রোগভক্ষক রউফ মিয়া (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ

রোগভক্ষক রউফ মিয়া (মিসির আলি) – হুমায়ূন আহমেদ

মিসির আলি গুরুতর অসুস্থ। ২৩১ নম্বর কেবিনে তাঁকে রাখা হয়েছে। শ্বাসনালির প্ৰদাহ, নিউমোনিয়া, ফুসফুসে পানি- একসঙ্গে অনেক সমস্যা। পাঁচজন ডাক্তারকে নিয়ে একটা মেডিকেল টিম করা হয়েছে। মেডিকেল টিমের ভাষ্য হচ্ছে, মিসির আলি সাহেবের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিউজেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

আমি দারুণ দুশ্চিন্তা নিয়ে ২৩১ নম্বর কেবিন খুঁজে বের করলাম। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখি, মিসির আলি গম্ভীর ভঙ্গিতে বিছানায় বসা। তার হাতে বই। তিনি মন দিয়ে বই পড়ছেন। আমাকে দেখে বই বন্ধ করতে করতে বললেন, যে বইটি পড়ছি তাঁর নাম Windows of the mind. লেখকের নাম Stefan Grey. বিজ্ঞানের নামে অবিজ্ঞানের ব্যবসা। এইসব বই বাজেয়াপ্ত হওয়া দরকার। এবং এ ধরনের বইয়ের লেখকদের কোনো জনমানবহীন দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া দরকার। তাদেরকে সেখানে খাদ্য দেয়া হবে। লেখালেখি করার জন্যে কাগজ-কলম দেয়া হবে। তারা কোনো বই লিখে শেষ করা মাত্র ক্যাম্পফায়ারের আয়োজন করে লেখা পোড়ানো হবে। আবর্জনা মুক্তি উপলক্ষে গানবাজনার উৎসব হবে।

আমি বিছানার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, শুনেছিলাম। আপনি অসুস্থ। মেডিকেল বোর্ড বসেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক।

মিসির আলি বললেন, গতকাল দুপুর পর্যন্ত অবস্থা আশঙ্কাজনকই ছিল। এখন পুরোপুরি সুস্থ। বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলাম, ডাক্তাররা যেতে দিচ্ছেন না। আমার অলৌকিক আরোগ্যলাভের ব্যাপারটা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চান। আপনার ফলের ঠোঙ্গায় কি আম আছে?

আছে।

কাউকে ডেকে দুটা আম দিন। কেটে এনে দিক। আমি খেতে ইচ্ছা করছে। মারোয়াড়িরা কীভাবে আম খায় জানেন।

না।

তারা রাতে বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে আম খায়।

তারা হলো জৈন সম্প্রদায়ের। তাদের ধর্মগুরুত্ব মহাবীর যে কোনো ধরনের প্ৰাণী হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন। আমে পোকা থাকলে সেই পোকা ‘হত্যা করা যাবে। না। কাজেই অন্ধকারে আম খাওয়া। দুএকটা পোকা অন্ধকারে যদি খাওয়া হয়ে যায় সেই দৃশ্য দেখা হবে না, কাজেই পাপও হবে না।

আম কেটে মিসির আলি সাহেবকে দেয়ার ব্যবস্থা হলো। তিনি আগ্রহ নিয়ে আম খাচ্ছেন। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে। মরণাপন্ন রোগী দেখব বলে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি- এখন দেখছি রোগী স্বাস্থ্যে ও আনন্দে ঝলমল করছে। আমি বললাম, মেডিকেল মিরাকল ঘটল কীভাবে?

মিসির আলি বললেন, মিরাকালের ব্যাখ্যা হয় না। ব্যাখ্যা হলে মিরাকল আর মিরাকল থাকে না। যাই হোক, ঘটনা। কী ঘটেছে আপনাকে বলতে পারি। আমার জীবনের অনেক অমীমাংসিত রহস্যের একটি।

বলুন শুনি।

মিসির আলি বললেন, একটা শর্ত আছে। শর্ত পালন করলে শুনাব।

কী শর্ত?

সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট খাওয়ার ব্যবস্থা করুন। বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট টেনে আসব, ডাক্তাররা টের পাবে না। এক প্যাকেট সিগারেট এবং একটা লাইটারের ব্যবস্থা করুন। শরীর নিকোটিনের জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছে।

গল্প শোনার লোভে মিসির আলিকে সিগারেট এনে দিলাম। মিসির আলি কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মহানন্দে সিগারেট টানতে লাগলেন। একজন অ্যাটেনডেন্টকে দরজার সামনে বসিয়ে রাখা হলো। সে দর্শনার্থীদের বলবে— এখন ঢোকা যাবে না। রোগী ঘুমাচ্ছে।

মিসির আলি গল্প শুরু করলেন।

সবাই পত্রিকায় খবর পড়ে। আমি পড়ি বিজ্ঞাপন। একটি জাতির মানসিকতা, সীমাবদ্ধতা, অগ্ৰগতি সবকিছুই বিজ্ঞাপনে উঠে আসে। একযুগ আগের কথা বলছি- একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল।

যে কোনো রোগ গ্যারান্টি দিয়া অ্যারোগ্য করি। আরোগ্য করিতে না পারিলে মাটি খাব।
রউফ মিয়া।

রউফ মিয়া বিজ্ঞাপনের নিচে ঠিকানা দেয়া এবং একটি টেলিফোন নাম্বার দেয়া! টেলিফোন নাম্বারের শেষে লেখা ‘অনুরোধে’।

আমি টেলিফোন করে রউফ মিয়াকে ডেকে দিতে অনুরোধ করলাম। যিনি টেলিফোন ধরলেন তিনি ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ফাজলামি করেন? রউফ মিয়াকে ডাকা ছাড়া আমাদের অন্য কাজকর্ম নাই? আবার যদি টেলিফোন করেন মা-বাপ। তুলে গালি দিব।

আমি রউফ মিয়ার ঠিকানায় চিঠি লিখে তাকে ঢাকায় আসতে বললাম। রউফ মিয়া এলো না, তবে তার কাছ থেকে ছাপানো চিঠি চলে এলো। চিঠির শেষে রউফ মিয়ার আকাবাকা হাতে দস্তখত। লোকটি যথেষ্ট গোছানো তা বোঝা যাচ্ছে। চিঠির উত্তর ছাপিয়েই রেখেছে। চিঠিতে লেখা–

জনাব জনাবা মিসির আলি

সম্মান সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন এই যে, আমার পক্ষে নিজ খরচায় আপনার কাছে যাওয়া সম্ভব নহে। রাহা খরচ বাবদ একশত টাকা মাত্ৰ’ পাঠাইলে তুরিত ব্যবস্থা নেওয়া হইবে।

রোগের জন্য আমার ফ্রি নিম্নরূপ

জটিল রোগ : পাঁচশত টাকা মাত্র

সাধারণ রোগ : আলোচনা সাপেক্ষে

সত্তরের বেশি বয়সের রোগী : চিকিৎসা করা হয় না।

হাড়ভাঙা রোগী চিকিৎসা করা হয় না।

শিশুদের জন্যে বিশেষ কনসেশনের ব্যবস্থা আছে।

ছাত্রদের জন্যে অর্ধেক কনসেশন। তবে হেডমাস্টার সাহেবের প্রত্যয়ন পত্র লাগবে।

ইতি
আপনার একান্ত বাধ্যগত
রউফ মিয়া

চিঠি পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই আমি মানি অর্ডার করে একশ’ টাকা পাঠালাম। ইন্টারেটিং একটা চরিত্র দেখার আলাদা আনন্দ আছে।

টাকা পাঠানোর দশ দিনের মাথায় গাঢ় লাল রঙের ব্যাগ হাতে রউফ মিয়া আমার বাড়িতে উপস্থিত। অপুষ্ট শরীরের একজন মানুষ। গ্ৰাম্য গায়কদের মতো মাথায় বাবড়ি চুল। সব চুল পাকা। চোখে সস্তার সানগ্লাস। ভাদ্র মাসের গরমে গায়ে বুকের বোতাম লাগানো কোট। ময়লা শার্টের সঙ্গে হাতের ব্যাগের মতো নীল রঙের টাই। তার গা থেকে উৎকট বিড়ির গন্ধ আসছে। রউফ মিয়া বললেন, রোগী কে? আপনি অল্প কথায় রোগ বৰ্ণনা করেন। অধিক কথার প্রয়োজন নাই। সার্থকতাও নাই। সময় নষ্ট।

আমি বললাম, এত দূর থেকে এসেছেন। খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেন। বাথরুমে যান, হাত-মুখ ধোন। দুপুরের খাওয়া নিশ্চয় হয় নাই। আসুন। একসঙ্গে খানা খাই।

রউফ বললেন, গোসলের ব্যবস্থা কি আছে? গরমে কাহিল হয়ে গেছি। আমার সঙ্গে লুঙ্গি-গামছা, তেল-সাবান সবই আছে। রোগী দেখতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হয়। সব ব্যবস্থা সঙ্গে রাখি। দাঁতের খিলাল পর্যন্ত আছে।

আমি বললাম, গোসলের ব্যবস্থা অবশ্যই আছে। আপনি আরাম করে গোসল করুন। তাড়াহুড়ার কিছু নাই।

রউফ বললেন, অবশ্যই তাড়াহুড়া আছে। রাতে লঞ্চে করে চলে যাব ভোলায়। ভোলা থেকে কল পেয়েছি। বিশ্বাস না করলে আপনাকে চিঠি দেখাতে পারি।

আমি বললাম, কেন বিশ্বাস করব না? অবশ্যই বিশ্বাস করছি। যান গোসল সেরে আসুন। সোজা চলে যান। ডান দিকে বাথরুম।

রউফ বললেন, একটা বিড়ি খেয়ে ঠাণ্ড হয়ে তারপর বাথরুমে ঢুকব। সিগারেট খাবার সামর্থ্য আমার আছে। বিড়ি খাই কারণ সিগারেট আমাকে ধরে না। তাছাড়া বিড়ি কম ক্ষতিকর। সিগারেটে নানা কেমিক্যাল মিশায়। বিড়ি হচ্ছে নির্ভেজাল তামাক।

রউফ বিড়ি ধরিয়ে বুকে হাত রেখে বিকট শব্দে কাশতে লাগলেন। যিনি গ্যারান্টি দিয়ে অন্যের রোগ সারান, তিনি নিজেই অসুস্থ বলে মনে হলো।

দুপুরে রউফ মিয়া অতি তৃপ্তি করে খেলেন। কেউ সাধারণ খাবার তৃপ্তি করে খাচ্ছে দেখলে ভালো লাগে। আমি মুগ্ধ হয়ে তার খাওয়া দেখলাম। খাদ্য-বিষয়ক। কথা শুনলাম।

এটা কী? করলা ভাজি। সবাই কড়া করে করলা ভাজে। কালো করে ফেলে। আপনার বাবুর্চি সবুজ করে ভেজেছে। অসাধারণ। এই করলা ভাজি দিয়েই এক গামলা ভাত খাওয়া যায়।

ছোট মাছ দিয়ে সজিনা? সঙ্গে আবার কাচা আমি। বেহেশতি খানা। একপদ হলেই চলে! এরকম একটা পদ থাকলে অন্য পদ লাগে না।

ডালের মধ্যে পাঁচফুড়ন দিয়েছে? আবার ধনেপাতাও আছে? স্বাদ হয়েছে। মারাত্মক? ভাই সাহেব, আপনার এই বাবুর্চির হাতে চুমা খাওয়া প্রয়োজন।

খাওয়া শেষ করার পর ভদ্রলোক যে কাজটা করলেন তার জন্যে আমি প্ৰস্তুত ছিলাম না। তিনি আমার কাজের ছেলে হামিদকে ডেকে বললেন, বাবা, তোমার রান্না খেয়ে অত্যধিক তৃপ্তি পেয়েছি। এই পাঁচটা টাকা রাখো বখশিশ। আমি দরিদ্র মানুষ, এর চেয়ে বেশি দেবার সামর্থ্য নাই। তবে তোমার জন্যে খাস দিলে এখুনি আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করব। হাত তোলো দোয়ায় সামিল হও।

রউফ হাত তুলে দােয়া শুরু করলেন, হে আল্লাহপাক আজ অতি তৃপ্তি সহকারে যার রন্ধন খেয়েছি। তুমি তাকে বেহেশতে নাসিব করো। যেন সে বেহেশতি খানা খেতে পারে। যে পিতা-মাতা এমন এক বাবুর্চির জন্ম দিয়েছে। তাদেরকেও তুমি বেহেশতে নাসিব করো। আমিন।

দোয়া শেষ হবার পর দেখি হামিদের চোখে পানি। সে চোখ মুছে ফুঁপাতে লাগল।

আমি বললাম, আজ রাতটা আপনি ঢাকায় থেকে যান। হামিদ মাংস রাধুক। সে ভালো মাংস রান্না করে।

রউফ বললেন, আচ্ছা থাকলাম! ভোলার রোগী একদিন পরে দেখলেও ক্ষতি কিছু নাই। এতদিন রোগ ভোগ করেছে, আর একদিন বেশি ভোগ করবে। উপায় কি? সবই আল্লাহপাকের ইশারা। আপনার রোগী সন্ধ্যার পর দেখব। এখন শুয়ে কিছুক্ষণ। ঘুমাব। অতিরিক্ত ভোজন করে ফেলেছি।

রউফ মিয়া সন্ধ্যা পর্যন্ত নাক ডাকিয়ে ঘুমালেন। আমি হামিদকে বললাম রাতে ভালো খাবারের আয়োজন করতে। পোলাও, খাসির রেজালা, মুরগির কোরমা। বেচারা আরাম করে থাক। দুপুরে অতি সামান্য খাবার খেয়ে যে তৃপ্তির প্রকাশ দেখেছি তা আবার দেখতে ইচ্ছা করছে।

রউফ মিয়া যখন শুনলেন আমার কোনো রোগী নেই, আমি গল্প করার জন্যে তাকে টাকা পাঠিয়ে আনিয়েছি, তখন তিনি খুবই অবাক হলেন। আমি বললাম, ভাই রোগ আপনি কীভাবে সারান?

রউফ মিয়া বললেন, রোগ ভক্ষণ করে ফেলি।

কী করে ফেলেন?

ভাই সাহেব, খেয়ে ফেলি। ভক্ষণ।

আমি বললাম, কীভাবে খেয়ে ফেলেন?

চেটে খেয়ে ফেলি।

আমি বললাম, কীভাবে চেটে খান? ভালোমতো ব্যাখ্যা করুন।

রউফ বললেন, রোগীর কপাল চেটে রোগ খেয়ে ফেলতে পারি। হাতের তালু, পায়ের তালু চেটেও খাওয়া যায়। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে ঘাড় চেটে রোগ খাওয়া আমার জন্য সহজ।

ও আচ্ছা।

রউফ দুঃখিত গলায় বললেন, আপনি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই। অনেকেই করে না। বাংলাদেশে বিশ্বাসী লোক পাওয়া কঠিন। সবাই অবিশ্বাসী। আমার কাছে দুটা সার্টিফিকেট আছে, দেখতে পারেন। আমি ইচ্ছা! করলে ব্যাগভর্তি সাটিফিকেট রাখতে পারতাম। রাখি নাই। কারণ আমি সাটিফিকেটের কাঙালি না।

আপনি কিসের কাঙালি?

ভালোবাসার কাঙালী। যে যার কাঙালা হয়। সে সেই জিনিস পায় না।

আপনি পান নাই?

জি না। তবে আপনি ভালোবাসা দেখায়েছেন। আদর করে পাশে নিয়ে ভাত খেয়েছেন। নিজের হাতে প্লেটে তিন বার ভাত তুলে দিয়েছেন। ছোট মাছের সালুন দিয়েছেন দুই বার। সালুনের বাটিতে একটা বড় চাপিলা মাছ ছিল, সেটা আপনি নিজে না নিয়ে আমার পাতে তুলে দিয়েছেন। এমন ভালোবাসা আমারে কেউ দেখায় নাই। ভাই সাহেব, সার্টিফিকেট দুটা পড়লে খুশি হব।

আমি সার্টিফিকেট দুটা পড়লাম। একটি দিয়েছেন নান্দিনা হাইস্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার। তিনি লিখেছেন–

যার জন্য প্রযোজ্য

এই মৰ্মে প্রত্যয়ন করা যাইতেছে যে, ব্যতিক্রমী চিকিৎসক মোঃ রউফ মিয়ার চিকিৎসায় নান্দিনা হাইস্কুলের দপ্তরি শ্রীরামের কন্যা সুধা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিয়াছে। সে দীর্ঘদিন জটিল জণ্ডিস রোগে আক্রান্ত ছিল। আমি মোঃ রউফ মিয়ার উন্নতি কামনা করি। সে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। তাহার নৈতিক চরিত্র উত্তম।

মোঃ আজিজুর রহমান খান
সহকারী প্রধান শিক্ষক
নান্দিনা হাইস্কুল

দ্বিতীয় প্রশংসাপত্ৰটি উকিল আশরাফ আলি খাঁ দিয়েছেন। এই প্ৰশংসাপত্ৰটি ইংরেজিতে লেখা।

I hereby confirm the fact that Mr. Rouf Mia is a genuine diseases eater. He has performed the feat in presence of me.

রউফ মিয়া বললেন, ইংরেজি লেখাটার জোর বেশি। কী বলেন ভাই সাহেব?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

রউফ মিয়া বললেন, উকিল মানুষ তো! অনেক চিন্তাভাবনা করে লিখেছেন।

আমি বললাম, আপনার খবর স্থানীয় কোনো কাগজে আসে নি। এই জাতীয় খবর তো লোকাল কাগজগুলি আগ্রহ করে ছাপায়।

রউফ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, নেত্রকোনা বার্তায় একবার খবর উঠেছিল। পেপার কাটিং হারায়ে ফেলেছি। তবে হারায়ে লাভ হয়েছে। ওরা আমার নাম ভুল করে ছেপেছে। লিখেছে রুব মিয়া। রব আর রউফ কি এক? ফাজিল পুলাপান সাংবাদিক হয়ে বসেছে। আর লিখেছেও ভুল। লিখেছে রব মিয়া অন্যের রোগ খেয়ে জীবনধারণ করেন। তিনি কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করেন না। খাদ্য গ্ৰহণ না করলে মানুষ বাঁচে?

আমি বললাম, আপনি বিয়ে করেছেন?

যৌবনকালে বিবাহ করেছিলাম। স্ত্রী মারা গোল কলেরায়। ছেলে একটা ছিল, নাম রেখেছিলাম রাজা মিয়া। সুন্দর চেহারা ছবি ছিল- এই জন্যে রাজা মিয়া নাম। ছেলেটা মারা গেল টাইফয়েডে। রোগ খাওয়া তখন জানতাম না। এইজন্যে চোখের সামনে মারা গেল। রোগ খাওয়া জানলে টাইফয়েড কোনো বিষয় না। চোটে ভক্ষণ করে ফেলতাম।

রোগ খাওয়ার কৌশল কীভাবে শিখলেন?

রউফ মিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমার ছেলে রাজা মিয়া আমারে শিখায়েছে। একদিন ভোর রাতে রাজা মিয়াকে স্বপ্নে দেখলাম। আমি বললাম, বাবা কেমন আছ? সে বলল, ভালো আছি। আমি বললাম, তোমার কি বেহেশতে নাসিব হয়েছে? সে বলল, জানি না। আমি বললাম, তোমার মা কই? তার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয় না? সে বলল, না। তারপরেই সে আমারে রোগ খাওয়ার কৌশল শিখায়ে দিল। আমি স্বপ্নের মধ্যেই ছেলেকে কোলে নিয়া কিছুক্ষণ কাদলাম। ঘুম ভাঙার পর দেখি চউখের পানিতে বালিশ ভিজে গেছে।

রউফ মিয়া চোখ মুছতে লাগলেন। একসময় বললেন, আপনার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি। আপনি যদি চান রোগ খাওয়ার কৌশল শিখায়ে দিব। তবে আপনারা ভদ্রসমাজ। আপনারা পারবেন না। চট্টাচাটির বিষয় আছে।

রউফ মিয়া দুদিন থেকে ভোলায় রোগী দেখতে গেলেন। ছয় মাস পর তার কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। এইবারের চিঠি ছাপানো না, হাতে লেখা। তিনি লিখেছেন–

বিরাট আর্থিক সমস্যায় পতিত হইয়াছি। যদি সম্ভব হয় আমাকে দুইশত টাকা কৰ্জ দিবেন। আমি যত দ্রুত সম্ভব কর্জ পরিশোধ করিব।

ইতি

আপনার অনুগত

রউফ মিয়া (র, ভ)।

পুনশ্চতে লেখা- আমি নামের শেষে র, ভ টাইটেল নিজেই চিন্তা করিয়া বাহির করিয়াছি। র, ভ-র অর্থ রোগ ভক্ষক।

আমি দুশ টাকা মানিঅৰ্ডার করে পাঠিয়ে দিলাম। এই ধরনের কর্জের টাকা কখনো ফেরত আসে না। তাতে কি। মানুষটার প্রতি আমার এক ধরনের মমতা তৈরি হয়েছে। অবোধ শিশুদের প্রতি যে মমতা তৈরি হয় আমার মমতার ধরনটা সে রকম।

রউফ মিয়া তিন মাসের মাথায় টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। দু’দিন থাকলেন। দেখলাম তার স্বাস্থ্য আরো ভেঙেছে। জীবন্ত কঙ্কাল ভাব চলে এসেছে। আমি বললাম, শরীরের এই অবস্থা কেন ভাই?

রউফ মিয়া বললেন, অন্যের রোগ খেয়ে খেয়ে এই অবস্থা হয়েছে। রোগ খাওয়ার পর বেশি করে দুধ খেতে হয়। দুধ কই পাব বলেন? পনেরো টাকা কেজি দুধ।

আমি বললাম, আসুন আপনাকে ডাক্তার দেখাই।

রউফ মিয়া আঁতকে উঠে বললেন, অসম্ভব কথা বললেন। আমি বিখ্যাত রোগভক্ষক। এখন আমি যদি ডাক্তারের কাছে। যাই, লোকে কী বলবে?

কেউ তো জানছে না।

কেউ না জানুক আপনি তো জানলেন। একজন জানা আর এক লক্ষ জন জানা একই কথা।

রউফ মিয়া শীতের সময় এসেছিলেন। বাজারে নতুন সবজি উঠেছে। তার জন্যে বাজার করলাম। হামিদ অনেক পদ রান্না করল। তিনি কিছুই খেতে পারলেন না। দুঃখিত গলায় বললেন, ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গেছে ভাই সাহেব। মানুষের রোগ ভক্ষণ করে করে এই অবস্থা হয়েছে। যদি সম্ভব হয় এক কাপ দুধ দেন।

আমি বললাম, রোগ খাওয়াটা ছেড়ে দিন।

রউফ বললেন, নিজের ছেলে একটা বিদ্যা শিখায়ে দিয়েছে। মানুষ বিপদে পড়ে আমার কাছে আসে। ভাই সাহেব, কয়েকদিন আগে ছেলেটাকে স্বপ্নে দেখেছি। সে এখনো তার মা’ক্সে খুঁজে পায় নাই। পরকালে বাপ-মা ছাড়া ঘুরতেছে, দেখেন তো অবস্থা!

রউফ মিয়া হঠাৎ বড় বড় করে নিশ্বাস নিতে নিতে শুয়ে পড়লেন। তাঁর মুখ থেকে ঘর্ঘর শব্দ হতে লাগল।

আপনার এ্যাজমা আছে না-কি?

রউফ মিয়া বললেন, আপে ছিল না। সম্প্রতি হয়েছে। একজনের হাঁপানি ভক্ষণ করে এই অবস্থা। আমাকে ধরে ফেলেছে। আপনার ছেলেটাকে একটু বলুন বুকে সরিষার তেল মালিশ করে দিতে। রসুন দিয়ে তোলটা পরম করতে হবে।

হামিদ দীর্ঘ সময় ধরে তেল ঘসিল। এক সময় রউফ মিয়া ঘুমিয়ে পড়লেন।

মিসির আলি থামলেন। আমি বললাম, আপনার রোগ মুক্তির পেছনে কি রোগভক্ষক রউফ মিয়ার কোনো ভূমিকা আছে।

মিসির আলি বললেন, জানি না। এই চিঠিটা পড়ে দেখুন। হামিদ ভোরবেলা চিঠিটা দিয়ে গেছে। রউফ আমাকে দেখতে এসেছিলেন। চিঠি লিখে বান্দরবান চলে গেছেন। মুরং রাজার এক আত্মীয়ের চিকিৎসার জন্যে ডাক এসেছে।

আমি চিঠি হাতে নিলাম। চিঠিতে লেখা—

প্ৰাপক জনাব মিসির আলি।

প্রেরক বিশিষ্ট রোগভক্ষক বাংলার গৌরব রউফ মিয়া।

জনাব,

বান্দরবানের মুরং, রাজার এক জ্ঞাতি ভ্ৰাতা উল্লাং প্রশ্ন সাহেবের চিকিৎসার জন্যে অদ্য সকল এগারোটায় রওনা হইব। ঢাকায় আসিয়া আপনার অসুখের খবর শুনিলাম! হামিদকে নিয়ে হাসপাতালে আসিয়া আপনার অচেতন মুখ দেখিয়া মৰ্মে আঘাত লাগিয়াছে। বিশিষ্ট রোগভক্ষক, বাংলার গৌরব যাহার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ভ্রাতাতুল্য তাহার এই অবস্থা কেন হইবে?

(বাংলার গৌরব টাইটেল বর্তমানে ব্যবহার করিতেছি। যে দেশের যে নিয়ম। নিজের ঢোল নিজেকেই বাজাতে হয়।)

যাই হোক, আমি আপনার ডান হাত চাটিয়া রোগ সম্পূর্ণই ভক্ষণ করিয়াছি। অবশিষ্ট কিছুই নাই। কিছুদিন শরীর দুর্বল থাকিবে। দধি এবং ফল খাইবেন। কচি ডাবের পানি শরীরের জন্যে রোগমুক্তি সময়ে অত্যন্ত উপকারী।

ইতি

আপনার

অনুগত

মোঃ রউফ মিয়া

বিশিষ্ট রোগভক্ষক

বাংলার গৌরব।

পুনশ্চ : জনাব, ভালো কাগজে একটা প্যান্ড ছাপাইতে কত খরচ পড়িবে সেই অনুসন্ধান নিবেন। প্যাডে। আমার নাম, ঠিকানা এবং টাইটেল লেখা থাকিবে। বাংলার গৌরব লেখা থাকিবে সোনালি কালিতে। প্যাডের ডান পার্শ্বে আমার ছবি। তিনটি ছবি সঙ্গে দিয়া দিলাম। যেটি পছন্দ হয় সেটি ব্যবহার করিবেন।

তিনটি ছবিরই ক্যাপশন আছে। একটিতে রউফ মিয়ার কানে মোবাইল টেলিফোন। ক্যাপশনে লেখা- রুগীর সঙ্গে বাক্যালপো রত।

দ্বিতীয় ছবিতে তিনি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে চোখে কালো চশমা। ক্যাপশনে লেখা- কলে যাবার জন্য প্রস্তুত।

তৃতীয় ছবিতে তিনি একটি শিশুর কপাল চাটছেন। ক্যাপশনে লেখা–চিকিৎসা চলাকালীন ছবি।

চিঠি মিসির আলির হাতে ফেরত দিতে দিতে বললাম, আপনার কি ধারণা?

সে সত্যি রোগ খেয়ে ফেলেছে?

মিসির আলি বললেন, রউফ আমার কাছে এসেছিলেন রাত ন’টায়। তিনি পনেরো মিনিটের মতো ছিলেন। এর মধ্যে হাসপাতালে হৈচৈ পড়ে যায়। নার্সডাক্তার মিলে বিরাট জটলা। বুড়ো এক পাগল মেঝেতে বসে কুকুরের মতো আমার হাত চাটছে। তাকে দারোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়। আমার জ্ঞান ফিরে রাত দশটার দিকে। জ্বর তখনি নেমে যায়। রাত বারোটার সময় বুঝতে পারি আমি পুরোপুরি সুস্থ।

আমি বললাম, আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি। আপনার কি ধারণা রোগভক্ষক আপনার রোগ ভক্ষণ করেছে?

মিসির আলি বললেন, জানি না। হিসাব মিলাতে পারছি না। রেইন ফরেস্টের আদিবাসী শমন চিকিৎসকদের মধ্যে রোগীর বুড়ো আঙুল চুষে রোগ আরোগ্যের পন্থা আছে। রেড ইন্ডিয়ানরা গায়ে হাত বুলিয়ে রোগ সারায়। অধ্যাপক মেসমার বডি ম্যাগনেটিজম চিকিৎসার কথা বলতেন। এর কোনোটাই বিজ্ঞান স্বীকার করে। না। যুক্তি স্বীকার করে না। আমি নিজে কঠিন যুক্তিবাদী মানুষ। তারপরেও…।

মিসির আলি রেডিও বন্ড কাগজে প্যাড ছাপিয়েছিলেন। রোগভক্ষক রউফ মিয়ার কাছে সেই প্যাড পৌঁছানো যায় নি। বান্দরবান থেকে ঢাকা ফেরার পথে বাসে বমি করতে করতে তাঁর মৃত্যু হয়। মিসির আলি বন্ধুর মৃত্যুর খবর পান এক মাস পরে।

No comments