ইন্দ্রজাল – ভবানীপ্রসাদ দে

ইন্দ্রজাল – ভবানীপ্রসাদ দে

ম্যাজিক সম্রাটকে বিরাট এক সালাম দিল ছেলেটি, তারপর কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কায়েস আফগানী সাহেব খুশি না হয়ে পারলেন না। শহরের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখন আর এমন সুন্দর করে সালাম দেয় না। গাঁয়ের নম্র-ভদ্র গোছের ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বললেন, “মাশাআল্লাহ, তোমার নাম কী? তোমাকে দেখে তো শহরের ছেলে বলে মনে হয় না। বাড়ি কোথায় তোমাদের?”

“আমার নাম স্বপন। স্বপন আহমেদ। বাড়ি চট্টগ্রাম জেলায়।”
“বয়স কত?”
“বারো বছর।”
“আমার কাছে ম্যাজিক শিখতে এসেছ তুমি?”
“অ্যা, হ্যা।”
“আমরা ঠিকানা পেলে কোথায়?”

“ট্রেনে করে কমলাপুর এসে স্টেশন থেকে বেরোবার সময় টিটিকে আপনার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন আপনি মগবাজারে থাকেন। মগবাজারে বাস থেকে নেমে এক ভদ্রলোককে ধরলাম, তিনিই আপনার বাড়ির ঠিকানা বলে দিলেন। একটুও অসুবিধে হয়নি।”

কায়েস আফগানী বললেন, “না বলে বাড়ি থেকে চলে এসছে তো?”

মুহূর্তে স্বপনের মুখটি শুকিয়ে গেল। সে নীরবে মাথা নেড়ে বোঝাল ম্যাজিক সম্রাটের অনুমান সত্যি।

কায়েস আফগানী বললেন, “অবাক হচ্ছ? ভাবছ আমি কী করে বুঝলাম? ম্যাজিশিয়ান হবার জন্যে তোমার মতন বয়সে আমিও বাড়ি থেকে পালিয়ে যাযাবর মাদারিদের সঙ্গে দেশে দেশে ঘুরেছি কত!” ষাট বছর বয়সী প্রৌঢ় ম্যাজিশিয়ান তার বয়স আর গাম্ভীর্যের বাঁধা ভেঙে হো হো করে হেসে বললেন, “সেই একই ইতিহাস, বুঝলে স্বপন।”

স্বপন বলল, “আমাকে ম্যাজিক শেখাবেন তো,”

“ম্যাজিক শিখে কী করবে তুমি? আমার মতন হাত সাফাইয়ের খেলা দেখিয়ে বেড়াবে দেশে বিদেশে?”

ম্যাজিক সম্রাটকে অবাক করে দিয়ে স্বপন বলল, “না। আমি অংকে খুব কাঁচা। অংকের মাষ্টারমশাই বলেছেন আমার মাথাভর্তি গোবর আছে। তাই আমি অংক পরীক্ষায় একশোর মধ্যে দশ বারো করে নম্বর পাই। আপনি অংকের যাদুটা শিখিয়ে দিলে এখন থেকে একশোয় একশো পাব।”

“আমি অংকের যাদু জানি তুমি কী করে জানলে?”

“শুনেছি আপনি চোখ বাঁধা অবস্থায় খুব তাড়াতাড়ি বিরাট বিরাট যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ বর্গমূল করে দেন বোর্ডের উপর। বড় বড় অংকের মাষ্টার মশাইরাও নাকি হিমশিম খেয়ে যান সে সব অংক করতে।”

কায়েস আফগানী স্মিত হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “শুধু অংকের যাদু শিখলেই চলবে তো তোমার?”

স্বপন বলল, “গাছ থেকে পড়ে গিয়ে আমাদের পাড়ার হাসান ভাইয়ের ডান হাত আর বাঁ পা-টা ভেঙে গিয়েছে। এখন সে আর গাছে উঠে নারকেল পেড়ে দিতে পারে না, পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে দিতে পারে না। হাসান ভাইয়ের বাড়িতে পাঁচজন লোক। না খেয়ে মরবার দশা হয়েছে তাদের। আপনার ম্যাজিক দিয়ে তাঁর ভাঙা হাত-পা ভালো করে দেব?”

“আমি ভাঙা হাত-পা সারিয়ে দিতে পারি একথা তোমাকে কে বলেছে?”

“কে আবার বলবে! টিভিতেই দেখেছি। আপনি ইলেকট্রিক করাত দিয়ে আপনার দলের একটা মেয়েকে একদম দু্টুকরো করে কেটে ফেললেন। আবার তাকে আপনি জোড়া দিয়ে দিলেন তখনই। হাসান ভাইয়ের ভাঙ্গা হাত-পা ভালো করে দেওয়া সে তুলনায় এমন কী শক্ত কাজ?”

জীবনে কখনও এমন অস্বস্তিতে পড়েননি ম্যাজিক সম্রাট। যাদু দিয়ে অসাধ্য সাধন করা যায় – এই বিশ্বাস নিয়ে সুদূর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছে অবুঝ কিশোর। বেশি দেরি হবার আগেই তার এই ভুল ভেঙে দেওয়া দরকার। আন্তরিক স্বরে কায়েস আফগানী বললেন, “আমি মন্ত্রতন্ত্র কিচ্ছু জানি না। হাত-সাফাই করে; কথার কারসাজি দিয়ে, মঞ্চে আলো-আঁধারি আর যন্ত্রপাতির সাহায্য নিয়ে দর্শকদের বোকা বানাই। যাদু দিয়ে কি আর সত্যি কিছু তৈরি করা যায়!”

হতাশ হয়ে স্বপন বল, “আমার তাহলে অংকে পাস করা হল না, হাসান ভাইয়ের ভাঙা হাত-পা আর সারানো হল না, কুমিরমারি খালের উপর সাঁকোটাও দেখছি হবে না।”
“সাঁকো? সাঁকো আবার কিসের?”

“আমাদের গ্রামের পাশে কুমিরমারি খাল। ইস্কুল-পাঠশালা, হাট-বাজার, পোস্ট অফিস, হাসপাতাল-যেখানেই যাও, ওই খাল পার হয়েই যেতে হবে। এমনিতে খালে হাঁটু সমান উঁচু জল থাকে, লোকে পায়ে হেঁটেই চলে যায়। কিন্তু বর্ষাকালে ওই খালই ছোটখাটো নদী হয়ে যায়। তখন ভারি কষ্ট হয় আমাদের। ভেবেছিলাম আপনার কাছে ম্যাজিক শিখে কুমিরমারি খালের উপর একটা সাঁকো বানাব, তাতে আমাদের সব অসুবিধে দূর হয়ে যাবে।”

বললেন, “আমি তো কখনও সাঁকো তৈরির খেলা দেখাইনি।”

স্বপন বলল, “কিস্তু আপনি তো স্টেজের উপর যাত্রীবোঝাই একটা মোটরগাড়িকে অদৃশ্য করে দেন হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে। পরে আপনিই আবার সেটা ফিরিয়ে আনেন সবার মাঝখানে। ইচ্ছা করলে আপনি কি আর ছোট একটা
সাঁকো তৈরি করে দিতে পারেন না?”

কায়েস আফগানী-ততক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছেন স্বপনকে তিনি ফিরিয়ে দেবেন না। বললেন, “ঠিক আছে, সব হবে। আমার এক বন্ধু আমার থেকেও ভালে অংকের যাদু জানে। আমার আরেক বন্ধু ভাঙা হাড় জোড়া লাগাবার ম্যাজিক জানে। সাঁকো তৈরির ম্যাজিক জানে, এমন একজন বন্ধুও আছে আমার।”

স্বপনের দু’চোখে আবার স্বপ্ন। সে বলল, “আমি শিখব, সব শিখব!”

শিখবে বৈকি, নিশ্চই শিখবে। আমার ছেলেবেলার বন্ধু ইমরান মাহমুদ দারুণ ভালো অংকের মাষ্টার, গভঃমেন্ট স্কুলে পড়ায়। সে-স্কুলের সব ছেলে অংকে লেটার পায়। আমার বন্ধু জাকারিয়া খুব বড় অর্থোপেডিক সার্জন। কত লোকের ভাঙা হাড় জোড়া দিয়ে দিয়েছে সে। আর সবুজ মজুমদারের নাম শুনেছ কি তুমি? সে খুব নামকরা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ব্রীজ বানানোর কাজে সারা বাংলায় তার জুড়ি নেই। আজই গভঃমেন্ট স্কুলে তোমাকে ভর্তির ব্যবস্থা করছি। মা-বাবাকে ছেড়ে আমার এখানে থাকতে পারবে তো তুমি?”

যাদুবিদ্যা শিখবার রঙিন স্বপ্ন নিয়ে মা, বাবা, ছোট বোন – সবাইকে ছেড়ে সেই কোন কাকভোরে বাড়ি থেকে চলে এসেছে স্বপন। এখন বাড়ির জন্য মন কেমন করতে লাগল তার। বাবা নিশ্চয় পাগলের মতো এখানে ওখানে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাকে, মা ঘরের দাওয়ায় চুপটি করে বসে চোখের জল ফেলছেন। বোন স্বপ্লাই বা কী করছে কে জানে! তবু মনটাকে শক্ত করে স্বপন বলল, “চেষ্টা করব।”

কায়েস আফগানী তাকে কাছে টেনে নিয়ে তার দু’কাধে হাত রেখে বললেন, “পারতেই হবে। স্কুলের পড়া ভালো করে শেষ করে তুমি ঠিক করবে ডাক্তার হবে না-কি ইঞ্জিনিয়ার হবে। এখন দাঁড়াও, চট্টগ্রামে আমাদের এক আত্মীয় থাকেন, তাঁকে একটা টেলিফোন করে দিই। তুমি যে আমার কাছে এসেছ আর মস্ত ম্যাজিশিয়ান হবার জন্য এখন থেকে আমার কাছেই থেকে যাচ্ছ, সে খবরটা তিনিই তোমার বাবার কাছে পৌঁছে দেবেন।”

মিষ্টি হাসল স্বপন, হাসলেন কায়েস আফগানীও।
যাদুসম্রাট এবার এক নতুন যাদুর খেলা শুরু করলেন – যাদুর মোহ থেকে মানুষকে মুক্ত করার যাদু।

No comments