নীরব ঘাতক - কামাল কাদের

নীরব ঘাতক  - কামাল কাদের

আজকাল ঢাকা শহরে ইদুঁরের দৌড়াত্বটি ক্রমশ বেড়েই চলছে। ঘরোয়া পরিবেশে তা যে কোনো  মজলিসের  আড্ডায় হোক অথবা কোনো  নিমন্ত্রিত উৎসবেই  হোক  এটি একটি প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে মহিলাদের অঙ্গনে। সবারই চোখে মুখে কেমন যেন এক ভীতিকর অবস্থা। ইঁদুর মারার ওষুধ ব্যাবহার করেও কোনো কুল কিনারা পাওয়া যাচ্ছেনা।  কেউ কেউ টিপ্পনি মেরে বলে ," এর সমাধান কখনও হবেনা , কারণটা রাস্তার চারিপাশে  সব সময়ে পাহাড় সমান যে বর্জ জমা হয়ে থাকে ,সে গুলো নিয়মিত পরিষ্কার না হলে এই উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া দুস্কর। ইঁদুরদের জন্য ওই সমস্ত জায়গা তো স্বর্গ-রাজ্য। মোট কথা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এর বিহীত করতে না পারলে এর সমাধান অসম্ভব। "

পুরানো ঢাকা শহরের অতিমাত্রা লাগোয়া ফ্লাট বাড়িগুলাতে এই সমস্যার  প্রকট বেশী। সম্ভবত ইঁদুরদের ওই সমস্ত ফ্লাট বাড়িগুলাতে খাবার দাবার সংগ্রহ করা এবং তাদের  বংশ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।নীচের তলায় ফ্লাটগুলাতে যারা থাকেন তাদের ইঁদুরের উপদ্রব অন্যাণ্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের চাইতে অনেক বেশী। কারণ হলো বাইরের রাস্তার আবর্জনা থেকে খুব সহজেই ইঁদুরের দল নীচের তলার ফ্ল্যাটে ঢুকে যেতে পারে। 
 
পুরানো ঢাকার  গেন্ডারিয়ার  ধুপখোলা মাঠের ওপারে বানিয়াটোলা।  সেখানে খাজা আব্বাস সাহেব বাপ দাদার জমির উপরে বিরাট অট্টালিকা বানিয়ে সুখ শান্তিতে বসবাস করছেন। চুক্তি অনুসারে  দশটি ফ্ল্যাটের মধ্যে পাঁচটি ফ্লাট ডেভলাপদের দিয়েছেন আর বাকি পাঁচটি নিজেরা রেখেছেন। চারটি ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়ারা থাকে এবং নীচের তলার  ফ্ল্যাটে নিজেরা থাকেন। বুড়ো বয়সে উঠা নামার কষ্টের ভয়ে নীচের ফ্লাটিতে থাকতে  অধিক শ্রেয় মনে করেন। সন্তানদের মধ্যে দুই মেয়ে। বড় মেয়েটি  স্বামী সন্তান নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থাকে।  ছোট  মেয়ে জাহিদা বেগম পুরানো ঢাকার হাজারীবাগে এক ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে অতি ধনী বাপের একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করে ঘর সংসার করছে।

বড় মেয়ে দেশের বাইরে। স্বভাবতই ছোট মেয়েটির ছেলে মেয়েদের প্রতি নানা নানীদের অনেক টান। নাতির বয়স সাত আর নাতনির বয়স তিন বছর। রাত দুপুরে  অর্থাৎ  যখন তখন খুশি মনে  জামাই ,মেয়ে ,নাতি নাতনি খাজা সাহেবের  বানিয়াটোলার বাসায় চলে আসে। বেশীর ভাগ সময়ই নানা নানীরা " বেবি মাইনডিং " করে থাকেন। বলা বাহুল্য ,উনারাও উদার চিত্তে নাতি নাতনিদের সহচর্য  উপভোগ  করে থাকেন।  এদিকে ছোট্ট ছেলে মেয়েরাও নানা নানীর অফুরন্ত ভালোবাসা এবং স্নেহ পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে থাকে  । মোট কথা উনাদের  জীবন  যাত্রা সুখে শান্তিতে চলছে।  

খাজা  সাহেবদের নীচের তলায় ফ্ল্যাটে থাকায় এক  বিরাট অসুবিধা হলো ইঁদুরের দৌরাত্ম  অন্যাণ্য ফ্ল্যাটের  বাসিনদারদের  চাইতে তাদের অনেক বেশী। রাস্তার বর্জ থেকে খুব সহজেই ইঁদুরের গোষ্ঠী নীচের ফ্ল্যাটে ঢুকে যায়, রান্নাঘরের খাবারদাবার  তছনছ করে দেয়।মহামুস্কিলে পরে যান। তবুও মনে করেন নীচের তলায় ভালোই আছেন ,আর মনকে সান্তনা দেন এই ভেবে " সব  রকম সুযোগ সুবিধা তো এক সাথে পাওয়া যায় না " !  বাধ্য হয়ে কি শীত কি গ্রীষ্মে দিনে দুপুরে রান্নাঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে রাখেন, যেন ইঁদুর ঢুকতে না পারে। তাছাড়া চোর ডাকাতের ভয় তো রয়েছেই  ! মাঝে সাঝে দিনের বেলায় কিছু সময়ের জন্য দরজা জানালা  খোলা রাখা হয়।
মানুষের জীবনে সময় যখন খারাপ হয় ,তখন সময় অসময় বলে কিছু রয় না। হঠাৎ করেই চলে আসে। আমরা অনেক সময় নিজেদের অসাবধানতাবশতঃ দুর্যোগ টেনে নিয়ে আসি। আবার অনেক সময় বাইরের অন্য কোনো উৎস থেকে চলে আসে, যেখানে আমাদের কোনো হাত থাকেনা অথবা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে অঘটনটি ঘটে যায়। জীবন এক মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।    

 ঢাকার বাসীরা সবচাইতে যে দুর্ভোগে জর্জিত তা হলো রান্না করার গ্যাসের অপ্রতুলতা। এমন কোনো দিন নাই রান্না করতে করতে হঠাৎ করে গ্যাস চলে যায় না । নিত্য দিনের  এ বিড়ম্বনা সহ্য করতে হচ্ছে বাসার গৃহকর্ত্রীর অথবা কাজের বুয়াকে।

শীতকালের এক সন্ধ্যায় খাজা সাহেবের মেয়ে এবং জামাই বাচ্চা দুজনকে নানা নানীর কাছে রেখে শহরের বাণিজ্য মেলায় বেড়াতে গেলো। বেড়ানো শেষে একটা রেস্টুরেন্টে  রাত্রির খাবারটা সেরে ফেললো। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো তাই  বাসার কাউকে  ডিসটার্ব না করে সোজা ড্রয়িং রুমের দরজাটি বন্ধ করে নিম্নস্বরে  টিভি চালিয়ে আড্ডা দিতে বসে গেলো। এদিকে বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে অচেতন।  কিছুক্ষন পর জামাই তার গিন্নিকে বললো ," ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে , আমার জন্য একটা ডিমের  ওমলেট বেশি করে পিয়াঁজ আর কাঁচামরিচ  দিয়ে নিয়ে এস । তুমি  চাইলে তোমার জন্যও একটা  ওমলেট করে নিতে  পারো  "।  

যেই   বলা সেই কাজ, জাহিদা বেগম নিজেও  কিছুটা ক্ষিধে অনুভব করছিলো। অপেক্ষা না করে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো। রান্নাঘরে  ঢুকেই যেই না দিয়াশালার কাঠি দিয়ে গ্যাসের চুলাটা জ্বালাতে গেলো তৎক্ষণাৎ বোমা ফাটানোর মত বিরাট শব্দ করে সমস্ত রান্নাঘরটির আগুনের অগ্নিশিখা  চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আগুনের তীব্রতা এতই প্রখর ছিল যে তার সমস্ত শরীর মুহূর্তে পুড়ে ঝলসে গেলো।  রান্নাঘর থেকে বের হতেও সময়টুকু পেলো না। রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে কোকাতে কোকাতে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লো। এদিকে জামাই , স্ত্রীর দেরী দেখে সেও  অবচেতন মনে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। আগুনের মুখমুখী হতেই  আগুনের শিখা তারও শরীরে জড়িয়ে ধরলো। রান্নাঘরের পাশেই ছিল "অ্যাটাচ শাওয়ার রুম "। হামাগুড়ি দিয়ে কোনোমতে  শাওয়ার রুমে ঢুকে পড়তেই সে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে রইলো।  

আগুনের লেলিহান যখন বাড়ীর অন্যান্ন ঘরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো তখন  শশুর -শাশুড়ীর ঘুম ভেঙে গেলো। ভীতত্রস্ত হয়ে ফায়ার সার্ভিসকে " কল " করলো। ফায়ার সার্ভিস অতি দ্রুততার সাথে চলে আসলো এবং ঘন্টা খানিকের ভিতর আগুন নেভাতে সক্ষম হলো। ইতিমধ্যে যখন ফায়ার সার্ভিসের লোক রান্নাঘরে ঢুকলো ,তখন তারা দেখতে পেলো জাহিদা বেগমের সমস্ত  শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।  জামাইয়ের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তাড়াতাড়ী করে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হলো। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পর জামাই হাসপাতালে মারা গেলো।  

এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বিভস্তরূপ ধারণ করার কারণটা খতিয়ে জানা গেলো যে ,বাড়ীর কাজের মেয়েটি  যখন গ্যাসের চুলায় রান্না করছিলো ,তখন এক  সময় হঠাৎ করে গ্যাস চলে যায়।  অবশ্য ঢাকা শহরে এ রকম ভাবে গ্যাস চলে যাওয়াটা  নুতন কিছুই নয়। আবার গ্যাস  যখন চলে আসে তখন গৃহকর্মীরা  আবার রান্না বসিয়ে দেয়। সেদিন কাজের মেয়েটি যখন গ্যাস চলে গিয়েছিলো তখন সে চুলার " নবটি ( knob )" বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। এরই মাঝে বাড়ীর কারোর রান্না ঘরে যাবার প্রয়োজন হয়নি।   ফলে গ্যাস যখন চালু হলো তখন চুলা থেকে  carbon monooxside নামক এক  প্রকার বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে রান্নাঘরে ছড়িয়ে পড়ল।এদিকে  ইঁদুরের এবং চোর ডাকাতের ভয়ে রান্নাঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ ছিল যার ফলে  বিষাক্ত গ্যাস বাইরে বের হতে পারেনি। পরিণামে জাহিদা বেগম রান্নাঘরে ঢুকেই যেই না  দেয়াশালের কাঠি  জ্বালালো, তৎক্ষণাৎ ঘরটির ভিতর   যুদ্ধক্ষেত্রের  বোমার মতো  শব্দ করে দাউ দাউ করে আগুনের ফুলকি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। জাহিদা বেগমের রান্নাঘর থেকে বের হবার কোনো সুযোগই রইলোনা ।  

 ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে  খাজা সাহেবের সুখী পরিবারটি মুহূর্তে  ধ্বংস হয়ে গেলো। মেয়ে  হারানোর  শোকে   তারা  বিপর্যস্ত ।  নরকের  যন্ত্রনা  এর চেয়ে বেশী  কি হতে পারে ? বিশেষ করে তিন বছরের ছোট্ট মেয়েটি অনেকক্ষন  অপেক্ষা করেও যখন মাকে দেখতে না পেয়ে নানীকে প্রশ্ন করে , " নানীজান ,মা কোথায় ? এখনো আসছেনা কেন " ? অবুঝ মেয়েকে কি সান্তনা দেবে ভেবে কুল কিনারা পায়না, তারা নিজেরাই তো মেয়েকে হারিয়ে তীব্র শোকাহত। কে তাদের সান্তনা দিবে ? নানীর কাছ থেকে কোনো সদ উত্তর না পেয়ে ,নানীর চুলের ঝুটি টানতে টানতে নাতনি রেগে বলে ," তুমি আমার মাকে শুধু শুধু লুকিয়ে রেখেছো , এখনই নিয়ে এস ,তা নাহলে  তোমার সাথে আমার আড়ি "।  নানী নাতনিকে জড়িয়ে  ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, " তুই আমাকে মাফ করে দে মা ,আমি তোর মাকে লুকায়ে রাখিনি ,সে আল্লাহর কাছে আমাদের কাছ থেকে অভিমান করে  চলে গেছে ,কবে ফিরবে জানিনা "। অবুঝ মেয়েকে কি বা বুঝোনো যায় !

ছোট্ট মামনি ,শুধুই কেঁদে চলে "। মাকে কাছে না পেয়ে  নিষ্পাপ মেয়েটির দু গাল বেয়ে শ্রাবন ধারার  মত জল গড়িয়ে পড়ছে আর  নানীকে বকছে ," তুমি  একটা মিথ্যুক  ,আমার  মাকে এক্ষুনি এনে দাও " । ছেলেটিকে বলা হয়েছে  মা বাবা সিঙ্গাপুরে  গিয়েছে  ব্যবসার কাজ শেষ  হলেই  ফিরে আসবে । বাড়ীর প্রধান ফটকের সামনে ছেলেটি চাতক পাখির মত  চেয়ে  থাকে কখন  মা বাবা ফিরে এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে। you never know  what is round the corner !  

No comments