জীবনযাপন - জীবনানন্দ দাশ

জীবনযাপন - জীবনানন্দ দাশ

জীবনযাপন – ১

অজিত চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতেই দরজা ঠেলে তারকবাবু ঢুকলেন—

অজিত বললে—বসুন রাঙাখুড়ো-এই রাজেন চেয়ার দে—

রাজেনকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না, কোনো প্রয়োজনও ছিল না, অজিত নিজের হাতেই শশব্যস্তে চেয়ার টেনে দিয়ে বললে—বসুন তারপর কি মনে করে রাঙাখুড়ো-তামাক দেব?

ডনা না না তামাকের কোনো দরকার নেই-দিলেও তোমার এখানে আমি খাব না তো।

অজিত বিস্মিত হয়ে বললে—কেন রাঙাখুড়ো—

—না-না-না—

অজিত ঘাড় হেঁট করে আধ মিনিট চুপ থেকে বললে—সব ভাল রাঙাখুড়ো?

—সব ভাল—

তারকবাবু কোঁচানো চাদরের জোড় একবার ঘাড়ের থেকে উঠিয়ে আবার বিন্যস্ত করে নিয়ে বললেন-বড় আঘাত পেয়ে তোমার কাছে এসেছি অজিত—

—আপনি আঘাত পেয়েছেন?

—হ্যাঁ অজিত।

—কেন?

—অজিত, তুমি শেষ পর্যন্ত থিয়েটারে নামলে?

অজিত ক্ষণকাল নিস্তব্ধ হয়ে তারকবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল।

তারকবাবু বললেন-তোমার বাবার কথা কি তুমি একটুও মনে কর নি?

অজিত কোনো কথা বললে না।

—তোমার মাকেও ভুলে গিয়েছিলে?

অজিত কোনো উত্তর দিল না।

—তোমার মা সেই ছেলেবেলা থেকে কত যত্ন করে তোমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন—

অজিত বললে—রাঙাখুড়ো—

তারকবাবু বাধা দিয়ে বললেন-তারপর বি-এ পাস করলে-এম-এ পাস করলে—

–হ্যাঁ

—তোমার চরিত্র তোমার বাপের মত মর্যাদা পেল-অন্তত আমরা তাই ভেবেছিলাম-অনেক দিন অব্দি ভেবেছিলাম-কিন্তু তোমার যত অধঃপতন হোক না কেন-এ সব দিকে যে তুমি আসবে কোনোদিন এ কথা তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না—

অজিত বললে—এসে পড়লাম।

—এসে পড়লে? থিয়েটারে? মহিমের ছেলে হয়ে?

তারকবাবু বললেন-তোমাদের পরিবারকে আমি চিরজীবন ধরে এমন শ্রদ্ধা করে এসেছি অজিত। এ পরিবার বামুন বা কায়েত বা কোনো সদ্বংশজাতহিন্দু পরিবার বলেই নয়-কিন্তু এর মনুষ্যত্বের জন্য। তোমার ঠাকুৰ্দ্দা আমার বন্ধু ছিলেন-তামাকটি অব্দি ছুঁতেন না-কোনো দিন কোনো মজলিস মজুরোয় তাঁকে দেখি নি-সঙ্কীর্তন ছাড়া অন্য কোনো গান তাঁর অত্যন্ত উপেক্ষার জিনিস ছিল-স্বামী স্ত্রীর সম্বন্ধ ছাড়া অন্য কোনো রকম প্রেমই তিনি কোনো দিন স্বীকার করতেন না। মেয়েমানুষের শরীরের কোনো রকম ব্যাখ্যাও কেউই কোনো দিন তাঁর কাছে করতে সাহস পেত না, পরস্ত্রীর দিকে তিনি ভুলেও কোনো দিন তাকাতে যেতেন না,—অথচ উদার-হৃদয়ের কত সৌন্দর্যে ঐশ্বর্য্যশালী মানুষ-তোমার বাবা ও তো ঠিক তাঁরই মত-সব বিষয়েই তোমার ঠাকুৰ্দ্দার মত।

একটু থেমে তারকবাবু বললেন-আমি ভেবে পাই না তাঁদের বংশের সন্তান হয়ে তোমার বাপমায়ের হাতে চরিত্র গড়ে কি করে তোমার এ রকম অবস্থা হ’ল—

তারকবাবু হতভম্ব হয়ে অজিতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

অজিত একটু হেসে বললে—এই কথা রাঙাখুড়ো?

—কথাটা কি সামান্য অজিত?

—আপনার কাছে নয়—

—থাক, তর্ক করব না বড় দুঃখ পাই। তবুও এই কথাটুকু নিয়েও তোমার কাছে আসতাম না আমি যদি না জানতাম তোমার ভেতর তোমার বাবার মতই একটা চমৎকার মর্যাদা আছে—

—সে মর্যাদা আমি হারিয়ে ফেলি নি কি?

—চরিত্র খারাপ হ’লেও অনেক সময় তা হারায় না—হারায় না?

—না

—কিন্তু আমার চরিত্র খারাপ হয়েছে এ কথা কেন বলেন?

–এ সব দিকে এলে তা খারাপ হয়ই—

এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে অজিত বললে—অনেক দিন আপনাদের নানা জনের সঙ্গে আমার দেখানেই রাঙাখুড়ো-কিন্তু আপনারা সকলেই কি এই কথাই বলেন?

—হ্যাঁ, আমরা সকলেই এই কথা বলি—

—আপনার ছেলেরাও?

—হ্যাঁ

—আপনার নাতি নাতনীরাও?

—আমার ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী বলেই তো নয়-এমন অনেক সন্তান সন্ততি পরিবার রয়েছে যারা তোমার এ রকম পরিণতি দেখে অত্যন্ত দুঃখ করে, কেউ কেউ তোমাকে খুব ঘৃণাও করে অজিত—

তারকবাবু থামলেন

—রানীদিও দুঃখ করে বুঝি?

— কে, রানী?

—হ্যাঁ

—সে তো করেই

—কি বলে-?

—কিন্তু রানী একা বলেই তো নয়-এমন অনেক মা বধূ কন্যা রয়েছেন যাঁরা এতে অত্যন্ত কষ্ট পান, খুব গ্লানি বোধ করেন।

অজিত বললে—কিন্তু রাঙাখুড়ো রানীদি কি বলে?

—রানী?

—হ্যাঁ

—রানী বলে-তারকবাবু একটু কেশে বললেন-রানী বলে যে অজিতের এ রকম দুর্ভাগ্য হবে তা স্বপ্নেও ভাবে নি—

তারকবাবু চুপ করে রইলেন—

অজিত চুপ করে রইল।

তারকবাবু বললেন-রানী তো খুব বেশি কথার মানুষ নয়—এই টুকুই বলে—

অজিত তারকবাবুর দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল —

একটু পরে বললে—কিন্তু রানীদিকে বোলো—

—এ সব নিয়ে রানীকে আমি কিছু বলতে পারব না।

—আচ্ছা, আমি গিয়ে তার সঙ্গে একদিন দেখা করব।

—তা যেও না।

—রানী দেখা করবে না?

—আমি বারণ করব।

তারকবাবু বললেন-কিন্তু তুমি এ সব ছেড়ে দিলে পার—

—ছেড়ে দেব?

—হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা সকলেই তাই চাই—

—আপনারা চান?

—নিশ্চয়ই-তোমার বাপমার মনেও কত দূর আঘাত দিয়েছ তুমি-তোমার বংশের মানসম্ভ্রমও কত দূর ছোট করে ফেলেছ-তোমার যে রকম চরিত্র ও মর্যদার সম্পদ ছিল তা নিয়ে একবার ভেবে দেখ তো অজিত।

তিন চার মিনিট চুপ থেকে অজিত বললে—ভেবে দেখেছি রাঙাবুড়ো। ভেবেছিলাম রানীদির সঙ্গে একদিন দেখা করতে যাব—কিন্তু তা হবে না। আমি যদি খুব ভালো অভিনয় করতে পারি তাহ’লে হয়তো একদিন এক দল আমাকে মাথায় তুলে নেবে; তাতে আমার খুব ভালো লাগবে কিনা বলতে পারি না-কিন্তু মা বা বাবা বা আপনি বা রানীদি যে কোনো দিন আমাকে বুঝাবেন না, এ আঘাত চিরদিনই আমার আঁতে লেগে থাকবে। জীবনের অত্যন্ত গৌরবের মুহূর্তেও এই কথা ভেবে আমাকে অনেক ঢোঁক গিলতে হবে—

তারকবাবু বললেন-এতই যদি বোঝ তাহ’লে আর থাক কেন এ সবে?

—থাকি-আপনারা আপনাদের মত করে বোঝেন-তাও আপনাদের অপরাধ নয়। আমি আমার কল্পনা ভালোবাসা বিচার বিবেকের অনুসারে চলি—

—এখানেও আবার বিবেক?

—তা আছে বৈকি রাঙাখুড়ো।

তারকবাবু গম্ভীর হয়ে উঠলেন।

অজিত বললে—প্রত্যেক মানুষের জীবনেই একটা ভালোবাসার জিনিস থাকে—

–তুমি তো এম-এ পাস করেছিলে—

—তা করেছিলাম—

—তারপর কোন ফার্মে কেমিক্যাল অ্যানালিস্ট হয়েছিলে, না?

—হ্যাঁ

—কত মাইনে ছিল?

—শত দেড়েক।

—তারপরেও প্রফেসরি পাওয়া? না?

অজিত ঘাড় নেড়ে বললে—পেয়েছিলাম—

–খুব বড় কলেজেও।

—কলেজটা মন্দ বড় নয়—

—এই সব সৎ পথ শিক্ষা-দীক্ষা শ্রদ্ধা মর্যাদার পথ ছেড়ে দিলে কেন তুমি —

অজিত একটু হেসে বললে—এক দিন লেকচার দিতে দিতে একটা প্র্যাক্টিক্যাল একসপিরিমেন্ট শুরু করতে গিয়েই দেখি সমস্ত ঘর আগুনে ভরে গেছে—

—কে?

—ভুল হয়ে গিয়েছিল; আর একটু হলেই সকলকে পুড়িয়ে মারতাম। এ রকম অল্প বিস্তর ভুল রোজই একটা আধটা হতে লাগল রাঙাখুড়ো। কেন জানেন? এ সব জিসিনের ভিতর আমার মন ছিল না। এ সব জিনিসের জন্য কোনো মমতা ছিল না-কোনো হৃদয় ছিল না—

—মমতা থিয়েটারের জন্য হ’ল?

—প্রথমে আমি কবিতা লিখতাম—

—সেও তো বেশ ছিল—

—কিন্তু বুঝলাম ঠিক হচ্ছে না; কলম ছেড়ে দিয়ে ভাবতে লাগলাম কেন এ সব খোঁচ-এ রকম গরমিল কেন সব লেখার ভিতর? বুঝতে পারলাম এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতেও চায় না যেন মন-আমি অন্য কিছু চাই যেন—

—অন্য কিছু শেষ পর্যন্ত এই সব গোবরের পাঁকের ভিতর গড়াল? তারকবাবু গলা খাকরে নিয়ে অজিতের দিকে তাকালেন—

অজিত বললে—পরের কবিতা আওড়ে যেন ভালো লাগত-ইংরেজি কবিতা। লিয়ার আবৃত্তি করে এমন ভালো লাগল আমার। অনেকেই মুগ্ধ হ’ত; নিজের জীবনের ভিতর আমিও এমন একটা আস্বাদ বোধ করতে লাগলাম কি বলব আপনাকে রাঙাপুড়ো! তারপর—

তারকবাবু বললেন–কিং লিয়ার সে তো বেশ ছিল—এটুকু আবৃত্তি করেই তুমি থামলে না কেন অজিত—

—কিন্তু বাংলা গল্পের আমাদের বাঙালির জীবনের কথাবার্তা নিজের মনের মত ক’রে বলতে পারলাম এমনই মনের মত করে যে নিজেই অনেক সময় বিমুগ্ধ হয়ে বসে থাকতাম, ভাবতাম এই তো কথাবার্তা যা কত সময় আমরা বলি, কত সময় আমরা শুনি-এই তো সব ভাব রস যা এমন কিছু গভীর ধোঁয়ার জিনিস নয়, কিন্তু তবুও এই সব উপকরণ ব্যবহার করেই যতক্ষণ না কবি তার বিধাতার মত হাত নিয়ে ব্যাপৃত হয়ে একটা গল্প তৈরি করল ততক্ষণ এ সবের মর্যাদা আমরা বুঝতে পারলাম কৈ?—তার পর আমি এলাম আমিও কবি; নট আমি-মানুষের জীবনের গল্পের আশা সাধ বিচ্ছেদ নিষ্ফলতার আমিও এমন মর্যাদা দিলাম যে লোকে গল্প লেখককেও ভুলে গেল—

অজিত হো হো করে হেসে উঠল—

তারকবাবু হয়তো শুনছিলেন না কিছু—

অজিত বললে—একটা অত্যন্ত অবজ্ঞেয় বইয়ের সাহায্যেও আমরা মানুষের হৃদয়কে অধিকার করে রাখতে পারি। বাংলা স্টেজে এ রকম বইই ঢের; সে সবের কোনোই সাহিত্যিক মূল্য নেই—জীবন সম্বন্ধেও কোনো ধারণা নেই। থিয়েটারে যে নেমেছি রাঙাখুড়ো অনেক নিজিসই আমি চাই-যে সব বই জীবন সম্বন্ধে খুব অভিজ্ঞ, যে সব কলম বিধাতার কল্পনা বিচার বুদ্ধি দুর্বুদ্ধি, সফলতা ব্যর্থতার নাড়ীর খবর সবচেয়ে গভীর ভাবে রাখে সে সব লেখা দিয়েই স্টেজ জমাতে চেষ্টা করব এখন, শুধু হৈ রৈ বা অবাস্তবতা দিয়ে নয়। এই একটা জিনিস রাঙাখুড়ো। আর একটা হচ্ছে এই—ষ্টেজের প্রতি লোকের বিরূপ বিরস ভাব আমি ঢের কমিয়ে আনতে চেষ্টা করব। আমি আস্তে আস্তে বোঝাব তাদের যে এই বইগুলো জীবনের পক্ষে যেমন মূল্যবান-এদের অভিনয়ও তেমনি; শুধু তাই নয়-অভিনয়েরই একটা মূল্য আছে-একটা ঐশ্বর্য্যভরা কবিতা বা গান বা ছবির যে মূল্য দাও তোমরা তত দূরই। আমি দেখেছি অনেক বাড়িতে বিশ্রী বীভৎস ছবি সব চিন্তাহীন কবিতা প্রবন্ধের এক একটা লাইব্রেরী নির্বোধ গান সব গানের বই গানের খাতা—এই সব-সবই নির্বিবাদে হজম করছে তারা-কিন্তু ছেলেরা যে পাড়ায় স্টেজ বেঁধে হয়তো তাদের নিজেদের লেখা একটা বই, কিংবা বাংলা সাহিত্যের কোনো সম্পদময় গল্প অভিনয় করতে চাচ্ছে এ তারা সহ্যই করতে পারে না।

—আমিও তো পারি না।

—এ কি উচিৎ রাঙাখুড়ো?

—তোমার ঠাকুদ্দার কথা মনে কর অজিত? -কি মনে করব?

—তিনি পরের স্ত্রীর দিকে ফিরেও তাকাবেন না—

–অভিনয় করতে গেলেই মানুষ তাই করে নাকি?

–সেই রকম ভাব এসে পড়ে নাকি? -একেবারেই না।

—কি বল তুমি?

—যে নট-আর্টিস্ট আমি তার কথা বলি?

—কি করে যে?

—একজন সচ্চরিত্র বুড়ো হেডমাস্টারের চেয়ে তার ঐকান্তিকতা একটুও কম নয়—

—তুমি যা খুসী কর অজিত-কিন্তু বাজে কথা বোলো না-আমাদের দিগম্বর মুখুয্যের সঙ্গে তুমি নটনটীর তুলনা কর—তুমি মহিমের ছেলে হয়ে। ঢের হয়েছে-ঢের হয়েছে-এখন আমি উঠি—

—আচ্ছা নমস্কার রাঙাখুড়ো—

—তুমি ঐকান্তিকতার কথা বলেছিলে?

—হ্যাঁ

—চরিত্রও তোমাদের ভালো—

—যে যে জিনিসকে ভালোবাসে তার সাধনায় যায় যদি, তার না সে? ধূলো লেগে পড়ে সেটা নিয়ে অপরে এত মাথা ঘামাতে যায় কেন? ধূলোকে তো সে নিজেই ধূলো বলে বোঝে—যথাসময়ে ফেলে দেয়। তার সাধনা কত দূর সত্য হ’ল এই নিয়েই কি বিচার করা উচিৎ নয়। ধূলোই যদি তাকে গিলে ফেলে তা হ’লে সে উকীলও নয় হেডমাস্টারও নয় দারোয়ানও নয় কবিও নয় নটও নয়-কিছুই নয় —

তারকবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে অজিত তৃপ্তি পাচ্ছিল না—

জানালার ভিতর দিয়ে অনেক দূর অব্দি মেঘ ও আকাশের দিকে চেয়ে অজিত বললে; একজন মানুষ বাস্তবিকই যখন তার অন্তঃসার হারিয়ে ফেলে তখন সে দারোয়ান হবার ও যোগ্য হয় না-নট ঢের বড় জিনিস রাঙাখুড়ো—

—কিন্তু আমার ছেলেকে নাতিকে তো কখনও সে রকম স্টেজ বাঁধতে দেব না—

–তারা যদি না চায়—

—চাইলেও দেব না।

—আমাদের বাড়ির লোকেরাও ঠিক এই রকম করত—

—যাদের ধর্মবোধ আছে তারাই করে—

— ধর্মবোধ?

—আমাদের বাড়ির মেয়েদের ওপর কড়া হুকুম আছে—

–জানি দেখাও নিষেধ তাদের।

—কোনো ভদ্র মজলিসেরও গানে যোগ দেবার অনুমতি তাদের নেই—

—জানি আমি অনেক কিছু অনুমতিই তাদের নেই। অনেক সময়ই ভাবি কি নিয়ে থাকে তারা। জীবনকেই বা এতভয় পায় কেন?

—জীবনকে?

অজিত বললে—আপনাদের এই পরিবার কিম্বা আমাদের পরিবারই শুধু নয়—এমন অনেক পরিবার আছে জীবনের সংস্পর্শে আসলেই ভয় পায়—

.

(পাণ্ডুলিপির খাতায় এর পর দুই পৃষ্ঠা লেখেন নি। )

অজিত বললে—করুণাবাবু

—আজ্ঞে

—আমি ভেবেছি একটা নতুন বই নেব

—কি বই?

—এই ধরুন এমন একটা বই যার বেশ সাহিত্যিক মূল্য আছে—

—তার মানে?

—ভালো ভাব-ভাষা-তাছাড়া—

—হঁ?

—মানুষের জীবনটা বুঝতে গিয়ে কোথাও ফাঁকি দেবার চেষ্টা নেই। এই সত্য প্রচেষ্টার ভিতর তবুও এমন একটা সংসত্য রয়ে গেছে যে অনেক দুঃখ অনেক গ্লানি বিচ্ছেদ ও নিষ্ফলতার এই জীবনটাকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে না-এর গভীর মূল্যের কথা ভেবে আপনাদের অবাস্তব নিয়ে পড়ে থাকতে ভালো লাগে না আর —

—আমাদের অবাস্তব?

—আপনাদেরই—

—কি রকম?

—মহাভারত পুরাণ রামায়ণ ইতিহাসের থেকে ঢের নেওয়া হয়ে গেছে-মহাভারতীয় নাটকটা আপনারা চালাচ্ছেন সেটা থামিয়ে দিন এখন—

—বল কি দেড়শো রাত ধরে চলেছে—

—আরো দেড়শো রাত হয়তো চলবে—

—নিশ্চয় দেড় হাজার রাতও চলতে পারে —

—টাকা আপনারা খুব পাবেন-লোকের বাহবাও পাবেন, কিন্তু স্টেজের কর্তব্য কি এইই শুধু—?

-লোকেরা তো এইই চায়—

—যাকে আপিং খাওয়া শেখানো হয়েছে সে আপিংই চায়।…যাক, আমি উপমা দিয়ে কথা বলব না। আমি এই কথা বলতে চাই করুণাবাবু যে আমাদের বাংলাদেশে এমন এক আধ জন লেখক আছেন যে জীবনটাকে সত্য ভাবে বুঝতে গিয়ে যাঁরা খুব কঠিন হয়ে ওঠেন নি-আর কঠিন হ’লেও তা কোনো অপরাধের নয়, আমার নিজের মনের ভিতরেও কেমন একটা বিরূপ নিষ্ঠুরতা নেই যে তা নয়-কিন্তু সে যাক, জীবনটাকে সত্যিকারভাবে বুঝবার মত প্রতিভা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েও দু’এক জন লেখক তাদের আন্তরিক সংসত্য এমন অক্ষুণ্ণ রেখেছে দেখলাম যে সেটা আমারও ভালো লেগেছে-আপনারও লাগবে-সে সব বই স্টেজে যারা দেখতে আসবে তাদেরও খারাপ লাগবে না—

—অবিশ্যি সে রকম বইএ আমরা নেই; যা লোকের ভাল লাগে তা নেব না কেন?

-আচ্ছা তাহ’লে বেছে দেব আমি?

—এখন নয়

—কেন?

—আপনি নতুন এসেছেন-মানেন না তো?

—কি মানতে হবে?

—স্টেজ একটা ব্যবসা। একটা নতুন বই নেবার আগে আমাদের ঢের ভাবতে হয়। আপনার যা ভালো লাগে সকলের তা ভালো লাগে না। এই মহাভারতের নাটকটাকে অনেক সময়ই মিথ্যা হৈ রৈ বলে আপনি আক্ষেপ করেছেন; আজ যদি লঙ্কায় বা কুরুক্ষেত্রে আবার তেমনি সেই সব যুদ্ধ বাধে, দেবতারাও বিস্মিত হয়ে আকাশ থেকে তাকিয়ে দেখেন -কিন্তু তবুও আপনার হৃদয়কে সে সব বড় একটা স্পর্শ করে না। কিন্তু আমাদের দেশের লোকদের তো সেই সবই ভালো লাগে মেয়েদেরও; আমারও। দেবতাদেরও এক দিন ভালো লেগেছিল-আজো লাগে। এর কি করবেন আপনি?

—এ আমাদেরই অপরাধ—

— কেন?

—এত দিনেও আমরা মানুষের রুচি তৈরি করতে পারি নি?

—সে কি স্ট্রেজের কাজ?

—স্টেজেরই।

করুণাবাবু একটু টিটকারি দিয়ে বললেন-আপনি হয়তো ভালো অভিনয় করতে পারেন। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট আপনার হাতে দিলে আর রক্ষা ছিল না—

—কেন?

—তা হ’লে দু’দিনেই এক একটা থিয়েটারকে নিঃশেষ করে ফেলতে পারতেন আপনি—

—অজিত আস্তে আস্তে চুরুটটা জ্বালাল।

করুণাবাবু বললেন-আপনি হয়তো বার্নার্ড শ-কে আমাদের স্টেজে টেনে আনতে চাইবেন—বলবেন সেই ধরনের নাটক চাই।

—না, তা আমি বলব না

—আজকাল কেউ কেউ এমন কথাই তো বলে—

—শয়ের মত লেখক আমাদের দেশে একজনও নেই

—তা আমি জানি

—কোনো দিন হবেও না হয়তো।

—তাও বটে

—যদিও বা হয় তাতে আমার আক্ষেপ বড় একটা ঘুচবে না

—কেন?

—বার্নার্ড শ-কে আমার ভালো লাগে না—

—কি রকম?

—জীবনটাকে বুঝতে গিয়ে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা তাঁর হয়তো নেই-কিন্তু সমস্তই কেমন একটা ভোজবাজীর ব্যাপার বলে মনে হয়। আমি যাকে ভালোবাসি সে মেয়ে শয়ের নায়িকার মত কথা বলে না, বললে আমার ভালোও লাগত না, আমিও শয়ের নায়কের মত অনুভব করি না, কথা বলি না; পৃথিবীর খুব কম লোকই তেমন ভাবে অনুভব করে—ও রকম ধরনের কথাবার্তাগুলোকেও একটা দায়ীত্বের মত মনে করে শুধু। ও একটা প্রবন্ধকারের জন্য। হয়তো কোনো ভবিষ্যৎ জীবন ঐ রকমই সজাগ সচকিত ও চতুর লোকে ভরে উঠবে কিন্তু আজকের জীবনের সংসত্যকে অন্তত ও রকম ভাবে হারিয়ে ফেলতে উপদেশ দেই না আমি আপনাদের—

—দিলেও তা গ্রহণ করবার ক্ষমতা নেই আমাদের—

—কিন্তু নতুন বইয়ের দরকার আমাদের—

—কিন্তু সে বই কে লিখবে?

—আজকের কাজ চলে যায় বাংলা গল্প উপন্যাসের ভিতর এমন দু’চার খানা প্রাণসম্পদভরা বই আমি দেখেছি; হয়তো কালকের কাজও চলে যাবে তাতে-হয়তো অনেক দিনের কাজ। কিন্তু ভবিষ্যৎ চলুক আর না চলুক-আমরা অন্তত ধোঁয়ার হাত থেকে বেরিয়ে একটা নিস্তার পাব। এ সংস্কার আপনাদের করা উচিত—এ রকম সাহস সাধ আপনাদের থাকা উচিত। যাতে এরকম ধরনের বই আরো বেরোয় আপনাদেরও একটু আধটু সাহায্য করা উচিত সে জন্য। লেখকের জন্ম দিতে পারবেন না আপনারা অবিশ্যি ভবিষ্যতের গঠনের ভিতর কার কোন প্রতিভার কতখানি হাত থাকবে তা বলাও শক্ত-কিন্তু আপনাদেরও খানিকটা হাত থাকা উচিত—

অজিত এই সব বললে!

এ সব অনেক দিন থেকে ভেবে এসেছে সে; এই সব তার প্রিয় চিন্তা, প্রিয় কথা। কিন্তু সকলের এ সব শুনবারও বড় একটা সময় নেই—

করুণাবাবু বললেন-আচ্ছা দেখব।

আজ রাতেও কৃষ্ণের পার্টই অভিনয় করতে হবে অজিতকে; যিনি এই নাটকখানা লিখেছেন অজিত দেখল কৃষ্ণচরিত্রের সম্বন্ধেও তাঁর বিশেষ কোনো জ্ঞান বা উপলব্ধি নেই— এ চরিত্রকে তিনি ফোটাতে পারেন নি। তা ছাড়া কোন ভাবও সেই তাঁর— কোনো ভাষাও নেই। প্রাণহীন অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল অজিত-চরিত্রের অবাস্তবতা তাকে ব্যথা দিচ্ছিল—কিছুই ভালো লাগছিল না।

বাইরে ঝর ঝর করে বৃষ্টি পড়ছে—

জীবনযাপন – ২

অজিত বললে—এসো পূর্ণিমা।

পূর্ণিমা সত্যভামার পার্ট অভিনয় করে। এ তার খুব ভালো লাগে; খুব অনুরাগের সঙ্গে বলতেও পারে সে; অভিনয়ে তাই তার একটা চমৎকার সুর বাজে।

অজিত প্রথম কয়েক দিন পূর্ণিমাকে আপনি বলে ডাকত; কিন্তু পূর্ণিমা একদিন অভিমান ক’রে বললে—আপনি বললে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব না আর।

অজিত বললে—আচ্ছা, তুমিই বলব।

তবুও কয়েক বার ভুল করে ফেলেছিল সে; পূর্ণিমাও কথা প্রায় বন্ধ করে এনেছিল। কিন্তু এখন ‘তুমি’ ছাড়া আর কিছু বলে না-অজিতের মুখে আর কিছু আসেও না-তা ভালোও লাগে না তার।

পূর্ণিমা অবিশ্যি অজিতকে এখনও আপনিই বলে-কিন্তু তাতে অজিতের কোনো রাগ বা অভিমানের কথা মনেই আসে না; এ নিয়ে সে চিন্তাও করতে যায় না।

পূর্ণিমা বললে—বাঃ, আপনি দেখি বই, খুলে বসে রয়েছেন—

—বসেই রয়েছি শুধু

—পড়ছেন না?

—নাঃ

—তবে যে বড় খুলে আছেন

—এ পড়তে আমার প্রবৃত্তি হয় না

—কি বই?

পূর্ণিমা কাছে এল—

অজিত বললে—বোস

একটা কৌচের ওপর বসল সে

পূর্ণিমা বললে—বইটা দিন

অজিত দিল

—ওঃ এই বইটা—

বইটা অজিতের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে পূর্ণিমা বললে—তা আপনার পার্ট তো বেশ নির্ভুলই বলতে পারেন আপনি-বইটা আর মিছেমিছি খুলে রেখেছিলেন কেন—

অজিত একটু হেসে বললে—নির্ভুল!

—বই যখন খুলে বসেছেন তখন নিশ্চয়ই ভুলের ভাবনা আপনার ছিল—

—তা নয়—

—আমিও তো জানি না কি অজিতবাবু; এ সব আপনার মনের ধাঁধা। এত ভালো পার্ট করেন–কিন্তু তবুও আপনার মনের ভিতর একটা সন্দেহ কেন যেন ঘোচে না—

—তাই না কি পূর্ণিমা?

—হ্যাঁ

—তুমি লক্ষ্য করেছ?

-করেছি বৈ কি—

অজিত প্রাণ খুলে হেসে উঠল।

তারপর ধীরে ধীরে পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে বললে—তুমি সবই বুঝে ফেলতে পার দেখেছি—

অজিস আবার হাসল

তারপর বললে—আমি ভেবেছিলাম স্টেজে যেমন জীবনেও তেমনি আমার সব সময়ের অভিনয়ের পিছনের মানুষটিকে কেউ দেখ না—

পূর্ণিমা নিস্তব্ধ হয়ে রইল—

অজিত বললে—স্টেজে দাঁড়িয়ে ভুল পড়বার ভয় আমার নেই পূর্ণিমা। এ যা বই-এ যে রকম সব কথাবার্তা এর চেয়ে ভালো জিনিস অভিনয় করতে দাঁড়িয়ে তখন তখনই আমি নিজের মনের থেকে তৈরি করে নিতে পারি—

পূর্ণিমা ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল।

অজিত বললে—আমার মুখে এ বইয়ের এ পদগুলোর অনবরত গরমিল হয়ে যায় যদি তাতে আমি একটুও ভাবি না-অনেক সময় তা হয়-আমি চাই যে তা হোক্-না হ’লে আমার মন খোলে না। কোনো একটা বিশেষত্বহীন অসাড় বইয়ের ভুল পড়া ঠিক পড়া নিয়ে আমি একটু মাথা ঘামাই না। আমার মনের সন্দিগ্ধতা সত্য কিছু নিয়ে।

—কি নিয়ে?

—এই এক্ষুণি ভাবছিলাম এমন বই আমাদের অভিনয় করতে হয় কেন; কোনো দিন লিখি না বটে-কিন্তু কলম নিয়ে বসলে এই জিনিসই এর চেয়ে আমিও তো ঢের ভালো করে লিখতে পারতাম-বাংলাদেশের অন্য লেখকদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম—

—বইটা ভালো কি মন্দ আমি বুঝি না অজিতবাবু। কিন্তু আপনার পার্ট শুনতেই ঘরটা তো অজস্র লোকে ভরে যায়—

অজিত মনে ভাবছিল।—কিন্তু এই ঘরভরা লোকদের ভিতর দু’চার জন বিচক্ষণ মানুষও যদি এক কোণে পড়ে থাকে তারা এই কথাই ভাবে যে এই একটা বই (কোনো দিক দিয়ে যার কোনো প্রয়োজন ছিল না-লেখকের কোনো বুদ্ধি ছিল না-হৃদয় ছিল না-ভাষা ছিল না-লিখবার কোনোই দরকার ছিল না তার-কতকগুলো অসাড় নির্বোধ অবাস্তব জিনিস দিয়ে একটা মিথ্যা সত্যভামাকে দাঁড় করাল মিছেমিছি সে-কিন্তু তবুও এই হাড্ডিসার চরিত্রের ভিতরেও পূর্ণিমা এমন প্রাণসম্পদ ফুটিয়ে তুললে যে বিমুগ্ধ হয়ে রাতের পর রাত বসে থাকতে ইচ্ছে করে শুধু—বইটার সম্বন্ধেই একটা ভুল ধারণা হয়ে যায়-এই তারা ভাবে না কি?

কিন্তু মুখে সে কিছু বললে না।

পূর্ণিমার অভিনয়ের কোনো প্রশংসা করলে না সে।

দু’জনেই চুপ করে বসে রইল।

পূর্ণিমা বললে—ওঃ এই আপনার সন্দেহ; এই সব বইটই নিয়ে।

—হ্যাঁ

—তাহ’লে নিজেই আপনি লিখুন না কেন?

অজিত বললে—আমি লিখতে পারি না।

—তবে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিন।

—কাকে দিয়ে লেখাব?

পূর্ণিমা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে—তবে কি হবে?

—থাক এ সব কথা এখন।

পূর্ণিমা বললে—আপনার বো” হয় মনে আছে কিছুদিন আগে বেশ একটা নামজাদা উপন্যাসকে ড্রামাটাইজ করা হয়েছিল এখানে—

—হ্যাঁ

—আপনি বুঝি সেই চান

—হ্যাঁ; এর চেয়ে ঢের ভালো হয়।

—কিন্তু সে রকম উপন্যাস কটা আর আছে?

—বেশি নেই—

—কিন্তু যে কটা আছে, সেগুলো একবার আমানত করলে মন্দ হয় না।

-আমিও তো তাই বলি—

অজিত বললে—কিন্তু, তোমার হয়তো তা ভালো লাগবে না পূর্ণিমা—

—আমার? সে উপন্যাসের অভিনয়ে আমি তো নেমেছিলাম—

–তা আমি জানি—

—কিন্তু এক রাত কি দু’রাত হয়েছিল শুধু—

—কেন?

—ভালো করে তৈরি না হতেই নামানো হয়েছিল।

—ওঃ

—কিন্তু এবার আপনি তৈরি করে দিন না।

—তাই ভাবছি—

—তা হ’লে হয়তো একশো দেড়শো রাতও চলতে পারে।

—চলবে কি পূর্ণিমা? তুমি পারবে (…)? তোমার ভালো লাগবে?

—আমার?

—একটা গল্প হলেই বুঝি তোমার খুব ভালো লাগে?

—আপনার যা ভালো লাগে না আমার তা খুব ভালো লাগে এই কথা বোধ করতেই আপনি বুঝি খুব তৃপ্তি পান।

অজিত হেসে উঠল।

পূর্ণিমা হাসছিল না।

অজিত গম্ভীর হয়ে গেল।

পূর্ণিমা বললে—আপনাকে খুব বড় মনে করেন আপনি; সে আপনার শোভা পায়-কিন্তু—

পূর্ণিমা থমকে চুপ করে রইল।

অজিত বললে—বড় মনে করি আমাকে? কোন বিষয়ে?

—সব বিষয়েই।

—অজিত—

পূর্ণিমা বললে—আপনি ঢের শিক্ষাদীক্ষা পেয়েছেন আমাদের চেয়ে-অনেক জানেন-অনেক বোঝেন-সদ্বংশের ছেলে-ভগবান আপনাকে ঢের ক্ষমতা দিয়েছেন-থিয়েটারে না এলেও আপনার কিছু এসে যেত না; যেখানেই যেতেন সেখানেই আপনি মানুষের পূজো পেতেন; থিয়েটারে আপনি এসেছেন এ আমাদের সৌভাগ্য কিন্তু একটা কথা আপনাকে অজিতবাবু-বরাবর আদর আহ্লাদ পেয়েই হোক বা যে করেই হোক—মনে আমার বড় অভিমান; সে অভিমানে অজ্ঞাতসারেও যদি আপনি এক আধ বার ঘা দিয়ে বসেন তা হ’লে বড় কষ্ট লাগে আমার—

—আমি কি তোমাকে আঘাত দিয়েছি পূর্ণিমা? কখন?

—আপনি বললেন যে কোনো একটা গল্প হলেই তো তোমার চলে—

–অজিত হাসতে লাগল—

কিন্তু পূর্ণিমা কাঠের মত শক্ত—

অজিত দু’এক মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে নিগূঢ় ভাবে চিন্তা করে বুঝে উঠতে পারল না এ কথা পূর্ণিমাকে কি করে-কেমন করে-কোথায় আঘাত দিতে পারে-কিন্তু তারপর চমকে উঠে বুঝতে পারল যেন সব-এ মেয়েটির অভিমান ও একটা প্রখরতার অপরিসীম পরিধি চোখ বুজে দেখে ফেলল যেন সব অজিত।

কিন্তু পূর্ণিমা হাসছিল, বললে—আপনি এত কি ভাবছেন?

অজিত কোনো উত্তর দিল না।

পূর্ণিমা বললে—রাগ করেছেন?

—আমি কখন কি বলে ফেলি-আমাকে সতর্ক করে দিও —

পূর্ণিমা বললে—আমি বড় বোকা; এই এক্ষুণি বলছিলাম আমার খুব অভিমান-কিন্তু অভিমানটা আপনার কাছে এলেই যেন বেড়ে ওঠে আমার। এর সমুচিত শাস্তি যখনই আপনার দরকার হয় তখনই আপনি দেবেন। আর কিছু বলবার নেই আমার।

বলেই মনে হল পূর্ণিমার সে ঢের বলে ফেলেছে যেন-এত বলবার কি প্রয়োজন ছিল তার। অত্যন্ত লজ্জা পেতে লাগল পূর্ণিমা-এক এক সময় যেন মাটির সঙ্গে মিশেও যেতে ইচ্ছে করে।

—পড়বেন?

—হ্যাঁ

—যাই তাহ’লে এখন আমি?

—আচ্ছা যাও—

জীবনযাপন – ৩

পরদিন পূর্ণিমা এল না-তার পর দিনও না—

তার পর দিন কোনো অভিনয় ছিল না।

শেষ রাত থেকেই পৃথিবী কালো করে শ্রাবণের বৃষ্টি পড়ছে—

ভোর চারটার সময় উঠে অজিত বিছানার ওপর জেগে বসে ছিল—কিছুই ভালো লাগছিল, না তার। রেনকোটটা গায় দিয়ে একটা শোলার টুপি মাথায় চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। কোথায় যাওয়া যায়?

এক পূর্ণিমা ছাড়া আর কোনো লোকের কথাই মনে হ’ল না তার।

কিন্তু পর্ণিমার কাছে এই সময়?

সে উঠেছে কি না তাও বা কে জানে?

গিয়ে সেখানে কি দেখতে হবে তাই বা কে বলতে পারে?

কিন্তু তবুও গেল অজিত।

দোতলায় পূর্ণিমার কোঠার পাশে গিয়ে দরজাটা ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে গেল।

পূর্ণিমা একটা শাল গায় দিয়ে জানালার পাশে মস্ত বেতের ইজিচেয়ারে বসে ছিল-অজিতকে দেখে তার মুখের কোনো ভাবপরিবর্তন হয়েছে বলে বোধ হ’ল না; ইজিচেয়ারে বসেই বললে—ওঃ আপনি—

—হ্যাঁ আমিই।

অজিত তার ভিজে কাপড়চোপড় জুতো নিয়ে ঘরের মাঝখানে এসে সমস্ত কার্পেটে কাদা জল মাখিয়ে দিতে লাগল-সে দিকে তার কোনো খেয়ালও ছিল না যেন—

পূর্ণিমা বললে—আঃ কার্পেটটা নষ্ট করে ফেললেন।

—ওঃ তাই তো।

—জুতোটা ছেড়ে আসুন।

অজিত তাড়াতাড়ি দরজার দিকে সরে গেল

পূর্ণিমা বললে–টুপী কোট র‍্যাকে রেখে আসুন।

—র‍্যাক কোথায়?

—বাইরের দেয়ালে

—থাক্-আমি অন্য জায়গায় যাচ্ছিলাম-তোমার জানালা খোলা দেখে ভাবলাম তুমি উঠেছ হয়তো—আমি চলে যাচ্ছি—

অজিত দরজা অব্দি গিয়ে একটু থেমে দাঁড়াল।

—যা বৃষ্টি

আস্তে আস্তে (পূর্ণিমার) কার্পেটের দিকে তাকিয়ে বললে—তোমার কার্পেটের ওপর এই মহিষের ক্ষুরের মত জুতো নিয়ে কি করে যে চড়ে কসলাম আমি?

পূর্ণিমা বললে—বুট আপনি খুলুন। একটু ইতস্তত করে সাত পাঁচ ভেবে একবার এগিয়ে একবার পিছিয়ে অজিত শেষ পর্যন্ত বুটজোড়া খুলে ফেলতে লাগল—

টুপীটা র‍্যাকে রেখে এল-রেনকোটটাও—

পূর্ণিমা ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে—এইখানে বসুন আপনি—

—এইখানে বসব? তা বেশ। অভ্যর্থনা করবার শক্তি ও সহৃদয়তা তোমারই আছে—কিন্তু তুমি কোথায় বসবে পূর্ণিমা?

—বিছানায়।

—ইজিচেয়ারটা একটু কাছে টেনে নি—

—নিন্

চেয়ারটা পূর্ণিমার দিকে অল্প খানিকটা টেনে নিলে অজিত—

পূর্ণিমা অজিতের বুটজোড়া বারান্দায় রেখে এল—

পূর্ণিমা বিছানার এক কিনারে এসে বসে বললে—আপনাকে চুরুট দেব

—চুরুট?

—খান তো আপনি—

—তা খাই বটে কিন্তু তুমি কোথায় পাবে?

—আনিয়ে দিচ্ছি-হয়তো দেরাজেও আছে।

—দেরাজে?

— হ্যাঁ

—কি করে থাকে পূর্ণিমা

—আপানাদের জন্য।

অজিত বললে—আমাদের? আমাদের কাদের জন্য?

কিন্তু প্রশ্ন করে এর কোনো উত্তর চাইল না সে। কেমন বিহ্বল হয়ে গেল-গম্ভীর হয়ে উঠল—

পূর্ণিমা উপলব্ধি করে বললে—আমার এখানে কেউ তো বড় একটা আসে না-থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ থেকে লোকেরা এসে মাঝে মাঝে আমাকে পার্ট বুঝিয়ে দিয়ে যায়। তা ছাড়া আমার সঙ্গে দেখা করতে হলে কার্ড দিয়ে দেখা করতে হয়—

(এর পর প্রায় তিন পৃষ্ঠা জুড়ে যা লিখেছেন, কেটে দিয়েছেন।)

এই মেয়েটির এই আত্মনিবেদনটুকু অজিতের পক্ষে যথেষ্ট—সে কি করে না করে-কার্ড দিয়ে মানুষ কত দূর নিজেকে সুরক্ষা করতে পারে-সে প্রবৃত্তি কতক্ষণই বা থাকে তার—কখন সমস্ত আত্মরক্ষাই লাঞ্ছিত হয়ে যায়-সে সব কথা ভাবতে গেলে হয়রান হয়ে পড়তে হয়।

পূর্ণিমার অভিনয়ের জীবন নিয়েই তো অজিতের দরকার-অন্য জীবনের খোঁজই বা সে নিতে যায় কেন?

ব্যথা লাগে—কিন্তু তবুও যে খোঁজ নেবার অধিকার নেই তার।

ব্যথা লাগে কি যে!

পূর্ণিমা বুঝল—

অজিত বড় ব্যথা পাচ্ছিল।

পূর্ণিমা অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে বোধ করল তা—

কিন্তু কি করবে যে? কি বলবে? পূর্ণিমা চুপ করে রইল।

অজিত বললে—পূর্ণিমা —

পূর্ণিমা অনেকক্ষণ পরে বললে—আপনি অস্বস্তি বোধ করছেন?

অজিত একটু হেসে বললে—না, অস্বস্তি নয়—

—কি চান আপনি?

—কেমন শীত করছে, কেন বল দেখি?

—ঠাণ্ডা পড়েছে যে।

—এই বাদলার জন্য?

—হ্যাঁ

পূর্ণিমা বললে—একটা হুইস্কি দেব আপনাকে?

অজিত স্তম্ভিত হয়ে পূর্ণিমার দিকে তাকাল—

পূর্ণিমা একটু ভয় পেয়ে গেল—

কিন্তু তবুও সে বললে—এক গ্লাস সোডার সঙ্গে দেই? তাহ’লে শরীরটা বেশ গরম হয়ে উঠবে-আরাম বোধ করবেন আপনি অজিতবাবু—

অজিত খানিকক্ষণ চুপ থেকে জানালার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললে—মদ!

—অল্প স্বল্প—

জানালার দিকে তাকিয়েই অজিত বললে—কোনো দিন খাই নি তো—

—একদিনও না!

—না

—একটুও না?

—শুনলে আমার মা কি বলতেন?

—কিন্তু আপনি থিয়েটার করছেন বলে মা খুব ভাল বলেন না আপনাকে।

—কিন্তু আমি জানি-একদিন যদি তাঁকে বুঝিয়ে বলি যে এ জিনিস ছবি আঁকার মত, কবিতা লেখার মত নানা রকম মানুষের নানা রকম জীবনের নানা রকম প্রিয় একাগ্রতার নিবেদনের ঐকান্তিকতার জিনিসের মত তাহ’লে তিনি তা বুঝবেন সব; কিন্তু মদ খেয়ে তাঁকে আমি কি বলব?

—এটা মদ খাওয়া নয়।

—কেন?

—এক গ্লাস তো খাচ্ছেন শুধু।

—যদি ভালো লাগে?

—আর এক গ্লাস চাইবেন?

—চাই যদি।

—আপনাকে দেব না আমি আর—

—কিন্তু এইকুটুই বা কেন দাও পূর্ণিমা?

—এতে আপনার লোভ বেড়ে যাবে মনে করেন?

—কত রকম কি হতে পারে—

—এত বড় হলেন-কিন্তু মদ নিয়ে কেউই কি কোনো দিন আপনাকে সাধে নি?

—সেধেছে—

—তবে?

—কিন্তু মেয়েমানুষ তো কোনোদিন সাধে নি —

পূর্ণিমার মুখ দু’এক মুহূর্তের জন্য ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল—

অজিতের চোখ পূর্ণিমার মুখের দিকে ছিল না-সে মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিল—

একটু পরে অজিত বললে—সকলকেই আমি অগ্রাহ্য করেছি, কিন্তু তুমি যদি আর একটু বেশি সাধ তাহ’লে অনেক কথাই আমার মনে পড়তে থাকবে-ওমর খৈয়াম-সাকী—জীবনের নশ্বরতা-মেয়েমানুষের রূপ-ভালোবাসা-আর্টিস্টের অধিকার—কত কি-তার পর একটা গেলাস শুধুই নয়-সমস্ত বোতলটাই আমি শেষ করে ফেলব-তোমার অনুমতি নিয়েই-তোমার চোখের সামনেই—

পূর্ণিমা পাথরের মত নিষ্প্রাণ হয়ে রইল—

—এমন তুমি অনেককে খেতে দেখেছ, না?

পূর্ণিমা কোনো কথা বললে না।

অজিত বললে—তুমি কি মনে কর পূর্ণিমা?

পূর্ণিমা কোনো উত্তর দিল না।

অজিত ছোট ছেলের মত বায়না ধর বললে—বল তুমি কি মনে কর।

পূর্ণিমা পীড়িত ভাবে বললে—কিসের কথা অজিতবাবু—

অজিত বললে—তুমি বললে, আপনি এত বড় হয়েছেন অজিতবাবু-তবুও কেউ আপনাকে সাধে নি? আমি বললাম কোনো মেয়েমানুষ আমাকে মদ নিয়ে সাধে নি পূর্ণিমা, কিন্তু তোমার মত মেয়েমানুষ যদি সাধাসাধি করে তাহ’লে আমি উপেক্ষা করতে পারব না। অজিত একটু থেমে বললে—তারপর আমার যে নতুন জীবন আরম্ভ হবে তুমিও সেটাকে উপেক্ষা করবে না—

—কেন উপেক্ষা করব?

—বরং সেই জীবনটাকে তোমার ভালো লাগবে আরো?

পূর্ণিমা কোনো জবাব দিল না। নারী সে; লজ্জা পাচ্ছিল—

অজিত বললে—তুমি তো খাও?

—খাই

—কবের থেকে -বছর দুই

—খুব বেশি খাও?

—না

—কতটুকু খাও?

–না

—এক আধ গেলাস-কিম্বা দুই-আড়াই—

বলতে বলতে পূর্ণিমা সঙ্কোচে মুখ নত করল।

অজিত বললে—রোজ?

পূর্ণিমা কোনো জবাব দিল না।

অজিত বললে—লোকজনের সঙ্গে মিশে

পূর্ণিমা বললে—এ রকম কেন জিজ্ঞেস করলেন আপনি!

অজিত পূর্ণিমার প্রাঙ্গণের একটা জামীর গাছের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল—

পূর্ণিমা বললে—আমার ঘরে এসে বসেছেন বলেই নানা রকম অধিকার আপনার জন্মায় নি—

এমনি করেই মেয়েটি নিজের লজ্জা চাপতে চাইল।

কিন্তু লজ্জার বিশেষ কোনো কারণ ছিল না তো তার। সে অভিনয় করেছে, ভেবেছে দু’এক গ্লাস খেলে অভিনয় তার সফল হবে, কিম্বা বন্ধুবান্ধবদের মাঝখানে বসে দু’এক গ্লাস খেলে সকলে তাকে সেয়ান মনে করবে-এই শুধু, যাতে চোখে কালি পড়ে, মুখ চুন হয়ে যায়, শরীর ঘামাতে থাকে নিঃশ্বাস রক্তের মত গরম বোধ হয়-জীবনের বা হৃদয়ের সে সব লালসা ও খেদের নিষ্ফলতার থেকে এই দিব্যি চেহারার নারীটি ঢের দূরে। সে ঢের মূল্যবান-এত মূল্যবান যে অজিতের সঙ্গেও অনেক সময় সম্ভ্রম রক্ষা করে চলাই সে ঠিক মনে করে-অন্যদের সঙ্গে সে সম্ভ্রমের এক তিলও সে খোয়াতে যায় নি। কেন যাবে? (সে অভিনয় করতে এসেছে-কোনো অবান্তর আরাধনা করতে আসে নি তো।)

কিন্তু তবুও নারী সে;-তার লজ্জা করছিল-বিশেষত অজিতের কাছে। যে লোকটা জীবনে এক গ্লাস মদও খয় নি-অথচ এত বড় হয়েছে-এত ভালো অ্যাক্টও করতে পারে-থিয়েটারে এল-তবুও মদের গেলাসের সম্ভাবনা দেখে যে মানুষ তার মায়ের কথা পাড়ে তার কোনো নাড়ীনক্ষত্র বুঝতে পারছিল না যেন পূর্ণিমা-নিজের নারীত্ব তার কেমন গুমরে উঠছিল যেন; অজিতকে শোনাতে গিয়ে নিজেই নিজের গলার সুরে কি যেন শুনতে পেল সে-লজ্জা পেল—

অজিত বললে—আমি এক সময় কবিতা লিখতাম—

পূর্ণিমা স্নিগ্ধ কথার সুরে বললে—কবিতা লিখতেন?

—হ্যাঁ, পূর্ণিমা, ঢের কবিদের সঙ্গে মিশবারও সুযোগ হয়েছিল। অনেকের চেয়েই আমি ভালো লিখতাম বলে আজো বোধ করি কিন্তু তাদের একটা বিশেষত্বকে আমি কিছুতেই আয়ত্ত করতে পারি নি।

—কি অজিতবাবু?

—তারা ভাবত এই যে যখন তারা মিল দিয়ে কবিতা লিখতে শিখেছে তখন তাদের জাত বদলে গেছে, অন্যরা যেখানে একটি স্ত্রী নিয়ে রয়েছে সেখানে দশটি মেয়েমানুষ নিয়ে তাদের থাকতে হয়, অন্যরা যেখানে জল চায় সেখানে তাদের মদ না হ’লে চলে না, অন্যরা যেখানে চুল ছাটে সেখানে তাদের বাবরি কাটা চাই-এই সব আর কি—

পূর্ণিমা চুপ করে শুনেছিল।

অজিত বললে—আচ্ছা ভূয়ো কবিদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, সত্যিকার কবি হ’লেও বড় বড় চুল রাখতে হবে? মদ খেতে হবে?

পূর্ণিমা ফাঁপড়ে-পড়া ভাবে অজিতের দিকে তাকাল।

অজিত হেসে বললে—বল তো পূর্ণিমা?

—আপনিই তো জানেন—

—কবিত্বের সঙ্গে লম্বা চুল বা মদের কোনো সম্পর্ক নেই।

—আমারও তাই মনে হয়-কিন্তু লোকে তো বিশ্বাস করে আছে—

—দু’লাইন মিল দিয়ে মদ খাবার নিরঙ্কুশ অধিকার এক এক জনের জন্মায়-তার কবিপ্রতিভাও সাব্যস্ত হয়ে যায়—কিন্তু গণিতের প্রতিভা নিয়ে যে লোকটা নব নব আবিষ্কারে মেতে আছে তার লম্বা চুল মানুষের উপহাসের জিনিস—মদ খাওয়াটাও অত্যন্ত দুনীর্তি অত্যন্ত অধঃপতন। কিন্তু সুবিধে এই যে লোক আমাদের চেয়ে মাথা ঢের ঠিক রাখে-মদ খেতেও যায় না, চুলও ছাটে-একটি স্ত্রী নিয়েও কিম্বা মেয়েমানুষবিহীন হয়েও প্রতিভার স্ফুরণে বিশেষ কিছু বাধে না তার-তার প্রতিভার কবিত্বের দিকটাও দু’লাইনের মিলের চেয়ে ঢের বেশি গভীর-কিম্বা আমাদের অনেক নটের চেয়েও খাঁটি নটরাজের তালে তালে ঢের বেশি সিদ্ধ হৃদয়ঘোরে চলেছে—

পূর্ণিমা চুপ করে রইল।

অজিত বললে—অঙ্ক জ্যামিতি জ্যোতিষ বিজ্ঞান মীমাংসা ন্যায় এই সব নিয়ে যাদের প্রতিভা ফুটে উঠছে তারাও নটরাজের বন্ধু-তারাও কবি-কিন্তু মদ বা লম্বা চুলের প্রয়োজন তারা বোধ করে না—আমরাই বা কেন বোধ করব? আমাদের এ আনুষঙ্গিকগুলোর কি প্রয়োজন আছে? কবিতা লিখতে গিয়ে, গান গাইতে গিয়ে কিম্বা অভিনয় করবার সময় ছবি আঁকবার সময় ব্রান্ডি ঝাকড়া চুল বা উচ্ছৃঙ্খলতার কি প্রয়োজন? কিন্তু আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই যে এক এক জন সত্যিকার কবি বা নাট্যপ্রতিভাও এ জিনিসগুলোকে তাদের অন্তরের জীবনের পক্ষেও এমন দরকার মনে করে।

অজিত বললে—এ রকম নির্বোধ কি করে হওয়া যায়?

অজিত বললে—এ ঘোর কেন তাদের কাটে না?

অজিত বললে—এর চেয়ে মদের রসের জন্যই যারা মদ খায় কিম্বা মেয়েমানুষ ভালো. লাগে বলেই নিরবচ্ছিন্ন উপভোগ করে চলে তারা ঢের বাস্তব।

পূর্ণিমা বললে—ঠিক তাই। কিন্তু যে ভড়ং দিয়েই শুরু করুক না কেন, কবি গুণী যাই বলুক না কেন অজিতবাবু শেষ পর্যন্ত রসের জন্যই খায় তারা-সব করে—

—তখন আর ভড়ং থাকে না!

—না। একটা বাস্তব দরকার হয়ে পড়ে।

—তোমারও তাই হয়েছে নাকি!

—এখনও হয় নি—

—কিন্তু হতে পারে?

—বলতে পারি কি অজিতবাবু?

—কিন্তু অভিনয়কেই তুমি সব চেয়ে ভালোবাস না পূর্ণিমা

—তাই তো বাসি—

—যে জন্য তুমি ভদ্রঘরের মেয়ে হয়েও অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করছ—

—হ্যাঁ, অজিতবাবু—

—তোমার শিক্ষাদীক্ষা এত রূপ এত গুণ তোমাকে মানুষের জীবনের চলতি পথের কত সুখ সম্মান সাধের দিকে নিয়ে যেতে পারত। পূর্ণিমা-কিন্তু স্টেজকে ভালোবেসেই তুমি এলে-কাজেই এ তোমার সুখের নয় সংগ্রামের জায়গা-আরাম নয় নিবেদনের স্থল হয়ে উঠল—কিন্তু পূর্ণিমা—

অজিতের গলা ভারী হয়ে উঠল।

তিন চার মিনিট চুপ করে রইল সে—

পূর্ণিমা বললে—কি ভাবছেন?

অজিত একটু হেসে বললে—তোমার এই নিবেদনের মূর্তিটি চিরদিনই রেখো। কোনো কিছুই যেন একে কোনোদিন পশু না করে ফেলে—

পূর্ণিমা হাসতে হাসতে বললে—আপনি ভয় পাচ্ছেন মদ খেয়ে আমি বুঝি বা নষ্ট হয়ে যাই—

অজিত ব্যথা পেয়ে বললে—থাক এ কথা—

—কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না—

—কি?

—যে মদ খেয়ে বা অত্যাচার করে প্রতিভা খরচ হয়ে যায়—

—তা যায়।

—আপনি জোর করে কেন বলেন?

—জোর নয়।

—কিন্তু আমি ঢের শুনেছি-আমি নিজেও জানি যে আমি এক আধ গ্লাস খেয়ে স্টেজে যখন উঠি তখন আমার (…) খুলে যায়। ও না হলে আমি হাঁপিয়ে উঠতাম—

অজিত নিস্তব্ধ হয়ে রইল।

পূর্ণিমা বললে—এ প্রয়োজন আমার বেড়ে চলে যদি-আমার মনে হয় ক্রমে ক্রমেই বেড়ে যাবে-বাড়ছে যেন—

অজিত অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বললে—কি?

—এ আমার প্রয়োজন যে—

—আমিও তো অ্যাক্ট করি—

—কিন্তু আপনার মত ভাগ্যবান আমি তো নই—

—তোমার ঢের সম্পদ আছে পূর্ণিমা-তুমি এ আর কোরো না—

—কিন্তু স্টেজে উঠে গুলিয়ে যায় যদি সব।

—মদ না খেলে?

—হ্যাঁ অজিতবাবু—

—বরং নেমে খেও-বা অন্য সময়ে এক আধটু খেও-এতে এ অভ্যাসের দৃঢ়তা কমে — যায়—

—তা হবে না।

—কেন?

—বড্ড নার্ভাস হয়ে পড়ি—

—এ তোমাকে কে শিখিয়েছে?

—প্রথম দু’চার রাত এমন ভালো অ্যাক্ট করলাম-কোনো ভুল হ’ল না। ভয় ভেঙে গেল—একটা সার্থকতা পেলাম-তখনই এই প্রবৃত্তি জাগল আমার। এতে জিনিসটা এমন সহজ হয়ে গেছে—

—সহজে হয়ে যায়?

—হ্যাঁ

—তাহ’লে আমিও খেতে আরম্ভ করব পূর্ণিমা?

পূর্ণিমা শঙ্কিত হয়ে উঠে বললে—আপনার কি দরকার? আপনার জন্মগত ক্ষমতার কাছে এ সব জিনিসের তো কোনো প্রয়োজন নেই।

অজিত অবসন্ন হযে হেসে বললে—জন্মগত ক্ষমতা! প্রতিটি রাতের জন্য আমার কত কষ্ট পেতে হয় তা তুমি জান কি পূর্ণিমা—

—আপনার দুটি পায় পড়ি-তাই বলে এ সব করবেন না।

অজিত হাসতে হাসতে বললে—আচ্ছা, এখন তো এক গ্লাস ঢাল।

—আপনার দুটি পায় পড়ি, চাইবেন না আপনি—

—দুটি পায়! কিন্তু আমি একটা বোতল কিনে নিয়ে নিজের ঘরে বসে খাই যদি—

–তাহ’লে আমি সব ছেড়ে দেব—

—মদ?

—এ স্টেজ এ অভিনয়-যাকে আমার নিবেদনের জীবন বলেছেন আপনি সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব—

অজিত হাসতে হাসতে বললে—অত বাড়াবাড়ি কেন করবে?

পূর্ণিমা বললে—সব ছেড়ে দিয়ে যখন এখানে চলে এলাম তখনও তো বাড়াবাড়িই করেছি।

–তাই তো।

—আবার যদি তেমনি তাগিদে চলে যাই।

—আমি মদ খেলে তাগিদটা তত বড় হবে?

-হ্যাঁ

—একটা সামান্য মদ খাওয়ার ব্যাপার শুধু—

—মদ খাওয়ার ব্যাপার শুধু নয়।

—তবে?

—আপনার মদ খাওয়া।

অজিত হাসতে লাগল—

হাসতে হাসতে বললে—এতে তো আমার অধিকার আছে—

পূর্ণিমা বললে—আপনার?

—হ্যাঁ, আমি কবি ছিলাম-এখন গুণী হয়েছি-লোকেও তো আমাকে সমর্থন করবে।

অজিত একটু থেমে বললে—হয়তো আমার কাছ থেকে এ জিনিস প্রত্যাশাই করবে তারা। আমি কবি ছিলাম-গুণী হয়েছি—তুমি চুপ করে আছ কেন পূর্ণিমা? আমার অদিকার নেই?

—আছে বৈ কি।

—তবে?

—আপনার অধিকারের প্রতিবাদ আমি করব না, কিন্তু আপনার মাকে আপনি কি বলবেন?

—হাঃ হাঃ……মা?

—কি বলবেন তাঁকে আপনি?

—বলবার কি দরকার আর?

—কিছুই বলবেন না?

—না।

—কেন?

—মানুষের জীবন ক্রমে ক্রমে তার নিজেরই জিনিস হয়ে দাঁড়ায়-কোনো শ্রদ্ধা মমতা ভালোবাসার সঙ্গে বাঁধ আর তেমন কঠিন হয়ে থাকে না, ঢিলে হয় খসে যায়। যা তার ভালো লাগে তা সে করে-এরই ভিতর থেকে তার নবীন ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও মমতার জন্ম হয়—

এখন আমি অভিনয়কে শ্রদ্ধা করি—চুরুটের প্রতি মমতা-কাকে ভালোবাসি আজো তা বুঝি না—

পূর্ণিমা বললে—কিন্তু মানুষের শ্রদ্ধা মমতা ভালোবাসা মোচড় দিয়ে ধীরে ধীরে আবার সেই পুরোনো জিনিসগুলোতেই গিয়ে বাঁধা পড়ে।

—ওঃ-পড়ে না কি?

—হ্যাঁ

—কি করে বুঝলে তুমি?

—মানুষ শেষ পর্যন্ত এই পুরোনো জিনিসগুলোকে কিছুতেই ছাড়াতে পারে না; যে জিনিস যত পুরোনো তাকে ভোলা ততই কঠিন-যতই দিন বাড়ছে ততই বুঝছি—

—তোমারও তোমার মাকে মনে পড়ে?

—মাকে বাবাকে।

—বেঁচে আছেন আজো?

—হ্যাঁ

—তুমি বাংলা অক্ষর প্রথম লিখলে কোথায়?

—মেমের স্কুলে।

—মেমের স্কুলে? ফ্রক পরতে?

—হ্যাঁ

—খুব ছোট্ট মেয়ে ছিলে?

—ছিলাম বৈ কি।

—দেশের নাম কি?

—হিজলডাঙা

—হিজলডাঙা! বা পৃথিবীতে এমন সুন্দর নামও আছে পূর্ণিমা? এ দেশ বাস্তবিকও কোথাও আছে-না একটা স্বপ্নের কথা বলছ তুমি? অনেক হিজল আছে সেখানে?

—আছে বৈ কি—

—কত দিন হিজল গাছ দেখি নি-ছাতিম দেখি নি-মাছরাঙা দেখি নি—তুমিও তো দেখ নি-এ সবের জন্য দুঃখ হয় না তোমার

—হয় বৈ কি-এক এক দিন রাতে ঘুম ভেঙে যায়-ঝর ঝর করে বৃষ্টি পড়তে থাকে-এমন একা লাগে-আপনি যে আত্মনিবেদনের মূর্তির কথা বলেছেন তাকে এমন হৃদয়হীন জন্তু বলে মনে হয়-আমি সব ছেড়ে দিয়ে আমার হিজলডাঙায় চলে যেতে চাই

অজিত উঠল—

পূর্ণিমা কাতর হয়ে বললে—বাঃ হিজলডাঙার কথা পেড়ে আপনি বিদায় নেবেন?

-হিজলডাঙার সঙ্গে আমার কি?

—কৈ আমার দেশের কথা এত দিন এমন ভালোবেসে জিজ্ঞেস করে নি তো কেউ! হিজলডাঙা নামের যে মধুরতা সে আমার নিজেরই জিনিস ছিল-আপনি এ সব বুঝলেন কি করে অজিতবাবু? কেন আপনি জিজ্ঞেস করলেন সে সব মধুর গাছপালা মানুষ ছায়া নিস্তব্ধতার কথা মনে করে আমার দুঃখ করে কিনা? আপনি এ সব বোঝেন কি করে? আমি ভেবেছিলাম আমার এ পাড়াগাঁকে আমি ছাড়া কেউ ভালোবাসে না-তার রূপও কেউ বোঝে না, আপনি এসে বললেন-কত দিন হিজলের ফুল দেখি, নি-তাই তো—এত সব ধরা পড়ে আপনার হৃদয়ে?

অজিত এ সব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললে—তারপর তুমি বড় হ’লে-কলকাতার কলেজে পড়তে এলে। অনেক শিক্ষাদীক্ষা পেলে তুমি-আমাদের স্টেজের পক্ষে এ খুব মূল্যবান জিনিস হ’ল-এমনটি হয় নি কোনো দিন-কে জানে আর কত দিন পরেই বা হবে। তোমার এই নিবেদনের মূর্তিকে সব সময়ই মনে রেখো পূর্ণিমা-আমিও মনে রাখব।

আজ আমাদের আর কোনো কথা নেই।

অজিত উঠে চ’লে গেল।

জীবনযাপন – ৪

অনেক গভীর রাতেও হিজলডাঙার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারল না পূর্ণিমা। সেই রূপশালী ধানের দেশে-দেশের কত রকম যে রূপ আর্ রস ছায়া মমতা গন্ধ তাকে নিবিড় ভাবে পেয়ে বসেছে—

বাইরে ঝর ঝর করে বৃষ্টি পড়ছে—

জানালার পাশে বসে পূর্ণিমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

কিন্তু তারপর অজিতের কথাগুলো মনে পড়ল তার; মানুষের জীবন ক্রমে ক্রমে তার নিজেরই জিনিস হয়ে দাঁড়ায়… মমতার জন্ম হয়।

তাই হয় না কি?

আর অজিতবাবুর এই কথাগুলো : তারপর তুমি বড় হলে…আমিও মনে করে রাখব।

মূল্যবান জিনিস? নিবেদনের মূর্তি? বাইরে কি গভীর বাদল এখনও! হিজলডাঙার বনে না কি? যেন ঝিঁ ঝিঁ জোনাকী অবসাদ কল্পরা স্বপ্ন ঘুম মিশে যাচ্ছে সব।

অজিত টাকা পাচ্ছিল—

একদিন মায়ের নামে দেড় শো টাকা মনিঅর্ডার করে সে পাঠিয়ে দিল-চিঠিতে লিখে দিল—এমনি মাঝে মাঝে পাঠাব।

কয়েক দিন পরে ডাকপিওন এসে সে টাকা ফেরৎ দিয়ে গেল-এ টাকা যাঁর নামে পাঠান হয়েছে তিনি রাখেন নি, তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন।

দিন তিনেক পরে চিঠি—

মা লিখেছেন : তোমার এ টাকা আমি রাখতে পারলাম না। তুমি আর আমাদের টাকা পাঠিও না। এর চেয়ে তুমি যদি মুদীর দোকান খুলে, গাড়োয়ানের কাজ করে, জুতো সেলাই করে আমাদের টাকা পাঠাতে তাও আমরা আদরে গ্রহণ করতাম।

কিন্তু তোমার অধঃপতন সে সবের চেয়ে ঢের বেশি হয়েছে।

তোমার জন্য লজ্জায় ঘেন্নায় অনেক সময় মানুষের কাছে মুখ দেখানোও শক্ত হয়ে ওঠে।

তুমি এ রকম করবে তা আমরা ভাবতেও পারি নি-নিধিবাবুর ছেলে হরিলাল যাকে সমস্ত দেশশুদ্ধ কেউ দেখতে পারত না সেও তাহ’লে তোমার চেয়ে ঢের মানুষ —

অজিত চিঠিখানা পনেরো ভাঁজ করল—তবু ছিঁড়ল না—

আবার খুলল-আবার ভাঁজ করল—

আবার খুলল—

চায়ের কাপ ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল—

একটা মাছি মরে পেয়ালার ভিতর পড়ে রয়েছে—

পূর্ণিমা যে কখন ঘরের ভিতর ঢুকে পড়েছে অজিত তা টেরও পায় নি। চোখ যখন তুলল তখন দেখল পূর্ণিমা বসে রয়েছে-একটা কৌচে

—কি মনে করে?

—আপনি কি ভাবছেন অজিতবাবু?

অজিত কোনো উত্তর দিল না।

—আজো সেই বইয়ের কথাই ভাবছেন নাকি?

অজিত ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়ল—

পূর্ণিমা বললে—আপনার হাতে ওটা কি? -একটা চিঠি।

—কার?

—মার—

—ওঃ

দু’জনেই চুপ করে রইল—

খানিকক্ষণ পরে অজিত বললে—মা লিখেছেন—

চায়ের পেয়ালা তুলতে গিয়ে অজিত বললে—একটা মাছি মরে পড়ে রয়েছে।

চায়ের পেয়ালাটা অজিত সরিয়ে রেখে দিল

—মা লিখেছেন তোমার টাকা আমি নেব না—

—মাকে টাকা পাঠিয়ে ছিলেন বুঝি?

—হ্যাঁ-সে টাকা তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন-লিখেছেন এর চেয়ে তুমি যদি মুদীর দোকান খুলে-গাড়োয়ানের কাজ করে-জুতো সেলাই করে আমাদের টাকা পাঠাতে আমরা তা সাদরে নিতাম—

—এমনি কথা লিখলেন আপনার মা? থিয়েটারকে তিনি এত দূর ঘেন্নার জায়গা মনে করলেন?

—লিখেছেন ‘তোমার অধঃপতন সে সবের চেয়ে…হরিলাল তোমার চেয়ে ঢের মানুষ—’ -হরিলাল কে?

—আমাদের দেশেরই একটা ছেলে।

—কি করে?

মদ গাঁজা খেয়ে বেড়ায়-বেশ্যাপাড়ায় পড়ে থাকে—

পূর্ণিমার সমস্ত শরীর দু’এক মুহূর্তের জন্য কাঁটা দিয়ে উঠল।—অত্যন্ত কষ্টে নিজেকে দমন করে একটা ঢোঁক গিলে পূর্ণিমা বললে—সেই হরিলালের কথাও উঠল আপনার এই টাকার ব্যাপার নিয়ে-তার চেয়েও আপনাকে হীন মনে করেন আপনার মা?

—হ্যাঁ, তার চেয়েও আমাকে হীন মনে করেন আমার মা, না হ’লে টাকা ফিরিয়ে দেন কখনও? পৃথিবীর সব চেয়ে বড় চামারের কাছ থেকে টাকা নিতে সাধুমানুষরা একটুও চিন্তা করে না কতবার দেখলাম-কিন্তু আমার এ টাকাও মার অস্পৃশ্য—

—থিয়েটারকে কি তিনি এতই জঘন্য মনে করেন?

—আমাদের পরিবারকে তো তুমি চেন না—

—কি রকম?

—ভদ্রলোকদের বাড়িতে যে গানের মজলিস হয় তাতেও তাঁরা—

–তাঁরা কি গান গান না?

—গান বৈ কি-ভজন-সঙ্কীর্তন-খুব প্রাণ ঢেলে গান। খুব শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস পরলোকে ভগবানের ওপর—

—তা তো সকলেরই আছে—

—হ্যাঁ, তোমার আছে পূর্ণিমা-তা আমি জানি। কিন্তু তাঁদের খুব বেশি আছে,—বলা না ঘটাই বেশি—ঘটা বেশি না বিশ্বাস শ্রদ্ধা বেশি সে সব খোঁজ নিয়ে আমার মনের কোনো রকম চরিতার্থতা পাই না-তবে খুব শ্রদ্ধা বিশ্বাস নিয়েই তাঁরা তৃপ্ত নন-সে জন্য আড়ম্বরও ঢের আছে বটে-এত আয়োজন এত সমারোহ যে তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না-তোমার কাছে সেগুলো খুব অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে—

—আপনার কাছে মনে হয়েছিল?

—কিন্তু খুব সৎ-কেউ তামাকও খান না-আমিই আমাদের বংশে প্রথম চুরুট খেয়েছি—গানের মজলিসে গিয়েছি-থিয়েটার দেখেছি-কবিতা লিখেছি—

—কবিতা লেখাও পাপ?

—আমাদের পরিবারই তো শুধু নয়—এমন অনেক পরিবার রয়েছে যারা এ সমস্ত জিনিসগুলোকেই অত্যন্ত অশ্রদ্ধার চোখে দেখে-কবিতা লিখলেও মনে করে-কবি-গুণী হয়ে গেল—জাত হয়ে গেল আলাদা-হয়তো সারা দিন একটা এস্রাজ নিয়ে পড়ে থাকবে-না হয় মদ খাবে-কিংবা এ সব কিছু না করলেও মেয়েমানুষের রূপ গুণ স্তন চুমো নিয়ে এই সব লিখবে-কবিতা বা কবি যে এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে সে ধারণাও নেই তাদের—

—আপনি হয়তো এস্রাজ নিয়ে পড়ে থাকতেন না সারাদিন!

—থাকতে পারলে মন্দ হ’ত না—

—আপনার কবিতা—

—থাক্

—আজকাল লেখেন না বুঝি আর? -না

যেগুলো লিখেছেন তা আছে?

(-তুমি দেখবে?)

—দেখতে ইচ্ছা করে।

—ছাপাই নি তো কোনো দিন-পুঁজি করেও রাখি নি-যদি জানতাম তুমি দেখতে চাইবে—

—তাহ’লে নেই?

—এই তো সেদিন সমস্ত পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেললাম—

—পুড়িয়ে ফেললেন? বলেন কি? কেন? কবে?

—সেই যে বড় বৃষ্টিটার দিনে।

—কেন?

—ভাবলাম ও পাট আমার শেষ হয়ে গেছে—এ সব ঘরের এক কোণে পড়ে থাকলেও আমার নতুন জীবনের একান্ততাকে বাধা দেয়-কেমন একটা সমস্যা নিয়ে আসে কেবলই মনে হয়, আমি নট না কবি?

পূর্ণিমা বললে—তাই পুড়িয়ে ফেললেন?

—হ্যাঁ। ভালো করি নি? একটা জিনিসকেই তো ধরতে হয় আমাদের-যে জিনিসটা আমরা সব চেয়ে ভালো পারি?

—কিন্তু তবুও কবি—হলে এত অশ্রদ্ধা পেতেন না আপনি—

—তাও পেয়েছিলাম—

—কিন্তু এখন একেবারে কলঙ্ক কুড়োচ্ছেন।

—কিন্তু সব পরিবারই তো আমাদের পরিবারের মত নয়—

—কিন্তু নিজের পরিবারের ঘৃণা উপেক্ষাই সব চেয়ে বেশি আঘাত দেয়—

–নিজের মাও যখন ছেলের টাকা ফিরিয়ে দেয়!

অজিত তার মায়ের চিঠিটা পনেরো ভাঁজ করছিল—

পূর্ণিমা বললে—এ চিঠিটার ওপর আপনি খুব নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছেন দেখছি।

অজিত একটু হাসল—

হেসে চিঠিটা পকেটের ভিতর রেখে দিল—

চায়ের কাপটা তুলতে গিয়ে অজিত দেখল একটা মাছি মরে পড়ে রয়েছে—

পূর্ণিমার সামনে চুরুট সে আর জ্বালাল না—

পূর্ণিমা বললে—আপনাদের পরিবারে আর কেউ বিগড়ায় নি?

—না

—খুব বড় পরিবার?

—হ্যাঁ, আমার ঠাকুদ্দার চৌদ্দটি ছেলেপিলে! -তাই নাকি!

—আমার জেঠামশায়েরও আঠারো কুড়ি জন।

পূর্ণিমা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললে—এরা সকলেই মানুষ হচ্ছে? -হ্যাঁ

—কেউই চুরুট খায় না?

—না

—গানের মজলিসেও যায় না?

—না

—কি করে?

—পড়াশুনো করে।

—তার পর।

—বিয়ে করবে, সন্তানের পিতামাতা হবে

—এমন আঠারো কুড়ি জন করে সন্তান?

—দেশেরই তো উপকার তাতে—নিজেদেরও ঢের সাধ—

বলেই পূর্ণিমা লজ্জিত হ’ল—

অজিত হয়তো শোনে নি-সে বললে—তাদের মানুষ করবে-সন্তান-সন্ততি কেউ কোনো দিন যাতে কুপথে না যায়-চুরুট না খায়, গানের মজলিসে না যায়, এস্রাজ নিয়ে না পড়ে থাকে-পড়াশুনো করে উকীল মোক্তার হেডমাস্টার হয় মানুষ হয়—এইই তারা দেখবে-এরা আছে বলেই দেশ টিকে আছে-স্টেটের কাছ থেকে এরা বৃত্তি দাবী করতে পারে—

—কেন?

—এদের কুলবধূরা তো খুবই পারে।

—কি রকম?

—সমস্ত জীবন ভরে এক একটি বধূ সতেরো কুড়ি জন সন্তানকে পেটে ধরবার অসহ্য কষ্ট ও সহিষ্ণুতা কেন মিছেমিছি বহন করবে? এর জন্য কি তারা পুরষ্কার পাবে না? হাজার হাজার বাঙালি রোজ মরে যাচ্ছে সেখানে আঠারো কুড়ি জন করে জ্যান্ত বাঙালি প্রতিটি মেয়ের কাছ থেকে চালানি মালের মত জুটে যাচ্ছে-এই অক্লান্ত ক্লেশ ও ধৈর্য একটা জাতকে রক্ষা করবার মত, এই নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসের কি কোনো মূল্য নেই?

পূর্ণিমা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললে—খুবই মূল্য আছে অজিতবাবু-কিন্তু আমার এই মনে হয় যে এরা গানও যদি ভালোবাসত—

—উপাসনা ভজনের গান ভালোবাসে বৈ কি—

—সঙ্কীর্তন ভজনের গানই শুধু নয়-অন্য রকম গানও দিন রাত যে লোকটা বীণা নিয়ে সাধছে তার একটা মূল্য দিতে পারত যদি নিজেদের প্রথামত জীবনের বাইরে অন্য অন্য জীবন।

—তাহ’লে কি হত?

—আপনার মা কি এই টাকা ফেরাতে পারতেন?

অজিত আবার চায়ের পেয়ালাটা মুখে দিতে গিয়ে দেখল একটা মাছি মরে পড়ে রয়েছে— বললে—মূৰ্ণিমা—

—কি?

—এই চায়ের পেয়ালাটা দেখ তো—

—বসুন আমি চা করে আনছি—

কয়েক দিন কেটে গিয়েছে—

অভিনয় বেশ জমছে—

সেই পুরোনো বইটাই-ভালো লাগছিল না অজিতের-কিন্তু আশ্চর্য লোকে তার অ্যাক্টিঙের নিন্দে করে না তবু-অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শোনে ভালোবাসে-কে জানে আরো কত কি করে—

পূর্ণিমাকে খুব সফল মনে হয়; এ দু’জনের অভিনয়ের সফলতা তো বটেই, আরো কত কি সার্থকতা নিয়ে মানুষের চাঁট বসায়।

অজিত ভাবছিল বইটাকে নিয়ে পূর্ণিমার তো বিশেষ ধোঁকা নেই—কিন্তু অজিত নিজে এ লেখাটির অন্তঃসারশূন্যতা পদে পদে বুঝতে পেরেও কোন হৃদয় নিয়েই বা একটা অনভিজ্ঞ নির্বোধ লেখকের অসাড় চরিত্রের ভূমিকা নিয়ে স্টেজে গিয়ে দাঁড়ায়-কি কথাই বা বলে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্ত নির্বোধ কথাগুলোই বলে তো সে-বলে প্রশংসাও পায়।

এমন কেন হয়?

অজিত বিছানায় এ পাশ ও পাশ ফিরতে ফিরতে ভাবছিল স্টেজে দাঁড়ালেই লেখকের মূর্খতার কথা আর মনে থাকে না তার অভিনয়কে সে এমনই ভালোবাসে যে তারই গুণে সমস্তই যেন প্রাণ পায়—

পূর্ণিমারও তাই।

কাল কি একটা পর্ব ছিল সারা রাত অভিনয় করে কাটাতে হয়েছে-পূর্ণিমার তার দু’জনেরই।

অজিতের ঘুম পাচ্ছিল—

সে ঘুমিয়ে পড়ত, কিন্তু চটকা ভেঙে গেল-স্নান টান করে শোভা সজ্জা রূপের হিল্লোল ভুলে পূর্ণিমা এসে ঢুকেছে—

—সারা রাত তো জাগলে কাল—

আপনিও তো জেগেছেন—

—আমি তো ঘুমুচ্ছিলাম-কিন্তু তোমার কি কোনো ক্লান্তি নেই?

-আমার ঘুম পায় নি অজিতবাবু।

অজিত ভালো করে একবার পূর্ণিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে—তোমাকে দেখে মনে হয়, কাল সারা রাত ফ্রক-পরে খুকির মত ঘুমিয়েছ-। মনে কোনো পাপ নেই তোমার, মুখে কোনো কালি নেই। অথচ সারা রাত জেগে পার্ট খিস্তি। এ সব তুমি কি করে ঘটাও পূর্ণিমা?

-আরসীতে একটু আগেও আমার মুখ দেখে এসেছি আমি-দেখে আর ফিরে তাকাতেও ইচ্ছে করে না—

আপনি বড্ড সৌখীন কি না—

—সে যাক্, ফিরে যে তাকাতে ইচ্ছে করে না তা আমিই জানি, আর আমার উনিই জানেন, ও রকম একটা রাতের পরিশ্রান্তির পর এই রকমই হয়।—কিন্তু তোমার এ দিব্যি চেহারা কি করে হইল?

অজিত বললে—শুনলাম তুমি না কি মদও ছেড়ে দিয়েছ।

—দিয়েছি অজিতবাবু।

—সেই দিন থেকেই

—হ্যাঁ

—বাঃ!

—কিন্তু কত দিন ছেড়ে থাকতে পারব বলতে পারি না—

অজিত সে কথার কোনো উত্তর দিল না।

পূর্ণিমা বললে—আপনি ঘুমোবেন?

—না

—আমি এসে আপনার ঘুম নষ্ট করে দিলুম—

–তুমি এসে?

পূর্ণিমা ঠোঁট ফাঁক করে হাসছিল—

একটা সাদা বেনারসী শাড়ী পরেছে সে—

ভোরের আলো জানালার ভিতর দিয়ে এসে পূর্ণিমার মুখ ঘিরে একটা দিব্য রৌদ্রচক্র সৃষ্টি করেছিল; সেই আভার ভিতর পূর্ণিমাকে আকাশযানী দিব্যযোনির মতন মনে হচ্ছিল।

অজিত মেয়েটির আপাদমস্তকের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ভরসা পেয়ে বললে—কলেজে পড়তে যখন থিয়েটার দেখতাম তখন একটা জিনিস আমাকে বড় আঘাত দিত—

পূর্ণিমা ঘাড় হেঁট করে আঁচ করছিল।

অজিত বললে—দেখতাম অ্যাকট্রেসদের সব হোঁৎকা চেহারা-কালো ঠোঁট চোখ বসে গিয়েছে—

পূর্ণিমা শিহরিত হয়ে উঠল—

অজিত বললে—এমন ঘেন্না করত।

—চেহারার জন্য?

—অত্যন্ত কদর্য চেহারা তা তুমি ধারণা করতে পার না।

পূর্ণিমা বললে—পারি না? তা বলবেন না। কালো কুরূপ হলে হয় কি-এক জন যদি ভালো গাইতে পারে কিম্বা পার্ট প্লে করতে পারে—

অজিত বাধা দিয়ে বললে—তা সে নিজের ঘরে বসে করুক।

পূর্ণিমা ব্যথিত হয়ে বললে—কেন?

অজিত বললে—শুধু ভালো অভিনয় বা গান করতেই পারলে হয় না-সে গ্রামোফোনে চলে রেডিওতে বেশ নিজের স্বামী বা স্ত্রী বা প্রেমিকের কাছেও তার মূল্য আছে। কিন্তু থিয়েটারে দেহের মর্যাদা কত যে মূল্যবান তা সেই-গ্রীকরা জানত, আমাদের যাদের বস্তুচেতনা আছে তারা বোঝে।

পূর্ণিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললে—চেহারার অপরাধ তো মানুষের নিজের নয় অজিত বললে—তা নয়।

—তবে?

—যে তাকে আমদানি করে তার অপরাধ—

পূর্ণিমা একটু হেসে বললে—কোথায় আমদানি করে?

—থিয়েটারে।

—তার অপরাধ?

—হ্যাঁ

—কেন?

—থিয়েটারের সর্বাঙ্গীণ সৌন্দর্যের দিকে তার চোখ নেই-ভাবে গাফিলতি করলেও চলে। কিন্তু এতে তাদের বড্ড খারাপ লাগে যারা দেখতে আসে, তারা বড্ড পীড়া বোধ করে। কলেজে পড়বার সময় আমার কিশোর মনও এমনি ঢের বিক্ষুব্ধ হয়ে অনেক দিন ফিরে গেছে। শৈবলিনীর পার্ট নিয়ে যে এল সে যদি এক জন হোঁৎকা বুড়ী হয়-ঠোঁটে তার তখনও তামাকের গন্ধ লেগে-মস্ত বড় ভুঁড়ো পেট-হাতের মাংস মুখের মাংস ঝুলছে কেমন লাগে তা হ’লে বল তো—

পূর্ণিমা বললে—এ রকম হয় না-এ রকম হয় নি কোনো দিন।

একটু থেমে পূর্ণিমা বললে—আমার নিজের চেহারাও কি রকম কে জানে?

অজিত বালিশের থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললে—তোমার চেহারা এ যুগের একটা সৌভাগ্যের জিনিস।

—এ যুগের?

—হ্যাঁ

—যুদ তো একটা বড় কথা।

—তোমার চেহারাও ছোট নজরের জিনিস নয় তো-বিধাতা খুব মহৎ হয়ে তৈরি করেছিলেন—

অজিত বললে—আজকাল যারা কলেজে পড়ে-যাদের কিশোর বয়স-তোমার অভিনয় ও শরীরের রূপকুশলতা দেখে কাটল তারা রোজ রাতেই যে সার্থকতা নিয়ে ঘরে ফিরে যায় তাকে আমি ঈর্ষা করি-আমার কৈশোর যৌবনের সময় শত চেষ্টা করেও এ সার্থকতা আমি একটা থিয়েটার দেখেও পাই নি। কি যে নিষ্ফল নিরুপায় দিন গিয়েছে সে সময়ে!

—উপায়হীন হয়ে পড়েছিলেন?

—থিয়েটারকে আমি ছোটবেলা থেকেই ভালোবেসেছি-বরাবরই এর অভাব অভিযোগগুলো নিয়ে মম হৃদয়হীন মন্তব্যে ভরে উঠেছে-আজো কত অভাব রয়েছে-কিন্তু শৈবলিনীর পার্ট যদি শৈবলিনীর মত মেয়ে এসেই করে কিম্বা পার্ট মত যুবা তাহলেও একটা মস্ত অভিযোগ কেটে যায়—

অজিত বললে—যুবাদের পাওয়া যায়-কিন্তু তোমার মত এক অধ জন মেয়েমানুষ যখন স্টেজের থেকে বিদায় নেবে তখন রমা বা ষোড়শীর ভূমিকার জন্য একজন ধুমসো ঝি ছাড়া কিছুই যদি আমরা খুঁজে না পাই?

পূর্ণিমা শুনে একটু হাসল।

পরে বললে—না, সে জন্য ভাববেন না অজিতবাবু, সে ব্যর্থতার দিন চলে গেছে—তুমি এসে দূর করে দিয়েছ বটে—কিন্তু তুমি যে দিন চলে যাবে—

—আমি চলে যাব কেন?

—তুমিই বা কত দিন থাকবে?

—আমাকে তাড়াতে চান?

অজিত হেসে বললে—না আমি স্টেজের অনেক দূর ভবিষ্যতের কথা বলছি-যখন আমিও মরে যাব আমাদের দু’জনের কেউই নেই—

—তা নিয়ে আক্ষেপ করে কি লাভ? সে আপনার প্রতিনিধিরা বুঝবে। আপনি যা পেয়েছেন তাই নিয়েই তৃপ্ত থাকুন—

অজিত শুরু করল-বিলেতে—

—বিলেতে আমার চেয়ে ঢের ভালো ঢের অভিনেত্রী মেলে-তা আমি জানি। কে জানে বাংলাদেশেও এক দিন মিলবে কি না—

—কিন্তু তার তো কোনো লক্ষণ দেখছি না —

—কিছুটা পথ আমরা হয়তো কেটে দিয়ে যাচ্ছি—তারপর?

—তারপর-একজন মানুষই দু’চার বছরের মধ্যে কত মুখোস বদলে ফেলতে পারে-একটা স্টেজ বা দেশের পরিবর্তনের কি আর সীমা আছে অজিতবাবু? আজ আপনার মা টকা নিলেন না-এক দিন হয়তো এ দেশেরই কত বড় ঘরের কত মা তাঁদের মেয়েদের গিয়ে সাধবেন-অভিনেত্রী হবার জন্য। যে জিনিস বস্তুনিষ্ঠ সৌন্দর্যের এবং হয়তো বা সত্যের এক দিন তা তার মূল্য পাবেই।

পূর্ণিমার কথা শুনতে শুনতে অজিত এর ভেতর প্রতিবাদ করবার কিছু খুঁজে পেল না-এই মেয়েটি যেন নিকষপাথরে রেখা কেটে কথা বলছে।

নিজে অজিত জিনিসটাকে কোনো দিন এমন করে বুঝে দেখে নি কি?

দু’এক মুহূর্তের ভেতরেই অজিত অকাতরে ঘুমুতে লাগল।

পূর্ণিমা ধীরে ধীরে উঠে চলে গেল।

আরো কয়েক দিন কেটে গিয়েছে।

অনেক লোক আজকাল অজিতের সঙ্গে দেখা করতে আসে-কেউ বা বইএর পাণ্ডুলিপি নিয়ে, কেউ বা পাশের জন্য, কেউ মন্তব্য করতে, কেউ বা প্রশংসার ভাষা খুঁজে পায় না-কেউ বা চাঁট বসাতে চায় শুধু, কেউ টাকা ধার করে নিয়ে যায়-কেউ মদ মজলিসের জন্য কামনা করে আসে-কেউ বা দু’কথা শুনিয়েও যায়-মেয়েরাও মাঝে মাঝে আসে—

এক দিন অজিত ভোররাতে ঘুমোতে এসে রাজেনকে ডেকে বললে—দেখ রাজেন-আজ কাউকেই আসতে দিবি না—

—বহুৎ আচ্ছা হুজুর!

—বলবি বাবুর শরীর ভালো নেই, বাবু ঘুমুচ্ছে —

—হুজুর

—বেলা আটটার সময় গোলমালে অজিতের ঘুম ভেঙে গেল-জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল রাজেন দাঁড়িয়ে আছে।

অজিত বললে—ভিতরে আয়।

রাজেন এসে বললে—অনেক ভিড় জমে গেছে বাবু—

–কিসের ভিড়?

—লোকজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায় —

অজিত পাশ ফিরে শুয়ে বললে—বলা গিয়ে দেখা হবে না।

রাজেন বললে—আমি কোলাপসিবল গেটে তালা বন্ধ করে এসেছি বাবু।

অজিত বিছানায় এ পাশ ও পাশ একটু অস্বস্তির সঙ্গে নড়ে চড়ে উঠে বসল।

রাজেন দোতলার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।

অজিত বললে—শোন —

রাজেন এসে বললে—বলুন—

—ক’জন লোক এসেছে?

—অনেক।

—কি চায়?

—যেমনি রোজ আসে-দেখা করতে চায় আর কি—

অজিত বললে—আচ্ছা বৈঠকখানায় নিয়ে বসাও-স্লিপ কার্ড যা হয় পাঠিয়ে দু’এক জন করে আসুক—

মিনিট পাঁচেক করে রাজেন এক রাশ স্লিপ এনে অজিতের টেবিলের ওপর রাখল।

অজিত বললে—মিশিয়ে ফেলেছিস দেখি সব-আচ্ছা যা।

একটা যে-কে-সে স্লিপ তুলে নিয়ে অজিত রাজেনকে বললে—নিয়ে যাও এটা—আসতে বল—

মিনিট খানেক পরে এক জন ছোকরা এসে হাজির।

অজিত বললে—বোস।

অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে একটা কৌচের ওপর সে বসল।

—কি চাও তুমি?

—কিছু চাই না।

—তবে? —

—আপনাকে দেখতে এসেছি।

—আমাকে দেখতে?

—হ্যাঁ

–স্টেজে কি দেখ না?

—দেখি

—তবে?

—একজন বড় লোক তাঁর প্রাইভেট লাইফে কেন?

—সেই তো আমার বাইরের জীবন-আমি তো প্যান্ডাল গিয়ে পোলিটিক্যাল লেকচার দেই না—

ছেলেটি বললে—স্টেজে আপনাকে তকমাপরা দেখি-আপনি পরের কথা আওড়ান-কিন্তু এখানে আপনার নিজের মুখের কথা শুনব —

—কতক্ষণ শুনবে?

—যতক্ষণ আপনি সময় দিতে পারেন—আচ্ছা মানুষের জীবনটা কি?

অজিত একটু হেসে বললে—তুমি কি বোঝ?

—আমার বোঝার কোনো মূল্য আছে?

—তুমি নিজে কি মনে কর?

—কোনো মূল্য নেই—

—কেন?

—আমার কোনো ক্ষমা নেই—

—তুমি কলেজে পড়

—হ্যাঁ

—কোন ক্লাসে?

—এবার বি-এ পাস করেছি—

—তার পর?

—বাবা অ্যাটর্নি তিনি আর্টিকেলড্ হতে বলেন—

—আর তুমি? তুমি কি বল?

আমি দেখি টাকার অভাব আমাদের নেই-আমাদের তিন পুরুষ অ্যাটর্নিগিরি করে খেয়ে ছেলেপিলে রেখে মরে গেছেন—কিন্তু মরে যাবার পর কেউ তাদের নামও করে না—কেউ তাদের কথা বড় একটা বলে না ভাবে না-ওদিকে যত দিন বেঁচে থাকেন কি কঠোর পরিশ্রমই না এরা করেন। আমার মনে হয় এদের পথে যদি যাই অবস্থা আমারও তো এদের মতনই হবে-এত খাটাখুটি—এত ঝকমারি-এত নেশা হয়তো টাকার, হয়তো নিছক এটর্নিপনার-যার জন্য জীবনের অন্য সমস্ত সাধ ও সম্পদ বিসর্জন দিতে হয়-শেষ পর্যন্ত এর কোনো মূল্য থাকে না কেন?

—থাকে বৈ কি?

—কি মূল্য?

—তা তাঁরা বুঝেছেন —

—আপনি যদি দয়া করে একটু বলে দেন—

—আমি?

—একটু দয়া করে যদি—

অজিত বললে—তুমি তো নিজেও বুঝেছ-বলেও ফেলেছ-বলেছ এত নেশা-হয়তো টাকার-হয়তো নিছক এটর্নিপনার এই নেশার তৃপ্তিই তাঁদের প্রত্যেক জীবনকে তাঁদের প্রত্যেকের কাছে একটা মূল্য দিয়েছে—

—কিন্তু সে মূল্যকে আমি রাবিশ মনে করি।

—রাবিশ?

—একেবারে রাবিশ —

—কেন?

—লাখ লাখ টাকা তো একটা মুদীও রোজগার করতে পারে-এটর্নিপনায়ও, তা মানুষের অন্তরের কোন কামনা বা সাধনা বা সত্য তৃপ্ত হয়—

—তোমার হয় না?

—একেবারেই না অজিতবাবু-এ সব জিনিসকে আমি ঘৃণা করি—

—কি ভালোবাস তা হ’ল—

—সেইটেই আজো বুঝছি না—

—ফুটবল?

ছেলেটির মুখ অভিমানে ও ব্যথায় রক্তিম হয়ে উঠল—

অজিত বললে—পড়াশুনো?

—কলেজের ডিগ্রির জন্য পড়াশুনো নয়-এমনি বইটই নিয়ে অনেক সময় মন্দ কেটে যায় না-কিন্তু সব চেয়ে আশ্রয়ের জিনিস বইও নয়—

—নারীপ্রেম?

—হয়তো না-কিম্বা কোনো নারীকে ভালোবাসলেও শেষ পর্যন্ত তার ভিতর কোনো চরিতার্থতা নেই—

—তাই বল?

—একে একে অনেক মেয়েকেই তো ভালোবেসে দেখলাম।

—তারপর?

—তবে এই নিষ্ফলা বা টাকার চেয়ে সে. ঢের ভাল—

—তবে এই কর না কেন? টাকার অভাব তো আমার নেই-এক পুরুষ এটর্নি না হলে কিছু এসে যাবে না-তোমার ছেলেকে না হয় এটর্নি করবে আবার—

ছেলেটি বললে—দেখুন নারীর সঙ্গে প্রেম নিয়ে জীবনটা কাটানো মন্দের ভাল। এর ভেতর ঢের মাধুর্য রয়েছে-তবুও বিচ্ছেদ ব্যথা ঈর্ষা একঘেয়েমিরও কি শেষ আছে? তারপর একটা ভালোবাসা যখন শেষ হয়ে যায় তখন মনে হয় কি কাদামাটি নিয়েই না ছিলাম—

এ ছাড়া অন্য কোনো কিছুই কি নেই যা নিয়ে বাবা ঠাকুদ্দার মত তৃপ্তও থাকতে পারি বটে—কিন্তু জীবনের একটা মূল্যবান কাজও করা হয়—

—এটর্নিগিরিকে একটু মূল্যবান মনে হয় না?

—একটুও না—

—এত বড় জিনিসই যখন তোমার কাছে অসার হয়ে উঠল তখন আমি ছোট ছোট জিনিসের কথা বলতে পারি শুধু—

—যে কোনো এটর্নি বা রাউন্ডটেবল কনফারেন্স ম্যানের চেয়ে ঢের বড় মনে করি আপনাকে আমি। একজন ভাইসরায়ের কি দাম অজিতবাবু? একজন ক্যাবিনেট মিনিস্টারেরই বা কি মূল্য? কিন্তু যে কবি—

অজিত থামিয়ে দিয়ে বললে—তোমার এই ভালোবাসাগুলো নিয়ে একটা উপন্যাস লেখ না—লিখতে আমি পারি না—

—চেষ্টা কর না—

—লেখা আমার আসে না।

—তবু কি করতে চাও তুমি-অ্যাক্ট?

—তাও আমি পারি না—

—তবে

—সেই জন্যই তো বলছি আপনাকে-আমার জীবন বড্ড নিষ্ফল—

—কিন্তু মেয়েরা তো তোমাকে ভালোবাসে?

—তা বাসে

—তবে প্রেম কর না গিয়ে-বাঃ-আমিও তো স্টেজে বাঁধা না পড়লে তাই করতাম—

–বাবা ঠাকুদ্দার কাজের চেয়ে সে ঢের ভালো জিনিস হয় —

অজিত হাসতে হাসতে বললে—তবে আর কি?

—কিন্তু জীবনের কৈফিয়ৎ দেওয়া হয় কি?

—কার কাছে কৈফিয়ৎ

—ধরুন নিজের কাছেই-মনে হয় জীবনটাকে নিয়ে এ খেলা করছি শুধু—। এর আরো তো ঢের ব্যবহার ছিল। ভালো আমি আরো ঢের বেসেছি যে রোজ হাঁপিয়ে উঠি। ঠিক যাকে ভালোবাসতে চাই তাকেও কিছুতেই তো পাওয়া যায় না।

ছেলেটি বললে—এবার কাকে ঠিক ভালোবেসেছি জানেন?

—কাকে?

—মিস পূর্ণিমাকে

অজিত একটা ধাক্কা সামলে বললে—ওঃ

—এখন কি করি বলুন তো?

অজিত কোনো উত্তর দিল না।

ছেলেটি বললে—তাকে কি করে পাওয়া যায়?

—পেতে চাও? দূরের থেকে ভালোরেসে ভালো লাগে না?

—না

—কেন?

—একটা ভালোবাসা হয় বটে-কিন্তু তাতে কোনো চরিতার্থতা নেই-অজিত-বাবু—

–অজিত বললে—জীবনটাকে মূল্যবান করতে চেয়েছিলে?

—হ্যাঁ

—আমি বললাম, লেখ, কিম্বা স্টেজ-অ্যাক্টিং যদি পার-তাও কর-কিন্তু কিছুই যখন পার না তুমি তখন এই জিনিসটা কর-পূর্ণিমাকে ভালোবেসে অন্য কোনো রকম রস চরিতার্থতার কথা ভাবতে যেও না। সে একজন অভিনেত্রী-স্টেজে দাঁড়িয়ে মানুষের জীবনের অনেক নিহিত সৌন্দর্য ও সম্পদকে অনুভব করতে সে তোমাদের সাহায্য করে। তোমরা যদি অনুভব করতে পার তাহলে সে কৃতার্থ হয়। তেমন ভাবে অনুভব করতে পেরেছ—এবং সে অনুভবের মাধুর্য নিয়ে অনেক দুঃখ ও নিষ্ফলতার রাত একা একা মুগ্ধতায় কেটে যাবে তোমার এমন যদি বোধ কর তাহ’লে তোমার সমস্ত জীবনের এই সাধনাটুকুই পৃথিবীর কোনো অমূল্য জিনিসের চেয়েই কম মূল্যবান হবে না।

তোমার জীবন মূল্যবান হবে—

ছেলেটি মাথা পেতে সব শুনল—

তারপর চলে গেল—

অজিত বললে—রাজেন, বেলা তো ঢের বেড়ে গেল—তুমি ওদের একে একে সকলকে আসতে বল।

(সমাপ্ত)

No comments