জলাভূমির আতঙ্ক – আলী ইমাম

জলাভূমির আতঙ্ক – আলী ইমাম

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানার জন্য পশু-পাখি সরবরাহ করার জন্যে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে চিড়িয়াখানার চাহিদানুযায়ী পশু-পাখি ধরে এনে সরবরাহ করা। প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়েও এ ধরনের সরবরাহ হয়ে থাকে। অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গহীন অরণ্য থেকে, দুর্গম অঞ্চল থেকে পশু-পাখি সংগ্রহ করে থাকেন ।

বিশ্ববিখ্যাত লন্ডন চিড়িয়াখানার জন্য বিরল প্রজাতির পশু-পাখি সংগ্রহ করে দিতেন মি. হ্যামিলটন। তিনি ছিলেন দুঃসাহসী প্রকৃতির। তার আগ্রহ ছিলো দুষ্প্রাপ্য প্রাণিকুলের প্রতি। যারা পৃথিবী থেকে বিরল হয়ে যাচ্ছে। তিনি এ জন্য অত্যন্ত দুর্গম এলাকাতেও যেতেন। বিষয়টাকে তিনি কোনো রোমাঞ্চকর অভিযানের মতোই মনে করতেন। এ কাজে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি অনুসন্ধান করতেন বিপন্ন প্রাণিদের ।

১৯৫০ সালে তিনি লন্ডন চিড়িয়াখানা থেকে একটি কার্যাদেশ পেলেন। তা হলো বর্ষাঅরণ্য বলে পরিচিত আমাজানের এলাকা থেকে দুপ্রাপ্য পশু-পাখি সংগ্রহ করা। | ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর বলে পরিচিত আমাজান। লাল-নীল রঙের কাকাতুয়া জাতীয় ম্যাকাও পাখি আছে আমাজানে। বিশাল ঠোটের টুকান পাখিও আছে ।

চিড়িয়াখানাতে এ দুটো পাখির আবার বেশ চাহিদা। আমাজান অরণ্যে এমন কিছু প্রাণি রয়েছে যা পৃথিবীর আর অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।

আমাজানের মস্ত বড় পাইথন সাপ অ্যানাকোন্ডা তো বিশ্ববিখ্যাত।

মি. হ্যামিলটন গিয়েছিলেন সমুদ্রের কাছাকাছি এক লোনা জলাভূমিতে। ঐ জায়গাটা একেবারে ভেনেজুয়েলার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

সেখানে ছিল অজস্র পাহাড়ি ঝরনা। যেগুলো সাগরের দিকে কলকলিয়ে ছুটে চলেছে। এই পাহাড়ি ঝরনাগুলো এলাকাটিকে যেন আলাদা ধরনের বৈশিষ্ট্য দান করেছিল।

সেখানে অনেকগুলো হ্রদ ছিল। বদ্ধ জলাভূমির দু’পাশে ছিল দুর্ভেদ্য জঙ্গল। হাজার হাজার মাইলব্যাপী গভীর বনাঞ্চল। জঙ্গলের বেশির ভাগ জায়গাই কয়েক ইঞ্চি পুরু ঝরা পাতায় ঢাকা। তার উপর গাছের শিকড়-বাকড়ের বিস্তৃতি। উপরে রয়েছে নিবিড় ছাউনি ক্যানপি। ঘন সবুজ গাছপালায় ঢাকা।

আমাজান যেন এক রহস্যময় বনভূমি। সেই বনভূমিতে ছিল প্রচুর জীবজন্তু। বিচিত্র প্রজাতির পাখি, পোকা-মাকড়, কীট-পতঙ্গ।

লন্ডন চিড়িয়াখানা থেকে প্রাণি চাহিদার যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল তার অধিকাংশই ছিল সেখানে। দুর্গম সেই অঞ্চলে পশু-পাখি সংগ্রহ করার কাজটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

বেশ দক্ষতার সাথে আমাজান অরণ্যে মি. হ্যামিলটন তার অভিযানটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। লাভ করেছিলেন অনেক ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেসব গা ছমছমে অভিজ্ঞতার কথা লিখে প্রকাশ করেছিলেন। লেখার বর্ণনার গুনে পাঠকেরাও যেন তার সাথে সাথে গভীর অরণ্যে চলে গিয়েছিল। তারাও রহস্যটকা বনাঞ্চলের স্পন্দনকে অনুভব করতে পেরেছিল। অচেনা-অজানা এক জগতের সাথে পরিচিত হয়েছিল। আর সে কথায় বর্ণিত হয়েছে এ গল্পে :

বর্ষাকালের শেষদিকে অনেক কষ্টকর ভ্রমণের শেষে আমরা সেখানে পৌছাতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেটা ছিল বিশাল বিস্তৃত এক জলাভূমি। পুরোটা পানিতে থইথই করছে।

আমাদের আস্তানা হল জলাভূমির পাশের ছোট্ট এক গ্রাম সান্তারোজায়। সেই ঘাঁটিতে পৌছাতে আমাদের দু’দিন সময় লেগেছিল।

এমিকুইকা নদীর উজান বেয়ে প্রথমে ছোট একটি লঞ্চে করে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরে ছোট ডিঙিতে ভাসতে হল। সেখানে নদীটা ছিল আবার খুবই সরু। স্রোত কম। পচা পাতা থেকে টালিন নামক বস্তু বের হয়ে পানির রঙ-কে কালো করেছে। আমাজান নদীর রঙ বাদামি। এই দুই রঙের পানি যখন মেশে অনেক দূর পর্যন্ত কালো ও বাদামি রেখা পাশাপাশি দেখা যায়। কালো পানিতে মশার উপদ্রব কম বলে আদিবাসিরা কালো পানির কাছাকাছি বাসা বেঁধে থাকে।

এই অরণ্যে আছে হাওলার বানর, তামারিন বানর, আগুতি, তাপির ও ক্যাপিবারা। এ ছাড়াও হাজার রকমের মাকড়সা আছে। বিরাট কালো লোমশ টারানটুলা নামের ভয়াবহ মাকড়সা আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

আমাদের ডিঙি তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে। দু পাশ থেকে ঝুঁকে রয়েছে নানা গাছ-গাছালি। আবছা অন্ধকার জমে আছে। সহজে ঝকঝকে নীল আকাশকে আর দেখতে পাওয়া যায় না।

নদী জলজপাতায়, দামঘাসে ঢেকে রয়েছে। পদ্মপাতা, কচুরিপানা আর নানা ধরনের পাতার ঠাসবুনোট সেখানে।

অনেক সময় মনে হচ্ছিল যে নদীটির উপরে বুঝি সবুজ ঘাস লতার বুনোন একটি মস্ত জাজিম পাতা রয়েছে। দু পাশের গাছপালা এত ঘন যে মনে হচ্ছিল আমরা বুঝি একটি সুড়ঙ্গ পথের ভেতর দিয়ে চলেছি। এ ছিল এক অভিনব পরিবেশ। আগে আর এ রকম কোথাও দেখিনি।

গাছের ডালে বসে আছে কাঠঠোকরারা। ঘন কালো রঙের লম্বাটে পাখি। লম্বা ঠোট, টকটকে লাল বুক।

ডিঙিটা এগিয়ে যেতেই চট করে সরে যাচ্ছে গাছের ওদিকে। তারপর মুখ বাড়িয়ে যেন আমাদেরকে দেখছে। প্রজাপতি উড়ছে ঝাকবেঁধে। কখনও উড়ে এসে ডিঙির গলুইয়ের মাথার কাছে এসে বসছে। এখানে নদীর ধারে অজস্ত্র রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। তাদের হরেক রকমের রঙ ও গড়ন। কারো ডানা কাচের মতো স্বচ্ছ। মনে হচ্ছে নদীতীরের কাদা ওদের কাছে প্রিয়। এদের মধ্যে সবচাইতে সুন্দর হচ্ছে মরকো । প্রায় ছয় ইঞ্চি আকারের বিরাট প্রজাপতি। ডানার রঙ উজ্জ্বল নিয়ন বাতির মতো নীল। অলস ভঙ্গিতে উড়ছে নিবিড় সবুজ জঙ্গলে। দেখতে যেন স্বপ্নের মতোই সুন্দর।

হঠাৎ করে ডানা ঝাপটে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে লাফিয়ে উড়ে আসে মাছরাঙ্গা। পাখিটা তীরের পাঝোপের ভেতরে এমনভাবে মিশেছিল যে তাকে দেখতে পাইনি। এটা ছিল চমৎকার এক দৃশ্য। উড়ন্ত রঙধনু যেন। খানিক দূরে গিয়ে ডানামুড়ে বসে পড়ে।

রাতের অন্ধকারে আমাজানকে সত্যি খুব রহস্যময় বলে মনে হয়। গাছের ছায়াগুলি বিকেল হতেই দীর্ঘ হতে শুরু করে। আধো ছায়াময় বনভূমি তখন আরও অন্ধকার হয়ে আসে। হঠাৎ ঝুপ করেই চারপাশটা নিকষ অন্ধকারে ডুবে যায় । জায়গাটা যেহেতু বিষুবরেখার কাছাকাছি তাই এখানে গোধুলিবেলা বলে কিছু নেই। এখানকার বৈশিষ্ট্য হলো যে সকাল ও সন্ধ্যা দুটোই আকস্মিকভাবে হয়। সারাদিন ধরে চেঁচামেচি করতে থাকা পাখিগুলো হঠাৎ চুপ করে যায়।

রাতে নদীর ধারে টর্চ জ্বেলে জোড়া জোড়া জ্বলন্ত চোখ দেখতে পেতাম। ওগুলো ছিল আমাজান কুমির কেইমানের চোখ। শুধুমাত্র ওরা নাকের ডগা আর চোখ দুটোকে পানির ওপর রেখে স্থির হয়ে ভেসে থাকে।

একসময় সান্তারোজা গ্রামটি চোখে পড়ল। ছোটখাটো একটা দ্বীপের মতো স্থান। কয়েকটি মাত্র আদিবাসিদের ঘর সেখানে। এদের রয়েছে ছোট ছোট মোচার খোলার মতো ডিঙি। এ রকম পানির দেশে ডিঙি নৌকাই হচ্ছে যাতায়াতের একমাত্র সহায়। এই আদিবাসিরা হল নদীর লোক। এরা রেড ইন্ডিয়ান। ছোট ছোট ক্ষেতে এরা কলা, পেঁপে, আলু ফলায়। নদী থেকে মাছ ধরে। গ্রামবাসীদের মধ্যে এরই লেনদেন চলে।

সান্তালরাজার চারদিকে রয়েছে বর্ষার বদ্ধজলা। আমার থাকার ব্যবস্থা করা হল গাঁয়ের শেষ দিকের একটি গোলপাতার ছাউনি দেয়া কুঁড়েঘরে। যার এক চিলতে বারান্দাটি ছিল জলার দিকে।

শীতকালে জলার পানি সরে যাওয়ার পর সেখানে জেগে উঠবে পলিমাটির জমি। ঐ উর্বর জমিতে আদিবাসিরা শীতের ফসল ফলায়।

বেশ কয়েকটি দিন আমাকে সেখানে পানিবন্দি অবস্থায় থাকতে হল। অলস সময়ে বারান্দার চেয়ারে বসে বাইনোকুলার দিয়ে পাখিদের দেখতাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমি একটি বিচিত্র চিড়িয়াখানতে চলে এসেছি। যার চারদিকে রয়েছে বিচিত্র ধরনের সব প্রাণি। চুপ করে বসে থেকে অনেক রকমের নতুন ধরনের শব্দ শুনতে পেতাম। গাছের পাতাকাঁপানো তুমুলভাবে বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ। হঠাৎ জেগে ওঠা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ।

ধূসর রঙের র্যাকুনকে দেখলাম। ওদের লেজে শাদা-কালো ডোরা দাগ। র্যাকুনটা পানিতে নেমে শিকার করত। ওর হাতটাকে ডুবিয়ে শিকার খুঁজত। ব্যাঙ অথবা কাঁকড়া ধরত । কাঁকড়া পেলে আঁছড়াতো। তীক্ষ্ণ দাঁতের সাহায্যে কাকড়াকে টুকরো টুকরো করত। তারপরে সেই খণ্ডিত অংশগুলোকে পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিত। এরকমভাবে ধোয়াটা হচ্ছে র্যাকুনদের এক স্বভাব। এভাবে এরা খাবারকে পরিষ্কার করে নেয়।

কুঁড়েঘরের পুব দিকের পেয়ারা বাগানে গেছো সজারুদের আসতে দেখলাম। ওদের সমস্ত শরীর ধূসর, শাদা কাঁটায় ঢাকা। কুঁচফলের মতো দুটো টলটলে চোখ। তরতরিয়ে উঠে যেত গাছের মগডালে। কখনও ডালের সাথে লেজটাকে জড়িয়ে নেয়। এরপর পেছনের দু পায়ে ভর দিয়ে উবু হয়ে বসে পেয়ারা চিবিয়ে খায়। এরা দলবেঁধে আসত। গাছের সমস্ত ফল সাবাড় করে চলে যেত। তবে ওদের কখনও মারামারি করতে দেখেছি। লেজ দিয়ে শক্তভাবে ডালের সাথে নিজেদের আটকে নিয়ে সামনের দু থাবা দিয়ে লড়াই করত। সেটা ছিল মারাত্মক ধরনের লড়াই । বাইনোকুলার দিয়ে সজারুদের চোখ মুখের ভঙ্গি স্পষ্টভাবে দেখতে পেতাম। তাদের প্রতিহিংসার ধরনটা দেখা যেত। ক্রোধে যেন ফুঁসে উঠছে।

বিরল শ্রেণীর নিশাচর বানরদের দেখলাম। এ ধরনের বানর পৃথিবীতে শুধুমাত্র এ বনেই আছে। খুদে বানর মারমোসেট। ওদের স্বভাব অনেকটা কাঠবিড়ালিদের মতো। এরা বাদাম খায়, পোকা ধরে খুঁটে খায়। দাঁত দিয়ে চিবিয়ে গাছের বাকলের রস খায়। পিগমি বানর। লম্বায় মাত্র ১০ সে. মি.। গাছের শাখায় ছুটোছুটি করে। শাখায় ওদের নখের আঁচড়ের দাগ পড়ে। ওখানে মাকড়সা বানরদের দেখলাম। এরা ওদের লেজকে দড়ির মতো বাঁকাতে পারে। শক্তিশালী লেজের সাহায্যে ঝুলে থেকে দু হাতে ফল পাড়ে।

একটা মেছোকুমিরকে জলাভূমিতে ভেসে যেতে দেখলাম। সাদা কালো পিঠেটাকা দাগ। এসব কুমির পানির প্রান্তরেখার বেশ দূরে একটা জায়গা বাছাই করে গর্ত খুঁড়ে থাকে। রাতের বেলায় ডিম পাড়ে। কতটুকু গভীরতায় সে ডিম রাখবে তা মাটির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। এমন জায়গায় ওরা গর্ত খুঁড়ে যেখানটায় আবার সারাদিন রোদ পড়ে। জলজ উদ্ভিদের সাহায্যে বাঁধ দিয়ে বাসা বানায়। সারাদিন নিঃসার ভঙ্গিতে শুয়ে থাকে। মনে হলো এখানে প্রাণিটা এ কলা থাকে। অন্য কোনো মেছো কুমিরকে আশপাশে আর দেখিনি।

জলাভূমির পদ্মপাতার ওপর দিয়ে তিরতিরিয়ে হেঁটে যায় একটা জলপিপি। হালকা নলখাগড়ার বনের মাঝে শাপলা ফুলের পাতা যখন পানির ওপরে আসল বিছিয়ে দিয়েছে সেখানে জলপিপিকে মনে হবে বুঝি পাখির রাজ্যে ওটি নর্তকী। বাদামি রঙের পালক পিঠে। চোখের ওপর দিয়ে শাদা একটি রেখা। এদের পাখার বাঁকে শক্ত, সুঁচালো আঙটার মতো অস্ত্র লাগানো থাকে।

জলপিপিদের পায়ের নখ ও আঙুলগুলি অনেক লম্বা। মাকড়সার পায়ের মতো। হওয়ার জন্য শরীরের ওজন ছড়িয়ে দিয়ে পানির ওপরে ভেসে থাকা পাতার উপর দিয়ে চলতে পারে।

মেছোকুমিরটার ভাবসাব দেখে ধারণা হয় ওটা বুঝি জলপিপিটাকে ধরার জন্য মনে মনে ফন্দি আঁটছে। জলপিপিটা পদ্মপাতার ওপর অতি সতর্কভাবে পা ফেলে চলাফেরা করে।

মেছোকুমিরটার দিকে তাকিয়ে হয়ত ভাবে, এটা আবার কেন এখানে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে? এর জাতভাইয়েরা তো বাস করছে দূরের হ্রদে। এটা কেন সেখানে চলে যায় না?

বিষয়টা আমাকে কেন জানি ভীষণ কৌতুহলী করে তোলে। আমি মেছোকুমিরটার কার্যকলাপ মনোযাগের সাথে লক্ষ্য করতে থাকি। কী করতে চাচ্ছে সে? তার ইচ্ছেটা আসলে কী? কোনোমতেই সে আর জলপিপিটাকে তার নাগালের মাঝে পায় না। জলপিপিটা ভাসমান পাতার ওপর দিয়ে চমৎকার নাচের ছন্দে দৌড়ায়। ইতিউতি তাকায়। মাঝে মাঝে তার লম্বা আঙুল দিয়ে কোনো এক পদ্মপাতার প্রান্তটাকে উল্টে ধরে। পাতার নিচে রয়েছে অজস্র জলজ জীব। পোকা-মাকড়, পানি মাকড়সা জোঁক। জলপিপিটা ঠোট দিয়ে সেগুলো খুঁটে খুঁটে খেত আর একটা চোখ মেলে রাখত তার জন্মশত্রু ঐ মেছোকুমিরটার দিকে।

কোনো কোনোদিন জলপিপিটা যখন কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত তখন মেছোকুমিরটা সক্রিয় হয়ে উঠত। ধীর গতিতে এগিয়ে আসত। যেভাবে টিকটিকি এগিয়ে যায় শ্যামাপোকার দিকে। একটু একটু করে কমিয়ে আনে দূরত্বটাকে। কিন্তু তারপরেই ভুল করে ফেলত মেছোকুমিরটা। লেজের বাড়িতে জলাশয়ের পানিকে তোলপাড় করে সাঁতারে ছুটে আসত জলপিপির দিকে। সেই শব্দে তখন জলপিপি সাঁই করে উড়াল দিত। ডানা ঝাপটে মেছো কুমিরটার ওপর চক্রাকারে পাক খেতে থাকত।

শিকার ধরার ঠিক আগ মুহূর্তে মেছোকুমিরটা এমন ধরনের ভুল করে বসত। সে যদি বুদ্ধি করে পদ্মশালুক পাতার জাজিমে মোড়া পানির নিচ দিয়ে চুপিসারে এগিয়ে এসে জলপিপিটার পা টাকে কামড়ে ধরত তাহলে পিপিটা আর পালাতে পারত না।

এমন করে শিকার ফসকে যাওয়াতে মেছোকুমিরটি পানিতে তার লেজটা হঠাৎ আঁছড়াতে থাকে। অন্য জলচর পাখিরা তখন দলে দলে পাক খেয়ে উড়তে থাকে। আমি ঐ জলপিপিটাকে নিয়ে ভাবতাম। সে কেন এই জোরে জোরে মৃত্যুভয়ের মাঝে সেখানে থাকছে? ইচ্ছে করলেই তো সে দূরের কোনো জলাশয়ে চলে যেতে পারে। যেখানে দারুণ পদ্মবন রয়েছে কিন্তু মেছোকুমির নেই। মৃত্যুর আতঙ্ক নেই।

ওদের এখানকার একসাথে অবস্থান করার কারণটা আমি ঠিক বুঝতাম না। জলপিপিটা নিশ্চিত এক মৃত্যু-থাবার আওতায় কাশঝোপের কিনারে বসে থাকে। আমার কৌতূহল জাগে ঐ কাশঝোপে কী আছে তা জানতে। সেটা জানার জন্য একদিন এগিয়ে গেলাম ঐ কাশঝোপের দিকে। গিয়ে দেখি কাশঝোপের মাঝখানে লতাপাতা, ঘাস দিয়ে তৈরি করা বাসায় মা জলপিপিটা ডিমে তা দিচ্ছে। আমাকে দেখামাত্রই পাখিটা ডানা ঝাপটে যেন প্রতিবাদ জানায়। আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম সেই বাসাতে মোট চারটে ডিম রয়েছে। ডিমগুলো একদিকে মোটা, অন্য দিকটা সরু হালকা সবুজ।

জলপিপিটা পিটি টু টুইট, পিটি টু টুইট শব্দে ডাকাডাকি শুরু করল । আমাকে দেখে সে খুব ভয় পেয়েছে। আমি যেন ওর ডিমগুলোকে চুরি করতে গেছি। আসলে আমার তো সে রকম কোনো ইচ্ছেই নেই। আমি ওখানে গিয়েছিলাম সেখানে কী আছে তা দেখার জন্য। ভয়ার্ত পাখিটা কেমন অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। আমি সেখান থেকে চলে এলাম।

এরপর কয়েকদিন জলপিপিটাকে আর দেখলাম না। এদিকে মেছােকুমিরটাও চলে গেছে জলাভূমির একেবারে দূরতম প্রান্তে। একদিন আবার সেই কাশঝােপের কাছে গেলাম। জলপিপিটার বাসা ফাঁকা। ভাঙা ডিমের খােলা এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হয়ত ঈগল বা পেঁচা এই কাজটি করেছে। গেছাে সজারুদেরও কাজ হতে পারে। কাদের কাণ্ড ঠিক বুঝতে পারলাম না।

জলপিপির নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণটা অবশ্য বুঝতে পারলাম। তার বাসাটিকে তছনছ করে ফেলা হয়েছে। পাখিটা হয়ত সেই দুঃখে অন্য কোথাও চলে গেছে। বেচারি পাখি শোক সামলাতে পারেনি।

এসব দেখে স্বভাবতই আমার মনটা একেবারে খারাপ হয়ে যায় । এই ভয়াবহ ঘটনার জন্য কে দায়ী তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আসল অপরাধী তাহলে কে? এটা জানতে না পারার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগল।

পরদিন বিকেলে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আছি। তখন সেই চমৎকার দৃশ্যটা আমার চোখে পড়ল। জলপিপি মায়ের সাথে চারটি তুলতুলে ছানা। মা পিপিটা বেরিয়ে আসে কাশঝোপের ফোকর থেকে। তার পেছনে তিরতির করে হেঁটে আসছে চারটি ছানা। এক একটা ছানা বড় পাতিলেবুর আকারের। গোলাকার দেহের নিচে এক জোড়া দেশলাই কাঠি আর তার নিচে মাকড়সার জালের মতো লম্বা সুতোর ধরনের আঙুল। এক একটা আঙুল আবার গোটা দেহের মতো লম্বা। ছানাদের চলার ভঙ্গিটি ছিল ভারি মজার। তারা হাঁটছিল তাদের মায়ের পাশাপাশি ।

মা জলপিপিটা পদ্মপাতার ওপরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা দিয়ে পদ্মপাতার কিনারটা উল্টে ধরছে। সেখানে কিলবিল করতে থাকা পোকা মাকড় খুঁটে তুলে খেতে দিচ্ছে তার ছানাদের । অল্প সময়ের মধ্যেই ঐ পদ্মপাতার নিচের জলজ জীবগুলোকে খুঁটে তুলে ফেলা হয়েছে। এবার মা জলপিপিটা এক পা বাড়িয়ে সামনের পদ্মপাতায় চলে আসে। তার সাথে পাতা ডিঙিয়ে ছানাগুলোও তিরতিরিয়ে আসে।

হঠাৎ আমার মনে ঝিলিক দিয়ে উঠল সেই মেছোকুমিরটার। এখন সেটা কোথায় রয়েছে? বাইনোকুলার দিয়ে সমস্ত জলাভূমিটা খুঁজে দেখলাম । কিন্তু কোনো জায়গাতেই ওটাকে আর দেখতে পেলাম না। তাহলে কি দূরের হ্রদে তার জাতভাইদের কাছে চলে গেছে? এটা ভেবে নিয়ে আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম। এখন থেকে জলপিপিটা তাহলে তার ছানাদের নিয়ে এখানে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে।

আমি যেই মাত্র দূরবিনটাকে আবার জলপিপির পরিবারের দিকে। ঘুরিয়েছি তখনই সেই ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখলাম। জলপিপির পরিবার থেকে মাত্র হাত দশেক দূরে পুরো শরীরটাকে পানিতে ডুবিয়ে রেখে শুধুমাত্র নাকটুকু জাগিয়ে রেখে স্থির হয়ে আছে মেছোকুমিরটা। সে যে ওখানটার ঘাপটি মেরে আছে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। তার নাক মুখ পিঠ ঢেকে রয়েছে থকথকে সবুজ শেওলার আস্তরণে। মনে হচ্ছে মেছোকুমিরটা ছদ্মবেশ ধরে ওখানে বসে আছে। জলপিপিটা অবশ্য তাকে তখনও দেখতে পায়নি। সে কারণে নিশ্চিন্ত পায়ে পায়ে সে মেছোকুমিরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। একেবারে অবধারিত মৃত্যুর মুখে এগুচ্ছে।

আমি মেছোকুমিরের অপলক দৃষ্টিকে পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মা জলপিপি তার ছোট পরিবারটিকে নিয়ে এখনই হিংস্র কামড়ের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। আমার তখন মনে হল জলপিপির পরিবারটিকে বাঁচানো উচিত। আমি বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে চাইলাম। যার প্রচণ্ড শব্দে জলপিপি পরিবারটি উড়ে যাবে আকাশে। বেঁচে যাবে মেছোকুমিরের ভয়ঙ্কর থাবা থেকে।

আমি তখন মনে মনে বলছি, মেছোকুমির, ঐ জলপিপি পরিবারের কারোর একটি পালকও যদি আজ খোয়া যায় তাহলে কাল সকালে তোমাকে অবশ্যই চিত হয়ে জলাভূমিতে ভাসতে হবে। এটা হবেই। কারণ মৃত্যুর শোধ আমি মৃত্যুতেই তুলব।

বন্দুক হাতে করে বারান্দায় ছুটে এলাম। দূরবিন দিয়ে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করলাম। মা জলপিপিটা তখনও পর্যন্ত তার বিপদের আঁচ টের পায়নি। সে এগিয়ে যাচ্ছে। দূরত্ব আর মাত্র হাত তিনেক। এর মানে হচ্ছে মেছোকুমিরটাকে আর সাঁতরাতে হবে না। তার শুধু একটা ঝাঁপই যথেষ্ট। জলপিপি মা তার ছানাদের নিয়ে নির্ভয়ে ঘুরছে। মেছোকুমিরের নাকটা ডুবে গেল । ওটা এবার ঝাঁপ দেবে। তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বন্দুকটা তুলে নিয়ে আকাশ লক্ষ করে একসাথে দুটো ট্রিগারই টেনে দিলাম। সেই প্রচণ্ড শব্দে জলপিপি মা টা শূন্যে লাফ দিল । মেছোকুমিরের মাথার ওপরে চক্রাকারে পাক খেতে লাগল। চারটি ছানা কিন্তু উড়তে পারল না। তার বোধ হয় ওড়ার শিক্ষাটা তখনও পায়নি। ছানাগুলো ভীত হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিল। মেছোকুমিরটাও ওদেরকে তাড়া করল। মা জলপিপি জলাশয়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত কেঁদে কেঁদে উড়তে থাকে। অন্য জলচর পাখিরা তাকে সমবেদনা জানায়।

বিকেলের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

আমি চোখ থেকে তখনও দূরবিনটা নামাইনি। কিন্তু নিরুদ্দিষ্ট কাউকেই আর চোখে পড়ল না। মেছোকুমিরটাকেও সেখানে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। জলপিপির চারটে ছানাকেও দেখলাম না। তবে কি ছানাগুলো কুমিরের দাঁতে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে?

আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে জলপিপি পরিবারটির কোনো রূপ ক্ষতি হলে মেছোকুমিরটাকে হত্যা করব। আমি বন্দুকে নতুন করে গুলি ভরলাম । কাল ভোর হলেই আমি মেছো কুমিরটাকে মারব। পরদিন সকালে বন্দুকটাকে ঘাড়ে ফেলে সেই কাশঝোপের কাছে গেলাম । অবাক হয়ে দেখি তার মাঝে মা জলপিপিটা বসে আছে। তার পেছনে তিনটি ছানা। আমাকে দেখতে পেয়েও জলপিপিটা উড়ে গেল না। আমি ভাবছি, চতুর্থ ছানাটি কোথায় গেল?

কিছুক্ষণ পর মা জলপিপি তার তিনটি ছানাকে নিয়ে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে যায়। দূরবিন দিয়ে তন্নতন্ন করে জলাশয়টা সন্ধান করি । মেছোকুমিরটাকে কোথাও দেখি না। ঐ হিংস্র প্রাণিটাকে যে ভাবেই হোক আমাকে পেতে হবে । আমি গ্রামের দু’জন সাহসী যুবককে সঙ্গী করলাম । একটা পাকনো শক্ত দড়ির মস্ত লম্বা ফাঁস বানিয়ে ডিঙি করে রওনা দিই। জলাভূমির একদম দূরতম প্রান্তে ঐ মেছোকুমিরটার সন্ধান পাওয়া গেল। রোদে পিঠ দিয়ে ঘুমুচ্ছে। দড়িরে ফাসঁটা বাগিয়ে ধরে সন্তর্পণে এগুতে থাকি। তারপর ফাঁসটাকে কুমিরের গলায় পরিয়ে দিই। এভাবে ওটাকে আটকাই। প্রচণ্ডভাবে ছটফটিয়ে উঠল কুমিরটা। ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গেছে। যত সে তড়পাচ্ছে ততই ফাঁসটা তার গলায় শক্তভাবে দেবে যাচ্ছে। আমরা তিনজন মিলে ওটাকে টেনে হিচড়ে ডিঙিতে তুলি। এরপর যেতে থাকি দূরের হ্রদটার দিকে। সেখানে আরো কয়েকটা মেছোকুমির বালির চড়ায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। সেখানে গিয়ে আমরা ডিঙি থেকে ফাঁস খুলে মেছোমিরটাকে ছেড়ে দিলাম। প্রাণিটা ডুব সাতারে চলে গেল।

এরপর যে ক দিন সান্তারোজা গাঁয়ে ছিলাম জলাভূমির পদ্মপাতার ওপরে মা জলপিপি আর তার তিনটি ছানার তিরতিরিয়ে ছোটাছুটি দেখলাম। জলাভূমির আতঙ্ক তাদের আর তাড়া করছে না।

No comments