আমিন মাস্টারের বাড়ি – তাহমিদ উল ইসলাম
এমনিতে আমি বেশ ঘরকুনো মানুষ; ঘর থেকে তেমন একটা বেরোই না, ছুটির দিনেও বসে বসে গল্পের বই পড়ি বা টেলিভিশন দেখি। স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে যেবার কক্সবাজার গিয়েছিলাম, সেবারও আমার একটা লম্বা সময় কেটেছে ওই হোটেলের রুমে শুয়ে-বসে। কাজেই যখন এই আমাকেই অফিসের কাজে বেশ দূরে, শোভনপুরে—এমন অজপাড়াগাঁ, যেখানে সাধারণত লোকজন যায় না—এমন একটা জায়গায় পাঠানো হলো, আমি একই সঙ্গে বেশ ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত বোধ করলাম। তবু কিছু বলা যায় না, কেননা এটা সরকারি চাকরি, আর এ হলো ওপর মহলের অর্ডার।
যা–ই হোক, বেশ পুরো একটা দিন লেগে গেল ঢাকা থেকে শোভনপুর যেতে। স্টেশনে যখন নামলাম, তখন সন্ধ্যের আলো বেশ জেঁকে ধরেছে চারপাশ, যদিও আমি সেই আলোতেও স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম বড় করে লেখা স্টেশনের নাম: শোভনপুর।
স্টেশনটা বেশ নিঃশব্দ; মানুষজন নেই তেমন একটা। রেলস্টেশনগুলোতে দু–একটা কুলি থাকে সাধারণত; তা–ও নেই এই শোভনপুরে। পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘেরা এলাকা, পথের ধারে বড় বড় গাছ, আমি পায়চারি করছি, আমায় যেতে হবে রেস্টহাউসে, দেখি কোনো কুলি পাই কি না; এমন সময় একটা ভরাট কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘শরিফ না?’
হ্যাঁ। আমার নাম শরিফুল ইসলাম শরিফ। বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। থাকি ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায়। একটা সরকারি চাকরি করি।
তাকিয়ে দেখি একটা লোক; পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর পাজামা, সারা মুখে ঘন দাড়ি, ঘাড়ের কাছে বেশ বড় একটা আঁচিল, বলল, ‘শরিফই তো! কী খবর? কেমন আছিস?’
কে এই লোকটা, চিনতে পারছি না তো! বললাম, ‘ইয়ে মানে…’
‘ওহ! আমায় চিনতে পারছিস না, এ–ই তো? পারবি কীভাবে? এত দিন পর দেখা! আর তার ওপর রেখেছি দাড়ি। তোর চেহারা দেখেই চেনা যায়, ক্লিন শেভড মুখে ছেলেবেলার ভাবটা একদম ফুটে উঠেছে।’
‘মানে আরকি…’
‘আমি আমিন, এবার চিনতে পেরেছিস নিশ্চয়ই?’
মনে পড়ল, ছেলেবেলার আমার একটা বন্ধু ছিল, নাম আমিন। তবে স্মৃতিটা অস্পষ্ট। স্বস্তি বোধ করলাম, কেননা এই অচেনা অজপাড়াগাঁয় এসে চেনা কারও খোঁজ পেলাম, খুব বেশি কিছু মনে পড়ছে না আমিনের বিষয়ে, তা–ও বললাম, ‘তারপর কী খবর?’
‘এই তো চলছে, তোর কী খবর?’
‘সরকারি চাকরি করছি একটা, এলাম একটা কাজে শোভনপুরে।’
‘তোর সাথে কত দিন পর দেখা! আমি এখানে একটা স্কুলে মাস্টারি করি। তা বিয়েটিয়ে করেছিস?’
‘হ্যাঁ, এই তো আরকি।’
‘বেশ, বেশ। আমি ওসব করে উঠতে পারিনি এখনো। দেখি, আরও সময় যাক। কী হয়! আমায় চিনতে তোর বেগ পেতে হচ্ছে, জানি।’ আমিন হাসতে লাগল।
আমি কথা কাটাবার জন্য বললাম, ‘তা থাকিস কোথায়?’
‘এই তো এদিকেই আমার বাড়ি। তুই উঠবি কোথায়?’
‘রেস্টহাউসে।’
‘রেস্টহাউসে? বন্ধুর বাড়ি থাকতে রেস্টহাউসে থাকবি কেন, হাঁদা? আমি কি এখানে বসে ঘাস কাটছি?’
‘ইয়ে মানে…’
‘কোনো ইয়ে আর মানে নেই। তুই এখন আমার সঙ্গে যাবি আমার বাড়িতে। দুমুঠো চাল বেশি বসিয়ে দিলেই চলবে, খেতে পারবি বেশ।’
‘রেস্টহাউসে জানাতে হবে না?’
‘কী জানাবি? এই সরকারি প্রজেক্টে কে কখন এল-গেল, কোনো খোঁজ থাকে নাকি?’
আমি খানিকক্ষণ ভেবে বললাম, ‘ঠিক আছে।’
‘লাগেজ তো সেই এনেছিস। কুলি খুঁজছিলি নাকি?’
‘হুঁ।’ মাথা নাড়লাম।
‘শহরে থেকে থেকে তোদের অভ্যাসটাই খারাপ হয়ে গেছে। এটুকু জিনিস নিতে কুলি লাগে আবার? আমিই নিচ্ছি।’ এই বলে আমিন আমার ব্যাগ তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করল। আমিও কিছু বললাম না আর, পাছে ছেলেবেলার বন্ধু যদি মন খারাপ করে বসে।
এদিকে মোবাইলের নেটওয়ার্ক তেমন একটা কাজ করে না। যথেষ্ট বিরক্তিকর বিষয়। আমি আমিনকে বললাম, ‘তোর কথা বল, শুনি কেমন কী আছিস।’
‘আমার কথা আর কী বলব, মাস্টার্সের পর এই গ্রামে এসে মাস্টারি করি, এই তো।’
‘এই অজপাড়াগাঁয় কেন?’
‘এমনিই। নির্জনতা ভালো লাগে। আর আমার না বাচ্চাদের খুব ভালো লাগে, ছোট বাচ্চাদের প্রতি একটা দুর্বার আকর্ষণ বোধ করি সব সময়, সে জন্য।’
‘ওহ, তা–ই বল। আমি সরকারি চাকরি করি, তাতেই হাঁপিয়ে উঠছি। যারা নয়টা–পাঁচটা ব্যাংকে বা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে, তারা যে কীভাবে বেঁচে আছে, কে জানে! ভাবছি অবসরের পর গ্রামে একটা বাংলো বাড়ি বানিয়ে থাকব, হা হা হা।’
উত্তরে কিছু বলল না আমিন। আমরা হাঁটতে লাগলাম। চারপাশে বুনো ঝোপ। ঝিঁঝি ডাকছে। দু–একটা শিয়ালকেও দৌড়ে যেতে দেখলাম আমরা। আমিনের হাতে একটা টর্চ লাইট, তার আলোতেই পথ চলছি।
‘আর কত দূর?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘বেশি দূর না। তবে একটু কাদাপানি পেরোতে হবে, কিছু মনে করিস না।’
আমি বিরক্ত হলাম, শাপ দিতে লাগলাম সেই ওপর মহলকে, যারা আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। আমিন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, ‘কিছু মনে করিস না। এখানে এমনই পরিবেশ। একদমই অজপাড়াগাঁ তো। বিদ্যুৎও থাকে না বেশির ভাগ সময়। তবে দু–এক দিন থাকলে এমনিতেই ইউজড টু হয়ে যাবি।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, অসুবিধা নাই। চল।’
‘কিছু দূর কাদাপানি পেরিয়ে গিয়ে দেখি একটা বাড়ি। আলো জ্বলছে।’
‘আর কত দূর?’ আমি বললাম।
‘এই যে সামনের বাড়িটা!’
খানিকক্ষণ থেমে আমিন বলল, ‘তোর রেস্টহাউস খুব বেশি দূরে না। এখান থেকে কাছেই। দুশ্চিন্তা করিস না। কাল দিনের আলোতে মহানন্দে পৌঁছে যেতে পারবি। বুঝলি?’
আমি মাথা নাড়লাম।
আমিনের বাড়িটা বেশ পরিষ্কার। ঝকঝকে, তকতকে। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে, আলো জ্বলছে; মনে মনে বললাম, যাক বাবা, বাঁচলাম! তা–ও তো বিদ্যুৎটা আছে। আমিন বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর খাওয়া শেষ করে ফেল বিদ্যুৎ থাকতে থাকতে।’
কলঘরটা বেশ পরিষ্কার। শেওলা পড়ে নেই একটুও। আমি হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখি, খাবার প্রস্তুত! বেশ অবাক হলাম। আমিন আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, ‘অবাক হচ্ছিস? অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমার সব রেডিই থাকে, জাস্ট চুলায় বসিয়ে দিই। আর আজকের খাবার আগেই রান্না করা ছিল, আমি শুধু গরম করেছি।’
খাবারের আয়োজন বেশ রাজকীয়। মুড়িঘণ্ট, ভাজা মাছ আর মুরগির ঝোল। খাবার শেষে পায়েসও ছিল। রান্না বেশ সুস্বাদু হয়েছে। ক্ষুধা পেটে স্বাদ যেন আরও বেড়ে গেছে বহুগুণ। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাতেই কেমন যেন খটকা লেগে আছে, বাল্যবন্ধুটির সঙ্গে এখনো সহজ হয়ে উঠতে পারিনি আমি।
খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই লোডশেডিং!
আমিন বলল, ‘যাক। আজ তো তা–ও ছিল বেশ কিছু সময়, অন্য দিন এটাও পাই না।’
‘তোর একা একা ভালো লাগে এমন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘খারাপ লাগে না। দিন কেটে যায়। ব্যস্ত থাকি। নানান কাজকর্ম করি। বইপত্র পড়ি। তোর তো পাশের রুমে যাওয়ার সুযোগ হয়নি এখনো। ওখানে প্রচুর বই জমা রেখেছি।’
‘বই আনিস কীভাবে?’
‘অর্ডার দিই কখনো। পার্সেল আসে। আবার ঢাকা গেলে নিয়ে আসি। আনাটা খুব ঝামেলার ব্যাপার জানিস, তা–ও আনি। বই ছাড়া আর কী আছে বিনোদনের এখানে! মোবাইল নেটওয়ার্ক বা ডিশ লাইন কিছুই ঠিকঠাক পাওয়া যায় না।’
খানিকক্ষণ নীরবতা। আমরা কেউই কিছু বললাম না। খানিকক্ষণ থেমে আমিন বলে, ‘তাহলে তুই এখন শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে তো। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি। যাব আর আসব।’
‘এত রাতে? বাইরে?’ আমি বেশ অবাক হলাম। এত দিন পর দেখা, কোথায় একটু কথাবার্তা বলবে, তা না, সে হঠাৎ চলে যাচ্ছে! কী তাজ্জব ব্যাপার!
‘হ্যাঁ। একটা কাজ ভুলে গেছি করতে। টেনশন করিস না। আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাব। রাতে কোনো প্রয়োজন হলে তুই অন্য দরজা দিয়ে বেরোতে পারবি।’
আমিন চলে গেল। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। জানালা দিয়ে চাঁদের মিষ্টি আলো আসছে ঘরে। হু হু করে বাতাসও বইছে। মোবাইল ফোনটাতে চার্জ নেই। চার্জ যে দেব, এমন উপায়ও নেই। একদম মেঘ নেই আকাশে। তারা দেখা যাচ্ছে। ওই তো সপ্তর্ষিমণ্ডল!
আমিনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম আমি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম ভাঙতেই দেখি, এ কী!
একটা ভাঙা বাড়ির মেঝেতে শুয়ে আছি আমি। অন্ধকার ঘর। চারপাশে একরাশ তেলাপোকা, চামচিকা আর ইঁদুর। দেয়ালে শেওলা, পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে।
আমার মালপত্র উধাও। কিচ্ছু নেই। পোশাকে ময়লা; মনে হচ্ছে কত দিন যেন গোসল করি না। গায়ে ধুলা, পোশাক জীর্ণ। বাইরে বেরোলাম, দেখি একটা বুড়ো লোক হেঁটে যাচ্ছে, ডেকে বললাম, ‘চাচা, এটা আমিন মাস্টারের বাড়ি না?’
‘হ।’
‘আমিন মাস্টার কই আছে এখন?’
‘এই দেখো, পাগলটার পাগলামি আবার এই সাতসকালে শুরু হইছে! যত্ত সব পাগল-ছাগল। আমিন মাস্টার তো সেই কবে মরে ভূত! তোরে কে বলে প্রতি রাতে এই আমিন মাস্টারের বাড়িতে থাকতে? হ্যাঁ?’
Post a Comment