কালো হরিণ চোখ - মাহফুজ আহমেদ

কালো হরিণ চোখ - মাহফুজ আহমেদ

শাড়িটার রঙ এত সুন্দর, খুব মানিয়েছে প্রকৃতিকে। আয়নার সামনে সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখল। আজ ওর মন আর মেজাজ দুটোই ভয়ানক খারাপ। যখন ওর মন খারাপ হয়, সে ঘরের দরজা বন্ধ করে শাড়ি পরে নিজেকে সাজায়। আস্তে আস্তে মন শান্ত হয়ে আসে৷ কিন্তু আজ কিছুতেই মনটা শান্ত হচ্ছে না৷ সে একদফা কান্নাকাটিও করেছে। তার অবশ্য একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। 

ছাদ ভর্তি ওর অসংখ্য গাছগাছড়া। সব সে হাতে ধরে ভীষণ যত্নে বড় করছে। এগুলো ওর এত প্রিয়। কিন্তু আজ সকালে ছাদে উঠে দেখে দুটো গাছ ভেঙে টব উল্টে পড়ে আছে। গতকাল রাতে ঝড়ো বৃষ্টি হয়েছে। পরম ভালোবাসার জিনিসের এমন ভঙ্গুর অবস্থা দেখলে কারই বা মন মেজাজ ঠিক থাকে! গাছগুলো ওর সন্তানের মতো, খুব প্রিয় বন্ধুর মতো। সেগুলোকে ছুঁয়ে সে কেঁদে ফেলল। সেগুলো আর ঠিক হবে কিনা জানে না, তারপরও পরম মমতায় আরেকবার লাগিয়ে এসেছে, শুশ্রূষা হিসেবে। 

দরজায় কয়েকবার ধাক্কা পড়ল, মা ডাকছেন। মা'য়ের এই এক সমস্যা। ওর যখন একা থাকতে ইচ্ছে করে, তখনই তার যাবতীয় কথাবার্তা মনে পড়ে যায়। দরজা খুললে হয়তো শুনতে হবে, 

"শুঁটকি ভর্তায় লবণ ঠিক আছে কিনা চেখে দেখ তো!" 

কিংবা "সুঁইতে সুতো লাগিয়ে দে তো।" 

প্রকৃতি আগে ধীরে সুস্থে শাড়ি বদলে নিল। এটা মায়ের প্রিয় শাড়ি। তাই আগে ভাঁজ করে জায়গা মতো রাখল। যদিও ভাঁজ ঠিকঠাক হলো না। তাই লুকিয়ে আলমারিতে তুলে রাখল। পরে ঠিক করা যাবে। নইলে বাড়ি মাথায় উঠবে। ওদিকে মা ক্লান্তিহীন ভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছেন৷ 

"কী রে দরজা খুলতে এত দেরি। এদিকে সব আমার ঘাড়ে। যত জ্বালা আমার।" 

"কী হয়েছে মা?" 

"আমাদের রুমের ফ্যানটা নষ্ট মাঝরাত থেকে। আজ মানুষটা ফিরবে। তুই একটু ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে নিয়ে আয় তো।" 

"আমি যাব?" 

"আর কে আছে বাসায়? আমাকে যেতে বলিস? আমার কত রান্নাবান্না বাকি, সব ফেলে আমি যাব? ময়নার মা-ও আজ আসেনি।" 

"আচ্ছা, যেতে হবে না, আমার কাছে ফোন নম্বর আছে। আমি কল করে দেখছি।" 

কল করা হলেও দেখা গেল নম্বর বন্ধ। কী এক যন্ত্রণা। সে ওড়না বদলে তৈরি হয়ে বেরুচ্ছিল৷ মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, 

"শোন, ফেরার সময় দোতলায় গিয়ে রুবিনা ভাবিকে বলবি, উনি যেন প্রিয়মকে নিয়ে দুপুরে চলে আসেন। কাল বলেছিলাম, আজ এখানে খেতে। তুই মনে করিয়ে দিয়ে আসবি।" 

"আচ্ছা।" 

রুবিনা চাচিকে প্রকৃতি ভীষণ পছন্দ করে। চমৎকার এক মহিলা। ভীষণ মজা করে কথা বলেন। উনি নিজে ওকে কিছু রেয়ার স্পেসিসের গাছ সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। তবে সমস্যা তার নাক উঁচু ফটোগ্রাফার ছেলেটা, প্রিয়ম। এত 'ভাবওয়ালা' ছেলে সে জগতে দুইটা দেখেনি। কীসের এত ভাব কে জানে! যেন সে রাজা, নিজের রাজত্বে রাজপাট সাজিয়ে বসেছে, বাকিরা বানের জলে ভেসে তার আশেপাশে ভিড়েছে। 


ফ্যান সারানোর লোক পাওয়া গেছে। তাকে পাঠিয়ে সে দোতলায় এসেছে। 

কলিং বেল বাজানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুললেন রুবিনা৷ মিষ্টি হেসে বললেন, 

"আরে প্রকৃতি কন্যা যে। কী খবর? আয়, আয়।" 

হাত ধরে ওকে ভেতরে নিয়ে বসালেন। নিজেও পাশে বসলেন। 

"শোনো, কাকি আজ দুপুরে তোমরা আমাদের বাসায় যাবে। মা পাঠালো।" 

"সে তো যাব। আগে বল, আজ ইউনিভার্সিটিতে যাসনি?" 

"নাহ্। মন খারাপ তাই যাইনি।" 

"সে কী! মন খারাপ কেন? তোর বৃক্ষকূল কেমন আছে?" 

এই কথায় প্রকৃতির আবার কষ্ট জেগে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, "ভালো নেই৷ দুটো গাছ ভেঙে গেছে।" 

ওর বৃক্ষ প্রীতির কথা সম্পর্কে তিনি অবগত। 

"মন খারাপ করিস না মা। দুটো ভেঙেছে, তুই চারটা লাগাবি আবারও।" 

প্রকৃতির চোখ টপটপ করে পানি পড়ল। রুবিনা চোখ মুছিয়ে দিচ্ছিলেন। তখনই প্রিয়ম এলো নিজের ঘর থেকে। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে। 

"তুই কই যাচ্ছিস?" 

"কাজে।"

"কী এমন কাজ তোর? সারাদিন ওই কটকটি সাথে নিয়ে ঘুরিস।"

"মা, আমার ক্যামেরাকে তুমি কটকটি বলছ কেন?"

"নেই কাজ তো খই ভাঁজ। ওটা খই ভাজার যন্ত্র ছাড়া আর কী!" 

মায়ের এমন বাছবিচারহীন মন্তব্যে প্রিয়ম যারপরনাই বিস্মিত হলো। 

প্রকৃতির চোখে এখনো জল। প্রিয়ম সেদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ঘটনা কী।

"শোন প্রিয়ম৷ আজ এখন যাস না। দুপুরে ওদের বাসায় দাওয়াত। খেয়ে তারপর বেরুবি। যা এখন ঘরে যা।"

প্রিয়ম অপ্রসন্ন মনে ফিরছিল, শুনল মা বলছেন, "শোন মা, তুই কাঁদিস না৷ গাছ ভেঙেছে তো কী হয়েছে, আমি এনে দেব। একবার হাস তো?" 

প্রিয়ম আবারও বিস্মিত হয়ে অস্ফুটস্বরে বলে ফেলল, "সামান্য গাছের জন্য কেউ এভাবে ফ্যাঁচফ্যাচ করে কাঁদে?" 

প্রকৃতির কানে গেল কথাটা। ওর গাছের অপমান সে হজম করতে পারে না। যুদ্ধংদেহী গলায় বলল,

"সামান্য গাছ মানে? পড়াশোনা জানা গণ্ডমূর্খ নাকি আপনি? গাছের যে প্রাণ আছে সেটা জানেন না? একটা জীবন কী করে তুচ্ছ হয়? আপনি তো মানুষ খু ন করতে পারবেন!"

"গণ্ডমূর্খ কেন বলছ? এভাবে অভদ্রের মতো কে কথা বলে? গাছ আর মানুষ এক হলো?" 

"আমি অভদ্র? আপনি অজ্ঞ। এই যে নাক টেনে অক্সিজেন নেন, সেটা কোত্থেকে আসে? আপনার কাঁধের ঝোলার মধ্যে থাকা ওই আর্টিফিশিয়াল জিনিস থেকে?" 

"খবরদার, আমার ক্যামেরাকে অপমান করবে না। গাছ কেটে যে ঘরবাড়ি হচ্ছে, ফার্নিচার হচ্ছে, তাদেরকে কী বলবে? ক"সা"ই?" 

"ও, আপনার জিনিসকে কিচ্ছু বললে খুব মানে লাগে, আর অন্য কারোরটা কিচ্ছু না? টিট ফর ট্যাট। কথাটা জানেন না? যুক্তিতে না পেরে কুযুক্তি খাড়া করানোই যায়।"

"তোমার মতো অতি ঝগড়াটে মেয়ের সাথে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।" 

"নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন বলে ধন্যবাদ। এমন সুবুদ্ধি চুয়ে চুয়ে পড়ুক আরও।" 

প্রিয়ম জানে এই চূড়ান্ত অভব্য মেয়ের সাথে কথা বলা বৃথা। কথায় কথা বাড়বে। সে তা এই মুহূর্তে চাইছে না৷ তাই চুপচাপ ভেতরে চলে গেল। 

এই বাড়িতে ওরা বহুদিন ধরে একসাথে থাকে। প্রথমে ভাড়ায় ছিল। তখন প্রিয়মের তিন বছর বয়স, সদ্য প্রকৃতির জন্ম হয়েছে। বাড়িওয়ালা এই বাড়ি বিক্রি করবেন। তার আরও বাসা আছে। হঠাৎ টাকার দরকার হয়েছিল। তখন আনোয়ার আর রুবিনার স্বামী জোবায়ের সাহেব দুজন মিলে বাড়িটা কিনে নেন। এই দুই পরিবারের সম্পর্কও মজবুত হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। 


প্রিয়ম ঘরে বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিল বলে নিজের তোলা ছবিগুলো দেখছিল। হঠাৎ পুরনো একটা স্মৃতি মাথাচাড়া দিল। যেই স্মৃতি প্রায়ই ওকে জ্বালাতন করে। 

তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ করেছে। বাবা প্রমিস করেছিলেন ভালো রেজাল্ট হলে একটা ক্যামেরা কিনে দেবেন। প্রতিশ্রুতি মতো সে ক্যামেরা পেয়ে খুশি মনে সেটা নিয়ে ঘুরে বেড়াত। 

একদিন হঠাৎ ওর দৃষ্টি আটকে গেল একটা মেয়েকে দেখে। বলা ভালো একজোড়া কাজল চোখ দেখে। কী যেন এক সম্মোহনী শক্তি ছিল সেই চোখে। 

মেয়েটার চেহারা ওর মনে নেই, তবে সেই সুগভীর চোখ দুটো সে আজও ভুলতে পারে না। কবি গুরুর কাছ থেকে ধার করে সেই চোখের নাম প্রিয়ম রেখেছে 'কালো হরিণ চোখ'। 

এই প্রজন্ম এটার নাম দিয়েছে 'ক্রাশ' বলে। কিন্তু প্রিয়ম জানে, এটা তেমন পলকা ব্যাপার নয়। কারণ সেই চোখে সে নিজের সর্বনাশ দেখেছিল। 

আজও আনমনে অবচেতনে সে ওই দুই চোখের সন্ধানে ঘুরে। স্বপ্নেও এসে জ্বালাতন করে যায় কখনো সখনো। কিন্তু ভাগ্য এখন অব্দি সুপ্রসন্ন হয়নি। ওর প্রতীক্ষা শেষ হয়নি। 

এক জোড়া কালো হরিণ চোখের প্রতীক্ষা, যে চোখে ডুবে যাওয়া যায় অনায়াসে। 
.......

প্রিয়ম সেই অদ্ভুত সুন্দর চোখের মেয়েটার একটা ছবিও তুলেছিল দূর থেকে। অনুমতি ছাড়াই লুকিয়ে এই গর্হিত কাজ সে করেছিল আশ্চর্য মোহাচ্ছন্ন হয়ে। তার শাস্তিস্বরূপ সে পরে খেয়াল করেছে অতিরিক্ত উত্তেজনায় ক্যামেরার মুখের ক্যাপটাই সরানো হয়নি। তাই ছবিও ওঠেনি। যখন খেয়াল হয়েছে তখন মেয়েটা বেমালুম হাওয়া। 

কী এক সন্তাপে সে পুড়েছিল তখন। মেয়েটা এক ঝলক দেখা দিয়ে হারিয়ে গেলেও অল্প বয়সের সেই আবেগের জোয়ার ওর মনের গহীন প্রকোষ্ঠে যেন চিরস্থায়ী হয়ে প্রোথিত আছে। 

এরপর কত ছবি সে তুলেছে৷ কিন্তু যে ছবিটা ওর জীবনের সেরা ছবি হতে পারত, সেটাই এখন অব্দি অধরা রয়ে গেছে। 


পড়ন্ত বিকেল প্রকৃতি ছাদে উঠে আসে। হাতে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। এটা ওর প্রতিদিনের রুটিন। ফুলগুলো বাতাসে দুলছে, সেদিকে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেবার ফাঁকে ফাঁকে সে গুনগুনিয়ে উঠছে, 'ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো...'

এই সময়টা ওর বড্ড প্রিয়। কেমন বিষাদ ছোঁয়া মন ভালো করা ক্ষণ। দুটো বিপরীত অনুভূতি কেমন সমান্তরালে বয়ে যায় হৃদয়ে। সূর্য ডুবি ডুবি করছে। সে এসে দাঁড়ালো রেলিংয়ের ধারে৷ তখনই চোখে পড়ল প্রিয়মকে। রিকশা থেকে নামছে। কাঁধে ক্যামেরা। চির পরিচিত ভঙ্গিতে গেটের ভেতরে ঢুকল। এরপর মিলিয়ে গেল।  

পুরো সময়টায় প্রকৃতি সেদিকে তাকিয়ে ছিল। সূর্য ডুবে গেছে। মাগরিবের আযান হচ্ছে। দূরে এক ঝাক পাখি উড়ে যাচ্ছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। সময়টা বোধহয় ঘরে ফেরার। মানুষের, পাখিদেরও। সে-ও দুদ্দাড় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিজের ঘরে। 

ভেতরে এসে মায়ের ডাক শুনল, তার গলায় উচ্ছ্বাস। তিনি অল্পেই আনন্দিত হন। আনন্দিত হবার এক অসম্ভব ক্ষমতা তার মধ্যে বিদ্যমান। 

সে এগিয়ে গেল মায়ের ঘরে, "তোর মেজ খালা, রানু বুবু আসছে। কতদিন পরে ওর সাথে দেখা হবে।" 

কিছুটা থেমে তিনি বললেন, "তোকে বলেছি না ঘর এলোমেলো করে রাখবি না। নিজের ঘরের জিনিস তো অন্তত গুছিয়ে রাখতে পারিস।" 

"গুছিয়ে রাখলে কিছু খুঁজে পাই না মা। আমার এভাবেই ভালো লাগে।"

"তা লাগবে কেন? বন্য বাপের জংলী বেটি।"

"বাবা কই মা?" কথা গায়ে না লাগিয়ে প্রশ্ন করল প্রকৃতি। 

"বাইরে গেছে। ঘরে থাকতে পারে নাকি? মানুষটা একেবারে বন্য। তাও মাঝে মধ্যে ভুল করে ফিরে আসে।" 

কপট রাগ করে বললেও তার মুখের হাসি অমলিন। একজন বন্য মানুষকে তিনি সংসারে বাঁধতে পেরেছেন, এই খুশি তার চোখেমুখে। মা তার আনন্দিত হবার ক্ষমতা সবসময় লুকিয়ে রাখতে চান বলেই অনেকসময় চিৎকার চেঁচামেচি করেন। এমন ভাণ করেন যেন বাবার উপরে তিনি অসম্ভব বিরক্ত। 

ক্ষেত্রবিশেষে তা সত্য হলেও বেশিরভাগ সময় কেবলই কপট অভিমান মেশানো থাকে। বাবা এই অভিমান বুঝতে পারেন, এবং তিনি চমৎকার করে সেটা ভাঙাতেও পারেন। এই দুজনের এত বছর পাশাপাশি থাকার পরেও যে অভূতপূর্ব রসায়ন সেটা মনোমুগ্ধকর। কী দারুণ বোঝাপড়া। কেমন নবপরিণীত দম্পতির মতো মনে হয় দুজনকে। যেন সদ্যই দু'জন পরস্পরকে পেলেন। ঝগড়া চলে তুমুল৷ ক্ষণেক পরেই গলায় গলায় ভাব। 

কী যে ভালো লাগে প্রকৃতির! মনে হয় এমন বাবা মায়ের সন্তান হতে পারাটা অসম্ভব সৌভাগ্যের। সে পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবানদের একজন। ওর চোখ চকচক করে উঠে আনন্দাশ্রুতে।


"মা, মা..." 

প্রিয়মের ঘর থেকে অনবরত ডাকাডাকিতে রুবিনা এসে জিজ্ঞেস করলেন, "চেঁচাচ্ছিস কেন?" 

"মা আমার সাদা শার্টটা খুঁজে পাচ্ছি না।"

"ক্যামেরার লেন্স দিয়ে দেখ। ওটা ছাড়া তো তোর চোখে আর কিছুই পড়ে না।" 

প্রিয়ম হেসে ফেলল, "মা, আমার এই নিতান্ত নিরীহ জিনিসটার প্রতি তোমার এত রাগ কেন?" 

"কারণ ঘরে যে তোর মা থাকে সেটা তো মনেই থাকে না। সারাদিন ওটা নিয়েই টো টো করিস।" 

প্রিয়ম এগিয়ে এসে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে আবারও হেসে বলল, 
"আচ্ছা এখন থেকে আরও বেশি করে সময় দেব। হলো? খুশি?" 

"মুখের কথায় চিড়ে ভিজবে না খোকা।"

"আচ্ছা, যা করলে চিড়ে ভিজবে তাই করব। শার্টটা কোথায় প্লিজ বলো মা?" 

"ছাদে। শুকাতে পাঠিয়েছিলাম।" 

প্রিয়ম সাথে সাথে গেল না, সে সেভাবেই কিছুক্ষণ মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। এরপর বলল, 

"মা, তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? ছোটবেলায় শুনতে চাইতে জিজ্ঞেস করে। তখন হাত মেলে পরিমাপ করে দেখাতাম। এখন বুঝি, এর পরিমাপ হয় না।" 

প্রিয়ম এরপর ছাদের জন্য পা বাড়ালো। রুবিনার চোখের কোণে পানি জমেছে। কী এক অপার্থিব সুখ ছুঁয়ে গেল তাকে। তিনি জানেন ছেলে মা অন্তপ্রাণ, তবুও এই যে মুখ ফুটে বলা, সেটা শুনতেও তাও কী ভীষণ ভালো লাগছে! ছেলের জন্য সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে দোয়া করলেন তিনি। 


প্রিয়ম যখন ছাদে এলো তখন অন্ধকার নেমেছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। চাঁদের আলোতে চারপাশ আলোকিত। সে শার্টটা নিয়ে এগুচ্ছিল, ছাদ ওর ভীষণ পরিচিত। কোথায় কী, তাও মুখস্ত। তাই সেই আন্দাজ মতোই এগুচ্ছিল, অতটা খেয়াল না করে। তাতেই কাল হলো। কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে সামলে নিল। তখনই ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলো। এবং নিচে তাকিয়ে দেখল, প্রকৃতির নতুন গাছের টব, এটা আগে এখানে ছিল না। 

সে ওটা উঠাতেই যাচ্ছিল, তখনই মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে উপস্থিত হলো প্রকৃতি। ক্ষ্যাপাটে ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা৷ 

প্রিয়ম মনে মনে বলল, "সর্বনাশ।"
.........

প্রকৃতির যুদ্ধংদেহী মূর্তিতে খানিকটা ভড়কে গেছে প্রিয়ম। সে বরাবরই শান্ত ছেলে। ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলে। তবে এই মেয়ে কেন যেন সুযোগ পেলেই দুটো বাঁকা কথা শুনিয়ে দেয়। নির্ঘাত মাথায় গণ্ডগোল আছে। সে-ও যে চুপচাপ হজম করে ফেলে ব্যাপারটা তেমন নয়। কথার পিঠে কথা তো কিছু চলেই আসে। 

"আপনি ইচ্ছে করে করেছেন, তাই না?" 

"আমি কেন খামাখা ইচ্ছে করে ভাঙতে যাব? এভাবে রাস্তার মাঝখানে এসব রাখার মানেটা কী? আর কোনো জায়গা ছিল না?" 

"এটা রাস্তার মাঝে? আপনি চোখে দেখেন না? এর আগে একবার ইচ্ছে করে আমার গাছের অনেকগুলো ফুল ছিঁড়েছিলেন। এবার যে তা করেননি কে বলবে?" 

প্রিয়মের মনে পড়ল তখন সে টেনে পড়ে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পাড়ায় একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল সেবার। ওর উপর দায়িত্ব পড়েছিল ফুলের। বড়রা ওদের পাত্তা দেয়নি বলে কিশোর সাঙ্গপাঙ্গ মিলে আলাদা আয়োজন করেছিল। যেহেতু স্কুলে পড়ত, স্বাভাবিকভাবেই অত টাকাপয়সা হাতে কারোরই ছিল না। যেটুকু কিছু টাকা উঠল, তা খাওয়া দাওয়া, পটকা, এসব আয়োজনের বাজেটেই টানাটানি পড়ে গিয়েছিল। তাই ফুলের জন্য বাজেট ছিল না। অগত্যা ওই ছাদের বাগনটাই হয়ে উঠে ভরসা। বন্ধুদের মধ্যে নিজের প্রেস্টিজ রক্ষা করতে রাতের অন্ধকারে ফুলগুলো সরিয়েছিল প্রিয়ম। 

তখন এখানে এত গাছ ছিল না। অল্প কিছু ফুল গাছ ছিল। যখন প্রকৃতি দেখেছিল, সে এক কাণ্ড হয়েছিল বটে! ওইটুকু মেয়ে ছিল তখন, সেভেনে পড়ত। সে কী রাগ। নেহায়েত সবিতা আন্টি মেয়েকে ধরে রাখলেন বলে রক্ষা, তবুও ওর চুল খাবলে ধরেছিল সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। সেদিন অল্পে চুলগুলো রক্ষা পেয়েছিল। তবে তার প্রতিশোধ প্রকৃতি নিয়েছিল অন্যভাবে। তবে সময় নিয়েছিল বছর ঘোরার। 

প্রিয়মের এক বন্ধু ছিল, জুবায়ের। এক ক্লাস উপরের, তবুও বেশ বন্ধুত্ব ছিল। নাম ধরেই ডাকত পরস্পরকে। সে পছন্দ করত সুপ্তি নামের একজনকে। যে প্রকৃতিদের স্কুলে নাইনে পড়ত। জুবায়ের সেসময় ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছিল এবং প্রিয়মকে ধরেছিল, সুপ্তির কাছে চিঠিটা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে। নইলে নাকি হারপিক বা ডেটল কিছু একটা খেয়ে সুইসাইড করবে। 

সুপ্তির ছোট বোন তৃপ্তি প্রকৃতির খুব ভালো বন্ধু ছিল, প্রিয়ম জানত। সেই সূত্রে সুপ্তির সাথেও ওর ভালো খাতির ছিল। 

প্রিয়ম প্রকৃতিকে ডেকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করিয়েছিল, আর বলেছিল "কাউকে বলবে না কিন্তু।" 

"ঠিক আছে। কাউকে বলব না।" কথাটা বললেও সে চিঠিটা সুন্দর করে নিয়ে সযত্নে পৌঁছে দিয়েছিল মায়ের কাছে। পিঠ রক্ষা করা যায়নি। দুমদুম কয়েকটা কিল জুটেছিল ডাকপিয়ন হবার অপরাধে। কানমলা খেয়ে কানে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। 

আর ওই অভব্য মেয়ে প্রিয়মেরই টেবিলে, তারই ফিজিক্সের নোট খাতার সবার উপরের পৃষ্ঠায় লিখে এসেছিল, 

"ফুল এর উপর ফুলের প্রতিশোধ" যেখানে প্রথম শব্দ ফুল এর বানান ছিল 'এফ ডাবল ও এল'।

প্রিয়মের ভীষণ গায়ে লেগেছিল ব্যাপারটা। মায়ের কানমলার চাইতে এটা নিঃসন্দেহে বেশি লজ্জার বিষয় ছিল। সেবার জুবায়েরকে নিজ গরজে একটা হারপিক ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। 

পাল্টা শোধবোধ সে-ও করেছিল। এরপর ওদিক থেকেও। টম এন্ড জেরির চলমান শোধবোধ খেলা ভালোই চলত প্রকৃতি আর প্রিয়মের মধ্যে। তারপর আস্তে আস্তে পড়াশোনায় ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। ওদের মধ্যে একটা দূরত্বও তৈরি হয়। ওর এডমিশন টেস্ট ছিল, ওদিকে প্রকৃতির এসএসসি পরীক্ষার প্রিপারেশন। সব মিলিয়ে কোথায় যেন একটা বড় গ্যাপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। 

"সেটা অনেক আগের কথা। এখন আমি কোন সুখে এসব করব?" 

"আপনি কোন সুখে করবেন সেটা তো আপনি জানবেন। আমি তো আপনার সুখ নিয়ে গবেষণা করতে বসিনি।" 

"শোনো প্রকৃতি, এটা আমার দোষ নয়। দোষটা তোমার। এভাবে অজায়গায় টবটা রাখা একদম ঠিক হয়নি। আমার পায়ে না লাগলে অন্য কারোর পায়ে লাগত। তবে এটা ভাঙতোই।" 

"আপনি কি এস্ট্রোলজার প্রিয়ম ভাই? নাকি সুপারন্যাচারাল পাওয়ার টাওয়ার কিছু আছে? ভবিষ্যত আগে থেকে দেখতে টেখতে পান নাকি?" 
রূঢ়ভাষী মেয়েটার মুখে হাসি থাকলেও কথা রসকষহীন। 

"এই স্বরে কথা বলছ কেন? ভদ্রভাবে কথা বলতে শেখো নাই?" 

"না শিখি নাই। কী করব বলেন, আমার প্রিয় খাবার চিরতার রস, আর করল্লা ভাজি। গুণাগুণ সহ জিনিসগুলো চাচির কাছে দিয়ে আসব। ঠিক আছে? করল্লা ভাজি তিনবেলা, চিরতার রস সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে।" 
 
দৃশ্যটা চিন্তা করে গা গুলিয়ে এলো প্রিয়মের। জগতে এত সুখাদ্য থাকতে সে কেন বিষ তেতো জিনিসগুলো খাবে! 

"তুমি ডাক্তারও নও, কবিরাজও নও। যে প্রেসক্রাইব করবে। যাই হোক, শুধু টবটা ভেঙ্গেছে। গাছের কোনো ক্ষতি হয়নি। তুমি চাইলে আমি টবটা কিনে দিতে পারি।" 

"আমি ফকির না যে আপনার টব কেনার আশায় আমি বসে থাকব। তবে জরিমানা আপনাকে দিতে হবে।"

"কীসের জরিমানা?" 

কড়া চোখে তাকাল প্রকৃতি, "আমার এক্সট্রা টব আছে। নিচে থেকে সেটা নিয়ে আসবেন এরপর সমস্ত প্রসিডিওর কমপ্লিট করে তারপর বৃক্ষরোপণ শেষ করে নিজের পথে যাবেন। তার আগে নয়।" 

"যদি না করি?" 

দুই হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে সোজা প্রিয়মের চোখের দিকে তাকালো প্রকৃতি। দুষ্টু হাসি মেয়েটার মুখে। এই হাসি ভয়ংকর। কোনো বড় মতলব ঠিকই আছে মাথায়। রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না, ভাবল প্রিয়ম। ঝামেলা ভালো লাগে না ওর, তাছাড়া একটা গাছ লাগানোয় আর ঝামেলা কীসের! 

"ঠিক আছে। করে দিচ্ছি।" 

বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শেষ হলো খানিকটা সময় নিয়েই। তবে প্রিয়মের খারাপ লাগল না। সে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছিল, যেহেতু ওর পা লেগেই ভেঙ্গেছে। সে দেখল এবার প্রকৃতির মুখে মেঘ সরেছে, সত্যিকারের হাসিতে ঝলমলে করছে। 

"আচ্ছা, এসব তোমার এত ভালো লাগার কারণ কী?" 

"আপনার ভালো লাগেনি?" 

"লেগেছে। তবে তোমার মতো পাগলামি নেই আমার।" 

আবারও মেঘ জমল খানিকটা প্রকৃতির মুখে। এরপর কিছুটা সময় নিয়ে সে বলল, 

"প্রিয়ম ভাই, এই যে আমি ছোট্ট চারাগাছ লাগাই, কখনো বীজ। এরপর দীর্ঘ একটা সময় পরিচর্যা করি। ধীরে ধীরে গাছগুলো হয়। কাণ্ড, শাখা-প্রশাখায় ভরে যায়। চোখের সামনে এই যে দেখাটা, এটার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আছে। মা'য়ের কাছে যেমন তাদের সন্তান, আমার কাছেও তেমন মনে হয়। একেক সময় মনে হয়, এরা আমার সন্তান। আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছে এদের সাথে।" 

প্রিয়ম এভাবে ভাবেনি কোনোদিন৷ বরং প্রকৃতির এই বৃক্ষ প্রীতি তার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বলেই মনে হতো। আজ অন্য চোখে দেখে মোটেও বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। গাছগুলোকে ওরও ভীষণ ভালো লাগছে। আরেকবার ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। 

চাঁদের আলোয় ভরে গেল প্রকৃতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ সাথে সামনের প্রকৃতি নামের অদ্ভুত মেয়ে দু'য়ে মিলেই চাঁদের মতোই প্রিয়মকে যেন আলোকিত করল। বড় ভালো এই মুহূর্তটুকু। তাই মনে হলো ওর কাছে। 
.........

প্রিয়ম আজ এসেছে রেস্টুরেন্টে। ওকে দিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানাতে চায় একটা ট্রাভেল এজেন্সি। সেটা নিয়েই আলোচনা করতে এসেছে। নতুন এজেন্সি, প্রফেশনালদের ডিমান্ড বেশি, নতুন একজনকে নিয়ে তারা কাজে আগ্রহী। প্রথমটা হবে সুন্দরবনের উপরে। ভালো হলে অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটের উপরেও ওকে দিয়ে ডকুমেন্টারি ধরনের বিজ্ঞাপন করানো হবে।  

ফলপ্রসূ আলোচনা শেষে প্রিয়ম বেরিয়ে আসছিল। তখন ওর চোখ আটকে গেল সামনের ফুটপাতে। প্রকৃতি হেসে হেসে হাঁটছে। পাশে একটা ছেলে কী যেন বলছে, মেয়েটা সেটা শুনেই হাসছে। কই এভাবে মন খুলে হেসে তো ওর সাথে মেয়েটা কখনো কথা বলেনি! 

ছেলেটা কে? ওর বয়ফ্রেন্ড? হলেই বা ওর কী এসে যায়। ব্যাপারটাকে সে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে বাসায় ফিরে এলো। অথচ ওর এখন যাবার কথা ছিল সিয়ামের সাথে দেখা করতে। ওর খুব ভালো বন্ধু। চট্টগ্রামে একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। অনেকদিন পরে এসেছে, তাই ওর সাথে আড্ডা দিতে চায়। কিন্তু কেন যেন আজ একদম যেতে ইচ্ছে করছে না। 

বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। রুবিনা ডাকলেন, "কী রে, এই অসময়ে শুয়ে পড়লি কেন? শরীর খারাপ?" 

"না মা, একটু ক্লান্ত লাগছে। তাই রেস্ট নিচ্ছি।" 

রুবিনা বিছানায় প্রিয়মের মাথার কাছে বসলেন। এরপর ছেলের চুলে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলেন। প্রিয়ম মাথাটা মায়ের কোলে রাখল। এবার খানিকটা শান্তি মিলল। 


প্রিয়ম গোধূলি লগ্নে তেমন একটা বাসায় থাকে না। আজ আছে, সে ছাদে এসে দেখল ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে প্রকৃতি বসে আছে। ওকে দেখেই প্রিয়মের দুপুরের কথাটা মনে পড়ল। সাথে সাথে কী এক জ্বলুনি বুকে বাজল। 

সে এগিয়ে গিয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখেও কাছাকাছি দাঁড়াল। এরপর বলল, 

"কেমন আছো প্রকৃতি?" 

মেয়েটার মগ্নতা কাটল৷ সে প্রিয়মের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে উত্তরে বলল, "ভালো। আপনি কেমন আছেন প্রিয়ম ভাই?"

উত্তর না দিয়ে প্রিয়ম বলল, "আজ তোমাকে দেখলাম রাস্তায়।" 

"তাই, ডাকেননি কেন?" 

"তোমার সাথে একজনকে দেখলাম। সেজন্য ভাবলাম ডিস্টার্ব না করি।" 

প্রকৃতি ভদ্রতাসূচক কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলা হলো না, প্রিয়মের পরের কথায় ওর চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। 

"ছেলেটা কে? বয়ফ্রেন্ড বুঝি?" 

"হলেও সেটা আপনাকে কেন বলব? সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নয় কী? আমি কি কখনো আপনার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছি? আপনি আপনার হরিণ চোখের প্রেয়সীর সাথে কতদিনের প্রেম সেটা নিয়ে কিছু কখনো জিজ্ঞেস করেছি? তাহলে আপনি কেন প্রশ্ন করছেন? প্রিয়ম ভাই, একটা কথা বলি, আমার পার্সোনাল বিষয়ে কখনো প্রশ্ন না করলে খুশি হব।" 

এতগুলো কথা হড়বড় করে বলে প্রিয়মকে কোনো সুযোগ না দিয়ে প্রকৃতি সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় নেমে গেল। হতচকিত ভাব কাটতে অনেকটা সময় লাগল প্রিয়মের। সে কী এমন প্রশ্ন করেছে যার জন্য এতটা রেগে যেতে হবে, বেচারা সেটাই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না। 

হতচকিত দশা কাটার পরে সর্ব প্রথম যেই প্রশ্ন মাথায় খোঁচা দিল তা হলো, কালো হরিণ চোখের প্রেয়সী বিষয়ক কথাটা। এটা তো প্রিয়মের নিগুঢ়তম কথা। যা সে কাউকে বলেনি। ওই মেয়ে কী করে জানল! প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতে ঘুরতে আরেকটা বিষয়ে নিজেকে নির্ভার করার চেষ্টা করল। 

প্রকৃতির বয়ফ্রেন্ড থাকলে তার তো কিছু হবে না, থাকুক ওর বয়ফ্রেন্ড। ওর কেন মাথা ব্যথা হবে তাতে। ও তো অন্য একজনের অপেক্ষায় দিনাতিপাত করছে। একদিন নিশ্চয়ই সেই গভীর চোখের দেখা মিলবে। ওর ভালোবাসার টান কী করে সেই সুনয়না উপেক্ষা করবে! বরং খানিকক্ষণ আগের ভাবনায় ওর খানিকটা লজ্জাবোধ হলো। তবুও রাস্তায় প্রকৃতির সেই হাসি, যার উপলক্ষ অন্য একজন, সেই হাসিকে সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারল না পুরোপুরি। 


প্রকৃতির আগামী পরশু একটা ক্লাসটেস্ট আছে। কিন্তু পড়া হচ্ছে না কিছুই। ভীষণ বিরক্ত লাগছে। বইতে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ অস্থিরতা কাটানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারল না। 

প্রিয়মের উপরে ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ছেলেবেলায় এই ছেলেটা ওর খেলার সাথী ছিল। এই বাড়ির ছাদে, বা পাড়ার খেলার মাঠে অন্যদের সাথে খেলত। নাইন, টেনে পড়ার সময় যখন অনুভূতি সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছিল প্রকৃতি, তখন প্রিয়মের প্রতি অন্যরকম অনুভূতির টান সে উপলব্ধি করেছিল। কিন্তু কখনো বলা হয়নি। ভেবেছিল আরেকটু বড় হলে, যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়বে তখন বলবে। 

এরমধ্যে প্রিয়মের এডমিশন টেস্টের আগে আগে তখন আর কয়েক মাস বাকি ছিল প্রকৃতির এসএসসি পরীক্ষার। সে ওর কাছে ফিজিক্স পড়তে যেত মাঝেমধ্যে। 

একদিন গিয়ে দেখল প্রিয়মের ধূম জ্বর। রুবিনা ছেলের জন্য ঝাল খাবার রান্না করছিলেন। প্রকৃতি গিয়েছিল ওর ঘরে। ছেলেটা কীসব বলছিল জ্বরের ঘোরে। ভীষণ মায়া হয়েছিল ওর। বিছানার কাছাকাছি গিয়েছে, তখনই শুনল, প্রিয়ম কাউকে খুঁজছে৷ যাকে সে ভালোবাসে। যে চোখে ডুবে যাওয়া যায়, এমন চোখের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে প্রিয়ম। 

নতুন এই আবিষ্কারে প্রকৃতির ভীষণ কষ্ট হয়েছিল প্রথমে। তারপর প্রিয়মকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন প্রকৃতি তা লুকাতে মরিয়া হয়ে পড়ে৷ অজুহাত হয়ে সামনে আসে পড়াশোনার ব্যস্ততা। এসএসসি পরীক্ষা বলে কারোর মনে প্রশ্নও জাগে না। এরপর দিন যত গড়িয়েছে, প্রকৃতি নিজেকে তত লুকিয়েছে। মনকে অন্তরালে রাখার মোক্ষম হাতিয়ার ছিল রুক্ষ ভাষার প্রয়োগ।  

প্রিয়ম যেন কোনোদিন জানতে না পারে, ওর দুর্বলতার একফোঁটাও যেন বুঝতে না পারে, তাই কখনো কাছেই আসতে দেয়নি, কাছে যায়ওনি। প্রিয়মও কখনো আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যায়নি। সে তখন ক্যামেরা আর সুনয়নার মোহে আচ্ছন্ন ছিল বোধহয়। থাক, তাতে প্রকৃতির কিছু যায় আসে না। আসলেই তাই! তাহলে আচমকা কোনো এক অলস দুপুরে মনের কোণে সে উঁকি দিয়ে যায় কেন! সে জানে না। তবে বরাবরের মতোই সে প্রশ্রয় দিতে চাইল না। 

"আসতে পারি মা?" 

আনোয়ার চিরন্তন হাসিতে দাঁড়িয়ে আছেন, "আরে বাবা, এসো তো।" 

বাবা এসে বসলেন প্রকৃতির পাশের চেয়ারে। 

"ব্যস্ত?" 

"একটু। তবে তোমার জন্য আমার অফুরন্ত সময়।" উদ্ভাসিত হেসে বলল প্রকৃতি। 

"তোর মন খারাপ মা?" 

"কই না তো?" 

"কিন্তু তোর মন খারাপ থাকলে তুই হাসলেও পুরো চোখ হাসে না। কী হয়েছে আমাকে বলা যায়?" 

"তুমি আমাকে এত বোঝো কীভাবে বাবা?" 

"তুই প্রকৃতি কন্যা। তোর জন্মের পরে পরে তোর মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন আমি তোকে সামলাতাম। কী ছোট্ট একটা পুতুল, যে হাসে, কাঁদে। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরতম দৃশ্য। যে প্রকৃতি আমাকে সবসময় বাইরে টানত, তুই আমাকে তার ডাক উপেক্ষা করালি। তোর মায়ের জন্য খানিকটা হয়েছিলাম, সেবার তোর মায়ায় আমি পুরোপুরি ঘরমুখো হলাম৷ তোকে বুঝব না!" 

"কিন্তু কথাটা তোমাকে এখন বলা যাবে না বাবা। ভীষণ ব্যক্তিগত। তুমি কিছু মনে করলে না তো বাবা?" 

"তুই বড় হয়েছিস মা। এটুকু প্রাইভেসি তোর প্রাপ্য। কেন জানিস? কারণ আমি জানি আমার মা কখনো আমাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না। এটুকু শিক্ষা আর বোধ তার আছে।"

প্রকৃতির মন ভালো হয়ে গেল, ভীষণ ভীষণ ভালো। শুধু বলল, "বাবা, তুমি কি জানো, তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা?" 

বাবা হাসলেন, প্রশ্রয়ের হাসি। 
............

প্রিয়ম বেশ কিছুদিন ধরে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন যাপন করছে। নিজেকে ঠিকঠাক চিনতে পারছে না। এতদিন নিজের কাছে সে ভীষণ স্বচ্ছ ছিল। আজ সব কেমন ঘোলাটে। 

সে তো বেশ ছিল এক পলক দেখা এক সুনয়নার সন্ধানে। স্বপ্নের পসরা সাজিয়েছিল বহুদিন ধরে। তাহলে সেদিন প্রকৃতিকে অন্যের পাশে হাস্যোজ্জ্বল দেখে এতদিনের চেনা চোখটা আড়াল হয়ে যেতে চাইছে কেন! তবে কি সে ভালোবাসতে পারেনি? ওর ভালোবাসার ভীত এতটা পলকা ছিল! তবে তো প্রিয়ম ভালোবাসতেই পারে না! প্রায় না দেখা স্বপ্নকন্যার প্রতি তীব্র অপরাধবোধে সে আচ্ছন্ন হলো। একরাশ হীনমন্যতা ওকে ঘিরে ধরলো। 

প্রিয়মকে দু'দিন ধরে বাইরে যেতে না দেখে রুবিনা চিন্তিত হলেন। যে ছেলের ক্যামেরা নিয়ে টো টো করে ঘোরা, ঘরে কম থাকা নিয়ে তিনি অভিযোগ তুলতেন, সেই ছেলের এমন আচরণ তাকে খানিকটা ভাবনায় ফেলে দিল। 

তিনি আজ খাবার সময় খেয়াল করলেন, প্রিয়ম হাত দিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করছে। খাচ্ছে না। 

"কী হয়েছে তোর?" 

"কিছু না তো মা।" 

"তাহলে খাচ্ছিস না কেন?" 

"খিদে নেই।" বলে আবারও খেতে চেষ্টা করল। 

"কী ঘোঁট পাকিয়েছিস রে?" 

"আমি ঘোঁট পাকাই? আমার নামে কোনো কমপ্লেইন পেয়েছ তুমি? টিচারদের কাছ থেকে? ফ্রেন্ডস এর কাছ থেকে?" 

"খুব গর্ব না নিজেকে নিয়ে? লায়েক হয়ে গেছিস? শোন, যত বড় হনুই হোস না কেন আমি কিন্তু তোর মা। তোকে পেটে ধরেছি, জন্ম দিয়েছি। আমার কাছে কিন্তু তুই সেই পুঁচকে আছিস। তাই ঝেড়ে কাশ তো।" 

প্রিয়ম বলতে পারল না। সে ভীষণ চাপা স্বভাবের ছেলে। নিজেকে সহজে প্রকাশ করতে পারে না। মা ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু। তবুও সে হৃদয়টা মেলে ধরতে পারল না। গহীন যাতনা সে নিজেই পুষতে চায়। তাছাড়া প্রকৃতি মা'য়ের অত্যন্ত স্নেহের। মা বিষয়টা কীভাবে নেবেন প্রিয়ম জানে না। প্রকৃতিকে নাকি সেই সুনয়নাকে? এমন কথায় মেয়েটাকে অসম্মান করা হতে পারে বলে মনে হলো। সে কাউকে অসম্মান করতে চায় না। 

সে চরম দ্বিধায় ভুগছে। অন্তর্দ্বন্দ্বে সে পুরোপুরি নাচার হয়ে আছে। নিজেকে বোঝার জন্য সময় প্রয়োজন। মনস্তাত্ত্বিক কলহ অসহ্য হয়ে উঠেছে প্রিয়মের কাছে।  

"মা, আমি কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। আমার প্রথম বড় কাজ। তুমি একা বাসায় কীভাবে থাকবে, তাই টেনশন হচ্ছিল।" 

রুবিনা বুঝলেন ছেলে এখন তাকে কিছু বলতে চায় না। ছেলে বড় হয়েছে, তার নিজস্ব কিছু ব্যাপার থাকতে পারে। তাই তিনি আপাতত নিরস্ত হলেন। 

"তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই কবে যাচ্ছিস?" 

"পরশু। তুমি কিন্তু সাবধানে থাকবে মা।"

"আমি তো বাসায়ই আছি। তুই সাবধানে যাবি। ওইদিকে পানির সমস্যা। তুই মিনারেল ওয়াটার সাথে রাখবি সবসময়। আমি তোর ব্যাগে স্যালাইন দিয়ে দেব। অযত্ন করবি না নিজের।" 

প্রিয়ম মৃদু হাসল। সে কাজে যাচ্ছে ঠিকই, তবে এ-ও সে জানে, সে আসলে কিছুদিনের জন্য পালাচ্ছে। সবকিছু থেকে, নিজের কাছ থেকেও। প্রিয়ন জানে না, নিজের কাছ থেকে কখনো পালানো যায় না!

"দোয়া কোরো।"

"দ্রুত ফিরবি কিন্তু।" 

"কথা তো হবেই মা। তোমার প্রেসক্রিপশনটা আমাকে দিও। আমি এক সপ্তাহ থাকব না। তোমার ওষুধগুলো কিনে দিয়ে যাব। ফুপুকে আসতে বলব। এই কয়দিন তোমার সাথে এসে থাকুক। ডায়াবেটিস বাড়িয়ে ফেলো না আবার।"

ছেলে তার জন্য চিন্তা করছে রুবিনা বুঝতে পারেন। তাই দ্বিমত করলেন না। নইলে দেখা যাবে তার চিন্তায় ছেলে কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। প্রশান্তির হাসি ফুটল তার মুখে, 

"বাপধন আমার, সব মনে থাকবে। তুই নিজে ঠিক থাকিস।"


প্রকৃতির এখন নিয়মিত ক্লাসটেস্ট নইলে এ্যাসাইনমেন্ট থাকছে। সময় কাটছে ব্যস্ততার মধ্যে। রাত দুইটা-তিনটা পর্যন্ত পড়াশোনা করছে। প্রতি সেমিস্টারে মনে হতো, সামনের সেমিস্টারে পড়া জমাবে না। শুরু থেকেই পড়ে ফাটিয়ে ফেলবে। কিন্তু সেটা কখনো হয়ই না। প্রতিবার পরীক্ষার আগে সেই একই চিত্র। এই শেষ সেমিস্টার ফাইনালের আগেও যা অপরিবর্তিত। শুরু থেকে গায়ে বাতাস লাগিয়ে চলা, আর পরীক্ষার আগে নাকেমুখে পড়াশোনা। ধূর, ভাল্লাগে না। 

চায়ে চুমুক দিল, বিস্বাদ লাগছে। অথচ এই ঘণ দুধের চা ওর বড্ড প্রিয়। অনেকটা সময় নিয়ে সে এই চা বানায়। হালকা গা গরম, জ্বর আসি আসি করছে। মা নির্ঘাত বকাঝকা শুরু করবেন। একসাথে এত প্রেসার নিয়ে পড়তে গিয়ে প্রতিবার পরীক্ষার আগে সে জ্বর বাধিয়ে বসে। 

একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। রথি পছন্দ করে মৃদুলকে। অনেক আগে থেকে। ওদিকে সেদিন মৃদুল এসে ধরেছে প্রকৃতিকে। যে করেই হোক, রথির মনোভাব জানতে। 

সে দুটোর একটাকেও কিছু বলেনি। মৃদুলকে বলেছে, "তুই নিজে বল। নিজে জানার চেষ্টা কর। ভীতু ছেলেদের কিন্তু মেয়েরা দু-চোখে সহ্য করতে পারে না।" 

"আচ্ছা প্রকৃতি, রথি কী কী পছন্দ করে জানিস? "রথির প্রিয় লেখক কে?
 "প্রিয় ফুল কী?" 
"প্রিয় বই কী?"
"কোন পারফিউম পছন্দ করে?" 

নানা প্রশ্নে জর্জরিত করেছে। বেচারা যদি জানত, রথি ওর জন্য আগে থেকেই উতলা হয়ে আছে, ওর অভিব্যক্তি কেমন হতো! 

প্রকৃতির মজা লাগছে, দু'জনের মনের কথাই সে জানে একমাত্র। ওরাও জানে না। সে চায় ওরা নিজেরাই নিজেদের আবিষ্কার করুক৷ তাতে আনন্দ আছে, সে এর ভেতরে নাক গলাতে চায় না। তাতে হয়তো দ্রুত কাছাকাছি আসবে, কিন্তু ধীরে ধীরে আবিষ্কারের যে আনন্দ তা নষ্ট হতে পারে। 

প্রকৃতি আজও আবার এসেছে ছাদে, ঘরে ফেরা দেখতে সূর্যের, পাখিদের, সেই সাথে প্রিয়মের। কিন্তু গত তিনদিনে ছেলেটাকে একবারও দেখতে পায়নি। এটুকুই ওর অজুহাত প্রিয়মকে দেখবার। বহুদিন ধরে সে এখানে বসে থাকে। না হওয়া প্রিয় মানুষকে এক পলক দেখবার জন্য।

কিন্তু নেই, কোথায় ছেলেটা? সেদিনের কথায় কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই। স্বাভাবিক, কষ্ট দেবার জন্য সে বলেনি, নিজেকে ঢাকবার প্রয়াসের সে বলেছিল, যেভাবে সবসময় বলত। 

বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে, সে নেমে এলো, বাতাসে শীত শীত লাগছে। জ্বরটা বেড়েছে। 
.............

প্রিয়মের সময়টা কাটল ভীষণ ব্যস্ততায়, ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখলে সে পুরো জগৎ ভুলে যায়। কিন্তু যেটুকু অবসর জুটল, সেটুকু সময়তে ওকে আচ্ছন্ন করে রাখল অসহ্য অস্থিরতার কালো মেঘ। 

এত অস্বস্তির মধ্যে কাজ ভালো হয়েছে ওটুকুই যা স্বস্তির। কাজ শেষে বাসায় ফিরে এলো। 

তিন-চারদিন পেরিয়ে গেলেও একদিনও প্রকৃতির দেখা পাওয়া গেল না। প্রায় সবসময় চোখের সামনে থাকা মেয়েটা হঠাৎই যেন ওকে তড়িৎ চৌম্বকীয় আকর্ষন বলে নিজের দিকে টানছিল। 

অনেকবার ভেবেছে মাকে জিজ্ঞেস করবে প্রকৃতি আসে কি-না। কিন্তু কী এক সংকোচ বোধ ওকে বাঁধা দিচ্ছিল। 

রুবিনা বুঝলেন ছেলে কিছু একটা নিয়ে ভাবিত। কিন্তু কী, তা বুঝতে পারলেন না। প্রিয়ম কখন বলবে সে-ই অপেক্ষায় থাকলেন, নিজে কোনো প্রশ্ন করলেন না। ছেলে বড় হয়েছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিক। তিনি তো সারাজীবন থাকবেন না। তবে তিনিও ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হলেন। 

প্রিয়মের সময় কাটছিল বিমর্ষতায়। এখনো সে নিজের কাছে স্পষ্ট হতে পারেনি। 

১০

প্রকৃতি জ্বরে কাহিল ছিল বেশ কয়েকদিন। ধুম জ্বর এসেছিল। এখন কিছুটা সুস্থ হলেও দুর্বলতা কাটেনি। পাশাপাশি পরীক্ষার পড়ার যানজট লেগে আছে। তাই ওর বাড়তি সময় নেই। সকালে একবার ছাদে উঠে গাছগুলোর পরিচর্যা করে আসে, কয়েকদিন এদেরও সময় দিতে পারেনি। সারাদিন আর ছাদে আসা হয় না। আজ ইউনিভার্সিটি যাবে। একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। না করলেই নয়।।

ওদিকে মৃদুল ফোন করেছিল, আজই সে রথিকে প্রপোজ করবে ছেলেটা। বেশ ভয়ে আছে। বন্ধু হিসেবে ওকে সাথে থাকতে বলেছে।

প্রথম ক্লাসটা ছিল শহিদুল্লাহ স্যারের। ভীষণ বোরিং ক্লাস। অনেকবার হাই তুলল। প্রায় ঘুম এসে যাচ্ছিল। বহু কষ্টে ঘুমকে রুখে দিয়েছে প্রকৃতি। দ্বিতীয় ক্লাসটা করার জন্যই সে মূলত এসেছে আজ। দুটো ক্লাস করে বেরিয়ে এলো। মৃদুল হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েছে বেরুতে। সে একটা ক্লাসও করেনি আজ। 

রথিও বেরিয়ে আসতে চাইছিল, প্রকৃতি বলল, "তুই ক্লাসটা কর। ইম্পর্ট্যান্ট টপিক পড়াবে। আমাকে ক্লাস খাতাটা দিতে পারবি পরে।" 

প্রকৃতি এসে দেখল মৃদুল লাল গোলাপ নিয়ে এসেছে। ওকে দেখে হেসে বলল, "বিশটা এনেছি। ঠিক আছে?" 

"ঠিক আছে। ফুল একটা হলেও সমস্যা নাই৷ বলার সময় সুন্দর করে বলবি। না বলতে পারলে হাজারটা ফুল হলেও লাভ নেই।" 

"এটাই তো সমস্যা। আমার না হাঁটু কাঁপছে। তুই একটু সুন্দর করে লিখে দে না, কীভাবে বলব!" 

প্রকৃতি রেগে বলল, "বুদ্ধু, আর্টিফিশিয়াল হয়ে যাবে মুখস্ত কথা বলতে গেলে। তুই যা ফিল করিস তাই বলবি। মন থেকে বলবি, যা বলবি তাতে যেন হৃদয়ের ছোঁয়া থাকে। তুই যে ওকে ভালোবাসিস, শুধু এটাই নাহয় বল, কিন্তু ও যে স্পেশাল ফিল করে। বুঝলি?" 

বলা শেষে ভরসার হাসি হাসল প্রকৃতি। তবুও পুরোপুরি নির্ভার হতে পারল না মৃদুল৷ উশখুশ করছিল। এরমধ্যেই দেখল রথি এদিকেই আসছে। মৃদুল হাতের ফুলগুলো ত্বরিতগতিতে পেছনে লুকিয়ে ফেলল। হৃদপিণ্ডে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে তুমুল গতিতে।  

"কীরে, তুই এখনো আছিস? আর মৃদুল, তুই ক্যাম্পাসে এসে ক্লাসে গেলি না কেন?"

মৃদুল কী করবে বুঝতে না পেরে প্রকৃতির দিকে তাকালে সে ইশারায় বুঝালে শুভক্ষণ উপস্থিত। 

মৃদুল রথির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে ফুলগুলো সামনে এনে বাড়িয়ে ধরল। কিন্তু মুখে কথা আসছে না। যেন বোবা হয়ে গেছে। অবশেষে অস্ফুটস্বরে কম্পিত গলায় বলল, 

"এটা তোর জন্য রথি। নিবি? কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না, আমার হাতটা ধরবি সারাজীবনের জন্য?" 

হতভম্ব রথি কিছুক্ষণ ভাষা খুঁজে পেল না। সে বুঝি বুঝতেও পারল না কী ঘটছে। পরিস্থিতি বুঝতে সে খানিকটা সময় নিল, যখন অনুধাবন করল, তখন চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। এই কান্নায় কোনো গ্লানি নেই, বরং প্রাপ্তি আছে এক পৃথিবী। 

"কী হয়েছে রথি? আমি কি তোকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?" মৃদুলের গলায় অস্থিরতা। 

রথি মৃদু হাসল, চোখে জল দিয়ে ঠোঁটের হাসিতে সে হয়ে উঠল অনন্যা। হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিল। মৃদুলের মনে হলো ফুলগুলো পূর্ণতা পেল। 

"এত সময় নিলি এটা বলতে? আমি বহুদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম তুই কবে বলবি।" 

মৃদুলের কপালের ভাজ সরল, উদ্ভাসিত হেসে বলল, "তুই আগে থেকেই আমাকে... তাহলে তুইও তো বলতে পারতিস।"

"জ্বি না জনাব, এটা ছেলেদের ডিপার্টমেন্ট। তোকেই বলতে হতো। শোন, আজ একসাথে এত ফুল দিয়েছিস মানে এটাই কিন্তু শেষ না। সপ্তাহে অন্তত একটা করে হলেও ফুল দিবি আমাকে। এরকম রক্ত গোলাপই দিতে হবে।"

মৃদুল রথির হাত ধরে বলল, "সারাজীবন দিতে চাই।" 

মুহূর্তটা এত সুন্দর, অদ্ভুত সুন্দর এই মুহূর্তের স্বাক্ষী হয়ে রইল প্রকৃতি। এমন আরাধ্য ক্ষণ সকলের জীবনে আসুক, পৃথিবীর সকল ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। মনে মনে কামনা করল প্রকৃতি। নিজের জন্য ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল কেবল। 

১১

একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষার কাঁটা প্রিয়মকে খোঁচাচ্ছিল। আজ সে নিজের পুরনো ক্যাম্পাসে এসেছিল। এরপর প্রকৃতির ডিপার্টমেন্টের দিকে গিয়েছিল। অনেকদিন দেখা হয় না। ভাবছিল আজ দেখা করবে। বাসায় তো দেখা হবার সুযোগ পাচ্ছে না। 

কিন্তু গিয়ে ওর পৃথিবী যেন থমকে গেল। সেদিনের সেই ছেলেটা একগুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, প্রকৃতি তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল হেসে হেসে। এরপরের দৃশ্য আর দেখার মতো মনোবল সে যুগিয়ে উঠতে পারেনি। দ্রুত পায়ে চলে এসেছে। সেই থেকে ছাদে এসে বসে আছে। ওকে সঙ্গ দিচ্ছে প্রকৃতির গাছগুলো। 

একসময় প্রকৃতি উঠে এলো ছাদে। এই পোশাকেই ছিল তখন। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেই হয়তো ওর প্রিয় গাছগুলোর খোঁজ নিতে এসেছে। প্রিয়ম অবুঝ রাগে বলল, 

"কেমন আছো প্রকৃতি?" 

প্রকৃতি দেখল চিরচেনা প্রিয়মের মধ্যে যেন আজ অন্য কেউ। ধীরস্থির ছেলেটার মুখাবয়ব জুড়ে একফোঁটা স্থৈর্য নেই যেন। 

"আপনি সুস্থ আছেন প্রিয়ম ভাই?" 

"ছেলেটার সাথে তোমাকে মানিয়েছে ভালো।"

"কোন ছেলে?" 

"কেন, যে তোমাকে লাল গোলাপ দিল। কিন্তু আমি জানি না, আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।" 

প্রকৃতি বুঝল প্রিয়ম বর্তমানে ঠিক প্রকৃতস্থ নয়। 

"প্রকৃতি, তুমি ওকে ভালোবাসো খুব?" 

প্রকৃতির খুশি হওয়া উচিত নাকি রেগে যাওয়া উচিত সে বুঝতে পারছিল না। বলল, 
"প্রিয়ম ভাই, আপনি একটু স্পষ্ট করে বলুন তো আপনার সমস্যাটা কোথায়?" 

"আমি নিজেও বুঝতে পারছি না আমার সমস্যাটা ঠিক কী! নিজেকে ভীষণ অচেনা লাগছে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট। আমার মনে হয়েছিল আমার সাথেও জিনিসটা ঘটেছে। ওকে আমি একবারই দেখেছিলাম। এরপর আর খুঁজে পাইনি। তবে অপেক্ষা করেছি এতগুলো দিন ধরে। কিন্তু তোমাকে ওইভাবে দেখে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম। আমার কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ এসে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।" 

অনেকবছর আগে যখন সে কিশোরী ছিল, তখন এমন স্বীকারোক্তি পেলে সে ভীষণ উৎফুল্ল হতো। খুশিতে পৃথিবী ভুলে যেত। কিন্তু আজ ওর রাগ হলো। ভীষণ ভীষণ রাগ। 

"প্রিয়ম ভাই, আপনাকে আমার এক্সপ্লেনেশন দেবার কিছু নেই। তবুও বলছি, মৃদুল আমার খুব ভালো একজন বন্ধু। আমার আরেকজন ভালো বন্ধু রথি। ওরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। আজ মৃদুল প্রপোজ করেছে। আমি ওকে সাহস দিয়েছি কেবল।" 

প্রিয়মের মুখাবয়ব আচমকা বদলে গেল। একটা সুখ সুখ অনুভূতি হলো ভেতরে। জগদ্দল পাথরটা সরে গেল। প্রকৃতি হারিয়ে যায়নি। খুশিটা প্রকাশ করতে গিয়ে বাঁধা পেল। প্রকৃতির মুখ কঠিন হয়ে আছে। 

"আমার কথা শেষ হয়নি, প্রিয়ম ভাই। আমি শেষ করি প্লিজ। আপনি এখনো কনফিউজড। আপনি কাকে চান তাও জানেন না। আমাকে অপশন হিসেবে চাইছেন এখন। যদি ওই মেয়েটাকে পেয়ে যেতেন আমি আপনার চাওয়ায় কখনোই আসতাম না। একটা মেয়েকে আপনি অপশন হিসেবে চাইছেন, বিষয়টা মেয়েটার জন্য কতটা অসম্মানজনক আপনি জানেন?"

"প্রকৃতি, আমি এখন..... "

"প্লিজ প্রিয়ম ভাই, আমি কিছুক্ষণ একলা থাকতে চাই ছাদে৷ যেহেতু ছাদটা আপনাদেরও, তাই আমি জোর দিয়ে বলতে পারছি না। আমি কি কিছুক্ষণ এখানে একলা থাকতে পারি?" 

প্রকৃতির দৃঢ়তায় প্রিয়ম আর কথা বলল না। অদ্ভুত এক বিষাদে ওর সমস্ত মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সে চাপা স্বভাবের মানুষ। নিজেকে প্রকাশ করতে শেখেনি। কীভাবে অনুভূতি গুছিয়ে বলতে হয় সে জানে না। ওর অগোছালো প্রকাশে অনিচ্ছা সত্বেও সে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। অথচ কত কী বলতে চেয়েছিল, সবই অব্যক্ত রয়ে গেল ওর বুকের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে। 

অবসন্ন প্রিয়ম সিঁড়ির কাছে গিয়ে একবার পেছনে ফিরে তাকাল। হাসিখুশি মেয়েটাকে গাম্ভীর্যের চাদর যেন আচ্ছাদিত করে রেখেছে। বুকে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে সে ফিরে এলো নিজের ঘরে। বিছানায় এলিয়ে দিল বিধ্বস্ত মনকে বেষ্টন করে রাখা আপাত অন্তঃসারশূন্য শরীরটাকে। 
.............

প্রিয়ম একমাস থাকল বাইরে বাইরে। বেশি করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাতে নয়টার পরে বাসায় ফিরে এসে রুবিনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে এরপর ছবি, ভিডিও এডিট করতে বসে। এরপর যখন শোয়, ঘুম আসে না। চোখের কোল জুড়ে সেই হরিণ চোখ দুটোও আর আসে না। একটা মুখ ভাসে, শান্ত সৌম্য, মায়াময় একটা স্নিগ্ধ মুখ। সেই শান্ত মুখ কখনো কখনো ভীষণ ক্ষ্যাপাটে হিসেবে আবির্ভূত হয় প্রিয়মের মানসপটে। 

চেনা মুখের রকম বদলে গেছে এখন। ওর মানসপটে ধরা দিচ্ছে অন্য রূপে। ভীষণ জ্বালাচ্ছে প্রকৃতি। মধুর যন্ত্রণায়। জ্বলতে ভালো লাগছে। এই একমাসে প্রকৃতির সামনে একবারও সে যায়নি। ওকে দেখেওনি। ইনফ্যাচুয়েশন নয়, এটা সে বুঝতে পেরেছে আরও আগে। তবে এবার সে কোনো ভুল করতে চায় না। নিজেকে প্রকাশ করতে চায় পরিপূর্ণ রূপে। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে সে। 

কিন্তু সমস্যা হলো, মেয়েটা ওকে ভুল বুঝেছে। আবার আরেকটা দ্বিধা আছে, ওর মনে যা আছে, প্রকৃতি ওকে সেভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত তো! যেভাবে ঝগড়া করে, তাতে মনে হয় প্রিয়মকে সে অপছন্দই করে। 

ছেলের মতিগতি বোঝা দায়, তাই একদিন রুবিনা রাতে খাবার পরে ওর ঘরে এলেন। 

"ব্যস্ত?"

"মা, ব্যস্ত হলেই কী? তোমার জন্য আমার অনেক সময় আছে।"

রুবিনা ছেলের বিছানার কাছে এসে বসলেন। 

প্রিয়মের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "তুই ইদানিং অন্যমনস্ক থাকিস। আগে তো এমন ছিলি না। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছিস?" 

"মা, কেউ যদি ভুল করে, সেটা শুধরানোর জন্য কী করা উচিত?" 

"ভুলটা কী সেটা না জানলে কীভাবে বলব?" 

"ধরো কারোর সাথে একটা ভুল এপ্রোচ করে ফেললে?" 

"সেই কারোর টা কি কোনো মেয়ে?" 

প্রিয়ম থমকে গিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। উত্তর দিতে গিয়ে ভীষণ লজ্জা পেল। গাল লাল হয়ে উঠল। কিন্তু কথা ফুটল না। 

"আমার ধারণা ঠিক তাহলে। বলেই যখন ফেলেছিস, এবার ঝেড়ে কাশ তো দেখি! এভাবে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।" 

প্রিয়ম ভীষণ ভদ্র ছেলে হিসেবে বড় হয়েছে। তাই নিজেকে সহজে মেলে ধরতে পারে না। কিন্তু মা ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু। কোনো সমস্যায় পড়লে সে সবসময় মা'র সাথে শেয়ার করে এসেছে। মা'য়ের কাছে মনে হয় একটা ম্যাজিক বক্স থাকে। যার ছোঁয়ায় সন্তানের মন এক তুড়িতে ভালো করে দিতে পারেন। তাই প্রিয়ম মনস্থির করল, এই সমস্যার কথাও সে মা'কে বলবে। অন্তত নিজেকে হালকা লাগবে। 

"মা, তুমি লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইটে বিশ্বাস করো?" 

"না। লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে আসলে কিছু হয় না৷ সেখানে কেবল একটা আকর্ষণ কাজ করে। সেই আকর্ষণ থেকে লোকে পরিচিত হয়, কথা বলে, এরপর জানাশোনা হয়, আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়৷ তারপর হয়তো ভালোবাসা আসে। সেটাকেই লোকে লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে বোধহয়।" 

প্রিয়মের মন থেকে একটা বিশাল পাথর ভার নেমে গেল, ভীষণ হালকা বোধ করল। 

"তুই প্রথম দেখায় কারোর প্রেমে পড়েছিস নাকি?" 

"তাই ভেবেছিলাম। বহুদিন তেমন ধারণা নিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, ওটা শুধুই একটা ইনফ্যাচুয়েশন ছিল। কারণ তাকে আড়াল করে দিচ্ছে অন্য কেউ।"

একগাল হাসলেন রুবিনা। এরপর বললেন, "তা মেয়েটি কে? নাম কী?" 

ইতস্তত করল প্রিয়ম, আরেকবার রাঙা হলো। এরপর ধীর স্বরে বলল, "ওকে তুমি চেনো মা। তোমার খুব কাছের একজন।" 

রুবিনা খানিকক্ষণ ভাবলেন, এরপর বললেন, "প্রকৃতি?" 

প্রিয়ম ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল৷ রুবিনা মনে মনে উচ্ছ্বসিত হলেন৷ মেয়েটাকে তার বড় পছন্দ। মনে মনে প্রিয়মের জন্য ওকে ভেবেছিলেন বটে। কিন্তু ছেলে যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে, সেজন্য কখনো মুখে আনেননি। পাছে তাকে আর প্রকৃতিকে অপ্রস্তুত হতে হয়! দুই পরিবারের এত ভালো সম্পর্কে যদি চিড় ধরে! এবার তার সেই চিন্তা দূরীভূত হলো। না, তার ছেলেও তার পছন্দে একাকার হয়েছে। তবে সেই উচ্ছ্বাস এখনই প্রকাশ করলেন না। 

"ভুল করেছিস কেন? তুই কী বলেছিস প্রকৃতিকে?" 

প্রিয়ম সেদিনের কথার সমস্তটুকুই মাকে খুলে বলল। 

রুবিনা বললেন, "এটা খুব স্বাভাবিক বাবা। এই বিষয়ে মেয়েরা সেনসেটিভ হয়। এখন যেহেতু তুই নিজের কাছে পরিষ্কার, তাই তোর ওর কাছেও সেটা প্রকাশ করে ফেল। দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।" 

"কিন্তু মা, ও যদি আমাকে পছন্দ না করে!" 

"তোকে পছন্দ করবে না কেন? তুই অপছন্দ করার মতো ছেলেই নোস। খালি একটু কাঠখোট্টা। আবার লাজুক।"

মায়ের দুষ্টুমিতে হতাশ বোধ করল প্রিয়ম। বলল, "মা, তুমি মজা করছো?" 

"আরে গাধা, ও যদি তোকে পছন্দ না-ই করত, তাহলে সরাসরি বলেই দিত সেদিন। তোকে নিজের কাছে আগে ক্লিয়ার হতে বলত না। ও ভীষণ সোজাসাপটা কথা বলে। নিজের অপছন্দও বলত। কিন্তু বলেনি, তুই এভাবে বলায় দুঃখ পেয়েছে। বোঝায় যায় তোর কাছে ওর কিছু এক্সপেকটেশন ছিল। সেটা পূরণ হয়নি বলে মন খারাপ করেছে।" 

"তুমি সত্যি বলছো মা?" 

"মেয়েরা সব কথা মুখ ফুটে বলে না সবসময়। তাদের কিছু কথার মানে একটু মাথা খাটিয়ে বের করতে হয়। তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছি। কিচ্ছু হবে না তোকে দিয়ে।"

"মা, এভাবে বলছ কেন? আমি..." থেমে গিয়ে প্রিয়ম আবার বলল, "মা, আমি কি করব এখন?" 

"সেটা তো আমি তোকে বলে দেব না। ওটা তোর নিজেকেই বের করতে হবে। ওর অভিমান হয়েছে। অভিমান ভাঙা। আমি এই বিষয়ে প্রকৃতির দলে।"

"এখনই দলাদলি শুরু করেছ?" 

"করলাম। মেয়েটা আমার মতো গাছ ভালোবাসে। খুব ভালো মেয়ে।"

"ভালো মেয়ে? আমার সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া করে সেটা তোমার চোখে পড়ে না?"

"তা ভালো যদি নাই হয়, ওই ঝগড়াটে মেয়ের প্রেমে পড়লি কেন চিৎপটাং করে?" 

"কী জানি? ওটাই হয়তো আমার ভালো লাগে।" অস্ফুটস্বরে অবচেতনে কথাটা বলল প্রিয়ম৷ এরপর আরেকদফা লজ্জা পেল। কী একটা অবস্থা, আজ বোধহয় ওর লজ্জা পাবার দিন। 

মা সশব্দে হাসলেন। এরপর বললেন, 'ঘুমা গাধা পুত্রধন। এরপর সুস্থির হয়ে একটা গেম প্ল্যান সেট করে। প্ল্যান এ, প্ল্যান বি, প্ল্যান সি রেডি কর। একটা ফেইল করলে অন্যটা যাতে কাজে লাগে৷ ঢাল ত"লো"য়ার নিয়ে নামিস মাঠে।"

প্রিয়মও এবার হাসল মায়ের রসিকতায়। অনেকদিন পর সে স্বস্তি পেল। ঘুমটাও চমৎকার হলো। 

১২

প্রকৃতির পরীক্ষা চলছে। প্রিপারেশন অনুযায়ী ভালোই হচ্ছে বলা যায়৷ আর দুটো পরীক্ষা আছে। পরের পরীক্ষার আগে বেশ বড় গ্যাপ পড়েছে। তাই আজ ছাদে এসেছে। কিন্তু এসে দেখল প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে৷ 

ওকে দেখে হাসল, "তোমার এক্সাম কেমন হচ্ছে?"

"আমার এক্সাম খারাপ হয় না। পড়াশোনা করি তো।" 

"তোমার সময় হবে এখন? একটু কথা বলতাম।" 

"আমার গাছগুলো অনেকগুলো দিন আমাকে দেখেনি। ময়নার মা'কে দেখেছে। তার যত্নের নমুনা আমি জানি।" 

"তোমার গাছের অযত্ন হয়নি। দেখতে পারো।" 

প্রকৃতি ঘুরে ঘুরে দেখল, এরপর প্রিয়মের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, "আপনি আমার গাছের পরিচর্যা করেছেন কেন?" 

"তোমার ভালোলাগাগুলো আমারও ভীষণ ভালো লাগছে ইদানিং। তাই। আমরা দু'জনে মিলে পুরো ছাদ আর বাড়ির আশেপাশে ছোটখাটো একটা অরণ্য বানাবো ভাবছি। তাতে অনেক লম্বা সময় প্রয়োজন। আমাকে এর সুযোগ দেবে?"

এমন অদ্ভুত প্রেমের প্রস্তাব প্রকৃতি কোনোদিন পায়ওনি, আশেপাশে দেখেছে বা কারোর কাছে শুনেছে বলেও মনে পড়ে না। তবুও সে গলে গেল না। কাঠিন্য বজায় রেখে বলল, 

"আপনার কনফিউশন?" 

"নেই। সেখান শুধু তুমি আছো।"

"আমিও যে কেবল কনফিউশান নই, কী করে বুঝব? প্রমাণ চাই আমার।"

"কীভাবে প্রমাণ করতে হবে?"

"সেটা তো আমি বলে দেব না। যদি আপনার এক্টিভিটিজ আমাকে স্যাটিসফাই করে তবেই সুযোগ পাবেন।" 

প্রিয়ম জানত এই মেয়ে এত সহজে রাজি হবে না। ওকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে চাইছে। তা চাক, রিজেক্ট তো এখনো করেনি। সে অবশ্যই উপায় বের করে ফেলবে। উপায় বের করতে আদাজল খেয়ে লাগবে। 
..........

প্রকৃতি পরীক্ষা দিতে গেছে আজ। প্রিয়ম ছাদে বসে আছে মেয়েটা কখন ফিরবে সেই তার প্রতীক্ষায়। প্রিয়ম জানে না, পাশার দান ঘুরে গিয়ে প্রকৃতির জায়গায় আজ সে চলে এসেছে। সময়টা পাল্টেছে অবশ্য, সে এসেছে খটখটে দুপুরবেলায়। এই একই জায়গায় বহুদিন ধরে মেয়েটা ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকত। প্রিয় ক্ষণে প্রিয় গাছগুলোর সাথে প্রিয় মানুষের ঘরে ফেরার স্বাক্ষী হতো প্রকৃতি। 

জানলে হয়তো আজকের ভয়াবহ টেনশন হতো না ওর। আজ প্রিয়মের ভালোবাসা জয়ের পথে এগিয়ে যাবার দিন। তবে এই ভালোবাসার বীজ ওর মধ্যে কবে, কখন বপন করা হয়েছে সে জানে না। হয়তো বহু আগে, সে-ই বুঝতে দেরি করে ফেলেছে। নয়তো অন্য কাউকে পাশে দেখে ভেতরে ভেতরে পুড়ছিল কেন! 

এই কয়েকদিনের ওকে না দেখা সময়ের ব্যপ্তি যেন অসীম। এর শেষ নেই, দীর্ঘ একাকিত্ব মনে হচ্ছে প্রিয়মের জন্য। অপেক্ষার সময় এত দীর্ঘ হয় কেন! অথচ একসাথে কাটানো সময়গুলো, ঝগড়া আর খুঁনসুটিতে কবেই চোখের নিমিষে ফুরিয়ে গেছে। 

পায়ের শব্দে সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল আনোয়ার সাহেব এসেছেন। 

"আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।"

"ওয়ালাইকুম আসলাম। কেমন আছো? তোমার ফটোগ্রাফি কেমন চলছে ইয়াং ম্যান?" 

"ভালো আঙ্কেল।"

আশেপাশে অনেকগুলো নতুন টব দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "প্রকৃতি তো পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। এসবের সময় পায়নি। এসব..." 

"আমি এনেছি আঙ্কেল।" ইতস্তত করে বলল প্রিয়ম। 

"বাহ্! তুমি ক্যামেরা প্রীতির পাশাপাশি বৃক্ষপ্রেমী হয়ে গেছ দেখে ভালো লাগল।" 

প্রিয়ম অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল। মনে মনে বলল, "প্রকৃতি প্রেমীও হয়েছি।" 

"এত আয়োজন যে, কোনো বিশেষ ব্যাপার আছে নাকি আজ?" 

প্রিয়ম দপ করে নিভে গেল, মেয়েকে পটানোর আগে যদি মেয়ের বাবাকে পটানোর প্রয়োজন হয়, পরিস্থিতিটা কেমন ভয়াবহ হয় তাই হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছে প্রিয়ম। 

সে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না, কী বলবে। আনোয়ার অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালেন ওর চোখের দিকে। প্রিয়ম চোখ নামিয়ে নিল। ওর অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে কিছু একটা যেন আঁচ করতে পারলেন তিনি। 

"তুমি কারো জন্য অপেক্ষা করছ? বিশেষ কেউ যার এই সময় ছাদে আসবার কথা?" 

প্রিয়মের ইচ্ছে হলো বলতে, ধরণী দ্বিধা হও। এভাবে ধরা পড়ে যেতে হলো। ওর মুখ কী খোলা বই? তাহলে প্রকৃতি ওকে পড়তে পারছে না কেন! 

একটা মাদুর বিছিয়ে রাখা। তার পাশে ব্যানারের মতো একটা জিনিস উনার চোখে পড়ল। তাতে লেখা, "প্রকৃতি কণ্যা, তোমার বৃক্ষছায়াকে গ্রহণ করো। দাবি না মানা পর্যন্ত আমরণ অনশন চলবে এই ছাদে।" 

"বেস্ট অফ লাক ইয়াংম্যান। আমার মেয়েটার আসার সময় হলো বলে।" 

প্রিয়মের এত বছরের জীবনে এমন অবস্থায় জীবনে কোনোদিন পড়েনি। কী বলতে হবে তাই বুঝতে পারছে না। এই সময় ইনি ছাদে এসে উপস্থিত হবেন, এটা ওর মাথায় ছিল না একেবারে। ওর এই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে৷ সুপার হিউম্যান হলে ভালো হতো, অদৃশ্য হবার সুপার পাওয়ার থাকা সুপার হিউম্যান। তবে হয়তো এমন লজ্জাস্কর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলত। 

"আমি ঘরে ওর জন্য অপেক্ষা করি। ওকে ছাদে দ্রুত পাঠাব নাকি দেরি করিয়ে দেব?" 

"আঙ্কেল, আসলে, মানে আমি... আমার... ওই যে.. আসলে..." 

"আমাকে এত ভয় পাবার কারণ নেই ইয়াং ম্যান। তবে ওকে ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ আছে। আমিও পাই মাঝেমধ্যে। লেগে থাকো৷ আসি।" 

প্রিয়মের মাথায় হাত দিলেন পরম স্নেহে। এরপর উদ্ভাসিত হেসে তিনি নেমে গেলেন। এই ছেলেটাকে তার ভীষণ পছন্দ। ভদ্র, সৌম্য একটা ছেলে। অন্যকে যথাযথ সম্মান দিতে জানে। এর সাথে তার মেয়ে ভালো থাকবে। 

মেয়েকে তিনি খুব ভালো বুঝতে পারেন। মেয়েরও যে অমত নেই, তা তিনি জানেন। তারুণ্যের মধ্যে এমন একটু আধটু পাগলামি থাকা বোধহয় মন্দ নয়। এতে কোনো ভণিতা যে নেই সেটা বোঝার মতো যথেষ্ট প্রাজ্ঞ তিনি। 

স্ত্রীর সাথে কথা বলে এরপর চার হাত এক করে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। 

প্রকৃতির বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল প্রিয়মের। 
এরমধ্যেই দেখল বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ উপস্থিত। ওই তো ফিরছে সে। হেলেদুলে গেটের ভেতরে ঢুকল প্রকৃতি। দুরুদুরু কেঁপে উঠল প্রিয়মের ভেতরটা। 

১৩

ছাদের মেঝেতে একটা মাদুর বিছিয়ে রেখেছিল প্রিয়ম। সেখানে বসল সে হাত পা ছড়িয়ে। 

প্রকৃতি ছাদে এসে হতভম্ব হয়ে গেল। 

"এসব কী পাগলামি?" 

"ভালোবাসায় এটুকু পাগলামি হয়ই। আমার এখন কিন্তু কোনো কনফিউশন নেই।"

দেখল একদিকে কতগুলো গোলাপের চারা, সবগুলোতে আধফোঁটা গোলাপ। আরও কয়েক ধরনের গাছপালা। 

"গাছের চারা দিয়ে প্রপোজ করছেন?" 

"ওগুলো ভালোবেসে এনেছি।"

"এই অনশনের পাগলামি কতদিন চলবে?" 

"যতদিন আমাকে একা থেকে দোকা না হব।" প্রকৃতির কঠিন চোখে তাকিয়ে হেসে নির্ভয়ে বলল প্রিয়ম। 

"যা খুশি করুন।" বলেই নেমে গেল প্রকৃতি। 

প্রিয়ম করুণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল। এখন থেকে পিছিয়ে আসার উপায় নেই। সে অনশন কর্মসূচিতে ঠিকঠাক মতো বসল। 

সময় গড়াতে থাকল। কঠিন হৃদয় গলল না। তৃষ্ণা পাচ্ছে, কিন্তু সে পণ করেছে পানিও খাবে না। এরমধ্যে এই বাড়ির সবাই এসে ওকে দেখে গেছে, ভাড়াটিয়ারাও। এমন অভিনব ঘটনা ঘটতে কেউই দেখেনি। শুধু যার আসার সেই আসছে না। 

গুণে গুণে তিন ঘণ্টা বত্রিশ মিনিট পরে সে আরেকবার এলো। প্রিয়মের চোখ স্থির হয়ে গেল। শাড়ি পরেছে মেয়েটি। টিয়া রঙের শাড়িটায় ঠিক প্রকৃতি কন্যা বলে ভ্রম হলো। গোধূলির লালচে সূর্যের আভা পুরোটাই যেন মেয়েটার গালে আদুরে পরশ বুলিয়ে গেল। কপালে কালো একটা টিপ, খোলা চুলগুলো মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে। হাতে একটা ট্রে। 
 তাকিয়ে আছে তার প্রতিটা পদক্ষেপে। স্বপ্নের মতো সুন্দর একটা ক্ষণ। এমন ক্ষণ পেতে সে বহুযুগ অনশন করতে রাজি৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে মোহাচ্ছন্ন প্রিয়ম। 

নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখল, ঘটনা সত্যি কি-না। চিমটিটা কিঞ্চিৎ জোরেই হয়েছে। ব্যথায় বুঝল, এই ক্ষণ স্বপ্ন নয়। বরং স্বপ্নময় বাস্তবতা। 

প্রকৃতি রাগী গলায় বলল, "এই যে ফটোগ্রাফার সাহেব, সারাদিন ধরে অনেক রঙঢঙ সহ্য করেছি। এখন উঠে আসুন তো। পুরো বাড়িসুদ্ধ সব্বাইকে এই পাগলামির জানান দিয়ে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলার খুব দরকার ছিল?" 

"আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি, যে পৃথিবীর স্নিগ্ধ সুন্দরতম প্রকৃতির মতোই সুন্দর। আমার সাধ্য থাকলে শুধু এই বাড়ি কেন পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিতাম৷" 

"মেলোড্রামা।"

"হলে হোক। প্রেমে মেলোড্রামা থাকা স্বাভাবিক এবং মার্জনীয়।"

প্রকৃতি পাশে ট্রে রেখে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "উঠে এসো মিস্টার ফটোগ্রাফার। অনশন ভাঙার সময় হয়েছে।" 

প্রিয়মের এখনো বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হচ্ছে যে এমন মিষ্টি আদুরে ক্ষণ ওর জীবনে এসেছে। তাই টপ করে হাত ধরতে পারল না। 

"দাবী আদায় হয়েছে কিনা বুঝব কী করে?" 

"এরপরও বোঝোনি? হাতটা ধরো, প্রিয়ম।" 

এমন প্রেমময় আহ্বান এড়ানোর মতো শক্তি কোনো প্রেমিকের থাকে না। প্রিয়মেরও নেই৷ 

মোহাচ্ছন্ন প্রিয়ম প্রকৃতির হাত ধরতে অপার্থিব প্রশান্তিতে ভেতরটা আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। হাত ধরে উঠে এগুতে গিয়ে একটা অঘটন ঘটল। প্রকৃতির প্রিয় দোলনচাঁপা গাছের একটা টব ভেঙে পড়ল প্রিয়মের গায়ের ধাক্কা লেগে। 

প্রকৃতি আগুন চোখে তাকাল৷ তবে তার উত্তাপ আজ ভালোবাসায় ঢেকে গেছে। প্রকৃতির চোখে কাজল নেই৷ তবুও ভীষণ গভীর। চোখ কালো হরিণ না হোক, প্রকৃতির চোখে ডুবে যাওয়া যায় অনায়াসে। 

ভালোবাসার একটা সমুদ্র ধারণ করতে পারে ভালোবাসাময় একজোড়া চোখ, চোখের গঠন যেমনই হোক। সেই সমুদ্র গভীর চোখের অথৈ জলে প্রিয়ম ডুবে গেল আকুণ্ঠ ভালোবাসায়।

(সমাপ্ত)

No comments