কামরূপিণী – রাজশেখর বসু
শীতকাল, বিকাল বেলা। শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেনে একটি দল গঙ্গার কাছে মাঠের উপর শতরঞ্জি পেতে বসেছেন। দলে আছেন—
প্রবীণ অধ্যাপক নিকুঞ্জ ঘোষ, তাঁর স্ত্রী ঊর্মিলা, মেয়ে ইলা, বয়স পনরো।
নিকুঞ্জর শালা নবীন অধ্যাপক বীরেন দত্তর স্ত্রী সুরুচি, আর তার ছেলে নুটু, বয়স ছয়।
বৃদ্ধ শীতল চৌধুরী। বীরেন দত্তের সঙ্গে এঁর কি একটা দূর সম্পর্ক আছে। ছোট বড় নির্বিশেষে সকলেই এঁকে শীতুমামা বলে ডাকে।
বীরেন দত্তর আসতে একটু দেরি হবে। তাঁর নববিবাহিত বন্ধু মেজর সুকোমল গুপ্ত সম্প্রতি তাঁর স্ত্রী আর শাশুড়ীর সঙ্গে আসাম থেকে কলকাতায় এসেছেন। বীরেন তাঁদের নিয়ে আসবে।
শীতল চৌধুরী বললেন, তোমাদের এ কি রকম পিকনিক? খাবার জিনিস কিছুই সঙ্গে আন নি, শুধু হাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরতে হবে নাকি?
সুরুচি বলল, ভয় নেই শীতুমামা। ওঁর সঙ্গে সবই এসে পড়বে, সস্ত্রীক সশাশুড়ীক মেজর সুকোমল গুপ্ত আর দেদার খাবার। গুপ্তর বউ আর শাশুড়ী নিজের হাতে সব খাবার তৈরী করে আনবেন। বউভাতের ভোজটা আমাদের পাওনা আছে, এখানেই খাওয়াবেন।
নুটু বলল, ও শীতুমামা, কাল যে গল্পটা বলছিলে তা তো শেষ হয় নি। খেতে অনেক দেরি হবে, ততক্ষণ গল্পটা বল না।
শীতুমামা বললেন, আচ্ছা বলছি শোন।—তার পর রাজা তো খুব সানাই ভেঁপু রামশিঙা ঢাক ঢোল জগঝম্প বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে সুয়োরানীকে বিয়ে করে রাজবাড়িতে নিয়ে এলেন। পঞ্চাশটা শাঁখ বেজে উঠল, রাজার মাসী পিসী মামীরা খুব জিব নেড়ে হুলুলুলু করলেন। বেচারী দুয়োরানী মনের দুঃখে তাঁর খোকাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন। এখন, সেই সুয়োরানীটা ছিল রাক্কুসী। সাত দিন যেতে না যেতে রাজার কাছে খবর এল—হাতিশালায় হাতি মরছে, ঘোড়াশালায় ঘোড়া মরছে, শুধু তাদের হাড় দাঁত আর ন্যাজ পড়ে আছে।
নুটু বলল, সুয়োরানী ওসব চিবুতে পারে না বুঝি?
নুটুর মা সুরুচি ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর খোকা, ও ছাই গল্প শুনতে হবে না। শীতুমামা, আপনি এইসব বিদকুটে গল্প কেন বলেন? এতে ছোট ছেলেদের মনে একটা খারাপ ছাপ পড়ে।
নিকুঞ্জ ঘোষ হেসে বললেন, আরে না না। সব দেশেরই রূপকথায় একটু উৎকট ব্যাপার থাকে, তাতে ছোট ছেলেমেয়ের কোনও অনিষ্ট হয় না। তারা বেশ বোঝে যে সবই বানিয়ে বলা হচ্ছে। নয় রে নুটু?
নুটু বলল, হুঁ। আমিও গল্প বানাতে পারি।
সুরুচি বলল, যাই হ’ক, শীতুমামা, আপনি ওসব বেয়াড়া মিথ্যে গল্প বলবেন না।
শীতুমামা বললেন, বেশ, মা—লক্ষ্মীর যখন আপত্তি আছে তখন বলব না। নুটু তুই বরং তোর মায়ের কাছে রামায়ণের গল্প শুনিস, শূর্পনখা রাক্কুসীর কথা, খুব ভাল সত্যি গল্প। কিন্তু একটা কথা তোমাদের জানা দরকার। রূপকথার সবটাই মিথ্যে এমন বলা যায় না। যা ঘটে তাই কতক কতক রটে।
নিকুঞ্জ—পত্নী ঊর্মিলা বললেন, আচ্ছা, শীতুমামা, রাক্কুসী সুয়োরানী, পাতালপুরীর রাজকন্যা, সোনার কাঠি রুপোর কাঠি, কামরূপ—কামিখ্যের মায়াবিনী যারা ভেড়া বানিয়ে দেয়—এ সবে আপনি বিশ্বাস করেন?
—কিছু কিছু করি বইকি, বিশেষ করে ওই ভেড়া বানাবার কথা যা বললে।
নিকুঞ্জ—কন্যা ইলা বলল, ভেড়ার কথাটা খুলে বলুন না শীতুমামা।
—নাঃ থাক। নুটুর মায়ের যখন আপত্তি।
নিকুঞ্জ ঘোষ বললেন, লোকের কৌতূহলে খোঁচা দিয়ে চুপ করে থাকা ঠিক নয়, খোলসা করে বলে ফেলাই ভাল।
সুরুচি বলল, বেশ তো, শীতুমামা, ভেড়ার গল্পটা খোলসা করেই বলুন, কিন্তু বেশী বেয়াড়া কথাগুলো বাদ দেবেন।
শীতুমামা বললেন, নাঃ থাক গে। বরং একটু ভগবৎপ্রসঙ্গ হ’ক। ইলা ভাই, তুমি একটু রবীন্দ্রসংগীত গাও, সেই ‘মাথা নত করে দাও’ গানটি।
সুরুচি বলল, অত মান ভাল নয় শীতুমামা। আমি মাপ চাচ্ছি, আপনি ভেড়ার গল্প বলুন।
নুটু বলল, না, আগে সেই রাক্কুসী সুয়োরানীর গল্প হবে।
সুরুচি বলল, তুই থাম খোকা। রাক্কুসীর চাইতে ভেড়াওয়ালী ভাল। বলুন শীতুমামা।
শীতল চৌধুরী বলতে লাগলেন—
পঁচিশ বৎসর আগেকার কথা। বলভদ্র মর্দরাজকে তোমরা চিনবে না, তার বাপ রামভদ্র মর্দরাজ বালেশ্বর জেলার একজন বড় জমিদার ছিলেন, রাজা বললেই হয়। তাঁর এস্টেটে আমি তখন কাজ করতুম। বলভদ্রর বয়স ত্রিশের নীচে, সুপুরুষ, মেজাজ ভাল, শিকারের খুব শখ। একদিন সে আমাকে বলল, ও শীতলবাবু, কেবলই সেরেস্তার কাজ নিয়ে থাকলে তোমার মাথা বিগড়ে যাবে। বাবাকে বলে তোমার বিশ দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে দিচ্ছি, আমার সঙ্গে কিমাপুর চল, উত্তর—পূর্ব আসামে, খাস জায়গা, দেদার শিকার। সেখানে আঠারো—শিঙা হরিণ পাওয়া যায়, আকারে খুব বড় নয়, কিন্তু শিঙ দুটো অতি অদ্ভুত, প্রত্যেকটার নটা ফেঁকড়া।
সব খরচ বলভদ্র যোগাবে, আমার কাজ হবে শুধু মোসাহেবি, সুতরাং রাজী হলুম। কিমাপুর জায়গাটা একটু দুর্গম, ব্রহ্মপুত্রের ওপারে ভুটান রাজ্যের লাগোয়া, তবে কামরূপ জেলাতেই পড়ে। পথ ভাল নয়, কোনও রকমে মোটর চলে। শিকারী বলে বলভদ্রর খুব খ্যাতি ছিল, সহজেই আসাম গভর্নমেন্টের কাছ থেকে সব রকম দরকারী পারমিট পেয়ে গেল। একটা বড় হডসন মোটর গাড়ি অনেক খাবার জিনিস, ড্রাইভার, আর একজন চাকর নিয়ে আমরা কিমাপুর ডাকবাংলায় উঠলুম। রোজই শিকারের চেষ্টা হত, নানা রকম জানোয়ারও পাওয়া যেত কিন্তু আঠারো—শিঙা হরিণের দেখা নেই। ওখানকার লোকরা বলল, আরও উত্তরে জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যাবে। খানিক দূর পর্যন্ত কোনও রকমে মোটর চলবে, তার পর হেঁটে যেতে হবে।
সকাল আটটার সময় আমরা যাত্রা করলুম। গাড়িতে বলভদ্র, আমি, ড্রাইভার কিরপান সিং, আর তার পাশে একজন ভুটিয়া, সে পথ দেখাবে। রাস্তা অতি খারাপ, দু বার টায়ার পাংচার হল, তিন মাইল যেতেই বেলা এগারোটা বাজল। গরম বেশ, খিদেও পেয়েছে খুব, আমরা বিশ্রামের উপযুক্ত জায়গা খুঁজছি, এমন সময় দেখতে পেলুম গাছের আড়ালে একটি সুন্দর ছোট বাংলা। আমরা একটু এগিয়ে যেতেই সেই বাংলা থেকে একটি অপূর্ব সুন্দরী বেরিয়ে এলেন। নিখুঁত গড়ন, খুব ফরসা, তবে নাক একটু খাঁদা আর চোখ পটল—চেরা নয়, লংকা—চেরা বলা যেতে পারে। আমরা নমস্কার করে নিজেদের পরিচয় দিলুম। সুন্দরী জানালেন, তাঁর নাম মায়াবতী কুরুঞ্জি, এখন একলাই আছেন, তাঁর সঙ্গিনী মাসীমা চাকরকে নিয়ে কিমাপুরের হাটে গেছেন। মায়াবতী খাঁটী বাংলাতেই কথা বললেন, তবে উচ্চারণে একটু আসামী টান টের পাওয়া গেল তাঁর সাদর আহ্বানে কৃতার্থ হয়ে আমরা আতিথ্য স্বীকার করলাম।
বলভদ্র মর্দরাজের ভঙ্গী দেখে বোঝা গেল সে প্রথম দর্শনেই প্রচণ্ড প্রেমে পড়েছে, তার কথার সুরে গদগদ ভাব ফুটে উঠেছে। আমাদের ভুটিয়া গাইড লাদেন গাম্পা চুপি চুপি আমাকে বলল, ওই মেমসাহেবটা ভাল নয়, পালিয়ে চলুন এখান থেকে। কিন্তু তার কথা কে গ্রাহ্য করে। বলভদ্র প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আর আমিও মুগ্ধ হয়ে গেছি।
মায়াবতী আমাদের খুব সৎকার করলেন। বললেন, আঠারো—শিঙা হরিণের সীজন এখন নয়, তারা শীতকালে পাহাড় থেকে নেমে আসে। মিস্টার মর্দরাজ আর মিস্টার চৌধুরী যদি দু মাস পরে আসেন তখন নিশ্চয় শিকার মিলবে। আমরা বহু ধন্যবাদ এবং আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলুম।
পথে গোটাকতক পাখি মেরে আমরা কিমাপুরে ডাকবাংলায় ফিরে এলুম। তার পর দিন বলভদ্র আবার মায়াবতীর কাছে গেল, শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় আমি বাংলাতেই রইলুম। অনেক বেলায় ফিরে এসে বলভদ্র বলল, শোন শীতলবাবু, আমি ওই মিস মায়াবতীকে বিয়ে করব, পনেরো দিন পরে ওকে নিয়ে কলকাতায় যাব। তুমি কালই চলে যাও, বালিগঞ্জে একটা ভাল বাড়ি ঠিক করে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। আমি অনেক বোঝালুম, অজ্ঞাতকুলশীলাকে হঠাৎ বিয়ে করা উচিত নয়, তার বাবাও তা পছন্দ করবেন না। কিন্তু বলভদ্র কোনও কথা শুনল না, অগত্যা আমি পরদিনই কলকাতায় রওনা হলুম।
পনরো দিন পরে বলভদ্রের ড্রাইভার কিরপান সিং আমার কাছে এসে খবর দিল—বলভদ্র হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছে, কোথায় গেছে কেউ জানে না, মেমসাহেব মায়াবতীও বলতে পারলেন না। জেরা করে জানলুম, চার দিন আগে গাড়িটা বিগড়ে যাওয়ায় বলভদ্র সকালবেলা মায়াবতীর কাছে হেঁটে গিয়েছিল। মনিব ফিরে এলেন না দেখে পরদিন কিরপান সিং খোঁজ নিতে গেল। গিয়ে দেখল, সেখানে শুধু মায়াবতী আর তাঁর বুড়ী মাসী আছেন। তাঁরা বললেন, বলভদ্র গতকাল সকালে এসেছিলেন বটে, কিন্তু এখান থেকে কোথায় গেছেন তা তাঁরা জানে না। কিরপান সিং আরও দেখল, একটি বাদামী রঙের নধর ভেড়া বারান্দার খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে, একটা ধামা থেকে ভিজে ছোলা খাচ্ছে।
সুরুচি বলল, শীতুমামা, আপনি কি বলতে চান, সেই ভেড়াটাই বলভদ্র মর্দরাজ?
—আমি কিছুই বলতে চাই না। যা শুনেছি তাই হুবহু জানালাম, বিশ্বাস করা না করা তোমাদের মর্জি।
নুটু বলল, শীতুমামা, ভেড়াটা ছোলা খাচ্ছিল কেন? সেখানে বুঝি ঘাস নেই?
ইলা বলল, বুঝলি না খোকা, গ্রাম—ফেড মটন তৈরি হচ্ছিল। উঃ আপনি খুব বেঁচে গেছেন শীতুমামা।
এই সময়ে সুরুচির স্বামী বীরেন দত্ত এবং তার সঙ্গে দুটি মহিলা এসে পৌঁছুলেন। খাবারের ঝুড়ি নিয়ে দুজন অনুচরও এল। মহিলাদের একজনের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, আর একজনের বাইশ—তেইশ। দুজনেই অসাধারণ সুন্দরী, যদিও চোখ আর নাক একটু মঙ্গোলীয় ছাঁদের।
বীরেন দত্ত পরিচয় করিয়ে দিল— ইনি হচ্ছেন সুকোমল গুপ্তর শাশুড়ী ঠাকরুন মিসিস মায়াবতী মর্দরাজ, আর ইনি সুকোমলের স্ত্রী মিসিস মোহিনী গুপ্ত। আমাদের আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে, এঁরা অনেক রকম খাবার তৈরি করলেন কিনা।
ইলা ফিসফিস করে বলল, শীতুমামা, এই মায়াবতীই আপনার সেই তিনি নাকি?
শীতুমামা বললেন চুপ চুপ।
নিকুঞ্জ ঘোষ জিজ্ঞাসা করলেন, কই, মেজর গুপ্ত এলেন না?
মধুর কণ্ঠে মোহিনী গুপ্ত বললেন, সুকোমল? তার কথা আর বলবেন না, পুওর ফেলো। কোথায় উধাও হয়েছে কিছুই জানি না।
আঁতকে উঠে ইলা ফিসফিস করে বলল, কি সর্বনাশ!
মায়াবতী বললেন, মিলিটারী সার্ভিসের মতন ওঁচা চাকরি আর নেই, হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম পেয়ে কিছু না জানিয়েই চলে গেছে। আপনারা খেতে বসে যান, নয়তো সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। মোহিনী আর আমি পরিবেশন করছি।
বীরেন দত্ত বলল, শীতুমামা, সব জিনিস নির্ভয়ে খেতে পারেন। আপনি মন্ত্র নিয়েছেন, নিষিদ্ধ মাংস এখন আর খান না, তাই এঁরা চিকেন বাদ দিয়েছেন। কাটলেট ফ্রাই পাই চপ শিককাবাব সবই পবিত্র ভেড়ার মাংসে তৈরি, এঁদের স্পেশালিটিই হল ভেড়া। হেঁ হেঁ হেঁ, এঁরা কামরূপ—কামিখ্যের মহিলা কিনা।
ইলা বলল, ওরে মা রে!
নিকুঞ্জ ঘোষ বললেন, কই আপনারা কিছু নিলেন না?
মায়াবতী স্মিতমুখে বললেন, আমরা একটু আগেই খেয়েছি।
শিউরে উঠে ইলা বলল, ইঁ হিঁ হিঁ, ওরে বাবা রে!
হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে সুরুচি বলল, আমার গা গুলুচ্ছে, গঙ্গার ধারে বসি গিয়ে।
ঊর্মিলা বললেন, আমারও কেমন কেমন বোধ হচ্ছে, আমিও যাই।
ইলাও তার মায়ের সঙ্গে গেল।
বীরেন ব্যস্ত হয়ে পিছনে পিছনে গিয়ে বলল, এঁরা ছ বোতল সোডাও এনেছেন, একটু খাও, নশিয়া কেটে যাবে।
সুরুচি বলল, ওআক থু! রাক্কুসীদের জলস্পর্শ করব না।
বাড়ি ফিরে এসে সব কথা শুনে বীরেন বলল, ছি ছি, কি কেলেঙ্কারি করলে তোমরা! এই জন্যেই শাস্ত্রে বলেছে স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ংকরী। শীতুমামার গাঁজাখুরী গল্পটা বিশ্বাস করলে। উনি নিজে তো গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়েছেন।
১৮৭৮ শক (১৯৫৬)
Post a Comment