে। পুলিশটা তখন সামনের পথ দিয়ে যাচ্ছিল।
কই, কী হয়েছে শুনি? কিসের এত গণ্ডগোল?
বলতে বলতে লম্বা পুলিশটা ঢুকল। লোকজন তাকে সেই মুণ্ডহীন দেহটাকে দেখিয়ে দিল । কেউ কেউ চিৎকার করছিল ভূত, ভূত বলে ।
কিসের ভূত! আমি ভূতের নিকুচি করছি। আমার সঙ্গে কিনা বুজরুকি।।
পুলিশটা লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে এসে দাঁড়াল আগন্তুকের সামনে।
আগম্ভক তখন গম্ভীর কণ্ঠে বলে, সামনে থেকে সরে যাও বলছি ।
কি, আমাকে আবার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এত বড় স্পর্ধা!
বলে পুলিশটা লাফিয়ে এসে আগন্তুকের গলা চেপে ধরে। আগন্তুক তখন পুলিশটির নাক বরাবর এক ঘুষি চালায়। সেই আঘাতে ছিটকে পড়ে যায় পুলিশটি। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে সে। তার নাক ফেটে দরদর করে রক্ত পড়তে থাকে। অদৃশ্য আগন্তুক তখন তার পোশাক খুলে ফেলল।
হতভম্ব হয়ে গেছে পুলিশসহ বাকি সবাই। আগম্ভক বলল, তোমরা আমাকে মোটেই দেখতে পাবে না। আমি তোমাদেরই মতো মানুষ। কিন্তু আমার এক আশ্চর্য ধরনের ক্ষমতা রয়েছে। আমি অদৃশ্য।
সরাইখানার খোলা দরজা গিয়ে অদৃশ্য মানুষ বাইরে বেরিয়ে গেল। কয়েকজন লোক ভয়ার্ত কণ্ঠে শুধু বলল, অদৃশ্য মানুষ! তাকে আর ধরা যাবে না।
সেদিন শেষ বিকেলের দিকে ইপিং গ্রামের এক বয়স্ক চাষি বসেছিল পাইন বনের কাছে। চারপাশে ঝোপঝাড়। ছোট ছোট মৌটুসি পাখিরা উড়ছে। চাষিটি বসেছিল একটি পাইন গাছের নিচে। হঠাৎ সে মানুষে গলার শব্দ শুনতে পেল। চারদিকে তাকিয়ে চাষিটি কাউকে দেখতে পেল না। ঘাসফড়িঙ বিনবিন করছে। আবার শব্দ শোনা গেল।
কে?
চমকে উঠল চাষি।
তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমার ঠিক সামনেই রয়েছি।
মানে। তুমি আমার শরীরের ভেতর দিয়ে সব কিছু দেখছ । তুমি কি বাতাস?
না, আমি একজন মানুষ।
মানুষ!
অদৃশ্য মানুষ।
চাষিটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সে অদৃশ্য মানুষের কথা গত ক’দিন ধরে শুনছে। গ্রামের বিভিন্ন লোক অদৃশ্য মানুষের বিভিন্ন বিচিত্র ঘটনা বলাবলি করছিল।
তুমি যে মানুষ তা আমি বুঝতে চাই। তোমার হাতটা দাও তো।
অদৃশ্য মানুষ তখন চাষিকে তা দিয়ে জড়িয়ে ধরল। বৃদ্ধ চাষি শিউরে উঠল সেই শিরিশিরে স্পর্শে।
শোন, আমি তোমার কাছে সাহায্য চাইছি। তুমি আমাকে পোশাক, খাদ্য আর আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করবে। প্রতিদানে আমি তোমার অনেক কাজ করে দেব। বুঝতেই পারছ, অদৃশ্য হয়ে থাকার জন্যে আমার রয়েছে প্রচুর ক্ষমতা। কিন্তু তুমি যদি আমার সঙ্গে কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতা করো তবে কেউ তোমার মৃত্যু রোধ করতে পারবে না।
বৃদ্ধ চাষি বুঝল অদৃশ্য মানুষের পাল্লায় পড়ে গেছে সে। সহজে তার হাত থেকে নিস্তার নেই। তাই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল।
এরপরের দু দিন চাষি অদৃশ্য মানুষের জন্যে অনেক কাজ করে দিল। অদৃশ্য মানুষ বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে কাজ করাল। এক সময় ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ল চাষি। তার স্নায়ুর উপর প্রবল চাপ পড়ছিল। এ রকমের অস্বাভাবিক পরিবেশে আগে আর কখনও পড়েনি সে। যে মানুষকে চোখে দেখা যায় না তার জন্যে কাজ করে দিতে হচ্ছে। সে মনে মনে ভাবছিল কীভাবে এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। একদিন সুযোগ পেয়ে প্রাণপণে বনপথ দিয়ে ছুটতে লাগল। অদৃশ্য মানুষটাও তখন তার পিছু নিল। বৃদ্ধ চাষি চিৎকার করতে করতে ছুটছিল।
আমাকে তাড়া করছে। সে আসছে।
পথচারীরা তার সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ অবাক হয়ে। জিজ্ঞেস করছে, কে আসছে?
অদৃশ্য মানুষ আসছে। আমাকে তাড়া করছে।
সামনে একটা সরাইখানা দেখতে পেয়ে তার ভেতরে ঢুকে পড়ল চাষিটি। তার কথা শুনে সরাইখানার বাকি লোকেরা দরজা জানালা ঝটপট বন্ধ করে দিল। কেউ কেউ পিস্তল নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল অদৃশ্য মানুষের জন্যে। হঠাৎ দেখা গেল চাষিটি মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কেউ যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। চাষিটি মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। আর আর্তনাদ করে বলতে লাগল, অদৃশ্য মানুষ আমার গলা চেপে ধরেছে।
অনেকেই এগিয়ে এলে তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু অদৃশ্য ঘুষির আঘাতে সবাই ছিটকে গেল। কিছুক্ষণ পর সরাইখানার দরজা খুলে অদৃশ্য মানুষ বেরিয়ে গেল।
সরাইখানার ভেতরের লোকগুলো পিস্তল হাতে বেরিয়ে গেল। তারা বাইরে এসে চারদিকে গুলি ছুড়তে লাগল। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করল অদৃশ্য মানুষের মৃতদেহের জন্যে।
সরাইখানার কিছু দূরেই ছিল ডাক্তার কেম্পের বাড়ি। তার কানেও গেল গুলির শব্দ। কৌতূহলী হয়ে ডাক্তার কেম্প পেছনের বারান্দায় গেলেন। পাখি শিকার করছে নাকি কেউ? এ সময় বুনোঁহাসের ঝাঁক আসে এ দিকের হ্রদে। হঠাৎ ডাক্তারের মনে হলো পেছনের বাগানে কেউ যেন শুকনো পাতা মাড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। ডাক্তার সেখানে কাউকে দেখতে পেলেন না।
এর কিছুক্ষণ পর ডাক্তার কেম্পের বাড়ির দরজায় শব্দ শোনা গেল। কেউ যেন টোকা দিচ্ছে। ডাক্তারের বাড়ির কাজের মেয়েটি দরজা খুলল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ডাক্তার কেম্প কাজ করলেন। পড়াশোনা করলেন। কাজ শেষে দোতলার নিজের শোবার ঘরের কাছে এলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন দরজার হাতলে রক্তের দাগ। দরজা খুললেন। মেঝেতে রক্তের চিহ্ন। আর বিছানার চাদরটা পড়ে আছে মাটিতে। একপাশ ঘেঁড়া। হঠাৎ তিনি শূন্যে একটা রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ দেখতে পেলেন। কে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলল। একটা অদৃশ্য কণ্ঠ শোনা গেল, ডাক্তার, একদম চিৎকার করবে না। আমিই হলাম সেই অদৃশ্য মানুষ। আমি এখন আহত। তাই তোমার সাহায্য দরকার।
ডাক্তার কেম্প অবাক হয়ে শুনতে লাগলেন অদৃশ্য কণ্ঠস্বর।
আমার নাম গ্রিফিন। আমি ছিলাম বেলাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্র। আমি নিজেকে অদৃশ্য মানুষে পরিণত করেছি।
ডাক্তার কেম্প বললেন, আমি গ্রিফিন নামের একজন মেধাবী ছাত্রের কথা শুনেছিলাম। যে রসায়নে সোনার পদক পেয়েছিল।
আমিই সেই ছাত্র। কিন্তু তোমার এই পরিণতি কেন?
সব পরে বলব। এখন আমি আহত। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। কয়েকটি গুলি লেগেছে। এখন আমার চিকিৎসার খুব প্রয়োজন ডাক্তার।
ডাক্তার কেম্প তখন তার চিকিৎসা শুরু করলেন। চিকিৎসা করতে করতে বললেন, তুমি এমন অদৃশ্য হলে কী করে?
গবেষণা করতে করতে এই অদ্ভুত ক্ষমতাটি পেয়েছি। প্রথমে ভেবেছিলাম এই রহস্য শুধু আমার নিজের কাছেই রাখব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার একজন অংশীদার প্রয়োজন।
রাতের বেলায় ডা. কেম্প সেখানকার পুলিশের বড় কর্তার কাছে সব জানিয়ে একটি চিঠি লিখে লোক মারফত পাঠিয়ে দিলেন।
সকাল বেলায় খাবার টেবিলে এসেছেন ডা, কেম্প। তার সঙ্গে বসেছে অদৃশ্য মানুষ।
আমি তোমার রহস্য জানতে চাই।
রুটিতে জেলি মাখাতে মাখাতে ডা, কেম্প বললেন। অদৃশ্য মানুষও খাচ্ছিল। সে বলতে লাগল, আমি উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছিলাম চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়তে থাকি। আমার একটি প্রিয় বিষয় ছিল আলোক রশ্মি। এই রশ্মির গভীরতা আমাকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলত। আশ্চর্য করত । এরপর আমি শারীরবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে থাকি। আমার কাছে একটি সত্য ধরা পড়ে। সে হলো, মানুষের হাড়, মাংশ ও অন্যান্য সব কিছু শুধু রক্তকণিকা ছাড়া অদৃশ্য রঙবিহীন কোষ দ্বারা গঠিত।
আমার মাথায় তখন নতুন ধরনের চিন্তা এলো। একদিন জানতে পার লাম গবেষণা করে রক্তকেও অদৃশ্য বা সাদা করা যায়। এরপর থেকে আমার একটাই ধ্যান। আমি অদৃশ্য হবে। তিন বছর ধরে একাগ্রভাবে গবেষণা করলাম। অবশেষে সফল হলাম। তৈরি করতে পারলাম সেই বিশেষ ওষুধ। একদিন রাতে সেই ওষুধ খেলাম। সারা রাত ধরে ওষুধটি আমার শরীরের ভেতরে কাজ করল। ভোরবেলায় আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে আমার কেননারকম প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম না। আমি অদৃশ্য মানুষে পরিণত হলাম।
অন্য কেউ যাতে এসব গোপন তথ্য জানতে না পারে সে জন্য গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেললাম। তারপর বেরিয়ে গেলাম পথে।
আশ্চর্য, আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। অথচ আমি সবাইকে দেখছি। কখনও ধাক্কা খেলাম পথ চলতি মানুষের সঙ্গে। পথচারীরা অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল । কিন্তু তারা কাউকে দেখতে পেল না। হালকা বরফের উপর আমার পায়ের দাগ দেখতে পেয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা আশ্চর্য হয়ে চেঁচামেচি করল।
ধীরে ধীরে আমার বিভিন্ন অসুবিধে দেখা দিতে লাগল। সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে উঠল। খাওয়া, থাকা, পোশাক পরা সব কিছুতেই আমার বেশ সমস্যা হচ্ছিল। আমি তখন হয়ে পড়লাম একাকী। ক্ষুধা আর শীত আমাকে কাবু করে ফেলল। মুখ ঢেকে রাখলাম ব্যান্ডেজে। কিন্তু আমার জীবন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠল। আবার আমি মানুষের মতো শরীর পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করতে লাগলাম । তাই চলে এলাম ইপিং গ্রামে। আশ্রয় নিলাম এক সরাইখানাতে। সেখানে একটি ঘরে শুরু করলাম গবেষণার কাজ।
ডা, কেম্প, এই কাজে জয়ী হতে আমাকে অনেক গবেষণা করতে হয়েছে। আমার এখন একজন বন্ধুর বিশেষ প্রয়োজন। আমি একটি জায়গা চাই থাকার জন্যে। নিয়মিত খাবার চাই। বিশ্রাম নেবার পরিবেশ চাই। কিন্তু আমার একার পক্ষে এসব করা সম্ভব হবে না। তাই তোমার সাহায্য চাইছি। আমরা দুজনে একত্র হয়ে সহজেই এক বিভীষিকাময় রাজত্ব চালাতে পারব। আমি নির্দেশ দেব। যারা আমার নির্দেশ মানবে না তাদের আমি হত্যা করব।
ডাক্তার কেম্প বলেন, কেন তুমি তাদের হত্যা করবে?
লোকের মনে ভয়ভীতি সৃষ্টি করার জন্যে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করার জন্যে।
এমন সময় নিচতলায় মানুষের হইচই শোনা গেল। কয়েকজন লোক ভারী বুট জুতোর শব্দ কাঠের সিড়ি তুলে আসছে। | অদৃশ্য মানুষ চিৎকার করে বলল, বুঝতে পেরেছি পুলিশ আসছে। তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ।
এ কথা বলে অদৃশ্য মানুষ তার পোশাক খুলে ফেলতে লাগল।
ডা, কেম্প তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু অদৃশ্য মানুষ শক্তি প্রয়োগ করে ঠেলে দরজাটা খুলে ফেলল। তারপর ডা. কেম্পকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা পুলিশদেরও ধাক্কা দিয়ে গড়িয়ে নিচে ফেলে দিল। তারপর ডা. কেম্পের বাড়ির দরজা একবার খুলল ও বন্ধ হলো । ডা. কেম্প অসহায়ের মতো চিৎকার করে উঠল, অদৃশ্য মানুষ চলে গেল।
পুলিশেরা ডা, কেম্পকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মনেই ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। অদৃশ্য মানুষ এখন ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় গ্রামে ঘিরে সে বিভীষিকার সৃষ্টি করবে। হত্যালীলা চালাবে। ডা. কেম্প বললেন, অদৃশ্য মানুষ যাতে খেতে, ঘুমাতে ও বিশ্রাম নিতে না পারে সেদিকটায় এখন বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এরপরের কয়েক ঘণ্টা অদৃশ্য মানুষের কোনো খবর পাওয়া গেল না। আশেপাশে গ্রামবাসীরা সতর্ক হয়ে উঠল।
সেদিন বিকেলে ডা. কেম্প একটি চিঠি পেলেন। তাতে লেখা, অদৃশ্য মানুষের আতঙ্ক শুরু হবে ডা. কেম্পের মৃত্যু দিয়ে।
ডা. কেম্প তাড়াতাড়ি পুলিশকে সব জানালেন। তার বাড়িঘরের চারদিক বন্ধ করে দেয়া হলো। কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হলো।
কিছুক্ষণ পর পুলিশের বড় সাহেব এলেন। ডা. কেম্প দেখল শূন্যে একটা পিস্তল উঠে এলো। তারপর গুলি করল পুলিশের বড় সাহেবকে। মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়লেন পুলিশের কর্তা। এরপর একটি অদৃশ্য কুড়াল এসে জানালায় আঘাত করতে লাগল । ডা. কেম্প পুলিশদের কয়েকটি লোহার দণ্ড দিলেন প্রতিরোধের জন্যে। হঠাৎ দরজা ভেঙে একটা কুড়াল শূন্য দিয়ে ভেসে প্রবেশ করল।
অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শোনা গেল, সাবধান পুলিশেরা। তোমরা সরে দাঁড়াও। আমি ওই বিশ্বাসঘাতক ডা, কেম্পকে চাই।
পুলিশরা তখন বলল, আমরা তোমাকে চাই।
তারপর যেদিক থেকে শব্দ আসছিল সেদিক লক্ষ করে পুলিশরা লোহার দণ্ড চালাতে লাগল। কুড়ালের এক আঘাতে একজন পুলিশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ডা. কেম্পকে খোঁজে কুড়ালটা। ডা. কেম্প জানালা খুলে রাস্তায় লাফ দিয়ে নামলেন। তারপর প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল।
পেছনে শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ।
ডা. কেম্প প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছেন।
পথচারীরা অবাক হয়ে দেখছে। ডা. কেম্প চিৎকার করছেন, অদৃশ্য মানুষ আসছে। অদৃশ্য মানুষ আমাকে তাড়া করছে।
এ কথা শুনে পথচারীরাও এলোমেলোভাবে দৌড়াতে শুরু করল। রাস্তার একপাশে একদল খনি শ্রমিক কাজ করছিল। ডা. কেম্প ছুটতে ছুটতে সেখানে এলেন।
বাঁচান আমাকে। অদৃশ্য মানুষ আমাকে খুন করতে চায়।
একথা বলে ডা. কেম্প মাটিতে পড়ে গেলেন। তার বুকের উপর চেপে বসলো অদৃশ্য মানুষ। তারপর ডা. কেম্পের গলা টিপে ধরল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছেন ডা. কেম্প। তার চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ডা. কেম্পের এই অবস্থা দেখে একজন খনি শ্রমিক তার হাতের শাবলটি দিয়ে কেম্পের বুকের একটু উঁচু স্থানে খুব জোরে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্তনাদের মতো শব্দ শোনা গেল। ডা. কেম্পের গলা থেকে সাঁড়াশির মতো চেপে থাকা অদৃশ্য হাত দুটো ধীরে ধীরে আলগা হয়ে গেল।
ডা. কেম্প মাটি থেকে উঠে বসলেন। পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, অদৃশ্য মানুষকে আহত করা হয়েছে। ও এখন মাটিতে পড়ে গেছে। ওর পা দুটো চেপে ধরো।
ডা, কেম্প হাতড়ে হাতড়ে অদৃশ্য মানুষকে ধরতে পারলেন। রাস্তার একপাশে একটা শরীর পড়ে আছে। চোখে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সেটার অস্তিত্ব অনুভব করা যাচ্ছে। ডা. কেম্প তার বুকের উপর ঝুঁকে হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করলেন। কোনোরকম নিশ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার শব্দ পেলেন না । ডা. কেম্প বললেন, অদৃশ্য মানুষ মরে গেছে।
খানিক পরে ওপাশ থেকে এক বৃদ্ধা চিৎকার করে উঠল, ওই তো আমি তার হাত দেখতে পাচ্ছি।
ধীরে ধীরে অদৃশ্য মানুষটির সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবয়ব নিয়ে ফুটে উঠতে লাগল। সমস্ত লোক নীরবে দাঁড়িয়ে এই অদ্ভুত দৃশ্যটি দেখতে লাগল। চোখের সামনে ক্রমশ ভেসে উঠছে একটি মানুষের শরীর। আকার পাচ্ছে। রক্তমাখা শরীর। শাবলের ক্রমাগত আঘাতে শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।
একটি চাদর এনে মৃতদেহটাকে ঢেকে দেয়া হলো।
(এইচ.জি, ওয়েলস-এর কাহিনি অবলম্বনে…)
Post a Comment