টেলিফোন – হেমেন্দ্রকুমার রায়
যে গল্পটি বলতে বসেছি তা গল্প বটে, কিন্তু একেবারে সত্য ঘটনা। কবি শেকসপিয়র বলেছেন, সত্য হচ্ছে, উপন্যাসের চেয়ে আশ্চর্য। অন্তত এ-ঘটনাটি সত্য হলেও এমন আশ্চর্য যে, বিখ্যাত বিলাতি লেখক কন্যান ডইল সাহেব একে অবলম্বন করেই শার্লক হোমসের একটি গল্প লিখে ফেলেছেন। আমি কিন্তু শার্লক হোমসের গল্প তোমাদের শোনাব না, আমি যা বলব তা হচ্ছে, অস্ট্রিয়া দেশের সত্যিকার পুলিশের কাহিনি, এর প্রত্যেকটি কথা পুলিশের নিজস্ব দপ্তরে লেখা আছে।
অস্ট্রিয়ার পুলিশ, চোর-ডাকাত-হত্যাকারী ধরবার জন্যে অনেক সময়ে এক নতুন উপায় অবলম্বন করে। ঘটনাস্থলে যে সব জিনিস পাওয়া যায়, পুলিশ সেগুলো দেয় রাসায়নিক পণ্ডিতদের হাতে। তাদের পরীক্ষার ফলে অপরাধীরা প্রায়ই বিচিত্র উপায়ে ধরা পড়ে। সে পরীক্ষার পদ্ধতি কীরকম, নীচের ঘটনা থেকে কতকটা আন্দাজ করা যেতে পারে।
কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে আর-একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, রসায়নশাস্ত্রের দুজন অধ্যাপক ঘটনাস্থল থেকে তিনশো ষাট মাইল দূরে অবস্থান করেও এবং ঘটনাস্থলে প্রাপ্ত কোন জিনিস চোখে না দেখেও আসল অপরাধী ধরে ফেলে পুলিশের চক্ষুস্থির করে দিয়েছিলেন! অপরাধের ইতিহাসে, এমনকী, কাল্পনিক গোয়েন্দা কাহিনিতেও এরকম ঘটনার কথা কেউ কখনও শোনেনি।
ভিয়েনা হচ্ছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী। ভিয়েনা শহরের পা ধুয়ে বয়ে যায় ডানিউব নদী। তার উপরে আছে কয়েকটি সাঁকো। একদিন খুব ভোরবেলায় সাঁকোর পিল্লাদার-রেলিংয়ের তলায় পাওয়া গেল একটি মৃতদেহ!
.
দেখলেই বোঝা যায়, সন্ত্রান্ত ব্যক্তির দেহ। জমকালো দামি পোশাক-পরা। বয়সে লোকটি প্রাচীন। দেহের খানিক তফাতে পাওয়া গেল রিভলভার, খুব সম্ভব, হত্যাকারী তাড়াতাড়ি পালাবার সময়ে ফেলে গিয়েছে। দেহে গুলির দাগ আছে। মৃতের পকেট একেবারে খালি।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, মৃত ব্যক্তির নাম হ্যাঁন্স ভোগেল, লোহার ব্যবসায়ে কোটিপতি। নিমন্ত্রণ খেয়ে শেষ-রাতে ফিরছিলেন, পথেই এই কাণ্ড। আরও প্রকাশ পেলে, তার পকেটে অনেক টাকা ছিল।
পুলিশ স্থির করলে, অর্থলোভে কেউ ভোগেলকে হত্যা করেছে। কিন্তু ওই পর্যন্ত। সে যে কে, তা জানা গেল না; কারণ, হত্যাকারী কোনও সূত্র রেখে যায়নি।
পুলিশ এ মামলা নিয়ে হয়তো বেশি মাথা ঘামাত না, কিন্তু ঘামাতে বাধ্য হল। এক জীবনবিমা কোম্পানির অধ্যক্ষ এসে পুলিশের বড়সাহেবকে জানালে, ভোগেল আমাদের কোম্পানিতে তিন লক্ষ টাকার জীবনবিমা করেছেন। দুষ্ট লোকেরা আমাদের বড় বড় মক্কেলকে যদি এইভাবে খুন করে পার পায়, তাহলে বেশি ক্ষতি হয় আমাদেরই। অতএব খুনিকে ধরা চাই, আর যে ধরতে পারবে তাকে আমরা তিন হাজার টাকা পুরস্কার দেব।
পুরস্কার বড় সামান্য নয়। হত্যাকারীকে ধরবার জন্যে পুলিশের বড়সাহেব উঠে পড়ে লাগলেন।
২
বড়সাহেব নিজে হালে পানি না পেয়ে, বিখ্যাত রাসায়নিক প্রফেসর এক্স-এর খোঁজে বেরুলেন।
কিন্তু প্রফেসর এক্স তখন ভিয়েনা শহর থেকে তিনশো ষাট মাইল দূরে টাইরেল। গেছেন বায়ু পরিবর্তনে।
বড়সাহেব তাকে ফোন করলেন।
প্রফেসর আগাগোড়া সব শুনে বললেন, ডাক্তারের মানা আছে, আমার পক্ষে এখন ভিয়েনায় ফেরা অসম্ভব!
বড়সাহেব এত সহজে ছোড়নেওয়ালা নন। বললেন, আচ্ছা প্রফেসর, ফোনের সাহায্যেই তাহলে কাজ চালানো যাক। আপনি যা বলবেন, আমি তা পালন করব। বলুন আমায় কি করতে হবে? যদি কোনও দরকারি তথ্য আবিষ্কার করতে পারেন, তাহলে তিন হাজার টাকা লাভের সম্ভাবনা!
প্রফেসর বললেন, বহুত আচ্ছা, ইজিচেয়ারে এই আমি খুব আরাম করে গদিয়ান হয়ে বসলুম। আমার সামনে আছে তামাকের পাইপ, খবরের কাগজ, পেনসিল আর টেলিফোন। বেশ, তাহলে কাজ শুরু করা যাক! আচ্ছা, একজন কেমিস্টকে ডাকুন, আমার এইসব কেমিকেল দরকার। তিনি কেমিকেলের ফর্দ দিলেন।
ভিয়েনার পুলিশের অফিসে কেমিস্টকে আনবার জন্যে খবর পাঠানো হল।
টাইরেল থেকে ফোনে প্রফেসর বললেন, বড়সাহেব, ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে যে রিভলভারটা পেয়েছেন, তার নলচেটা (barrel) খুলে ফেলুন। নলচের দুটো মুখই ছিপি এঁটে এমনভাবে বন্ধ করে দিন, ভিতরে যাতে ধুলো-হাওয়া ঢুকতে না পারে।
বড়সাহেব খানিক পরে জবাব দিলেন, প্রফেসর, আপনার কথামতো কাজ করা হয়েছে। কেমিস্টও এসেছেন।
টেলিফোনে কেমিস্টকে ডেকে প্রফেসর বললেন, আমি যা বলি তাই করুন। রিভলভারের নলচের ছিপি দুটো খুলে ফেলুন। হয়েছে? আচ্ছা, খানিকটা distilled জল নলচের ভিতরে পুরে বেশ করে নাড়াচাড়া করুন। হয়েছে? আচ্ছা, এইবার নলচের জলটুকু filter করে নিন। আচ্ছা এইবারে নলচের জলে Sulphuric acid, alkaline sulphides আর Salts of iron-এর খোঁজ করুন। পরীক্ষার ফল কী হল? নলচের ভিতর থেকে মর্চে, কী green crystals of ferrous sulphate পাওয়া গেল?
না।
যে জলটা বেরুল তার রং কি হালকা হলদে নয়?
না মশাই!
সে কি, এ তো বড় অদ্ভুত কথা! আচ্ছা, ও-জলে কি Sulphuretted hydrogen এর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে?
না।
তাই তো, আমি যে কিছু বুঝতে পারছি না! বেশ, জলের সঙ্গে salts of lead মিশিয়ে দিন তো! কী হল? কালো তলানি দেখতে পাচ্ছেন?
উঁহু!
কী! বিশেষজ্ঞ প্রফেসরের কাছ থেকে খানিকক্ষণ কোনও জবাবই এল না। তারপর তার গলা আবার পাওয়া গেল? শুনুন! এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে নিশ্চয় কোনও গভীর রহস্য আছে! নলচের জলের ভিতরে Sulphuric acid পেলে প্রমাণিত হত যে, ওই রিভলভার চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে ছোঁড়া হয়েছে। কিন্তু তা যখন পাওয়া যায়নি তখন বুঝতে হবে যে, রিভলভারটা ছোঁড়া হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টার আগেই। কিন্তু তা হতে পারে না, কারণ তাহলে অমন প্রকাশ্য সাঁকোর উপরে মৃতদেহটা ঘটনার আগের দিন সকালেই পাওয়া যেত! আচ্ছা, জলে বোধহয় oxide of iron আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে!
বেশ। পুলিশের বড়সাহেবকে ফোন ধরতে বলুন।
বড়সাহেব ফোন ধরে বললেন, প্রফেসর, এসব কী শুনছি? ও রিভলভারটা পাওয়া গেছে লাশের ঠিক পাশেই, আর তা থেকে যে একটা গুলি ছোঁড়া হয়েছে, সে প্রমাণও রয়েছে!
–হতে পারে। কিন্তু ও রিভলভারটা মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর জন্যে দায়ী নয়। কারণ, ওটা ছোঁড়া হয়েছে ঘটনার দেড়দিন থেকে পাঁচদিন আগে!
তাহলে আমাদের ঠকাবার জন্যেই হত্যাকারী ওটা ওখানে ফেলে গেছে।
আচ্ছা, আরেকটু পরখ করা যাক। আচ্ছা মৃতব্যক্তির দেহের ভিতর থেকে গুলি পাওয়া গেছে?
হ্যাঁ, সেটা আমার টেবিলের উপরেই রয়েছে।
গুলিটা পরীক্ষা করেছেন?
এখনও করিনি।
বেশ, এখন পরীক্ষা করে দেখুন দেখি, গুলিটার মাপ কত?
খানিক পরেই বড়সাহেব অভিভূত কণ্ঠে বললেন, প্রফেসর, প্রফেসর! আপনি যা বলেছেন তাই! ও গুলিটা এ-রিভলভারের ব্যাসের চেয়ে বড়! ওটা অন্য কোনও রিভলভারের গুলি!
বড়সাহেব প্রায় হতভম্ব! চোর-ডাকাত-খুনে ধরা তার ব্যবসায়, ঘটনাস্থল তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, সমস্ত প্রমাণ তারই হাতে রয়েছে এবং শত শত গোয়েন্দা তাকে সাহায্য করছে, অথচ একজন প্রফেসর সাড়ে তিনশো মাইল দূরে বসে, কোনও কিছু চোখে না দেখে এবং হাতে-নাতে পরীক্ষা না করে অনায়াসেই রহস্যটা ধরে ফেললেন! তার আত্মসম্মানে বোধহয় অত্যন্ত আঘাত লাগল।
প্রফেসর এক্স বললেন, বড়সাহেব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্বের সহকারী প্রফেসর ওয়াই সম্প্রতি আমার এখানে আছেন। এইবারে আপনি ফোনে তার সঙ্গে কথা বলুন। হ্যাঁ, আর-এক জিজ্ঞাসা। মৃত ব্যক্তির জামাটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে আছে? দেখুন তো, জামায় যেখানে গুলি ঢুকেছে, সেখানে পোড়া বারুদের দাগ আছে কিনা?
আছে।
হুঁ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, মৃতের দেহের খুব কাছ থেকেই গুলি ছোঁড়া হয়েছে। আচ্ছা, প্রফেসর ওয়াই কথা বলছেন।
প্রফেসর ওয়াই ফোন ধরে বললেন, নমস্কার বড়সাহেব। ভোগেলের মৃতদেহ থেকে আপনি কী কী জিনিস পেয়েছেন, আর কী কী হারিয়েছে?
প্রাপ্ত জিনিসের ফর্দ দিয়ে বড়সাহেব বললেন, কিন্তু, ভোগেলের পকেটে তিনখানা গভর্নমেন্টের প্রমিসরি নোট ছিল তা পাওয়া যাচ্ছে না!
বড়সাহেব, আসল ব্যাপার আমরা কতকটা আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু সেটা এখন আপনাকে বলতে পারব না। ওই প্রমিসরি নোটগুলোর নম্বর আপনার কাছে আছে তো?
আছে।
সরকারি ব্যাঙ্কের নামে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিন, যে ব্যক্তি ওই নোটগুলো ফেরত দেবে, সে ওদের বর্তমান দামের চেয়ে বেশি মূল্য পাবে!
বড়সাহেব বললেন, প্রফেসর, আপনি কি খুনিকে এতই বোকা ভাবেন যে, সে এই বিজ্ঞাপনের উত্তরে ধরা দিয়ে আত্মহত্যা করবে?
একবার বিজ্ঞাপন দিয়েই দেখুন না! আমাদের বিশ্বাস, অপরাধী নিজে না এসে, অর্থলোভে অন্য-কোনও লোককে ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেবে।
৩
পরদিনেই প্রফেসরদের ঘরে পুলিশের বড়সাহেব ফোনের ঘণ্টা বাজিয়ে বললেন, আশ্চর্য প্রফেসর, আশ্চর্য ব্যাপার! আপনারা যা বলেছিলেন ঠিক তাই হয়েছে। একজন লোক সেই নোটগুলো নিয়ে সত্যি-সত্যিই ব্যাঙ্কে এসেছিল। তাকে যে পাঠিয়েছিল, আমরা সে-ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তার করেছি।
সে কী বলে?
সে ভয়ে দিশেহারা হয়ে মহা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। বলে, ভোগেল নিমন্ত্রণ খেয়ে মাতাল হয়ে ফেরবার পথে এক জায়গায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেইসময়ে সে তার পকেট কেটে, নোট নিয়ে পালিয়ে এসেছে।
আপনার কী মনে হয়?
প্রফেসর, আমার বিশ্বাস সে খুন করেনি। যারা মানুষ খুন করে তাদের চেহারা, ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা অন্যরকম হয়। আপাতত তাকে আমি গারদে পুরে রেখেছি।
বেশ করেছেন। কারণ, সে যে ভোগেলের পকেট কেটেছে, তাতে তো আর সন্দেহ নেই! বড়সাহেব, এক কাজ করতে পারবেন?
কী কাজ?
সাঁকোর উপরে যেখানে ভোগেলের লাশ পাওয়া গেছে একবার সেইখানে যান। সাঁকোর ধারে যে লোহার রেলিং পাবেন, তার নীচে মনে রাখবেন ভিতরদিকে লোহার গায়ে কোনও চটাওঠা দাগ আছে কিনা দেখে আসুন।
প্রফেসরের অদ্ভুত অনুরোধ শুনে পুলিশসাহেব রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন। রেলিংয়ের গায়ে দাগই-বা থাকবে কেন, আর থাকলেও তার সঙ্গে এই খুনের সম্পর্ক কি?
খানিকক্ষণ পরে টেলিফোনে আবার পুলিশসাহেবের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। হ্যালো প্রফেসর! আমি দেখতে গিয়েছিলুম! হ্যাঁ, নীচের রেলিংয়ের ভিতরদিকের রং এক জায়গায় চটে গেছে বটে! নতুন দাগ! যেন সেখানে কোনও একটা ভারী জিনিস গিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেটা আপনি জানলেন কী করে? কেউ কি আপনাকে বলেছে?
সশব্দে হাস্য করে খুশি গলায় প্রফেসর বললেন, না! আমরা দুই প্রফেসর মাথা খাঁটিয়ে একটা সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছি। আমরা যে গল্পটি তৈরি করেছি সেটা সত্য কি না, আপনারা খোঁজ নিলেই বুঝতে পারবেন। এই হচ্ছে আমাদের গল্পঃ
৪
ভোগেলের ব্যবসায়ে আজকাল খুব লোকসান হচ্ছিল, আর দুদিন পরেই হয়তো তাকে দেউলে হতে হত এবং তার পরিবারবর্গ পথে বসত।
চোখের সামনে স্ত্রী-পুত্রকন্যার দারিদ্রের ছবি দেখতে-দেখতে ভোগেল প্রায় পাগলের মতন হয়ে উঠল। দিন-রাত ভাবতে লাগল, এই দুর্ভাগ্যের দায় থেকে কি উপায়ে সে পরিবারবর্গকে উদ্ধার করবে?
প্রথমে সে তিন লক্ষ টাকায় নিজের জীবনবিমা করলে। কিন্তু জীবনবিমার শর্তে লেখা রইল, সে আত্মহত্যা করলে জীবনবিমা কোম্পানি তার পরিবারবর্গকে টাকা দিতে বাধ্য থাকবে না। এ শর্ত না থাকলে ভোগেলের খুবই সুবিধা হত। কারণ সে স্থির করেছিল, এই উপায়েই পরিবারবর্গকে রক্ষা করবে।
প্রথমে সে একটি রিভলভারে ছয়টি গুলি পুরে একটি গুলি ছুড়লে। সেই রিভলভারের সঙ্গে আর-একটা গুলিভরা রিভলভার পকেটে পুরে ভোগেল নিমন্ত্রণ বাড়িতে গেল।
অনেক রাতে নিমন্ত্রণ খেয়ে সে পথে বেরুল। দেখলে একটা চোরের মতন লোক তার পিছু নিয়েছে। তখন তার মাথায় আর এক বুদ্ধি জুটল। সে মাতলামির অভিনয় করতে করতে এক জায়গায় বসে পড়ে ঘুমের ভান করলে! চোর তার পকেট কাটলে, কিন্তু সজ্ঞানেও সে বাধা দিলে না!
তারপর ভোগেল উঠে সাঁকোর উপরে গেল। প্রথম রিভলভারটা বার করে একটু তফাতে ফেলে দিলে! লোকে ভাববে, তাকে খুন করে পালাবার সময়ে খুনি ওই রিভলভারটা ফেলে গেছে। রিভলভারটা তার কাছে থাকলে পাছে কেউ ভাবে যে, ওর দ্বারা সে-ই আত্মহত্যা করেছে, তাই সেটাকে ফেলে দিলে খানিক তফাতে। দ্বিতীয় রিভলভারটা বার করে একগাছা শক্ত দড়ির একপ্রান্তে বেঁধে ফেললে। এবং দড়ির অন্য প্রান্তে বাঁধলে একটা খুব ভারী জিনিস– খুব সম্ভব মস্ত একখানা পাথর। তারপর পাথরখানা রেলিং গলিয়ে সাঁকোর বাইরে ঝুলিয়ে দিলে। তারপর নিজের বুকে রিভলভার রেখে গুলি ছুড়লে!
হতভাগ্য ভোগেলের তখনি মৃত্যু হল। এবং সঙ্গে সঙ্গে দড়িবাঁধা রিভলভারটা ছিনিয়ে নিয়ে সেই মস্ত ভারী পাথরখানা ডানিউব নদীর ভিতরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু রেলিংয়ের ভিতর দিয়ে গলাবার সময়ে ভারী পাথরের টানে রিভলভারটা খুব জোরে রেলিংয়ের উপরে গিয়ে পড়ল–লোহার গায়ে তাই চটা-ওঠা দাগ হয়ে গেল।
বড়সাহেব, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই নাটকের দুরাত্মা ওই পকেটমার বেচারা নয়, ভোগেল নিজেই! ডানিউব নদীতে ডুবুরি নামিয়ে খোঁজ করলেই দড়ির দুই প্রান্তে বাঁধা সেই রিভলভার ও পাথরখানা খুঁজে পাওয়া যাবে। ভোগেল ভেবেছিল, এত চালাকির পরেও তার মৃত্যুকে কেউ আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করতে পারবে না, জীবনবিমা কোম্পানি তার পরিবারবর্গকে তিনলক্ষ টাকা দিতে বাধ্য হবে এবং নম্বরি নোট ভাঙাতে গিয়ে তাকে হত্যা করবার অপরাধে ধরা পড়বে ওই পকেটকাটা-ই!
কিন্তু নিজের স্ত্রী-পুত্রকন্যার সুখের জন্যে সে আর-এক অভাগাকে ফাঁসিকাঠে তুলে দিতে চেয়েছিল, আপন প্রাণ বিসর্জন দিয়েও, তাই সে ভগবানের দয়া পেলে না!
৫
প্রফেসরদের অনুমান সব দিক দিয়েই সত্যে পরিণত হল।
ডানিউব নদীর গর্ভ থেকে দড়িবাঁধা পাথর ও রিভলভার দুই-ই পাওয়া গেল।
জীবনবিমা কোম্পানি তিন লক্ষ টাকা লোকসানের দায় থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে, কৃতজ্ঞ হয়ে, অঙ্গীকৃত তিন হাজার টাকার চেয়েও বেশি পুরস্কার দিয়ে প্রফেসরদের খুশি করলে।
এই ব্যাপারটি কি উপন্যাসের চেয়ে আশ্চর্য নয়? কখনও কোনও উপন্যাসের ডিটেকটিভও কি ওই দুই প্রফেসরের চেয়ে বেশি বুদ্ধির পরিচয় দিতে পেরেছে? কিন্তু তোমরা কেউ এই ব্যাপারটিকে অবিশ্বাস কোরো না, কারণ, এটি হচ্ছে অস্ট্রিয়া দেশের একটি বিখ্যাত সত্য ঘটনা!
Post a Comment