রক্তকরবী – অনুষ্টুপ শেঠ

রক্তকরবী – অনুষ্টুপ শেঠ

“আপনি আগে এই ফ্ল্যাটে এসেছেন?”

খসখসে গলায় পালিশ ছিল না। বরং ভদ্রতার পাতলা চাদর ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল পুলিশি কড়কানি। কাঁপা গলায় উত্তর দিল বিশ্ব, “না স্যার।”

“তাহলে আজ এসেছিলেন কেন?” নিপুণ যোশি’র চোখজোড়া বিশ্ব’র মাথার ভেতরটা ফুঁড়ে ফেলতে চাইছিল। এমনিতে তো ব্যাপারটা সহজই মনে হচ্ছে। কিন্তু ড্রেসিং-টেবিলের দেরাজে পাওয়া ডায়েরিটা সব গুলিয়ে দিচ্ছে।

“উনি আসতে বলেছিলেন।” ভয় সরিয়ে শোক ফিরে আসছিল বিশ্ব’র চোখে, “কী একটা জরুরি কথা নাকি বলার ছিল।”

একটা বড়ো শ্বাস ফেললেন নিপুণ। ডায়েরিতে এমন কিছুই আছে বটে। কিন্তু…

বুকের ওপর রঞ্জনের হাত এসে পড়লে চিরকালই শিউরে উঠেছে নেহা।

বাইরের লোকের জন্য নেহা, তবে রঞ্জন ওকে নন্দিন বলেই ডাকত।

ওই শক্ত হাত শিকারী নেকড়ের মতো ঘুরে বেড়াত বুকের পাহাড় আর উপত্যকায়। মুঠোয় পিষে দিত সবকিছু। কিন্তু প্রতিনিয়ত এই রুটিনের পরেও কানের কাছে ফিসফিস করে ‘নন্দিন’ ডাক শুনলে নেহা আমূল মোমবাতির শিখার মতো কেঁপে উঠত। দুরন্ত ইচ্ছের মোম গলে পড়তে থাকত বুকের মধ্যে।

আজও রঞ্জন সেই চেনা ভঙ্গিতে বুকে হাত বোলাচ্ছিল। কানের কাছে মুখ এনে নামটা বলতেই শিউরে উঠেছিল নেহা— কিন্তু ইচ্ছেয় নয়, আদরে নয়। আপাদমস্তক নড়িয়ে দেওয়া এই অনুভূতির নাম আলাদা।

স্বাধীনতা! মুম্বই আসা, প্রীতি’র মতো সোজাসাপটা একটা মেয়ের সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করা, নিজের সীমিত রোজগারেও সপ্তাহের শেষে কোথাও বেড়াতে যাওয়া— এগুলো সব আসলে ওই একটাই অনুভূতিকে বোঝাত। ওটা কিছুতেই ছাড়তে চায়নি নেহা। হয়তো সেজন্যই মনের ‘নো ম্যারেজ, নো কিড, লিভ্-ইন্’ ইচ্ছেটা বলে ফেলেছিল প্রীতিকে।

কখনও ভাবেনি, সেটার সূত্র ধরেই এক সন্ধ্যায় ওর দুনিয়াটা এমন এলোমেলো হয়ে যাবে।

রঞ্জন সিনহা প্রীতি’র দাদার বন্ধু। সে অফিসের কাজে মুম্বই এসেছে শুনে এক সন্ধ্যায় ডিনারে গেছিল প্রীতি। একরকম টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নেহাকেও। রেস্তোরাঁয় নেহা’র উলটো দিকেই বসেছিল রঞ্জন। ছ’ ফুটের কাছাকাছি উচ্চতা, গালে হালকা চাপদাড়ি, ডার্ক-ব্লু রিমের চশমা, ঝকঝকে চোখ— সব মিলিয়ে প্রবল চার্মিং ব্যক্তিত্ব। পরিশীলিত উচ্চারণে, ভরাট গলায় প্রীতি’র সঙ্গে রঞ্জনের খুনসুটি দেখছিল নেহা।

রঞ্জন বলেই দিয়েছিল ওর ট্রিট, ওরা যেন একদম ইতস্তত না করে। সে কথার মান রাখতেই হয়তো প্রীতি পেগের পর পেগ চালান করছিল। কথায়-কথায় ও রঞ্জনকে বলেও দিয়েছিল, নেহা’র ‘নো ম্যারেজ, নো কিড, লিভ্-ইন্’ ইচ্ছের ব্যাপারে। আর তখনই রঞ্জন পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল নেহার দিকে। সে চাহনির সামনে নেহা লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলেছিল। এরকম আগে কখনো হয়নি ওর, অসম্ভব দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছিল সে ভিতরে ভিতরে। বিস্রস্ত দশা সামাল দিতে মুখ ফিরিয়ে নেহা দেখেছিল, প্রীতির অবস্থা সুবিধের নয়। মুখ লাল, খরচোখে রঞ্জনকে দেখছে, অত সুন্দর ঠোঁট দুটো কেমন ক্রূরভাবে বেঁকে গেছে।

“আব্বে কামিনা!” হিসহিসিয়ে উঠেছিল প্রীতি, “তোমরা সব সমান! দু’দিন অন্তর ঘর কা মুর্গি দাল বরাবর, তাই না?”

প্রীতি’র কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। রঞ্জন চুপ করে বসে ছিল অন্যদিকে তাকিয়ে। নেহা হতচকিত হয়ে গেছিল, ভাবছিল একে কী করে শান্ত করিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবে।

একটু পরেই ওয়েটারকে ডেকে বিল মিটিয়ে দিল রঞ্জন। উঠতে গিয়ে প্রীতি’র পা এলোমেলো হচ্ছে বুঝে তাকে জাপটে ধরে নিয়ে চলল বাইরের দিকে। পিছন থেকে রঞ্জনের মেদহীন লম্বা শরীর দেখে নেহা’র তখন মনে হচ্ছিল, প্রীতির সঙ্গে জায়গা পালটাপালটি করলে কেমন লাগবে?

ক্যাব ডেকে, তাতে ওদের তুলে রঞ্জনও সামনে উঠে বসল। নেহা’র আপত্তিতে ও শান্ত গলায় বলেছিল, “এ নিজে হাঁটতে পারছে না। তুমি একা বয়ে তুলতে পারবে তো?”

এর জবাবে নেহা কিছু বলতে পারেনি। শুধু খেয়াল করেছিল, প্রথম থেকেই ওকে ‘তুম’ বলেছে রঞ্জন, ‘আপ’ নয়।

“রঞ্জন সিনহা বলে কাউকে চিনতেন আপনি?”

“না স্যার।” ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়েও গলা থেকে কাঁপুনি সরাতে পারে না বিশ্বজিৎ, “উনি কে?”

মাছি তাড়ানোর মতো করে প্রশ্নটা সরিয়ে পরের প্রশ্নটা করেন নিপুণ, “প্রীতি নামের কেউ আছেন আপনাদের অফিসে?”

“তা আছেন। ও নামটা তো বেশ কমন। তবে আমি তেমন কাউকে…”

“নেহা ভাসিনের সঙ্গে তাঁদের কারও আলাপ ছিল?”

“ছিল তো।” কোশ্চেন কমন পড়ার আনন্দ ফোটে বিশ্ব’র মুখে, “আমাদের বস্ ললিত শ্রীবাস্তবের স্ত্রী’র নাম প্রীতি। তাঁর সঙ্গে আলাপ ছিল নেহা’র।”

ঘাড়ে শেভ না করা গোঁফদাড়ির খোঁচা লাগছে। ঠোঁট দুটো এত চেপে বসেছে গলার পাশে যেন মিশেই যাবে ওর চামড়ায়।

কিন্তু… চাবি ছাড়া রঞ্জন ঘরে ঢুকল কী করে?

যেভাবেই ঢুকুক, খুব ভালো লাগছে নেহা’র। তাছাড়া, কত-কতদিন পর ও রঞ্জনের গলায় আদরের নামটা শুনতে পাচ্ছে। এই নাম শোনার শুরু হয়েছিল সেই মাতাল সন্ধ্যার পরেই।

ঘরে ঢুকে বেহুঁশ প্রীতিকে সযত্নে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল ওরা দু’জন। রঞ্জন ঘরের মধ্যে এক মিনিটও দাঁড়ায়নি। তবে দরজার ওপাশে গিয়ে, নেহার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, অল্প ঝুঁকে বলেছিল, “একটা কথা বলি?”

মোহময় পারফিউমের সুবাস ভেসে আসছিল রঞ্জনের গা থেকে। পরে জেনেছিল ওটা হিউগো রেড, রঞ্জনের অলটাইম ব্র‍্যান্ড। তার সঙ্গে মিশেছিল হালকা তামাকের গন্ধ।

“বি মাই নন্দিন্।” নেহা’র চোখে চোখ রেখে বলেছিল রঞ্জন। নামটার কিচ্ছু তখন বোঝেনি নেহা। কিন্তু সেটা শুনতে ওর ভীষণ ভালো লেগেছিল। সেই পুরুষালি গলায় রঞ্জন বলেছিল, “নিজের ইচ্ছেমতো বাঁচার কথা ক’টা মেয়ে বলতে পারে? এর জন্য গাটস লাগে বস্। লাভড দ্যাট। লাভড ইউ! এনিওয়ে, রাত হচ্ছে, আর থাকা ঠিক হবে না। এই আমার হোটেলের নাম, এই আমার ফোন নাম্বার।”

দুম করে পিছন ফিরে চলে গেছিল রঞ্জন। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল নেহা।

প্রীতি পরদিন জানতে চেয়েছিল, রঞ্জন কিছু বলে গেছে কিনা। দরজার মুখে রঞ্জনের বলা কথাগুলো চেপে গেছিল নেহা। গা ম্যাজম্যাজ করার অজুহাত দিয়ে দুপুরের মুভি আর লাঞ্চ আউটের প্ল্যানও ক্যান্সেল করে দিয়েছিল। প্রীতি বিরক্ত হয়ে ওর কোন কলিগকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে গেছিল। তারপর নেহা ফোনটা করেছিল।

হোটেল খুব দূরে ছিল না। তবুও রঞ্জন এসে ওকে পিক-আপ করেছিল, রাত্রে ডিনারের পর পৌঁছে দিয়ে গেছিল।

পরদিন নেহা জীবনে প্রথমবার অফিস থেকে ডুব মেরেছিল। তারপর মুভি, লাঞ্চ, হোটেলের আয়েসি বিছানায় আগ্রাসী ওলটপালট। প্রথমবারেই পাকা খেলোয়াড়ের হাতে পড়ার বিধ্বংসী মুগ্ধ অভিজ্ঞতা। সেদিনও রাত্রে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায় রঞ্জন।

তার পরদিন অফিসের কাজ মিটিয়ে ভুবনেশ্বর ফিরে গিয়েছিল সে। নেহা জানতও না, আর রঞ্জনের সঙ্গে দেখা হবে কি না। খুব কেঁদেছিল লুকিয়ে-লুকিয়ে। এভাবে কখনও কাঁদেনি ও কারও জন্য।

তবে দেখা হয়েছিল। দেড় দুমাস বাদে বাদে রঞ্জন মুম্বই আসত— কখনও দু’দিনের জন্য, কখনও চারদিনের জন্য। গুচ্ছ-গুচ্ছ উপহার নিয়ে আসত নেহার জন্য। নেহা’র কেমন যেন অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল এই স্বাধীনতা আর ‘যা চাই তাই’ পেয়ে যাওয়ায়। ও মনেপ্রাণে অনুভব করেছিল, এমন জীবনই সে বরাবর চেয়েছে। বাঁধাধরা ঘর গৃহস্থালি তাকে টানে না। রঞ্জনকে সে কথাটা ও বলেছিল একবার। খুব খুশি হয়েছিল রঞ্জন। নন্দিনকে চিনতে ওর নাকি ভুল হয়নি!

রঞ্জন সেই আগের মতই ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, সেই ফিল্টার উইলস আর হিউগো রেড মেশানো তুমুল পুরুষালি গন্ধটা। কিন্তু রঞ্জন তো আসতে পারে না। কিছুতেই পারে না! এ তার মনের ভুল। অথচ নেহা বুঝতে পারছে, তার জামার ভিতরে সেই হাতদুটোই আরো গাঢ় আদরে মেতে উঠছে। ব্যথার তোয়াক্কা না করে যেন সব ছিঁড়ে ফেলতে চায় তারা— একবার ডানদিকে, পরক্ষণেই বাঁদিকে!

নেহা শিউরে ওঠে। পুলকে নয়, আতঙ্কে!

কী করে ফিরে এল রঞ্জন? সেই শক্ত পুরুষালি শরীরটা তো সেই কবেই তার জীবন থেকে ‘নেই’ হয়ে গেছিল।

তবু, ভয় পেতে-পেতেও সে টের পায়, সে নিজেও রঞ্জনকে ভীষণভাবে মিস করছিল।

কিন্তু, এগুলো কী বলছে রঞ্জন? এ তো শুধু সুখের অব্যক্ত ধ্বনি নয়। কোন অন্ধকার থেকে এই কথাগুলো উঠে আসছে?

বাবা’র সঙ্গে নেহা’র মিটমাট হয়ে গেছিল। সময় অনেক ক্ষতস্থান ভরাট করে দেয়— এই কথাটাই আবার বুঝেছিল ও। তবু নেহা বাড়ি ফিরে যাবার তাগিদ বোধ করেনি আর। বাবাও একবারও বলেনি চলে আসতে। সেদিন হঠাৎ এতকাল পরে ফোনে বলল, “নেহা বেটি, আমার বয়স হয়েছে। শরীরও ভালো যাচ্ছে না। তুই একটু বিয়ে-থা করে সেটল করে গেলে শান্তিতে মরতে পারতাম।”

কথাটা তখন হেসে উড়িয়ে দিলেও, কোথাও যেন মনটা খারাপ হল নেহা’র। বড়ো আলোটা জ্বেলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, খুব খুঁটিয়ে দেখল নিজেকে। ডাবল চিন হচ্ছে। কপালে কয়েকটা সূক্ষ্ম দাগ বোঝা যাচ্ছে খেয়াল করলে। চুলের সাদাগুলো চাপা দিতে রঙ করা ধরতে হয়েছে।

বয়স দ্রুত তিরিশের দিকে এগোচ্ছে।

রঞ্জনকে মনখারাপের কথাটা বলতেই হো-হো করে হেসে দামাল আদরে ভাসিয়ে দিল সে। এই প্রথম, নেহা ভেসেও ভাসল না পুরোপুরি। রাতে খেতে বসে আবার প্রসঙ্গটা তুলল নেহা। রঞ্জন প্রথমে অবাক হল। তারপর ভয়ঙ্কর রেগে গেল। শীলিত উচ্চারণে চিবিয়ে চিবিয়ে জিগ্যেস করল, “তোমার যখন বাচ্চা আনতে এত আপত্তি, নিত্যকার রান্নাবান্না ঘর সামলানোয় এত আপত্তি, তখন বিয়ে নামক একটা সোসাল ফার্সের জন্য এত মাথাব্যথা কেন?”

নেহা নিজের একাকিত্বের ভয়টা ভাগ করে নিতে চেয়েছিল। জবাবে রঞ্জন চিবিয়ে-চিবিয়ে বলেছিল, “সম্পত্তির ভাগ চাই বুঝি? বেশ তো। মাসোহারার ব্যবস্থা করে দেব না হয়।”

মাসোহারা শব্দটা থাপ্পড়ের মত আছড়ে পড়েছিল নেহার কানে। আধখাওয়া প্লেট তুলে নিয়ে উঠে গেছিল সে।

রঞ্জনও উঠে পড়েছিল তৎক্ষণাৎ। সেই প্রথম নেহার গায়ে হাত তুলেছিল সে। আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল একটা কুয়োর মধ্যে নেহা’র তলিয়ে যাওয়া।

“হাতের লেখাটা চিনতে পারছেন?” সেলোফনে বন্দি ডায়েরিটা সাবধানে বের করে একটা পাতা বিশ্ব’র চোখের সামনে খুলে ধরেন নিপুণ।

“পারছি।” বিশ্ব নিচু গলায় বলল, “এটা নেহা’র লেখা।”

“এটা এক্সপার্টরা কনফার্ম করবেন। তবে…” মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন নিপুণ, “আমিও একমত যে এই ডায়েরিটা মিস ভাসিনের লেখা। কিন্তু মিস্টার ব্যানার্জি, উনি এই ডায়েরিতে ওঁর নামটা কোথাও লেখেননি কেন, বলতে পারবেন?”

“আমি…” বিশ্ব’র কণ্ঠার কাছটা ফুলে ওঠে। একটা ঢোঁক গিলে ও বলে, “বিশ্বাস করুন স্যার, আমার সঙ্গে নেহা’র আলাপ হয়েছিল মাত্র কিছুদিন হল। ও আমাকে খুব… পছন্দ করত। আজকেই ও প্রথমবার আমাকে ডেকেছিল। এই ডায়েরিটা আমি আগে কখনও দেখিনি।”

ঠান্ডা চোখে বিশ্ব’র দিকে তাকিয়ে রইলেন নিপুণ। ছোকরার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক হয়ে গেছে। বিপিও-তে চাকরি পেয়ে এই কমপ্লেক্সে নতুন টেন্যান্ট। কবিতা লেখে, ভালো ফটো তোলে। সেই করতে গিয়েই নেহা ভাসিনের সঙ্গে আলাপ। এই অবধি সব ঠিক আছে।

কিন্তু তাহলে নন্দিনী কে?

নন্দিন্ উধাও হয়ে গেছিল তারপর থেকেই।

রঞ্জন ফিরে এসেছিল পরের মাসে। অনেক উপহার, অনেক আদর নিয়ে এসেছিল ওর জন্য। নেহাও ভেবেছিল, হয়তো ওর তরফেও চাওয়াটা বড়ো বেশি ছিল। কিন্তু রঞ্জনের আদরটা বড্ড হিংস্র হয়ে উঠছিল তারপর থেকেই। নির্মম, জান্তব। ওর অধিকারবোধের তাড়নায় নেহা কষ্ট পাচ্ছে দেখেও ও বোঝেনি। ওকে নিজের মতো থাকতেও দেয়নি। দেয়নি স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার।

নন্দিন্ নয়, নেহা বলেই ওকে ডাকতে শুরু করেছিল রঞ্জন।

একটা অদ্ভুত নাটকের কথা বারবার বলত রঞ্জন। তাতে একটা দমবন্ধ খাঁচার মতো জটিল জালের পেছনে, অন্ধকার জায়গায় নিজেকে আটকে থাকত রাজা।

সেই নাটকেই ছিল নন্দিনী। আর ছিল তার ভালোবাসার রঞ্জন।

বন্য, পাশবিক মন্থনের পর নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে থাকত নেহা। ও ভাবত, অধিকার আর অহংকারের জালের আড়াল থেকে যে রাজা ওকে পিষে দিচ্ছে প্রতিদিন, তার হাত থেকে কি ওর মুক্তি নেই?

“মুক্তি, নন্দিন্!” শরীরে আগুন আর গলায় মধু ঢেলে সে ওকে বলছিল, “মুক্তি পেতে চাও না তুমি?”

চাইত। নেহা খুব-খুব করে চাইত মুক্তি পেতে। সেজন্যই তো এতকাল বাদে সেই প্রীতিকেই সব খুলে বলেছিল ও।

সেই প্রথম দিনের মতো প্রীতির মুখ লাল হয়ে গেছিল। ঠোঁট বেঁকে গেছিল ক্রূর হাসিতে। সেইসঙ্গে চোখে উপচে উঠেছিল কৌতুক।

“তোকে আবার বিয়ে করবে?” হেসে উঠেছিল প্রীতি, “ওর তো বউ-ছেলে, ঘর-সংসার সব আছে।”

নেহা প্রথমে পাথর হয়ে গেছিল। তারপর আছাড়িপিছাড়ি কেঁদেছিল। কান্নার দমক কমলে রাগে, অপমানে পাগল হয়ে গেছিল। ছিন্নভিন্ন করে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল ওই জাল লোকটাকে, আর ওর গড়া জালকে!

ঝড় থেমে গেছিল তৎক্ষণাৎ। ফেলে আসা ক্লাস, আর তাতে নেহাত অনিচ্ছেতে পড়া বইটা নেহা’র চোখের সামনে ফিরে এসেছিল আচমকা।

স্থির, সবুজ পাতার ভিড়ে মাথা তোলা একটা ফুল। অযত্নলালিত বাগানেও রঙ জাগানো একটা গাছ। ছবিটার নীচে টুকরো-টুকরো ছড়িয়ে থাকা কিছু কথা। ব্যস, এটুকুই।

জালের আড়াল থেকে মুক্তির সন্ধান পেয়েছিল নেহা।

“আপনার সঙ্গে নেহা ভাসিনের সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিল, মিস্টার ব্যানার্জি?” খসখসে গলায় বললেন নিপুণ, “কিছু লুকোবেন না। লুকোলে আমরা সব জানতে পারব।”

“উ… উনি আমাকে পছন্দই করতেন, স্যার।” বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি, ওরফে বিশ্ব’র মুখচোখ দেখে নিপুণের একটু দয়া হল। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে এইরকম চক্করে ফাঁসবে তা বোধহয় ভাবতেও পারেনি। জলের বোতলটা এগিয়ে দিলেন নিপুণ। কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে বেশ কিছুটা জল খেল বিশ্ব। তারপর আবার বলতে শুরু করল।

“নেহা ক’দিন ধরেই একাকিত্বে ভুগছিলেন। এখানে ওঠানামার সূত্রেই আমার সঙ্গে ওঁর দেখাসাক্ষাৎ হত। আমার সঙ্গে কথা বলতে ওঁর ভালো লাগে, আমার ব্লগ খুব ইন্টারেস্টিং— এগুলোই বলতেন। আপনি অন্যদের জিজ্ঞেস করুন। এমনকি ফুটেজ…”

নিপুণ হাত তুলে বিশ্বকে থামিয়ে দিলেন। তারপর থেমে-থেমে বললেন, “আপনি ওঁকে কী নামে ডাকতেন?”

“প্রথমে মিস ভাসিন বলতাম।” ঢোঁক গিলল বিশ্ব, “একবার নেহাদিদি বলায় ভয়ংকর রেগে গেছিলেন। নেহা-ই বলতাম। তবে গত কয়েকদিনে…”

“কী?”

“উনি বলছিলেন, ওঁকে নন্দিনী বলে ডাকতে।”

গাছটাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়নি জিনিসগুলো তার থেকে আদায় করে নিতেও। প্রীতির মাধ্যমে ওর বরের ক্লাবে নানা কোম্পানির হরেক কাজের লোকের সঙ্গে পরিচিতি তো ছিলই। তাদেরই একটা কাজে লেগে গেছিল।

অনেকদিন পর রঞ্জনের আসার অপেক্ষায় ছটফট করছিল ও!

রঞ্জন মুম্বই এসেছিল এর ক’দিন পরেই। এসেই ওকে বলেছিল কাজকর্ম ছেড়ে হোটেলে চলে আসতে।

এ-ঘটনা আগেও ঘটেছিল। কাজের ক্ষতি হচ্ছে জেনে, ক্যারিয়ারে দাগ লাগছে জেনে খুব খারাপ লাগত নেহা’র। সেটা বলতে গিয়ে ওকে মার খেতে হয়েছিল। শিকার হতে হয়েছিল অমানুষিক সঙ্গমের। তবে সেই বিশেষ দিনে একটা লাল শিফন পরেছিল নেহা— ঠিক যেমনটা রঞ্জন চাইত। তারপর হোটেলের ঘরে গেছিল।

তার আগেই অনেক কষ্টে ও জোগাড় করেছিল রঞ্জনের ফেভারিট বিটার ‘পেশো’জ’— তিতকুটে অথচ ভেতরে-ভেতরে শরীরকে গলিয়ে দেওয়া সুরা। মিন্টের হালকা গন্ধ আর জংলি সুবাসের মধ্যে ঢাকা পড়েছিল পাতার নির্যাস।

ওর শরীরটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছিল রঞ্জন। কিন্তু কষ্ট হয়নি নেহার। রঞ্জনের কপাল-জুড়ে আসা বিন্দু-বিন্দু ঘামের দিকে তাকিয়ে ও বুঝতে পেরেছিল, ডালপালা মেলছে মুক্তির গাছটা।

“মুক্তি পেয়েছিলে নন্দিন্?” নেহা’র সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করে ওঠে পুরুষালি গলা শুনে আর কানের লতিতে আলতো কামড়ের অনুভূতিতে, “তাহলে কেন আবার ধরা পড়তে চাইছ?”

এই বাচ্চা ছেলেটাও কি ওকে বেঁধে ফেলবে? নাকি ছেলেটা ওকে বুঝবেই না?

বয়সের দুস্তর পারাবার কি একটা জটিল জাল হয়ে আবার ওকে বন্দি করে ফেলবে?

“ওকেও মুক্তি দাও বরং।” অন্ধকারের মধ্য থেকে গলাটা ভেসে আসে। কিন্তু… রঞ্জন তো ওর শরীর লেপটে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে আওয়াজটা সামনের ওই আয়না থেকে আসছে কেন?

কথা হয়েছিল, পরদিন ওর ফ্ল্যাটে আসবে রঞ্জন।

“এই খুবসুরত চিজটি থাকবে তো?” লুব্ধ চোখে বরফের মধ্যে রাখা বোতলটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল রঞ্জন। হেসে সায় দিয়েছিল নেহা। ও জানত, রঞ্জন আসবেই। ট্যাক্সি নিয়ে নয়, ভাড়া করা গাড়ি নিয়েই আসবে। শরীর খারাপ লাগলেও আসবে। না এলে পৌরুষের জোর দেখাবে কী করে?

পরদিন সন্ধ্যায় ঘরের সবটা ও সাজিয়েছিল রঞ্জনের পছন্দ অনুযায়ী। সযত্নে বানিয়েছিল ক’টা ডিশ। ক্যান্ডল-লাইট ডিনারের আয়োজন করেছিল। রোমান্স? নাহ্, আসলে প্রায়ান্ধকার ঘরেও মোমবাতির আলোয় নেহা দেখতে চাইছিল, কীভাবে রঞ্জনের মধ্যে ডালপালা ছড়িয়ে দেয় গাছটা।

ডিনারে পুদিনার সঙ্গে মিশে গেছিল আরও কিছুটা গুঁড়ো। পেশো’জ-এও মিশে ছিল পাতা আর ডাল থেঁতলে পাওয়া তরলের শুদ্ধতম চেহারাটা। বিছানায় দাপট দেখিয়ে রঞ্জন যখন স্টিয়ারিঙের পেছনে বসল তখন ওর হাত কাঁপছে। নেহা জানত, মুক্তি আর খুব বেশি দূরে নেই। সত্যিই সে তখন উঠে আসছিল পরের বাঁকের ঢালু সার্ভিস রোড দিয়ে।

ঢাল বেয়ে উঠে আসা ভারী ট্রাকগুলো থামার অবস্থায় থাকে না। রঞ্জনের হাতে গাড়িটা নড়বড় করতে-করতে ওইটুকু যেতে পেরেছিল শুধু। তারপর বিশাল আওয়াজ, আগুন, হইচই।

পেশো’জ-এর ফাঁকা বোতলটা লুকিয়ে ফেলেছিল নেহা। মুছে ফেলতে পেরেছিল রঞ্জনের সঙ্গে ওর যোগাযোগের চিহ্নগুলো। বাকিটুকু চুপ করিয়ে দিয়েছিল প্রীতি’র কনট্যাক্টস।

“আজ উনি কেন আপনাকে ডেকেছিলেন বলে মনে হয়?”

“লাঞ্চ করাবেন, আর কিছু একটা আলোচনা করবেন।” শুকনো গলায় বিশ্ব উত্তর দিল, “এর বেশি কিছু বলেননি।”

বিশ্বকে মাপছিলেন নিপুণ। ছোকরা নির্ঘাত ভেবেছিল, লাঞ্চের পর কিছু উপরিও জুটবে। মার্তণ্ড থিয়েটার্সের দাশগুপ্ত ওই ব্যাপারটাকে বোঝানোর জন্য কী যেন বলত? হ্যাঁ, মনে পড়েছে— ‘বেণীর সঙ্গে মাথা!’

দাশগুপ্ত’র কথা মনে হতে নিপুণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এই ছোকরাকে নিয়ে বেশি টানাহ্যাঁচড়া করে লাভ নেই। গলাটা নরম রেখেই নিপুণ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এসে কী দেখেছিলেন?”

“কলিং বেল বাজানোর পর আমি ভেতরে একটা ঝটাপটির মতো শব্দ পেয়েছিলাম।” শীত করলে যেমন হয়, সেভাবেই কেঁপে উঠল বিশ্ব, “তারপর কাচের কিছু একটা জিনিস ভাঙল যেন। আমি বারবার কলিং বেল বাজাচ্ছিলাম তার আগে থেকেই। ভাবছিলাম, উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নীচের সিকিউরিটিকে খবর দিলাম তারপর। ওরা এসে দরজা ভাঙল। ভেতরে…!”

বেসিনের দিকে ছুটল বিশ্ব।

“কী করবে নন্দিন্?”

ভারী গলাটা নেহার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল। বিশ্ব বলে ছেলেটাকে লাঞ্চের জন্য ডেকেছিল ও। তারপর আর কী বলত ও?

আর কী করত ও?

সেই নাটকটা ও পড়েছিল তারপর। নেহা সত্যিই বোঝার চেষ্টা করেছিল, কোন অদ্ভুত অসুখে ওর রঞ্জন ভেতরে-ভেতরে পচে গিয়ে হয়ে উঠেছিল অন্ধকারের রাজা। উত্তর পায়নি নেহা, তবে খোঁজাটাও বন্ধ রাখেনি।

তারপর হাতের এক্কেবারে কাছে ও ছেলেটাকে দেখেছিল। বিশ্বজিৎ, বিশ্ব… বিশু পাগল!

একটা ভারি অদ্ভুত গান ছিল ওই নাটকে? কী যেন… “চোখের জলে লাগল…” মনে পড়ছে না কেন?

বিশু পাগলও কি ওকে ঠেলে সরিয়ে দেবে?

“দরজা খুলে দাও নন্দিন।” ওর বুক মুচড়ে দিচ্ছে পুরুষালি হাতদুটো, “কলিং বেল বাজল যে! এসেছে তোমার পাগল। ওকে মুক্তি দেবে না?”

ব্যথা। বড্ড ব্যথা করছে ওর বুকে। সে কি শুধুই রঞ্জনের হাতের চাপে? না এই ব্যথা আসছে আরও গভীর থেকে?

বিশ্বও যদি ওকে একা করে চলে যায়, তাহলে সেটা সহ্য করতে পারবে না নেহা। সেজন্যই কি সেই পাতাগুলো পিষে বানানো টলটলে সবুজ তরলটুকুর অবশিষ্টটুকু শিশিতে ভরে ও রেখে দিয়েছিল হাতের নাগালেই?

এভাবেই কি কাটবে ওর দিনগুলো? নন্দিনী কি মুক্তি পাবে না?

“ও চাঁদ,” নেহা’র দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, “চোখের জলে লাগল জোয়ার!”

ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল নেহা। ওর কানে হিসহিস করছিল রঞ্জন। ওকে টেনে সরিয়ে আনতে চাইছিল দরজার দিকে, কিন্তু পারছিল না।

সরু ফাইলটা তুলে নিয়ে নিজের গলার সোজাসুজি আনল নেহা। আয়নার দিকে তাকিয়ে ও নিজেকে দেখতে পেল না। তবে রঞ্জন সেখানে ছিল! কলিং বেলের ঘনঘন আওয়াজ ছাপিয়ে রঞ্জনের ডাক শুনতে পাচ্ছিল নেহা।

“আরে এ বোরকর!” চায়ের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে হাঁক পাড়লেন নিপুণ, “ডক্টর মাথরে ওই শিশিটার ব্যাপারে কিছু বলেছেন?”

“জি স্যার।” বোরকর একটা কাগজের টুকরো হাতে উদয় হল, “বললেন ওর মধ্যে একটা গাছের পাতার এক্সট্র্যাক্ট ভরা আছে। গাছটা আনকমন কিছু নয়, তবে ওই তরলটা মারাত্মক বিষাক্ত। আমার তো শুনে অবধি ভয় হয়ে গেছে স্যার! এইরকম ডেঞ্জারাস জিনিস আমাদের আশেপাশেই হয় নাকি?”

“বাজে না বকে কাজের কথা বলো।” বিরক্ত মুখে বললেন নিপুণ, “কী গাছ? আর তার চেয়েও বড়ো কথা, ওইরকম বিষ নিয়ে মহিলা কী করছিলেন?”

“মহিলা ভালোমতোই সুইসাইডাল হয়ে পড়েছিলেন স্যার।” বিজ্ঞের মতো বলল বোরকার, “সেজন্যই হাতের কাছে হোমমেড বিষ রেখেছিলেন। হয়তো ভাবেননি, ওইভাবে শেষ অবধি আত্মহত্যা করতে পারবেন।”

“গাছটার নাম?” দাঁতে দাঁত ঘষে নিজেকে শান্ত রাখলেন নিপুণ।

“রেড ওলিয়্যান্ডার্স।”

No comments